শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব - ১০

 

১০


স্কুলে তাঁর কাজের চাপ বাড়ছে। তিনি এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস। মাস ছয়েক পরে এখন যিনি হেডমিস্ট্রেস, কণিকাদি, রিটায়ার করবেন। খুব চান্স আছে, কণিকাদির পর শুভময়ীদেবীর হেডমিস্ট্রেস হওয়ার। সেক্ষেত্রে কাজের প্রেসার আরো বাড়বে, বাড়বে দায়িত্ব। বেড়ে যাবে এডুকেশান বোর্ড, কাউন্সিল, স্কুল কমিটির মিটিং সামলানোর টেনসান। এরই মাঝে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা কথা শুভময়ীদেবীর বারবার মনে আসছে, বিরক্তিকর মাছির মতো, তাড়িয়ে দিলেও বারবার যেমন ফিরে আসে। কথাটা হল, বিট্টুর কি হবে? কতদিন, আর কতদিন সম্ভব এভাবে বিট্টুকে সামলে চলা এবং তার সঠিক দেখভাল করা? 

বিট্টুর বয়েস বাড়ছে প্রকৃতির সমস্ত নিয়ম মেনেই। আজ সে তার বয়েস প্রায় পনের। তার শরীরে এখন নবীন যৌবনের সূচনা। তার গালে নরম দাড়ি, নাকের নীচে চিকন গোঁফের উন্মেষ। দিন পনের-কুড়ি অন্তর তার মাথার চুলের সঙ্গে তার গোঁফ-দাড়ি বাড়িতেই ছেঁটে দেন শুভময়ী দেবী। এই বয়সের সুস্থ ও স্বাভাবিক ছেলেরা লেখাপড়া, বন্ধু-বান্ধবী, খেলাধুলো, সিনেমা, গান, ফাজলামি নিয়ে চঞ্চল থাকে। বিট্টুর কোন কাজ নেই, বাইরের জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন, অচঞ্চল নিয়ন্ত্রণহীন আলাদা এক সত্ত্বা। অথচ নিষ্ঠুর নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকৃতি তার শরীরে, তার মনে সাজিয়ে তুলছে যৌবন, জীবধর্ম মেনে তার শরীরে গড়ে উঠছে নতুন জীবন সৃষ্টির সমস্ত সরঞ্জাম ও আয়োজন! বাড়ছে নিত্যনতুন জটিলতা। সে নিজে বিপন্ন হচ্ছে, বিপন্ন করছে ছবিকে, নিজের পরিবারকে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে বারবার। কাজেই বিট্টুর এখন দরকার প্রফেসনাল কেয়ার। 

তাছাড়া আজকাল আরও একটা চিন্তা শুভময়ীদেবীর মগজে বাসা বাঁধছে, সেটা হল তাঁদের, তাঁর আর বিট্টুর বাবার মৃত্যুর পর কী হবে বিট্টুর? হয়তো আজই নয় কিন্তু পাঁচ, দশ, বিশ বছর বাদে, ঠিক কবে তাঁরা চলে যাবেন কে বলতে পারবে? সেদিন কার কাছে, কার ভরসায় রেখে যাবেন বিট্টুকে? আজ পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোন মিরাক্‌ল্‌ ঘটেনি এবং ঘটার কোন সম্ভাবনাও নেই, যাতে বিট্টু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। কাজেই কি হবে ওর ভবিষ্যৎ? 

এইসব চিন্তার মধ্যেই বিট্টুর বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন চেন্নাই। কোম্পানীর রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে তাঁর প্রমোশন হওয়াতে, তাঁকে সমস্ত দক্ষিণ ভারতের ব্যবসা সামলাতে হবে এখন থেকে। শুভময়ীদেবী প্রস্তাব করেছিলেন, প্রমোশন অ্যাক্সেপ্ট না করার জন্য, অন্য কেউ যাক না। এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে, অতদূরে যাওয়া, কী এমন জরুরি? বিশেষ করে বিট্টুর এইরকম অবস্থায়? বিট্টুর ভালোমন্দ সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে শুভময়ীদেবীর? কেন, বিট্টুর এই অবস্থার জন্যে কি শুভময়ীদেবী দায়ী? মা হয়ে নিজের সন্তানকে তিনি এইভাবে বড়ো হতে দেখছেন, তাঁর এই যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ থাকবে না তাঁর পাশে? বাবা হিসেবে কোন ফিলিংস যদি নাও থাকে, কর্তব্যবোধটুকুও কিভাবে লোপ পেয়ে যায়? এই সব ভেবে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন শুভময়ীদেবী। এক এক সময় তাঁর মনে হয়, তাঁর স্বামীর এমন আচরণ, শুধু তাঁকেই শাস্তি দেবার জন্যে। তিনি তাঁর স্বামী ও শাশুড়ির নির্দেশ মতো স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিট্টু-অন্ত-প্রাণ মা এবং গৃহবধূ হতে চাননি বলেই আজও এতদিন পরেও, এও একধরনের প্রতিশোধ ছাড়া আর কি হতে পারে!

কোন এক বহুজাতিক সংস্থার কোটি কোটি টাকার ব্যবসাকে আর বেশী বেশী কোটিতে দাঁড় করানোটা কি এতই জরুরি! আর তিনি যে ঘরের অধিকাংশ কাজ সামলেও কয়েক হাজার মেয়েকে বড়ো হতে, মানুষ হতে সাহায্য করে চলেছেন, তার কোন মূল্যই নেই কারো কাছে! আজকাল শুভময়ী দেবী নিজেকে ভীষণ একলা অনুভব করেন। কোন ধরনের অ্যাপ্রিসিয়েসনহীন, কোন প্রত্যাশাহীন এমন একটা দীর্ঘ লড়াই, একদম একা একা লড়ে যেতে, তিনি আর যেন পেরে উঠছেন না। কেউ একজন, যদি কেউ একজন থাকত তাঁর পাশে। যার থেকে কোন সাহায্য না পেলেও, তাঁর কাছে দিনের শেষে অন্ততঃ একবার বসলেও যদি পাওয়া যেত একটু শান্ত অবসর। তাহলেই বেঁচে যেতেন তিনি, ফিরে পেতেন লড়ে চলার নতুন শক্তি।  

তিনি কথাবার্তা বলতে লাগলেন নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর আগেও অনেক জায়গা থেকেই তাঁদের কাছে অনেকে এসেছিল। যে ক্লিনিকে বিট্টুর রেগুলার চেকআপ করানো হয়, কোন প্রবলেম হলেই। যেখানে বিট্টুকে নিয়ে দৌড়ে যান ট্রিটমেন্টের জন্যে, তারাও রেফার করেছিল এরকম বেশ কতকগুলি প্রতিষ্ঠানের নাম। তখন আমল দেননি তাঁরা কেউই। মনে হয়েছিল নিজের সন্তান সে যেমনই হোক, তাঁদের কাছেই থাকুক। আজ যতদিন যাচ্ছে শুভময়ীদেবী অসহায় বোধ করছেন, অসম্ভব এক ক্লান্তি তাঁকে ঘিরে থাকছে সারাটাক্ষণ। যে ক্লান্তি থেকে তাঁর আর যেন মুক্তি নেই।

শনিবার, রবিবার, ছুটির দিন করে তিনি একা একাই আজকাল ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি, তাঁর বিতানের মতো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সারাটা দিন প্রফেসনাল ট্রেনিং দিয়ে চলেছে, ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল দুটোই, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কেয়ার। কেয়ার মানে কিন্তু আদরের প্রশ্রয় নয়। তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এদের মধ্যেও একধরনের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার। বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করার পর শুভময়ীদেবীর মনে হল, তিনি হয়তো ভুলই করেছেন, বিতানকে আরো আগেই এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিলে হয়তো ভালই হত। বিতান তার মতো আরো অনেকের সঙ্গে থাকতে থাকতে, এঁনাদের ট্রেনিং পেয়ে সুস্থ নিশ্চয়ই হয়ে উঠত না, কিন্তু এতটা রিপালসিভ না হয়ে, অনেক সোশাল হয়ে উঠতে পারত ওর নিজের মতো করে। হয়ে উঠতে পারত অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ। আজকে বিতানকে নিয়ে যে নিত্যনতুন সমস্যা গড়ে উঠছে, হয়তো সেটা এড়ানো যেত। বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় মনস্থির করে ফেললেন। পাকা কথা দেবার আগে বিতানের বাবার সঙ্গে কথা বলা জরুরি। এক রবিবার সকালে তিনি ফোন করলেন, “হ্যালো। কেমন আছ, কেমন? শরীর ঠিক আছে তো”?

“হুঁ। ঠিক আছে”।

“খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধে নেই তো, স্পাইসি ফুড অ্যাভয়েড করবে, পারলে একদম খাবে না, সাবধানে থেক কিন্তু”।         

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোন অসুবিধে নেই”।

“ওষুধগুলো রেগুলার নিও, ভুলে যেও না।”।

“হুঁ, নোবো”। এত নিরুত্তাপ, সংক্ষিপ্ত জবাবের পর শুভময়ীদেবী আসল কথাটা কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একবারের জন্যেও ওর কি জানার ইচ্ছে হয় না, কিংবা সামান্য কৌতূহলও হয় না, বিট্টু কেমন আছে! আমি কেমন আছি? তবুও বলতে তো তাঁকে হবেই। তিনি খুব দ্বিধার সঙ্গে আবার কথা বললেন, “শুনছ”?

“হুঁ”।

“তোমার “একান্ত সহায়” সোসাইটির কথা মনে আছে? ডাক্তার বাগচি যার কথা বার বার বলতেন”?

“আছে, কেন”?

“তুমি তো জান বিট্টুর কি কি প্রবলেম, ও মাঝে মাঝেই খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমাদের পক্ষে। ভাবছি, “একান্ত সহায়”তে বিট্টুকে এবার অ্যাডমিশন করিয়ে দেব।”।

“ভালোই তো”।

“তুমি কি বলছ, ওখানে দেওয়াটা ঠিক হবে”?

“আমার বলায় কি আসে যায়? যা ভালো বোঝো করো”। ব্যস এইটুকুই, ফোনটা কেটে গেল ওপ্রান্ত থেকে।

একজন পিতা কিভাবে এত শীতল হতে পারে, কিভাবেই বা থাকতে পারে এমন দায়িত্বহীন। শুভময়ীদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মোবাইলের দিকে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন নেক্সট মান্থের পয়লা তারিখেই তিনি বিট্টুকে অ্যাডমিশান করিয়ে দেবেন “একান্ত সহায়ে”। 



চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক (ভৌতিক রহস্যগল্প)

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...