[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে
"ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।
এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে, স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে
ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
নিজের দিদি নাই বা থাকল, কিন্তু ভাইফোঁটার দিনে আমার ছোট্ট মাসতুতো দিদিও হঠাৎ বড় হয়ে যেত, আমাকে আচমকা অবাক করে দিয়ে। ওই একটাই দিন – আগে পরে আবার দিদি ফিরে আসত আমার নিত্য দেখা দিদিতেই। আগের দিন রাত্রে ভাইফোঁটার নেমন্তন্নে আমার ডাক পড়ত মাসির বাড়ি।
সক্কাল সক্কাল দিদি আমার পিছনে লেগে, ঘুম ভাঙিয়ে দৌড়ে চলে যেত চান করতে। সদ্য স্নান সারা দিদিকে নতুন শাড়ি পড়িয়ে মাসিমা সাজিয়ে তুলতেন – যদিও একটু আলুথালু, একটু অপ্রস্তুত, তবু অন্যদিনের চেয়ে একদম অন্য এক দিদি উপস্থিত হত কোন জাদুতে কে জানে। ঘরে ফ্রক পড়া, স্কুলে স্কার্ট পড়া আটপৌরে দিদিকে মাসিমার মতোই রীতিমত গম্ভীর দেখাত।
ভিজে খোলা এলোচুল থেকে টপকাত ফোঁটা ফোঁটা জল। এ ঘর ও ঘর
করতে করতে নানান কাজ সারতে সারতে আমাকে মাঝে মাঝেই শোনাত, ”বাথরুমে গরম জল করা আছে, চান করে নে। চান না করে আমাকে ছুঁয়ে ফেলিস না যেন, তোর সব বাসি আকাচা জামা কাপড়...”।
পাটায় চন্দন ঘষতে ঘষতে খোলা চুল কতবার চলে আসত মুখের ওপর, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বার বার সরিয়ে তুলত পিঠে। কখনো নেমে আসত
শাড়ির আঁচল, চন্দনে মাখামাখি। দিদির গায়ে
মৃদু চন্দনের গন্ধ ভরে উঠত। সে এক অন্য দিদি। আজ ভাইফোঁটা।
সেদিন মেসোমশাই মিষ্টি কিনতে বের হচ্ছেন দেখলেই দিদির
মুখভার। বাবাকে কিছু বলতে পারত না, মায়ের কাছে ঘুনঘুন
করত।
“আজকের দিনে ওকে দাও
না, পছন্দ করে মিষ্টি নিয়ে আসুক
– রোজ তো তুমিই আনো”। মাসিমা বললেন
মেসোমশাইকে। মেসোমশাইয়ের সদাগম্ভীর মুখেও প্রশ্রয়ের উচ্চ হাসি।
“হা, হা, হা, হা, তাই তো আমার পাগলি
মাটা বড় হয়ে গেছে কতো – বুঝতেই পারিনি”!
দিদি আড় চোখে আমার দিকে তাকাল, ভাবখানা – বাবাকে একটুও ভয় পাই না আমি, উল্টে বাবা আমার কেমন কথা শোনে দেখলি তো?
অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে খুব ভিড়। দিদির মতোই সব খদ্দের, ক্যাচর ম্যাচর, কলর বলর – হরেনকাকুর দম ফেলার অবকাশ নেই। একটু দেরী হলেই দিদিদের অভিমান, ”আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি কাকু, আমাকে ছাড়া সব্বাইকে দিচ্ছ কিন্তু, আমি সেই থেকে দেখছি”।
হরেনকাকুর
চটজলদি উত্তর, ”তোমারটাই যে দিচ্ছি, মা”।
“বারে, আমি কখন বললাম আমার কি কি চাই”?
“বল না, মা বল। আমি শুনছি – সব শুনছি”। হরেনকাকুর হাত থেমে নেই, অবিরত বাকসো ভরে চলেছে ছোট্ট ছোট্ট দিদিদের ফরমাস অনুযায়ী।
দিদি
বীরদর্পে মিষ্টি কিনে ঘরে ফিরে স্যান্ডালটা পা থেকে এলোমেলো ছেড়ে রাখলো বসার ঘরে।
অন্য দিন হলে মেসোমশাই বকাবকি করতেন – আজ নয়। আজ অন্য দিদি। আজ ভাইফোঁটা।
আমার স্নান সারা, হাফ প্যান্ট আর প্যান্টের ভেতর গুঁজে পড়া রঙীন জামা – জামাটা দিদির পছন্দ করে কেনা (আমারও ভীষণ পছন্দ – কিন্তু দিদিকে বলিনি - বরং দিদিকে মুখ বেঁকিয়ে জানিয়েছি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি রংটা) মাসিমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে। তেল চুকচুকে নিখুঁত আঁচড়ানো পাট পাট চুল। মাসিমা আমার চিবুক আর গাল চেপে আঁচড়ে দিয়েছেন নিজের হাতে। মাসিমার শাড়িতে গোবিন্দভোগ চালের গন্ধ, পায়েস রান্না হয়ে গেছে।
চটের ওপর রঙীন সুতোয় বোনা আসন। লাল ব্যাকগ্রাউন্ড। তার মধ্যে সবুজ রঙের মুখোমুখি বসা শুক-সারী পাখি। ওপরের দিকে হলুদে লেখা ”সংসার সুখের হয়” আর একদম নীচে ”রমণীর গুণে” আকাশী রঙে। এ আসনটি ছোটমাসিমার হাতে বোনা।
সেজেগুজে আসনে বসে আছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো। সামনে কাঁসার রেকাবি ভরা দিদির আনা মিষ্টি। পাশে পেতলের ছোট্ট পিলসুজ, তার ওপর তেল ভরা পেতলের প্রদীপ। তেলের মধ্যে ডুবে আছে দুটো সলতে – একটা লম্বালম্বি, অন্যটা আড়াআড়ি। লম্বালম্বি সলতের মুখটা ক্যান্টিলিভার বারান্দার মতো সামান্য ঝুলে আছে প্রদীপের বাইরে।
সব যোগাড় সারা। মাসিমা দিদিকে তাড়া লাগাচ্ছেন। আশে পাশের বাড়ি থেকে শাঁখ আর উলুধ্বনি এলেই মাসিমা দিদিকে চাপে ফেলছেন বারবার। মেসোমশাই চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছেন আর মিটি মিটি হাসছেন দিদির কান্ডকারখানা দেখে। মেসোমশাইয়ের চোখে প্রশ্রয় আর স্নেহের হাসি চিকমিক করছে।
দিদি এলো। খোলা চুল। কোমরে শাড়ির আঁচল শক্ত করে গোঁজা। হাতে পেতলের রেকাবিতে সুন্দর করে সাজানো দুর্বা, ধান, চন্দন, চুয়া, পানসুপুরি, এক ছড়া কলা।
হাঁটু গেড়ে দিদি বসল সামনে। প্রদীপ জ্বালতে দুটো কাঠি নিভে
গেল। তিনটে কাঠি ভেঙে গেল বাকসে ঠুকতে গিয়ে। পরেরটায় জ্বলে উঠল প্রদীপ। কাঁপা
কাঁপা ছোট্ট শিখা। চারটে ধুপ জ্বালিয়ে নিল প্রদীপের শিখা থেকে। বারবার হাতের
ঝাপটা দিয়েও দিদি নেভাতে পারছিল না ধুপগুলো...
“ফুঁ দে না দিদি,
নিভে
যাবে”।
“এ মা, তুই কি বোকা রে?
ফুঁ
দিয়ে ধুপ নেভাতে নেই, এটাও জানিস না? ওতে ধুপ এঁটো হয়ে যায়”।
দিদির
হাতের ঝাপটাতেই হোক অথবা আমার চূড়ান্ত অজ্ঞতার জন্যেই হোক ধুপগুলো নিভে গিয়ে
জ্বলতে শুরু করল ধুপের মতোই। চারটে ধোঁয়ার মোটা এলোমেলো ভাঙাচোরা রেখা হয়ে।
মাসিমা এসে বসলেন দিদির ঠিক পাশে, হাতে শাঁখ। দিদি ধান আর দুব্বো নিয়ে রাখলো আমার মাথায় – দিদির আশীর্বাদ! বারবার তিনবার। দিদি ঠোঁটদুটো জড়ো করে জিভের সিম্পল হারমনিক মোশনে উলু দিচ্ছিল প্রত্যেকবার। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল মাসিমার শাঁখের আওয়াজ। যে শঙ্খটা রোজ সন্ধ্যেবেলা বাজে সংক্ষিপ্ত দ্রুত লয়ে – আজ সকালে সেটাই বাজল দীর্ঘ বিলম্বিতে। আজ অন্য এক দিন – আজ ভাই ফোঁটা।
আশীর্বাদের পর্ব শেষে এবার ফোঁটা। অনামিকায় চন্দন আর চুয়া
নিয়ে দিদি তিনবার টিপ লাগিয়ে দিল আমার কপালে – সঙ্গে সেই অমোঘ ছড়া – “ভাইয়ের
কপালে দিলাম ফোঁটা...”। টিপ পড়ানোর সময় দিদির অন্য আঙুলগুলি স্পর্শ করছিল আমার
চোখ আর নাকে।
“দিদিকে প্রণাম কর”, মাসিমা বললেন।
শুনেই
দিদি দেখি চট করে বসে পড়ল পায়ের পাতা দুটো মেলে। আমার দ্বিধা দেখে মাসিমা আবার
বললেন, ”কি রে, প্রণাম কর। দিদি বড় হয় না”?
সেরেই
ফেললাম প্রণামটা। ছোট্ট ছোট্ট চিমটি কেটে দিদির দুই পায়ের পাতায়।
“মা দেখলে, কেমন চিমটি কেটে দিল”- চেঁচিয়ে উঠলেও দিদি কিন্তু খুব
খুশি। তার মনে তখন জীবনে প্রথম প্রণাম পাওয়ার আনন্দ শিহরণ। আনন্দে আমার চিবুক ধরে
চুমো খেয়ে দিদির শান্তি হলো না, আমার গালেও একটা চুমো
খেয়ে বসল।
মেসোমশাই সব দেখছিলেন চেয়ারে বসে। বিশাল শব্দে হেসে উঠলেন, ”হা, হা, হা, হা, ঠিক হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে”।
কী ঠিক হয়েছে? কোনটা খুব ভাল হয়েছে বুঝতে পারিনি সেদিন। আজও কি বুঝেছি, সবটা?
সাবান-ক্রিম-ফোম, এক-দুই-তিন ব্লেডে নিত্য শেভ করলেও, কোনভাবেই তোর সেই চুমোটা আজও মুছে যেতে দিইনি, রে দিদি। আজকের অবসর জীবনেও, গাল ভরা অনেকটা পাকা কিছুটা কাঁচা দাড়ির আড়ালে ঠিকঠাক আছে সেদিনের সেই চুমোটা – আমার অনুভবে। পৃথুলা, হাঁটুর ব্যাথায় কাতর তুই থাকিস এখন এক প্রান্তে – আমিও বহু দূরের অন্য প্রান্তে।
কিন্তু আবার যদি সুযোগ পেতাম তোর সেই ছোট্ট ছোট্ট দুই চঞ্চল পায়ের পাতা পরশ করার – নো চিমটি, আই প্রমিস, জাস্ট একটা প্রণাম করব...বিশ্বাস কর, দিদি।
-- ০০ --
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন