[এবার পুজোয় আমার লেখা কল্পবিজ্ঞানের নতুন উপন্যাস - "লিলিপুট" প্রকাশ করল "জয়ঢাক শরৎ- ২০২৫ সংখ্যা"। পত্রিকার প্রকাশককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উপন্যাসটির লিংক শেয়ার করলাম এখানে -
শুধু আমার উপন্যাসটিই নয়, খুলে যাবে আরো অনেক গল্প-উপন্যাস-ছড়া ও মজার সন্ধান।]
অথবা উপন্যাসটি এখানেও পড়ে নিতে পারবেন -
লিলিপুট
দোয়াহীন সোনসার
বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া হঠাৎ নিজেই
এসে হাজির ইন্দ্রনারায়ণের বাড়িতে। সঙ্গে একজন শুঁটকো চেহারার লোক নিয়ে। আগে কোনদিনই
পরিচয় ছিল না, কাজেই বসার ঘরের চেয়ারে বসে, সে বলতে আরম্ভ করল, “হামাকে আপনি
চিনবেন না দাদা। হামি মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া
আছে। রাজস্থানের বাসিন্দা হলেও বঙ্গালমে তিন পুরুষ হইয়ে গেলো। হামার বাঙ্গলা শুনে
ওনেক বাঙ্গালীভি বোলে, হামি বাঙ্গালী আছে। এএহে হে হে হ। টাগোরভি হামি খুব পড়িয়েছে।
“বোগোবান, তুম দূত ভেজেছো বারেবারে, দোয়াহীন সোনসারে”, “বিপোদে মোরে রকষা কোরো ইয়ে
নাহি মোর পরারথনা, বিপোদে হামি না যেনো কোরি ভোয়”। কী, এএহে হে হে হে। কিমন মনে হোলো
দাদা? এএহে হে হে হে”। মনোহরলাল রবিঠাকুরের কবিতা নির্ভুল আবৃত্তি করে টেনে টেনে
খুব হাসতে লাগল।
ইন্দ্র মুখে খুব উদাসীন একটা হাসি নিয়ে বলল, “খুব আনন্দ পেলাম আপনার
সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তবে আপনি নিশ্চয় আমার সঙ্গে রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে
আসেননি। যদি তাই এসে থাকেন, তাহলে বলব, আমি কিন্তু এ বিষয়ে সঠিক লোক নই”।
“বঢিয়াঁ কহিয়েছেন, দাদা। আপনি রসিকভি আছেন, ইনটেলিজেনভি আছেন। হামি
শুনেছি অচ্ছা অচ্ছা ফোরেন নোকরির ওফার ভি আপনি একসেপ্ট করল না। আপনি রিয়েল
দেশপরেমী সচ্চা ইনসানভি আছে।”
“ওরে বাবা, না না, সেরকম কিছু নয়। আসলে আমি একটু কুঁড়ে টাইপ, নিজের
মতো, নিজের খুশিতে মন যা চায় করতে চাই। বেশি দৌড়োদৌড়ি, বেশি টেনসন আমার পোষায় না।”
“একদম মনের কোথাটা বলিয়েছেন, দাদা। পুরানা টাইমমে হামাদের মুনি
ঋষিদেরভি এইসা সোচ বিচার ছিল। আপনা আপনা আশরোমমে বৈঠে কোতো কুছু ডিস্কভার
করিয়েছেন। হামাদের আরিয়াভাট জিরো ডিস্কভার করলো, দুনিয়াকো শিখিয়েভি দিলো।
কিন্তু নোবেল-উবেলকে লিয়ে একবারভি সোচলো না।”
“বলেন কী, আর্যভট্টের সময় নোবেল ছিল নাকি! নোবেল তো এল, ডিনামাইট
ফাটানোর লাভের পয়সা থেকে!”
“নোবেল না থাক, কুছ তো ছিল, দাদা। হামি চাই আপনি নোবেলটা লিন। আপনি কাম
কোরতে থাকুন, ভাগদওড় হামি কোরবে। আপনি কুছু টেনসান লিবেন না, সোব হামার। যো কোরার হামি পুরা মদত
কোরবে, লেকিন নোবেলটা আপনি লিন, না করবেন না।”
ইন্দ্র হো হো করে হেসে ফেলল এই কথায়, বলল, “বোঝো, নোবেল কী বেলগাছের বেল নাকি?
গেলাম আর পেড়ে নিলাম। আমি এমন কিছুই এখনো করিনি, যার জন্যে নোবেল পেয়ে যাবো। যদি
কোনদিন সেরকম কিছু করে ফেলি আপনাকেই প্রথম জানাবো, মনোহরলালজি!”
ইন্দ্রর এই কথায় মনোহরলাল মোটেই খুশি হল না, ভীষণ গম্ভীর মুখে বলল, “হামার
কোথাটা আপনার মাজাক লাগলো, দাদা? মনোহরলাল বেকার টাইম ওয়েস্ট কোরে না। সোব খবর
লিয়ে, সোব দিক সোচ বিচার করে, হামি আসিয়েছি। হামার কোথা শুনলে আপনারভি ফায়দা,
হামারভি মুনাফা!”
ইন্দ্র ব্যাপারটা এতক্ষণ হাল্কাভাবেই নিচ্ছিল, এবার সেও সিরিয়াসলি জিজ্ঞাসা
করল, “এত ধানাইপানাই না করে, ঠিক কী বলতে চাইছেন, বলুন তো?”
মনোহরলাল ইন্দ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনি মিনি অ্যানিমেল বানিয়ে
ফেললেন, মানুষকেও এই এত্তোটুকুন...”, ডানহাতের দু আঙুলে সাইজ দেখিয়ে, “...বানিয়ে
ফেললেন। এত্তোদিন এই যে পৃথিবীটাকে ছোট্ট মনে হচ্ছিল, সেটাই এখন বিশাল হইয়ে যাবে”।
ইন্দ্র তেমন মুগ্ধ হল না মনোহরলালের কথায়, বলল, “আজকের ইন্টারনেটের
যুগে, এ এমন কী আশ্চর্য বিষয় মনোহরবাবু? আমার এই গবেষণা নিয়ে বিদেশের অনেকগুলি
ম্যাগাজিনেই এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। গুগল্ সার্চ করলেই যে কেউ সে সব তথ্য
পেয়ে যাবে। কিন্তু এ বিষয়ে আপনার এত কৌতূহল কেন, সেটা কিন্তু আমার কাছে এখনো
পরিষ্কার হল না।”
মনোহরলাল একই রকম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “হামার নানা, পন্দ্র
বোছোর বোয়সে পেনিলেস ওবোস্থায় এখানে চলে এলো, টু ট্রাই হিজ লাক। ভাগ্গো ওন্নেষোণ।
দোশ বোছোরের মোধ্যে বিজিনেস কিং বোনে গেল। আর পিছোন ফিরে তাকালো না। নানার নানান
বেওসা, নানান ধান্দা, এক ভি বেওসা নন-সকসেস হোলো না। মাই ফাদার মোহনলাল ইক্কিশ
বোছোরে নানার বেওসা হাতে লিল। দোশ বোছোরের মোধ্যে হামাদের বিজিনেস, হামাদের হোউসের
নাম কলকাত্তা থেকে শিলিগুড়ি; পটনা, ইল্লাহাবাদ, ভোবনেশোওর থেকে গুয়াহাটি, শিলচর
পর্যন্ত ছোড়িয়ে গেল”।
মনোহরলাল একটু থেমে দম নিল, সেই সুযোগে ইন্দ্র মুচকি হেসে বলল, “মনোহরবাবু,
আপনাদের এই ‘দোশ’ বছরে আমাদের কোন দোষ হয়ে গেল কী?”
সে কথায় কান না দিয়ে, মনোহরলাল বলল, “বেওসা আমাদের রোক্তে। বিজিনেসটা
হামরা বোঝে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, বারুইপুর, ইল্লাহাবাদ, কানপুরে হামার শ শ একারস
জমিন আছে। ওই সোব জমিনে হামি হাউসিং কমপ্লেক্স বানাবে। ইউপি, বিহার,
ওয়েস্টবেঙ্গলের সমস্ত লোককে আমি ওই সব কমপ্লেক্সে সরিয়ে লিব। পুরা ইস্টেট হামার
কব্জায় চলে আসবে। ইন্দরবাবু দোশ বোছোরে আপনার ফিউচার হামি বদলে দেবে। আপনি হামার
বিজিনেস পার্টনার বনিয়ে যান, এইট্টি-টুয়েন্টি পার্টনারশিপ, এইট্টি হামার, টুয়েন্টি
আপনার”। মনোহরলাল একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে রইল ইন্দ্রর দিকে।
ইন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মনোহরবাবু,
আমার সব থেকে বড়ো দোষ আমি খুব কুঁড়ে, ওই দোশ বোছোরে আমার কিছুই হবে না। আমার রক্তে বিজনেসের ব-ও
নেই! কাজেই বিজনেস তো আমি করবো না”।
একটু বিরক্ত হয়ে মনোহরলাল বলল, “সেভেন্টি-থার্টি?”
“কিসের?”
“সেভেন্টি হামার, থার্টি আপনার”।
এই কথায় ইন্দ্রও এবার একটু বিরক্ত হল, বলল, “ওটা উলটে দিলেও আমি রাজি
হবো না, মনোহরবাবু। আপনি বৃথাই এতক্ষণ সময় নষ্ট করলেন”।
মনোহরলাল খুব শীতল আর কর্কশ গলায় বলল, “না কোথাটা হামি পসোন্দ কোরল না,
ইন্দরবাবু। সোহোজ কোথায় কাজ না হোলে, ওন্য রাস্তাভি হামার জানা আছে”।
ইন্দ্র মনোহরলালের চোখে চোখ রেখে বলল, “সে তো বটেই, ব্যাঁকা পথ ছাড়া কী
আর বিজনেস এতো বাড়ানো যায়?”
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মনোহরলাল বলল, “হামি এখন চোলি, ইন্দরবাবু। হুট করে
কোন ডিসিসান লিবেন না, এটা হামার এডভাইস ফ্রম এ ওয়েল উইশার। টাইম লিন। সোচ বিচার করুন। হামি
আবার আসবে”।
ইন্দ্রও উঠে দাঁড়াল, জোড়হাতে নমস্কারের ভঙ্গি করে বলল, “আপনি ব্যস্ত
মানুষ, আমার অ্যাডভাইস যদি নেন, খামোখা সময় নষ্ট করবেন না।”
হঠাৎ মনোহরলালের মুড বদলে গেল। পিছনে চুপ করে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা,
সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বলল, “আরে বৃহৎরাম, মেরে পিছে খড়ে খড়ে মক্ষি গিন রাহা হ্যায়
ক্যা? ইন্দরদাদাকে প্রভুজির পরসাদ দেওয়ার কোথাটা ইয়াদ করালি না, বুরবক?” বৃহৎরাম
হাতের বটুয়া থেকে সিঁদুর মাখানো শালপাতার একটা মোড়ক তুলে দিল মনোহরলালের হাতে।
মনোহরলাল মোড়কটা হাতে নিয়ে, খুব ভক্তিভরে খুলল মোড়কটা। তার থেকে এক চিমটিভর শুকনো
চাল তুলে ইন্দ্রর দিকে বাড়িয়ে, অমায়িক হেসে বলল, “হামার বাড়ির মন্দিরে প্রভুজীর
নিত্য আর্তি হোয়। বিজিনেস হো না হো, ইন্দরদাদা আপনাকে হামার বহোত পসন্দ হোলো।
প্রভুজীকা পরসাদ থোড়া পাইয়ে, মনকা শরীরকা শান্তি হোবে”। ইন্দ্র না করতে পারল না, হাত পেতে
চালের দানা নিয়ে মুখে পুরল। ঠিক সেই সময়েই বাজার থেকে ফিরল, ঝিঙেদা। এ বাড়িতে
ইন্দ্রর একমাত্র সঙ্গী, বন্ধু এবং তার সকল কাজের সহায়ক।
তাকে দেখে মনোহরলাল বলল, “আপনি ইন্দরদাদার ঝিঙ্গাদাদা আছ? কী ঠিক বলি
নাই? এএহে হে হে হে। লিন, লিন আপনিও পরসাদ পেয়ে লিন”। ঝিঙেদাদাও পাজামার পিছনে হাত মুছে
ভক্তিভরে প্রসাদ নিয়ে মুখে পুরল। তারপর মনোহরলাল হাতজোড় করে নমস্কার করে দরজার
দিকে এগোলো। দরজার বাইরে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “প্রভুজীর ইঞ্ছা হোলে আপনার
ডিসিসান বদলভি হোতে পারে। প্রভুজী হামাকে কখনো নিরাশ করলো না। আজ চলি ইন্দরদাদা,
হামি ফিন আসবে। আপনার সঙ্গে আলাপ হোয়ে খুব মোজা হল। এএহে হে হে হে হে”।
ইন্দ্র দরজায় দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করল, একটা কথাও বলল না।
উদাসীন তাকিয়ে রইল মনোহরলালের যাওয়ার দিকে।
তিমি থেকে পুঁটি
“আজ নিয়ে তিনদিন হল, সতীশ আর বল্টু খুব আতান্তরে পড়েছে। হঠাৎ কী যে হল,
একসঙ্গে ছোটকত্তা আর ঝিঙেদা দুজনেই অসুস্থ। সাধারণ জ্বরজারি হলেও কথা ছিল, কিন্তু
তা নয়। দুজনের একই অসুখের লক্ষণ,
হাত-পায়ের গাঁটে অসহ্য যন্ত্রণা, হাঁটা-চলা করতে পারছে না। বিছানায় দিনরাত শুয়ে
আছে, কোনরকমে টয়লেট-বাথরুমে যাচ্ছে, তাও লাঠিতে ভর দিয়ে, দেয়াল, দরজা ধরে ধরে। আর
ওইটুকু হাঁটাতেই এমন হাঁফাচ্ছে, মনে হচ্ছে পাহাড় চূড়া জয় করে ফিরল। ফ্রিজে যেটুকু
খাবার-দাবার, সেও শেষের মুখে। আজকালের মধ্যে দোকান-বাজার যেতে না পারলে, বিপদ
বাড়বে”।
“যেতে বাধা কোথায়? সতীশ কিংবা বল্টু যাচ্ছে না কেন”?
“যা জানো না, তা নিয়ে কথা বলো কেন? কী করে যাবে? সতীশ এমন একজন মানুষ,
যার হাইট মাত্র তিন ইঞ্চি আর বল্টু একটা অবোলা কুকুর, মানুষের মতো কথা বলতে পারে
না। সতীশ বাজারে গেলে কী হতে পারে, কোন ধারণা আছে? পথের বেড়াল-কুকুররা ছেড়ে দেবে?
বাজারে যে ধেড়ে ইঁদুরগুলো পায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে যায়, তারা তো দেখলেই সতীশকে মুখে
নিয়ে, তাদের গর্তে ঢুকে যাবে! আচ্ছা, ধরে নিলাম, সে সব বাঁচিয়ে বল্টু না হয় সতীশকে
বাজারে নিয়েই গেল। দোকানের মানুষগুলো? তারা ছেড়ে দেবে? কেউ ভয়ে আঁতকে উঠবে, কেউ
ভাববে, হয়তো কোন পোকা, চপ্পলের ঘায়ে সতীশের পেট ফাটিয়ে দেবে না? মানুষের স্বভাব
জানো না? অজানা, অচেনা কোন প্রাণী দেখলেই আগে ধপাধপ মেরে দেবে, তারপর মোবাইলে ফটো
তুলে হোয়াট্স্ অ্যাপে বা ফেসবুকে পোস্ট করে খুব খানিক বাহাদুরি নেবে, নয়তো আদিখ্যেতা
করবে”।
“মানুষের হাইট তিন ইঞ্চি? একথা বললেই আমি বিশ্বাস করে নেব? আমাকে কী
খুব উজবুক মনে হয়, তোমার? তিনফুটিয়া মানুষ দেখেছি, কিন্তু তিন ইঞ্চি, ইমপসিব্ল্”।
“ওই তো তোমাদের মুশকিল। যা জানো না, যা দেখনি, যা শোননি সেরকম কিছু
শুনলেই, বলে দাও ইমপসিবিল। খুব বিজ্ঞ আর কী? যেন পৃথিবীতে তোমার জানতে আর কিছুই বাকি
নেই। বলি বিজ্ঞান বলে একটা জিনিষ আছে সেটা শুনেছ? ধরো আজ থেকে একশো বছর আগে, টিভির
কথা বললে বিশ্বাস করতে? আমার এক বন্ধু আছে, নিবারণ রাণু, সারগাছিতে তার পাঁচখানা
আমবাগান, সারাদিন আমগাছেই বসে থাকে। তার ছেলেটা বেজায় গুণী, ফ্রান্সে থাকে।
সেখানকার স্ট্রবেরী ক্ষেতে কাজ করে। সেখান থেকে ভিডিও কল করে, সে তার বাবাকে অবাক
করে দিয়েছিল। আজ থেকে বিশ-তিরিশ বছর আগেও, তোমাকে এমন কথা বললে, ঘাড় নেড়ে মুরুব্বি
চালে বলতে, “ইমপসিবিল”। কী? বলতে না?”
“না, না, সে ঠিক আছে। সেটা তো বিজ্ঞানের ব্যাপার! কিন্তু ছিল রুমাল হয়ে
গেল বেড়াল, এটা তো আর বিজ্ঞান নয়, নিছক মজার গল্প। তিন ইঞ্চি মানুষও তেমনি...”।
“তুমি তো ঘোড়ার ডিম কিছুই বুঝলে না। বলি ইন্দ্রনাথের নাম শুনেছো?
শোনোনি। ওর বাবা বড়োকর্তা নগেন্দ্রনাথের নাম? শুনেছো। যাক বাবা, আমার খাটনি একটু
কমলো। তাঁরই ছেলে, ইন্দ্র। দারুণ মাথাওয়ালা ছেলে। এখানকার স্কুলই হোক, কলকাতার কলেজ
কিংবা ব্যাঙ্গালুরুর বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি, কোনদিন সেকেণ্ড হয়নি। রিসার্চ করতে
বিদেশেও গিয়েছিল। রিসার্চ শেষে, ওকে চাকরি দেওয়া নিয়ে, ওখানকার বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো
লাইন লাগিয়েছিল ওর দরজায়। কিন্তু ওর পোষালো না। বলল, ওসব করে কী হবে? নতুন কিছু
করতে হবে। মানুষের সত্যিকারের কাজে লাগে এমন কিছু। এখানে ফিরে এল। পয়সার তো অভাব
নেই, বাড়িতেই ল্যাবোরেটরি বানিয়ে ফেলল। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক অনুরোধ চিঠিচাপাটি,
কলেজে কিংবা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করো, প্রফেসারি করো। না তো, না, গেলই না কোথাও!
ওর বাবাও আপত্তি করলেন না। একমাত্র ছেলে, চোখের সামনে থাকে
তো থাক না। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জমি জায়গা, ঘরবাড়ি, কোম্পানির কাগজ যা আছে,
তাতে খাওয়াপরার ভাবনা তো নেই! ঘরে বসে যা পারে করুক। তবে তিনি চেষ্টা করেছিলেন, ছেলের
বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিতে, ছেলে কিছুতেই মানলে না। শেষে বড়কর্তা চোখ বুঝতে
ইন্দ্রনাথ এখন ঝাড়া হাতপা। ওর সর্বদার সঙ্গী এখন ঝিঙে সর্দার আর ওই সতীশ। ঝিঙেদার
বাবা পটল সর্দার এ বাড়িতে এসেছিল খুব ছোটবেলায়। সেই থেকে সে ছিল বড়কত্তার
ছায়াসঙ্গী। তার ছেলে, ঝিঙেদাও এখন সেই বড়কত্তার ছেলেকে সর্বদা বুক দিয়ে আগলে রাখে।
মানে আমাদের ছোটকত্তা ইন্দ্রনাথকে।
তা এই ছোটকত্তার জন্যে আমাদের এই মফস্বল শহর, বকুলপুর ক্রমে ক্রমে বেশ
বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এখানকার পোস্টাফিস থেকে যতো বিদেশী চিঠিপত্র চালাচালি হয়,
কলকাতা ছাড়া আর কোন জেলায় হয় বলে আমার জানা নেই। আর আসে নানান বিদেশী লোকজন,
লালমুখো, ফ্যাকাসেমুখো, কালামুখো, মেমও এসেছে দু চারজন। গাড়ি হাঁকিয়ে আসে, সারাদিন
থেকে, কলকাতা ফিরে যায়, সেখান থেকে হিল্লিদিল্লি কোথায় উড়ে যায় কে জানে”?
“তার সঙ্গে এই তিন ইঞ্চি মানুষের কী সম্পর্ক, সে তো বুঝলাম না”?
“আরে ধ্যাত্তেরি, আমিও কি সবটা বুঝি নাকি, ছাতার মাথা? সে বুঝলে, আমিও
তো বিজ্ঞানী হয়ে যেতাম। তা হলে আর তোমার সঙ্গে ফালতো বকে এই কাল হরণ করতাম? তবে
হ্যাঁ এটুকু জানি, ওই তিন ইঞ্চি সতীশ তোমার আমার মতোই পাঁচফুট সাত-আট ইঞ্চির
প্রমাণ মানুষ ছিল, ছোটকত্তা কী সব ওষুধ দিয়ে তাকে ওইরকম একরত্তি বানিয়ে দিয়েছে”।
“সে কী? কেন”?
“সে খুব জটিল ব্যাপার। পৃথিবীতে এখন মানুষ তো বটেই, সব জীবজন্তুর থাকার
জায়গা, আর খাবারের খুব অভাব হচ্ছে। জঙ্গল সাফ করে, মানুষ চাষআবাদ আর বসতি
বাড়াচ্ছে, ওদিকে জঙ্গল ছোট হওয়ার জন্যে,
খাবারের সন্ধানে জন্তুজানোয়াররা বসতির মধ্যে চলে আসছে। কী ভজকট ব্যাপার বলো
দেখি? এ যেন সেই “রামে মারলেও মরণ আর রাবণে মারলেও মরণ” দশা। ঠিক কী না? এই
সমস্যার সমাধান হতে পারে, যদি মানুষ সমেত সব প্রাণিদের ছোট করে দেওয়া যায়। ধরো যে
ঘরে তিনজন মানুষ থাকতে পারে, সেই ঘরেই যদি চল্লিশ জন থাকে, তাহলে থাকার জায়গার
সাশ্রয় হয় কী না? কিংবা একটা জোয়ান ছোকরা দিনেরাতে একপো চালের ভাত, দশখানা রুটি,
তার সঙ্গে ডাল, তরকারি, মাছ-মাংস-ডিম খায়। পেটটা ছোট্ট হয়ে গেলে সে খাবারেই পনের-বিশ
জনের খোরাক হয়ে যাবে কী না? আরো চিন্তা করে দেখ, মানুষ ওরকম তিন ইঞ্চি হয়ে গেলে,
একটা উড়ো জাহাজে হাজার পাঁচেক লোক, কিংবা ট্রেনে লাখখানেক লোক বয়ে নিয়ে যাওয়া কোন
ব্যাপার হল? তাতে কত তেল, কত বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে! এই যে সব লোকে বলছে কয়লা আগামী
বিশ তিরিশ বছরের মধ্যে আর লোহা বছর চল্লিশের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সেগুলোও আরও দু
একশ বছর টেনে দেওয়া যাবে, নয় কী? এই ভাবে হাতি থেকে পিমড়ে, পুঁটি থেকে তিমি, চড়ুই
থেকে উটপাখি - সবাইকে ছোট্ট করে দিতে পারলেই, কেল্লা ফতে। সে যাকগে, এসব তোমাকে
বলে ফেললাম বলে, তুমি আবার যেন পাঁচকান করতে যেও না, হে। যতই হোক গবেষণা এখনো চলছে
তো, তাই ব্যাপারটা খুব গোপনীয়”।
“তা তুমি এত সব জানলে কী করে, ভাই? তোমার সঙ্গে ছোটকর্তার বুঝি খুব
দহরম-মহরম”?
“আরে না না, কিসে আর কিসে? ধানে আর তূষে! ওঁনারা নমস্য ব্যক্তি। আমাদের
সঙ্গে ওঁদের কী লেনা-দেনা। তবে হ্যাঁ আমার কাজটাও ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার মতো নয়। সেও
একপ্রকার গোপনীয় বৈকি”!
“ভালই তো! কাজটা কী, সেটা জানা যায় না”?
“না না, সে তেমন কিছু নয়। বড়ো মুখ করে বলার মতো তো নয়ই”।
“আহা, বড়ো মুখে নাই বা বললে, মুখটা হাল্কা ফাঁক করেও তো বলা যায়! যাকে
বলে চুপিচুপি”।
“তা বলা যায় বৈকি! তবে ওই ইয়ে... মানে আমার কাজের অনেক নাম, কেউ বলে
হাতটান, কেউ বলে চক্ষুদান, কেউ বলে হাতসাফাই। অনেকে তস্কর বলে, কেউ কেউ তো
নিশিকুটুম্বও বলে। তবে আমি অত বলাবলির মধ্যে থাকি না, নিজের সম্বন্ধে ঢাক পিটিয়ে
বলে বেড়াবো, সেও আমার পছন্দ নয়”।
“কী সর্বনাশ, তার মানে তুমি চোর?”
“আজ্ঞে, তাই বটে। তবে চোর বলে অবহেলা করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাটা আজকাল
তেমন কাজের কথা নয়। খানদানি চোরেরা আজকাল বড় বড়ো প্রাসাদে থাকে, দামি দামি গাড়িতে
চড়ে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কথায় আছে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী, কথাটা কিন্তু
মোটেই ন্যায্য হল না। আজকাল ধর্মের কাহিনী কে শোনে বল দেখি? তা বলে কী সবাই চোর?
অই দেখ, ও ভাই, চোর শুনেই হনহনিয়ে চললে কোথায়? হে হে হে হে, আতংকবাদী শুনলে বোধহয় মুচ্ছো
যেতে...”।
ব্যাঁকা
আঙুল
রাত সাড়ে আটটার সময় একটা কালো এসইউভি গাড়ি এসে দাঁড়াল লোহার মস্ত গেটের
সামনে। এই সময় মফস্বল শহরের এই অঞ্চলের রাস্তা এমনিতেই নির্জন থাকে। আজ আরও নির্জন, কিছুক্ষণ আগে
জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার জন্যে। হেডলাইট বার দুয়েক হাই-ডিপ করতে, গেটের
পাশের একটা গুমটি ঘর থেকে বের হয়ে এল, দশাসই চেহারার এক গুঁফো দারোয়ান। গেটের
সামনে এসে টর্চ জ্বেলে গাড়ির নাম্বার প্লেট আর ড্রাইভারের মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল,
“কৌন?”
ডানদিকের জানালার কাচ নামিয়ে ড্রাইভার গলা বের করে বলল, “মনোহারলালজির
সঙ্গে দেখা করতে, কলকাতা থেকে তিন জন
স্যার এসেছেন।” টর্চ নিভিয়ে লোহার গেটের একটা পাল্লা খুলে সেলাম ঠুকে দাঁড়িয়ে রইল
দারোয়ান। ড্রাইভারও ভেতরে ঢুকে কিছুটা গিয়ে, পর্চের নিচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্টার্ট
বন্ধ করল। গাড়ির দুপাশের দরজা খুলে নেমে এলেন তিনজন।
গাড়ি ঢোকার আওয়াজে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন সিড়িঙ্গে চেহারার এক ভদ্রলোক।
ড্রাইভারকে বললেন, “সোজা একটু গিয়েই বাঁদিকে পার্কিং লট আছে, গাড়ি নিয়ে আপনি
ওখানেই অপেক্ষা করুন”।
তারপর হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার করে বললেন, “আসুন ভেতরে আসুন। আমার
নাম বৃহৎরাম মলমল। আপনাদের জন্যে বড়োবাবু
ওয়েট করছেন”।
বাইরের লবি আর করিডরের আলোগুলো খুবই ম্লান। সেগুলো পেরিয়ে উজ্জ্বল ও
শীতল প্রশস্ত বসার ঘরে ঢুকে তিনজনেই খুব স্বস্তি পেলেন। বৃহৎরাম বললেন, “আপনারা
এখানে বসুন। বড়োবাবু এখনই আসছেন”।
তিনজন ভদ্রলোক সোফায় আরাম করে বসার পর, বৃহৎরাম বললেন, “ডিনারের তো
দেরি আছে, এখন কী লিবেন? চা, কফি, লস্যি, কোল্ড ড্রিংক্স...”। সবথেকে কমবয়সি
ভদ্রলোক, সব থেকে বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী নেবেন, স্যার? এই রাত্রে
লস্যি না খেয়ে, কফি নেওয়াই ভালো”।
চোখ থেকে চশমা খুলে বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “সেই ভালো, তার আগে এক গ্লাস
জল দেবেন। তা
ইয়ে...বৃহৎরামভাই, আপনি তো এদিককার লোক নন, কিন্তু খাসা বাংলা বলছেন। কে বলবে আপনি
বাঙালী নন। তবে “লিবেন”-এ এসেই ধরা পড়ে গেলেন যে!”
সবকটি দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন বৃহৎরাম, তারপর হাত কচলে বিনয়ের অবতার
হয়ে বললেন, “হে হে হে হে...আমি আসছি, স্যার... জল আর কফির ব্যবস্থা
করি...বড়োবাবুকেও খবর দিয়ে আসি...”।
আগন্তুক তিনজনেই কলকাতার বিখ্যাত এক জেনেটিক রিসার্চ সেন্টারের
বিজ্ঞানী। সকলের সিনিয়র যিনি, তিনি প্রফেসার বীরেন্দ্র ঘোষদস্তিদার, সংক্ষেপে
বিজিডি। জেনেটিক টেকনোলজিতে
তিনি দিকপাল। তাঁর জুনিয়র কলিগ সায়েন্টিস্ট একই বিষয়ের বিজ্ঞানী নাম, দুরন্তসূর্য সামন্ত,
সংক্ষেপে ডিএসটু। আর কনিষ্ঠজন রিসার্চ স্কলার – বছর দুয়েক হল ডিএসটুর আণ্ডারে রিসার্চ
করছেন। তাঁর নাম জীবক নাথ। ডিএসটু জীবককে খুবই স্নেহ করেন। তাঁর মতে
জীবক খুবই ব্রাইট ও প্রমিসিং ছেলে। অচিরেই তাঁদের জেনেটিক
রিসার্চ সেন্টারের একজন সম্পদ হয়ে ওঠার মতো সবকটি গুণই এই ছেলেটির মধ্যে রয়েছে।
ডিএসটু জীবককে জিজ্ঞাসা
করলেন, “কী বুঝছো, জীবক? কী মনে হচ্ছে?”
জীবক বললেন, “মালদার পার্টি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাড়িখানা কী,
যেন প্যালেস! এই বিদঘুটে জায়গায় এমন বাড়ি...ভাবাই যায় না”।
ডিএসটু বললেন, “কী জান জীবক, তুমি আমি যে সুবিধের কথা চিন্তা করে বড়ো
বড়ো শহরে থাকি, এই ধরনের বিজনেসম্যানদের কাছে সেগুলোই অসুবিধে। ধরো ওঁনার কোন
কারখানায় লেবার আনরেস্ট হল, কলকাতায় পনের কুড়িজন জড়ো হয়ে বাবুর বাড়ি ঘেরাও করতে
কতক্ষণ লাগবে? কিন্তু এখানে? অনেক কাঠখড় পুরিয়ে এই অব্দি পৌঁছনোর কথা কেউ ভাববেই
না, ঘেরাও করা তো দূরের কথা”।
জীবক বললেন, “তা ঠিক”।
ডিএসটু
আরও বললেন, “ধরো ইনকাম ট্যাক্স বা কোন বেআইনি কাজে পুলিশ কেস হল,
কলকাতায় হলে রাতারাতি বাড়িতে রেড হয়ে যেতে পারে। এখানে তেমন কোন রেড হওয়ার অনেক
আগেই উনি খবর পেয়ে, গা ঢাকা দেওয়ার অনেক সময় পেয়ে যাবেন। সব দপ্তরেই তো ওঁনার
লোকজন থাকে, তারাই সংবাদ দিয়ে দেবে”।
জীবক আর কিছু বলল না। এ ধরনের বড়োলোকদের শহর থেকে এত দূরে থাকার কারণটা
বুঝতে আর তাঁর বাকি রইল না। আর এও বুঝতে পারলেন, এই লোকটি শুধু ধনী ব্যবসাদার নন,
পাক্কা একটি ঘুঘু।
ডিএসটু ঘরের অত্যাধুনিক ইন্টিরিয়ার দেখতে দেখতে আরও বললেন, “তাছাড়াও কলকাতা
শহরের বুকে এত বড়ো জায়গা নিয়ে এমন প্রাসাদ বানানো, অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ বৈকি।
ওঁনার শত্রুপক্ষের পক্ষে ওঁর অতুল সম্পদের
আঁচ পেতেও কোন অসুবিধে হবে না। তাতে ওঁনার নানান বিপদ বাড়বে। কাজেই সকলের চোখের
থেকে দূরে এই নিরিবিলি নিশ্চিন্ত গরিবের কুটিরেই...”।
ডিএসটুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে এসে
ঢুকলেন, বিষ্ণুদাস মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া। গোলগাল বেঁটেখাটো চেহারা। নাকের নিচে ছোট্ট
সরু গোঁফ। ঘরে ঢুকেই হাতজোড় করে সকলকে নমস্কার করলেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে সকলেই
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, মনোহরলালজি সবিনয়ে বললেন, “বোসুন বোসুন, সমঝে লিন কি
এ আপনাদেরই ঘর। আসতে কোন ওসুবিধা হয়নি তো, ডিএসটু স্যার?”
ডিএসটু বললেন, “একদম না। তার আগে আপনার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে
দিই...”।
পরিচিত হয়ে সকলের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে
মনোহরলালজি বললেন, “আপনাদের আজ ইখানে আসার কারণ ডিএসটু স্যারের
কাছে নিশ্চয়ই শুনেছেন। লেকিন... আপনাদের এখনও কুছু দেয় নাই কিন?”
এইসময়েই বৃহৎরাম ঘরের মধ্যে ঢুকল ট্রলি নিয়ে।
চকচকে জলের জাগ থেকে জল ঢালল তিনটে গ্লাসে। তারপর এগিয়ে নিয়ে তিনজনের হাতে দিল।
তারপর তিনজনের জন্যে কফিমাগে কফি ঢালতে ঢালতে তিনজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“স্যার চিনি কতটা দেব?”
জীবক জল খেয়ে জলের খালি গ্লাসটা লক্ষ্য
করছিলেন। মেটাল বডি। দেখে তো মনে হচ্ছে সিলভার – রূপো!
পরিমাণ মতো চিনি গুলে সকলকে কফি দিয়ে এবং খালি
গ্লাসগুলো তুলে নিয়ে, ট্রলি সমেত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বৃহৎরাম। বিজিডি কফির মাগে
চুমুক দিয়ে বড়ো আনন্দ পেলেন, রোস্টেড ফিল্টার কফি...এর ফ্লেভার আর টেস্টের মেজাজই
আলাদা। তিনি মাগটা হাতে ধরে রেখেই বললেন, “মনোহরলালজি, এইবার কাজের কথায় আসা যাক”।
তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মনোহরলালজি
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “ইন্দরনারায়ণ চৌধুরিকে বীরেন্দরস্যার তো
চেনেন, আশা করি আপনারাও তাকে চিনেন”।
ডিএসটু সম্মতি জানালেন, আর জীবক ঘাড় নেড়ে
বললেন, “চিনি না, তবে নাম শুনেছি। রিসেন্টলি “মাইক্রো অ্যানিমেল” নামে একটা
যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। দেশে বিদেশে যা নিয়ে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেছে। কেউ বলছে
এই আবিষ্কার পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে। আবার অনেক বলছে এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধ
কাজ, পৃথিবীর জীবজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে”।
মনোহরলালজি খুব মন দিয়ে শুনছিলেন জীবকের কথা।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “লেকিন আপনি কী বোলেন?”
জীবক কিছুটা আবেগঘন গলায় বললেন, “পৃথিবীর
সর্বনাশের রাস্তা তো আমরা অনেকটাই সেরে এনেছি, ইন্দ্রবাবুর আবিষ্কারের ফল কী হয়
সেটা পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কী?”
মনোহরলালজি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “একদম সহি কথা
বোলিয়েছেন, জীবকবাবু। হামিও ওইটাই চাই। ইমোন একটা আবিষ্কার, ছোট্ট করে ট্রাই করতে
ক্ষতি কী? সাকসেস হল, তো খুব ভাল হল। না হলে যেমোন ছিল, আগের ওবোস্থায় ওয়াপ্স্...”।
ডিএসটু বললেন, “ইন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কথা
বলেছেন? সে কী বলছে?”
মনোহরলালজি বললেন, “ওনেকদিন ধরেই আমি
ইন্দরনারায়ণের পিছনে লেগে রয়েছি। হামার ওনেক জানাশোনা লোককে দিয়ে ওনার কাছে
ওনেকবার বিজিনেস প্রোপোজালভি ভেজিয়েছি। গত কাল হামি লিজেও গিয়েছিলাম, ডাইরেক্ট
আলাপ পরিচয় করলাম...”।
“তাই নাকি?” বিজিডি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বলছে,
ইন্দ্র?”
দুই হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে মনোহরলালজি বললেন,
“আপনারা বাংলায় “গোঁয়ার গোবিন্দ” বোলেন না? হে হে হে হে, উনি ওহি গোবিন্দ টাইপ।
আমার কোন বিজিনেস প্রোপোজালেই উনি রাজি হলেন না। হামার মোনে
হয়, উনি কোন বিদেশী মাফিয়ার সোঙ্গে হাত মিলিয়েছেন”।
জীবক বলল, “তাহলে উপায়? উনি যদি নিজের
আবিষ্কার অন্য কাউকে দিয়ে দিতে চান,
আমাদের কী করার আছে?”
মনোহরলালজি এবার খুব গম্ভীর হয়ে বললেন,
“আমাদের ওনেক কিছু কোরার আছে, জীবকবাবু, ওনেক। ইন্দরনারায়ণ হামার সোব প্রোপোজাল
“না” কোরে দিল। লেকিন হামি “না” কোথাটা পসন্দ করি না। সোজা আঙুলে তো ঘি ওঠে না
জীবকবাবু, আঙুল বেঁকাতে হয়। ওঁনার সোব ফরমুলা হামি জুগাড় করে লিয়েছি। এতদিন করি
নাই, কেন কি, হামি ও ফরমুলা লিয়ে কি করতাম! ইখন আপনারা আছেন, ওই ফরমুলা আপনাদের
হামি দিবে। আমরা একসোঙ্গে ওই ফরমুলা লিয়ে কাজ করবো। আপনাদের ব্রেন, হামার
ইনভেস্টমেন্ট। মুনাফা ফিফটি ফিফটি”!
জীবক বলল, “এটা যদি একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট
হয়, এর মধ্যে আবার মুনাফা আসছে কোথা থেকে?”
ডিএসটু বললেন, “একটা গ্রামের সমস্ত লোকজনকে তাদের গাইবাছুর
সমেত যদি একটামাত্র বড়োসড়ো বাড়িতে গুছিয়ে সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে কতটা জমিজায়গার
সাশ্রয় হবে বুঝতে পারছো, জীবক? সে জমিতে ফসল ফলিয়ে সমস্ত মানুষের খাদ্যাভাব
ঘুঁচিয়ে ফেলা যাবে অচিরেই! সেটাই তো আমাদের লাভ, তাই না...?”
জীবক এভাবে ব্যাপারটা চিন্তা করেনি। এখন বুঝতে
পেরে চমকে উঠে বাক্যহারা হয়ে গেল। তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। কী সাংঘাতিক
পরিকল্পনা। ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে জীবক অন্যমনস্ক হয়ে গেল, বিজিডি, ডিএসটু এবং
মনোহরলাল নিজেদের মধ্যে অনেক কথা আলোচনা করতে লাগলেন। সব কথা জীবকের কানে ঢুকল না।
১৪ + ২ = ১৪ (!)
দুপুরের দিকটায় খদ্দের-পাতি কমে আসে। দোকানে চাপটা একটু কম থাকায়,
টাকার ড্রয়ার খুলে নলিনবাবু নোট গুছোচ্ছিলেন। দশের জায়গায় দশ, পঞ্চাশে পঞ্চাশ,
একশতে একশ, এরকম গুছিয়ে ফেললে হিসেবের সুবিধে হয়। দশ-কুড়ি-পঞ্চাশ গুছিয়ে, সবে একশর
নোট গুছোতে শুরু করেছেন, সেই সময় কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে নলিনবাবুর
ভুরু কুঁচকে উঠল। সাবধানের মার নেই,
ক্যাশের ড্রয়ারটা বন্ধ করে, জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চাই?”
লোকটা সন্ধানী দৃষ্টিতে দোকানের ভেতরটা দেখতে দেখতে বলল, “আজ্ঞে, পাঁউরুটি”।
স্বস্তির শ্বাস ফেলে, নলিনবাবু, মুচকি হেসে বললেন, “পাঁউরুটি আমি রাখি
না। পাঁউরুটি ওই মোড়ের চায়ের স্টলে পাবেন”।
লোকটা কিন্তু বিদেয় হল না, ব্রেডের প্যাকেট দেখিয়ে বলল, “আজ্ঞে, এগুলো
বুঝি পাঁউরুটি নয়?”
“না, ওগুলো ব্রেড। মিল্ক, ব্রাউন, ফ্রুট - নানান রকমের হয়”।
“অ, একটা দিক কেলে নোড়ার মতো গোল আর অন্য দিকটা চৌকো হলে, পাঁউরুটি
বলে? চায়ের গেলাসে, ঘুগনির হলুদ ঝোলে চুবিয়ে খেতে মন্দ লাগে না, কিন্তু। তা একখান
করে ওই তিনটেই দেন দেখি”।
অন্য খদ্দের হলে, নলিনবাবু টাকা নেওয়ার আগেই খদ্দেরের সামনে জিনিষ
সাজিয়ে দেন, এখন দিলেন না। ব্যাটা প্যাকেট নিয়ে দৌড় লাগালে? এই নির্জন দুপুরে তিনি
দৌড়ে পারবেন? সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আর কিছু”?
লোকটা খিক খিক করে হেসে পাজামার পকেট থেকে একটা পাঁচশোর নোট বের করে,
নলিনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নেন, টাকাটা রাখুন। প্যাকেট হাতিয়ে পালাবো
ভাবছিলেন তো? ভালো ভালো জিনিষ কেনার সময় একটু ঘেঁটে ঘুঁটে দেখতে বেশ মজা লাগে, তাই
না?”
টাকাটা জাল কিনা, নলিনবাবুকে চেক করতে দেখে লোকটা খিক খিক করে হেসে আবার
বলল, “চেক করে নিন, চেক করে নিন। টাকাটা কোথায় পেলাম সেটা আবার জিজ্ঞাসা করবেন না
তো?”
নলিনবাবু এবার একটু অপ্রতিভ হলেন, তাড়াতাড়ি ড্রয়ারে টাকাটা রেখে বললেন,
“আরে না না, ছি ছি, কী যে বলেন! আর কী দেব বললেন না তো?” তিন প্যাকেট ব্রেড লোকটার
সামনে রেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
লোকটি খুব মজা পাওয়া মুখে বলল, “একটা জ্যামের শিশি, আরেকটা মাখনের
প্যাকেট!”
ফ্রিজ থেকে বাটারের প্যাকেট বের করে, কাউন্টারে রাখতে রাখতে নলিনবাবু
বললেন, “কোন জ্যাম? মিক্সড্ ফ্রুট, পাইন্যাপেল্, ম্যাংগো, নাকি অরেঞ্জ মার্মালেড”।
“ম্যাংগো মানে আম, আর অরেঞ্জ মানে কমলালেবু, তাই না? ও দুটোই দিন।
পাইনা ফল, আর একটা কী বললেন, ওগুলো চাই না”। নলিনবাবু দুটো জ্যামের
বোতল বের করে, কাউন্টারে রাখলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “আর কিছু?”
লোকটা ফিচেল হেসে বলল, “হিসেব করে দেখে নিন, পাঁচশোর বেশি হয়ে
যায়নি, তো?”
“আরে না, না, সে ঠিক আছে, আর কী চাই বলুন না”।
“কেঁচোর মতো, কিন্তু কিলবিল করে না, জলে সেদ্ধ করে আজকাল ছেলেমেয়েরা
খুব খায়...”।
“অ নুড্ল্স্, ক প্যাকেট?”
“আট দশ প্যাকেট দিন না”
“দশ প্যাকেটের দামে বারো প্যাকেটের অফার আছে, সেটা দিই? দু প্যাকেট
ফ্রি”।
“তাই দেন। তবে রোদ-বৃষ্টি-হাওয়া ছাড়া ফিরি বলে কিছু হয় নাকি? আগে
আরেকটা জিনিষও ফিরি হত - মা বোনের আদর যত্ন, ইদানীং সেটাতেও কিছু ঘাটতি হচ্ছে...”
খদ্দের লক্ষ্মী, তার সঙ্গে তর্ক মানায় না, নলিনবাবু হে হে হে অমায়িক
হেসে বললেন, “তা যা বলেছেন, আর কিছু?”
“এই থাক এখন, কত হল হিসেব জুড়ে দেখুন না...”।
“কত আর হবে...ক্যালকুলেটরে হিসেব করতে করতে বললেন...ছশো আটাত্তর
হয়েছে...”
“বাঃ, তেমন বেশি কিছু হয়নি তো”? লোকটা আরেকটা পাঁচশোর নোট এগিয়ে দিয়ে
বলল, “একটা বড় দুধের প্যাকেট, আর এক বাস্কো কন ফেলেক্স হয়ে যাবে, বাকি পয়সায়?”
বড়ো প্লাস্টিকের ব্যাগে সব জিনিষ গুছিয়ে ভরে, আরেকবার হিসেব করে, ফেরত
পয়সা দিয়ে নলিনবাবু অমায়িক হেসে বললেন, “আবার আসবেন”।
লোকটাও একগাল হেসে বলল, “আসতে পারলে ভালো হতো বৈকি! আজকের দিনে এমন
উপকার কেউ করে? আসি?”
এই অসময়ে, দোকান বন্ধ করার আগে এত টাকার বিক্রিতে নলিনবাবু বেশ খুশিই হলেন। আজকাল শুধু চেহারা আর আচার আচরণে লোক চেনা যায় না। এমন সজ্জন দিলদরিয়া খদ্দের বড়ো দেখা যায় না। অন্য খদ্দের এত টাকার জিনিষ কিনলে, দশ-পনের টাকা ডিস্কাউন্ট নেওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি করে। এ ভদ্রলোক, দাম শুনে কোন উচ্চবাচ্যই করল না! ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পর, নলিনবাবু আবার টাকার গোছ নিয়ে বসলেন। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশর নোট গোনা শেষ করে দেখলেন, পাঁচশোর নোট দুটো কম পড়ছে। ড্রয়ারটা পুরোটা টেনে, ভেতরে দিকে কোন ফাঁকে আটকে গেছে হয়তো, কিংবা হতে পারে, মেঝেয় পড়ে গেছে, অথবা ফতুয়ার পকেটে...। কিন্তু নাঃ কোত্থাও নেই। এই খদ্দের আসার বেশ খানিক আগে তিনি সুলভ শৌচালয়ে গিয়েছিলেন। যাবার সময় অন্যদিনের মতোই পাশের দোকানের পশুপতিবাবুকে দোকানের দিকে চোখ রাখতে বলেছিলেন, আর বড়ো নোটগুলো ফতুয়ার পকেটে ভরে সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, চোদ্দটা পাঁচশর নোট ছিল। সেক্ষেত্রে এখন ষোলোটা পাঁচশ হওয়ার কথা, কিন্তু না নেই, পাঁচশর নোট চোদ্দটাই রয়েছে! অথচ ভদ্রলোক দুটো পাঁচশোর নোট যে দিয়েছে, তাতে নলিনবাবুর কোন সন্দেহ নেই! তাহলে, ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?
হংসপাখায় জল
“ঝিঙেদা, ও ঝিঙেদা, একটু জল খাওয়াবে গো?” ভেতরের ঘরের চৌকিতে শুয়েছিল এবাড়ির
ছোটকর্তা ইন্দ্র, আর চৌকির পাশে মেঝেয় ঝিঙেদা। ঝিঙেদার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙলেও
আলস্য যাচ্ছিল না। মেঝে থেকে ঘাড় তুলে দেখেছিল, ছোটকর্তা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাই আর
ওঠেনি, গভীর তন্দ্রায় আবার নিজেকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। এখন ছোটকর্তার ডাকে
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল, “এই দেই, ছোট বাবু”। মেঝের বিছানা চটপট গুটিয়ে তুলে দিয়ে ঝিঙেদা জল এনে দেখল,
ছোট কর্তা বিছানাতে উঠে বসেছে।
জলের গেলাসটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝিঙেদা বলল, “এই লাও”।
গেলাসটা খালি করে, আরামের আঃ বলে ইন্দ্র গেলাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ঝিঙেদা,
গা-হাত-পায়ের ব্যথাটা মনে হচ্ছে কমেছে, তাই না?”
“হ্যাঁ, কত্তা। কাল রাত্তিরেও লড়তেচড়তে পারছিলাম না। আজ একটু চাঙ্গা
ঠেকছে”।
“কিন্তু ঘরে খাবার দাবার কিছু আছে? নাকি বাড়ন্ত। খিদেয় যে পেটে আগুন
লেগেছে গো”!
“খিদের আর দোষ কী? তিনদিন ধরে যা চলছে, ঘরের বাইরে তো বেরোতেই পারছি না”।
“আজকে কী পারবে? দেখ না, ভরপেট না খেলে শরীর আরো দুর্বল হয়ে উঠবে যে”।
“সে তো বুঝছি কত্তা, কিন্তু এই অবেলায় বাজার তো বন্ধ হয়ে গেছে।
সাড়েপাঁচটা–ছটার আগে তো দোকানপাট খুলবেনি”।
“তাহলে উপায়? ফ্রিজে কিছু নেই?”
“উঁহু, কাল রাত্তিরেই সব শেষ হয়ে গেছে। তুমি উঠে মুখ হাত ধোও, আমি
বেরিয়ে দেখি কিছু পাই কিনা!”
“সতীশ আর বল্টু কোথায়? ওদের সাড়া পাচ্ছি না”।
“দুজনেই বসে আছে, ঘরের ওই কোণে। ওরাও খিদেয় নিজ্জিব হয়ে গেছে মনে হয়”। বল্টু করুণ চোখে ছোটকত্তা
আর ঝিঙেদার দিকে তাকিয়ে, খুব মিহি গলায় ডাকল, “ভুখ্”।
ঝিঙেদা বাইরে যাওয়ার ফতুয়া পরতে পরতে বলল, “ভুখ তো বুঝছি, বাবা। একটু
দাঁড়া, তোর ওই ভুখের কোন ব্যবস্থা করতে পারি কি না, দেখি!”
এই সময়, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। খুব একটা জোরে নয়, একটু যেন
সন্তর্পণে।
ইন্দ্র খুব বিরক্ত মুখে বলল, “এখন আবার কে এল রে, বাবা? জ্বালালে দেখছি”!
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায়, চমকে উঠে বলল, “অ্যাই শোন ঝিঙেদা, হুট করে দরজা
খুলবি না। সাড়া নিয়ে, দরজার ফুটো দিয়ে দেখে তবেই খুলবি। মনোহরব্যাটা বা তার কোন
লোকজন এলে মোটেই দরজা খুলবি না”।
“আচ্ছা, আচ্ছা। দেখছি। মনোহরের ওপর তোমার এত রাগ কেন”? আবার কড়া নাড়ার
শব্দ হল, এবার একটু জোরে।
“ওই হতভাগার জন্যেই আমাদের এই দশা। তুই আগে দেখে আয়, কে। পরে বলছি”।
ঝিঙেদা প্রথমেই দরজা খুলল না, ফুটো দিয়ে দেখল। অখাদ্য চেহারার চিমসে
অচেনা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বড়ো প্লাস্টিকের ব্যাগ। ঝিঙেদা খুব গম্ভীর
গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কাকে চাই?”
চিমসে লোকটা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকে চাই হুট করে বলা
মুশকিল। ছোটকত্তাকেও চাই, আবার ঝিঙেদাকেও চাই। রাত্তির হলে দরজায় আসতাম না। দিনের
বেলা তো, তাই দরজা ছাড়া উপায় নেই। পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকলে, পাড়ার লোকজন দেখে ফেলত এবং
বেজায় হৈ চৈ পড়ে যেত। দরজাটা খুললে খুব ক্ষতি হবে না, আজ্ঞে। বরং ভালোই হবে বলা
যায়”।
ঝিঙেদা দরজার হুড়কো নামিয়ে খুলে দিল। অখাদ্য চেহারার লোকটা ভেতরে এসে
বলল, “ছোটকত্তা কোথায়, ঝিঙেদা?”
অচেনা লোকের মুখে নিজের নাম শুনে খুব অবাক হল ঝিঙেদা, বলল, “ভেতরে এসো।
ছোটকত্তা ঘরে আছেন।” সদর দরজা বন্ধ করে ঝিঙেদা লোকটাকে নিয়ে ভেতরে এল। ছোটকত্তার ঘরে ঢুকেই
লোকটা মস্তো একটা নমস্কার ঠুকল, তারপর প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে এক এক করে অনেক
জিনিষ বের করে ছোটকত্তার সামনে বিছানার ওপর রাখল। তিন প্যাকেট ব্রেড। দুটো জ্যামের
বোতল, বাটারের প্যাকেট। নুড্ল্স্, দুধ আর কর্ন ফ্লেক্সের প্যাকেট। তারপর নিচু
হয়ে বলল, “পেন্নাম হই, ছোটকত্তা। তিনদিন ধরে বড্ডো কষ্টে রয়েছেন। ঘরে খাবার
দাবারের বাড়ন্ত। আমরা থাকতে আপনার মতো লোক অভুক্ত থাকবেন, এ হতে পারে? সামান্য
কিছু আহার করে উপবাস ভঙ্গ করুন, আজ্ঞে”। বিছানার ওপর সাজানো খাবার দেখে সবারই খিদে চনমন করে উঠল,
ছোটকর্তা ইন্দ্রেরও! কিন্তু উটকো লোকটার এই গায়ে পড়া উপকারে ইন্দ্রর মনে সন্দেহ
হল, বলল,
“আপনি কে,
চিনতে পারলাম না তো? আর এতো খাবারই বা কে পাঠালো?”
লোকটা বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে, সে সব অনেক বেত্তান্ত! আপনার
বাপ-ঠাকুরদার সময় হলে বলতাম, আমি আপনাদের এক অনুগত প্রজা। আর আমার মতো তুচ্ছু
লোককে আপনি-টাপনি বলে লজ্জা দেবেন না, ছোটকত্তা। আপনারা সেবা করুন, আমি দেখে চক্ষু
সাত্থক করি। খেতে খেতে সব কথাই বলবো, ছোটকত্তা, কিচ্ছু লুকোবো না।” ছোটকর্তা ইশারা
করতে, ঝিঙেদা প্যাকেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরে গেল। বল্টুর পিঠে চেপে সতীশও গেল,
ঝিঙেদার পেছন পেছন।
ওরা চলে যেতে ছোটকর্তা বলল, “দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো না। তোমার নামটাও
তো বললে না ভাই।”
লোকটা ঘরের এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেয় উবু হয়ে বসে, বলল, “আজ্ঞে,
অধমের নাম নেত্তানন্দ, নেত্তানন্দ তস্কর”।
“তস্কর? ও আবার কী নাম হল? এমন তো শুনিনি কখনো!”
“আজ্ঞে, ছোটকত্তা এ সব আপনার, আমার জন্মের অনেক আগেকার ঘটনা। আমার
পিতৃদেবের মুখে শুনেছি, আপনার ঠাকুরদাদা, আমার ঠাকুরদাদাকে ওই উপাধি দিয়েছিলেন।”
“তাই নাকি? চুরি করাটা একটা প্রাচীন জীবিকা ঠিকই, কিন্তু সেটার জন্যে
উপাধি পাওয়া যায় এমন শুনিনি।”
“আজ্ঞে সে রাজ্যও নেই, আর সে সব রাজারাও নেই! রাজ্যপাট চালাতে গেলে কত
ধরনের লোক যে কাজে আসে, সে কী আমার মতো মুখ্যু মানুষের বোঝার কথা? তবে ছোটকত্তা
একখান মিনতি, আমরা বেশ কিছুদিন তস্করের বদলে দাস নামটাই ব্যাভার করি। সেও ওই
রাজকর্মের গোপনীয়তার জন্যে। আপনার কাছে সত্য বৈ মিথ্যে বলব না, কয়েকপুরুষ ধরে
আপনাদের নিমক খেয়েছি বলেই, আপনাকে সব কথা খুলে বললাম। আপনাকে এটুকু গ্রান্টি দিতে
পারি, ছোটকত্তা, শরীলে যে পজ্জন্ত ক্ষমতা থাকবে আপনার উপকার বৈ অপকার করবনি।”
ইন্দ্র খুব মন দিয়ে লোকটার কথা শুনছিল। লোকটা পাক্কা ধড়িবাজ আর চালিয়াৎ
তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই এখন যে কথাগুলো বলল, সেটা বোধহয় সত্যিই বলল।
সেক্ষেত্রে এই লোকটা তার খুব কাজে আসবে। ইন্দ্র লোকটাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্যে
বলল, “তা ভাই, নিত্যানন্দ দাস। বাড়িতে কদিন ধরে আমাদের শরীর খারাপ, রান্নাবান্না
হচ্ছে না, ঘরে খাবার বাড়ন্ত, এ খবরটা তোমাকে কে দিল? আর এই যে গাঁটের কড়ি খরচ করে,
একগাদা খাবার কিনে আনলে, সেটাই বা কার বুদ্ধিতে? বলি মনোহরলাল ঘংঘোরিয়ার হয়েও কী
তোমায় কাজকর্ম করতে হয় নাকি?”
নিত্যানন্দ হাত খানেক জিভ বের করে বলল, “নেত্ত দাস, নিজের মর্জির
মালিক। এক আপনাদের ছাড়া কারো অধীন নয়। মনুঘংঘোরের বাড়ি আমার যাওয়া আসা আছে, তবে সে
নিশাকালে, আমার পেটের ধান্দায়। আপনাদের বিশাল বাড়ির পেছনের একটা ভাঙাচোরা ঘরে আমার
একটা আস্তানা আছে। বড়ো কোনো কাজকম্মো হলে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, কদিন গা ঢাকা
দেবার জন্যে ওখানে উঠি। গত কদিন থেকেই রয়েছি, আজ্ঞে। আপনাদের হাল-অবস্থার দিকে আমার
নজর ছিল”!
“বড়ো কাজকম্মো মানে? বড়োসড়ো চুরি? চুরি করে আমাদের বাড়ির পেছনে আস্তানা
গেড়েছো! চোরাই মালও রাখছো নাকি? সর্বনাশ, পুলিশ এলে আমাদের নিয়েও টানাটানি করবে
যে!”
“ছিছি তাই কোনদিন করতে পারি কত্তা? চোরাই মাল পাচার করেই এখানে এসে
ঘাপটি দিয়ে গা ঢাকা দেই। আপনাদের বদনামের কাজ কক্ষণো করবো না, ছোটকত্তা, এটুকু
বিশ্বেস এই নেত্ত দাসের ওপর করতে পারেন”।
ঝিঙেদা এই সময় দুটো বড়ো বাটিতে করে গরম নুডলস্ বানিয়ে নিয়ে এলো। একটা
রাখল ইন্দ্রর সামনে, আরেকটা নিত্যানন্দের সামনে, বলল, “গরম থাকতে খেয়ে নাও দিকি।
কটা করে বাটার টোস্টও আনছি”।
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করল, “সতীশ, বল্টুকেও দিয়েছো তো?”
“হ্যাঁ গো, দিয়েছি। ওরা খাচ্ছে, তুমি খাও দেখি।”
“আর তুমি?”
“খাচ্ছি গো, খাচ্ছি। তোমার টোস্ট কটা এনে দিয়ে, আমারটাও নিয়ে আসছি।”
ঝিঙেদা ভেতরে চলে যেতে ইন্দ্র হাতে বাটি নিয়ে, কাঁটা চামচে এক গ্রাস মুখে তুলতে
গিয়েও থমকে গেল, বাটিতে চামচ রেখে বলল, “নিত্যানন্দ, এ তার মানে তোমার চুরির পয়সায়
কেনা? এ খাবার তো আমি খেতে পারবো না”।
নিত্যানন্দ মাটিতে গড় হয়ে শুয়ে প্রণাম করল ইন্দ্রকে, তারপর উঠে বসে
বলল, “রাজার মতোই মোক্ষম কথা বলেছেন, ছোটকত্তা। চুরির পয়সায় কেনা খাবার খাওয়া,
আপনার কোনমতেই উচিৎ হয় না। তবে বিবেচনা করে দেখুন, আপৎকালে নিয়মের একটু নড়চড় হলেও
খুব অন্যায্য হয় না। জীবন রক্ষার থেকে বড়ো আপৎকাল আর কী হতে পারে? আর এই টাকা
যদি আপনি ফেরত দিয়ে দেন, তাহলে আর সেটা চুরির টাকাও থাকল না। আপনার সামান্য যে
দোষটুকু, হংসের পাখায় জলের ফোঁটার মতো, ঝেড়ে দিলেই ঝরে যাবে, ছোটকত্তা।”
ইন্দ্র হেসে ফেলল নিত্যানন্দের কথায়, এক চামচ নুডলস্ মুখে নিয়ে বলল, “খাওয়ার
পর তোমার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করা দরকার নিত্য। আমাদের খুব বিপদ। তোমার সাহায্য
কাজে লাগবে মনে হচ্ছে”।
“আপনার যে কোন কাজে লাগতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো, ছোটকত্তা”।
“ভেরি গুড”। চিন্তিত মুখে নুডলস্ খেতে খেতে ইন্দ্র বলল, “কিন্তু
সেক্ষেত্রে তোমাকে চুরিটুরি ছাড়তে হবে”।
নিত্য একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান হলে, ও
আর এমন বেশি কথা কী, ছোটকত্তা? ছেড়ে দিলেই হল”।
“সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে, নিত্য। এ বাড়িতে ঘরের অভাব নেই, ইচ্ছে হলে এখানেই থাকবে। আর আমাদের দুবেলা দুমুঠো জুটলে, তোমারও জুটে যাবে। চিন্তা করো না”।
ঘন ঘোর ঘংঘরিয়া
অত্যন্ত খিদের পর প্রচুর খাওয়া দাওয়া করে সকলেই বেশ একটু ধাতস্থ হল।
হাতেপায়ে যেন জোর আসতে লাগল। ঝিঙেদার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ইন্দ্র বলল, “ঝিঙেদা,
তিনদিন ওপরের ঘরে যাওয়া হয়নি। কী অবস্থা চল তো একবার দেখে আসি”।
ঝিঙেদা একটু রাগ রাগ স্বরেই বলল, “তোমার আর তর সইছে না? অবস্থা আবার কী
হবে? তিনদিন পর এই সবে উঠে বসেছ, উদরে একটু তল পড়েছে, এখনই ওপরে যেতে হবে?”
ইন্দ্র একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “আঃ ঝিঙেদা, তুই বুঝছিস না। আমাদের এই
শরীর খারাপ হওয়াটা সাধারণ অসুখ নয়। আমার ধারণা গভীর কোন ষড়যন্ত্র। সেক্ষেত্রে
ওপরের ঘরগুলো ঠিকঠাক থাকলে, বেশ আশ্চর্যই হবো! চল চল, চট করে একবার ঘুরে আসি। যদি
সব ঠিক থাকে, তাহলে আমার সন্দেহটাও দূর হয়ে যাবে!”
ইন্দ্র বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোলো। এই ঘরের বাইরে লম্বা দালান,
সেটা পেরিয়ে বাঁদিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি।
নিত্যানন্দ দাস মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি তবে এইখানেই রইলাম
কত্তা, ওপরে যাওয়াটা আমার বোধহয় ভালো দেখায় না”।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে দালানে পা রাখতে রাখতে ইন্দ্র একটু চিন্তা করে বলল,
“তুমিও ওপরে আসতে পারো, নিত্য। আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। বললাম না, তোমাকে দিয়ে
আমার কিছু কাজ হতে পারে। তুমি থাকলে হয়তো আমার সুবিধেই হবে”।
নিত্য বিগলিত মুখে নমস্কার করে বলল, “আপনার এই বিশ্বেসের কদর যেন আমি
রাখতে পারি, এই আশীর্বাদ করেন, কত্তা। আপনার সঙ্গে অবিশ্বেসের কাজ করলে, আমার
বাপ-পিতেমো আমাকে আস্ত রাখবে ভেবেছেন?”
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ইন্দ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার
বাপ-ঠাকুরদা এখনো বেঁচে আছেন নাকি?”
তার উত্তরে দুঃখ মাখানো স্বরে নিত্য বলল, “না কত্তা, তেনারা বহুদিন গত
হয়েছেন, আজ্ঞে! তবে আমার প্রমায়ু শেষ হলে সেই সেখানেই তো যেতে হবে, আজ্ঞে, তেনারা
যেখানে আছেন! আমি এখানে আপনার বিঘ্ন করলে, তখন তেনারা আমাকে ছাড়বেন, কত্তা? পিটিয়ে
পিঠের ছাল তুলে দেবেন না?”
ইন্দ্র নিত্যর কথায় বেশ মজা পাচ্ছিল, মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করল, “সবই তো
বুঝলাম, নিত্য, কিন্তু তোমার ওই প্রমায়ু ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হল না। গোমায়ু মানে
শেয়াল জানি কিন্তু প্রমায়ু মানে কী?”
একগাদা দাঁত বের করে নিত্য হাসল, মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে যারে কয় আয়ু,
তারেই কয় প্রমায়ু”।
ইন্দ্র খুব জোর হেসে উঠল হো হো করে, তারপর বলল, “ওঃ, পরমায়ু! তাই বলো”।
কথা বলতে বলতে তারা তিনজনেই ওপরের টানা বারান্দা দিয়ে হেঁটে ইন্দ্রর পড়ার ঘরের সামনে দাঁড়াল। এই ঘরের পাশেরটা ইন্দ্রর শোবার ঘর। দুট ঘরেরই শেকল তোলা বন্ধ দরজা দেখে ইন্দ্র এবং ঝিঙেদা একটু স্বস্তি পেল। ঝিঙেদা বলল, “লাও, সেদিন যেমন শেকল তুলে নিচেয় গেছিলে, তেমনই আছে। এবার শান্তি হল তো? তোমার ওই ঘরে কী যে ঘোড়ার ডিম আছে, কে জানে বাপু। চোরের চুরি করার আছেটা কী, শুনি?” শেকল খুলে ইন্দ্র ঘরে ঢুকল, ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে তেমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না।
বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “সব চোর কী আর টাকা-পয়সা, সোনা-দানা চুরি করে,
রে ঝিঙেদা? আরো কত কী থাকে চুরির জিনিষ, সে সব তোর সরল মাথায় না ঢোকাই ভালো”।
বেজার মুখ করে, ঝিঙেদা বলল, “তুমি কী তাহলে এখন ওপরেই থাকবে, নাকি
নিচেয় যাবে? আমি বাজারে যাবো যে। ঘরে তো সবই বাড়ন্ত। অনেক কিছু আনতে হবে”।
“তুই যা না, বাজার করে নিয়ে আয়। টাকা-পয়সা আছে তো?”
“টাকা -পয়সা আছে। কিন্তু, তুমি আর এই শরীলে এখন কাজে বোসনি বাপু, বরং
পাশের ঘরে নিজের বিছানায় একটু গড়িয়ে নাও দেখি”।
“আচ্ছা, আচ্ছা, সে আমি দেখছি, তুই আর বেশি পাকামি করিস না ঝিঙেদা। আমার
শরীর এখন ফার্স্টক্লাস আছে। তুই বরং চট করে বাজার থেকে ঘুরে আয়। আর ফিরে এসে,
আমাকে এক কাপ কফি করে দিস”।
“আমার কতা তুমি কবে আর কানে তুলেছো? যা ভালো বোজো, কর। আমি চললাম।”
“আয়”।
নিত্য এতক্ষণ দুজনের কথা শুনছিল, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে, ঝিঙেদা ঘরের
বাইরে আসতে বলল, “হাজারটা টাকা, দেবেন কত্তা” তারপর ফতুয়ার পকেটে হাত ঢুকিয়ে, কিছু
নোট আর খুচরো বের করে ঝিঙেদার হাতে দিয়ে বলল, “এই হচ্ছে, হাজার টাকার ফেরৎ। দুপুরে
কিছু টাকার সংস্থান করে আপনাদের সামান্য কিছু খাবার যোগাড় করেছিলাম, কত্তা! তবে সে
কিনা পাপের রোজগার, আমার সহ্য হলেও আপনাদের হবে না”।
ইন্দ্র ব্যাপারটা ভুলেই গেছিল, ঝিঙেদার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর কাছে
আছে, ঝিঙেদা? নিত্যকে এখনই ওই টাকাটা দিয়ে দে। আর নিত্য তুমিও ঝিঙেদার সঙ্গে
যাও, বাজার সেরে ফিরে আসবে, তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
“আসবো কত্তা, নিচ্চই আসবো, আপনার সেবা করতে পারলে...”।
অধৈর্য হয়ে ঝিঙেদা বলল, “হয়েছে, হয়েছে, এখন চলো দিকি, আর বেশি বকতে
হবেনি”।
ওরা চলে যাওয়ার পর ইন্দ্র পড়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে, দরজা খুলে পাশের
শোবার ঘরে ঢুকল। এ ঘরের অবস্থাও ঠিকই আছে। চারদিকে বইয়ের স্তূপ, খাতা, ডাইরি
নোটবুক। বিছানার ওপর ডালা খোলা ল্যাপটপ। তিনদিনের অব্যবহারে কি বোর্ডের ওপর পাতলা
ধুলোর আস্তর। আলতো হাতে ধুলোটা মুছে নিয়ে, ল্যাপটপটা চালু করল ইন্দ্র। পর্দায়
উইনডোজের লোগো আসতে দেখে বুঝল, ল্যাপটপ ঠিকই আছে। অবিশ্যি তার ল্যাপটপ পাসওয়ার্ড
দিয়ে লক করা আছে, চট করে খুলে ফেলা সহজ নয়। বিছানার পাশে একটা কাঠের আলমারি, তার
পাশে একটা স্টিলের ক্যাবিনেট। আলমারিটা বহুদিনের পুরোনো, হয়তো এই বাড়ির সমসাময়িক।
বার্মা টিকের বানানো বলেই এতদিন সুন্দর টিকে আছে। ওই আলমারিতে তার জামকাপড় থাকে।
ওটা ঝিঙেদাই গুছিয়ে রাখে। ওর ভেতরে গোপন একটা বাক্সে সংসারের টাকা-পয়সা থাকে, তার
চাবি কোথায় থাকে, সেটা জানে তারা দুজন - সে আর ঝিঙেদা।
স্টিলের ক্যাবিনেটটা বছর দুয়েক আগে ইন্দ্রই কলকাতা থেকে আনিয়েছিল। বড়ো
কোম্পানির জব্বর জিনিষ। ক্যাবিনেটের চাবিটা কোথায় থাকে, সেটা ঝিঙেদা জানে। কিন্তু
সে কোনদিনই ওটা খোলে না। ওটার খোলা-বন্ধ করে ইন্দ্রই। কী মনে হতে, লুকোনো জায়গা
থেকে চাবিটা বের করে, ইন্দ্র ক্যাবিনেটটা খুলল। ওপরের ড্রয়ারের মধ্যেই তার সব থেকে
জরুরি ফাইলগুলো থাকে। সাদা রঙের প্লাস্টিকের অনেকগুলি ফোল্ডার, তার মধ্যেই তার গবেষণার কাগজপত্র
থাকে। প্রত্যেকটা ফোল্ডার তুলে ওপর ওপর চোখ বুলিয়ে চেক করে দেখল। নাঃ, সবই ঠিকই
আছে, যে সন্দেহটা সে করছিল, সেটা বোধ হয় অমূলক!
ক্যাবিনেটের থেকে একটা ফোল্ডার নিয়ে, ইন্দ্র ল্যাপটপে বসল। তার আর
ঝিঙেদার অসুস্থ হওয়ার আগের রাত্রেও এই ফাইলটা নিয়েই, অনেক রাত অব্দি সে কাজ করেছিল। ডি ড্রাইভের নির্দিষ্ট
ফোল্ডার খুলে সে তিনটে ফাইল খোলার জন্যে পরপর তিনবার ডাব্ল্ ক্লিক করল। তিনটে
ফাইলই বেশ বড়ো। খুলতে একটু সময় লাগবে। পর্দার ওপর নীল চাকা ঘুরতে লাগল দেখে,
ইন্দ্র হাতের ফোল্ডার থেকে কাগজগুলো বের করল। আর তখনই তার ব্যাপারটা নজরে এলো।
প্লাস্টিকের ফোল্ডারে মোট আটত্রিশটা স্টেপ্ল্ড্ করা পৃষ্ঠার প্রিন্টআউট রাখা
ছিল। ইন্দ্র গুণে দেখল আটত্রিশটাই আছে, কিন্তু সেগুলো সিরিয়ালি সাজানো নেই! এটা
অসম্ভব। কারণ এই প্রিন্ট আউটগুলো সে নিয়েছিল বেশ কদিন আগে। প্রিন্ট আউট নেওয়ার
পরেই সেগুলো স্টেপল করেছিল এবং তারপরে এই কাগজগুলো নিয়ে বেশ কদিন সে কাজও করছিল।
তখন নিঃসন্দেহেই সাজানো ছিল! সাধারণতঃ পেজ
নাম্বার ইনসার্ট করেই ইন্দ্র প্রিন্ট নেয়, কিন্তু এই কাগজগুলোর প্রিন্টের সময় সে
পেজ নাম্বার দিতে ভুলে গেছিল। কিন্তু তাতে অসুবিধা হয়নি, কারণ প্রিন্টার কখনো
এলোমেলো, র্যাণ্ডাম সিরিয়ালে প্রিন্ট করে না! তাহলে? এখন এমন হল কি করে? কেউ কী
স্টেপল খুলেছিল, তারপরে সিরিয়াল নম্বর না থাকায় সাজাতে পারেনি?
স্টেপ্ল্ করা জায়গাটা খুব খুঁটিয়ে দেখল ইন্দ্র। সাধারণ স্টেপ্লারে
আটত্রিশটা পৃষ্ঠা স্টেপ্ল্ করতে বেশ জোর লাগে, ঠিক মতো না হলে, পিনের পেছনদিক
ঠিকমতো ভাঁজ হয় না। ইন্দ্র খুব মন দিয়ে দেখে বুঝতে পারল, স্টেপ্ল্ খোলা হয়েছিল,
তারপর আবার একই পয়েন্টে স্টেপ্ল্ করার চেষ্টা করলেও সেটা নিখুঁত হয়নি, সামান্য
সরে গেছে। কে খুলেছিল এবং কেন? সে কি এই ডকুমেন্টগুলো কপি করেছে? করতেই পারে, কারণ
ও ঘরে তার থ্রি-ইন-ওয়ান প্রিন্টার আছে, যাতে প্রিন্ট, স্ক্যান ও কপি করা যায়!
সেখান থেকে কপি করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অথবা ক্যামেরায় ছবি তুলে নিতে পারে।
আজকাল সবার হাতেই স্মার্টফোন থাকে, তাতে ছবি তুলে, যাকে খুশি পাঠিয়ে দেওয়া যায়!
যেভাবেই হোক তার ডকুমেন্ট্স্ পাচার হয়ে গেছে! শুধু যে এই প্রজেক্ট রিপোর্টটা
চুরি হয়েছে, এমনও নয়, হয়তো সবগুলিই! কারণ যে চুরি করেছে, সে হয়তো জানেও না, কী
চুরি করছে, কেনই বা চুরি করছে। তার কাছে এই সবগুলিই জরুরি ডকুমেন্টস্। যে তাকে
পাঠিয়েছে, তার হাতে এগুলি তুলে দিলেই সে টাকা পেয়ে যাবে! তাতেই তার দায়িত্ব শেষ!
অতএব, আসল ব্যাপারটা হল, চোরকে কে পাঠালো? মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া? কিন্তু
সে কি ওই ডকুমেন্টস্ দেখে কিছু বুঝতে পারবে? অসম্ভব। তার সঙ্গে আর কে আছে? যার
ভরসায় মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া এমন কাজ করল? অর্থাৎ ইন্দ্রর মনে প্রথম থেকেই যে সন্দেহটা
হয়েছিল, সেটাই ঠিক। মনোহরলালের প্রসাদ খেয়েই তার ও ঝিঙেদার এই অসুস্থতা।
মনোহরলালের কোন প্রস্তাবেই সে রাজি না হওয়ায়, মনোহরলাল তাদের দুজনকে শয্যাশায়ী করে
রেখে, ডকুমেন্টগুলো হাতিয়ে নিয়েছে।
ইন্দ্র বিছানায় বসে ভাবতে লাগল, এখন তার কী করা উচিৎ? পুলিশে কমপ্লেন
করবে? সেক্ষেত্রে পুলিশ প্রমাণ চাইবে, তাদের সামনে সামান্য এই অগোছালো ডকুমেন্টের
প্রমাণ ধোপে টিকবে না। তাছাড়া মনোহরলালের মতো প্রভাবশালী ও বিখ্যাত ব্যবসায়ীর
বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তারা শুনবেই বা কেন? উপরন্তু, তাকেই প্রশ্ন করে জেরবার করে
তুলবে, সে কে? জরুরি ডকুমেন্টগুলো কী এমন বস্তু? ওই ডকুমেন্টগুলো চুরি না হলে, সে কি
দেশ উদ্ধার করে ফেলত? এখন ওগুলো চুরি যাওয়াতে দেশের কী এমন ক্ষতি হয়ে গেল? তাছাড়া
তার কোন ডকুমেন্ট চুরিও তো যায়নি, কপি হয়েছে! কপি করা আর চুরি করা কি এক?
নাঃ, পুলিশ-টুলিশ নয়, যা করার তাকেই করতে হবে। ইন্দ্র বিছানায় বসে, মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল। এতদিন সে নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায়, অন্য কোনদিকে তাকায়নি। আজ স্বার্থ ও লোভের অন্ধকার, তার সেই আবিষ্কারের চারদিকে ঘিরে উঠছে। সেই অন্ধকার কেটে, অন্য কেউ নয়, তাকেই বেরিয়ে আসতে হবে! গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইল ইন্দ্র, ওদিকে ল্যাপটপের পর্দাটাও ঝপ করে অন্ধকার স্লিপ মোডে চলে গেল।
চোরের হদিশ
ইন্দ্র কিছুক্ষণ চিন্তা করে, উঠে দাঁড়াল। বসে বসে ভেবে লাভ নেই, যা
করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। মনোহরলাল এবং তার দলবলকে ধরতে হবে। তাদের সব প্ল্যান
ভেস্তে দিতে হবে।
টেবিলের নিচের ড্রয়ার থেকে সে একটা ডিওডোরেন্টের কৌটো বের করল।
ডিওডোরেন্টের মতো দেখতে কিন্তু এটা একটা কেমিক্যাল, নাম নিনহাইড্রিন। এই কেমিক্যাল স্প্রে করলে
আঙুল ও হাতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাচ কিংবা পরিষ্কার ধাতব জিনিষে হাত রাখলে,
হাতের ছাপ পড়তে বাধ্য। প্রথমেই প্লাস্টিকের ফোল্ডারের ওপর কেমিক্যালটা হাল্কা
স্প্রে করল ইন্দ্র। কয়েক মিনিট পরেই তার ওপরে ফুটে উঠল অনেক আঙুলের ছাপ। নিজের আঙুলের
ছাপ ইন্দ্র খুব ভালোভাবেই চেনে। অচেনা এক হাতের ছাপ পেল গোটা তিনেক। এই
ক্যাবিনেটের ড্রয়ারে এ বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ হাত দেয় না, অতএব অচেনা ছাপটা
নিশ্চয়ই চোরের! ইন্দ্রর চিন্তিত মুখে একটু স্বস্তির হাসি ফুটল। একে একে সব কটা ফোল্ডারেই
স্প্রে করে সে দেখল, অচেনা সেই হাতের ছাপ সব ফোল্ডারেই রয়েছে।
ইন্দ্র স্লিপ মোডে চলে যাওয়া ল্যাপটপটাকে আবার চালু করল। এবার টেবিলের
অন্য ড্রয়ার থেকে ছোট্ট একটা স্ক্যানার মেসিন বের করল। এটা একটা ইনফ্রারেড
স্ক্যানার। সেটাকে ল্যাপটপের ইউএসবি পোর্টে কানেক্ট করে, চালু করল একটা অ্যাপ।
অ্যাপ চালু হয়ে স্ক্যানার মেসিনটাকে ডিটেক্ট করে ফেলার পর, ইন্দ্র স্ক্যানার মেসিন
দিয়ে অচেনা আঙুলের ছাপগুলোকে স্ক্যান করতে লাগল। অচেনা হাতের অনেকগুলি ছাপই ঘষা
লেগে কিংবা তার নিজের হাতের ছাপে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো স্ক্যান না করে, যেগুলো
বেশ স্পষ্ট, শুধু সেগুলোকেই স্ক্যান করে, সে ল্যাপটপে সেভ করে নিল। গোটা দশেক ইমেজ
সেভ করে, সে এবার বসল ল্যাপটপে।
স্ক্যান করা সবগুলো ইমেজকে সিলেক্ট করে, সে ডিটেক্ট কম্যাণ্ড দিতেই,
অ্যাপটা স্ক্রিনে লিখল, “ডিটেক্টিং... ওয়েট, ইট মে টেক ফিউ মিনিট্স্”। সবকটা
ইমেজ চেক করতে অন্ততঃ মিনিট পাঁচেক লাগবে। ইন্দ্র অপেক্ষা করতে করতে একতলায় ঝিঙেদা
আর নিত্যর গলা শুনতে পেল। এই সময়ে তাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখলে, ঝিঙেদা খুব বকাবকি
করবে। ইন্দ্র চটপট উঠে, প্লাস্টিকের কভারগুলো ক্যাবিনেটে ঢুকিয়ে সেটা লক করে দিল।
নিনহাইড্রিনের ক্যানটা এবং স্ক্যানারটা ল্যাপটপ থেকে খুলে নিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে
যথাস্থানে রাখল। তারপর চুপ করে এসে যখন ল্যাপটপের সামনে বসল, তখনই সিঁড়িতে ঝিঙেদার
পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ওরা আসছে।
ঘরে ঢুকেই ঝিঙেদা একটু বিরক্ত হয়েই তাকাল ইন্দ্রর মুখের দিকে, বলল,
“বসে পড়েছো তোমার ওই ল্যাপটপ নিয়ে? তিনদিন ওই অবস্থা গেল, একটু বিশ্রাম নিলে কী
মহাভারত অশুদ্ধ হতো?”
“কফি খাওয়া, দেখি। কিন্তু ঝিঙেদা তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস, আর নিজে যেন
কত বিশ্রাম করছিস! তোর বাজার হল?”
“আমার হচ্ছে শরীলের কাজ, আর তোমার বেরেনের। দুটো এক হল? আমি একবেলা
ভরপেট খেয়ে ঘন্টা খানেক ঘুমোলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবো! কিন্তু তোমার বেরেনের কাজ, অত
সহজ নয়। যাগ্গে, বাজার হল। কিন্তু এই নিত্যদা দুপুরে কী করেছিল জান? এই লোককে
বিশ্বেস করে তুমি বাড়িতে রাখবে?”
ইন্দ্র অবাক হয়ে নিত্যর দিকে একবার তাকিয়ে ঝিঙেদাকে জিজ্ঞাসা করল,
“কেন? ও নিজেই তো বলল, চুরি করেছিল, আবার কী করবে?”
ঝিঙেদা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “সে তো বলেছিল, কিন্তু কার পকেট কেটেছিল,
জানো? নলিনবাবুর দোকান থেকে ও খাবার-দাবার কিনেছিল, আর সেই নলিনবাবুরই পকেট
কেটেছিল”!
কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে ইন্দ্র বলল, “তাই নাকি? শুনি তো গল্পটা”।
কম্পিউটার ডিটেকশন শেষ করে ফেলেছে, পর্দায় “ডিটেলস্ অফ দি পার্সন” দেখাচ্ছে। যার
আঙুলের ছাপ, সে একটি পুরুষ। তার আনুমানিক উচ্চতা ১.৭২ মিটার, আনুমানিক বয়েস ৪২,
ওজন ৭২কেজি, গায়ের রঙ শ্যামলা, নাম বিকাশ সামন্ত, আধারকার্ড নম্বর...। গ্রাম - শ্যামতলা,
পোঃ অঃ - রাধাবিনোদপাড়া, হুগলি, পবঙ্গ।
পর্দায় চোখ বোলাতে বোলাতে ইন্দ্র ঝিঙেদার কথা শুনতে লাগল, ঝিঙেদা
বলছিল, “নলিনবাবু দোকান খালি রেখে কিছুক্ষণের জন্যে বাজারের শৌচালয়ে গিয়েছিল। চুরি
হবার ভয়ে, ড্রয়ারের ক্যাশ থেকে বের করে পাঁচশোর নোটগুলো নিজের ফতুয়ার পকেটে
নিয়েছিল। নিত্যদা ওই শৌচালয়ের মধ্যেই তার পকেট থেকে দুটো পাঁচশোর নোট তুলে
নিয়েছিল, নলিনবাবু বুঝতেই পারেনি”।
লোকটার ডিটেল্সে চোখ বুলিয়ে ইন্দ্র নিচের দিকে একটা বক্সে ক্লিক করল,
“ক্রিয়েট ইমেজ?” ক্লিক করতেই পর্দায় ভেসে উঠল “ক্রিয়েটিং...ওয়েট, ইট মে টেক ফিউ
মিনিট্স্”।
ইন্দ্র ঝিঙেদার কথায় আবার মন দিল, বলল, “তাও তো ভালো রে ঝিঙেদা। নলিনদা
আমাদের চেনা লোক, তাকে টাকাটা ফেরত দিয়েছিস তো?”
“তা দিয়েছে...কিন্তু...”
“কিন্তু আবার কী? নিত্য যদি কোন উটকো লোকের পকেট মারতো, কী করে ফেরত
দিতিস টাকাটা?”
“তা ঠিকই বলেছো, কিন্তু চোর তো চোরই নাকি?”
“না রে, ঝিঙেদা, ও আর চুরি করবে না, আমাকে কথা দিয়েছে। কী রে নিত্য,
তাই না?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, কত্তা। সে কথার খেলাপ হবেনি”।
ইন্দ্র হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু টাকাটা কী বলে ফেরত দিলে বলো
তো? নলিনদা সন্দেহ করেনি?”
নিত্য বলল, “তা সন্দেহ হয়তো করেছেন, কিন্তু টাকাটা ফেরত পেয়ে খুশীও
হয়েছেন”।
ঝিঙেদা বলল, “কী বলেছে শুনবে, দোকানে ঢুকেই নিত্যদা নলিনবাবুকে বলল,
“এমন সরল আর ভুলো মন নিয়ে এই দোকান কী করে চালাচ্ছেন, বাবু? হিসেব-টিসেব মিলিয়ে
দেখেছেন? আপনার দুটো পাঁচশোর নোট কম পড়েনি?” নলিনবাবু অবাক মুখে হতভম্ব তাকিয়ে
রইলেন ওর মুখের দিকে। নিত্যদা দোকানের কাউন্টারে পাঁচশোর নোটদুটো রেখে বলল, “ফেরত
দেওয়ার সময়, পঞ্চাশের নোট ভেবে আমায় দুটো পাঁচশোর নোট দিয়ে দিলেন? তাড়াহুড়োতে আমিও
তখন খেয়াল করিনি, ছি ছি কী বিপদেই যে পড়েছিলাম! ঘরে গিয়ে তুলে রাখতে গিয়ে দেখি এই
ব্যাপার! সেই থেকে যেন বুকের ভেতরে বেড়াল আঁচড়াচ্ছিল! ওঃ এতক্ষণে শান্তি!”
নলিনবাবু নোট দুটো হাতে নিতেই, আমরা আর একমূহুর্ত দাঁড়াইনি, চলে এসেছি”।
হাসতে হাসতে ইন্দ্র বলল, “বেশ করেছিস। কিন্তু দেখা হলে নলিনদা তোদের
আবার ধরবে, দুটো পঞ্চাশের হিসেব মিলবে না যে! যাগ্গে সে কথা এখন থাক, এখন এই
লোকটাকে ভালো করে দেখ তো? চিনিস কী না?
নিত্য, তুমিও দেখ তো”। ইন্দ্র ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে রাখল, যাতে দুজনেই দেখতে
পায়। পর্দায় লোকটার মাথা থেকে চোখ পর্যন্ত ছবিটা এসে গেছে, বাকিটা আস্তে আস্তে
ফুটে উঠছে।
নিত্য এবং ঝিঙেদা নিচু হয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে, ঝিঙেদা বলল, “উঁহু,
দেখেছি বলে তো মনে হয় না, কিন্তু কী করেছে লোকটা?”
“লোকটা একটা চোর। চুরি করেছে, আমার এই ঘর থেকে”।
ঝিঙেদা চমকে উঠল, বলল, “সে কী? কবে? টাকা-পয়সা সব নিয়ে গেছে?”
“যে তিনদিন আমরা নিচেয় বসার ঘরে শুয়েছিলাম, মনে হচ্ছে সেই সময়েই।
টাকা-পয়সা আর কটা ছিল, সে চুরি গেলে কী আর ভাবতাম?”
নিত্যদা খুব চিন্তিত মুখে বলল, “আজ্ঞে কত্তা, বলতে যদি কোনো বাধা না
থাকে, তাহলে ঠিক কী চুরি গেছে বলবেন?”
“টাকা-কড়ি চুরি যায়নি, সেকথা তো আগেই বললাম, নিত্য। আমার নিজের লেখা অনেকগুলো নথি চুরি
গেছে”।
ইন্দ্র নিত্য এবং ঝিঙেদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “অবিশ্যি, ওগুলো বুঝে
ওঠা যে সে লোকের কম্মো নয়। ঘটে যথেষ্ট বিদ্যে এবং বুদ্ধি
দরকার”।
নিত্য খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, “আপনার কাগজপত্র
সব চুরি হয়ে গেছে বলছেন, কিন্তু তাও তেমন হাহুতাশ করছেন না। তাহলে যা গেছে তা যাক
না। দুশ্চিন্তা করছেন কেন?”
“উঁহু, তা বললে হয়। আমার ঘরে ঢুকে চোর চুরি করে নিয়ে গেল, আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? তা কি হয় নাকি? আমার তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি ঠিকই, তাই
বলে যে লোকের এমন দুর্মতি তার শাস্তি হবে না? কিন্তু এখন ওসব থাক। ঝিঙেদা, গরম গরম
ভাত, মুশুরডাল সেদ্ধ, ডিমের ঝোল করে ফেল, তাড়াতাড়ি। অনেক কাজ আছে, অনেক কথা আছে,
রাত্রে খাওয়ার পর আমরা সবাই বসব।”
বন্ধু না শত্রু
রাত্রি পৌনে নটা নাগাদ ইন্দ্রর মোবাইলে একটা
কল এল, আননোন নম্বর। সাধারণতঃ অচেনা নাম্বারের কল ইন্দ্র ধরে না, কিন্তু এখন ধরল,
বলল, “হ্যালো”?
“ইন্দ্রদা, মানে ইন্দ্রনারায়ণদা বলছেন?”
“বলছি। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না”।
“না চিনবেন না, আমি জীবক নাথ। আপনি যে কলেজে
এবং সায়েন্স অ্যাকাডেমিতে পড়েছেন, আমিও সেই কলেজ এবং অ্যাকাডেমির এক্স-স্টুডেণ্ট। তবে
আপনার চেয়ে সাত বছরের জুনিয়ার। কলেজে আর অ্যাকাডেমিতে পড়তেই, ব্রিলিয়ান্ট
স্টুডেন্ট হিসেবে আপনার নাম আমি শুনেছিলাম। কিন্তু এখন আমি আপনার একটা কাজের সঙ্গে
বিচ্ছিরিভাবে জড়িয়ে পড়েছি!”
“ঠিক বুঝলাম না, ভাই। আপনাকে তো আমি চিনিই না,
অথচ আপনি আমার কাজের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে পড়লেন?”
“সেটাই আপনাকে বলতে চাই, কিন্তু ফোনে সব কথা বলা
উচিৎ নয়। আপনার এবং আমার - দুজনের
পক্ষেই ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে...”।
“তাহলে”?
“আমি এখনই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই”।
“এখন? এত রাত্রে? কোথা থেকে ফোন করছেন আপনি?”
“আমি বকুলপুরেই আছি। বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে একটা
বড়ো অশ্বত্থগাছের নিচে”।
“আপনি কী আমাদের বাড়ি আসতে চান? আমাদের বাড়ি
আপনি চেনেন?”
“না চিনি না। তবে আমি আপনার বাড়িতেই আপনার
সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু ছদ্মবেশে। হেল্প করতে পারেন?”
“বাড়ি চেনেন না। তার ওপর ছদ্মবেশে আসতে
চাইছেন... একটু ভাবতে দিন। এক কাজ করুন আপনি ওখানেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করুন। আমি
দেখছি কাকে পাঠানো যায়। তবে মিনিট পনেরকুড়ি তো লাগবেই...”
“তা লাগুক। আমি অপেক্ষা করছি”।
“ওক্কে”। ইন্দ্র ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ
চিন্তা করে, একতলায় নামল। রান্নাঘরের দরজায় দেখল নিত্য বসে আছে আর ঝিঙেদা রান্না
করছে। দুজনে গল্প করে চলেছে একটানা।
ইন্দ্রকে দেখে ঝিঙেদা বলল, “কী আবার কফি খাবে,
নাকি চা? রান্না হতে দেরি আছে...”।
সেকথার উত্তর না দিয়ে ইন্দ্র বলল, “তোর একটা ধুতি
আর ফতুয়া দে তো, ঝিঙেদা। কাচা আছে তো? আর ওই সঙ্গে কাপড়ের একটা ঝোলাও দিস তো”।
“আমার ধুতি আর ফতুয়া নিয়ে তুমি কী করবে?” অবাক
হয়ে জিজ্ঞাসা করল ঝিঙেদা।
“বলছি। আমাদের একটা সাইকেল আছে না, ঝিঙেদা?
সেটা ঠিক আছে? চালানো যাবে?”
“আছে তো, চালানোও যাবে। কিন্তু আমার ধুতি পরে
সাইকেলে চড়ে এত রাতে তুমি কোথায় যাবে? অব্যেস নেই ধুতিতে জড়িয়ে আছাড় খাবে তো মাঝ
রাস্তায়! তোমার মাথা-ফাথা খারাপ হল নাকি?”
সে কথার উত্তর না দিয়ে ইন্দ্র নিত্যকে বলল,
“নিত্য, ঝিঙেদার ধুতি, ফতুয়া আর ঝোলা নিয়ে তুমি এখনই সাইকেলে বকুলপুর বাসস্ট্যাণ্ডে
যাও। ওদিকে যে পুরোনো অশ্বত্থ গাছ আছে না, তার আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে কলকাতার এক
ছোকরা বাবু। নাম জীবক নাথ। সে তার জামা-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি ফতুয়া পরবে আর ওই ঝোলায়
তার ছেড়ে ফেলা জামাপ্যান্টগুলো ভরে নেবে। তারপর তাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে এ
বাড়িতে নিয়ে আসবে। সদর দিয়ে ঢুকবে না। পেছনের দিক দিয়ে ঢুকবে। রাতের অন্ধকারে তুমি
যেমন গা ঢাকা দিয়ে সর্বত্র যাওয়া আসা করো, তেমনি। পারবে?”
নিত্য এতক্ষণ ইন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে
শুনছিল, এখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “একশবার পারবো, ছোটকত্তা। কেউ টেরও পাবে না”।
মিনিট তিনেক সময় লাগল, তারপর সাইকেল নিয়ে
নিত্য বাড়ির পিছনের অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ঝিঙেদা ইন্দ্রকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা
করল, “তা তোমার ওই কলকাতার বন্ধুটি এখানে খাবে তো? ডিমের ঝোল-ভাত আর মুসুর ডাল
সেদ্ধ, চলবে?”
ইন্দ্র চিন্তিত মুখে বলল, “চলবে কি রে? দৌড়বে।
তবে ছোকরা বন্ধু না শত্রু সেটাই তো জানি না রে”।
ঝিঙেদা আতঙ্কিত গলায় বলল, “তার মানে? সে আবার
কী কতা?”
নিশিকুটুম্ব
রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ, পিছনে সেই লোকটাকে
নিয়ে নিত্য নিঃশব্দে বসার ঘরে ঢুকল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ছোটকর্তাকে বলল কথা না বলতে।
পিছনের লোকটার চোখেমুখে স্পষ্টতঃই আতঙ্কের ছাপ। তবে কাঁচাপাকা চুল আর ঝুপসি
গোঁফওয়ালা লোকটাকে দেখে মোটেই মনে হয় না, ইন্দ্রর থেকে
সে সাত বছরের জুনিয়ার – জেনেটিক টেকনোলজির একজন রিসার্চ
স্কলার। নিত্যর ইশারা মেনে নিয়ে ইন্দ্র চুপ করেই রইল, কিন্তু হাতের ইশারায় জিজ্ঞাসা
করল, “কী ব্যাপার কি?” লোকটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিত্য ইশারায় বলল, চুপটি করে
একটু বসেন, আমি আসছি – বলেই আবার নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
নিত্যর আচরণে বেশ অবাক হল ইন্দ্র। কিন্তু
বুঝতে পারল নিত্য তার দীর্ঘদিনের তস্কর বৃত্তির পেশা থেকে যে সতর্কতা কিংবা বলা
ভাল বিপদের গন্ধ পাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সে কিছু একটা আঁচ
করেছে। নিত্য বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই পিছনদিকের ঝোপ-ঝাড়ের থেকে বেশ
কিছুক্ষণ হুটোপুটির শব্দ পাওয়া গেল, একটু পরে থেমেও গেল, নিত্যর ডাক শোনা গেল,
“ছোটকত্তা, শিগ্গির আসেন, কেমন চোর ধরেছি দেখে যান”।
নিত্যর গলা পেয়ে ইন্দ্র এবং ঝিঙেদা দুজনেই
দৌড়ল বাড়ির পিছনদিকে। দেখল পিছমোড়া করে বাঁধা একটা লোককে ঘাড় ধরে টেনে আনছে নিত্য,
আর হাঁফাতে হাঁফাতে বলছে – “তুমি ঘোরো ডালে ডালে আর আমি ফিরি পাতায় পাতায়, চাঁদু।
এ হতভাগা সেই বাসস্ট্যাণ্ড থেকে আমাদের পিছু নিয়েছে। দেখেন তো এই লোকটাই আপনার সেই
কম্পুটারের লোকটা না? এখন আপনি যা বিচার করবেন, তাই হবে”।
সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনে লোকটাকে ফেলে, চেপে ধরে
নিত্য আবার বলল, “ঝিঙেদা মোটা একখান রশি দাও দিকি, ব্যাটার পা দুখানাও বাঁধি”।
ঝিঙেদা ব্যাপার স্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, এখন দৌড়ল দড়ি আনতে।
ইন্দ্র বলল, “সাবাশ নিত্য, এই লোকটাই আমার ঘরে
ঢুকে ফরমুলা চুরি করেছিল”।
লোকটা হাঁউমাউ করে বলে উঠল, “বিশ্বাস করুন স্যার,
আমি চোর-টোর নই। ভদ্রলোক। এম এ পাস। এখানকার জুটমিলে চাকরি করি। বি শিফ্টে ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার জন্যে এই পথে আমি বাসস্ট্যাণ্ডে
যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে এই লোকটা এসে পিছন থেকে ঘাড়ে এমন রদ্দা ঝাড়লে সাইকেল
নিয়ে উলটে পড়লাম। আমি কিচ্ছু
জানিনা স্যার, আমি চোর নই”।
এই সব কথাবার্তার মধ্যেই ঝিঙেদা নাইলনের একটা দড়ি
নিয়ে এসেছিল, নিত্য সেটা দিয়ে বেঁধে ফেলল, লোকটার পা-দুটোও। পা-বাঁধা সম্পন্ন হতে নিত্য
এবার হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “অনেকদিন
পর, গাটা বেশ গরম হল ছোটকত্তা। বাপ-পিতেমোর শিক্ষে এখনো ভুলিনি”।
ইন্দ্র বলল, “নিত্য, ওর পকেট থেকে মানিব্যাগ আর
ফোন বের করে নাও। ফোন কিন্তু দুটোও থাকতে পারে”। নির্দেশ পাওয়া মাত্র নিত্য নিপুণ হাতে
জামা এবং প্যাণ্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ, একটা স্মার্টফোন, রুমাল, সিগারেটের প্যাকেট,
দেশলাই, পেন, ভাজা-মৌরি ভরা ছোট্ট একটা ডিব্বা বের করে ফেলল।
ইন্দ্র বলল, “ফোনটা আমায় দাও, আর মানিব্যাগে দেখ
তো আধার বা ভোটার কার্ড রয়েছে কিনা”।
“আছে, ভোটার কার্ড। নাম ঝন্টু নস্কর। বাড়ি, নস্করপাড়া,
উঃচপ”।
“তার মানে?”
নিত্য অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে উত্তর
চব্বিশ পরগণা”।
“ওটা ফালতু – ওর আধার কার্ড আমার কাছে আছে।
নাম - বিকাশ
সামন্ত। বাড়ি-রাধাবিনোদপাড়া, হুগলি। এক কাজ করো নিত্য ওর মুখে চেপে একটা গামছা
বাঁধ, তারপর তুলে আনো ভেতরের ঘরে। দেখছি কী করা যায়...”।
ঝন্টু নস্কর বা বিকাশ সামন্ত ইন্দ্রর কথায় বেশ ভয় পেল, চেঁচিয়ে বলল, “আমি
বিকাশ-টিকাশ নই স্যার, আমি ঝন্টু, বিশ্বাস করুন। আপনাদের কোথাও খুব ভুল হচ্ছে...”।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, নিত্য গামছা দিয়ে মুখটা চেপে বেঁধে ফেলল, তারপর ঝিঙেদাকে
বলল, “মুখপোড়ার ঠ্যাংদুটো ধরো তো, ঝিঙেদা, মালটাকে ভেতরের ঘরে লাদাই করি”। নিত্য
আর ঝিঙেদা লোকটাকে তুলে যখন ভেতরের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, ইন্দ্র বলল, “আমাদের
ভুল হচ্ছে কি ঠিক, সে আপনার ফিংগার প্রিন্ট নিলেই বোঝা যাবে। আমার ঘরের ফাইল চুরি
করতে এসে চোর যে আঙুলের ছাপ রেখে গেছে – তার সঙ্গে মেলালেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর
এখান থেকে সবচে কাছের জুটমিল প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার দূরে। সেখানকার বাসস্ট্যাণ্ড
ছেড়ে আপনি রাত সাড়ে নটার সময়, আমাদের বাড়ির পেছনে উপস্থিত হলেন বাস-স্ট্যাণ্ড
খুঁজতে?”
ভেতরের ঘরের চৌকিতে লোকটাকে শুইয়ে দেওয়ার পর, ইন্দ্র চৌকির সামনে একটা
চেয়ারে বসে বলল, “নিত্য, এ ঘরে ওই ভদ্রলোককেও নিয়ে এসো। আলাপ পরিচয় যা কিছু
একসঙ্গেই হোক। ও হ্যাঁ, ঝিঙেদা একটা খালি কাচের গ্লাস দাও তো – এই ভদ্রলোক ঝন্টু নস্কর
না বিকাশ সামন্ত সেটা ফয়সালা করা দরকার”।
“কাচের গ্লাস দিয়ে তুমি লোক চিনে ফেলবে? কি যে বলছ, ছোটকত্তা, কিছুই
বুঝছি না”। নিত্যও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রর মুখের দিকে।
ইন্দ্র দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “চেনা যায় রে, ঝিঙেদা, চেনা
যায়। আমার ঘরে ঢুকে যে লোকটা চুরি করেছিল তার হাতের ছাপ আমার কাছে রয়েছে। সে ছাপের
সঙ্গে এ ভদ্রলোকের হাতের ছাপ যদি মিলে যায়, তাহলেই ভদ্রলোক চোর না নিরীহ বুঝে ফেলা
যাবে। কাচের গ্লাসে খুব সহজে হাতের ছাপ পড়ে যায়, বলেই তোকে কাচের গ্লাস আনতে
বললাম, এবার বুঝলি?”
ঝিঙেদা দৌড়ে গিয়ে কাচের গ্লাস নিয়ে এল। ইন্দ্র রুমাল দিয়ে সে গ্লাসটা
খুব ভালো করে মুছল, তারপর লোকটাকে কাত করে শুইয়ে বেঁধে রাখা হাতের আঙুলে গ্লাসটা চেপে
চেপে ছাপ নিল। তারপর সাবধানে গ্লাসটা নিয়ে দোতলায় যেতে যেতে বলল, “ঝিঙেদা চট করে রান্না-টান্না
সেরে নাও, অনেক কাজ আছে। আর এই ঝন্টু না বিকাশ – ওর জন্যেও দুটো চাল ফেলে দিও।
আমরা খাবো, আর রাতের অতিথি – সে নিশিকুটুম্ব বা ভদ্রলোক যাই হোক – অভুক্ত থাকবে?”
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ঝিঙেদা বলল, “সে চিন্তা তোমায় করতে হবে না,
এই উটকো ঝামেলা তুমি তাড়াতাড়ি মেটাও দেখি... ভালো লাগে না এসব...”।
সাধের কুটুম
মিনিট পনের পরে ইন্দ্র নিচের ঘরে ফিরল হাতে তিনটে এ৪ সাইজের কাগজ নিয়ে।
ঘরে পা দিয়েই একটু চমকে গেল। মেঝেয় বসে থাকা নিত্যকে জিজ্ঞাসা করল, “এ ভদ্রলোক কখন
এল? আর বসার ঘরের সেই ভদ্রলোককে কোথায় রেখে এলে?”
নিত্য বলল, “আজ্ঞে তিনিই ইনি। আপনি ওঁনাকে জামাপ্যান্ট ছেড়ে ঝিঙেদার
ধুতি আর ফতুয়া পরিয়ে আনতে বলেছিলেন, থা আমার মনে হল, আরেকটু মেকাপ করে দিলে মন্দ
হয় না। আমার কাছে ওসব ধরাচূড়ো তো থাকেই – তাই যাবার সময় ওই চুল আর গোঁফ নিয়ে
গিয়েছিলাম। তাই দিয়ে ভদ্রনোকের হুলিয়াটাও বদলে গেল। থা যার জন্যে এই মেকাপ সেই যখন
ধরা পড়ে গেল, ওসবে এখন আর কাজ কি? তাই আপনি ওপরে যেতে সব মেকাপ খুলে ফেলতে বললাম।”
ইন্দ্র নিত্যর বিচক্ষণতায় খুশি হল খুব, মুচকি হেসে বলল, “বাঃ, বেড়ে
বুদ্ধি তোমার নিত্য। ভেরি গুড। তাহলে আপনিই জীবক সেন, রিসার্চ স্কলার?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে “আপনি”
বলবেন না, দাদা। আমি আপনার কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির জুনিয়র। আপনি আমাকে “তুই” বা
“তুমি” যা খুশি বলে ডাকবেন”।
চুলের মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে ইন্দ্র গভীর চোখে লক্ষ্য করছিল জীবককে, “সমুঙ্গসুন্দর
কেমন আছে? চেন?”
আচমকা এই প্রশ্নে জীবক একটু থতমত খেলেও মৃদু হেসে বলল, “ব্যাঙ্গালুরু
সায়েন্স অ্যাকাডেমিতে আমাদের ল্যাব ইনস্ট্রাক্টর। দারুণ হেল্পফুল আর মাই ডিয়ার
ভদ্রলোক। আপনার কথা...”।
“আমাদের কলেজের একটা ক্লাসরুমে অফ পিরিয়ডে প্রায়ই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
স্টুডেন্টদের নিয়ে স্যারেরা আসতেন...”
“হ্যাঁ, ইন্দ্রদা। আমাদের ওই ক্লাসরুমের দেওয়ালে আর বিমে বেশ কিছু ফাটল
মানে ক্র্যাক ডেভেলপ করেছিল – সেগুলোর মাপজোক করে ওরা রিপোর্ট ...”।
“আমার রিসার্চ ডকুমেন্ট পড়ে তোমার কী মনে হল?”
এবার জীবক হেসে ফেলল, বলল, “আপনার ডকুমেন্টগুলো আমি হাতে পাই পরশু
রাত্রে। গতকাল আর আজ সারাদিন লড়াই করে মাত্র একটা পৃষ্ঠাই পড়তে পেরেছি – অবিশ্যি
জানিনা কত নম্বর পৃষ্ঠা!”
“তার মানে? দু-দুটো দিনে ওই কটা পৃষ্ঠায় চোখ বোলাতে পারলে না? কোনটা
প্রথম পৃষ্ঠা সেটাও বুঝতে পারোনি?” জীবকের মুখের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্র অদ্ভূত
মুখভঙ্গি করল।
জীবক হাসল, “আপনার লেখাটি ডিকোড করতেই আমার কালকের গোটাদিন-গোটারাত
কেটে গেছে। আপনি পি, কিউ, আর, এস, টি – এই পাঁচটি কনসোনেন্টকে যথাক্রমে পাঁচটি
ভাওয়েল দিয়ে রিপ্লেস করেছেন। এইটা কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না, আজ ভোরে ডিকোডিংয়ের
আশা ছেড়ে দিয়ে যখন দাঁত ব্রাশ করতে গেলাম - হঠাৎ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল...”।
ইন্দ্র একইরকম গাম্ভীর্যে বলল, “তোমার ব্রেন তার মানে মাথায় নয়, দাঁতে”?
জীবক আবারও হাসল, “না ইন্দ্রদা, ব্রেন মাথাতেই আছে – তবে তার বেশির
ভাগই গোবর”।
ইন্দ্র একই রকম স্বরে বলল, “তা বেশ, ডিকোড তো করে ফেললে, তারপর যে
পাতাটি পড়ে ফেললে, সেটি প্রথম পৃষ্ঠা কিনা বুঝতে পারলে না কেন?”
জীবক এবার একটু চিন্তার সুরে বলল, “আমার মনে হয়, ডকুমেন্টগুলো চুরি করে
ফটোকপি করার সময় চোর পৃষ্ঠার সিরিয়ালটা
ঘেঁটে ফেলেছিল। কারণ পৃষ্ঠাগুলোয় কোন পেজ নাম্বার দেওয়া ছিল না”।
ইন্দ্র অবাক সুরে বলল, “তাই নাকি?”
জীবক হেসে বলল, “আপনি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন, বুঝছি। কিন্তু আমি সিয়োর, প্রতিটা
পরীক্ষাতেই আমি ফুল মার্কস পেয়ে পাস করে গেছি”।
এবার ইন্দ্রও হেসে ফেলে বলল, “পরীক্ষা তো নিতেই হবে, ভাই। কে কী করতে
চাইছে, কোথা থেকে কী বিপদ উপস্থিত হবে, সেটা যাচাই করতে হবে না? আর তোমার পাশে যে লোকটি
শুয়ে আছে – সে-ই কিন্তু ওই চোর। ওর এই মাত্র নেওয়া আঙুলের ছাপ আর আমার প্লাস্টিক ফোল্ডারে
পাওয়া ছাপগুলি হুবহু এক। আর সেই আঙুলের ছাপওয়ালার আধার কার্ড নাম্বার আমি জানি,
নাম জানি, ধাম জানি। কী বিকাশবাবু, এখনও কি আপনি ঝন্টু নস্করই রয়েছেন? তাহলে এই
ছবিটা দেখুন তো...আপনার কোন যমজ ভাই রয়েছে? তারই নাম বিকাশ? কিন্তু যমজ ভাই-বোনদেরও
কিন্তু আঙুলের ছাপে মিল থাকে না”।
এই সময় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিঙেদা বলল, “তোমাদের দুজনের খাবার বেড়ে
দিয়েছি, খাবে এসো। আর তোমার ওই সাধের কুটুম কী করে খাবে? ওর তো হাত পা বাঁধা, মুখ
বন্ধ”।
ইন্দ্র উঠে দাঁড়াল, বলল, “ও নিয়ে ভাবিস না, ঝিঙেদা, মুখের গামছা খুলে নিত্য
ওকে খাইয়ে দেবে...খাওয়ার সময় চেঁচামেচি বা শয়তানি করলেই, ঘাড়ে দিয়ে দেবে দুই
রদ্দা। যেমন কুটুম, তার তেমনই খাতির, বুঝলি না, ঝিঙেদা? চলো, জীবক খেয়ে আসি – তারপরেই
শুরু হবে আমার আসল কাজ...”।
চোরের স্বীকারোক্তি
ইন্দ্র আর জীবক খাওয়া দাওয়া সেরে ভেতরের ঘরে এসে দেখল, নিত্য বিকাশবাবুকে
বিছানার ওপর খাড়া করে বসিয়ে দিয়েছে, আর চামচে করে মাখা ভাত খাওয়াচ্ছে। বিকাশের দু
চোখ বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুর বন্যা।
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করল, “নিত্য, বিকাশবাবু অমন হাপুস নয়নে কাঁদছে কেন?
পিঠে দু-চারটে কিল-টিল পড়েছে বুঝি”?
নিত্য বলল, “না গো ছোটকত্তা, মুখের বাঁধন খুলে দিতেই ঘ্যানঘ্যান শুরু
করেছে। বলছে ইন্দ্র স্যারকে বলে আমায় ছেড়ে দিন। আমি যা করেছি ভুল করে ফেলেছি, আর
কক্খনো এমন কাজ করবো না”।
ইন্দ্র বলল, “তাই বুঝি? ছেড়ে দিলেই তো ও চলে যাবে মনোহরলালের কাছে, আজ
সন্ধে থেকে যা যা দেখেছে, তার রিপোর্ট সবিস্তারে জানিয়ে দেবে। তারপর মনোহরলাল তার
যতো সাঙ্গপাঙ্গদের পাঠিয়ে দেবে আমাকে জব্দ করার জন্যে...”।
ইন্দ্রর কথা শেষ করার আগেই, বিকাশ হাউমাউ করে আরও কান্নাকাটি করে বলল,
“আমি কোনদিন আর মনোহরলালজির সঙ্গে দেখা করব না, ওঁনার কাজও করবো না, বিশ্বাস করুন
স্যার...”।
ইন্দ্র সে কথায় কান না দিয়ে বলল, “কতটা খেয়েছে? রাতটা কাটবে তো?”
“আজ্ঞে, তা মনে হয় কাটবে, এই থালা ভরেই তো ভাত- ডাল - ডিমের তরকারি
নিয়ে এসেছিলাম, দেখেন না, কট্টুকু পড়ে আছে?”
“তাহলে এক কাজ কর, নিত্য, আর রাত না করে, তুমি আর ঝিঙেদা খেয়ে নাও। আর
বল্টুর সঙ্গে সতীশকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও”।
নিত্য বিকাশের মুখটা গামছা দিয়ে মুছে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মুখটা আবার
বেঁধে দেব কি?”
ইন্দ্র একটু চিন্তা করে বলল, “নাঃ খোলাই থাক। এখন চেঁচালে কেউ শুনবে
না, আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে, তোমার রদ্দা তো রইলই। আমি বরং ওর সঙ্গে দুটো কথা বলি,
ততক্ষণ, তুমি যাও, খেয়ে নাও”।
নিত্য ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, ইন্দ্র বিকাশকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি আমার
ঘর থেকে যে কাগজগুলো চুরি করে নিয়ে গেলেন,
সেগুলো কিসের কাগজ জানেন কি?”
“আজ্ঞে না। জানতাম না। মনোহরলালজি বলেছিলেন, কাজটা ভালোয় ভালোয় করে
দিতে পারলে, পাঁচহাজার টাকা দেবেন”।
“সে টাকা পেয়ে গেছেন?”
“কোথায়? ঘোড়ার ডিম পেয়েছি। কাগজগুলো যখন ওঁনার হাতে তুলে দিই, তখন
পাঁচশটাকা দিয়েছিলেন। ব্যস। তারপর আজ বিকেলে আমাকে ফোন করে বললেন, ওই স্যার...” মুখ
তুলে জীবকের দিকে দেখাল – “আপনার বাড়িতে আসছে কিনা নজর রাখতে আর জানাতে”।
“জানিয়ে দিয়েছেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। উনি বকুলপুর বাসস্ট্যাণ্ডে নামা মাত্রই জানিয়ে
দিয়েছি”। খুব ভয়ে ভয়ে বিকাশ উত্তর দিল।
“তার উত্তরে মনোহরলাল কী বলল?”
“বললেন, ফলো করতে। উনি এখানে এসে কতক্ষণ রইলেন, কথাবার্তা কী হল -কিছু
আঁচ করতে পারলে, জানাতে”।
ইন্দ্র একটু কড়া স্বরেই বলল, “তারপরেও বলছেন, আপনাকে ছেড়ে দিতে? মামার
বাড়ির আবদার, না?”
এই সময়েই বল্টু এসে ইন্দ্রর পাশে দাঁড়াল। তার পিঠে চড়ে আছে সতীশ।
ইন্দ্র বল্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, সতীশের দিকে হাত পেতে দিয়ে বলল, “সতীশ,
উঠে আয়”। সতীশ ইন্দ্রর হাতের তালুতে উঠে বসল।
ইন্দ্র তাকে নিজের বুকের কাছে নিয়ে, বিকাশ আর জীবকের মুখের দিকে তাকাল।
জীবক অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলল, “স্প্লেন্ডিড, ইন্দ্রদা ইউ আর দি গ্রেটেস্ট
জিনিয়াস”।
বিকাশ অবাক তো বটেই – ভয়ও পেয়েছে, সে আতঙ্কিত চোখে জিজ্ঞাসা করল,
“মানুষ না ভূত?”
ইন্দ্র বলল, “এই ছেলেটি ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গে এ বাড়িতে আমার ছোটভাইয়ের
মতোই বড়ো হয়েছে। ও যখন খুব ছোট্ট, এখান থেকে কিছুটা দূরে – ওদের গ্রামে প্রবল বন্যা
হয়েছিল। সে বন্যায় ও বাবা-মা দুজনকেই হারায়। আমার বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ি
এনে, আমার মায়ের কোলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে আমার মা, আমাদের দুজনকে নিজের ছেলের
মতোই বড়ো করেছেন। হতভাগার সব ভালো, শুধু লেখাপড়াতে কোনদিন এতটুকু মন দিল না।
সারাদিন মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, পাখপাখালির সঙ্গে কথা বলে। কাঠবেড়ালির সঙ্গে খেলা
করে। বাড়িতে কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে সময় কাটায়। বকুলপুরের যত লোকের দুঃখে কষ্টে পাশে
গিয়ে দাঁড়ায়। এক কথায় বলতে গেলে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়, আর আমাকে ভালবাসে
নিজের দাদার থেকেও বেশি”।
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ইন্দ্রর গলাটা একটু ধরে এল, একটু থেমে আবেগ সামলে আবার
বলল, “সতীশ আমাকে এতটাই ভরসা করে, বিশ্বাস করে যে, যখন আমি আমার এই নতুন
এক্সপেরিমেন্টের কথা ওকে বললাম, ও এক কথায় রাজি হয়ে গেল। জীবক, সতীশ একবারও ভাবেনি,
আমি আবার যদি ওকে ওর স্বাভাবিক চেহারা ফিরিয়ে দিতে না পারি, তাহলে ওর কী অবস্থা
হবে!”
একটু থেমে আবার বলল, “যে পাখ-পাখালি, কাঠবেড়ালি ওর বন্ধু – তাদের প্রায়
সবাই এখন ওর সমান আকারের। চিল, শিকরের মতো পাখি ওর পক্ষে মারাত্মক। পেঁচা, বাঁদর,
ইঁদুরের মতো প্রাণীও ওর পক্ষে মারাত্মক। এমনকি অচেনা কুকুর-বেড়ালও ওর পক্ষে আর
নিরাপদ নয়। যদি ওর আগের চেহারা আমি ফিরিয়ে দিতে না পারি, সারাজীবন ওকে ঘরেই বন্দী হয়ে,
ভয়ে সন্ত্রস্ত থেকে, আমাদের চোখের সামনেই বেঁচে থাকতে হবে”।
ইন্দ্রর হাতের তালুতে বসে, সতীশ দাদার বুকে মাথা রেখে হৃদয়ের শব্দ শুনছিল, আর সতীশের মাথায় পরম মমতায় গায়ে হাত বোলাতে লাগল ইন্দ্র। জীবক এবং বিকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আশ্চর্য এই বিজ্ঞানী আর তার সহযোগী ভাইয়ের দিকে।
রাতের বন্দী
ঘরের কেউই কথা বলছিল না, সকলেই নিজের মতো করে নিজ নিজ পরিস্থিতি চিন্তা
করছিল। এমন সময় ঝিঙেদা ঘরে ঢুকে বলল, “আজকে সারারাত এভাবে বসেই কাটিয়ে দেবে? বলি ঘুমোবে
কখন?”
ইন্দ্র বলল, “তোদের খাওয়া হয়ে গেছে, ঝিঙেদা? সেটাই তো ভাবছিলাম রে, এই
বিকাশটাকে কতক্ষণ আর এভাবে বেঁধে-ছেদে ফেলে রাখা যায়?”
বিকাশ খুব আনন্দে বলে উঠল, “আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার। মা কালীর দিব্বি
বলছি আমি মনোহরজিকে কিচ্ছু বলব না”।
“ওই আনন্দেই আপনি থাকুন, বিকাশবাবু। কিন্তু ঝিঙেদা, আমার চিন্তা হচ্ছে,
মনোহরলাল যদি এখানে খোঁজ করতে লোকজন পাঠায় এবং তারা যদি এই অবস্থায় বিকাশবাবুকে
দেখে, আমরাই বিপদে পড়ে যাবো”।
জীবক বলল, “কেন ইন্দ্রদা? ও যে চোর, আপনার ডকুমেন্ট চুরি করেছে, সে কথা
তো প্রমাণ হয়েই গেছে”।
ইন্দ্র বলল, “উঁহু। ঠিকঠাক বললে, চুরি তো করেনি, কপি করেছে। আর চোর হোক
আর যাই হোক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের, চোরকে বেঁধে রাখার কোন অধিকার আছে কি? নেই।
সে অধিকার আছে পুলিশের – প্রশাসনের। অতএব, ওর চুরি প্রমাণ হোক বা না হোক, ওকে
এভাবে ধরে রাখার জন্যে আমরাই অপরাধী হয়ে যাবো”।
ঝিঙেদার পেছনে নিত্য দাঁড়িয়ে, এতক্ষণ সব কথা শুনছিল, বলল, “ওকেও আপাততঃ
সতীশদাদাবাবুর মতো ছোট্ট করে দিন না। আমাদের সামলাতে সুবিধে হবে, আর চট করে
পালাতেও পারবে না। বাইরে একা একা বেরোলে কুকুর বেড়াল, কাক-চিল ছেড়ে দেবে নাকি?”
ইন্দ্র বলল, “আমিও সে কথাটাই ভাবছিলাম, তার আগে ওর মুখটা গামছা দিয়ে চট
করে বেঁধে ফেল, দেখি"।
বিকাশ ইন্দ্রর কথা শুনে চিৎকার করে উঠল, “না, না, স্যার, এমন করবেন না,
আমার ঘরে বুড়ি মা আছে, বউ ছেলে মেয়ে আছে, তাদের কথাটা চিন্তা করুন, আমার কিছু হয়ে
গেলে তারা না খেয়ে মরে যাবে, স্যার...” কথা শেষ করার আগেই নিত্য মুখটা চেপে বেঁধে
দিল বিকাশের মুখটা।
ইন্দ্র খুব নরম স্বরে বলল, “এত উতলা হবেন না, বিকাশবাবু, তিন-চার দিনের
ব্যাপার, তারপর আপনি আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। এই তিন চারদিন আপনাকে একটু কষ্ট তো
করতেই হবে। আমার বাড়িতে আপনি না বলে ঢুকেছেন, আমার ব্যক্তিগত জিনিষপত্র ঘাঁটাঘাঁটি
করেছেন, এই অভিযোগেই আপনার দিন পাঁচেক হাজতবাস হয়ে যেতে পারে, তারপর বিচারে দোষী
সাব্যস্ত হলে – তিনমাসের বা ছমাসের জেল হলে, সে কষ্ট আরও বেশি কষ্ট নয় কি? ঝিঙেদা
আর নিত্য, বিকাশবাবুকে ধরে দোতলার ছোট ঘরের বিছানায় নিয়ে চলো। আমি যাচ্ছি”।
বিকাশ হাত-পা খোলার জন্যে ছটফট করতে করতে কেঁদে ফেলল, মুখ দিয়ে নানান
আওয়াজ করছিল – কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। নিত্য আর ঝিঙেদা বিকাশকে তুলে নিয়ে
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।
ইঞ্জেকশানটা বিকাশের শরীরের পুশ করার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বিকাশ গভীর
ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ইন্দ্র বলল, “এবার ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দাও, নিত্য,
মুখটাও খুলে দাও। বেচারা এখন ঘুমোক।
জীবক জিজ্ঞাসা করল, “আপনার ওই ওষুধের প্রভাব কতক্ষণে বোঝা যাবে,
ইন্দ্রদা”?
“মোটামুটি বারো তেরো ঘন্টা পর থেকেই ওর শরীরে পরিবর্তন শুরু হয়ে যাবে,
তবে সম্পূর্ণ হতে মোটামুটি কুড়ি ঘন্টা”।
“আপনার ওষুধের একটা ডোজেই কি আপনার সতীশ বা এই বিকাশবাবু চিরদিনের
জন্যে লিলিপুট হয়ে থাকবে?”
“সঠিক জানি না, তবে সতীশকে প্রথমবার লিলিপুট বানিয়েছিলাম, মাস ছয়েক আগে
– তারপর আবার স্বাভাবিক করে তুলেছিলাম দিন সাতেক পরে। কারণ প্রথমবার সতীশ ছোট্ট
হয়ে গিয়েছিল ঠিকই – কিন্তু মাথাটা হয়ে গিয়েছিল নেড়া – একটাও চুল নেই। গায়ের লোম সব
উধাও। হাত-পায়ের আঙুলে একটাও নখ ছিল না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম - আমার ওষুধের
ফর্মুলায় কিছু ত্রুটি ছিল। কাজেই নতুন করে আবার গবেষণা শুরু করলাম। আরও একটা বিষয়
জানার বিশেষ প্রয়োজন ছিল – সেটা হল আমার বানানো ওষুধের কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অর্থাৎ সাইড এফেক্ট কিছু রয়েছে কি না”।
“সে রকম কিছু পেয়েছেন?”
“সতীশের ওপর আমার ফর্মুলার ওষুধ প্রয়োগ করার আগে – ওর শরীরের পুরো
মেডিক্যাল চেক আপ করিয়েছিলাম। ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার তিনচারদিনের
মধ্যেই আবার একই রকম চেক আপ করিয়েছিলাম। না ডাক্তারেরা কোন তফাৎ বুঝতে পারেননি।
বরং ডাক্তার বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন আমার ওপর। বলেছিলেন, সুস্থ স্বাভাবিক একটি ইয়াং
ছেলেকে কেন বারবার চেক আপ করিয়ে হয়রান করছি? তাঁরা আমাকে বাতিকগ্রস্ত বা ছিটিয়াল অভিভাবক
ভেবেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই” ইন্দ্র একটু হাসল।
“তারপর সতীশের ওপর ওষুধটা আবার কবে প্রয়োগ করলেন”?
“এই তো দিন পনের হল। আমার ওষুধের ফর্মুলার ত্রুটিগুলো সব ঠিকঠাক করে
যখন মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, তখন”।
“এবারে আর কোন গণ্ডগোল হয়নি?”
ইন্দ্র মুচকি হাসল “নাঃ। একশ ভাগ পার্ফেক্ট। সাইজে ছোট হয়েছে ঠিকই
কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক শরীরে যা ফিচার থাকা উচিৎ - সব আছে”।
“সত্যিই এমন যে হতে পারে, ভাবা যায় না – অবিশ্বাস্য। নিজের চোখে দেখেও
মনে হচ্ছে কল্প বিজ্ঞানের গল্প। আচ্ছা, আপনার ভাই সতীশকে স্বাভাবিক অবস্থায় আবার
ফিরিয়ে আনতে কতক্ষণ সময় লাগবে?”
“মোটামুটি একই সময় লাগে – ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর কুড়ি ঘন্টা”।
ঝিঙেদা বলল, “এভাবে গল্প করেই রাত কাবার করবে নাকি? শুতে যাবে না?”
ইন্দ্র বলল, “এঃহে সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেল, শোওয়ার ব্যবস্থা কী
করেছিস, ঝিঙেদা?”
ঝিঙেদা বলল, “তুমি তোমার ঘরেই শোবে – কিন্তু আজ সতীশ আর বল্টুও শোবে
তোমার ঘরে। নতুনবাবু শোবে এ ঘরের পাশের ঘরটায়। নিত্যদা শোবে আমার সঙ্গে”।
“তাহলে শুয়ে পড়া যাক, জীবক গুড নাইট। কালকে অনেক কাজ আছে...”।
ইন্দ্র নিজের ঘরে ঢুকে দেখল তার খাটের পাশে আলাদা মশারি খাটানো ছোট্ট
বিছানায় সতীশ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মেঝেয় শুয়ে বল্টুও ঘুমোচ্ছিল, তার পায়ের শব্দে দুবার
লেজ নাড়ল। সতীশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইন্দ্র বিছানায় বসে চিন্তা করল, জীবক
ছেলেটি কেমন? ইন্দ্র তাকে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু সে কতটা বিশ্বাসযোগ্য? সে তো ওপক্ষেরই
লোক। মনোহরলালের সঙ্গে তার যোগসাজশ থাকতেই পারে! আজ রাত্রে সে যদি চুপিসাড়ে বেরিয়ে
যায় – মনোহরলালকে গিয়ে সব বলে দেয়...!
হঠাৎ দরজায় টোকা দিয়ে মাথা বাড়াল নিত্য, পিছনে ঝিঙেদা। সতীশ ঘুমোচ্ছে
বলে ইন্দ্র খুব চাপা স্বরে বলল, “কী ব্যাপার? তোমরা এখনও শুতে যাওনি?”
“কত্তা, আপনার অনুমতি ছাড়াই একটা কাজ আমি করে এসেছি, সেই কতাটাই বলতে
এলাম। ঝিঙেদা ওই নতুন বাবুটির ঘরে গিয়েছিল খাবার জল দিতে। সঙ্গে আমিও ছিলাম।
বেরোনোর সময় ওঁনার ফোনটা আমি ওঁকে বলেই নিয়ে এসেছি, আর দরজায় বাইরে থেকে শিকল তুলে
দিয়ে এসেছি। ও ঘরের সঙ্গে বাথরুম আছে – কাজেই রাতে-ভিতে দরকার পড়লে অসুবিধে হওয়ার
কথা নয়। আসলে, কার কী মতলব বোঝা যাচ্ছে না, কত্তা। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করাটা কোন
কাজের কথা নয়। আপনার ওই জীবকবাবু আজ থাকুক রাতের বন্দী হয়ে”।
ইন্দ্র স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাসল, বলল, “এবার তোমরা শুতে যাও, কাল সকাল
থেকে অনেক ঝামেলা...”।
জরুরী মিটিং
ইন্দ্র আর জীবক ডাইনিং টেবিলেই একসঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট সারছিল। জীবক
কালকের তুলনায় বেশ গম্ভীর। সকালে প্রথম দেখা হতে “গুড মর্নিং” বলা ছাড়া আর একটাও
কথা বলেনি।
ইন্দ্র বলল, “রেগে আছ নাকি? কাল রাত্রে তোমাকে বন্দী রাখা হয়েছিল বলে?”
জীবক ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, “সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আমাকে বিশ্বাস করতে
পারলেন না, ইন্দ্রদা?”
ইন্দ্র বলল, “দেখ জীবক, আমার এই ফর্মুলাটা দুর্জন লোকের হাতে পড়লে – গরীব
সাধারণ মানুষদের নিয়ে তারা ছেলেখেলা শুরু করে দেবে। যেভাবে ইওরোপের কিছু জাতি ব্রিটিশ,
ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজরা করেছিল, আমাদের দেশবাসীদের সঙ্গে এবং আফ্রিকার সমস্ত
অধিবাসীদের সঙ্গে। মানুষের ভবিষ্যত সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে কয়েকজন বজ্জাত লোকের
জন্যে। সেই ফর্মুলা একবার চুরি হয়ে গিয়েছে - কাজেই আমার সতর্ক থাকাটা জরুরি। তাই
নয় কি?”
জীবক বলল, “তোমার কথা মানছি, কিন্তু আমাকে...আমি তো নিজেই তোমার কাছে
এসেছি”।
“কাল রাত্রের ব্যাপারটা নিয়ে এত কেন ভাবছ, জীবক? ওই একটা ব্যাপার ছাড়া,
সব বিষয়েই আমরা খোলাখুলি আলোচনা করেছি। তাই না? ওটা ভুলে যাও। এখন আমাকে বলো তো,
মনোহরলাল তোমাকে যে ডকুমেন্টগুলো দিয়েছিল, সেগুলো কি প্রিন্টেড কপি? নাকি পিডিএফ
ফাইল, ফোনে বা মেলে পাঠিয়েছিল?”
“প্রিন্টেড কপি বা ফটোকপি করা”।
“তুমি ছাড়া আর কাকে কাকে দিতে পারে, সে ব্যাপারে তোমার কোন আন্দাজ
আছে?”
“আমার দুজন বসকেও দিয়েছে সেটা আমি নিশ্চিত, কিন্তু আর কাউকে দিয়েছে
কিনা...”।
“তোমার বসদের নাম কি?”
“প্রফেসার বীরেন্দ্র ঘোষ দস্তিদার, সংক্ষেপে বিজিডি আর দুরন্তসূর্য সামন্ত, আমরা ওঁনাকে ডিএসটু বলে থাকি”।
“এঁনারা লোক কেমন? এঁদের সম্পর্কে তোমার ব্যক্তিগত মত কি?”
“প্রফেসর বিজিডি, আদ্যন্ত অধ্যাপক – পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই প্রায় বোঝেন
না। অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ছাত্রদের সঙ্গে নিজের পুত্রের মতো ব্যবহার করেন”।
“আর ডিএসটু?”
“বিজিডি স্যারের একদম উল্টো। আমার তেমন পছন্দ হয় না। ভদ্রলোক প্রচুর
বিত্তবান বোঝা যায় এবং তাঁর এই বিত্তের উৎস নিয়ে নানান কথা শোনা যায়। আচ্ছা,
ইন্দ্রদা আপনি বিজিডিকে চেনেন না? আপনার সম্পর্কে উনি কিন্তু অনেক কিছুই জানেন। মনোহরলালজির
সঙ্গে মিটিংয়েও উনি আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন।”
ইন্দ্র হাসল, বলল, “আমার বিদ্যের অনেকটাই বিজিডিস্যারের দান। ওঁনাকে
চিনব না? তোমার থেকে জানতে চাইছিলাম, ওঁনার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা! কিন্তু ওঁনার
মত সজ্জন ভদ্রলোক মনোহরলালের দলে ভিড়লেন কী করে?”
“আমার মনে হয় ডিএসটুই বিজিডিস্যারকে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়েছেন। বিজিডিস্যার
সরল মনের মানুষ...। ডিএসটু আমাকেও তোমার নামে অনেক কিছু বলেছিলেন। আপনি নাকি ইটালির
কোন এক মাফিয়া দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে গোটা বিশ্বের
মানুষকে আপনারা “লিলিপুট” বানিয়ে, গোটা পৃথিবীটাই কুক্ষিগত করে নেবেন!”
“আশ্চর্য, বিজিডিস্যার আমার সম্পর্কে এসব কথা বিশ্বাস করে নিলেন?”
“না ইন্দ্রদা, আমার মনে হয়, এ সব কথা উনি বিজিডিস্যারকে বলেননি। তাঁকে অন্য
কিছু বুঝিয়েছেন। কী বলেছেন, আমি জানি না। ডিএসটু ভয়ানক ধুরন্ধর আর শয়তান লোক এটুকু
আমাদের ইনস্টিটিউশনের সবাই জানে”।
ইন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁম। এরকম লোকের হাতে ফর্মুলা গেলে কী হতে
পারে বুঝতে পারছ, জীবক? ফটোকপি করা ওই ডকুমেন্টগুলো আর কার কার কাছে, কোথায় কোথায়
চলে গেছে, কে জানে? জানি না, তারা কী মতলব ভাঁজছে!”
জীবক বলল, “একটা কথা বলব, ইন্দ্রদা? আমার হাতে যে পেপারগুলো রয়েছে, যার
একটা মাত্র পৃষ্ঠাই আমি পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি – সেটা তোমার কোন থিসিসের নোট্স্
- সেটা আর যাই হোক, তোমার ওই “লিলিপুট” বানানোর ফর্মুলা নয়”।
ইন্দ্র অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জীবকের চোখের দিকে, তারপর হো হো করে হাসল
কিছুক্ষণ, বলল, “ভেরি গুড জীবক। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। তোমাকে
ফাঁকি দিতে পারিনি”।
জীবক লাজুক হেসে বলল, “আপনার প্রশংসা পাওয়া আমার কাছে বিরাট পাওনা।
আমাদের ইনস্টিটিউশনে বিজিডি স্যারের পরেই আপনার কথা আলোচনা হয়। সে ঠিক আছে। কিন্তু
তোমার আসল ফর্মুলা তো চুরি যায়নি, তাহলে তুমি এত টেনসন করছ কেন?”
“জীবক ভুলে যেও না, মনোহরলাল আমার কাছে এসেছিল ওই ফর্মুলাটা কিনতে। আমি
রাজি না হওয়াতে আমাকে আর ঝিঙেদাকে বিচ্ছিরি কোন ওষুধ খাইয়ে প্রায় দুদিন নির্জীব
করে রেখেছিল। আর তার মধ্যে ওই বিকাশকে পাঠিয়েছিল আমার ঘরের ক্যাবিনেট থেকে ফর্মুলা
চুরি করতে। চুরি করতে পারেনি, তার কারণ আমি ফর্মুলার কাগজ ওখানে রাখিইনি। কিন্তু...”
“কিন্তু কি, ইন্দ্রদা”?
“দ্যাখ, তোমার আমার মতো বুদ্ধিমান মানুষ এই দেশে আর কেউ নেই এটা ভেবে
নেওয়াটা হবে চরম বোকামি। তুমি যেমন ধরে ফেলেছ ওটা সেই ফর্মুলা নয়, তেমনি আরও কেউ
কেউ আছেন যাঁরা ধরে ফেলতে পারবেন। এবং মনোহরলালের কাছে সে খবর পৌঁছে গেলে, আমাকে
ছেড়ে দেবে ভেবেছ? সে আমাকে কিছু করবে না, কিন্তু ঝিঙেদা কিংবা সতীশকে হয়তো তুলে
নিয়ে যাবে – বলবে ফর্মুলা না দিলে ওদের মেরে ফেলবে। তখন? তখন আমি কী করব? মনোহরলালকে
ঠেকাতে পারব?”
জীবকের চোখেমুখেও আতঙ্ক, বলল, “সত্যিই তো, এভাবে ভাবিনি। এ ধরনের লোক
স্বার্থের জন্যে যা খুশি করতে পারে। এখন কী করবে ভাবছো?”
ইন্দ্র ঘড়ির দিকে তাকাল, বলল, “এখন পৌনে নটা বাজে। বিকাশ আজ বিকেল চারটে
সাড়ে চারটে নাগাদ মোটামুটি সতীশের সমান হয়ে যাবে। ভাবছি আজকে একটা মিটিং ডাকব। সন্ধে
ছটা নাগাদ। সেখানে পুলিশের বড়সায়েব এসিপিস্যার থাকবেন, তুমিও
থেকো আর থাকবে মনোহরলাল ঘংঘোরিয়া। তাছাড়া পুরো মিটিংটার ভিডিও রেকর্ড করাব কোন
নিউজ চ্যানেলের প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে দিয়ে”।
জীবক বলল, “পুলিশের বড়োসায়েব আসবেন? আর মনোহরলাল? সে বুঝে গেছে বিকাশ
ধরা পড়েছে, এবং জেনে গেছে আমিও তোমার সঙ্গে রয়েছি”।
ইন্দ্র বলল, “বড়োসায়েবের সঙ্গে আমার যা পরিচিতি, আমি সাহায্য চাইলে তিনি
না এসে পারবেন না। এবং আমি ও তিনি দুজনেই মনোহরলালকে ডাকলে তাকে আসতেই হবে। তার
অপকর্মের সাক্ষী স্বয়ং বিকাশ তো রয়েছেই। তুমি আছ, বিজিডি স্যারও আছেন। আর বিজিডিস্যারকে
আজকের মিটিংয়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে আমি ডাকলে, আশা করি, না করবেন না”।
“মিটিংয়ে কী নিয়ে আলোচনা করবেন, ইন্দ্রদা?”
ইন্দ্র হাসল, বলল, “এখন থাক, সেটা মিটিংয়েই শুনে নিও। আর হ্যাঁ, তুমি এখন বাড়ি
যেতে পার, তবে মিটিংয়ের সময় অবশ্যই থাকবে”।
জীবকও হাসল, বলল, “আমি তো যাব না, ইন্দ্রদা। ভাবছি আপনার কাছেই রিসার্চ
করব, বিজিডি স্যার আশা করি অনুমতি দেবেন। আমি আপনার সঙ্গেই থাকব, আর আজ রাত্রেও
আপনাকে আর ঝিঙেদাকে জ্বালাব”।
১৪
লিলিপুটিয়াম
বিকেল সাড়ে
পাঁচটা নাগাদ বিজিডি স্যার এলেন কলকাতা থেকে, আর এসিপি সায়েব
এলেন পৌনে ছটা নাগাদ। চা-বিস্কুট খেতে খেতে ইন্দ্র এ কদিনের সব ঘটনার কথা বলল। তার
সঙ্গৎ করল জীবক। তারপর দুজনকেই বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে ছোট্ট সতীশ আর বিকাশকেও চিনিয়ে
দিল। এসিপি সায়েব নিজের ফোনে ওদের ছবি তুলে বললেন “আনবিলিভেব্ল্। বিজ্ঞানকে তোমরা
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ইন্দ্র?” বিজিডিস্যার খুব গর্বের সঙ্গে বললেন,
“ইন্দ্র ইজ দা ব্রাইটেস্ট স্টুডেণ্ট, আমার সুদীর্ঘ কেরিয়ারে ওর মতো ছেলে আর একটিও পাইনি।
ইন্দ্র আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ”।
ইন্দ্র
সলজ্জ মুখে হাত কচলাল, বলল, “আপনাদের প্রশ্রয় আর সাহায্য না পেলে…। স্যার, একটা ব্যাপারে
আপনাদের অনুমতি চাই”।
এসিপি
সায়েব বললেন, “কি ব্যাপারে, ইন্দ্র?”
