মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ১


আমার এই ব্লগে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত কেনোপনিষদের ৩য় খন্ডের দ্বাদশ শ্লোকটি মনে করুন – “তখন সেই আকাশেই বহু সোনার অলংকারে সজ্জিতা এক নারী, উমা হৈমবতী আবির্ভূতা হলেন। ইন্দ্র তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “এই যক্ষ কে?””  উপনিষদ অর্থাৎ বৈদিক শ্লোকে আমরা যে এই হৈমবতী নারী উমার পরিচয় পাই – পৌরাণিক কালে তিনিই আদ্যাশক্তি মহামায়া – তন্ত্রের পরমাশক্তি।  

মহালয়ার ভোরে, দেবী পক্ষের শুরুতে আমরা যে “চণ্ডীপাঠ” শুনি – সেই দেবী চণ্ডীই, তন্ত্র মতে পরমাশক্তি আদ্যা মা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের তেরটি অধ্যায়কে (৮১ থেকে ৯৩) একত্রে “দেবী মাহাত্ম্যম্‌” বা “চণ্ডী” বলে। আনুষ্ঠানিক চন্ডী পাঠের আগে বহুবিধ স্তোত্র-স্তব পাঠের বিধিবিধান আছে। সে বিস্তারিত প্রকরণের মধ্যে নাক না গলিয়ে, প্রধান যে স্তোত্রটি সর্বজনপ্রিয়, “অর্গলা স্তোত্র”-এর উল্লেখ করে – মূল চন্ডীপাঠে মনোনিবেশ করব।

তার আগে মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও ঋষি মার্কণ্ড সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিই।  মার্কণ্ড বা মৃকণ্ড প্রাচীন হিন্দু ঋষি, তাঁর জন্ম মহর্ষি ভৃগুর বংশে অর্থাৎ তিনি ভার্গব ঋষি। তিনি ভগবান শিব এবং বিষ্ণুর পরমভক্ত ছিলেন। অধিকাংশ পণ্ডিতের মত, তাঁর রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণের রচনাকাল খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর কোন এক সময়। লোকশ্রুতি অনুসারে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায় যমুনোত্রী মন্দির যাওয়ার পথে যে স্থানটি “মার্কণ্ডেয় তীর্থ” নামে পরিচিত, সেখানেই ঋষি মার্কণ্ড তাঁর এই পুরাণটি নাকি রচনা করেছিলেন।


অর্গলা স্তোত্র

ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ

    ওঁ অস্য শ্রীঅর্গলাস্তোত্রমন্ত্রস্য বিষ্ণুঃ ঋষিঃ অনুষ্টুপ্‌ ছন্দঃ শ্রীমহালক্ষ্মীর্দেবতা শ্রীজগদম্বা প্রীত্যর্থং সপ্তশতীপাঠাঙ্গজপে বিনিয়োগঃ।

এই অর্গলা-স্তোত্র মন্ত্রের ঋষি বিষ্ণু, ছন্দ অনুষ্টুপ, দেবতা শ্রীমহালক্ষ্মী, দেবতা শ্রীজগদম্বার প্রীতির জন্যে সাতশ শ্লোকময় চণ্ডীপাঠের অঙ্গরূপে জপনীয়।

[অর্গল শব্দের অর্থ আগল অর্থাৎ প্রতিবন্ধক বা বাধা। যে কোন সিদ্ধি বা সাফল্যের পথে যা কিছু বাধা, তাদের দূর করাই এই অর্গলা-স্তোত্র সমূহের প্রধান উদ্দেশ্য।]  

 

ওঁ মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ওঁ জয় ত্বং দেবি চামুণ্ডে জয় ভূতাপহারিণি।

জয় সর্বগতে দেবি কালরাত্রি নমোঽস্তু তে।। ১

ওঁ ঋষি মার্কণ্ডেয় তাঁর শিষ্যদের বললেন, হে দেবি চামুণ্ডে তোমার জয় হোক। হে ভূত(বিঘ্ন)-অপহারিণী তোমার জয়, হে সর্বব্যাপিনি দেবি তোমার জয়, হে কালরাত্রিরূপিণী তোমাকে প্রণাম।

জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।

দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।। ২

হে দেবি, তুমি জয়ন্তী (জয়যুক্তা বা বিজয়িনী), তুমি মঙ্গলা (মঙ্গলদায়িনী), কালী (মহাসংহারিণী), ভদ্রকালী (মঙ্গলকারিণী), কপালিনী (প্রলয়কালে নৃমুণ্ডধারিণী), দুর্গা (দুর্গতিনাশিনী), শিবা (চিৎ-স্বরূপা চৈতন্যময়ী), ক্ষমা (কৃপাময়ী), ধাত্রী (বিশ্বপালিকা), স্বাহা (দেব সহায়িকা), স্বধা (পিতৃসেবিকা) রূপা, তোমাকে নমস্কার।

 মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃ বরদে নমঃ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৩

হে মধু-কৈটভ বিনাশিনি, বিধাতার বরদাত্রি, তোমাকে নমস্কার। তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো। (দ্বেষ অর্থ শত্রুতা, আমাদের অন্তরে বাহিরে অনেক শত্রু। অন্তরের ষড়রিপু – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, আমাদের পারলৌকিক সিদ্ধি পথের অর্গল বা বাধা। আর পার্থিব জগতের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঐহিক সুখের অর্গল অর্থাৎ অন্তরায়। এই সমস্ত শত্রুতা তিনি জয় করুন, অর্থাৎ দূর করুন।)   

মহিষাসুরনির্ণাশি ভক্তানাং সুখদে নমঃ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৪

 হে মহিষাসুরনাশিনি এবং ভক্তদের সুখদাত্রি, তোমাকে নমস্কার। তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

ধূম্রনেত্রবধে দেবি ধর্মকামার্থদায়িনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৫

হে ধূম্রলোচননাশিনি, তুমি ধর্ম, কাম ও অর্থ দায়িনি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

রক্তবীজবধে দেবি চণ্ডমুণ্ডবিনাশিনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৬

হে রক্তবীজঘাতিনি, হে চণ্ডমুণ্ডবিনাশিনি দেবি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

নিশুম্ভশুম্ভনির্ণাশি ত্রৈলোক্যশুভদে নমঃ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৭

হে নিশুম্ভ-শুম্ভমর্দিনি, ত্রিলোকের শুভদায়িনি, তোমাকে নমস্কার, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

বন্দিতাঙ্ঘ্রিযুগে দেবি সর্বসৌভাগ্যদায়িনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৮

সৃষ্টির আদিতে দেব-বন্দিতা হে দেবি, তুমি সর্ব সৌভাগ্যদায়িনি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

অচিন্ত্যরূপচরিতে সর্বশত্রুবিনাশিনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ৯

হে দেবি তোমার রূপ ও মহিমা অচিন্ত্যনীয়, তুমি সর্ব শত্রুবিনাশিনি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

নতেভ্যঃ সর্বদা ভক্ত্যা চাপর্ণে দুরিতাপহে।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১০

হে অপর্ণে, তোমার আশ্রিত ভক্তদের তুমি সর্বদাই পাপহারিণি, হে দেবি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

[দেবী পার্বতীর আরেক নাম অপর্ণা। দেবী পার্বতী কুমারী অবস্থায়, শিবকে পতিরূপে লাভ করার জন্যে কঠোর তপস্যা করেছিলেন, নিরাহারী সেই তপস্যায় একটি পর্ণ বা পাতাও তিনি আহার করেননি, তাই তাঁর নাম অপর্ণা।]  

স্তবদ্ভ্যো ভক্তিপূর্বং ত্বাং চণ্ডিকে ব্যাধিনাশিনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১১

ভক্তিভরে স্তব করলে, তুমিই আমাদের ব্যাধিনাশিনি, হে চণ্ডিকে, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

চণ্ডিকে সততং যুদ্ধে জয়ন্তী পাপনাশিনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১২

হে চণ্ডিকে সকল যুদ্ধেই তুমি বিজয়িনি ও পাপনাশিনি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো। 

দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম্‌।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৩

হে দেবি আমাদের সৌভাগ্য, আরোগ্য এবং পরমসুখ দাও, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

বিধেহি দেবি কল্যাণং বিধেহি বিপুলাং শ্রিয়ম্‌।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৪

হে দেবি আমাদের কল্যাণ বিধান কর, বিপুল ঐশ্বর্য বিধান কর, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

বিধেহি দ্বিষতাং নাশং বিধেহি বলমুচ্চকৈঃ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৫

হে দেবি, আমাদের শত্রুনাশের বিধান কর, আমাদের বিপুল শক্তির বিধান করো, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

সুরাসুরশিরোরত্ন-নিঘৃষ্টচরণাম্বুজ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৬

হে দেবি, দেবতা ও অসুরদের মুকুটের রত্নরাজি তোমার চরণকমলে বিরাজ করে, হে দেবি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং লক্ষ্মীবন্তঞ্চ মাং কুরু।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৭

আমাকে বিদ্বান, যশস্বী এবং সমৃদ্ধিশালী কর, হে দেবি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

দেবি প্রচণ্ডদোর্দণ্ড দৈত্যদর্পনিষূদিনি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৮

হে দেবি তুমি প্রচণ্ড-প্রতাপশালী দৈত্যদের গর্বহারিনি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

প্রচণ্ডদৈত্যদর্পঘ্নে চণ্ডিকে প্রণতায় মে।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ১৯

প্রচণ্ড-দৈত্যদের দর্পনাশিনি, হে চণ্ডিকে তোমাকে প্রণাম করি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

চতুর্ভুজে চতুর্বক্ত্র-সংস্তুতে পরমেশ্বরি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২০

হে চতুর্ভুজে, চতুর্মুখ ব্রহ্মা আপনার স্তুতি করেন, হে পরমেশ্বরি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

কৃষ্ণেন সংস্তুতে দেবি শশ্বদ্ভক্ত্যা সদাম্বিকে।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২১

হে দেবী, কৃষ্ণ (বিষ্ণু) তোমার সদাভক্তরূপে স্তব করে থাকেন, হে অম্বিকে, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

হিমাচলসুতানাথ-সংস্তুতে পরমেশ্বরি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২২

হে পরমেশ্বরি, হিমালয়-দুহিতা উমার পতি (মহাদেব), তোমার স্তুতি করেন, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

ইন্দ্রাণীপতিসদ্ভাব-পূজিতে পরমেশ্বরি।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২৩

ইন্দ্রপত্নী তাঁর পতির অবস্থান জানতে আপনার আরাধনা করেছিলেন, হে পরমেশ্বরি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

[পৌরাণিক কাহিনী আছে, একবার দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন এবং সকলের অজ্ঞাতে পদ্মবনে মৃণাল হয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। তখন ইন্দ্রপত্নী শচী দেবী চণ্ডীর আরাধনা করে পতি ইন্দ্রের অবস্থান জানতে পারেন এবং মৃণালবনে মিলিত হন।]  

দেবি ভক্তজনোদ্দাম-দত্তানন্দোদয়েঽম্বিকে।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২৪

ভক্তজনের হৃদয়ে উদ্দাম আনন্দ প্রদায়িনি হে দেবি অম্বিকে, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্‌।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২৫

সম মনোবৃত্তির মনোরমা ভার্যা দাও, হে দেবি, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

তারিণি দুর্গসংসার-সাগরস্যাচলোদ্ভবে।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। ২৬

দুর্গম সংসার-সাগরতারিণি, হে পর্বতদুহিতে, তুমি আমাদের রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমাদের দ্বেষ জয় করো।

ইদং স্তোত্রং পঠিত্বা তু মহাস্তোত্রং পঠেন্নরঃ।

সপ্তশতীং সমারাধ্যা বরমাপ্নোতি দুর্লভম্‌।। ২৭

এই স্তোত্রসমূহ পাঠ করে ভক্তজনের মহাস্তোত্র (শ্রীশ্রীচণ্ডী) পাঠ করা উচিৎ এবং এইভাবেই সাতশত স্তোত্রের আরাধনায় দুর্লভ বর লাভ করা যায়।

  ইতি অর্গলা-স্ত্রোত্রম্‌ সমাপ্তম্‌।

এখানেই অর্গলা-স্তোত্র সমাপ্ত হল।


শ্রীশ্রীচণ্ডী

[শ্রীশ্রী চণ্ডীর প্রথম চরিত্র (প্রথম অধ্যায়), মধ্যম চরিত্র (দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়) এবং উত্তর চরিত্র (পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায়) মনে কামনার সংকল্প নিয়ে পাঠ করলে, ধর্ম, অর্থ ও কাম অর্থাৎ অভ্যুদয় বা সাংসারিক উন্নতি লাভ হয়। আর নিষ্কাম সংকল্প নিয়ে পাঠ করলে মোক্ষলাভ অর্থাৎ সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অতএব চণ্ডীপাঠে মানবজীবনের সমুদয় চতুর্বর্গ লাভ হয়ে থাকে। এই কারণেই শ্রীশ্রীচণ্ডীদেবীর আরাধনা করে রাজা সুরথ হারানো-রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন এবং বৈশ্য সমাধি ব্রহ্মজ্ঞান বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন।]          

 

ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ

ওঁ অস্য শ্রীপ্রথমচরিত্রস্য ব্রহ্মা ঋষিঃ, মহাকালী দেবতা, গায়ত্রীছন্দঃ, নন্দা শক্তিঃ, রক্তদন্তিকা বীজম্‌, অগ্নিস্তত্ত্বম্‌, ঋগ্বেদঃ স্বরূপম্‌। মহাকালী-প্রীত্যর্থং প্রথমচরিত্র জপে বিনিয়োগঃ।

শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রথম চরিত্রের ঋষি - ব্রহ্মা, দেবতা - মহাকালী, ছন্দঃ – গায়ত্রী, শক্তি - নন্দা, বীজ - রক্তদন্তিকা, তত্ত্ব- অগ্নি, স্বরূপ – ঋগ্বেদ। শ্রীমহাকালীর প্রীতিলাভ করার জন্যে প্রথমচরিত্র জপ করাই বিধেয়।

 

মহাকালীর ধ্যান

 

ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান্‌ শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্‌।

নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাং যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্‌।।

[ওঁ খড়্গং চক্র-গদা-ইষু-চাপ-পরিঘান্‌ শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ শঙ্খং সন্দধতীং করৈঃ ত্রিনয়নাং সর্ব-অঙ্গ-ভূষা আবৃতাম্‌।

নীল-অশ্ম-দ্যুতিম্‌ আস্য-পাদ-দশকাং সেবে মহাকালিকাং যাম্‌ অস্তৌৎ শয়িতে হরৌ কমল-জঃ হন্তুং মধুং কৈটভম্‌।।]

(দশ হাতে) খড়্গ, চক্র, গদা, তির, ধনুক, লগুড়, শূল, ভুশুণ্ডী, নরমুণ্ড, শঙ্খ ধারণ করে, যে ত্রিনয়না(দেবী) সর্ব অঙ্গভূষণে অলংকৃতা। দশমুখ ও দশ পায়ে যিনি নীলকান্তমণির মতোই প্রভাময়ী। হরির (যোগনিদ্রায়) শয়নকালে, মধু-কৈটভের বিনাশের জন্যে স্বয়ং ব্রহ্মা যাঁর স্মরণে স্তব করেছিলেন, আমি সেই মহাকালীকার সেবায় ধ্যান করি।

[পৌরাণিক সৃষ্টি তত্ত্বে বর্ণনা করা হয়েছে, মহাপ্রলয়ে বিশ্বসংসার অর্থাৎ এই পৃথিবী একার্ণব অর্থাৎ একটিমাত্র সমুদ্রের জলে ডুবে ছিল। ঘন অন্ধকার ও সীমাহীন সেই সমুদ্রের জলের উপর যোগনিদ্রায় নিদ্রামগ্ন ছিলেন, শ্রীহরি বা ভগবান বিষ্ণু। অনন্তনাগ তাঁর সহস্র-ফণা বিস্তার করে, শ্রীহরির মাথার ওপরে ছত্রি ধারণ করেছিলেন এবং তাঁর কুণ্ডলি পাকানো শরীরকে তাঁর শয্যা রচনা করেছিলেন কোন এক সময়, যখন আদি-সৃষ্টির শুভক্ষণ এল, শ্রীহরির নাভি থেকে উৎপন্ন হল আশ্চর্য এক পদ্ম। একই সময়ে বিষ্ণুর শরীর থেকে বের হয়ে প্রজাপিতা ব্রহ্মা এসে বসলেন সেই পদ্মের উপর। সেই পদ্মের উপর বসে, ব্রহ্মা যখন চারদিকের পরিস্থিতি লক্ষ্য করছিলেন, তখনই শ্রীহরির কান থেকে বেরিয়ে এল দুই ভয়ংকর দৈত্য – মধু ও কৈটভ।

জনপ্রাণীহীন, ঘনান্ধকার প্রলয় সাগরে অদ্ভূত এক পদ্মের উপর বসে থাকা ব্রহ্মাকে দেখে দুই দৈত্য ব্রহ্মাকে বিনাশ করতে উদ্যত হল। অসহায় ব্রহ্মা কী করবেন? শ্রীহরি ছাড়া কে ওই দুর্দান্ত দুই দৈত্যকে হত্যা করতে পারবে? কিন্তু শ্রীহরি তো তখন মহামায়ার প্রভাবে গভীর নিদ্রামগ্ন – তাঁর ঘুম কে ভাঙাতে পারবেন? তিনি উপলব্ধি করলেন, যে মহামায়ার মায়ায় বিষ্ণু নিদ্রাচ্ছন্ন, একমাত্র সেই মহামায়াই পারবেন তাঁর নিদ্রা ভাঙাতে। অতএব তিনি মহামায়ার স্তব শুরু করলেন, এবং অচিরেই দেবী সেই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীবিষ্ণুর শরীর থেকে বেরিয়ে এসে, বিষ্ণুকে মায়ামুক্ত করলেন। শ্রীবিষ্ণু জেগে উঠেই দেখলেন দুই দৈত্য ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত। তিনি তখনই তাদের আক্রমণ করলেন এবং পাঁচহাজার বছর ধরে যুদ্ধের পর – সেই দুই দৈত্যকে বধ করলেন। সেই নিহত মধুকৈটভের মেদ থেকেই সৃষ্টি হল এই মেদিনীর – অর্থাৎ পৃথিবীর।]                       


পরের পর্বে আসবে মূল চণ্ডীর প্রথম চরিত 

গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির।    



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

সুরক্ষিতা - শেষ পর্ব

  [এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি ...