[এর আগের পর্ব পড়তে পারবেন এই সূত্রে - "লোকশিল্পীর বিলুপ্তি"]
গ্রামের বড়োরা মিলে দুটো যাত্রা করবেন এইবার মকর সংক্রান্তির দিন আর তার পরের দিন। আমাদের মামাবাড়ি ছাড়িয়ে গ্রামের আরো ভিতরে চৌধুরি পাড়া যাবার পথেই শিবমন্দির পড়ে। তার সামনে সিমেন্টের বাঁধানো চাতাল, টিনের চাল দিয়ে ঢাকা। তার ঠিক পাশেই ডালপালা ছড়ানো বিশাল এক ছাতার মতো প্রাচীন বকুলগাছ। ওই চাতালে যাত্রার আসর বসবে দুদিন। গাঁয়ের সবাই জায়গাটাকে শিবতলা বলে।
ওই শিবতলার মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ গৌরীপীঠে বিরাজিত। কুচকুচে কালো পাথরের সেই লিঙ্গ। এর আগে গরমের ছুটিতে এসে দেখেছি, শিকে থেকে ঝোলানো মাটির ফুটো কলসি থেকে সারাটা নির্জন দুপুর ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে পড়ে শিবঠাকুরের মাথায়। গাঁয়ের মেয়ে-বউরা পুকুর থেকে স্নান সেরে ফেরার পথে কাঁসার বা পিতলের ঘটিতে জল বয়ে আনেন । সেই জল শিবঠাকুরের মাথায় ঢেলে পুজো করেন। আর সকালের দিকে শিবতলায় এসে দাঁড়ালে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ত অজস্র বকুল ফুল – ছোট্ট ছোট্ট মাকড়সার মতো। হাতের অঞ্জলি ভরা বকুল ফুলের অপূর্ব ঘ্রাণে ভালো লাগায় আবিষ্ট হয়ে থাকত মন।
অভিনয় দক্ষতার জন্যে আমার বড়োমামার গ্রামে খুব সুনাম ছিল। গ্রামের যে কোন যাত্রায়
তিনিই থাকতেন মুখ্য ভূমিকায়। এবারে ঠিক হয়েছে একটি পৌরাণিক পালা –
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর একটি ঐতিহাসিক – ‘ধূলার স্বর্গ’। কদিন ধরেই দাদারা সন্ধ্যের
পর রিহার্সাল দেখতে যাচ্ছে। আমিও যাবার জন্যে রোজই বায়না করতাম, কিন্তু মা আমাকে
বড়োদের মধ্যে যাওয়ার অনুমতি দেননি। একদিন বড়োমামা রিহার্সালে যাবার সময় শুনে
ফেললেন আমার বায়না আর মায়ের বকাবকি, বললেন-
-‘রিহার্সাল দেখতে যাবি তো, চ আমার সঙ্গে। এরজন্যে নাকে
কাঁদছিস কেন’? মা বললেন-
-‘না, দাদা, ও গিয়ে তোমাদের অসুবিধে করবে, বিরক্ত করবে’।
আমি বলে উঠলাম-
-‘মোটেও না, আমি কাউকে বিরক্ত করব না। একটা কথাও বলব না’।
বড়োমামা মাকে বললেন
-‘কিচ্ছু অসুবিধে করবে না, চলুক আমার সঙ্গে, ও তো খুব ভালো ছেলে’। এরপর মা আর কিছু বলতে পারলেন না আর আমিও বড়োমামার হাত ধরে ভালো ছেলের মতো চললাম রিহার্সাল দেখতে।
হাজরাবাড়ির বিশাল হলঘরে রিহার্সালের আসর বসেছিল। গোটা তিনেক হ্যারিকেনের
আলোয় সে ঘরের অন্ধকারই যেন আরো প্রকট হচ্ছিল। যাত্রার রিহার্সাল যে এত বিরক্তিকর
ব্যাপার কে জানত? একজন হ্যারিকেনের সামনে বসে বই থেকে ডায়লগ পড়ছিল - সে হচ্ছে
প্রম্পটার আর যার যে পার্ট সে সেই ডায়লগটাই রিপিট করছিল নাটকীয় ভঙ্গীতে।
প্রম্পটার-‘বড়দা, এবার আপনার ডায়লগ -“পরাজয়?-(অট্টহাসি)–
পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা হয়, বোমভার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।
বড়োমামা-‘ওটা, বোমভা নয় রে, জিতেন, ব্রহ্মা। আরেকবার বল
দেখি লাইনটা’।
প্রম্পটার-“পরাজয়?-(অট্টহাসি)– পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা
হয়, বোমহার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।
বড়োমামা-‘পরাআআজয়? হুহুহাহাহাহাহা – পরাআআজয় নাহি জানি
কিরূঊঊপে বা হয়। ব্রহ্মার বরে আমি অজেএএএয়, ত্রিভুবনমঅঅঅঅয়’।
জলদমামা-‘বিষ্ণু, ওইখানটা তোমার ঠিক জমল না, ওই যে - “ব্রহ্মার বরে”। ওই জায়গায়টায় তোমার গলাটা একটু নামাতে হবে। মানে একটু নম্র আর কি। যতোই হোক তুমি তো ব্রহ্মার ভক্ত আর তাঁর তপস্যা করেই না তোমার এই শক্তি ...বুয়েচ? বাকি সব জায়গায় তোমার ঔদ্ধত্যটা ঠিকঠাক এয়েচে...।’ চৌধুরিবাড়ির জলদমামা এই যাত্রাদুটির ডিরেক্টর, বড়োমামার চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো।
মহিষাসুরের ভূমিকায় চাদর মুড়ি-ধুতি পড়া বড়োমামার এহেন
অভিনয় চর্চাতে আমি মজা পাচ্ছিলাম না। ডোরাকাটা পাজামা আর চাদরমুড়ি ঝন্টুমামা এরপর
মা দুর্গার ভূমিকায় ডায়লগ বলতে শুরু করল অদ্ভূত মেয়েলি কণ্ঠে আর ঢঙে - কি আশ্চর্য
যে মনে হচ্ছিল তাকে!
ঝন্টুমামা -‘ওরে মুডহো মইশাসুর, আজি তোরে পাঠাইব শমন
সদন...’।
জলদমামা- ওটা মুডহো নয় রে, মূঢ় – মূঢ় – এইদ্যাখ জিভটা
আলটাগরায় ঘষে বল –ঢ় -ঢ়। আর মইশাসুর কিরে –মঅহিইইষাআআসুর – ঠিক মতো উচ্চারণ না হলে
অভিনয় হয় রে, বাপ’?
জলদমামা পারফেকসনে বিশ্বাসী। কাজেই এরপর চলতেই লাগল ঝন্টুমামার জিভের আড় ভাঙানোর প্রচেষ্টা। হতাশ হয়ে আমি হ্যারিকেনের আলোয় হলঘরের দেয়ালে নড়ে চড়ে বেড়ানো বিশাল বিশাল ছায়াগুলো দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়েই পড়লাম।
ধান ভেঙে চাল করার হাস্কিং মেসিন তখন চালু হয়ে গেছে। কিন্তু সে মেসিন সেদ্ধ ধান থেকে সেদ্ধ চাল বের করার জন্যে। সেদ্ধ ধান বা চাল মানেই সেটা এঁটো – উচ্ছিষ্ট। কাজেই সে চালে কোন পুজো বা শুভ অনুষ্ঠান হবে না। পুজোপার্বণের জন্যে আতপ চাল বিধেয়। কাজেই কদিন ধরেই ঢেঁকিতে নতুন ধান কোটা চলছিল। নতুন চাল জলে ভিজিয়ে রেখে শিলে বাঁটা চলছিল। সেই বাঁটাচাল পরিষ্কার কাপড়ে বিছিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে চালের গুঁড়ো হিসেবে যত্ন করে রেখে দেওয়া হচ্ছিল। গাছের থেকে গোটা ত্রিশেক নারকেল পেড়ে ছোবড়া ছাড়িয়ে, ভেঙে, নারকেল কুড়ুনি দিয়ে কুড়ে গুড় দিয়ে রান্না করে নারকেলের ছাঁই বানানো হয়ে গেল। সংক্রান্তিতে নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো হবে সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে, ভাজাপিঠে, ক্ষীরপুলি। পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে আর ভাজাপিঠের মধ্যে পুর হিসেবে ঢুকে পড়বে নারকেলের ছাঁই। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া, ভিজে চাল বাঁটা, নারকেল কোড়া - এসব কাজে ভামিমাসি, মোক্ষমাসিদের সাহায্য নেওয়া যায়, কিন্তু এরপরের এন্ড প্রোডাক্ট - পিঠেপুলি বানানোটা একান্তভাবেই বাড়ির মহিলাদের কাজ।
আজ পৌষমাসের সংক্রান্তি - মকর সংক্রান্তি। আজই রাত্রে শিবতলায়
প্রথম যাত্রা মঞ্চস্থ হবে – ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। একটু আগেই একবার ঘুরে এসেছি শিবতলা
থেকে। ছ-ছটা হ্যাজাক জ্বলছে, মঞ্চের মাঝখানে মাথার ওপর ডেলাইট। গোটা শিবতলাটা ঝলমল
করছে আলোয়। বকুল গাছের নীচে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। দর্শকদের বসার জায়গা টিনের চাল
দেওয়া চাতালে এবং মন্দিরের বারান্দায়। শতরঞ্চি বিছিয়ে জায়গা রিজার্ভ করা হয়ে গেছে।
আমাদের জায়গা রিজার্ভ করে বসে আছে মামাবাড়ির রাখাল ভুবনমামা আর ভামিমাসি। আমরা
রাতের খাওয়া সেরে এসে বসলে ওরা খেতে যাবে। খেয়ে এসে ওরাও বসবে একসঙ্গে।
রান্নাঘরেই একসারিতে সবার সঙ্গে বসে পাল্লা দিয়ে গরম গরম সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, ভাজাপিঠে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে আমাদের যখন হাঁসফাঁস দশা - রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ ঢং করে প্রথম ঘন্টা পড়ল শিবতলায়। আর শুরু হয়ে গেল কনসার্ট – বেহালা, ফ্লুট, হারমোনিয়ম আর তবলার সমবেত বাদ্যধ্বনি। আমাদের খাওয়ার পরেই মা-মাসিমারাও বসে পড়লেন। দিদিমা আর মামীমা খাবেন সবার শেষে - ভুবনমামা আর ভামিমাসি এলে। মায়েদের খাওয়া হতে হতে দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ল ঢং ঢং।
ঝকমকে জোব্বা, মাথায় বাহারি উষ্ণীষ, পায়ে সুন্দর নকশা করা
জুতো আর কোমরে বাঁধা খাপে ঢাকা তলোয়ার। রিহার্সালে দেখা আমার চেনাজানা সাধারণ
মানুষগুলো আমূল বদলে গেছে। পোষাক-পরিচ্ছদ যে একটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে এবং শরীরী
ভাষাকে কতখানি বদলে দিতে পারে – প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম সেদিন। মহিষাসুরকে আমার
বড়োমামা বলে একবারও মনে হল না – এমনকি
প্রহরণ আঁকা আটটা কাঠের হাত পিঠে বেঁধে ঝন্টুমামা যখন বড়মামার বুকে ত্রিশূল
ঠেকিয়ে, পা তুলে দিল বড়োমামার গায়ে – একটুও রাগ হয় নি ঝন্টুমামার ওপর। উপস্থিত
মহিলাদর্শকরা সমস্বরে উলুধবনি দিতে লাগলেন, বেশ কয়েকটা শাঁখও বেজে উঠল, শেষবারের
মতো বিবেক প্রবেশ করল শ্রীশ্রী চন্ডীর শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে। মহিলারা উপুড় হয়ে প্রণাম
করতে লাগলেন – মা দুগ্গা কর্তৃক মহিষাসুর নিধনের freezed দৃশ্যে।
বড়ো মামা তার হাত ধরে আটকে দিলেন বললেন, ‘ছি ছি ছি, ঝন্টু,
কী করছিস কি তুই? এখন তুই ঝন্টু নাকি? তুই এখন মা দুগগা’।
‘শিখে নে ঝন্টু, বিষ্ণুর থেকে শিখে নে। এমন ভাবনা না থাকলে
অভিনয় হয় না রে...’। বললেন জলদমামা।
রাজনীতি ছিল, দলাদলি ছিল, ছিল ঈর্ষার রেষারেষি। ভীষণ স্পষ্টভাবে ছিল ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ও ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা শান্ত পারম্পরিক এবং পরিপূরক সম্পর্কবোধ সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবহমাণ ছিল। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও নির্দিষ্ট মাত্রাবোধসম্পন্ন মানসিকতা, যা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত - এক সনাতন সভ্যতার উত্তরণের ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে।
আজও ভেদাভেদ রয়ে গেছে অন্য নামে অন্য রূপে - সুভদ্র মুখোশের আড়ালে, কিন্তু উপড়ে গেছে সব সম্পর্কের শিকড় এবং যাবতীয় মূল্যবোধ এসে ঠেকেছে তলানিতে। সর্বহারাদের স্বার্থে যাঁরা বিদেশী আদর্শকে অনুকরণ করছিলেন তাঁরা সব হারিয়ে ফেলে এখন দিশাহারা – উপহার দিয়েছেন একটি হযবরল সমাজ, যেখানে হাতের পেন্সিলটুকুও হারিয়ে গেছে বিপ্লবের দমবন্ধ করা ধোঁয়ায় আর তোলাবাজদের পৈশাচিক হুমকিতে।
ভাঙনটা শুরু হয়েছিল শহরে এবং ছড়িয়ে পড়ল দেশময় সর্বত্র -
টের পাচ্ছিলাম পরবর্তী কয়েক বছরে। যে অরূপরতনের সন্ধান পেয়েছিলাম ওই ক’মাসে, সে সব
হারিয়ে গেল বিলুপ্ত প্রজাতির মতো। সেসব অন্য কথা – সে অন্য প্রসঙ্গ।
...০০...
...চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন