[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
[আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে "সুরক্ষিতা - পর্ব ১৬"]
১৭
বেশ কিছুক্ষণ ওদের এই আলাপচারিতা
দেখতে দেখতে তাঁর চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। তাঁর মনে হল বিট্টুকে
তাঁদের আঁচলের তলায়, বদ্ধ একটা ঘরে এতদিন বন্দী রেখে শুধু ভুল নয়, তাঁরা অন্য্যয়
করেছেন। একটা শিশু সুস্থই হোক বা অসুস্থ, বেড়ে ওঠার জন্যে, বাবা-মা এবং ঘরের
পরিবেশ ছাড়াও বাইরের সঙ্গে পরিচিতিও সমান জরুরি। তাঁর বিট্টুকে সাধারণ স্কুলে
দেওয়া সম্ভব হত না ঠিকই, কিন্তু এরকম কোন প্রতিষ্ঠানে আগেই দেওয়া যেত। তাতে তাঁর
এই পিছিয়ে পড়া বিট্টুর ভালোই হত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি দেখতে লাগলেন ওদের, খুশীতে
তাঁর মুখে ফুটে উঠল হাসির আভাস, অথচ দুচোখ ভরে উঠল জলে।
বেশ কয়েকবার ছবিকেও নিয়ে গেছেন সঙ্গে, আজ নিলেন না। গতকাল স্কুলে বেরোনোর আগেই ছবিকে তিনি বলে দিয়েছিলেন – ওর মা আর দিদুকে বলতে – দুপুরে আজ এখানে খাবে। আরও বলেছিলেন, ভালো করে রান্না করতে। ভাত, শুকনো করে সরু সরু ফালির করলা ভাজা, পোনা মাছের তরকারি, বিউলির ডাল, সঙ্গে বেশ ঝালঝাল আলুপোস্ত, আর শেষ পাতে চাটনি ধরনের কিছু। তাঁর এই খাবারের ফর্দ শুনে খুব অবাক হল এবং ভয়ও পেল ছবি, কিন্তু কিছু বলল না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি খুব অবাক চোখে লক্ষ্য
করতে লাগল শুভময়ীদেবীকে। গত কয়েকদিন ধরেই শুভময়ীদেবী অনেকটাই হাল্কা মেজাজে
রয়েছেন। তাঁর মুখের থেকে বিষণ্ণ গম্ভীর ছায়াটা সরে গেছে। জল দিয়ে ধুয়ে কাপড় দিয়ে
গাড়ির বডি মুচ্ছিল ড্রাইভার রামদীন, শুভময়ীদেবী গাড়িতে না বসে ঘুরে ঘুরে দেখতে
লাগলেন গাড়িটা। কোনদিন এমন করেন না। আগে মনে হত, এ গাড়ি যেন তাঁর নয়, অন্য কারো
ভাড়ার গাড়ি। তিনি শুধু যাত্রী। আজ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন,
দু’একটা নির্দেশ দিলেন রামদীনকে। তারপর অল্প হেসে ছবির দিকে তাকিয়ে, হাত নেড়ে
গাড়িতে উঠে বসলেন।
এই সময়ে ছবির একটা কথা মনে পড়ল।
অনেকদিন আগে মিঠুদিদি বলেছিল, ওদের স্কুলে নাকি শুভময়ীদেবীকে, শুভ“মই” বলে আড়ালে। “মই”
কেন? “বারে দেখিস নি - ছিপছিপে কি সুন্দর লম্বা গড়ন আন্টির? দুর্ধর্ষ ফিগার। কম
বয়সে বহু ছেলের হার্টথ্রব ছিলেন নিগ্ঘাৎ”। “হার্টথ্রব” মানে? ছবির এ
প্রশ্নে, হাল ছেড়ে দিয়ে মিঠুদিদি বলেছিল “কিন্তু সব ছেড়ে কেন যে অমন ভোঁদকা স্বামী
জুটল কে জানে”। আজ এই সময় কথাটা তার হঠাৎই মনে পড়ল, কেন?
শুভময়ীদেবীকে নিয়ে গাড়ি বেড়িয়ে যেতে, ছবি
ঘরে ঢুকল, তাকে এখন বাজার যেতে হবে। কিনে আনতে হবে, টাটকা করলা, মাছ, আলু। পোস্ত, বিউলির ডাল, মৌরি,
কাঁচা লঙ্কা, সাদা সরষে, সরষের তেল ঘরেই আছে, আনতে হবে একটু টক দই...আরো কিছু
টুকটাক। তার কাছেই এখন মাস খরচের টাকা দিয়ে দেন শুভময়ীদেবী। টাকা আর বাজারের
থলি নিয়ে, দরজায় তালা দিয়ে ছবি বের হল বাজারের উদ্দেশ্যে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে।
কী এমন হল যে, মামী তার মা আর দিদুকে
ডেকে পাঠাল? তার ওপর আবার দুপুরে খাওয়াবে, বেশ তরিবত করে? কেন? তাকে কি ছাড়িয়ে দেবে
বলে, ঠিক করে নিয়েছে মামী? তা যদি হয়, সেকথা তো ছবিকেই বলতে পারত – সরাসরি। “এ মাসের
কটা দিন যাক – সামনের মাস থেকে তুই অন্য কোথাও কাজ ধরে নে, ছবি”। তার কাজটা যে সামনের
মাস থেকে আর থাকবে না – সে কথা বলার জন্যে এত ঘটা করে, তার মা আর দিদুকে ডেকে খাওয়ানোর
কি দরকার ছিল?
বাজার থেকে ফিরে প্রত্যেকটা রান্নাই খুব মন দিয়ে আর যত্ন নিয়ে করল ছবি। যেমনভাবে তাকে শিখিয়েছিলেন শুভময়ীদেবীর শাশুড়ি। বাজার থেকে ফেরার পথে মিষ্টি দই কিনে এনে রেখে দিয়েছে ফ্রিজে – শুভময়ীদেবী বলেননি, কিন্তু ছবি জানে শুভময়ীদেবী শেষ পাতে মিষ্টি দই পছন্দ করেন খুব। রান্না বান্না সেরে, সব গুছিয়ে ফেলার পর হাত খালি হয়ে গেল ছবির। আপাততঃ তার আর কোন কাজ নেই, সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। শুভময়ীদেবীর ফিরতে এখনো ঘন্টা খানেক তো বটেই।
রান্নাবান্না
সেরে চট করে স্নানটা সেরে নিল ছবি। ঘড়িতে দেখল সোয়া বারোটা বাজছে। মা আর দিদুর আসতে
সাড়ে-বারোটা, পৌনে একটা হবে। মামীর আসতেও প্রায় একটাই হয়। আপাততঃ হাতে এখন আর কোন কাজ
নেই বলে বারান্দায়
এসে দাঁড়াল ছবি। এই মধ্য দুপুর ছুটিরদিনে সামনের বাগানে লোকজন বেশ কম। দু তিনটে
কুকুর ল্যাং
ল্যাং করে ঘুরে
বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক – শুঁকছে, দাঁড়াচ্ছে, আবার হাঁটছে...। ছবির মনে ফিরে এল
দুশ্চিন্তা।
এই বারান্দা। এই ঘর। এই
অ্যাপার্টমেন্ট। এই ঘরে তার ওপর অর্পিত গৃহিণীপনা! কতদিন, আর কতদিন। এ সব ছেড়ে,
সেও কি প্লাস্টিকের চটি ঘসটানোর আওয়াজ তুলে দৌড়বে টালিগঞ্জ স্টেসনে ট্রেন থেকে নেমে। আধা
রাতে ঘরে ফিরে আলু-পটল সেদ্দ-ভাত রান্না করে খাবে আর
ক্লান্ত শরীরটাকে ফেলে দেবে ঘুমের কোমল কোলে। তাও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাবে। সারাটা দিন সস্তা
ডিটারজেন্ট পাউডার আর জলে হেজে যাওয়া হাতের আর পায়ের যন্ত্রণায়। সে দেখেছে তার
মাকে। তার দিদুকে। মাঝরাতে লম্ফ জ্বেলে ওরা তেল লাগায় হাতের তালুতে, পায়ের আঙুলের
ফাঁকে ফাঁকে। জলে ভিজে থাকলে হাজার যন্ত্রণা কম হয়, শুকোলে বাড়ে।
নিজের হাতের পরিষ্কার তালুর দিকে
সে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, এই স্পষ্ট রেখাগুলি নাকি মানুষের ভাগ্য বলে দেয়? কি আছে
তার ভাগ্যে? বাসন মাজার সস্তা ডিটারজেন্টের দাপটে তার মায়ের, দিদুর হাতের তালু কবেই ক্ষয়ে-হেজে গেছে, হাতের ভাগ্যরেখাও ঝাপসা হয়ে গেছে কতদিন...। তাই কি তাদের ভবিষ্যতও সর্বদাই অনিশ্চিত আর ঝাপসা? অনেক, অনেকদিন পর চোখে
জল চলে এল ছবির, ঝাপসা হয়ে এল মেলে রাখা দুহাতের তালুতে আঁকা রেখাগুলিও। এই মাসটাই কী শেষ? তারপর
তাকেও কি রোজ ভোরে পান্তা খেয়ে বেরোতে হবে কলকাতার ট্রেন ধরতে? রোজ – প্রত্যেকদিন,
মাস, বছর!
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন