শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ২/১


 [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


দ্বিতীয় পর্ব - ১ম পর্বাংশ

(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)

 [এর আগের পর্বাংশ "ধর্মাধর্ম -১/৮" পড়া যাবে এই সূত্রে -  ধর্মাধর্ম - ১/৮ ]

 

প্রাককথা

আমাদের সভ্যতাকে যদি অসীম এক সিঁড়ি হিসেবে কল্পনা করি, তাহলে তার প্রতিটি উত্তরণকে আমরা এক একটি ধাপ বলে মনে করতে পারি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি পূর্ববর্তী ধাপ পার হয়েই পরবর্তী ধাপে যাওয়া সম্ভব। আমাদের সভ্যতা-বিকাশের পক্ষে – ১২০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই - এই পর্যায়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই পর্যায়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের যদিও খুব অভাব নেই, কিন্তু লিখিত প্রমাণ নেই বললেই চলে। যেটুকু পাওয়া গেছে, দুর্ভাগ্যবশতঃ, তার পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। এই পর্যায়ের পরে আমরা যে যুগে প্রবেশ করব, আমরা দেখব মানুষের সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তার শুরু নিশ্চয়ই একদিনে হয়নি। তার সূচনা অবশ্যই হয়েছিল বর্তমান পর্যায়েই। অতএব আগের পর্যায়ের মতোই, এই সময়ের মানুষদেরও ভাবনা-চিন্তা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং পারষ্পরিক সম্পর্কের নানান জটিলতার কিছু কিছু বিষয় আমাকে আবারও কাল্পনিক পুননির্মাণ করতে হয়েছে।

২.১.১ কৃষিসমাজ ও পরিবর্তিত মূল্যবোধ

সূর্য একটু আগেই অস্ত গেছে, কিন্তু তার রঙিন আলোর রেশ এখনও রয়ে গেছে পশ্চিম দিগন্তে। বৃদ্ধ ভুলকা বসে আছেন ঘরের দাওয়ায়, তাঁর কোলের কাছে বসে আছে বালক নাতি। ভুলকার ছয় ছেলে পাঁচ মেয়ে, এই ছেলেটি তাঁর চতুর্থ পুত্রের। বড়ো চঞ্চল, দুরন্ত, বাড়ির সবাইকেই সর্বদা তটস্থ করে রাখে। এ ছেলে একমাত্র দাদুর কাছেই কিছুটা শান্ত থাকে, কারণ দাদু তাকে গল্প বলেন, সারাদিনে দাদু তাকে অনেকটা সময় দিতে পারেন, কারণ বাড়িতে অন্যদের তুলনায় দাদুরই অবসর বেশি।

দাদু, তুমি কোনদিন যাওনি, ওই জঙ্গলে?”

জঙ্গলে? কী করতে যাবো বলতো? জঙ্গলে কী যে কেউ যেতে পারে?”

কেন?”

বাঃ রে, ওখানে যাওয়া কী সোজা কথা? জঙ্গলে কী আছে জানো? বাঘ আছে, সিংহ আছে। হাতি আছে, হায়না আছে, সাপ আছে...”

তুমি দেখেছ”?

তা আর দেখব না? মাঝে মাঝে তারা তো আমাদের গ্রামের কাছেই চলে আসে। আমরা তখন সবাই মিলে হৈচৈ করে, ঢাক-বাদ্যি বাজিয়ে, মশাল দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিই”।

কামড়ায় না?”

কামড়ায় বৈকি, একা পেলে হালুম করে এসে ঘাড়ে পড়ে। কিন্তু সবাই থাকলে ওরাই আমাদের ভয় পায়, লেজ তুলে পালিয়ে যায়”।

তাই?” 

হ্যাঁ গো। ওরা তো তাও ভালো, জঙ্গলে আরও কী আছে জানো?”

কী আছে দাদু”?

আর আছে এত্তো বড়োবড়ো কান, এই বড়ো বড়ো দাঁত নিয়ে রাক্ষস, দৈত্য, দানো[1]। তাদের চোখগুলো আগুনের গোলার মতো, সব সময়েই যেন জ্বলছে”।

তাই?”

হ্যাঁ গো, মানুষ দেখলেই তারা বড়ো বড়ো দাঁত বের করে তেড়ে আসে। তারা যে মানুষ খায়”!

মানুষ খায়?”

তা না হলে আর বলছি কী? আমরা যেমন কড়মড়িয়ে ছাগলের হাড় চিবোই, তারাও তেমনি মানুষের হাড় চিবোয়”।

তুমি বুঝি দেখেছ?”

দেখতে পেলে কী আমাকে তারা ছেড়ে দিত, বলো? আর আজ কি তোমাকে ওদের কথা শোনাতে পারতাম?” বালক চুপ করে গেল। সত্যিই তো ভাগ্যিস দাদু জঙ্গলে যায়নি। তাহলে ওরা তো দাদুকে খেয়েই ফেলত। তাহলে আজ তাকে কে গল্প শোনাতো?

সন্ধে নেমে এসেছে, আকাশে জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতারা। ভুলকার ছোট পুত্রবধূ, ঘর থেকে নেমে উঠোনে গেল। তার হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ। বাড়ির সদর দরজায় প্রদীপ দেখিয়ে ফিরে এল। উঠোনের একধারে রয়েছে তুলসী মন্দির। সেখানে প্রদীপটি রেখে গড় হয়ে প্রণাম করল, তারপর শাঁখ বাজাল তিনবার। ভুলকা জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “হে পশুপতিবাবা, মঙ্গল কর, হে দেবী মা, কল্যাণ করো, সকল বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করো মা”। দাদুর দেখাদেখি বালকও জোড় হাত কপালে ঠেকাল, তারপর জিগ্যেস করল, “পশুপতিবাবা কে দাদু?”

ও বাবা, পশুপতিবাবাকে চেন না? পশুপতিবাবা, আমাদের সব্বার বাবা। আর দেবীমা আমাদের সব্বার মা। তাঁরা যেমন আমাদের বাবা-মা, তেমনি যত পশুপাখি দেখছ, সব্বার বাবা-মা”।

বাঘ-সিংহদেরও?”

একশ বার, তাঁদের ছাড়া কারও একপাও চলবার ক্ষমতা আছে?”

আর রাক্ষসদের?”

রাক্ষসদেরও বৈকি”!

রাক্ষসরা পশুপতিবাবাকে খেয়ে ফেলে না?”

ভুলকা হা হা করে হাসলেন, বললেন, “তাই কখনো পারে, বাবা? তিনি যে সবার বাবা, তাঁর ক্ষতি কে করবে? পশুপতিবাবা রেগে গেলে, সাংঘাতিক! রেগে গেলে, এই যে এখানে কপালের মাঝখানে”, ভুলকা আঙুল রাখলেন বালকের ছোট্ট কপালের মাঝখানে, “তাঁর তৃতীয় নয়ন ঝলসে ওঠে, আগুন ঠিকরে বেরোয়, আর সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সবকিছু”।

তৃতীয় নয়ন মানে?”

নয়ন মানে চোখ। আমাদের সব্বার, জন্তু-জানোয়ারের চোখ থাকে দুটো। পশুপতিবাবা আর দেবীমার চোখ তিনটে। ওই চোখ দিয়েই তাঁরা যে সব দেখেন। কে কোথায় কী করছে। তাঁদের চোখ এড়িয়ে কিচ্‌ছু করার উপায় নেই। তুমি যে মা-ঠাকুমাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করো, সে সবও তিনি লক্ষ্য করেন। আর রেগে গেলেই ব্যস, ওই চোখের আগুনে সব পুড়িয়ে ছাই করে দেন”।

বালক একটু ভয় পেল, দাদুর কোল ঘেঁষে আরেকটু সরে এল। তার দুষ্টুমি দেখে ফেলার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বলল, “তাহলে পশুপতিবাবা, রাক্ষসদের পুড়িয়ে ছাই করে দেন না কেন? তাহলে তো আর তারা আমাদের খেতে পারবে না”!

তাই কী হয় বাবা? তিনিই যে সবাইকেই সৃষ্টি করেছেন! আমাদেরও সৃষ্টি করেছেন, আবার ওদেরও সৃষ্টি করেছেন”।

কেন? ওদের সৃষ্টি করলেন কেন? আমাদের যে ঝামেলা বেড়ে গেল?”

সে তুমি এখনই বুঝবে না, বাবা, বড়ো হও তখন বুঝবে। তিনি আমাদের পরীক্ষার জন্যেই ওদের বানিয়েছেন। প্রচণ্ড ঝড় দেখেছ, গাছপালা সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়? আবার গরমের সন্ধেয় কি সুন্দর হাওয়া বয়, শরীর জুড়িয়ে দেয়, দেখেছ? তোমার কাকিমা ওই যে প্রদীপ জ্বেলে দিলেন, কি সুন্দর নরম আলো, তাই না? আবার ওই জঙ্গলে আগুন লাগলে, সে এক ভয়ংকর কাণ্ড হয়। গাছপালা, পশুপাখি আগুনে অসহায় পুড়ে মরতে থাকে। সে আগুনের যেমন তেজ, তেমনি তার তাপ, গরম হাওয়ার হল্কা আমাদেরও যেন ঝলসে দেয়। এসব তিনিই করান, কেন জান?”

কেন?”

তিনি আমাদের পরীক্ষা নেন। আমাদের বিপদের মধ্যে তিনিই ঠেলে দেন, আবার তিনিই রক্ষা করেন”।

তাতে কী হয়?”

আমরা নানান কষ্টের শিক্ষা পাই, কষ্ট সহ্যের শক্তি পাই। আর যদি কেউ মারা যায়, তাহলে বুঝবে তিনি তাদের শাস্তি দিয়েছেন”।

তিনি শাস্তি দেন কেন”?

দেবেন না? তুমি দুষ্টুমি করলে, তোমার মা তোমাকে শাস্তি দেন না? তেমনি বড়রা অন্যায় করলে, তিনিও তাদের শাস্তি দেন – বাবা পশুপতি আমাদের বাবার মতো, দেবীমা আমাদের মায়ের মতো, তাঁরা শাস্তি দেবেন বৈকি?”

নাতির সঙ্গে কথা বললেও ভুলকা ক্রমশঃ উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, এখনও তাঁর ছেলেরা মাঠ থেকে ফিরল না। কিছুদিন ধরেই তাঁর ভাইপোরা অনেকটা জমির অধিকার নিয়ে বড্ডো জ্বালাচ্ছে।

সেই ঘটনার সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে। তখন বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই মিলে ভুলকারা একসঙ্গেই থাকতেন। ভুলকার ছয় ছেলের মধ্যে তখন চার ছেলে তরুণ ও দুই মেয়েও কিশোরী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁর সেজভাইয়ের তখনও কোন সন্তান হয়নি। সকলেরই মনে হয়েছিল সেজবৌমা হয়তো বন্ধ্যা। সন্তানহীন দুঃখী সেজভাই নিজে থেকেই তখন ভুলকাকে বলেছিল, “একা একা আমি আর পেরে উঠছি না, দাদা, আমার কিছু জমি তুমি বরং নিয়ে নাও। তোমার ছেলেরা বড় হচ্ছে, চাষ-আবাদের সুবিধে হবে”। কথাটা ঠিকই, লোকবল বেশি না হলে চাষের কাজে অসুবিধে হয়। অতএব ভুলকা ও তাঁর ছেলেরা সেজভাইয়ের দেওয়া সেই জমি নিজেদের মনে করেই চাষ-আবাদ শুরু করেছিল। সে জমি যে কোনদিন ফেরত দিতে হবে, একথা তারা কল্পনাও করেনি।   

কিন্তু দেবী মায়ের লীলা কে আর বোঝে? ওই ঘটনার কয়েকবছর পরে, পোড়া-অশথ তলার থানে মানত করে, সেজবৌমার ছেলেপুলে হওয়া শুরু হল। নয় নয় করে, দেবী মায়ের কৃপায় সেজভাইয়ের চারটি ছেলে ও  তিনটি মেয়ে হল। দেখতে দেখতে তারা বড়ও হয়ে উঠল। ভুলকা সবই দেখেছেন, মনে মনে উচিৎ-অনুচিৎ অনেক চিন্তাভাবনাও করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে থেকে কোনদিন সেজভাইকে জমি ফেরত দেওয়ার গরজ দেখাননি, এবং সেজভাইও মুখ ফুটে জমি ফেরতের কথা কোনদিন বলেনি।

এর মধ্যে গতবছর হঠাৎ করেই সেজভাই মারা গেল। সেজবৌমা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিধবা হল। শোকতাপ মিটে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই, ভুলকার ভাইপোরা জ্যাঠার থেকে তাদের বাপের দেওয়া সেই জমিগুলো ফেরত চাইছে। তাঁর ভাইপোরা এখন বড়ো হয়েছে, দুই ভাইপোর বিয়ে হয়েছে, এক ভাইঝির বিয়ে হয়েছে, দুই ভাইঝিও বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠছে। ওদের পরিবারে লোক বাড়ছে, বাড়ছে লৌকিকতা, কুটুম্বিতা। ভুলকা খুব ভালো করেই জানেন, জমিগুলো ভাইপোদের এখন ফেরত দেওয়া উচিৎ। জমিগুলো ফিরে পেলে ওদের কিছুটা স্বচ্ছলতা বাড়বে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর নিজের ছেলেরা যে কিছুটা হলেও আতান্তরে পড়বে! ভুলকার ছেলেরাও তাদের খুড়তুতো ভাইদের ওই জমি ফেরত দিতে মোটেই রাজি নয়। তাদের বক্তব্য, এতদিন ওই জমিতে তারা ঘাম ঝরিয়েছে, তার স্বত্ব ভোগ করেছে, ও জমি এখন তাদের।

এখন এই নিয়েই চলছে দু পক্ষের মনোমালিন্য, বিবাদ।

ও দাদু, কথা বলছো না, কেন? অন্যায় মানে কী?”

ভুলকা একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন, নাতির কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন, বললেন, “অন্যায় মানে কী আর এক কথায় সব বলা যায়, বাবা? যে কাজ করা উচিৎ, তা না করাকে অন্যায় বলে। যেমন, মিথ্যে বলে কাউকে ঠকানো। গায়ের জোরে কাউকে বঞ্চিত করা।  তোমাকে কেউ হয়তো বিশ্বাস করল, কিন্তু তুমি তার সঙ্গে অবিশ্বাসের কাজ করলে... । সে অনেক কিছু, তুমি এখন ছোট্ট, তোমার ওসব জেনে কাজ নেই। বড়ো হতে হতে নিজেই সব বুঝে যাবে, বাবা, কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়”।

ভুলকা উদ্বিগ্ন মুখ বিড়বিড় করে বললেন, “কিন্তু তোর বাবা-জ্যাঠাদের কী ব্যাপার বল তো? এত দেরি করছে কেন? অন্যদিন সন্ধের আগেই তো ওরা ফিরে আসে”।

বাবারা তো আজ ফেরার সময় বিশ্‌-জ্যাঠার বাড়ি হয়ে আসবে”।

তাই? তুই কী করে জানলি?”

দুপুরে খাওয়ার পর মাঠে যাওয়ার আগে, জ্যাঠা তোমাকে বলতে এসেছিল, তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে, তাই ঠাকুমাকে বলে গেছে, আমি শুনেছি”।

অ”। ভুলকা নাতিকে কিছু বললেন না, কিন্তু আরেকটু উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি প্রদীপের ম্লান আলোয় উঠোনে আবছা দাঁড়িয়ে থাকা শস্যের গোলা দুটোর দিকে তাকালেন, তাকালেন খড়ের বিশাল পালার দিকে। তাঁদের এই স্বচ্ছলতা আর কী থাকবে না? সেজভাইয়ের জমিগুলো ভাইপোদের দিতে হলে, তাঁদের হয়তো অসংকুলান হবে না, কিন্তু এই স্বচ্ছলতাও থাকবে না।

ভুলকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করতে লাগলেন, বাড়তি শস্য দিয়ে এই কয়েক বছরে তাঁর ছেলেরা গাই-গরু কিনেছে। ঘরে এখন দুধ-দইয়ের অভাব নেই। বউমাদের জন্যে কিছু না কিছু গয়না কিনছে প্রত্যেকবছর। লাপিসের গয়না, নানান রঙিন পাথরের গয়না, শাঁখ, শাঁখের গয়না। সুতোর মোলায়েম বস্ত্র। হাড়ের কিংবা হাতির দাঁতের দামি চিরুনি। ভালো লবণ, নানান মশলা, চাল। তাঁদের পরিবার এখন সম্পন্ন। এই গ্রামে ভুলকার পরিবারকে নিয়ে সবাই মুখে গর্ব করলেও, মনে মনে অনেকেই যে ঈর্ষা করে, সেটা টের পান ভুলকা। এই ঈর্ষা তাঁকে যেমন আত্মতৃপ্তি দেয়, তেমনি মনে ভয়ও জাগায়। তাঁর বিশ্বাস ঈর্ষার নিঃশ্বাসে বিষ থাকে, সে বিষে অকল্যাণ হয় পরিবারের। তিনি বাবা পশুপতিকে জোড়হাতে নমস্কার করে, মনে মনে বললেন, “রক্ষা করো, দেবতা, রক্ষা করো”।

ভুলকার মনে এখন দ্বন্দ্ব, কোনটা ঠিক বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। একদিকে তাঁর পরিবারের অস্বচ্ছলতার ভয়, অন্য দিকে সেজভাইয়ের ছেলেদের বঞ্চিত করা। সত্যি বলতে এখন তাঁর ভাইপোরা তাদের বাবার দেওয়া জমি ফেরত চেয়ে খুব অন্যায় কিছু করছে না। এখন সেজভাই নেই, জ্যাঠা হিসেবে তাঁরও তো কর্তব্য ভাইপোদের ভালোমন্দের খবর রাখা, দুঃখে-দৈবে পাশে থাকা। যতই হোক, ভাইপো মানে রক্তের সম্পর্ক, আপন না হোক, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। তারা অভাবে থাকবে আর তিনি ও তাঁর পরিবার স্বচ্ছল বিলাসিতা উপভোগ করবেন, এটা তাঁর উচিৎ মনে হচ্ছে না। এও তো এক অন্যায়! যে কথা তাঁর বালক নাতি একটু আগেই জিগ্যেস করছিল, তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। এই অন্যায়ের জন্যে বাবা পশুপতি, দেবীমা তাঁদের কোন শাস্তি দেবেন না তো? ভুলকা আবার জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে স্মরণ করলেন, “হে দেবীমা, কিছু একটা বিহিত করো, মা। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে”।

তাঁর আরও মনে হল, শৈশবে তাঁরা সব ভাই মিলেমিশে মহানন্দেই তো বড়ো হয়েছিলেন। কখনো মনে হয়নি তাঁদের সেই ভালোবাসা কোনদিন হারিয়ে যাবে। কিন্তু যখন থেকে নিজেদের সংসার, জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি এসবের চিন্তা মাথায় ঢুকেছে, তখন থেকেই ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব বেড়ে উঠেছে। এই যে তাঁর সেজভাই গতবছর মারা গেল, তিনি কান্নাকাটি চেঁচামেচি করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন কিছু দুঃখও পাননি। সেজভাইয়ের বউ বা তার ছেলেমেয়েদের প্রতিও তেমন সহানুভূতি টের পাননি।

হঠাৎ তাঁর মনে হল, তাঁর নিজেরও তো ছয় ছেলে, এখনও পর্যন্ত তারা একসঙ্গে ভালই তো আছে। তিনি মারা গেলে, তাঁরা ছেলেরাও কী সব আলাদা হয়ে যাবে? তিনি মাথা নাড়লেন, ভাবলেন, তাঁর ছেলেরা সকলেই খুব ভালো, তাদের মধ্যে এমন হতেই পারে না।          

২.১.২ পারিবারিক বিভাজন

ছেলেদের ফিরতে সেদিন একটু রাতই হয়েছিল। যখন এল তার আগে শেয়ালের দল দু’বার প্রহর ঘোষণা করে ফেলেছে। পাড়ার কুকুরগুলো দু’বারই সেই আওয়াজে ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে গেছে, গ্রামের সীমানায়। উৎকণ্ঠিত ভুলকা বারবার সদরে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকছিলেন, ছেলেদের দেখার আশায়। ছেলেরা বাড়ি ঢুকতেই ভুলকা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, বড্ডো দেরি করে ফেললি? শুনলাম তোরা নাকি বিশ্‌-এর কাছে গিয়েছিলি? কী ব্যাপারে?”

বড়ছেলে বলল, “ব্যাপার আর কী? তোমার ভাইপোরা বড্ডো ঝামেলা করছে, বাবা। নিজেদের জমি চষা ছেড়ে দিয়ে, আজ সকালে চারভাই একসঙ্গে এসে হাজির ওই জমিগুলো চাষ করতে। খুব খানিক তর্কাতর্কি, বাদ-বিতণ্ডা হল। অন্যান্য জমিতে যারা কাজ করছিল তারাও এসে জুটল। আমাদের দু পক্ষের কথা শুনে সবাই বলল, এক কাজ করো, এভাবে ঝগড়া না করে, তোমরা দু’পক্ষই বিশ্‌-এর কাছে যাও, সে কী সমাধান দেয় দেখ। বিকেলে মাঠ থেকে ফেরার পথে, তাই আমরা বিশ্‌দাদার বাড়ি গেছিলাম”।

ওরাও গেছিল”?

তা আর যাবে না?”

বিশ্‌ কী বলল?”

আমাদের কথা, ওদের কথা সবই শুনল। তারপর মুচকি হেসে বলল, এ আবার একটা সমস্যা নাকি? তোদের সেজকাকা তোদের যে জমিটুকু দিয়েছিল, তার অর্ধেক তোরা ভাইদের ছেড়ে দে। আর বাকি অর্ধেক জমি তোরা জঙ্গল কেটে আবাদ করে নে”।

ভুলকা বললেন, “এটা আবার কী সমাধান? জঙ্গলে নতুন জমি বানাতে কম ঝক্কি? আর সে নতুন জমি হবে জঙ্গলের ধারে, আলাদা জায়গায়, গ্রামের শেষ প্রান্তে। চাষ করতে অসুবিধে হবে না?”

ভুলকার মেজছেলে বলল, “সে কথা আমরাও বলেছিলাম, ওরাও একই আপত্তি তুলেছিল, বাবা। তুমি তো জানো, বিশ্‌দাদা কেমন লোক। সর্বদাই তার মুখে মুচকি হাসি, বলল, তা তো অসুবিধে একটু হবেই। কিন্তু এছাড়া অন্য উপায় কী বল? তোরাও ওই জমি ছাড়তে চাইছিস না, তোর ভাইয়েরাও নয়। তাহলে আরেকটা মীমাংসা হল তোরা ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি কর, কাটাকাটি কর, যে জিতবে তারাই ও জমি ভোগ করবে!”

ভুলকা একটু বিরক্তই হলেন, বললেন, “বিশ্‌ এভাবে বলল?”

বড়ছেলে বলল, “হ্যাঁ বাবা। আর সেই নির্বিকার হাসিমুখে, যেন মারামারি করাটা জলভাত”।

ভুলকা বললেন, “তোরা কী বললি?”

বড়ছেলে বলল, “কী আর বলব? মেনে নিলাম, ওদের অর্ধেকটা ছেড়ে দেব”।

ভুলকা বললেন, “কিন্তু অর্ধেকের মাপ করবে কে?”

বিশ্‌দাদা, সে উপায়ও বলে দিয়েছে, বলেছে হাত দিয়ে মেপে লম্বা আর চওড়ার হিসেব করে দেবে”।

অত বড়ো জমি হাত দিয়ে মাপা হবে? সে তো অনেক খাটনি আর সময়ের ব্যাপার। ওসব করতে গেলে এবারের চাষই তো হবে না ওই জমিতে”।

আমরাও তাই বলেছিলাম। বিশ্‌দাদা বললে, ঠিক আছে কাল সকালে আসিস, আমি আমার ছ’হাত মাপের লম্বা একটা বাঁশ দিয়ে দেব। সেটা দিয়ে চট করে হয়ে যাবে। তার সঙ্গে কিছু ছোট বাঁশও দেব, এক বিঘৎ, এক হাত, দেড় হাত মাপের। জমি মাপতে অসুবিধে হবে কেন? বিশ্‌দাদার কাছে সব সমস্যারই সমাধান আছে”।

হুঁ, তাই হোক তবে। কিন্তু অর্ধেকের সীমানাটা যেন পাক্কা হয়, তা নাহলে ওই নিয়ে আবার পরে বিবাদ শুরু হবে”।

সেকথা বিশ্‌দাদাও বলেছে। বলল, কালকে জমি মেপে, দুই অর্ধেকের দাগ ধরে ফাঁক ফাঁক করে কিছু পাথরের ফলক পুঁতে দিতে, ওটাই হবে দুপক্ষের জমির সীমানা”।

ভুলকা গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন, “যা, হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া কর”। ছেলেরা চলে যাচ্ছিল, তিনি আবার ডাকলেন, বললেন, “তোরা সব ভাইরা মিলে ঠিক করে নে, কোন অর্ধেকটা নিবি। যে অর্ধেকে জল পেতে অসুবিধে হবে না, রাস্তার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে, সেই জমিটাই নিবি। ওদের পিছনে ঠেলে দে”।

বড়ছেলে মিচকে হেসে বলল, “সে সব আমার ভাবা হয়ে গেছে, বাবা”।

ওরা চলে যেতে ভুলকা গম্ভীর হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, তৈরি জমির অর্ধেকটা তো হাতছাড়া হয়ে গেল। জঙ্গল জ্বালিয়ে সাফ করা নতুন জমি আবার কেমন হবে কে জানে? বিশ্‌ জমির বিবাদ হয়তো মিটিয়ে দিল, কিন্তু দুশ্চিন্তা থেকেই গেল।

দীপ জ্বলা ঘরে একলা শুয়ে তিনি এসব নিয়েই চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ল এ ঘর থেকে যাওয়ার সময় তাঁর বড়ছেলের মুখের সেই হাসি আর তার কথাগুলো। ভুলকা উঠে বসলেন, তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, তাঁর এই বড় ছেলেটিই এই পরিবারে ভাঙন ধরাবে। ভবিষ্যতে তাঁর অন্য ছেলেদের বঞ্চনা করতে সে এতটুকু দ্বিধা করবে না। ভুলকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, তিনি কী ভাবে আর এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন?  ভালমন্দ যা করার করবেন, বাবা পশুপতি আর দেবীমা। তাঁরাই ভুলকার শেষ ভরসা।  দুশ্চিন্তা করা ছাড়া ভুলকা আর কীই বা করতে পারেন?          

২.১.৩ আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ, প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য

বিশ্‌ শুধু এই গ্রামের নয়, আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মধ্যে মান্যগণ্য ব্যক্তিত্ব। সকলেই তাঁর পরামর্শ শোনে, উপদেশে মন দেয় এবং যে কোন বিবাদে তাঁর মধ্যস্থতা চায়। বিশ্‌কে শ্রদ্ধা করে না বা ভালোবাসে না, এমন লোক নেই বললেই চলে। তার অন্যতম কারণ তাঁর জীবনচর্যা। বিশ্‌ তাঁর পত্নীকে নিয়ে খুবই সহজসরল জীবন যাপন করেন। সামান্য জমি যেটুকু আছে, তার ফসলে তাঁর ছোট্ট সংসার প্রতিপালিত হয়ে যায়। একমাত্র কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে, সে দূর গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করছে। তেমন কোন পিছুটান নেই বলে, চাষবাস সংসারের কাজ সামলে তিনি বেরিয়ে পড়েন দূরে - পরিচিত কোন গ্রামে অথবা বহুদূরের অচেনা কোন গ্রামেও। এই  যাত্রা পথে তাঁর হাতে থাকে একটি বর্শা, জঙ্গলের পথে আত্মরক্ষার জন্যে। আর কাঁধে থাকে একটি ঝোলা, সংগ্রহ করা খাবার রাখার জন্যে। তাঁকে জিগ্যেস করলে বলেন, “এই যথেষ্ট, জঙ্গলের পথে ফলমূলের কোন অভাব তো নেই। আর যতক্ষণ বুকে আছেন দেব পশুপতি আর দেবীমা, আমার ভয় কিসের, আমার আবার অভাব কিসের?”

গ্রাম ছেড়ে তাঁর এই একলা বের হওয়াটা সাধারণ মানুষকে যেমন আশ্চর্য করে, তার থেকেও আশ্চর্য করে, তাঁর ফিরে আসাটা। প্রায় প্রত্যেকবারই তিনি ফিরে আসেন কিছু না কিছু আশ্চর্য তথ্য কিংবা প্রযুক্তি নিয়ে। যা শুনে এবং দেখে গ্রামের মানুষেরা অবাক হয়ে যায়।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা, এমনই দেশ ভ্রমণ সেরে ফিরে এসেই, তিনি বসে গিয়েছিলেন, কাঠের চাকা গড়তে। সে বড়ো সহজ কাজ নয়। কাঠের মাঝারি দুটো গুঁড়ি কেটে, তাদের মাঝখানে গোল ছিদ্র করে নিলেন। সেই ছিদ্রে পড়িয়ে দিলেন, আরেকটি কাঠের মোটা লাঠি। তারওপর বিছিয়ে দিলেন, বাঁশের মাচা। তৈরি হয়ে গেল, টানা গাড়ি বা ঠেলার গাড়ি। মাঠ থেকে শস্যের ঝুড়ি অথবা খড়ের গোছা আর মাথায় বয়ে গ্রামে আনতে হবে না, গাড়িতে চাপিয়ে দিলেই হল। দুজন লোক মাথায় বয়ে এক বেলায় যা বয়ে আনত, তার দ্বিগুণ চলে এল একগাড়িতে। কী সহজ আর কী কাজের জিনিষ। দেখতে দেখতে সমস্ত গ্রামের লোক চাকা আর গাড়ি বানিয়ে নিল নিজেদের মতো। যার গাড়ি সব থেকে সুন্দর, হাল্কা অথচ মজবুত হল, তাকেই সবাই ধরল, আমাদের গাড়িটাও তুমিই বানিয়ে দাও হে, কিছু গম বা সব্জি নিও তার বদলে। এভাবেই সমাজে শুরু হল নতুন এক পেশা, সূত্রধর – যারা কাঠের কাজে দক্ষ হয়ে উঠল।

চাকার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটি হল রাস্তা। জমি থেকে একটু উঁচু, সমতল পথে গাড়ির চাকা গড়ায় গড়গড়িয়ে। অতএব, জরুরি হয়ে উঠল গ্রামীণ পথ নির্মাণের পরিকল্পনা। আবাদি জমি, কিংবা চারণ ক্ষেত্র থেকে প্রত্যেকটি বসত বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোনোর জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল নির্দিষ্ট পথ নির্মাণ।    

এর কয়েক বছর পরেই দেশবিদেশ ঘুরে বিশ্‌ ফিরলেন, চারটে অদ্ভূত জন্তু নিয়ে, এমন জন্তু এ অঞ্চলের মানুষরা দেখেনি আগে। বিশ্‌ তার নাম বললেন গাধা। চারটে গাধার মধ্যে একটা ছিল মদ্দা আর তিনটে মাদী। সবাই বলল, কী করবে তুমি এদের নিয়ে? এদের মাংস খাবে? বিশ্‌ বললেন, মাংস খাবো কেন? মাংস খাবার জন্যে তো ঘরে ছাগল, ভেড়া রয়েছে। এরা আমার অনেক কাজ করে দেবে। মাঠ থেকে ফসল আনার জন্যে আমাকে আর গাড়িও ঠেলতে হবে না। ওরাই নিয়ে আসবে নিজের মতো। দু একবার সঙ্গে নিয়ে রাস্তা চিনিয়ে দিলেই হল। মাঠে আমি ওদের পিঠে বোঝা চাপিয়ে দেব, ওরা নিজেরাই বয়ে আনবে বাড়িতে, বউ ওদের পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে, আবার ওদের মাঠে ফেরত পাঠিয়ে দেবে! সত্যি সত্যি গ্রামের মানুষ গাধাদের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেল, বলল, বিশ্‌ভাই আমাদেরও এমন গাধা এনে দাও। বিশ্‌ হাসলেন, বললেন, চিন্তা নেই, আমি বলে এসেছি, বর্ষার পরেই ওরা নিয়ে আসবে, নদীর ধারের পথ বেয়ে। তখন নিও, ওরা কিন্তু বদলে গম নেবে। কারা? যারা এরকম নানান পশুদের পোষ মানায়, পশুপালক।

একবার বেশ কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে, বিশ্‌ গ্রামে ফিরলেন, সাদা কাপড় পরে। গ্রামের লোক আশ্চর্য, হয়েছিল। বিশ্‌ সবাইকে সে কাপড় দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন পশ্চিমের এক দেশে তুলোর চাষ হয়। আমাদের যেমন হয় গম বা যব, ওদিকে তেমনি হয় কাপাস তুলো। তুলো থেকে তারা সরু সুতো বানাতে পারে, সেই সুতো থেকেই তারা এমন নরম, পাতলা কাপড় বানায়। পরে খুব আরাম। তুলোর চাষ হয় যেখানে বিশ্‌ সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখেছেন কী ভাবে তুলো থেকে সুতো বের করা হয়। তারপর কী ভাবে সেই সুতো থেকে কাপড় বানানো হয় কাঠের তাঁত যন্ত্রে।

এমন কত যে আশ্চর্য সামগ্রী ও তার খবর বিশ্‌ নিয়ে আসেন, তার কোন লেখাজোখা নেই।

 যে কোন গ্রামের যে কোন উৎসবে বিশ্‌-এর নিমন্ত্রণ থাকে, এমনই জনপ্রিয়তা তাঁর, বিশ্‌ভাই না এলে যেন উৎসব জমে না। বয়স্ক লোক, মহিলা-পুরুষ এমনকি ছেলেমেয়েরাও তাঁকে ঘিরে ধরে, বলে ‘গল্প বলো’।

বিশ্‌ভাই হাসেন, তাঁর মুখে সর্বদাই হাসি লেগে থাকে, কখনো বিরক্তি বা রাগের চিহ্নমাত্র দেখেনি কেউ। বলেন, “গল্প শুনবে? কত গল্প চাও, পৃথিবী জুড়ে আশ্চর্য সব গল্প ছড়িয়ে আছে। কুড়িয়ে আনার অপেক্ষা। সেবার চলে গেছিলাম পশ্চিমে সমুদ্রের ধারে”।

সমুদ্র মানে?”

সমুদ্র মানে জল আর জল। আমরা যত নদী, নালা সরোবর, পুকুর দেখেছি, তার থেকে অনেক অনেক  বড়ো। নীল জলে ঢেউ দিচ্ছে সারাদিন, সারারাত। সে জলের শেষ দেখা যায় না, আকাশে গিয়ে মেশে। আর পশ্চিমে সূর্য যখন অস্ত যায়, মনে হয় সূর্য বুঝি জলেই ডুব দিল। সেখানকার মানুষরা কত কী যে জানে, কত যে আশ্চর্য কাজ করে, তার আর সীমা নেই। তারা সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিয়ে তুলে আনে কতরকমের মাছ, শাঁখ, কড়ি, ঝিনুক আরও কত কি। কিছু কিছু ঝিনুকে পায় মুক্তো। সেই মুক্তোর মালা গাঁথে, বহু দূর দূর দেশের সম্পন্ন মানুষেরা মুক্তোর মালা পরতে ভালোবাসে। ওদিকের অনেক মানুষ কাঠের বড়োবড়ো নৌকো বানিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়ে। বহু দূর দূর সব দেশে যায় বাণিজ্য করতে”।

বাণিজ্য মানে?”

বাণিজ্য মানে, জিনিষের বদলে অন্য জিনিষ নিয়ে আসা। আমাদের গ্রামেও তো আসে, চকমকি পাথর নিয়ে, গরু আর গাধার পাল নিয়ে, কাপড়ের বোঝা নিয়ে। তোমরা গম বা যবের বদলে ওসব কেন। আমাদের মাটিতে গম আর যব হয়, আমাদের দরকারের থেকেও ফলন বেশি হয়। ওদের মাটিতে তুলো হয়, গম বা যব ভালো হয় না। তাই তারা কাপড়ের বদলে গম বা যব নিয়ে যায়। পাথুরে জায়গায় আবার কিচ্ছু হয় না, ভালো চকমকি পাথর হয়। ওরা পাথরের দেশের লোক, পাথর কাটতেও জানে, দারুণ ধারালো ফলা বানাতে পারে। তার বদলে ওরা গম-যব নিয়ে যায়। পশুপালকরা চাষবাস করতে জানে না, তারা জঙ্গলের পশুকে পোষ মানাতে পারে। তারা পশুর দল নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায় ঘাসজমির সন্ধানে। ওরা কতো যে দেশ দেখেছে, কত যে মানুষ দেখেছে, সে আর বলার কথা নয়। ওরা গরু, ছাগলের বদলে যব-গম, কাপড় কেনে। একেই বলে বাণিজ্য। সমুদ্রে যারা যায় তারা আরও কত কী নিয়ে যায়, ফিরে আসে নানান আশ্চর্য জিনিষ নিয়ে”।

আচ্ছা, এই যে তুমি চেনা নেই, জানা নেই, এত দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও, তারা তোমার সঙ্গে কথা বলে কেন? তোমাকে উটকো লোক দেখে সন্দেহ করে, তাড়িয়ে দেয় না?”

বিশ্‌ হেসে ফেললেন, বললেন, “তাড়িয়ে দেবে কেন? হ্যাঁ প্রথম প্রথম একটু সন্দেহ করে না, তা নয়, কিন্তু আমি তো সন্দেহ করার মতো কিছু করি না। হাসি আর কথা বলি। প্রথম প্রথম তাদের কথাও ভালো বোঝা যায় না, অন্যরকম ভাষা তো, তবে সেও হয়ে যায়। কিছুক্ষণ শুনতে শুনতে আর কথা বলতে বলতে বোঝা যায়, তখন তারাও আমাকে তাদের দলে নিয়ে নেয়। মনের কথা বলে। এবার পশ্চিমে গিয়ে যেমন দেখে এলাম, ওরা বিদেশ থেকে ধাতুর যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে”।

ধাতু সেটা আবার কী জিনিষ?”

সে কী আর আমিও ভাল জানি? তবে দেখলাম সে এক আশ্চর্য জিনিষ বটে। চকচকে আর ধারালো সব যন্ত্রপাতি, অস্ত্র–শস্ত্র। শস্য কাটার কাস্তে, মাটি কাটার কোদাল, পাথর কাটার গাঁইতি, ছেনি। বর্শার ফলা, ছুঁচোলো শাবল। মোক্ষম জিনিষ সব। সে সব ধাতুর নাম বলল, তামা আর ব্রোঞ্জ। বেশ জিনিষ – আমাদের পাথরের মতো গাব্দা ভারি নয়”।

দু একটা নিয়ে এলে না কেন?”

বিশ্‌ হেসে ফেললেন, বললেন, “তাই হয় বুঝি? আমাকে হাতে নিয়ে দেখতে দিয়েছে তাই না ঢের, ওগুলোর বদলে দেওয়ার মতো আমার যে কিছুই ছিল না”।

তাহলে গাধাগুলো কী করে নিয়ে এসেছিলে”?

বিশ্‌ হাসলেন, বললেন, “সে তারা বিশ্বাস করে দিয়েছিল, আমি ওদের যে আমাদের গ্রামে আসতে বলেছিলাম। ওরা যখন এসেছিল, তোমরা তো অনেকেই গাধা নিয়েছিলে। সেই সময় আমিও গম, অনেক ফল, মাছ দিয়েছিলাম যে। ওই ধাতু যারা বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে, তারা কেউ এদিকে আসবে না।

তবে শুনেছি, এখান থেকে বহুদূরে, আমাদের উত্তরপশ্চিমে অনেক পাহাড় আছে, সেখানে ধূধূ করছে মরুভূমি। শুনেছি সেখানে অমন ধাতুর কাজ শুরু হয়েছে, হয়তো আমরাও কবছরে মধ্যে সহজেই পেয়ে যাবো, তামা আর ব্রোঞ্জের সামগ্রী”।

মরুভূমি মানে?”

বিশ্‌ হাসিমুখে বললেন, “মরুভূমি খুব কষ্টের জায়গা। যতদূর চোখ যায়, শুধু বালি আর বালি। গরমের সময় যেমন গরম, শীতে তেমনি ঠাণ্ডা। একফোঁটা খাবার জলের জন্যে অনেক কষ্ট করতে হয়”।

সেখানে মানুষ থাকে?”

থাকে বৈকি। যেখানে একটু আধটু জল আছে, সেখানেই থাকে, পশুপালন করে, সামান্য কিছু চাষবাস করে, আর পাথরের কাজ করে। শুনেছি ওরাই নাকি তামা খুঁজে পেয়েছে, ভাবছি পরের বার যাবো। ওদের ছাগল ভেড়া ছাড়াও অন্য এক পশু আছে, তার নাম উট। অনেক বড়ো চেহারা, কিন্তু খুব নিরীহ প্রাণী। মরুভূমির গরম বালিতেও উটের দল খুব হাঁটতে পারে। তারাই জিনিষপত্র নিয়ে, মানুষ নিয়ে মরুভূমির একদিক থেকে অন্য দিকে যাওয়া আসা করে।” 

২.১.৪ প্রযুক্তির জোয়ার

বিশ্‌ভাইয়ের যোগাযোগের ফলেই, নদীপথে আর নদীর ধারের পায়ে চলা পথ ধরে আজকাল কত যে দল আসে, আশ্চর্য সব জিনিষ নিয়ে। ছোটখাটো জিনিষপত্র নিয়ে যারা আসে তারা আসে নদীপথে নৌকায়। তাদের কাছে থাকে গৃহস্থালীর নানান সরঞ্জাম, চাষ-আবাদের সরঞ্জাম। বিশ্‌ভাই ঠিকই বলেছিল, তামা আর ব্রোঞ্জের জিনিষপত্র নিয়েও ওরা আসে। ব্রোঞ্জ অর্থাৎ কাঁসার সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র সত্যিই দেখার মতো। যেমন ধারালো তেমনি টেকসই। কাঁসার ফাল, লাঙলের আগায় লাগিয়ে নিলে, মাটি কাটা যায় সহজে, কাঠের লাঙল ভেঙে যায় কিন্তু ফাল ভাঙে না। কাস্তে দিয়ে শস্য কাটতে যেমন সুবিধে তেমনি সুবিধে ছুরি দিয়ে সব্জি কিংবা মাংস কাটতে, রান্না করতেও অনেক সুবিধে হয়। ওরা আরও নিয়ে আসে তামা এবং কাঁসার বাসনপত্র, হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, ঘটি। আগে মাটির পাত্রে রান্না করার ঝকমারি ছিল কম? একটু অসাবধান হলেই ভেঙে যেত। এখন কাঁসার পাত্র অনেক বেশি টেকসই, বহুদিন চলে। মাটি আর বালি দিয়ে পরিষ্কার করলে ঝকঝক করে নতুনের মতো। যদিও গ্রামের বয়স্ক লোকেরা কাঁসার বাসনের রান্না পছন্দ করে না, তারা বলে, মাটির জিনিষে রান্নার যে স্বাদ বা গন্ধ হত, তামা বা কাঁসার পাত্রে তা পাল্টে যায়। তামা খাবারকে বিষাক্ত করে। কিন্তু তাও মাটির হাঁড়ি-কড়াইয়ের বদলে আজকাল কাঁসার বাসনের চল বাড়ছে।

নদীপথে ওরা আরও নিয়ে আসে নানান অলংকার। হাতির দাঁত কিংবা মোষের হাড়ের অলংকার তো আগেও আসত, এখন তারা আনে মুক্তোর মালা, লাপিস, স্ফটিক কিংবা নানান রঙিন পাথরের হার। তারা শাঁখার গয়না আনে, ধবধবে সাদা শাঁখের বালা কিংবা আংটি। মেয়েরা এই সব গয়না খুব পছন্দ করে, ছেলেরাও করে। উৎসবের দিনে মুক্তোর কিংবা লাপিসের মালা একখানা গলায় পরলে, যেমন সুন্দর দেখায়, তেমনি সবাইকে মুগ্ধও করে দেওয়া যায়। যারা এই সব অলংকার নিয়ে আসে, তারাও বলে অন্যান্য গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থের মহিলা-পুরুষ, বিয়েবাড়ি বা কোন উৎসবে, পুজো পালায় এই অলংকারই পরে থাকেন। তাঁদের রূপ যেন ঠিকরে বেরোয়। আর আপনার আদরের মেয়েকে, তার বিয়ের দিনে, যদি এই মুক্তো বা লাপিসের মালায় সাজিয়ে তোলেন, তার থেকে চোখ ফেরাবে কোন মূর্খ? বর তো বটেই, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদও মুগ্ধ হয়ে থাকবে। 

দৈনন্দিন জীবনধারণের পরেও উদ্বৃত্ত সম্পদ দিয়ে সংগ্রহ করা এই অলংকার তো আসলে স্বাচ্ছল্যের প্রতীক। সমাজে অন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে ওঠা এবং উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সোপান। অতএব, যতবেশী উদ্বৃত্ত সম্পদ, তত বেশি সামাজিক আধিপত্য এবং সমাজকে প্রভাবিত করার ব্যক্তিত্ব।

বেশ কয়েক বছর ধরেই, সাদা কাপড় আসছিল, তবে এখন আসে নানান ধরনের। আগেকার মতো সাধারণ সাদা কিংবা অনুজ্জ্বল রঙের কাপড় ছাড়াও, কিছু কাপড়ে থাকে নানান ধরনের চোখ ধাঁধানো রঙ আর কারুকার্যের বুনোট। সে কাপড় সাধারণ কাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি মসৃণ, নরম এবং সূক্ষ্ম। আজকাল ছেলেদের জন্যে একরকম আর মেয়েদের জন্যে অন্যরকম কাপড় আসছে। ছেলেদের কাপড়ের নাম ধুতি আর মেয়েদের কাপড়কে শাড়ি বলে। আজকাল সুতি কাপড় ছাড়াও আরেক ধরনের ধুতি আর শাড়ি আসছে, সেগুলো পাটের, পাটের তন্তু থেকে বানানো। যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি ঝলমলে। পাটের কাপড় যারা নিয়ে এসেছিল তারা বলেছিল, অন্যান্য গ্রামের বড়োবড়ো মানুষরা পুজো-পার্বণে এই ধুতি বা শাড়ি পরে পুজো করেন। এই পাটের তন্তু কখনো অপবিত্র হয় না, সর্বদাই শুদ্ধ। আর দিনের আলোই হোক কিংবা সন্ধের মশালের আলোয় এই পাটের কাপড় যখন ঝলমল করে, তখন মনে হয় দেবতার আশীর্বাদে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ভক্ত।

নদীপথে আরও আসে তেল, বড়োবড়ো তামার হাঁড়ি কিংবা কলসিতে। তেল দিয়ে কী হবে? তেল নিয়ে আসা লোকগুলো হেসেছিল, তাও জানো না বুঝি? রান্নার সময়, জলে সেদ্ধ করার আগে, ভেজে নাও যে কোন সব্জি কিংবা মাংস। তারপর দেখ কেমন স্বাদ আর গন্ধ হয় রান্নার। কিসের তেল এগুলো? তেল অনেক রকমের হয়, বেশির ভাগ হয় তিল থেকে, যার জন্যেই তো নাম তেল। আরও হয় সরষে, নারকেল, বাদাম, কাপাসের বীজ থেকে। এ তেল শুধু রান্নাতেই নয়, গায়ে মাখো, চুলে মাখো। উস্কোখুস্কো চুল, খড়িওঠা চামড়ার রঙই বদলে যাবে। আমাদেরই দেখো না, আমরা রোজ চানের সময় গায়ে মাথায় তেল মাখি, কেমন চুকচুকে লাগছে দেখছো না? ছোট ছোট মেয়েরা এখন বড় হচ্ছে, কদিন পরেই তাদের বিয়ে, তাদের গায়ে আর চুলে তেল মাখাও, দেখবে ছেলেপক্ষের লোকেরা চোখ ফেরাতে পারবে না। এক কথায় বিয়ে হয়ে যাবে ভালো বরে, ভালো ঘরে।

বেশ কবছর ধরেই, নদীর ধারের হাঁটা পথে আগে গরু, গাধা, ছাগল, ভেড়া নিয়ে আসত কিছু মানুষ। এখন তারা আরও আনছে বলদ আর খাসি। এঁড়ে গরু বড়ো হয়ে ষাঁড় হয়, গাভীদের নিষিক্ত করা ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই। ষাঁড় ভীষণ বদমেজাজি আর একগুঁয়ে হয়, পোষ মানে না। তাই এতদিন গ্রামে দু একটা এঁড়ে রেখে, সকলকে মেরে ফেলা হত। এরা এঁড়ে গরুদের নির্বীর্য করে দিয়েছে (castrated)তাতে কী হবে? একজোড়া নিয়েই দেখ না। ওদের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে লাঙল টানাও, গাড়ি টানাও। যেমন ক্ষমতা তেমনি খাটিয়ে। দুজন মানুষ সারাদিনে কতটা জমি চষতে পারে, লাঙল টানে যে মানুষটা তার বুক, পা আর কাঁধের কী অবস্থা হয় দেখেছ? একবেলা চাষ করতে কবার জিরোতে হয়? এখন লাঙলের ফাল মাটির কত গভীরে যেতে পারে, ছয় আঙুল, এক বিঘৎ? এই জোড়া বলদের কাঁধে জোয়াল ফেলে দাও, আর পেছনে শক্ত মুঠিতে গেঁথে ধরো লাঙলের ফাল। মাটি এক হাত গর্ত হয়ে বেরিয়ে আসবে উর্বর মাটি। তোমরা দুজন মানুষ পনেরদিনে যতটা জমি চষতে পারো, একজন মানুষ আর এই জোড়া বলদে সেই জমি চষে দেবে একটিমাত্র দিনে। কত জমি আবাদ করবে করো না, কত ফসল ফলাবে ফলাও না। শুধু শীতের গম কিংবা যবই বা কেন? তিল কর, সরষে কর? এর সঙ্গে বর্ষায় চাষ করো ধান, পাট। বছরের আট মাস চাষের জমি ফেলে রাখবে কেন? তার মধ্যেও ফসল ফলাও, ঘরে ভরে তোল সম্পদ আর ঐশ্বর্য।

তৎকালীন গ্রাহকদের (consumers) কাছে তাদের পণ্যসামগ্রীর (products) গুণমান এবং উপযোগীতা নিয়ে বণিকরা এভাবেই বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করত কিনা, জানার কোন উপায় নেই, সবটাই আমার কল্পনা। কিন্তু আজকের অত্যাধুনিক সমাজেও অতি হানিকারক পণ্যসামগ্রীর মিথ্যা বিজ্ঞাপনে যেভাবে গ্রাহকদের প্রলোভিত করা হয় এবং আমরা স্বচ্ছল মানুষরা সেই ফাঁদে পা দিয়ে থাকি, তার দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক। আজও আমাদের আধুনিক, সংস্কারমুক্ত(?) ও যুক্তিবাদী(?) সমাজে আমরা ছেলেমেয়েদের পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে নানান হেল্‌থ্‌ ড্রিংক খাইয়ে থাকি। তার মেধা, স্মরণশক্তি এবং দৈহিক শক্তি বাড়াতে। তারা কেউই আইনস্টাইন বা নিউটন বা মনোতোষ রায় হতে পারে না, বরং অনর্থক গাব্দাগোব্দা হতে থাকে। একটু বড় হয়ে কিশোর কিংবা তরুণ ছেলেমেয়েরা যখন স্বাস্থ্য সচেতন হয়, তখন তারা জিমের বিজ্ঞাপন ও সিনেমার নায়কদের দেখে। তখন তারাই আবার জিমগুলি ভরিয়ে তোলে মাত্র তিনমাসে সিক্সপ্যাক বানিয়ে তোলার স্বপ্নে। বেশ কিছু কার্বোনেটেড শীতল পানীয় আছে, যেগুলি বারবার পান করলে, কখনো আমাদের পৌরুষ জেগে ওঠে, কখনো আসে যুক্তিবাদী প্রজ্ঞা! একটি বিশেষ ধরনের আঠা (adhesive) মানুষের জেনেটিক সংজ্ঞাকে পালটে দিতে পারে। একটি মেয়ে ছোটবেলায় পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করতে নাকের নিচে গোঁফ লাগিয়েছিল, বিশেষ ওই আঠাটি দিয়ে। মেয়েটির সেই গোঁফ আর সারাজীবনে খোলা যায়নি, এমনকি তার বিয়ের পর তার ছেলেমেয়েরাও জন্ম থেকেই বিশাল শ্মশ্রুর অধিকারী হতে পেরেছিল।

তখনকার বণিকেরা এতটা শিল্প সম্মত মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিতে শেখেনি, কিন্ত তাদের সামগ্রীর বাস্তব বিজ্ঞাপন করাটা অবশ্যই জরুরি ছিল। কারণ গ্রামের সাধারণ মানুষদের কাছে সে সময় ব্রোঞ্জ সামগ্রী, তেল, গাভী ও বলদ কিংবা মূল্যবান পট্টবস্ত্র ছিল, একেবারেই নতুন এবং অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অতএব আমার এই কল্পনা, অলীক অবাস্তব নয়। আমরা প্রকৃতিজাত অনন্য এক প্রাণী - হোমোস্যাপিয়েন্স, সেদিনও ছিলাম, আজও আছি। সে সময় ব্যবসায়ীরা মনোহারী সত্য কথায় মানুষকে প্রলুব্ধ করত, এখন ব্যবসায়ীদের মনোহারী নির্জলা-মিথ্যা কথায় আমরা প্রলুব্ধ হই, তফাৎ এইটুকুই।   

২.২.১ সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস

এমন নয় যে গ্রামের সক্কলেই নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং উপকরণের সুবিধে ভোগ করতে পেরেছিল। আজও যেমন হয় না। এরোপ্লেনের ভাড়া অনেক কম হয়ে গেছে বলে, ট্রেন কিছু ফাঁকা হয়ে যায়নি। মোটরবাইক বা স্কুটার সহজলভ্য হওয়ায় সাইকেল উঠে যায়নি। চারচাকা তুলনামূলক সস্তা হয়ে গেলেও বাস তুলে দেওয়া যায়নি। আজও আমাদের দেশে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা টেলিভিসন, মোবাইল-ফোন, কম্পিউটার কী জানেন না, ব্যবহার তো দূরের কথা। সেসময়ও পরিস্থিতি একই রকম ছিল।

যারা লোকবল ব্যবহার করে প্রচুর জমি জায়গা আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল, তারা তাদের উদ্বৃত্ত ফসলের বদলে আমদানি করতে লাগল একের পর এক প্রযুক্তি। তারা বলদের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে চাষ করতে লাগল বছরের প্রায় দশমাস। উদ্বৃত্ত ফসল আরও অনেক উদ্বৃত্ত হতে লাগল। উদ্বৃত্ত ফসলের বদলে ভরে তুলল তাদের খামার - গরু, বলদ, ছাগল, ভেড়ায়। আজকাল তারাও শিখে ফেলেছে এঁড়ে বাছুরকে কীভাবে বলদ করে তোলা যায়। অতএব বলদও হয়ে উঠতে লাগল উদ্বৃত্ত সম্পদ। গাভীর দুধ পরিবারের শিশু এবং বৃদ্ধদের যেমন পুষ্টি যোগাতে লাগল, তেমনই উদ্বৃত্ত দুধ থেকে ঘি, মাখন, দই, ছানা বানাতে শিখে গেল। অর্থাৎ দুধও এখন উদ্বৃত্ত সম্পদ। এখন তাদের গ্রামেও উৎপন্ন হয় তিল এবং সরষে, বলদ আর কাঠের ঘানিতে তেল বানানোর পদ্ধতি শিখতেও দেরি হল না। প্রথম থেকেই যারা সম্পন্ন হতে পেরেছিল, তারা অতি দ্রুত আরও সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠল, এবং তারাই হয়ে উঠল সমাজের উচ্চশ্রেণী। উৎসবে, পুজাপার্বণে তাদেরই আধিপত্য। তাদের পরিবারের মহিলা-পুরুষ, ছেলে-মেয়েরা উজ্জ্বল পট্টবস্ত্র, অলংকার এবং তৈলসিক্ত চুলে ও ত্বকে হয়ে উঠতে লাগল সভ্য, ভদ্র, উচ্চকুলশীলসম্পন্ন। সমাজে তারাই হয়ে উঠল অভিজাত সম্প্রদায়।

অন্যদিকে যারা প্রথম দিকে কিছুটা দুর্বল ছিল, জমির ফসল আর এদিক সেদিক থেকে যাদের অন্নসংস্থান হয়ে যেত কোন মতে, উদ্বৃত্ত সম্পদের অভাবে তারা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে পারল না। তার ওপর দৈবদুর্বিপাক তো ছিলই। সব বছর সমান সুবৃষ্টি হবে এমন তো কথা নেই, কোনবার অনাবৃষ্টি, কোনবার অতিবৃষ্টি। কোন কোন বার আসত পঙ্গপালের দল। ফসল হত যৎসামান্য। সারা বছরের অন্নসংস্থান করাই দুরূহ হয়ে উঠত। অনাহার এবং স্বল্পাহারে জীবনধারণ করতে পারলেও স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে লাগল। শীর্ণ শরীরের দুর্বল সামর্থ্যে সামান্য জমিটুকু সুবর্ষার বছরেও হয়তো সঠিক চাষ দেওয়া যেত না। তবুও বেঁচে থাকতেই হবে, বেঁচে থাকতেই হয়। তারা এবং তাদের ছেলেপুলেরা নিজেদের একফসলি জমির ভরসা ছাড়াও ধনী মানুষের জমিতে চাষ করতে শুরু করল। জমির মালিকানা, শস্যবীজ, জোড়া বলদের লাঙল, ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম, সবই ধনী মালিকের, তাদের শুধু শ্রম। শ্রমের বদলে তারা পেত উৎপন্ন শস্যের কিছু অংশ। তারা ক্ষেতমজুর। আর ছিল পশুপালন -  ধনী মালিকের খামার ভরা পশুদের প্রত্যেকদিন সকালে চারণক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া এবং বিকেলে তাদের ফিরিয়ে আনা, তারা হল রাখাল[2]

অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের সাধারণ জনগণের মতো মাটির ঘর আর খড়ের চালে থাকা শোভা পায় না। ঝড়বৃষ্টিতে কুঁড়ে ঘর তছনছ হয়ে যায়, তাছাড়া সম্পদ বাড়লেই বেড়ে যায় নিরাপত্তাহীনতা। অতএব ধনী ব্যক্তির উপযুক্ত বাসগৃহ বানানো প্রয়োজন। বাণিজ্য করতে আসা মানুষরা বহু গ্রাম দেখেছে, দেখেছ বহু জনপদ, অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের খাতিরও বেশি। তারাই সন্ধান দিল অভিজাত বাড়ি কীভাবে বানানো যায়। কাদা মাটি দিয়ে বানানো ছোট ছোট ইঁট রোদ্দুরে শুকিয়ে নিলে, খুব শক্ত হয়ে ওঠে। সেই ইঁটে দেয়াল তুললে ঝড়-ঝঞ্ঝাতে ভয় থাকে না। মোটা মোটা কাঠের কাঠামো বিছিয়ে তার ওপর খড়ের আঁটি মোটা স্তরে বিছিয়ে দেওয়া যায়। অথবা কাঠের আরো ঘন কাঠামোর ওপর পোড়া মাটির টালি বিছিয়ে তার ওপর চুন আর সুরকির ঢালাই। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে বিপদের ভয় নেই বললেই চলে। তার ওপর দেখতেও হয়ে ওঠে ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। এমন সব বাড়ি বানিয়ে তুলতে প্রয়োজন অসংখ্য শ্রমিক! এই শ্রমিক হল তারা, যারা ভূমিহীন, অন্ন সংস্থানের মতো পর্যাপ্ত জমি না থাকায়, খাদ্যের বিনিময়ে যারা শ্রম দিতে বাধ্য হয়।

অর্থাৎ এতদিনের মোটামুটি সমমর্যাদার মানুষের সমাজে জন্ম নিতে লাগল অসম-মর্যাদার বিভিন্ন মানুষের  শ্রেণী। সমাজের নিম্নস্তরে চলে গেল ভূমিহীন শ্রমিক মানুষ এবং রাখাল। তাদের ওপরে রইল কৃষক মানুষের শ্রেণী এবং নানান পেশাদার শ্রমজীবি। যেমন কুম্ভকার – যারা মাটির তৈজসপত্র বানায়, সূত্রধর – যারা কাঠের জিনিষপত্র বানায়, কর্মকার – যারা ধাতুর জিনিষপত্র বানায়, এমনই নানাবিধ পেশার শ্রমজীবি। এই শ্রেণীর উপরে এল বণিক শ্রেণী, যারা বাণিজ্য করে। আর সবার ওপরে রইল অভিজাত শ্রেণী, যারা কোনোই শ্রম করে না।  কিন্তু নিজেদের উদ্বৃত্ত সম্পদের বিনিময়ে অন্য মানুষের শ্রম ব্যবহার করে, তারা আরও বেশি সম্পদের অধিকারী হতে থাকল। তার অধিগত সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী, তার ব্যক্তিত্ব এবং প্রতাপ বাড়তে লাগল। সে এক বা একাধিক সমাজের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল।

কৃষিভিত্তিক এই গ্রাম সমাজের বাইরেও কিছু শ্রেণী রয়ে গেল। তারা হল অরণ্য বাসী, আরণ্যক শ্রেণী। এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার সে সময়ের সমস্ত মানুষই যে শিকারী-সংগ্রাহী জীবন ছেড়ে দিয়ে কৃষিসমাজে চলে এসেছিল তা কিন্তু নয়। এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অরণ্য অঞ্চলে বেশ কিছু মানুষগোষ্ঠী রয়ে গেল আগের মতোই, একই পেশা, একই ধরনের পারিবারিক আচরণ এবং বিশ্বাস নিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের অধিকাংশই এই আগ্রাসী কৃষি সমাজকে খুব ভাল চোখে দেখেনি। কারণ এই আগ্রাসী কৃষিসমাজ সর্বদাই নদী তীরবর্তী অগভীর অরণ্য গ্রাস করে কৃষি জমি বানিয়েছে এবং তাদের ঠেলে দিয়েছে, বিপজ্জনক গভীরতর অরণ্যের দিকে। যেখানে জীবনধারণ করা শুধু বিপজ্জনকই নয়, অনেক বেশি দুরূহ।

 অতএব এই তথাকথিত সভ্য হয়ে ওঠা মানুষগোষ্ঠীদের ওপর আরণ্যক গোষ্ঠীদের একাংশ বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল। তাদের সেই বিদ্বেষ প্রায়ই হয়ে উঠল হিংস্র অতর্কিত আক্রমণ। সভ্য মানুষদের বসতি এবং গ্রামে তারা প্রায়শঃ হানা দিত শস্যের লোভে এবং গৃহপালিত পশুর লোভে। সে আক্রমণে হতাহত হত অনেক গ্রামবাসী। কারণ কয়েক হাজার বছরের মধ্যে গ্রামবাসীরা, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের তুলনায় হয়ে উঠেছিল অনেক শ্লথ, দুর্বল এবং লড়াইতে অদক্ষ। যার ফলে গ্রামের কৃষিনির্ভর মানুষদের মনেও এই অরণ্যবাসী মানুষদের সম্পর্কে গড়ে উঠল আতঙ্ক। কয়েক হাজার বছর আগেকার সমগোত্রীয় অরণ্যবাসী শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরাই এখন সভ্য সমাজের চোখে হয়ে উঠল ভয়ংকর রাক্ষস কিংবা দৈত্য-দানব শ্রেণী।

আবার অরণ্যে থেকে যাওয়া সকল শিকারী-সংগ্রাহী মানুষই কৃষি সমাজের ওপর বিদ্বিষ্ট এবং হিংস্র হয়ে উঠেছিল তাও নয়। কিছু কিছু দল নিজেদের শিকারী-সংগ্রাহী বৃত্তিকে না ছাড়লেও, তারা বাইরে থেকে কৃষি সমাজের সুবিধেগুলোও কিছু কিছু উপভোগ করত। যার ফলে তাদের সঙ্গে কৃষিসমাজের কিছুটা দূরত্ব থাকলেও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠেছিল, এবং সাংঘাতিক বিদ্বেষ ছিল না। এই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা জঙ্গলের বিশেষ কিছু শিকার এবং সংগ্রহ নিয়ে আসত, কাছাকাছি কৃষিসমাজের গ্রামগুলিতে। যেমন তারা শিকার করে আনত হরিণ, বুনো শুয়োর, সংগ্রহ করে আনত মধু, বুনো কন্দ, ওষধি লতাপাতা। তার বদলে তারা নিয়ে যেত গম, যব বা ধান, কিংবা ব্রোঞ্জের অস্ত্র-শস্ত্র, সরঞ্জাম। কৃষিজীবি মানুষদেরও পোষ্য প্রাণীর একঘেয়ে মাংসের থেকে হরিণ কিংবা বুনো শুয়োরের মাংসে মুখ বদল হত, গ্রামে বসেই পেয়ে যেত মধু কিংবা ওষধি লতাপাতার সংগ্রহ। কৃষি সমাজের সভ্য মানুষরা একদা সমগোত্রীয় এই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের নাম দিল কিরাত, ব্যাধ, শবর, নিষাদ, ইত্যাদি।



[1] এই প্রাণীগুলি ঠিক কারা? এরা কী হোমো স্যপিয়েন্সদেরই একটা অংশ, যারা জঙ্গলের জীবন ছেড়ে, কৃষি সমাজে আসেনি? নাকি হোমো ইরেক্টাস মানবপ্রজাতির বিচ্ছিন্ন কোন মানবগোষ্ঠী? যারা প্রাকৃতিক কারণে এবং সভ্য মানুষের আক্রমণে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছিল? অবশ্য পরাজিত প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে ছোটলোক, অসভ্য, বর্বর না বললে কিংবা তার ভয়ংকর রূপের বর্ণনা না করলে, জয়ী মানুষদের অহং তৃপ্ত হয় না যে। পরবর্তী কালেও দেখব, আর্যদের কাছে, অনার্যরাও ছিল দস্যু এবং অসুর। ব্রিটিশদের কাছে সকল ভারতবাসীই ছিল ব্লাডি নিগার। আজও সুসভ্য ও গণতান্ত্রিক মার্কিন দেশে প্রকাশ্য রাস্তায় কালো মানুষকে গলা টিপে হত্যা করে ফর্সা সভ্য মানুষরা।    

[2] এই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। শহর ও শহরতলির আওতা ছাড়িয়ে একটু দূরের গ্রামে ঢুকলে আজও এমন দৃশ্য ভারতবর্ষের সর্বত্র চোখে পড়বে। দশ-বারো হাজার বছরে ভারতের গ্রামীণ সমাজে আহামরি তেমন পরিবর্তন ঘটে ওঠেনি। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের আলো কিংবা প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা এই ধরনের মানুষদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় তেমন আলোকপাত করতে পারেনি। তবে একথাও সত্যি, স্বাধীন ভারতে এই শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে দু-একজন করিতকর্মা মানুষ বছর পাঁচেক কোন শাসক দলের সোনারকাঠির ছোঁয়া পেলে, কাঞ্চনপ্রভায় সমাজের চোখ ঝলসে দিয়ে থাকেন। 


...চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...