[এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে... ]
“হাঁদির মা চাঁদি খেয়ে নাদি নাদি হাগে।
আর হাঁদি আহা নিশিভোর বাসরঘরে জাগে”।।
লোকটা উঠোনে বসে গলার শির ফুলিয়ে গান গাইছিল। গানের অন্তরায় ঠোঁটের উপর হাত চেপে অদ্ভূত আওয়াজ তুলছিল মিউজিক হিসেবে। আর নিজেরই পিঠে একটা চেরা কঞ্চি পেটাচ্ছিল সঙ্গৎ হিসেবে - তাল উঠছিল চট চটাস - চট চটাস শব্দে। অদ্ভূত এক ছন্দে একটানা দীর্ঘগানটি সে পরিবেশন করেছিল, যার সবটা তখন বুঝিনি, মনেও নেই। মনে রয়ে গেছে শুধু ঐ দুটি মাত্র লাইন – কারণ গানের ধুয়ো ধরে ওই লাইনদুটিতে সে ফিরে আসছিল বারবার। এ ধরনের গানের নাম নাকি ‘হাপু’।
পরনে ধূসর হয়ে যাওয়া ছাপা লুঙ্গি। পোষের কনকনে শীতেও তার
খালি গা। পিঠের যেখানে কঞ্চির চোট পড়ছিল, সে জায়গায় লম্বা কালশিটের
স্থায়ি দাগ। রুক্ষ খড়ি ওঠা তেলহীন হাড় জিরজিরে শরীর। ঠোঁটের দুকোণায় সাদা ফেকো,
চোখের কোণায় পিচুটি। তার সারা শরীরে অপুষ্টি আর নিদারুণ খিদের ছাপ।
পাড়ার বেশ কিছু ছেলেপুলে আর আমরা তাকে গোল হয়ে ঘিরে দেখছিলাম তার রকম সকম আর শুনছিলাম তার গান গাইবার কেরামতি। নাম তার এনামুল, পাড়ার ছেলেপুলেরা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে অভ্যস্ত ও তাকে চেনে। তারা এনামুলকে ঘিরে - গান শোনার চেয়েও - বিরক্ত আর বিদ্রূপ করছিল বারবার। অসহায় এনামুল আমার অচেনা মুখের দিকে চাইছিল বারবার। কি চাইছিল সে আমার থেকে - কোন সাহায্য, নাকি আমার মতো অচেনা ছেলের সামনেও অপদস্থ হতে থাকার জন্যে বাড়তি লজ্জা?
দূর থেকেই এনামুল মাটিতে উবু হয়ে বসে দিদিমাকে প্রণাম করল। উঠোনের থেকে সামান্য একটু মাটি আঙুলে নিয়ে জিভে ঠেকাল, তারপর একগাল হেসে বলল, ‘পেনাম, মা ঠাকরেন। কতাটা কয়েচেন এক্কেরে নিজ্জলা সত্তি। তবে কি জানেন, বাপ- পিতেমোর থেকে হাপুগানই শিকেচি – আর তো কিচু জানা নেই কাজকাম। লোকে আর এর কদর করে না, কোতাও দুটো পয়সা হয় - কোতাও হয় না, উল্টে মস্করা করে এ গান লিয়ে, আমাকে লিয়ে...’।
বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে যেন। দিদিমা ভিতর বাড়িতে যেতে যেতে বললেন, ‘বোস বাছা, বোস। না খেয়ে যাবি না কিন্তু -’।
‘দিদিমা’।
‘অ। মামাবাড়ি এয়েচো, তা কোথায় থাকা হয় বা’ঠাকুর’?
‘কলকাতায়’।
‘অ। কলকেতায় – তার মানে তো তুমি আমাদের নদি’ঠাকরেনের
ছেলে, বা, বা, বা.... তা তুমি ছোটটি না বড়টি’?
‘ছোট’।
‘বেশ, বেশ খুব ভাল।’ এই বলেই সে আবার উবু হয়ে বসে, দিদিমাকে যেভাবে প্রণাম করেছিল, ঠিক সেইভাবেই আমাকে নমস্কার করে বসল। অস্বস্তিতে আমি ঠিকরে পিছনে সরে এলাম অনেকটা।
আমাকে অমন চমকে উঠতে দেখে এনামুল বলল, ‘আহা, হা, হা, ভয় পাও কেন? তুমি মা ঠাকরেনের লাতি, আমরা ওঁনারে অন্নপুন্না মানি, সাক্ষাৎ দেবতা গো, দেবতা। তোমাদের পুরাণের সেই গপ্পোটা জানোতো, শিব ঠাকুর যে শিব ঠাকুর - তিনিও অন্ন ভিক্ষে করেছিলেন একবার অন্নপুন্নার কাচে। বুজেচ বা’ঠাকুর যেমন তেমন দেবতা নয় -’। তার কথার মধ্যেই বন্নিদিদি একটা ছোট ধামায় করে মুড়ি এনে ফেলল অনেকটা, সঙ্গে গুড়ের বাটি। বন্নিদিদিকে দেখেই এনামুলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বন্নিদিদি বলল, ‘চাচা, তোমার লেকচার থামিয়ে, যাও একখান কলাপাতা কেটে আনো’। এনামুলচাচা দৌড়ে চলে গেল আমাদেরই বাড়ির খিড়কি দোরের বাইরের কলাগাছ থেকে পাতা আনতে।
বন্নিদিদিকে চেয়ে দুবারে প্রচুর মুড়ি ও গুড়, জল দিয়ে ভিজিয়ে এনামুলচাচা অদ্ভূত তৃপ্তি করে খেল। এত আনন্দ ও যত্ন করে খেতে এর আগে আর কাউকে দেখিনি। একটিও মুড়ি ফেলা গেল না। কলাপাতায় একটুও কিচ্ছু লেগে থাকল না। সেদিন টের পেয়েছিলাম প্রকৃত খিদে কাকে বলে আর সেই খিদে কি, উপলব্ধি না করলে, খাদ্যের প্রতি এমন সমীহ ও সম্মান শেখা যায় না। আমরা সময়মতো অথবা খিদে পাওয়ার আগেই খাবার পেয়ে যাই বলেই খাবারের অপচয় বা অবহেলা করতে দ্বিধা করিনা।
বিশাল ঘাড় নেড়ে এনামুল চাচা বলল, ‘আসব মা, আসব। মাঠাকরেণ ডেকেচেন – না এসে পারি’?
এনামুল চাচা কলাপাতাটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল, আমি বন্নিদিদিকে জিগ্যেস করলাম, ‘দিদিমা আবার কেন ডাকলো ওকে? গান শুনবে বলে?’
‘ধুর বোকা, দুপুরে ও ভাত খাবে না? আমাদের বাড়িতেই খাবে
তো...আর গান? গান না ছাই। ওই গান আবার কেউ শোনে নাকি?’
আজ মনে হয় বাংলার সেই লোক-সঙ্গীতের
পারম্পরিক গায়ককে আমাদের সভ্য সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা থেকে অবচেতনে বিদেয় করে দেওয়া
হয়েছিল বিদ্রূপ আর অবহেলার কুলোর বাতাস করে অথবা মমতা দিয়ে আদরের অন্নদাস বানিয়ে।
...চলবে...
(পরের পর্ব "জীবন যাত্রা")
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন