[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে,
স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
[কৃতজ্ঞতাঃ পণ্ডিতেরা বলেন, বাইবেলের পরে সব থেকে যে প্রাচীন গ্রন্থটি পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, সেই গ্রন্থের নাম “পঞ্চতন্ত্র”। পঞ্চতন্ত্রের রচয়িতা পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের মহিলারোপ্য নামক কোন এক রাজ্যের রাজা অমরশক্তির তিন মূর্খ পুত্রকে মাত্র ছয়মাসে নীতিশাস্ত্রের পণ্ডিত করে তোলার ব্রত নিয়ে পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা, এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন়। প্রধানতঃ জঙ্গলের পশুপাখিদের নিয়ে সেই সব নীতিশিক্ষার গল্পগুলির একটি নিয়েই এই নাট্যরূপ।]
প্রথম
দৃশ্য
[সামনে বেশ চওড়া এক নদী। এপাড়ে বেশ কিছু গাছপালা। সেখানে জামগাছের
ডালে বসে একটি বাঁদর জাম খাচ্ছে, তার কপিকান্ত ।]
বাঁদরঃ হেউ...হেএএউ.. নাঃ, আর পারা যাচ্ছে না, পেট
ফুলে জয়ঢাক হয়ে গেল! এরপর আরও খেলে পেটটাই হয়তো ফেটে যাবে ফটাস করে! না, আর খাবো
না। এবার নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে একটু বসি আরাম করে। (গাছ থেকে নেমে নদীর ধারে গিয়ে
হাত-মুখ ধুল, তারপর পাড়ে বসে, ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে মহানন্দে গান ধরলো....)
গাছে গাছে নেচে বেড়াই এই ডালে ওই ডালে।
পাকা পাকা ফলগুলি ভাই, টপ করে নিই গালে।।
বগলদুটি চুলকোই খুব, আরো চুলকোই ভুঁড়ি।
বাঁদরামিতে এই দুনিয়ায় নেই গো মোদের জুড়ি... [ হঠাৎ গান
থামিয়ে..]
আরেঃ, ওটা আবার কী রে বাবা, নদীর
জলে ভেসে আসছে, মস্ত গাছের গুঁড়ির মতো! উঁহুঃ, ভালো ঠেকছে না। গাছে উঠে পড়ে, আড়াল থেকে ঘাপটি মেরে দেখি,
ব্যাপারটা কী?
[বাঁদর তরতরিয়ে গাছে উঠতেই, হাপুস
হুপুস শব্দ করে পাড়ে উঠল একটা কুমীর। বিশাল হাঁই তুলে বলল]
কুমীরঃ ওফ সেই থেকে সাঁতার কাটতে কাটতে, গায়ে শ্যাওলা পড়ে গেল! মাছেরা
সারা দিন রাত জলের মধ্যে কী করে থাকে কে জানে! আমার তো আধ ঘন্টা থাকলেই হাঁফ ধরে
যায়। পাড়ে উঠে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে চুপ করে একটু শুয়ে থাকলে ধড়ে প্রাণ আসে। ঘন্টা
খানেক ঘুমিয়ে নিই, তারপর ফেরার পথে বউ আর ছেলেমেয়েদের জন্যে মাছ ধরে নিয়ে যাবো। এ
তল্লাটে নদীর মাছ ছাড়া আর কিছু পাওয়াও যায় না ছাতা। দু একটা জন্তুজানোয়ার পেলে
মাঝে মাঝে একটু মুখ বদল হতে পারতো। এমন ওঁচা জঙ্গল এর আগে কোনোদিন দেখিনি বাপু!
[জঙ্গলের নিন্দে শুনে বাঁদর বেজায়
রেগে গেল, উত্তেজিত হয়ে বলল, ]
বাঁদরঃ অ্যাইও, কে হে আপনি, হঠাৎ এসেই জঙ্গলের নিন্দে শুরু
করে দিয়েছেন?
[থতমত খেয়ে কুমীর চারদিকে তাকাল, কাউকে
দেখতে না পেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,]
কুমীরঃ কে ভাই? আপনি কোথায় ভাই? কিছু ভুল বলে ফেললাম
কী, ভাই?
বাঁদরঃ আপনি বেশ নড়েভোলা তো! চারদিকে তাকালেন, আর ওপরেই
তাকালেন না? এই যে এদিকে, এখানে, গাছের ওপর। [কুমীর ওপরের দিকে তাকিয়ে, বাঁদরকে
দেখতে পেল, বলল]
কুমীরঃ অ, আপনি গাছের মগডালে উঠে বসে আছেন, আপনি উট
নাকি?
বাঁদরঃ আপনি বেশ গোলমেলে জীব তো মশাই, গাছে উঠলেই বুঝি
সব উট হয়ে যায়! উট থাকে মরুভূমিতে, যেখানে জল পাওয়া যায় না।
কুমীরঃ তাই বুঝি? আমি তো কোনোদিন মরুভূমিতে যাই নি, তাই
চিনি না। আমি কুমীর, আমি জলেও থাকি আবার ডাঙাতেও থাকি। মানে উভচর, আর কি, হে হে
হে।
বাঁদরঃ আমি কপি। আমাদের আরো অনেক নাম আছে, যেমন, বানর,
শাখামৃগ। মানুষরা আমাদের বাঁদরও বলে। শুনেছি তারা নিজের ছেলেমেয়েদের আদর দিয়ে দিয়ে
বাঁদর বানায়। আমরা গাছেও থাকি, আবার মাটিতেও হাঁটাচলা, লাফালাফি করতে পারি। কিন্তু
আমাদের কেউ উভচর বলে না।
কুমীরঃ বলে না বুঝি?
বাঁদরঃ না না, বলে না। স্যরি, একটা কথা মনে পড়লো, তাই
বলছি, আপনারা সরীসৃপ না?
কুমীরঃ ঠিক ঠিক, আমরা সরীসৃপই তো! আমরা যে বুকে হাঁটি। কিন্তু
এতে স্যরি হবার কী আছে?
বাঁদরঃ একে উভচর, তাতে আবার সরীসৃপ, এর পরেও স্যরি না
হলে, আর কিসে হবেন? যাগ্গে, ওকথা থাক। তা আপনাদের খাবার দাবারের কী ব্যবস্থা?
কুমীরঃ আমাদের আবার খাবারের অভাব? জলে মাছ ধরে খাই।
ডাঙায় গরু, ছাগল, কুকুর, হরিণ যখন যা জোটে খাই। সুযোগ পেলে মানুষও খাই। তবে এ
জঙ্গলে তেমন কিছুই মেলে না, সেই জন্যেই বলছিলাম, বাজে জঙ্গল।
বাঁদরঃ বাজে বললেই শুনবো? এমন সুন্দর জায়গা ভূভারতে আর
কেউ দেখেছে? দেখেনি। আমি বলছি কেউ দেখেনি। সামনেই এমন তিরতিরে নদী। নদীর ধারে এমন
জমকালো জঙ্গল। আর সেই জঙ্গলে ফল ভরা এমন গাছ, পাবে কেউ? গরমকালে আম জাম লিচু। সারা
বছরভর কলাটা, পেয়ারাটা- কত ফল খাবে খাও না। আর সে ফলে ভাগ বসাতে, দুচারটে পাখি
ছাড়া, আর কেউই নেই এ জঙ্গলে!
কুমীরঃ [খুব অবাক হয়ে] ফল খাবো? গাছের? আমরা?
বাঁদরঃ উঠলে তো নদীর জল থেকে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন
আকাশ থেকে পড়লে! কোনোদিন খেয়েছো? খেয়ে দেখেছো?
কুমীরঃ না তা খাইনি।
বাঁদরঃ তবে? সর্বদা মাংস খাবার জন্যে হাঁকপাক না করে,
মাঝে মাঝে ফল-টল খেয়েও দেখো না!
কুমীরঃ না মানে, ইয়ে ফল খাবার কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি
কোনদিন। বলি পেট-ফেট খারাপ হবে না তো?
বাঁদরঃ হে হে, খুব অবাক করলে যা হোক। পাকা ফল খেয়ে কারো
পেট খারাপ হয়েছে, এমন শুনিনি ভাই।
কুমীরঃ [লেজ দিয়ে পিঠ চুলকে] আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখবো
না হয়।
বাঁদরঃ আরে ধুর চেষ্টা করবে কী? গোটা কয়েক ফল দিচ্ছি, এখনই
খেয়ে দেখো দেখি! হাঁ করো, হাঁ করো...ও বাবা, অত্তো বড়ো হাঁ! ঠিক আছে এই নাও।
[বাঁদর বেশ কটা পাকা জাম ছুঁড়ে দিল কুমীরের মুখে, কুমীর চিবোতে লাগল] কি, কেমন?
কুমীরঃ বাঃ, সত্যিই দারুণ তো! কী মিষ্টি! আরও আছে নাকি?
আমাকে আরো কটা দাও দেখি, বাড়ির জন্যেও কটা নিয়ে যাবো! বউ ছেলেমেয়েরাও এ জিনিষ পেলে
অবাক হয়ে যাবে! কোনোদিন খায়নি তো! কী নাম বলো তো এগুলোর?
বাঁদরঃ হে হে, এ হল জাম। এ তো কিছুই না, এর থেকেও কতো
ভালো ভালো ফল আছে! সে সব খেলে তো আর মাছ-মাংসের ধার ঘেঁষবে না! আচ্ছা সে হবে খন,
আমার সঙ্গে কদিন কাটাও, তোমাকে আরো অনেক ফল খাওয়াবো। আজ এই জামগুলো নিয়ে গিয়ে
বাড়িতে সকলকে খাওয়ায়, কাল এসে বলবে, বাড়িতে কে কী বলল!
[বাঁদর গাছের ডালপালা ঝাঁকিয়ে
অনেক জাম ফেলল মাটিতে, কুমীর সেগুলো কুড়িয়ে নিল চটপট।]
কুমীরঃ তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল, বাঁদর ভাই।
অনেক কিছু জানা হল, শেখা হল। কাল এরকম সময়েই আবার আসবো।
বাঁদরঃ আচ্ছা। কুমীরভাই। কাল আসবে কিন্তু আবার। আজ তো
তেমন কোন কথাই হল না। কাল অনেক গল্প হবে, কেমন? কাল সকালে আরো নতুন কিছু ফল তোমার
জন্যে যোগাড় করে রাখবো।
কুমীরঃ একটা কথা তোমাকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু
কী জানি তুমি কী ভাববে, সেই ভেবে বলতে ভরসা পাচ্ছি না।
বাঁদরঃ কী কথা বলো তো?
কুমীরঃ আমার তো কোনো বন্ধু নেই! তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব
হলে বেশ হতো!
বাঁদরঃ হা হা হা হা। আমরা তো বন্ধু হয়েই গেছি! তা, এ কথাটা
বলতে এতো কিন্তু কিন্তু করছো কেন, বন্ধু?
কুমীরঃ না অনেকে বলে, সমান সমান না হলে বন্ধুত্ব হয় না।
তাই একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম।
বাঁদরঃ সমান সমান বলতে?
কুমীরঃ মানে এই যেমন ধরো আমি সরীসৃপ আর তুমি
স্তন্যপায়ী। তারপর যেমন ধরো, আমার তুলনায় তোমার চেহারা অনেক ছোট্ট। তুমি ফলটল খাও,
আর আমরা মাংস খাই। আমাদের গায়ের জোরও তোমার তুলনায় অনেক অনেক বেশি...
বাঁদরঃ বুঝেছি বুঝেছি, আর বলতে হবে না। ওই সব কথা
পণ্ডিতেরা বলে। ওদের সব কথায় কান দিতে আছে, নাকি? সব কিছু সমান যদি নাও হয়, তবু
মনের মিল বলে একটা ব্যাপার আছে, বলি সেটা মানবে তো?
কুমীরঃ সে কথা তো একশ বার।
বাঁদরঃ ব্যস্, ব্যস্, ওটুকুই যথেষ্ট। মনের মিল যখন
হয়েছে, তখন আমরা বন্ধু।
কুমীরঃ বড়ো আনন্দ পেলাম, বন্ধু। আজকে বাড়ি গিয়ে বলবো,
এতদিনে আমি একজন বন্ধু পেয়েছি। আজ তবে আসি বন্ধু?
বাঁদরঃ এসো বন্ধু, এসো। কাল আসবে কিন্তু। বেশ জমিয়ে
গল্প করা যাবে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
[কুমীরের বাসা। কুমীর আর তার
ছানাপোনারা কচর মচর করে ফল খাচ্ছে। কুমীরের বউ চোখকুঁচকে দেখতে দেখতে বলল- ]
কুমীরীঃ পরশু আবার যেন হুট করে কোথাও বেরিয়ে পড়ো না।
কুমীরঃ কেন? পরশু কী আছে?
কুমীরীঃ পরশু ছেলেমেয়ের স্কুল থেকে আমাদের দুজনকেই
ডেকেছে।
কুমীরঃ [ছানাপোনাদের ধমকে] কেন রে? কী করেছিস তোরা?
নিশ্চয়ই নিয়মিত হোম টাস্ক করিস না। নাকি পড়া পারিসনি? পড়াশুনোর নাম নেই, দিন রাত
কেবল খেলা আর খেলা। পিঠের চামড়া তুলে দিতে হয়!
কুমীরীঃ পুরোটা না শুনেই ছেলেমেয়েদের বকছো কেন? আমার
ছেলেমেয়েদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম হতে পারে, কিন্তু ফাঁকি দেয় না।
কুমীরঃ তাহলে স্কুল থেকে ডাকল কেন? তার মানে নিশ্চয়ই
কোন বদমায়েশি করেছে! দুষ্টুমি করে থাকলে, দুটোরই লেজ মুচড়ে দেব – এই বলে রাখলাম।
কুমীরীঃ ধ্যাত্তেরিকা, খালি পিঠের চামড়া তুলছে, নয় লেজ
মুলে দিচ্ছে! আর অন্য কোন কথা নেই মুখে? বেশ
কদিন ধরেই তোমার রকমসকম কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না। ছেলেমেয়েরাও দেখছি তোমার চোখের
বালি হয়ে উঠছে দিন দিন।
কুমীরঃ [ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আম খেতে খেতে] বাজে না বকে,
কী ব্যাপার হয়েছে খুলে বলবে নাকি?
কুমিরীঃ আগে বলো তো, আজকাল রোজই তোমার এই হাবিজাবি ফলপাকুড়
নিয়ে আসার মতি হচ্ছে কেন? তুমি কী আমার ছেলেমেয়েদের ছাগল-গরু বানিয়ে তুলতে চাইছো?
কুমীরঃ [ভারি অবাক হয়ে] তার মানে?
কুমীরীঃ তা নয়তো কি? কুমীরের বাচ্চারা, কবে কোথায় ওই সব
ছাইপাঁশ খেয়ে বড়ো হয়েছে, শুনি?
কুমীরঃ ছাইপাঁশ মানে? জানো, আমার বন্ধু বলেছে, এইসব ফল মানুষেরাও খায়। আম, জাম, কাঁঠাল, কলা এসব ছাইপাঁশ!
কী বলছো গো, গিন্নি?
কুমীরীঃ রাখো তোমার বন্ধু। ওই বন্ধুই তোমার মাথাটা
খেয়েছে। কুমীরের বন্ধু বাঁদর! এমন শুনেছে কেউ, নাকি দেখেছে? লজ্জায় মরি আর কি!
কুমীর সমাজে কেউ শুনলে, ছি ছি করবে। আমাদের সঙ্গে আর কেউ সম্পর্ক রাখবে? আমাদের এক
ঘরে করবে।
কুমীরঃ আহা, ব্যাপারটা বুঝছো না, গিন্নি! এতদিন আমাদের
কেউ কোন ফল পায়নি, তাই খায়নি।
কোন কুমীর কি কোনদিন গাছে চড়েছে, নাকি ফল পেড়ে খেয়েছে? কুমীর তো গাছে চড়তেই পারে
না! সে আবার ফল খাবে কী করে? আমার বন্ধু বাঁদর, গাছে চড়তে পারে। তার দৌলতেই আমরা
ফলের স্বাদ পেয়েছি। আমি বলি কী – আমাদের পাড়ার সবাইকে একদিন নেমন্তন্ন করো,
সক্কলকে ফল খাওয়াই!
কুমীরীঃ বোঝো নেমন্তন্ন করে কী করবে শুনি? তোমার
ছেলেমেয়ের পেটে কোন কথা থাকে? স্কুলে গিয়ে তারা বন্ধুদের গিয়ে গল্প করেছে। ওদের
ক্লাসের বন্ধুরা আবার তাদের বাবা-মাকে গিয়ে বলেছে, “ও বাবা, ফল খাবো, ফল এনে দাও!
ও মা, বাবাকে বলো না অনেক অনেক ফল আনতে”। ছেলেমেয়েদের
নাকে কান্না শুনে তাদের বাবা-মায়েরা কমপ্লেন করেছেন স্কুলের হেড দিদিমণির কাছে...
কুমীরঃ হা হা হা হা, এ হচ্ছে হিংসে, গিন্নি, হিংসে! তুমি
কিচ্ছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কুমীরীঃ ঘোড়ার ডিম ঠিক হবে! অলরেডি ক্লাসের
বন্ধুবান্ধবেরা ওদের সঙ্গে কথা বলে না। ওদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসে না। তাদের
গার্জেনরা একসঙ্গে হেডদিদিমণিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের যদি স্কুল
থেকে বের করে না দেওয়া হয়, তারাই নিজেদের ছেলেমেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দেবে!
কুমীরঃ তার মানে? আমাদের ছেলেমেয়ে পড়াশুনো করে, অসভ্য
নয়, দুষ্টু নয়, তাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, তারা ফল খায় বলে? এ কি মগের মুল্লুক
নাকি? আমরা আমাদের মতো যা খুশি খেতে পারবো না? আমরা কী খাব না খাব, সেটা আর পাঁচ
জনে ঠিক করে দেবে? আর স্কুলও সেটা মেনে নেবে? দেখে নিও, স্কুল নিশ্চয়ই এই অন্যায়
আবদার মানবে না!
কুমীরীঃ ওই ভরসায় থাকলেই হয়েছে আর কী! অলরেডি স্কুল ঠিক
করে ফেলেছে আমাদের ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে দেবে! পরশু হেডদিদিমণি আমাদের সেই কথাই
বলবেন, আর শেষ বারের মতো হয়তো দুচারদিন সময় দেবেন। আমরা যদি আর কোনোদিন ফল-টল খাবো
না বলে প্রমিস করি, তাহলে স্কুল ওদের পড়তে দেবে।
কুমীরঃ এ তো অত্যাচার। কুমীরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এ
চলতে পারে না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
কুমীরীঃ ভালো, তুমি প্রতিবাদ করো। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা
মুখ্যু হয়ে বড়ো হোক। অন্য কুমীরের ছানারা স্কুল থেকে পাস করে, বড়ো বড়ো হরিণ, গরু,
ছাগল, মানুষ-টানুষ শিকার করার নানান ফন্দি ফিকির শিখে, দুবেলা ভরপেট মাংস খাবে! আর
আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে, আর কেঁদে কেঁদে ভিক্ষে করবে, “দুপিস
মাংস হবেএএএ..”! দুএকজন হয়তো দয়া করে একটা কান বা দুটো ক্ষুর ছুঁড়ে দেবে, ওদের
দিকে!
কুমীরঃ কী ভয়ানক কথা বলছো, গিন্নি! আমার তো চোখে জল চলে
আসছে!
কুমীরীঃ যাক এতদিন মানুষরা “কুমীরের কান্না”, “কুমীরের
চোখে জল” বলে, যে সব ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, তোমার চোখের জল দেখে, সে সব বন্ধ হয়ে
যাবে!
কুমীরঃ এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী, গিন্নি?
কুমীরীঃ খুব সহজ। ওই কুচুটে বাঁদরটাকে মেরে ফেললেই সব
ল্যাঠা চুকে যাবে। বরং কুমীরেরা তোমাকে ধন্য ধন্য করবে!
কুমীরঃ ধন্য ধন্য করবে? কী বলছো, গিন্নি?
কুমীরীঃ ঠিকই বলছি। এখন পর্যন্ত কুমীরের দল, অনেক জন্তু
জানোয়ারের স্বাদ পেলেও, বাঁদরের স্বাদ খুব একটা পায়নি মনে হয়। একে তারা গাছে থাকে,
আর খুব সেয়ানা হয়, তাদের ধরা কুমীরের পক্ষে বেশ শক্ত!
কুমীরঃ তাতে কী?
কুমীরীঃ
[মুচকি হেসে] তাতেই আমাদের কপাল খুলে যাবে!
ধরো বাঁদরটাকে তুমি মেরে আনলে, তারপর বাঁদরের মাংসের টুকরো আমরা পাড়ার মাতব্বর
কিছু কুমীরকে, স্কুলের হেড দিদিমণির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।
কুমীরঃ তাতে লাভ কী হবে?
কুমীরীঃ বুঝলে না? পাড়ার লোক বুঝবে, বাঁদরটাকে ধরার
জন্যেই তুমি এতদিন, বন্ধু সেজে, ওই সব ছাই-পাঁশ ফল-টল খাচ্ছিলে! লোকে তোমার
বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে, দেখে নিও।
কুমীরঃ যা বললে সেটা হয়তো ঠিকই বললে! কিন্তু আমি সত্যিই
বাঁদরকে বন্ধু বলে মনে করি। আমি বাঁদরকে কোনমতেই মারতে পারবো না।
কুমীরীঃ সে আমি জানি, তুমি শুধু তাকে এখানে নিয়ে এসো,
তোমাকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। তারপর যা করার আমিই করবো।
কুমীরঃ কিন্তু, বন্ধু হয়ে বন্ধুর সঙ্গে এমন শয়তানী করা
উচিৎ হচ্ছে না, গিন্নি!
কুমীরীঃ তুমি তো কিছু করছো না গো, তুমি শুধু নেমন্তন্ন
করে ডেকে আনবে।
কুমীরঃ নেমন্তন্ন করলেই চলে আসবে! প্রথম কথা সে সাঁতার
জানে না। তার ওপর আমরা যে মাংস ছাড়া কিছুই খাই না, সেও সে জানে! আমরা তাকে
নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো কী? নেমন্তন্ন করলেই সন্দেহ করবে।
কুমীরীঃ ধুর বাবা, তুমি বড্ডো বোকা। নেমন্তন্ন মানে বলবে,
“আমাদের ও পাড়েও অনেক গাছপালা আছে, তাতে অনেক রকম ফলও ফলে। আমরা তো ফল চিনি না, আর
ফল পাড়তেও পারি না। বন্ধু, তুমি যদি আমাদের ওখানে গিয়ে ফলগুলো চিনিয়ে দাও, আর কিছু
পেড়ে দাও, তাহলে খুব উপকার হয়। আমাদের ওখানে সারাদিন থেকে, তুমিও যতো খুশি ফল
খাবে, তারপর বিকেল হলে তুমি এপাড়ে ফিরে আসবে”!
কুমীরঃ ওফ্ তুমি তো আমার প্রথম কথাটা শুনলেই না, ও আসবে
কী করে? ও তো সাঁতারই জানে না!
কুমীরীঃ ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় গো, উপায় হয়। বাঁদর এমন কী আর
বড়ো আর ভারি হয়? তুমি পিঠে চাপিয়ে নিয়ে চলে আসবে। নিয়ে আসতেই তোমার যা একটু কষ্ট
হবে। তারপর আমরা তো সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েই নেব। পিঠের ভার, পেটে এলে, দেখবে মন্দ
লাগবে, না গো!
কুমীরঃ হুঁ, যে ফন্দি তুমি বের করেছো, তাতে আমার বন্ধু,
বাঁদর বিশ্বাস করে নেবে এবং সত্যিই চলে আসবে।
কুমীরীঃ আসবে গো আসবে। নিশ্চয়ই আসবে দেখে নিও। ওফ্, আমার
যা আনন্দ হচ্ছে না! সারা জীবন মিষ্টি মিষ্টি ফল খেয়ে তোমার বন্ধুর কলজেটার যা
স্বাদ হয়েছে, ভাবতেই আমার জিভে জল আসছে গো!
কুমীরঃ [খুব মনমরা মুখে] সেই তো মানলে, যে ফল খেতে
মিষ্টি আর মজাদার!
কুমীরীঃ বাজে কথা বকো না তো। তোমার ওই ফলের জন্যে
ছেলেমেয়েদের, আমাদের ভবিষ্যৎ-টবিষ্যৎ - সব জলাঞ্জলি দেবো নাকি? যা বললাম, তা যদি
না করেছো, তাহলে আমি কালই ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো। তখন থেকো তোমার
মিষ্টি ফল আর প্রাণের বন্ধুকে নিয়ে।
[দুমদুম
পা ফেলে, মুখ হাঁড়ি করে, কুমীরী বেরিয়ে গেল অন্য জলায়।]
কুমীরঃ [দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল] হায় বন্ধু,
আমাদের এই বন্ধুত্ব না হলেই ভালো হত। ছি ছি বন্ধু হয়ে বন্ধুকে কী বিপদেই ফেললাম!!
তৃতীয় দৃশ্য
[প্রথম
দৃশ্যের নদীর পাড়। পাড়ে বসে বাঁদর। নদী থেকে মাথা তুলল কুমীর।]
বাঁদরঃ গুডমর্নিং, কুমীরভাই। আজ একটু দেরি করে ফেললে,
আসতে!
কুমীরঃ হ্যাঁ, ঘরের কিছু কাজকর্ম সেরে আসতে, একটু দেরি
হল।
বাঁদরঃ খুব কাজের চাপ, নাকি বন্ধু? মুখটাও কেমন ভার ভার
দেখছি!
কুমীরঃ মুখভার? না না মুখভার হবে কেন? এই তো হাসছি। আজ
আমাদের ওখানে তোমার নেমন্তন্ন, আমার সঙ্গে তোমাকে একবার যেতেই হবে বন্ধু।
বাঁদরঃ ওয়াও, অনেকদিন নেমন্তন্ন খাইনি! কিসের
নেমন্তন্ন, ভাই? বিবাহ-বার্ষিকী নাকি ছেলেমেয়ের জন্মদিন? তা কী কী খাওয়াবে গো,
বন্ধু?
কুমীরঃ আমরা তো মাংস খাই, সে তো তুমি খাবে না, বন্ধু।
তাই আমার বউ বলল, আমরা যে জলা জঙ্গলে থাকি সেখানেও তো অনেক ফল-ফুলুরির গাছ আছে। সে
সব ফলের কোনটা খাদ্য কোনটা অখাদ্য, সেও তো আমরা জানি না। তুমি একবার গিয়ে আমাদের
চিনিয়ে দেবে, আর ওই সঙ্গে তুমি নতুন নতুন ফলও খেয়ে আসতে পারবে পেট ভরে।
বাঁদরঃ কথাটা মন্দ বলোনি, কিন্তু যাবো কী করে? আমি তো
সাঁতারই জানি না।
কুমীরঃ ধুর বাবা, আমি থাকতে ও নিয়ে তুমি ভাবছো কেন? আমার
পিঠে চেপে পড়বে, নৌকোর মতো ভেসে ভেসে, হাওয়া খেতে খেতে দিব্যি আরামে যাবে আর আসবে।
বাঁদরঃ হে হে এত করে যখন বলছো, তখন তো যেতেই হয়। কিন্তু
আজ তো অনেক দেরী হয়ে গেল, আজ কী আর হবে, বরং কাল একটু সকাল সকাল চলে এসো, কাল
বেরিয়ে পড়বো দুই বন্ধুতে।
কুমীরঃ না না বন্ধু, আজই যেতে হবে, আমার বউ আরো অনেককে
বলে রেখেছে, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে - তারা সব এসে বসে থাকবে যে!
বাঁদরঃ [জনান্তিকে] হঠাৎ হুটোপাটি করে কিসের নেমন্তন্ন কে
জানে? গতিক সুবিধের ঠেকছে না। কিন্তু যেভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছে, না করাও বেশ মুশকিল।
কুমীরঃ কী এতো ভাবছো, বলো তো, বন্ধু? একেবারে চুপ মেরে
গেলে যে? বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বাড়ি যেতেও তোমার এত ভাবনা?
বাঁদরঃ না না, ভাবনা আর কিসের? চলো তবে যাওয়া যাক।
[পাড়
থেকে নেমে, বাঁদর কুমীরের পিঠে উঠে বসতেই, কুমীর জলে নামল। প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় লাগলেও পরে বেশ মজাই
লাগল বাঁদরের!]
কুমীরঃ কেমন লাগছে, বন্ধু? ভয় লাগছে না তো? হাত পা
ছড়িয়ে আরাম করে বসো, বন্ধু। আমার পিঠটা তেমন ছোট তো নয়।
বাঁদরঃ না, না বন্ধু, তোমার মতো বন্ধু থাকতে আবার ভয়
কীসের? আর সত্যিই, নদীর মাঝখান থেকে দুই পাড় যে এত সুন্দর দেখায়, তোমার সঙ্গে না
এলে জানতেই পারতাম না!
কুমীরঃ তবে? আমার সঙ্গে এসে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হল বলো?
বাঁদরঃ তা হলো। কিন্তু আজকে আমার কিসের জন্যে নেমন্তন্ন
সেটা বললে না তো, বন্ধু?
কুমীরঃ কিসের নেমন্তন্ন? বন্ধুর বাড়ি বন্ধু যাচ্ছে,
তাতে আবার কারণ দরকার হয় নাকি?
বাঁদরঃ
সে কথা একশ বার। কিন্তু তুমি বললে না, আজকে
আমার নেমন্তন্ন! কিসের নেমন্তন্ন সেটা জানলে একটু সুবিধে হতো!
কুমীরঃ কিসের সুবিধে?
বাঁদরঃ বাঃরে, প্রথম দিন তোমার বাড়ি যাচ্ছি নেমন্তন্ন
খেতে, খালি হাতে যাওয়া ভাল দেখায় না, বন্ধু।
কুমীরঃ খালি হাতে মানে?
বাঁদরঃ
মানে কোন উপহার-টুপহার নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল
আর কী! ধরো ছেলে-মেয়ের জন্মদিন হলে, একটা দুটো চকোলেট। অথবা বিবাহ-বার্ষিকী হলে
বৌদির জন্যে এক গোছা ফুল...
কুমীরঃ
ভুল করছো, বন্ধু, মস্তো বড়ো ভুল। সত্যি
কথাটা তাহলে তোমাকে বলেই ফেলি। তোমাকে মিথ্যে বলতে আমার ভালোও লাগছে না!
বাঁদরঃ
মিথ্যে কথা? কী মিথ্যে কথা, বন্ধু? [ভয়ে
বুক কেঁপে উঠল বাঁদরের]
কুমীরঃ
নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন কিচ্ছু না। তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছি...
বাঁদরঃ নেমন্তন্ন নয়? তাহলে কী?
কুমীরঃ
আমার বউ তোমার দেওয়া মিষ্টি ফল খেয়ে খুব
খুশী হয়েছে। তার ধারণা, সারাজীবন এমন মিষ্টি মিষ্টি ফল খেয়ে তুমিও নিশ্চয়ই মিষ্টি
হয়ে উঠেছো!
বাঁদরঃ আমি মিষ্টি হয়ে উঠেছি? যাঃ, কোনদিন টের পাইনি
তো!
কুমীরঃ তুমি না পেলে কী হবে? আমার বউ টের পেয়েছে! তার
খুব ইচ্ছে আজ তোমার কলজে খাবে...
বাঁদরঃ কী খাবে? [বাঁদরের মাথা ঘুরতে লাগল, কোন রকমে
বলল।]
কুমীরঃ কলজে, কলজে...মানে হৃৎপিণ্ড!
[ভয়ে
বাঁদরের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। কী সর্বনাশ। এখন কী উপায়? মাঝনদীতে সে বসে
আছে মস্তো এক কুমীরের পিঠে, সেখান থেকে পালাবার কোন উপায় নেই! জলে ঝাঁপ দিলেও
কুমীর অনায়াসে ঝপ করে কামড়ে ধরবে! কী করা যায়, ভাবতে লাগল, বাঁদর। এদিকে অনেকক্ষণ
সাড়া না পেয়ে কুমীর বলল,]
কুমীরঃ কী হল? চুপ করে গেলে যে? কিছু বলছো না তো! ভয়
পেলে নাকি? ভয় কী? আর মিনিট পাঁচেক গেলেই আমার বাসা, সেখানে গেলেই আমার বৌ তোমার
গলাটা টিপে দেবে...ব্যস্, ভয়-ভরসা সব মিটে যাবে, বন্ধু।
বাঁদরঃ হো হো হো হো [হাসতে হাসতে
বাঁদর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল কুমীরের পিঠে] হো হো হো হো...
কুমীরঃ [অবাক হয়ে] পাগল হয়ে গেলে
নাকি? বন্ধু, এত হাসছো কেন?
বাঁদরঃ হো হো হো হো ...
কুমীরঃ কী বিপদ, কেন হাসছো বলবে তো?
বাঁদরঃ এ কথাটা তুমি আমাকে আগে বলতে
পারলে না? হা হা হা হা হা, হাসবো না তো কী?
কুমীরঃ কোন কথাটা?
বাঁদরঃ হো হো হো হো ...ওই ওই ...
আমার কলজের কথাটা।
কুমীরঃ কেন...কী হতো বললে?
বাঁদরঃ কী হতো? তুমি যে এতটা মুখ্যু
আমি বুঝতেই পারিনি, বন্ধু। বাঁদরেরা বুঝি সর্বদা কলজে নিয়ে ঘোরে?
কুমীরঃ তার মানে?
বাঁদরঃ বলি বাঁদরের কলজে কটা হয়?
কুমীরঃ একটাই তো হয়!
বাঁদরঃ তবে? আমরা যে গাছের এডালে
ওডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াই, যদি হাত ফস্কে পড়ে যাই?
কুমীরঃ হাত - পা ভাঙবে, সে আর
আশ্চর্য কী?
বাঁদরঃ আজ্ঞে না, স্যার, হাত-পা ভাঙলে সেরে যায়, তার
জন্যে আমরা চিন্তা করি না। চিন্তা করি কলজের জন্যে। পড়ে গিয়ে কলজেটা ফাটলেই – শেষ,
অক্কা।
কুমীরঃ তাহলে?
বাঁদরঃ
তাহলে? কলজেটা খুলে গাছের কোটরে আমাদের
বাসায় রেখে দিই। তারপর গাছে গাছে লাফালাফি করি।
কুমীরঃ তারপর?
বাঁদরঃ তারপর আবার কী? সন্ধেয় ঘরে ফিরে কলজে বুকে নিয়ে
ঘুমিয়ে পড়ি। রাত্রিবেলা ছাড়া কলজের দরকারই বা কী?
কুমীরঃ তাই? তার মানে, তোমার কাছে এখন কলজে নেই?
বাঁদরঃ হা হা হা হা, সেই থেকে কী বলছি কী তোমায়? আর
হাসছিই বা কেন? তুমি যদি তখনই বলতে তোমার মিষ্টি বৌ আমার মিষ্টি কলজে খেতে চেয়েছে,
তখনই তোমায় দিয়ে দিতাম!
কুমীরঃ
তাই বুঝি? তাহলে এখন উপায়?
বাঁদরঃ উপায় আর কী? আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। নয়তো আমার
কলজেহীন ফাঁপা শরীরটা পেলে তোমার বউ খুব দুঃখ পাবে - হয়তো কেঁদেই ফেলবে, বেচারি!
কুমীরঃ কাঁদবে না, ছাই! গাল দিয়ে আমার ভূত তাড়াবে! না
হে, বন্ধু, চলো ফিরেই যাই।
বাঁদরঃ সেই ভালো। একটু দেরি হয়তো হবে, কিন্তু কলজেটা
পেয়ে যাবে!
[কুমীর
ঘুরে উল্টোমুখে সাঁতার দিতে লাগল।]
কুমীরঃ ভাগ্যে তোমায় সময় থাকতে
বলেছিলাম, বন্ধু, তা না হলে ঘরে আজ কী অশান্তিটাই না হতো!
বাঁদরঃ যাই বলো, আর তাই বলো, বন্ধু। তুমি কিন্তু আমাকে সত্যিকারের
বন্ধু বলে মনে করো না!
কুমীরঃ কেন কেন? এ কথা বলছো কেন?
বাঁদরঃ প্রথমেই আমায় যদি সব কথা খুলে
বলতে, তাহলে এই হয়রানি হতো, বলো?
কুমীরঃ সে কথা সত্যি! আমার খুব ভুল
হয়ে গেছে, বন্ধু!
বাঁদরঃ যাগ্গে, যা হবার হয়ে গেছে, এখন তাড়াতাড়ি চলো,
দেরি দেখে, ওদিকে তোমার বৌ আবার উতলা হয়ে উঠবে। [বাঁদরের কথায় কুমীর সাঁতারের গতি
বাড়ালো। নদীর পাড়ে তার গাছটাকে দূর থেকে দেখতে দেখতে বাঁদরের বুক মানে কলজে দ্রুত
ধুক ধুক করতে লাগল। পাড়ের কাছাকাছি এসে পড়ার পর, কুমীর জিগ্যেস করল,]
কুমীরঃ আচ্ছা, বাঁদর ভাই, কলজে ছাড়া কোন জীব বাঁচতে
পারে?
বাঁদরঃ
হা হা হা হা, কী যে বলো তার কোন মাথামুণ্ডু
বুঝি না। কলজে
ছাড়া যদি বাঁচা না যায় তো, আমি রয়েছি কী করে?
[নদীর
পাড় এসে যাওয়াতে, বাঁদর বিশাল লাফ দিয়ে কুমীরের পিঠ থেকে লাফ মারল পাড়ে, সেখান
থেকে তরতরিয়ে উঠে গেল গাছের মগডালে। আরাম করে গাছের মগডালে বসে লেজ দুলিয়ে বলল]
ওরে হতভাগা কুমীর, শুধু কলজে নয়, মগজ
ছাড়াও দিব্যি বেঁচে বর্তে থাকা যায়! তা নইলে তোদের মতো শয়তান কুমীরকে বিশ্বাস করে,
আমি তোর পিঠে চড়তে যাই? আর ভাগ্যে তুইও মগজ ছাড়াই জন্মেছিস, নইলে কী আর আমার কলজের
কথায় বিশ্বাস করে, ফিরে আসতিস? যাঁরা বলেন সমানে সমানে ছাড়া বন্ধু হয় না, তাঁরা
ঠিকই বলেন, তাঁরা সত্যিকারের পণ্ডিত! তাঁদের কথা না শুনলে, আমার মতোই বিপদে পড়তে
হয় রে, বজ্জাত কুমীর। যা, এবার কেটে পড়, কোনদিন যদি তোকে আর এপাড়ে দেখি, পাথর
ছুঁড়ে তোর মাথা ভাঙবো, এই বলে রাখলাম!
[কুমীর ডুব দিল জলে। পর্দানেমে এল।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন