শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মহালয়ায় মহা-স্মরণ

 

এই কিছুক্ষণ আগে স্বপনদা ফোন করেছিল, আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। এমন অসময়ে স্বপনদা ফোন করে না তো! কোন বিপদ-আপদ হল নাকি? ফোনটা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী খবর স্বপনদা, এত রাতে?”

“লে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?”

“না। না। ঘুমোইনি, বই পড়ছিলাম”।

“অ। তোর তো আবার বইপড়ার নেশা – আমার যেমন মালের। শোন না, কাল তো মহালয়া বলে আমাদের অফিস ছুটি। তোর কি প্রোগ্রাম? চলে আয় একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে দিতে মাল খাওয়া যাবে”।

“কখন?”

“মাল খাওয়ার আবার কখন কিরে? তিথি নক্ষত্র দেখতে হবে নাকি? সকালেই চলে আয়, ব্রেকফাস্টের সঙ্গে হাল্কা বিয়ার...”।

আমি ইতস্তত করে বললাম, “না, মানে স্বপনদা, হয়েছে কি? কাল মহালয়া তো, তাই ওই একটু...”

“তর্পণ? তুই সেই চিরকেলে মাকড়াই রয়ে গেলি, মানুষ হলি না। আচ্ছা, এত বছর তর্পণ করে কী পেয়েছিস বল তো, কটা হাত পা গজিয়েছে?”

হেসে ফেললাম, বললাম, “তর্পণ করি আর না করি নতুন হাত-পা কোনভাবেই গজায় না। বরং যে কটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, সে কটা আবার জমা করে যেতে হবে যাওয়ার সময়...”।

“একদম হক কথা বলেছিস। লোকে পুজো-আচ্চা করে কিছু পাওয়ার ধান্ধায় – টাকা দাও, ক্ষ্যামতা দাও, নামজাদা করে দাও, গুচ্ছের বাচ্চা-কাচ্চা দাও, চাকরি দাও, মেয়ের জন্যে ঘ্যামা বর দাও, ছেলের জন্যে টুকটুকে আত্মীসূয়ো বউ দাও...খালি শালা দাও, দাও...যেন ভিখিরির বাচ্চা। তুই কিসের জন্যে পুজো করবি, রে হতভাগা?”

আমি হাসলাম, বললাম, “আমি পুজো তো করব না, তর্পণ করব”।

“আবে ছাড়, যারে কই চালভাজা তারেই কয় মুড়ি। কিছু অংবং মন্ত্র ঝাড়া, আর গঙ্গা থেকে হাতে জল নিয়ে গঙ্গাতেই হাত ঝেড়ে ফেলা। ব্যাপারটা একই। মরে হেজে যাওয়া পূর্বপুরুষদের তেল দিয়ে কিছু কামাই করার ছক”।    

“না স্বপনদা, তর্পণ মানে কাউকে কোন তেল-টেল দেওয়া নয় – পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা – জাস্ট স্মরণ করা”।

“আচ্ছা লে, তোর কথা মেনে নিলাম, স্মরণ করা। ওসব করে কী পাস কি”?

“আশ্চর্য এক তৃপ্তির অনুভূতি। সেটাই আমার পাওনা”।

“অ তুই তো আবার লিখিস-টিখিস, আবেগ আর অনুভূতি তো তোর লেখার মূলধন। তার মানে তর্পণ করে তুই গল্পের প্লট পেয়ে যাস”?

“না, স্বপনদা, এ অনুভূতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতি। ব্যস্‌, তার বাইরে আর কিচ্ছু পাই না”।

“কৃতজ্ঞতা? যা শালা, কার প্রতি কৃতজ্ঞতা? কিসের জন্যে কৃতজ্ঞতা”?

আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “এখনও পর্যন্ত তোমার ক পেগ হল? কার প্রতি এবং কিসের কৃতজ্ঞতা -  সেটা বোঝাতে একটু সময় লাগবে”।

“আবে, চার পেগ চলছে, আরও না হয় দু পেগ মেরে দেব। কালকে ছুটি – বেলা পর্যন্ত হোগ্‌গা উলটে ঘুমোব – কোন ব্যাপার না। তুই যখন বলছিস, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। বলে যা শুনছি”।

“বেশ। তোমার মেয়ে ঝিমলি প্রমিসিং সায়েন্টিস্ট, থাকে মিউনিখে। তোমার ছেলে অলোক একজন আইএএস, থাকে দিল্লিতে”।

“অ্যাই তুই ভাঁট বকছিস। তার সঙ্গে তর্পণের কি সম্পর্ক, বে?”

“আরে বলতে দেবে তো? ধর ঝিমলি এবং অলোক তোমাকে কাল থেকে আর স্বীকার করল না। বাবা হিসেবে তোমাকে, এবং মা হিসেবে বৌদিকে পাত্তাই দিল না, বলল বাবা-মা কী করেছে কি আমাদের জন্যে?”

স্বপনদা বেশ ক্ষুব্ধ হল, বলল, “কী আলবাল বকছিস? তাই কোনদিন হতে পারে? আমরা ওদের জন্ম দিলাম, ঠিকঠাক গাইড করে বড়ো করলাম। অস্বীকার করব না, ওরাও ব্রিলিয়ান্ট, উই আর প্রাউড অফ দেম। তাই বলে, আমাদের স্বীকার করবে না?”

“রেগে গেলে তো? স্বাভাবিক, রাগ হবারই কথা। ভয় নেই, ঝিমলি এবং অলোক সেরকম ছেলেমেয়েই নয়। এবার বলি তুমিও ভালই ছাত্র ছিলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্পোরেটে অফিসের অনেক উঁচুতে উঠে এসেছ। তোমাকে বড়ো করার পেছনে তোমার বাবা-মার অবদানকে, তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে?”

“আলবাৎ না। কিন্তু তখন থেকে তুই কী ধানাইপানাই করছিস বলতো? কী বোঝাতে চাইছিস?”

“তোমার হাতের গ্লাসটা কি খালি হয়ে গেছে? হয়ে গেলে আর এক পেগ ঢাল”।

“আবে, তোর কথামতো চলব নাকি, অলরেডি আমার ঢালা হয়ে গেছে”।

“গুড। তাহলে ধৈর্য ধরে শোন। তোমার বাবা যখন তোমাদের নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন, তোমার দাদু সেটা মেনে নেননি। দাদুর কথা না শুনেও তোমার বাবা এসেছিলেন, শহরে এসে লেখাপড়া শিখতে সুবিধে হবে বলে। তাও তোমার বাবা-মা কি তোমার দাদু-ঠাকুমাকে কোনদিন অশ্রদ্ধা করেছেন?”

“কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি একটু বড় হতেই দাদু-ঠাকুমা সব রাগ-অভিমান ঝেড়ে ফেলে আমাদের কাছেই এসে থেকে গিয়েছিলেন”।

“ঠিক, তুমি তোমার দাদুর থেকে তাঁর বাবা, কিংবা তাঁর দাদুর কথা কোনদিন শোননি? অথবা তোমার ঠাকুমার থেকে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি এবং তাঁর বাবা-মা-ভাই-বোনদের গল্প”?

“ওফ, সে সব দিনের কথা মনে করিয়ে মনটা খারাপ করিয়ে দিলি, মাইরি। ছোটবেলায় পাশে বসিয়ে ঠাকুমা আর দাদু এমন গল্প করতেন, বাবার – ছোটবেলাটা যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড়, তালগাছের সারি, গাঁয়ে ঢোকার মুখে বড় একটা অশ্বত্থ গাছ...আহা ফ্ল্যাশব্যাকে সিনেমা দেখার মতো...”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে স্বপনদার কথা শুনতে লাগলাম – স্বপনদা আপন মনে কথা বলেই চলেছে। কিছুক্ষণ পরে স্বপনদার টনক নড়ল, বলল, “হতভাগা, চুপ করে গেলি, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি, শালা?”

আমি হাসলাম, বললাম, “না রে, বাবা, তোমার স্মৃতিচারণ শুনছিলাম মন দিয়ে। সে যাক, এ ভাবেই তুমি যদি পিছিয়ে যেতে থাক... আমাদের পারিবারিক ইতিহাস কেউই মনে রাখেনি, লিখেও রাখেনি...কিন্তু ভারতের বা বাংলার ইতিহাস তো জানি...। আমাদের বা তোমাদের এই পূর্বপুরুষরা কত বিপদ-আপদ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঝড়-ঝাপটা, বন্যা, খরা, সামলেছেন, চিন্তা করতে পারো? ইংরেজ শাসন, তার আগে পলাশীর নবাবী আমল, বর্গী আক্রমণ, তারও আগে পাঠান রাজত্বের শুরু, সেনরাজাদের পতন...। অনুমান করার চেষ্টা কর, এই সমস্ত রাজনৈতিক পালাবদলের সময় তাঁদের সুদীর্ঘ জীবনসংগ্রামের ইতিহাস! সে কথা কোথাও লেখা নেই...তাই বলে ভুলে যাবো?”

“কী বলছিস রে, আমার তো গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠছে...দাঁড়া, দাঁড়া...একটু সামলাতে দে...”

আমি চুপ করে রইলাম। আওয়াজে মনে হল স্বপনদা খালি গ্লাসে আরেক পেগ ঢালল, তারপর বলল, “নেশাটা জমে আসছিল, কিন্তু এমন সব চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিলি... নে আর কী বলবি বল”।  

“আর তো বেশি কিছু বলার নেই, স্বপনদা, এইটুকুই বলার যে আমাদের এই জীবন যাঁদের সুদীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের জন্য আমরা আজ পেয়েছি, সেই সব অজানা পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানানোটা কি কুসংস্কার – নাকি অন্ধ ধর্মবিশ্বাস”?

“বুঝলাম। কিন্তু সংস্কৃত ওই মন্ত্রগুলো”?

“তোমার কি সংস্কৃততে এলার্জি, তাহলে কোনটা শুনতে বা বলতে তোমার সুবিধে হবে, বাংলা না ইংরিজি?”

“প্যাঁক দিচ্ছিস? দে। কিন্তু বাংলাতেই বল”।

“আচ্ছা শোন। অন্য সব বিধিবিধান বাদ দিয়ে পিতৃতর্পণ দিয়ে শুরু করি? তর্পণ মানে জানো তো? তৃপ্তি সাধন অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের তৃপ্তি দান। সে তৃপ্তি কী আর গঙ্গাজল আর কালোতিলের অঞ্জলি দিয়ে হয়? না, ওটা বহিরাচার – তুমি যে তাঁদের স্মরণ করছ, তাতেই তাঁরা তৃপ্ত হবেন। বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা বেঁচে থাকলে কিন্তু তাঁদের নামে তর্পণ হবে না, হবে শুধুমাত্র মৃত ও মৃতাদের উদ্দেশে। তোমার পূর্বপুরুষদের কতজনের নাম জানো?”

“আমি? ধুস্‌, দাদু-ঠাকুমার নাম জানি, তার আগেকার কিছুই জানি না। বাবা জানতেন, মনে হয় বাবার কোন ডায়েরিতে লেখা আছে”।

“দেখে নিতে পারো। সাতপুরুষের নাম – মানে বাবার তরফে দাদু ও ঠাকুরমাদের নাম, মায়ের তরফে দিদিমা, দাদামশাইদের নাম। বুঝতেই পারছ, এক এক জনের নাম বলে, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ পিতামহ, প্রবৃদ্ধপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ ইত্যাদি এবং একইভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী এরকম। প্রত্যেকের জন্যেই তিনবার করে, না পারলে অন্ততঃ একবার করে বলবে, “হে পিতামহ/ পিতামহী, আমার এই সতিল জলাঞ্জলি গ্রহণ করে তৃপ্ত হও বা তৃপ্তা হও”। কি, খুব শক্ত কিছু?”

“না, আগে আমাকে নামগুলো যোগাড় করতে হবে”।

“সে কাল সকালে খুঁজে দেখ। কিন্তু এরপর যা বলব শুনে আশ্চর্য হবে, আমাদের ইতিহাসের কিছু কিছু টুকরোও হয়তো খুঁজে পাবে...”।

“কিরকম?”

ওঁ নমঃ আ-ব্রহ্মভুবনাল্লোকা, দেবর্ষি-পিতৃ-মানবাঃ ,

তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্ব্বে , মাতৃ-মাতামহাদয়ঃ

এর মানে হচ্ছে, ব্রহ্মলোক থেকে শুরু করে, সকল লোকে বাস করা জীবগণ ( যক্ষ, নাগাদি), দেবর্ষি (মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাদি ), পিতৃগণ, মনুষ্যগণ ( সনক, সনন্দ প্রভৃতি ), পিতা-পিতামহাদি এবং মাতা-মাতামহাদি সকলে তৃপ্ত হোন”

“সেই তো তুই ঘুরেফিরে ব্রহ্মা আর ঋষি এনে হাজির করলি”।  

“বাঃ, এই ঋষি, মনীষীরা না থাকলে ভারতীয় সংস্কৃতি থাকত কোথায়? আচ্ছা বেশ, পৌরাণিক মনীষীদের ছেড়েও যদি দাও – কালিদাস, বরাহমিহির, আর্যভট্ট, বিষ্ণুগুপ্ত থেকে সেদিনের রবিঠাকুর, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ এমনকি সত্যজিৎ রায় – এঁরাও কি মনীষী নন? তাঁদের শ্রদ্ধা জানালে খুব কুসংস্কার হয়ে যাবে?”

“হতভাগা, তুই বেজায় ধুরন্ধর। আচ্ছা, তারপর বল”।     

আমি হাসলাম, বললাম, “অতীত-কুলকোটীনাং, সপ্তদ্বীপ-নিবাসিনাং

                        ময়া দত্তেন তোয়েন, তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ং ।

অর্থাৎ অতীতের কোটি কোটি কুলের মানুষ, সপ্তদ্বীপের বাসিন্দা (জম্বু, প্লক্ষ, শাল্মলি, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর, এই সপ্তদ্বীপ) সমুদয় মানুষ এবং ত্রিভুবনের সব্বাই আমার এই জলে তৃপ্ত হোন”।

“আবার ঢপের গল্প এনে ফেললি, সপ্তদ্বীপ আর ওই ত্রিভুবন”।

“ঠিক আছে, ওসব বাদ দিয়ে অখণ্ড ভারতভূমির সমুদয় মানুষ বল, তাহলে হবে তো?”

“চলবে, এগো”।

“এরপরেই, যে কথা আগে বলেছিলাম, আসছে ইতিহাসের সামান্য আভাস।

ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ

তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ ।

যেমন, আমার যে আত্মীয়রা কখনো অবান্ধব হয়েছেন, পরে আবার কখনো বান্ধব হয়েছেন, তাঁরাও আমার জলের অর্ঘ্যে তৃপ্ত হোন”।

“এতে ইতিহাসের আভাস কোথায় পেলি?”

“ধরো, অতীতে দেশ ও সামাজিক পরিস্থিতিতে, আমাদের কোন জ্ঞাতি-আত্মীয় হয়তো শত্রুতা করেছিলেন বা শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিই হয়তো পরে নিজের ভুল বুঝে আবার মিত্র হয়েছেন...তাঁরাও আমার হাতের জলে তৃপ্ত হোন”।

“বড্ডো গোঁজামিল দিচ্ছিস মনে হচ্ছে”।

“বোধ হয় না, পরেরটা শুনলে আরও স্পষ্ট হবে।

ওঁ নমঃ অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবা, যেহপ্যদগ্ধাঃ কুলে মম

ভূমৌ দত্তেন তৃপ্যন্তু, তৃপ্তা যান্ত পরাং গতিং ।

যেমন, যাঁদের মৃতদেহের দাহ হয়েছে, অর্থাৎ সৎকার হয়েছে, আবার যাঁদের মৃতদেহের সৎকার হতে পারেনি, তাঁরাও আমার হাতের জলে তৃপ্ত হোন। অবশ্য এই জল সিঞ্চিত করতে হবে মাটিতে - জলে নয়। মৃতদেহ সৎকার হতে পারেনি, এর অর্থ অনেককিছু হতে পারে। মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্লাবন, ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে অজস্র মৃতদেহের যে সৎকার হয় না, এ কথা আমরা সকলেই জানি। করোনা কালে এমন ঘটনা আমরা অজস্র দেখেছি। কাজেই এমনটা যে আগেও ঘটেছে, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়। আবার বর্গী, হার্মাদ দস্যুদের, শত্রুরাজ্যের আক্রমণে গ্রামকে গ্রাম যখন ধ্বংস হয়েছে, সেক্ষেত্রে কে করবে আত্মীয়দের দেহ সৎকার? আমরা সেই মানুষদেরও স্মরণ করে যদি দু-বিন্দু জল অর্পণ করি, সেটাকে তুমি বোগাস, কুসংস্কার বলবে?”

“আর কেউ আছে?”

“আছে বৈকি।

ওঁ নমঃ যে চাস্মাকং কুলে জাতা, অপুত্রা-গোত্রিণো মৃতাঃ

তে তৃপ্যন্তু ময়া দত্তং, বস্ত্র-নিষ্পীড়নোদকং ।

এঁরা হলেন, আমাদের বংশের সন্তানহীনা নারীরা। সন্তানহীনা নারী বন্ধ্যা হতে পারেন অথবা তিনি বাল-বিধবাও হয়ে থাকতে পারেন। অভাগী সেই নারীদের স্বামীর মৃত্যুর অনেক কারণ থাকতে পারে, অসুখ, দুর্ঘটনা, অথবা ওই আগের মন্ত্রে মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্লাবন ইত্যাদি যা যা বললাম, যে কোন একটা হতে পারে। তবে এঁদের জল দেওয়া হচ্ছে পরনের ভিজে কাপড় নিংড়ানো জল দিয়ে”।  

“কাপড় নিংড়ানো জল? ছ্যাঃ, কেন?”

“জানি না গো, স্বপনদা, মন্ত্রকার কী চিন্তা করে এমন লিখেছিলেন। তোমার পছন্দ না হলে, তোমার যেমন পছন্দ সেভাবেই দিও। ক্ষতি কি?” 

“হুঁ। তুই বেশ ভাবিয়ে তুললি, সংস্কৃত বুঝতাম না, বা বলা ভাল সেভাবে বুঝতে চেষ্টাও করিনি কোনদিন। তোর কথায় বুঝলাম এটা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো নয়”।

“একটা জাতের মানসিক ব্যাপ্তিটা বুঝতে পারছ, স্বপনদা? হাজার-হাজার বছরের আত্মীয়-অনাত্মীয় সকল মানুষকে মনে করে, বিশেষ দিনে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো... এই আশ্চর্য ঐতিহ্যকে আমরা অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কার বলে অবহেলা করব...?”  

দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপনদা বলল, “না রে, অন্ধ সংস্কার বলে মনে তো হচ্ছে না। বছরের একটা দিন মিনিট পনের-কুড়ির জন্যে পূর্বপুরুষদের কথা মনে না করার, তেমন কোন যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছি না। তাতে আমাদের পূর্বপুরুষরা তৃপ্তি পাবেন কিনা জানি না, আমি তো নিশ্চিত পাব। রাখছি রে, বাবার ডাইরিটা বের করে, কাল সকালে তোকে আবার ফোন করব। গুড নাইট”।

 ...০০...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

কিরণাগড়ের বাঘ

  ১৪৩২-এর একপর্ণিকা পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত আমার "কিরণাগড়ের বাঘ" - উপন্যাস গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক অরণ্যবাদী মানুষ ও মানুষখেকো বাঘের...