১
“আপনে কোন এস্টেশনে লামবেন, বাবু?”
মাথা বোঝাই উস্কোখুস্কো চুল, একমুখ দাড়িগোঁফ। দুটো পা তার অচল। মুখে
একগাল হাসি, চোখদুটো চিকচিক করছে, যেন খুব মজা পেয়েছে। ভাবলাম আলাপ-টালাপ শুরু করে ভিক্ষে
চাইবে হয়তো, এ হচ্ছে তারই ভূমিকা। লোকটার প্রশ্নে একটু অবাক হলেও, বিরক্তি চেপে
উদাসীন সুরে বললাম, এই ট্রেনের প্রান্তিক স্টেশনের নাম। আমার
কথায় দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ঢাকা, তার মুখের ভূগোলে হাসির সাম্রাজ্যবিস্তার ঘটে গেল মুহূর্তে।
“কাদের বাড়ি যাবেন, আজ্ঞে?” এত খোঁজে তোমার কী দরকার বাপু? আমি
চলেছি আমার অজানা এক জনপদে, আমার কাছে সে তো অচিনপুর। কিন্তু সেখানকার সব লোককেই তুমি চেন বুঝি? সেখানে কেউ কি তোমার
অচেনা নেই? তাছাড়া আত্মীয়-কুটুম-বন্ধুর বাড়ি যাওয়া ছাড়া কোন জায়গায় কি যাওয়া যায়
না? নিছক বেড়াতে, নিছক অচেনা জায়গার সঙ্গে চেনা-পরিচয় সারতে? লোকটা আমার মুখের
থেকে একবারের জন্যেও তার দৃষ্টি সরায়নি। আমার সঠিক গন্তব্যের কথাটি না শুনলে তার
যেন স্বস্তি হচ্ছে না।
“কারও বাড়ি-টাড়ি নয়, এমনিই। জায়গাটা কেমন দেখতে এলাম”। ক্ষণেকের জন্যে লোকটার বিস্তীর্ণ হাসিটা একটু গুটিয়ে এল,
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর গলা উঁচিয়ে পেছনের দিকে কাউকে ডেকে বলল, “তোকে
বলেছিলাম না, ফুলবন্তি, এ বাবু তেমন বাবু নয়”।
আমি চমকে উঠে পিছনে ঘাড় ঘোরালাম। আমার পিছনের সারিতে জানালার ধারের
সিটে বসে আছেন এক মহিলা। ওই মহিলাই নিশ্চয় ফুলবন্তী। কামরায় আর কাউকেই তো দেখতে
পেলাম না। মহিলার পরনে গরীবগুর্বো ঢংয়ের জামা আর শাড়ি। মহিলা যাকে রূপসী বলে তা
নয়, কিন্তু তার মুখের ভাবে এমন কিছু আছে, যা চট করে নজর কাড়ে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি
হতেই মহিলা হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করল, মুখে অস্বস্তির হাসি।
শেয়ালদা থেকে লোকাল এই ট্রেনে চড়ে পড়েছিলাম,
তেমন কিছু পরিকল্পনা ছাড়াই। দু আড়াই ঘন্টা সময়ে যদ্দূর যাওয়া যায় - গিয়ে, ফেরার
ট্রেনে আবার ফিরে আসা। মাঝে – দু-পাঁচঘন্টা যতটা সময় মেলে - জায়গাটা একটু ঘুরেফিরে
দেখা, জানা, চেনা। লোকে উইকএণ্ডে দীঘা বেড়াতে যায়, মন্দারমণি, বেথুয়া, পুরুলিয়া,
বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর। আমার উইকএণ্ড মানে টুরিষ্ট ম্যাপের বিপরীতে অচেনা অজানা
জায়গায় হানা দেওয়া। এর মধ্যে আবিষ্কারের গন্ধ পাই।
টুরিজ্মের থাবার আঁচড় না লাগা নতুন জায়গা, যার কৌলিন্য নেই, গোত্র
নেই। আছে শুধু নাম। নাম কার না থাকে? নাম ছাড়া কাকেই বা
চেনা যায়? যত ছোট গ্রামই হোক তার একটা নাম থাকে, যত ছোট্ট ফুলই হোক, তারও নাম
থাকে। যত সামান্য মানুষই হোক একটা নাম থাকে তারও।
এতক্ষণ বেশ ছিলাম, নিজের ঘোরে। যাত্রাপথের
অচেনা সব স্টেশনের চেহারা আর নাম দেখছিলাম, সেখানকার লোকজন দেখছিলাম। দৌড়ে চলা
রেলগাড়ির জানালা দিয়ে দেখছিলাম, পিছনদিকে ছুটে চলা সবুজ জাজিমে শুয়ে সোনা রোদ্দুরে
হাসতে থাকা ঝলমলে সরষে ক্ষেতের পীতবরণ চাদর।
মাঝে একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াল। মহিলা বেশ
বড়ো একটা থলে আর পুঁটলি নিয়ে সিট ছেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার উল্টোদিকের সিটের কোনায়
সসঙ্কোচে বসল, প্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর এত আগ্গহ কিসের লেগে বল
দিকি?” কথাটা বলে চোখের কোণে আমার দিকে তাকাল, ঠোঁটে লাজুক হাসির ছোঁয়া।
কিন্তু মেঝেয় বসে থাকা পঙ্গু লোকটি নিরস্ত
হবার মানুষই নয়, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর চোক থেকেও চোক নাই ফুলবন্তি,
বাবুর চোকের দিকে তাকিয়ে দ্যাক, অন্তরে যে ভরা কোটাল – সে তত্ত্বটি তুই টের পাসনি।”
আমার দিকে এক ঝলক তাকাল ফুলবন্তি, আমার চোখের গভীরে তাকাল হয়তো! চোখ দেখে কি মনের
কথা বলা যায়? বাপরে, সে তো সাংঘাতিক – মানুষের মনে দিন-রাত কত রকম মতলব খেলে বেড়ায়
– সে সবের ছায়াছবি কি ধরা পড়ে চোখের তারায়? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার নাম কী,
ভাই?”
লোকটার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চোখ
নাচিয়ে ফুলবন্তিকে বলল, “কিচু বুজলি, ফুলবন্তি? “আপনে”, তায় আবার “ভাই” – এ লোককে
চিনতে কিচু ভুল করেচি বল?” ফুলবন্তি আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসল,
বলল, “ওর আবার নাম কী, বাবু? কেউ বলে ল্যাংড়া বাউল। কেউ ল্যাংড়া ফকির। কেউ বলে
নুলো খ্যাপা”। লোকটার মুখে হাসি যেন আর ধরে না, ফুলবন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে, আদুরে
হেসে জিজ্ঞেস করল, “আর তুই? তুই কী বলে ডাকিস সেটাও বাবুকে বলে দে!”
ফুলবন্তি এবার সত্যিই লজ্জা পেল, তার কালোকোলো
দুই গালে লজ্জার হাসি, ঘাড় ঝামটা দিয়ে বলল, “মরণ, আমি আবার কী বলি? আমি বলি, বালাই
– মনের বালাই”। ফুলবন্তির কথা শুনে আমি
চমকে উঠি। ও বাবা, এ যে মনে এক, মুখে আর। ফুলবন্তির চোখের আলোয়, লজ্জা মাখা
হাসিতে, তার মানুষটি যে মোটেই মনের বালাই নয়, সেটুকু বুঝতে আমার মতো অচিন মানুষেরও
এতটুকু অসুবিধে হল না।
ফুলবন্তির মুখের থেকে চোখ সরিয়ে বালাইয়ের
মুখের দিকে তাকাতেই দেখি, সে আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে, চোখে-মুখে তার
পাজির-পাঝাড়া ধরনের হাসি। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুর করে গেয়ে বলল, “জেবন বড়ো
বালাই বাবু, জেবন বড়ো বালাই, মনটুকু সব উজোড় করে, করলে চুরি কালাই। অগো, শুষ্ক
জেবন রইল পড়ে, সে বড়ো এক জ্বালাই!”
ফুলবন্তি এবার সিট থেকে উঠে মুখ ঝামটা দিয়ে
বলে উঠল, “থাক, ঢের আদিখ্যেতা হয়েচে।
এবার নামতি হবে!” বালাইয়ের স্বর এবং গায়ন ভঙ্গি শ্রুতিমধুর সন্দেহ নেই, আর
সেই গান শুনতে শুনতে আমিও খেয়াল করিনি, গাড়ির গতি কমে এসেছে – অচিরেই আমার যাত্রা
শেষ – যাত্রা শেষ এই ট্রেনেরও।
ফুলবন্তি থলি আর পুঁটলি নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। তার পেছনে চলল বালাই, দু হাতে ভর দিয়ে, পশ্চাতে মেঝে ঘসটে ঘসটে। তার পেছনে আমি, আমার কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ। ট্রেন থেকে নেমে ফুলবন্তি থলে আর পুঁটলি নামিয়ে রাখল প্ল্যাটফর্মের মেঝেয়। তারপর ছোট্টছেলেকে যেমন মা কোলে করে আগলে নামায়, তেমনি বালাইকে নামাল প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্মে স্থিতু হয়েই বালাই আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “আসেন বাবু, আসেন। আমাদের বাসাতেই চলেন। দেখতেই তো এয়েচেন, আমাদের ওদিকেই দেখতে পাবেন, অচেনা মাঠঘাট, অচেনা আকাশ, অচেনা সাগর-নদী, হাড়হাভাতে অচেনা মানুষজনের জেবনযাপন...”।
স্টেশনের বাইরে যাওয়ার গেটের দিকে ফুলবন্তি
এগিয়ে গেল, তার থলি আর পুঁটলি নিয়ে। আমি বালাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “তার
দরকার কী, বালাই ভাই? স্টেশনের বাইরে কোন হোটেলে টুকটাক খেয়ে নিয়ে, একটা রিকশ নিয়ে
যা দেখার দেখে নেব”।
ফুলবন্তি ঘাড় ঘুরিয়ে হাসল ফিক করে, বালাইয়ের
সঙ্গে চোখচোখে কিছু কথাও সেরে নিল। বালাই হাতে ভর দিয়ে চলতে চলতে বলল, “এখানে
হোটেল তো নেই বাবু। বাইরে একখানি চায়ের দোকান আছে, হারানের। তা সেও ঝাঁপ ফেলে এখন
ঘরে যাবে। দুপুরের
দিকে তেমন খদ্দেরপাতি হয় না। ঝাঁপ তুলবে আবার সেই বিকেলে, চারটে নাগাদ – তাপরে আটটা
সাড়ে আটটা বাজলেই হল - সারাদিনের মতো ব্যবসাপত্তর শেষ”। আমার দিকে মুখ তুলে আবার
বলল, “ফুলবন্তির রান্না একবারটি খেয়ে দেখেন না বাবু, ভাত আর চুনো মাছের সরষে ঝাল,
আহা মুখে লেগে থাকে, যেন অমেত্ত”।
যাত্রীরা সবাই চলে গেছে, কালোকোট পরা রেলের
ভদ্রলোক গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, বালাই আর ফুলবন্তির সঙ্গে আমাকে দেখে তিনি বেশ
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বালাই একগাল হেসে তাঁকে বলল, “পেন্নাম বড়বাবু, সব খপর ভালো
তো?” বড়বাবু বেজার মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে ফিরছিস রে খ্যাপা? টিকিট আছে?”
চোখ নাচিয়ে একগাল হেসে বালাই উত্তর দিল “আপনে থাকতে আমাদের টিকিট কাটা লাগবে - এ
কেমন বিচার বলেন দিকি, বড়োবাবু”?
ফুলবন্তী কিন্তু ওসব রহস্য কথার ধার দিয়েও গেল
না, কাঁকালের পুঁটলি নামিয়ে, কোঁচড়ে বাঁধা প্লাস্টিরের মোড়ক খুলে দুটি টিকিট
দেখাল। “পারানির কড়ি ফাঁকি দিয়ে আমি পথ চলতে পারি, কিন্তু ফুলবন্তীর কাছে যে সেটি
হবার জো নেই, বড়োবাবু?” বালাই তার উজ্জ্বল চোখে হাসি ঝলমলিয়ে বলল।
আমি দাঁড়িয়ে পকেট থেকে টিকিট বের করতে উদ্যত
হতেই স্টেশনের বড়োবাবু বললেন, “থাক, থাক দেখাতে হবে না”। বালাই আমার পায়ে হাত রেখে হাসতে
হাসতে বলল, “চলেন বাবু, চলেন, বড়োবাবুর পারমিশিন হয়েচে, আজ্ঞে”।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে সত্যিই অথৈ জলে পড়লাম। সেখানে কিস্সু নেই। জনবিরল চত্বরে শোভা বাড়িয়েছে কয়েকটি দুর্বল ছাগল। বাঁদিকে একটা চায়ের ঝুপড়ি, কেরোসিনের পাম্প-স্টোভ নিভে গেছে অনেকক্ষণ! তোবড়ানো সসপ্যান, কাচের গেলাস ধোয়া সেরে, উঠে দাঁড়াল যে, সেই কী হারান? আমাদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “আজ ফেরা হল, বাউল? বেশ আছিস ব্যাটা, আজ এ মেলা, কাল...”। বালাই চলতে চলতেই একগাল হেসে উত্তর দিল, “তা বটে, কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়াই এঘাটে, সেঘাটে...সব হারিয়েও আমরা হারান নাম পেলাম না, গো। অথচ সব থেকেও তোমার নাম হল কিনা হারান?” হাতের কাজ সারতে সারতে হারান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, “হারামজাদা, কথায় কে পারবে তোর সঙ্গে?”
স্টেশনের বাইরের হাল দেখে আমি একটু থমকে
গেলাম। কোথায় যাবো, কিছু কী আছে দেখার মতো? আমার থমকে যাওয়া দেখে, বালাই বলল,
“থেমে থাকবেন না, বাবু, সব্বাই চলছে, চলতে থাকেন। ওই দ্যাখেন ফুলবন্তি কদ্দূর
এগিয়ে গেছে...ওর তাড়া আছে...অনেকদিন পর ঘরে ফেরা...আওতা ঘরটা তাকে গুছিয়ে তুলতে
হবে...রান্নাবান্না করবে... অতিথ সেবার যোগাড় আছে...চলেন বাবু...চলেন”।
ফেরার ট্রেনের তো অভাব রাখেননি সরকার। এক দেড়
ঘন্টা অন্তর ট্রেন রওনা হয় স্টেশন থেকে। অথৈ জলে তো আর পড়িনি। এসে পড়েছি যখন দেখেই
যাই।
বালাইয়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে খুব সঙ্কোচের
সঙ্গে বললাম, “তোমাদের ছোট্ট সংসারে, উটকো আমার ব্যবস্থা না করলেই কি নয়, বালাই?”
এই প্রথমবার বালাইয়ের মুখ কিছুটা গম্ভীর হল। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, উদাস
চোখে বলল “আমাদের সংসার ছোট্ট। সে কথাটি নিজ্জস সত্যি বাবু। কিন্তু সে কারণে তো
আপনার সংকোচ নয় বাবু, আপনি ভাবতেচেন আমাদের অভাবের কথা, তাই না বাবু! কিন্তু
আমাদের তো অভাব নেই, বাবু, সকলের সঙ্গেই যে আমাদের ভাব...ভাবের কথায় আমাদের চোখে
পানি ঝরে! আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু অভাব আছে? কই না?”
বালাইয়ের মুখ আবার আগের মতোই হাসিতে উজ্জ্বল। একটু
থেমে থেকে সে আবার গেয়ে উঠল, “ভবে এসে ভাবের বশে ঘুরি ফিরি আপন মনে, সাদা কালো
ভাবের আলো, আমি জানি আর কালা জানে”।
আর কোন গত্যন্তর নেই দেখে মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেললাম। অচেনা পথে বালাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “এসব গান তুমি মুখে মুখেই বানাও, বালাই?” বালাই হাসল, কিছু বলল না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পিচের রাস্তা ছেড়ে উঠে এলাম, উঁচু বাঁধের পথে – এ রাস্তা কংক্রিটের। বাঁধে উঠে ডান দিকে চোখ ফেরাতেই সামনে ভেসে উঠল সীমাহীন দৃশ্য। বাঁধ বরাবর আমাদের পায়ে চলা রাস্তা। তার ডানদিকে অনেকটা নীচে বিস্তীর্ণ বালির চড়। তার পরেই ছোট্ট একটা আঁকাবাঁকা খাল। তাতে তিরতির করে বয়ে চলেছে অল্প জল। খালের স্বল্প জলেই নোঙর বেঁধেছে তিনটে মাছ ধরার নৌকো। তারপর আবার অনেকটা চড়া – তারপর আকাশের রঙে রঙিন হয়ে ওঠা সাগরের জল। বাঁধ বরাবর আর বাঁধের বাঁদিকে গাছপালা, বাড়িঘর, চাষের জমি, আর ডানদিকে বিশাল ব্যাপ্ত এক প্রেক্ষাপট। ভারি নিরিবিলি শান্তির ছবি।
হাঁটতে হাঁটতে বালাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি
তো মুসলমান, তাহলে কৃষ্ণের নামে গান গাও কেন?” বালাই খুব হাসল কিছুক্ষণ, তারপর বলল,
“ওই যাঃ, চিনলেন কী পেকারে? চোখে পানি ঝরার কতায়?” কোন উত্তর দিলাম না, বালাই আমার
মুখের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠল, “ছলছল চোখে আনিতে জল ছল করে যায় যমুনায়, নয়নমণিরে
হারায়ে অভাগী হেথা কোথা বৃথা খুঁজিয়া বেড়ায়... আমার ওই এক কথাতেই আমায় চিনে
ফেললেন, বাবু? তাহলে ব্যাপ্ত এই দিগন্তের মাঠঘাট-সাগর-নদী-প্রান্তর দেখেই আপনার এই
অচেনা অজানা দেশও চিনে ফেলেছেন, বলেন?”
দাড়ির আড়ালে মিচকে হাসির রেশ টেনে সে আবার
বলল, “এত সহজে কী চেনা যায়, বাবু, আমার কালাকে...বসেন, দেখেন, সুখদুখের কথা কন
কিয়ৎক্ষণ, তারপর না জানাজানি, চেনাচিনি...?”
আমার শহুরে শিক্ষায় একটু লজ্জা পেয়ে আমি
বালাইয়ের সঙ্গে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। বাংলার বাইরে সর্বত্রই জলকে পানি বলে, তবু
কী করে আমি ধরে নিলাম “পানি” বলা মানেই সে মুসলমান? বালাই আর কিছু বলল না, গুনগুন
করে কোন গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এগিয়ে চলল দু হাতে ভর দিয়ে পশ্চাৎ ঘষতে ঘষতে...।
বোল্ডার আর মাটি দিয়ে বানানো পোক্ত বাঁধের ডানদিকের কোল বরাবর শালবল্লা
গেঁথে তৈরি করা গেছে এ বাঁধের সুরক্ষার
ব্যবস্থা। নামটা “শাল-বল্লা” ঠিকই, কিন্তু সভ্য মানুষের ভদ্র কামড়ে শালগাছ আর কোথায়? যেটুকু
পাওয়া যায় তাও অগ্নিমূল্য। মানুষের বিজ্ঞান আর লোভের গুমোরে প্রকৃতিতে অন্য কারো
টিকে থাকার জো আছে? প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে জঙ্গল সাফ হয়ে চলেছে, পাহাড় সমতল হয়ে
চলেছে নগর সভ্যতার পাথর আর কংক্রিটে। আজকাল বিপন্ন পশুপাখিদের জন্যে সুসভ্য মানুষ
কেঁদে ভাসায়। অনন্ত লোভে মানুষ যেদিন নিজেদেরই শেষ করবে, সেই দিনই মানুষ পৌঁছবে
সভ্যতার চূড়ায়। রিক্ত প্রকৃতি সেদিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
নামে শালবল্লা হলেও, এখন এসব কাজে ইউক্যালিপ্টাসের লগ ব্যবহার করাই
দস্তুর। এই গাছ বাড়ে তাড়াতাড়ি, অতএব বনসৃজনের পরীক্ষা পাসের সিওর সাকসেস স্টোরি
ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল। যদিও আমাদের দেশে ইউক্যলিপটাস আদৌ পরিবেশবান্ধব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের
অবকাশ রয়ে গেছে। তবু তো আসে বনসৃজনের সাফল্য। আর মেলে সস্তায় বল্লির উৎপাদন, যা
দিয়ে বাঁধকে বেঁধে রাখার ব্যয়কেও বেঁধে রাখা যায় আয়ত্তের মধ্যে।
বাঁধের ওপরে মাঝখান বরাবর কংক্রিটের রাস্তা, দুপাশে বোল্ডার-মাটির শোলডার। এপথে
পাশাপাশি দুটো টোটো দিব্বি চলতে পারে। চারচাকার গাড়িও চলতে পারে, কিন্তু উল্টোদিক
থেকে গাড়ি এলে কংক্রিট ছেড়ে চাকা নামাতে হবে ওই শোলডারে।
দশ-বারো ফুট উঁচু বাঁধের কোল থেকে সোনালি বালির চর শুরু হয়ে, মিশেছে বহুদূরে নীলাম্বরী শান্ত
সাগরের জলে।
বাঁধনহারা দৃষ্টির সেই সুদূর দিগন্ত থেকেই বয়ে আসছে মন জুড়োনো হাওয়া। সেই একটানা হাওয়ায়
সবই যেন ফুরফুরে হাল্কা হয়ে উঠল, এমনকি আমার ভারিক্কি শহুরে মনের ভারও। বাঁধের
গায়ে সারে সারে লাগানো রয়েছে যে ইউক্যালিপ্টাস আর বাবলা গাছ। হাওয়ার বাচালতা সেই
গাছের পাতায় পাতায় – সারাক্ষণ চলছে তাদের ঝরঝর মর্মর। আকাশের অভিলাষে তাদের
শাখাপ্রশাখা যত উচ্ছল, তার থেকেও নিবিড় সম্পর্ক তাদের মাটির সঙ্গে। মাটির গভীরে শিকড়ের বাঁধন যত পোক্ত হয়, ততই
নিশ্চিত হয়ে ওঠে ওদের এবং মানুষের গড়ে তোলা এই বাঁধের অস্তিত্ব।
“গরম চায়ে গলাটা এট্টু ভিজিয়ে নেবেন নি, বাবু”? এতক্ষণ চারদিকের পরিবেশ প্রকৃতি দেখতে দেখতে যে ভাবনায় ডুবে ছিলাম, বালাইয়ের কথায় সেটা টুটলো। হেসে উত্তর দিলাম, “চা একটু হলে মন্দ হত না, বালাই। কিন্তু এখানে পাব কোথায়?” বালাই মুখ তুলে আমার দিকেই তাকিয়েছিল। তার মুখে বাবলাগাছের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া রোদ-ছায়া খেলে বেড়াচ্ছে। ভুরুর ওপরে হাতের আড়াল করে হেসে সে বলল, “আছে বৈকি বাবু, মন চাইলেই মিলবে সকল তাম্ঝাম্...। মোড় ঘুরলেই মালতীমায়ের চায়ের এসটল”।
গাছপালার আড়ালে চোখে পড়েনি, বালাইয়ের কথায় এখন লক্ষ্য করলাম, সামনে
একটু এগোলেই বাঁধ এবং কংক্রিটের রাস্তা মোড় নিয়েছে বাঁদিকে। তারপর একদম নাক বরাবর
সোজা চলে গেছে বালির চর ধরে। এই মোড়ের কাছটিতে রাস্তাও একটু চওড়া, চওড়া বাঁধটাও।
আর সেখানেই রাস্তা ছেড়ে গাছের ছায়ায় প্লাস্টিকের টেবিল। একজন মহিলা সে টেবিলে পসরা
সাজিয়েছেন। প্লাস্টিকের কিছু বয়ামে ক্যাণ্ডি আর দিশি বিস্কুটের সম্ভার।
সিগারেট-বিড়ি-দেশলাইও রয়েছে। আছে গুটখা-জর্দার পাউচও! অর্থাৎ তরিবতের অভাব নেই
কোথাও। টেবিলের পাশে গুটিকতক প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা আছে, হাওয়ার দাপটে সেগুলো
উলটে যায় বলে, একের ভেতর আরেক করে সাজিয়ে রাখা আছে। তাছাড়া একটা বাবলা গাছের নীচে দুটো বেঞ্চ -
বাঁশের খুঁটিতে পেরেক ঠুকে আধলা বাঁশের ফালি বসানো। সেই বেঞ্চে জনা চারেক লোক বসে
আছে, কিছু ছেলে মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেবিলের আশেপাশে।
দোকানের মালকিন সম্ভবতঃ বালাইয়ের মালতীমা এক মুখ খুশির হাসি নিয়ে
বললেন, “একটু আগে কাকিমারে দেকেই বুইচি, তুমি আসতেস, কাকা। কদ্দিন পড়ে ফিরলে বল
দিকিনি? বাইরের পানেই তোমার
যত মনের টান, ভুলে থাকো আমাদের -
ঘরের নোকদের”। মালতীমায়ের গলায় অকৃত্রিম অনুযোগের সুর। বালাই একটু অপ্রস্তুত হল
বলেই মনে হল, লাজুক হেসে বলল, “মার ‘পরেই দুঁদে ছেলেপিলেদের যত্তো চোটপাট, দেখিসনি
মা? বাইরে বাইরে তারা যতই ফচকেমি করুক, বজ্জাতিতে ফিরুক, ঝাঁপাই ঝুরুক – পোড়ার
মুখোরা মনে মনে জানে মা ঠিক দেঁইড়ে আছে দোরটি ধরে...ওই বুঝি খোকা এল... কী বল?”
বালাইয়ের এই কথাটুকুতেই মালতীমায়ের চোখ উঠল ছলছলিয়ে। আঁচলে নাক আর মুখ
চেপে কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়ে ধরা ধরা গলায় বললেন, “তোমার মতো মন ভোলানো কথার
ছল আর কে বলতে পারে কও দিনি কাকা? জন্মের সময় তোমার মুখে কত মধুই যে ঢেলেছিল তোমার
মা, ধন্যি বাপু”।
বালাই আমার দিকে তাকিয়ে মিচকে হাসি মাখা মুখে গেয়ে উঠল,
“মন মানে না, খুঁজে ফিরি বিশ্ব মায়ের অকূল কোল,
ফিরলে ঘরে আদর করে, নে মা আমায় বক্ষে তোল”।
গান শেষ করেই বালাই বলল, “বাবুরে ধরে লিয়ে এলাম ইস্টিসান থেকে, খুব ভাল
করে চা খাওয়া বাবুকে, আর সবথে ভালো চেয়ারখানায় বসা দিনি। মা পুতের ঝগড়ার কী আর
অন্ত থাকে মা, সে যে আঁতের কথা, আঁতের ব্যথা। বসেন বাবু, নিজের মনে করে বসেন”। শেষ
কথাটা আমাকেই বলল, বালাই। হাল্কা-পল্কা প্লাস্টিকের চেয়ারের থেকে বাঁশের বেঞ্চিই
আমার বেশি নিরাপদ মনে হল। আমি বাবলা গাছের নীচে বেঞ্চিতেই বসলাম। মালতী মা হৈ হৈ
করে বললেন, “বেঞ্চিতে বসবেন কেন বাবু, ও কী আর আপনাদের বসার? চেয়ারে বসেন না”।
বালাই চোখ পিটপিট করে মিচকে হাসল, বলল, “বাবু বসুক না বেঞ্চে, ক্ষেতি
কী? তুই যেমন ভাবচিস এ বাবু তেমন লয়, এ বাবুর বুকখান যেন হুদোস কপাট। যখন কুলুপ
আঁটেন তখন মাথা খুঁড়লেও সাড়া মিলবে না, কিন্তু যখন খোলা - সাত হাতি দেখ-না-দেখ
ঢুকে পড়বে...”।
আমি খুব কুণ্ঠিত গলায় বললাম, “বালাইবাবুর কথায় কিছু মনে করবেন না, কি
যে বলে...তার মাথামুণ্ডু নেই”।
মহিলা চোখ সরিয়ে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন, “চায়ে চিনি
দেব? লিকার চা না দুধ চা, কী খাবেন?”
“আমার কিছুতেই আপত্তি নেই, যেটায় আপনার সুবিধে”। বালাইয়ের কথার
কারিকুরির ফাঁদ থেকে মুক্তি পেয়ে আমি একটু উৎসাহ নিয়েই বললাম। পাম্প দেওয়া স্টোভে
আগুন জ্বলল, কেটলিতে জল নিয়ে স্টোভে চাপিয়ে, মালতীমা গম্ভীর মুখে চায়ের সরঞ্জাম
গোছাতে লাগলেন।
মাটিতে উবু হয়ে বসে থাকা চারজন লোক এতক্ষণ কোন কথা বলেননি। এবার তাঁদের
একজন বালাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তা বাবুকে কোথায় ধরলে হে? একদম মেলা থেকে নাকি”?
একমুখ হেসে বালাই বলল, “না গো না, ফেরার পথে আমাদের ট্রেনে। চলার
শুরুতে কত লোক ছিল ট্রেনে। যার যার ইস্টিসনে সব লোক নেমে গেল, এই বাবু একলা পড়ে
রইল আমাদের লাস্ট ইস্টিসন তক। সবার যে যাবার জায়গা আছে, বাবুরই নেই। শুধোলাম,
কোথায় যাবেন, বাবু, কাদের বাড়ি? তো বাবু বললে, কোথাও না, জায়গাটা শুধু দেখব, চিনব,
জানব...”।
ভেবেছিলাম মালতীমার মন চা বানানোতেই বুঝি নিবিষ্ট, এদিকের কথায় মন নেই।
সে ভুল ভাঙল তাঁর টিপ্পনিতে, “ব্যস, তুমিও ওমনি বাবুকে দেশ চেনাবার দায় লিয়ে লিলে
নিজেরই কাঁধে, তাই না, কাকা?”
আমি বালাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি
হাসছে, তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান ধরল,
“মন বাদামে লাগলে বায়, আর কী তারে বাঁধা যায়,
ভেসে চলে পরাণ খানা অকূল দরিয়ায়।
ও সেই মন-মাঝি হায়, বসত করে মনপবনের নায়”।
বালাইয়ের গানটার ধরতাইয়ের মাঝে আমি একটু ডুব দিয়েছি কী দিইনি, চারজন
লোকের মধ্যে একজন আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “তা বাবুর কোথা থেকে আসা হচ্ছে? কলকাতা
থেকে বুঝি?”
বালাইয়ের কথা ও সুরের জাল কেটে আচমকা বেরিয়ে আসতে হল বাস্তব জগতে। বালাই
না হয় তার মনের আসন মেলে ধরেছে – এস জন বসো জন, গরম ভাতে চুনো মাছের সরষে ঝাল বেড়ে
দিই, খেও জন। তা বলে সবাই কেন মানবে? উটকো লোক যখন, কে না কে? তার মতলব কী? সে পরিচয়
দিতে হবে না? পাসপোর্ট, আধারকার্ড না হোক, পুছতাছ থেকেই অনেকটা টের পাওয়া যাবে, তুমি
বাপু মানুষটা কেমন হে?
আমি তাঁর কথার উত্তরে বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ”।
নিমেষে পরের প্রশ্ন ভেসে এল “কলকাতার কোথায় বটে?” আমি কলকাতায় আমার
পাড়ার নাম বললাম।
“অ। আমি অবিশ্যি কলকাতার তেমন কিসুই চিনি না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
দুবার মাত্র কলকাতায় গেছি, পেথমবার ময়দানে । আরেকবার আলিপুরে। আলিপুরে পুলিশদের
টেনিং দেওয়ার ইস্কুল আছে না? চেনেন?”
“চিনি বৈকি, পিটিএস। তবে ভেতরে ঢোকার সুবিধে পাইনি কোনদিন”।
“তা না পাওয়াই ভালো, বাবু। ওসব খানে আমাদের মতো লোকের পেয়োজন কী”? একটু
থেমে থেকে আবার বললেন, “পেথমবার কলকাতায় গেছিলাম, বাবু, সে এক্কেরে ছোকরা বয়েসে।
ময়দানে মিটিং ছিল, পাড়ার সব্বাই হুজুগ তুললে চল, মিছিলে যাব।” আমাকে পেয়ে ভদ্রলোকের
পুরোনো দিনের অনেক স্মৃতিই, মনে হল, ফিরে আসছে। ভদ্রলোক কথা থামিয়ে মুখে একটা বিড়ি
নিলেন, মনের গহনে জমে থাকা সেসব কথা বের করতে গেলে – কিঞ্চিৎ অগ্নি আর ধোঁয়ার
সংযোগ যে আবশ্যিক। কিন্তু দেশলাই ধরাতে গিয়েই বিপত্তি। একটানা এই ঝিরঝিরে বাতাসে তাবড়
তাবড় অভিজ্ঞ ধূমপায়ীরাও বিড়ি-সিগারেট ধরাতে হিমসিম খাবে। তিনটে কাঠি নষ্ট করে
অবশেষে বিড়িটা ধরল।
লম্বা একটা টান দিয়ে ভদ্রলোক শুরু করলেন, “মিছিলে যাওয়াটা বাবু মন্দ
লাগেনি তখন, জানেন। যার যার বাড়ি থেকে আলুচোকা দিয়ে দুটি পান্তা সাঁটিয়ে, ভোর ভোর
দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। জানেন তো সবই, মিছিলে গেলে রেলের ভাড়া-টাড়া বিলকুল ফিরি।
দলের হাতে দু চারটে ঝাণ্ডা থাকলেই, টিকিটবাবুরা সবাই ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন। সাড়ে
বারোটা - একটা থেকে মিটিং, তা আমরা শেয়ালদা পৌঁছে গেলাম সকাল-সকাল। আমাদের দলে
তিনজন পাণ্ডা ছিল, তাদের পেছন পেছন কখনো ট্রাম ধরে, কখনো পায়ে হেঁটে, আমরা প্রায়
ঝড়ের বেগে দেখে ফেললাম, কালীঘাটে মায়ের থান, আলিপুরের চিড়িয়াখানা, রাণি
ভিক্টোরিয়ার বাগান। আমাদের পাণ্ডাদের মধ্যে দুজন ছিল কলকাতা গুলে খাওয়া লোক, বাবু।
তারাই আরো কত কি দেখাল, পিজি হাসপাতাল, পুলিশ টেনিংয়ের ইস্কুল, রবি ঠাকুরের ভবন না
সদন, যেখানে নাকি নাচ-গান হয়। তারপর যাদুঘর। যাদুঘরের ভেতরে ঢোকা হয়নি, হাতে আর
সময় ছিল না যে! দেরি করলে দুপুরের ডিমের
ঝোল দিয়ে গরমভাত ফসকে যেত! সময় থাকলে যাদুঘরে নিগ্ঘাত ঢুকতাম বাবু, সেই তিমির
চোয়াল আর ন্যাকরা জড়ানো মিশরের মরা দেখতে। আপনি নেশ্চয় দেখেছেন, বাবু”।
কথার ঝোঁকে বিড়িটা অনেক আগেই নিভে গেছিল, ভদ্রলোক এতক্ষণে সেটা লক্ষ্য
করলেন এবং একটু বিরক্ত হয়েই ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট
বের করে ভদ্রলোককে অফার করতে, ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তুলে নিলেন একটা।
বাকি সকলকেই অফার করলাম, বালাইকেও – বালাই নিল, আর কেউ নিলেন না। এই সময়েই মালতীমা
স্টিলের প্লেটে ছটা কাগজের কাপে চা নিয়ে এলেন, বললেন, “ন্যান বাবু, বিড়ি ধরানোর
আগে, চা টুকু খেয়ে ন্যান। থা নয়তো হাওয়ায় জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে”।
আমাদের পরাণটা কখন কিসের জন্যে যে আঁটুবাঁটু করে সে বোঝা ভার। কিছুক্ষণ
আগে এই প্রকৃতি পরিবেশে মন মজে ছিল, মন মজে ছিল বালাইয়ের গানে। এই মাত্র শুনছিলাম
ময়দানে মহাসভায় মিছিল করে যাওয়ার গল্প। কিন্তু উষ্ণ চায়ের গন্ধে মনটা যেন গেয়ে উঠল
আনন্দে। মালতীমায়ের প্লেট থেকে দুটো কাগজের কাপ তুলে একটা দিলাম বালাইকে, একটা
নিলাম নিজে। বাকিরাও তুললেন একে একে। প্রথম চুমুকেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “আঃ”
শব্দটা। তারপর বললাম, “চায়ে মনে হচ্ছে একটু আদাছেঁচাও পড়েছে!”
মালতী মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটু আদার রসে চায়ের তারটা
ভালো জমে - ভালো হয়েছে চাটা?
“ভালো মানে? এখানে এরম চায়েরই খোঁজ করছিলাম মনে মনে। তবে, দিদি, এইটুকু
কাপে তো গলাও ভিজবে না। আরেক কাপ দেবেন কিন্তু এটা শেষ হলে। বালাইবাবুকেও দেবেন।
আপনারা?” আমি সামনে বসা চারজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা সকলেই মাথা নাড়লেন, মিছিলের
ভদ্রলোক বললেন, “না, না, এই আমাদের ঢের”।
ছোট্ট কাপের চা তিন চুমুকে শেষ করে, মিছিল-ভদ্রলোক চায়ের খালি কাপ
প্লাস্টিকের বালতিতে ফেলে আবার বিড়ি ধরানোর কসরত করতে শুরু করলেন। বিড়ি ধরিয়ে
বললেন, “যে কথা বলছিলাম”, মনে হল ওঁর কথার মধ্যে চায়ের বিরতি এবং সেই প্রসঙ্গে
মালতীমায়ের সঙ্গে আমাদের কথোপকথনে উনি কিঞ্চিৎ বিরক্তই হয়েছেন। এখন নতুন উদ্যমে
হারানো সূত্র কণ্ঠে তুলে নিলেন, “থা কলকাতা দেখা সেরে আমরা যখন ময়দানে পৌঁছলাম, ও
বাব্বা, সে কি, মানুষের ঢল রে, নব্নে”। বন্ধুজনের আন্তরিক সম্বোধনে নবীনকে হয়তো,
নব্নে হতে হয়ে হয়েছে এবং এই গল্প নবীনবাবু হয়তো একশবার শুনে থাকবেন, তবুও পাশে
বসে থাকা নবীনবাবু নির্বিকার মুখে বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে বললেন, “তাই”?
বন্ধুর কৌতূহলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে মিছিলবাবু বললেন, “তাই, মানে?
চারিদিকে গিজগিজ করছে লোক আর লোক – সে যে কত! শুনলাম আরো নাকি লোক ঢুকছে তো ঢুকছে।
একদম সামনে – বহুদূরে বিশাল মঞ্চ, সেখানে সব গান-টান হচ্ছে, নেতারা ব্যস্ত সমস্ত
হয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন। মুখ্যমন্ত্রী তখনো এসে পৌঁছোননি, তিনি এলে যে কী হবে কে জানে?
ভিড়ের জন্যে এতটাই দূরে দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছিলাম, সেখান থেকে মঞ্চের কাউকেই চেনা
যায় না। এত লোক এত লোক, কেউ বললে পাঁচলাখ, কেউ বললে ছয় - আমারও তাই মনে হচ্ছিল।
লাখ পাঁচেকের কম হতেই পারে না”!
মিছিলবাবু বিড়ির সুখটান সেরে ছুঁড়ে দিলেন বালির চড়ায়, তাঁর বন্ধু
নবীনবাবু বললেন, “পাঁচলাখ - সে কী মুখের কথা, বাপু?”
আমার চায়ের কাপ শেষ হয়েছিল, মালতীমা লক্ষ্য রাখছিলেন, আমি তাকাতেই
ফ্লাস্ক থেকে নতুন দুটো কাপে চা ঢেলে নিয়ে এলেন, আমি হেসে তুলে নিলাম কাপ দুটো –
একটা বালাইয়ের অন্যটা আমার।
যদিও পাঁচলাখ লোকের কথাটা আমার অত্যন্ত বাড়াবাড়ি মনে হল। ময়দানের যা
আয়তন, তার থেকে নিরাপত্তার বেষ্টনি আর বিশাল মঞ্চের আয়োজন ছেড়ে দিলে, বড়জোর
লাখখানেকের মতো লোককে অ্যাকোমোডেট করা যায়। সেটাও যথেষ্ট এলাহি কাণ্ড। তবে শুনেছি
রাজনৈতিক দলগুলিও নির্দ্বিধায় চার-পাঁচ লক্ষ লোক সমাগমের লক্ষ্যে পৌঁছে যান।
কিন্তু আমি আদার ব্যাপারী, আমার এ বিতর্কের প্রয়োজন কী? বরং আদার রসে স্বাদু চায়ের
দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিয়ে কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর?”
আমার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন, ভদ্রলোক হেসে বলতে শুরু করলেন,
“তার আর পর কী? আমাদের পাণ্ডা ছিল ওমরিদা, সে বললে, সাড়ে বারোটা বাজছে, চল খাবার
যোগাড় কী আছে দেখি। খেয়েদেয়ে আমরা একটু ঘুরেঘেরে দেখে রওনা হবো শেয়ালদা। আমি
বললাম, সে কি? আমরা মিটিং বক্তিতা শুনবো না? ওমরিদা আমার মাথায় হাল্কা চাঁটি মেরে
বলল, তুই শুনতে হলে থেকে যাস, আমি কেটে পড়বো। এর পরে আর ফেরার ট্রেনে চাপতে পারবি,
হতভাগা?”
আমি দ্বিতীয় কাপ শেষ করে সিগারেট ধরালাম, বালাইকেও একটা দিলাম।
মিছিলবাবুর ওমরিদা হয়তো অমরদা কিংবা ওমরদা। মনে মনে তাঁর বাস্তববোধকে পূর্ণ
অ্যাপ্রিসিয়েট করে, খুবই হতাশ গলায় বললাম, “সে কি, মিটিং না শুনেই চলে এলেন”?
মিছিলবাবু একটু যেন লজ্জাই পেলেন আমার কথায়, বললেন, “থা আর কী করা
যাবে? ওমরিদা খারাপ তো বলেনি কিচু! আর অতদূর থেকে আমরা কী আর চিনতে পারতোম কাউকে?
চারদিকের অজস্র মাইকের এমন গমগমে আওয়াজ নেতাদের সব কথাও কী আর বুজতে পারতোম? কাজেই
কালবিলম্ব না করে ময়দানের সে পাশে - যেখানে ওমরিদা বলল, শীতকালে নাকি ঘোড়া দৌড়োয়,
তার বেড়ার ধারে গিয়ে আমরা খাওয়ার পাট চুকিয়ে, বরাবর হাঁটা দিলাম শেয়ালদা পানে”।
দেশ ভ্রমণ এবং কলকাতা ভ্রমণের অনেক বিখ্যাত কাহিনী শুনেছি, পড়েছি,
কিন্তু এমন ভ্রমণের কথা কোনদিন শুনিনি। জনসভার দিন টিভিতে এবং পরের দিন সকালের
খবরের কাগজে আমরা রেকর্ড জনসমাবেশের যে তরজা শুনি, তার এমন বাস্তব চিত্র তেমন
কোথাও চোখে পড়েনি। আমার এই মিছিলবাবুকে বড়ো ভাল লাগল। কোনরকম বারফট্টাই আজগুবি কথা
বলেননি, যা করেছেন, যা দেখেছেন, যেটুকু শুনেছেনে সেটুকুই বললেন সরল কথায়। এমন সহজ
সত্যি কথা আজকাল কে বলে আর?
আমার কৌতূহল তখনো একটুও টসকায়নি, জিজ্ঞাসা করলাম, “আর আপনার সেই পিটিএস
যাওয়ার কথাটা? সেখানে কেন গিয়েছিলেন? সেখানে তো কোন মিটিং-টিটিং হওয়ার কথা নয়”।
মিছিলবাবু খুবই উৎসাহী হলেন আমার প্রশ্নে, “না, না, ওখানে কোন মিটিং
নয়, তবে সে এক কাণ্ড বলতে পারেন। আমাদের পাশের গাঁয়ে যাদবখুড়োর ছেলে এক কেলেংকারি
বাধিয়ে বসেছিল, জানেন? একটা সিগারেট দেন তো। আপনার আবার কম পড়ে যাবে না তো?”
কুণ্ঠিত স্বরে আমাকে মনে করাতেও ভুললেন না।
তৎক্ষণাৎ আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরে বললাম, “কম পড়লেই
বা কী? মালতীমায়ের কাছে সিগারেটের প্যাকেট আছে আমি দেখে নিয়েছি”।
সিগারেটটা ধরিয়ে মিছিলবাবু বলতে শুরু করলেন, “বেশি দিনের কথা নয়, এই
বছর তিন-চার আগেকার ঘটনা। যাদবখুড়ো সরকারি কাজ করতেন, সবে রিটার করেছেন। সে সময়
তিনি, রিটার করলে ওই গ্রাচুটি না কী যেন বলে, সে টাকা পেয়েছেন, পিএফ পেয়েছেন।
পেনসন পাচ্ছেন। কিন্তু তার ছেলেটা গুচ্ছের পাস দিয়েও চাকরি পাচ্ছে না। এদিকে
খুড়িমা চাইছেন ছেলের বে দিয়ে ঘরে বৌমা আনতে। তা কথাটা মন্দ কী? বাপের পেনসন আছে,
পোস্টাপিসে কিছু টাকাও গচ্ছিত আছে। কিছু জমিজমা আছে, সেখান থেকে ধানটা,
তরিতরকারিটা যা ফলে তাতে বছরের খোরাকিটা উঠেই যায়। কিন্তু না, ভাইপো আমার শিক্ষিত
ঘাড়ত্যাড়া, বললে, চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তবেই বে করব। আমি বলি, বাপু
নিজের পায়ে দিব্যি দাঁড়য়ে রয়েছিস, দৌড়োদৌড়ি করছিস, বিয়ের বেলাতেই বসে পড়লি, বাপ?
থা সে যাগ্গে”।
সিগারেটের শেষ পাফটুকু বিড়ির মতো সুখটান মেরে ছুঁড়ে ফেললেন বালির চরে,
তারপর বললেন, “শ্যালে রক্তের গন্ধ পায় জানেন তো?” মনে মনে ভাবলাম, শ্যাল মানে
নিশ্চয়ই শেয়াল। “ঠিক শ্যালের মতন টাকার গন্ধ পেয়ে আর উজবুগ ভাইপোর একলষেঁড়েপনা টের
পেয়ে কোথা থেকে এসে উদয় হল এক ফড়ে দালাল। সে ভাইপোকে আর যাদবখুড়োকে বুঝিয়ে ফেলল,
আটলাখ নগদ দিলেই রেলের চাকরি এক্কেরে পাকা। যাদবখুড়ো সরকারি চাকরি করেছেন, কাজেই
সেই সরকারি মধুর লোভ কি আর ছাড়তে পারেন? বাপ আর ব্যাটা মিলে রাজি হয়ে গেল। অনেক
দরদস্তুর টানাহেঁচড়া করে, পাঁচ লাখে রফা করল। যাদবখুড়ো দেড়লাখ টাকা পরের দিনই
ফড়েটার হাতে তুলে দিলে। আর কথা হল পোস্টাপিসের জমা ভাঙিয়ে বাকি টাকা দেবে দিন
চার-পাঁচেক পর। দালালটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, তারপর নাকি অনেক আকচা-আকচিতে
হারামজাদা রাজি হল। বলল “আজ শুক্রবার, আসছে মঙ্গলবার বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে
পিটিএসে থাকবো, ওইদিন বাকি টাকা যদি পাই, রেলে চাকরি হবে নয়তো লবডংকা”। ভদ্রলোক
দুই হাতের বুড়ো আঙুল তুলে দেখালেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “পিটিএসে রেলের চাকরি?”
মিছিলবাবু মুখে একগাল বাহাদুরির হাসি নিয়ে বললেন, “ওইটাই তো কথা, বাবু,
এতসব ঘটনা হয়েছে, আমাকে কেউ একটা খপরও করেনি। খপরটা আমার কানে এল, রোববার। শুনেই
যাদবখুড়োকে গিয়ে ধরলাম। যাদবখুড়ো আর খুড়িমাতো তো আল্লাদে আটখানা – ছেলের রেলে
চাকরি হবে, বে হবে, বৌমা আসবে...। সব বিবরণ শুনে আমি বললাম, খুড়ো আমিও যাবো ভাইপোর
সঙ্গে। দেখবো কে টাকা নেয়, আর কে চাকরি দেয়। থা গেলাম, জানেন? শেয়ালদা থেকে হলুদ
ট্যাস্কি নিয়ে যাদবখুড়ো, আমি আর ভাইপো। পিটিএসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে
রইলাম...বারোটা, সাড়ে বারোটা, একটা, দেড়টা, আড়াইটে... কারো দেখা নেই...”।
মিছিলবাবু আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন, “সে দালালের আর দেখা নেই, বুঝলেন
বাবু? এমনি সময়ে আমার চেনা একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল, তার বাড়ি ডায়মণ্ডে। সে
পুলিশেই চাকরি করে। সে আমাকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললে, আরেঃ তুমি এখানে, খি
ব্যাপার? তাকে সব কথা খুলে বললাম। সে একগাল হেসে বললে, যা গেছে অল্পের উপর দিয়েই
গেছে হামিদভাই। বাড়ি যাও, টাকাটা পোস্টাপিসে আবার জমা করে দাও গিয়ে। ফেরেব্বাজ
দালালের খপ্পরে পড়েছিলে – কোনমতে বেঁচে গিয়েছ। রেলের চাকরি কোনদিন পুলিশে দিতে
পারে এমন কস্মিনকালেও শুনেছো?” যাক মিছিলবাবুর নামটা জানা গেল হামিদ। আর হামিদ
ভাইয়ের চেনা লোকের বাড়ি নিশ্চয়ই ডায়মণ্ড হারবারে।
আমি রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর, হামিদভাই?”
হামিদভাই বললেন, “তারপর আর কি? আমরা পাঁচটা অব্দি ওখানেই ঘোরাঘুরি করে
ফিরে এলাম। আজ পর্যন্ত বকেয়া টাকা নিতে সে হারামজাদা আর এ মুখো হয়নি। দেড়লাখ পেয়ে
সে গায়েব...মাঝের থেকে যাদবখুড়োর সাড়ে তিন লাখ আমি বাঁচিয়ে দিলাম”। আমরা সকলেই চুপ
করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বেশ খানিক পরে হামিদভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বজ্জাত
আর ফিকিরবাজে দেশ ভরে উঠেছে, জানেন বাবু। আমি আর একলা কত সামলাব? যাই, বেলা হল,
চান খাওয়া সেরে আমাকে একবার ডায়মণ্ড যেতে হবে। তবে যাই বলেন, বাবু, শহরের লোকগুলোর
থিকে এদিকের লোকজন অনেক সাদাসিধে। রাজধানীর লোকেদের পেটে আর মুখে আনকথা। তাদের
সব্বোদাই যেন লোক ঠকানোর ব্যবসা। এ আমি পেতক্ষ দেখেছি বাবু”।
হামিদভাই উঠে দাঁড়ালেন, যাবার আগে বললেন, “চলি বাবু, আমাদের এ গেরাম
ঘুরেঘেরে দেখুন, বাউলকাকা আপনাকে সবই দেখাবে... দেখার আছেটা কি সে অবিশ্যি আপনিই
জানেন...হে হে হে...”। হামিদভাই চলে গেলেন, ওঁনার সঙ্গেই উঠে গেল অন্য
সবাই...সকলের একইসঙ্গে যেন কাজের কথা মনে পড়ে গেল।
হামিদভাই ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা চলে গেলেন, কিন্তু একটা খোঁচা রয়ে গেল
আমার মনে। এমন তো হবার কথা ছিল না। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বালাইয়ের মুখের দিকে
তাকালাম।
৪
“রাগ করলেন বাবু?” বালাই আরও একটু ঝুঁকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
একটু ঝাঁজালো সুরে উত্তর দিলাম, “রাগ করার কী আছে, বালাই? চা খেয়েছি,
দাম দেব না?”
“আহা, চায়ের দাম তো দেবেন বটেই। আপনিও পালাচ্ছেন না, মালতীমাও নয়।
কিন্তু জেবনের সব দেনা একদিন সত্যি মিটিয়ে যেতে পারবেন তো, বাবু”? এ আবার কেমন
কথা, আমি বালাইয়ের হেঁয়ালি বোঝার চেষ্টা করলাম ওর মুখের দিকে চেয়ে। বালাই চোখের
কোলে একই রকম মিচকে হাসি নিয়ে বলল, “আপনে যে মন নিয়ে আজ এখানে এসেচেন, আপনার সেই
মনের খপর আপনের আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব জানে? বলেন না, জানে? কিসের টানে আপনি
এই অকূলে এসে পৌঁছলেন বলেন দিকি? আপনের মুখের আর মনের খপর কী আলাদা নয়?”
যেটুকু রাগ জমা হয়েছিল, বালাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সেটুকু মুছে গেল।
হেসে ফেলে বললাম, “তুমি এক নম্বরের বিচ্ছু। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে এলে? তোমার
লাজবন্তী ঠিকই বলে, সত্যিই তুমি মনের বালাই”।
বালাইয়ের মুখে এখন সরল একগাল হাসি। বিষয়ী মানুষজনের কথার বিষে সে যেন
এতক্ষণ নির্জীব হয়ে উঠেছিল, এখন যেন ঝিরিঝিরি স্নিগ্ধ বাতাসের সুরেই সে গেয়ে উঠল,
“মনের কথা বলব কারে, হায় হয়নি সময় কথা বলার
পথের টানে ঘর ছেড়েছি হায় হয়নি যে শেষ পথ চলার।
মনের খাঁচায় বসত করে বদ্ধ মনের ব্যাকুল বালাই।
ও তোর মনোতরীর গুণ টানে হায়, গুণের রসিক বংশীকালাই”।
বন্ধুদের আড্ডা, পরিজনের আপ্যায়ন ছেড়ে, একটু ছুটি পেলেই কেন যে এমন ছুটে ছুটে পথে বেরিয়ে পড়ি, সে তত্ত্বটি বালাইয়ের রসিক কৃষ্ণঠাকুর হয়তো জানেন, কিন্তু আমি? নাঃ সত্যিই জানি না...।
ঝলমলে সুনীল আকাশের নীচে চওড়া সোনালী পাড়ের নীলাম্বরি জড়িয়ে আমার সামনে শুয়ে আছে নিবিড় প্রকৃতি। দূরে সাগরের জলের সঙ্গে ‘ও বুড়ি তোর জলকে নেমেছি’ খেলতে খেলতে খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত অজস্র নাম না জানা পাখি। একটানা ঝিরঝিরে বাতাস। এ সবের সঙ্গে মিশে গেল বালাইয়ের গানের সুর আর ওর কণ্ঠস্বর – ওর গানের সকল হেঁয়ালি যে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি তা নয় – কিন্তু সব মিলিয়ে সে গান যেন প্রকৃতিরই অঙ্গ হয়ে উঠল।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে অনুভব করলাম পরিবেশটা, তারপর বালাইকে বললাম,
“তোমাদের এ জায়গাটা সত্যিই ভারি সুন্দর, বালাই”। একটা সিগারেট ধরিয়ে গভীর উপলব্ধির
সঙ্গে আবার বললাম, "সকালে বেরোবার সময় ভাবিনি যে আজ এমন একটা শান্ত নিরিবিলি
জায়গার দর্শন পাবো। আচ্ছা, বালাই তুমি তো প্রায় সর্বদাই ঈশ্বরের নাম গান নিয়েই
থাকো। ঈশ্বরের নামই তোমার জীবিকা, আমোদ, প্রমোদ, সুখের সঙ্গী, শোকের সাথী...। এমন
শান্ত প্রকৃতি - আকাশ, সাগর, সৈকত, গাছপালা, আমরা, ওই পাখিরা...এই সব যখন একই
সঙ্গে এমন বিশালভাবে আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত হয়, তখন তোমার কী মনে হয়? আমার তো
মনে হয় – তিনি নিরাকার কিংবা সাকার সে সব তত্ত্বের কচকচানি বুঝি না, জানি না –
কিন্তু এই শান্ত সৌম্যতাই ঈশ্বর”। বালাই আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার
মুখের সদানন্দ ভাবটা, একটু যেন ম্লান মনে হয়ে এল।
মালতীমা কিছুক্ষণ আমাদের ভরসায় দোকানদারি ছেড়ে ঘরে গিয়েছিলেন কাজ
সারতে। তিনি ফিরে এসেছেন, আমার কথা শুনেছেন, খেয়াল করিনি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি
গভীর বিষণ্ণ স্বরে বললেন, “না, বাবুভাই, এ যা দেখছেন সে আমাদের ভগমানের ছোট্ট একটা
রূপমাত্র। এ রূপ তাঁর আসল রূপ নয়, এ তাঁর ছলনা। তাঁর আসল রূপ দেখা যায় বছরে মাত্র
কয়েকটা দিন। সে রূপ করাল, ভয়ংকর, যে রূপ সইতে পারে আমাদের মতো কিছু পাষাণ মনের
মানুষরা। সে রূপ আপনে দেখেননি, দেকলে সইতে পারবেননি। চোখের সামনে তাঁর সেই ধ্বংসের
লীলা - সে রূপ যারা দেখেছে, তারাই বুঝবে ভগমান কী ভয়ানক মৃত্যু তাণ্ডবে মেতে উঠতে
পারেন”।
আমি মালতীমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলাম, এখন বালাইয়ের মুখের
দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে মাথা নীচু করে রয়েছে, তারও মুখে বিষাদের ছায়া। আমি
জিজ্ঞাসা করলাম, “ধ্বংসের লীলা মানে?”
চোখের সামনে তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এমনই স্বরে তিনি বললেন, “চিন্তা করেন না বাবু, ওই যে দূরের সাগরের ওপার থেকে অজস্র খ্যাপা হাতির মতো দৌড়ে আসছে দুরন্ত ঝড়। এই যে নীল আকাশ দেখছেন, ওই আকাশ জুড়ে তখন কাঁড়ি কাঁড়ি মেঘ বৃষ্টি ঢালছে হুড়হুড় করে, সে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে বিঁধছে বর্শার ফলার মতো। তার সঙ্গে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে এই বাঁধের ওপর। এ বাঁধের শক্তি কতটুকু, এ বাঁধও ভেঙে যায়, সাগরের প্রবল ঢেউ ভাসিয়ে দিয়ে যায় আমাদের ঘর বাড়ি, আমাদের গ্রাম। আমাদের চাষের জমি তখন সাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়...। সে জল সরে গেলে, জমিতে পড়ে থাকে বালি। চাষিদের হাতের ছোঁয়ায় যে মিঠে মাটি, একদিন আগেও হেসে ফসল ফলাত, সেই মাটিই হয়ে ওঠে বোবা-লোনা। এর থেকে বড়ো বিনাশ আর কী হতে পারে, বাবু?”
আমি খবরের কাগজে এবং টিভির ব্রেকিং নিউজে চোখ রেখে কলকাতায় নিশ্চিন্ত
আরামের সোফায় বসে সে সব দৃশ্য দেখিনি কী? সে দৃশ্য দেখতে দেখতে বলিনি কী, “সত্যি
মানুষগুলো কী কষ্টের মধ্যে থাকে... বৌদি শুনছো, ওয়েদারটা বেশ ঠাণ্ডা হয়েছে...এক
কাপ কফি খাওয়াবে নাকি... এমন ওয়েদারে চায়ের থেকে কফিই জমবে ভালো”! অথবা ভাইঝিকে
জিজ্ঞাসা করিনি কি, “হ্যারে, তোর অ্যাপে একবার চেক করে দেখতো, সাইক্লোনের আইটা ঠিক
কতদূরে? ল্যাণ্ডফলটা ঠিক কটার সময় হবে?”
আজ এইখানে এসে এই শান্ত সুন্দর পরিবেশে দাঁড়িয়েও সেই দিনগুলোর কথা কিছুটা হলেও কল্পনা করতে পারলাম। কিছুটা হলেও উপলব্ধি করলাম সেই “কষ্ট”-টুকু, যার প্রতিটি মুহূর্ত এখানকার বাসিন্দাদের ছিল বেঁচে থাকার লড়াই। ঝড়বৃষ্টি অবসানের পরে, প্রকৃতি যখন শান্ত হয়ে এসেছিল। ত্রাণ শিবিরের খিচুড়ি খেয়ে তারা যখন নিজেদের গ্রামের ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন তাদের চোখের জলও বাঁধ মানেনি, কিন্তু একই সঙ্গে জন্ম নিয়েছিল নতুন জেদ আর স্বপ্ন। বুকের সেইটুকু সম্বলেই এরা শুরু করেছিল যার যার নিজস্ব অধিকারের ধ্বংসস্তূপগুলিকে ধীরে ধীরে আবার বাড়ি-ঘর, গ্রামকে বাসযোগ্য এবং জমি-জিরেতকে কৃষিযোগ্য করে তুলতে! প্রশাসনিক সহায়তা ছিল, কিন্তু সে আর কতটুকু, তার মধ্যেও তো থাকে অজস্র বঞ্চনা এবং তঞ্চকতা। তবু জীবন থেমে থাকেনি, জীবন থেমে থাকে না। আজ আমি এইখানে দাঁড়িয়ে সেই ধ্বংসের এতটুকু অবশেষ দেখতে পেলাম না। যেটুকু রয়েছে সে আছে এখানকার অধিবাসীদের মনে – আতঙ্ক এবং উদ্বেগ। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায় – এই মানুষগুলো তেমনি ডরায় “নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর”-কে এবং উদ্ধত ঝড়ের উন্মাদনাকে।
আমি মালতীমায়ের মুখের দিকে নতুন করে তাকালাম। দেখতে পেলাম তাঁর
মুখের-কপালের প্রতিটি রেখায় লেখা রয়েছে সেই সব অজস্র ঝড়ঝঞ্ঝার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ক্ষত ও ক্ষতির চিহ্ন। কিছু বলতে পারলাম না,
চুপ করে বসে রইলাম। একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে রইলাম, সামনের বিস্তীর্ণ সোনালি
বালুতট আর দূরের সবজে-নীল সাগরের আভাসের দিকে। মালতীমা বললেন, এ রূপ ছলনা, এ আসল
রূপ নয়। কিন্তু এ রূপ ছলনা না তো নয়, এ যে সত্য – প্রত্যক্ষ করছি নিজের চোখে।
সোনালী চওড়া পারের নীলাম্বরি পরিহিতা শান্ত সুন্দরী এই বালিকা, বছরের কয়েকটা দিন
যে মত্ত মাতঙ্গের মতো রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করেন, সেও একই ভাবে সত্যি। এই সত্য
নিয়েই আমাদের জীবন।
আনমনে গেয়ে উঠলাম,
“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম
দুয়ার খুলে হে প্রিয়তম,
চাই যে বারেবার। পরাণ সখা বন্ধু হে আমার।
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই, তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার। পরাণ সখা বন্ধু হে আমার”।
গান শেষ হতে লম্বা ছাই সমেত সিগারেটটা ফেলে দিলাম। চেষ্টা করছিলাম খুব, কিন্তু পারলাম না, আমার চোখ জলে ভরে উঠল, চশমা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে চোখের দুই কোণ টিপে বসে রইলাম একইভাবে। নতুন দেশ আমার ভেতরে এমন নাড়া দেবে ভাবতে পারিনি। তবে কী বালাই আমাকে ঠিক চিনেছে, আমার মনের মধ্যে কী আছে আমি নিজেই জানি না, অথচ মুখে কত কী যুক্তি আর তর্ক নিয়ে আজীবন দিন কাটাচ্ছি!
“কী বেপার রে? তোরা মুখ ঝুড়ি করে চুপ করে বসে আছিস, আর নতুন বাবু,
বাউলদাদু, মালতী কানচে? কী হয়েছে?”
মহিলা কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালাম, দেখি বালাইয়ের লাজবন্তী উপস্থিত।
কোমরে হাত দিয়ে অবাক চোখে আমাদের তিনজনকে দেখতে দেখতে বললেন, “আমি ঘরদোর সামলে
রান্নাবান্না সেরে বসে আছি, ভাবছি বাবুকে নিয়ে বালাইটা এই আসছে ওই আসছে...। শেষে
আর ভরসা হল না, ওর তো আর গুণের ঘাট নেই, বাবুকে নিয়ে কোথাও হয়তো পালিয়েই গেল বুঝি। তাই দৌড়ে
দেখতে এলাম”। তারপর একটু বিরতি দিয়ে বললেন, “এসে দেখি, ওম্মা, ছেলেমেয়েগুলো মুখ
ঝুড়ি করে চুপটি দাঁড়িয়ে, আর তোমরা সব কাঁদছো? কী অলক্ষুণে কাণ্ড বলো দিকি? এই মালতী কী হয়েছে রে?”
৫
লাজবন্তী মালতীমায়ের কাঁধে বাঁ হাত রেখে, মা যেমন সমবেদনায় মেয়ের ঘনিষ্ঠ হয় সেভাবেই, ডানহাতে মালতীমায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে, রে, কানছিস কেন?” মালতীমা লাজুক হেসে সব কথাই মনে হল বললেন, আমি শুনতে পেলাম না, কিন্তু লাজবন্তী মাঝেমাঝেই আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিলেন, তার থেকেই বুঝতে পারলাম, আমার কথার পিঠে যা সব কথা হয়েছে, সে সবই রিপোর্ট হল লাজবন্তীর কাছে। কথা শেষ হতে লাজবন্তী হেসে মালতীমাকে বললেন, “অনেক বেলা হল, দোকান তুলে বাড়ি যা। বিকেলে আবার দোকান খুলবি...যা দেরি করিস না”।
মালতীমায়ের বাড়ি যাওয়ার কথায় আমার হুঁশ হল, ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
পকেট থেকে পার্স বের করতে করতে বললাম, “আমাদের চায়ের দাম কত হল দিদি? ওই সঙ্গে
দুপ্যাকেট সিগারেট দেবেন। আর এই ছেলে মেয়েদের সকলের হাতে দুটো করে ক্যান্ডি...ইয়ে
মানে লজেন্স আর বিস্কুট দিন না। যা দাম হবে আমি দেব”।
মালতীমা বললেন, “ওদের আবার ওসবে কী দরকার? ওরা তো সব এখন যার যার ঘরে
যাবে ভাত খাবে”।
“তা খাক। এতক্ষণ ধরে ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রইল, একদম শুকনো মুখে
থাকবে? না না, আপনি দিন সব্বাইকে”।
মালতীমা প্লাস্টিকের বয়াম খুলে সকলের হাতে লজেন্স দিলেন, প্যাকেট ছিঁড়ে
বিস্কুট দিলেন। ওদের মধ্যে একটু যারা বড়ো, বিশেষ করে হাল্কা নীল আর গভীর নীলের মেঘ
মেঘ ছাপা ফ্রক পরা মেয়েটি, সে লজ্জা পাচ্ছিল। বললাম, “স্কুলে যেতিস নিশ্চয়ই? স্কুল
তো কতদিন
হয়ে গেল বন্ধ।
সারাটা দিন কী করিস? এই
বাঁধের ধারে ঘুরে বেড়াস, আর বড়ো বড়ো লোকেদের কথাবার্তা শুনিস? পুরোনো বইখাতাগুলো
আছে? সেগুলো
উলটেপালটে
দেখিস? নাকি সব ভুলে গেছিস”?
মেয়েটি এবার লজেন্স বিস্কুট নিল, বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলল, “মালতীমাসি
বলল না, বানে ঘরদোর সব ভেসে গেছিল? বই-খাতাই নাই, পড়বো কী”? “ওঃ” আমি এইটুকুই শুধু বলতে পারলাম।
তারপর মালতীমার মুখের দিকে তাকালাম। মালতীমা হিসেব করে বললেন, কত টাকা হয়েছে। আমি
টাকা মিটিয়ে দিয়ে লাজবন্তীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “চলুন দিদি, আপনাকে অনেক কষ্ট
দিলাম। নানান কথায় দেরিও হয়ে গেল অনেক”।
লাজবন্তী ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর
কোমরে হাত রেখে রীতিমতো জেরার সুরে বললেন, “আপনি নাকি গানও শুনিয়েচেন...আমার বালাইকে, মালতীকে...ঝড়ের
রাতের গান”।
একথার কী জবাব দেওয়া যায় আমার মাথায় এল না। অবিশ্যি আমার জবাবের
অপেক্ষায় লাজবন্তী যে বসে থাকবেন তাও কখনো হয়? “আমি ঘরের কাজ সেরে সবে একটু হাত খালি করে
এসেচি, একটু সুখদুখের কথা কব, ঘর-পরিবারের সমাচার জানবো...তার আগেই বালাইকে গান
অব্দি শোনানো হয়ে গেল”?
মালতীমায়ের দোকান গোছানো হয়ে গিয়েছিল, ছেলেমেয়েরা সকলে মিলে দোকানদারি
নিয়ে এগিয়ে গেল বাঁধের ঢাল বেয়ে গ্রামের দিকে। তাদের মুখে লজেন্স থাকায় সবারই
একপাশের গাল টোপলা হয়ে আছে। এই বয়সে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা কত কীই খায়, কত বায়না
আবদার...অথচ সামান্য এই লজেন্সেই এরা কত খুশি। একটি ন্যাংটাপুটো শিশু, সে চলেছে
দিদির কোলে, নিজের মুখের থেকে বের করে দিদি ভাইয়ের জিভেও দু একবার ছুঁইয়ে দিচ্ছিল,
লজেন্সের গুলিটা। ভাইকে পুরোটা দেয়নি, এক রত্তি ভাই - গলায় লাগিয়ে ফেললেই তো বিপত্তি!
ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, আর লাজবন্তীর অভিযোগের কী জবাব দেব ভাবছিলাম।
“গান কী বলছিস, লাজবন্তী? যে সে গান নয়, বাবুর যেমন গলা তেমনি ভাব”।
বালাই আবার উস্কে দিল লাজবন্তীকে, “মালতীমা ওই যে বললে, দুর্যোগের রাতেই ভগমানের
নিষ্ঠুর আসল রূপটি দেখা যায়, বাবুও অমনি নিজের মনে গান গেয়ে উঠলেন। পরাণসখা মানে
তো ভগমানই, তাই না বাবু? ঝড়ের রাতে তিনিই আসেন অভিসারে – কত দূর দূরান্ত
থেকে...তাই না?”
লাজবন্তী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বালাইকে মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “ঢের হয়েছে, এবার ঘরে চলো, নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলে চলবে?” বলেই তিনি ছেলেকে কোলে তুলে নেওয়ার মতো বালাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে, আমার দিকে ফিরে বললেন, “আসেন বাবু। আমাদের খাওয়ার যা ছিরি, জুড়িয়ে গেলে মুখে তুলবেন কী করে?”
কথা না বাড়িয়ে আমি লাজবন্তীকে অনুসরণ করলাম। বাঁধের যে বাঁকের মুখে
আমরা ছিলাম, সেদিক থেকে উত্তরের দিকে সোজা বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁধের ঢাল বেয়ে আমরা
নেমে এলাম মাটিতে। তারপর পশ্চিমের মেঠোপথ ধরে কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল পরিচ্ছন্ন
ছিমছাম একটা মন্দির, সেই মন্দির ঘিরেই কয়েকটা পলেস্তারাহীন ইঁটের ঘর – মাথায় টিনের
ছাউনি।
বালাই লাজবন্তীর ঘাড়ের পাশে মুখ তুলে বলল, “ওই ঝড়ের রাতে আমাদের এই
বসতটুকুও চলে গেছিল সাগরের ঢেউয়ের তলায়। খড়ের চাল দেওয়া মাটির ঘর ছিল। সব ধুয়ে
মুছে ভেসে একাকার। শিবের থান ওই মন্দিরটুকুই শুধু টিকে ছিল। আপনার পরাণসখা বোধ হয়
শিবঠাকুরই হবেন, তাই নিজের থানটুকু আর ভাসিয়ে দেননি”।
আমি আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সে সময় তোমরা কোথায় ছিলে? এখানেই”?
“না, না বাবু। সরকারি বাবুরা তাই থাকতে দেন, নাকি? গাঁয়ের সব লোকদের
জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, বড়ো রাস্তার ওধারের ইস্কুল বাড়িতে। প্রায় দিন দশেক
আমাদের ঠিকানা হয়েছিল ওখানেই। সেও এক আজব কাণ্ড, বাবু। গাঁয়ের যারা দালান কোঠায়
থাকা বড়ো মানুষ আবার আমাদের মতো হাভেতে হাঘরে ভিখিরির দল - সব্বাই ছিলাম একসঙ্গে।
ইস্কুলের বড়ো বড়ো ঘরগুলোতে। সবাই একই খিচুড়ি খেয়েচি, বাবু, দুবেলা করে, পাশাপাশি
মেঝেয় বসে...। আপনের
পরাণসখার এক ধাক্কায় সক্কলে একই মেঝেয় নেমে এসেছিলাম - উঁচু-নীচু, জাত-বেজাত, ধনী-নিকড়ি সব্বাই”।
টানা দাওয়ার পাশাপাশি বেশ কখানা ঘর, সে দাওয়ায় নীচু হয়ে লাজবন্তী
বালাইকে নামালেন। এতখানি রাস্তা
মানুষটাকে বয়ে আনতে তাঁর
পরিশ্রম হয়েছে বেশ, নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। একটু দম নিয়ে লাজবন্তী কোমরে হাত রেখে
বললেন, “সাবান গামছা নিয়ে
কলতলায় গিয়ে নেয়ে আসবে আগে, তারপর অন্য কথা। বাবুকেও সঙ্গে নে যাও...”
আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম, “না, না আমি চান করবো না, সকালে আমি চান
করেই বেরিয়েছি”।
লাজবন্তী বললেন, “তা হোক মুখে হাতে পায়ে একটু জল দেবেন না। নাহলে খেতে
বসবেন কী করে?”
ঠিক কথা। খাওয়া অনেক রকমের হয় – বাধ্যতামূলক ক্ষুণ্ণিবৃত্তি – স্টেসনে,
বাসস্ট্যাণ্ডে আমরা অনেকসময় খিদে মেটানোর জন্যে যত্রতত্র খাওয়া শুরু করি, শেষ করি।
কিন্তু এখানে তেমনটি চলবে না, হাত-পা মুখে চোখে জল দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে,
তারপর আসনে পরিপাটি বসে খাদ্যের মুখোমুখি হতে হবে। হোক না খুদকুঁড়ো, কিন্তু সেও তো
অন্ন। আর অন্ন দিয়ে যিনি উদরকে পূর্ণ করান, তিনিই অন্নপূর্ণা। মলিন শরীরে অন্ন
স্পর্শ করলে অন্নপূর্ণা অখুশি হবেন বৈকি!
বালাইয়ের সঙ্গে আমি কলতলায় গেলাম, এ পাড়ায় এই একটিই টিউবওয়েল, চলতি
কথায় যাকে বলে টেপাকল। বালাই কলের নীচে বসল, বলল, “বাবু কলটা ক’বার টিপেন দেখি,
রুখা শরীলটারে পেথমে জুড়িয়ে নিই”। আমি টিপলাম, বার চারেক টেপার পরেই বালাই
বলল, “আর না বাবু, এখন থাক”। কোমরে গামছা জড়িয়ে ময়লা পেন্টুলুনটা খুলে ফেলল অনেক
কসরতে। আর তখনই আমি শিউরে উঠলাম আমার ভ্রান্ত ধারণায়। শুরুর থেকেই বালাইকে দেখে
আমার মনে হয়েছিল, ও হয়তো পোলিও বা রিকেট্স্ রোগী। ওর যা বয়েস ওর শৈশবে “দো
বুঁদ”-এর এত ব্যাপক প্রচার বা প্রচলন হয়নি। কাজেই এ ধরনের মানুষের সচরাচর যেমন হয়ে
থাকে তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি ভুল
ভেবেছিলাম, দাবনার মাঝামাঝি থেকে বালাইয়ের দুটি পা-ই কাটা! ফুলপ্যান্টের বাড়তি দৈর্ঘের মোড়কে মুড়ে ও এমন ভাবে
বসে থাকে এবং পশ্চাৎ ঘষটে চলে বেড়ায় - বোঝাই যায় না, তার এই অঙ্গহানির বীভৎসতা!
বালাই তার গায়ের জামা আর প্যান্টে সাবান ঘষতে লাগল, আমি কলের মাথায় ভর
দিয়ে ডুবে গেলাম ভাবনার মধ্যে। কী করে এমন হল? ও কি কারখানায় কাজ করত, কোন চালু
মেশিনে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে? নাকি রাস্তাঘাটে গাড়ির তলায় চাপা পড়েছিল? জিজ্ঞেস করা
উচিৎ হবে কী? হয়তো ও ভুলে থাকতেই চায়, আমি আবার খুঁচিয়ে সেই দুর্ভাগ্যের কথা ওকে
মনে করিয়ে দিই কেন? কলের নীচে জামা-প্যান্ট থোবা দিয়ে কিছুক্ষণ কাচার পর, একই
সাবান সে সারা গায়ে মাখল, মুখে মাথায়, সাদা ফেনায় মুড়ে তাকে এখন ভূতের মতো
দেখাচ্ছে। সাবানের ফেনায় তার চোখও এখন বন্ধ, হাতড়ে হাতড়ে আবার সরে এল কলের মুখের নীচে।
তারপর বলল, “বাবু, ও বাবু, কলটা টেপেন দেকি”। আমার ভাবনায় আমি এতটাই ডুবেছিলাম
প্রথমে আমি বালাইয়ের ডাক শুনতেই পাইনি।
বালাই দু হাতে চোখের থেকে ফেনা সরিয়ে, চোখ কুঁচকে বলল, “কী ভাবছেন,
বাবু? ও বাবু, কলটা টেপেন না”! আমি সম্বিৎ পেয়ে কল টিপতে লাগলাম ধীরে ধীরে। প্রথমে
সে নিজে চান করল। তারপর জামাকাপড় কাচতে কাচতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার
পা দুখানির কথাই ভাবছেন, তাই না বাবু?” আশ্চর্য এই কথার মধ্যেও ওর মুখের হাসি
এতটুকু মলিন হয়নি।
জামা কাপড় কাচতে কাচতে সে বলতে লাগল, “ছোকরা বয়সে বেশ ডাকাবুকো ছিলাম,
জানেন বাবু। গা-গতরে ক্ষেমতাও ছিল খুব।
বিঘে দুয়েক জমি ছিল, নিজেই চাষবাস করতাম। অবসরে অন্য লোকের জমিতেও মুনিষের কাজ
করতাম। থা আমাদের এখানে ফি বছরই ঝড়ের তাণ্ডব কামড় মারে, সেকথা তো শুনলেন
মালতীমায়ের কাছে। আজ থেকে তা ধরুন চল্লিশ বছর আগে, আমার বয়েস তখন কত আর, আঠেরো,
উনিশ হবে। সে সময় ঝড়ের খবর আজকের দিনের মতো আগাম জানা যেত না। আর সরকারি ব্যবস্থাও
যা ছিল সে না থাকাই। ওইসব দিনে পেত্যেকবার আমরাই লড়তাম বাবু, গায়ের সব লোকজন মিলে।
ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেই ভাঙা বাঁধ মেরামত করার কাজে লাগতাম। গ্রামে জল ঢুকে পড়লে
ছেলেমেয়েদের বুড়োবুড়িদের নিয়ে কলাগাছের ভেলায় করে বড়ো রাস্তায়, ইস্কুলবাড়িতে পৌঁছে
দিতাম। তখনকার ইস্কুলবাড়িগুলোও হত ছোট ছোট কামরার একতলা বাড়ি – সকলের সংকুলান হত কই?”।
“আরেক বার টেপেন বাবু, আপনারে বেজায় কষ্ট দিচ্ছি বটে, কিন্তু বিশ্বাস
করেন এতটুকু সংকোচ হচ্ছে না আপনারে হুকুম করতে”। হাসতে হাসতে বলল বালাই। আমি আবার
কল টেপা শুরু করতে, সে আবার শুরু করল, “ঘন অন্ধকারে, ঝড়ে জলে কাদায় পাগলের মতো
ছুটোছুটি করছিলাম বাবু, গ্রামের বাড়ি বাড়ি... কেউ আটকে রইল কিনা, চেনা লোকেদের নাম
ধরে চেঁচাচ্ছি আর দৌড়ে বেড়াচ্ছি এ ঘর সে ঘর। হঠাৎ কী যে হল, আমার ওপরেই হুড়মুড় করে
ভেঙে পড়ল টিনের চালদেওয়া একটা ঘরের মাটির দেওয়াল। অন্ধকারের মধ্যেও যেটুকু ঠাহর
করতে পাচ্ছিলাম, সেও গেল ঘুঁচে”। বালাইয়ের জামা প্যান্ট কাচা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো
নিংড়ে জল ঝরিয়ে, নিজের কাঁধে রাখল, তারপর বলল, “চলেন বাবু”। আমি এতটুকু দ্বিধা না
করে, বালাইয়ের হাল্কা শীর্ণ শরীরটা লাজবন্তীর মতোই বুকে তুলে ধরলাম, বালাই বলে
উঠল, “এ কী করেন বাবু, আমার ভেজা গায়ের জলে আপনার জামা-প্যান্ট নোংরা হয়ে যাবে
যে...ছি ছি, লাজবন্তী দেখলে আমাকে খুব...”
আমি বালাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গোপন কথার মতো বললাম, “তুমি সেই
ভয়ংকর রাত্রের কথা বলো বালাই, আমরা যারা শহরে থাকি তাদেরকেও টের পেতে দাও তোমাদের
জীবন যুদ্ধের বীভৎসতা...”। আমি বালাইকে নিয়ে ফিরে চললাম ওদের বাসার দিকে।
বালাই হাসল, বলল, “পেথম দেখাতেই আমি আপনারে চিনতে ভুল করিনি বাবু, ঠিক
কিনা বলেন?” তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সে রাত্তিরের তারপরের কথা তো আমার মনে
নাই বাবু। যখন আবার চোখ মেলে তাকালাম, আমি তখন হাসপাতালে, লাজবন্তী শুকনো মুখে বসে
আছে আমার বিছানার পাশে। শুনেছি ওই দেওয়ালের তলায় চাপা পড়ে আমি নাকি সারারাত ওখানেই
ছিলাম। বেলার দিকে ঝড় বৃষ্টি থামতে একটা দল গ্রামে এসে আমার গোঙানির আওয়াজ শুনে,
আমায় বের করেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল লাজবন্তী। লাজবন্তী নাকি সারারাত পাগলের মতো
আমাকে খুঁজে বেরিয়েছিল – ইস্কুলবাড়িতে আর বড়ো রাস্তার ওপরে – যেখানে যেখানে গ্রামের লোকেরা আশ্রয়
নিয়েছিল। পরের দিন সকালে যে দলটি আমায় উদ্ধার করতে এসছিল – তারাও এসছিল ওরই
জোরাজুরিতে”।
“তোমাদের কী তখনই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
বালাই হাসল, “বিয়ে তো আমাদের কোনদিনই হয় নাই, বাবু। কে দিবে আমাদের
বিয়ে? আমি তো ছোটবেলাতেই বাপ-মা মরা। লাজবন্তীর বাবা-মা-দাদা সবই ছিল। কিন্তু
হাসপাতালে আমার থ্যাঁতলানো পা দুটো বাদ যাওয়ার পর, ওর বাপ-মা আমার সঙ্গছাড়া করতে
অনেক চেষ্টা করেছিল। আমিও অনেক বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু লাজবন্তী বড্ডো অবুঝ বাবু, ও সব্বাইকে
ছাড়ল, ছাড়ল না শুধু আমাকে...”।
এই দুই চরিত্রকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, পরিচয়ের শুরুতে আমার বাঁধা
গতের চিন্তায় যা মনে হয়েছিল, তার কিছুই মিলছে না...কী আশ্চর্য বাঁধন দুজনার।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে, এই জীবনে কী করে চলে
এলে? তোমার তো বিঘে দুয়েক জমি ছিল বললে?”
বালাই বেশ জোরে হেসে উঠল, তারপর বলল, “মানুষরে আপনি তেমন চেনেননি,
বাবু। আমার
সেরে উঠতে উঠতে সাত-আটমাস পার হয়ে গেল বাবু, ততদিনে আমার জমি আর তখন কোথায়? গ্রামের
লোকেরাই সে সব আপন করে নিয়েছে। গ্রামে ফিরতে আমাকে বললে, এ জমি নিয়ে তুই কী করবি,
চাষ করতে তো পারবিনি? জমিন নাকি মা লক্ষ্মী – অনাবাদী রাখতে নেই! আমার বা
লাজবন্তীরও সে নিয়ে বিবাদে যাওয়ার দুর্মতিও হলনি। সব হারিয়ে ভিখারিই হলাম, বাবু,
তবে ভিক্ষে করি ভগমানের নামে। ছোটবেলা থেকেই আমার যাত্রা-পালা, গানটানের দিকে ঝোঁক
ছিল, লাজবন্তীর সঙ্গে আমার ভাবও সেই কারণেই। পঞ্চায়েত থেকে গ্রামের বাইরে একখান
থাকার ঘর দিল, সেখানেই আমাদের বাসা হল, কপালে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে লাজবন্তী আমার
বউ হল। ব্যস, তারপর থেকে জীবন চলছে এ ভাবেই। এই গ্রামের মায়া ছাড়তে পারিনা, তাই
ফিরে ফিরে আসি – আর সারা বছর ঘুরে বেড়াই নানান মেলায় – জয়দেব, ঘোষপাড়া, বোলপুর,
এক্তেশ্বর, জল্পেশ...”। কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, বালাই
বলল, “লাজবন্তীর সামনে এ সব কথা তুলবেন না, বাবু। মন খারাপ করে খুব”।
“তোমার করে না?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
বালাই হেসে বলল, “নাঃ, বিশ্বাস করেন, বাবু, একটুও না। যদি দুই পা আজ
থাকত, এই গ্রামেই আমি পড়ে থাকতাম, জমিজিরেত নিয়ে পাড়াপড়শিদের সঙ্গে আকচাআকচিতেই আমার দিন কাটত। এখন
দেখেন আমার পা নাই, কিন্তু কত দেশ দেখছি, কত গ্রাম দেখছি, কত লোক দেখছি। আমার যদি
পা থাকত, আপনি আজ
আমাকে এমন করে বুকে ধরতেন বাবু, বলেন
না, বুকে তুলতেন এমন করে?”
আমি বালাইকে যখন দাওয়ায় বসিয়ে দিলাম, ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন লাজবন্তী। অবাক হয়ে আমার দুই চোখের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, কিছু বললেন না, তাঁর দুই চোখ ভরে উঠল জলে। বালাইও মিচকে হাসি মাখা চোখে তাকিয়ে রইল লাজবন্তীর দিকে – বলল, “এ বাবুকে কিছুটা কী বুঝলি, লাজবন্তী?”
৬
তেল মাখতে মাখতেই বালাই, লাজবন্তী আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে
গান ধরল,
“তুমি কে? পাগলপারা হে, বহুদিনের চিনা বলে মনে হতেছে।
বসেছিলাম বুক পেতে, পথের মাঝে আন্ধারেতে
জীবন আলো নিয়ে তুমি ধরা দিলে যে, পাগলপারা হে।
যতই মাখো ধুলাবালি, নেব তোমার কালো
কালি,
চলবে না হে ফাঁকিবাজি, ছাড়বো না আর হে।
তোমার ডালে আমি যে হায়, ঝুলে আছি পাতায় পাতায়,
রাখো কিনা রাখো ধরে তোমার কৃপায় যে, পাগলপারা হে।
তুমি কে? পাগলপারা হে, বহুদিনের চিনা বলে মনে হতেছে”।
আমি হেসে বললাম, “এ তোমার কথা তো নয়, বালাই। এ গান তোমার নয়। এ গান আমি
বহুদিন আগেই শুনেছি, আমার বড়ো প্রিয় গান”।
বালাই এখন জামা-কাপড় পরে ফিট-ফাট বাবুটি, হেসে বলল, “এ গান আমার নয় ঠিকই,
কিন্তু আমার কথা নয় এ কথাটি আপনি কেমন করে বললেন? আপনি তখন যে গানটি আমাদের শোনালেন
সে গান কী আপনি বেঁধেছিলেন? তা তো নয়, বাবু। অন্যের গানেও যে মনের কথা ফুটিয়ে তোলা
যায় – সে কথাটি আপনার না জানা নয়”।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “কথাটা সত্যি। যে গানে আমাদের মনের কথাই
স্পষ্ট শোনা যায়, সেই গানই তো আমাদের প্রাণের গান হয়ে ওঠে!”
চোখ নাচিয়ে বালাই বলল, “তবে? কিন্তু এসব গানও আপনি শুনলেন কোথায়? সব মেলাতেই দেখেছি
আপনাদের মতো শহুরে শ্রোতারা ঘুরে ফিরে “সাধের লাউ”, “গোলেমালে পিরিত কইরো না”,
কিংবা “বড়োলোকের বিটি লো”, “মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা” এই ধরনের গান গাইতে বারবার
অনুরোধ করে। আমাদের নতুন গান তেনাদের কাছে অছ্যুত”। বালাইয়ের কথা শুনেই আমার চোখের
সামনে বিভিন্ন বাউল মেলার কয়েকটা টুকরো দৃশ্য ভেসে উঠল। শুষ্ক নেশায় মত্ত শহুরে
তরুণ-তরুণীদের উদ্দাম নৃত্য – আর তার সঙ্গে গলার শির ফুলিয়ে তারকা বাউলদের গাওয়া
ওই গানগুলি। যে গানগুলির সারার্থ নিঃশেষে মুছে গিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে উৎকট চটুলতা! “আপনার বুঝি বাউলদের আখড়ায়
বা মেলায় যাওয়ারও অভিজ্ঞতা রয়েছে?”
আমি বললাম, “না, না, সে তেমন কিছু না। তবে কালকূট ছদ্মনামে এক বাউলমনা মানুষের লেখা বই আমার খুব
প্রিয়। তাঁর লেখা
“অমৃত কুম্ভের
সন্ধানে” বইতে এই গান পড়েছিলাম। ওই বই নিয়ে পরে একটা সিনেমা হয়েছিল, তাতে বিখ্যাত
শিল্পী অমর পাল গানটি গেয়েছিলেন। সেই ছোকরা বয়সেই গানটি আমার মনকে বড়ো নাড়া দিয়েছিল।
তাই আজও মনে আছে…”।
আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই আসন এনে লাজবন্তী দাওয়ায় পেতে দিলেন, বললেন,
“এখানে বসেন বাবু, বেলা পড়ে এল প্রায়...খুদকুঁড়ো দুটো মুখে দিন”। তার গলা এখনও
ভারি, কান্নাভেজা। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না, মৃদু হেসে আসনে
বসলাম। আমার সামনে বালাই বসে বসে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, “ঘরে বসে শুধু বই পড়ে
মনটারে এমন বাউলো করলেন কী পেকারে বলেন তো? তখন যে পরাণসখার গানটি গাইলেন, সেটি
গানটি কার, বাবু?”
“রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।
“সেই শান্তিনিকেতনের কবি, নয়? যাঁর নোবেল চুরি গেছে অনেকদিন হল”! আমি
ঘাড় নাড়লাম। বালাই আবারও বলল, “শুনেছি তিনি সব বাউলের পরমবাউল। তিনি নাকি এক্কেরে
জনক রাজার মতো। সংসারধর্ম পালন করেছেন
রাজার মতো, কিন্তু মনটারে তুলে রেখেছিলেন জগদীশ্বরের আড়ায়। জেবনে তিনি যতো
দুঃখশোকে জেরবার হয়েছেন, ততোই বেড়েছে তাঁর ভগমানে পেত্যয়...!”
বালাইয়ের মুখে রবীন্দ্রনাথের এমন নিখুঁত মূল্যায়ন শুনে অবাক হলাম।
বাংলা ভাষায় সাম্মানিক নিয়ে উত্তীর্ণ বহু মানুষের মধ্যে এমন উপলব্ধি কোনদিন নজরে
আসেনি। আমি বালাইয়ের দিকে নতুন চোখে তাকিয়ে রইলাম। আর এরই মধ্যে লাজবন্তী দু হাতে থালা
নিয়ে বাইরে এলেন, প্লাস্টিকের থালায় চূড়ো করা ভাত – একপাশে কুঁদুরি ভাজা। আমার সামনে
প্রথমে তারপর বালাইয়ের সামনে থালা রাখলেন। ভাতের পরিমাণ দেখে আমি বললাম, “ভাত যে একটু
কমাতে হবে, দিদি? এত ভাত খেতে পারব না, তুলে নিন, লাগলে পরে আবার না হয় চেয়ে নেব”।
ভাতের থালা বেড়ে দিয়ে লাজবন্তী ভেতরে গিয়েছিলেন, ডাল আর চুনোমাছের ঝাল আনতে।
ওই সঙ্গে একটা শূণ্য
থালাও আনলেন
সঙ্গে। আমার থালার সামনে রেখে বললেন, “জোর করবো না, আপনার মুখে এই ভাত রুচবে কি না
জানিনা, তবে যতটা পারেন…”।
দুমুঠো ভাত খালি প্লেটে তুলে রেখে হেসে বললাম, “ওই রুচির কথাটি মনেও স্থান
দেবেন না, দিদি। এই বাংলার অনেক গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি, ঘুরে বেড়িয়েছি কেরালা থেকে হিমাচল,
গুজরাট থেকে শিলচর। নানান জায়গার বিবিধ ভাতের সন্ধান আমি পেয়েছি। কোনদিন কোথাও রুচিতে
বাধেনি, সে ধনী বাড়ির সেরা বিরিয়ানিই হোক, অথবা অকিঞ্চনের পেঁয়াজ-পান্তাভাতই হোক”।
ভাতের মাঝখানে গাব্বু বানিয়ে বললাম, “এইখানে ডাল দিন দেখি, ভাত কটা মাখি”।
বালাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল, ডাল দিয়ে ভাত মেখে কুঁদুরি ভাজা দিয়ে আমি গ্রাস তুলতে সে হাসল, সেও গ্রাস তুলল মুখে। একটু শক্ত মোটা মোটা ভাতের দানা - এই চালের ভাতে আমি অভ্যস্ত নই ঠিকই। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষরা এই চালের ভাতেই তৃপ্তি পান, তাঁরা বলেন এই ভাত পেটে অনেকক্ষণ থাকে – খিদের দীর্ঘ উপশম। ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতেও দেখেছি, ক্ষেতে কাজ করা মুনিষদের জন্যে শক্ত চালের ভাত রান্না হত। বড়ো কানা উঁচু বেলুঞ্চিতে বেড়ে দেওয়া ভাতের চূড়ো, বার তিনেক শেষ করে তাঁরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন। কিন্তু বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে সবার জন্যে সরু চালের ভাত হলে, তাঁরা বড়ো মনঃক্ষুণ্ণ হতেন, বলতেন, “এ ভাতে কী আর পেট ভরে, ছোড়দাঠাকুর? এ য্যানো ঢ্যামনা সাপকে ফড়িং গেলানো – তার যে গোদা কোলাব্যাঙের পেয়োজন”!
কুঁদুরি কোনদিনই আমার প্রিয় সবজি নয়, ডালটাও খেয়ে মনে হল পাঁচমিশালি ডাল
– মুগ, মুশুর, ছোলা…। তবু গরম ভাতের সঙ্গে সবকিছুই শেষ করে দেওয়া গেল সহজেই। শুকনো
ভাত ভেঙে হাসতে হাসতে বললাম, “এবার আপনার চুনো মাছের সর্ষে ঝালটা দিন দেখি, বালাই বলছিল
অমেত্ত, অমন তার অন্য কোথাও আর পাবো না”!
এবার লাজবন্তী সত্যিই লজ্জা পেলেন, আমার পাতে চুনোমাছের ঝাল তুলতে তুলতে
বললেন, “ওর কথা ছাড়েন দিকি, ওর যতো ভালাই ভুলোনো কথা। অন্যের মুখে ঝাল খেয়ে লাভ কী, নিজেই খেয়ে দেখেন না।
আরেক মুঠো ভাত দিই, আদ্দেক ভাত তো তুলেই দিয়েছিলেন”। চারটি ভাত আরও নিলাম।
সর্ষের ঝোল দিয়ে মেখে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতেই মুখের মধ্যে যেন আগুন ছুটল।
এতই ঝাল।
অন্যের মুখে ঝাল না খাওয়ার প্রবাদ যে এমন হাতে হাতে ফলে যাবে, কে জানত? নিজের রুচির কথা গর্ব করে
একটু আগেই খুব ঢাক পিটিয়েছি, এখন
সেই ঢাক আক্ষরিক অর্থেই পৌঁছোলো চুলোর দুয়োরে। অতিরিক্ত ঝাল আমার সহ্য হয় না। যদিচ
ঝালের সম্মুখীন হয়েছি বহুবার - এই বাংলায়, ঊড়িষ্যায়, আসামে, তেলেঙ্গানায় এবং বাঙালের
শুঁটকিতেও! আমার মুখের অবস্থা এবং খাদ্যে অনাগ্রহ দেখে লাজবন্তী এবং বালাই আমার অস্বস্তি কিছুটা আন্দাজ করে নিল।
লাজবন্তী আন্তরিক সংকোচে বললেন, “আপনি বুঝি ঝাল খান না? এঃ রাম, দেখেন দিকি - বাকি ভাতকটা
মুখে তুলবেন কী পোকারে”?
আমি আগুন ঝরা ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললাম, “কই তেমন কিছু নয় তো। এট্টু ডাল দেন দেখি”। তারপর ডাল মেখে অতি দ্রুত গলাধঃকরণ করলাম “অমেত্ত”-সম চুনোমাছের ঝাল! খাওয়া শেষ হতে লাজবন্তী বালতিতে রাখা প্লাস্টিকের মগে তুলে হাত ধোবার জল দিল। বেশ কয়েকবার কুলকুচি করে মুখের উত্তাপ অনেকটাই কমল, ধাতস্থ হলাম মুখ হাত মুছে একটা সিগারেট ধরিয়ে। বালাই তখনো খাচ্ছিল, বড়ো তৃপ্তি করে, আর আমার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে বারবার দেখছিল।
সিগারেট ধরিয়ে আমি লাজবন্তীকে বললাম, “আপনার অতিথি সেবা তো হয়েই গেল দিদি,
এবার আপনিও বসে পড়ুন, বাইরের লোক বলে লজ্জা করবেন না। বেলা কিন্তু সত্যিই থেমে নেই”।
বালাইও আমার কথার সমর্থন করল, বলল, “সত্যিই বাবুর কাছে আবার লজ্জা কিসের? তুইও এখানেই
বসে যা, খেতে খেতে গল্প-সল্প করাও যাবে”।
আমার এঁটো প্লেট সরিয়ে লাজবন্তী দাওয়ার একধারে রাখল, তারপর নিজের
প্লেটে ভাত ডাল তরকারি সাজিয়ে এনে খেতে বসল, ঘরের দরজা ছেড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে।
খাওয়া শুরু করার আগে বলল, “ঘরে মুখশুদ্দি কিছু নেই, বাবু, জানি না খাওয়ার পর মুখে
কিছু দেন কিনা”। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দেখিয়ে বললাম, “এই আমার মুখশুদ্ধি, দিদি, ও
নিয়ে চিন্তা করবেন না”।
কোন কথা না বলে ওরা দুজনেই খেতে লাগল, আমিও শেষ করলাম আমার সিগারেটটা।
তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা বালাই, তখন ঝড়ঝঞ্ঝার কথা বলতে মালতীমা অতটা ভেঙে
পড়লেন কেন? তোমাদের কাছে এ ধরনের ঘটনা তো কিছুটা গা-সওয়া বাৎসরিক দুর্দৈব...”।
বালাই কিছু বলার আগেই লাজবন্তী বললেন, “মালতীর বুকে যে কতো বড়ো পাথর চাপা দেওয়া আছে,
সেটা তো আপনের জানার কথা নয়, বাবু। দেকতে দেকতে বারো বছর পার হয়ে গেল, সেই যে ভয়ংকর ঝড়টা এসেছিল,
নাম ছিল আয়লা[1]!
আপনারা শহরের বাবুরা সে সব ঝড়ের আবার আদর করে কেমন সব নাম দেন, আয়লা, বুলবুল, ইয়াস,
আম্পান…! বড্ডো ক্ষতি হয়েছিল সেবারে আমাদের এদিকে। গ্রাম কে গ্রাম ভাসিয়ে ভেঙে চুরে
একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু”।
কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন, “সেবার অবিশ্যি
আমরা এখানে ছিলাম না, আউসগ্রামে রামনবমীর মেলা সেরে আমরা দল বেঁধে
ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বর্ধমান আর বীরভূমের ওদিকে। তার মধ্যেই জষ্টিমাসের শুরুর দিকে
আয়লা আছড়ে পড়েছিল। এদিকের সমাচার দেখেশুনে আমরা একটু দেরি করেই আষাঢ়ের মাঝামাঝি
ফিরলাম। ফিরে এসে গ্রামের মানুষজনের মুখে যা শুনলাম, নিজেরাও ধ্বংসের যে সব
লক্ষণ দেখলাম – সে আর আপনের শুনে কাজ নেই।
ঝড়ের আগে ওই মালতীর ছিল উথলে ওঠা সংসার, আর মালতীর বর ছিল
লক্কিমন্ত করিতকর্মা মানুষ। ধনসম্পদ যা
কিছু করেছিলেন গতরে খেটে – লোক ঠকিয়ে, বজ্জাতি
করে নয়। আমরা ফিরে এসে দেখলাম, মালতীদের দোতলা বাড়ির কংকালসার চেহারা – যদিও মিস্ত্রি
লেগে সারাইয়ের কাজ চলছে। ওর ছেলেমেয়েদের মুখে শুনলাম – ঝড়ে ওদের ঘর দোরের ক্ষেতি হয়েছিল
বেজায়। ওদের গোয়াল ঘর ধ্বসে সাফ হয়ে গিয়েছিল বিলকুল। চারটে গাই, তিনটে বাছুরের খোঁজ
পাওয়া যায়নি – ওদের মধ্যে একটা গাই ছিল পোয়াতি। জল সরে যেতে ক্ষেতের জমিতে বালি পড়েছিল
প্রায় আধহাত! এসব দেখে মালতীর বর কেমন যেন নিঃসাড় হয়ে গেছিল, জানেন বাবু? মুখে কোন
কথা নেই, দু চোখের দৃষ্টিও কেমন বেবাক। মালতী
তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সব যখন গুছিয়ে তোলার উদ্যোগ কচ্ছে, মালতীর বরের কোন
হ্যাঁৎক্যাঁৎ নেই - বেভুল মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াত এদিক সেদিক। নাওয়া খাওয়ার সময় তাকে
ধরে আনতে হত সাগরের পাড় থেকে কিংবা বালিচাপা মাঠ থেকে…”। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লাজবন্তী,
মাথা নীচু করে কথা শুনছিল বালাই, সেও গভীর শ্বাস ছেড়ে আকাশপানে
তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজতে লাগল।
“দিন দশেক পর, মানুষটাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না কোথাও, জানেন
বাবু!”
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, “সে কী? কোথায় গেলেন?”
“আজও জানা যায়নি, বাবু, মালতীর বর কোথায় গেল। মারা গেছে না
বেঁচে আছে সে কথাও জানা যায়নি আজ পর্যন্ত”। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, মালতীমায়ের
চেহারা - কপালে, সিঁথিতে উজ্জ্বল সিঁদুরের এয়োতি-লক্ষণ। দু হাতে তাঁর শাঁখা, পলা, সোনা
বাঁধানো নোয়া। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু ওঁনাকে দেখে তো বোঝার জো নেই…”।
লাজবন্তী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেন, বাবু? বেহদিশ মানুষের জন্যে বারো বছর অপেক্ষা করার বিধেন নাকি হিন্দু শাস্ত্রে
আছে?” কথাটা শুনেছি আগে, আমি বললাম, “ও হ্যাঁ, শুনেছি বটে, অমন বিধান দেওয়া আছে আমাদের
শাস্ত্রে”।
“ছমাসের ওপর হল, বারো বছর পার হয়ে গেছে, বাবু। কিন্তু মালতীকে
কে মনে করাবে সে কথা? দরকারই বা কী মনে করানোর। এই বারো বছরে ওর ছেলেমেয়েদের বে হয়ে
গেছে, ছেলে-মেয়েদের ঘরে ওর নাতি নাতনিও এসে গেছে – জীবন তো থেমে থাকে না বাবু। মালতীর
জীবনটাই শুধু থমকে থাকে তো থাক না – সেই বারো বছর আগেকার দিনে, তাতে কার কী ক্ষতি?”
আমিও মাথা নীচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে
আরেকবার মনে করলাম মালতীমায়ের মুখ, আমার কথার উত্তরে তাঁর তীব্র শোকের সেই হাহাকার
করা কথাগুলোও আমার কাছে নতুন মাত্রা এনে দিল। মালতীমায়ের আবেগের প্রতি আমি মনে মনে
মাথা নত করে রইলাম। বাইরে থেকে একদিনের জন্যে বেড়াতে এসে, কিছুই না জেনে তাঁর ব্যথার
ক্ষতে আমিই তো খোঁচা দিয়েছিলাম!
লাজবন্তীর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, সকড়ি নিকিয়ে, এঁটো থালা বাসন
আর বালতি নিয়ে সে চলে গেল কলতলার দিকে। আমি বালাইকে একটা সিগারেট দিলাম, নিজেও নিলাম
একটা। সিগারেট ধরিয়ে বললাম, “ব্যাপ্ত এই দেশের বহু জায়গাতেই আমি গিয়েছি এবং থেকেছি,
বালাই। তাদের নিবিড় জীবনযাত্রার বহু ছবিও এঁকে রেখেছি আমার মনে। কিন্তু এমন গোত্রহীন
জায়গায় এসে এমন যাপন চিত্র দেখতে পাবো, কল্পনাও করিনি। আর কথা বলার আগেই মনের সুর টের
পেয়ে যাওয়া তোমার মতো গাইডও পাইনি কোথাও। এখানে
হয়তো আর আসব না কোনদিন – তোমাদের সঙ্গেও অন্য কোথাও আবার দেখা হওয়াও প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু তোমাদের কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না, বালাই।”।
“আবার দেখা হবে না কেন, বাবু? আমার সঙ্গে নাই হোক, আপনের
যা স্বভাব তাতে আমার মতো বালাইয়ের অভাব কোনদিন ঘটবে না। কিন্তু ওই কথাটা ঠিক বুঝলাম
না বাবু, ওই যে বললেন গাইড কথাটা…” বালাইয়ের চোখে আবার সেই মিচকে হাসি, “আমাকে গাই-বলদের
দলে ঠেলে দিলেন নাকি, বাবু?”
আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “কথাটা গাইড, যারা বেড়াতে যাওয়া
লোকেদের, নতুন জায়গার সব চিনিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়…”।
“গাইড, বাঃ বেশ কথাটি। ইংরিজি শব্দ না বাবু? অচেনা এক মানুষ
যে অচেনাকে চিনিয়ে দেয়… তাই না, বাবু?” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম বালাইয়ের দিকে, গাইড
শব্দের এমন অর্থবহ তাৎপর্য কোনদিন ভাবিনি তো! বালাই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে গেয়ে উঠল,
“চিনি না যেই অচিন জনে, ও সেই সাথী হল আমার সনে
আমার মনের খপর পড়ল ধরা তাহারও মনে, সেই অচিন
জনে।
আঁধার মনে জ্বেলে আলো, জেবনের পথ দেখালো।
অনেক কথাই হল কওয়া, কিছু রইল গোপনে, সেই অচিন
জনে।
ঘুরতে ছিলেম আপন মনে, মাঠে ঘাটে
সাগর বনে।
দেখতেছিলেম রূপের ডালি ভরে
মোর দুই নয়ানে।
তুমি এসে ধইরলে যে কর, ভুলিয়ে দিলে আপন-পর
বসত তোমার রইবে জেনো মনের গহনে, সেই অচিন জনে”।
মুখে মুখে বালাইয়ের এই গান বেঁধে ফেলার প্রতিভায় আমি আবার
মুগ্ধ হলাম। আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম বালাইয়ের গানের কথাগুলো। গানের মাঝখানে লাজবন্তী
কাজ সেরে ফিরে এসেছিলেন। তিনিও এসে বসলেন দাওয়ায়। তাঁর মুখ দেখে বুঝলাম, বালাইয়ের গানে
তিনিও বেশ বিচলিত। আমি এবার দাওয়া থেকে মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে বললাম, “বালাই, এবার আমাকে
বিদায় দাও ভাই। দিদি, এবার তবে আমি আসি?”
আমার কথা শুনেই লাজবন্তী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন, কোমরে হাত
রেখে রুদ্রমূর্তিতে বলে উঠলেন, “তার মানে? আপনে বালাইকে গান শুনিয়েছেন, আমাকে গান না
শুনিয়ে এক পা এগোন দেখি?”
আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “আমি তো বালাইয়ের মতো গান বাঁধতে
পারিনা, আর অমন গাইতেও শিখিনি, আমার আবার গান…”।
বালাই চোখ টিপে বলল, “কলকাতার যাওয়ার ট্রেন সেই রাত নটা অব্দি
আছে, বাবু। কোন চিন্তা না করে গুছিয়ে বসেন, দু-একখান গান শোনান। থা নইলে লাজবন্তী আমাকেও
আস্তো রাখবে না…”।
অগত্যা আবার দাওয়ায় উঠে বসলাম। লাজবন্তীও ফিক করে হেসে আবার বসলেন - ঠিক যেন ছোট্ট মেয়েটির মতো, বললেন, “লক্ষি ছেলের মতো বসেন আর গান শোনান”।
৭
আমি দাওয়াতে বসতে – লাজবন্তী আর বালাই আমার মুখের দিকে উৎসুক আগ্রহে এমন তাকিয়ে রইল, মনে হল আমি যেন কোন সঙ্গীত শিল্পী, গলা খুললেই ঝরে পড়বে সুরের মূর্ছনা!
একটু সময় নিলাম মনটাকে স্থির করতে, তারপর বললাম, “এই গানটি আমার খুবই প্রিয়, রবি ঠাকুরের গান – বলা চলে আমার অন্তরের গান। আমি তো গাইয়ে নই, মুগ্ধ শ্রোতা মাত্র। কাজেই ঠিকঠাক সুরে তালে গাইতে না পারলেও ক্ষতি নেই, আশা করি আমার মনের ভাবটুকু বুঝে রবি ঠাকুর আমাকে ক্ষমা করবেন, ক্ষমা করবে তোমরাও”।
তারপর একটু ধীর লয়ে শুরু করলাম,
“অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া,
সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া।।
দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,
বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা।
কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,
সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া।। সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া...
হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে
রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে।
সেই-যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন
দিনের খণ্ড আলোর মালা
সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা -
এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,
একতারাতে আধখানা গান গাওয়া।। সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া...”।
চোখ বন্ধ করে গাইছিলাম, গান শেষ হতে চোখ মেলে তাকালাম লাজবন্তী আর বালাইয়ের মুখের দিকে। দুজনের চোখেই অশ্রুর বন্যা। বালাই তো মাথা নীচু করে রীতিমতো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আজ সকাল থেকে আমি আর বালাই একই সঙ্গে সারাক্ষণ রয়েছি, স্বভাবতঃ হাসিমুখ বালাই এতটা ভেঙে পড়বে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের এই গানটি প্রেম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং শততম গান। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুললিত কণ্ঠে বহুবার শুনেও আমার মন কখনই কারো প্রতি প্রেমে ব্যাকুল হয়নি। বরং সর্বদাই আকুল হয়েছি অপার্থিব এক স্বর্গীয় অনুভবের আবেশে। আমি কোন কথা না বলে, আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ।
কতক্ষণ পরে বালাই মুখ তুলে বলল, “এমন গান যিনি রচনা করতে পারেন, তাঁর অন্তরে যাঁর অধিষ্ঠান তাঁর প্রকাশটুকু বুঝতে আর বাকি থাকে না, বাবু, তাই না?” একটু থেমে
গভীর শ্বাস নিয়ে আবার বলল, “সারা জীবনে তাঁর কতো সহস্র কৃপা-কণা প্রতি পলে আমাদের ওপর ঝরে পড়ে বাবু, তার কতটুকুই বা টের পাই। প্রায় সবটুকুই অবহেলায় আমরা হারিয়ে ফেলি”। বিগলিত
চোখ-নাক মুছে একটু
বিরতি দিয়ে বালাই
আবার বলল, “ধুলোয় ঝরে পড়া, সামান্য যেটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি, তাই দিয়েও এতদিন কোন মালা তো গাঁথতে পারিনি, বাবু! সেই সামান্য মালাটুকু সম্বল
করতে পারলেও তো আমরা তাঁর দুয়ারে পৌঁছে
যেতে পারতাম, তাই না, বাবু”? এই বলে
সে গান ধরল গভীর আবেগে,
“মতামতের
কট্কেনাতে, ভ্রমি ভ্রমের সাধনাতে,
তোমার মিলনপথের সন্ধানেতে, সব যে গোঁজামিল। সে হায় গোড়ায় গরমিল।
ভাবের ঘরে আপনি বসে, জপি মালা হিসেব কষে,
ভুলেই গেলাম ব্যাপ্ত তুমি এ বিশ্ব নিখিল, সে হায় গোড়ায় গরমিল...
জ্বলেনি দীপ আমার মনে, আঁধার ঘরের অন্ধ কোণে,
তবু তোমার মিলবে পরশ, ভাবতেছিলাম ক্ষণে ক্ষণে।
আনলে টেনে বাহির পানে, গাইলে কী সুর কানে কানে।
তোমার কনক-প্রভা-কণায় দেখি জগৎ করতেছে ঝিলমিল,
এবার বুঝি হবেই হবে তোমায় আমার মিল, মিটবে সকল গোঁজামিল...”।
ঝটিতি এমন গান শুনিয়ে বালাই আমাকে আবার অবাক করে দিল। মুগ্ধ চোখে আমি
তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। কিন্তু বালাইয়ের কোন হেলদোল নেই, আগের কথার জের টেনে
সে বলল, “বড়ো
ভীষণ গান শোনালেন বাবু। আমাদের হাজার কথার সার ওই গানের কয়টি পদেই বাঁধা হয়ে আছে। বদ্ধ ঘরের কবাট ভেঙে,
পেলাম ঝোড়ো মুক্তির
বাতাস। তবু এই দুঃখ আমার চিরটাকাল রইবে, বাবু, সারা জীবনে আমার একতারাতে আধখানা গানও যে, তাঁর উদ্দেশ্যে গেয়ে ওঠা হল না…”।
কথাগুলো
বলার পরেই বালাই আবার ফুঁপিয়ে উঠল
নতুন করে, আমি কোন কথা বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, আমরা শহুরে বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে মনে করি
আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তাঁকে ভাঙিয়ে, তাঁকে ভেঙে-চুরে আমরা কত না বৈদগ্ধ্য ফলাই! অথচ
নিষ্ঠুর ভাগ্যের হাতে আহত, অনপড় এই মানুষটা কত অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারল রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির কাছাকাছি!
শিক্ষার প্রয়োজন সর্বস্তরে, কিন্তু তার থেকেও প্রয়োজন সে শিক্ষাকে অনুভবের। কিন্তু আমাদের কাছে
শিক্ষা শুধু পরীক্ষা পাস এবং চাকরি লাভের অনুপান মাত্র। যে অনুভবে আমাদের তথাকথিত অশিক্ষিতা ঠাকুমা-দিদিমারা
মহাভারত,
রামায়ণ অথবা পৌরাণিক কথকতা শুনে অনায়াসে বুঝে ফেলতেন ভারতীয় মননের সারাৎসার, বালাই
তার ধমনীতে সেই ট্রাডিশনই বহন করে চলেছে! কিন্তু আমরা নিজেদের হাতে উপড়ে ফেলছি
আমাদেরই শিকড়!
দাওয়া থেকে মাটিতে নেমে আমি বালাইয়ের কাছে গেলাম। তার কাঁধে হাত রেখে
বললাম, “এবার আমায় বিদায় দাও, বন্ধু। এই মূহুর্তে আমাদের মনে যে আনন্দের আবেশ
রয়েছে, সাংসারিক কথায় তার রেশ যাবে কেটে। আমাদের বিদায়ের সুরটি এমন তারেই বাঁধা
থাক। সে সুর অন্তরে বাজবে, যখনই মনে পড়বে বিশেষ এই দিনটির কথা”।
বালাই আমার হাত দুটো ধরে বলল, “তবে তাই হোক, বাবু, তাই হোক”।
লাজবন্তী আঁচলে চোখ মুছে, বললেন, “যাবেন বাবু? তা যেতে তো হবেই। কিন্তু
আপনারে ছাড়তে যে মন চায় না”। তারপর ভিক্ষে চাওয়ার মতো করুণ আগ্রহে বললেন, “আপনার
ফোনের নম্বরটা লিখে দেন না, বাবু। আমাদের আবার তো দেখা হতে পারে। এখানে না হোক,
অন্য কোথাও। আপনাকে খপর দেবো, অবসর করে যদি আসতে পারেন... সে কিন্তু বেশ হবে”।
বালাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও উৎসুক চোখে আমার মুখের দিকেই
তাকিয়ে আছে। আমার জামার পকেটে কাগজ বলতে ছিল আসার সময়ে কাটা ট্রেনের টিকিটটা। আমার
নাম আর ফোন নম্বর লিখে, সেটা লাজবন্তীর হাতে দিলাম। লাজবন্তী সেটি হাতে নিয়ে যত্ন
করে আঁচলে বাঁধলেন। আমি এবার পার্স থেকে পাঁচটা একশ টাকার নোট বের করে বালাইয়ের
সামনে ধরে বললাম, “বালাই, তোমাকে এ আমার সামান্য দক্ষিণা...”
লাজবন্তী দুচোখ ঝলসে রাগে ফোঁস করে উঠলেন, “আপনি আমাদের এত ছোট করে
ধুলোয় মেশাতে পারলেন, বাবু? গান গেয়ে আমরা ভিখ মেগে খাই, একথা সত্যি। কিন্তু
আপনারে আমরা বড়ো আপনার ভেবেছিলাম। এক থাল ভাতের দাম দিচ্ছেন বুঝি? কিন্তু তার দাম
তো অত হতে পারে না!”
আমি কিছু বললাম না, চুপ করে লাজবন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর
রাগটা থিতিয়ে যেতে ধৈর্য ধরলাম। বালাইও আহত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
আমি কিছুক্ষণ পরে বললাম, “পথে ঘাটে ভিক্ষে যাকে দিই, তাকে বুঝি আমার নাম ঠিকানা
দিই, দিদি? দিই না তো! তাদেরও কেউ কোনদিন চায় না! সেখানে দাতা কিংবা দানগ্রহীতা কেউই কাউকে
মনে রাখার দায় তো
বহন করে না”।
ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে আবার বললাম, “মানছি টাকাপয়সা অনেক সম্পর্ককেই ছোট করে দেয়।
কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তেমন ঠুনকো সম্পর্ক তো করিনি। সারাদিনে যাদের হাত ধরে এই
বয়সে আমি জীবনের নতুন পাঠ পেলাম, তার দক্ষিণা না দিলে আমার শিক্ষা যে অপূর্ণ
থাকবে, দিদি। এ কটা টাকা মনে করুন না, আমার আন্তরিক উপহার”। আমি মাথা নীচু করে
নিজের আবেগকে একটু সংযত হতে সময় দিয়ে আবার বললাম, “আমাদের সমাজে কতশত নির্লজ্জ ধনী
দেখেছি, যাদের অভাব কোনদিনই ঘোঁচে না। তারা সকলেই ভিখারি, তারা প্রত্যেকেই দস্যু।
আপনাদের অনুভবে যে ঐশ্বর্য রয়েছে, সেখানে কোন অভাবের ছায়াটুকুও থাকতে পারে না। আমি
আপনাদের অভাব ঘোঁচানোর চেষ্টা মাত্র করছি না”।
শেষ কথাটা বলতে আমার গলা কেঁপে উঠল আবেগে।
বালাই হাত বাড়িয়ে আমার হাতদুটো ধরল, তারপর একটা মাত্র নোট নিয়ে বলল,
“একটা টাকা আরো দেবেন বাবু?” আমি কথা বাড়ালাম না। চারটে নোট পার্সে ঢুকিয়ে, এক
টাকার একটা কয়েন তুলে দিলাম বালাইয়ের হাতে। বালাই টাকা আর কয়েন মাথায় ঠেকিয়ে বলল,
“আপনার উপহার ফিরিয়ে আপনাকে বিমুখ করবো না, বাবু”। লাজবন্তীকে টাকাটা দিতে –
লাজবন্তী এটাও আঁচলে বেঁধে রাখল। বালাই আবার বলল, “চলেন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি”।
এবার আমার রাগার পালা, বললাম, “পাগলামি করো না, বালাই। বাঁধের পথ চিনে
আমি ঠিক চলে যাবো। তুমি অকারণ ব্যস্ত হয়ো না”।
লাজবন্তী বললেন, “তার চে আপনি রিকশতে চলে যান না। গ্রামের ভেতর সিয়ে
সিমেণ্ট বাঁধানো পাকা রাস্তা। দাঁড়ান,
এস্ট্যাণ্ড থেকে আমি একটা রিকশ ধরে আনি”। বালাইও সে কথার সমর্থনে বলল, “সেই ভালো,
চট করে এস্টেসনে পৌঁছেও যাবেন”।
লাজবন্তীর প্রস্তাব আমার ভালই লাগল। দিনের শেষ প্রহরে বাঁধের পথে সমস্ত
রাস্তাটা হেঁটে পার হওয়ার থেকে রিকশ করে স্টেসন পৌঁছানো অনেকটাই আরামদায়ক। আমি বললাম, “রিকশ আপনাকে ডেকে আনতে হবে কেন? আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে, ওখান থেকেই বেরিয়ে যাবো
রিকশ ঠিক করে?”
লাজবন্তী বললেন, “যতটা পারেন থাকুন না, বালাইয়ের সঙ্গে। এত বছর আমি
বালাইয়ের ঘর করছি, আমার
সঙ্গেও বালাইয়ের এমন মনের মিল গড়ে ওঠেনি, বাবু”। লাজবন্তী হাসলেন, কিন্তু সে হাসিতে সামান্য হলেও
কী বিষাদের ছোঁয়া দেখতে পেলাম? নাকি সেটা আমার দেখার ভুল?
আমি মৃদু হেসে বললাম, “ওটা আপনার ভালোবাসারই লক্ষণ, দিদি। যে ভালোবাসায় আপনি
সারাজীবন ওকে বুকে করে আগলে রেখেছেন, তার থেকে এতটুকু অধিকারও আপনি খোয়াতে চান না। আমাকে অতি
নিরাপদ উপলক্ষ জেনেও!”
লাজবন্তী চমকে উঠল আমার কথায়, একবার বালাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা দুজনেই একই রকম।
নির্মম ছলে যেমন পথের ধুলো থেকে বুকে তুলে নিতে পারেন। মধুর হাসিমুখে তেমনই হেলায়
ফেলেও যেতে পারেন পথের ধুলোয়”। আমার চোখে চোখ রেখে তীব্র কটাক্ষ হেনে আবার বললেন, “আমি রিকশ নিয়ে এখনই আসছি, মোহনকালা”।
বালাইয়ের চোখে এখন আগের মতোই মিচকে হাসি, বলল, “লাজের কথায় রাগ করলেন নাকি, বাবু। তবে নামটা দিয়েছে
মোক্ষম, মোহনকালা। বেশ নাম”।
তারপর গুনগুন সুরে গাইল,
“বাঁশী হাতে মোহন কালা, ও রাই, ওরাই যে তোর কণ্ঠ মালা,
নয়ন মণিরে নয়নে হারিয়ে, ও সই, সইতে হবে যে দহন জ্বালা”।
আমি হেসে ফেললাম, কিন্তু কিছু বললাম না। বলার কিছু ছিলও না। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম, ভাবের রাজ্যে বাস করা অদ্ভূত এই দুই চরিত্রের কথা – অভাব ওদের স্বভাবে কোন দাগ ফেলেনি। ওদের মনবসনে জীবনের কোন দুঃখ-শোকের কালিই ধোপে টেকেনি। কোন ভক্তির আবেশে ওরা এমন নির্দ্বন্দ্ব থাকতে পারলো – চারিদিকে আজকের এই নগ্ন-নির্লজ্জ জীবন যাত্রার মধ্যেও? শ্রদ্ধায় মাথা নত করে বসে রইলাম চুপচাপ।
ঝরঝর শব্দে একটা রিকশা এসে ঢুকল সামনের প্রাঙ্গণে। দুর্বিনীত স্বরে রিকশওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, “ওই মেয়েছেলেটা আমাকে পাঠাল। কে যাবেন এস্টেসনে?”
এতক্ষণ যে আনন্দ অনুভবে মজে ছিলাম, ‘মেয়েছেলে’ কথাটা আমাকে টেনে
নামাল চরম বিরক্তিতে। লাজবন্তীই নিশ্চয়ই সেই ‘মেয়েছেলে’! ‘ছেলেমেয়ে’ এবং ‘মেয়েছেলে’
– এই শব্দদুটিতে গুণগত তফাৎ থাকার কথা নয়। কিন্তু ভয়ানক তফাৎটা আছে অর্থের দিক
থেকে। “আপনার কটি ছেলেমেয়ে?” বা “আপনার ছেলেমেয়েরা কী করে?” একথা আমরা পরিচিত জনকে জিজ্ঞাসা
করলে, সন্তানগর্বে সকলেই উত্তর
দিতে দেরি করেন না। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করি, “আপনার কটি মেয়েছেলে?” বা “আপনার মেয়েছেলেরা
কী করে?”, সে ক্ষেত্রে
প্রশ্নকর্তার প্রাণ সংশয় ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়!
তবে এই গ্রাম্য পরিবেশে, রিকশওয়ালার জিজ্ঞাসায়, ‘মেয়েছেলে’ কথাটা যদি
‘ব্যাটাছেলে’-র বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে স্বাভাবিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমার অতটা
বিরক্ত না হলেও হয়তো চলতে পারে। তবু মনে খটকা একটা রয়েই গেল। আমি উত্তর দিলাম, “আমিই
যাবো, ভাই। রিকশ ঘুরিয়ে রাখুন, এখনই যাবো”।
আমি বালাইয়ের কাঁধে হাত রাখলাম,
বললাম, “চললাম, ভাই, মনের বালাই। তোমার মতো এমন “মনের বালাই” মিত্র এখন পর্যন্ত কেউ
হয়ে উঠতে পারেনি। ফোন নাম্বার দিলাম, বাইরে গেলে আমাকে খবর দিও, সুযোগ সময় পেলে নিশ্চয়ই যাবো”।
বালাই বিষণ্ণ মুখ তুলে, আমার হাতদুটো ধরে বলল, “সে কী আর বলার কথা বাবু,
নিশ্চয়ই জানাবো। আর কালার ইচ্ছে হলে, আমাদের ডাকে মোহনকালা কী আর কালা সেজে ঘরে থাকতে পারবেন? আসুন বাবু।
আজকের দিনটা আমাদের জীবনে আলোক-কণায় স্থির উজ্জ্বল করে দিয়ে গেলেন, বাবু”।
রিকশওয়ালা পেছন থেকে তাড়া দিল, “ওঠেন বাবু, দেরি করবেন না”।
বালাইয়ের কথায় আমি হাসলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “লাজবন্তী এখনও ফিরল না কেন? যাবার
সময় ওর সঙ্গে দেখা হবে না?” বালাই হাসল, “বলল, আপনি রওনা হন বাবু, দেখা হবে, ঠিক জায়গাতেই
সে আপনার অপেক্ষায় থাকবে”।
বালাইয়ের কথাটা আমার কাছে কেমন যেন রহস্য বলে মনে হল। আমার অপেক্ষায় সে
কোথায় থাকবে, কোন জায়গায়? আমি রিকশয় উঠলাম। প্যাডেলে চাপ দিয়ে রিকশওয়ালা বলল, “স্টেসন
যেতে তিরিশটাকা লাগবে, বাবু। এমনিতে ভাড়া কুড়িটাকা, তবে আপনাকে তুলতে এতটা উজিয়ে এলাম,
এতক্ষণ দাঁড়ালাম…সে সব নিয়ে”। মৌন থাকাই সম্মতির লক্ষণ চিন্তা করে, আমি কোন উত্তর না
দিয়ে গুছিয়ে বসলাম রিকশয়।
মিনিট চারপাঁচ গড়ানোর পরেই পৌঁছলাম, চার রাস্তার এক মোড়ে। মনে হল, সেখান থেকে বাঁদিকে
স্টেসনের রাস্তা, ডানদিকে বাঁধের দিকে যাওয়ার রাস্তা। আর সামনেরটা হয়তো চলে গেছে অন্য
পাড়ার দিকে। এই মোড়ের ঠিক বাঁহাতেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক অশ্বত্থ গাছ, শাখাপ্রশাখার বিপুল বিস্তার
নিয়ে। তার ডালে ডালে ঘরে ফেরা পাখিদের উচ্ছ্বল কাকলিতে কানপাতা দায়। বিকেলের মরা আলোয় অনুজ্জ্বল কিন্তু অদ্ভূত
স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। যেন অনেক ঝড়ঝাপটা সয়ে, কতকালের কত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে, প্রপিতামহের মতো, উদাসীন দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে।
দেখলাম সেই গাছের নীচেই দাঁড়িয়ে আছে লাজবন্তী। আমি রিকশওয়ালাকে থামতে বলে নীচেয় নামলাম। লাজবন্তীর সামনে
গিয়ে বললাম, “আপনি এখানে, দিদি? বাড়ি ফিরলেন না?”
আমার চোখে চোখ রেখে লাজবন্তী বললেন, “আমি আপনার সঙ্গে এই গাছতলাতেই দেখা
করতে চেয়েছিলাম, মোহনকালা। এই পরিবেশেই আপনার বিদায় পর্ব শেষ হোক। সাক্ষী থাকুক এই
বুড়ো অশথ গাছ, আর এই দিনান্তের আবছা আলো”।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর বললাম, “চলি”।
লাজবন্তী চোখ নামিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, “আপনাকে খপর দেব, আর আশায় থাকব আপনার
দর্শনের। চলি নয় বলুন আসি।
আসুন”।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। একটু হাসলাম। তারপর পিছন ফিরে রিকশয় চড়ার সময়,
রিকশওয়ালার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, সে কুটিল চোখে তাকিয়ে আছে লাজবন্তীর দিকে। সে আমাদের
সব কথাই হয়তো শুনেছে। রিকশওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে রিকশ চালু করল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম
লাজবন্তীর দিকে। সে একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে আবছা
আলোয় ঘেরা গাছতলায়। তাকিয়ে আছে এই রিকশটার দিকে…ওর থেকে আমার দূরত্ব বেড়ে চলেছে প্রতিটি
মুহূর্তে…।
৮
মিনিট দশেক গড়ানোর পর, রিকশর চেনটা ঝড়াক করে খুলে গেল। একধারে দাঁড়
করিয়ে রিকশওয়ালা পেছনে চলে গেল চেন সেট করতে। সিটে বসে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। রিকশর
নীচে চেন সেট করে, ওর সিটে বসতে
বসতে বলল, “ওরা আপনার কে হয়, বাবু?” সেই ‘মেয়েছেলে’ কথাটা কানে বাজার পর, ওর সঙ্গে
কথা বলার তেমন ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবু প্রশ্নের উদয় হলে, উত্তর না দেওয়াটা আমার দিক থেকে
চূড়ান্ত অভদ্রতার প্রকাশ হবে। তাই বললাম, “কেউই হয় না, ভাই। আজকে সকালে এখানে আসার
সময় ট্রেনে পরিচয়, তারপর থেকেই…”।
“বাবা, ট্রেনের পেত্থম পরিচয়েই এতো?” কিছুটা শ্লেষ নিয়ে বলল, রিকশওয়ালা। ওর মন্তব্যের
ইঙ্গিতটা রীতিমতো আপত্তিকর। এতো মানে, কিসের এতো? কথায় কথা বাড়ে, অতএব আমি নীরব হয়েই
রইলাম। আমার নীরবতা ওকে আরো উস্কে দিল বোধ হয়। একটু পরেই বলল, “আপনাদের মতো বাইরের
- শউরে লোকদের ভালোমানুষি ভাঙিয়েই
ওদের সংসার চলে, বাবু। ওরা ভালো লোক না…”।
আমি খুব বিরক্তির সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার নাম কী, ভাই”?
“আজ্ঞে, মিলন, সবাই মিলে মিলে বলে ডাকে”।
“দেখুন মিলন, ভাই। আমি এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কোন কথা কিংবা আপনার কোন মন্তব্যই
শুনতে চাই না। আপনি চুপচাপ রিকশ চালিয়ে, আমাকে স্টেসনে পৌঁছে দিন, ব্যস…”।
মিলন বেশ কিছুক্ষণ নীরবে রিকশ চালাতে লাগল, তারপর আবার বলল, “আমার আর কী
বলুন। বাইরে থেকে আমাদের জায়গা দেকতে এসেচেন, আপনাদের মতো লোককে সতক্কো করার জন্যেই
বলা। তা নইলে বলুন না, সরকারি ঘরে থাকে, কাজকম্ম কিছু করে না। লোকটাও তো লুলা। সারা
বছর কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় শুনেছি…। পেটের ভাত, পরনের কাপড় জুটছে কোথা থেকে? লুলা
আবার নাকি গান গায় – গান গাওয়ার এতো ফুত্তিই বা পায় কোথায় বলেন না? সব ওই মেয়েছেলেটার…”।
খুব রুক্ষ কণ্ঠে বললাম, “এখনই রিকশ দাঁড় করাও, মিলন। আমি নেমে যাব”। মিলন
ব্রেক দিয়ে রিকশ দাঁড় করাল, তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এস্টেসনে যাবেন না?”
“না”। আমি রিকশ থেকে নেমে রাস্তায় পা দিলাম। পকেট থেকে পার্স বের করতেই
মিলন বলল, “পুরো টাকাটাই কিন্তু লাগবে, এক টাকাও কম লিবনি…”।
একটা বাইকের শব্দ পাচ্ছিলাম পিছন থেকে, সেটা আমাদের পেরিয়ে যেতে যেতে ব্রেক
দিয়ে দাঁড়াল। আরোহী বাইকে বসেই বলে উঠলেন, “আরেঃ বাবু, আপনি? স্টেসন যাচ্ছিলেন নাকি?
নেমে পড়লেন কেন, কোন পব্লেম?”
আমি আরোহীকে দেখে চিনতে পারলাম, হেসে বললাম, “হামিদভাই? ভেবেছিলাম রিকশতেই
স্টেসনে যাব। কিন্তু নাঃ, এখন ভাবছি হেঁটেই যাবো”।
হামিদভাই রাস্তার ধারে বাইক স্ট্যাণ্ড করিয়ে কাছে এগিয়ে এলেন, মিলনের দিকে
এক ঝলক তাকিয়ে, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে বলেন তো?” আমি হাসলাম, বললাম, “কিছু না।
ওর কথাবার্তা আমার ভাল লাগছিল না। কথা না বলে, চুপ করে চালাতে বললাম, তাও শুনল না, বক বক করেই চলেছে। তাই…।
এই নাও ভাই, তিরিশটাকা…।
হামিদভাই আমার হাত চেপে ধরলেন, “দাঁড়ান বাবু। তিরিশ টাকা কিসের রে, মিলে?
স্টেসনের ভাড়া তিরিশটাকা?”
মিলনের সুর এখন অত্যন্ত মৃদু, বলল, “আচ্ছা বাবু, কুড়িটা টাকাই দ্যান”।
হামিদভাই ছাড়ার পাত্র নন, আমার হাত থেকে দশটাকার একটা নোট নিয়ে, মিলনের হাতে দিয়ে বললেন,
“এই নে ধর। আমি হলে টাকা তো দিতামই না, উলটে কানের নীচে দিতাম এক কানচাপাটি…”।
আমি হামিদভাইকে অনুরোধ করলাম, “হামিদভাই, আপনার কথাও থাক, আমার কথাও রাখুন
– কুড়িটা টাকা দিতে দিন”।
হামিদভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বললেন, “আচ্ছা নে, বাবু
যখন দিচ্ছেন। এ টাকা নিয়েই তো ঢুকবি গিয়ে সেই চুল্লুর ঠেকে, হারামজাদা। আসেন বাবু,
বাইকে চড়েন”। শেষ কথাটা বললেন আমারই উদ্দেশে।
“আরে না, না, তার কী দরকার”, “আমি হেঁটেই চলেই যাবো, আদ্দেক রাস্তা তো এসেই
গেছি” – এসব নিম-ভদ্রতার
কথা বলে অকারণ
কাল হরণ করলাম না। নীরবে উঠে বসলাম, হামিদভাইয়ের পিছনে। মিলন রিকশ ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে
ফিরে গেল – হয়তো হামিদ ভাইয়ের ভয়ে, অথবা কে
জানে নেশার অনিবার্য টানে।
বাইক চালাতে চালাতে হামিদভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারে দেখে তো রাগী
মনে হয় না। কিসের জন্যে রেগে গেলেন বলেন তো? যার জন্যে মাঝ রাস্তায় দুম করে নেমে পড়লেন?
এখান থেকে
এস্টেসন যেতে রিকশতেও
মিনিট দশেক তো লাগবেই”।
আমি হাসলাম, বললাম, “তা একটু রাগ হয়েছিল বৈকি! প্রথমে তো বালাই আর লাজবন্তীর সঙ্গে
আমার কিসের সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করল। তারপর ওদের নিয়ে এমন কিছু বলতে শুরু করল, যা কানে
তোলা যায় না…। বারণ করলাম, শুনল না, বক বক করেই চলল”।
“ইস্স্স্, তখনই যদি বলতেন, শালার দুখান দাঁত অন্ততঃ আমি উপড়ে নিতাম”।
মিনিট দু-তিন হবে, হামিদভাই বড়ো সাজানো একটা দোকানের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে বললেন, “আসেন বাবু, গরিবের দোকানে
বসে একটু চা খেয়ে যাবেন”। তারপর গলা তুলে হেঁকে বললেন, “আনিমুল, দুইখান চেয়ার বাইরে
দে তো…”।
আনিমুল নামের কিশোর ছেলেটি দুখানা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে রাখল – দোকানের
সামনের সিমেন্ট বাঁধানো ধাপিতে। একটা ঝাড়ন দিয়ে চেয়ারদুটো ঝেড়েও দিল। হামিদভাই বললেন,
“বসেন, বাবু। এটি আমার ছোট ভাই”। আনিমুল আদাব জানাল। আমিও নমস্কার করলাম
জোড়হাতে।
আমি চেয়ারে বসতে হামিদভাইও আমার সামনে বসলেন, তারপর আনিমুলকে বললেন, “আম্মিকে
বলে দু কাপ চা নিয়ে আয় তো, তুইও খাবি নাকি? থালে তিনটে বলিস”। আনিমুল দৌড়ে চলে যাচ্ছিল,
হামিদভাই হেঁকে বললেন, “চা যেন ফাস্কেলাস হয়…”।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই আমার দোকান বাবু। মা লক্ষ্মীর কৃপায়
এই আমাদের প্রধান ভরসা। পিছনেই আমাদের বাসা। কিছু জমিজিরেত আছে। বছর দুয়েক হল, পাইকিরি
মালের ডিস্টিবিউটরি শুরু করেছি। ওটা আর একটু দাঁড়িয়ে গেলে, এ দোকান আনিমুলকে দিয়ে দেব”।
একটু বিরতির পর
বললেন, “আব্বা
চলে যাওয়ার পর কবছর খুব আতান্তরে পড়েছিলাম, বাবু, আল্লার মেহেরবানি আর আপনাদের আশীব্বাদে
– এখন কিছুটা…। তা কেমন দেখলেন, বাবু, আমাদের জায়গাটা?”
ওঁনার কথা শুনতে শুনতে দোকানটা দেখছিলাম ভাল করে। এমন জায়গায় এরকম সম্পন্ন
দোকান বসাতে পর্যাপ্ত মূলধনের প্রয়োজন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি উত্তর দিলাম, “ভীষণই
ভালো লাগল, হামিদভাই। অচেনা অজানা জায়গায় এমন হুটহাট বেরিয়ে পড়া, আমার একধরণের নেশা
বলতে পারেন। বহু জায়গা দেখেছি, কিন্তু এমন খুব একটা দেখিনি। এখানকার লোকজন, আপনি, মালতীমা, সকালের সেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা,
আর সবার বড়ো, বালাই আর লাজবন্তীদি…। এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না, হামিদ ভাই। এমন আনন্দ
বহুদিন পাইনি”।
হামিদ ভাই চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “আপনি যাকে বালাই বলছেন,
তাকে আমরা বাউলকা বলি, বাউলকাকা। আর কাকিমা। দুজনেই অদ্ভূত মানুষ, বাবু। বাউলকাকার
মুখে সর্বদাই হাসি আর গান। আল্লা, মানে আপনাদের ভগবান যেন ভর করে আছেন বাউলকাকাকে।
কখনো রাগতে দেখিনি, লোভ নেই, হিংসে নেই। দুবেলা দুমুঠো ভাতের যোগাড় হলেই, ব্যস্, খুশি”।
একটু থেমে আবার বললেন, “আমাদের এখানে ঈদের সময় বেশ বড়ো মেলা বসে, বাবু, ঈদের নামাজ শেষ
হলে ঈদগার মাঠে। যেমন আপনাদের মেলা হয় চড়কে আর শিবরাত্রিতে। সেখানে এই দিগড়ের অনেক
ফকির, দরবেশ আসেন, আমরা ডাকি বাউলকাকাকে। তাঁদের ধর্মকথা, আলোচনা আর তার সঙ্গে বাউলকাকার
দু চার পদের গান – সকলের মন জয় করে নেয়, বাবু। বাউলকাকার কাছে, হিন্দু, মুসলমান, ধনী,
দরিদ্র, ব্রাহ্মণ,
ছোটজাত –
কিচ্ছু নেই, সবাই ইনসান, মানুষ। স্বার্থের জন্যে কাউকে তেলও দেন না, আবার কাউকে তুচ্ছ
জ্ঞানও করেন না”।
এসময় আনিমুল একটা স্টিলের প্লেটে তিন কাপ চা নিয়ে এসে আমাদের সামনে ধরল,
আমি তুলে নিলাম একটা কাপ। হামিদভাই একটা, বাকি কাপ আর প্লেট নিয়ে আনিমুল দোকানের ভেতরে
ঢুকে গেল। চায়ে চুমুক দিয়েই আমি বলে ফেললাম, “বাঃ। এসময় এরকম চাই যেন মন চাইছিল”। এ
আমার মনরাখা কথা নয় - এলাচ, আদা, তেজপাতা দেওয়া ঘনদুধের চা, কিন্তু পরিমিত মিষ্টি।
হামিদভাই হাসলেন, বললেন, “এটা আমার আম্মুই বানাতে পারেন, ছোটবেলাতে যখন
আমরা চা খেতাম না, খুব ঠাণ্ডার দিনে এমন চা বানিয়ে দিতেন আব্বুকে”।
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হামিদভাইয়ের দোকানের দিকে আবার মন দিলাম।
চালডাল, তেলনুন, মশলাপাতি। নানা রকমের চকোলেট, বিস্কিটের পাকেট থরে থরে সাজানো।
সঙ্গে আছে খাতা, কাগজ, পেন, পেনসিল, স্কুল কলেজের স্টেসনারি। সাবান, শ্যাম্পু,
তেল, ক্রিম, মেয়েদের সাজের সরঞ্জাম। তার সঙ্গে কোদাল, তাগাড়ি, বেলচা। নারকেলের
দড়ি, নাইলনের দড়ি, লোহার তার, ফুলঝাড়ু, নারকেলের ঝ্যাঁটা। সিগারেটের প্যাকেট,
বিড়ি, দেশলাই, গুটখার প্যাকেট। বহুল প্রচলিত বহুবিধ স্ন্যাক্সের প্যাকেট ঝুলছে
অজস্র। নাম করা সব ঠাণ্ডা পানিয় এবং জলের বোতল।
চা শেষ হয়ে গেল, দোকানের পসরা সম্ভার দেখা শেষ করা গেল না। দোকানের
বিচিত্র পসরার প্রাচুর্য থেকে এটাও বোঝা গেল, এ অঞ্চলে স্বচ্ছল অধিবাসীর সংখ্যাও
নিশ্চয়ই প্রচুর। হামিদভাইয়ের বিপুল লগ্নি নয়তো ব্যর্থ হতো। নিয়মিত ঝড়-ঝঞ্ঝায় পীড়িত
হলেও, এখানকার মানুষ স্বাভাবিক নিয়মেই উৎরে ওঠেন সে সংকট। ঘুরে দাঁড়াতে পারেন
জীবনের মূল স্রোতে। ও বেলায় মালতীমা আর বালাইয়ের ইতিহাস শুনে যতটা মন খারাপ
হয়েছিল, এ বেলায় কিছুটা স্বস্তি মিলল।
চা শেষ করে আমি সিগারেট ধরালাম, হামিদভাইকে দিতে গেলাম, হামিদ ভাই
নিলেন না। চুপিচুপি বললেন, “মাপ করবেন, বাড়িতে ও সব খাই না। আম্মু একদম পছন্দ করেন
না”। একটু পরে হামিদ ভাই বললেন, “বাউলকাকার পা দুটো কী করে কাটা যায় শুনেছেন?”
আমি বললাম, “শুনেছি। বালাই নিজেই বলল। আশ্চর্য! ওই ঘটনার কথা বলতে
গিয়ে, ওর মুখে বিষাদের ছায়া মাত্র দেখতে পেলাম না। স্বাভাবিক হাসি মুখে এমন করে
বলল, মনে হল যেন খুব একটা মজার গল্প শোনাচ্ছে”।
উচ্ছ্বসিত হয়ে হামিদ ভাই বললেন, “অ্যাই। এই কথাটাই আমি বলতে চাইছিলাম।
আমার আব্বুর কিতাব-টিতাব পড়ার খুব ঝোঁক ছিল। তাঁর কাছে শুনেছিলাম, আপনাদের
শাস্ত্রে নাকি আছে, শত দুঃখেও যিনি উতলা হন না, সুখের দিনেও যিনি উদাসী থাকেন,
যাঁর মনে লোভ, ভয় বা রাগ নেই, তাঁরাই নাকি সত্যিকারের জ্ঞানী?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ এ কথা আমাদের গীতাতে আছে, আপনার বাবা গীতা
পড়েছিলেন! কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে অর্জুন যখন একান্তই নারাজ হলেন, তাঁকে যুদ্ধে
প্রবৃত্ত করার জন্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে কথাগুলি বলেছিলেন, সেগুলির সংকলনই গীতা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার সাংখ্যযোগ অধ্যায়ে অর্জুনকে বলেছিলেন,
“দুঃখেষু
অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ
স্থিতধীঃ মুনিঃ উচ্যতে।।
বাংলায় এই শ্লোকের মানে হল - যিনি দুঃখের সময় উদ্বেগ করেন না, যিনি
সুখের সময় উদাসীন থাকেন, যিনি সমস্ত আসক্তি, ভয় এবং ক্রোধ জয় করতে পেরেছেন, সেইরকম
যোগীকেই স্থিতধী বা স্থিতপ্রজ্ঞা মুনি বলা হয়”।
“ঠিক। বাউলকাকাকে যখনই দেখি। আমার আব্বুর ওই কথাগুলি মনে পড়ে”।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আমি ভাবছিলাম, সকালে হামিদভাইকে যেভাবে
বুঝেছিলাম, এখন সেই মানুষটাই কত আলাদা। বিষয়ী লোক ব্যবসা-পত্র ভালই বোঝেন। অর্থ
উপার্জনের পথে অনেক গলিঘুঁজি, অনেক ঘাঁতঘোঁত জেনেছেন, অনেক ফড়ে-ফেরেব্বাজ
সামলেছেন। অথচ তাঁর অন্তরে বসত করেন তাঁর আব্বাজান – একজন মোরশেদের মতোই যিনি
পুত্রকে জীবনের সঠিক পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতার আকস্মিক মৃত্যু, পুত্রকে
ভয়ংকর এক সংকটের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা হামিদভাইকে শিখিয়েছিল বাস্তববোধ,
অতএব তিনি সে পথে না হেঁটে – নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন।
সদর শহর, ছোটবড়ো নানান শহরের হাল-হকিকত বুঝে, পাকা ব্যবসায়ীদের ধড়িবাজি
সামলে, নিজের হাতেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন সমৃদ্ধির দিকে। সেই কারণেই, সকালে তাঁর
মুখে শুনেছি শহরবাসীদের প্রতি তিক্ত বিরক্তি। অথচ এখন এই সন্ধ্যায় পাখিরা যখন
সারাদিনের খাদ্য সন্ধান সেরে নিশ্চিন্তে নিজনিজ বাসায় ফিরেছে। ঠিক সেই সময়েই, আপন
হাতে গড়ে তোলা ঝকঝকে দোকানের সামনে, নিশ্চিন্তে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিতে পারলেন
কত সহজেই। বিষয় উপার্জনের তীব্র বিষেও তিনি মোরশেদ পিতার কথাগুলি অনুভবে রেখেছেন
আজও।
হামিদভাই সকালে আমাকে বলেছিলেন, “রাজধানীর লোকেদের পেটে আর মুখে আনকথা।
তাদের সব্বোদাই যেন লোক ঠকানোর ব্যবসা। এ আমি পেতক্ষ দেখেছি, বাবু”। আমি মনে মনে
হাসলাম। গ্রাম হোক বা শহর, ধনী হোক বা দরিদ্র, হিন্দু হোক বা মুসলমান, আসলে
প্রত্যেক মানুষের অন্তরেই দুই বা ততোধিক সত্ত্বা আছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই
সত্ত্বাগুলিই ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের বিচিত্র চিন্তা-ভাবনা এবং মননের
নিয়ামক।
দোকানের দেওয়ালে একটা বড়ো ঘড়ি ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবার যে
আমাকে উঠতেই হবে, হামিদভাই”। হামিদভাই হয়তো তাঁর বাল্য এবং কৈশোরে ফিরে গিয়েছিলেন
– তাঁর আব্বাজানের স্নেহমাখা শাসনের দিনগুলিতে। একটু চমকে, নিজের হাতঘড়ি নিরীক্ষণ
করে বললেন, “মিনিট কুড়ি পরেই একটা ট্রেন আছে কলকাতার, এটা মিস করলে পরেরটা প্রায়
একঘন্টা পরে। চলেন আপনারে ছেড়ে আসি”।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, মৃদু আপত্তির সুরে বললাম, “এখান থেকে স্টেসান
কদ্দূর? আমি না হয়...”।
হামিদভাই বাইকের চাবি নিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে বললেন, “ওদিকে আমার একটু
কাজও আছে, আসেন। আনিমুল, দোকানে থাক, আধাঘন্টার মধ্যেই আসছি”। দাদার ডাকে আনিমুল
দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল, সলজ্জ হাসিমুখে আমাকে আদাব করে বিদায় জানাল, আমি হেসে
বললাম, “চলি, আনিমুলভাই, ভালো থেকো”।
চার-পাঁচমিনিটের মধ্যেই আমরা স্টেসনে পৌঁছে গেলাম। বাইক থামিয়ে
হামিদভাই জিজ্ঞাসা করলেন, “রিটান টিকিট আছে তো? তাহলে, সোজা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে
পড়ুন”।
আমি বাইক থেকে নেমে মৃদু হেসে বললাম, “রিটার্ন টিকিট ছিল, কিন্তু সেটা
বালাইয়ের হাতে জমা দিয়েছি, আমার ফোন নম্বর লিখে। কাজেই টিকিট একটা কাটতে হবে...”।
হামিদভাই হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, “বুঝেছি, টিকিট কাউন্টার ওই যে
সামনে, বাঁদিকে”।
আমি দুই হাত তুলে নমস্কার করলাম, বললাম, “সারাটাদিন বড়ো আনন্দে কাটল,
হামিদভাই। আপনাদের সকলকে আমার সারাজীবন মনে থাকবে”।
হামিদভাইও জোড়হাতে নমস্কার করলেন, বললেন, “আদাব, দাদা। সকালে প্রথম
পরিচয়ে আপনাকে যেমন মনে হয়েছিল, এখন বুঝলাম আপনি তেমন না। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে
আমারও খুব ভালো লাগল”।
আমি হাসিমুখে বললাম, “আমি আরও খুশী হলাম, ভাই, বাবু থেকে আপনার দাদা
হতে পেরে”।
হামিদভাই হাসলেন। তারপর আমার দুটো হাত ধরে বললেন, “ভালো থাকবেন দাদা,
আসি?”। আমি হেসে সম্মতি দিলাম।
বাইক স্টার্ট করে বেরিয়ে গেলেন হামিদভাই, আমিও এগিয়ে গেলাম টিকিট
কাউন্টারের দিকে। পিছনে রইল, এখন আর ততটা অচেনা নয়, সেই অচিনপুর। রইলেন আশ্চর্য
কিছু মানুষজন – আর তাঁদের সঙ্গে আমার মাত্র একটি দিনের আন্তরিক সাহচর্য। এই মধুর
স্মৃতি আমি বহন করে ফিরে যাবো রাজধানী কলকাতায়। নির্জন শীতের বিকেলে যখনই মনে পড়বে
এঁদের কথা... কর্মক্লান্ত মনের সমস্ত আপদ-বালাই দূর হয়ে যাবে – লাজবন্তী আর তার
মনের বালাইয়ের কথা মনে পড়লেই।
শেষ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন