[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে,
স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
প্রথম অধ্যায়ঃ অর্জুনের বিষাদযোগ
এই সেই প্রান্তর, যেখানে প্রাচীন কালে মহারাজ কুরু, যিনি কুরুবংশের গোত্র রাজা, বহু যজ্ঞ পবিত্রভাবে সম্পন্ন করেছিলেন বলেই, তাঁর নাম অনুসারে এই প্রান্তরের নাম কুরুক্ষেত্র। বহু যজ্ঞের সুষ্ঠু আয়োজনে এই প্রান্তর ধর্মক্ষেত্রও বটে।
কুরুক্ষেত্রের এই প্রান্তরে যুদ্ধ শুরুর আয়োজন। কুরুবংশের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এই যুদ্ধ, একদিকে দুর্যোধনের নেতৃত্বে কৌরববাহিনী এবং অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে পাণ্ডববাহিনী। সমসাময়িক ভারতের প্রায় সমস্ত মহাবীর রাজন্যবর্গও বিরোধী দুই পক্ষকে সমর্থন করার জন্যে এসে মিলিত হয়েছেন এই যুদ্ধের প্রান্তরে। সবার উপরে আছেন দ্বারকাধীশ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, আসন্ন এই যুদ্ধে নিজহাতে অস্ত্র ধরবেন না, অর্জুনের রথের সারথি হয়েই তিনি পরিচালনা করবেন পাণ্ডবপক্ষের সকল রণকৌশল।
অবশেষে,
দীর্ঘ প্রস্তুতির পর সেদিন যুদ্ধ শুরু করার জন্য কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দুইপক্ষই
সমবেত হয়েছে। চির অন্ধ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের পরিস্থিতি কি জানার জন্যে
উদ্গ্রীব হয়ে তাঁর দিব্যদৃষ্টিধারী মন্ত্রী সঞ্জয়কে বললেন,
|
১/১ |
ধৃতরাষ্ট্র বললেন - আমাদের বাহিনী
আর পাণ্ডবের সৈন্যসামন্ত, যুদ্ধ করার জন্যে পবিত্র এই কুরুক্ষেত্রে একত্র হয়ে
এখন কে কী করছে, আমায় বিস্তারিত বলো, সঞ্জয়। |
|
|
১/২ |
সঞ্জয়
বললেন – হে মহারাজ, রাজা দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবের কুশলী সেনাবিন্যাস
দেখে আচার্য্য দ্রোণের কাছে গিয়ে বলছেন - |
|
|
১/৩ |
পাণ্ডবদের
এই বিশাল সেনাবিন্যাস দেখছেন, গুরুদেব? আপনারই যোগ্য শিষ্য রাজা দ্রুপদের পুত্র
বুদ্ধিমান ধৃষ্টদ্যুম্ন এটির পরিচালনা করছেন। |
|
|
১/৪-৬ |
এই
সেনাবাহিনীর মধ্যে ভীম ও অর্জুনের মতো মহাবীর যেমন আছে, তেমনই আছেন মহাবীর
সাত্যকি, মৎস্যরাজ বিরাট, মহাযোদ্ধা দ্রুপদ। আরো রয়েছেন শিশুপাল
পুত্র ধৃষ্টকেতু, যদুবংশের সেরা বীর চেকিতান, বীর শ্রেষ্ঠ কাশীরাজ, কুন্তিভোজের
পুত্র পুরুজিৎ, শিবিদেশের রাজা শ্রেষ্ঠ বীর শৈব্য, পাঞ্চালদেশের মহা পরাক্রমশালী
যুধামন্যু ও উত্তমৌজা। এছাড়াও রয়েছে সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পাঁচ
পুত্র, এরাও কিন্তু বীরত্বে কম যায় না। |
|
|
১/৭ |
আমাদের
পক্ষে যাঁরা প্রধান এবং আমাদের বাহিনীর যাঁরা সেনানায়ক, তাঁদের কথাও আপনাকে বলে
রাখি, গুরুদেব। তাঁদের সকলের নাম আপনার জেনে রাখা ভাল। |
|
|
১/৮ |
আপনি
নিজে আছেন, আর আছেন ভীষ্ম, কর্ণ, রণবিজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তের
পুত্র ভূরিশ্রবা এবং সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ। |
|
|
১/৯ |
এছাড়াও
অনেক বীর আছেন যাঁরা আমার জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, তাঁরা সকলেই নানান
অস্ত্রশস্ত্র চালনায় খুবই পারদর্শী এবং যুদ্ধবিদ্যাতে খুবই দক্ষ। |
|
|
১/১০ |
হে
আচার্য, পিতামহ ভীষ্মের বিশেষ পরিচালনায় আমাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী অপরাজেয়,
আমাদের বিরুদ্ধে ভীমের অধীনে থাকা পাণ্ডবের সৈন্যদল কিন্তু আদৌ যথেষ্ট নয়। |
|
|
১/১১ |
অতএব আপনারা
সকলেই প্রতিটি সেনাব্যূহে প্রবেশের দরজায়, নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব নিন এবং
সব দিক থেকে ভীষ্মকে রক্ষা করুন। |
|
|
১/১২ |
এই কথা
শুনে, কুরুকুলের মহাপ্রতাপশালী বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন,
আর দুর্যোধনকে খুশি করার জন্যে বজ্রস্বরে শাঁখ বাজাতে শুরু করলেন। |
|
|
১/১৩ |
সঙ্গে
সঙ্গে চারিদিক থেকে বেজে উঠল অসংখ্য শাঁখ, ভেরী, ঢাক, মৃদঙ্গ, আর রণশিঙা।
তুমুল
শব্দে ভয়ানক হয়ে উঠল রণস্থল। |
|
|
১/১৪ |
তার ঠিক
পরেপরেই অনেকগুলি সাদা ঘোড়ায় টানা একটি মহারথে বসে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন তাঁদের
দুজনের অলৌকিক শঙ্খদুটি বাজালেন। |
|
১/১৫ |
শ্রীকৃষ্ণ
তাঁর পাঞ্চজন্য, অর্জুন তাঁর দেবদত্ত আর মহাবলশালী ভীম তাঁর পৌণ্ড্র নামক বিখ্যাত
শঙ্খের শব্দ তুললেন। |
|
১/১৬ |
কুন্তীপুত্র
রাজা যুধিষ্ঠির তাঁর অনন্তবিজয়, নকুল তাঁর সুঘোষ ও সহদেব তাঁর মণিপুষ্পক নামক
শাঁখও একই সঙ্গে বাজিয়ে দিলেন। |
|
|
১/১৭-১৮ |
হে
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহা তীরন্দাজ কাশীরাজ, মহাবীর শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, রাজা
বিরাট, অপরাজেয় বীর সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রেরা, সুভদ্রা পুত্র
মহাবীর অভিমন্যু, এঁরা সকলেই নিজের নিজের শাঁখগুলি বাজাতে শুরু করলেন। |
|
|
১/১৯ |
সেই
সমবেত তুমুল শাঁখের ধ্বনি আকাশে এবং পৃথিবীর চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলে
ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দিল। |
|
|
১/২০ |
হে
মহারাজ, এরপর আপনার পুত্রদের সকলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখে, অর্জুন তাঁর
রথের কপিধ্বজা উড়িয়ে দিলেন এবং তির নিক্ষেপের জন্যে ধনুক হাতে প্রস্তুত হয়ে
শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- |
|
|
১/২১-২৩ |
অর্জুন
বললেন- হে কৃষ্ণ, দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে আমাদের রথ নিয়ে চলো। আমি
দেখব। যাঁদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, তাঁদের সকলকে দেখব। দুষ্ট বুদ্ধি
দুর্যোধনের হিতৈষী যে সব রাজা ও বীরগণ এসেছেন, তাঁদেরকেও আমি দেখতে চাই। |
|
|
১/২৪-২৫ |
সঞ্জয়
বললেন – হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, অতন্দ্র বীর অর্জুনের এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের
অপেক্ষায় থাকা দুই পক্ষের সেনা বাহিনীর মাঝখানে সবার সেরা তাঁদের সেই সুন্দর
রথটি স্থাপনা করলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ এবং উপস্থিত কৌরবপক্ষের সমস্ত
রাজন্যবর্গের সামনে রথ স্থাপনা করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে পার্থ, রণক্ষেত্রে
উপস্থিত সমবেত কৌরবগণকে দেখে নাও। |
|
|
১/২৬ |
অর্জুন
উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর মধ্যে পিতৃস্থানীয়, পিতামহস্থানীয়, আচার্য্য, মাতুল,
পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, শ্বশুর এবং সুহৃদ্ স্থানীয় সকলকেই দেখতে পেলেন। |
|
|
১/২৭ |
রণক্ষেত্রে
উপস্থিত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, আদরের পরিজন ও প্রিয়বন্ধুদের দেখে অত্যন্ত কাতর হয়ে
বিষণ্ণ অর্জুন বলে উঠলেন - |
|
|
১/২৮ |
অর্জুন
বললেন - হে কৃষ্ণ, রণক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত আমার এই পরিজনদের দেখে,
আমি অত্যন্ত অবসন্ন ও হতাশা বোধ করছি। আমার শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে, আমার কণ্ঠ
রুদ্ধ হয়ে আসছে। |
|
|
১/২৯ |
আমার
সর্ব অঙ্গ কাঁপছে, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার অসাড় হয়ে আসা হাত থেকে ধনুক খসে
পড়ছে, সর্ব অঙ্গে আমি তীব্র জ্বালা অনুভব করছি। |
|
|
১/৩০ |
হে কেশব,
আমি এই রণক্ষেত্রে আর থাকতে পারছি না। আমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। চারদিকে আমি
অমঙ্গলের সমস্ত লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি। |
|
|
১/৩১ |
এই
যুদ্ধে স্বজন হত্যা করে, আমার মনে হচ্ছে না, আমাদের এতটুকুও মঙ্গল হবে। এমন জয় আমি
চাই না, হে কৃষ্ণ, রাজ্যলাভের সুখও আমি চাই না। |
|
|
১/৩২-৩৩ |
কি হবে
রাজ্য জয় করে, কি হবে রাজ্য ভোগ করে? আর হে গোবিন্দ, বেঁচে থেকেই বা কি লাভ?
যাঁদের জন্যে আমরা রাজ্য ভোগের সুখ কামনা করি, সেই গুরু, পিতৃব্য, পুত্র,
পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক এবং কুটুম্বজনেরা ধন ও প্রাণের মায়া ছেড়ে
এখানে যুদ্ধ করার জন্যে সমবেত হয়েছেন। |
|
|
১/৩৪ |
এই
পৃথিবী কিংবা তিন ভুবনব্যাপী রাজ্যলাভও আমার কাছে তুচ্ছ, এঁনারা যদি আমাদেরকে আজ
হত্যাও করেন, তাও আমি এঁদেরকে নিধন করতে চাই না, হে মধুসূদন। |
|
|
১/৩৫ |
হে
জনার্দ্দন, বলতে পারো, দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের অন্যান্য পুত্রদের হত্যা করে
আমাদের কি ধরনের সুখ মিলবে? এরা সকলেই আততায়ী ঠিকই, কিন্তু এদের হত্যা করলে
আমাদেরও তো পাপ হবে! [যে
অন্যের ঘরে আগুন দেয়, যে অন্যকে বিষ দেয়, যে ধন অপহরণ করে, যে পরের স্ত্রীকে
অসম্মান করে, আর যে অন্যকে হত্যার জন্যে অস্ত্র ধারণ করে – তারাই আততায়ী।
দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা এই সব কটি অপরাধেই অপরাধী, অতএব আততায়ী।] |
|
|
১/৩৬ |
অতএব
ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনদের ও তাদের আত্মীয় পরিজনদের হত্যা করা আমাদের আদৌ উচিৎ
হবে না। হে মাধব, স্বজন হত্যা করে কিভাবে আমাদের সুখ মিলবে? |
|
|
১/৩৭-৩৮ |
যদিও
এঁনারা সবাই রাজ্যলোভে উন্মত্ত হয়ে, নিজেদের কুলক্ষয়, বংশনাশ ও মিত্র হত্যার মতো
ভয়ংকর পাপ দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমরা কেন জেনে বুঝেও এমন স্ববংশ ধ্বংসকারী
পাপ কাজ থেকে বিরত হবো না, হে জনার্দন? |
|
|
১/৩৯ |
কুলক্ষয়
হলে সেই বংশের নিজস্ব কুলধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম নাশ হলে অধর্ম এসে কুলকে গ্রাস করে
এবং ভবিষ্যৎ বংশধরগণও অধর্মাচারী হয়ে থাকে। |
|
১/৪০-৪১ |
হে
কৃষ্ণ, অধর্মের সংস্রবে কুলস্ত্রীরা ব্যাভিচারিণী হয়, কুলনারী ব্যাভিচারিণী হলে
বর্ণসংকরের জন্ম হয়। এই বর্ণসংকরের পিতৃকুল, পিণ্ড ও তর্পণের জলাঞ্জলি থেকে
বঞ্চিত হয়ে নরকে পতিত হয়ে থাকেন। বর্ণসংকর নিজ কুলের এবং কুলনাশকারীরও নরকের
হেতু হয়ে থাকে। |
|
|
১/৪২-৪৩ |
অতএব
যারা কুলঘাতক তারা সমাজে বর্ণসংকর সৃষ্টি ক’রে সমাজের সনাতন ধর্ম থেকে সমাজকে
বিচ্যুত করে। হে জনার্দন, শুনেছি উৎসন্নে যাওয়া কুলধর্মের কারণে মানুষের চিরদিন
নরকবাস হয়ে থাকে। |
|
|
১/৪৪ |
হায়, আমরা কি ভয়ংকর এক পাপ কাজের আয়োজন করতে চলেছি, সামান্য রাজ্যলাভের জন্য আমরা স্বজন হত্যার পরিকল্পনা করেছি। |
|
|
১/৪৫ |
ধৃতরাষ্ট্রের
পুত্রেরা নিরস্ত্র এবং অসহায় পেয়ে যদি আমাকে হত্যাও করে, তাও আমার পক্ষে অনেক বেশী
মঙ্গলজনক হবে। |
|
|
১/৪৬ |
সঞ্জয়
বললেন – অর্জুন এই কথা বলে ধনুক এবং তির ত্যাগ করে যুদ্ধ থেকে বিরত হলেন ও
বিষণ্ণমুখে রথেই বসে রইলেন। |
|
অর্জুনের বিষাদযোগ সমাপ্ত
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন