রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

তখনও কলকাতাকে যেন ঠিক নিজের জায়গা বলে মনে হত না। কর্মসূত্রে বাবার কলকাতায় থাকাটা সুবিধেজনক। উপরন্তু কলকাতায় লেখাপড়া করার সুযোগসুবিধেও অনেক বেশী। সেই কারণেই যেন আমাদের কলকাতায় থাকা। সেই সময়ে বাবা ও মায়ের পরিকল্পনা ছিল বাবার রিটায়ারমেন্টের পর বর্ধমানেই আবার ফিরে যাবেনগ্রামের বাড়িতে নয়, তবে বর্ধমান শহরেসেই মতো বর্ধমান শহরের নীলপুরে বাবা একফালি বাস্তুজমিও কিনে ফেললেন, আর অবসর সময়ে বাবা ও মা সেই বাড়ির পরিকল্পনা করতে লাগলেন 

মায়ের গা ঘেঁষ্টে বসে আমি বহুদিন দিন শুনেছি মায়ের স্বপ্নসমূহ। কোনখানে তুলসীমঞ্চ বসবেবারান্দায় উঠতে সিঁড়ির দুপাশের দেওয়ালটা হবে ঘোরানো মত, লাল টুকটুকে সিমেন্ট দিয়ে মাজা হবে সেই দেয়াল। সিঁড়ি উঠতে ঘোরানো দেয়ালের মধ্যে মাটি দিয়ে দুপাশে বসানো হবে সাদা আর রক্ত গোলাপের ঝাড়। বাড়িটা হবে এল প্যাটার্নের। একতলায় থাকবে বৈঠকখানা, দুটো শোবার ঘর, রান্নাঘর আর সিঁড়ির ঘর, টানা বারন্দার ওপাশে একটু তফাতে বাথরুম টয়লেট। বাথরুমের সামনে সিমেণ্ট বাঁধানো চত্বরে বাসনমাজা, কাপড়কাচার জায়গা আর টিউবওয়েল। গ্লোব নার্শারি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে নারকেল গাছ, যে গাছে পাঁচবছরের মাথায় ফল ধরে। তারমধ্যে অন্ততঃ দুটো থাকবে সোনামুখী নারকেল। বুকউঁচু পাঁচিলের কোল ঘেঁষে থাকবে ফুলগাছের সারি- টগর, কামিনী, কাঞ্চন, জবা, রঙ্গন, চাঁপা, নয়নতারা। মায়ের নিত্যপুজোয় ফুলের অভাব থাকবে না। প্রাঙ্গণের ছোট্ট বেডে ফুটবে মরশুমী ফুল, বেলী, রজনীগন্ধা, দোপাটি, অথবা ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালেনডুলা।

ওই সময়েই বাবার অফিস কলিগরা অনেকে মিলে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডের অনতিদূরে একলপ্তে অনেকটা জমি কিনলেন। বাবাকেও বহুবার তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন, ওইখানে কিছুটা জমি নিতে, একসঙ্গে সকলে থাকলে সবদিকেই অনেক সুবিধে হয়। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। প্রথমতঃ আগেই বলেছি আমাদের কাছে কলকাতা তখনও ‘আমচি’ শহর হয়ে ওঠে নি। দ্বিতীয়তঃ যাদবপুরের ওই অঞ্চল তখনও ছিল নগর সুবিধের আওতার অনেকটাই বাইরে, অনুন্নত, সেখানে সন্ধের পর শৃগাল ও মশার চরম আধিপত্যতৃতীয়তঃ ওই অঞ্চলের প্রতিবেশি এবং বাবার কলিগদের সকলেই ছিলেন ওপার বাংলার লোক, অর্থাৎ বাঙাল। বাঙাল অধ্যুষিত অঞ্চলে একক ঘটির পক্ষে সারাজীবন বসবাস নাকি আদৌ সুখপ্রদ হতে পারে না। কাজেই যাদবপুরের পরিবর্তে বর্ধমানে ঘটি পরিবেষ্টিত বসবাসের স্বপ্নেই আমাদের দিন কাটতে লাগল।

আমার ক্লাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় সকলেই ছিল পুরাতনী বাঙাল, এমনকি আমরা যে শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বিশিষ্ট ঘটি পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম, সেখানেও পাড়ার বন্ধুদের অধিকাংশই ছিল ভাড়াটে এবং বাঙাল। ওপাড়ার ক্ষয়িষ্ণু ঘটি পরিবারগুলি অধিকাংশই বাড়ি ভাড়ার টাকার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু ভাড়াটে হিসেবে আমরা ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে ছিলাম একটু অবজ্ঞার পাত্র! আমাদের মধ্যে বাঙাল-ঘটি সংক্রান্ত ঠাট্টা-ফাজলামোর চলন ছিল ঠিকই, কিন্তু কোন সংকট না আমার মধ্যে ছিল, না পেয়েছি কোনদিন কোন বন্ধুর থেকে।

এই রকম সময়েই, ৭১-এর ২৬শে মার্চ শুরু হল পূর্বপাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ। ওইদিন ঘোষণা হল, প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। অবিসংবাদিত জননেতা জনাব মুজিবুর রহমান বন্দী হলেন পাকসেনাদের হাতে। কিন্তু রুদ্ধ করা গেল না তাঁর কণ্ঠস্বর, সেই স্বরের বজ্রনির্ঘোষ ওপারের বাঙালী জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলএ পারে আমার বন্ধুরাও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল এবং আশ্চর্য আমরা, সনাতনী ঘটি হওয়া সত্ত্বেও, সেই উত্তেজনায় সমান সামিল হতে পেরেছিলাম।

রেডিওয় রাত আটটার সংবাদ ও সংবাদ পরিক্রমার একমাত্র আকর্ষণ তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় রোজই সংবাদ পরিবেশন করতেন শ্রীযুক্ত বিভূতি চৌধুরি ও শ্রীযুক্ত দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়বিভূতিবাবু গম্ভীর কণ্ঠে যেদিন রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর পতনের, মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীদের সাফল্যের সংবাদ দিতেন সেদিন অদ্ভূত এক আনন্দ অনুভব করতাম। তাঁর কণ্ঠে জয়ের প্রত্যেকটি সন্দেশ আমাকে রোমাঞ্চিত করে তুলত। আর দেবদুলালবাবু তাঁর রোমান্টিক কাব্যিক কণ্ঠে জাগিয়ে দিতেন আমার আবেগ। সংবাদের পরে প্রচার করা হতো রেডিও কার্টুন। পাকিস্তান সরকারকে বিদ্রূপ করে সেই সব নকশায় থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। 

সেই সময় ‘সোনার বাংলা’ বলে একটা রেডিও স্টেশনও খুব শুনতাম। সেই স্টেশন প্রচার করা হতো ঢাকা থেকে, যদিও সেটি আদতে ভারত থেকেই গোপনে প্রচার হতো, ঢাকার নাম দিয়ে সেই বেতার কেন্দ্রের শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। আর একটি গান শুনতাম –

“বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ...বাংলাদেশ”।

মাঝে মাঝেই সেখানে প্রচার করা হত বঙ্গবন্ধুর সেই বিপ্লবের ডাক –

“বন্ধুগণ, তোমাদের কাসে যার যা অস্ত্র আসে লইয়া ঝাপায়ে পড়। আমাদের যদি হত্যা করা হয়, আমরাও সেড়ে কতা কইব না...”আর অনুষ্ঠানের শেষে বাজতো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত – “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। 

দীর্ঘ ন’ মাস ধরে চলতেই থাকল বীভৎস রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। কলকাতা শহরের আশেপাশে এবং সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি ভরে উঠল সর্বস্বহারা বাস্তুচ্যুত মানুষে। শোনা যায়, ওই কমাসে এককোটির উপর উদ্বাস্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। অবশেষে একাত্তরের তেসরা ডিসেম্বর, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, আক্রমণ হানল পশ্চিম সীমান্তে। এতদিন ছিল পরোক্ষ সমর্থন, এবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ভারতও জড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। 

সেই সময়, এই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আমার বালকমনে অদ্ভূত এক আলোড়ন তুলেছিল। তার ওপর এই যুদ্ধে কলকাতার পরিস্থিতিও আমার মনে ভীষণ এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলশহরে তখন ব্ল্যাক আউট ঘোষণা হয়েছে। সন্ধের পর ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে আলো জ্বালতে হত রাস্তার সমস্ত বিজলিবাতিতে ঠুলি লাগানো হয়েছিল আলোর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে। সমস্ত গাড়ির হেডলাইটের উপরের অর্ধেকটা কালো রং দিয়ে ঢেকে ফেলতে হয়েছিল, যাতে রাত্রের আলো কোনভাবেই বোমারু বিমানের চোখে না পড়ে। পুরো কলকাতা শহর সতর্ক হয়ে থাকত বোমা পড়ার আশংকায়। আমাদের স্কুলের মেন গেটের সামনে ও ভেতরের বারান্দাগুলি্র সামনে গার্ড ওয়াল তুলে দেওয়া হল পোক্ত ইটের গাঁথনিতে। যদি কোন সময় বোমা পড়েও, স্পিলন্টার যেন বেশী ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের নিরাপত্তার কারণে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছুটির আগের দিন স্কুলের উঠোনে আমাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হল, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ। বোমা পড়ার সময়, দুই হাঁটু ও কনুইয়ে ভর দিয়ে কিভাবে শুয়ে থাকতে হবে মেঝেয়। বুঝিয়ে দেওয়া হল সাইরেনের বিভিন্ন সংকেতের তাৎপর্য।

সন্ধের পর বাবা অফিস থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমরা চরম উৎকণ্ঠায় থাকতামবাবা বাড়ি ফিরলেই সবাই মিলে একসঙ্গে রেডিওর সংবাদ শোনা হতফেরার পথে বাবা নিয়ে আসতেন তাজা সংবাদ নিয়ে সান্ধ্য পত্রিকার সংস্করণ। তখন রেডিওতে বার বার প্রচার করা হতো ‘কোন রকম গুজবে কান দেবেন না’। তা সত্ত্বেও অজস্র গুজব ছড়িয়ে পড়ত পাড়ায় পাড়ায়। শোনা যেত বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানী সেনা ঢুকে পড়ছে। এক ঝাঁক চিলের মতো বোমারু বিমানও নাকি দেখেছে কেউ কেউ। সেই পরিস্থিতিতে কে বলে দেবে কোনটা গুজব আর কোনটা তথ্য! 

এই উত্তেজনার আঁচ অবিশ্যি বেশীদিন রইল না, মাত্র বারোদিনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনা সমর্পণ করতে বাধ্য হল বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর কাছে। দিনটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১অবসান হল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। জন্ম নিল একটি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র - বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে রচনা হয়ে গেল এক ইতিহাস। আর আমার মনের মধ্যে সঞ্চয় হয়ে রইল দেশ সম্পর্কে অদ্ভূত আবেগময় এক অভিজ্ঞতা।

১৯০৫ সালে অতিধূর্ত বৃটিশরাজ নিজেদের স্বার্থে বাংলাকে ভেঙে দু টুকরো করেছিল । সার্বিক আন্দোলনে ভাঙাবাংলা আবার জোড়া লেগেছিল ১৯১০-এ। ১৯৪৭ সালে দেশীয় নেতাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ভারত ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হয়েছিল - ভারত আর পাকিস্তান  বাংলাকেও আরেকবার ভেঙে ফেলে গড়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান। প্রতিবেশী এই দুটি দেশের আম জনগণের ভাষা এক, সংস্কৃতি, চালচলন, আচার ব্যবহারও এক। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধর্ম ছাড়া অন্য কোন সাযুজ্য না থাকলেও, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল পাকিস্তানের অংশ! এসব ঘটনা আমরা জানছিলাম ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে আবার টুকরো হয়ে গেল, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া একটি নবীন দেশ। তবে কি ধর্ম ধরে রাখতে পারে না মানুষকে? পারে, নিশ্চয়ই পারে, যদি না সেই ধর্মের আড়ালে থাকে আঞ্চলিক স্বার্থ আর ক্ষমতা আয়ত্ত্বে রাখার আগ্রাসী মনোভাব। আর যদি থাকে এক সহমর্মী মানবিক মন।

এবারে আর বইপড়া ইতিহাস নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের তীব্র আঁচ লাগা অভিজ্ঞতায় সাক্ষী হয়ে রইলাম। ১৯৫২-র রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন, সার্থক হল দেশের পূর্ণ স্বাধীনতায়। আর কিছু না পারলেও, আমার আন্তরিক সমর্থনটুকুতো দিতে পেরেছিলাম।   



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

সুরক্ষিতা - শেষ পর্ব

  [এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি ...