[এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - ধর্মাধর্ম ১/৬ ]
প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৭ম পর্বাংশ
১.৫.৫
বেড়া ভাঙা ভালবাসা
দেখতে দেখতে এসে গেল অমাবস্যা।
কাল থেকে শুরু শুক্লপক্ষ। এই পক্ষের ষষ্ঠ দিনে আসবে ওই দলের লোকেরা। কৃষ্ণপক্ষের
সপ্তম দিনে তিনজন যুবক গিয়ে ওদের খবর দিয়ে এসেছে, আমাদের দল কন্যা সম্প্রদানে
প্রস্তুত। এই তিনজন, আন্নো, বিজে আর বলা, এরা সেই তিনজনই, যারা প্রথম দিন গিরিজ এবং
মিত্তিকার সঙ্গে গিয়েছিল ওদের বসতিতে। পিতা পশুপতি যাবার সময় ওদের হাতে বেশ কিছু
পেয়ারা আর দুটো বড়ো মেটে আলু পাঠিয়েছিলেন, মঙ্গল উপহার হিসেবে।
অন্য দলের বসতি থেকে ওরা তিনজন শেষ দুপুরে বেরিয়েছিল, এখানে এসে পৌঁছলো সন্ধের
বেশ কিছুটা পরে। এ দলের সকলে ওদের অপেক্ষাতেই বসেছিল, পিতা পশুপতিকে ঘিরে। আর বড়োবাবার
দুপাশে বসে ছিল দুই কন্যা, ঊষি আর ইশি। ওরা তিনজনে উঠোনে ঢুকতেই ওরা অবাক হয়ে গেল।
তিনজনেরই মাথায় রঙিন পালকের মুকুট। সকলেই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে উঠল, “ও কী রে? মুকুট পরেছিস? ওরা দিল বুঝি?”
তাদের অজস্র প্রশ্নের উত্তরে উচ্ছ্বসিত তিন যুবক যা বলল, তার সারাংশ হল, “পেয়ারা আর কন্দ-আলু পেয়ে
ওরা খুব খুশি। যাওয়া মাত্র আমাদের জল খাওয়াল, বেশ টকটক স্বাদ”।
“জল
আবার টকটক হয় নাকি?”
“জল
টক নয়, বলল জলে লেবুর রস দিয়েছে।
ওদের ওদিকে নদীর ধারে অমন টকটক ফল খুব হয়। মিত্তিকা মাসি এসে বসলেন পাশে। বললেন, রোদে এতটা পথ এলি, এই জল খেয়ে দেখ ভালো
লাগবে। তারপর গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের কথা। বড়োবাবার কথা। ঊষি
আর ইশির কথাও। তারপর যখন বললাম, বড়োবাবা আপনাকে বলতে বলেছেন, আমাদের ঊষি আর ইশি ওখানে যাবে। যে
কজন বয়স্ক ছিল,
এমন হৈচৈ
করে উঠল - না দেখলে তোমাদের বিশ্বাস হবে না। আর ছেলেমেয়েরাও রীতিমতো লাফালাফি
নাচানাচি শুরু করে দিল উঠোনময়। আর মিত্তিকা মাসি জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “তোমাদের পাথর-আত্মাকে
আমার প্রণাম,
প্রণাম দিও
তোমাদের বড়োবাবাকেও।
সবাই মিলে অনেক গল্প-গুজব হল, আমরা ওদের বসতির চারপাশটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বেশ লাগল
জায়গাটা। দুপুরের বেশ খানিকটা পরে দলের অন্যেরা জঙ্গল থেকে ফিরল। শিকার করেছিল বেশ
বড়ো একটা হরিণ। বেশ কিছু ফল আর কন্দ। ওই দলে বিহি আর হানোও ছিল। আমাদের দেখে আর
মিত্তিকা মাসির কাছে বড়োবাবার সম্মতির কথা শুনে, তারাও আনন্দে হৈহৈ করে আগুন
জ্বালিয়ে রান্না শুরু করল। যত ভালো ভালো ফল আর মাংসের বড়ো বড়ো টুকরো জোর করে
খাওয়ালো আমাদের। মিত্তিকা মাসি বললেন, তোমাদের এতটা পথ ফিরতে হবে, বেশি করে না খেলে খিদে পেয়ে যাবে।
তখন তোমাদের বড়োবাবা বলবেন, মিত্তিকা আমাদের ছেলে তিনটেকে খেতে দেয়নি। মিত্তিকামাসি
তোমাকে দারুণ শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন, বড়োবাবা। সারাক্ষণ তাঁর মুখে শুধু
তোমার কথা। বারবার বলছিলেন, ওঁনার মতো মানুষ আর হয় না। ফেরার মুখে গিরিজদাদু আমাদের
তিনজনের মাথায় পরিয়ে দিলেন এই মুকুট আর হাতে দিলেন ওদের বানানো চারটে বল্লম, বাঁশের লাঠির মাথায় শক্ত
করে বাঁধা পাথরের ফলা। তারপর বিহি, হানো আর শালু নামের আরেকটি ছেলে এসেছিল আমাদের এগিয়ে দিতে, ওরা ওই বড়ো পাহাড়ের কোল
অব্দি এসে ফিরে গেল”।
আন্নোদের কথা শেষ হতে দলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে নানান কথায় ব্যস্ত হয়ে
উঠল। তারা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল বল্লমগুলো। সে সময় ঊষি আর ইশি ওদের
তিনজনকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। বড়োদের কৌতূহল তো মিটেছে, এবার যে ওদের কৌতূহল
মেটাবার পালা!
ঊষি এবং ইশি দুজনেই আন্নোকে নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, “বিহি আর হানো আমাদের কথা
কিছু বলেনি?”
আন্নো মুচকি হেসে বলল, “তোদের কথা আবার কী বলবে?”
“বাঃরে
কিছুই বলল না?”
দুই মেয়েরই
মুখ ভার হয়ে এল,
চোখের পাতা
কাঁপতে লাগল অভিমানে।
এই আন্নোর সঙ্গেই ঊষি আর বিজের সঙ্গে ইশির জুটি বাঁধার কথা ছিল – ওরা
মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন। বিজে একটু খোঁচা দিয়ে বলল, “আর যদি কিছু বলেই থাকে, তোদের বলতে যাবো কেন? তোরা তো আমাদের ছেড়ে দিয়ে
চলেই যাচ্ছিস”।
ইশি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “বড়োবাবা চাইছেন যে”।
আন্নো বলল, “অ, মনে হচ্ছে তোদের কোন
ইচ্ছেই নেই,
সবই
বড়োবাবার ইচ্ছে”!
ঊষি বলল, “বাজে
কথা ছাড় তো। তোদের জন্যে বড়োবাবা অন্য কাউকে ঠিক করে দেবেন। কী বলেছে বল না”।
আন্নো, বিজে
আর বলার মধ্যে চোখেচোখে কিছু কথা হয়ে গেল, বলা বলল, “বলতে পারি একটা শর্তে। আমাদের হয়ে
যদি একটা কাজ করে দিস”।
ঊষি আর ইশি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী কাজ?”
বিজে আর বলার দিকে তাকিয়ে আন্নো বলল, “ও দলের তিনটে মেয়েকে আমাদের পছন্দ
হয়েছে। তোদের ব্যবস্থা করতে হবে”।
ঊষি আর ইশি চমকে উঠে বলল, “অ্যাঁ, তোরাও? তোরা আমাদেরই যত দোষ দেখছিলি, আর এখন নিজেরাই”?
আন্নো বলল, “আর
তোরা যে আমাদের দুজনকে দুম করে ছেড়ে দিলি?”
ঊষি আর ইশি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, বলল, “আমরা তোদের ছেড়ে দেওয়াতে খুব যে
দুঃখ পেয়েছিস,
তেমন তো মনে
হচ্ছে না?”
আন্নো এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “সেদিন বড়োবাবা, যা যা বলেছিলেন সবগুলোই
মোক্ষম কথা রে। আজ অন্যদলের মানুষগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখে সেটা আরো বুঝতে পারছি।
তোদের দুজনের জন্যে ও দলের প্রত্যকটি লোক যেভাবে উদ্গ্রীব অপেক্ষা করছে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
তুই আর আমি ছোট্টবেলা থেকে একসঙ্গে আছি, দলের সব্বাই জানে বড়ো হয়ে তুই আর আমি সারা জীবন একসঙ্গেই
থাকব। আমাদের ছেলেপুলে হবে, তার মধ্যে কোন উত্তেজনাও নেই, আবেগও নেই। তার থেকে তোরা যে চলে
যাচ্ছিস,
তাতে ভালো
হোক বা মন্দ হোক, বেশ
একটা উত্তেজনা আছে”।
সেদিন নিভৃতে ঊষি আর ঈশি এবং তাদের সম্পর্কিত তিন দাদার মধ্যে তাদের
ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে নিভৃত আলাপ চলল অনেকক্ষণ।
তারপর আন্নোরা ওদের দুই বোনের হাতে তুলে দিল সাপের হাড় সাজিয়ে, লতার তন্তুতে বানানো
দুখানি মালা। তার মাঝখানের লকেটটি সাপের খুলি। বিহি আর হানো তাদের দুই প্রিয়ার
জন্যে পাঠিয়েছে প্রেমের উপহার। মানুষের সভ্যতার সেই প্রথম প্রেমোপহারের কথা কেউ
মনে রাখেনি। কিন্তু ছিল যে, একথা নিশ্চিত।
১.৬.১
কনে দেখার আলো
এমন উৎসব, এমন
অনুষ্ঠানের আয়োজন এই পৃথিবীতে প্রথম। অন্য কোন প্রাণী তো বটেই, সকল মানব প্রজাতিতেও এমন
অনুষ্ঠানের কথা কোনদিন কেউ ভাবেওনি। আলাদা দুই পারিবারিক দলের মিলনের অনুষ্ঠান।
যার কেন্দ্রে রয়েছে, পিতা
পশুপতির পরিবারের নয়নমণি দুই কন্যা, আর মিত্তিকার পরিবারের দুই তরুণ।
শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে ওরা এল, সকাল-সকাল। বিহি, হানো আর মিত্তিকাকে নিয়ে
দশজন মেয়ে-পুরুষ। সকলের মাথায় রঙিন পালকের মুকুট। বিহি আর হানোর মুকুটদুটোই বেশি
জমকালো। তাদের দুজনের গায়ে হরিণের উজ্জ্বল চামড়া। পরনে লম্বা পাতার ঝালর। তাদের
কোমরে রয়েছে সাপের হাড় দিয়ে গাঁথা মালা, তার মাঝখানে সাপের ত্রিভুজ খুলি। গলায় সরু লতায় গাঁথা রঙিন
সুগন্ধী ফুলের মালা। ওদের সঙ্গের মেয়েপুরুষেরাও সুন্দর সেজেছে। তবে মিত্তিকা তেমন
সাজেননি,
অন্যদিনের
মতোই তাঁর পোষাক, গায়ে
ছাগলের চামড়া আর পরনে পাতার ঝালর। সকলের হাতেই বল্লম আর কাঁধে সরু লতা আর পাতা
দিয়ে বানানো ঝোলা। এই দলের অঙ্গনে এসে ঝোলা উজাড় করে তারা ঢেলে দিল, তাদের উপহার – প্রচুর ফল, বাদাম, শস্যের দানা, বুনো আলু। বেশ কিছু লেবু।
ও দলের এক মহিলা বলল, “খাবার
জলে দু একফোঁটা লেবুর রস, ঝলসানো মাংসেও একটু লেবুর রস মাখালে, দেখবেন স্বাদ আর গন্ধ
কেমন বদলে যায়”। ইতিহাসের প্রথম বরযাত্রী।
পিতা পশুপতির দলের লোকেরাও কয়েকদিন ধরেই ফল, বুনো আলু, কন্দ, শস্যদানা সঞ্চয় করছিল। গতকাল তারা
শিকার করেছিল দুটো হরিণ, তার মধ্যে একটা রাখা আছে। হরিণের মাংস একটু বাসি হলে, সেঁকে খেতে সুবিধে হয়।
আজও একটু সকাল সকাল তারা বেরিয়েছে, দেখা যাক কী যোগাড় হয়। আশা করা যায় ভালো কিছু পেয়ে যাবে, কারণ তাদের হাতে আছে অন্য
দলের দেওয়া চারটে নতুন বল্লম, এতদিনে ওরাও বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ওই বল্লমে।
গতকাল থেকেই এ দলের মেয়েরা সংগ্রহ করে এনেছে প্রচুর ফুল। অঙ্গনের ধারেই
বড়ো একটা গাছের ছায়ায় বরপক্ষের বসার আয়োজন হয়েছে। সেটাকে নানান ফুলের মালা দিয়ে
সাজানো হয়েছে। ফুলের সুগন্ধে জায়গাটা সুরভিত। ঊষি আর ইশি আজ কোন কাজেই ঘরের বাইরে
আসবে না,
এমনই
নির্দেশ পিতা পশুপতির। তাদের সঙ্গে থাকবে শুধু ছোট ছেলেমেয়েরা। আয়োজনের যাবতীয় কাজ
করবে ওদের বোনেরা এবং মা-কাকিমা-মাসিমারা। পদ্মের পাপড়ি ভাসানো স্বচ্ছ সরোবরের জল
আর কিছু ফল,
যেমন পেয়ারা, কলা, সবেদা, পাকা পেঁপে দিয়ে শুরু হল
বরপক্ষের আপ্যায়ন।
পিতা পশুপতি বরপক্ষদের সঙ্গেই রয়েছেন। তাঁর পাশেই রয়েছেন মিত্তিকা। আজ
গিরিজ আসেননি। তিনি বসতিতেই রয়ে গেছেন, ওদিকটা সামলাতে। পিতা পশুপতি সকলের আপ্যায়নের দিকেই লক্ষ্য
রাখছিলেন। মিত্তিকাও কিছু ফল নিয়ে বসলেন পিতা পশুপতির পাশেই, জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কিছু খাবেন না, বাবা?”
পিতা পশুপতির মুখে প্রশান্তির হাসি, বললেন, “না মা, যতক্ষণ না কন্যাদানের শুভ
অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, আমি
উপবাসেই থাকব। ঊষি আর ইশিকেও বলেছি উপবাসে থাকতে”।
মিত্তিকা বেশ আশ্চর্য হলেন, বেঁচে থাকার অন্যতম উপচার খাদ্য। যে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানের
আয়োজনেই থাকে আহারের প্রাচুর্য। আজ এই অনুষ্ঠানে অন্য সকলে যখন অপরিমিত আহারে
আনন্দ করবে,
তখন পিতা
পশুপতি এবং দুই কন্যা উপবাসে থাকবে কেন? মিত্তিকা হাতে ধরা ফলটি খেতে গিয়েও থমকে গেলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “উপবাস কেন, বাবা?”
পিতা পশুপতি স্মিত মুখে বললেন, “উপবাসে শরীর ও মন পবিত্র হয়, মা। প্রচুর আহারের সামনেও
নিজেকে নির্লোভ রাখতে পারলে, মনের মধ্যে আসে সংযম। মেয়েরা তাদের জীবনের অভূতপূর্ব এক
পথে এগিয়ে চলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের তো সংযত এবং পবিত্র হতেই হবে, মা। ওদের এই নতুন পথচলায়
আমি ওদের দীক্ষা দেব। আমার প্রিয়তমা দুই কন্যাকে তোমার হাতে আমি সমর্পণ করব। আমাকে
যে আরও বেশি সংযত থাকতে হবে”।
মিত্তিকা শিউরে উঠলেন অদ্ভূত এই অনুভবে। তিনি ফল সরিয়ে রাখলেন, শুধু জল খেলেন, তারপর বললেন, “তবে তাই হোক, বাবা, আমিও উপবাসে থাকব। আমিও
শুদ্ধ চিত্তে আপনার দুই কন্যাকে গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হই। আমাদের পরিবারে ওদের
সসম্মান প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমার একমাত্র ব্রত”। কথা বলতে আবেগে তাঁর গলা কেঁপে
উঠল। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মঙ্গল হোক মা, তোদের, আমাদের এবং সবার আগে ওই
দুই নবীন যুগলের”।
সকলের খাওয়া সাঙ্গ হলে, এ দলের মহিলারা নানান কাজের মধ্যেও বারবার আসছিলেন সকলের
সঙ্গে আলাপ করতে। ছোট ছেলেমেয়েরাও ছোট ছোট পোষাকে আর ফুলের সাজে আজ বড়ো সুন্দর হয়ে
উঠেছে। আজ বরপক্ষকে ঘিরে তারা খুবই চঞ্চল, উত্তেজিত এবং দুরন্ত। পিতা পশুপতি
এবং তাদের মায়েরা মাঝেমাঝেই বকাবকি করছিলেন, মিত্তিকা বললেন, “ওদের আনন্দে বাধা দেবেন
না, বাবা। এমন আনন্দের
অনুষ্ঠান ওরা কোনদিন দেখেনি যে! আমারই ইচ্ছে হচ্ছে, ওদের মতো দুরন্তপনা করতে, পারি না বুড়ি হয়ে গেছি
বড্ডো”!
পিতা পশুপতি কিছু বললেন না, শুধু হাসলেন। মিত্তিকা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা সবাইকে দেখতে
পাচ্ছি, ঊষি আর ইশিকে দেখছি না তো? ওরা আজও কি জঙ্গলে গেছে?”
পিতা পশুপতি শান্ত হাসলেন, বললেন, “আজ ওদের জঙ্গলে যেতে দিইনি। জঙ্গলে গিয়ে কোন বিপদ আপদ ঘটলে
– না, না, তাই কি হয়? ওরা কোথাও যায়নি, ওই ঘরে রয়েছে। ওদের আমি
ঘরের মধ্যেই থাকতে বলেছি, বাইরেও আসবে না। এত কাছে থেকেও, এতক্ষণের অদেখায় ওরা চারজনেই অধীর
হয়ে উঠুক। তবেই না ওদের মিলন হবে রোমাঞ্চকর!” মিত্তিকা পিতা পশুপতির কথায় আরও
আশ্চর্য হলেন। তাঁর মনের মধ্যেও অদ্ভূত এক অনুভব সঞ্চারিত হল, দুচোখ তাঁর ভরে উঠল
অশ্রুতে। তিনি নত মস্তকে পিতা পশুপতির চরণ স্পর্শ করলেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, “আপনার দেখানো পথেই আমি
যেন বাকি জীবন চলতে পারি, বাবা। আপনার সহায় রয়েছেন আপনার পাথর-আত্মা, আর আমার রইলেন আপনি”।
দুপুরে জঙ্গল থেকে সকলে শিকার ও সংগ্রহ সেরে ফিরে এল। ঊষির বাবা
হাসিমুখে,
মিত্তিকাকে
জোড়হাতে নমস্কার করল, তারপর
পিতা পশুপতিকে বলল, “বিহি
আর হানোর জন্যে আজ আমরা পেয়ে গেছি, মস্ত দুটো শুয়োর। মিত্তিকাদিদি, আপনাদের বল্লমের তাকৎ সত্যিই
দেখার মতো। আমার হাতের বল্লমটাই ফুঁড়ে দিয়েছিল, প্রথম শুয়োরটার কলজে। ওই এক
আঘাতেই সে শেষ। যাক আপনাদের জন্যে যোগাড় হয়ে আছে গতকালের একটা হরিণ আর আজকের এই দুটো শুয়োর। আশা করি ভোজ
দারুণ জমে উঠবে”।
পিতা পশুপতি বললেন, “এ সবই তাঁর কৃপা”। তা না হলে, তিনি ভাবলেন, কী ভাবে ঘটে চলেছে এমন
সাবলীল আনন্দের আয়োজন?
ভোজ একটা জমল বটে – মহাভোজ। এত হৈচৈ আনন্দ-হাসি আর পর্যাপ্ত আহারে
সকলেরই গুরুভোজন হয়ে উঠল। তাও উদ্বৃত্ত হল প্রচুর খাদ্য। পিতা পশুপতি নিজে কিছুই
আহার করলেন না,
কিন্তু
সকলের সঙ্গে বসে সকলের আহারের দিকেই লক্ষ্য রাখছিলেন, তাঁর পাশেই বসে ছিলেন উপবাসী
মিত্তিকা। অপরিমিত আহারে তৃপ্ত সকলের মধ্যে বসে নিজের উপবাসী সংযমের শুদ্ধতা এই
প্রথম তিনি অনুভব করলেন। এই আনন্দ উপভোগ করতে করতে তিনি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালেন
পিতা পশুপতিকে। মানুষটি এই ক’মাসে শুধু তাঁকে নয়, তাঁর পুরো দলটিকে প্রভাবিত
করেছেন। বদলে দিতে পেরেছেন তাঁর দলেরও প্রত্যেকটি মানুষের ভাবনা-চিন্তা। দু দলের
সকলেই অনুভব করছে নতুন এই যৌথ জীবনের তাৎপর্য। দুই দলেরই প্রতিটি মানুষ পিতা
পশুপতির প্রতি শ্রদ্ধায় আজ অভিভূত। আমরা এই শ্রদ্ধা ও পরম নির্ভরতাকেই, পরবর্তী কালে নাম দিয়েছি
“ভক্তি”। পিতা পশুপতির প্রতি একান্ত ভক্তিতে, মিত্তিকার দুচোখে বারবার ভরে
উঠছিল অশ্রু,
ঝাপসা হয়ে
যাচ্ছিল তাঁর দৃষ্টি।
গুরুভোজনের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম - কিছুটা অলস গল্প-গুজব। ও দলের
মহিলা-পুরুষদের সঙ্গে এ দলের মহিলা-পুরুষদের আলাপ। মায়েদের পেছনে বসে কৌতূহলী
কিশোরীরা এবং বালিকারা। ওদের সঙ্গেই বালক এবং কিশোরেরা। মিত্তিকা তাদের মধ্যমণি।
বিহি আর হানো আজ বড় শান্ত, কিছুটা অন্যমনস্ক। তারা সকলের সঙ্গেই রয়েছে, কিন্তু নিজেদের কিছুটা
যেন সরিয়ে রেখেছে অন্য কোথাও।
পিতা পশুপতি স্মিত মুখে লক্ষ্য করছেন ওদের আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে
তাকাচ্ছেন,
বিকেলের
নিস্তাপ রোদ্দুরে উজ্জ্বল পাথর-আত্মার দিকে। তিনি আজ কিছুটা শঙ্কিত, তিনি এতদিন এই দলের পিতা
ছিলেন, এখন কী দুই দলেরই পিতা
হয়ে উঠছেন তিনি?
এই গুরু
দায়িত্ব তাঁর কাঁধে কেউ তুলে দিচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু দু দলের সকলেই যে বড় বেশি
নির্ভর করছে তাঁর ওপর! ভরসা রাখছে তাঁর উপদেশে, তাঁর নির্দেশে। তিনি বারবার
পাথর-আত্মাকে মনে মনে প্রার্থনা করছেন, “শক্তি দাও, পিতা, শক্তি দাও। দাও শুভবুদ্ধি, আমাদের এই বৃহত্তর পরিবারের সকলের
কল্যাণ কর”।
সূর্য এখন পশ্চিম দিগন্তের কিছুটা ওপরে। ম্লান হয়ে আসছে রোদ্দুরের
ঔজ্জ্বল্য। গাছপালার ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। বনের পাখিরা সারাদিনের খাদ্য সংগ্রহ সেরে
ফিরে আসছে তাদের বাসায়। পিতা পশুপতি এবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। নিজের ছেলেমেয়ে এবং
নাতি-নাতনীদের ডেকে বললেন, “শুভক্ষণের আর দেরী নেই, এবার তোরা প্রস্তুত হ। যেমনটি আমি
বলেছি, তার আয়োজনে এতটুকু ভুলচুক
যেন না ঘটে”।
গাছের নিচে যেখানে বরপক্ষের বসার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই ছোট্ট একটি
জায়গার চার কোণের মাটিতে পুঁতে, খাড়া করা হল চারটে কেটে আনা ফলন্ত কলাগাছ। তাতে জড়িয়ে
দেওয়া হল সুগন্ধী ফুল ভরা লতা। আর ফুলের মালা বেঁধে বানিয়ে তোলা হল ঘেরাটোপ। পিতা
পশুপতির নির্দেশে গড়ে উঠেছে এই সম্প্রদানের মঞ্চ।
ওদিকে কিশোরী মেয়েরা সাজিয়ে তুলছিল ঊষি আর ইশিকে, তারা নিজেরাও সাজছিল।
তাদের কুঁড়ে থেকে বারবার ভেসে আসছিল উচ্ছ্বসিত হাসির ধ্বনি। এদিকে দু দলের ছেলেরা
মিলে বিহি আর হানোকে সাজিয়ে তুলছিল একটু একান্তে, ওরাও মেয়েদের থেকে কিছু কম যায়
না। তবে বিহি আর হানো এখনো কিছুটা অন্যমনা।
পিতা পশুপতি, মিত্তিকা, এবং ঊষি ও ইশির মা-বাবা-কাকা-কাকিমা - মধ্যবয়স্ক
মহিলা-পুরুষ সকলেই উপভোগ করছিলেন মেয়েপক্ষ এবং ছেলেপক্ষের এই চপলতা। তারা সকলেই
এখন বেশ কিছু পুত্র-কন্যার মাতা বা পিতা। একটি ছেলে ও মেয়ের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে ওঠার
এই দিনটিকে যে এত সুন্দর করে পালন করা যায়। এই দিনটিকে যে এমন করে স্মরণীয় করে
তোলা যায়। একথা তারা কোনদিন কল্পনাও করেনি। তারা সকলে এই অনুষ্ঠানের কাজে শুধু যে
আনন্দ পাচ্ছিল তা নয়, তারা
প্রতিটি মূহুর্তে অনুভব করছিল এই অনুষ্ঠানের মাধুর্য।
আর ছোট ছেলেমেয়েরা? তারা সারাক্ষণ উঠোনের সর্বত্র এবং কুটিরের ভেতরেও – আনন্দে ছুটোছুটি করছিল। তারা লক্ষ্য করছিল
নানান বয়েসের বড়োদের নানান আচরণ, সব কিছু স্পষ্ট না বুঝলেও তারা সবকিছুর সাক্ষী থাকছিল। ওরা
বড়ো হতে হতে হয়তো এমন উৎসব আরও দেখবে, বুঝবে, শিখবে। তখন ঊষিদিদি কিংবা ইশিদিদির মতো প্রেমে পড়লে, তাদের আর আতান্তরে পড়তে
হবে না!
পশ্চিম দিগন্তের কাছে সূর্য তখন ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে রক্তিম। পিতা পশুপতি
আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না, একটু উত্তেজিত হয়েই সকলকে ধমকে উঠলেন, “সেই থেকে তোদের বলছি
প্রস্তুত হ। বেলা বয়ে যাচ্ছে, তোদের আর শেষ হচ্ছে না”। সম্প্রদান মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে
তিনি এবার হুংকার দিলেন, “এখনই আমার সামনে নিয়ে আয় দুই ছেলেকে আর আমাদের দুই মেয়েকে।
অনেক সাজিয়েছিস। এবারে শেষ কর।” ধীরস্থির
পিতা পশুপতিকে এতটা অধীর হয়ে রাগারাগি করতে তাঁর ভাই-বোন, ছেলেমেয়েরাও বহুদিন দেখেনি।
দেখেননি মিত্তিকাও!
বিহি আর হানোকে নিয়ে ছেলেরা এল, পিতা পশুপতি তাদের ডেকে নিলেন, সম্প্রদান মঞ্চের
মাঝখানে। তাঁর বাঁদিকে দুজনকে দাঁড় করালেন পূর্বমুখ করে, তাদের পিছনে রইল অস্তগামী সূর্য।
এদিকে বোনেদের সঙ্গে দুই মেয়েও চলে এল সলজ্জ ভীরুপায়ে। ছটফটে, চঞ্চল, গাছে চড়া এবং শিকারে দক্ষ
দুই মেয়ের এমন সলজ্জ ভীরু হাঁটা! পিতা পশুপতি, মিত্তিকা এবং দুই মেয়ের বাবা-মা, গুরুজন সকলেই মুগ্ধ হলেন, তাঁদের সপ্রতিভ দুই
কন্যার এমন রূপান্তরে। সকলেই অনুভব করলেন, কন্যাদের বাসর গমনের
মাধুর্য।
পিতা পশুপতি দুই মেয়েকে দাঁড় করালেন তাঁর ডানদিকে। তারপর ঋজু হয়ে
দাঁড়িয়ে তাঁর বাঁ হাত রাখলেন দুই ছেলের কাঁধে আর ডান হাত রাখলেন দুই কন্যার কাঁধে।
তাঁর দীর্ঘ আলিঙ্গনেই যেন আবদ্ধ হল ওরা চারজন। তারপর চোখ বন্ধ করে পিতা পশুপতি
উচ্চ উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “হে পিতা আজ এই অস্তগামী সূর্যকে সাক্ষী রেখে এবং তোমার
অনুমতি নিয়ে মিত্তিকার দুই পুত্রের হাতে আমাদের পরিবারের এই দুই কন্যাকে সম্প্রদান
করছি এবং ওদের দুই যুগলের মিলন-যজন করছি”।
তারপর চোখ মেলে বিহি আর হানোকে বললেন, “আমি যেমন যেমন বলবো, তোরা দুজনেই সেই শপথ
উচ্চারণ করবি – বল, আমি, আমার মাতা এবং আমার
আত্মীয়বন্ধুদের সামনে শপথ করছি, আজ এই নারীকে আমি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করলাম। আজ থেকে
আমরা পরষ্পরের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অংশীদার হব। আজীবন এই নারীর যাবতীয় ভরণপোষণ, নিরাপত্তা এবং সম্মান
রাখার দায়িত্ব আজ থেকে আমার এবং আমার পরিবারের সকলের”। শেষের কথাগুলো তিনি খুব
স্পষ্ট করে একটু বিরতি দিয়ে বলছিলেন, যাতে বিহি এবং হানোর পক্ষে বলতে অসুবিধে না হয়। ওদের বলা
শেষ হতে,
তিনি দুই
কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরা যেমন বলল, তোরাও তেমনি আমার সঙ্গে শপথের কথা বলবি, বল – আজ আমার মাতা, পিতা, সকল গুরুজন এবং পরিবারের
সকলের সামনে শপথ করছি যে, আজ থেকে এই পুরুষকে আমরা জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করলাম।
আজ থেকে আমরা পরষ্পরের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অংশীদার হব। আজ থেকে আমি এই পরিবারের একজন
সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলব এবং সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে এই পরিবারকে সমৃদ্ধ
করব”।
পিতা পশুপতি একটু থামলেন। তিনি আগে থেকেই তাঁর ছোট মেয়েকে চারটি বিশেষ
ফুলের মালা গেঁথে রাখতে বলেছিলেন। ছোট মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পিতা পশুপতির পিছনেই। তার
হাত থেকে মালা চারটি নিয়ে, দুটি হলুদ মালা দিলেন বিহি আর হানোর হাতে, আর লাল দুটি দিলেন ঊষি আর
ইশির হাতে। বললেন, হাতের
মালাগুলি নিজেদের গলায় পরে নিতে। চারজনের মালা পরা হয়ে যেতে বললেন, এবার তোমরা মালা বদল কর, বিহির মালা ঊষির গলায়, ঊষির মালা বিহির গলায়।
হানোর মালা ইশির কণ্ঠে আর ইশির মালা হানোর কণ্ঠে। মালা বদল যখন শেষ হল, সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে
অস্তগামী। সিঁদুরে সূর্যের আলো রাঙিয়ে দিল দুই কন্যার সিঁথি। তারা আজ থেকে আর এই
পরিবারের কন্যা নয়, হয়ে
উঠল অন্য পরিবারের বধূ।
পিতা পশুপতি দুই নবদম্পতিকে আবার জড়িয়ে ধরলেন বুকের কাছে, তাদের মুখের দিকে গভীর
দৃষ্টি রেখে তাঁর চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে, তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, “মঙ্গল হোক তোদের, তোদের নতুন জীবন ভরে উঠুক
আনন্দে। জীবনের সকল যুদ্ধেই তোরা জয়ী হ। এখন প্রথমেই পাথর-আত্মাকে প্রণাম করবি, তারপর বাবা-মা, গুরুজনদের”। পিতা পশুপতির
বাহু বন্ধন থেকে মুক্তি পেতেই, তারা সকলেই পা স্পর্শ করে প্রথম প্রণাম করল পিতা পশুপতিকে।
তারপর তাদের মা-বাবাদের সঙ্গে গেল পাথর-আত্মাকে দূর থেকে প্রণাম করতে।
গোধূলি লগ্নের এই কনে দেখা আলোয় সেদিনের এই সরল অনুষ্ঠান, বহুদিন পরে আরো বহুবিধ
জটিল প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠেছিল বিবাহ, পরিণয়, মালাবদল। পরবর্তীকালে বিবাহিত দম্পতির বিভিন্ন সংস্কৃতিতে
নাম হয়েছিল,
পতি-পত্নী, স্বামী-স্ত্রী, মাগ-ভাতার। আধুনিক সভ্য
সমাজের উচ্চস্তরে বলা হয়, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ।
হাবি-বেবি।
১.৬.২
হরিষে বিষাদ
অনুষ্ঠান শেষে পিতা পশুপতির সেজ
এবং ছোট কন্যা ওঁনার এবং মিত্তিকার জন্যে খাবার নিয়ে এল। ছোট মেয়ে বলল, “এবার কিছু মুখে দাও তোমরা, সারাদিন উপবাসে রয়েছ”।
ওরা কলাপাতায় সাজিয়ে এনেছে কিছু ফল, সেদ্ধ করা বুনো আলু আর অনেকটা হরিণের মাংস। পিতা পশুপতি
মৃদু হেসে বললেন, “এই
বয়সে এই অবেলায়,
অত কিছু খাব
না, মা। মাংসটা তুলে নে, ফল আর সেদ্ধ আলুটা থাক।
কলা আছে,
থাকলে দুটো
দে না। মিত্তিকাকেও দিস”। পিতা পশুপতি ফল খাওয়া শুরু করতে, মিত্তিকাও খাওয়া শুরু করলেন। খেতে
খেতে ওঁরা দেখলেন, সম্প্রদান-মঞ্চ
খুলে ফেলা হয়েছে। আকাশের নিচে, মুক্ত অঙ্গনে সকলের বসার জায়গা করা হয়েছে। তার চারদিকের
খুঁটিতে জ্বলছে চর্বির মশাল। সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি যত এগোচ্ছে বাতাস স্নিগ্ধ হচ্ছে
তত। আর মশালের আলোয় ততই জমে উঠছে দুই পরিবারের গল্প-গুজব আর আড্ডার আনন্দ। অন্যদিন
ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমোনোর জন্যে মা-মাসিদের বিরক্ত করে, আজ ওদের চোখেও ঘুমের কোন লেশ নেই, ছুটোছুটি আর মহানন্দে
খেলা করে বেড়াচ্ছে উঠোন জুড়ে।
মিত্তিকা খেতে খেতে বললেন, “কয়েকমাস আগেও কী আমরা একসঙ্গে এমন আনন্দ করার কথা কল্পনা
করেছিলাম,
বাবা? সবটাই ঘটে গেল স্বপ্নের
মতো। আপনার এই উদ্যোগ আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দেবে, দেখবেন”।
“আমার
নয় মা, এ উদ্যোগ তোর। তুইই তো
কন্যা গ্রহণের প্রস্তাব এনেছিলি”।
“তা
ঠিক। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে, সেই প্রথম দিন না যেতেন, তাহলে আমি এই প্রস্তাব
কার কাছে করতাম,
বাবা? আমাদের দলের প্রতি আপনার
সেই দিনের সহানুভূতি এবং সেই তিরষ্কার – আমাদের সবার – বিশেষ করে আমার, বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে
দিয়েছিল যে। আমাদের এতদিনের পারিবারিক বিশ্বাস, সংস্কার আর অহংকার, আপনার ওই আশ্চর্য শান্ত
আঘাতে ভেঙে পড়েছিল, পোকাধরা
বিশাল গাছের মতো। আমার বাবা ভয় পেয়েছিলেন, আর আমি ভরসা পেয়েছিলাম। সেই
ভরসাতেই আজকে আমরা এই দিনে পৌঁছেছি”।
“হুঁ”
“আমাদের
এলাকার ওপাশে একটা নদী আছে, তার ওপারে আছে ঘন জঙ্গল। ওখানে কিছুদিন আগে নতুন একদল
মানুষ এসেছে। আমরা ওপারে যাইনি, এপার থেকেই দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, চেঁচিয়ে কথা বলার চেষ্টা
করেছিলাম। শুনতে পেল কী না, অথবা কী বুঝল কে জানে? বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওরা
চলে গেল। আমরাও ফিরে এলাম আমাদের এলাকায়”। হরিণের মাংস সামলাতে সামলাতে মিত্তিকা
আবার বললেন,
“দেখবেন, আমি ওদের সঙ্গে ঠিক একদিন
যোগাযোগ করব”।
“বেশ
তো, করিস।”
“আপনাদের
এদিককার হরিণের স্বাদ আমাদের তুলনায় অনেক ভালো। নাকি আমরাই ভালো ঝলসাতে পারি না, কে জানে? তবে আপনি যাই বলুন, বাবা, আমি এখন থেকে চেষ্টা করে
যাবো, আরো অনেক দলের সঙ্গে
যোগাযোগ গড়ে তুলতে। এভাবে এক একটা পরিবারের দলে আবদ্ধ থেকে আমাদের চলবে না, বাবা, অনেক দল মিলে আমাদের বানিয়ে তুলতে হবে বিশাল সমাজ। সেখানে
ঝগড়াবিবাদ থাকবে না, থাকবে
মৈত্রীর বন্ধন। আর থাকবে সংস্কৃতির আদানপ্রদান। সে বেশ হবে, না বাবা?”
“নিশ্চয়ই”।
মাংস শেষ হতে মিত্তিকা কলা শেষ করলেন, তারপর তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন, তিনি এতক্ষণ কথা বললেও, পিতা পশুপতি তেমন কিছু
বলছেন না। তিনি পিতা পশুপতির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “সারা দিন উপোস করে ছিলেন, আপনার কি শরীর খারাপ
লাগছে, বাবা? খুব ক্লান্ত?”
“না, না শরীর ঠিক আছে। তবে
ক্লান্তি – হ্যাঁ ক্লান্তি একটু আছে বৈকি”।
“একটু
বিশ্রাম নিন না,
আমি বরং
আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দি?”
পিতা পশুপতি উঠোনের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “কী জানিস, মা, সকাল থেকে আজকের
অনুষ্ঠানটা নিয়েই বড়ো উদ্বিগ্ন ছিলাম। সে সব শেষ হল, কিন্তু উদ্বেগ তো কাটল না!”
“সে
কি? কিসের উদ্বেগ, বাবা? খুব সুন্দর আয়োজনে শুভকাজ
সুসম্পন্ন হয়েছে।”
“আজকের
অনুষ্ঠানের কথা বলছি না, মা। আমি ভাবছি, কালকের কথা, তার পরের দিনগুলোর কথা। সব নাতি-নাতনীদের মধ্যে, ঊষি আর ইশি আমার সব থেকে
প্রিয়। কাল সকালে ওদের নিয়ে তোরা চলে যাবি। তারপর আবার কবে দেখা হবে কে জানে?” হতাশায় পিতা পশুপতি হাত
নাড়লেন, বললেন, “ওরা যখন ছোট্টটি ছিল, আমি তখন জোয়ান। জঙ্গল
থেকে ফিরলেই ওরা দৌড়ে এসে আমার হাঁটু দুটো চেপে ধরে বলতো, আমাদের জন্যে কি এনেছ, বলোবাবা? ড় বলতে পারত না, ল বলত। আমিও আনতাম, ঝোলা থেকে কিছু না কিছু
ফল বের করে দিতাম। কোন দিন কলা, কোনদিন পেয়ারা। কিংবা কুল। যেদিন যেমন জুটত। তারপর আমার
পিঠ ঘেঁষে সেই যে বসত দুটিতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অব্দি...” আবেগে পিতা পশুপতির কণ্ঠ
বুজে এল। তিনি থেমে গেলেন, হাতের তালুতে মুখ ঢাকলেন, কান্নার আবেগে কেঁপে উঠল তাঁর
শরীর।
মিত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে পিতা পশুপতির মাথায় হাত রেখে, তাঁর সাদা চুলের মধ্যে
আঙুলের বিলি কাটতে কাটতে ইশারায় ছেলেমেয়েদের দল থেকে ঊষি আর ইশিকে ডাকলেন। ওরা
এতক্ষণ গল্প-গুজবে মগ্ন ছিল, এদিকে লক্ষ্য করেনি, উদ্বেগে দুই মেয়েই দৌড়ে এল। তাদের
পিছনে অন্য সবাই। মিত্তিকা কথা বলতে নিষেধ করলেন সবাইকে।
পিতা পশুপতি একই ভাবে বসে আরও বলছিলেন, “সেই মেয়েরা বড়ো হল, ছটফটে দুরন্ত কিশোরী, আর আমি বৃদ্ধ হলাম। এখন
ওরা জঙ্গল থেকে ফিরে এসে রোজ - প্রত্যেক দিন - দুই বোন দুটি করে ফল আলাদা করে রাখত
আমার জন্যে। এসে বলত, “বড়োবাবা, দেখ তো মিষ্টি কিনা?” পাকা বুড়ি যেন। তারপর
সারাদিন কত কাজ করত আর ঘুর ঘুর করে আমার কাছে এসে বসত বারবার। কত কথা। কত গল্প। কী
শক্তপোক্ত আর পাথরের মত কঠিন মানুষ ছিলাম আমি। ওদের আদরে আর ভালোবাসায় নরম হয়ে
গেছি, কাদা হয়ে গেছি একেবারে...
কিন্তু কাল... কাল থেকে আমি কী করব?” ঊষি আর ইশি এবার জড়িয়ে ধরল তাদের বড়োবাবাকে, তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমিই তো আমাদের তাড়িয়ে
দেবার ব্যবস্থা করলে, বড়োবাবা, কেন করলে?”
আচমকা দুই মেয়ের স্পর্শে পিতা পশুপতি সংযম হারালেন, তিনিও উচ্ছ্বসিত কান্নায়
ভেঙে পড়ে বললেন,
“ভুল করেছি
মা, ভুল করেছি। তখন তো এভাবে
বুঝিনি, পাঁজর ভেঙে দিয়ে সত্যি
সত্যি তোরা চলে যাবি...কতদূরে...কবে আর দেখা পাবো কে জানে, মা?”
বৃদ্ধকে জড়িয়ে দুই কিশোরী কন্যার এই কান্নার দৃশ্য উপস্থিত সকলের চোখেই
জল এনে দিল। মেয়েদের বাবা-মা, পরিবারের সকলেই এখন কাঁদছে। কাঁদছে ছোট ছেলে মেয়েরাও।
সারাদিনের এত আনন্দ ও হাসির আড়ালে যে লুকিয়ে আছে এমন কান্না – একথা
এতদিন কেউই জানত না। আজ প্রথমবার সকলেই বুঝছে সম্প্রদানের হর্ষের মধ্যেই থাকে
কন্যা-বিদায়ের বিষাদ।
এতক্ষণ যা কিছু বললাম সবই আমার অনুমান – আমার কল্পনা। এই মানুষগুলি কোন
ভাষায় কথা বলতো,
তার কোন
হদিশই আমাদের জানার কোন উপায় নেই। এমন ঘটনা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তারও কোন প্রমাণ আজ আর
কোথাও আমরা খুঁজে পাবো না। তবু একথা নিশ্চিত, এভাবেই বিচ্ছিন্ন মানুষের
গোষ্টীগুলির মধ্যে সংযোগের সূচনা হয়েছিল। তার কেন্দ্রে অবশ্যই ছিল বিবাহের বন্ধন
এবং আন্তঃপারিবারিক প্রজনন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ। আর বিভিন্ন দল একত্র হয়ে যৌথ পথ
চলা দিয়েই গড়ে উঠেছিল নিবিড় সমাজ। অবিশ্যি সফল একটি সমাজের সম্পূর্ণ রূপ পেতে কেটে
গিয়েছিল অনেক অনেক হাজার বছর। সে কথায় এর পরের অধ্যায়েই আসছি।
১.৬.৪
পুজো-মানত-ব্রত – পথ চলা শুরু ধর্মবিশ্বাসের
এরপর আমরা এগিয়ে যাবো আর হাজার পঁচিশেক বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে পনের
হাজার বছর আগের কোন এক সময়। দেখা যাক, পিতা পশুপতি এবং মিত্তিকার দুই পরিবার যৌথভাবে যে সামাজিক
দিক্বদলের পথে হাঁটা শুরু করেছিল, তার ফলাফল কী দাঁড়াল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়েই পৃথিবীর অন্তিম তুষারযুগ শেষ হয়ে এসেছে। ভারতীয়
উপমহাদেশের প্রাণীজগতে তুষার যুগের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব না থাকলেও, তুষার যুগের শেষে
প্রকৃতিতে জলহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছিল দ্রুত। হিমবাহ গলে সমুদ্রের জলস্তর ফিরে আসছিল
তার স্বাভাবিক উচ্চতায়। এতদিনের ক্ষীণধারা নদীগুলি, হিমবাহ গলা জলে স্রোতস্বিনী হয়ে
উঠছিল। নদীর অববাহিকাগুলি হয়ে উঠছিল সরস, এবং উঠে আসছিল ভূগর্ভস্থ জলস্তর। সুদীর্ঘ ষাট হাজার বছরের
রুক্ষ তুষার যুগের অন্তে, গাছপালা, ঝোপঝাড়, তৃণক্ষেত্রে দেখা দিল নতুন প্রাণের জোয়ার। তুষার যুগে জলস্তর
নিচে চলে যাওয়ায়, বাতাসের
আর্দ্রতা কমে গিয়েছিল বিস্তর, তার ফলে কমে গিয়েছিল বৃষ্টির পরিমাণ। এখন উষ্ণায়নে আকাশে
আবার দেখা দিল জল ভরা মেঘ, বৃষ্টিতে স্নান করে তৃপ্ত হল মাটি। তৃণভূমি, অরণ্য, প্রান্তর হয়ে উঠতে লাগল
গভীর সবুজ। উর্বর মাটিতে মিশে থাকা শস্য দানা, হঠাৎ যেন প্রাণ পেয়ে নিবিড় সবুজ
করে তুলল নদীর দুই পাড়। স্বাভাবিক ভাবেই
তৃণভোজী প্রাণীরাও স্বস্তি পেল, স্বস্তি পেল তাদের ওপর নির্ভর করে থাকা মাংসাশী প্রাণী এবং
মানুষও।
পরিবেশের এই পরিবর্তন মানুষের চোখ এড়াল না, বরং তারা এই সুযোগের পূর্ণ
সদ্ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল দ্রুত।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই পিতা পশুপতি, মিত্তিকা কিংবা বিহি-উশি, হানো-ইশিরা কেউই নেই।
তাদের দুই পরিবার এখন বিপুল জনগোষ্ঠী, বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তাদের
অবস্থিতি। তাদের সকলের অন্তরে এখন পিতা পশুপতির বসত, মাতা মিত্তিকার অধিষ্ঠান। তাঁরা
এখন পাথরের ফলকে আঁকা দেবতা। পিতা পশুপতি এখন দেবতা পশুপতি। পাথরের ফলকে তিনি বসে
আছেন, ধ্যানমগ্ন ভঙ্গীতে। তাঁর
মাথার কাছে সূর্যের প্রতীক, পায়ের নিচে কয়েকটি পশুর অবয়ব। হাতি, বাইসন। তাঁর দুপাশে ছোট
ছোট দুটি মাতৃকা মূর্তি, যেন শূণ্যে ভেসে রয়েছেন। মিত্তিকা এখন মাতৃকাদেবী। পাথরের
ফলকে তাঁর দাঁড়ানো মূর্তি। ঋজু, গুরুস্তনী, ক্ষীণকটি। মাথায় ফুলের মুকুট, গলায় পুঁতির অলংকার। তাঁর পদতলে
হাতির অবয়ব,
দুপাশে কিছু
ফল ও শস্যের প্রতীক।
পিতা পশুপতি এবং মিত্তিকা যে বিভিন্ন দলের মৈত্রী গড়ে তোলার ব্যাপারে
উদ্যোগী হয়েছিলেন, সে
উদ্যোগও থেমে থাকেনি। পিতা পশুপতির মৃত্যুর আগে মিত্তিকা আরও তিনটি মানুষের দলকে
একত্র করতে পেরেছিলেন, আর
এখন এই দুই পরিবারের সঙ্গে আশেপাশের চোদ্দটি দলের ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। তাদের মধ্যে
আছে বৈবাহিক সম্পর্ক। উৎসব, অনুষ্ঠানে সকলেই একে অন্যের গ্রামে সমবেত হয়। পিত পশুপতি
আর মিত্তিকার পরিবারে যেমন চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল-ষষ্ঠীর ব্রত হয়।
প্রত্যেকটি পরিবার থেকেই বহু মানুষ সমবেত হয় এই কয়েকটি দিন - নীল-ষষ্ঠীর পুজো এবং
চড়ক পুজো ঘিরে।
চৈত্র মাসের শুরুর দিন থেকেই পিতা পশুপতি এবং মিত্তিকার পরিবারের
কয়েকজন যুবক ব্রত গ্রহণ করে। এই একমাস তারা শুদ্ধভাবে থাকে, সারাদিনে মাত্র একবার
আহার করে,
তাও নিরামিষ, কিছু শস্য, ফলমূল। চৈত্র সংক্রান্তির
আগের দিন তারা নীল পুজো করে। ওরা মনে করে নীল রঙ শক্তি, ঐশ্বর্য, সাহস, স্থিত প্রজ্ঞা এবং গভীর ভাবনার
রঙ। পশুপতি দেবের অন্য নাম তাই নীল। সেদিন তারা সারাদিন উপবাসে থাকে। সন্ধ্যায়
নীলাবতী ষষ্ঠী মায়ের পুজো করে, পুজো করে নীল পশুপতির। নীলাবতী-ষষ্ঠী মা, দেবী মাতৃকা-মিত্তিকা।
গোষ্ঠী-বৃদ্ধরা নীল ও নীলাবাতী মাতৃকার কথকতা বলে। এই পুজো উপলক্ষে আসা সমবেত ভক্ত
মহিলা-পুরুষ,
ছোট
ছেলেমেয়েদের,
দেব ও দেবীর
মহিমা-কথা শোনায়।
পরের দিন চড়ক, সেদিন আনন্দ-উৎসবের দিন। দীর্ঘ একমাসের ব্রত উদ্যাপনের
সমাপ্তি। ঐদিন সমস্ত দলের তরুণ-তরুণী এবং যুবক-যুবতীরা দর্শকদের সামনে তাদের নানান
নির্ভীক সাহস আর দক্ষতার খেলা দেখায়, নকল যুদ্ধ করে। জ্বলন্ত আগুনের বাধা টপকে যায় লাফিয়ে। উঁচু
গাছের মগডালে উঠে নানান খেলা দেখায় অবহেলায়। দর্শকেরা শিহরিত হয় তাদের সাহসে ও
দক্ষতায়। লতায় বাঁধা শুকনো খড়, পাতা দিয়ে বানানো নকল শিকারের ওপর নানান দুরূহ ভঙ্গিতে
লাফিয়ে পড়ে বল্লমে বিদ্ধ করে। দর্শকদের সবাই মুগ্ধ চোখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। ছোট
ছেলেমেয়েরাও উৎসাহে লাফিয়ে বেড়ায় ওদের নকল করে। সন্ধের পর জ্বলে ওঠে অজস্র মশাল, সমবেত ঢাকের
দ্রিমি-দ্রিমি আওয়াজে কাঁপতে থাকে অরণ্যের নৈশ বাতাস। সকলে মত্ত হয়ে ওঠে নাচ-গান
আর ভোজনের আনন্দে।
পশুপতি দেব এবং মাতৃকাদেবী এই সকল দলের আরাধ্য দেব ও আরাধ্যা দেবী।
কিন্তু পাথর-আত্মার গৌরব তারা এখনও ম্লান হতে দেয়নি। বরং আজকাল তারা বিশেষ বিশেষ
পর্বদিনে বেলপাতা, আমের
পল্লব, তুলসী আর নানান সুগন্ধী
ফুলের উপচারে পুজো করে, নৈবেদ্য ফলমূল দিয়ে। অন্য দলের বয়স্ক লোকেরাও খুঁজে পেয়েছে
তাদের অভিভাবক আত্মার প্রতীক। ঝুড়ি নামানো প্রাচীন যে বটের মূল কাণ্ড নষ্ট হয়ে
গেছে, ফোঁপরা হয়ে গেছে কাণ্ডের
অনেকটা, সেই গাছ মাতৃ-আত্মার
প্রতীক। সেটি মায়ের থান। এই বটের অজস্র ঝুড়িতে তারা বেঁধে রাখে মানতের ঢেলা –
বাঁজা মেয়ের ছেলে হবার মানত, দীর্ঘকাল রোগে ভোগা সন্তানের সেরে ওঠার মানত।
বেশ কবছর আগে বিশাল অশ্বত্থ গাছের দুটো প্রকাণ্ড ডাল বাজ পড়ে ঝলসে
গেছিল। বাকি গাছটা আছে সবুজ সতেজ, কিন্তু ওই দুটো পোড়া ডাল যেন আজও আকাশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে
আছে। ওই পোড়া-অশথতলার থানে বয়স্ক মায়েরা তাদের মেয়েদের ভালো বরের আশায় মানত করে।
আজকাল মেয়েদের মা এবং বাবা মেয়েদের বিয়ে নিয়ে সর্বদাই দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে থাকে।
আদরের মেয়েটা কোথায় কার ঘরে, কোন বরের হাতে পড়বে, কেমন হবে তাদের আচার-ব্যবহার।
পাশের গ্রামের কুল্তির মেজমেয়ের গতবছর বিয়ে হল নদীর ওপারের গাঁয়ে, কিন্তু তার বরটা, চরিত্রহীন, সে থাকে ওই পরিবারেরই
অন্য এক নারীর সঙ্গে। কুল্তির মেয়েকে সে এখন দেখেও না। কুলতি কী করবে সারাটা জীবন? বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসবে
বাপের গ্রামে?
অন্য কোথাও
তার বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে? কোন সমাধান মেলে না। তার কারণ দুই পরিবারের বয়স্ক মানুষরা
এই সমস্যাটিকে এড়িয়ে যান। প্রথমতঃ পশুপতিদেব এবং মাতৃদেবীর সামনে, সূর্য সাক্ষী করা বিয়ে কী
ভেঙে ফেলা যায়?
এই ঘটনার
থেকে যদি দুই দলের মৈত্রী নষ্ট হয়ে, কোনভাবে বৈরীতা সৃষ্টি হয়, সেটা কোন দলের পক্ষেই মঙ্গলজনক
হবে না। অতএব দু দলের সকলেই উদাসীন থাকাই শ্রেয় মনে করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, দুটি গ্রামের সমস্ত
মানুষের মঙ্গলের জন্যে একটি ব্যক্তিকে উৎসর্গ করাই যায়।
১.৬.৫
পায়ের তলায় শিকড়
শিকারী-সংগ্রাহী জীবনের সরলতা তাদের জীবনে এখন আর নেই। শিকারী-সংগ্রাহী
মানুষ আগেকার দিনে যে কোনদিন, যে কোনসময়ে বেরিয়ে পড়তে পারত নতুন চারণক্ষেত্র এবং
তৃণভূমির খোঁজে। আগেকার দিনে, একটি দলের সকলেই ছিল একই পরিবারের একই রক্তসম্পর্কিত
ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সে সময় পরিবারের দলনেতা অর্থাৎ পিতামহ বা পিতা বেরিয়ে পড়তে চাইলে, পরিবারের সকলেই
নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু এখন একটি দল মানে বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত
পরিবারের একক নিয়ে বড়ো একটি পরিবার – পরিবারের ভাই এবং ছেলেদের প্রত্যেকের পত্নী ও
সন্তানসহ নিজস্ব পরিবার গড়ে উঠেছে। কাজেই পারিবারিক সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে নানান
জটিলতা এবং পরিবারের পিতামহ এবং পিতাকে সব কটি পরিবারের সুবিধে-অসুবিধে, মতামত বুঝে সিদ্ধান্ত
নিতে হচ্ছে। কারণ অন্য পরিবারের মেয়েরা পতিগৃহে এসে উশি বা ইশির মতো মানিয়ে নিতে
পেরেছে, এমন প্রায়ই হয় না। বহু
পরিবারেই শাশুড়িরাও মাতা মিত্তিকার মতো নন, তাদের সঙ্গে বউমাদের নিত্য
ঠোকাঠুকি – কিছুতেই বনিবনা হয় না। যার ফলে পরিবারের নিবিড় বন্ধন আজকাল কিছুটা যেন
আলগা। অতএব শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের পায়ের নিচে গজিয়ে উঠতে লাগল শিকড়।
প্রাক-সামাজিক পরিবারে সম্পদ বলতে ছিল কিছু পাথরের অস্ত্রশস্ত্র, কিছু বল্লম, কিছু পশুর চামড়া। এখন
তাদের পরিবারে,
সামগ্রীর
বাহুল্য। অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার বেড়েছে। বেড়েছে মেয়ে এবং পুরুষের অলংকার সামগ্রী -
রঙিনপাথরের পুঁতি, পশুর
হাড় এবং হাতির দাঁত থেকে বানান গহনা তাদের সকলেরই প্রিয়। তাদের জীবনে এসে গেছে
মাটির এবং পাথরের তৈজসপত্র। তারা এখন নানান ছোটবড়ো বাদ্যযন্ত্র বানাতে শিখে গেছে।
ঢাক, বাঁশের বাঁশি, হরিণ বা ছাগলের শিং থেকে
বানানো শিঙ্গা। সন্ধের পর কোন ছোকরা এককোণে বসে হঠাৎ হঠাৎ বাঁশিতে সুর তোলে। সেই
সুরের মায়া ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে বসে থাকা মানুষের মনে। ছোট ছেলেমেয়েরা উঠোনে
যুদ্ধ-যুদ্ধ কিংবা শিকার-শিকার খেলা আর তেমন করে না। তারা মাটির তৈরি হাতি, কুমির, হরিণ কিংবা ভেড়ার পুতুল
নিয়ে খেলা করে। এ ছাড়া জমে উঠেছে আরো কত যে গৃহস্থালীর সামগ্রী।
এই সব নানা কারণে, আজকাল এই মানুষেরা ঋতু
পরিবর্তনের সময় হলেই অন্য এলাকায় সরে যাওয়ার তেমন আর তাগিদ অনুভব করে না। তারা এখন
বছর, দিন, সপ্তাহ, মাস গুনতে শিখেছে। বয়স্ক
মানুষেরা কবে থেকে বর্ষা হবে, কবে নাগাদ মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দেবে শরতের আকাশ, হেমন্তের শিরশিরে বাতাস
কবে হয়ে উঠবে শৈত্য প্রবাহ, মোটামুটি সঠিক বলতে পারেন। মানুষেরা সেই অনুযায়ী আগে থেকে
পরিকল্পনা করে নেয়। আজকাল তারা মাটির বড়ো বড়ো পাত্র বানাতে পারে, সুন্দর না হোক হয়তো একটু
ব্যাঁকা-টেরা - কিন্তু কাজ চলে যায়। সেই সব পাত্রে জমিয়ে রাখে শস্যের দানা। ভারি
দুটো পাথরের জাঁতাকলের মাঝখানে শস্যদানা রেখে, ওপরের পাথর ঘুরিয়ে দানার খোসা
ছাড়িয়ে নেয় কিংবা দানা ভেঙে গুঁড়ো করে নেয়, যেমন বুনোগম ও যব ভেঙে করে আটা।
চোদ্দটি এলাকার চোদ্দটি দলের সহযোগিতায় খাদ্য সংগ্রহে অসুবিধে হয় না খুব।
তাছাড়া তারা আজকাল আরও যেটা শিখেছে সেটা হল বড়শিকার বা গণশিকার। সবকটি
দলের সেরা শিকারীদের যৌথ দল বানিয়ে তারা শিকারে বেরোয়। সে দলে থাকে দারুণ দক্ষ আর
চটপটে অভিজ্ঞ শিকারীরা - পঞ্চাশ-ষাট জন তো বটেই। সে দলে মেয়েদের বড় একটা নেওয়া হয়
না, মেয়েরা আজকাল ব্যস্ত থাকে
ঘরের কাজেই। এরকম দল তারা বানিয়ে তোলে, হাতির দলের সন্ধান পেলে অথবা বাইসন কিংবা নীলগাইয়ের দল।
শিকারের কথা সবার কাছে পৌঁছে যায় ঢাকের আওয়াজের সংকেতে। ঠিক সময় মতো, সঠিক জঙ্গলে তারা পৌঁছে
যায় সবাই।
শরতের পর এই সব প্রাণীরা যখন দল বেঁধে হাঁটতে থাকে পূর্বদিকে, তাদের পথের মধ্যে বানিয়ে
রাখে বিশাল বড় গর্ত। গর্তের দিকের পথের দুধারে মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি পুঁতে বানিয়ে
তোলে পোক্ত বেড়া। তারপর হাতি বা নীলগাইয়ের দলটাকে তিনদিক থেকে তাড়া করে, তারা এনে ফেলে ওই বেড়া
বাঁধা রাস্তার মধ্যে। সমবেত মানুষের চিৎকার আর একটানা ঢাকের আওয়াজে পশুগুলো
দিশাহারা হয়ে যায়। আতঙ্কে আর প্রচণ্ড শব্দের তাড়নায় তাদের অনেকেই অন্ধের মতো দৌড়ে
চলে সামনে - বেড়া ঘেরা পথ ধরে, বড়ো সেই গর্তের দিকেই। গর্তের সামনে এসে প্রথম পশু থমকে
গেলেও তার কিছু করার থাকে না। কারণ পিছন থেকে উন্মাদের মতো দৌড়ে আসা পশুদের
ধাক্কায় সে গর্তে পড়ে, তার
পিছনে পড়ে অজস্র। গর্ত ভরে গেলে, তাদের শরীরের উপর দিয়েই নিরাপদে দৌড়ে চলে যায় বাকি পশুরা।
গর্তে পড়ে যাওয়া অসহায় পশুরা, তাদের পায়ের চাপে আরও বেশি আহত হয়।
পেছনে ধাওয়া করে আসা শিকারী মানুষের দল, এবার গর্তের চারদিক থেকে আক্রমণ
করে গর্তের মধ্যে তালগোল পাকানো আহত পশুদের। বড়ো বড়ো পাথর আর কাঠের ভারি মুগুর
দিয়ে ভেঙে দিতে থাকে পশুদের মাথা। আর বল্লমের খোঁচায় অন্ধ করে দিতে থাকে তাদের
চোখ। এভাবেই মাত্র দু চারদিন আগের প্রস্তুতিতে, সবকটি দলের সমস্ত মানুষের বেশ
কিছুদিনের খাদ্য সংস্থান হয়ে যায় অনায়াসে, মাত্র এক দিনের যৌথ শিকারে।
প্রচুর মাংস,
প্রচুর
চর্বি, অজস্র হাড়, শিং, খুর আর প্রচুর চামড়া। সফল
গণ শিকারের পর তারা সমবেত প্রার্থনা করে, “হে দেব পশুপতি, আপনার কৃপায় পশুরা দিক্ভ্রান্ত হয়ে আমাদের উদ্দেশ্য সাধন
করেছে। আপনার অসীম কৃপায় আমরা কৃতজ্ঞ। আপনি আমাদের পিতা এবং সকল পশুদেরও পিতা।
আপনি সকলেরই মঙ্গল সাধন করুন। আমাদের কৃতজ্ঞ প্রণাম গ্রহণ করুন”।
অতএব প্রতি বছরের নিয়মিত পরিযায়ী জীবন ছেড়ে আদিম মানুষ এখন হয়ে উঠছে গ্রামবাসী। তাদের ঘরবাড়ি-বাসা এখন আর আগের মতো অস্থায়ী নয়। কাঠের কাঠামো আর মাটির দেওয়াল, বড়ো পাতা, লম্বা লম্বা শুকনো ঘাসের ছাউনি দিয়ে তারা মোটামুটি পোক্ত বাড়ি বানাতে শিখে গেছে। শিকারী-সংগ্রাহীদের যাযাবর জীবন এখন ধীরে ধীরে গৃহস্থী হয়ে উঠছে। এতদিনের যে জীবনযাত্রায় তাদের ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা, সারল্য এবং কঠোর বাস্তবতা, এখন তাদের জীবনে আসছে কিছু কিছু বিলাসিতা, কিছু আড়ম্বর এবং কিছু কিছু শিল্পকলাও!
১.৬.৬ আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা
এবারে হেমন্তের শুরুতে নদীর
দু’ধারেই বিস্তীর্ণ জমিতে শস্য হয়েছে দেখার মতো। এতদিন ছিল নিবিড় সবুজ, শীতের শেষ থেকে তাতে রং
ধরল সোনালী। তারপর বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সোনালী স্বপ্নের মতো দুলতে লাগল বুনো গম
এবং যবের শিষ। নদীর দুই পাড়ের দু’দলের মানুষই প্রস্তুত ছিল, তারা নিজেদের এলাকার
সমস্ত শস্য,
তুলে আনল
নিজেদের গ্রামে। তাদের মাটির জালা উপচে উঠল। রাতারাতি তাদের বানিয়ে তুলতে হল নতুন
শস্য ভাণ্ডার! নিয়মিত খাদ্যের নিশ্চিত সঞ্চয়! পরিযায়ী শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরা আরও
বেশি বাঁধা পড়ে গেল এই শস্য ভাণ্ডারের সঙ্গে।
ভ্রাম্যমাণ জীবনের প্রতি কিছু বয়স্ক ‘সেকেলে’ মানুষের যদিও বা কিছুটা
পক্ষপাত ছিল,
সেটাও আপাতত
আর রইল না। আরও বেশি গৃহস্থ হয়ে উঠতে লাগল তারা। শস্যের প্রাচুর্যে তারা কৃতজ্ঞ
হয়ে আরও বেশি উপচারে এবং নৈবেদ্যে পুজো করল দেব পশুপতিকে এবং মাতৃকা দেবীকে। “হে
মাতা, পৃথিবীকে আরও বেশি
শস্যশালিনী করো,
উর্বর করো, আমাদের প্রচুর শস্য দাও।
স্বামী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে - আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় নিরাপদ জীবন দাও”।
বেশ কিছুদিন ধরেই কিছু বুনো কুকুর মানুষের আবাসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি
করছে। কাছাকাছি আসে না, তারা মানুষকে ভয় পায়। তাদের তাড়িয়ে দিলে, কিছু দূরে পালিয়ে যায়, কিন্তু আবার ফিরেও আসে।
তারা ফিরে আসে,
গ্রামের
অদূরে মানুষের ফেলে দেওয়া মাংসের অবশেষ, হাড়গোড় নাড়িভুঁড়ি খাওয়ার লোভে। প্রথমদিকে মানুষের দল
বিরক্তই হচ্ছিল। মাংসাশী প্রাণী, কখন কী করে বলা যায় না। রাত্রের দিকে সুযোগ পেয়ে যদি দল
বেঁধে একলা মানুষকে আক্রমণ করে। তারাও ভয় পাচ্ছিল ওই কুকুরের দলকে।
গতকাল গভীর রাত্রে বাঘ এসেছিল। গ্রামের মানুষেরা দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় টের
পেয়েছিল তার উপস্থিতি। কাছাকাছি ঘন একটা ঝোপের আড়ালে বাঘটা ওঁত পেতে বসে আছে।
সারারাত দু তিনটে চর্বির মশাল জ্বলে, সেদিনও জ্বলছিল। বল্লম নিয়ে ওরা ছজন ঘর থেকে বেরিয়ে পিছনের
দিকে গেল। ঝোপের আড়ালে প্রস্তুত হয়ে বসল সবাই। তাদের কিছুটা আগেই দাঁড়িয়ে, কুকুরের দলটা তখন
তারস্বরে ডেকে চলেছে একটানা। মানুষগুলো অন্ধকারে বাঘটাকে দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু তাদের মনে হল
কুকুরগুলো নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে। কারণ কুকুরগুলো নির্দিষ্ট একদিকেই তাকিয়ে ডেকে
চলেছে।
অনেকক্ষণ একই রকম চলল। কিছুক্ষণ পরে, কুকুরগুলো হঠাৎ একটু পিছিয়ে এল, কিন্তু তাদের ডাকের
তীব্রতা বেড়ে গেল। মানুষগুলো বুঝতে পারল, বাঘটা এতক্ষণ বসেছিল, এবার সে উঠে দাঁড়িয়েছে। সতর্ক হয়ে
উঠল সবাই। আবার দীর্ঘসময় একই রকম চলল। কিছুক্ষণ পর কুকুরগুলো আবার একটু সতর্ক হয়ে
উঠল, তারপর এক পা এক পা করে
এগোতে লাগল বড় ঝোপটার দিকে কিন্তু তারা তখনও ডেকে চলেছে তারস্বরে। মানুষরা বুঝতে
পারল, বাঘটা জঙ্গলের দিকে ফিরে
যাচ্ছে। হয়তো একটানা কুকুরের ডাকে সে বিরক্ত হয়েছে এবং টের পেয়েছে ছজন মানুষের বসে
থাকা। শিকারের আশা নেই দেখে ফিরে চলেছে গভীর জঙ্গলের দিকে। এর পরেও কুকুরগুলো বেশ
কিছুক্ষণ ডাকল,
তবে তাদের
মধ্যে সেই আতঙ্ক ভাবটা আর নেই। দু তিনটে কুকুর ডাক থামিয়ে ওখানেই বসে তাকিয়ে রইল
জঙ্গলের দিকে। একটু পরে সকলেই শান্ত হল। বোঝা গেল বাঘ আর কাছাকাছি নেই, সে এখন নিরাপদ দূরত্বে।
পরের দিন দুপুরেই ওই মানুষগুলোর কয়েকজন খাবার সময় কুকুরগুলোকে ডাকল, তাদের হাতে ঝলসানো-মাংসের
টুকরো। প্রাথমিক ভয় আর দ্বিধা কাটিয়ে ওদের মধ্যে দুটো কুকুর সামনে এল এবং মানুষের
ছুঁড়ে দেওয়া মাংসের টুকরোগুলো লুফে নিল মুখে। তাদের চোখের দৃষ্টি আর তাদের লেজের
আস্ফালনে - কৃতজ্ঞতার ভাষা বুঝতে ভুল করল না মানুষ। সে আর একটু এগিয়ে গিয়ে হাত
রাখল একটি কুকুরের মাথায়, একটু আদর করল। কুকুরের দল মুগ্ধ কৃতজ্ঞতায় মানুষটির সামনে
বসে পড়ল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। সেই দিন থেকেই গড়ে উঠল মানুষ আর কুকুরের অনবদ্য এক
সম্পর্ক। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম মানুষের সঙ্গে অমানুষ এক প্রাণীর আন্তরিক
সখ্যতা গড়ে উঠল।
কিছুদিনের মধ্যেই কুকুর এবং মানুষের পারষ্পরিক বোঝাপড়া এমনই সাবলীল হয়ে
উঠল, দুজনেই দুজনকে নিশ্চিন্তে
নির্ভর করতে লাগল। আজকাল দিনের বেলা কিংবা রাত্রেও সমস্ত গ্রাম পাহারা দেয় কুকুরের
দল। যে কোন বড়সড়ো প্রাণী কিংবা অচেনা কোন মানুষ এলেই তীব্র চিৎকারে সকলকে সতর্ক
করে দেয়। জঙ্গলের পথে একসঙ্গে চলার সময়ও কুকুর অনেক আগেই বিপদের গন্ধ পায়, তার আচরণ এবং ডাকে সতর্ক
হওয়া যায় নিরাপদ দূরত্ব থেকেই। এর পর শিকারের সময়েও কুকুর হয়ে উঠল মানুষের
অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
আজ থেকে প্রায় চোদ্দ হাজার বছর আগে কুকুরই মানুষের প্রথম গৃহপালিত
প্রাণী হয়ে উঠল। এর পরবর্তী সময়ে মানুষ আরও অনেক পশু ও পাখিকে গৃহপালিত করতে
পারলেও, কুকুর ছাড়া অন্য কোন
প্রাণীর সঙ্গে তার এমন নিবিড় নির্ভরতার সখ্য গড়ে ওঠেনি।
একবার শিকারে গিয়ে বুনো ছাগলের বেশ বড় একটা দলকে শিকার করা গেল। তাদের
মধ্যে মদ্দা আর মাদীগুলোকে বয়ে আনার সুবিধের জন্যে মেরে ফেলা হয়েছিল। ওই দলে বেশ
কিছু ছাগলছানাও ছিল, সেগুলোর
কথা মানুষগুলো ভাবেইনি। শিকারীদল যখন জঙ্গলের পথে কাঁধে মরা ছাগল নিয়ে গ্রামে
ফিরছিল, ছাগলছানাগুলোও তাদের সঙ্গ
নিল। তারা হয়তো বোঝেনি, তাদের মায়েদের পরিণতি, কিন্তু মরা মায়ের গন্ধ শুঁকেই
মানুষগুলোকে তারা অনুসরণ করেছিল। এবং আশ্চর্য তারা চলে এল একদম গ্রাম অব্দি! তাদের
মধ্যে ছিল ছটা মেয়ে আর দুটো ছেলে ছাগল।
গ্রামের বাচ্চারা খুব মজা পেয়ে ছানাগুলোকে নিয়ে খেলতে লাগল। আর তাদের
মায়েরা বসল শিকার করে আনা ছাগলের ছাল ছাড়িয়ে আগুনে সেঁকার যোগাড় করতে। ছাগলের ছাল
ছাড়াতে ছাড়াতে,
দু’জন মহিলা
বলল, “আহা রে, ছাগলছানাগুলোর কী কষ্ট না? ওদের মাও নেই বাবাও নেই”।
এবং এ কথা তাদের আবারও মনে হয়েছিল, সেঁকা হয়ে যাওয়ার পর ছাগলের নরম মাংসে তৃপ্তির কামড় দিতে
দিতে।
শেষ পর্যন্ত দুটো মেয়ে ছাগলছানা মরে গেলেও, বহাল তবিয়তে টিকে রইল চারটে মেয়ে
আর দুটো ছেলে ছাগলছানা। কয়েকবছরের মধ্যে ওই গ্রামের খামারে তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠতে
লাগল দ্রুত। বর্ষার দিনে শিকারে যাওয়া সম্ভব না হলেও, মানুষের আর প্রোটিনের অভাব হল না।
পরের বছরে, নদীর
দু পাড়ই আবার আগের মতোই যখন শস্যের চারায় সবুজ হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষেরা খুব
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল, ওই একই চারা গজিয়ে উঠেছে, তাদের গ্রামের ভেতরেও, তাদের শস্য ভাণ্ডারের
আশেপাশে। শুধু তাই নয়, যে পথে ওরা নদীর পাড় থেকে
গম বা যবের শিষ কেটে গ্রামে এনেছিল, সেই পথের ধারে ধারেও গজিয়ে উঠেছে গমের চারা। অর্থাৎ যেখানে
যেখানেই মাটিতে গম বা যবের দানা পড়েছে, গজিয়ে উঠেছে তাদের চারা। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার। তাদের এতদিন
ধারণা ছিল,
যে গাছ, যে তৃণ, যে শস্য জঙ্গলে বা নদীর
ধারে যেখানে যেখানে জন্মায়, সেই সেই জায়গা ছাড়া তারা অন্য কোথাও জন্মাতে পারে না। তারা
জানত, এ সবই প্রকৃতির লীলা।
কিন্তু এখন তারা অন্যরকম দেখল, যেখানে যেখানে গমের দানা মাটিতে পড়েছে, অনুকূল পরিবেশে সেখানেই
তার চারা বেরিয়েছে। অর্থাৎ গম বা যব যে জায়গাতেই উপযুক্ত মাটি এবং অনুকূল পরিবেশ
পাবে, সেখানেই গজিয়ে উঠতে পারে!
গ্রামের বাইরের কিছুটা জমির ঝোপঝাড় আগাছা সাফ করে, সেখানে তারা ছড়িয়ে দিল
কিছু গমের বীজ। কয়েকদিনের মধ্যেই গজিয়ে উঠল চারা। অবিশ্যি সব গম থেকে চারা বেরোতে
পারেনি, কারণ মাটির ওপর থেকে কিছু
গম পাখিতে খুঁটে খেয়েছিল, কিছু নষ্ট করেছিল ইঁদুর আর পোকায়। সে যাই হোক, একটা ব্যাপার নিশ্চিত
হওয়া গেল,
তাদের
বানিয়ে তোলা জমির মাটিতেও গম বা যবের মতো ফসল ফলানো সম্ভব। তার সঙ্গে আরও একটা
অভিজ্ঞতা হল,
গমের দানা
থেকে ঠিকঠাক ফসল পেতে হলে, মাটি কিছুটা খুঁড়ে মাটির ভিতরে দানা বসাতে হবে। তা হলে
পাখি, ইঁদুর এবং পোকামাকড়ে সহজে
সে দানা খেতে পারবে না।
এভাবেই মানুষ ধীরে ধীরে শিখতে লাগল চাষবাস এবং পশুপালন। দিনে দিনে তারা
সভ্য হওয়ার দিকে এগোতে লাগল।
এমন সমৃদ্ধি আর স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরা কেন নিঃস্ব যাযাবরের মতো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে যাবে, অনিশ্চিত অচেনা বিপজ্জনক এলাকায়? তাদের ঘরেই তো এখন মজুত থাকে শস্য সম্পদ, পোষা থাকে প্রাণী সম্পদ। শিকারী-সংগ্রাহী সমাজ এখন দ্রুত বদলে উঠতে লাগল কৃষিভিত্তিক ও পশুপালক সমাজে।
...চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন