১৫
সেই বর্ষার পরে বেশ কিছুদিন পার
হয়ে গেল। না, শুভময়ীদেবী ছবিকে ছাড়িয়ে দেননি বা তার মাইনে কম করে দেবার কথাও
উচ্চবাচ্য করেননি। যদিও ছবি সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকে ভয়ে। সেদিনের সেই পড়শি ভদ্রমহিলার
কথা তার কানে বাজে অহরহ। কথাটা সত্যি তো বটেই – ভীষণ স্বচ্ছ এবং স্পষ্টও বটে।
একথাটা ছবি যে এতদিন ভুলে ছিল তাও নয়। নিজেকে কোনদিনই সে “কাজের লোক” বা আরও
স্পষ্ট করে বললে “ঝি” ছাড়া ভাবেনি এবং মনে মনে সেকথা ভুলেও যায়নি। সংসারে তারা যতই
অপরিহার্য হোক না কেন – আসল সম্পর্কটা হল “ওরা” আর “আমরা”। ওরা মালিক – আর আমরা - ছবিরা ঝি। ভদ্রতার
মুখোশে ওরা মুখের ওপর সরাসরি বলে না – কিন্তু দূরত্বটা বজায় থাকে – সেটা টেরও পাওয়া যায় অহরহ। এই কথাগুলোই সেদিন
মিঠুদিকে বলেছিল – ভেবেছিল, অন্ততঃ মিঠুদির কাছে মন খুলে সুখ-দুঃখের কথা বলাই যায় – কিন্তু
মিঠুদি রেগে
গেল। যে বিকল্প কাজের জন্য সেদিন মিঠুদিকে অনুরোধ করেছিল – এতদিন হয়ে গেল, মিঠুদি সে কথার উচ্চবাচ্য তো অনেক
দূরের কথা - খোঁজও নেয়নি। মিঠুদির এতদিনের ভালোবাসা, আদর, “ছবি রে, তোর মধ্যে কী
যেন একটা আছে… আমি পাগল হয়ে যাই”। সেসব সবই এখন ফুস্ - হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। আসলে
তারা – ছবিরা
- এক এক জন
ব্যবহার্য বস্তু – অনেকটা দাঁত মাজার ব্রাশের মতো – যতদিন চলছে – তার খুব যত্ন। পুরোন
হলেই তার স্থান হয় আস্তাকুঁড়ে। সে ভুল করেছিল, কিন্তু মিঠুদি কোন ভুল করেনি – কারণ
মিঠুদিও তো একজন “ওরা”।
এতগুলো বছর সে এই বাড়িতে রয়েছে।
নিখুঁত যন্ত্রের মতোই নিঃশব্দে সে কাজ করেছে। অক্ষরে অক্ষরে সে পালন করেছে শুভময়ীদেবীর
স্বামী এবং শ্বাশুড়ির প্রতিটি নির্দেশ। সে কাজে যোগ দেওয়ার বছর দুয়েকের মাথায় শুভময়ীদেবীর
শ্বাশুড়ি মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে কালাশৌচ নামক কোন পালন এ বাড়িতে হয়নি। মালতী সব
দেখেশুনে ছবিকে বলেছিল – এ আবার কেমন ধারা মানুষরে, ছবি? নিজের মা মারা গেল – আর তার
ছেলে, তার ছেলের বৌ কোন নিয়ম-কানুন পালন করবেনি? এ একটা কথা হল? ছবি শুনেছে বাইরে কোথাও
কোন গৌড়ীয় মঠে নাকি কাজকর্ম সেরে এসেছিল ওরা। না, ছবিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি, ছবি
গেলে বাড়িতে একলা থাকা বিট্টুকে দেখত কে?
শুভময়ীদেবীর শ্বাশুড়ি ছবিকে
স্নেহ করতেন বেশ। অন্ততঃ ছবির তাই মনে হয়। ছবি তাঁকে দিদা বলত। সেই দিদার কাছেই রান্না-বান্নার
নানা কায়দা-কৌশল শিখেছে ছবি। দিদা বলতেন, “চিরকাল ওই এক ছেলের হাগা-মোতা সাফ করেই কি
তোর জীবন কাটাবি? এদিকটাও শিখে রাখ। তোরা তো, মা, আমাদের মতো বসে খাওয়ার মানুষ নোস।
আর তোর মামীর মতো বড়ো বড়ো পাশ দিয়ে চাকরি করেও খেতে পারবি না। গতর খাটিয়েই যখন সারাজীবন
খেতে হবে, সব দিক শিখে রাখা ভাল। কখন কী কাজে লেগে যায়, কে বলতে পারে?”
মামা-মামী যখন নিজের নিজের
অফিসের কাজে ব্যস্ত। বিট্টু দুপুরের খাওয়া সেরে, ওষুধ পেয়ে অঘোরে ঘুমোত। হাতের কাজ
সেরে, সে আর দিদা নির্জন দুপুরে খাওয়া সারত একসঙ্গে বসে। দিদা তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন তাঁর
খাওয়ার প্রতি। ছবির পাতে মাছের ভাঙাচোরা কিংবা ল্যাজের টুকরো দেখলে বিরক্ত হতেন। কোনদিন
ডাল না থাকলে বা তরকারি কম থাকলেও বিরক্ত হতেন। বলতেন, “তোকে কি কেউ কোনদিন বলেছে তুই
সব কিছুই কম-কম খাবি? তুই উঠতি বয়সের মেয়ে, সারাদিন এত খাটছিস – তোকে খেতে হবে না?
তোর কাজে আমরা সকলেই খুশি – কিন্তু মনে রাখিস দুর্বল হয়ে অসুখে পড়লে, তোকে ছাড়িয়ে অন্য
মেয়ে আনতে – আমরা কেউ দুবার ভাববো না। সংকোচ করে কম-কম খেয়ে তুই যে অসুখ বাধিয়েছিস,
একথা আমরা কোনদিন বুঝবো না। কেউ বলতে এলেও আমরা উত্তর দেব – কেউ কি ওর হাত-পা বেঁধে
রেখে দিয়ে যায় – একলাই তো থাকে সারাদিন – ওর হাতেই সব – কে বলেছে ওকে কম কম খেতে? এটাই
আমাদের নিয়ম। নিজের শরীরটাকে কখনও অবহেলা করিস না, রে মা”।
আজ মনে হয়, এই বাড়িতে দিদার
অবস্থানও কিছুটা নড়বড়ে ছিল। হয়তো তার মতোই। অথবা তার থেকেও খারাপ। তাও তো তার কাজের
একটা মূল্য ছিল এ বাড়িতে, কিন্তু দিদার? মামা অফিসের কাজে এতই ব্যস্ত – সারাদিনে একবার
বসে মায়ের সঙ্গে দুটো কথা বলারও তাঁর সময় ছিল না। সময় না গরজ – নাকি দুটোর কোনটাই ছিল
না? মামীর চাকরি করা নিয়ে দিদার খুব আপত্তি ছিল – দিদার মুখেই শুনেছে। তবে এ বাড়িতে
কাজে যোগ দেওয়ার পর, এ নিয়ে ওঁদের দুজনকে কোনদিন কথা বলতে সে শোনেনি। এবং দুজনের সম্পর্কে
ছিল গভীর শীতলতা। স্কুল-ছুটির দিনগুলোতে মামী বিট্টুর দেখাশোনা করতেন কিছুটা, বেশ কিছুটা
সময় কাটাতেন বিট্টুর সঙ্গে। সেসব না থাকলে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে, নিজের ঘরে বসে লেখাপড়া
করতেন। ভীষণ প্রয়োজন না থাকলে, ছবি প্রায় কোনদিনই মামী আর দিদাকে একসঙ্গে বসে কথা বলতে
দেখেনি।
এইসব নানান কারণেই, বিট্টু
“একান্ত সহায়”-এ চলে যাওয়ার পর, সে তড়িঘড়ি মাকে এ বাড়ির কাজ থেকে ছাড়িয়ে, অন্য বাড়িতে
কাজে লাগতে বলেছিল। কারণ, তাকে যদি মামী হুট করে ছাড়িয়ে দেয়, মাও এ বাড়িতে আর কাজ করতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে দুজনের একসঙ্গে কাজ চলে যাওয়ার বিপদ সামলানো
মোটেই সহজ হবে না। এবং সেই আশঙ্কা থেকেই সে প্রস্তুত হচ্ছে, অন্য কোন বাড়িতে অন্য কোন
কাজে যোগ দিতে।
বেশ কিছুদিন
ধরেই মাকে
আর দিদুকে সে লাগাতার তাগাদা দিয়ে চলেছে নতুন কাজের সন্ধানে। মিঠুদিদির বাড়ি প্রায়
বছর তিনেক আর এ বাড়িতে প্রায় বছর ছয়েক কাটিয়ে ফেলার পর ছবি এখন অনেকটাই পালটে
গেছে। তার ছোটবেলার অভ্যস্ত জীবন থেকে সে সরে এসেছে অনেকটাই দূরে। যেখানে ফিরে
যাওয়া তার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর। তার জীবনযাত্রায় ঢুকে পড়েছে
কলকাতা শহর - তার স্বাচ্ছন্দ্য আর আপাতশান্ত ভদ্রতা নিয়ে। দিদুর ঘরে ফিরে গিয়ে
রাতটুকু থাকা, রোজ সকাল-সন্ধ্যে ট্রেন ধরে নানান বয়সি মেয়েদের দলের সঙ্গে যাওয়াআসা
করা। তাদের মুখের আবেগহীন ইতর ভাষা – ছবির কাছে আতঙ্ক মনে হয়। ছবি জানে ওদের অনেকেরই
বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেপুলেও আছে সংসারে। রাত্রে বাড়ি ফিরে অনেকেই সম্মুখীন হয় তাদের
মাতাল স্বামীদের। দেশী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে সব। চেঁচামেচি, মারধোর নিত্যসঙ্গী তাদের। সেসব সামলে রাত ভোর হতেই
আবার সবাই বেরিয়ে পড়ে কলকাতার নির্দিষ্ট ট্রেন ধরতে। তার প্রথম বারো বছরের ফেলে আসা জীবনধারা,
এই দশটা বছরের ব্যবধানে, সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে ছবিকে। ওই জীবনটা তার কাছে এখন দুঃস্বপ্নের
মতো - ওই
জীবনে কোনভাবেই সে যেতে
চায় না।
ওই বর্ষার দিন – যা সব ঘটনা ঘটল তারপর
থেকে শুভময়ীদেবীকে আরও বেশি ভয় পাচ্ছে ছবি। সেদিন এক তো বাহাদুরি করে মামী ডিম আনতে গেল। তারওপর সিঁড়ি উঠতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল। বলতে নেই,
শুভময়ীদেবী চেহারাটা মোটা না হলেও, ছবির তুলনায় যথেষ্ট ভারি
– মাথাতেও অনেকটাই লম্বা। অত বড়ো শরীরটাকে একতলা থেকে তিনতলা, টেনে আনা কি মুখের কথা?
মানছি, মামী তার ওপর শরীরের সমস্ত ভার চাপায়নি – দুপায়ে ভর দিয়ে – সামান্য খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে উঠছিল। কিন্তু তাও ছবির পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন