[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
১
শনিবারের রাত আর রোববারের সারাটা দিন কলকাতার মেসে একা একা কাটানো বড়ো বিড়ম্বনা। অফিস থেকে ফিরে অন্যদিন যে মেসে সর্বদা হইহুল্লোড়, হইচই আর আড্ডা লেগে থাকে, সেখানে যেন বিরাজ করে শ্মশানের স্তব্ধতা। মেসের ম্যানেজার, মাঝবয়েসি ভদ্রলোক, খ্যাংরা কাঠির ডগায় আলুরদম টাইপের চেহারা। নাম সত্যচরণ। লোক খারাপ নয় – মেসের সকলের সঙ্গেই তাঁর সদ্ভাব। এই হপ্তায় তিনি বলেছিলেন বাড়ি যাবেন না, কিন্তু বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজতেই তিনি পড়ি কি মরি দৌড়লেন হাওড়া স্টেসান। বাড়ি থেকে কি জরুরি তার এসেছে, বাড়ি না গেলেই নয়। তাঁর বাড়ি বেলমুড়ি। সকালের দিকে বেলমুড়ি নাম শুনলে ওই লাইনের লোকজন খুব রেগে যায়, বলতে হয় শ্রীফল-চালভাজা। হাওড়া থেকে সন্ধে ছটা ষোলোর বর্ধমান কর্ডের ট্রেন ধরবেন তিনি।
সত্যবাবু বেড়িয়ে
যাবার পর কানাইবাবু ছিলেন লাস্ট। ওঁর বাড়ি কাঁচড়াপাড়া, শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরেন।
মেস থেকে শেয়ালদা হাঁটা পথে পাঁচমিনিট। কানাইবাবু বেরোনোর আগে মৃগাঙ্কর ঘরে এসে বললেন,
“কি ব্রাদার, গিন্নি বাড়ি নেই বলে, এ হপ্তাটা ডুবই দিয়ে দিলেন? একলা মেসে কী করে থাকবেন
মোহায়, জানিনা। এখনো সময় আচে, ঝটপট বেরিয়ে পড়ুন ছটা আটান্নর ট্রেনটা ধরে ফেলুন। গিন্নি
নেই তো কি হয়েচে, বাপ-মা আচে, বন্ধুবান্ধব আচে। সময়টা তবু কেটে যাবে। কলকেতার ধুলো-ধোঁয়া থেকেও
দুটো দিন মুক্তি মিলবে”।
“না, না কানাইবাবু। কাজেকম্মে কদিন বেশ অবহেলা করে ফেলেছি।
বেশ কিছু কাজ জমা হয়ে গেছে। ভাবছি এই দুটো দিনে সেগুলো সামলে নেব”।
“বটে? তবে তাই সামলান। এদিকে দেকলাম সত্যচরণবাবুও সটকে পড়লেন”।
“হ্যাঁ। বললেন বাড়ি থেকে তার এসেছে, জরুরি ব্যাপার”।
“ধুর মোহাই, আপনিও যেমন। ও তার কি আর টেলিগ্রাপের তার? ও
মনের তার, শনিবারের বিকেল হলেই টক্কা টক্কা টরে টক্কা”। এক চোক বন্ধ করে খ্যাঁ
খ্যাঁ করে হাসল, কানাইবাবু। “যাকগে, তাহলে আপনি সত্যি সত্যি যাচ্চেন না, তাহলে আমি
আসি। সোমবার সন্ধেয় আবার দেকা হবে”।
কানাইবাবুর চলে যাওয়া জুতোর শব্দ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে এক
সময় আর শোনা গেল না। আর তখনই মৃগাঙ্কর মনে হল, মেসের খালি ঘরগুলো এবার দাঁত
শানাচ্ছে। সন্ধের অন্ধকার নামলেই দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে মৃগাঙ্কর ওপর।
কানাইবাবু কথাটা খারাপ কিছু বলেন নি। তার গিন্নি আশালতা তিন
মাসের ওপর পশ্চিমের ভাগলপুরে বাপের বাড়ি গেছে। কথা ছিল একমাসের মধ্যেই ফিরে আসবে।
তিন সত্যি করে গিয়েছিল। কিন্তু আসেনি। গোলাপি খামে হপ্তায় দুটো করে চিঠি লেখে।
কিন্তু সে চিঠিতে কি আর সামনে দেখার আনন্দ মেলে, নাকি মেলে স্পর্শের রোমাঞ্চ? মাঝে
শ্বশুরমশাইয়ের চিঠি এসেছিল, মৃগাঙ্কর বাবার কাছে। মৃগাঙ্ক গত শনিবার বাড়ি গিয়ে
মায়ের কাছে সেই চিঠি দেখেছিল ।
“পরমশ্রদ্ধেয় বৈবাহিক মহাশয়,
পরম মঙ্গলময়ের করুণায় আশা করি আপনি ও বেয়ান মহোদয়া
সর্বাঙ্গীন কুশলে আছেন। আমাদের পরম আদরের মৃগাঙ্কবাবাজীবনও সুস্থ ও কুশলে আছে।
কলিকাতায় মেসে তাহার কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য আমরা যারপরনাই দুশ্চিন্তায় থাকি জানিবেন।
আপনাদের দুইজনের স্নেহ ও আদরে আমাদের কল্যাণীয়া কন্যা আশালতা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিতা ও
আনন্দিতা। তাহার মুখে সর্বদা আপনাদিগের স্নেহের কথা শুনিয়া আমার পিতৃহৃদয়ে কিঞ্চিৎ
ঈর্ষা অনুভব হয় সত্য, কিন্তু কন্যা সন্তানের পিতা হিসাবে আশালতা মার এই নিশ্চিন্ত
আনন্দে আমার দুই নয়ন যে অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠে, তাহা অস্বীকার করিব কী প্রকারে?
এক্ষণে, একান্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই, আমার মাতাঠাকুরাণির পীড়ার
কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি হইয়াছিল। এক্ষণে শ্রীরাধাগোবিন্দের কৃপায় তিনি ধীরেধীরে উপশম
হইতেছেন। অন্ধ স্নেহের বশে তিনি তাঁহার পৌত্রী আশালতাকে সর্বদাই কাছে কাছে ধরিয়া
রাখিতে চাহেন। পীড়িতা মাতার অবুঝ চিত্তের সান্ত্বনার জন্য আশালতা মাকে আটকাইতে
বাধ্য হইলাম । অতএব একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনাদিগের স্নেহক্রোড়ে আশালতার
ফিরিতে কয়েকদিন বিলম্ব হইবে, তাহার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত এবং আমার কথার খেলাপ
হইবার কারণে আমি অত্যন্ত লজ্জিত জানিবেন। মাতাঠাকুরানি কিঞ্চিৎ আরোগ্য লাভ করিলেই,
আমি সকন্যা আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইব এবং আপনাকে আমার পরিবারের সমস্ত কথা অবগত
করাইব।
লক্ষ্মীজনার্দ্দনের ন্যায় আপনারা চিরসুখী থাকুন। জামাতা
বাবাজীবনকে আমার আশীর্ব্বাদ দিবেন। বাড়ির গুরুজনদের আমার প্রণাম ও ছোটদের আমার
প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাইবেন। ইতি।
শ্রদ্ধাবনতঃ
অমিয় কান্তি সান্যাল।
সেই চিঠি পড়ার পর থেকে তার বুকের ভেতর জমতে শুরু করেছে
অভিমানের পাহাড়। গত বুধবার আশালতার একটা চিঠি পেয়েছে মৃগাঙ্ক। তাতেও নতুন কিছু
নেই, একই খবর। ফেরারও কোন হদিস নেই।
“ওগো,
আজি তিন মাসের ওধিক আপনার সহিত আমার দেকা হয় না। আপনি
কি খাচ্চেন কি কচ্চেন, আপনার ধুতি জামা কে পষ্কার করে দিচ্চে এই চিন্তা
সারাদিন আমাকে কুরে কুরে খায়। আমার বুকের এ ব্যাতা কারও কাচে মুক ফুটে বলতেও
পারি না। ঠাকুরমার শরীর খারাপের খপর বাবার চিটিতে আশা করি পেয়েচেন। ঠাকুরমা খুব কাঁদেন আর বলেন লতু আমার কাচটিতে এসে বোস, আমার
মাতায় হাত বুলিয়ে দে। বুড়ো মানুষ, আমাদের কাঁকে-কোলে করে মানুষ করেচেন, কি করি বলুন?
আপনার দুই পায়ে পড়ি, রাগ কোরবেন না লক্ষিটি। আমি কি জেনেশুনে আপনাকে এত কষ্ট দিচ্চি, বলুন?
ওই ঠাকুরমা আবার ডাকচেন, আমি যাই,
কেমন? আমার ওপর রাগ করে থাকবেন না কথা দিন? প্রণাম নিন। ইতি।
প্রনতা
আপনার শ্রী চরণের দাসী
আশা”।
চিঠিটা পড়ে মৃগাঙ্কর খুব স্পষ্ট ভাবেই মনে হল, তার কথা
আশালতা একটুও ভাবে না। অথচ তার মনে সারাদিন সারাক্ষণ, সমস্ত কাজের মধ্যে, আশালতার
সুন্দর মুখখানা ছাড়া আর কোন চিন্তাই আসে না।
বাক্সের তালা খুলে মৃগাঙ্ক আরেকবার পড়ল চিঠিটা। এর আগেও
অন্ততঃ আট, নয় বার পড়েছে। প্রতিটি অক্ষর, শব্দ এবং বাক্যের আড়ালে অন্য কোন সংকেত
কিংবা বিশেষ কোন বার্তা লুকিয়ে আছে কিনা, বোঝার চেষ্টা করেছে বারবার। এবারও সেরকম
কোন ইঙ্গিত তার কাছে ধরা দিল না। চিঠিটা পড়ার শেষে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, খামের মধ্যে
ঢোকাতে ঢোকাতে তার মনে হল, কানাইবাবু ঠিকই বলেছেন। অভিমান করে নির্জন এই মেসবাড়িতে
ভুতের মতো শুয়ে বসে থেকে কী লাভ। আশালতা তার ঠাকুরমাকে নিয়ে, মা বাবা ভাই নিয়ে দিব্বি
খোশমেজাজে নেচে নেচে বাপের বাড়ির আদর উপভোগ করছে। সে কেন নিজেকে এইভাবে নির্বাসনে
রাখবে?
মৃগাঙ্ক সিদ্ধান্ত
নিতে আর দেরি করল না। দ্রুত হাতে ছোট্ট ব্যাগে কিছু জামা কাপড় নিয়ে, ঘরের
দরজায় তালা দিল। তারপর দৌড়ে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। একটু তাড়াতাড়ি করলে, ছটা
আটান্নর গাড়িটা এখনো ধরে ফেলা যায়!
২
শুক্রবার বিশেষের অফিস ছুটি, পরপর তিনদিনের ছুটিতে কাছে
পিঠে কোথাও ঘুরে এলে মন্দ হয় না। এখান থেকে আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন খুব কাছে।
আগ্রা অন্ততঃ পঁচিশ বার ঘোরা হয়ে গেছে, বন্ধুবান্ধব যে আসে, সেই বলে চ, তাজটা মেরে
আসি। ঘুরতে ভালোই লাগে, তাই বিশেষ না করে না, সুযোগ পেলেই দৌড়য়। কিন্তু এই ছুটিতে
আবার আগ্রা যাবার মানে হয় না। মথুরা বৃন্দাবন অনেক আগে একবার ছোটবেলায় গিয়েছিল। ওখানকার বাঁদর আর হনুমান ছাড়া বিশেষ কিছুই তার মনে নেই। কাজেই তিনদিনের
ছুটিতে বৃন্দাবন, ঘুরে এলে মন্দ হয় না। তবে মনে হয় না, বন্ধুবান্ধবদের কেউ তার বৃন্দাবন
যাত্রার সঙ্গী হতে চাইবে। তবুও বিশেষ হোয়াট্স্অ্যাপে তার বন্ধুদের “বাতাতে রহো”
গ্রুপে ঢুকে লিখল, “লেটস হ্যাভ আ ট্রিপ ইন দিজ হলিডেজ”।
“হোয়্যার? তাজ? ওঃ নো নট এগেন ডুড”। প্রকাশ মেহেরা উত্তর
দিল।
“বোরড ইন তাজ, ক্যা হ্যায় রাজ? ললিত ভরদ্বাজের উত্তর।
“কাম অন ইয়ার। ভিশ, আয়াম উইথ ইউ, ওয়্যার টু গো?” বিশেষকে
সমর্থনই করল প্রকাশ।
“বৃন্দাবন”। বিশেষ উত্তর দিল।
“ওয়াও। বাট দ্যাট কান্ট বি আ ট্রিপ, বাই দি ওয়ে আই’ল কাম ডাউন
অ্যাট ৭ পিএম, ইজ ইট ওকে”? জিতু তানোয়ার।
“আবে, ভিশ ইজ কিডিং ইয়ার। উল্লু কা পাট্ঠা”। ললিত লিখল।
“নট জোকিং, গাইজ, আয়্যাম সিরিয়াস”। বিশেষ লিখল।
“হেল্লো, ইউ আর প্রোপজিং টু গো বৃন্দাবন বার, রাইট? অ্যান্ড
দ্যাট্স্ নট আ ট্রিপ!” জিতুর উত্তর ।
“তু লোক শালে কভি নেহি শুধরেগা? ইট্স্ নট আ ট্রিপ, ইট্স্
আ ট্রিট। ইট ওয়াজ আ মিসটেক, রাইট? এনিওয়ে, ওয়াট ফর দিস ট্রিট, ভিশ? ইট্স্ নট
ইয়োর বার্থডে!” প্রকাশ বোদ্ধার মতো উত্তর লিখল।
বিশেষ লিখল, “ইয়ার তুলোগ, একহি জাগাপে লটক রহে হো। আয়্যাম
টেলিং অ্যাবাউট বৃন্দাবনধাম, নট বৃন্দাবন বার”।
ললিতের উত্তর, “ও শিট। ভিশ ইয়ার, তুনে তো কামাল কর দিয়া।
লেকিন বৃন্দাবনধাম নাম শুনতেহি মেরা শর দর্দ চালু হো গয়া। সরি ইয়ার”।
“আর ইউ ওক্কে, ভিশ? চল, ম্যাঁয় আ রাহা হুঁ তেরা রুম মে।
তেরে কো উঠাকে লাউংগা। ইয়ার তুলোগ ঘরমে ব্যাঠকে ফ্যামিলিকে সাথ মস্তি মারেগা,
ছুট্টি মানায়েগা, বেচারা ভিশকে লিয়ে সোচা কুছ? শালা বাত করতা”। জিতু্র ভীষণ
সেন্সিটিভ উত্তর।
“বাট, জিতু, আয়্যাম সিরিয়াস। আই’ল গো বৃন্দাবন টুমরো
মর্নিং, ইটস ফাইনাল। কিসিকো চলনা হ্যায় তো চল, নেহিতো হাম নিকল পড়েঙ্গে, আকেলা”। বিশেষ লিখল।
“অকেলে অকেলে কাঁহা যা রহে হো...অকেলে...অকেলেএ এ এ এ...”
ললিত চ্যাংড়ামি করল।
“আর ইউ ক্রেজি, ভিশ”? প্রকাশ লিখল।
“শালে তেরা দিমাক ঠিকানে পে হ্যায় তো? বৃন্দাবন যাকে তু
ক্যা করেগা”? জিতুর উত্তর।
“হরে কিসনা, হরে রাম। হরে রাম, হরে রাম...”। ললিত ফোড়ন দিল।
“কল হম নেহি যা পায়েঙ্গে, ইয়ার। ফির কভি প্ল্যান কর লেঙ্গে।
বোর মৎ কিয়া কর, ভিশ”, জিতু বোঝাতে চেষ্টা করল বিশেষকে। বিশেষ আর কোন উত্তর দিল
না। গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এল।
সকাল সাতটার বাস ধরে বৃন্দাবন পৌঁছতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা
লাগল। বৃন্দাবনের বাসষ্ট্যান্ডে বিশেষ যখন পা দিল, বেলা এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ
মিনিট। তার বাবার কথা মতো এখান থেকে শেঠ রতনলাল ধরমশালা হেঁটে মিনিট পনেরর পথ।
রিকশ নেওয়া যায়। এক্কাও চলছে। কিন্তু হেঁটে যাওয়াই ঠিক করল। হোয়াটসঅ্যাপ চালু করে
বিশেষ বাবাকে লিখল, “রিচ্ড্ বৃন্দাবন”।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোন উত্তর না পেয়ে, বিশেষ মনে
করার চেষ্টা করল, গতকাল রাত্রে বাবা কি বলেছিলেন। বাস থেকে নেমে, কাউকে জিজ্ঞাসা
করে নিতে, ছিপি গলিটা কোন দিকে। ছিপি গলির মোড়ের কাছেই শিবাজির মন্দির, তারপর সোজা
মিনিট পাঁচ সাত হাঁটার পর বাঁদিকে, বড়ো তিনতলা ধরমশালার বাড়িটা চোখে পড়বেই।
উল্টোদিকে মিঠাইয়ের দোকান। কচৌরি-সবজি, পেঁড়া, মোরব্বা, ক্ষীর, রাবড়ি। খোঁজখবর করে বিশেষ
হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার দুপাশেই অজস্র দোকান পাট। মোবাইল রিপেয়ারিংয়ের দোকান। নানান
ভক্তিভজন সমৃদ্ধ সিডির দোকান। সিডি প্লেয়ারে গম গম করে বাজছে রাধা কিংবা কৃষ্ণের
ভজন। রাধা কে বিনা শ্যাম আধা। ছিপি গলি আর শিবাজি মন্দিরের হদিস পেয়ে বিশেষ বেশ
খুশিই হল, যাক সে তাহলে ঠিকঠাকই হাঁটছে।
খুব তাড়া কিছু নেই। পথের দুপাশে দোকান দেখতে দেখতে বিশেষ ধীরেসুস্থে
হাঁটতে লাগল। পাশাপাশি বেশ কিছু পুজোর ডালির দোকান। খাবারের দোকান থেকে নাকে আসছে,
কোথাও শুদ্ধ ঘিউয়ের গন্ধ, কোথাও সস্তা তেলের গন্ধ। মনোহারি দোকান। কাঁচের চুড়ি,
পেতলের গামলায় মেটে সিঁদুরের বিশাল পাহাড় - চূড় করে
রাখা। নানান ধরনের মনকাড়া সস্তার খেলনা। অজস্র ঠাকুর দেবতার ফটো, ছোট্ট থেকে বিশাল
ফ্রেমে বাঁধানো। বৈষ্ণব ভোজনালয়, শুদ্ধ শাকাহারি। বাঙালি বৌদির হোটেল। ভাত, ডাল,
শুক্তো, পোস্ত, এঁচোড়ের ডালনা, চাটনি, পাঁপড় লেখা টিনের বোর্ড। প্লাস্টিকের চেয়ারে
বসে খদ্দের ডাকা মানুষ। তার ফোনে মেসেজের টোন বেজে উঠতে, ফোনটা আনলক করল বিশেষ।
দুটো মেসেজ এসেছে। একটা বাবা, অন্যটা “বাতাতে রহো” গ্রুপের। বাবার মেসেজটা খুলে
পড়ল, “পৌঁছে গেছিস? দোকানে গেছিলাম, ফোনটা নিয়ে যাই নি। দেরি হল। তুই এখন কোথায়”?
“ছিপি গলি পেরিয়ে হাঁটছি”।
“কতদূর”
“স্টেট ব্যাংকের কাছাকাছি”।
“স্টেট ব্যাংকের কাছে? যাঃ, অনেকটা বেশি চলে গেছিস তো।
পিছনে ফিরে আয়”।
বিশেষ ঘুরে দাঁড়াল, পাশের একটা দোকানে জিজ্ঞাসা করল, “শেঠ
রতনলাল ধরমশালা, কোনদিকে”?
পেছনদিকে ফেলে আসা পথের দিকে হাত তুলে দেখালো ভদ্রলোক, “ও
লাল মকান। সংকটমোচন মন্দিরকে বগলমে। আপ ছোড় কে আয়া। ব্রিজবাসী ভুজিয়াওয়ালা দুকানকা
বিলকুল সামনে”।
“সুক্রিয়া জি”। হাসল বিশেষ ।
পিছন ফিরে আবার হাঁটতে লাগল বিশেষ। বাবার মেসেজ এসেছে, “কদ্দূর?
পেয়েছিস?”
“না ফিরে যাচ্ছি। এবার মনে হয় পেয়ে যাবো”।
“পেলে জানাস”।
মিনিট পাঁচেক এসে বিশেষ ব্রিজবাসী দোকানটা পেয়ে গেল,
দোকানের উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল লাল বাড়িটা। সবুজ রঙের
বিশাল কাঠের গেট ছাড়া বাড়ির দেওয়াল ধরে দোকানের সারি। সেইজন্যেই যাবার সময় চোখে
পড়েনি। সবুজ গেটের ওপরে সিমেন্টের ভাঙাচোরা লেখা “শেঠ রতনলাল ধরমশালা”। ভাঙাচোরা
হলেও পড়ে ফেলা যায়। বিশেষ লিখল, “পেয়েছি, গেটে ঢুকছি”। সবুজ গেটের এক পাশে উইকেট
গেটটা খোলাই ছিল, বিশেষ মাথা নিচু করে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
দুপাশে বন্ধ দরজার একসারি ঘরের প্যাসেজ পেরিয়ে বিশেষ এসে
দাঁড়াল একটা সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনে। উঠোনের একধারে তুলসীমঞ্চ, তার ওপরে শীর্ণ তুলসীগাছ। আর
শেষ প্রান্তে একটা পেয়ারা গাছ। এই বাড়ির মতোই প্রাচীন। তার সামনে বিশাল চৌবাচ্চা। বাঁদিকে
একসার ঘর; সবগুলি দরজাই বন্ধ। মাঝখানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলার বারান্দায় দড়িতে
শাড়ি, ধুতি, গামছা শুকোচ্ছে। কাউকে দেখতে না পেলেও ভেতর থেকে লোকজনের গলা পাওয়া
যাচ্ছে। টানা বারান্দার এক কোণায় একটা তোলা উনুন। তার পাশে পোড়া কয়লার ছাই। বিশেষ
গলা তুলে ডাকল, “কোই হ্যায়? হেল্লো? অন্দরমে কোই হ্যায়?”
৩
“সবাই এমন ঘুমিয়ে
পড়ল? বাবা, ও বাবা। মা, ও মা?
তিওয়ারিদা? অ্যাই তিওয়ারিদা”?
বন্ধ সদর দরজায় মৃগাঙ্ক দুম দুম আওয়াজ আর চিৎকারে
পাড়া মাথায় তুলে ফেলল। বাড়ির লোকের দোষও দেওয়া যায় না। এতো আর কলকাতা শহর নয়, রাত
বারোটাতেও ট্রাম গাড়ি চলবে, টানা রিকশা নিয়ে বিহারি রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকবে বড়ো
রাস্তার মোড়ে। রাত এগারোটা মানে, হুগলির এই প্রত্যন্ত গ্রামে মধ্যরাত।
মৃগাঙ্কর এত দেরি হওয়ার কথা নয়। মেস থেকে বেরিয়ে হাওড়াগামী
ট্রামে ছুটে এসে উঠে পড়েছিল। চিৎপুর পৌঁছে দেখল রাস্তায় ভয়ংকর জ্যাম। আধঘন্টা
ট্রামেই বসেই থাকল। তারপরও ট্রাম এক চুলও নড়ল না দেখে হাঁটা শুরু করেছিল। পথে নেমেও যাত্রীদের
ভিড়ে হাঁটা দায়। শনিবারের সন্ধ্যে, ঘরমুখো বঙ্গসমাজ দু হাতে চটের থলি নিয়ে পথে
নেমেছে ঘরে ফেরার জন্যে। হাওড়া স্টেশনে যখন ঢুকল মৃগাঙ্ক, ছটা আটান্ন তো বটেই, সাতটা
বত্রিশের লোকালটাও বেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। পরের ট্রেন আটটা বাইশে। আটটা বাইশের
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মেই ঢুকল বেশ দেরি করে, তারপর আটটা পঁয়ত্রিশে ছাড়ল। তার গ্রামের
স্টেশানে পৌঁছোল যখন, ঘড়িতে তখন দশটা দশ। স্টেশান থেকে তার বাড়ি এমন কিছু দূর না
হলেও, হাঁটা পথে আধ ঘন্টা তো লাগবেই।
সদর দরজা থেকে অনেকটা জমি ছেড়ে তাদের বাড়িটা। সামনের জমিতে
অনেক ফুলের গাছ, টুকটাক ফলের গাছ থাকায়, দোতলার বারান্দা ছাড়া সদর দরজাটা দেখতে
পাওয়া যায় না। কিন্তু গেটের পাশেই তেওয়ারিদার ঘর, বহুদিনের পুরোনো লোক। সারাদিন এই
দরজা খোলাই পড়ে থাকে, বন্ধ হয় সন্ধের পরে। তেওয়ারিদা নিশ্চয়ই তার ঘরে নেই, থাকলে
উঠে আসত ঠিক। অধৈর্য হতে হতে মৃগাঙ্ক যখন আশা ছেড়েই দিয়েছে, দোতলায় মার ঘর খুলে হাতে
হ্যারিকেন নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল, দুই মহিলা অবয়ব। মা-ই হবেন, আর মায়ের পাশে
বাসন্তীদিদি, মায়ের কাজের সঙ্গী, হাত নুরকুত। মায়ের অস্পষ্ট গলা শুনতে পেল,
মৃগাঙ্ক।
“খোকা এয়েচিস? দাঁড়া বাবা, দাঁড়া। বাসন্তী, হ্যারিকেনটা
নিয়ে একবার যা না সদরে, তিওয়ারিজীর কী হলটা কি? বাঁচল কি মরল, কে জানে? খোকা মনে
হচ্ছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে! ডেকে ডেকে সারা হয়ে গেল, তবু আমাদের কারও কোন সাড়া
নেই?”
