সুদূর মার্কিনমুলুক থেকে বললেই ঝট
করে চলে আসা যায়? এক তো অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করা, তার ওপর টিকিট কাটা! আজকাল
উড়ানসংস্থাগুলা টাকা নেংড়ানোর কল পেতে বসে আছে। তার মধ্যে থেকে সস্তা, কিন্তু কম
ঘুরপথ অথচ পা ছড়ানোর বিস্তর জায়গাওয়ালা উড়ান খুঁজে বের করা নেহাৎ কম ঝক্কি নয়। গত
বুধবার সকালে পিতার দেহরক্ষার সংবাদ পাওয়ার পর, মাত্র পাঁচটি কর্মদিবস পার না হতে,
মঙ্গলবার রাত্রে তমালসায়েবকে কলকাতায় পৌঁছতে দেখে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়পরিজন
সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগল। আজকাল বাবামায়ের প্রতি ছেলেমেয়েদের এত দায়িত্ববোধ বড়
একটা দেখা যায় না। আজ বুধবার সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু করে, স্বর্গের শীত থেকে বাবার
দেহ বের করে, তারপর নিমতলা ঘাটে দাহ করে, অনেকটা শান্ত হলেন তমালসায়েব।
বহুদিন সুট-বুট পরা সায়েব, কাচা
কাপড়ের ধরাচূড়ো ধারণ করে, কোমরে কম্বলের আসন গুঁজে, মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে, তমালসায়েব
আজ সকাল থেকেই বাবু হয়ে বসে আছেন বসার ঘরের সোফায়। তাঁকে ঘিরে, কিছু প্রতিবেশী,
কিছু আত্মীয় বসে আছেন। বসে আছেন পুরোহিত মশাই। ঘাট, শ্রাদ্ধ আর নিয়মভঙ্গ
অনুষ্ঠানের নিয়ম কানুন, কর্তব্য নিয়ে জোরদার আলোচনা হচ্ছে। তমালসায়েব তেমন কিছু
বলছেন না! তিনি শুনছেন, সকলের মতামত এবং সিদ্ধান্ত।
তাঁর প্রতিবেশী নির্মল নস্কর, নির্মলবাবু
বললেন, ‘পুরোহিতমশাই, আমি বলি কী - ঘাট, শ্রাদ্ধ আর নিয়মভঙ্গ একই দিনে সেরে ফেললে
হয় না?’ একথায় পুরোহিতমশাই কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেন। তিনদিনের পৌরোহিত্য একদিনে সারলে,
পুরোহিতের হিতটা কী আর পুরো হয়? হয় না, আংশিক হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু
নির্মলবাবুকে কিছু বলাও সম্ভব নয়, কারণ এই শাঁসালো প্রবাসী মক্কেলের সন্ধান দিয়ে
তাঁকে ডেকে এনেছেন, নির্মলবাবুই।
তাই একটু বেজার মুখে বললেন, ‘তা
হয় বৈকি। থ্রি ইন ওয়ান কম্বো অফার। সকলে সমবেতভাবে গঙ্গার ঘাটে সকাল সকাল পৌঁছে
যাওয়া। সেখানে ঘাট কর্তব্য, কেশশ্মশ্রুমুণ্ডনাদি কর্মের পর, ওই স্থলেই শ্রাদ্ধাদির
অনুষ্ঠান দ্বিপ্রহরের মধ্যে সমাধা করে, ঘাট থেকে সোজা পিত্তরক্ষা এবং নিয়মভঙ্গর
জন্যে গৃহে প্রত্যাবর্তন।’
নির্মলবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘বাঃ,
ভেরি গুড! তমালসায়েব, পুরোহিত পণ্ডিত আর অভিজ্ঞ হলে খুব সুসার হয়। শাস্ত্রের সব
বিধান, আর সমস্যার সমাধান, তাঁদের এক্কেবারে ঠোঁটের ডগায়! আমার তো মনে হয়, এর থেকে
ভালো কিছু আর হতে পারে না। তমালসায়েব, কী
বলেন? আমার প্রস্তাব, গঙ্গার ঘাট থেকে ঘরে ফেরা নয়, সোজা “হেসে হেসে হেঁসেলে”-এ।
নতুন বাঙালি রেষ্টুরেন্ট। রান্নাবান্না একদম আগেকার দিনের মা, পিসিমা, জ্যেঠিমার
মতো। সোনামুগের ডাল, সবৃন্ত বেগুনভাজা, সুগন্ধী সাদা ভাত, শুক্তো, এঁচোড়ের ডালনা,
দুরকমের মাছ – কাতলার কালিয়া আর তোপসের সর্ষে ঝাল, আনারসের চাটনি, পাঁপড়, পরমান্ন,
দই, মিষ্টি! ব্যস্ - সমস্ত কর্তব্যই সুসম্পন্ন, একই দিনে! আপনার মতো ব্যস্ত
মানুষের পক্ষে এর থেকে বেশি সময় ব্যয় করার মতো সময় কোথায়? আজকাল সফল মানুষের হাতে
অর্থ, সম্পদ, প্রতিপত্তি, অক্ষয় যৌবন, দীর্ঘ আয়ু সব আছে, কিন্তু যা নেই, সেটা
হচ্ছে সময়! কী, ভুল বললাম?’ বসার ঘরে উপস্থিত দশ-বারোজন পরিজন-প্রতিবেশীদের সকলের
দিকে তাকিয়ে নির্মলবাবু জিগ্যেস করলেন।
উপস্থিত সকলেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি
জানাল। দু-একজন চিন্তিত মুখে বলল, ‘তাই তোওওওও! সে আর বলতেএএএএএ’!
নির্মলবাবু খুবই করিতকর্মা লোক।
যে কোন বিপদে, রণে বনে জলে জঙ্গলে, তাঁর সাহায্য পাওয়া যায়, সর্বত্রই তাঁর
চেনাজানা ঘনিষ্ঠ লোকের অফুরন্ত সংস্থান। আজ সকাল থেকেই যেমন, তমালসায়েবের পিতৃদেবের
দেহ বের করা, সৎকার সমিতির এসি কাচের গাড়ি, শ্মশানযাত্রীদের জন্য তিন খানা এসি
গাড়ি। শ্মশানে ভিআইপি লাইনে দাহ, অস্থি সংগ্রহ এবং গঙ্গায় বিসর্জন পর্যন্ত সমস্ত
কিছুই মসৃণ হয়ে গেছে, তাঁর কয়েকটি মোবাইল কলের দৌলতে।
তমালসায়েব প্রবাসী বাঙালীসায়েব
সুলভ গাম্ভীর্যে গলা ঝেড়ে বললেন, ‘একদিনেই সব কাজ সুসম্পন্ন হচ্ছে, সে খুব ভালো
কথা। কিন্তু ইয়ে, মানে একটা কথা বলছিলাম, ব্যাপারটা
কালকের মধ্যে সেরে ফেলা যায় না?’
পুরোহিতমশাই এবার কিছুটা অধৈর্য
হয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে স্যার, তাতে কিঞ্চিৎ বাধা আছে। কারণ আপনারা ব্রাহ্মণ,
শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণদের দশদিন অশৌচের বিধান। আজ বুধবার, বিধিমতে শুক্রবার ঘাট-অনুষ্ঠানের
দিন, মানে পরশু’।
‘হুঁ। কিন্তু আমার আরও কিছু
কাজকর্ম ছিল। বাবার ব্যাংকে, পোস্টাপিসে কোথায় কী আছে। ধারদেনা, বাকি বকেয়া,
সেসবেরও একটা ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্যেও চার-পাঁচটা ওয়ার্কিং ডে পেলে ভালো
হত’। মুখ বেঁকিয়ে আরো বললেন, ‘ইণ্ডিয়াতে যা ওয়ার্ক কালচার – চার-পাঁচদিনেও হবে কী
না সন্দেহ! শুক্রবার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান হলে, তার পরের দুটোদিন, শনি-রবিবারে কোন
কাজ হবে না – দুটো দিন বেকার যাবে’।
নির্মলবাবু খুব জোরের সঙ্গে বললেন,
‘ওটা কোন সমস্যা হল, তমালসায়েব? দশদিন পর্যন্ত অশৌচ, তার আগে করা যাবে না, কিন্তু
তার পরে করতে তো কোন আপত্তি নেই? কী পুরোহিতমশাই? আমরা অনুষ্ঠানটা যদি রোববারে করে
ফেলি? ছুটির দিন। কোনই ঝঞ্ঝাট নেই। শুনেছি, ফরেনের দিকে দুগ্গাপুজোও তো কোন একটা
উইকএন্ডে হয়। শনি-রোববারে চারদিনের কমপ্যাক্ট পুজো কমপ্লিট। রোববারে আপনার
পিতৃদেবের কাজ হলে, বেষ্পতি, শুক্র, শনি তিনটে দিন আপনি ব্যাংক-পোস্টাপিসের কাজগুলোও
কিছুটা সামলে নিতে পারবেন, কী বলছেন?’
তমালসায়েব গদগদ স্বরে বললেন, ‘তেমনটা
করা গেলে, বড্ডো উপকার হয়, পুরোহিতমশাই’।
পুরোহিতমশাই তেঁতোমুখে ঘাড় নেড়ে
বলল, ‘তা মন্দ হয় না, করতেই পারেন। আপনারই তো বাবা, আপনি তাঁর সুযোগ্য পুত্র, যেমন
করে তাঁর ক্রিয়াকর্ম করতে চান সেভাবেই হতে পারে’।
‘আজ্ঞে, তার মধ্যে খরচ-খরচার
ব্যাপারটাও জেনে যাওয়া যাবে, বড়োকত্তার পোস্টাপিসের খাতায় যা আছে, সেটা তুলতে
পারলে, সব খরচই মনে হয় উঠে আসবে। স্যারকে আর ডলার ভাঙাতে হবেনি’।
ছোটমুখে এতো বড়ো কথাটা যে বলল, সে
ঘরের কোনায় মেঝেয় বসেছিল। ময়লা জামাপ্যান্ট পরা, ভাঙা গালে উড়োখুড়ো দাড়ি, কোটরে
বসা চোখ। ঘরের অন্য সকলে তার কথায় কিছুটা অবাক হয়ে, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
নির্মলবাবু বললেন, ‘তমালসায়েব, ইনি
কী আপনাদের কেউ? আপনার পিতৃদেবের দেখাশোনা করত?’
তমালসায়েব আকাশ থেকে পড়লেন, ‘সে
কী? আপনারা কেউ ওঁকে চেনেন না? আমি তো ভেবেছিলাম, এই আবাসনের কেয়ার টেকার, বা
পাড়ার রিকশওয়ালা! আমি তো কস্মিনকালেও দেখিনি ওঁকে! কলকাতায় আমি এলাম অবিশ্যি বছর
খানেক পরে, তবে বাবার সঙ্গে ফোনে তো রেগুলার যোগাযোগ রাখতাম। এমন লোকের কথা বাবার
মুখেও কোনদিন শুনিনি। কে আপনি, ভাই?’ উটকো ওই লোকটার আলটপকা মন্তব্যে নির্মলবাবু
মোটেই খুশি হননি। তিনি থাকতে এই জমায়েতে কেউ মাতব্বরি করে বেরিয়ে যাবে, এ কখনো হতে
পারে? আর তিনি তা হতে দেবেনই বা কেন?
তমালসায়েবের অচেনা জেনে, নির্মলবাবু
খুব জোর পেয়ে গেলেন, এক ঝটকায় ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে গিয়ে বললেন, ‘অ্যাই যে,
শোনো, কী করা হয়? এখানে এভাবে জাঁকিয়ে বসে রয়েছো, তুমি কে হ্যা? বলি মতলবটা কী?’
লোকটা ম্লান হেসে বলল, ‘আজ্ঞে
আমার সঙ্গে বড়োকত্তার আলাপ থা ধরুন গে’, মাস ছয়েক হবে। তারপর থিকে আমি হামেশা
আসতাম। বড়োকত্তা আমায় বেশ স্তেঁহ করতেন। আর এদান্তিতে আমাকে বেশ কিচুটা পেস্শয়
দিয়ে, আমাকে মাতায়ও তুলচেলেন। ইয়ে মানে...আমার মতো নোকের সঙ্গে তাঁর যে সকল কতা
বলা উচিৎ লয়, সে সব কতাও খুব বলতেন’।
নির্মলবাবু আর ধৈর্য রাখতে পারলেন
না, এসব উটকো লোককে অঙ্কুরেই বিনাশ না করলে, পরে ভোগান্তি বাড়াবে। নির্মলবাবু খুব
রাগতস্বরে বললেন, ‘তুমি কোথাকার হরিদাস পাল হে? মেসোমশাই তোমার সঙ্গে এমন কথা
বলেছেন, যা বলা তাঁর উচিৎ হয়নি? এত বড়ো আস্পদ্দা তোমার? কাঁর সম্বন্ধে কী কথা বলছো
জানো?’
‘আজ্ঞে জানি বৈকি। উনি মস্তো
সরকারি অফসার চেলেন। এক সময় খুব দাপট চেল ঠিকই, কিন্তু এদান্তিতে খুব দুখী থাকতেন,
আজ্ঞে। বিশেষ করে গিন্নিমা চলে যাওয়ার পর থিকে। আপনারা সব ব্যস্তমস্ত মানুষ, তাঁর
খপর নেওয়ার আপনাদের সময় কোতায়? বড়োকত্তা খুব বলতেন, ছেলেপিলেকে বেশি ন্যাকাপড়া
শিকিয়ে বড়োমানুষ বানিও না, বাবা। থালেই আমার দশা হবে। আমি বলতাম, কী যে বলেন কত্তা, রোজ যাদের
জন্যে দুবেলা ভরপেট ভাত যোগাতে পারি না, তাদের ন্যাকাপড়া শেকাবো কী করে? ওসব
আপনাদের বিলেস, কত্তা। ছেলেমেয়েকে কাঁড়ি কাঁড়ি খরচা করে বড়ো বড়ো ইস্কুল-কলেজে
পড়াবেন, “কোচিনে” পাঠাবেন, সাঁতার শেকাবেন, কিরিকেট শেকাবেন, গান শেকাবেন, লাচ
শেকাবেন। আর সভায় গিয়ে বক্তিমে দেবেন, আমরা শিশুদের শৈশব কেড়ে লিচ্চি। এতই যকন
জানেন, থালে শৈশব কেড়ে লিচ্চেন কেন? কে মাতার দিব্যি দিয়েচে, একবার শুনি?’
নির্মলবাবু আর থাকতে পারলেন না, “তুমি”
থেকে “তুই”তে নেমে, চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘হারামজাদা,
তুই এইসব বলতিস, বড়োকত্তাকে? বড়োকত্তা তোর জিভ ছিঁড়ে নেন নি?’
‘আজ্ঞে ওই কতাটাই তো বলতিসি। যখন অফসর
চেলেন, এসব কতা তিনি শুনতেন? চারদিকে আরদালি, মোসায়েব, আমার মতো আলবড্ডে তাঁর কাচ
ঘেঁষতে পারত? পারতনি। আর পারলেও এমন কতা বললে, বাপরে, জুতিয়ে পিটের চামড়া তুলে
দিতেন না? কিন্তু মাস ছয়েক খুব কাচ থেকে তো দেকলাম, মানুষটা অনেক আগেই য্যান মরে
গেচিল, স্যার। খুব
দুকখু করে বলতেন, ছেলেকে মানুষ করে ফলটা কী হল বলো? চার-পাঁচমাস হতে চলল, ছেলে,
ছেলের বউ একটা ফোন করেও খপর লেয় না। বুড়ো বাপটা মরল না, বাঁচল – একবার জানতেও কী
তাদের মন যায় না, বাবা? থা আমি বললাম, দুক্খু করেন কেন বড়োকত্তা, ফলের আর দোষ কী?
যেমন কর্ম করেচেন, তেমন ফল পেয়েচেন? ছেলে ন্যাকাপড়া শিকে বিদ্দান হল, বিদেশ গেল।
আপনি বুক ফুলিয়ে, গর্ব করে দশজনকে বলে বেড়ালেন, ছেলে আমার ফরেন গ্যাচে। আপনার মুক,
আপনার বংশের মুক উজ্জ্বল করল। আজ আর সে খোঁজখপর ল্যায় না বললে চলবে ক্যানে? লিজের
দেশের গোলামি সে একরকম। বাইরের দেশের গোলামি কী চাট্টিখানি কতা? ঠাটবাট বজায় রাকতে
কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, সে তো আপনি আমার থেকে অনেক ভালো জানেন কত্তা! আমি আর কিই বা
জানি, গণ্ডমুক্খু একখান’।
নির্মলবাবু আবার কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলেন, তমালসায়েব বাধা দিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সঙ্গে বাবার আলাপ হল কী করে?
দেখা হল কোথায়?’
‘আজ্ঞে সে পাকেচক্রে হয়ে গেচল। সেদিন
উনি গেচলেন পোস্টাপিসে টাকা তুলতে, আমিও গেচলাম কিচু টাকা কামাতে’।
নির্মলবাবু আবার ধমকে জিগ্যেস
করলেন, ‘পোস্টাপিসে টাকা কামায় তো এজেন্টরা। তুই কী পোস্টাপিসের এজেন্ট
নাকি?’
‘আজ্ঞে, আপনারা বিদ্দন বিদ্যেধর
মানুষ। আপনারা কতাবাত্তা যেমন খুশি ঘুরিয়েজড়িয়ে, প্যাঁচ-পয়জারি করে বেশ বলতে
পারেন, আমরা মুক্খু তো, কতার মাঝে কতা কাটলে, আমাদের খেই হারিয়ে যায়। সব বলবো,
একটু ধৈজ্জ ধরেন, আজ্ঞে। বড়োকত্তা বুড়ো
মানুষ, খুব দুব্বল, তারওপর সেদিন শরীলটাও মনে হল ঠিক নেই। খুব কাশতেচিলেন। টুকুর
টুকুর করে এসে লাইনে দাঁড়ালেন, বিস্তর লোকের পেছনে। পেনসনের দিন খুব ভিড় হয়। আর ওই
সবদিনেই আমাদেরও দু-চারশো কামাই হয়। এর ব্যাগ থেকে, ওর পকেট থেকে’।
‘তার মানে, তুই চোর? পকেটমার’? নির্মলবাবু
আর সহ্য করতে পারছিলেন না লোকটাকে। সেই থেকে হতভাগা বকে বকে সময় নষ্ট করে চলেছে।
এতক্ষণ তাঁর কত কাজ হয়ে যেত! কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলে, সকলের যাওয়া আসার জন্যে
ভলভো বাস বুক করা। তমালসায়েব এবং তাঁর পুরো হিতের জন্যে খরচ-খরচার একটা হিসেব করা।
শ্রাদ্ধের কেনাকাটা। কতজন নিমন্ত্রিত হবে বুঝে, “হেসে হেসে হেঁসেলে”তে টেবিল বুক
করা। কাজ কম নাকি? নিপুণ হাতে এসব করতে পারলে দশ-বিশহাজার উপরি কামাইও হয়ে যাবে! ডলারের
বহতা স্রোত থেকে মাত্র ঘটিদুয়েক ইণ্ডিয়ান কারেন্সি!
নির্মলবাবু কড়া গলায় বললেন, ‘আমি
এখনই থানার বড়োবাবুকে ফোন করছি। হাজতে ভরে কদিন আড়ং ধোলাই পড়লেই, সব রস শুকিয়ে
যাবে, হতভাগা’।
তমালসায়েব এবার একটু বিরক্ত হলেন,
বললেন, ‘নির্মলবাবু, সে না হয় পরে করবেন, এখন ওঁকে বলতে দিন না, কী বলতে চাইছে। আপনি
বলুন, ভাই’।
‘ভিড়ের মধ্যে ভিড় হয়েই আমরা মিশে
থাকি, সুযোগের সন্ধান করি। কখন কে একটু আনমনা হবে, একটু অসাবধান হবে। নিমেষের
মধ্যে আমাদের কাজ সারতে হয় কিনা? বড়ো কত্তার অবস্থা সেদিন বেজায় খারাপ ছিল আজ্ঞে,
দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হতেচেল। আমি বললাম, আপনি চেয়ারে বসেন কাকু, আমি আপনার লাইন
রাখতিসি। আপনার সময় হলে, ডেকে নেব। আমার কতায় বড়োকত্তা যেন হাতে সগ্গো পেলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে,
ফোকলা মুখে ঘোলাটে চোখে এমন হাসলেন, দেকে আমি একেবারে ন্যাজেগোবরে হয়ে গেলাম।
বড়োকত্তাকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসালাম। চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বড়ো আরামে
বসলেন বড়োকত্তা। আমার বাপটা মরে গেচে, বাবু, বছর কয়েক হল। ওইরকমই বুড়ো হয়েচেল,
অসুখবিসুখ কিচু হয়েচেল কিনা জানি না, ডাক্তার দেখাবো, চিকিচ্ছে করাবো, সে সংস্থান
তো আর আমাদের নেই। আপনাদের, স্যার সংস্থান আছে, তবু বড়োকত্তার চিকিচ্ছে হলনি। হঠাৎ একদিন সকালে দেকলাম,
আমার বাপটা রাতের বেলা টুপ করে কখন যেন মরে গেছে! শক্ত হয়ে যাওয়া শরীর, মুখটা হাঁ
করা, তাতে দু একটা মাছি ঘুরতিচে। কাচের গুলির মতো শেতল চোকদুটো আধখোলা তাকিয়ে
রয়েচে টালির চালের দিকে। বড়োকত্তার ওপর খুব মায়া হল, নিজের ওপর খুব খানিক ঘেন্নাও
হল। এই বুড়োগুলোর থেকেই আমি টাকা সরাই! মড়ার ওপর আমিই দিই খাঁড়ার ঘা! সেদিন সব
উল্টোপালটা হয়ে গেল। আমার কাজকম্মো আর কিচুই হল না। বড়োকত্তার টাকা তুলিয়ে, রিকশা
ডাকলাম, রিকশায় ধরে বসিয়ে দিলাম।
বড়োকত্তা বড্ডো অসহায় আর দুব্বল কণ্ঠে
বললেন, ‘তুমি যাবে না, সঙ্গে?’
‘আমি?’
‘যাবে না?’ কতাদুটোর মধ্যে যে কী
আকুতি ছিল, সে আমি বুজয়ে পারবনি, স্যার। আমি রিকশায় উঠে পাশে বসলাম। শুধু
রিকশাতে নয়, এই ঘর অব্দি পৌঁচে দিয়ে গেলাম।
দরজা থেকে ফিরতেচিলাম, বড়োকত্তা বললেন,
‘এতটাই উপকার যখন করলে, বাবা, আরেকটু করবে না? শরীরের অবস্থা তো দেখছো, ঘরে খাবার
নেই, ওষুধ নেই। কাজের মেয়ে, কলমিটাও কদিন
ধরে না আসাতে, বড়ো আতান্তরে পড়ে গেছি, বাবা।’
সেই শুরু হল, আমার যাওয়া আসা।
যতটা পারতাম করতাম। বড়োকত্তাও অবুঝ ছিলেন না, হাতে টাকা গুঁজে দিতেন। কখনো দুশো,
কখনো তিনশো। মায়া পড়ে গেচিল, ভাবতেচিলাম খুব একখান উবগার করতিসি! কিন্তু হাত পেতে
টাকা নিলে উবগারটা আর উবগার রইল কোথায়? পয়সার বিনিময়ে কী আর উবগার হয়, স্যার? এই
সব যাওয়া-আসার মধ্যে কতাবাত্তাও হত। বড়ো দুক্খু করতেন। বলতেন, শেষ বয়সে এসে,
নিজের বলতে সঙ্গে কেউ রইল না, রে। একমাত্র ছেলে থেকেও নেই। এ কেমন হল বলো দিকি, বাবা?’
অনেকক্ষণ কথা বলে উটকো লোকটা একটু থামল, সকলে মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইল, কেউ
কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ পর লোকটা আবার বলল, ‘আমাকে
বড়োকত্তা এই সদর দরজার একটা চাবিও দেচেলেন। বলেচেলেন, শুনেচি আমার মতো বুড়োদের
অনেকে বন্ধ ফ্ল্যাটে মরে পড়ে থাকে, কেউ জানতেও পায় না। কদিন পরে পচা দেহের দুগ্গন্ধ
থেকে প্রতিবেশীদের টনক নড়ে। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে পচা লাশ নিয়ে যায়। তোর কাচে একটা
চাবি রাখ, বাবা। দিনে একবার অন্ততঃ দেখে যাস, টিকে আচি কী না। তা একবার করে আসতাম
রোজ। সেদিনও এসচেলাম। দরজা খুলে
বড়োকত্তাকে ডেকে সাড়া পেলাম না। ঘরের ভেতর ঢুকে দেকলাম, বড়োকত্তা যেমন ভেবেচেলেন,
তেমনই হয়েচে। বিছানার ওপর শক্ত হয়ে শুয়ে আচেন, সিলিংয়ের দিকে আধবোজা চোখ মেলা।
মুখটা অল্প হাঁ করা। তবে মাছি নেই, পাঁচতলার ঘরে মাছি আসে না বোধহয়। নিচের
কেয়ারটেকারবাবুকে খবর দিলাম। লোকজন আসতে শুরু করল, ভিড় জমে উঠল, আমি ভিড়ের মধ্যে
মিশে রইলাম’।
উটকো লোকটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ
করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তমালসায়েবের দিকে এগিয়ে গিয়ে, জামার পকেট থেকে একটা চাবি
বের করে বলল, ‘এই সেই চাবি আপনারে ফেরত দিলাম। আর আমারও তো একেনে পেয়োজন ফুরিয়েচে,
আমি আসি থালে, স্যার?’
তমালসায়েব লোকটার কথায় সামান্য
আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সেটা সামলে চশমা খুলে চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘আপনি,
আসবেন মানে? কোথায় যাবেন? আপনার নামটাও তো জানতে পারলাম না’।
‘হে হে হে, আমার নামধাম জেনে কী
করবেন বাবু? পুলিশের খাতায় আমার নামও আছে, ছবিও আছে, আজ্ঞে, আমি - আমার নাম পরিমল সর্দার’।
নির্মলবাবু অনেকক্ষণ পর সুযোগ
পেয়ে কথা বললেন, কথার ভঙ্গিতে তীব্র শ্লেষ! ‘পরিমল সর্দার? কাদের সর্দার,
তস্করদের?’ ঘরের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রসিকতা করলেন, ‘চোরের নাম আবার পরিমল?’
লাজুক ম্লান হেসে পরিমল বলল, ‘না
বাবু, সর্দার হলে কী আর এভাবে থাকতোম? তস্কর বটে তবে তস্করদের সর্দার নই। সর্দার
হয় আপনাদের মতো ভদ্রলোকদেরই কেউ কেউ, সে আমরা নই আজ্ঞে, আমিও নই। আমরা তস্কর, কিন্তু সে
করি দুমুঠো চালের জন্যি, আর ভদ্রলোকেরা চুরি করে বড়োলোকি চালের নোভে। ছোট মুকে বড়ো
কথা কয়ে ফেললাম, আজ্ঞে। মনে কিচু লেবেননি, এখন আমি আসি বাবু। আপনারা অনেক উঁচু
থাকের মানুষ। অসহায় বুড়োমানুষটা আতান্তরে পড়ে কটা মাস আমায় ভরসা করেচেলেন, তা বলে
কী আমি আপনাদের যুগ্যি হয়ে উটেচি? তাই আবার হয়? পোস্টাপিসে আসবেন, সেকেনে দেকা
হবে, আপনার কোন অসুবিধে হবে না। নমস্কার আজ্ঞে, আপনাদেরও নমস্কার”।
..০০..
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন