উপনিষদ ও পুরাণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উপনিষদ ও পুরাণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

গীতা - ৮ম পর্ব

 





এর আগের সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে "গীতা - ৭ম পর্ব"


অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রহ্মযোগ


অর্জুন উবাচ

কিং তদ্‌ব্রহ্ম কিমধ্যাত্মং কিং কর্ম পুরুষোত্তম।

অধিভূতং চ কিং প্রোক্তমধিদৈবং কিমুচ্যতে।।

অর্জুন উবাচ

কিং তৎ ব্রহ্ম কিং অধ্যাত্মং কিং কর্ম পুরুষোত্তম।

অধিভূতং চ কিং প্রোক্তম অধিদৈবং কিম্‌ উচ্যতে।।

অর্জুন বললেন- হে পুরুষোত্তম, ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? কাকেই বা অধিভূত বলে আর কাকেই বা অধিদৈব বলা হয়?

 

অধিযজ্ঞ কথং কোঽত্র দেহেঽস্মিন্‌ মধুসূদন।

প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়োঽসি নিয়তাত্মভিঃ।।

অধিযজ্ঞ কথং কঃ অত্র দেহে অস্মিন্‌ মধুসূদন।

প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়ঃ অসি নিয়ত-আত্মভিঃ।।

হে মধুসূদন, এই দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং কোথায় তার অবস্থান? আত্মসংযমী ব্যক্তি কিভাবেই বা মৃত্যুকালে তোমাকে জানতে পারে?

 

শ্রীভগবানুবাচ

অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোঽধ্যাত্মমুচ্যতে।

ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ।।

শ্রীভগবান উবাচ

অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবঃ অধ্যাত্মম্‌ উচ্যতে।

ভূতভাব-উদ্ভবকরঃ বিসর্গঃ কর্ম-সংজ্ঞিতঃ।।

শ্রীভগবান বললেন- অক্ষরকেই পরম ব্রহ্ম বলে। ব্রহ্মের স্বভাবকে অধ্যাত্ম বলে। সমস্ত ভূতবস্তুর সৃজনকারী দেবতাদের উদ্দেশে বিসর্গের নাম কর্ম। 

[ওঁ হল পরম অক্ষর ও আদি শব্দ, প্রণব। এই শব্দ থেকেই এই জগতের সৃষ্টি বিসর্গ মানে বিসর্জন, দেবতাদের উদ্দেশে দ্রব্য উৎসর্গ করা হয় যে যজ্ঞে, তাকেই বিসর্গ বলে।]

 

অধিভূতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চাধিদৈবতম্‌।

অধিযজ্ঞোঽহমেবাত্র দেহে দেহভূতাং বর।।

অধিভূতং ক্ষরঃ ভাবঃ পুরুষঃ চ অধিদৈবতম্‌।

অধিযজ্ঞঃ অহম এব অত্র দেহে দেহভূতাং বর।।

হে নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, বিনাশশীল সমস্ত পদার্থই অধিভূত, পরমপুরুষ ব্রহ্ম অধিদেবতা, আর আমিই এই দেহে অবস্থিত অধিযজ্ঞ।

 

অন্তকালে চ মামেব স্মরণ্মুক্ত্বা কলেবরম্‌।

যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ।।

অন্তকালে চ মাম্‌ এব স্মরন্‌ মুক্ত্বা কলেবরম্‌।

যঃ প্রয়াতি স মৎ ভাবং যাতি নাস্তি অত্র সংশয়ঃ।।

এবং মৃত্যুকালে আমাকেই স্মরণে রেখে, দেহ ত্যাগ ক’রে যিনি প্রয়াণ করেন, তিনি আমার স্বরূপেই মিলিত হন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

 

যং যং বাপি স্মরন্‌ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্‌।

তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতাঃ।।

যং যং বা অপি স্মরন্‌ ভাবং ত্যজতি অন্তে কলেবরম্‌।

তং তম্‌ এব ইতি কৌন্তেয় সদা তৎ ভাব ভাবিতাঃ।।

হে কুন্তীপুত্র অর্জুন, যিনি সর্বদা যে দেবতার শরণাগত থাকেন, মৃত্যুকালেও সেই দেবতার বিষয়ে চিন্তা করে দেহ ত্যাগ করলে, তিনি সেই দেবতারই স্বরূপ লাভ করেন।

   

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ।

ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যস্যসংশয়ম্‌।।

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মাম্‌ অনুস্মর যুধ্য চ।

ময়ি অর্পিত মনঃ-বুদ্ধিঃ মাম্‌ এব এষ্যসি অসংশয়ম্‌।।

অতএব, আমাকে সর্বদা স্মরণে রেখে, তুমি যুদ্ধ করো। কোন দ্বিধা বা সংশয় না ক’রে, তোমার মন এবং বুদ্ধি আমাকে সমর্পণ করলে, তুমি আমাকেই লাভ করবে। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

 

অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা নান্যগামিনা।

পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থানুচিন্তয়ন্‌।।

অভ্যাস-যোগ-যুক্তেন চেতসা না অন্যগামিনা।

পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থ অনুচিন্তয়ন্‌।।

হে পার্থ, অন্তরে সর্বদা ঈশ্বর চিন্তার অভ্যাসকে অন্তরঙ্গ সাধন বলে। অভ্যাস যোগে, একাগ্র মনে সর্বদা ধ্যান করতে করতেই সেই দিব্য পরমপুরুষকে লাভ করা যায়। 

 

কবিং পুরাণমনুশাসিতারমণোরণীয়াংসমনুস্মরেদ্‌ যঃ।

সর্বস্য ধাতারমচিন্ত্যরূপমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।।

কবিং পুরাণং অনুশাসিতারম্‌ অণোঃ অণীয়াংসম্‌ অনুস্মরেৎ যঃ।

সর্বস্য ধাতারম্‌ অচিন্ত্য-রূপম্‌ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।।

যিনি সর্বজ্ঞ, চিরায়ত বিশ্বকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, যিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর, যাঁর স্বরূপ চিন্তা করা যায় না, যিনি সূর্যের মতো স্বপ্রকাশ ও দীপ্তিমান, যিনি সমস্ত অন্ধকারের অতীত এবং সর্ব জীবের কর্মফলদাতা

  

১০

প্রয়াণকালে মনসাঽচলেন

   ভক্ত্যা যুক্তো যোগবলেন চৈব।

ভ্রুবোর্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্‌

   স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্‌।।

প্রয়াণকালে মনসাঃ অচলেন

   ভক্ত্যা যুক্তঃ যোগবলেন চ এব।

ভ্রুবোঃ মধ্যে প্রাণম্‌ আবেশ্য সম্যক্

   স তং পরং পুরুষম্‌ উপৈতি দিব্যম্‌।।

মৃত্যুকালে একান্ত ভক্তিতে, একাগ্র মনে, একনিষ্ঠ সাধনায়, নিজের প্রাণকে ভ্রূযুগলের মধ্যে স্থির রেখে, তাঁর স্মরণে যিনি ধ্যানমগ্ন থাকেন, তিনিই সেই দিব্য পরম পুরুষকে লাভ করেন।

 

১১

যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি

   বিশন্তি যদ্‌ যতয়োঃ বীতরাগাঃ।

যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি

   তৎ তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে।।

যৎ অক্ষরং বেদবিদঃ বদন্তি

   বিশন্তি যদ্‌ যতয়োঃ বীতরাগাঃ।

যৎ ইচ্ছন্তঃ ব্রহ্মচর্যং চরন্তি

   তৎ তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে।।

বেদবিৎ পণ্ডিতেরা যাঁকে অবিনাশী অক্ষর বলেন, বিষয়ের আসক্তিহীন সন্ন্যাসীরা যাঁর স্বরূপে মিশে যান, যাঁকে উপলব্ধির জন্যে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়, সেই পরম ব্রহ্মপদ লাভের উপায় আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি।

 

১২

সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ।

মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্‌।।

সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনঃ হৃদি নিরুধ্য চ।

মূর্ধ্নি আধায় আত্মনঃ প্রাণম্‌ আস্থিতঃ যোগধারণাম্‌।।

সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার সংযত করে, অস্থির চিত্তকে হৃদয়ের মধ্যে রুদ্ধ রেখে, ভ্রুযুগলের মাঝখানে নিজের প্রাণকে স্থির রেখে, একনিষ্ঠ সাধনায়,

 

১৩

ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্‌ মামনুস্মরন্‌।

যঃ প্রয়াতি ত্যজন্‌ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্‌।।

ওম্‌ ইতি এক-অক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্‌ মাম্‌ অনুস্মরন্‌।

যঃ প্রয়াতি ত্যজন্‌ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্‌।।

এবং যিনি মৃত্যুকালে দেহত্যাগের সময় ব্রহ্মস্বরূপ ‘ওঁ’ এই এক অক্ষর উচ্চারণ করতে করতে, আমার চিন্তা করেন, তিনি পরম ব্রহ্মপদ লাভ করেন।

  

 

১৪

অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।

তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।।

অনন্যচেতাঃ সততং যঃ মাং স্মরতি নিত্যশঃ।

তস্য অহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।।

হে পার্থ, যিনি অন্য কোন চিন্তা না করে, সারা জীবন সব সময় আমাকেই স্মরণ করেন, আমার চিন্তায় মগ্ন সেই সন্ন্যাসীর কাছে আমি সহজেই ধরা দিয়ে থাকি। 

 

১৫

মামুপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখালয়মশাশ্বতম্‌।

নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ।।

মাম্‌ উপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখ-আলয়ম্‌ অশাশ্বতম্‌।

ন আপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ।।

আমাকে লাভ করার পর, পরমজ্ঞানী সিদ্ধ পুরুষকে, দুঃখের আধার এই অনিশ্চিত সংসারে আর জন্ম গ্রহণ করতে হয় না।

 

১৬

আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোঽর্জুন।

মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।

আব্রহ্ম ভুবনাৎ লোকাঃ পুনঃ-আবর্তিনঃ অর্জুন।

মাম্‌ উপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।

হে অর্জুন, ব্রহ্মলোক থেকে এই ভূলোক পর্যন্ত সর্বত্র বার বার জন্ম নিতে হয়, কিন্তু, হে কৌন্তেয়,  আমাকে লাভ করলে আর পুনর্জন্ম হয় না।  

 

১৭

সহস্রযুগপর্যন্তমহর্যদ্‌ ব্রহ্মণো বিদুঃ।

রাত্রিং যুগসহস্রান্তাং তেঽহোরাত্রবিদো জনাঃ।। 

সহস্র-যুগ-পর্যন্তম্‌ অহঃ যৎ ব্রহ্মণঃ বিদুঃ।

রাত্রিং যুগ-সহস্র-অন্তাং তে অহঃ-রাত্র-বিদঃ জনাঃ।। 

হাজার যুগ ধরে ব্যাপ্ত ব্রহ্মার দিন এবং হাজার যুগ ব্যাপি তাঁর রাত, এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিই দিনরাত্রির রহস্য উপলব্ধি করতে পারেন।  

 

১৮

অব্যক্তাদ্‌ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্ত্যহরাগমে।

রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে।।

অব্যক্তাদ্‌ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্তি অহঃ আগমে।

রাত্রি আগমে প্রলীয়ন্তে তত্র এব অব্যক্তসংজ্ঞকে।।

ব্রহ্মার দিন শুরু হলে অব্যক্ত থেকে এই জগতের সবকিছুই আকার পায় এবং রাত্রিতে তারাই আবার নিরাকারে বিলীন হয়।

 

১৯

ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে।

রাত্র্যাগমেঽবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে।।

ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে।

রাত্রি-আগমে অবশঃ পার্থ প্রভবতি অহঃ-আগমে।।

হে পার্থ, সেই পার্থিব বস্তুসকল বার বার সৃষ্টি হয়ে ব্রহ্মার রাত্রিতে বিলীন হয় এবং তাঁর দিনের শুরুতে,  নিজের কর্মের ফল অনুসারে তারা আবার জন্মলাভ করে।

   

২০

পরস্তস্মাৎ তু ভাবোঽন্যোঽব্যক্তোঽব্যক্তাৎ সনাতনঃ।

যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি।।

পরঃ তস্মাৎ তু ভাবঃ অন্যঃ অব্যক্তঃ অব্যক্তাৎ সনাতনঃ।

যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি।।

কিন্তু যে অব্যক্তভাব থেকে এই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়, তার থেকে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অগোচর সনাতন অব্যক্তভাব। সমস্ত বিশ্বচরাচরের বিনাশ হলেও এই ভাব নষ্ট হয় না।

   

২১

অব্যক্তোঽক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম্‌।

যঃ প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।

অব্যক্তঃ অক্ষর ইতি উক্তঃ তং আহুঃ পরমাং গতিম্‌।

যঃ প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তৎ ধাম পরমং মম।।

এই যে সনাতন অব্যক্তভাবের কথা বললাম, এই ভাবকেই অক্ষর বলে, এই ভাবকেই পরমা গতি বলে। এই ভাব লাভ করলে পুনর্জন্ম হয় না, আর এই ভাবই আমার পরমধাম।

 

 

২২

পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যস্ত্বনন্যয়া।

যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং ততম্‌।।

পুরুষঃ স পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যঃ তু অনন্যয়া।

যস্য অন্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বম্‌ ইদং ততম্‌।।

হে পার্থ, যাঁর অন্তরে সকল জীবজগতের আশ্রয়, যিনি এই বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন, সেই পরম পুরুষকে হৃদয়ের একান্ত ভক্তি দিয়ে লাভ করা যায়।

 

২৩

যত্র কালে ত্বনাবৃত্তিমাবৃত্তিং চৈব যোগিনঃ।

প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভঃ।।

যত্র কালে তু অনাবৃত্তিম্‌ আবৃত্তিং চ এব যোগিনঃ।

প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভঃ।।

হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ, যে কালে মৃত্যু হলে, যোগীগণ পরমমুক্তি লাভ করেন অথবা আবার জন্ম গ্রহণ করেন, সেই কালের কথাই তোমাকে এখন বলব। 

 

২৪

অগ্নির্জ্যোতিরহঃ শুক্লঃ ষণ্মাসা উত্তরায়ণম্‌।

তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ।।

অগ্নিঃ জ্যোতিঃ অহঃ শুক্লঃ ষণ্মাসা উত্তরায়ণম্‌।

তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ।।

অগ্নি, জ্যোতি, দিবস, শুক্লপক্ষ, এবং উত্তরায়ণের ছয়মাস, দেবযানের এই মার্গে প্রয়াণ হলে, ব্রহ্মসাধক ব্যক্তিগণ ব্রহ্মলোক লাভ করেন।

 

২৫

ধূমো রাত্রিস্তথা কৃষ্ণঃ ষণ্মাসা দক্ষিণায়নম্‌।

তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতির্যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে।।

ধূমঃ রাত্রিঃ তথা কৃষ্ণঃ ষণ্মাসা দক্ষিণায়নম্‌।

তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতিঃ যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে।।

ধোঁয়া, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ এবং দক্ষিণায়নের ছয় মাস, পিতৃযানের এই মার্গে যোগী চন্দ্রের জ্যোতি লাভ ক’রে আবার এই জগতে ফিরে আসেন।  

 

২৬

শুক্লকৃষ্ণ গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে।

একয়া যাত্যনাবৃত্তিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ।।

শুক্লকৃষ্ণে গতী হি এতে জগতঃ শাশ্বতে মতে।

একয়া যাতি অনাবৃত্তিম্‌ অন্যয়া আবর্ততে পুনঃ।।

শুক্ল এবং কৃষ্ণ এই দুটি পথই জগতের সনাতন পথ বলে জ্ঞানীরা মনে করেন, একটি পথে পরম মুক্তি পাওয়া যায়, আর অন্যটিতে আবার দেহধারণ করতে হয়।

 

২৭

নৈতে সৃতী পার্থ জানন্‌ যোগী মুহ্যতি কশ্চন।

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু যোগযুক্তো ভবার্জুন।।

ন এতে সৃতী পার্থ জানন্‌ যোগী মুহ্যতি কঃ চন।

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু যোগ-যুক্তঃ ভব অর্জুন।।

হে পার্থ, এই দুই মার্গ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে, কোনও যোগীই মোহের বন্ধনে আবদ্ধ হন না। অতএব, হে অর্জুন, তুমি সর্বদা ব্রহ্মধ্যানে অভ্যস্ত হও। 

 

২৮

বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চৈব

দানেষু যৎ পুণ্যফলং প্রদিষ্টম্‌।

অত্যেতি তৎ সর্বমিদং বিদিত্বা

যোগী পরং স্থানমুপৈতি চাদ্যম্‌।

বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চ এব

দানেষু যৎ পুণ্যফলং প্রদিষ্টম্‌।

অত্যেতি তৎ সর্বম্‌ ইদং বিদিত্বা

যোগী পরং স্থানম্‌ উপৈতি চ আদ্যম্‌।

বেদ পাঠ, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, কঠোর তপস্যা এবং দান কর্ম থেকে যে সমস্ত পুণ্যফলের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে, তোমার ওই সাতটি প্রশ্নে আমার এই উত্তর সম্যক উপলব্ধি করতে পারলে, ধ্যানযোগী ঐ সব পুণ্যফল অতিক্রম করে জগতের আদি কারণস্বরূপ পরমপদ লাভ করে থাকেন।    

 

অক্ষরব্রহ্মযোগ সমাপ্ত


চলবে...

বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

গীতা - ৭ম পর্ব

 








এর আগের ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ধ্যানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে "গীতা - ৬ষ্ঠ পর্ব"



সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ


শ্রীভগবানুবাচ

ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ।

অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু।।

শ্রীভগবান উবাচ

ময়ি আসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্‌ মৎ আশ্রয়ঃ।

অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তৎ শৃণু।।

শ্রীভগবান বললেন – হে পার্থ, আমার প্রতি পূর্ণ অনুরাগে, আমার একান্ত শরণাপন্ন হয়ে, যোগ সাধনার যে প্রক্রিয়ায়, আমার আত্মাকে পূর্ণস্বরূপে সন্দেহাতীত উপলব্ধি করা সম্ভব, এখন সেটাই শোনো। 


জ্ঞানং তেঽহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ।

যজ্‌জ্ঞাত্বা নেহ ভূয়োঽন্যজ্‌ জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে।।

জ্ঞানং তে অহং সবিজ্ঞানম্‌ ইদং বক্ষ্যামি অশেষতঃ।

যৎ জ্ঞাত্বা ন ইহ ভূয়ঃ অন্যৎ জ্ঞাতব্যম্‌ অবশিষ্যতে।।

আমি তোমাকে আমার এই পরমব্রহ্ম অনুভবের বিশেষ জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণ বর্ণনা করব। যে জ্ঞানের কথা উপলব্ধি করতে পারলে, এই জগতে অন্য আর কিছুই জানার বাকি থাকে না।

 

মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্‌ যততি সিদ্ধয়ে।

যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।

মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে।

যততাম্‌ অপি সিদ্ধানাং কশ্চিৎ মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।

হাজার মানুষের মধ্যে খুব অল্প লোকই আত্মজ্ঞানের জন্যে চেষ্টা করে থাকেন। আবার সেই অল্প লোকের মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ আমার আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন।

 

ভূমিরাপোঽনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।

অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।

ভূমিঃ আপঃ অনলঃ বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিঃ এব চ।

অহংকার ইতি ইয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিঃ অষ্টধা।।

ভূমি, জল, অগ্নি, বাতাস, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার – এই আটভাগে আমার ঐশ্বরী প্রকৃতি বিভক্ত।

 

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্‌।

জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।

অপরা ইয়ম ইতঃ তু অন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্‌।

জীবভূতাং মহাবাহো যয়া ইদং ধার্যতে জগৎ।।

এই যে আটটি প্রকৃতির কথা বললাম, এগুলি আমার নিকৃষ্ট স্বরূপ। এর বাইরে সমস্ত জীবের চেতনা স্বরূপ আমার যে উত্তম প্রকৃতি, হে মহাবীর, তার কথা শোনো। আমার এই প্রকৃতিই জগৎকে ধারণ করে আছে। 

  

এতদ্‌যোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয়।

অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা।।

এতৎ-যোনীনি ভূতানি সর্বাণী তু উপধারয়।

অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়ঃ তথা।।

ধারণা করো যে, আমার এই উভয় প্রকৃতি থেকেই জগতের সমস্ত জড় ও জীবের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আমিই এই জগতের স্রষ্টা এবং আমিই এই জগতের প্রলয়। 

 

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়।

ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।

মত্তঃ পরতরং না অন্যৎ কিঞ্চিৎ অস্তি ধনঞ্জয়।

ময়ি সর্বম্‌ ইদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।

হে ধনঞ্জয়, আমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য আর কিছুই হতে পারে না। সুতোয় গাঁথা মণির মতো, এই জগতের সবকিছু আমার স্বরূপেই বাঁধা আছে।

 

রসোঽহমপ্সু কৌন্তেয়ঃ প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ।

প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।

রসঃ অহম্‌ অপ্সু কৌন্তেয়ঃ প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ।

প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।

হে কুন্তীপুত্র, আমিই জলের তারল্য, আমিই সূর্য ও চন্দ্রের জ্যোতি, চারবেদে আমিই ওঁকার, আকাশে আমিই শব্দ এবং মানুষের মধ্যে আমিই পৌরুষ। 

 

পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাঞ্চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ।

জীবনং সর্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বষু।।

পুণ্য গন্ধঃ পৃথিব্যাঞ্চ তেজঃ চ অস্মি বিভাবসৌ।

জীবনং সর্বভূতেষু তপঃ চ অস্মি তপস্বষু।।

পৃথিবীতে আমি পবিত্র গন্ধ, আমিই অগ্নির দাহিকা শক্তি, সমস্ত জীবের আমিই প্রাণস্বরূপ এবং আমিই তপস্বীগণের তপস্যা।

 

১০

বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্‌।

বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্‌।।

বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্‌।

বুদ্ধিঃ বুদ্ধিমতাম্‌ অস্মি তেজঃ তেজস্বিনাম্‌ অহম্‌।।

 হে পার্থ, জেনে রাখো, স্থাবর ও জঙ্গমের আমিই চিরন্তন কারণ, আমিই জ্ঞানীব্যক্তিদের জ্ঞান এবং তেজস্বীব্যক্তিদের তেজ।

  

১১

বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জিতম্‌।

ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোঽস্মি ভররর্ষভ।।

বলং বলবতাং চ অহং কামরাগবিবর্জিতম্‌।

ধর্ম অবিরুদ্ধঃ ভূতেষু কামঃ অস্মি ভরতর্ষভ।।

হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ, আমিই বলবান ব্যক্তির কামরাগহীন শক্তি, আবার আমিই সর্বজীবের জীবধর্ম পালনের কামনা

[না পাওয়া জিনিষ পাওয়ার ইচ্ছাকে বলে কাম, আর পাওয়া বস্তু অস্থায়ী জেনেও, তার প্রতি আগ্রহের নাম রাগ। দেহধারণ ও বংশরক্ষার জন্যে যে কামনা, সে কামনা ধর্মবিরুদ্ধ নয়, সেটা জীবধর্ম, জীবধর্ম না থাকলে জীবের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায়।] 

 

১২

যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে।

মত্ত এবেতি তান্‌ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।

যে চ এব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাঃ তামসাঃ চ যে।

মত্ত এব ইতি তান্‌ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।

জেনে রাখো, আমার থেকেই জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাবের উৎপত্তি হয় আমি এদের বশীভূত না হলেও, এই সমস্তভাব আমার অধীন।

 

১৩

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরিভিঃ সর্বমিদং জগৎ।

মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্‌।।

ত্রিভিঃ গুণময়ৈঃ ভাবৈঃ এভিঃ সর্বম্‌ ইদং জগৎ।

মোহিতং না অভিজানাতি মামেভ্যঃ পরম্‌ অব্যয়ম্‌।।

এই তিনগুণের মায়ায় সমস্ত জীব মুগ্ধ ও বিভ্রান্ত হয়, এবং তার ফলে এই তিনগুণের অতীত আমার পরম নির্বিকার স্বরূপ তারা উপলব্ধি করতে পারে না।

[ত্রিগুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণ - এই গুণের কথা সবিস্তারে পড়া যাবে গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগ যোগে।]

 

১৪

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।

মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।

দৈবী হি এষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।

মাম্‌ এব যে প্রপদ্যন্তে মায়াম্‌ এতাং তরন্তি তে।।

সত্ত্ব, রজ ও তম, এই তিনগুণের প্রভাবে, আমারই সৃষ্টি করা অলৌকিক মায়াকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আমার শরণাপন্ন হয়, তার পক্ষেই এই মায়া অতিক্রম করা সম্ভব।

  

১৫

ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ

মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।

ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ

মায়য়া অপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবম্‌ আশ্রিতাঃ।।

এই মায়ার প্রভাবে, দুর্জন ও মোহগ্রস্ত ইতর জনেরা বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে অসুরের মতো ব্যবহার করে, কিন্তু  তারা আমার ভজনা করে না। 

 

১৬

চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোঽর্জুন।

আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।

চতুর্বিধাঃ ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনঃ অর্জুন।

আর্তঃ জিজ্ঞাসুঃ অর্থ-অর্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।

হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ অর্জুন, রোগশোকে অভিভূত আর্তজন, আত্মজ্ঞানের জন্য উৎসুক, সম্পদের প্রত্যাশী ও ব্রহ্মজ্ঞ – এই চার প্রকৃতির ব্যক্তি আমাকে ভজনা ক’রে সুকৃতি করেন

 

১৭

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে।

প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোঽত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্তঃ একভক্তিঃ বিশিষ্যতে।

প্রিয়ঃ হি জ্ঞানিনঃ অত্যর্থম্‌ অহং স চ মম প্রিয়ঃ।।

এই চার প্রকৃতির ব্যাক্তিদের মধ্যে আমাতে একনিষ্ঠ এবং সর্বদা আমাতে ভক্তিযুক্ত জ্ঞানীই সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ আমি জ্ঞানীব্যক্তির অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার প্রিয়। 

 

১৮

উদারাঃ সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্‌।

আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্‌।

উদারাঃ সর্ব এব এতে জ্ঞানী তু আত্মা এব মে মতম্‌।

আস্থিতঃ স হি যুক্তা আত্মা মাম্‌ এব অনুত্তমাং গতিম্‌।

এঁদের সকলেই মহান ও আমার প্রিয়, কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মা স্বরূপ এবং আমার সঙ্গে তাঁর কোন প্রভেদ নেই, কারণ শ্রেষ্ঠ সাধনায়, জ্ঞানী আমাতেই তাঁর সবকিছু সমর্পণ করে থাকেন।

 

১৯

বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্‌ মাং প্রপদ্যতে।

বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।

বহূনাং জন্মনাম্‌ অন্তে জ্ঞানবান্‌ মাং প্রপদ্যতে।

বাসুদেবঃ সর্বম ইতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।

জ্ঞানী আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার কারণ বহুজন্মের একাগ্র সাধনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ‘এই নিখিল বিশ্বই বাসুদেব’  এই অনুভবে আমার ভজনা করেন। এই প্রকৃতির মহাপুরুষ খুবই দুর্লভ।

  

২০

কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেঽন্যদেবতা।

তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।

কামৈঃ তৈঃ তৈঃ হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তে অন্যদেবতা।

তং তং নিয়মম্‌ আস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।

অনেক বিবেক বুদ্ধিহীন ব্যক্তি পুত্র, বিত্ত এবং বিষয়ের কামনায়, নানান জপ ও উপবাসের নিয়ম পালন করেন এবং নিজের স্বভাব অনুসারে অন্য অনেক দেবতার পুজা করেন।

 

২১

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।

তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্‌।।

যঃ যঃ যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়া অর্চিতুম্‌ ইচ্ছতি।

তস্য তস্য অচলাং শ্রদ্ধাং তাম্‌ এব বিদধামি অহম্‌।।

যে যে ভক্ত যে যে প্রতিমায় শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজা অর্চনা করেন, আমি সেই সেই ভক্তদের সেই সেই প্রতিমার প্রতি অচলা ভক্তি প্রদান করে থাকি।

 

২২

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।

লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়ৈব বিহিতান্‌ হি তান্‌।।

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তঃ তস্য আরাধনম্‌ ঈহতে।

লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়া এব বিহিতান্‌ হি তান্‌।।

সেই ভক্ত পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর প্রিয় যে দেবতার আরাধনা করেন, আমারই বিধানে সেই ভক্ত তাঁর প্রিয় দেবতার থেকে কাম্য বস্তু লাভ করে থাকেন।

 

২৩

অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ভবত্যল্পমেধসাম্‌।

দেবান্‌ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।

অন্তবৎ তু ফলং তেষাং তৎ ভবতি অল্পমেধসাম্‌।

দেবান্‌ দেবযজঃ যান্তি মৎ ভক্তা যান্তি মামপি।।

কিন্তু অল্পবুদ্ধি ভক্তদের এই যে ফল লাভ, তা অস্থায়ী হয়। দেবতার উপাসক ভক্তেরা দেবতাকেই পেয়ে থাকেন। কিন্তু একই প্রচেষ্টায় আমার ভক্তগণ আমাতেই মিলিত হয়ে থাকেন।

 

২৪

অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।

পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্‌।।

অব্যক্তং ব্যক্তিম্‌ আপন্নং মন্যন্তে মাম্‌ অবুদ্ধয়ঃ।

পরং ভাবম্‌ অজানন্তঃ মম অব্যয়ম্‌ অনুত্তমম্‌।।

অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার অপূর্ব ও অক্ষয় পরমাত্মস্বরূপ উপলব্ধি করতে না পেরে, আমাকে ব্যক্তিভাব স্বরূপ দেহধারী মনে করে।

 

২৫

নাহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়াসমাবৃতাঃ।

মূঢ়োঽয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্‌।

না অহং প্রকাশঃ সর্বস্য যোগমায়া-সমাবৃতাঃ।

মূঢ়ঃ অয়ং না অভিজানাতি লোকঃ মাম্‌ অজম্‌ অব্যয়ম্‌।

আমি যোগমায়ার আড়ালে থাকি, সকলের কাছে প্রকাশ হই না। সেই কারণে, মায়ায় মুগ্ধ এই জগতের লোক জন্মমৃত্যুর অতীত আমার এই অক্ষয় স্বরূপও জানতেও পারে না।

   

২৬

বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন।

ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন।।

বেদ অহং সমতীতানি বর্তমানানি চ অর্জুন।

ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কঃ চন।।

হে অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালের সমস্ত ভূত অর্থাৎ জীবের বিষয় আমার জানা আছে, কিন্তু আমার স্বরূপ কেউ জানতে পারে না। 

 

২৭

ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত।

সর্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ।।

ইচ্ছা-দ্বেষ-সমুত্থেন দ্বন্দ্ব-মোহেন ভারত।

সর্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ।।

হে শত্রুদমন অর্জুন, আসক্তি আর বিদ্বেষের দ্বিধায় জন্মকাল থেকেই সমস্ত জীব মোহগ্রস্ত হয়ে থাকে।

[প্রিয় বিষয় পাওয়ার ইচ্ছে থেকে আসে আসক্তি, আর অপ্রিয় বিষয়ে আসে বিদ্বেষ। এই দ্বিধা থেকেই মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-শোকের মোহে বাঁধা পড়ে।]

 

২৮

যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্‌।

তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতা।।

যেষাং তু অন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্‌।

তে দ্বন্দ্ব-মোহ-নির্মুক্তাঃ ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতা।।

কিন্তু যে সকল পুণ্যকর্মা ব্যক্তির পাপ আর অবশিষ্ট নেই, চিত্ত থেকে দ্বন্দ্ব এবং এই মোহ দূর হয়ে গিয়েছে, তাঁরা একনিষ্ঠ কঠিন ব্রতে আমার ভজনা করেন।  

 

২৯

জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে।

তে ব্রহ্ম তদ্‌ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম চাখিলম্‌।।

জরা-মরণ-মোক্ষায় মাম্‌ আশ্রিত্য যতন্তি যে।

তে ব্রহ্ম তদ্‌ বিদুঃ কৃৎস্নম্‌ অধ্যাত্মম্‌ কর্ম চ অখিলম্‌।।

যাঁরা জরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তির ইচ্ছায়, আমার শরণাগত হয়ে সাধনা করেন, তিনি পরম ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যাত্ম এবং নিখিল কর্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন।

 

৩০

সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ।

প্রয়াণকালেঽপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ।।

স-অধিভূত-অধিদৈবং মাং স-অধিযজ্ঞং চ যে বিদুঃ।

প্রয়াণকালে অপি চ মাং তে বিদুঃ যুক্ত-চেতসঃ।।

যাঁরা অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে উপলব্ধি করতে পারেন, সেই সব সমাহিতচিত্ত ব্যক্তি মৃত্যুর সময়েও আমায় ভুলতে পারেন না।  

[অধিভূত - আমাদের এই নশ্বর শরীর যে পঞ্চভূতের অধিষ্ঠান, সেই পঞ্চভূতও প্রকৃতপক্ষে পরম ব্রহ্মাই। অধিদৈব - অধিষ্ঠাতা দেবতা, দেবতাত্মা ব্রহ্ম - হিরণ্যগর্ভ, অর্থাৎ আমরা যে যে দেব-দেবী প্রতিমার ধ্যান বা পূজা করি, তাঁদের সকলেরই আত্মা পরমব্রহ্ম। অধিযজ্ঞ - যে দেবতার উদ্দেশ্যেই আমরা যজ্ঞ সংকল্প করি না কেন, পরম ব্রহ্মই সেই যজ্ঞের প্রবর্তক ও ফলদাতা।]   

 

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ সমাপ্ত

        চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৮ম পর্ব

  এর আগের সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে " গীতা - ৭ম পর্ব " অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রহ্মযোগ ১ ...