বাসন্তীদিদি হ্যারিকেন নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে
গেল, তারপর আর দেখা গেল না তাকে।
মা যখন এসে দাঁড়িয়েছেন, আর চিন্তা নেই। মৃগাঙ্ক দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল, আধখানা মরা চাঁদ, ফ্যাকাসে ঝুলে রয়েছে পশ্চিম আকাশে।
তারার চুমকি দেওয়া অন্ধকার আকাশ। চারপাশে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ। একটু দূরে একপাল শেয়াল
ডেকে উঠতেই তার গায়ের পাশ থেকে দৌড়ে গেল তিনটে কুকুর। গাঁয়ে ঢোকার পর থেকে এই
কুকুরগুলোই তার সঙ্গী হয়েছিল। চেনা কুকুর, এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল, তার পিছনে।
বিশাল আওয়াজ করে, কাঠের ভারি দরজা একটু ফাঁক করে দাঁড়াল
তেওয়ারিজি, “খোঁখাবাবু আছেন কি”?
“তা নয়তো কি, আমাকে নিশি মনে হচ্ছে? তুমি তো কুম্ভকর্ণকেও
হার মানিয়ে দেবে, তেওয়ারিদাদা”।
বাসন্তীদিদি উত্তরে বলল, “ঘুমোয়নি গো, ছোড়দাবাবু, দরজায় হুড়কো
দিয়ে, বাড়ির পিছনে টহল দিতে গেছিল। আমি গে ডাকতে, তিওয়ারিদাদা বিশ্বেসই করে না, যে তুমে এয়েচো?”।
দরজায় ঢুকে আসার পর, বাসন্তীদিদি হ্যারিকেন নিয়ে আগে আগে
চলল, মৃগাঙ্ক রইল পিছনে। বাড়ির দালানে ওঠার আগে, মৃগাঙ্ক বারান্দার দিকে মুখ তুলে
তাকাল, এবার মায়ের পাশে বাবাকেও দেখতে পেল।
গতকাল অনেক রাত্রে ফিরে, মৃগাঙ্কর খাওয়াদাওয়া মিটতে বেশ রাত
হয়ে গিয়েছিল। সকালে এসে ঘুম ভাঙালেন মা। মাকে দেখে অবাক লাগে মৃগাঙ্কর। গতকাল
রাত্রে মায়েরও শুতে অনেক দেরি হয়েছিল। অথচ আজ তিনি যখন মৃগাঙ্কর ঘুম ভাঙাতে এলেন,
রোজ যে সময় স্নান করে পুজোআর্চা সেরে ফেলেন, তার এতটুকুও ব্যত্যয় হয়নি।
“খোকা, উঠে পড় বাবা, কাল রাত্রে খুব কষ্ট গেছে তোর। নিচে চল,
বাবা তোর জন্যে বসে আছে। খানকতক লুচি ভেজে দি, গরম গরম খা”।
গতকাল রাত্রের ছেড়ে রাখা মৃগাঙ্কর ময়লা জামাকাপড়গুলো তুলে
নিতে নিতে বললেন, “হ্যারে, বৌমা তোকে কিছু লিখেছে, কবে আসতে পারবে? মেয়েটা কতদিন
হল নেই, পায়ে পায়ে ঘুরত, আর মা মা ডাকতো। খুব খালি খালি লাগে আজকাল”।
গামছা নিয়ে বাথরুমে যেতে যেতে মৃগাঙ্ক বলল, “তুমি বৌমা বৌমা
করছো, ওদিকে তার তো কোন হেলদোল নেই”। মা
একটু হাসলেন, বললেন, “ও সব তুই বুঝবি না, খোকা। সব মেয়েই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির
হয়ে যায়। ও যে কি মরমে জ্বলে মরছে, সে আমি জানি”।
“কি জানি, মা। আমি তো কিছু বুঝি না”।
মা হাসতে হাসতে বললেন, “তোর আর বুঝে কাজ নেই, তুই নিচে আয়”।
জলখাবারের পর নিজের ঘরে ফিরে এসে কী করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিল
না মৃগাঙ্ক। একবার পাড়ায় গেলে হয়। অনেকদিন বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখা হয় নি। সেটাও
ঘুরে এলে হয়। অথবা বাড়ির ছাদে। বাড়ির ছাদে বহুদূর পর্যন্ত মাঠঘাট, গাছপালা দেখতে
বেশ লাগে। কিন্তু কোনটাই করল না মৃগাঙ্ক, মেহগিনির বিশাল খাটে টানটান হয়ে শুয়ে
পড়ল। এই খাটটা আশার বাবার দান। ভাঁজ করা দুইহাতে মাথা রেখে শুয়ে, মৃগাঙ্ক ছাদের
সিলিং দেখছিল, শাল কাঠের কড়ি বরগা।
এমন সময় পিসিমার গলা পেল, “কি করছিস, খোকা? কাল অনেক রাত্রে
ফিরেছিস শুনলাম”।
বিছানায় উঠে বসল মৃগাঙ্ক, বলল, “এসো পিসিমা, এসো। বসো। কেমন
আছো”? পিসিমা আসাতে একটু যেন স্বস্তি পেল মৃগাঙ্ক। পিসিমা কথা বলতে ভালোবাসেন আর
এখন মৃগাঙ্কর সে কথা শোনার অখণ্ড অবসর রয়েছে।
খাটের একপাশে বসতে বসতে পিসিমা বললেন, “আর পেরে উঠি না রে,
খোকা। শরীর আর বইছে না। এমনিতে রাত্তিরে ঘুম হয় না, কাল যে কী কালঘুম ধরল, কে
জানে। তুই কখন এলি, এত ডাকাডাকি করলি, কিছুই জানতে পারলাম না। বৌমা কবে ফিরছে কিছু
জানিস নাকি রে, খোকা”?
“না গো, পিসিমা, জানি না”।
“ও মা, চিঠি পত্তর দেয় না? আমরা না হয় মুখ্যুসুখ্যু মানুষ,
ক লিখতে কলম ভাঙে। বৌমা তো তা নয়, ওতো দুপাঁচ কলম লিখতে পারে”?
“লেখে। চিঠিপত্র মাঝে মধ্যে দেয়”।
“তাই বল। তা সেখানে কিচু লেখে নি, কবে ফিরছে। কেমন আছে”।
“নাঃ”
“এ বাপু ভারি অন্যায়। আর তো তুমি বাপের মেয়েটি নও।
শ্বশুরঘরে এসেছ। তোমার এখন ভরা ভাদরের পরিপুণ্ণ সংসার। শ্বসুর, শ্বাশুড়ি, বর, ঘর,
গেরস্ত; আমার কথা না হয় নাই বললাম, আমি আজ আছি, কাল নেই। কবে কোনদিন গোবিন্দর ডাক আসে
তার অপেক্ষাতেই আছি। এসব ফেলে এতদিন ধরে বাপ-মা-ভাই-বোনদের সঙ্গে হা হা হি হি করা
শোভা পায় না, বাছা”।
পিসিমা মৃগাঙ্কর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মৃগাঙ্ক বিরক্ত
হচ্ছে কিনা। তাঁর তেমন কিছু মনে হল না। তিনি নবোদ্যমে শুরু করলেন, “তুই পিসিমাকে যাই ভাবিস না কেন, খোকা, আমি
বাপু এইসব অসৈলন মেনে নিতে পারি না। আর তোকেও বলি, পুরুষমানুষ ম্যাদামারা হলে চলে?
একটু হাঁকডাক, রোখঠোক না থাকলে পুরুষমানুষকে মানায় না। তুই বাবা একটু শক্ত হ। সব
কিছু যদি মুখ বুজে সয়ে নিস, সবাই যে ঘাড়ে পা চাপিয়ে দেবে, বাবা? আমি বলি কি, বৌমার
বাবাকে বেশ কড়া করে একটা চিঠি লেখ। ঘরের লক্ষ্মী এত বার মুখো হলে, মা লক্ষ্মী সংসার
থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। চঞ্চলা হন”।
পিছন ফিরে বসেছিলেন বলে, মা এসে কখন দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন,
পিসিমা দেখতে পাননি। কিছুক্ষণ ঠাকুরঝির কথা শুনে, মা আস্তে আস্তে ঘরে পা দিলেন,
মৃগাঙ্ককে ডেকে বললেন, “খোকা, বাড়ি এসে সেই থেকে ঘরেই তো বসে রয়েছিস। যা না, পাড়া
থেকে একটু ঘুরে আয় না। তুই কলকাতায় গেলে তোর বন্ধুরা আসে, জিজ্ঞাসা করে তুই কবে
ফিরবি। এতদিন পর ফিরলি, সবার সঙ্গে দেখা না করে, ঘরে বসে রয়েছিস কেন, রে? আর
ঠাকুরঝি, খোকার সঙ্গে তোমার কথা শেষ হয়েছে? আমার সঙ্গে নিচেয় চলো তো, আমার হাতে
হাতে একটু কাজ করে দেবে”।
মৃগাঙ্কর বাবার থেকে বয়েসে অনেকটাই ছোট এই পিসিমার
দুর্ভাগ্যের কোন সীমা নেই। মৃগাঙ্কর যখন বছর সাত আট বয়েস তখন পিসিমার বিয়ে হয়েছিল।
খুব স্পষ্ট না হলেও, বেশ মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। বিয়েবাড়ির হৈচৈ আনন্দের
কথা। এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটির বিয়ে উপলক্ষে ধুমধাম হয়েছিল খুব। বউভাতের দিন পিসিমার
শ্বশুরবাড়িতে বাবার সঙ্গে মৃগাঙ্কও গিয়েছিল। তাদের মতো পিসিমার
শ্বশুরবাড়িও যথেষ্ট স্বচ্ছল, সম্পন্ন কিন্তু তাদের থেকে অনেক বড়ো পরিবার। পিসেমশাইদের অনেক ভাই
বোন মিলে খুব জমজমাট আনন্দের সংসার। বউভাতের অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফেরার পরদিনই
বাবার কাছে ভয়ংকর দুঃসংবাদটা এসে পৌঁছেছিল। নতুন পিসেমশাই সর্পদংশনে মারা গেছেন। ঠাকুমা তখনও বেঁচে
ছিলেন, মেয়ের এই চরম সর্বনাশের সংবাদে তিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।
অপঘাতে মৃত্যুর শ্রাদ্ধশান্তি তিনদিনে হয়। সব কাজ সেরে বাবার
সঙ্গে, পিসিমা এই বাড়িতে আবার ফিরে এল যেদিন, তার দুদিন পরেই অষ্টমঙ্গলায়, পিসিমার
এ বাড়িতে ফিরে আসার কথাই ছিল। কিছুদিন আগেই বিয়ের সাজে পিসিমার হাসিখুশি মুখটা তখন
বিষণ্ণ, অসহায় এবং বিপন্ন। পিসিমার জীবনের সমস্ত রঙ নিকিয়ে নিয়ে চলে গেছেন নতুন পিসেমশাই।
পিসিমার পরনে সাদা থান শাড়ি। নির্বাক শূণ্য সিঁথি। দুর্ভাগ্য কেড়ে নিয়েছিল কপালের
টিপ, সমস্ত অলংকার। তারপর পিসিমা এই বাড়িতেই রয়ে গেলেন চির জীবনের মতো।
বড়ো হয়ে মৃগাঙ্ক শুনেছে, পিসিমার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকে,
বিশেষ করে পিসেমশাইয়ের মা, পিসিমার অন্য জা-এরা ও দিদিরা নাকি পিসিমাকে রাক্কুসি,
ডাইনী বলেছিল। পিসিমার বৈধব্য যোগের কারণেই নাকি পিসেমশাইয়ের এভাবে অপঘাতে মৃত্যু
হল। “তা না হলে যে পথে গ্রামের সবাই হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, যে রাস্তায় আশৈশব আমাদের
মন্টু যাওয়া আসা করেছে, সেখানে কোনোদিন সাপ এলো না; বিয়ের পর পরই এসে গেল! আমাদের
মন্টুকে সাপে নয়, খেয়েছে ওই নতুন বৌ। মানুষ নয় ও আসলে পিচেশ”। মন্টু মৃগাঙ্কর
নতুনপিসেমশাইয়ের ডাক নাম। আশ্চর্য ব্যাপার হল, বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া, ওই পিশাচ কিংবা
ডাইনি পিসিমার সোনার গয়না, নগদ টাকা, দান-সামগ্রী, আসবাবপত্র, শাড়ী কাপড় চোপড়
আত্মসাৎ করতে কিন্তু কোন বাধা আসেনি, শ্বশুরবাড়ির কোন লোকের তরফ থেকে। আর সেই সময়ে
মৃগাঙ্কর বাবা, ঝগড়া করে সে সব জিনিষ উদ্ধার করার মতো মানসিক অবস্থাতেও ছিলেন
না।
বাইরে যাওয়ার জামা কাপড় পরে সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নামতে নামতে
মৃগাঙ্কর মনে হল এবাড়িতেও পিসিমা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছে কি? বড়োদাদা ছোট বোনকে
খুবই ভালোবাসেন, কিন্তু সে ভালোবাসায় একজন নারী তার নিজস্ব সংসার না পাওয়ার হতাশা
কি ভুলতে পারে? এই সংসারের কোন দায়িত্ব, কোন সিদ্ধান্তেই তার মা পিসিমাকে দখল
ছাড়েন না। ঠাকুমা মারা যাবার পর এই সংসারে তার মায়ের একচ্ছত্র অধিকার। তার মায়ের
মনোমত না হওয়া, পিসিমার যে কোন আচরণেই মা খুব বিরক্ত হন। মুখের ওপরে বলেও দেন, “ঠাকুরঝি,
তুমি শোকতাপ পাওয়া কপালপোড়া মানুষ, তুমি আর এসবের মধ্যে জড়িও না, গো”। ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া অসহায় ওই নারীকে
সেই কথার তীক্ষ্ণ খোঁচার যন্ত্রণাও ভোগ করতে হয় অহরহ।
৪
ভেতরের কোথাও লোকজন কথা বলছে, অথচ ডাকলে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে
না! ভুতুড়ে বাড়ি নাকি রে, বাবা। তাও আবার দুপুর সোয়া বারোটার সময়? বিশেষ এবার বেশ
জোরেই হাঁক পাড়ল।
“কোই হ্যায়? অন্দরমে কোই হ্যায়”?
অবশেষে বিশেষের হাঁকডাক শুনে একটি লোক বারান্দায় বেরিয়ে এল,
তার মুখ দেখে মনে হল মুখের মধ্যে যেন একরাশ নিমপাতা। বাংলার পাঁচের মতো বিরক্ত মুখ।
সামনে এসে দাঁড়াল, কোন কথা নেই, বার্তা নেই, বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল।
ভাবখানা, কী বলবে তুমিই বলো। আমার কোন দায় পড়ে নি, উটকো লোকের সঙ্গে কথা বলার। অগত্যা
বিশেষই কথা বলল, “দো দিন রহনে কে লিয়ে ঘর মিল শকতা হ্যায়?”
“কিতনে”? লোকটা আকাশপানে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল। নিমপাতা
নয়, মুখভর্তি গুটখা নিয়ে।
“দো দিন, বাস”।
“উঁহুঁহঁহুঁ। কিতনে লোক”? ঘাড় নাড়িয়ে লোকটা এবার আরেকটু
খোলসা করল।
“বাস। ম্যাঁয় হি হুঁ। অওর কোই নেহি”। এই কথায় কোন উত্তর না
দিয়ে লোকটা বারান্দা ধরে হেঁটে গেল এক কোণায়। বারান্দার
নিচে নালির মুখে উগরে দিল মুখ ভর্তি গুটখার লালা আর থুথু। পরনের ধুতির খুঁটে মুখটা
মুছে নিয়ে বলল, “ধরমশালামে অকেলে কিসিকো ঘর দেনা, নিয়ম নেহি। ইঁহা নেহি হোগা, আগে
কোই হোটেলমে যাইয়ে”।
“হীরালালজি হ্যায়”? লোকটা ভেতরের দিকে যাবার জন্যে ঘুরে
দাঁড়াতে গিয়েও ফিরে তাকালো। তারপর বিশেষের মাথা থেকে পা অব্দি মেপে নিয়ে জিজ্ঞাসা
করল, “গুরুজিকো আপ ক্যায়সে জানতে হ্যাঁয়”?
“ম্যাঁয় নেহি, মেরা পিতাজি জানতে হ্যাঁয়। মেরা পিতাজি বহোত
দফে ইধার আয়ে থে। পিতাজিই মেরেকো বোলেঁ হ্যাঁয়, হীরালালজীকে সাথ মিলনে কে লিয়ে”।
কিছু একটা ভাবল লোকটা, তারপর বিশেষকে হাতের ইশারায় ডাকল,
বলল “অন্দর আইয়ে”।
বারান্দায় উঠে সিঁড়ির পাশের প্যাসেজ দিয়ে ঢুকে গেল বিশেষ,
সামনে সেই লোকটা। দুপাশে ঘরের দেওয়ালের জন্যে প্যাসেজটা এই দুপুরেও হালকা অন্ধকার।
প্যাসেজ পার হয়ে আবার একটা বারান্দা, সামনে উঠোন। বাঁদিকে মোড় নিয়ে লোকটা একটা
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “আইয়ে”। বিশেষ দরজার বাইরে জুতো খুলে রাখল। তারপর ঘরের
মধ্যে ঢুকল। কাঠের হেলানো একটা চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ, মাথার চুল দাড়ি গোঁফ
ধবধবে সাদা। পরনে ধুতি, গায়ে একটা সাদা ফতুয়া। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। হাতে
ইংরিজী দৈনিক। ঘরের অন্যদিকে মেঝেয় বসে একজন বয়স্কা মহিলা কিছু একটা সেলাই করছেন।
একধারে একটা নিচু তক্তপোষ। তার ওপরে পাতলা তোষক, টান টান সাদা চাদরে ঢাকা।
সঙ্গের লোকটি খুব সন্তর্পণে বৃদ্ধ লোকটির সামনে গিয়ে,
সামান্য নত হয়ে করজোড়ে বলল, “গুরুজি, আপসে কোই মিলনে আয়েঁ হ্যাঁয়”।
বৃদ্ধ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন বিশেষের দিকে। চোখ থেকে নামিয়ে
চশমাটা হাতে নিয়ে বললেন, “আপ মেরে কো জানতে হ্যাঁয়? লেকিন ম্যাঁয় আপকো...?”
বিশেষ নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে বৃদ্ধকে প্রণাম করল। বৃদ্ধ
হীরালালজী বিশেষের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। বিশেষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি
বিশেষ ভাদুড়ি। কলকাতার সুদীপ্ত ভাদুড়ি আমার বাবা। বাবা বলেছিলেন, বৃন্দাবনে এলে
আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে”।
হীরালালজির সাদা দাড়িগোঁফ ঢাকা মুখে এবার ফুটে উঠল প্রসন্ন
হাসি। চেয়ার ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন বিশেষকে। তারপর চেয়ারে বসতে
বসতে বললেন, “এক কুর্সি তো লা, রামু। বাচ্চা খাড়াহি রহেগা কেয়া? অওর শুন্, বাদ মে
সরবৎ ভি বানাকে লা”।
এই ঘর অব্দি বিশেষকে যে লোকটি সঙ্গে এনেছিল তার নাম রামু।
রামু এতক্ষণ তার গুরুজির পাশে নত হয়ে দাঁড়িয়েইছিল, গুরুজির আদেশের প্রতীক্ষায়।
দৌড়ে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিতে, হীরালালজি বললেন, “বোস, বেটা বোস।
তোকে যখন দেখেছিলাম, তখন তোর কত বয়েস, চার কি পাঁচ হবে? তোর মনে আছে”?
লাজুক হেসে বিশেষ ঘাড় নেড়ে বলল, নাঃ।
“না থাকারই কথা। কত বড়ো হয়ে গেছিস। মনে হয় যেন, এই তো
সেদিন। তুই কী করছিস এখন”?
“চাকরি। নোয়দায় থাকি”।
“চাকরি? বলিস কি, লিখাপড়া সব শেষ? এত বড়ো হয়ে গেছিস? বাঃ,
বাঃ খুব ভালো। শাদিবিহা করেছিস”?
“নাঃ”। লাজুক হেসে বিশেষ মাথা নামাল।
হীরালালজিও হাসলেন, বললেন, “তোরা বাঙালীরা খুব দেরি করে
শাদি করিস। সুদীপ্ত কী করছে, এখন?
“বাবা বছর খানেক হল, রিটায়ার করেছেন। বাড়িতেই থাকেন,
কলকাতায়”।
“তোর বাবা দিল্লীতে এলেই, এখান থেকে একবার ঘুরে যেত। যেমন পণ্ডিত
লোক, তেমনি পড়াশোনা। এখানেই থাকত প্রত্যেকবার। অতোবড়ো প্রফেসার, কোনদিন হোটেলে
উঠত না। ঘরে এসি নেই, শুধু পাংখা, আলাদা টয়লেট নেই। তবু এসে থাকত। বলত সব জায়গাতেই
তো হোটেলে থাকি। এই সব জায়গায় এসে ধরমশালায় না থাকলে স্থানমাহাত্ম্যটাই টের পাওয়া
যায় না। সারাদিন ঘুরে বেড়াত, শহরের অলিতে গলিতে। আর সন্ধের পর ফিরে এলে, আমরা
বসতাম তিনতলার ছাদে। কতো কথাই যে হত। ধর্ম নিয়ে। ইতিহাস নিয়ে। এই বৃন্দাবন নিয়ে। গল্প
করতে করতে কতদিন মাঝরাত হয়ে যেত, টেরই পেতাম না”।
“আপনি এত ভালো বাংলা বলেন, কী করে”?
“কেন? তোর বাবা তোকে বলে নি? আমি কলকাতায় অনেক দিন ছিলাম
তো। তোর বাবা আর আমি একই স্কুলে পড়েছি। সুদীপ্ত অবশ্য আমার থেকে চার ক্লাস নিচেয়
পড়ত। সুদীপ্তর আর আমার ফুটবল খেলার খুব নেশা ছিল। সেখান থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব,
তোর বাবা আমাকে দাদা বললেও আমরা খুব ভালো বন্ধু”।
“জানি, বাবা বলেছেন। আপনি হায়ার সেকেণ্ডারির পর কলকাতা ছেড়ে
ছিলেন। এতদিন বাইরে থেকেও আপনি বাংলা ভোলেননি, এটাতেই অবাক লাগছে”।
বিশেষের কথায় হীরালালজি একটু হাসলেন, বললেন, “আমি এখনও
নিয়মিত বাংলা পড়ি। বই, পত্রিকা। বৃন্দাবনে অনেক বাঙালি আছে, অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত
দেখা হয়, আলাপ হয়। যে বিষয় নিয়ে তুই ভালোবেসে চর্চা করবি, সেটা তুই ভুলতে
পারবি না। তোদের বঙ্কিম, শরৎ, রবি ঠাকুরের কথা ছেড়েই দে, এই সেদিনের সমরেশ, সুনীল,
রমাপদ, বিমল কর - আমার ভীষণ প্রিয় লেখক ছিলেন। তবে হ্যাঁ, চর্চার অভাবে বাংলা
লিখতে এখন অসুবিধে হয়”। একটু থেমে মুচকি হেসে হীরালালজি বললেন, “আমার বাংলা নিয়ে
জিজ্ঞাসা করছিস, তোরা স্কুলে কোন মিডিয়মে পড়েছিস – বেঙ্গলি না ইংলিশ?”
বিশেষ একটু অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল, “ইংলিশ মিডিয়াম”।
অস্বস্তির কারণ বাংলা সাহিত্যের রবি ঠাকুর, বঙ্কিম, শরতের সঙ্গে তার সামান্য পরিচয়
থাকলেও, পরের যে লেখকদের নাম করলেন হীরালালজি, তাঁদের নাম শুনলেও, লেখা কিছুই
পড়েনি।
হীরালালজি বললেন, “তোদের জেনারেশনে কলকাতার বাঙালী
ছেলে-মেয়েদের অনেকেই নাকি বাংলা লিখতে জানে না। সে কথাও আমার কানে আসে”। বিশেষ
মাথা নিচু করে নিরুত্তর রইল। হীরালালজি কোন উত্তরের প্রত্যাশা না করে আবার বললেন,
“এত ইন্টেলেকচুয়াল একটা জাত – কী ভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে... বিশ্বাস
হয়ই না”। তাঁর কণ্ঠে গভীর আক্ষেপ।
ছোট একটা স্টিলের প্লেটের ওপর কাচের দুটি গ্লাশে সরবৎ নিয়ে,
রামু এসে পাশে দাঁড়াল। হীরালালজি বললেন, “লে। সরবৎভি আ গয়া। পি লে। সরবৎ খা। তারপর বল,
তোর এখানে আসার মতলব কি”?
সরবৎ শেষ করে বিশেষ খালি গ্লাস ফিরিয়ে দিল রামুর হাতে ধরে
রাখা থালায়। হীরালালজি এক চুমুক দিয়ে গ্লাস হাতে ধরে রইলেন, ইশারায় রামুকে বললেন
চলে যেতে। বিশেষ বলল, “সেরকম কিছু নয়। দুদিনের ছুটি ছিল, ব্যস্, চলে এলাম ঘুরতে।
বাবার কাছে বৃন্দাবনের কথা অনেক শুনেছি, দেখতে এলাম”।
“আচ্ছা কিয়া, বেটা। লেকিন সাথ মে অওর ভি তো কোই হোগা?
দোস্তওস্ত, সাথিউথি”?
“নাঃ। একলা। কেউ নেই সঙ্গে”।
“কোথায় থাকবি”?
“এখানে তো জায়গা হবে না। আপনার রামু বলছিল, একলা কাউকে
ধর্মশালায় থাকতে দেওয়া হয় না!”
“আরে ছোড় না ও বুরবক কা বাতেঁ। শুনতি হো, এ ভি একদম সুদীপ্ত
য্যায়সাই পাগলা হোগা। ইসকা খানেকা ইন্তেজাম করো। ইয়ে বাচ্চা হামারা সাথ দো দিন
রহেগা ইধার। দেখ বেটা, হামারা ইধার মচ্ছিউচ্ছি নেহি মিলেগা, বিলকুল ভেজ খানা,
চলেগা”?
“দওড়েগা”। বিশেষ হাসতে হাসতে বলল।
“চল, রামু তেরে কো রুম দিখা দেগা। নাহা ধোকে ফ্রেস হো যা।
ফির একসাথ খানা খায়েঙ্গে। উসকে বাদ আরাম কর লেনা। রামু, বিশেষ বেটেকো কামরা দিখা দে।
আর খায়ালভি রাখনা”।
৫
আজ দুপুরে মৃগাঙ্কর খাওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। তার পাশে
বাবাও খাচ্ছিলেন, আর মা, পিসিমা ছিলেন পরিবেশনে। “আরেকটু নে”, “কিছুই তো খেলি না”,
“মেসে না খেয়ে খেয়ে তোর খিদে মরে গেছে”, “কাল রাতে প্রায় কিছুই খাসনি”। এই সব মন্দ-মধুর
অনুযোগ শুনলে বেশি না খেয়ে উপায়ও থাকে না। তবে এটাও ঠিক, মেসে রোজকার একঘেয়ে
খাওয়ার পর, বাড়ি ফিরে এমন তরিবত করে খাওয়ায় তৃপ্তি হয় খুব। মৃগাঙ্ক ভেবে খুব আশ্চর্য
হয়, মেসের ওড়িয়া ঠাকুরের হাতে কী জাদু কাজ করে? প্রত্যেকদিন মাছের ঝোলের এমন
নিখুঁত বিস্বাদ স্বাদ কী ভাবে একই রাখতে পারে! কলকাতা শহরে এমন সবজি নেই যা পাওয়া
যায় না। কিন্তু মেসের মেনুতে কুমড়ো, লাউ, পেঁপে আর আলু ছাড়া কোন সবজি থাকে না
বললেই চলে। শীতে ফুলকপি বা গরমে পটলের তরকারি হলে, ভোজ মনে হয়।
খাওয়ার পরে মায়ের কাছে একটা পান চেয়েছিল মৃগাঙ্ক। এমন তৃপ্তির
খাওয়ার পর ভাজা মৌরি দেওয়া একটা পান বড়ো ভাল লাগে। আবার আয়ুর্বেদ মতে পান হজমিও
বটে। মা বললেন, তুই ওপরে যা, আমি পাঠাচ্ছি। নিজের ঘরে এসে, পশ্চিমের জানালা দুটো
বন্ধ করে, পুবের আর দক্ষিণের জানালাদুটো খুলে দিল। পশ্চিমের রোদ আসবে না, কিন্তু
হাওয়া ঢুকবে অন্য জানালাগুলো দিয়ে। কাচের পাল্লা দেওয়া কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখল
কিছুক্ষণ। এই আলমারিটা আশালতার সাজানো। নিচের দুটো তাকে নানা রকমের শোপিস পুতুল।
কাচের সায়েবমেম। মাটির পটল, বেগুন, কলা, আম। ওভাল শেপের একটা ফ্রেমে কুরুশের কাজে
শুকশারি পাখির ছবি। তার ওপরে লেখা “ভালোবাসা ছাড়া”, নিচেয় লেখা “কেমনে গাহিবি গান”। কাঠের গরুর
গাড়ি।
তার ওপরের দুটি তাকে বই। এই বইগুলির অধিকাংশই তাদের বিয়েতে
পাওয়া। কিছু মৃগাঙ্কর বন্ধুবান্ধবের দেওয়া, কিছু আশালতার আত্মীয়স্বজনের দেওয়া।
পাতলা একটা বই বের করল মৃগাঙ্ক। বাঁধানো বই, প্রচ্ছদে নববধূর সাজে একটি মেয়ের ছবি।
উপরে বইয়ের নাম “যাও সখি, নিজগৃহে”। লেখক শরৎচন্দ্র চ্যাটার্জি। একটু হাসল মৃগাঙ্ক
এ শরৎ চ্যাটার্জি জাল, “চরিত্রহীন” শরৎবাবুর সুনাম ভাঙিয়ে বই লিখেছে, যদি কিছু
বিক্রি হয়। আজকাল জাল জিনিষে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। বইটা হাতে নিয়ে মৃগাঙ্ক বিছানায়
বসল। বিছানায় বসে ঘরের চার দিকে তাকিয়ে দেখল, এই ঘরের সব কিছুতেই আশালতার হাতের
ছোঁয়া। বিয়ের আগেও এই ঘর তারই ছিল। বিয়ের পর চার মাসের মধ্যেই আশালতার স্পর্শ, এই
ঘরে এনেছে আমূল পরিবর্তন, এনে দিয়েছে অদ্ভূত শ্রী। কতদিন হয়ে গেল সে কাছে নেই।
অভিমানে রুদ্ধ হয়ে এল মৃগাঙ্কর কণ্ঠ, আমাকে কি ভুলেই গেলে আশা?
হাতে বইটা নিয়ে মৃগাঙ্ক শুয়ে পড়ল বিছানায়। প্রচ্ছদ উল্টেই
তার চোখে পড়ল ঝরনা কলমে ঝরঝরে হাতের লেখা, “নিজ গৃহে যা, সই”। তার নীচে লেখা, “তোর
শশী”। শশীটা কে? লতার বান্ধবী? এত সুন্দর ঝরঝরে লেখা কি কোন
মেয়ের? কিন্তু বাসর ঘরে লতার যে সব বাচাল
ও মুখরা বান্ধবীরা ছিল, তাদের মধ্যে শশী নামের কোন মেয়ের কথা মনে করতে পারল না
মৃগাঙ্ক। এ শশী কী শশীমুখী, শশীবালা কিংবা শশীকলা? নাকি শশীভূষণ, শশীশেখর, শশীচরণ?
মৃগাঙ্কর মনের মধ্যে জমে ওঠা অভিমান এবার সন্দেহের দিকে বাঁক নিল। এই জন্যেই কি আশার
বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না?
গভীর ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় তীব্র অধিকারবোধ। মৃগাঙ্ক
বহুবার তার কালেজের বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে তীব্র বিতর্ক করেছে, গোলদীঘিতে বসে। এই
অধিকারবোধ থেকেই আসে ঝগড়া, ঈর্ষা, ভুল বোঝাবুঝি। রবিবাবুর চোখের বালি, শরৎবাবুর গৃহদাহ
থেকে টেনে এনেছে অনেক উদাহরণ। মৃগাঙ্ক বলেছিল, অত্যন্ত ভালোবাসার লোককেও, তার
নিজের ভাবনা চিন্তার জন্যে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। বট গাছের একটি চারাকে যদি
বেঁধে দাও সংকীর্ণ বেড়ার বাঁধনে, সে না পারবে নিজের মতো বাড়তে, না পারবে বিশাল
ছায়া হয়ে সংসারের মাথায় আড়াল হতে। আজ, এই বইটা হাতে নিয়ে সে সব ভাবনা চিন্তা
মৃগাঙ্কর মনেও এল না। বরং বিয়ের পর থেকে বাপের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আশালতার সমস্ত
কথাবার্তা, মান-অভিমান, আচার-আচরণ তার মনে পড়তে লাগল। আর এই সমস্ত স্মৃতির মধ্যে থেকে,
সে জোর করেই মনের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে লাগল দ্বিচারিণী এক নারীর লক্ষণ। হতাশায় আর রাগে
তার মাথা গরম হতে থাকল।
মাথার বালিশের পাশে একটা তালপাতার হাতপাখা ছিল, তার ধারগুলো
নীল হলুদ শাড়ির পাড়ের কুঁচি দিয়ে সেলাই করে মোড়া। এটাও আশালতারই কাজ। এ বাড়িতে
যতগুলি হাতপাখা আছে সবগুলি খুব যত্ন নিয়ে সে মুড়ে দিয়েছে রঙিন শাড়ির পাড়ে। সকলেই
খুশি হয়েছিল, এর দৃষ্টি শোভনতায় আর উপযোগিতায়। সেই হাতপাখাটি নিয়ে বার কয়েক হাওয়া
খাওয়ার পর মৃগাঙ্কর চোখে পড়ল ওই শাড়ির পাড়। চোখে পড়া মাত্র তার মনে হল এই হাত
পাখার হাওয়ায় যেন তীব্র গ্রীষ্মের দাবদাহ। ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মেঝেয়।
“ও কিরে খোকা, ঘুমোলি নাকি? হাত থেকে পাখাটা পড়ে গেল”? কখন কে জানে পিসিমা
চুপিসাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার খাটের পাশে। “এই নে, পান আনতে বলেছিলি। নিচের
কাজ সেরে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল”।
মৃগাঙ্ক উঠে বসল খাটে। পিসিমার হাত থেকে পান নিয়ে মুখে দিল।
পিসিমা মেঝে থেকে পাখাটা তুলে আবার বিছানায় রাখল, বলল, “খুব গরম
পড়েছে এবার না রে? চোখ বন্ধ করে একটু শো, তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আরাম লাগবে,
ঘুম এসে যাবে। সারা হপ্তাটা তোর কী যায়, সে কি আর জানি না? পরের ছেলে পেয়ে অফিসের মিনসেরা
নাকে দড়ি দিয়ে কী খাটায়, সে বাপু আমি জানি”। বাধ্য ছেলের মতো মৃগাঙ্ক, চোখ
বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। পিসিমা বালিশের পাশে বসে, এক হাতে মাথায় হাত বোলাতে লাগল, আর
অন্য হাতে নাড়তে লাগল হাতপাখা। একলা ঘরে মৃগাঙ্কর মনের মধ্যে তীব্র আবেগ থেকে যে
রাগ আসছিল আশালতার ওপর, সেটা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এল পিসিমার স্নেহ স্পর্শে।
“পুরুষ মানুষের শরীর, তেতেপুড়ে এসে একটু আরাম চায়, একটু
শান্তি চায়। এই কথাই তোকে সকালে বলতে চাইছিলাম, খোকা। বৌদিমণি ভুল বুঝল, বলল আমি
নাকি তোর কান-ভাঙানি দিচ্ছিলাম। আচ্ছা আমি কি তোর পর। না হয় তোকে আমি পেটে
ধরিনি, তাই বলে কি আমি তোর মায়ের থেকে কম, বল? তা নাহলে আর পিসিমা বলবে কেন, বল?
আমি চাইব, তোর সংসারে ভাঙন ধরাতে? বৌদিমণি আমাকে কী চোখে যে
দেখে বুঝতে পারি না, বাপু। বৌদিমণির কোল আলো করে তুই যখন এলি, আমার তখন সবে বারো।
কি সুন্দর তুই ছিলি, রে! ঠিক যেন পুতুল। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নাড়তিস, গুলু গুলু
চোখে তাকিয়ে থাকতিস মুখের দিকে। তোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে, আমি ঘুরে বেড়াতাম
পাড়ায়। কি সুন্দর হাসতিস, হাত বাড়াতিস আমার কোলে আসার জন্যে। তারপর যখন তোর কথা
ফুটল, তুই ডাকলি পি-তি-মা”।
পিসিমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল কান্নায়। মৃগাঙ্ক চোখ
মেলে একবার তাকাল পিসিমার মুখের দিকে। বলল, “পিসিমা, কেঁদো না, সংসারে থাকলে ওরম
ঠোকাঠুকি একটু আধটু হয়”।
আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে ধরা গলায় পিসিমা বলল, “তা হয়। সে কি
আর জানি না। বড়দা বল, তোর মা বল, আমি - তোর এই পিসিমা বল, সবাই কার মুখ চেয়ে সংসার করি, বাবা? তোর মুখ
চেয়ে। কোন ভাবে আমি তোর অকল্যাণ চাইব, এ হতে পারে খোকা? তুই ছাড়া আমার এই সংসারে
কিসের টান বল দেখি, বাবা? আমার তো কোথাও কোন বাঁধন নেই। ভাঁটার
স্রোতে কচুরিপানা হয়ে কখনো ভেসে যাই সাগরের দিকে, জোয়ারের ধাক্কায় আবার ফিরে আসি
সংসারের ঘাটে”।
পিসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মৃগাঙ্ক চোখ
বন্ধ করে অনুভব করতে পারল তার পাশে বসে থাকা এই নারীর বাস্তব নিঃস্বতা।
“খোকা ঘুমোলি”? চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল পিসিমা।
“না। শুনছি তোমার কথা”।
“ভাবছি, কাশী যাবো”।
“পিসিমা, আমিও যাবো, তোমার সঙ্গে”। মৃগাঙ্ক ছোট্ট ছেলের মতো
লাফিয়ে উঠে বলল।
“কথা শোন পাগল ছেলের, তুই কেন কাশী যাবি, বাবা”?
“বারে, তুমি যাবে, আর আমি যাবো না? চলোনা, পিসিমা চলো না।
অনেক গল্প শুনেছি, পড়েছি। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট,
অহল্যাবাঈ ঘাট। কাশীর গলি। ষাঁড়। খাঁটি দুধ। রাবড়ি, পেঁড়া, পুরি, কচৌরি। দাঁড়াও
সন্ধ্যেবেলায় বাবার সঙ্গে কথা বলি। আমি বললে বাবা, না করতে পারবেন না”।
মৃগাঙ্কর আনন্দ দেখে পিসিমা বিষণ্ণ হাসল, মৃগাঙ্কর চুলের
মধ্যে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমি আর ফিরবো না রে, খোকা। আমি চলেই যাবো
তোদের এই সংসার ছেড়ে। আমার পোড়াকপালের দোষে তোদের কোন অকল্যাণ হয়, এ আমি চাই না,
বাবা”।
“ধ্যাত, তুমি এত বাজে বকো না, পিসিমা”। মৃগাঙ্ক পিসিমার
কোলে মাথা রাখল, পিসিমা পরম মমতায় মৃগাঙ্কর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “দেখিস।
একদিন ঠিক চলে যাবো”।
“থাক, খুব হয়েছে। মাথায় থাকুন বাবা বিশ্বনাথ। কাজ নেই আমাদের
কাশী বেড়ানোয়”।
৬
দুটো ঘি মাখানো রুটি। করেলার সবজি। একটু খানি আচার।
ছোট্ট বাটি উপুড় করা আতপ চালের ভাত। টক দই। বিশেষের খাওয়ার এই বহর দেখে হীরালালজির
পত্নী খুব দুখী হয়ে গেলেন।
“বেটা তু কুছ ভি নেহি খায়া। ইতনাসা খাকে কোই জি শকতা, ভলা?
তেরা পসন্দিদা খানা নেহি মিলা, এহি হ্যায় না? হাঁ জি, শুনতে হো, বচ্চে কো ছোড় দো।
বাহার সে খানা খাকে ইধার আ জায়েগা”। হীরালালজির পত্নী বিশেষের খাওয়া দেখে বললেন।
বিশেষ হাসতে হাসতে বলল, “বহোত খা লিয়া, মাজি। বাস মজা আ গিয়া। আপ সোচিয়ে মত,
ম্যাঁয় বিলকুল খুশ হুঁ”।
“বাঙ্গালিলোগ অ্যায়সাই হোতা হ্যায়, উমা। খাতে হ্যায় কম, দুধ
দেতা জ্যাদা” হীরালালজি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। তারপর বিশেষের দিকে তাকিয়ে
বললেন, “কি রে ঠিক বলেছি, তুই তো আবার বারিন্দির বামুনের ছেলে। শুনেছি বামুনের গরু
- খায় কম, দুধ দেয় বেশি”। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন হীরালালজি। তারপর বললেন, “বুরা
মত মান না বেটা। তু একদম বাপ পর গয়া। একদম, সহি মে”। বিশেষ হাসল। অবাঙালী বয়স্ক এই
মানুষটির আন্তরিকতা তার খুব ভালো লাগল।
খাওয়ার পর বিশেষ নিজের কামরায় এল। ঘড়িতে দেখল দুটো দশ বাজে।
দুপুরে ঘুমোনো তার পোষায় না। ফোনে বাবাকে লিখল, “ঘর দখল। চান খাওয়া সব হয়ে গেল”।
উত্তর এল, “কেমন মনে হচ্ছে, হীরালালজিকে”?
“দারুণ। তোমাকে খুব ভালোবাসেন”
“আই নো। সেই জন্যেই তো পাঠালাম তোকে। ধর্মশালায় থাকতে একটু কষ্ট
হবে, তা হোক। ইউ উইল লাভ ইট”।
“আয়্যাম লাভিং বাবা। দে আর গ্রেট, দিলদরিয়া, হাসিখুশি”।
“দেখলে বোঝা যায় না, ভীষণ পণ্ডিত মানুষ। সংস্কৃত, হিন্দী,
ইংরিজি, বাংলা গুলে খেয়েছেন”।
“তোমার সম্বন্ধে, আজেবাজে বলছিলেন”।
“তাই? হা হা হা হা। বলতেই পারেন না। তুই আমার লেগপুল করছিস? নিজের বাবাকে”?
“ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেণ্ড, বাবা”।
“আই নো। আয়্যাম প্রাউড অফ ইউ, বিয়িং ইয়োর ফাদার”।
“তোমাকে উনি খুব রেসপেক্টও করেন”।
“না রে, স্নেহ করেন। ভালোবাসেন। ভাবি কেমন আছেন”?
“ভালো”।
“এখন কী করছিস”?
“ঘরে রয়েছি। এবার বেরোবো। তোমার অতীতের ভারতকে খুঁজবো”?
“আমার অতীত না তোর বাবার অতীত”?
“তাই তো বললাম। হা হা হা হা”।
“ও তাও তো বটে। আমিই তো তোর বাবা। ঘুরে আয়, সন্ধে বেলা ফিরে
এসে তোর ফোন থেকে আমাকে কথা বলাবি”।
“ওক্কে”।
“এনজয়, বাই”।
“বাই”।
ঘরের দরজা চেপে দিয়ে বিশেষ নিচেয় নামল সিঁড়ি দিয়ে। প্যাসেজ
দিয়ে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় পা দিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল। বারান্দায় জনা পঁচিশেক
বুড়ি বসে রয়েছে। অধিকাংশই খুনখুনে, বয়েস সত্তরআশির কম নয়। সকলেই বিধবা, সকলেরই
পরনে ভীষণ সস্তার সাদা শাড়ি। নোংরা, মলিন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, বাংলায়। সকালে
যখন এসেছিল, সব কটা ঘর বন্ধ আর নির্জন দেখেছিল। এখন
বারান্দার দুখানা ঘরের দরজা খোলা। এরা কি তীর্থযাত্রী, দলবেঁধে এসেছে তীর্থ করতে? হয়তো
বাঁকুড়া, বর্ধমান কিংবা হয়তো জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে বাস রিজার্ভ করে।
বিশেষকে দেখে সকলেই কথা বন্ধ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আচমকা
ওদের মধ্যে একজন বুড়ি হঠাৎ তার শীর্ণ কংকালসার হাত বের করে বলল, “দশটা টাকা দিবি,
বাবা”?
বিশেষ চমকে উঠল। বাস রিজার্ভ করে সুদূর বাংলা থেকে এরা কি
এসেছে ভিক্ষে করতে? ওই বুড়ির বাড়ানো হাত, আর বাকি সকলের চোখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ
যেন ভয় পেল। প্রত্যেকের চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিছু একটা প্রত্যাশা নিয়ে। যে
ভিক্ষে চাইল, সে যেন সকলের প্রতিনিধি। সকলেই যেন ভিক্ষে পেলে বর্তে যাবে। বিশেষ
লক্ষ্য করল, প্রত্যেকের শরীর একই ধরনের জীর্ণ। সে জীর্ণতা শুধুমাত্র বয়সের জন্যে
নয়। দীর্ঘদিন অসম্ভব দৈন্য আর অসহনীয় ক্ষিদের সঙ্গে যুঝতে থাকার লক্ষণ সবকটি
শরীরে। তাদের শুকনো খড়িওঠা মুখ। চোখের চাউনি, ক্লিন্ন চোখের কোল। তাদের হাত-পায়ের
আঙুল, আঙুলের দীর্ঘ ময়লা নখ। বিশেষ বিপন্ন বোধ করল। ওদের সামনে তার বহুমূল্য
ব্র্যাণ্ডেড জিন্স্, শার্ট, স্নিকারে মোড়া সুষম পুষ্টির যুবক শরীর একদম খাপছাড়া
মনে হল। অসহায় অনুভূতিতে স্থাণু দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ।
“যাইয়ে জি, যাইয়ে। ঘুমকে আইয়ে। বৃন্দাবন দর্শন করকে আইয়ে। ইয়ে
বুড়িয়াঁ অ্যায়সাই হ্যায়, ইনকি কভি ভি দিল নেহি ভরতি। হর টাইম ভিখ মাংতি রহতি
হ্যাঁয়। ইনকি বাতোঁ মে মত যাইয়ে”।
চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে বিশেষ দেখতে পেল, রামু ভাইকে। সম্বিত
ফিরে পেল, বিশেষ। মাথা নিচু করে খুব দ্রুত নেমে গেল উঠোনে, হেঁটে গেল সদর দরজার
দিকে। যেতে যেতে তার কানে এল, কেউ একজন খনখনে
স্বরে বলল, “মরাটা এসে ব্যাগড়া না দিলে,
ছোঁড়াটাকে বেশ কাবু করে ফেলেছিলাম”।
প্রেতের হাসির মতো আওয়াজ তুলে হেসে উঠল বুড়ির দল। আরেকজন কেউ বলল, “মরা
না মরা। আগের জম্মে মরা মরা করে, আজ রামু হয়ে উঠেছে, আবাগির বেটা,
বেআক্কেলে, মুকপোড়া মিন্সে”।
বিশেষ রাস্তায় পা দিয়ে স্বস্তি পেল। ওই বুড়িগুলোর সামনে সে
কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন বাঁধা পড়ে গিয়েছিল শীর্ণ-জীর্ণ
অতীতের মাঝখানে। কোনমতে টিকে থাকা ওই প্রাণগুলো যেন বিগত-জীবন। শেষ দুপুরের
উজ্জ্বল আলোয় ব্যস্তসমস্ত লোকজন, দোকান পাট, পথে হেঁটে চলা তীর্থযাত্রীর দল তাকে
ফিরিয়ে আনল জীবনে। রাস্তার ধারের দোকানের একটি লোককে জিজ্ঞাসা করে সে রওনা হল যমুনার
দিকে। বাবার কাছে বিশেষ শুনেছে অতি প্রাচীন এই জনপদ, বিস্মৃতির জঙ্গলে ঢাকা পড়েছিল
বহুদিন, প্রায় ষোড়শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত। ১৫১৫ সালে শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর
দৈবী দৃষ্টিতে, এই পতিত জঙ্গলের মধ্যে থেকে খুঁজে আবিষ্কার করেছিলেন পৌরাণিক
সমস্ত ক্ষেত্রগুলি, কেশী ঘাট, গোকুল, সেবাকুঞ্জ বা নিকুঞ্জবন, নিধিবন, গিরি
গোবর্ধন। বৃন্দাবন ফিরে পেয়েছিল তার হারানো ঐতিহ্য। তারপর থেকে শুরু
হয়েছিল বৈষ্ণব ভক্তদের বিপুল আনাগোনা। গড়ে উঠতে শুরু করেছিল অজস্র ছোট-বড়,
সাধারণ-অসাধারণ মন্দির।
কেশীঘাটে যমুনার পাড়ে এসে খুবই হতাশ হল বিশেষ। এই সেই নীল
যমুনা! ঠাকুমার মুখে গল্প শোনা পবিত্র স্বচ্ছতোয়া যমুনা। স্কুল জীবনে পড়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং দু চারটে
বৈষ্ণব পদাবলীর পদ্যের বর্ণনা থেকে যমুনার যে রূপ তার কল্পনায় ছিল, তার সঙ্গে এই
যমুনার কোন মিলই খুঁজে পেল না। প্রায় স্রোতহীন, নোংরা এই যমুনার জলে শ্রীকৃষ্ণ
কিংবা শ্রীরাধা নিশ্চয়ই অবগাহন করেননি। সে যমুনা ছিল অন্য কোন যমুনা। শ্রীরাধাকৃষ্ণের
যত বড়ো ভক্তই কেউ হোক না কেন, এই যমুনা নিয়ে রোমান্টিক কল্পনার কোন অবকাশ নেই। এই
যমুনায় ডুব দিলে মোক্ষলাভ যে হবে না সে কথা নিশ্চিত বলা যায়, কিন্তু ভয়ংকর চর্মরোগ
যে হবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। যমুনা দর্শন সেরে এবার বিশেষের লক্ষ্য ইমলিতলা,
তারপর নিকুঞ্জবন।
৭
কপালে নরম হাতের স্পর্শে মৃগাঙ্কর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে
দেখল, খুব সুন্দর মুখের একটি মেয়ে নিচু হয়ে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মুখে তার
হাল্কা হাসি, কপালে টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর। নাকে ছোট্ট নোলক, কানে দুল, কণ্ঠে সোনার
হার। ঘোমটা নেমে গেছে ঘাড়ের কাছে। দু হাত বাড়িয়ে মৃগাঙ্ক মেয়েটির মুখটা টেনে নিল
খুব কাছে, তারপর তার অধরে ডুবিয়ে দিল নিজের ঠোঁট। মেয়েটি অদ্ভূত শিহরণে আপ্লুত
হয়েও, ছটফট করে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। কিছুটা সামলে নিয়ে লজ্জানত চোখে বিছানার পাশে
বসে বলল, “আপনি এমন করবেন জানলে আমি কিন্তু এখন আসতাম না। নিচেয় মায়ের কাছে বসে
থাকতাম”।
মৃগাঙ্ক হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে বসল, দেখতে লাগল তার স্ত্রী
আশালতাকে, তার অনুভবে তখনো আশালতার অধরের শিহরণ ও স্বাদ। খুব
গম্ভীর মুখ করে বলল, “তাই বুঝি? আমার কাছে আসতে তোমার একদম ভালো লাগে না, না? সেই
জন্যে বাপের বাড়ি থেকে ফিরতে এত দেরি করলে? তাহলে তাই করো, নিচেয় মায়ের কাছে বসে
থাকো, তারপর আবার চলে যেও বাপের বাড়িতে”।
“ও মা, আপনার মুখে কোন কথাই দেখি আটকায় না। আমি বুঝি তাই
বললাম? আমি এ বাড়ির বৌ, বাপের বাড়ি কেন যাবো? আপনি আমাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে এনেচেন,
আমি বাপের বাড়িতে থাকবো বলে”?
“বাবা, আমাদের জন্যে যেন কত দরদ? একমাসের জন্যে যাচ্ছি বলে,
সেই যে যাওয়া হল, চারমাস পরে এই ফিরলে”।
“মোটেই চারমাস নয়। তিনমাস নদিন। আপনি তো সব জানেন, আমি বুঝি
শখ করে বাপের বাড়িতে ছিলাম”?
“বাবা মাস, দিন সব একেবারে হিসেব করে রাখা হয়েছে দেখছি”।
“বা রে, আমার বুঝি ভালো লাগছিল থাকতে? কবে ফিরে আসব সেই দিন
গুনছিলাম। আপনাদের কথা সবসময় মনে হত”।
“আপনাদের মানে”?
“বাবা, মা, পিসিমা। বাসন্তীদিদি,
তিওয়ারিদাদা। বামুনদিদি, রাখালদাদা, পুণ্যিদিদি”।
“অ, আর কেউ না”?
“ও মা, আর কার কথা ভাববো”?
“আমার কথা একটুও ভাবতে না? এদিকে আমি যে তোমার কথা ভেবে
ভেবে পাগল হচ্ছিলাম!”
“এ মা। সে কথা আবার বলতে হয় নাকি। আপনি তো আমার ইহকাল,
পরকাল। আপনার চরণের দাসী হয়ে যেন আমরণ থাকতে পারি, আমাকে সেই আশীব্বাদ করুন”।
“আচ্ছা, সে আশীর্বাদ না হয় করা যাবে, সে এখনই কিছু পালাচ্ছে
না। কিন্তু তোমাকে চরণের দাসী করে আমি তো রাখবো না, আশা”।
“ও মা, সে কি কতা। নিশ্চই আপনার চরণে আমার কিছু ঘাট হয়েচে। আপনার দুটি
পায়ে পড়ি, আপনি আমার ওপর আর রাগ করে থাকবেন না”।
“তোমাকে আমি আমার বুকের রাণি করে রাখবো, আশা”।
“রাণিটানি আমি বুজি না। আমি তো আর আপনার মতো কালেজে অত পাস
দিইনি। আমি মুক্খু মেয়েছেলে, আপনার চরণে থেকে আপনার সেবা করতে চাই”।
মৃগাঙ্ক আশালতার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নিল,
দীর্ঘদিন বিরহে থাকার পর এই মিলনের আবেগে আশালতা ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল, কিন্তু
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “আপনার দুটি পায়ে পড়ি,
তিন সন্ধে বেলা এমন করতে নেই। মা লক্ষ্মী চঞ্চলা হন, গেরস্তর অকল্যাণ হয়। আমাকে ছেড়ে
দিন, আমি নিচেয় যাই। আমি এখানে থাকলেই আপনি এসব করবেন। আপনিও নিচেয়
চলুন, সবাই নিচেয় আছেন কতা বলচেন, আপনাকে সকলে ডাকচেন।”
মৃগাঙ্ক ছেড়ে দিতে, আশালতা বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে
দৌড়ে গেল দরজার দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে বলল, “আপনি আর দেরি করবেন না।
নিচেয় সকলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করচেন”।
আশালতা চলে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃগাঙ্ক, তারপর
বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো চুলটা ঠিক করে নিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ধুতি আর বেনিয়ান
পড়া ছিল, এখন তার ওপর পড়ে নিল একটা পাঞ্জাবি।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় তার মনে হল, আশালতা কার সঙ্গে
এসেছে সে জিজ্ঞাসা করেনি। খুবই অন্যায় হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে আশালতাকে দেখে তার এতই
আনন্দ হয়েছিল, ভুলে গিয়েছিল কর্তব্য।
বসার ঘরে তার বাবার সঙ্গে বসে আছেন আশালতার বাবাও।
মৃগাঙ্ককে দেখে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মৃগাঙ্ক নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে
উঠতেই, বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসো বাবা, এসো। দীর্ঘজীবি হও। তোমার বাবার কাছে,
তোমাদের কাছে, আমার যে কত অপরাধ ঘটে গেল, এই ক মাসে, সে আর বলার নয়”। মৃগাঙ্ক সামনের
তক্তপোষে বসে থাকা বাবাকেও প্রণাম করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল, শুনতে লাগল আশালতার
বাবার কথা।
“মায়ের অসুখটা ভেবেছিলাম, সাধারণ ব্যাধি। শরীর থাকলেই
জ্বরজারি যেমন হয়ে থাকে আর কি। তারওপর বয়েসও হয়েছে সত্তরের ওপর। মা বললেন আশা মাকে
একবার দেখতে চান। বেয়াই মশাইয়ের থেকে আমি যদিও এক মাসের অনুমতি নিয়েছিলাম, তবে
আমার মনে ছিল, দিন পনের কুড়ির মধ্যেই আমি নিজে এসে দিয়ে যাবো আশা মাকে। কিন্তু হয়ে
গেল একদম অন্যরকম”।
মৃগাঙ্কর বাবা বললেন, “বেয়াই মশাই, আধিব্যাধি, দৈবদুর্বিপাক
না আপনার হাতে, না আমার হাতে। গোবিন্দর কৃপায় আপনার মাতৃদেবী এখন সুস্থ হয়ে
উঠেছেন, এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। এ নিয়ে আপনি নিজেকে আর কুণ্ঠিত করবেন না। আমাদের
কাছেও বারবার বলে, আমাদের অপরাধী করবেন না। দাঁড়িয়ে রইলি কেন, খোকা, বোস না এখানে। বৌমা আমাদের যেমন ঘরের
লক্ষ্মী, তেমনি আপনার কন্যা, আপনার মাতার পৌত্রী। কাজেই এ নিয়ে আপনি আর মনে খেদ
রাখবেন না”।
“এমন উদার মনের কথা আপনার পক্ষেই বলা সম্ভব বেয়াইমশাই, এ
কথা আমি বাড়িতেও আলোচনা করি। তা, মৃগাঙ্ক বাবাজীবন, কাল তোমার আপিস যাওয়া আছে নাকি”?
“আজ্ঞে, হ্যাঁ”।
“সকালে কটায় বেরোতে হয়, বাবা”?
“আজ্ঞে সাড়ে ছটার মধ্যে বেরোলে, সাতটা ষোলোর গাড়িটা ধরা যায়”।
“সেই ভালো, বাবা, সেই ভালো। আমিও তোমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব।
আমি উল্টোদিকের গাড়ি ধরে বর্ধমান, সেখান থেকে সকালে অনেক গাড়ি পেয়ে যাবো”।
“না না, বেয়াই মশাই, সেটি হচ্ছে না। আপনি এলেনই আজ সন্ধের
মুখে। এ আপনাদের শহর নয় যে, এই রাত্রে বাজারে লোক পাঠিয়ে আপনার জন্যে কিছু আয়োজন
করে ফেলব। কাল সকালে পুকুরে জাল নামাবো, দুপুরে মাছের ঝোল দিয়ে চারটি ভাত খেয়ে তবে
আপনার মুক্তি। তার আগে আপনাকে ছাড়ছি না”। হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন মৃগাঙ্কর
বাবা।
আশালতার বাবা জোড়হাত করে বললেন, “অপরাধ নেবেন না বেয়াইমশাই,
আপনার আতিথেয়তার কোন তুলনা নেই। কিন্তু আমাদের বংশে বিবাহিতা কন্যার ঘরে কন্যার
পিতার অন্নগ্রহণ করার প্রথা নেই। আমি অবিশ্যি এসব কুপ্রথা বা সংস্কারে খুব একটা
বিশ্বাসী নই। তাছাড়া, এই রাত্রে যাবোই বা কোথায়, অগত্যা রাত্রের অন্নসংস্থান আমাকে
স্বীকার করতেই হবে”।
“এরকম প্রথা আমাদের বংশেও চালু আছে। তবে তাই হোক। ময়দা তো
অন্ন নয়, বেয়াইমশাই। লুচিতে নিশ্চই আপনার আপত্তি হবে না”।
“হে হে হে হে। আপনি বড়ো বিচক্ষণ ব্যক্তি, বেয়াইমশাই”।
“এই কে আছিস, ভিতরে বলে দে, রাত্রে বেয়াইমশাই ভাত খাবেন না,
লুচি হবে”।
“অন্দরের মা লক্ষ্মীরা আবার বিব্রত না হন, বেয়াইমশাই”।
হাতে ধরা ট্রেতে জলখাবার নিয়ে বাসন্তীদিদি ঢুকল। তার
সঙ্গে ঘোমটা দিয়ে ধীর পায়ে এল আশালতা। তার পিছনে এসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল
পিসিমা। সবচেয়ে বড়ো সাজানো রেকাবিটি আশালতা বাসন্তীদিদির থেকে নিয়ে
রাখল, নিজের বাবার সামনে। তারপরের ছোট রেকাবি দুটি দিল মৃগাঙ্কর বাবাকে ও মৃগাঙ্ককে।
নিজের সামনে বড়ো প্লেট দেখে আশালতার বাবা বিষণ্ণ হাসি মুখে
বললেন, “এই দেখুন বেয়াই মশাই। আপনিই দেখুন, বিয়ের পর মেয়ে পর হয়ে যায় কিনা। আমি
বাইরের অতিথি, তাই আমাকে আগে দিল এবং বড়ো রেকাবিটাই দিল। আপনি নিজের লোক বলে, পরে
দিল আর দিল ছোট প্লেট”।
আশালতার বাবার এই কথায় মৃগাঙ্কর বাবা খুব জোরে হেসে উঠলেন
হা হা করে, বললেন, “সে কথা তো একশবার বেয়াইমশাই, বৌমা এখন আমার ঘরের লক্ষ্মী,
সংসারের কল্যাণ-অকল্যাণ ওকেই তো সামলাতে হবে। নিন চালু করুন”।
“তবে যাই বলুন, বেয়াইদাদা, মেয়ে যতই পরের ঘরে
যাক, নিজের সংসার হোক। নিজের বাপমাভাইয়ের জন্যেও তার বুক ফাটে। মুখ ফুটে বলতে পারে
না ঠিকই, কিন্তু প্রাণটা কি আর কাঁদে না”? একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিসিমা হঠাৎ বলে
উঠল। আশালতার বাবা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন পিসিমাকে, বললেন, “ও, ছোট বেয়ান? ভালো
আছেন তো?”
মৃগাঙ্কর মনে হল আশালতার বাবা পিসিমার এই কথায় খুব প্রসন্ন
হলেন না। আর মৃগাঙ্কর বাবা তো বেশ বিরক্তই হলেন। পিসিমা কিন্তু থামলেন
না, আবারও বললেন, “আমাদের বৌমার মতো মেয়ে হয় না। যে কটা দিন ছিল না, ঘর যেন
অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরে এ কটা মাসেই বৌমা সব্বার মন এমন জয় করে নিয়েছে, যে
বৌমা ছাড়া আমরা চোখে এখন অন্ধকার দেখি। পরের ঘরে এসে এমন আপন করে নেবার শিক্ষা তো
আপনারাই দিয়েছেন, বেয়াইদাদা। তাই বলে ঠাকুমার শরীর খারাপ হলে সে যাবে না? ভগবান না
করুন আজ যদি কিছু একটা ঘটে যেত, ওর মনে সারা জীবনের একটা আক্ষেপ থেকে যেত,
ঠাকুমাকে চোখের দেখাটাও দেখতে পেলাম না। ষোলো বছর যে বাড়িতে বড়ো হয়েছে, তার বাবার
কাছে, মায়ের কাছে আবদার করেছে, ভাইদের সঙ্গে দৌরাত্ম্যি করেছে, সে কি এত সহজে ভুলে
যাওয়া যায়, বেয়াই দাদা? ও সম্পর্ক যে রক্তের সম্পর্ক”।
পিসিমা এত কথা বললেও কেউ কোন উত্তর দিলেন না। মৃগাঙ্ক অবাক
হয়ে তাকিয়েছিল পিসিমার দিকে। পিসিমা এসব কথা এসময় কেন বলতে এল? কেউ কিছু বলল না
দেখে পিসিমা চলে যেতে গিয়ে দরজার সামনে একটু থমকে দাঁড়াল, তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল
ঘর থেকে। মৃগাঙ্ক দরজার বাইরে দেখতে পেল মায়ের আঁচলের প্রান্তটুকু।
৮
যমুনা দর্শনে যতটা হতাশ হয়েছিল, নিকুঞ্জবন দেখে ততটাই মুগ্ধ
হল বিশেষ। বহু প্রাচীন এই বনস্থলীতে শ্রীকৃষ্ণ আজও নাকি নিত্য নেমে আসেন, শ্রীরাধা
ও গোপিনীদের সঙ্গে সারারাত মত্ত হয়ে ওঠেন রাসলীলায়। প্রাচীন গাছবহুল এই উদ্যানের
উচ্চতা কোমর, বড়ো জোর বুক সমান। কোন এক পরম যুগলের চরণরেণু স্পর্শ করার জন্যে
সমস্ত গাছের মাথা যেন নত হয়ে আছে মাটির দিকে। সন্ধের আগে নিকুঞ্জবনের গেট বন্ধ করে
দেওয়ার সময় বিশেষ বেরিয়ে এল। ঘুরতে লাগল শহরের পথে, মন্দিরে মন্দিরে। আলোয় উজ্জ্বল
মন্দিরে মন্দিরে চলছে আরতি। অবিরত নাম গান। রাস্তার দু ধারে মোবাইলের দোকান,
কম্পিউটারের দোকান, এটিএম, ব্রাণ্ডেড পোষাকের ঝকঝকে শোরুম, চিনিয়ে দেয় আধুনিক
ভারতবর্ষের নাগরিক চিত্র। পাশাপাশি এই অজস্র মন্দির, তাদের সমবেত আরতির বাদ্য, মন্ত্র উচ্চারণ,
নাম গান, বিশেষকে চিনিয়ে দিচ্ছিল এক সনাতন ভারতবর্ষকে। যে সনাতন
ভারতবর্ষকে চেনার মন্ত্র সে পেয়েছে তার বাবার থেকে।
অদ্ভূত এই শহরে অতীত
ও বর্তমানের পাশাপাশি অধিষ্ঠানের অনুভূতি
সংগ্রহ করতে করতে বিশেষ একসময় ক্লান্তি অনুভব করল তার দুই পায়ে। ঘড়িতে তখন
সাড়ে আটটা বাজে। এই পরিক্রমা আজকের মতো শেষ করা উচিৎ। বাকিটুকু দেখার জন্যে কাল
সারাদিন আছে। ধর্মশালায় ফেরার কথা মনে হতেই, এতক্ষণ যে ঘটনাটা ভুলে ছিল, সেই ঘটনার
বিভীষিকা আবার তার মনে পড়ে গেল। এখনো কি সেই বুড়িগুলো বসে আছে ওই প্রাচীন
বারান্দায়? ওই প্রাচীন দেওয়ালের প্রেক্ষাপটে? দিনের আলোতেই যে দৃশ্য তার অসহনীয় মনে
হয়েছিল, রাত্রের অন্ধকারে সেই দৃশ্য আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
সদর দরজার কাছে এসে বিশেষ একটু থমকাল। কান পেতে রইল কিছু
শোনার জন্যে। শুনতে পেল না কিছু। সন্তর্পণে ঢুকে এল দরজা দিয়ে, প্যাসেজ পেরিয়ে
উঠোনের সামনে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল বিশেষ। নাঃ কেউ নেই। আশেপাশে, বারান্দায়
কোন বুড়ি নেই। বারান্দার সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা প্লাস্টিকের তারে একটা বাল্ব আলো
ছড়াচ্ছে চারদিকে। তার স্বল্প ক্ষমতায় আঁধার দূর হয়েছে ঠিকই কিন্তু জায়গাটা আলোকিত
হয় নি।
উঠোন থেকে বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে পা দিয়ে একটা আওয়াজ শুনতে
পেল বিশেষ। কিছুটা গোঙানি, ভাঙা কান্নার মতো। বারান্দায় কেউ তো নেই।
তাহলে বন্ধ দরজার ভেতর থেকে এই আওয়াজ এল? নাকি পুরোটাই তার মনের ভুল? না, ওই আবার
শুনতে পেল, একটানা কেউ যেন কেঁদে চলেছে বিকৃত স্বরে। আওয়াজ অনুসরণ করে বিশেষ
দাঁড়াল একটা বন্ধ দরজার সামনে। এই ঘর থেকেই আওয়াজ আসছে সে নিশ্চিত। বাইরে থেকে
দরজা বন্ধ নয়, ভেতর থেকে কি বন্ধ? বিশেষ কি দরজা ঠেলে দেখবে? কারা আছে এই ঘরে, কে
কাঁদছে, কেনই বা কাঁদছে? কিন্তু এই কৌতূহলের কি দরকার আছে কোনো? কী যায় আসে, বিশেষ
যদি শুনেও না শুনে চলে যায় তার ঘরে? স্নানটান সেরে, যদি হীরালালজির সঙ্গে বসে গল্প
করতে বসে যায়?
বিশেষ দরজায় হাল্কা চাপ দিতে খুলে গেল দরজাটা। ঘরের মধ্যেও
কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। দু হাতে ঠেলে হাট করে খুলে দিল দরজাটা। বদ্ধ ঘরের থেকে উৎকট
দুর্গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। অল্প আলোয় তার চোখে পড়ল দুপাশের দেয়াল ধরে, মেঝেয়
ভাঁজ করা অন্ততঃ গোটা পনের বিছানা। একধারে একটা মাত্র বিছানায় শুয়ে কাঁদছে এক
বুড়ি। জানালাহীন, বদ্ধ ঘরের মধ্যে সন্তর্পণে ঢুকল বিশেষ। দুর্গন্ধটা এবার চিনতে
পারল। পচা চামড়ার মতো গন্ধ। হস্টেলে থাকতে, ঘরের কোনায় জমে ওঠা
না-কাচা মোজা থেকে এরকম গন্ধ সে পেয়েছে। শুয়ে থাকা বুড়ির দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে
গেল বিশেষ। বুড়ি তাকে দেখতে পেয়েছে। অল্প আলোয় বুড়ির ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি তার
দিকেই। এখন আর তাই কাঁদছে না।
বুড়ির কাছে গিয়ে, বিশেষ উবু হয়ে বসল, জিজ্ঞাসা করল, “কী
হয়েছে? ও বুড়ি, কাঁদছো কেন?”
দাঁতহীন ফোগলা মুখে ধাতব উচ্চারণে বুড়ি উত্তর দিল, “খাআআআবো।
কিচু খেতে দিবি বাবা? তিনদিন কিচু খাইনি”। এইটুকু কথা বলেই বুড়ি হাঁফাতে লাগল। “কি
খাবে”? বিশেষ জিজ্ঞাসা করল। বুকের পাঁজরগুলো হাপরের মতো ওঠানামা করতে করতে বুড়ি
বলল, “ভাআআআত, দুটি ভাত খাবো”।
কথা বলার পরিশ্রমে কংকালের মতো বুক থেকে কাপড়ের আঁচলটুকু
সরে গেল। বিশেষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল বুড়ির বুকের দিকে। যে স্তন্য
পান করে বড়ো হয়ে ওঠে স্তন্যপায়ী মানুষ। যুগ যুগ ধরে যে স্তনের স্তব করে এসেছে বিশ্বের
তাবৎ পুরুষকুল। এই সেই স্তন - কদর্য, অবাঞ্ছিত দুটি প্রত্যঙ্গের মতো!
বদ্ধ ঘরের দুর্গন্ধে, বিশেষ অস্বস্তি অনুভব করছিল। ঘাড়ের
নিচেয় একটা হাত আর হাঁটুর নিচে অন্য হাত দিয়ে বিশেষ তুলে নিল বুড়িকে। মেদহীন,
পুষ্টিহীন, অত্যন্ত হালকা কংকাল শরীরটাকে বাইরে এনে, বারান্দায় বসিয়ে দিল, দেয়ালে
হেলান দিয়ে। ঘরের বাইরে নিশ্বাস নিয়ে স্বস্তি পেল, বিশেষ। বুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল
একবার, ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে বুড়ি তাকিয়ে আছে তার দিকেই। নিচু হয়ে শাড়ির আঁচলে
ঢেকে দিল বুড়ির শুকনো বুকটা। বুড়ি একই ভাবে তাকিয়ে বসে রইল, পাঁজরের দ্রুত ওঠা
নামায় তার বুক ভরে উঠতে লাগল বাইরের বাতাসে।
“বুড়ি, বসো, আমি আসছি, ভাত পাওয়া যায় কিনা, দেখি”।
বিশেষ আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল। আসার সময় বাঁদিকে একটা
বাঙালি ভাতের হোটেল দেখেছিল, সেই দিকেই গেল। হোটেলে গিয়ে বলতে প্লাসটিকের প্যাকেটে
আলাদা করে দিল ভাত, ডাল, একটা ভাজা, একটা তরকারি। দাম মিটিয়ে ফিরে আসার সময়
বিশেষের মনে হল, এই বুড়িটাও দুপুরের সেই বুড়িগুলোর মতো তাকে “কাবু” করে ফেলল
না তো? হয়তো সবটাই নাটক। একলা ঘরে কাঁদছিল, কেউ না কেউ শুনতে পাবেই, এই ভেবে!
ফিরে এসে দেখল বুড়ি একই ভাবে বসে আছে। বুকের হাপরটা একটু
কমে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে শ্বাস প্রশ্বাস। প্যাকেটগুলো বারান্দার মেঝেয় যখন
রাখল, বুড়ি আবার বলল, “ভাআআআত”? মুখ তুলে তাকালো বিশেষের দিকে। বুড়ির ফোগলা মুখে
আনন্দের হাসি। দু চোখের দৃষ্টিও এখন অনেকটা স্বচ্ছ। প্যাকেটের
মুখগুলো খুলে, মেঝেয় সাজিয়ে দিল বিশেষ, বলল, “ও বুড়ি, এই হল ভাত, এই ডাল, ভাজা আর
এই তরকারি। খেয়ে নাও”। বাঁহাতে শরীরের ভর রেখে বুড়ি আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল খাবারের
ওপর। তার শরীরের ভারে থরথর করে কাঁপছে বাঁ হাতটা। ডান হাতে ভাত তুলে নিল মুঠিতে,
মুখ অব্দি তুলতে পারল না। ঝরঝর করে পড়ে গেল মেঝেতে, কাপড়ে। অসহায় চোখ তুলে বুড়ি
বলল, “খেতে পাআআরি না”।
কি করবে এখন বিশেষ? খাইয়ে দেবে? উপায় কি? বুড়ির জন্যে নিয়ে
আসা ভাত যদি বুড়ি খেতেই না পারে? দ্বিধা সরিয়ে ভাতের প্যাকেটের মধ্যে ঢেলে দিল
কিছুটা ডাল, তার মধ্যে তরকারি, প্যাকেটের মধ্যেই মেখে নিল। তারপর ভাতের গ্রাস বানিয়ে, তুলে
দিল বুড়ির মুখে। বুড়ি ফোগলা মুখে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে গিলে নিল, মুখ খালি করে
আবার হাঁ করল। বিশেষ একের পর এক গ্রাস তুলে দিতে লাগল বুড়ির মুখে।
বুড়ির ভাঙাচোরা জরাগ্রস্ত মুখের দিকে বিশেষ দেখতে লাগল। অজস্র
বলিরেখার ভাঁজেও সে খুঁজে পেল শান্তির আবেশ, তৃপ্তির আনন্দ, নির্ভার ভরসা। ছানিপড়া
ঘোলাটে চোখে কৃতজ্ঞতা। বিশেষের কণ্ঠে তখন দলাপাকানো এক কষ্টের অনুভূতি। তার আশৈশব
স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল জীবনে, এমন অনুভবের সম্মুখীন, সে কোনদিন হয়নি।
৯
এক তলার বসার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পিসিমা সিঁড়ি বেয়ে উঠে
গেল দোতলার ছাদে। যতদূর চোখ যায় চারদিকে অন্ধকার। খাপছাড়া দু একখানা বাড়ি, আর
অজস্র গাছপালার আবছা অবয়ব। কেউ কোত্থাও নেই যেন, এই বিশ্ব চরাচরে। মাথার ওপর ঘন
কালো আকাশ ভর্তি কোটি কোটি গ্রহ-তারা তাকিয়ে রয়েছে এই পৃথিবীর দিকে। সাক্ষী থাকছে
সংসারের প্রতিটি ঘটনার। পিসিমা শুনেছে নটি মাত্র গ্রহ নাকি মানুষের ভাগ্য
নিয়ন্ত্রণ করে। ওই আকাশের অজস্র আলোক বিন্দুর মধ্যে কোন নটি গ্রহ তার জীবনকেও
প্রভাবিত করে চলেছে অহরহ! পিসিমা এও শুনেছে জন্মাবার আগে বিধাতা পুরুষ নাকি
প্রতিটি জাতকের কপালে লিখে দেন তার ভাগ্যলিপি। সেই লিখন অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের
জীবন বইতে থাকে বিভিন্ন খাতে। মানুষের জীবনে সেই লিখনের বাইরে অন্য কিছু আর ঘটতে
পারে না।
তাই যদি হয়, পিসিমার কপালে এমন লিপি কেন লিখে দিলেন ঈশ্বর?
কেন তারই জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলছে শনি, রাহু, কেতু, মঙ্গল অথবা বৃহষ্পতি? এই
বিশাল বিশ্বের মধ্যে সে কতটুকু? এই সংসারে তার মতো মানুষের কতটুকুই
বা ঋণ আর কতটুকুই বা অবদান? তার জন্যে বরাদ্দ
সেই সামান্য প্রাপ্যটুকুই যদি সংসার তাকে দিত, মহাভারত
কতখানি অশুদ্ধ হয়ে উঠত? ঊণিশ বছরের এক তরুণীকে কনের সাজে সাজিয়ে
কেন তিনি তার মনে এঁকে তুলেছিলেন হাজার স্বপ্নের ছবি। তার শরীরের ভিতর কেন তিনি
দিয়েছিলেন, একটি স্বপ্ন দেখার মন? একটি নারী পূর্ণতা পায় তার স্বামী, পুত্র,
শ্বশুরের পরিবারে। মুখের কাছে এনে দিয়েও কেন তিনি কেড়ে নিলেন, এমন নিষ্ঠুর
ভাবে? ছাদের আলসেতে পিঠ দিয়ে পিসিমা বসে পড়ল ছাদের মেঝেয়, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে চেষ্টা
করল নিজের হাহাকার কান্না রুদ্ধ করতে।
এই বাপের বাড়িতে আজন্ম ঊণিশ বছর সে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার
জন্যে এ বাড়িতে কোন অমঙ্গল হয়েছে, এমন তো সে কোনদিন দেখেনি। কেউ বলেওনি তাকে। বাবার
মৃত্যু হয়েছে ছেষট্টি বছর বয়েসে তার যখন ন বছর বয়েস। সে মৃত্যুর জন্যে সে নিশ্চয়ই
দায়ি হতে পারে না। বাবার মৃত্যুর পর বড়ো দাদা তাকে বুকে করে বড়ো করে তুলেছে। সেও
বুকে করে বড়ো আদরে বড়ো করেছে দাদার একমাত্র ছেলে খোকাকে। কই, কোনদিন তো কারো
অকল্যাণ কিছু হয়নি।
বিয়ের তিনদিনের মাথায় বউভাতের পরদিন, তার সেই ক্ষণস্থায়ী স্বামী
গিয়েছিল গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে তাসের আসরে আড্ডা দিতে। সেখান থেকে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়েছিল। ফেরার সময় তাড়াতাড়ি
হবে বলে, সে আসছিল চৌধুরিদের পোড়ো জমির ভেতর দিয়ে। ওই পোড়ো জমি আর পরিত্যক্ত ভাঙা
বাড়ি নিয়ে অনেক কথাই গ্রামে শোনা যায়। সে পথ দিনের বেলাতেই লোকে এড়িয়ে চলে, অনেকটা
ঘুরে হলেও সাধারণ মানুষ সদর পথেই যাওয়া আসে করে। ওই পোড়ো পথে রাতের অন্ধকারে কে তাকে আসতে বলেছিল?
তার ভাগ্য? পথের মধ্যে কে বিছিয়ে রেখেছিল বিষধর সাপ, তার নিয়তি? সেই সাপের ঘাড়ে পা
দিয়ে কে তার স্বামীকে মরণ ছোবল খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, তার কপালের লিখন? এই সব,
এই সমস্ত ঘটনার জন্যে দায়ী সে?
সেই লোকটা, যে তার মাত্র তিনদিনের স্বামী, যার সঙ্গে তার
সম্যক পরিচয় ফুলশয্যার রাতের ঘন্টা তিনেক, তার ভাগ্যে কী লেখা ছিল? তার বিধিলিপিতে
এই অকাল মৃত্যুর কথা লেখা ছিল না? তার ভাগ্যের গ্রহচক্রে সুস্থ নীরোগ দীর্ঘ
পরমায়ুর নির্দেশ ছিল বুঝি? স্ত্রী পুত্র, নাতি
পুতি নিয়ে সুখের জীবন কাটানোর আদেশ ছিল তার ভাগ্যে? তার মানে শুধুমাত্র তার সঙ্গে
বিয়ের সংযোগেই আচমকা বদলে গেল তার স্বামীর নিয়তি? কিন্তু লোকে যে বলে নিয়তি বদলায়
না, বদলানো যায় না। একজন সালংকরা, সুসজ্জিতা, তরুণী ও কল্যাণীয়া নববধূ বদলে দিল
সেই মানুষটার জীবন? এনে দিল অপঘাত মৃত্যু? সে হয়ে গেল, রাক্ষসী, পিশাচ, ডাইনী। তিনদিনের
মধ্যে মাত্র তিন ঘন্টার সম্যক পরিচয়, তার জীবন থেকে মুছে দিল সমস্ত রঙ, সমস্ত শখ,
আহ্লাদ, স্বপ্ন, আশা। সেটা বুঝি মৃত্যু নয়? শুধু টিকে থাকাটাই জীবন? জীবন থেকে
বেঁচে থাকার সমস্ত আনন্দ হারিয়ে ফেলাটা নিষ্প্রাণতা নয়?
বাঁধন তৈরি হওয়ার আগেই তাকে ছেড়ে আসতে হল শ্বশুরঘর। ফিরে
এলো সেই বাপের বাড়িতেই। মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিল সুখের থেকে স্বস্তি ভালো। এই তো আমার বাড়ি, আমার
গ্রাম, আমার দাদা, আমার বৌদিমণি, আমার ভাইপো, এই সব নিয়েই তো তার সংসার। কিছুদিনের
জন্যে সেজেগুজে সে বেড়াতে গিয়েছিল বৈ তো নয়, আবার ফিরে এসেছে তার নিজের
স্থানটিতে।
কিন্তু না, তা হল না, খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে টের পেল তার
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। যে বাঁধনের জোর নিয়ে সে আশ্বস্ত ছিল, সে বাঁধনের
জোড় ছিঁড়ে গেছে। সে এখন অকল্যাণী, রাঁড় বিধবা। তার ছায়াতেও সংসারের অমঙ্গল নেমে
আসে। গ্রামের যে বান্ধবীদের বাড়িতে তার সময়ে অসময়ে ছিল অবাধ যাতায়াত, সেই
বান্ধবীদের সকলের একে একে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের দিন তাদের একজনের বাড়িতেও তার
প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সে বান্ধবীরা বিয়ের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাপের বাড়ি
এসেছিল পোয়াতি হয়ে। তাদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে, একজন বান্ধবীর মা আড়াল থেকে তাকে শুনিয়ে
শুনিয়ে বলেছিল, “এ বেদবা মাগী কেন মরতে আসে রে, আমাদের বাড়ি? নিজের ভাতারটাকে
খেয়ে, এবার আমাদের বাড়ি এয়েছে। কিচু একটা অকল্লেণ ঘটিয়ে তবে ছাড়বে। রাঁড় মাগি,
পুজোআচ্চা, সন্দে-আন্নিক নিয়ে থাকলেই পারে, তা না, লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুদিষ্টি
দেওয়া...”।
এ বাড়িতেও সেবার খোকার পৈতে হল। ব্রহ্মচারী হয়ে খোকাকে তিন
দিন তিন রাত্রি ঘরে থাকতে হল। সে সময় শূদ্রদের মুখ দেখার নিয়ম নেই। পিসিমাকেও মুখ
দেখানোর নিয়ম ছিল না, পিসিমা যে বিধবা! এ বাড়ির প্রতিটি পুজো অর্চনায়, মঙ্গল
অনুষ্ঠানে পিসিমাকে সর্বদাই আড়ালে থাকতে হয়। এই তো সেদিন কত ধুমধাম, আড়ম্বর করে
খোকার বিয়ে হল। কত আত্মীয়-স্বজন, কুটুম পাড়া-প্রতিবেশী, কত হৈ হুল্লোড়। সাজ-গোজ,
আমোদ আহ্লাদ। কত আয়োজন, রান্নাবান্নার ভিয়েন, যোগাড়-যন্ত্র। এ সব কিছু থেকেই তাকে
সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে। একবারের জন্যেও এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, কেউ
তাকে আবাহন করেনি। অসাবধানে গিয়ে পড়লে, কেউ না কেউ মনে করিয়ে দিয়েছে, “তুই এখানে,
কেন বাছা? এসবের মধ্যে তোকে আর থাকতে নেই, রে। তুই শোকেদুক্খে পোড়া মানুষ, যা
নিজের ঘরে গিয়ে ভগবানের পায়ে নিজেকে সঁপে দে, মা। পরজন্মে এমন
জেবন যেন আর না আসে, তারই তপিস্যি কর...”।
পিসিমা পাগলের মতো ছাদের আলসেতে নিজের মাথা ঠুকতে লাগল।
কান্না ভাঙা গলায় বলতে লাগল, “হে ভগবান, কি করেছি আমি? কেন, কেন আমাকে এই শাস্তি
পেতে হবে, সারা জীবন? কী দোষ আমার? যে জন্মের কথা একবিন্দু মনে নেই, সেই আগের
জন্মের কোন্ পাপের শাস্তি আমাকেই কেন বইতে হবে? হে করুণাময়, আমায় রক্ষা করো,
রক্ষা করো, হে পতিতপাবন, আমায় শান্তি দাও। আমায় মৃত্যু দাও, হে ঈশ্বর।”
মৃগাঙ্কর মা, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, অন্ধকারে ছাদের সিঁড়ির
মুখে। কিছু বলেননি, শুধু দেখছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কপালপোড়া মেয়েটা ছাদ থেকে
ঝাঁপ দিয়ে, কোন অঘটন না ঘটিয়ে বসে। বাড়িতে কুটুম এসেছে। তারপরে আছে পাড়া
প্রতিবেশী। সকলে তাঁকেই দুষবে, বলবে বৌদির বাক্যের জ্বালায় মেয়েটা ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ
জুড়োল।
অভাগী এই মেয়েটার জন্যে তাঁর দুঃখ হয়, মায়া হয়। বিয়ের সময় এ
বাড়িতে যখন তিনি বউ হয়ে আসেন, বয়সে তাঁর থেকে ছ বছরের ছোট এই মেয়ে তাঁর ছোট বোনের
মতো সর্বদা পায়ে পায়ে ঘুরত। সে সব দিনগুলির কথা ভাবলে আজও তাঁর চোখে জল ভরে আসে।
ভাল ঘর, ভাল বর দেখে, এই মেয়েকে নিজে হাতে সাজিয়ে, তিনিই পাঠিয়েছিলেন স্বামীর ঘর
করতে। পোড়াকপালীর সে সুখ সইল না, পাঁচদিনের মাথায় সব খুইয়ে ফিরে এল বাপের ঘরে। এ
মেয়েকে নিয়ে এখন তাঁর হয়েছে যতো জ্বালা। তাঁর ছোট্ট সুন্দর সাজানো এই সংসারে কবে
কখন কোথায় এই মেয়ের বিষ নিঃশ্বাস পড়ে কে জানে।
নিঃশব্দ অথচ দ্রুত পায়ে, মৃগাঙ্কর মা পিসিমার কাছে গিয়ে উবু
হয়ে বসলেন। তার মাথায় হাত রাখলেন। পিসিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তারপর মৃগাঙ্কর মায়ের
বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে হু হু করে ভেঙে পড়ল কান্নায়, “আমাকে একটু বিষ এনে দিতে
পারো, বৌদিমণি, একটু বিষ? কি হবে আমার বেঁচে থেকে, আমায় শান্তি দাও বৌদিমণি, আমায়
একটু শান্তি দাও”।
“তিন সন্ধ্যেবেলা এমন কাঁদতে নেই, ঠাকুরঝি। এমন কথাও বলতে
হয় না। ছিঃ। সংসারের অকল্যাণ হয়। ওঠো, শান্ত হও। অবুঝ হয়ো না। তোমার কষ্ট কি
আমাদের কষ্ট নয়? আমি কি বুঝি না ঠাকুরঝি, তোমার বুকের জ্বালা? নাকি, তোমার দাদা
বোঝেন না? কোনদিন কোনভাবে আমরা তোমাকে অছেদ্দা করেছি, ঠাকুরঝি? কি করবে বলো,
ভাগ্যের কাছে আমরা সবাই অসহায়। চলো, নিচেয় চলো, ঠাকুরঝি। আমরাও চাই, তুমি শান্তি পাও। ভগবানের আশীর্বাদ পাও। এই জীবনের সমস্ত দুঃখ
দুর্দশার হিসেব, এই জন্মেই শেষ করে, পরের জন্মে যাতে সুখী হতে পারো, ভগবান তোমাকে
সেই আশীর্বাদ নিশ্চই করবেন। আমি বলছি, ঠাকুরঝি, তিনিই অগতির গতি, করুণাসিন্ধু।
তিনিই দীনসহায়, মানুষের চিরদিনের বন্ধু। তিনিই সর্বক্ষণ থাকবেন তোমার পাশটিতে। এখন চলো, নিচেয় চলো”।
মৃগাঙ্কর মা পিসিমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে
এগোতে লাগলেন সিঁড়ির দিকে। এই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী রইল নির্জন অন্ধকার আর মাথার
উপর তারায় ভরা আকাশ।
১০
বুড়িকে আবার তার বিছানায় বসিয়ে রেখে, বিশেষ ঘরে এল। চটপট
জামা কাপড় ছেড়ে তোয়ালে নিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। পারিবারিক বা এ ধরনের সামাজিক সেবা-টেবার
কাজ তাকে কোনদিন করতে হয়নি, করার ইচ্ছেও হয়নি। এ কাজগুলো, এতদিন সে জেনেছে, সে
নয়, অন্য কেউ – কোন তৃতীয় ব্যক্তি করবে। সামাজিক সেবাকর্ম সর্বদাই রাষ্ট্রের করা
উচিৎ, অথবা কোন এনজিওর। তার বন্ধুবান্ধব – পরিচিতজন - সকলেই তাই মনে
করে। কেউ সেবা করছে বা করেছে জানলে, ফেসবুকে, হোয়াটস্আপে, এক্স-হ্যাণ্ডেলে শেয়ার করেছে, লাইক করেছে। কমেন্ট করেছে “soooo gr8!”, “Congts,” “well dn”, “keep it up”। তার সোসাল
মিডিয়ায় নানা ধরনের “Social Cause” ঢুকে পড়ে।
পলক ফেলতেই সেই সকল “Cause” শেয়ার করে দেয় তার পরিচিতদের নানান গ্রুপে। কত যে পিটিশন সে
অ্যাক্সেপ্ট করেছে। গুয়াতেমালায় বিড়ালের হাঁপানি বাড়ছে, “সেভ ক্যাট”। মালাউইর
জঙ্গলে ভোঁদড়রা খাবার মতো যথেষ্ট মাছ পাচ্ছে না, অতএব “সেভ ওটার”। একটা ক্লিক
করলেই সাপোর্ট ফর Cause। কোন
অনুভূতি, দায় কিংবা মাথাব্যথা নেই। এসি ঘরের আরামে বসে, বিশ্ব জুড়ে কত লোক যে
ক্লিক-ক্লিক করে লড়ে যাচ্ছে, অচেনা দেশের, অচেনা মানুষ ও প্রাণীদের জন্যে। অস্পষ্ট
কারণের জন্যে, ভাবা যায় না!
বিশেষও তাদের দলেই ছিল। আজকের এই ঘটনাটা তার চোখের সামনে
থেকে সেই পর্দাটা সরিয়ে নিয়েছে। দারিদ্র্য, খিদে আর বঞ্চনা কোন পর্যায়ে যেতে পারে,
এই বুড়িকে না দেখলে তার বিশ্বাস হত না। তার চেয়েও সে আশ্চর্য হল, একটা ক্লিক করে
সে যা মজা পেত, তার চেয়ে আজ অনেক বেশী আনন্দ সে অনুভব করল। দুর্গন্ধময় ঘর, নোংরা
অসুস্থ বুড়ি, তাকে কোলে নেওয়া, খাওয়ানো। এরকম পরিস্থিতি তার সামনে কোনদিনই আসে নি।
এই অভিজ্ঞতা তাকে খুব তৃপ্তি দিল। বাস্তবিক আজ, ফর আ গুড কজ, সে কিছু একটা করতে
পেরেছে!
ফ্রেস হয়ে বিশেষ হীরালালজির ঘরে যখন গেল, হীরালালজি টিভিতে
সিরিয়াল দেখছিলেন।
বিশেষকে দেখে বললেন, “আ বেটা, আ। তোর জন্যেই ইন্তেজার
করছিলাম। ইধ্যার ব্যায়ঠোগে, ইয়া ছাদ মে? সিরিয়াল মে দিলচস্পি হ্যায় কেয়া?”
“সিরিয়ালমে কোই দিলচস্পি হ্যায় নেহি”। বিশেষ হেসে উত্তর দিল।
“তব ছাদ মে, চল। রামু ছাদ মে দো কুর্সিয়া লাগা দে”।
হীরালালজি আর বিশেষ ছাদে গিয়ে বসল সামনাসামনি দুটি চেয়ারে।
চোখে পড়ল বৃন্দাবন শহরের আলোয় ভরা অজস্র মন্দিরের চূড়া। আর অজস্র তারার চুমকি
দেওয়া, শামিয়ানার মতো মাথার ওপর বিছানো, বিশাল কালো আকাশ। চেয়ারে বসার পর
হীরালালজি বললেন, “আজ তু একদম কামাল কর দিয়া, শুনা। এক বুড়ি কা বহোত সেবা কিয়া,
খানা খিলায়া। বহোত আচ্ছা, বেটা। মেরা তো শুনতেহি দিল ভর গয়া”।
একটু লজ্জা পেয়ে বিশেষ বলল, “অ্যায়সা কুছ নেহি, আংকল, বুড়ি
রো রহি থি। বাস, কুছ মদত করনে কি কোশিশ কিয়া”।
“এ লোক বহোত দুখী হ্যায়, বেটা। এক দো দিনমে, ইসকি ক্যায়সে কেয়া শুধার
পাওগে? এদের দুঃখ কষ্টের সীমা নেই”।
“আংকল, এরা কোথা থেকে এসেছে? সবাই দেখলাম বাঙালী। কতদিন
থাকবে, এদের বাড়ির লোক এই অবস্থায় এদের ছাড়ল কি করে, সেটাই
ভাবছি”।
“বাড়ির লোক তো এদের কবেই ছেড়ে দিয়েছে। তুই জানিস না, জানার
কথাও না। বৃন্দাবনে এমন বিধবা কয়েক হাজার আছে, কেউ বলে আট হাজার, কেউ বলে দশ
হাজার। এদের সবাইকেই তাদের সমাজ-সংসার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ছেড়ে গিয়েছে
ভগবানের আশ্রয়ে। এরা এখানেই আছে, এখানেই থাকবে, এখানেই মরবে। মুক্তি পাবে
গোবিন্দের চরণে। এরকমই তো বিশ্বাস এদের”।
“এদের অধিকাংশই দেখলাম বাঙালি। এদের সংসার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে
, বলছেন। কিন্তু কেন”?
“ছোড় দে, বেটা। ওসব জেনে কি করবি? দু দিনের জন্যে এসেছিস,
বৃন্দাবন দেখে নে। বৃন্দাবনের অনেক রূপ। আজ কী কী দেখলি বল। কোথায় কোথায় গেলি, কেমন লাগল, সেই কথা বল”।
হীরালালজি এই বুড়িগুলোর কথা এড়িয়ে যেতে চাইছেন, বিশেষ সেটা
বুঝতে পারল। কিন্তু তার মনে কৌতূহল না মেটা পর্যন্ত সে ছেড়ে দেবে না। এই বুড়িগুলোর
হদিস তাকে জানতেই হবে।
সে বলল, “কেশীঘাট, যমুনা, সেবা কুঞ্জ, তারপরে অনেক মন্দির
দেখলাম। যমুনা দেখে খুব বোর হয়েছি। বাট সেবাকুঞ্জ ইজ টু ইন্টারেস্টিং”।
“ঠিক বলেছিস। যমুনার যে বর্ণনা আমরা নানান বৈষ্ণব সাহিত্যে
পাই, তার ধারেকাছে নেই। সেকালে নিশ্চয়ই ছিল, এখন আর নেই। নদীর জল কমে গেছে, এদিকে
মথুরা, দিল্লীর অজস্র কল কারাখানার ওয়েস্ট। যমুনা শেষ হয়ে গেছে। সেই যমুনা ভক্তদের
কল্পনা ছাড়া আর কোথাও থাকবে না। তুই কি কালই চলে যাবি?
“হ্যাঁ। বিকেলের দিকে। তার আগে সকালে একবার বসবো ওই বুড়ির
সঙ্গে, আমাকে জানতে হবে, নিজেদের সংসার ছেড়ে কেন ওরা এখানে!”
“বেটা, তু সমঝনে কো কোশিশ কর। ওরা নিজের মতো
আছে, থাকতে দে না। তু দো দিনকা মেহমান, কী করবি সব জেনে সব বুঝে?”
“আংকলজি, বুরা মত মানিয়ে। একবার যখন এদের সন্ধান পেয়েই
গেছি, আমি জানবোই। আপনি না বললে, অন্য কেউ বলবে”। হীরালালজি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে
রইলেন বিশেষের দিকে।
তাঁর চোখে প্রশ্রয়ের হাসি, বললেন, “তুই একদম বাপের মতো
হয়েছিস, বেটা। ঠিক হ্যায়। তোর যখন এতই কৌতূহল, আমি বলছি। লেকিন, তোর খারাপ লাগলে,
আমার খুব খারাপ লাগবে। দু দিনের জন্যে আমার কাছে এসেছিস, তোর বাবা তোকে পাঠিয়েছে
আমার কাছে। তোকে এসব কথা বলেছি জানলে, তোর বাবা আমার উপর গুস্সা করবে”।
বিশেষ কিছু বলল না, আগ্রহ নিয়ে হীরালালজির মুখের দিকে
তাকিয়ে রইল। হীরালালজি আবার বিশেষের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তারপর বললেন, “এ বুড়িরা
কোথা থেকে এসেছে, কবে এসেছে আমি জানি না। কেউই বোধহয় জানে না। এমনকি ওরা নিজেরাও
হয়তো মনে করতে চাইবে না। ওদের জীবন থেকে বছর, মাস, সপ্তাহ বহুদিন অর্থহীন হয়ে
গেছে। ওদের হিসেব এখন প্রত্যেকটি দিনের। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ওদের চিন্তা, যে
ছাদের নীচে ওরা আশ্রয় পেয়েছে, সেটা আজ সারাদিন থাকবে তো? যে মন্দিরে ওরা নাম
কীর্তন করতে যায়, সেখানে আজও কীর্তন করতে দেবে তো? কীর্তন শেষে দু হাতা খিচুড়ি
মিলবে কি? গতকালের চিন্তা ওরা করে না, কারণ প্রয়োজন নেই। আগামীকালটা ৬ধোঁয়াটে,
চিন্তা করে লাভ নেই”।
“এরা খিচুড়ির বিনিময়ে নাম কীর্তন করে? ব্যাপারটা কি রকম”?
“বেটা, এ আমাদের সনাতন
ধর্মের এক আশ্চর্য জটিল
প্রক্রিয়া। ধর কোন এক বড়ো বেওসাদার বেওসায় প্রচুর লাভ করেছে। লাভের ছোট একটা অংশ
দিয়ে সে ভগবানের মন্দির বানাল। ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানালে, বেওসাতে আরো তরক্কি হবে, এই আশায়।
লেকিন নয়া মন্দির, ছোটা মন্দির, দর্শনার্থী কম। আরতির সময় নাম কীর্তন করবে কে?
পেশাদার কীর্তনিয়া রাখার অনেক খরচ। তখন তারা এই বিধবাদের জড়ো করে। পঁচিশ তিরিশ জন
বিধবা, রোজ চার হাতা খিচুড়ির লোভে, নাম কীর্তন করে। সেই কীর্তনের টানে আরতির সময়
বেশ ভিড়ও জমে ওঠে। তাতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ে, প্রণামী বাড়ে দানপেটিতে। কম খরচে
পুণ্য অর্জন। কিছু অর্থ উপার্জন, যা দিয়ে মন্দিরের মেন্টিন্যান্সও চলে যেতে পারে। আর কী ভাবে সম্ভব”?
“বাঃ, বেশ অদ্ভূত পরিপূরক ব্যবস্থা”।
“পরিপূরক কেন বলছিস, বেটা”?
“পার্ফেক্ট ডিম্যান্ড এণ্ড সাপ্লাই সিস্টেম, ইউ গিভ মি
পুণ্য, আই’ল গিভ ইউ খিচুড়ি”।
“একদম। কোই হেডেক ভি নেহি হ্যায়। তুমি কোথায় থাকবে, কিভাবে
থাকবে, আমার দেখার দরকার নেই। তুমি না করলে, আরো অনেকে আছে। অন্য কেউ আসবে, কোই
ফিকর নেহি। এরা এই শহরের নানান বস্তিতে থাকে, এক একটা ঝুপড়িতে পঁচিশ-তিরিশ জন। বছর
চারেক আগে, এরকম একটা বস্তি ভেঙে হোটেল উঠল, বেঘর হয়ে গেল বেশ কিছু বিধবা।
আজকাল শহরে অনেক হোটেল হয়েছে, ধরমশালায় লোকে থাকতেও চায় না।
আমার এই ধর্মশালায়, বেশ কিছু ঘর খালিই পড়ে থাকে সারা বছর। সোচা, ইসি মওকে মে, আমারও কিছু পুণ্য অর্জন হোক। তাই ওদের থাকার জন্যে, দুটো ঘর একটা বাথরুম আমি ছেড়ে দিয়েছি। সেই থেকেই জনা তিরিশেক
বিধবা আমার এই ধর্মশালায় আছে। রোজ সকালে ওরা বেড়িয়ে যায়, পথে পথে ভিক্ষা করে।
আরতির সময় হলে, মন্দিরে পৌঁছে যায়, কীর্তন করে, খিচুড়ি খেয়ে দুপুরে ফিরে আসে।
বিকেলে আবার বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যার আরতি সেরে, খিচুড়ি খেয়ে রাত করে ফেরে। এই ওদের
দৈনন্দিন রুটিন”।
“এই অসম্ভব অপমানজনক উঞ্ছবৃত্তি ওরা নিয়েছে কেন, আংকল,
পুণ্যের আশায়”?
“বেটা, অ্যায়সা কভি হো সকতা হ্যায় ভলা? কোই ভি অওরত আপনি সংসার,
আপনি সমাজ ছোড়না চাহতি হ্যায়, ইয়ে ম্যায় তো কভি ভি মাননেওয়ালা নেহি হুঁ”।
“তাহলে? কিসের জন্যে এরা এসেছে”?
“এরা কেউ নিজের ইচ্ছায় আসে নি, বেটা। ওদের সংসারই ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এরা সংসার ছেড়ে
আসতে বাধ্য হয়েছে। খবর নিলে দেখবি, এরা সকলেই অল্প বয়সের বিধবা, অধিকাংশই
নিঃসন্তান। তোদের বিদ্যাসাগরজী বিধবাদের আবার বিয়ের জন্যে যতই কোশিশ করে যান না
কেন, আমাদের হিন্দু সমাজে, এই সেদিনও বিধবাদের দুসরা বিহা কোই সোচ ভি নেহি শকতে থে। আজকাল থোরা বহোত চালু হুয়া হোগা। ও ভি শহর মে। সংসারে
ভাইয়ের বিধবা বউ, কিংবা বাপের ঘরে ফিরে আসা বিধবা মেয়ে বা বোন, কতটা বিপজ্জনক, তুই
কি বুঝবি, বেটা? সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা দিতে হবে। পড়োশিরা সর্বদা তোর পিছনে কানাকানি
করবে, তোর নিন্দে করবে। বলবে, বিধবা বউটাকে কিংবা বিধবা বোনটাকে ঝিয়ের মতো খাটায়। দুবেলা
ঠিকমতো খেতে দেয় না।
আর একটা কথা কী জানিস বেটা? প্রকৃতি বিধবা – বিপত্নীক বোঝে
না। সে তার যৌবনের নিয়ম মেনে এক যুবকের শরীরেও যেমন আগুন জ্বালায় তেমনি এক যুবতীর
অঙ্গেও উত্তাপ সঞ্চার করে। আমাদের সামাজিক সংস্কার দিয়ে প্রকৃতির সেই নিয়মকে আমরা রোধ
করব, এমন সাধ্য কোথায়? পুরুষরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর অচিরেই আবার বিয়ে করে ফেলে। সমাজ
অনুমোদন দেয়। এমনকি পত্নী বর্তমান থাকতেও কত পুরুষ নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় বিবিধ রমণীর
রসাস্বাদন করতে। তখন সমাজ চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না - নিশ্চিন্তে
নিদ্রা যায়।
কিন্তু যুবতী বিধবাদের ক্ষেত্রে সমাজ নিদ্রাহীন, সদা জাগ্রত
- সঙ্কীর্ণ, অনুদার, নিষ্ঠুর। সতীদাহপ্রথাকে আমাদের সমাজ এককালে গৌরবের আসন
দিয়েছিল। সেই প্রথাকে বন্ধ করতে গিয়ে তোদের রাজা রামমোহনকে কম যন্ত্রণা দিয়েছিল, অন্ধ
হিন্দু সমাজ? সেই প্রথা যখন বন্ধ হল,
আমরাই বিধবাদের বোঝালাম – বৈধব্যও একরমের তপস্যা। সমস্ত ধরনের কামনা বাসনা রুদ্ধ
করে, এই জীবনটা যদি নানান ব্রত-উপবাসে আর কঠোর সংযমে পার করে দেওয়া যায় – পরজন্মে
মিলবেই স্বামী-সন্তানসহ সর্ব-সুখের এক জীবন।
কিন্তু এত কিছু বাধা-নিষেধের পরেও, প্রকৃতির নিয়মে বিধবা
মেয়েটি যদি সংযম হারায়? যদি তার পা পিছলে যায়? যদি অসামাজিক কোন সম্পর্কে লিপ্ত
হয়ে ওঠে? তাহলে কোথায় থাকবে সে পরিবারের সামাজিক সম্মান আর বোলবোলাও!”
কথা বলতে বলতে হীরালাললজি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন,
একটু বিরতির পর দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আবার বললেন, “আমাদের ছোটবেলায় এমন অনেক দেখেছি, জানিস
বেটা? পত্নী মারা গেছে, সেই শোকে স্বামী ঘর ছেড়ে দিল। এক সাল, দু সাল, তার কোন খবর
নেই। কোথায় গেছে, কী করছে কেউ জানে না। আবার হঠাৎ একদিন সে গ্রামে ফিরে এল। তার
স্বজন, পড়শিরা একদম হামলে পড়ল তার ওপর - “বাউরা বনকে কাঁহা চলে গয়ে থে”? দু-চারদিন
পরেই স্বজনরা তাকে চেপে ধরে, বলে – “বিতে হুয়ে বাতে সব ভুল যা, ইয়ার, ফির শাদি কর –
ফিরসে ঘর বসা লে”। তা সে স্বামী লোকটির জন্যে জলদি মেয়েও জোগাড় হয়ে যায়, বিয়েও হয়ে
যায়। পুরুষমানুষ কখনও কুলটা হয় না, বেশ্যা হয় না। তার জন্যে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের
সিমপ্যাথির এতটুকুও কমি কোথাও দেখতে পাবি না।
“কিন্তু ঘটনাটা যদি উলটো হয়? স্বামীর মৃত্যুতে শোকেদুঃখে মেয়েটা
যদি ঘর ছেড়ে দেয়? বছর দুয়েক পর যদি সে গ্রামে ফিরে আসে? তার বাবা-মা-ভাই-বোন তাকে
ঘরেই ঢুকতে দেবে না। পড়শিরা তাকে গাল দিয়ে ঝ্যাঁটা মেরে পাড়ার বাইরে বের করে দেবে।
সবাই – হ্যাঁ সব্বাই নিশ্চিত হয়ে যাবে, সে মেয়েটা কুলটা বন গয়ি”।
“এ সবের থেকে ভালো
কাশিতে কিংবা বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দাও। চোখের আড়ালে থাক। ভগবানের নাম নিক। মাসে মাসে
পঞ্চাশ-একশ টাকা মাসোহারা পাঠিয়ে দিলেই, দায়িত্ব খালাস। বাঁচলে বাঁচল, বিপথে গেলে
গেল, মরলে মরল। মরলে বলা যাবে ভগবান উঠা লিয়া, মুক্তি মিল গয়ি। তোদের বাংলায় একটা
কথা আছে না? “বেড়াল পার করা?” এই বিধবারাও সেই অবাঞ্ছিত বিল্লি, বেটা”।
হীরালালজি থামলেন। বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।
তারপর বললেন, “বেটা, একদম চুপ হয়ে গেলি? বলেছিলাম না, সব সচ শুনতে নেই। জীবনের এবং
সমাজের এমন অনেক কিছু অজানা থাকাই ভালো। মন খারাপ হয়ে গেল তো? ভুল যা এ সব বাতেঁ। তোরা আজকাল “মেমরি”
থেকে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই “ডিলিট” করে দিস না? এটাকেও সেরকম ডিলিট করে দে।
শান্তি না পাস, স্বস্তি পাবি। চল এখন নিচেয় যাই, অনেক রাত হল, খেয়ে নিই”।
হীরালালজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিশেষের পিঠে হাত রাখলেন,
বিশেষ মুখ তুলে তাকাল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, বলল “চলিয়ে”।
১১
হাতের সব কাজ সেরে মৃগাঙ্কর মা, তাঁর শোবার ঘরে ঢুকে দরজায়
খিল দিতে দিতে বললেন, “কি গো, তুমি এখনো ঘুমোও নি”?
“না। তোমার এতো দেরি হল”?
“তোমার সংসারের কাজ কিছু কম নাকি? তারপরে তোমার বেয়াইমশাই
কাল ভোরে বেরোবেন। সেই সব যোগাড় যন্ত্র করতেই দেরি হল”।
মৃগাঙ্কর বাবার মুখে মুচকি হাসি, তিনি বললেন, “অ। সবই আমার।
আমার সংসার। আমার বেয়াইমশাই। তোমার কিছুই নয়, তাই না মিনু”?
মৃগাঙ্কর মায়ের নাম মৃণালিনী। তাঁর স্বামী শশাঙ্ক আদর করে
ডাকেন মিনু। মৃণালিনী ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বললেন, “তুমি তো এই সংসারের কত্তা।
আমি তোমার শ্রীচরণের দাসী। তোমার সংসারে আমি এসেছি তোমার আর তোমার সংসারের সেবা
করার নিমিত্তে”।
পাশ ফিরে বিছানায় কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে উঠলেন শশাঙ্ক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে আফগান স্নো লাগাতে থাকা স্ত্রীকে বললেন, “আজ তোমার খুব ফুরফুরে মেজাজ
দেখছি, কি ব্যাপারটা কী”?
“ছেলেটা বেশ কিছুদিন ধরে মনমরা ছিল। বৌমাকে পেয়ে, আজ কেমন
খুশি হয়েছে, দেখলে না”?
“কই আমি তো তেমন কিছু লক্ষ্য করলাম না। সন্ধেবেলা খোকা এসে
পাশে বসল, আমি তেমন কিছু বুঝলাম না তো”?
“ব্যাটাছেলেরা ওরকমই
হয়। তোমাদের ওসব চোখে পড়বে না। আমাদের চোখে সব ধরা পড়ে”।
কথা বলতে বলতে মৃণালিনী বিছানায় এসে বসলেন, শশাঙ্কর পাশে।
থুতনি ধরে মৃণালিনীর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে শশাঙ্ক বললেন, “সেই জন্যেই তো
তোমাকে চোখে হারাই, গো মিনু”।
স্বামীর সোহাগে উচ্ছ্বসিত হলেও, মৃণালিনী ঝটকা দিয়ে মুখ
সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আহা, ঢঙ। আজ বাদে কাল নাতি নাতনীর মুখ দেখতে হবে, এখনো তোমার
এত”?
হা হা করে হাসলেন শশাঙ্ক, বললেন, “দিন দিন তুমিই বা এমন
সুন্দরী, হচ্ছো কেন, মিনু? ইচ্ছে হচ্ছে, তোমাকে আরেকবার বিয়ে করে নতুন করে সংসার
পাতি”।
“বাবা রে, শখ দেখে আর বাঁচি না। আবার নতুন সংসার, রক্ষে
করো, গো। যা পেয়েছি ভগবানের কৃপায় ঢের পেয়েছি। শুধু একটাই মনস্তাপ সর্বদা বেঁধে”।
মৃণালিনীর এই কথায় শশাঙ্ক চিন্তিত হলেন, শংকিত মুখে জিজ্ঞাসা
করলেন, “কি ব্যাপার বলতো? কিসের মনস্তাপ তোমার, মিনু”?
“ঠাকুরঝিকে নিয়ে কী করা যায়, বলো তো”?
“কেন, সে আবার কী করল? তোমাকে কিছু কুকথা বলেছে বুঝি? কালই সকালে আমি খুব
বকে দেব তাকে”?
“বোঝো। কুকথা কেন বলতে যাবে? ঠাকুরঝি আমাদের সেরকম মেয়েই নয়”।
“তা হলে”?
“আজ বসার ঘরে যে কাণ্ডটা করলে, তারপর সে যে ছাদে গিয়েছিল,
সে খবর রাখো”?
“না তো। কি করতে গিয়েছিল, ছাদে”?
“মরতে। দৌড়ে উঠে গেল, তিন সন্ধেবেলায়। তখনই আমার সন্দেহ
হয়েছিল। পিছু পিছু আমিও গেলাম নিঃশব্দে। দেখি মেয়ে এক কোণায় বসে খুব কাঁদছে।
ভাবলাম একলা নির্জনে বসে কাঁদছে, কাঁদুক বুকটা হালকা হবে। কপালপোড়া মেয়েছেলের
কান্না ছাড়া আর আছেটা কী? একটুপরে দেখি ঢক ঢক করে মাথা কুটছে দেয়ালে। ছটফট করছে
জ্বালা যন্ত্রণায়”।
মৃণালিনী বিছানায় শুলেন। শশাঙ্ক পাশে শুয়ে স্ত্রীর মুখের
কাছে মুখ নিয়ে বললেন, “ওর তো কোন অভাব রাখিনি, মিনু। তাহলে ওর কিসের যন্ত্রণা”?
“তোমরা ব্যাটাছেলেরা কোনদিন বুঝবে না, মেয়েরা কি চায়। তুমি ওর
ভাত-কাপড় ছাড়া আর কোন অভাবটা মেটাতে পারবে? ওর নিজের একটা সংসার, সন্তান, স্বামীর
সোহাগ, এসব অভাব মেটাতে পারবে? শুধু জামাকাপড়, আর দুবেলা দুটো ভাত হলেই মেয়েদের
চলে না গো, মেয়েদের আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন”।
“তা ঠিক”। শশাঙ্ক মৃণালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলেন,
মিনু তার অভাগী ননদের জন্যেও এত চিন্তা করে?
“আজ খোকা আর বৌমার সংসার দেখে তার কি মনে আসে না, যে তারও
এমন একটা আদরের সংসার হতে পারত? আজ বাদে কাল বৌমার কোল আলো করে আসবে আমাদের খোকার
সন্তান। ঠাকুরঝি তাদের নিয়েও খুব আনন্দ করবে, কিন্তু সারাদিনে অন্ততঃ একবার তো তার
মনে হবেই, তারও এমন সন্তান হতে পারতো! নিয়তি তার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়েছে”?
“হুঁ, বুঝতে পারছি”। গভীর চোখে শশাংক তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর
মুখের দিকে।
“এই জ্বালায় যদি কোনদিন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে? যদি গলায় দড়ি
দেয়। যদি ছাদ থেকে নিচেয় ঝাঁপ দেয়? কিংবা কোন হাঘরে মিনসের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে
বংশের মুখ পোড়ায়? আমাদের মুখটা কোথায় থাকবে, বলো তো”?
“তুমি কিন্তু বড্ডো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছ, মিনু”। মৃণালিনী
স্বামীর কথায় হেসে ফেললেন। তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে থাকা দেবতুল্য এই
মানুষটিকে তিনি বড়ো ভালোবাসেন।
হাত বাড়িয়ে তিনি স্বামীর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে
বললেন, “তুমি কেন ভয় পাবে গো? ভয় পাক আমার শত্তুরে। তোমার এই দাসী রয়েছে কি করতে”?
স্ত্রীর এই হাসিতে, হাতের স্পর্শে এবং তার এই কথায় বড়ো
নিশ্চিন্ত হলেন শশাংক। তিনি জানেন তাঁর মিনু নিশ্চই কোন উপায় ঠাউরেছে। ভাগ্যহীনা
বিধবা বোনের জন্যে তাঁর ব্যথা কিছু কম নয়, কিন্তু সে ব্যথার অনেকটাই ভাগ করে
নিয়েছে তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীর প্রতি অদ্ভূত ভালোবাসা তাঁর মনে সঞ্চার হতে থাকল।
তিনি হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর কপাল থেকে সরিয়ে দিলেন আলগা চুলের গুছি। তারপর একহাতের
তালুতে স্ত্রীর গালটি ধরে মুখটি ফিরিয়ে নিলেন নিজের দিকে, তারপর স্ত্রীর অধরে
ডুবিয়ে দিলেন নিজের ঠোঁট।
কতক্ষণ পরে শশাংক মুখ তুললেন, স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে টের
পেলেন, তার সমর্পণের বাসনা। ধীরে ধীরে তিনি উন্মোচন করতে লাগলেন অত্যন্ত ভালোবাসার
স্ত্রীকে। মৃণালিনী নিজেকে সমর্পণ করতে করতেও অস্ফুট স্বরে বললেন, “ঠাকুরঝি, আজকাল প্রায়ই কাশী
যাবার কথা বলছে। বাবা বিশ্বনাথের সেবায় সারাজীবনটা কাটিয়ে দেবে। সেখানে তার পুজো
আচ্চার সাধনা, সংসারের মায়ামোহতে বার বার ছিঁড়ে যাবে না। পাঠিয়ে দাও না।”
স্ত্রীকে উন্মুক্ত করে শশাংক নিজেকেও উন্মুক্ত করতে করতে
বললেন, “তাই হোক, পাঠিয়েই দাও। তাতেই যদি ও মনে শান্তি পায়, পাক না। মানি অর্ডারে
মাসে মাসে একশটা টাকা পাঠিয়ে দেব, হাত খরচের জন্যে”।
“এখনই বলো না কিছু। খোকা কলকাতা যাক, তারপর বলো”।
“খোকা তো কাল সকালেই
বেরিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে না”?
মৃণালিনী তাঁর উন্মুখ শরীরে স্বামীকে দুই বাহু বন্ধনে টেনে
নিয়ে, মায়াবী দৃষ্টি হানলেন স্বামীকে, বললেন, “যাবে কি? আমার কিন্তু মনে হয় না”।
“কেন, কেন? যাবে না কেন? হপ্তার শুরুতেই অফিস
কামাই করাটা কোন কাজের কথা নয়”।
“এতদিন পরে, বৌমা ফিরেছে, তাও কাল ছেলেকে আপিস পাঠাবে?” চোখ ও ঠোঁটের নিপুণ
ভঙ্গীতে মৃণালিনী কিছু ইঙ্গিত করলেন। শশাংক এতক্ষণে ইশারাটা বুঝতে পারলেন,
উন্মুক্ত স্ত্রীকে আদর করতে করতে, হাসি মুখে বললেন, “যেমন বাপ, তেমন ছেলে বলছ?
অবাক হয়ে যাই, মিনু, তোমার সব দিকেই নজর”?
স্বামীর আদরে জেগে ওঠা মৃণালিনী, নিজের নগ্ন বুকে চেপে
ধরলেন স্বামীকে, কানে কানে বললেন, “এও জানি, ঠাকুরঝি কান পেতেছে ওদের বন্ধ জানালায়”।
স্ত্রীর শরীরে পূর্ণ অবগাহনের আগে, শশাংক বললেন, “মেয়েটা কিছুই পেল না, এই জীবনে।
বড়ো দুখী মেয়েটা”।
১২
আজ সকালে বিশেষের ঘুম ভাঙল একটু দেরিতেই। প্রায় সাড়ে সাতটা
নাগাদ। কাল রাত্রে খাওয়ার পরও কথা বলতে বলতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া
সকালের বাস জার্নি, বিকেলে অনেকটা হাঁটাহাঁটিতে খুব ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল। ঘরে ফিরে
বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে ডুব দিয়েছিল। আজ
ঘুম ভেঙে খুব ফ্রেশ লাগছে। চটপট রেডি হয়ে হীরালালজির ঘরে গিয়ে শুনল, হীরালালজি বেরিয়ে
গিয়েছেন, ফিরতে ফিরতে বেলা সাড়েএগারোটা, বারোটা হবে।
বিশেষ নিচেয় নেমে এল। প্যাসেজ পেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখল
কেউ নেই। বুড়িরা সব বেরিয়ে গিয়েছে ভিক্ষায়, খিচুড়ি খেয়ে দুপুরে ফিরবে। কালকে যে
বুড়িটাকে সে খাইয়েছিল, সেও কি যেতে পেরেছে? বিশেষ ঘরের বন্ধ দরজা ঠেলে দেখল, বুড়ি
বসে আছে, তার বিছানায়। বাকি সব বিছানা পাট করে সাজিয়ে রাখা দেওয়াল ঘেঁসে। বিশেষ
গুনে দেখল, মোট ষোলোটা বিছানা, বুড়িরটা নিয়ে। বুড়ির বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “বুড়ি,
আজ কেমন আছো? আজকেও বেরোও নি”?
বুড়ি চিনতে পেরে একগাল হাসল ফোগলা মুখে, বলল, “চলতে পাআআআরি
না। বসেই আছি। ওরা যদি কেউ খিচুড়ি আনে” বিশেষ জিজ্ঞাসা করল, “না আনলে”? বুড়ি কোন
উত্তর দিল না। হয়তো উত্তর দেবার কিছু নেই।
বিশেষ বলল, “বাইরে বসবে? নিয়ে যাবো”? বিশেষ নিচু হয়ে জিজ্ঞাসা করল। বুড়ি ঘাড় নেড়ে
জানাল, হ্যাঁ।
বিশেষ কালকের মতোই তুলে আনল বুড়িকে, বারান্দায় এনে দেয়ালে
হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। কালকে বুড়ির যা অবস্থা ছিল, আজ ততটা খারাপ নয়। কালকে
রাত্রের ভরপেট খাদ্যে, বুড়ি অনেকটাই জোর পেয়েছে। হয়তো কিছুদিন আরো টিকে যাবে বুড়ি।
বুড়ি কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে বিশেষের দিকে। সকালের আলোয়
বুড়ি আজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিশেষকে। বিশেষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু
খাবে? খিদে পেয়েছে”?
বুড়ি ঘাড় নাড়ল, না, বলল, “খিদেএএএএ নেই। কাল কতদিন
পরে ভাত খেলাম”।
বিশেষ বুড়ির সামনে হঠাৎ উবু হয়ে বসল, বুড়ির হাঁটুতে এক হাত
রেখে জিজ্ঞাসা করল, “বুড়ি, তোমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয়”? বুড়ি খুব জোরে মাথা নাড়ল,
না।
“কেন? ইচ্ছে হয় না, ছেলেরা, নাতিরা কেমন আছে, দেখতে”?
বুড়ি আবারও ঘাড় নাড়ল, দুই হাত উলটে বলল, “আমার আবার ছেলেপুলে ছিল কোথায়?”।
“তাও। ধরো তোমার বাড়ি, তোমার গ্রাম, শহর, দেখতে ইচ্ছে হয়
না? কোথায় ছিল তোমার বাড়ি”?
“ওরা আমাকে তাড়িয়ে দিল। আমার বাড়ি নেই, আমার গ্রাম নেই”।
“কারা”?
বুড়ি উত্তর না দিয়ে ছানি পড়া ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইল উঠোনের
ওপাশে পেয়ারা গাছটার দিকে।
অনেকক্ষণ পর অস্পষ্ট
জড়ানো গলায় ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের বাড়িতে ওর চেয়েও বড়ো
একটা পেয়ারা গাছ ছিল। এখনো আছে কিনা কে জানে। খুব পেয়ারা হতো। ছোটবেলায় খুব
দৌরাত্ম্যি করতাম গাছটার ওপর। কষটা, ডাঁশা, পাকা কোন পেয়ারাই ছাড়তাম না। আর ছিল
একটা আম গাছ। খুব আম হতো, কিন্তু টোকো। পেকে হলদে হয়ে গেলেও তার গা থেকে টক ছাড়ত
না। আমও খেতাম। রান্নাঘর থেকে নুন আর লংকারগুঁড়ো যোগাড় করে মাখিয়ে খেতাম”।
বুড়ির ফোগলা মুখে জিভের নাড়াচাড়ায় বিশেষের মনে হল, সে স্বাদ
আজও যেন তার জিভের কোথাও লেগে আছে। বিশেষ জিজ্ঞাসা করল, “তারপর”?
“তারপর আর কি? আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের কদিন আগে খুব
কেঁদেছিলাম। আমার ওই গাছ দুটোকে ছেড়ে অন্যের বাড়ি চলে যেতে হবে বলে। মেয়েদের তো
পরের বাড়িতে যেতেই হয়। সব মেয়েই যায়। আমিও গেলাম। সানাই বাদ্যি। ভিয়েন বসল বাড়ির
পিছনে। কদিন বাড়ি ভরে উঠল আত্মীয় কুটুম্বে। সবাই বলল তোর কপাল খুব ভালো, রে সদু। এমন
শ্বশুরঘর কটা মেয়ে পায়! আমিও আনন্দে নেচে নেচে বেড়াতে লাগলাম খুব। বিয়ের দিন
শ্বশুরবাড়ির তত্ত্ব দেখে সবাই উথলে উঠল। তোর শ্বশুরের কি উঁচু নজর রে, সদু?
দেখেছিস কেমন মাছ পাঠিয়েছে! কত শাড়ি, মিষ্টি, মন্ডা মেঠাই, দই। সে সব কথা শুনে
গর্বে আমার মাটিতে পা পড়ে না। বিয়ে হল, সাঁঝের বেলা। ছাদনা তলায় কত হাসি ঠাট্টা
আমোদ আহ্লাদ। শুভদৃষ্টিতে পান পাতার আড়াল সরিয়ে বরের মুখ দেখে বুকটা ভরে গেল। আহা
এমন আমার বর, এতো রাজপুত্র। বাসর ঘরে সারা রাত কেটে গেল, নানান আমোদে, নানান
খুনসুটিতে। সকাল হতে সবাইকে প্রণাম করলাম, অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর
শয্যাতুলুনির টাকা মিটিয়ে আমি উঠলাম পাল্কিতে, বর চলল গরুর গাড়িতে।
শ্বশুরবাড়িতে পা দিতেই গ্রামের যতো মেয়ে বউ এল নতুন বউ
দেখতে। গয়নাতে, শাড়িতে সেজেগুজে আমি তখন যেন রানি। সবাই এসে বলতে লাগল, আমাদের
মন্টুর কি ভাগ্য, এমন চাঁদের মত বউ কজনার ভাগ্যে জোটে! অই দ্যাখ, আমি আবার স্বামীর
নাম বলে ফেললাম। স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই”। বুড়ি বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে একগাল হাসল,
বলল, “আমার আবার স্বামী, তার আবার নাম
করা, না করা”?
রুদ্ধ নিশ্বাসে বিশেষ বুড়ির কাহিনী শুনছিল। তার চোখের সামনে
প্রত্যেকটা চরিত্র আর ঘটনা যেন জীবন্ত ধরা দিচ্ছিল। সে অধৈর্য হয়ে বলল, “তারপর”?
“তারপর আর কি, বাছা? কাল-রাত্রি পার করে পরের দিন
বউভাত। দুপুরবেলা বাড়ির যত বড়োরা বসল। আমার
দাদা, ভাইপো খোকাও ছিল। আমার হাতের দেওয়া অন্ন
খাবে বলে। চওড়া লালপেড়ে পাটের শাড়ি, হাতে, কানে, গলায় গয়না। সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর,
কপালে সিঁদুরের টিপ। বড়োরা আমার আচার আচরণ দেখে বলতে লাগল, বৌমা আমাদের সাক্ষাৎ
অন্নপুন্না। আমার বুক ভরে উঠতে লাগল গর্বে। মনে হতে লাগল এই আমার সংসার। জন্ম জন্ম
ধরে মেয়েরা যে সংসারের জন্যে শিবের থানে হত্যে দেয়, পুজো দেয়, এই আমার সেই ভরা
সংসার।
বউভাতের সব কাজ কম্ম, আমোদ খুনসুটি গুটিয়ে আমরা আমাদের ঘরে
গেলাম মাঝরাত পার করে। অচেনা সেই সুন্দর পুরুষের সামনে লজ্জা কাটিয়ে কথাবার্তার
সময় যখন এল, ততক্ষণে ভোর হয়ে এল, বাইরে শোনা যাচ্ছিল কাকপক্ষির ডাক। আমি বেরিয়ে এলাম।
বেরিয়ে আসার আগে আমার সেই স্বামী আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এ রাত্রে তো কোন কথাই হল
না, আজ রাত্রে কিন্তু আমরা সারারাত অনেক গল্প বলবো। সে রাত তো আর কোনদিন এলই
না”।
বুড়ি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মনে মনে হয়তো ধুলো ঝেড়ে
পরিষ্কার করে নিচ্ছিল তার স্মৃতি। বিশেষের দিকে তাকিয়ে বুড়ি একগাল হেসে জিজ্ঞাসা
করল, “এসব কথা শুনে তোর কী হবে, বলতো বাছা? এ মরা বুড়ির কথা শুনতে তোর ভালো লাগছে”?
“তোমার কথা কেউ
কোনদিন শোনেনি। শুনতে চায়নি। আমি শুনছি, বুড়িমা তুমি বলো”।
“তাআআআ বটে। সেদিন সকালে দাদা খোকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। বিকেলে আমার স্বামী গেল বন্ধুদের
সঙ্গে তাদের তাসের আড্ডায়। পাছে
আড্ডার বন্ধুরা তাকে খোঁটা দেয় – বউ পেয়েই আমাদের সবাইকে ভুলে গেলি, মন্টু? সেখান থেকে বেশ একটু রাত করে ফেরার পথে তাকে সাপে ডাঁশল।
জাত সাপ। একবন্ধু দৌড়ে এসে খবর দিতে, বাড়ির লোকরা ধরাধরি করে যখন তাকে নিয়ে এল, তার তখন শেষ
অবস্থা। এমন সুস্থ সবল জলজ্যান্ত সুন্দর মানুষটা এত সহজে মরে গেল? আমি অবাক হয়ে
গেলাম। আমি আমার ঘরের দরজায় নির্বাক পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। উঠোনে শোয়ানো
আমার স্বামীর দেহের উপরে আছড়ে পড়ে কাঁদছে, আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে, সবাই। হঠাৎ আমার
সেজজা, আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই যে, ওই সেই রাক্ষুসি, ডাইনি, পিচেশ, ওই
খেয়েছে ছোট ঠাকুরপোকে। অন্য দুই জা এসে আমাকে উঠোনে টেনে নামালো। আমার শরীর থেকে
খুলে নিলে সমস্ত গয়না, জল দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে দিলে আমার সিঁথির সিঁদুর, কপালের রাঙা
টিপ। ঠুকে ঠুকে ভেঙে দিল হাতের শাঁখা-পলা।
সে কি আক্রোশ তাদের। আমি পাথর হয়ে পড়েই রইলাম
উঠোনে। আমার অনেক ভাগ্য করে পাওয়া স্বামীকে ওরা শ্মশানে নিয়ে গেল, বলহরি হরিবোল
আওয়াজ দিতে দিতে”।
বুড়ি মুখ তুলে একবার দেখল বিশেষের দিকে, ভুরু কুঁচকে কিছু
বোঝার চেষ্টা করল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, “তিনদিনের মাথায় সব মিটে গেল। আমার
এই সংবাদ পেয়ে আমাকে দেখতে এসেছিল দাদা। দাদাকে দেখে আমি ভেঙে পড়লাম
কান্নায়। দাদা কিই বা বলবে, কিই বা সান্ত্বনা দেবে, আমাকে। আমার শাশুড়ি আর বড়ো
ভাসুর দাদাকে বলল, আমার আর ওই বাড়িতে একদিনও ঠাঁই হবে না। আমি ডাইনী, আমি পিশাচ। এ
বাড়ির যা অমঙ্গল হয়েছে, তারপরে আর কোন অমঙ্গল তারা চায় না। পোড়াকপালি ছোটবোনকে
দাদা আবার ফিরিয়ে আনল বাপের বাড়ি।
কিন্তু ছদিন আগে যে মেয়েটা এই বাড়ি ছেড়েছিল, আজ সেই মেয়েটাও
তো আর আগের মেয়ে নয়। সে বাড়িও আর তার আগের বাপের বাড়ি নয়। সে মেয়ে এখন কপালপোড়া
হতভাগী বিধবা। বিধবাদের দিয়ে কোন মঙ্গল কাজ হয় না। তার স্পর্শে সর্বদাই অকল্যাণ। আমাকে
নিয়ে সংসারে ঠোকাঠুকি, কান্নাকাটি, বকাবকি চলছিলই। কিন্তু বিপদ শুরু হল দাদার
ছেলের বিয়ের পর। নতুন বউ এল দাদার ঘরে। বৌদির
মনে হল, তার ছেলের নতুন সংসারে পিসিমার
অমঙ্গলের আঁচ এসে লাগছে বারবার। আর সহ্য করা গেল না কিছুতেই। গ্রামের কিছু বুড়ি
সেবার দলবেঁধে তীর্থে বেরিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আমি চলে এলাম কাশীতে। কাশী জায়গাটা
দেখার ইচ্ছে আমার যে ছিল না তা নয়। আমার ইচ্ছে ছিল দু চারমাস থেকে আবার বাড়ি ফিরে
যাবো।
আমার কোন ইচ্ছেই পূরণ হবার নয়, এটাই বা কেন হবে? কাশীতে
একটা আস্তানা ঠিক করে আমাকে রেখে, সেই তীর্থযাত্রীর দল চলে গেল এলাহাবাদের দিকে।
বলে গেল, তীর্থযাত্রার শেষে ফেরার পথে তারা আমাকে নিতে আসবে। ছমাস গেল, একবছর ঘুরে
গেল, কেউ এল না। যে আস্তানায় থাকতাম, তার বাড়িওলার নামে মাসে মাসে টাকা আসত। কত
টাকা জানি না। কোন মাসে সে আমার হাতে তুলে দিত তিরিশ, কোন মাসে চল্লিশ। বাকি
টাকাটা সে নাকি বাড়ি ভাড়া হিসেবে কেটে নিত।
বছর দুই কি আড়াই হবে, ঠিক মনে নেই, এভাবে চলার পর আর চলছিল
না। দাদাকে চিঠি লিখলাম। আমার এখানে মন টিকছে না, দাদা। তোমার দুটি পায়ে পড়ি,
অভাগী ছোট বোনটাকে ক্ষমা করে দাও। আমি বাড়ি যাবো, টাকা পাঠাও। পাঁচমাসের মধ্যে
পরপর চারবার। কোন উত্তর পেলাম না। এদিকে আমার বাড়িওয়ালা বলল, গত তিনমাস নাকি কোন টাকা আসেনি,
আমাকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা একদিন সকালে সত্যি সত্যি আমাকে ঘর থেকে বের করে
দিলে। রাস্তায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে আমার সামান্য যা কিছু জিনিষপত্র ছিল।
জিনিষপত্র গুছিয়ে, কী করবো, কোথায় যাবো, ভাবছি। গঙ্গার ঘাটে
আরো কজন বেধবার সঙ্গে আলাপ হল। তাদের দশাও আমারই মতো। তারা বললে, চল বেন্দাবন যাই।
বেন্দাবনে নাকি মন্দিরে কেত্তন গাইলে খেতে দেয় দুবেলা। নামগানে পাপ খণ্ডে যাবে, তার সঙ্গে
পেটটাও ভরবে। কাশীতে তাদের আস্তানায় দিন তিনেক থেকে, আমরা রওনা হলাম বেন্দাবন। বাস, সেই
থেকেই চলছে এই বেন্দাবন বাস। তা প্রায় পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর তো হলোই, বেশিও হতে
পারে। অত আর মনে রাখতে পারি না রে”।
বুড়ি চুপ করে গেল। আগের মতোই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল
বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাথা নিচু করে বিশেষ শুনছিল। এখন মুখ তুলে তাকাল বুড়ির
দিকে। ভাবলেশহীন বুড়ির ভাঙাচোরা মুখে কোথাও কোন দুঃখ, বিশেষের নজরে এল না। চোখের
কোণায় এতটুকু জলও জমে ওঠেনি। কত বয়েস হবে এখন বুড়ির, আশি, নব্বই? পঞ্চাশ বছর
ধরে একটা মড়া জীবনকে যে ঘষটে টেনে নিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। তার অন্তরে অভিমান,
দুঃখ, শোকের ছায়া কল্পনা করাও অন্যায়।
বিশেষ আবার বুড়ির কাছে মুখ নিয়ে গেল, জিজ্ঞাসা করল, “বুড়িমা,
তোমার সেই গ্রামের নাম কি? কি নাম তোমার সেই দাদার”?
বুড়ি হেসে ফেলল এবার হে হে করে। এমন হাসি বহুকাল হাসেনি। এ
ছোঁড়াটা তো বেশ। বুড়ি ভাবল। কাল রাত থেকে ছোঁড়াটা কিসের জন্যে তার পেছনে লেগে আছে,
বুড়ি বুঝতে পারছে না। এর আগেও তার জীবনে দু একজন এমন দয়া দাক্ষিণ্য দেখিয়েছে। দু
একদিন খাইয়েছে। শীতের চাদর কিনে দিয়েছে। কিন্তু এত কথা কেউ বলেনি। কেউ জিজ্ঞাসা
করেনি তার জীবনের কথা। বুড়ি হাসি মুখে বলল, “কী করবি জেনে”?
“কিচ্ছু না, কী আর করবো। তোমাকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবো, তোমার সেই গ্রাম,
সেই বাড়ি ঘরদোর? তোমার সেই ফেলে আসা জীবন? এমনি”।
“গ্রামের নাম কুসুমপুর, দাদার নাম শশাংক। আমি কপালপোড়া সদু,
সৌদামিনী”।
১৩
গত আড়াই বছরে মৃণালিনীর জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তাঁর বয়েস আড়াই নয় বেড়ে গেছে দশ বছর। তাঁর মাথার চুলে পাক ধরেছে। শরীরেও দেখা দিয়েছে ভাঙনের লক্ষণ। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা স্থায়ি আস্তানা গেড়েছে। মাত্র মধ্য চল্লিশেই তাঁকে এখন দেখলে বুড়ি মনে হয়। বাংলার ঘরে মেয়েরা অবিশ্যি কুড়িতেই বুড়ি হয়, এমন প্রবাদ আছে। কিন্তু এই কবছরে তাঁর এই আকস্মিক পরিবর্তন চোখে না পড়ে উপায় নেই।
তাঁর একমাত্র পুত্র খোকা ও বৌমা আশালতার একটি পুত্র হয়েছে।
সেই সম্পর্কে তিনি এখন ঠাকুমা। সেই শিশুর দৌরাত্ম্য এবং দুষ্টুমি তাঁর মন প্রাণ
জুড়িয়ে দেয়, কিন্তু তিনি এই দুরন্ত নাতির সঙ্গে তাল রাখতে পারেন না। একটুতেই
হাঁফিয়ে পড়েন, হাতে দুধের বাটি নিয়ে, রণে ভঙ্গ দিয়ে ডাকেন, “বাবু, সোনাবাবা আমার,
লক্ষ্মীবাবা আমার, অত দৌড়লে কি আমি পারি বাবা, তোমার সঙ্গে”? দুরন্ত শিশু ঘাড়
ঘুরিয়ে একটি দুটি দাঁতের খিলখিল হাসিতে মুগ্ধ করে তোলে ঠাকুমাকে, বলে, “এচো এচো,
আমায় ধলবে এচো”। এ শিশুর নাম, সুদীপ্ত, ডাক নাম নীলু। মৃণালিনীর দুটি নামের কোনটাই
পছন্দ নয়। তাঁর পছন্দের নাম ঠিক করেছিলেন শশীভূষণ। কিন্তু তাঁর ছেলের এই ধরনের
পুরোনো নাম পছন্দ হয়নি। মৃণালিনীর মনে হয় এ ব্যাপারে, তাঁর ছেলের থেকেও বৌমা
আশালতার পছন্দের জোর অনেক বেশী। আশালতা সামনাসামনি কোন দ্বন্দ্বে কোনদিন আসে না,
কিন্তু একমাত্র ছেলের উপর থেকে তাঁর কর্তৃত্বের রাশ নিরন্তর আলগা হয়ে চলেছে, এটা
তিনি টের পান নিজের অন্তরে।
মাস ছয়েক আগে তাঁর স্বামী কী এক
ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চরম সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। প্রায় মাস দুয়েক ধরে চলেছিল
মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াই। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ, আশু বিপদের আর কোন সম্ভাবনা
নেই। কিন্তু ব্যাধির আক্রমণে তাঁর বাঁদিকটা এখন প্রায় অসাড়। লাঠিতে ভর দিয়ে বাঁ পা
টেনে টেনে হাঁটা চলা করেন। কলতলায় যেতেও তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কথাবার্তা
বুঝতে, শুনতেও অনেক সময় লাগে। একই কথা উচ্চস্বরে, বারবার বলতে হয়। সামান্য বিকৃত
হয়ে যাওয়া মুখে কোন বার্তাতেই তাঁর আর তেমন কোন ভাব পরিবর্তন হয় না।
দুপুরে খাওয়ার পর মৃণালিনী আগে একটু বিশ্রাম নিতেন। এখন
দুপুরে বিছানায় শুলে তাঁর নিদ্রা আসে না, আসে যত রাজ্যের দুশ্চিন্তা। অবেলায় যদি
ঘুমিয়েও পড়েন, রাত্রে একদম ঘুম আসে না। ঘুম না আসা রাত্রে দুশ্চিন্তার জালে তিনি
অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। খাওয়ার পর স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, স্বামীর নাসিকা ধ্বনি শোনার
পর তিনি নিশ্চিন্ত মনে একতলার বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। এই সময়টা তাঁর
নিজস্ব, তাঁর নিজস্ব ভাবনার সময়। এই সময় তিনি নিজের মনে হিসাব করতে বসেন। বিচার
করতে বসেন তাঁর জীবনের ফেলে আসা দিনগুলির ভুলভ্রান্তি, ব্যর্থতা আর সাফল্য।
আজ দুপুরে মৃণালিনী চেয়ারে বসে তাকিয়ে ছিলেন, সামনের পেয়ারা
গাছটির দিকে। এ গাছটি অনেকদিনের পুরোনো, বিয়ের পর, এ বাড়িতে এসে থেকে তিনি দেখছেন।
এই গাছটির ওপর সারাটা দুপুর দৌরাত্ম্য করত, তাঁর ননদ সৌদামিনী। কাঁচা থেকে ডাঁশা
অব্দি কোন পেয়ারাই মেয়েটা ছাড়ত না। পেয়ারার টুকরোয় নুন লংকারগুঁড়ো মাখিয়ে নিয়ে
আসত, বলত “বৌদিমণি খাবে? দারুণ খেতে”। মৃণালিনী কখনো এক আধ টুকরো চিবিয়ে দেখতেন,
কষ্টা, তেঁতো। বলতেন, “আজ নয় কাল দুদিন বাদে তোমার বিয়ে হবে, বিয়ের পরেও কি এমন
করবে নাকি, ঠাকুরঝি? এবার ছেলেমানুষী ছেড়ে, একটু বড়ো হও”। আজ হঠাৎ ঠাকুরঝির কথা
খুব মনে পড়ছে মৃণালিনীর। কেন কে জানে? কেমন আছে মেয়েটা, কিভাবে আছে মেয়েটা, কে
জানে? অবিশ্যি তিনি যে জানতে খুব আগ্রহী তাও নয়। ছোটবোনের মতো এই ননদিনী তাঁর খুব
নেওটা ছিল, সারাদিন কাজে কর্মে পায়ে পায়ে ঘুরত মেয়েটা। মৃণালিনীও খুবই স্নেহ করতেন
এবং প্রশ্রয়ও দিতেন মেয়েটিকে।
কিন্তু আজ মৃণালিনী বোঝেন জীবনে কিছু কিছু ভালোবাসা, মায়া,
স্নেহমাখা স্মৃতি আলমারিতে ভাঁজ করে রাখা দামী শাড়ির মতো। তামাক-পাতা এবং ন্যাপথালিনের
ঝাঁজে চোখের আড়ালে সংরক্ষণ করা চলে। কিন্তু বাইরে সবার চোখের সামনে মেলে ধরা যায়
না, প্রাণে ধরে ব্যবহার তো করাই চলে না। কখনো সখনো, ঘুঘু-ডাকা অলস মধ্যাহ্নে
আলমারি খুলে সে শাড়িতে একলা নির্জন ঘরে বসে হাত বোলানো চলে। কিন্তু কোনভাবেই আর
ফিরিয়ে আনা যায় না, আটপৌরে জীবনের মাঝখানটিতে।
এ গ্রামে ডাক আসে এই দুপুরবেলাতেই। আজ তেওয়ারিজি হাতে একটা
পোস্টকার্ড এনে মৃণালিনীর হাতে দিয়ে বলল, “মাইজি, এক চিট্ঠি আয়ি”। হাত বাড়িয়ে
মৃণালিনী চিঠিটা নিতে নিতে ভাবলেন, খোকা তো সবে কাল কলকাতায় গেল, আজ তার চিঠি আসার
তো কথা নয়। পোস্টকার্ডের উল্টোপিঠের শেষে দেখলেন সৌদামিনীর নাম। তাঁর ভুরু কুঁচকে
উঠল, তিনি চিঠিটা পড়তে শুরু করার আগে তিওয়ারিজিকে ডাকলেন, “তিওয়ারিজি”?
তিওয়ারিজি চিঠিটা দিয়ে আবার গেটের দিকে যাচ্ছিল। মাইজির
ডাকে ফিরে এসে বলল, “জি, মাইজি”।
“আজ থেকে এ বাড়িতে যা চিঠি আসবে, সব আমার হাতেই দিয়ে যাবেন।
মনে থাকবে তিওয়ারিজি”?
“জি মাইজি”।
“ঠিক আছে যান, গেটে যান”।
চিঠিটা পড়তে লাগলেন মৃণালিনী।
শ্রীচরণকমলেষু দাদা,
আপনি ও বৌদিমণি আমার প্রণাম নেবেন। খোকা ও বৌমাকে আমার
আশীর্বাদ দেবেন। আশা করি ভগবানের কৃপায় আপনারা সকলে কুশলে আছেন। প্রায় তিনবছর হল
আমি কাশীতে এসেছি, এখানে থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না। দাদা, আপনার দুটি পায়ে পড়ি।
বৌদিমণিকে বলে আমাকে অন্ততঃ মাস খানেকের জন্যে হলেও গ্রামে ফিরিয়ে নিন। আপনাদের
সকলকে চোখে দেখার জন্যে আমার মন বড়োই অতিষ্ঠ হয়। আপনার পাঠানো টাকাতে সংকুলান হয়
না। বাড়িওয়ালা বলছিল, গত পাঁচ-ছমাস আপনি নাকি কোন টাকা পাঠান নি। দাদা, আপনার ও
বৌদিমণির চরণে যা অপরাধ করেছি তা ক্ষমা করে, এই হতভাগী বোনকে ফিরিয়ে নিন। আপনি ও
বৌদিমণি আমার প্রণাম নেবেন। আপনার চিঠির অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি আপনার একান্ত অভাগী
সৌদামিনী
চিঠিটা পরপর দুবার পড়লেন মৃণালিনী। তারপর চিঠিটা কুচি কুচি
করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে এলেন রান্নাঘরের উনুনে। রান্নাঘরের এই উনুনে গুঁড়োকয়লা দিয়ে
ঢিমে আঁচ রাখা থাকে। তার ওপর বসানো থাকে লোহার কড়াই ভর্তি দুধ। সময়ে অসময়ে দরকার
পড়লে এই উনুনের আগুন কাজে লাগে। উনুনের ঢিমে আঁচে জ্বলে উঠল চিঠির ছেঁড়া
টুকরোগুলো। মৃণালিনীর যাবতীয় অমঙ্গলের
আশঙ্কা এবং সুদূর কাশীতে নির্বাসনে থাকা
ঠাকুরঝির বুকের অনন্ত জ্বালা, ছাই হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
১৪
বিশেষ ওই গ্রাম চেনে। বিশেষ শশাঙ্কর নাম শুনেছে। প্রতিবার দুর্গাপুজোর সময় বিশেষরা ওই
কুসুমপুরের বাড়িতে যায়। কুসুমপুরের বাড়িতে এখন থাকেন বৃদ্ধ মৃগাঙ্ক এবং তাঁর
স্ত্রী আশালতা। সে শুনেছিল তাদের বাড়িতে এই দুর্গাপুজো চালু হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ
বছর আগে। মৃগাঙ্কর বাবা শশাঙ্কর মৃত্যুর এক বছর পর, শশাঙ্কর স্ত্রী মৃণালিনীর
ইচ্ছায়। বিশেষের বাবা সুদীপ্ত তখন বছর ছয়-সাতের বালক
মাত্র। বহুদিনের পুরোনো সাবেকি পুজোর সুনামের জন্যে, কুসুমপুর গ্রামে তাদের বাড়ির
এই পুজোয় অনেকেই আসে। অনেক আত্মীয়, দূর সম্পর্কের বহু পরিজন। তাদের বাড়ির এই
প্রাচীন দুর্গাপুজোর কথা বন্ধুবান্ধবের কাছে খুব গর্ব করেই বলে থাকেন তার বাবা। নিজেদের সেই ঐতিহ্যের কথা বিশেষ নিজেও বন্ধুবান্ধবদের
বলে থাকে। বাবার অনেক বন্ধু সপরিবারে গিয়ে পুজোর কটা
দিন মহানন্দে কাটিয়ে এসেছেন। পুকুরের টাটকা মাছ, গ্রামের কচি ও নধর পাঁঠার স্বাদে
বেড়ে উঠেছে পুজোর আমোদ।
বারান্দা থেকে নেমে বাবাকে ফোন করল, বিশেষ, রিং হচ্ছে। বাবা
কথা বললেন, “তুই এখন কোথায়? বৃন্দাবন ঘোরা হয়ে গেল”?
“বাবা, সদু, সৌদামিনী বলে কাউকে চেন”?
“সৌদামিনী? শরৎচাটুজ্জে কি রবিঠাকুরের কোন চরিত্র মনে
হচ্ছে, কেন বলতো? তুই হঠাৎ সৌদামিনী পেলি কোথায়? শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্রে কোন
সৌদামিনী তোর মনে বিদ্যুৎ হানল, রে!”
“ইয়ার্কি নয়, বাবা। পেয়েছি, হীরালালজির ধর্মশালায়। এ কোন
উপন্যাসের চরিত্র নয় বাবা, আমাদের পরিবারেরই জনৈক পার্শ্বচরিত্র। আমার আন্দাজে একশর কাছাকাছি বয়সের এক বুড়ি”।
“কি বলছিস, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের পরিবারে সৌদামিনী বলে কাউকে আমি
চিনি না। তোকে মিথ্যে কথা বলেছে”।
“মিথ্যে হতে পারে না, বাবা। সৌদামিনী তোমার দাদু শশাঙ্কর
বোন”।
“দাঁড়া, দাঁড়া। মনে পড়েছে। আমার দাদুর এক বিধবা বোনের কথা, বাবা-মার কাছে দু একবার
শুনেছি। অল্প বয়সের বিধবা, কাশীতে থাকতেন”।
“থাকতেন বলো না, বাবা। আমাদের পরিবার তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল,
তিনি থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি এখন বৃন্দাবনে”।
“কিন্তু তিনি
বৃন্দাবনে যাবেন কেন?”
“সে কথা আমাদের পরিবার তো কোনদিন জানতে চায়নি বাবা?”
“বুঝতে পারছি তুই খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিস। কিন্তু নামটা তো আমি জানি না রে, অমু। বাবাকে কিংবা মাকে জিজ্ঞাসা করলে পেয়ে যাবো”।
“আমি পেয়ে গেছি বাবা, আমি ওঁনাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি,
নোয়দায়”।
“পাগলামি করিস না, অমু। কোথাকার
কে বুড়ি, জানা নেই, শোনা নেই। বিপদে পড়বি”।
“আমাদের পরিবার; তোমরা, তোমার বাবা-মা, তোমার
দাদু–ঠাকুমা, ওঁনাকে বহু বছর ধরে বহু বিপদে ফেলেছেন, বাবা। সারাটা জীবন উনি বিপদের মধ্যেই রয়েছেন”।
“অমু। অমু আমার কথা শোন, হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলিস না। একটু
ভাবতে দে, তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দে”।
“না বাবা, এ সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। তুমি আমাকে সনাতন ভারতের ঐতিহ্যের সন্ধান করতে বলো, বাবা। সে
ঐতিহ্য খুঁজতে এসে আমি জেনেছি আমাদের অপরাধের ঐতিহ্যের কথাও। দাদু-ঠাকুমা সব কিছু জেনে-বুঝেও
কোন সিদ্ধান্ত নেননি, এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তোমরা শুনেছিলে কিন্তু জানার চেষ্টাও করনি।
অতএব এ প্রায়শ্চিত্ত আমার এবং সে সিদ্ধান্ত আমারই। তোমরা সাপোর্ট না করলেও কিছু যাবে আসবে না। তোমাকে
জানানো উচিৎ, জানালাম”।
ফোনটা কেটে দিল, বিশেষ। সৌদামিনী একইভাবে বসে আছেন
বারান্দায়। ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। বাবার সঙ্গে বিশেষের কথায়
তিনি কি বুঝলেন কিছু? বিশেষ বুঝতে পারল না। সে সৌদামিনীর পাশে আবার গিয়ে বসল, “বুড়িমা,
আমার সঙ্গে যাবে”? সৌদামিনী মুখ ঘুরিয়ে বিশেষের দিকে তাকালেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “কোতাআআয়?”
“আমার ফ্ল্যাটে, আমার বাড়িতে?” সৌদামিনী ভুরু কুঁচকে
তাকালেন, তাঁর চোখে কি সন্দেহের ছায়া? বললেন, “কেন?”
“এমনি, থাকবে আমার সঙ্গে”।
“আমার তো আর সে বয়েস নেই, বাছা। গতর নেই। ঝি-গিরি
করার ক্ষমতাও আর নেই। কেন নিয়ে যাবি আমাকে”?
“বুড়িমা, আমি অমু। আমি বিশেষ। তোমার ভাইপো মৃগাঙ্ককে মনে
পড়ে? আমি তার নাতি”।
“মৃগাঙ্ক, খোকা - লতাবৌমা - তুই তাদের নাতি? সত্যি বলছিস”?
সৌদামিনী তার শীর্ণ ডানহাত বাড়িয়ে বিশেষের মুখে, বিশেষের
চুলে একবার হাত বুলিয়ে, হাত সরিয়ে নিলেন। তাঁর শুকনো চোখের কোলে জমে উঠল এক বিন্দু জল। তাঁর সমস্ত
শরীর, হাত-পা কাঁপতে লাগল থরথর করে।
বিশেষ বলল, “বুড়িমা, যাবে তো, আমার সঙ্গে”?
“তোর বাড়িতে দাদা আছে? বৌদিমণি আছে?”
“না, তাঁরা তো কবেই মারা গেছেন”।
“মারা গেছে”? সৌদামিনী কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলেন, তারপর
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন, “না”।
“কেন যাবে না, বুড়িমা? চলো না, বুড়িমা, আমার বাড়িতে চলো। তোমাকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো আমাদের গ্রামের বাড়িতে”, বিশেষের স্বরে আন্তরিক আকুতি।
বুড়ি তবু ঘাড় নাড়ল, “না”।
“অভিমান? অভিমান করছ, বুড়িমা? কার ওপর? এক ভাগ্যহীনা মেয়েকে
যে পরিবার তার প্রাপ্য মান দেয়নি, তাদের ওপরে অভিমান? এত বছর পরেও? কেন?” সৌদামিনী
বিশেষের মুখের দিকে তাকিয়ে, বিশেষের চোখে চোখ রাখলেন।
বিশেষ আবার বলল, “আমি সেই পরিবারেরই একজন, বুড়িমা। এত বছর
বাদে তোমাকে চিনতে পেরেছি। তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি, আমাদের পরিবারে, আমাদের
বাড়িতে, আমাদের গ্রামে...তবুও আসবে না তুমি?”
বুড়ি দুই চোখ নামিয়ে শীর্ণ দুই হাতে বিশেষের দুই হাত ধরে ঘাড়
নাড়লেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, “যাআআআবো”।
আশ্চর্য এক অনুভূতিতে বিশেষ নির্বাক হয়ে রইল বহুক্ষণ। এই
অনুভূতি সে কীভাবে প্রকাশ করবে? সৌদামিনীর দুই হাত সে চেপে ধরল নিজের দুই হাতের
মাঝখানে। স্পর্শ দিয়ে কি না বলা আবেগ বোঝানো যায়? বিশেষ জানত না। এখন কি সে জেনেছে?
শান্ত স্বরে বিশেষ জিজ্ঞাসা করল, “বেরোনোর আগে একটু ভাত খাবে না, বুড়িমা”?
সৌদামিনীর মুখ তুলে তাকালেন। প্রসন্ন মুখে বললেন, “খাআআবো।
তুই যাআআআ খাওয়াবি, খাআআবো”।
ধর্মশালা থেকে রাস্তায় বেরোনোর মুখে হীরালালজীর সঙ্গে
বিশেষের দেখা হল। বিশেষ সব কথা খুলে বলল হীরালালজীকে। সব শুনে হীরালালজী বিশেষের
কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বাবাকে বলেছিস”?
“বলেছি”।
“কি বলল। অনুমতি দিয়েছে”?
“বোধহয় না। আমি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, বুড়িমাকে আমি
নিয়েই যাবো, আংকল। বাবা বলুন আর নাই বলুন”।
“আমার ধারণা তোর বাবা মেনে নেবে, কিন্তু তোর মা”?
“জানিনা, আংকল”। হীরালালজি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর
বললেন, “কিসে যাবি? বাসে তো বুড়ি যেতে পারবে না, মরেই যাবে”।
এ কথাটা বিশেষের মাথায় আসে নি। অসহায় স্বরে বলল, “সত্যিই
তো, তাহলে”?
“গাড়িতে নিয়ে যা, আমার চেনা গাড়িকে বলে দিচ্ছি”।
“বাঃ, তাহলে তো খুব ভালো হয়”। বিশেষ
হীরালালজীর হাতটা দুই মুঠিতে চেপে ধরল।
“টাকা পয়সা কিছু লাগবে? দেবো”?
“না, না টাকা পয়সা হয়ে যাবে। এটিএম থেকে তুলে নিতে পারবো। ও
নিয়ে ভাববেন না”।
“ঠিক তো? গাড়ি বলে দিচ্ছি, এসে যাবে আধাঘন্টার মধ্যে। তুই
এখন কোথায় যাচ্ছিস”?
“বুড়িমার জন্যে ভাত কিনে আনতে”।
হীরালালজী বিশেষের এ কথায় হাসলেন, বললেন, “বেশ, খুব ভালো।
ওই সঙ্গে দুটো সাদা থান শাড়ি, শায়া, ব্লাউসও
কিনে আনিস। তুই কি তোর
ফ্ল্যাটে ওই ছেঁড়া-ময়লা কাপড়ে মোড়া বুড়িকে নিয়ে তুলবি? একদমই না। মনে রাখিস, তুই ওঁকে বরণ
করছিস। তার জন্যে কিছুটা
পরিচ্ছন্ন সাজসজ্জা তো ওঁনার পাওনা হয়, বেটা।
যা বেটা, ঘুরে আয়। ভাবিস না, সব ভালোই হবে। সবার মঙ্গলই হবে – সবার। তোর পরিবারের সকলের – যাঁরা জীবিত
– যাঁরা এখন পরলোকে – সবার”।
দু সেট শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ
আর বুড়িমার জন্যে ভাত তরকারি কিনে বিশেষ ফিরে এল।
দেখল রামু বসে আছে বুড়িমার সামনে। বুঝতে পারল হীরালালজী পাঠিয়েছেন। সৌদামিনীর
সামনে গতকাল রাত্রির মতো প্যাকেট খুলে সাজিয়ে রাখল ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজি। আজ আর
কোন দ্বিধা না করে, কালকের মতোই ভাতের সঙ্গে সব কিছু মেখে বিশেষ খাইয়ে দিল সৌদামিনীকে।
রামু বসে বসে দেখল। কিছু বলল না। খাওয়ার পর, বিশেষ সৌদামিনীকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে
গেল। সৌদামিনীকে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বুড়িমা, শাড়ি পড়তে পারবে তো”?
“নোওওতুন? পাআআআরি”। সৌদামিনীর হাতে নতুন শাড়ি, শায়া, ব্লাউসের একটা সেট তুলে দিয়ে বিশেষ বলল, “তাহলে এগুলো চটপট পড়ে
ফেল দেখি”।
বিশেষের এই কথায় সৌদামিনী এবার একটু
ঝাঁজিয়ে উঠলেন, বললেন, “বাআআইরে যা, মুখপোড়া। তোর সামনে আমি কাপড় ছাড়বো নাকি রে, ছোঁড়া”?
বিশেষ হাসতে হাসতে ঘরের বাইরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তার দুই চোখ ভরে উঠল জলে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল, এই বুড়ির
নিষ্প্রাণ জীবনেও জেগে উঠছে লজ্জা, স্নেহ, মায়া, মমতা। আশ্চর্য এক অনুভূতিতে সে আবার আচ্ছন্ন হতে
থাকল। উঠোনের
পেয়ারা গাছটার দিকে তাকিয়ে সে মনে করার চেষ্টা করল, কুসুমপুরের বাড়িতে কোন
পেয়ারাগাছ রয়েছে কিনা। মনে করতে পারল না। এই সময় ফোন এল, পকেট থেকে ফোন বের করে
দেখল, বাবা।
“বলো”।
“তুই কি বুড়িকে তোর ওখানে আজই নিয়ে যাচ্ছিস, অমু?”
“হ্যাঁ, বাবা”।
“আরেকটা দিন ওয়েট করা যেত না? আমি আর তোর মা ভাবছিলাম ভোরের
ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছে, কাল বৃন্দাবন যাবো। তারপর না হয় ডিসিসানটা ফাইন্যাল করা যেত”।
“ডিসিসান ফাইনাল হয়ে গেছে, বাবা। হীরালালজি গাড়ি বলে
দিয়েছেন। আমি মিনিট পনেরর মধ্যেই বেড়িয়ে পড়তে চাই”।
“বড্ড তাড়াহুড়ো করলি, অমু। আচ্ছা শোন। আমি বাবাকে ফোন
করেছিলাম, মাও পাশেই ছিলেন। বাবার ওই পিসিমার নাম সৌদামিনীই”।
“আমি জানি, বাবা”।
“মা তো কেঁদেই ফেললেন, তাঁর পিস্শাশুড়ির কথা শুনে।
তোকে যে কী আশীর্বাদ করলেন”।
“এরপরেও তুমি ডিসিসানের কথা বলছো, বাবা?”
“ঠিক তা নয়, আসলে তোর মা বলছিল, অমুটা কী করতে কী করে ফেলবে”।
“মাকে চাপ নিতে মানা করো, বাবা। আমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়ে
উঠেছি”।
“আচ্ছা আচ্ছা, সে ঠিক আছে। শোন, আমরা কাল ভোরের ফ্লাইটে দিল্লি
আসছি। তোর ফ্ল্যাটে আসবো”।
“এসো, বাবা। এক মিনিট। এক মিনিট হোল্ড করো, বাবা”।
এইসময় ঘরের দরজা খুলে সৌদামিনী বেরিয়ে এলেন বারান্দায়,
একলাই হেঁটে, হেঁটে। কুঁজো হয়ে, দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে। পরনে তাঁর
ধবধবে সাদা থান শাড়ি। বগলে কাপড়ে বাঁধা একটা ছোট্ট পুঁটলি। রামু ধরে ধরে বসিয়ে
দিল, বারান্দার মেঝেতে। বিশেষ অবাক হয়ে দেখল বুড়িমার মুখের হাসি।
“হ্যাঁ, বাবা। তোমার পিসিঠাকুমার ছবি দেখবে”?
“আমি তো কোনদিন দেখিই নি, চিনতে পারবো নাকি?”
“চেনার কি খুব দরকার, বাবা? ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড,
ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড, পাসপোর্ট কিচ্ছু নেই। কি করে চিনবে? আমাদের
ক্ষেত্রে ওগুলো কিন্তু খুব জরুরি নয়, বাবা। হোয়াটস্অ্যাপে ফটো আপলোড করছি, দেখে
নিও। রাখছি এখন”।
কল এণ্ড করে, বিশেষ হোয়াট্স্অ্যাপ খুলল। সৌদামিনীর লাজুক
হাসিমাখা ফোগলা মুখের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল বাবার মেসেজে।
এই সময় হীরালালজি বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। সৌদামিনীকে
দেখলেন, নতুন চোখে। তাঁর চোখেও খুশির হাসি। তিনি বিশেষকে বললেন, “কেয়া বেটা, রেডি?”
“একদম রেডি। আপনার
গাড়ি কদ্দূর?”।
“এসে যাবে এখনি,
বাস দো মিনিট”।
“ওকে। আংকল। বুড়িমা তোমার আর কিছু নেবার নেই তো”? সৌদামিনী
ঘাড় নেড়ে বলল, না।
“তুই কিছু খেয়েছিস? খাস নি তো? কিছু খেয়ে যা। বাড়ি পৌঁছতে
ঘন্টা চারেক তো লাগবেই”।
“আজ নয় আংকল, ফির কভি”।
“ঠিক হ্যায়, বেটা। যে ঝড় এখন তোর মনের মধ্যে বইছে, টের পাচ্ছি বেশ। একদিনের উপোসে কিছু
যাবে আসবে না”।
কথা বলতে বলতে গাড়ি ঢুকে এল, ভিতরে। হীরালালজীর চেনা
ড্রাইভার, ভেতরে ঘোরানো যাবে না, ব্যাক করেই ঢোকালো।
উপরের ঘর থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে নামল বিশেষ। তারপর
সৌদামিনীকে তুলে দিল গাড়িতে। নিজে গাড়িতে ওঠার আগে হীরালালজিকে প্রণাম করতে গেল।
হীরালালজী বিশেষের হাত দুটো ধরে, বুকে টেনে নিলেন প্রথম দিনের মতো। পিঠে চাপড় মেরে
বললেন, “দিল জিত লিয়া, বেটা।”
এই সময়ে বিশেষের ফোন বেজে উঠল আবার, বাবা। “অমু, আমাদের
প্রোগামটা একটু বদল হচ্ছে। বাবা-মা আজ সন্ধেতেই কলকাতা আসছেন। কাল ওঁরা দুজনেই আমাদের
সঙ্গে তোর ওখানে যেতে চান। বাবা-মার পক্ষে ভোরের ফ্লাইট ধরা শক্ত, আমরা একটু বেলার
ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে তোর ফ্ল্যাটে আমাদের পৌঁছতে দেড়টা-দুটো হয়ে যাবে…।
বিশেষ হাসল, “ঠিক আছে, এস। সাবধানে এস। ঠাম্মি-দাদুর যেন
কোন অসুবিধে না হয়। আমরা আগামীকাল এক সঙ্গে লাঞ্চ করব বাবা – চার প্রজন্ম একসঙ্গে…!”
ও পাশ থেকে কোন উত্তর এল না। ফোনটা কি কেটে গেল? কান থেকে সরিয়ে ফোনটা দেখল… না, কানেকশন
চালু…বিশেষ বলল, “বাবা? হ্যালো, বাবা?”
“কাল দেখা হবে, এখন রাখছি”। ধরাধরা ভারি কণ্ঠে বাবা উত্তর
দিলেন। বাবা কি কাঁদছেন?
ফোন অফ করে বিশেষ
হীরালালজির দিকে তাকাল, একটু হাসল। বলল, “বাবা। খুব ইমোশনাল
হয়ে পড়েছেন। বাবা-মা কাল সকালের ফ্লাইটে আসছেন, সঙ্গে আসছেন আমার দাদু ও ঠাম্মি, মানে
ঠাকুমা। হয়তো এখানেও একবার আসবেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে”।
হীরালালজি হাসলেন, বললেন “আসতে দে। আমি
থাকব।”
বিশেষ বলল, “চলি?”
“উঁহু, আসি বলতে হয়”।
গাড়ি উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে এল। অনন্ত এক সময়ের তরণী বেয়ে সৌদামিনী আজ ঘরে ফিরছে।
-০০-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন