১
শুক্রবার
বেড়ালটাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, আর তার ফলে, অটোটা ফস্কে গেল। অটোয় একটাই সিট অবশিষ্ট ছিল, আমাকে পাশ কাটিয়ে ডেঁপো এক ছোকরা টুক করে উঠে বসতেই অটোটা ছেড়ে দিল। এর পরেরটা কখন পাবো কে জানে! আমার এখানে অটোস্ট্যাণ্ড নয়, মাঝ-রুটে অটোয় জায়গা পাওয়া যথেষ্ট ভাগ্যের ব্যাপার। কাজেই অটোটা মিস হওয়াতে বেশ আফশোষ হচ্ছিল! তবে পরের অটোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে, কিছুক্ষণ পরেই যা শুনলাম, তাতে আরো ঘাবড়ে গেলাম। আমাদের গলিটা সোজা গিয়ে যেখানে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে, সেখানে উল্টোদিক থেকে আসা একটা বাইক সজোরে ধাক্কা মেরেছে ওই অটোটায়! আর তাতে কাত হয়ে উল্টে গিয়েছে অটো। মারাত্মক কিছু না হলেও, সকলেই চোট পেয়েছে। সব থেকে বেশি চোট পেয়েছে, সেই ছোকরা, যে আমাকে টপকে অটোয় চড়েছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে! বেড়ালটা যেখানে বসেছিল, আমি সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। নাঃ, এখন আর নেই। কিন্তু আমার মনটা কেমন দমে গেল। ছোটবেলার স্কুল বয়েসের বন্ধু শ্যামলের বাড়ি যাচ্ছিলাম, ঠিক করলাম, আজ আর যাবো না। অটোর অপেক্ষায় আর না থেকে, আমি বাড়িতে ফিরে এলাম।
২
শনিবার
পরেরদিন সাড়ে আটটা নাগাদ বারান্দার চেয়ারে বসে খবরের কাগজ
দেখছিলাম, হঠাৎ কলমি এসে বলল,
“ও মামা, তুমি আবার খইনি খাওয়া ধরলে কবে থেকে গো”?
“খইনি? আমি? বড্ডো আবোলতাবোল বকিস তুই, কলমি”।
“বাঃ রে, তাহলে এটা কোত্থেকে এলো শুনি? বসার ঘরে সোফা
ঝাড়তে গিয়ে বেরোলো, এই দ্যাখো!” কলমির বাড়ানো হাত থেকে লালরঙের প্লাস্টিকের কৌটোটা
হাতে নিয়ে আমিও অবাক হলাম। খইনির ডিব্বাই বটে। দুমুখো ডিব্বে, এ ধরনের ডিব্বার একদিকে
তামাকের পাতা থাকে, অন্য দিকে গোলা চুন। ফুটপাথে বিহারি খইনিওয়ালাদের কাছেও বিক্রির
জন্যে এমন ডিব্বে দেখেছি। কিন্তু আমার এখানে এলো কী করে? আমি বা আমার
চেনাশোনা কেউ কস্মিনকালেও খইনি খায় এমনতো মনে পড়ল না। কলমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে
পাকাবুড়ির মতো উপদেশ দিল,
“মামা, তামাকের নেশা করতে নেই গো, ওতে ক্যানসার হয়,
শোননি?” আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
“যাঃ যাঃ, বেশি বকিসনি। ভালো করে চা কর দেখি, আমি দেখি,
এটা কোথা থেকে এল”। কলমি মুখটা গোমড়া করে রান্নাঘরে যেতেই আমি ডিব্বের দুদিকের
মুখের ঢাকনা খুলে ফেললাম। খইনি রাখার বড়ো দিকটাতে কিচ্ছু নেই, খালি। আর পিছনের
ছোটদিকটা মিহি বালি দিয়ে ভরাট করা। কী মনে হতে বাঁ হাতে ঢেলে নিলাম বালিগুলো, আর
তার মধ্যে থেকে যা বেরোলো, দেখে চমকে উঠলাম। কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর
কলমি এখনই চা নিয়ে আসবে ভেবে, বালিগুলো আবার ডিব্বেয় ভরে রাখলাম, আর অবাক করা
জিনিষটা ঢোকালাম পাঞ্জাবির পকেটে!
সকালে কলমি আসে, ঘরদোর ঝাড়পোঁছা করে, আমার জলখাবার বানিয়ে
দিয়ে যায়। একটু বেলায় আসে অন্নদাদিদি। দুপুরের রান্নাবান্না সেরে, আমার
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে বাড়ি ফেরে। অন্নদাদিদির আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। আমি
শোবার ঘরে এসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে হলদে রঙের পাথরের মতো জিনিষটা বের করে দেখলাম। আমার
যদিও তেমন কিছুই ধারণা নেই, তবু মনে হল এটা হয়তো কোন দামি পাথর। যাকে জেমস্টোন
বলে। জানালা দিয়ে একফালি রোদ্দুর আসছিল, সেই আলোয় জিনিষটা ধরতেই, জিনিষটা ঝিলিক
দিয়ে উঠল। চোখের
আরো কাছে এনে দেখলাম, পাথরের ভেতরে বেড়ালের চোখের মতো উজ্জ্বল একটা আলো। বেড়ালের
চোখ, যাকে ইংরিজিতে বলে ক্যাটস আই? তার মানে বৈদূর্যমণি? এ জিনিষ খইনি ডিব্বের
মধ্যে লুকিয়ে, আমার সোফার কোণায় কে রেখে গেল? নাকি ভুলে ফেলে গেছে কেউ? আমার চেনা
পরিচিতর মধ্যে রত্নের কারবার কে করে? কই, তেমন তো জানি না কাউকে!
গতকাল অটোয় উঠতে যাবার আগে সেই বেড়ালটার কথা আবার মনে পড়ল। মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছাদের কার্ণিসে বেড়ালটা বসেছিল। তার “মিঁয়াও” ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে যখন আমি তাকে দেখলাম, বেড়ালটা আমার দিকে তার একটা থাবা তুলে নাড়াল, মনে হল আমাকে যেন সে নিষেধ করছে! যদিও আমি বেড়াল বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু বেড়ালকে ওভাবে থাবা নাড়াতে কোনদিন দেখিনি! এই পাথরটা যদি ক্যাটস্ আই হয়, তার সঙ্গে ওই বেড়ালের কোন যোগাযোগ রয়েছে কী? কে বলবে? কাউকে জিগ্যেস করলে, ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
বিকেলে একটু বেরিয়েছিলাম, একটু হাঁটাও হবে, টুকটাক কিছু
জিনিষপত্র কেনার ছিল, সেগুলো কেনাও হবে। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েকটা বাড়ি
ছেড়েই রণধীরবাবুর বাড়ি। সেই বাড়ির বারান্দায় গ্রিলের ফ্রেমে বেশ কয়েকটা ফুলগাছের
টব আছে। দূর থেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ওই বাড়ির নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় আবার সেই
বেড়ালটাকে আজ ফুটপাথের ধারে বসে থাকতে দেখলাম। আজও অদ্ভূতভাবে থাবা তুলে বসে আছে,
ঠিক যেমন ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে থামতে বলে, সেরকম ভঙ্গী। বেড়ালটাকে দেখে আজও একটু
থমকে গেলাম। আর সেই সময়েই আমার দু হাত সামনে ফুলগাছ সমেত একটা টব ওপরের বারান্দা
থেকে ধপাস করে ফুটপাথে এসে পড়ল এবং ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আশেপাশে লোকজন হৈচৈ করে
উঠল, রণধীরবাবুর নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম। ভয়
পেয়েছিলাম ভীষণ, কয়েক সেকেণ্ড পরেই ওই টবটা আমার মাথায় পড়লে আমার যে ভবলীলা সাঙ্গ
হত, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন অদ্ভূতভাবে বেঁচে যাওয়াতে আশ্চর্য
হলাম অনেক বেশি! আরো আশ্চর্য, সেদিনের মতোই এখন আর বেড়ালটাকে কোথাও দেখতে পেলাম
না।
৩
রবিবার
প্রত্যেকদিনের মতো আজও সকালে কলমি এসেছে, সঙ্গে ওর মেয়ে
ফুটকি। ফুটকি ক্লাস সিক্সে পড়ে, আমার কাছে পড়তে আসে। লেখাপড়ায় বেশ ঝোঁক আছে
মেয়েটার, বুদ্ধিশুদ্ধিও ভালোই। স্কুলের ছুটির দিনগুলোয় আমার কাছে সে আসে মায়ের
সঙ্গে, আর ফেরে দিদিমার সঙ্গে, আমার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে।
ফুটকিকে আজ বাংলা পড়াতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। ওদের
বইতে মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্য”-এর একটা অংশ আছে, সেটার অনেকগুলো শব্দের
মানে কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। যেমন, ইরম্মদ, আনায়, কোদণ্ড। বাংলায় যে খুব
খারাপ নম্বর পেতাম, তা নয়, স্কুলে পড়তে এগুলো জানতাম, কিন্তু এত বছর চর্চার অভাবে
সেসব ভুলে গেছি! কিন্তু এখন শব্দগুলোর মানে জানা দরকার। ফুটকিটা বারবার জিগ্যেস
করছিল, ও দাদু, ইরম্মদ মানে কী? বলো না, তুমি জানো কিন্তু বলছো না, বলো না, দাদু”।
কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারির ওপরের তাকে “চলন্তিকা”টা থাকার কথা। বহুদিন খুলেও দেখা
হয়নি বইটা। এতদিন মনেও ছিল না বইটার কথা, আজ মনে পড়ল। ওটাকে পাড়তে গেলে চেয়ার বা
টুল দরকার একটা।
ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির নিচেয় একটা পুরোনো টুল ছিল, সেটা নিয়ে
এলাম। টুলটার অবস্থা খুবই খারাপ। নড়বড় করছে। আশা করি আমার ভার নিতে পারবে। টুলটাকে
আলমারির সামনে রেখে সেটায় উঠতে যাবো, চোখ পড়ল জানালার বাইরে। সেই বেড়ালটা ওখানে
বসে আছে, আর আমার দিকে তাকিয়ে থাবা নাড়ছে! স্পষ্ট বুঝলাম, আমাকে নিষেধ করছে! বেড়ালটাকে
গ্রাহ্য না করে, টুলটায় উঠতে যেতেই বেড়ালের থাবা নাড়া বেড়ে গেল, উপরন্তু বেশ রাগ
রাগ গলায় ডাকল, “ম্যাঁয়াও”।
অলৌকিক ব্যাপারে আমার একেবারেই বিশ্বাস নেই, আর কাক ডাকলেই
তাল পড়বে এমন কাকতালীয় ঘটনাতেও আমার মোটেই
বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু পর পর দু দিনের ঘটনায় সেই বিশ্বাসে মনে হচ্ছে টান পড়েছে!
তাই আর জেদ না করে, টুলে চেপে “চলন্তিকা” পাড়ার ব্যাপারটা আপাততঃ স্থগিত রাখলাম।
নড়বড়ে টুলটা তুলে নিয়ে সিঁড়ির নিচে যেমন ছিল সেরকমই রেখে এলাম। ফিরে এসে জানালার
দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই বেড়ালটা যথারীতি আর নেই। আর তখনই আমার ওই সব কটা শব্দের
মানে মনে পড়ে গেল! আমার রকমসকম দেখে ফুটকি ফিকফিক করে হেসে গড়িয়ে পড়ল, বলল,
“ও দাদু, তুমি পাগল হলে নাকি? ভাঙা টুলটা একবার নিয়ে এলে,
আবার রেখে এলে, কী ব্যাপার বল তো?” আমি খুব গম্ভীর গলায় বললাম,
“বাজে বকিস না, জানালার ওপাশে হাতনাড়া বেড়ালটাকে দেখলি?
একটু আগেই বসেছিল?” তাতে আরো মজা পেয়ে ফুটকি বলল,
“বেড়াল? বেড়াল আবার কোথায় দেখলে? আমি তো সেই থেকে বসে
রয়েছি, কই, কোন বেড়াল তো দেখলাম না! তাছাড়া বেড়ালের আবার হাত হয় নাকি? বেড়ালের তো
চারটেই পা ! বেড়াল তো চতুষ্পদ প্রাণী”। ফুটকির মাকে আমি ধমক দিলে কথা শোনে, কিন্তু
ফুটকি শুনবে কেন? সে তো আমার নাতনী, দাদুদের ধমকে নাতনীরা কবে আর কাবু হয়? আমি
ফুটকিকে আর না ঘাঁটিয়ে, গম্ভীর গলায় বললাম,
“বাঃ চতুষ্পদ মানে চারপা যখন জানিস, তখন ইরম্মদ মানে জানিস
না কেন?” ফুটকি হার মানার মেয়েই নয়, বলল,
“বারে, আমি তো ছোট্ট, আমি সবই যদি জেনে যাবো, তাহলে তোমরা
আমাদের শেখাবে কী? আর তুমি আমার দাদুই বা হয়েছো কেন?” ফুটকির উত্তরে আমি জবাব দিতে
পারলাম না, তাই নিরীহ স্বরে বললাম,
“বেশ, পাকু হয়েছিস তুই, খাতা পেন বের কর, লেখ, ইরম্মদ মানে
বজ্র”। বাংলা খাতা খুলতে খুলতে ফুটকি বলল,
“বজ্র, মানে বাজ? বর্ষা কালে মেঘের থেকে গুড়ুমগুড়ুম শব্দ
করে যা পড়ে?”
“হুঁ”।
“আর কোদণ্ড?”
“ধনুক। ধনুকে বসিয়ে আগেকার দিনে তির ছুঁড়ে যুদ্ধ হত”।
“ও হ্যাঁ, টিভিতে দেখেছি, ভগবান রামচন্দ্র হেব্বি তির
ছুঁড়তে পারতেন। আর আনায় মানে?”
“আনায় মানে বড়োসড়ো খাঁচা। যার মধ্যে বাঘ, সিংহকে বন্দী
রাখা হয়, চিড়িয়াখানায় দেখিসনি?” ফুটকি কিছু বলল না, ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল, আর খাতার
ওপর ঝুঁকে লিখে নিতে লাগল মানেগুলো।
৪
সোমবার সকাল
বলা নেই কওয়া নেই, আজ সকালে পৌনে আটটা নাগাদ সন্ময় এসে
হাজির। অবিশ্যি ও এমন হুট করেই আসে। শ্যামলের মতো সন্ময়ও আমার স্কুলের বন্ধু এবং খুব
ভালো বন্ধু। কদিন আগেও সন্ময় এসেছিল, বুধবার, না না বেষ্পতিবারে। ও এলে নিজেই গাড়ি
চালিয়ে আসে। আর ঘরে পা দিয়েই হাঁকডাক শুরু করে, যেমন আজও করল,
“অ্যাই কলমি, মামার জন্যে জলখাবারে কী বানাচ্ছিস রে?”
কলমিও সন্ময়কে খুব পছন্দ করে, সে মুখ টিপে হেসে উত্তর দিল,
“মামার জন্যে শুকনো রুটি আর কুমড়োর মলম, কিন্তু তুমি ভেবো
না সনুমামা, তোমার জন্যে পরোটা আর আলুরদম বানাবো”। হো হো করে হাসতে হাসতে সন্ময়
বলল,
“তোর পেটরোগা মামাটা খুব জব্দ হবে, বল কলমি, যখন ওকে
দেখিয়ে দেখিয়ে পরোটা খাব?” কলমি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফিক করে হাসল, তারপর
রান্নাঘরে ঢুকল। আমার সামনের সোফায় ধপাস করে বসে, সন্ময় ভুরু নাচিয়ে আমায় জিগ্যেস
করল,
“ঠিকঠাক আছিস দেখছি। কটা দিন কেমন কাটালি?”
“কেন বলতো? রিটায়ার করে এখন ঘরে বসে সময় কাটাই, সব দিনই এক
রকম, নতুনত্ব কিছুই নেই”!
“কিছুই হয়নি, এ কদিনে? কোন আশ্চর্য ঘটনা”? চোখ ছোট করে
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সন্ময় জিগ্যেস করল। বলব কি বলব না ভেবেও, আমি কিন্তু কিন্তু
করে বলেই ফেললাম,
“কই তেমন কিছু তো হয়নি। তবে, তিন-তিনটে দুর্ঘটনা থেকে
নির্ঘাৎ বেঁচে গেছি”!
“কী রকম? শুনি!” আমি শুক্র, শণি আর রবিবারের তিনটে ঘটনার
কথাই বললাম, অদ্ভূত সেই বেড়ালের হাত নাড়া সমেত। খুব মন দিয়ে শুনেটুনে সন্ময়
স্বস্তির শ্বাস ফেলল, তারপর উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“একবার ওঠ তো!” আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“কেন?” সন্ময় কোন উত্তর তো দিলই না, উল্টে ঝেঁজে উঠে
জিগ্যেস করল,
“আঃ, ওঠ না, উঠে দাঁড়াতে তোর কষ্ট হচ্ছে নাকি?” অগত্যা উঠে
দাঁড়ালাম। আমি যে সোফাটায় বসেছিলাম, তার
বসার গদির নিচে হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। একবার ডানদিক, তারপর বাঁদিক
কোণাদুটো খুঁজে আপনমনেই বলল,
“যাচ্চলে, এই খানেই তো রেখেছিলাম, গেল কোথায়?” আমি কৌতূহলে
জিগ্যেস করলাম,
“কী খুঁজছিস বলতো”?
“আরে, প্লাস্টিকের একটা কৌটো। যাতে খইনি আর চুন
রাখে”। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“ওটা তুই রেখেছিলি? তুই কী আজকাল খইনি খাওয়া ধরেছিস নাকি,
এই বয়েসে? সোফা ঝাড়তে গিয়ে কলমি ওটা পেয়ে আমাকে খুব ধমকাচ্ছিল, “মামা তামাক খেও
না, ক্যানসার হবে!”” সন্ময় এবার কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, আমার দিকে
সোজাসুজি তাকিয়ে বলল,
“অঃ, তার মানে ওটা এখন তোর হাতে? তার মানে ওটা তুই খুলেছিস
এবং নিশ্চয়ই মণিটাও পেয়েছিস?”
“তা পেয়েছি, কিন্তু কী ব্যাপার বলতো? হঠাৎ তুই না বলে কয়ে
আমার সোফায় ওটা রেখে গেলি কেন?” সন্ময়
ধপাস করে আমার সোফায় বসল, আর আমিও বসলাম, সন্ময়ের সোফাটায়। সন্ময় বলল,
“মাকে তুই তো চিনিস, আমার থেকেও মা কোন কোন সময় তোকে অনেক
বেশি ভালোবাসে”! মুখ টিপে হেসে আমি বললাম,
“মায়ের ভালোবাসা নিয়ে হিংসে করছিস? দাঁড়া মাসিমাকে গিয়ে
আমি বলবো!” সন্ময় সেকথায় কোন গুরুত্বই দিল না, বলল,
“যাঃ যাঃ বলবি তো বলবি। কদিন আগে, কী করে জানি না, মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, তোর সামনে খুব বিপদ। শুক্র থেকে রবি এই তিনদিন পার করতে পারলেই ব্যস্। আমাকে মা বললেন, সনু, শিগ্গির যা, মনুর ঘরে কাউকে কিচ্ছু না বলে, যেখানে হোক এটা রেখে আসবি। বেষ্পতিবার এসেছিলাম, রেখে গিয়েছিলাম। আজ আবার মা বললেন, যা তো দেখে আয়, মনুটা কেমন আছে! আসার সময় মনুকে সঙ্গে নিয়ে আসবি, আর জিনিষটাও নিয়ে আসবি। তাই আজ আবার চলে এলাম”। এ সময় কলমি এল জলখাবার নিয়ে, দুজনের জন্যেই পরোটা আর আলুরদম। গরম গরম পরোটা খেতে খেতে আমরা ওই বেড়ালটা আর সব ঘটনাগুলো নিয়েই আলোচনা করছিলাম। অলৌকিক ঘটনা যে আজও ঘটে সে বিষয়ে আমাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না।
৫
সোমবার শেষ দুপুর
আমাদের দুপুরের খাওয়া শেষ হতে অন্নদাদিদি চলে গেল। অন্নদাদিদিকে
বলে দিলাম, আমি একটু পরেই সন্ময়ের বাড়ি যাবো, ফিরবো কাল সন্ধে নাগাদ, তার মানে সেই
অব্দি কলমি, অন্নদাদিদি দুজনেরই ছুটি। খইনির
ডিব্বে সমেত সেই পাথরটা আমি সন্ময়কে আগেই ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। সন্ময় বেরিয়ে গিয়ে
গাড়িতে গিয়ে বসল, যাবার সময় বলল,
“আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি, তুই তালা-টালা লাগিয়ে আয়”। সব ঘরের
জানালা দরজা বন্ধ করে, সদরের তালা লাগিয়ে, পকেটে চাবি নিয়ে, আমি সন্ময়ের গাড়িতে
উঠলাম হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে। তার মধ্যে আছে পাজামাপাঞ্জাবি, টুথব্রাশ,
শেভিংসেট এরকম কিছু টুকটাক। আমি উঠতেই সন্ময় গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল,
“সিটবেল্ট লাগা”। আমি বাঁদিক থেকে সিটবেল্টটা টানতে ঘাড়
ঘোরালাম, আর দেখলাম, সেই বেড়ালটা আমার সদর দরজার সামনে বসে হাত নাড়াচ্ছে! দেখেই
আমি চমকে উঠলাম। সর্বনাশ, তার মানে আবার কিছু বিপদ ঘটবে! আতঙ্কে আমি সিটবেল্ট
বাঁধা বন্ধ করে, সন্ময়কে বললাম,
“আমি যাবো না, সনু। সামনে বিপদ!” সন্ময় স্টার্ট বন্ধ করে
বলল,
“বিপদ? কোথায় বিপদ? তোর হঠাৎ আবার কী হল, বলবি তো?” আমি
কোন উত্তর না দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। সদর দরজার দিকে এগোনোর সময়ও দেখলাম
বেড়ালটা বসে আছে, অন্যদিন এতক্ষণ থাকে না। সন্ময়ও গাড়ি থেকে নেমে এল, আমার কাছে
আসতে আসতে বলল,
“কী হল বলতো তোর?” আমি বললাম,
“বেড়াল। দেখছিস না?” সন্ময়ও বলল,
“বেড়ালই তো। তাতে অবাক হবার কী আছে?” আমি ততক্ষণে দরজার
সামনে পৌঁছে গেছি, বেড়ালটা একভাবেই বসে আছে, আমাকে এত কাছে যেতে দেখে মুখ তুলে
তাকিয়ে লেজটা নাড়ল, মিঁহি সুরে ডাকল “মিঁয়াও”। তারপর টুকটুক করে হেঁটে গিয়ে লাফ
দিয়ে উঠল আমাদের পাঁচিলে! সেখান থেকে আরেক লাফে চলে গেল পাশের বাড়ির জানালার
কার্নিশে। আর সেখান থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে স্পষ্ট বলল,
“আসল বেড়াল আর নকল বেড়াল চেনেন না, আচ্ছা উজবুক লোক আপনি,
মশাই। নিরিবিলি ধাপিতে বসে, আরাম করে একটু কান চুলকোচ্ছিলাম, সামনে চলে এলেন
বিরক্ত করতে?” বলেই সে আর দাঁড়াল না, জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে লাফ দিল! আর দেখতে
পেলাম না তাকে।
("শুকতারা"য় প্রকাশিত ও "এক কুড়ি কিশোর" গ্রন্থে সংকলিত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন