মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তুলনা তার নাই...


[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 





[এর আগের পর্ব পড়তে হলে পাশের সূত্রে যান নীড় ছোট ক্ষতি নেই... ]


 


 ক্লাস ফাইভে যখন পড়ছিলাম, মর্নিং সেসানে আমরা ছিলাম সিনিয়রমোস্ট বাচ্চা। আর ক্লাস সিক্সে উঠে হয়ে গেলাম ডে সেসনের জুনিয়ারমোস্ট বড়।

তবু বড়ো তো হয়েছি। মা ভরসা করে একলা ছেড়ে দিয়েছেন। স্কুলে বেরোনোর সময় হাতে দিয়েছেন একটা সিকি, বলেছেন, ‘টিফিনে খিদে পেলে কিছু কিনে খাস। তাই বলে ছাইপাঁশ খেয়ে যেন পেট খারাপ করিস না’। 

প্যান্টের পকেটে সিকি, জামার বুকপকেটে ফাউন্টেন পেন আর হাতে একটা খাতা নিয়ে প্রথম দিন রওনা দিলাম স্কুলেএতদিন মর্নিং সেসানে সকাল পৌনে সাতটায় বেরোতাম। সকালের কোমল আলো, শান্ত পরিবেশে। ওই সময়ে বড়ো রাস্তায় লোকজন কম থাকত, গাড়ি থাকত আরো কম লোকজনের হৈ হট্টগোলের চেয়ে চড়ুই, কাক, শালিক আর পায়রাদের ব্যস্ততা নজরে আসত বেশী। দোকানপাট সবই থাকত বন্ধ – বেশ নিরিবিলি, নিশ্চিন্ত ছিল পথচলা। সে ছিল একরকম। আর আজ বেলা সাড়ে দশটায় - উজ্জ্বল চোখে লাগা আলো। এই শেষ ফেব্রুয়ারিতে রোদ্দুর তার উষ্ণতার মোড়ক ছাড়িয়ে তপ্ত হয়ে উঠেছেবড়ো রাস্তায় গাড়ির অবিচ্ছিন্ন চলাচল। দোকানপাট সব খোলা। পথে লোকজনের চরম ব্যস্ততা - চারিদিকে হৈচৈ কোলাহল। 

প্রথমতঃ দিদিমা, মাসিমাদের ও বন্নিদিদির অপরিমিত আদর ও যত্নের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক। দ্বিতীয়তঃ, তিনমাসব্যাপী নিয়মছাড়া – লাগামহারা গ্রামজীবনের জমাট হ্যাংওভার তৃতীয়তঃ জীবনে প্রথমবার একা এই পথচলা এবং একা একা বড়ো রাস্তা পার হওয়ার চাপা ভয়মিশ্রিত জিদতারও ওপর মর্নিং সেসনে স্কুলে যাওয়ার মতো অভ্যস্ত পথচলাও এখন আর নেই। সব মিলিয়ে আমার মনটা বেশ ভারি হয়ে উঠছিল পথ চলতে চলতে। পাঁচবছর যে রাস্তা অবহেলায় হেঁটে পার হয়েছি – আজ নিজেকে মনে হচ্ছে অনন্ত পথের সঙ্গীসাথীহীন যাত্রী – ওইটুকু পথও যেন শেষ হচ্ছিল না

সব দুঃখরাত্রির পর যেমন ভোর আসে। প্রবল দুর্যোগের পর যেমন নেমে আসে মেঘভাঙা রোদ। ঠিক সেভাবেই স্কুলে পৌঁছে গেলাম। ভাস্করদা, গেটেই ছিল একগাল হেসে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আসি গলা? তোমারঅ বাপঅ কেত্তে থরে আসিলা আউ, খবরঅ পাঁই... যাও, যাও...নতুন ঘরে গিয়ে বসো’। ক্লাস সিক্সের ঘরে গিয়ে জুটলাম এবং সেখানে একে একে জুটতে লাগল আমাদের ক্লাসের সকলে।

এতদিনের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে - তিনমাসের সংযোগহীন থমকে থিতিয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার সুসম মিশ্রিত হয়ে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। এই কমাসের অনালাপের সঙ্কোচ কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বভাবসুলভ হট্টগোলে পরিণত হল। সকলেই শোনাতে চায় সে কি করেছে এই তিনমাস – কেউ গেছে পাহাড়ে। কেউ সাগরে। রোমাঞ্চে ভরপুর সেই সব ভ্রমণ কাহিনী।

সেইসব ভ্রমণকাহিনীর ভূমিকার হট্টগোলের মধ্যেই সেদিন ক্লাস শুরু হয়ে গেল। নতুন সেসনের নতুন ক্লাস। নতুন মাস্টারমশাই। রেজাল্ট বের হবার কোন দুশ্চিন্তা নেই। কাজেই ভাল রেজাল্টের আনন্দ অথবা খারাপ রেজাল্টের বিমর্ষতাহীন সাদামাটাভাবে শুরু হল ক্লাস সিক্সের সূচনা। কিছুটা কথাবার্তার পর আমাদের বইয়ের তালিকা বোর্ডে লিখে দিলেন মাস্টারমশাই – কারণ এবারে বুকলিস্ট ছাপানো সম্ভব হয়নি। বোর্ডে লিখে দিলেন ক্লাসের রুটিন – আর ঘোষণা করলেন আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে পুরোদস্তুর রুটিন মাফিক।            

মাস্টারমশাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে আমাদের হট্টগোল আবার শুরু হল। এলোমেলো ভাবে শুনলাম অনেকের ভ্রমণ কাহিনীগুলি। সকলেই ভাগ করে নিতে চাইছিল তাদের রোমাঞ্চ ও উত্তেজনাপূর্ণ অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। তার মধ্যে ছিল - সূর্যোদয়ের আভায় মহিমান্বিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ ও হতাশা। পুরীর সাগরবেলায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নুলিয়াদের সাহায্যে লবণাম্বু স্নানে কালো হয়ে ওঠা ফর্সা মুখ। ভাইজ্যাগের সীবীচ, পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রম। বোম্বাই শহর - তার জুহু বীচ, মেরিন ড্রাইভ, এলিফ্যান্টা কেভস...নিয়ে ঢুকে পড়ল আমার কল্পনায়। ছোট ছোটো ঝর্ণা, তিরতিরে নদী, ঘন শালের জঙ্গল, হরিণ, ময়ুর, নীলগাই চড়া কুয়াশায় প্রসাধিত পূর্ণিমার রাত। রাতচরা পাখির ডাক। দূর থেকে ভেসে আসা বাঘের গর্জন ... এইসব নিয়ে ভিতরকণিকা, বেতলা, পালামৌ, হাজারিবাগ... হাজির হতে থাকল আমার কল্পনায়... 

আমার বন্ধুদের বিখ্যাত পর্বত-সাগর-অরণ্য জয়ের রম্য রোমাঞ্চের পাশে আমার বাংলার গ্রাম্য অভিজ্ঞতা নিছক পানসে এবং জোলো মনে হচ্ছিল। অনেকেই যখন জিগ্যেস করেছিল – কিরে তুই কোথাও যাসনি – নাকি কোলকাতাতেই ছিলি? খুব উদাসীন উত্তর দিয়েছিলাম – নাঃ, মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। ও বয়সে মামারবাড়িতো সকলেই যায় – কাজেই কেউই উৎসাহ দেখায়নি আমার অভিজ্ঞতার অংশভাক হতে। আমারও গ্রাম বাংলায় দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে যে সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহ মনে আহৃত হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য আজও অর্জন করতে পারিনি। কাজেই সেদিন  নীরব ও আপাত উদাসীন থাকা ছাড়া আমার কোন গত্যন্তর ছিল না। তাছাড়াও হয়তো একধরনের হীনমন্যতাও কাজ করেছিল আমার বালক মনে – কারণ আমার দর্শনে না ছিল কোন গ্ল্যামার, না ছিল কোন চমক       

স্কুল ছুটির পর, একলা ফেরার পথটা, সকালের আসার পথের মতো আর কোন প্রতিক্রিয়া করল না মনে। সকালের সফল যাত্রার পর বেড়ে গিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। দীর্ঘদিন অদেখা সমবয়সী সহপাঠীদের সঙ্গ আমার মনকেও অনেকটা স্থিতাবস্থা এনে দিয়েছিল। মামাবাড়ির স্নেহের আর আদরের জীবনযাত্রা আর স্কুলে আমার এই নিজস্ব জগৎটা খুব স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার মনে - তাদের নিজ নিজ মহিমা নিয়েই। দুটো পরিস্থিতিই যে আলাদা আলাদা ভাবে আমার কাছে ভীষণ প্রয়োজনীয় - সেই বোধ আমার আসছিল ধীরে ধীরে। কাজেই ফেরার পথটা বরং বেশ কেটে গেল বন্ধুদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার সাদামাটা গ্রাম্য অভিজ্ঞতার তুল্যমূল্য বিচার করতে করতে।

 পুকুরপাড়ে ঝুঁকে মুখ দেখতে থাকা narcissus তালগাছের ছায়ায় সারাটা দিন ভেসে বেড়ান নিশ্চিন্ত হাঁসের পাল। স্বর্গদ্বার অথবা মেরিন ড্রাইভের মহিমা তারা পাবে কোথায়? গলায় বাঁধা ঘন্টার আওয়াজ তুলে ঘরে ফেরা গরুর পাল আর শেষ বিকেলে তাদের পিছনে সধবার মস্ত সিঁদুরের টিপের মতো অস্তগামী সূর্যের আলোমাখা গোধূলি। জুহুর সূর্যাস্তের অপরূপ বৈভবের কাছে সেতো তুচ্ছ! প্রচুর ফসল ফলানোর পর অলস ক্ষেত্রের নিঃস্ব অবসরযাপনের দিগন্ত বিস্তৃত প্রসার, কোথায় পাবে বেতলা বা পালামৌয়ের আরণ্য রহস্য?

প্রথমদিন নিরাপদে বাড়ি এসে পৌঁছতে মাও খুব নিশ্চিন্ত হলেন। আমার মুখে বন্ধুদের নানান দেশ বেড়ানোর কাহিনী শুনতে শুনতে মা কী উপলব্ধি করেছিলেন জানিনা। মা বলেছিলেন – ‘ওসবের জন্যে তো সারাজীবনটাই পড়ে রইল – কিন্তু এই কমাসে তুই যা দেখলি, সঞ্চয় করলি, তা কোনদিনই আর ফিরে পাবি বলে আমার মনে হয় না। কী পেয়েছিস সে বোঝার সাধ্য আজ তোর না হবারই কথা, ধৈর্য ধর - বড় হলে বুঝতে পারবি - যা পেয়েছিস তুলনা তার নেই’।


...চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...