মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ১/৬

 

[এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - ধর্মাধর্ম - ১/৫ ]


প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৬ষ্ঠ পর্বাংশ


১.৪.৫ দুই গোষ্ঠী-পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা

মনস্থির করার পর পিতা পশুপতি তাঁর অতি প্রিয় চার কিশোরী নাতনীকে একান্তে ডেকে, প্রথমে তাদের কাছে অদ্ভূত এই প্রস্তাবের কথা উত্থাপন করলেন। স্বাভাবিকভাবেই, চারজনের প্রতিক্রিয়া ছিল সাংঘাতিক প্রতিকূল। তারা সকলেই একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠেছিল।

তাদের সকলের হয়ে ঊষি ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “বড়োবাবা, আমরা কী এমন অপরাধ করেছি, যে তুমি আমাদের দল থেকে বের করে দিতে চাইছ? আমরা কখনও তোমার বা কোন গুরুজনের অবাধ্য হইনি। জঙ্গলে শিকার কিংবা খাদ্য সংগ্রহের কাজে কখনও আলস্য করিনি। অসতর্ক হয়ে আমাদের বা দলের কাউকে বিপদে ফেলিনি। ঘরের কাজেও কখনো কোনদিন অবহেলা করিনি, সকলের সঙ্গে আমরা সমান উৎসাহ এবং আনন্দে সব কাজ করেছি। কখনও পরিবারের কারও সঙ্গে কলহ করিনি। আমাদের দলের বাচ্চাদেরও আদর, ভালোবাসা এবং যত্নের কোনও ত্রুটি করিনি। তুমি এসব জান আর জান বলেই আমরা সকলেই তোমার অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী। নাঃ, হয়তো আমরা ভুল বুঝেছিলাম। আমরা তোমার প্রিয়পাত্রী তো দূরের কথা, এখন মনে হচ্ছে, আমাদের প্রতি তুমি একান্তই বিরক্ত। নচেৎ এমন একটা অদ্ভূত প্রস্তাব তুমি কী করে করতে পারলে, বড়োবাবা? আমাদের ছেড়ে তুমি কী করে থাকবে, অথবা তোমাদের সকলকে ছেড়ে আমরাই বা কী করে থাকব? অন্য একটি পরিবারের অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে”?

পিতা পশুপতি চার কন্যার অভিযোগ মন দিয়েই শুনছিলেন। ওঁদের কথায় তাঁর বুকের ভেতরেও ভীষণ এক কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠছিল বারবার। ওদের চারজনের উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হলে, তিনি স্মিতমুখে বললেন, “তোরা চারজনই আমার পাঁজরের চারখানি হাড়, তোদের থেকে বেশি প্রিয় এই পরিবারে আমার কাছে আর কেউ নয়। তোরা যে যে কাজ এবং যে যে দায়িত্ব পালনের কথা এতক্ষণ বললি, সে কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে? আর সেই জন্যেই, অন্য পরিবারে যাওয়ার কঠিন দায়িত্বটা তোদের মধ্যে দুজনকে দিতে চাই। তবে ওদের দলে যাওয়া বা না যাওয়ার ব্যাপারে আমি কখনোই তোদের জোর করবো না। এটুকু নিশ্চিত জানিস। 

চারজনের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে পিতা পশুপতি আরও বললেন, “যে কথা এখন তোদের বলব, তার সবটা এখনই তোরা বুঝবি না। যখন আমি থাকবো না, তোরা আরও বড় হবি, তখন বুঝবি। একই পরিবারের ঘনিষ্ঠ পুরুষের সন্তান ধারণ মোটেই মঙ্গলদায়ক নয়। যদিও এমনটাই চলে আসছে বহু প্রজন্ম ধরে, বহু বহু বছর ধরে। কিন্তু এই প্রথা বহু বছর ধরে চলে আসছে বলেই আজও আমরা তাকে টেনে নিয়ে চলব কেন? সেই প্রথাকে ভাঙার আমাদের কাছে যখন প্রথম একটা সুযোগ এসেছে?

তোরা আমাদের সকলেরই প্রিয়। তোরা যদি অন্য কোন পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হস, সেই পরিবারের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ থাকবে কি? তোরা যদি ওদের পরিবারে গিয়ে সুস্থ সুন্দর সন্তানের জন্ম দিস, তোরাও হয়ে উঠবি ওই পরিবারের নয়নের মণি। সেক্ষেত্রে ওরাও আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা কোনোদিন ভাববেও না। তখন আমরা দুই পরিবার মিলে হয়ে উঠবো একটাই পরিবার – বৃহত্তর পরিবার। বিপদে-আপদে, দুঃখে, শোকে আমরা একে অপরের সহায় হব। আমাদের আনন্দ, সুখ, আমাদের হাসি, সব আমরা একসাথে ভাগ করে নেব।

বয়স্ক গুরুজনদের থেকেই, যে কোন পরিবারের প্রতিটি সদস্য জ্ঞান, আচরণ এবং সংস্কার শেখে। শৈশব থেকেই তারা তাদের বড়োবাবা-দিদিমা, বাবা-মায়ের কথা শুনে, তাদের অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে করতেই বেড়ে ওঠে। কাজেই পরিবারভিত্তিক এই জ্ঞান বা সংস্কারের একটা সংকীর্ণতা আছে। আমাদের পরিবারেই ধর, তোরা সকলেই বিশ্বাস করিস, তোদের বড়োবাবা কত কী জানে। এমনটি আর জগতে কোথাও নেই! কে বলেছে, আমার থেকে অনেক বেশি জানা লোক অন্য দলে নেই? কে বলেছে, মানুষের অন্য দলগুলি আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান বা উন্নত নয়? কিন্তু আমরা সেকথা চিন্তা করি না। আমরা মনে করি এই জগতে আমরাই সেরা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুই পরিবারের এই বন্ধনে, বেড়ে উঠবে আমাদের জ্ঞান, প্রসার ঘটবে আমাদের ভাবনা চিন্তার। হয়তো দুই পরিবারের ভাবনা মিলে উন্নতি এবং মঙ্গলের পথে আমরা অনেক দ্রুত চলতে পারব।

 

তবে যাই বলি না কেন, এ সবই ভবিষ্যতের কথা, আমাদের কথা নয়। তোদেরও পরের প্রজন্ম, তোদের সন্তানদের কথা। সেই অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি এমন প্রস্তাবে তোদের সম্মত হতে বলছি। আমি শপথ করে বলতে পারি, তোদের হাত ধরেই গড়ে উঠতে পারে মানুষের অনেক বড়ো আর ব্যাপ্ত একটা সমাজ। তারা ছোট্ট একটি এলাকার গণ্ডিতে বন্দী থেকে, পরষ্পরের মধ্যে সর্বদা বিদ্বেষের লড়াইতে মগ্ন না থেকে, একত্রে জয় করবে এই বিশাল জঙ্গল, দূরের ওই পাহাড়, সব…”।

দীর্ঘ বক্তৃতার পর পিতা পশুপতি একটু থামলেন, গভীর দৃষ্টিতে চার নাতনীর নত মুখের দিকে তাকালেন, তারপর আবার বললেন, “আমার কথা যা ছিল, সব তোদের বললাম। এখন চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিবি তোরা। কোন তাড়াহুড়ো নেই, আজ চাঁদের একাদশ দিন, গিরিজ আর মিত্তিকা আসবেন পূর্ণ চন্দ্রে, তার আগে আমাকে জানিয়ে দিস তোদের মতামত”।

শুধু ওই চারকন্যাকেই নয়, সেদিন রাত্রে, মশাল-জ্বলা আধো অন্ধকার অঙ্গনে বসে, পিতা পশুপতি তাঁর দলের সকলের কাছেই তাঁর একই প্রস্তাবের কথা বললেন। প্রথমতঃ সকলেই তাঁর এই অদ্ভূত প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ –আহত হয়ে উঠেছিল, প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। তারপর এই প্রস্তাবের পেছনে তাঁর ভবিষ্যত লক্ষ্যের যুক্তি শুনে, সকলেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে নীরব হয়ে রইল। তিনি তাদেরও চিন্তাভাবনার সময় দিলেন, চাঁদের চোদ্দ দিন পর্যন্ত।

কিন্তু কেউই পিতা পশুপতির কাছে, তাদের মতামত স্পষ্ট জানাতে পারল না। পূর্ণচন্দ্রের দিন সকালে সকলেই যখন জঙ্গলে শিকার এবং সংগ্রহের জন্যে বেরিয়ে যাচ্ছে, পিতা পশুপতি, চার কন্যাকে নিষেধ করলেন। বললেন, “তাঁদের প্রস্তাবে আমরা সম্মত হই বা না হই, তাঁরা আমাদের সম্মানীয় অতিথি, তাঁদের সাদর আপ্যায়ন হওয়াটা জরুরি”। পিতা পশুপতির কথা মেনে চার কন্যা রইল, তাদের সঙ্গে রইল, ওদের মায়েরাও। পিতা পশুপতি স্মিতমুখে মেনে নিলেন, তিনি বুঝতে পারলেন, মায়েরা চাইছেন, তিনি যেন মিত্তিকাদের সামনে কোনভাবেই কন্যাদের প্রভাবিত করতে না পারেন। তিনি মনে মনে পাথর-আত্মাকে স্মরণ করে হাসলেন। তাঁর যদি এমনই ইচ্ছা হয়, পিতা পশুপতি কিংবা তাঁর পরিবারের সাধ্য কি, তাঁকে আটকানোর? আর যদি তাঁর ইচ্ছা না হয়, যে যতই চেষ্টা করুক, কিছুই হতে পারবে না।

মেয়েরা এবং তাদের মায়েরা থাকায় ভালই হয়েছিল। সেদিন ওই গিরিজ এবং মিত্তিকা ঠিক সময়েই এসেছিলেন এবং ওঁদের সঙ্গে এসেছিল, মিত্তিকার দুই পুত্র। বিহি আর হানো – যারা ওই দুই কন্যার পাণিপ্রার্থী, অতএব যথাসম্ভব আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রইল না।

পিতা পশুপতি আজ গিরিজকে নিয়েই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসলেন। আর লক্ষ্য করলেন, তাঁর চার নাতনী, তাদের মায়েরা, মিত্তিকার সঙ্গে আন্তরিক আলাপে মগ্ন। আর মিত্তিকার পিছনেই বসে আছে তাঁর পুত্রদুটি।

পিতা পশুপতি নানান চিন্তায় আজ অন্যমনস্ক, কিন্তু গিরিজ কথা বলছিলেন অনর্গল, “কী সব দিনকাল পড়ল। আগের তুলনায় আবহাওয়া আর জঙ্গলের কত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। তাঁর ছোটবেলায় ফুল আর ফলে ভরে থাকত বনের গাছপালা। খাবারের কোন অভাব দেখেননি কোনদিন। যে কোন জঙ্গল থেকে সামান্য সময়েই প্রচুর ফল সংগ্রহ করা যেত অনায়াসে। আর সে ফলের কী স্বাদ আর মিষ্টতা ছিল!  এখন আর তেমন কই, ফলে সেই স্বাদও নেই, সেই রসও নেই। আজকাল এক একটা ফল খেয়ে বোঝাই যায় না, সেটা কোন ফল, সবই কেমন একই রকম স্বাদ আর গন্ধ। আর পশুরা, সেও ছিল বটে সে সময়। প্রত্যেকদিন দু একটা পশু যেন শিকার হওয়ার জন্যে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত। প্রচুর নরম তুলতুলে মাংস, আর পুরু চর্বির পশু হত সব। পাথরের ছেনি দিয়ে তাদের হাড় ফাটিয়ে মজ্জা খাওয়ার মজা তো আজকালকার ছেলে-মেয়েরা বুঝলই না। আজকালকার পশুর মাংস যেন শুকনো ছিবড়ে, চিবিয়েই চলেছেন, কিছুতেই তাকে বাগে আনা যায় না”।

পিতা পশুপতি স্মিত মুখে গিরিজের কথা শুনছিলেন, মাঝে মাঝে তাঁর কথার সমর্থনে দু-একটি কথা বলছিলেন। কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল মেয়েদের আর ওই ছেলেদুটির দিকে। তিনি দেখছিলেন, মেয়েদের সঙ্গে গল্প-গুজবে ছেলেদুটিও এখন যোগ দিয়েছে। তাদের সকলের মুখেই সকালের রোদ্দুরের মতোই উজ্জ্বল হাসি।

মিত্তিকার পরিবারে তাঁদের দুই কন্যা যাবে কিনা এখনো নিশ্চিত নয়, কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে অন্তরঙ্গ এক সম্পর্কের যে সূচনা হচ্ছে, তাতে নিঃসন্দেহ হলেন পিতা পশুপতি।                 

 

১.৫.১ চারি চক্ষুর চোরা-চাহনি

প্রথম আলাপে জোড়হাতে নমস্কার বিনিময়ের পরেও মেয়েরা তেমন সহজ হতে পারেনি। মিত্তিকার দুই পুত্রকে তারা দেখল। তারাই কিনা সেই দুই পুরুষ, যাদের জন্যে ওদের মা এই পরিবারের দুই কন্যাকে চেয়েছেন! সুঠাম পেশিবহুল বলিষ্ঠ চেহারা, তাদের পরনের পাতার পোষাকে আবার লতানে ফুলের কারুকাজ। তাদের মাথার ঝুঁটিতে গাঁথা নানান পাখির রঙচঙে পালক, দুজনের গলাতেই শুকনো লতায় বাঁধা শেয়ালের কয়েকটি নখ। সব মিলিয়ে চেহারার খোলতাই মন্দ নয়। তাদের পরিবারে পুরুষদের এমন সাজুগুজু করতে তারা কোনদিনই দেখেনি। মেয়েরা করে, তবে সে কোন বিশেষ উৎসব বা আনন্দের দিনে। ওদের ছেলেরা কি সর্বদাই এমন সাজুগুজু করে শিকারে যায়? তবেই হয়েছে আর কী! এই রঙচঙে পোষাক দেখলেই ছোট বড়ো শিকারের দল ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে, বহু দূর থেকে। তাদের পিছনে ছুটেও লাভ হবে না।

নাকি ওরা এই পোষাক আর সাজগোজ করেছে, এখানে আসবে বলে? আজ বিশেষ একটা দিন বলে? কিশোরী কন্যাদের মধ্যে অন্ততঃ দুজনের মনে হল, তারাই হয়তো ছেলেদুটির এই সাজের উপলক্ষ্য! প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা কন্যারা জানে, মিলন-ঋতুতে বহু পুরুষ পাখিই চোখ ধাঁধানো বর্ণময় হয়ে ওঠে। মহিলা পাখিদের মন জয় করার উদ্দেশে, প্রকৃতিই তাদের ওই ভাবে সাজিয়ে দেন। এই ছেলে দুটিও কি তাদের মন জয় করার জন্যেই এমন সুন্দর সাজে নিজেদের সাজিয়েছে? এ কথা মনে হতেই, তাদের দুজনের মনে কী যেন এক সুর জেগে উঠল, যে সুর এতদিন ঘুমিয়ে ছিল।

প্রথম দিকে কথাবার্তায় একটু আড়ষ্ট লাগছিল, ওদের ভাষার জন্যে। ওদের ভাষা একটু অন্যরকম, এদলের কথার সঙ্গে পুরোটা মেলে না, যদিও বোঝা যায়। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও, আলাপ চলতে চলতে সড়গড় হয়ে এল। তখন বেশ মজাই লাগছিল ওদের নতুন ভঙ্গির কথা শুনতে। আর ওদের কথায় চমক রয়েছে বৈকি, কারণ সে কথা যে অন্য মানুষের, অন্য এলাকার! বিহি এখন বলছে, ওদের এলাকার কথা, সামনের ওই পাহাড়ের ওপাশে কিছুটা উঁচুনীচু, অনেকটা সমতল তৃণক্ষেত্র আর জঙ্গলের কথা।

ওদের এলাকার পাশেই ছোট্ট একটা নদী আছে। বর্ষার ঘোলা জলের নদীতে, বাপরে কী স্রোত! অথচ শীতে স্বচ্ছ জলের ধীর প্রবাহ। তখন নদীতে হাঁটু ভর জল, জলের তলায় সাঁতরে চলা মাছও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। তখন বল্লমে গেঁথে কত মাছ শিকার করা যায়, আর সে মাছের তেমনি স্বাদ। আবার এখন এই গ্রীষ্মে নদীতে জল নেই বললেই চলে, পায়ের গোছ ডোবে না। নদী পার হয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় ওপারের জঙ্গলে।

আর যদি পাহাড়ে চড়ো, সেও ভারি মজার। জমি থেকে অনেক উঁচু, সেখানে গাছের তলায় একটু বসলে এই গরমেও খুব আরাম হয়। আর ওপর থেকে সামনে নিচের দিকে তাকালে কী যে মজা লাগে, সে আর বলার নয়। জঙ্গলের বিশাল উঁচু গাছগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট সবুজ ঝোপঝাড়, তাদের আলাদা আলাদা গাছ বলে মনেই হয় না। মনে হয় আমাদের পায়ের নিচে ভেসে রয়েছে এক বিশাল বড়ো আর ঘন সবুজ মেঘ। তৃণক্ষেত্রটাকে মনে হয়, ঠিক যেন ছোট্ট এই উঠোনটা, যেখানে বসে আমরা গল্প করছি। আর নদীটা?  সরু সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে দুপাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ওই রোদ্দুরের আলোয় নদীর জল যখন চিকমিক করে, মনে হয় আকাশের বিদ্যুৎ নেমে এসেছে মাটিতে।

আর ওই পাহাড়ের মাথা থেকে পিছনে তাকালে, চোখে পড়বে ছোট্ট ছোট্ট পাহাড় আর বড়ো পাথর ছড়ানো, বেশ রুক্ষ ধূসর জমি। বড়ো কোন গাছ নেই, ছোট ছোট ঝোপঝাড়, কাঁটাগাছে ভরা। আর তারপরে অনেকটা দূরে চোখে পড়ে গভীর সবুজ জঙ্গল। সেটাই এই জঙ্গল, যেখানে তোমরা থাকো।

ওই পাহাড় থেকে তোমরা বুঝি আমাদেরও দেখতে পাও? আমাদের এই বসতি?” চার কন্যার একজন, যার নাম ইশি, উৎসুক হয়ে জানতে চাইল।

হেসে উত্তর দিল হানো, “তাই বুঝি দেখা যায় অতদূর থেকে? সে যে অনেক দূর”।

আমাদের বসতিতে আসতে, তোমরা কী ওই পাথুরে পথেই এলে?” ঊষি জিজ্ঞাসা করল।

না, আমরা আসি সমতলের পথে, অনেকটা ঘুরে। ওই পাথুরে জমি ধরে এলে দূরত্ব হয়তো অনেকটাই কমবে। কিন্তু ওদিকে কোন পথ নেই যে। ঝোপের কাঁটায় পা ক্ষতবিক্ষত হয়। পাথরের আড়ালে আবডালে আছে প্রচুর বিষাক্ত সাপ আর কাঁকড়া বিছের বাসা। তাদের একটা ছোবল খেলে আর রক্ষে নেই। তাছাড়া ও পথে কোথাও এতটুকু ছায়া পাবে না। চলতে চলতে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যে একটু জিরোবে, তার কোন উপায় নেই”। বিহি উত্তর দিল ঊষির চোখের দিকে তাকিয়ে।         

এই দলের ছেলেরা এমন নতুন এলাকার কথা তো বলতে পারবে না। এই দল যে এলাকায় বিচরণ করে, তার কথা প্রতিটি ছেলের মতো প্রতিটি মেয়েও জানে, চেনে তাদের নিজেদের হাতের তালুর মতো। সে কথায় মনে চমক আসে না। কিন্তু ছেলেদুটোর কথায়, তাদের মনে অচেনা একটা জগতের ছবি ভেসে উঠতে লাগল। পাহাড়, নদী, নদীর স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়ানো মাছ, পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা নিচের নিবিড় দৃশ্য – সব মিলিয়ে তাদের মনে এখন অদ্ভূত এক রোমাঞ্চ। নতুন এলাকা, নতুন জীবন, নতুন সব মানুষ...।

 

মনের মধ্যে সদ্য ঘুম ভাঙা সুর এবার যেন বেজে উঠল, অচেনা পাখির সুরেলা ডাকের মতো।

 

তাদের পরিবারের বয়স্ক মানুষেরা, যেমন বড়োবাবা, জন্ম থেকে আজ অব্দি কাটিয়ে দিলেন, একই মানুষজনের গণ্ডিতে। তাঁর শৈশবে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, মা-বাবাকে দেখেছিলেন, বড়ো হয়েছেন অনেক ভাইবোনের সঙ্গে। আরো বড়ো হয়ে তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা বাবা-মা হয়েছেন অনেক সন্তানের, তাঁদের সেই সন্তানদেরই মেয়ে তারা চারজন। বড়োবাবা একদিন চলে যাবেন, চলে যাবেন তাদের বাবা-মা। এই পরিবারে আসবে তাদের সন্তান-সন্ততি... এইভাবেই অনন্তকাল চলতে থাকবে একঘেয়ে গণ্ডিবদ্ধ জীবনের চক্র। এই কথাই কী সেদিন বড়োবাবা তাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন? এই গণ্ডির বেড়া খুলে বেরিয়ে পড়তে বলেছিলেন, তাদের চার বোনের মধ্যে দুজনকে?                            

কিছুক্ষণ পরে, একটু সুযোগ পেয়ে চার বোন একত্র হল নিরিবিলি এক বকুল গাছের নিচে। তাদের নিভৃত আলাপে স্পষ্ট হল ওদের মধ্যে দুই বোন অন্য পরিবারে যাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই নারাজ। কিন্তু অন্য দুই বোন, ঊষি আর ইশি – হ্যাঁ বা না, স্পষ্ট কিছুই বলল না। এ নিয়ে তারা কী ভাবছে জিজ্ঞাসা করায়, ঊষি কিছু বললই না, এমন একটা বিরক্তির ভঙ্গি করল, যেন এমন ফালতু আলোচনায় সে নেই। আর ইশি বলল, “ছাড় তো, খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, আমি এখন ওই নিয়ে ভাবতে বসেছি, আর কী?”

দুপুরের কিছু পরে, দলের লোকেরা শিকার ও সংগ্রহ সেরে জঙ্গল থেকে ফিরে এল। অতিথিদের সৌভাগ্যে, আজও তারা মনোমত শিকার পেয়েছে, বেশ বড়োসড়ো দুটি বুনো ভেড়া। সংগ্রহ করতে পেরেছে বেশ কিছু কন্দ-আলু এবং ফল। মহা আনন্দে হৈ চৈ করতে করতে, তারা সব্বাই লেগে পড়ল ভেড়া দুটির ছাল ছাড়িয়ে, আগুনে সেঁকে নেওয়ার প্রস্তুতিতে। মিত্তিকার ছেলেদুটি – বিহি আর হানোও লেগে পড়ল সমান উৎসাহে। এই পরিবারের লোকেরা আপত্তি তুলেছিল, অতিথি কাজ করবে কেন? বিহি হানো সে কথার উত্তরে বলল, “সবার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার আনন্দই আলাদা - বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি?” 

পিতা পশুপতি আর গিরিজ দুজনেই অঙ্গনের একধারে গাছের ছায়ায় বসে দেখছিলেন, ছেলে-ছোকরাদের উৎসাহ আর আনন্দ। তাঁদের দুজনের মুখেই প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি। তাঁর দুই নাতনী, ঊষি আর ইশির সঙ্গে মিত্তিকার দুই ছেলের সলাজ[1] আলাপের দৃশ্যগুলিও পিতা পশুপতির নজরে এড়াল না। কাজে ব্যস্ত থেকেও মেয়েদুটি কোন না কোন অজুহাতে ছেলেদুটির কাছাকাছি থাকতেই যেন পছন্দ করছে। তাঁর অধরের হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর দুই চোখে, গালের কুঞ্চিত ত্বকে। ওই দুই সম্ভাব্য জুটির জন্যে তাঁর দুই চোখে এখন আশীর্বাদ। তিনি মুখ তুলে তাকালেন পাথর-আত্মার দিকে, তাঁর মনে হল, তিনিও হাসছেন।

সকলেই কাজে ব্যস্ত, তাই মিত্তিকা এখন কিছুটা অবসর পেলেন মহিলামহল থেকে, তিনি ধীরে ধীরে এসে বসলেন, পিতা পশুপতির পায়ের কাছে। গভীর আন্তরিকতা নিয়ে বললেন, “এসে থেকে আপনার সঙ্গে তেমন কথা বলার সুযোগই পাইনি, বাবা, আমার প্রস্তাবের কথা কিছু স্থির করলেন?”

পিতা পশুপতি মাথা নাড়লেন, বললেন, “এখনও কিছুই স্থির হয়নি, মা, যিনি স্থির করবেন, তিনি তাঁর কাজ করে চলেছেন, এখন শুধু অপেক্ষা”। গিরিজ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “যা কিছু কাজ করার ওরাই তো করছে, রান্নার যোগাড়-টোগাড়, ওদের মধ্যে কে স্থির করবে?” মিত্তিকা কিছু বললেন না, চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওপরে তাকা, ওই যে, বড়ো ওই পাথরের মধ্যে দেখতে পাবি আমাদের বৃদ্ধ পিতামহের স্নেহমাখা মুখটি। নিবিষ্ট হয়ে, মনে বিশ্বাস এনে দেখ। উনিই আমাদের জীবনের সকল কার্য এবং কারণ নিয়ন্ত্রণ করেন। ওঁনার সহযোগ ছাড়া আমার সম্মতি দেওয়া কিংবা না দেওয়াতে কিছু এসে যাবে না। অপেক্ষা কর, যদি স্থির করার হয়, তিনি নিজেই যথা সময়ে সব স্থির করে দেবেন”।

গিরিজ এবং মিত্তিকা মুখ তুলে তাকালেন পাথরের দিকে, গিরিজ মাথা নেড়ে বললেন, “কই আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, আর পাঁচটা পাথর যেমন হয় তেমনই তো!” মিত্তিকা কিছু বললেন না, অনেকক্ষণ নিবিষ্ট তাকিয়ে থাকার পর চোখ বন্ধ করলেন, বেশ কিছুক্ষণ পরে অস্ফুট স্বরে বললেন, “আপনার পাথর-আত্মাকে আমার প্রণাম দেবেন। তিনি কি আমাদের কথাও শুনবেন, বাবা”?

দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে পিতা পশুপতি স্মিত মুখে বললেন, “আমাদের সঙ্গে তোদের পরিবারও যদি জুড়ে যায়, তিনি সবার কথাই শুনবেন বৈকি”। জোড়হাতে পাথর-আত্মাকে নমস্কার করে, মিত্তিকা বললেন, “আশীর্বাদ করুন, তাঁর কৃপা থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই”।

খাবার প্রস্তুত হয়ে এল, সকলের ডাক পড়েছে, অঙ্গনের মাঝখানে সবাই এসে বসল গোল হয়ে। সামনের বৃত্তে বসে, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, তাদের তর সইছে না। বড়োরাও এবার খাওয়া শুরু করলেন, তার সঙ্গে কথাবার্তা হৈচৈ চলতে লাগল। পিতা পশুপতির একপাশে গিরিজ, অন্যপাশে মিত্তিকা, আর মিত্তিকার পাশে দুই পুত্র বসেছে। পিতা পশুপতি লক্ষ্য করলেন, ঠিক উল্টোদিকেই বসেছে তাঁর দুই নাতনী, ঊষি আর ইশি। তারা অন্যদিন খেতে বসে খুবই কথা বলে, পিতা পশুপতি রোজই ওদের ওই কথা-কাকলি খুবই উপভোগ করেন। কিন্তু আজ তারা দুজনেই বড়ো বেশি শান্ত। তাদের দুজনেরই দৃষ্টি বারবার ঘুরে আসছে, এই দিকে, মিত্তিকার দুই পুত্র, বিহি আর হানোর দিকে। কিশোরী মেয়েদের এমন আচরণ তাঁর চোখেও নতুন। এই আচরণ কিসের ইঙ্গিত সেটা তাঁর কাছে খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই বয়সেও এর মাধুর্য তিনি অনুভব করছেন মনে। তাঁর মনে হল, তাঁদের কৈশোরে এমন অনুভবের সুযোগ তিনি পাননি। তাঁর প্রিয় দুই কিশোরী নাতনী এবং মিত্তিকার তরুণ পুত্রেরা এই অনুভবে সিক্ত হোক। পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধাধরা নিয়মে নয়, পরবর্তী প্রজন্ম আসুক ভালোবাসা মাখা ওই চোরাচাহনির মিলনে।

 

১.৫.২ দিনশেষের বিদায়  

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেলে, সামান্য একটু বিশ্রামের পর, অতিথিদের বিদায় নেবার সময় এল। মিত্তিকা জোড়হাতে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর উপস্থিত সকলকে ডেকে বললেন, “আপনাদের আন্তরিক ব্যবহারে আমি, আমার পিতা এবং আমার দুই পুত্র সকলেই অভিভূত। আমি চাই আপনারাও কোন একদিন আমাদের বসতিতে এসে আমাদেরও এমন সেবার সুযোগ দেবেন। বড়ো আনন্দ পাবো। আপনাদের পিতা, এখন আমারও পিতা, তাঁকে আমিও ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি। আমাদের দুই পরিবারের এই মৈত্রী যেন চিরকাল থাকে। এই মৈত্রী কথাটাও আমি শিখেছিলাম আপনাদের পিতার থেকেই। তাঁর থেকেই আরও শিখেছি জোড়হাতে মাথা নীচু করে সম্মান জানানোর প্রথা। আপনাদের পিতার কাছে আগের দিন আমি একটি অনুরোধ করেছিলাম। আমার এই দুই পুত্র, বিহি আর হানোর জীবনসঙ্গী হতে, আমি আপনাদের দুই কন্যাকে প্রার্থনা করেছিলাম। আপনাদের পিতা এখনও সম্মতি দেননি, কিন্তু আমি আপনাদের সবার থেকে সম্মতি চাইছি, আপনাদের দুই কন্যাকে...”।

পরিবারের যুবক-যুবতী এবং মধ্যবয়স্ক মেয়ে-পুরুষ বেশ কয়েকজন বলল, “এ হতে পারে না, এ অসম্ভব”। “আমাদের কোন মেয়েই অন্যদলে যেতে চাইছে না”। “আর যাবেই বা কেন, পিতা-পিতামহের দল ছেড়ে?” “একদল ছেড়ে অন্যদলে, কোন পশুও যায় না, আমরা তো মানুষ”। “আপনি এ অনুরোধ আর করবেন না, মিত্তিকাদিদি।”    

মিত্তিকা জোড়হাতে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনলেন। কোন কথা না বলে, তাকিয়ে রইলেন সকলের মুখের দিকে। পিতা পশুপতিও মাথা নীচু করে রইলেন, কোন কথা বললেন না। হঠাৎ তাঁর পায়ের কাছে এসে বসল তাঁর দুই নাতনি, অস্ফুটস্বরে ইশি বলল, “বড়োবাবা, আমাদের বাবা-মাকে বোঝাও না, আমরা তো ‘না’ বলিনি”।

পিতা পশুপতি মুখ তুলে সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। তারপর দুই নাতনীর হাত ধরে পাশে বসিয়ে স্মিতমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “‘না’ বলিসনি, তার মানে কী ‘হ্যাঁ’ বলছিস?” কিশোরী দুই কন্যা, বড়োবাবার প্রশ্নে লজ্জায় মুখ নামাল, বলল, “আমরা আর কিছু জানিনা, বড়োবাবা”।

মিত্তিকা ওদের কাছে এগিয়ে এলেন, দুই হাতে দুই কন্যাকে হাত ধরে তুললেন, দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “আপনারা অনুমতি দিন, আমি এই দুই কন্যাকে, ঊষি আর ইশিকে ভিক্ষা চাইছি”। পিতা পশুপতি সবার মুখের দিকে তাকালেন, মিত্তিকা ও তাঁর দুই নাতনীর দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর দলের সকলের দিকে, কিন্তু কিছু বললেন না। দলের মানুষরা তাদের দুই কন্যার এই আচরণে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তারাও কেউ কোন কথা বলল না।

মিত্তিকা আবার বললেন, “আগামীকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষের শুরু, এই কাল শুভ অনুষ্ঠানের উপযুক্ত নয়। শুভ শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে আমরা এখানে এসে, এই দুই কন্যাকে আমরা গ্রহণ করতে চাই। ওই দিন আমার দুই পুত্রের সঙ্গে আসবে আমাদের পরিবারের আরও সাত-আটজন। সপ্তম দিবসের সকালে আমরা কন্যাদের নিয়ে ফিরে যাবো আমাদের বসতিতে। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা চন্দ্রের অষ্টম দিনে আমাদের বসতিতে আসুন। আপনাদের দুই কন্যার নতুন জীবন এবং নতুন পরিবারের মঙ্গল কামনা করুন। আজ চলি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা অনুমতি দেবেন। তবে আপনাদের সম্মতির কথা যত তাড়াতাড়ি জানতে পারব, অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ততই সুবিধা হবে”।

মিত্তিকা হাসিমুখে সকলকে জোড়হাতে নমস্কার করলেন, তারপর পিতা পশুপতির পায়ের কাছে বসে বললেন, “আজ চলি বাবা”। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মঙ্গল হোক মা”। তার পরেই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ওঁদের সঙ্গে দু-তিনজনকে পাঠানোর ব্যবস্থায়। মিত্তিকার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি, তিনি মানা করলেন, বললেন, “আজ আর প্রয়োজন হবে না, বাবা, সঙ্গে আছে বিহি আর হানো, ওরাই আমাদের নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট”।

কিন্তু আমি যে খুব চিন্তায় থাকব মা”।

মিত্তিকার দুই পুত্রের মধ্যে হানো বলল, “চিন্তা করবেন না বড়োবাবা, আমরা বসতিতে পৌঁছেই আপনাদের বার্তা পাঠিয়ে দেবো”। ছেলেটির মুখের “বড়োবাবা” ডাকটি বেশ সুন্দর লাগল, উপস্থিত বড়দের কাছে, এমনকি পিতা পশুপতির কাছেও।

পিতা পশুপতির বড় ভাইপো, ঊষির বাবা, বার্তা পাঠানোর কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের পৌঁছতে তো অনেক রাত হবে, তারপরে বার্তা কী করে পাঠাবে?”

হানো বলল, “আমাদের কাছে বিশাল একটা ঢাক আছে, তার শব্দ বহু দূর দূরান্ত থেকেও শোনা যায়। রাত্রের দিকে কাছাকাছি পশুদলের উপস্থিতি টের পেলেই আমরা ওই ঢাক বাজাই, তার শব্দে পশুর দলও পালিয়ে যায়”।

সকলেই আশ্চর্য হয়ে শুনছিল, এখন ইশির বাবা, পিতা পশুপতির বোনের ছেলে, জিজ্ঞাসা করল, “ঢাক ব্যাপারটা কী? ঠিক বুঝলাম না তো?” বিহি বলল, “মরা গাছের বড়ো একটা গুঁড়ি কেটে আমরা বানিয়েছি, তার একদিক ছিল বন্ধ আর ভেতরটা ফাঁপা। তার ওপরটা চামড়ার ছাউনি লতা দিয়ে খুব শক্ত টানটান করে বেঁধে, লাঠি দিয়ে পেটালে আওয়াজ ওঠে ধ্বম্‌ম্‌, ধ্বম্‌ম্‌...রাত্রের দিকে সে আওয়াজ শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করতে থাকে”।

ওদের বল্লমগুলো দেখেছ, বাবা?” ইশি হানোর হাত থেকে তার বল্লমটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই দ্যাখ, মোটা বাঁশের বল্লম, লতা দিয়ে তার আগায় বেঁধেছে পাথরের ধারালো ফলা, যেমন হাল্কা আর তেমনি মজবুত। একবার কোন শুয়োরের পাঁজরে এভাবে গেঁথে দিতে পারলে, তার পাঁজর ভেঙে যাবে বাবা”। মেয়েটি অদৃশ্য কোন পশুর গায়ে বল্লমটা গেঁথে দেওয়ার ভঙ্গি করল। পরিবারের সকলেই দেখল, সত্যিই তাদের কাঠের ছুঁচোল বল্লমের থেকে এই বল্লম অনেক বেশি মজবুত আর ধারালো। তাদের কাঠের বল্লমের ছুঁচোলো ফলা প্রায়ই ভেঙে যায়। দৌড়ে চলা পশুর মোটা চামড়া অনেক সময়েই ভেদ করতে পারে না। তারা দেখল নতুন প্রযুক্তি। তারা এও বুঝল, তাদের পরিবারের দুই প্রিয় কন্যাই মজেছে, মিত্তিকার দুই পুত্রে।

মিত্তিকা এবার ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, শেষ দুপুরের রৌদ্র এখন গাছের শীর্ষে, আর বিলম্ব করা মানে, জঙ্গলের দীর্ঘ পথে বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো। তিনি পিতা পশুপতির কাছে গিয়ে বিদায়ের নমস্কার করে, সকলকেই নমস্কার করলেন। দলের অন্য সদস্যরাও বিদায়ের নমস্কার করল। বিহি আর হানোর হাতে তুলে দিল দুটি চর্বির মশাল, অন্ধকার পথে ওরা জ্বালিয়ে নেবে চকমকি (flint) পাথর ঘষে। ওদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে গেল, এ দলের চারজন ছেলে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গিরিজ, মিত্তিকা এবং তাঁর পুত্ররা দ্রুত মিলিয়ে গেলেন পায়ে চলা পথের বাঁকে।

ওরা চলে যাওয়ার পরে দলের সবাই ঘিরে বসল পিতা পশুপতিকে। তাদের এখন যত রাগ ঊষি আর ইশির ওপর। ওরা কেন ছেলে দুটোর সামনে অমন ঘোরাঘুরি করছিল। অন্য দলের অন্য পরিবারের অচেনা, অজানা দুটো ছেলে, তাদের সামনে এই পরিবারের যেন মাথা কাটা গেল। এর জন্যে তারা দায়ী করল পিতা পশুপতিকেই। তাঁরই আদরে মেয়েদুটো অসভ্য হয়ে উঠেছে। অন্য পরিবারে যাওয়ার বাজে হুজুগটা, উনিই তো ওদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন! কচি কচি বাচ্চা মেয়ে, ওরা কী জানে? কতটুকু দেখেছে ওরা জীবনের? ভালমন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের ধারণা ওদের কতটুকু হয়েছে? ওই দলের ওই বুড়ো আর ওই মহিলার কথায়, বাবার মতো এত বয়স্ক অভিজ্ঞ একজন মানুষের এতটা নেচে ওঠা মোটেই উচিৎ হয়নি।

পিতা পশুপতি মাথা নীচু করে শুনছিলেন, তাঁর ভাই-বোন, তাঁর এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের অভিযোগের কথা। পরিবারের সকলের অভিযোগ আর নিন্দায় মেয়েদুটি কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা দুজনেই এসে বসেছে বড়োবাবার পিছনে। মুখ লুকিয়েছে তাঁর পিঠের আড়ালে। দুজনের চোখের জলে ভিজে উঠছিল তাঁর উন্মুক্ত চওড়া পিঠ। মেয়েদুটির প্রতি আরও বেশি স্নেহ ও ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত হচ্ছিলেন। তিনি মনে মনে নিশ্চিত হলেন, এই দুই মেয়েই হবে মানুষের নতুন সমাজের জননী। তিনি হৃদয়ে অনুভব করলেন, পাথর-আত্মার এই বার্তা।       

 

১.৫.৩ অন্তরে বাজে ঢাকের বাদ্যি

পরিবারের মানুষগুলোর প্রাথমিক উত্তেজনা এবং আবেগ কিছুটা থিতিয়ে যেতে পিতা পশুপতি খুব শান্ত স্বরে বললেন, “আমাদের মেয়েরা কেন অন্য দলে যাবে, এতেই তোদের এত আপত্তি, তাই না? ঠিক আছে, আমি না করে দেব। আমাদের মেয়েরা আমাদের পরিবারের মধ্যেই থাকুক। ওদের খুড়তুতো বা মাসতুতো দাদার সঙ্গে থেকে সন্তান প্রসব করুক। তাতেই আমাদের পরিবারের মঙ্গল। তাতেই আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি অটুট থাকবে। বাইরের দলের হাওয়া তার গায়ে যেন না লাগে, তাই তো?”

পিতা পশুপতির দুই পুত্র এবং কন্যারা সমস্বরে বলল, “একশ বার, উটকো অচেনা দলের রীতি-প্রথা একবার ঢুকে পড়লে, আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি চুলোয় যাবে”।

তার মানে, আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি খুবই পলকা, গাছের শুকনো ডালের মতো, একটু চাপ পড়লেই ভেঙে যাবে মট্‌ করে”।

তোমার মতো মানুষ, একথা কী করে বলছ বাবা? আমাদের সংস্কৃতি সনাতন, কবে থেকে চলে আসছে? সেই তোমার বাপ-ঠাকুরদাদেরও আগে থেকে। পলকা হতে যাবে কেন, রীতিমত পোক্ত, মজবুত”।

পিতা পশুপতি মৃদু হাসলেন, “আমি তো বলিনি, বলছিস তো তোরা। উটকো দলের প্রথা আমাদের দলের মধ্যে ঢুকল কি না ঢুকল, এরই মধ্যে তোরা ভাবতে শুরু করেছিস, আমাদের সংস্কৃতি চুলোয় যাবে। তাহলে কী আমাদের সংস্কৃতি পলকা নয়?” তাঁর ছেলেমেয়েরা চট করে কোন উত্তর দিতে পারল না, একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, “ঠিক তা নয়, তবে...প্রাচীন একটা প্রথাকে মেনে চলাই তো সঠিক পথ, বাবা। আমরা এতদিন ধরে যা করে এসেছি, তাতে আমাদের তো কোন ক্ষতি হয়নি, বাবা”।

না ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবার হয়তো হতে থাকবে”।

সে কি, কীভাবে?”

তোরা ওদের দলের ওই বর্শাগুলো হাতে নিয়ে তো দেখলি, কি বুঝলি?”

বেশ ভালই তো। শক্ত-পোক্ত, মোক্ষম অস্ত্র এবং বেশ হাল্কা, ব্যবহার করতে খুব সুবিধে”।

দু’ দলের লড়াইতে ওই বর্শা যদি আমাদের বুকে বা কাঁধে এসে গিঁথে যায়, আমাদের কী হবে?”

বাঃ রে, ওদের সঙ্গে তো আমাদের ভাব হয়ে গেছে। ওই যে মিত্তিকা বলল, তুমিই নাকি তাকে শিখিয়েছ, “মৈত্রী”। সে মৈত্রী তো আমাদের হয়ে গেছে। তাহলে আর আমাদের লড়াই হবে কেন?”

পিতা পশুপতি হাসলেন, “ওদের দল ছাড়া মানুষের আর কোন দল নেই? আমরা এতদিন জানতাম, আমাদের বর্শাগুলো সবার সেরা। একটা দলের সঙ্গে মৈত্রী হতেই আমরা জেনে ফেললাম, আমাদের থেকে অনেক ভালো বর্শা ওরা বানাতে জানে। কিন্তু অন্য দলের বর্শাগুলো? সেগুলো কী আমাদের থেকে খারাপ, নাকি ওদের থেকেও ভালো? সে কথা আমরা জানিই না। এমন কোন দলের সঙ্গে যদি আমাদের লড়াই হয়, আমাদের নিহত শরীরগুলো পড়ে থাকবে জঙ্গলে, হায়না-শেয়াল-শকুনের ভক্ষ্য হয়ে। কিন্তু তাতেও আমাদের সংস্কৃতি থেকে যাবে ঠিকঠাক...”

পিতা পশুপতির বড়োপুত্র বলল, “কী যে বলো না, বাবা? আমরা সব্বাই মরে গেলে, আমাদের সংস্কৃতি থাকবে কী করে?”

পিতা পশুপতি শান্তস্বরে বললেন, “ঠিকই তো, থাকবে না। তার মানে, সংস্কৃতির থেকেও জীবনটা অর্থাৎ বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি। আমরা বাঁচলে তবেই না আমাদের সংস্কৃতি বাঁচবে!” তাঁর এই কথায় কেউই কোন উত্তর দিতে পারল না, তারা পিতা পশুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তিনি আবার বললেন, “দুর্ধর্ষ এমন কোন দলের সঙ্গে লড়াইয়ে, তারা হয়তো আমাদের পুরুষদেরই মেরে ফেলল, আর লুঠ করে নিল আমাদের মেয়েদের...”

পিতা পশুপতির দুই কন্যা একযোগে বলে উঠল, “কী বলছ, বাবা, আমরা ছেড়ে দেব নাকি? প্রাণ থাকতে আমাদের কেউ লুঠ করতে পারবে না, আসুক না কেউ!”

পিতা পশুপতি নিষ্ঠুর গলায় বললেন, “তাহলে তারা তোদেরও মেরে ফেলবে! কিন্তু আমাদের ছোটছোট মেয়েরা? তারাও কী পারবে ওদের আটকাতে? পশুদের জগতে এমনটাই হয়ে থাকে, অথর্ব পুরুষ দলপতিকে দল থেকে তাড়িয়ে, নতুন যে পুরুষ দলের প্রধান হয়, সেই সে দলের মেয়েদের অধিকার করে। যে দলের কাছে আমরা চূড়ান্ত পরাস্ত হব, তারাও চেষ্টা করবে আমাদের মেয়েদের অধিকার করতে। তাতে দ্রুত সন্তান-সন্ততি বাড়াতে তাদের সুবিধে হবে। আমাদের দলের সেই অসহায় মেয়েরা তখন কী করবে? সংস্কৃতি রক্ষা না জীবন ধারণ?”

পিতা পশুপতির বড়োপুত্র বলল, “এ তোমার বাড়াবাড়ি, বাবা, বড়ো বেশি দুশ্চিন্তা করছ। কে বলেছে এমন হবেই?”

পিতা পশুপতি মাথা নাড়লেন, বললেন, “কেউ বলেনি, আর বলবেই বা কে? যে দল এমন করবে, তারা কী আমাদের আগে থেকে বলে-কয়ে করবে? গিরিজ আর মিত্তিকাদের দলটা অন্য একটি দলের সমস্ত মানুষকে হত্যা করেছিল, তারা কী বলে কয়ে করেছিল?”

পিতা পশুপতির বড়ো পুত্র বলল, “সেটাই তো আমরাও বলছি, বাবা। এরকম একটা বাজে দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দরকারটা কী”?

স্মিতমুখে পিতা পশুপতি বললেন, “আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে, আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই দরকার। যত বেশি দলের সঙ্গে আমরা যুক্ত হতে পারবো, বেঁচে থাকতে আমাদের ততই সুবিধে হবে”।

পিতা পশুপতির ছেলেমেয়েরা বলল, “তার মানে? আমাদের দলের সব মেয়েরা একে একে অন্য দলে চলে যাবে?”

পিতা পশুপতি হাসলেন, বললেন, “তা কেন? আমাদের দলের ছেলেদের জন্যে আমরা অন্য দলের মেয়েদেরও আনতে পারি। আর সব থেকে মঙ্গল হবে, আমাদের পরিবারের মেয়েরা সবাই যাবে অন্য দলে, আর আমাদের সব ছেলেদের জন্যে আসবে অন্য দলের মেয়েরা। একই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক থাকবেই না”।

পিতা পশুপতির ছোট মেয়ে এতক্ষণ কিছু বলেনি, শুধু শুনছিল, এখন বলল, “বাবা, তোমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আমাদের সবার থেকেই অনেক বেশি। তার থেকেও যেটা অদ্ভূত, সেটা হল তোমার ভাবনা। তোমার কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে, অন্ততঃ আমার তো হচ্ছেই, তোমার কথাতে লুকিয়ে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তবুও আমাদের ভয় করছে। এতদিনের সংস্কার ছেড়ে, নতুন পথে যেতে ভয় হচ্ছে। শেষে পুরোটাই আমাদের সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যাবে না তো?”

পিতা পশুপতি মুখে স্নেহমাখা হাসি নিয়ে, ছোটমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথে চলতে ভয় তো করবেই, মা। নতুন এলাকার সন্ধানে, আমরা যে এই বসতি ছেড়ে প্রতিবার বেরিয়ে পড়ি, আমাদের ভয় করে না? কোন এলাকায় যাবো, সেখানে আমাদের মনোমত পরিবেশ এবং খাবার জুটবে কিনা। সে সময়েও এমন হাজার ভয় থাকে আমাদের মনে। তাও তো আমরা বেরিয়ে পড়ি। কিছু যে বিপদ-আপদ ঘটেনি কোনদিন এমনও তো নয়! তবুও এই বসতির চেনা গণ্ডি ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আজ নয়, অনন্তকাল ধরে”।

একটু থেমে আবার বললেন, “এখন সেই ভাবেই পারিবারিক ছোট গণ্ডি ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। যুক্ত হতে হবে আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে। সে পথেও আপদ-বিপদ থাকবে, থাকবে ভুল বোঝাবুঝি এবং সংস্কারের বিরোধ, তবুও চলতে হবে। তা নাহলে অচিরেই শুরু হবে আমাদের অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতির সংকট”।

 পিতা পশুপতি চুপ করলেন, তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও আর কেউ কোন প্রশ্ন করল না, তারা সকলেই এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। যদিও ব্যাপারটা তাদের ঠিক মনে ধরছে না, কিন্তু তাও বাবার কথাগুলোকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পিতা পশুপতি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন, বেশ কিছুক্ষণ তিনি লক্ষ্য করলেন তাদের মুখগুলো।

তারপর হঠাৎই হাল্কা হাসিতে মুখ ভরে তুলে বলে উঠলেন, “অ্যাই, তোরা দুজন সেই থেকে আমার পিঠের কাছে বসে কী করছিস রে”? ঊষি আর ইশি এতক্ষণ মন দিয়ে তাদের বাবা-কাকা, মা-কাকিমাদের সঙ্গে বড়োবাবার কথা শুনছিল। তাদের বিশ্বাস, তাদের এই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বড়োবাবা ঠিক বের করে আনবেন। এবং এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূল না হলেও, পরিবারের বড়োরা অন্ততঃ নিমরাজি।

ইশি কিছুটা নিশ্চিন্ত গলায় বড়োবাবাকে বলল, “কী আবার করব, তোমার পিঠে গুচ্ছের ঘামাচি হয়েছিল, গেলে দিচ্ছিলাম”। ইশির কথায় পিতা পশুপতি হো হো করে হেসে উঠলেন, তাদের সামনে টেনে এনে বসালেন তাঁর পাশটিতে, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “বড়োবাবার পিঠের ঘামাচির কথা, আজই তোদের বড্ডো বেশি করে মনে পড়ল, মা?” ঊষি বলল, “বারে, আমরা বুঝি তোমার পিঠে কখনো হাতাপিতি করে দিই না?”

দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পিতা পশুপতি অত্যন্ত স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, “তাই কী বলেছি মা, বরং দুঃখ পাচ্ছি, ওই পরিবারে চলে গেলে, তোদের মতো কে আমাকে যত্ন-আত্তি করবে”? লজ্জারুণ মুখে ঊষি আর ইশি মাথা রাখলো পিতা পশুপতির দুই কাঁধে। পিতা পশুপতি তাঁর মেয়ে, ভাইঝি এবং ভাগ্নীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা তোরা তো মেয়ে, তোরা কোনদিন এই দুই মেয়ের মতো এমন আচরণ করতে পেরেছিস?”

মেয়ের দল ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “ছিঃ! অমন অসভ্যতা আমরা কোনদিনই করতে পারব না, বাবা”।

পিতা পশুপতি হাসলেন ওদের কথায়, “কী করে পারবি, মা? তোরা তো কোনদিন ওদের মতো পরিস্থিতিতে পড়িসনি। তোরা শৈশব থেকে বড়ো হতে হতে জেনে গিয়েছিলি কোন খুড়তুতো দাদা, বা পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে তোদের জীবন কাটাতে হবে। আমরাই আলোচনা করতাম, আমি, তোদের মা, কাকা-কাকিমারা। একই পরিবারে একই সঙ্গে বড়ো হতে হতে তোদের মধ্যে ওই বোধ আসেইনি। তোরা যখন বড়ো হয়েছিস, আমরা অনুমতি দিয়েছি, শুরু হয়ে গেছে তোদের যুগল-জীবন। ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক, অনেকটা মায়ের দুধ ছেড়ে বাচ্চাদের অন্য খাবার শুরু করার মত। কিংবা বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে বাচ্চাদের মাটিতে হাঁটার মত। উঠোনের খেলা আর হুল্লোড় ছেড়ে কিশোর-কিশোরীদের জঙ্গলে যাওয়ার মতো”।

মেয়েরা একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ, সেটা ঠিক বুঝলাম না বাবা। তার মানে ওদের থেকে আমরা বোকা-হাঁদা ছিলাম। ওরাও তো নাচছে দুটো ছেলের পেছনেই”।

পিতা পশুপতি হেসে ফেললেন আবার, বললেন, “সত্যিই ওরাও নাচছে দুটি ছেলের পিছনে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ওরা কেউ কাউকে চিনতই না। ওদের ভাষাও এক নয়। ওদের কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি। তবু ওরা দুজনে অচেনা দুটি ছেলেকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। ওরাও মুগ্ধ হয়েছে ছেলেদুটিতে। তোদের মা আমাতে মুগ্ধ বা আমি তোর মায়ের প্রতি মুগ্ধ কিনা, একথা কোনোদিন কেউ ভাবিইনি। দুজনে একসঙ্গেই থেকেছি,  খেলেছি, ঝগড়া করেছি, জঙ্গলে যাওয়া আসা করেছি। একদিন আমাদের বড়োবাবা বললেন, তোরা দুটিতে আজ থেকে একসঙ্গে থাক। ব্যস্‌, আমরাও একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। শৈশব থেকে একসঙ্গেই ছিলাম, একসঙ্গেই রইলাম, তোদের মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু কোনদিন মুগ্ধ হওয়ার কথা মনেও আসেনি। তোদেরও আসে নি। তা নাহলে তোরা ধরে ফেলতে পারতিস, ওদের এই আচরণ অসভ্যতা নয়, এ হল মুগ্ধতা। হঠাৎ আসা এই অনুভূতি নিয়ে ওরা ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ওদের কী করা উচিৎ সেই পরামর্শ দিতে তোরা কেউ ওদের পাশে থাকতে পারলি না। কারণ তোদের কারও জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আদৌ হয়নি।”

পিতা পশুপতি চুপ করলেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরা সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অবাক চোখে। এতদিনের গতানুগতিক জীবনে যে মস্তিষ্ক আর পাঁচটা পশুর মতোই জীবনধারণের কাজে সদা ব্যাপৃত ছিল, তার ভেতরে আসছে নতুন এক আবেগের জোয়ার। সেদিন ওই আদিম মানুষগুলি প্রথম যে অনুভবে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের বহু প্রজন্ম পরে, এই অনুভূতির নাম দেওয়া হবে, প্রেম, ভালোবাসা। ছেলে ও মেয়ের ভালোবাসার এই অনুভূতি নিয়ে অজস্র কাব্য, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা হবে। খুলে যাবে মানব সংস্কৃতির আরেকটি দিক – যার নাম সাহিত্য। আরো পরে, মহান এই প্রেমও বহুল ব্যবহারে সস্তা হয়ে একদিন নেমে আসবে প্রেমহীন যৌনতার চুটকি মজায়।

কথাবার্তায়, তর্কে বিতর্কে রাতের প্রথম প্রহর পার হল। সকলেই মগ্ন রয়েছে নানান চিন্তায়। দিনের উষ্ণতা ঝেড়ে ফেলে স্নিগ্ধ হচ্ছে আকাশ-বাতাস-ভূমি। দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল দু একটা পশুর ডাক। ঊষি আর ইশি পিতা পশুপতির দুপাশে বসে বারবার ঢুলে পড়ছিল ঘুমে। হঠাৎ ইশি ডাকল দিদিকে, “অ্যাই দিদি, শুনতে পাচ্ছিস”।

ঊষি জিজ্ঞাসা করল, “কী?”

কান পেতে শোন”। চুপ করে দুই বোন মগ্ন রইল কিছুক্ষণ।

ঊষি উজ্জ্বল মুখে বলল, “বড়োবাবা, মন দিয়ে শোন, ঢাকের আওয়াজ, গুম, গুম, গুম...”।

শুধু পিতা পশুপতি নয় দলের সকলেই শুনল, খুব মৃদু সেই আওয়াজ আসছে উত্তর থেকে, টানা তিনবার, একটু বিরতি দিয়ে আবার...।

ঊষি আবার বলল, “তার মানে ওরা নিরাপদে পৌঁছে গেছে, বড়োবাবা”।

খুশিতে উজ্জ্বল ইশি বলল, “তুই তো ঢুলছিলি, আমিই তো শোনালাম তোকে”।

তারা দুজনেই এতক্ষণ যেন উদ্বিগ্ন ছিল, এতক্ষণে হল তাদের উদ্বেগের শান্তি। মেয়েদের এই আবেগে পিতা পশুপতি অভিভূত হলেন, চোখ তুলে তাকালেন ওদের মায়েদের দিকে। এখন ওদের মায়েরাও অনেকটা শান্ত, কিছুটা হলেও তারা বুঝতে পারছে দুই মেয়ের আবেগ। ঊষির মা বলল, “আর না, অনেক রাত হল, এবার সবাই শুতে চল”।

ওরা চলে যাওয়ার পর পিতা পশুপতিও উঠলেন, অন্ধকারে পাথর-আত্মার দিকে মুখ তুলে মনে মনে বললেন, “তোমার জয় হোক পিতা, মঙ্গল করো আমাদের সকলের”।

 

১.৫.৪ ধান ভানতে শিবের গীত?

আমি কি এই পর্যায়টিকে অকারণ একঘেয়েমি দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি? আপনারা কি ধৈর্য হারাচ্ছেন?

আমার অনুরোধ একটু ধৈর্য ধরুন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – পারিবারিক দল ভেঙে বহুদলীয় সমাজ গড়ার দিকে যে মানুষ এগিয়েছিল - সে কী এক কথায় শুরু হতে পারে? তার সঙ্গে এসেছে কত না নতুন অনুভব, কত না নতুন ভাবনা, চিন্তা! কত না নতুন প্রথা, রীতি, ব্রত, নিয়ম-কানুন। সেগুলি ছাড়া এমন ঘটনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। গড়ে উঠতে পারে না, আমাদের বিশ্বাস – আমাদের ধর্ম। অতএব এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আমাদের আদিম জীবন, কীভাবে সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলল, সে কথা একটু বিস্তারে না বললে চলবে কেন?

জীবনের সেই পরিবর্তনগুলি বুঝতে, আসুন, ধৈর্য নিয়ে আমরা লক্ষ্য করি ওই আদিম পরিবারদুটির পরবর্তী ক্রিয়াকলাপ।       



[1] সলাজ’ বললাম ঠিকই, তবে পিতা পশুপতি বা তাঁর পরিবারের কারো সেই সময় এই লজ্জা পাওয়া-র ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। আজন্ম লালিত পরিবারের মানুষের কাছে লজ্জা নামক অনুভূতির অবকাশ ছিল কি? অপরিচিত লোকের সঙ্গে সদ্য পরিচয়ের পরেই না লজ্জা পাওয়ার সুযোগ ঘটে!      

...চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

কেনোপনিষদ - খণ্ড ৩ ও ৪

  [এর আগের পর্ব পড়ুন এই সূত্রে -  কেনোপনিষদ খণ্ড ১ ও ২ ] তৃতীয় খণ্ড ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে, তস্য হ ব্রহ্মণো বিজয়ে দেবা অমহীয়...