ইন্দ্র
বলল, “মনোহরলালকে নিয়ে আমাদের এই মিটিংটার একটা ভিডিও রেকর্ডিং করাতে চাই। তার জন্যে
সব ব্যবস্থাও হয়ে গেছে”।
এসিপি
সায়েব ভুরু কুঁচকে বললেন, “এসবের কী দরকার, ইন্দ্র? আরেকটু খুলে বল”।
ইন্দ্র
বলল, “প্রথম কথা মনোহরলালের শয়তানিটা সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়তঃ আপনাদের মতো গণ্যমান্য
মানুষদের সামনে আমার এই আবিষ্কারের একটা রেকর্ড রেখে দেওয়া”।
এসিপি
সায়েব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “রেকর্ড তুমি রাখতে চাও, রাখো। কিন্তু এই ভিডিও যেন
কোন নিউজ চ্যানেলে না আসে, ইন্দ্র”।
“আসবে
না স্যার, এটা আমি আমার ব্যক্তিগত ব্লগে আপলোড করব। সেখানে পুলিশের একজন বড়ো সায়েবের
উপস্থিতি বোঝা যাবে, কিন্তু তিনি যে আপনিই সেটা বোঝা যাবে না”।
এসিপি
সায়েব অবাক হলেন, বললেন, “বিজিডি স্যারকে চেনা যাবে?”
ইন্দ্র
বলল, “হ্যাঁ, ওঁনাকে রাখতেই হবে”।
এসিপি
সায়েব বললেন, “তাহলে আমাকে কেন নয়, ইন্দ্র? আমি কী দোষ করলাম?
এরকম একটা আবিষ্কারের সাক্ষী হলে, আমি নিজেকে গর্বিতই বোধ করব”।
ইন্দ্র
বলল, “ওঃ। আমি ভেবেছিলাম আপনি নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইছেন। তাহলে তো কোন কথাই নেই স্যার”।
এসিপি
সায়েব বললেন, “নিউজ চ্যানেলকে আমি ভয় পাই। একবার দেখালেই হাজার লোকের হাজার প্রশ্নের
সামনে পড়তে হবে রোজ – ওটা আমার সহ্য হয় না। তুমি তো বিজ্ঞানী হিসেবে তোমার নিজের ব্লগে
দেবে, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে ভিডিওটার একটা কপি আমাকেও দিও, নিজের কাছে রেখে
দেব। কিন্তু তোমার আসামি এখনও পর্যন্ত এল না, ছটা দশ হয়ে গেল। ব্যাটা আসবে তো?”
“আসবে
স্যার। এই ধরনের লোকেদের সময় জ্ঞান থাকে না। আপনি ডেকেছেন, না এসে যাবে কোথায়?”
ইন্দ্রর
কথা শেষ হতে না হতেই মনোহরলাল এসে উপস্থিত হল আর কী আশ্চর্য তার সঙ্গে এসেছেন ডিএসটু!
মনোহরলাল
চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “এসিপি সাব, হামার একটু দের হয়ে গেলো, আমি মাফি মাগল। প্রফেসার
সাব আপনিভি এখানে এসেছেন! তাজ্জব কি বাত!”
মনোহরলালের
কথার কেউ কোন উত্তর দিল না। এসিপি সায়েব বললেন, “সকলেই যখন এসে গেছে, ইন্দ্র তোমার
কথা শুরু কর”।
“হ্যাঁ
স্যার। শুরু করছি”।
কথা
শুরুর আগে, সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ইন্দ্র। বিশেষ করে মনোহরলাল আর ডিএসটুর।
মনোহরলাল ভুরু কুঁচকে কড়া চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর ডিএসটু ভয়ে ভয়ে বারবার আড়চোখে
তাকাচ্ছে এসিপি সায়েবের দিকে। ইন্দ্র ইশারাতে ফটোগ্রাফার দুই ছেলেকে ইশারা করল, ভিডিও
শুরু করার জন্যে। ওরা ক্যামেরা অন করতেই, ইন্দ্র গলাটা সাফ করে নিয়ে বলতে শুরু করল,
“এখানে সকলেই সকলকে চেনেন, কাজেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ঝামেলায় যাচ্ছি
না। সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি”।
মনোহরলাল
আচমকা বাধা দিল, বলল, “এসিপি সাহাব, এরা ভিডিও কেনো তুলছে? এটা আমার ঠিক পসন্দ হোল
না। আপনি কি পারমিসন দিয়েছেন?”
এসিপি
সায়েব ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন, আর মুখে আঙুল দিয়ে মনোহরলালকে চুপ করতে ইশারা করলেন।
ইন্দ্র
আবার শুরু করল, “আজ থেকে আটমাস আগে আমি একটি ওষুধ আবিষ্কার করি। ওষুধটির নাম দিয়েছিলাম
“লিলিপুটিয়াম”। যেটার নির্দিষ্ট একটা মাত্রা ইঞ্জেকশন করে শরীরে প্রয়োগ করলে, যে কোন
প্রাণী আকারে ছোট হয়ে যাবে। । কিরকম একটা উদাহরণ দিই, একজন ছেলে, তার হাইট যদি সাড়ে
পাঁচফুট হয় – সে তিন ইঞ্চির হয়ে যাবে”।
অন্য
কেউ চমকে গেল না, কিন্তু ভিডিও করা ছেলে দুটি চমকে উঠল। একজন বলেই ফেলল, “কী বলছেন,
ইন্দ্রদা…”। বলে ফেলেই সে অবিশ্যি জিভ কেটে চুপ করে গেল। তার মনে পড়ল ভিডিওতে কথা-বার্তাও
রেকর্ড হয়ে চলেছে।
“আমার
এই ওষুধটি পরীক্ষার জন্যে প্রথম প্রয়োগ করেছিলাম, আমার ছোট ভাই সতীশের ওপর। মোটামুটি
কুড়ি ঘন্টা ঘুমিয়ে থাকার পর, সে যখন জাগল, সে সত্যিই ছোট হয়ে
গেল। তখন তার হাইট মাত্র তিন ইঞ্চি। তবে কিছু একটা ভুল ছিল আমার ফর্মুলায়। সতীশ ছোট
হল ঠিকই, কিন্তু তার মাথায় চুল ছিল না, গায়ে লোম ছিল না, হাত-পায়ের আঙুলে নখ ছিল না।
অতএব চার-পাঁচদিনের মধ্যেই আমার ওষুধের অ্যান্টিডোট, যার নাম রেখেছি “গালিভারিয়াম”
প্রয়োগ করে ওকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলাম।
এখানে
বলে রাখি, লিলিপুটিয়াম প্রয়োগ করার তিনচারদিন আগে আমি স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে দিয়ে সতীশের
থরো হেলথ চেক আপ করিয়েছিলাম। এবং গালিভারিয়াম প্রয়োগ করে সতীশ যখন স্বাভাবিক অবস্থা
ফিরে পেল, তার চারদিন পরেও একই রকম হেলথ চেক আপ করিয়েছিলাম। প্যাথলজিস্টরা এবং সেই
স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্রথমবার ও দ্বিতীয়বারের রিপোর্টে কোন তফাৎ খুঁজে পাননি। অর্থাৎ
আমার ওষুধের সেরকম কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ধরা পড়েনি।
সে
যাই হোক, এর পরে আমি আমার ফর্মুলাগুলো আবার চেক করলাম, এবং ছোটখাট কিছু পরিবর্তন করে
নতুন লিলিপুটিয়াম বানিয়ে আবার প্রয়োগ করলাম আমার ভাই, বেচারা
সতীশের ওপর। এবারে আর কোন সমস্যা হল না। সর্বাঙ্গসুন্দর নিখুঁত – শুধু ওর হাইটটাই হল
তিন ইঞ্চি।
এরপরই আমি আমার রিসার্চ রিপোর্ট বিদেশী জার্নালে প্রকাশের জন্যে পাঠাই
এবং সে জার্নালে পেপারটি অচিরেই প্রকাশিত হয়। তারপরেই বিষয়টা নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে গেল
– একদিকে প্রচুর প্রশংসা, আর অন্যদিকে, তার থেকে অনেক বেশি বহু বিরূপ মন্তব্য, ঠগ,
জোচ্চোর, মিথ্যেবাদী ইত্যাদি শুনতে হল।
জানি না, কার থেকে আমার সেই সুনাম ও বদনাম শুনেই মনোহরলালজির কৌতূহল হয়,
এবং দিন সাতেক আগে একটি প্রস্তাব নিয়ে আমার বাড়ি আসেন। আমার ফর্মুলাটি নিয়ে তিনি
প্রকল্প বানাতে ইচ্ছুক – আমার জন্যে লাভের বখরা ঠিক করেছিলেন, প্রথমে কুড়ি তারপরে তিরিশ
পারসেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই আমি রাজি হইনি। তাতে উনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, সহজ কথায়
কাজ না হলে, ওঁনার অন্য রাস্তাও জানা আছে। একধরনের ধমকিই বলা চলে, তাই তো মনোহরলালজি?”
মনোহরলালজি বললেন, “এ আপনি কী বোলচেন ইন্দরবাবু? আপনার মতো সেলিবিরিট
মানুষকে হামি ধমকি দিবে...”!
এসিপি সায়েব আগের মতোই ইশারা করে মনোহরলালজিকে চুপ করতে বললেন, তারপর
বললেন, “ইন্দ্র তুমি বলো”।
“তারপরেই মনোহরলালজির কী দয়া হল জানি না, যাওয়ার সময় হঠাৎ আমাকে আর
ঝিঙেদাকে প্রভুজির প্রসাদ খাওয়ালেন। কয়েকটি করে চাল বা শুকনো ভাতের দানা। পুরীর
মহাপ্রভুর প্রসাদ যেমন হয়, প্রায় সেরকমই। যদিও এই প্রসাদ-ট্রসাদে আমার তেমন
বিশ্বাস নেই, তবুও না করতে পারলাম না। এমনিতেই ওঁনার “বেওসা”র প্রস্তাব নাকচ করে
দিলাম, তার ওপর প্রসাদ নিতেও না করব? খেয়েই নিলাম।
এরপর ঠিক কখন থেকে আমরা – মানে আমি আর ঝিঙেদা - গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে
পড়েছিলাম জানি না। শুধু এটুকু মনে আছে ঘুম একটু পাতলা হলেই সারা শরীরে – বিশেষ করে
মাথায় কাঁধে বিশ্রী একটা ব্যথা অনুভব হত। আর সারা শরীরে ক্লান্তি – আবার ঘুমিয়ে
পড়তাম। মাঝে কয়েকবার টয়লেট যেতে ভয়ানক কষ্ট হত, সেটা মনে আছে। এভাবেই চলল প্রায়
দুদিন। তৃতীয় দিন দুপুরে আমরা উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় এলাম। এই
দুটো দিন আমার ভাই ছোট্ট সতীশ, আর আমাদের কুকুর বল্টু দুজনের কী অসহায় অবস্থা,
চিন্তা করুন। তারা না পেরেছে বাইরে গিয়ে ডাক্তার ডাকতে, না পেরেছে আমাদের দুজনের
ঘুম ভাঙাতে! এসিপি স্যার, সেসময় আমাদের দুজনের কিছু হয়ে গেলে, বেচারা সতীশও মারা
পড়ত”।
মনোহরলালজি বলে উঠলেন, “হায় রাম, এ একদম ঝুট – প্রভুজির পরসাদ...”।
এসিপি সায়েব এবার জোর ধমক দিলেন, “চোপ! আপনার যা বলার আছে পরে শুনব, এখন ইন্দ্রকে বলতে দিন”।
মনোহরলালজি একদম চুপসে গেলেন। ইন্দ্র লক্ষ্য করল, ডিএসটুর মুখটাও
ফ্যাকাসে হয়ে গেল ভয়ে।
ইন্দ্র
আবার শুরু করল, “তৃতীয় দিন দুপুরে, আমরা উঠে বসলাম, কিন্তু ঘরে প্রায় কিছুই ছিল না
খাবার মতো। সে সময় নিত্যানন্দ দাস – আমাদের পরিবারের পুরোন লোক সে এসে না পড়লে আমাদের
দুর্গতির সীমা থাকত না। এই নিত্যানন্দ দাস থাকাতে আমার পরের কাজগুলো করতে খুব সুবিধেই
হয়েছিল। সত্যি বলতে ও না থাকলে, মনোহরলালজির শয়তানিগুলো আমি ধরতেই
পারতাম না।
যাই
হোক, প্রায় আড়াই দিন পর দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে, আমাদের দুজনেরই একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে
পড়াটা নিয়ে চিন্তা করলাম এবং সন্দেহ হল। আমার পড়ার ঘরে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম,
আমার কোন ডকুমেন্টই চুরি যায়নি, কিন্তু
কপি হয়ে গেছে। ডকুমেন্টটা ছিল একটা প্লাস্টিক ফোল্ডারে। সেটায় খুঁজে পেলাম অচেনা হাতের
ছাপ – ওই ফোল্ডারে কোনভাবেই যা আসতে পারে না। আমার কাছে কিছু যন্ত্রপাতি আছে যা দিয়ে
ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে মানুষটাকে চিহ্নিত করা যায়। দেখলাম তার নাম বিকাশ সামন্ত”।
নামটা
শুনেই মনোহরলালজি চমকে উঠল। ইন্দ্র হেসে বলল, “বিকাশ সামন্তই
মনোহরলালজির বেঁকানো আঙুল”। ইন্দ্রর খোঁচায় মনোহরলালজি
কোন উত্তর দিল না, আড়চোখে এসিপি সায়েবের দিকে তাকাল।
ইন্দ্র
আবার শুরু করল, “এর মধ্যেই সেদিন বেশ রাতের দিকে জীবক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল, এবং
আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। সাইকেল নিয়ে ওকে বকুলপুর বাসস্ট্যাণ্ড
থেকে আনতে গেল নিত্য। আড়াল থেকে জীবককে ফলো করছিল বিকাশ, ওদের পিছনে
বিকাশও এসে পৌঁছে গেল আমাদের বাড়ির পিছনে। নিত্যর সতর্কতায় বিকাশ ধরা পড়ে গেল। প্রথমে
অস্বীকার করলেও, পরে বিকাশ সব কথাই স্বীকার করে নিয়েছে। আমার ডকুমেন্টগুলো চুরি করতে পারলে বিকাশকে পাঁচহাজার টাকা দেবে বলেছিল
মনোহরলালজি কিন্তু দিয়েছে মাত্র পাঁচশ। তাই না, মনোহরলালজি, সব দিকেই মুনাফা!
সে যাক, আমাদের হাতে ধরা পড়ার আগেই বিকাশ যে মনোহরলালজিকেই
ফোন করেছিল, তার কল রেকর্ডও আমি বিকাশের ফোনে দেখেছি। বিকাশ আমাদের এখানেই আছে, কিন্তু
সে ছোট্ট বিকাশ। আপনাদের সামনে নিয়ে আসছি”।
এই
বলে ইন্দ্র নিত্য আর ঝিঙেদাকে ডেকে বলল, সতীশ আর বিকাশকে এই ঘরে আনতে। দুজনকে হাতে
করে নিয়ে এল নিত্য। তারপর টেবিলের ওপর মোটামোটা দুটো বইয়ের ওপর আলাদা আলাদা বসিয়ে দিল
দুজনকে। সতীশ বইয়ের ধারে পা ঝুলিয়ে আনন্দে পা দোলাতে লাগল। আর বিকাশ জড়োসড়ো হয়ে বসে
রইল, ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল সবাইকে।
মনোহরলালজি আর
ডিএসটু আঁতকে উঠল দুজনকে দেখে। মনোহরলালজি বলে উঠল, “ইন্দরবাবু,
বিকাশকে এ কোণ্ডিশনে লিয়ে এলেন, ওর ফেমিলির বেপারটা একবার শোচলেন না? এসিপি সাব, আপনিই
এ বিচারটা ঠিক কোরেন”।
এসিপি
সায়েব খুব ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, “মনোহরলালজি, ইন্দ্র তো তার কীর্তির
কথা শোনাচ্ছে এবং দেখাচ্ছে, আর আপনি যে এতগুলো কুকীর্তি করলেন, তার কোন বিচার হবে না,
বলতে চান?” মনোহরলালজি আর কিছু বলল না, চুপ করে বসে রইল। ইন্দ্র
নিত্যকে বলল, “সতীশকে ভেতরে নিয়ে যাও নিত্য, ওর এসব কথা না শোনাই ভাল”।
নিত্য
সতীশকে ভেতরে নিয়ে যেতে ইন্দ্র বলল, “বিজিডি স্যার এবং এসিপি
স্যার, এবার আমার কথার উপসংহার টানি। প্রথমেই জানাই, আমার “লিলিপুটিয়াম” এবং “গালিভারিয়াম”
ওষুধের ফর্মুলা চুরি যায়নি। মনোহরলালজির লোক বিকাশ যে কাগজগুলো
কপি করে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো অতি সাধারণ কিছু নোট্স্। সেটা বুঝতে পেরেই জীবক আমার
সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। অতএব চুরি করা ডকুমেন্ট দিয়ে ওই ওষুধ বানানোর কোন সম্ভাবনাই
নেই, এ ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।
তবে
এ কদিনের ঘটনা থেকে আমি এবং আমরা সকলেই স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার ওই ফর্মুলা মনোহরলালজি এবং ডিএসটুর মতো মানুষদের হাতে পড়লে, আমাদের সর্বনাশের শেষ
থাকবে না। অতএব সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি ওই ফর্মুলা নষ্ট করে ফেলব”।
বিজিডি স্যার
বললেন, “কী বলছ ইন্দ্র, বিজ্ঞানের এত বড়ো একটা আবিষ্কারকে তুমি নষ্ট করে ফেলবে?”
ইন্দ্র
সবিনয়ে বলল, “স্যার আমরা সবাই জানি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ফিসন, ফিউসনের তত্ত্ব আবিষ্কার
করে, একটা ফর্মুলা বানিয়েছিলেন - ই ইকোয়ালস টু এম সি স্কোয়ার। তিনি জানিয়েছিলেন, ক্ষুদ্র
একটা কণিকাকে ভাঙতে পারলে কী বিপুল পরিমাণ শক্তি সৃষ্টি করা সম্ভব। সে ফর্মুলা দিয়ে
অন্য বিজ্ঞানীরা বানিয়েছিলেন এটম বোম্ব। আইনস্টাইনের আশ্চর্য তত্ত্বের কী বীভৎস পরিণাম,
স্যার চিন্তা করুন। এখন নিউক্লিয়ার ওয়েপন জলভাত হয়ে গেছে। আমার ফরমুলা নিয়েও এমনটা
ঘটুক আমি মনেপ্রাণে চাই না। আমার বানানো “গালিভারিয়াম” ওষুধে, আমার ভাই সতীশ এবং বিকাশকে
আমি আগের অবস্থাতেই ফিরিয়ে আনব। এবং সেই সঙ্গেই শেষ করে দেব আমার এই আবিষ্কারের সমস্ত
নথি ও প্রমাণ”।
ইন্দ্রর
কথা শেষ হতে কেউই কোন কথা বললেন না অনেকক্ষণ। একটু পরে, এসিপি সায়েব বললেন, “ইন্দ্র,
তোমার আবিষ্কার নিয়ে তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু মনোহরলালজি, ইন্দ্রর থেকে আপনার সম্পর্কে যা যা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি,
তাতে এই সবের পেছনে আপনার হাত যে রয়েছে সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। আপনার বিরুদ্ধে
এখনই কোন পদক্ষেপ আমি নিচ্ছি না। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার দিকে তো বটেই, আপনার বিশাল
ব্যবসার দিকেও আমাদের নজর থাকবে। আপনি এখন আসতে পারেন”।
বিজিডি স্যারও
বললেন, “মনোহরলালজি, আপনি দুরন্তবাবুকেও সঙ্গে নিয়ে যান। ছি ছি,
আপনাদের কথায় বিশ্বাস করে ইন্দ্রর মতো ছেলেকে আমি অবিশ্বাস করেছিলাম! দুরন্তবাবু, মনোহরলালজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আপনি আমাদের বিজ্ঞানীসমাজের মাথা এভাবে
হেঁট করে দিতে পারলেন? খুব খারাপ করলেন, খুব খারাপ…”।
মনোহরলালজি আর
ডিএসটু মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ইন্দ্র ইশারায় ভিডিও ফটোগ্রাফি বন্ধ করতে বলল।
বিজিডি স্যার
এবং এসিপি সায়েবও উঠে দাঁড়ালেন। এসিপি সায়েব বললেন, “আমাকে তোমার ভিডিওর কপি একটা দিও,
ইন্দ্র। আর তোমার ওই “গালিভারিয়াম” পেয়ে সতীশ আর বিকাশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে, কেমন থাকে জানিও”।
“নিশ্চয়ই
জানাব, স্যার”।
“আমরা
তাহলে আসি?”
“আসার
জন্যে অনেক ধন্যবাদ স্যার”। ইন্দ্র বলল।
--**--
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন