[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - ধর্মাধর্ম - ১/৭ ]
প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৮ম ও শেষ পর্বাংশ
১.৭.১
মানুষের বিশ্ববিজয়
এতক্ষণ শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের হোমো স্যাপিয়েন্সদের নিয়েই আমরা
আলোচনা করলাম। কিন্তু তাতে এই মানুষ প্রজাতির অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়ের
অনেকটাই অধরা রয়ে গেল। এই উপমহাদেশ ছাড়াও সমকালীন বিশ্বে এই মানুষদের অদ্ভূত
সাফল্যের কথা এইখানে সংক্ষেপে আলোচনা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কারণ সে প্রসঙ্গ
না টানলে মনে হতে পারে, হোমো স্যাপিয়েন্সদের যত কিছু দবদবা বুঝি শুধু এই দেশেই!
কিন্তু ঘটনা হল, আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে অজস্র মানুষের গোষ্ঠী চারদিকেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। নিচের চিত্র থেকে তাদের সেই দিগ্বিজয়ের চরণ রেখা কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। তার সঙ্গে নিয়াণ্ডারথাল ও হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির মানবদের রাজ্য বিস্তারের দৌড়ও টের পাওয়া যাবে নীচের চিত্র থেকেই। চিত্রে সমুদ্রের নীল রং ছাড়াও তিনটি রং ব্যবহার করা হয়েছে - তাতে ১ নম্বর রংটি হল হোমো স্যাপিয়েন্স প্রভাবিত অঞ্চল এবং তাদের যাত্রাপথ। ২ নম্বর রংটি নিয়াণ্ডারথাল এবং ৩ নম্বরটি হোমো ইরেক্টাস মানব প্রজাতির প্রভাবিত অঞ্চল দেখানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, হোমো স্যাপিয়েন্সদের বেশ কিছু শাখা ইওরোপের দিকে ছড়িয়ে
পড়েছিল আজ থেকে মোটামুটি চল্লিশ হাজার বছর আগে। প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে কিছু
মানুষ ঢুকতে শুরু করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। সেই শাখার বেশ কিছু মানুষ চলে গিয়েছিল
উত্তরে মধ্য এশিয়ায়, এবং
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার বছর আগে তারা সেখানেই স্থিতু হয়েছিল। কিছু মানুষ আমাদের
এই উপমহাদেশ পার হয়ে আরও পূর্বদিকে সরে গিয়ে নেমে গেল ইন্দোনেশিয়ার দিকে। সেখান
থেকে তারা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে পৌঁছে গিয়েছিল
অষ্ট্রেলিয়ায়। যদিও নিউজিল্যাণ্ড পৌঁছতে তাদের সময় লেগে গিয়েছিল অনেকটাই - আরও
প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হাজার বছর। ওদিকে মধ্য এশিয়ার দিকে রওনা হওয়া শাখার একটি
উপশাখা উত্তরপূর্ব দিকে রওনা হয়ে, রাশিয়ার ভয়ংকর তুন্দ্রা-সাইবেরিয়া অঞ্চল পার হয়ে পৌঁছে
গিয়েছিল আলাস্কায়। আজ থেকে প্রায় পনের-ষোলো হাজার বছর আগে ওই মানুষের দল পিছন দিকে
না ফিরে,
নেমে গেল
সোজা দক্ষিণ দিকে। আলাস্কা থেকে পরবর্তী তিন-চার হাজার বছরে তারা নেমে গেল এখনকার
কানাডা, উত্তর আমেরিকায়। তারা
সেখানেও থেমে রইলো না, এরপর
আরও হাজার দুয়েক বছরের মধ্যে তারা পৌঁছে গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দু
- তিয়েরা ডেল ফুয়্যাগো দ্বীপেও!
অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় আদিম মানুষের এই উপনিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টি এতই
আশ্চর্যের যে তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে আধুনিক বিজ্ঞানী মহল হিমসিম খেয়ে
গিয়েছিলেন। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে, সেই মানুষদের বেশ কয়েকটি সমুদ্র চ্যানেল পার হতে হয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকটি একশ
কিলোমিটারের বেশি চওড়া। তার ওপর সেখানে পৌঁছেই, সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তুতন্ত্রের
সঙ্গে প্রায় রাতারাতি, তাদের
মানিয়ে নিতে হয়েছিল।
১.৭.২
অষ্ট্রেলিয়া বিজয়
অষ্ট্রেলিয়া বিজয়ের পক্ষে বিজ্ঞানীদের সবথেকে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা
থেকে আমরা যে ইঙ্গিত পাই, সেটি হল, আজ থেকে প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে ইন্দোনেশিয়
দ্বীপপুঞ্জে (এশিয়া থেকে এবং নিজেদের থেকেও বিচ্ছিন্ন একগুচ্ছ দ্বীপ, যাদের মধ্যে সরু সরু
প্রণালী আছে) যে স্যাপিয়েন্সরা বাস করত, তারাই প্রথম ‘সাগর অভিযান’ সমাজের বিকাশ ঘটিয়েছিল। তারা
শিখে ফেলেছিল,
সমুদ্রে
যাওয়ার মতো বড়ো নৌকা কীভাবে নির্মাণ এবং চালনা করতে হয়। যে শিক্ষায় তারা বহু দূরে
যাওয়া জেলে,
ব্যবসায়ী
এবং অভিযাত্রী হয়ে উঠেছিল। অতএব এই অসাধারণ দক্ষতা ওই অঞ্চলের মানুষদের জীবনধারায়
অভূতপূর্ব এক বদল এনে দিতে পেরেছিল।
এ প্রসঙ্গে আরেকবার মনে করিয়ে দিই, সেই সময় পৃথিবীতে চলছিল শেষ তুষার
যুগ। বিজ্ঞানীরা বলেন, বিগত
দশলক্ষ বছরে,
মোটামুটি
একলক্ষ বছর অন্তর একটি করে তুষার যুগ এসেছিল। সেই তুষার যুগের পর্যায়টি চলত
মোটামুটি ষাট-সত্তর হাজার বছর ধরে। শেষ যে তুষার যুগের হদিশ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, সেটি শুরু হয়েছিল
মোটামুটি পঁচাত্তর হাজার বছর আগে এবং শেষ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পনের হাজার বছর
আগে। এর মধ্যে আবার অন্ততঃ দুবার তীব্র শীতের পর্যায় গিয়েছিল – প্রথমটি সত্তর
হাজার বছর আগে এবং দ্বিতীয়টি আজ থেকে প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগে।
অতএব পঁয়তাল্লিশ হাজার বছর আগে, ধরে নেওয়া যায়, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ
থেকে অষ্ট্রেলিয়া পৌঁছতে যে সমুদ্র তাদের পার হতে হয়েছিল, তার গভীরতা এখনকার সমুদ্রতল (sea level) থেকে অনেকেটাই নীচুতে
ছিল। এর সঙ্গে আরও অনুমান করা যায়, সেই সময়কার সমুদ্র পথে তারা আরো অনেক ছোট ছোট দ্বীপের
সন্ধান পেয়েছিল। যে দ্বীপগুলিতে তারা কয়েক মাস বা বছর বিশ্রাম নিয়ে, পানীয় জল এবং খাদ্যও
সংগ্রহ করতে পেরেছিল। এমনকি এই দ্বীপগুলির জঙ্গলের কাঠ দিয়ে তাদের নৌকাগুলির
মেরামতির কাজও হয়তো তারা করতে পেরেছিল। এইভাবেই একের পর এক দ্বীপ পার হতে হতে, নিছক কৌতূহল বশেই হোক
অথবা পিছনে মানুষের দলের প্রবল স্রোত প্রবাহেই হোক - তারা পৌঁছে গিয়েছিল নতুন এক
মহাদেশে,
যার নাম
আমরা দিয়েছি অষ্ট্রেলিয়া।
বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যার সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক কোন প্রমাণ পাওয়া আর
এখন সম্ভব নয়। কারণ ইন্দোনেশিয়ার সেই প্রাচীন তটরেখা এখন প্রায় একশ মিটার গভীর
সমুদ্রের তলায়। অতএব ওই আদিম নাবিকদের কোন গ্রাম, বা তাদের বানানো কাঠের ভেলা বা
নৌকার ভগ্নাবশেষ, অথবা
তাদের ব্যবহার করা পাথরের যন্ত্রপাতির জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া প্রায় অসাধ্য।
ওই মানুষদের অনেকগুলি দল যে ওই সময় অষ্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে
তুলেছিল তার আরেকটি ভয়ংকর প্রমাণ বিজ্ঞানীরা উপস্থাপিত করেছেন। সেটি হল, ওই সময়ের পরেই, অর্থাৎ মানুষ ওই মহাদেশে
পা ফেলার পর থেকেই শুরু হয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার বাস্তুতন্ত্রের আমূল বিপর্যয়।
অ্যাফ্রো-এশিয়া মহাদেশের জঙ্গল এবং সেই জঙ্গলের অজস্র প্রাণী দেখতে যে মানুষের দল
এতদিন অভ্যস্ত ছিল, তারা
অষ্ট্রেলিয়ার মতো বিচ্ছিন্ন মহাদেশের অদ্ভূত এবং অচেনা প্রাণীদের দেখে এতটাই
আশ্চর্য হল,
যে তাদের
নির্বংশ করাতেই তারা যেন মনোনিবেশ করেছিল।
এই প্রাণীদের মধ্যে ছিল, প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম ওজনের ২ মিটারের ক্যাঙারু। ওই
মহাদেশের সব থেকে বড় শিকারী পশু ছিল মারসুপিয়াল সিংহ, যার আয়তন ছিল আধুনিক বাঘের মতোই।
বেশ বড়ো আকারের নিরীহ কোয়ালা। অস্ট্রিচের থেকে প্রায় দ্বিগুণ আকারের উড়তে না জানা
পাখি। ড্রাগনের মতো বড়ো বড়ো টিকটিকি এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে সরসরিয়ে চলে যাওয়া পাঁচ
মিটার লম্বা সাপ। দৈত্যের মতো বিশাল ডিপ্রোটোডন (diprotodon) এবং আড়াই টন ওজনের
ওমব্যাট (wombat)। পাখি আর সরীসৃপ ছাড়া, এই সমস্ত স্তন্যপায়ী
প্রাণীই ছিল মারসুপিয়াল – ক্যাঙারুর মতোই তারা অসহায়, ছোট্ট ভ্রূণের মতো বাচ্চাদের জন্ম
দেয় এবং বাচ্চারা পেটের কাছে ছোট্ট একটা থলিতে থেকে মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয়।
মারসুপিয়াল প্রাণী এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চলে প্রায় বিরল, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় তাদেরই ছিল
একচ্ছত্র রাজত্ব।
মানুষ পৌঁছবার কয়েক হাজার বছরের মধ্যে, আক্ষরিক অর্থেই, এই বিশাল বিশাল প্রাণীরা
অদৃশ্য হয়ে গেল। পঞ্চাশ কিলোগ্রাম বা তার বেশি ওজনের চব্বিশটি প্রজাতির প্রাণীর
মধ্যে, তেইশটাই অবলুপ্ত হয়ে গেল।
ছোট প্রজাতির আরও অনেক প্রাণীর একই দশা ঘটেছিল। মানুষের হঠাৎ উপস্থিতি, অস্ট্রেলিয়ার সেই সময়ের
সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খলটাকেই ভেঙে দিয়েছিল এবং প্রকৃতিকে নতুন ভাবে গড়ে
উঠতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন বাস্তুতন্ত্রে এই সময়েই ঘটেছিল
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
১.৭.৩
আমেরিকা বিজয়
অস্ট্রেলিয়ার মহাপ্রাণীসম্ভারের অবলুপ্তি, পৃথিবীর বুকে রেখে যাওয়া, হোমো স্যপিয়েন্সদের
সম্ভবত প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষতচিহ্ন। এর পরে তারা এর থেকেও বড় বস্তুতন্ত্রের
বিপর্যয় ঘটিয়েছিল আমেরিকায়। হোমো স্যাপিয়েন্সরা হল একমাত্র এবং প্রথম মানব জাতি
যারা প্রায় ১৬,০০০ বছর আগে পশ্চিম
গোলার্ধের ভূখণ্ডে পৌঁছেছিল, তার মানে মোটামুটি ১৪,০০০ বি.সি.ই-তে। তুষার যুগের এই
শেষ পর্যায়ে,
সমুদ্রতল
অনেকটাই নীচুতে ছিল। যার ফলে একটি ভূমি সেতু উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়াকে উত্তর-পশ্চিম
আলাস্কার সঙ্গে যুক্ত করেছিল। আর সেই পথেই তারা পায়ে হেঁটেই আলাস্কা পৌঁছতে
পেরেছিল।
এমন নয় যে এই যাত্রা খুব সহজ ছিল, বরং অত্যন্ত দুঃসাধ্য, হয়তো অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র
অভিযানের থেকেও কঠিন। এই পথে যাওয়ার সময় স্যাপিয়েন্সদের প্রথমেই, উত্তর সাইবেরিয়ার সুমেরু
অঞ্চলের চরম জলবায়ু-পরিস্থিতি সহ্য করতে শিখতে হয়েছিল, যেখানে শীতকালে কোনদিন সূর্যের
মুখ দেখা যায় না এবং তাপমাত্রা মাইনাস পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়।
এর আগে কোন মানব প্রজাতিই উত্তর সাইবেরিয়ার মতো জায়গা জয় করতে সক্ষম
হয়নি। এমনকী,
যে
নিয়াণ্ডারথালরা শৈত্য সহ্য করায় বিশেষ পারদর্শী ছিল, তারাও দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ
অঞ্চলেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্স, যাদের শরীর, তুষার এবং বরফের দেশের
জন্যে আদৌ উপযুক্ত নয়, বরং
আফ্রিকার সাভান্না অঞ্চলের জন্যে অভিযোজিত হয়েছিল, তারা এই পর্যায়ে অসাধারণ
উদ্ভাবনীশক্তির পরিচয় রাখতে পেরেছিল।
স্যাপিয়েন্সদের সংগ্রাহী গোষ্ঠী ঘুরতে ঘুরতে শীতল আবহাওয়ার দিকে যত
এগিয়েছিল,
তারা শিখে
নিয়েছিল তুষার-জুতো (snow shoe) এবং বেশ কিছু পশুলোম এবং চামড়ার পরতকে সূচ দিয়ে শক্ত সেলাই করা গরম
পোশাক বানাতে।তারা বেশ কিছু নতুন অস্ত্র
এবং শিকারের অভিনব কৌশলও উদ্ভাবন করেছিল, যা দিয়ে তারা সুদূর উত্তরের ম্যামথ এবং অন্য বড় প্রাণীদের
তাড়া করে শিকার করতে সমর্থ হয়েছিল। তাদের গরম পোশাক এবং শিকারের কৌশলে যত উন্নতি
হতে লাগল,
হিম শীতল
অঞ্চলের গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার সাহসও স্যাপিয়েন্সদের বাড়তে লাগল। উত্তর দিকে চলতে
চলতে তাদের পোশাক, তাদের
শিকারের কুশলতা এবং বেঁচে থাকার অন্যান্য দক্ষতারও উন্নতি হতেই থাকল। সুনগিরে[1] পাওয়া নানান প্রত্ননিদর্শন
থেকে স্পষ্টতঃ বোঝা যায়, ওই মানুষদের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল, সঙ্গে এসেছিল সূক্ষ্ম
শিল্পবোধও।
কিন্তু তারা কেন এত ঝামেলার মধ্যে গেল? ইচ্ছে করে কেন নিজেদের সাইবেরিয়ায়
নির্বাসন দিল?
হয়তো কোন
দলের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তারা উত্তরদিকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল, জনসংখ্যার চাপ অথবা
প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কেউ কেউ হয়তো উত্তরদিকে যেতে প্রলুব্ধ হয়েছিল ওই অঞ্চলের
সহজলভ্য ও সুস্বাদু প্রাণীজ প্রোটিনের জন্যে। সুমেরু ভূখণ্ডে বড়ো বড়ো, অজস্র রসাল প্রাণী, যেমন রেইনডিয়ার এবং
ম্যামথ, চরে বেড়াত। প্রত্যেকটা
ম্যামথ ছিল বিপুল পরিমাণ মাংসের উৎস (ওই অঞ্চলের তাপমাত্রায়, যে মাংস পরে খাবার জন্যেও
হিমায়িত করে রাখা চলত), তার সঙ্গে ছিল সুস্বাদু চর্বি, গরম পশুলোম এবং মূল্যবান দাঁত ও
হাড়।
সময় যত গড়াতে লাগল, ম্যামথ, ম্যাস্টোডন, গণ্ডার এবং রেইনডিয়ারের পিছু পিছু, তাদের দল আরও দূরে ছড়িয়ে পড়তে
লাগল। মোটামুটি ১৪,০০০
বি.সি.ই-তে এরকমই তাড়া করতে করতে, তাদেরই কোন একটা দল উত্তরপূর্ব সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কায়
গিয়ে পৌঁছল। তারা অবশ্যই জানত না যে তারা নতুন একটা মহাদেশ আবিষ্কার করতে চলেছে।
ম্যামথ এবং মানুষ দুজনের কাছেই আলাস্কা ছিল সাইবেরিয়ারই সংযোজিত অংশ।
শুরুর দিকে আলাস্কা থেকে আমেরিকার বাকি অংশে যাওয়ার রাস্তাটা হিমবাহের
জন্যে বন্ধ ছিল,
সে পথে আরও
দক্ষিণে ক্বচিৎ কয়েকজন পথিকৃৎ হয়তো তদন্ত করতে যেতে পেরেছিল। কিন্তু তারপরে, মোটামুটি ১২,০০০ বি.সি.ই-র বিশ্ব
উষ্ণায়নের সময়,
হিমবাহের
বরফ গলে গিয়ে সহজ এক রাস্তা খুলে গেল। এবং নতুন এই অলিন্দপথ ব্যবহার করে মানুষ দলে
দলে দক্ষিণে ঢুকতে লাগল এবং সমগ্র মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
এই মানুষগুলো যদিও সুমেরু অঞ্চলের প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বড়ো বড়ো পশু
শিকার করে বহু বছর অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তারাই এখন জলবায়ু এবং বাস্তুতন্ত্রের বিস্ময়কর
বৈচিত্রের সঙ্গেও চটপট মানিয়ে নিল। সাইবেরিয়ানদের উত্তরসূরিরা পূর্ব মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের গহন জঙ্গলে, মিসিসিপি ব-দ্বীপের জলাভূমিতে, মেক্সিকোর মরু অঞ্চলে এবং মধ্য
আমেরিকার উষ্ণ বনাঞ্চলে অনায়াসে স্থিতু হয়ে গেল। তাদের মধ্যে কেউ অ্যামাজন
অববাহিকার নদী জগতে বাসা বানিয়ে তুলল, আরও কেউ আন্দিজ পর্বতমালার উপত্যকায় অথবা আর্জেন্টিনার
মুক্ত পম্পাস তৃণাঞ্চলে শিকড় গাড়ল। এবং এই সব কিছুই ঘটে গেল এক-দু’হাজার বছরের
মধ্যে! ১০,০০০ বি.সি.ই-র মধ্যে
আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্তেও মানুষ বসবাস করত, তিয়েরা ডেল ফুয়্যাগো দ্বীপে, এই মহাদেশের দক্ষিণতম
বিন্দু।
গোটা আমেরিকা জুড়ে মানুষের এই ঝোড়ো অভিযান, হোমো স্যাপিয়েন্সদের অতুলনীয়
উদ্ভাবনী শক্তি এবং মানিয়ে নেওয়ার অদম্য
ক্ষমতাকেই প্রমাণ করে। বাস্তবিক, সর্বত্রই সেই একই জিন ব্যবহার করে, অন্য কোন প্রাণী কোনদিন এমন বিপুল
বৈচিত্র্যময় এবং সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা পরিবেশে এত দ্রুত পৌঁছে যেতে পারেনি।
আমেরিকায় বসতি স্থাপনও রক্তপাতহীন হয়নি, তারা পিছনে ফেলে রেখে গেছে অজস্র
হত্যার দীর্ঘ পথচিহ্ন। আমেরিকার প্রাণী সম্ভার ১৪,০০০ বছর আগে, এখনকার তুলনায় অনেক
সমৃদ্ধ ছিল। আলাস্কা থেকে দক্ষিণে কানাডার সমতলভূমি এবং ইউনাইটেড স্টেট্সের
পশ্চিম দিক ধরে চলার পথে, প্রথম আমেরিকানরা যাদের মুখোমুখি হল, তারা হল - ম্যামথ এবং
ম্যাস্টোডন,
বিশাল
আকারের ভালুক,
ঘোড়া আর
উটের পাল,
বিপুল
চেহারার সিংহ এবং আরো ডজন খানেকের ওপর বড় প্রজাতির প্রাণী, যাদের কথা আমরা আজ জানিই না।
তাদের মধ্যে ছিল ভয়ংকর সেবার-টুথ বেড়াল এবং দৈত্যাকার স্থল-শ্লথ, যাদের ওজন হত আট টন
পর্যন্ত এবং উচ্চতায় ছ মিটার পর্যন্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় ছিল এর থেকেও বেশি অদ্ভূত ও
বিশালকায় স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ এবং পাখিদের সংগ্রহশালা। আমেরিকা যেন বিবর্তনের
পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশাল এক গবেষণাগার ছিল, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় অজানা
বহুপ্রাণী এবং উদ্ভিদের এখানে বিবর্তন হয়েছে এবং শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে।
কিন্তু স্যাপিয়েন্সরা পৌঁছনোর ২০০০ বছরের মধ্যে ওই সব অনন্য প্রজাতির অধিকাংশ প্রাণীই লুপ্ত হয়ে গেল। আজকের অনুমান অনুযায়ী, সাতচল্লিশটি গোত্রের বড় স্তন্যপায়ীর মধ্যে উত্তর আমেরিকা সাঁইত্রিশটিই হারিয়ে বসল, খুব কম সময়ের মধ্যে। দক্ষিণ আমেরিকা হারাল ষাটটির মধ্যে পঞ্চাশটি। ৩০ মিলিয়ন বছর ধরে, যারা বেশ ভালভাবেই বেঁচে বর্তে ছিল, সেই সেবার-টুথ বেড়াল অদৃশ্য হয়ে গেল এবং একই ব্যাপার ঘটল দৈত্যাকার স্থল-শ্লথদের, বিশালাকার সিংহের, আমেরিকার দেশী ঘোড়া এবং উট, দৈত্যাকার রোডেন্ট এবং ম্যামথদের ক্ষেত্রেও। কয়েক হাজার প্রজাতির ছোট স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, পাখি এমনকি কীটপতঙ্গ এবং পরজীবিরা (ম্যামথরা যখন অবলুপ্ত হল, ম্যামথের গায়ে বসা এঁটুলি জাতীয় যত কীট তারাও তাকেই অনুসরণ করল) অবলুপ্ত হল।
১.৭.৪
কী আছে মানুষে, যা আর কারও নেই?
আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে থেকে এই চোদ্দ হাজার বছর আগে
পর্যন্ত,
প্রায় ষাট
হাজার বছর ধরে,
আদিম
মানুষদের সভ্য হয়ে ওঠার পর্বগুলো আমি কল্পনায় পুনর্নির্মাণ করতে চেষ্টা করলাম। তার
সঙ্গে জানলাম তাদের বিশ্বজয়ের (অজস্র প্রাণীর রক্ত লিপ্ত) গৌরব গাথা। অন্য আর কোন
প্রাণী নেই,
যারা
প্রকৃতিতে মানুষের মতো এমন দুর্জয় সাফল্য পেয়েছে। মানুষের পূর্বসুরী মানব
প্রজাতিগুলিও এই সময়ের মধ্যে চলে গেছে অবলুপ্তির পথে। ইরেক্টাস প্রজাতির সামান্য
কিছু মানব গোষ্ঠী তখনো টিকে ছিল। তাদেরও অবলুপ্তি হবে হাজার দুয়েক বছরের মধ্যেই!
কী সেই বৈশিষ্ট্য যা মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও নেই? মানুষের সেই অনন্য বিশেষত্ব নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা চলে যাবো পরবর্তী পর্বে।
১. যে কোন পরিবেশে মানিয়ে
নেওয়াঃ
প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার সাভান্না অরণ্য থেকে মানুষ (homo sapiens)-এর অজস্র গোষ্ঠী একের পর
এক বেরোতে শুরু করেছিল। বিষুবীয় ক্রান্তিমণ্ডলের গ্রীষ্মপ্রধান সাভান্না অঞ্চলের
স্বাভাবিক বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাদের অতি উষ্ণ মরু অঞ্চল থেকে তুষারাবৃত
সুমেরীয় তুন্দ্রা অঞ্চলের পরিবেশে মানিয়ে নিতে তেমন কিছু অসুবিধে হয়নি।
পৃথিবীতে বহু স্থলচর প্রাণীই বিবর্তিত হয়ে নানান পরিবেশগত প্রতিকূলতার
সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিবর্তিত হয়ে পরিবেশের উপযুক্ত হতে তাদের সময়
লেগেছে লক্ষ লক্ষ বছর। সেখানে এতটুকু বিবর্তিত না হয়েও, অর্থাৎ জিনগত কোন পরিবর্তনের
তোয়াক্কা না করে, মানুষ
সব পরিবেশেই সামান্য কয়েক হাজার বছরের মধ্যে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিল।
বেশি শীতে নিজেদের মানিয়ে নিতে শরীরে বাড়তি লোম গজিয়ে ওঠার অপেক্ষায়
মানুষ বিবর্তনের ভরসায় থাকেনি। পরিবেশে শৈত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা শরীরে
চাপিয়েছে পশুর লোমশ চামড়া। আজও আমরা কলকাতা বা চেন্নাই থেকে রাশিয়া বা
সুইজারল্যাণ্ড যেতে যা করে থাকি - বারমুডা আর গেঞ্জি ছেড়ে কোট-ওভারকোট পরে সে দেশে
যাই, ফিরে এসে আবার বারমুডা আর
গেঞ্জিই পরি। এমন কী নিল আর্মস্ট্রং এবং এডুইন অ্যালড্রিনকেও চাঁদে হাঁটাহাঁটি
করার জন্যে বিশেষ কিছু পোষাক পরতে হয়েছিল। চাঁদে যাওয়ার জন্যে তাঁদের শরীরে কোন
বিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি এবং দেশে ফিরে তাঁদের আবার জিন্স্ আর টিশার্ট পরতেও কোন
অসুবিধে হয়নি।
পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রকৃতিজাত দ্রব্যকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের বিচক্ষণতাই প্রাণী জগতে মানুষকে অনন্য করে তুলেছে।
২. খাবারে নেই বাছবিচারঃ
শুধু যে আবহাওয়ার প্রতিকূল ঠাণ্ডা-গরমকে তারা জব্দ করতে পেরেছিল এবং পেরেছে, তা নয়, তারা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচিত্র খাদ্য যোগাড় করেও স্বচ্ছন্দে সুস্থ-সবল থেকেছে। শাক-সব্জি, ফলমূল, শস্য তো আছেই, তার সঙ্গে আছে প্রাণীজ খাদ্য। স্থলচর, উভচর, জলচর, সরীসৃপ, খেচর – এক কথায় কেঁচো থেকে ম্যামথ এবং উইপোকা থেকে তিমি, কোন কিছুই তাদের খাদ্য তালিকার বাইরে নয়। এখানেও বিচিত্র খাদ্য অনুযায়ী বিচক্ষণ রন্ধন প্রণালী আবিষ্কারই তাদের অন্য প্রাণীদের থেকে সুদূর দূরত্ব গড়ে দিয়েছে[2]।
৩. যে কোন জিনিষকে কাজে লাগানোঃ
মানুষ যত পেশীবহুল কিংবা শক্তিধরই হোক না কেন, শারীরিক শক্তিতে বহু প্রাণীর
তুলনায় তারা অত্যন্ত দুর্বল। মানুষের নখ কিংবা দাঁত কোনটাই ভালো শিকারীর উপযুক্ত
কোনদিনই নয়। সত্যি কথা বলতে, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরা শিকারীর থেকেও আসলে অনেক বেশি
বিচক্ষণ সংগ্রাহক ছিল। কুড়িয়ে পাওয়া খুব সামান্য জিনিষকেও, সে পাথরখণ্ড হোক, বা গাছের ভাঙা ডাল, নিজের সঠিক প্রয়োজনে
ব্যবহার করতে পারত। নানারকম পাথরের মধ্যে বিশেষ বিশেষ পাথরকে বিশেষ স্তরে ভেঙে
তারা তীক্ষ্ণ ফলা তৈরি করতে পারত। নিরীহ কাঠ কিংবা বাঁশের সঙ্গে পাথরের ফলা জুড়ে
কী ভাবে একটা মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করা যায়, সে বিচক্ষণতা তাদের ছিল বলেই তারা
সফলতম শিকারী হয়ে উঠেছিল। কুড়িয়ে পাওয়া জিনিষ সংগ্রহ করে এবং তার সামান্য কিছু
রদবদল করে শুধু অস্ত্র-শস্ত্রই নয়, আরও অনেক কিছু তারা বানিয়ে ফেলতে পারত। যেমন ঢাক, পশুর শিং থেকে শিঙা, শুকনো লতার তন্তু থেকে
দড়ি, শুকনো পাতা দিয়ে ঝোলা, শুকনো পাতা দিয়ে, কিংবা পশু চামড়া থেকে
পোশাক, জুতো আরও কত কী। আরও পরে
কাদা মাটি ছেনে,
রোদে শুকিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, তারা তৈরি করেছে নানান
বাসনপত্র,
নানান
পুতুল। বাঁশ বা কাঠের ভেলা, বড়ো নৌকা বানিয়েছে নদী – এমনকি সাগর পারাপার করতে!
একমাত্র মানুষই পারে, খুব সাধারণ উপাদান থেকে অসাধারণ উপযোগী জিনিষ বানিয়ে তুলতে।
৪. আগুন নিয়ে খেলাঃ
মানুষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল আগুন। এই পর্বের অনেকটা জুড়েই আছে মানুষের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করার কাহিনী। এর পরের পর্বগুলিতে দেখবো আগুনের আরো ব্যাপক ব্যবহার।
৫. অনন্য এক ভাষাঃ
উপরের সব কটি কৃতিত্বের পরেই মানুষের আরেকটি অন্যতম প্রধান উপকরণ হল ভাষা। এই ভাষার কথা সবিস্তারে বলেছি, এই পর্বেই ১.৩.১ ও ১.৩.২ অধ্যায়ে। অতএব তার পুনরাবৃত্তি করার মানে হয় না।
৬. যৌথ সমাজঃ
প্রাথমিক ভাবে অন্যান্য যূথবদ্ধ প্রাণীদের মতোই মানুষও পরিবারভিত্তিক
দল বেঁধে বাস করত। অর্থাৎ একটি পরিবারের সকলেই ঘনিষ্ঠ রক্তসম্পর্কিত ছিল, যেমন আজও গরিলা, শিম্পাঞ্জী কিংবা হাতিদের
মধ্যে দেখা যায়। এই গ্রহে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা এই প্রথা ভেঙে, প্রজননের জন্যে পরিবারের
বাইরের মানুষকে,
পরিবারে
অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। এই নতুন প্রথায় তাদের একদিকে যেমন নতুন প্রজন্মের মধ্যে
বৈচিত্র্য বাড়তে লাগল, তেমন
দুই বা ততোধিক পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়ল। ফলতঃ একটিমাত্র দলের সীমিত ক্ষমতা, বহুগুণ বেড়ে গেল বহুদলীয়
যৌথ ক্ষমতায়। ক্ষমতা বলতে এখানে শুধু বাহুবল নয়, বহুজনের বুদ্ধি ও বিবেচনার মিলিত
শক্তিকেও বোঝাতে চাইছি। উদাহরণে বলা যায়, মানুষ যতদিন একক পরিবারের দল হিসেবে শিকার করত, তারা বড়ো শিকার করতে খুব
একটা সাহস পায়নি। কিন্তু যখন বহুদল মিলে যৌথ শিকার শুরু করল, তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল
হাতি, ম্যামথ, নীলগাই বা বাইসনের মতো
বড়ো পশুর দল।
বৃহত্তর স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, নিজেদের কিছু কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করার বিচক্ষণতাও একমাত্র মানুষই দেখাতে পেরেছিল।
৭. কূটনৈতিক বুদ্ধিঃ
বহুদলীয় সামাজিক কাঠামোতে একদিকে যেমন অনেক সুবিধে হল, তেমনি অনেক জটিলতাও বাড়ল। আরো সঠিক বললে, এই সমাজ ব্যবস্থা মানুষের বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতাকে আরো শাণিয়ে তুলল। আলাদা আলাদা সংস্কৃতির অনেকগুলি দলের মানুষকে দীর্ঘদিন একজোট রাখা বড়ো সহজ কাজ নয়। প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব স্বার্থ মোটামুটি অটুট রেখে যৌথ স্বার্থের জন্যে একত্রে কাজ করতে লাগে অনেক কূটনীতি, রাজনীতি এবং কুশলী নেতৃত্ব। একটি দলের সহজ সরল একমাত্রিক সংস্কৃতি থেকে বহুদলীয় জটিল সংস্কৃতি পরিচালনার দক্ষতা, তাদের আরও বৃহত্তর সমাজ গড়ে তোলার আত্মবিশ্বাস দিল।
৮. অবাস্তবে আস্থাঃ
এই প্রসঙ্গেও সবিস্তারে আলোচনা করেছি, এই পর্বের ১.৪.১, ১.৪.২ ও ১.৪.৩ অধ্যায়ে। তার সঙ্গে সামান্য কিছু কথা যোগ করতে চাই। অবাস্তবে আস্থা এক অদ্ভূত অনুঘটক। কিছু বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীল মানুষ সাধারণের মনে এই আস্থা, বিশ্বাস বা নির্ভরতার বীজ যদি একবার রোপণ করতে পারেন, তার ফল হয় চমকপ্রদ। এই আস্থা থেকেই আসে গণ-সহযোগীতার মানসিকতা। এ প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে আসবে পরবর্তী পর্বগুলিতে।
৯. নিষ্ঠুরতা, সহমর্মীতা অর্থাৎ দ্বিচারীতাঃ
মানুষের মত যে কোন দলবদ্ধ প্রাণীর মনেই সহমর্মীতা থাকে, তা নাহলে তো দলই গড়ে উঠত
না। কিন্তু উদাসীন সহমর্মীতা মানুষের অনবদ্য একটি বৈশিষ্ট্য। ছাগলের হাড় চুষে
মজ্জার মজা নিতে নিতেও, তার অসহায় ছানাদের কথা তারা চিন্তা করে, “আহা রে, ওদের কী কষ্ট, বাপ-মা কেউ নেই!” ছাগল
শিশুকে পরম আদরে লালন করে, মানুষই নধর করে তোলে। তারপর নিজের সুবিধে মতো দিনে, পরম তৃপ্তিতে তার মাংস
থেকে নিজেদের শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন আহরণ করে। তার চামড়া দিয়ে বানায় শীতের
পোষাক।
সভ্য শিক্ষিত মানুষ আজও নৃশংসভাবে ধর্ষিতা কন্যার প্রতি সমবেদনায়
মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়। অপরাধীর চরম শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। এই
প্রতিবাদী হুজুগ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মহানন্দে রেস্তোরাঁয় যায় বা
সিনেমা দেখে। কিংবা কোহলির ব্যাটিংয়ের সূক্ষ্মতার চুলচেরা বিচারে মত্ত হয়। আবার
কয়েকমাস বা কয়েক বছর পর সেই অপরাধীদের বিচারে ফাঁসির মতো চরম শাস্তি হলেও, তারা সামাজিক মাধ্যম
তোলপাড় করে তোলে। “মৃত্যুদণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতা”, “একটু নরম সরম শাস্তিও দেওয়া যেত”।
“মৃত্যুদণ্ড এ সমস্যার সমাধান নয়”। ইত্যাদি।
কয়লা পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে তারা সেমিনারে সেমিনারে গলা ফাটায়।
জঙ্গল সাফ করে তৈরি উৎকৃষ্ট কাগজের হাজার হাজার পাতায় তারা রিসার্চ রিপোর্ট তৈরি
করে। কিন্তু সেমিনার হলে দৈবাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ কিছুক্ষণের জন্যেও বন্ধ হয়ে গেলে, বিক্ষোভে সবাই হাহাকার
করে ওঠে। কয়লা পোড়ানো বিদ্যুতে এসি না চললে, আলো না জ্বললে, পরিবেশ সচেতন
বিজ্ঞানীদের দম বন্ধ হয়ে আসে।
এই উদাসীনতা থেকেই মানুষ বহুক্ষেত্রে অকারণ নৃশংস নিষ্ঠুরও হয়ে উঠতে
পারে। এলাকা অধিকারের জন্যে পশুরাও নিজেদের মধ্যে লড়াই করে, কিন্তু তারা বিপক্ষকে
নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বড় একটা করে না। শত্রুর অবশেষ না রাখার মানসিকতা মানুষের
আরেকটি বৈশিষ্ট্য। শুধুমাত্র শত্রু বা প্রতিপক্ষ নয়, দীর্ঘদিনের অতি পরিচিত সহবাসী, প্রতিবেশী এবং
জ্ঞাতিভাইদেরও তারা গণহত্যায় নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়। তার কারণ কখনো ব্যক্তিগত
স্বার্থ,
কখনো
সম্পদের অধিকার,
কখনও
রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভেদ, এমনকি কখনো, ত্বকের তুচ্ছ রঙ!
অতএব শুধু দ্বিচারীতা নয়, বহুচারীতাও মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রগুণ।
১.৭.৫
সম্পন্ন ভবিষ্যতের আশা
এতক্ষণ যা কিছু জানলাম, তাতে মনে হয়, প্রাথমিকভাবে মানুষ বেশ কষ্টে-সৃষ্টে এবং ভয়ে-সন্ত্রাসেই
কাল কাটাত। জঙ্গলে শিকার বা খাদ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাণ হাতে করে টই-টই করে ঘুরে
বেড়ানো। এই বুঝি বাঘ বা হাতির দল এসে তাদের শেষ করে দিল। এই বুঝি অন্য মানুষের দল
হামলা করল। আকাশে মেঘ দেখলেই মনে হত, এই বুঝি ঝড়ে-ঝঞ্ঝায় তছনছ হয়ে গেল তাদের হালকা-পলকা বাসা।
গ্রীষ্মের দাবদাহে, দূরের
অরণ্যে দাবানলের আগুন চোখে পড়লে মনে হত, আমাদের কী হবে?
এখন সবকিছুই অনেক সাবলীল। জগতে তারা আর একলা নয়, তাদের সঙ্গে আছে বিশাল এক
সমাজ । খাদ্য যোগাড়ের সমস্যাও এখন অনেক
সহজ। একদিকে আছে গণ শিকার থেকে ভাগ পাওয়া প্রচুর পশুমাংস। তার ওপর মোটামুটি আন্দাজ
হয়ে গেছে প্রকৃতির নিয়ম – ঝড়-বৃষ্টি, শৈত্য কিংবা উষ্ণ প্রবাহ। অন্য দিকে বশে আনা গেছে কিছু
কিছু শস্য,
কিছু কিছু
পশুকে। পোষ্য কুকুরদের ভরসা করে, উদ্বিগ্ন রাতগুলোতেও আজকাল আর বিনিদ্র থাকতে হয় না। দূর
হয়েছে অন্ধকারের ভয়, ঘরে
ঘরে আজ দীপ জ্বলে। আজকাল জীবনে এসেছে আনন্দ অবসর, নাচ-গান। বিলাসিতার অলঙ্কার, ছেলেমেয়েদের খেলনা।
পশুপতি দেব এবং মাতৃকা দেবী আমাদের অনেক দিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে। কিন্তু
আমরা আরো চাই - সম্পদ, সন্তান, নিরাপত্তা, শত্রুবিনাশ। কৃপা করো
পিতা, হে মাতা করুণা করো।
আমাদের উদ্বেগহীন, দুশ্চিন্তাহীন
জীবন দাও।
অতএব প্রতিটি মানুষ তার আশ্চর্য কিছু চরিত্র গুণে এবং দেব পশুপতি ও
মাতৃদেবীর কৃপায় অচিরেই যে সুখী, সমৃদ্ধ নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপন করবে, সাধারণভাবে সে কথা বলাই
বাহুল্য। কিন্তু মানুষ তো সাধারণ নয়, তারা অসাধারণ প্রাণী। অতএব প্রকৃতপক্ষে ঠিক কী ঘটল - সে
আলোচনা আসবে পরবর্তী পর্বে।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত
তত্ত্ব ও তথ্য সমূহের গ্রন্থঋণঃ
1. The
Penguin History of Early India – Romila Thapar.
2. Sapiens
– A Brief History of Humankind – Yuval Noah Harari.
৩. মহাভারতের সমাজ – সুখময় শর্মা (ভট্টাচার্য)।
চিত্রঋণঃ Wikipedia
[1] সুনগির
(Sungir)
মস্কো শহরের
দুশো কিলোমিটার দূরে, ভ্লাদিমির
শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।
[2] আধুনিক শহুরে উচ্চবিত্ত মানুষের খাদ্যের নানান বাছবিচার খুবই চিত্তাকর্ষক সন্দেহ নেই। কেউ বলেন আমিষ-নিরামিষ মিশিয়ে সুষম আহার করো। কেউ বলেন শুদ্ধ শাকাহার স্বাস্থ্যের পক্ষে, অতি উত্তম। কেউ বলেন, আমিষের কোন তুলনা নেই। কেউ আবার বলেন ভেগান হও, স্বাস্থ্য বাঁচাও। সত্যি বলতে, আজকের যে কোন উচ্চবিত্ত পরিবারের আছে বিচিত্র খাদ্য সম্ভারের অফুরন্ত প্রাচুর্য। অতএব খাদ্য নিয়ে নানান বাছবিচারের তত্ত্ব-বিলাসিতা তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের সীমিত খাদ্য বৈচিত্র্য চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটিয়েছিল মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে, এ কথা অস্বীকার করার কোন স্থান নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন