এই "উপমন্যু" গল্পটি "মাধুকরী" ওয়েব পত্রিকার ২০২৫ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে - সম্পাদক ও কলাকুশলীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এখানে ওই পত্রিকার সূত্রটি শেয়ার করলাম,
শুধু আমার লেখাটিই নয়, উপভোগ করুন বহু কৃতী লেখকের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার সাহিত্যরস।
অথবা গল্পটি এখানেও পড়ে নিতে পারেন -
শীতের বেলা চট করে শেষ হয়ে আসে, গরমে ঠিক তার উল্টো, যেন নড়তেই চায় না।
ভোর থেকে বেলা যত এগোতে থাকে, সূর্য আগুন ঢালে। শুকনো খড়কুটো-পাতা জড়ো করে আগুন
ধরালে তার ধোঁয়ায় যেমন গন্ধ ছাড়ে, দুপুরের বাতাসে সেরকম পোড়া গন্ধ টের পায় বিজু। কোথাও
যেন আগুন ধরেছে।
চাটুজ্জে বাড়ি কাজ সেরে সে আর মা ফিরেছে একটু আগে। ঘরে ঢুকে রান্নার
যোগাড় করেই মা বেরিয়ে গেল ঘাটে স্নান সারতে। যাওয়ার সময় বিজুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“চানটা সেরে আয় বিজু, আমি ফিরে এসেই ভাত চড়াব। অনেক বেলা হল, খিদে পেয়েছে খুব,
নারে?” মায়ের এই স্নেহের কথাটাও সহ্য হল না বিজুর। কত বেলা হল, মা জানে না? কখন
থেকে তার খিদে পেয়েছে সে কথাটাও মায়ের অজানা নয়। মাথায় হাত দিয়ে মিষ্টি করে কথা
বললেই খিদে মিটে যায় বুঝি? প্রচণ্ড গরমে আর আনচান খিদেয় বিজুর শরীরে এখন জমা হতে
লাগল রাগ। সে রাগটা তার মা কিংবা বাবার ওপর নয়, কিন্তু কার ওপর? বিজু জানে না। বিজু ঘর
ছেড়ে বেরিয়ে এল। চান করতে পুকুরের দিকে না গিয়ে, হাঁটা দিল উলটো দিকে।
ওদিকে কেউ বড়ো একটা যায় না, ঝোপঝাড় আর আগাছার আড়ালে পড়ে আছে একটা পচা
ডোবা। স্বল্প জলে পোকামাকড়, ব্যাঙাচি কিলবিল করে। বিকেল হলেই আনাচ-কানাচ থেকে ঝাঁকে
ঝাঁকে মশা উড়ে আসে। নোংরা জলে গাছের ডালপালা
আর পাতা পচে দুর্গন্ধ ওঠে। ওপাড়েই কারা আবার ঠ্যাংয়ে দড়ি বাঁধা একটা মরা কুকুর
ফেলে দিয়ে গেছে। পচে ফুলে উঠেছে সেটা। বড়ো বড়ো নীল মাছিরা ভনভন উড়ছে ওটাকে ঘিরে। দমকা
তপ্ত বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে উৎকট দুর্গন্ধ।
অন্যসময় হলে বিজু হয়তো পালাত এই কদর্য পরিবেশ থেকে, কিন্তু এখন সে নির্বিকার।
বিশাল তেঁতুল গাছের নিচু একটা ডালে বসে সে
সবই দেখল। আরও দেখল তার পায়ের নিচে ঢোল কলমির ফুলে ফুলে উড়তে থাকা ফড়িংয়ের ঝাঁক।
ফিনফিনে ডানা কাঁপিয়ে পতঙ্গগুলো উড়ছে বসছে উড়ছে। যেন খুব ব্যস্ত। তার চোখে পড়ল পাড়ের
কাছে জলে স্থির ভেসে থাকা একটা তেকোণা মুখ। তার চকচকে পুঁতির মতো দুটো চোখ। মুণ্ডুটুকু
বের করে একভাবে তাকিয়ে আছে জলঢোঁড়াটা।
ঝিরিঝিরি পাতার ছাউনির নিরিবিলি ছায়ায় বসে সে দেখতে পেল অনেক দূরের
মাঠঘাট, বড়ো রাস্তা, এমনকি তাদের দোতলা স্কুলবাড়িটাও। সামনে একলা একটা টিউবওয়েল নিয়ে,
নির্জন দাঁড়িয়ে আছে, মাঠের প্রান্তে, বড়ো রাস্তার ধারে। পরশুদিন বিকেলে একবার
গিয়েছিল ওদিকে, দরজা জানালা সব বন্ধ। বারান্দায় পুরু হয়ে জমে উঠেছে ধুলো, শুকনো
কাঠকুটো-পাতা, ছাগল নাদি আর শুকনো গোবর। ছাদের কাছে মাথা চাড়া দিচ্ছে অশ্বত্থের
চিকন চারা।
বছর পেরিয়ে গেল স্কুল যাওয়া বন্ধ। গতবার গরমের শুরুতেই সেই যে বন্ধ
হয়েছিল, আর খোলেনি। সেই সঙ্গেই তার এবং তার বাবা মায়ের জীবনটাও পাল্টে গেছে। শুধু
স্কুল নয়, সবই বন্ধ হয়ে গেল একে একে। তার বাবার টোটো চালানোও বন্ধ হল। মায়েরা যে সমিতিতে
কাজ করত সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকমাস আগে বাবা টোটোটা বিক্রি করে দিল। পাশের পাড়ার
রমেশ পোদ্দার বাবার হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল, “বড্ডো ঠকা হয়ে গেল রে,
রাজু, এই পুরোনো টোটোর জন্যে এতগুলো টাকা গুণাগার দেওয়া, সে শুধু তোর মুখ চেয়ে”। সেই
মুহূর্তেই তার বাবার টোটোটা হয়ে গেল রমেশ পোদ্দারের। বাইকের ব্যাটারি থেকে টোটো
চালু করে ড্রাইভার সনাতন টোটো নিয়ে চলে গেল। মৃদু হেসে রমেশ পোদ্দার এগিয়ে গেল তার
বাইকে।
মা আক্ষেপ করেছিল, “দেশ জুড়ে কী যে লক ডাউন শুরু হল, বুঝি না বাপু। লোকজন
করেকম্মে খাবে কী করে? সবার বাড়িতে বুঝি কাঁড়িকাঁড়ি টাকা জমানো থাকে?”
বিজু অল্পঅল্প ইংরিজি শিখেছে, সে বলল, “লক মানে তালা আর ডাউন মানে নীচু – তাই না মা?”
বিজুর মা বলল, “আমরা এখন নীচু
তলার মানুষ। তোর বাবার গাড়িটা ছিল। ছুটির দিনে আমরা কেমন সবাই মিলে বিশালাক্ষী তলায়
পুজো দিতে যেতাম। স্টেশন বাজারে যেতাম। এখন সে সব গেল চুলোর দুয়োরে।”
বিজুর বাবা বিষণ্ণমুখে বলেছিল, “এখন আমাদের সবদিনই ছুটি, কাজের দিনগুলো
সব লোপ পেয়ে গেছে। কবে যে শেষ হবে এই ছুটির অভিশাপ”। অভিশাপ ব্যাপারটা ঠিক কী বিজু
বুঝতে না পারলেও, বাবার টোটো বেচা টাকায় বিজুদের কিছুদিন ভালই চলেছিল। দিন তিনেক
বাড়িতে চিকেনও এসেছিল। বহুদিন পরে ভরপেট তৃপ্তির স্বাদ এসেছিল তাদের জীবনে। সে
স্বাদ এখনও মনে পড়ে বিজুর।
যতদিন স্কুল চালু ছিল, ছুটি ব্যাপারটায় বেশ মজাই পেত বিজু। বর্ষার
ছুটি, পুজোর ছুটি। তাছাড়াও স্বাধীনতার ছুটি। শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী, ঈদের ছুটি। প্রজাতন্ত্রের
ছুটি। কিন্তু এখনকার এই ছুটি বড়ো একঘেয়ে। কবে যে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। এই
ছুটি এখন বিভীষিকা, তাদের জীবনটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে। বিজুর বাবা সাইকেলে রোজ
স্টেশন বাজারে যায়, বণিকদের দোকানে বস্তা তোলা নামানোর কাজে। বিজুর মা এখন ঝি,
চাটুজ্জে আর হাজরা, দুই বাড়িতে কাজ নিয়েছে। ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, এঁটো বাসনকোসন ধোয়া,
ময়লা জামাকাপড় কেচে শুকোতে দেওয়া।
গতমাস থেকে চাটুজ্জে বাড়িতেই কাজে লেগেছে বিজুও! ওদের গোয়ালের তিনটে
গাই আর দুটো বাছুরের দেখভাল করতে হয়। খড়কাটা, ডাবায় জাবনা দেওয়া, গোয়াল সাফ করা। পুরোনো
কাজের লোককে মনিবরা এখনও ছাড়িয়ে দেয়নি। তার বয়েস হয়েছে, ঘোলাটে চোখ, কোমর সোজা হয় না।
সে সাহায্য করে বিজুকে। প্রথম প্রথম কষ্ট হত খুব, ঘেন্না লাগত, এখন সয়ে গেছে।
তেঁতুল গাছের ডালে বসে স্কুলবাড়িটা দেখতে দেখতে, বিজু ভাবে, স্কুল খুললেই কী তারা আবার ফিরে যাবে তাদের আগের জীবনে? তার বাবা আবার টোটো কিনবে? স্টেশন থেকে সাজাদপুর - যাত্রী নিয়ে আবার যাওয়া আসা করবে? মা পরের বাড়ি ঝিগিরি ছেড়ে, তাদের বাড়ির কাজেই আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে? খুলে যাবে তাদের সকলের জীবনের বন্ধ হয়ে যাওয়া সব তালাগুলো?
ইন্দিরাদিদিকে খুব মনে পড়ে বিজুর। এই স্কুলে উনি বছর তিনেক হলো এসেছেন।
এর মধ্যেই ছেলেমেয়েদের সব থেকে প্রিয় দিদিমণি হয়ে উঠেছেন। উনি বাংলা পড়ান। ক্লাসে
পায়চারি করতে করতে পড়ার কবিতাগুলি আবৃত্তি করে শোনাতেন, অদ্ভূত লাগত শুনতে। গোটা ক্লাস
চুপটি করে শুনত। তাদের ক্লাসের হাড় বজ্জাত পানু, যে শেষ বেঞ্চে বসে সারাক্ষণ অন্য
সবার পেছনে লাগত, সেও মুগ্ধ হয়ে শুনত।
ইন্দিরাদিদি সব দিনই ক্লাশে এসে যে পড়াতে শুরু করতেন, তাও নয়। এক এক
দিন ফাঁকিও দিতেন। বলতেন, “তোরা যেমন বাড়িতে পড়া না করে কিংবা ক্লাশে বসে কাটাকুটি
খেলে পড়ায় ফাঁকি দিস, আজ আমিও সেরকম ফাঁকি দেব। আজ আমি শুধু গপ্পো করবো। রোজ রোজ পড়া করতে ভালো লাগে, বল? আজ তাই গপ্পো
হবে।
সে অনেকদিন আগের গল্প। সে সময় আমাদের দেশে বিখ্যাত সব ঋষিমুনিরাই ছিলেন
মাস্টারমশাই। তাঁরাই ছেলেদের পড়াতেন। তখনকার দিনে মাস্টারমশাইকে বলত গুরু আর ছাত্রদের
বলত শিষ্য। এমন একজন গুরু ছিলেন ধৌম্য। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিল উপমন্যু। শিষ্যরা
তখন ঋষিদের আশ্রমেই থাকত, তাঁদের বাড়ির কাজ করে দিত, আবার সময়মতো পড়াও মুখস্থ করত।
ঋষি ধৌম্যর অনেকগুলো গরুবাছুর ছিল, সেগুলোর দেখাশোনার ভার ছিল তাঁর এই শিষ্য উপমন্যুর
ওপর। ভোরবেলা উঠে উপমন্যু রোজ গরুবাছুরগুলোকে নিয়ে মাঠে চরাতে যেত। সন্ধে নামার আগেই
তাদের আবার ফিরিয়ে আনত গুরুর আশ্রমে। সন্তোষ জিজ্ঞাসা করেছিল, “দিদিমণি, উপমন্যু
তার মানে রাখালি করত?” ইন্দিরাদিদি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “ঠিক তাই”।
গরুগুলো তো মাঠে সারাদিন ঘাস-পাতা খেয়ে পেট ভরাত। কিন্তু উপমন্যু
সারাটা দিন কী খাবে? গুরু সেকথা একটুও ভাবতেন না। বেচারা উপমন্যুর ঠিক তোদের মতোই বয়েস।
ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কিচ্ছুটি না খেয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ালে কী রকম খিদে পাবে
বলতো? উপমন্যুরও ভীষণ খিদে পেত, সে এক একদিন এক একটা গরুর দুধ খেয়ে পেট ভরাত। এদিকে
গুরু ধৌম্য খুব অবাক হলেন, ভাবলেন ছেলেটা সারাটাদিন তো কিচ্ছু খায় না, সাতদিনেই তো
তার দুর্বল আর রোগা হাড়জিরজিরে হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সে আগের থেকেও বেশী
স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে কী করে? তিনি উপমন্যুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সারাদিন তুই কী
খাস রে, উপমন্যু?”
তখনকার দিনে লোকে মিথ্যে কথা বলত খুব কম, আর উপমন্যু তো তোদের মতো
ছোট্টছেলে, সে তো মিথ্যে কথা বলতে জানতই না। সে সত্যি কথা বলতেই ঋষি ধৌম্য খুব
বিরক্ত হলেন, বললেন, “না না, এ তোর ভারি অন্যায়, তোর দুধ খাওয়ার জন্যে বাছুরেরা কম
দুধ পাচ্ছে, তারা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আশ্রমেও দুধের ঘাটতি হচ্ছে। কাল থেকে তুই
আর দুধ খাবি না”। গুরুর আদেশে উপমন্যু দুধ খাওয়া বন্ধ করল। কিন্তু খিদে তো বন্ধ
হবার নয়। গরুরা ভরপেট খাওয়ার পর এক জায়গায় বসে জাবর কাটে দেখেছিস তো? সেই জাবর
কাটার সময় দেখবি তাদের মুখ থেকে ফেনা বের হয়। উপমন্যু এবার খিদের জ্বালায় সেই
ফেনাই খেতে লাগল রোজ”। ক্লাশের অনেক ছেলেমেয়েই একসঙ্গে বলে উঠল “ইস্, এ ম্ম্যা”।
ইন্দিরাদিদি মৃদু হাসলেন, বললেন, “খিদে কী ভয়ংকর হতে পারে, সে ধারণা
তোদের কারও কোনোদিন যেন না হয়। প্রচণ্ড খিদেয় মানুষ কত কী যে খায়! সে যাকগে, গরুর
মুখের ফেনা খেয়েই উপমন্যুর দিন কাটতে লাগল। গুরু ধৌম্য কিছুদিন পর আবার লক্ষ্য
করলেন, সারাদিন না খেয়েও উপমন্যু আগের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক রয়েছে। এবার তিনি
উপমন্যুকে ডেকে বেশ ধমকেই বললেন, “হতভাগা তুই এখনও দুধ খাচ্ছিস?” উপমন্যু খুব ভয়ে
ভয়ে সত্যি কথাই বলল। গুরু ধৌম্য বললেন, “ছি ছি এও তোর অন্যায়, উপমন্যু। গরুগুলো
তোকে চেনে, তোকে ভালোবাসে। জাবর কাটার সময় নিজেরা কম খেয়ে তোর জন্যে তারা বেশি করে
ফেনা তোলে রে, হতভাগা! তোর লোভের জন্যে এবার আমার গরুগুলোই দুর্বল হয়ে পড়বে দেখছি।
কাল থেকে তুই ফেনাও খাবি না, দুধও না। কোনভাবেই তুই ওদের বিরক্ত করবি না”।
ইন্দিরাদিদি একটু থেমে স্মিতমুখে ছেলেমেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অনুভব
করলেন, গুরু ধৌম্যের প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা। তিনি আবার শুরু করলেন, “গুরুর আদেশ উপমন্যু
অমান্য করে কী করে? উপমন্যু পরেরদিন দুধ কিংবা ফেনা কিছুই খেল না। কিন্তু খিদে তো গুরুর
আদেশ মানে না। খিদের জ্বালায় উপমন্যু জংলী গাছের কিছু পাতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। সেই পাতার
মধ্যে কিছু ছিল দারুণ বিষাক্ত, সে বিষে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ল, সে অন্ধ হয়ে গেল।
ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, “ইসস্স্”, ইন্দিরাদিদি তাদের মুখে দেখতে পেলেন তীব্র
সমবেদনা।
“সন্ধে হল, বেশ রাতও হয়ে এল। উপমন্যু আশ্রমে ফেরেনি, ফেরেনি আশ্রমের গরুবাছুরগুলিও।
গুরু ধৌম্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন, এমন তো কোনদিন হয়নি। কিছু শিষ্যদের সঙ্গে হাতে মশাল
নিয়ে তিনি মাঠের দিকে রওনা হলেন। মাঠে গিয়ে দেখলেন, গরুগুলি রাতের অন্ধকারে ভয়
পেয়ে একজায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু উপমন্যুর কোন হদিশ নেই। তিনি এবং
তাঁর শিষ্যরা ডাকাডাকি করতে উপমন্যুর সাড়া মিলল। সে পড়ে আছে গভীর এক গর্তের মধ্যে।
গুরু ধৌম্য খুব রেগে গেলেন, চেঁচিয়ে বললেন, “এত রাত অব্দি এখানে কী করছিস, হতভাগা”?
উপমন্যু হাতজোড় করে, খুব মৃদু স্বরে বলল, “বিষাক্ত গাছের পাতা খেয়ে আমি
অন্ধ হয়ে গেছি, গুরুদেব। তারপর এই গর্তে পড়ে গিয়েছি”।
গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, “বিষাক্ত পাতা তুই খেলি কেন?”
“আপনি দুধ কিংবা ফেনা খেতে মানা করেছিলেন, তাই খাইনি। কিন্তু আমার যে
ভীষণ খিদে পেয়েছিল, গুরুদেব...”। সকলে মিলে তাকে গর্ত থেকে তুলে আনার পর গুরু
ধৌম্য উপমন্যুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, “কঠোর সত্যের এমন প্রতিজ্ঞা যার রয়েছে উপমন্যু,
তার আর কোন্ শিক্ষার দরকার হয়? তোর শিক্ষা আজ সম্পূর্ণ হল। আজ থেকে তুই পরম
জ্ঞানী, তোর দৃষ্টি ফিরে আসুক, সে দৃষ্টি হোক আরও উজ্জ্বল, আরও গভীর”।
ইন্দিরাদিদি থামতেই সবাই কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেছিল, “উপমন্যু, সত্যিই সব
শিখে ফেলেছিল। সত্যিই সে ফিরে পেয়েছিল তার দৃষ্টি?” ইন্দিরাদিদি মাথা নীচু করে
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “গল্পে তো তাই বলে”।
পুঁতির মতো চোখওলা জলঢোঁড়া সাপটা আচমকা এক ঝটকায় ধরে ফেলল, ছোট্ট একটা
মাছ। মাছটা ছাড়া পেতে প্রাণপণ ছটফট করছিল
সাপটার মুখে।
“বিজু, কোথায় গেলি, বাবা, আমি যে খাবার বেড়ে বসে আছি...”। মায়ের
ব্যাকুল ডাক কানে এল। বিজু ছোট্ট লাফে মাটিতে পা দিল। তার পায়ের শব্দে সন্ত্রস্ত
সাপটা নিস্তরঙ্গ জলে মৃদু ঢেউ কেটে ডুব দিল গভীরে।
ভয়ংকর খিদেটা বিজু আবার টের পেল সমস্ত শরীরে। বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তার
মনে হল, এই খিদের কথাই কী বলেছিলেন, ইন্দিরাদিদি? স্কুলে না গিয়েও সে কী উপমন্যুর
মতোই সব শিক্ষা পেয়ে যাবে! চাটুজ্জে বাড়ির রাখালি করে আর ইন্দিরাদিদির আশীর্বাদে? গল্পে
নাকি তাই বলে!
-00-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন