[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে
"ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।
এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে, স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে
ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
দ্বিতীয় পর্ব - ৫ম পর্বাংশ
(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)
২.৫.৩ মহাভারতে সমাজ কথা
সমাজের একক যদি ধরা হয় পরিবার, সেক্ষেত্রে
পরিবারের অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বিবাহ। বিবাহ ছাড়া
দাদু-ঠাকুমা-মাতা-পিতা-পুত্র-কন্যা-ভাই-বোন সম্পর্কগুলির প্রবাহ, নির্দিষ্ট
অবস্থান, অধিকার
ও দায়িত্ব নির্ণয় করা যায় না। এই বিবাহ সম্পর্কে মহাভারতের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর
দিকে নজর রাখা যাক।
ঋষি উদ্দালকের পুত্র ঋষি শ্বেতকেতু আর্যসমাজে
প্রথম বিবাহ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ এসেছিল নিজের অক্ষমতার কারণে
রাজা পাণ্ডু যখন পত্নী কুন্তীকে নিয়োগ প্রথায় সন্তান ধারণের কথা বোঝাচ্ছিলেন। তিনি
পত্নী কুন্তীকে বলছেন,
“হে সুমুখশ্রীযুক্তে,
আগেকার দিনে মহিলারা অনাবৃত ছিলেন। তাঁরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারতেন। তাঁদের
কারও অধীনে থাকতে হত না। যৌবনে তাঁরা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে আসক্ত হলে কোন
দোষের হত না। ইতর প্রাণী অর্থাৎ পশুপক্ষীরা আজও তাই করে থাকে। উত্তরকুরু[1]-তে আজও এই প্রথাই চালু রয়েছে।
হে চারুহাসিনি, এই
(বিবাহের) প্রথা কীভাবে এদেশে প্রচলিত হয়েছিল, বলছি শোন। প্রাচীন কালে উদ্দালক নামে
এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁর
পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আছেন, এমন সময় এক
ব্রাহ্মণ এসে তাঁর মায়ের হাত ধরে বললেন, “এস, আমরা যাই”। পিতার সামনেই মাতাকে জোর
করে তুলে নিয়ে যাওয়াতে মহর্ষিপুত্র ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তাই দেখে মহর্ষি উদ্দালক
বললেন, “বৎস, ক্রোধ করো
না। এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। গাভীদের মতো মহিলারাও সজাতীয় শত-সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও, কোন দোষের
হয় না”। মহর্ষি পুত্র পিতার কথা শুনে আরও ক্রুদ্ধ হলেন এবং এরপর মানব সমাজে জোর
করে এই নিয়মের প্রচলন করে বললেন, “আজ থেকে যে স্ত্রী পতি ছাড়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে এবং
যে পুরুষ পতিব্রতা স্ত্রীকে ছাড়া অন্য মহিলায় আসক্ত হবে, দুজনকেই
ভ্রূণহত্যার মতো ঘোরতর পাপের পাঁকে লিপ্ত হতে হবে। আর স্বামী পুত্র লাভের ইচ্ছায়
নিয়োগ করলে যে স্ত্রী তাঁর আজ্ঞা অমান্য করবে, তারও ওই একই পাপ হবে”। [আদি/১২২][2]
এর অর্থ আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার বেশ কয়েকশ
বছর পরে, “বিবাহ”
নামক প্রথম সামাজিক অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করেছিল। মহারাজ পাণ্ডুর মুখে আমরা এই কথা
যখন শুনলাম, তখনও
যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম হয়নি, তাঁদের জন্ম বিষয়ে তাঁদের পিতা-মাতার
মধ্যে সবে মাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। অতএব কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ যদি ঐতিহাসিক মতে ৯০০
বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়ে হয়ে থাকে, তাহলে রাজা পাণ্ডু ও রাণি কুন্তীর এই
কথোপকথন তার থেকে আরও বছর চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগেকার, অর্থাৎ ৯৫০
বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়ের ঘটনা অনুমান করা যায়। উত্তরকুরু যদি উত্তরভারতেরই
কোন অঞ্চল হয়, সেক্ষেত্রে
তখনও সেখানে বিবাহ প্রথার চল শুরু হয়নি। আর উত্তরকুরু যদি কিরঘিজস্তানের কোন অঞ্চল
হয়, তাহলে
তো এই প্রথার প্রচলন হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কারণ, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমির নতুন
সামাজিক প্রথা, সে
সময় সুদূর কিরঘিজস্তানে কে প্রচার করবে? তবে আর্যরা নতুন দেশের সন্ধানে
কিরঘিজস্তান ছেড়ে বেরিয়ে পারস্য হয়ে, এদেশে পৌঁছতে অন্ততঃ দেড়-দু হাজার
বছর সময় নিয়েছিলেন। অতএব দেড়-দু হাজার বছর আগে ছেড়ে আসা কিরঘিজস্তানের সামাজিক
প্রথা নিয়ে, রাজা
পাণ্ডুর মাথাব্যথা থাকার কথা নয়, অতএব নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় উত্তরকুরু উত্তর ভারতেরই কোন
অঞ্চল।
অতএব মোটামুটি ১৫০০ বি.সি.ইতে, মূল ভারতীয়
উপমহাদেশে পা দেওয়ার পর,
আর্যদের বিবাহ নামক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানটিকে প্রথা হিসেবে প্রচলিতি
করতে প্রায় তিন-চারশ বছর লেগে গিয়েছিল। এবার অনেক মানুষ প্রশ্ন তুলবেন, আর্যদের মতো
তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন মানুষরা যদি মাত্র ১২০০-১১০০ বি.সি.ই-তে বিবাহের গুরুত্ব
উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে
আমি কী করে অনুমান করলাম,
অনার্যদের মতো মাথামোটা মানুষরা আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগেই সেটা
বুঝে ফেলেছিল?
এই অনুমানের প্রধানতম কারণ, অনার্যদের
গড়ে তোলা সিন্ধু সভ্যতা,
যার সূত্রপাত হয়েছিল,
আর্যরা এদেশে আসার অন্ততঃ দু-আড়াই হাজার বছর আগে। এই পর্বে আমরা দেখেছি, প্রায় ১৭৫০
বছর ধরে একটানা টিকে থাকা সিন্ধুসভ্যতা, যা পরিবারভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট
গোষ্ঠীর পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর পিছনে ছিল নিবিড় সামাজিক মৈত্রীবন্ধন ও যৌথ
উদ্যোগ। আর বলা বাহুল্য,
নিবিড় এই সামাজিক বন্ধন হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনি, তার পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের পথ চলা।
কাজেই আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে
বিবাহের সূত্রপাত মোটেই আশ্চর্যের নয়, কারণ অনার্য মানবগোষ্ঠীই বৈবাহিক
সম্পর্ক দিয়ে সমাজ গড়ে তোলার প্রাথমিক ধারণাটা আবিষ্কার করেছিল। একবার যখন এটা
শুরু হয়ে গেল, এর
সঙ্গে গড়ে উঠতে লাগল আরও নানারকম বৃহত্তর সামাজিক বন্ধনের উপকরণ। যার মধ্যে অন্যতম
বাণিজ্য। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রযুক্তি ও উদ্বৃত্ত সম্পদ আদানপ্রদানের
মাধ্যমে।
এখানে আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, চাষবাস শিখে
যাওয়ার পর, এদেশের
অনার্য অধিবাসীরা, নিজ
নিজ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী সামাজিক স্থিতাবস্থায় চলে এসেছিল। সামাজিক
স্থিতাবস্থা মানেই, নিজেদের
প্রচলিত প্রযুক্তি ও ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে থাকা এবং নতুন প্রযুক্তিকে চট করে গ্রহণ
করতে প্রাথমিক অনীহা।
উদাহরণে বলা যায়, আমাদের পিতাদের প্রজন্মে রেডিওর
ব্যবহারে অনীহা ছিল – তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, ছেলেমেয়েরা দিনরাত ‘লারেলাপ্পা’ গান
শুনে উচ্ছন্নে যাবে। তার বছর পঞ্চাশেক বছর পরে এল সাদাকালো টিভি। বাড়িতে টিভি
মানেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া মাথায় উঠবে। সারাক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে চোখ খারাপ হবে।
সন্ধে হলেই, সবাই
নিজের নিজের বাড়িতে বসে টিভি দেখবে, আর আড্ডা, গল্পগাছা, আত্মীয়স্বজন, লোকলৌকিকতা
চুলোয় যাবে, সামাজিকতা
উচ্ছন্নে যাবে। অতএব,
প্রচলিত স্থিতাবস্থা থেকে আমরা চট করে নিজেদের পরিবর্তন করতে চাই না। এই একই
কারণে আমাদের প্রাচীন অনার্য ভারতীয়দের, সামাজিক পরিবর্তনের এক পর্যায় থেকে
অন্য পর্যায়ে যেতে সময় লাগত অনেক বেশি। ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তন
হতে হতে, সিন্ধু
সভ্যতার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে, তাদের সময় লেগেছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর!
উল্টোদিকে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হয়ে, মূলতঃ
পশুপালক আর্যদের ছোট ছোট পারিবারিক গোষ্ঠীগুলি
এদেশে আসছিল ভাগ্যের সন্ধানে, তাদের উদ্দেশ্য শস্যশ্যামল প্রকৃতির
বরপুত্র এই দেশে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলা। নতুন এবং অচেনা পরিবেশে স্থিতু হয়ে
জাঁকিয়ে বসা। পেছনে আসা আরও আর্যগোষ্ঠী দলের তাড়া খেতে খেতে তারা যত উত্তর-পশ্চিম
ভারত থেকে পূর্ব আর দক্ষিণদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, ততই তারা অনার্য ভারতীয় সমাজের সঙ্গে
পরিচিত হচ্ছিল। পশুপালক এবং যাযাবর আর্যগোষ্ঠী ততই শিখছিল, অনেক মানুষ
মিলে স্থায়ী গ্রাম বা জনবসতি গড়ে তোলার সামাজিক নিয়ম-কানুনগুলো। এভাবেই ভারতের
প্রাচীন অনার্য সমাজের থেকে তারা সামাজিক বন্ধনের প্রথম চাবিকাঠি যে “বিবাহ” –
সেটা বুঝে ফেলল, মাত্র
সাড়ে তিনশ কি চারশ বছরের ভেতরে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনাত্মীয়া নারী ও পুরুষের মধ্যে
সাংসারিক বন্ধনের যে সামাজিক অনুষ্ঠান, যার সংস্কৃত নাম “বিবাহ”, সেই
অনুষ্ঠানের অধিকাংশ রীতি ও প্রথাই এসেছে অনার্য সংস্কৃতি থেকে। অর্থাৎ পাত্র ও
পাত্রীর প্রাক-বিবাহ এবং বিবাহ-পরবর্তী যাবতীয় প্রথা, সবই
অনার্যদের রীতি। এর মধ্যে আর্য রীতি ঢুকেছিল যজ্ঞের অগ্নিকে সাক্ষী রেখে, সংস্কৃত
মন্ত্র উচ্চারণ করে বর ও কনের সারাজীবন একত্রে থাকার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ। আর্যদের
অগ্নি ছিল অন্যতম অবসেসন (obsession)
– জন্ম থেকে মৃতদেহ সৎকার তাদের জীবনের প্রতিটি অনুষ্ঠানের
আবশ্যিক উপকরণ হল আগুন। প্রসঙ্গতঃ আর্যরাই আমাদের দেশে শবদাহের প্রথারও প্রচলন
করেছিল।
অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, ঠিক এই সময়
থেকেই, সংস্কৃত
ভাষার মোড়কে অনার্য সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য-ধর্মে ঢুকে পড়ল এবং সম্ভবতঃ এটাই তার
হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। বিবাহ-অনুষ্ঠানের সৃষ্টি যদি
ব্রাহ্মণ্যধর্মের হত,
সারা ভারতে তার প্রকরণ মূলতঃ একই রকম থাকত। কিন্তু তেমনটা হয়নি, ভারতের
বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে, আঞ্চলিক নিজস্ব রীতি ও প্রথায় বিচিত্র ধরনের বিবাহ-অনুষ্ঠান
হয়ে থাকে, যার
মধ্যে অগ্নিসাক্ষী রেখে পাত্র-পাত্রীর জীবন সঙ্গী হয়ে ওঠার শপথ গ্রহণেই একমাত্র
মিল দেখতে পাওয়া যায়।
এই আনুষ্ঠানিক বিবাহ সহ মহাভারতে আটপ্রকার
বিবাহের বিধান দেওয়া আছে,
সেই আটটি হল,
১. ব্রাহ্ম – বরের বিদ্যা, বুদ্ধি ও
বংশ বিচার করে, কন্যাকর্তা
যখন কন্যাদান করেন।
২. দৈব - যজ্ঞের ঋত্বিকের উপর সন্তুষ্ট কন্যার
পিতা যদি তাঁকে কন্যা দান করেন।
৩. আর্য – কন্যার শুল্কস্বরূপ বরের থেকে দুই বা
ততোধিক গো গ্রহণ করে কন্যাদান।
৪. প্রাজপত্য– বরকে প্রচুর ধনরত্নে সন্তুষ্ট করে
কন্যাদান।
৫. আসুর – কন্যাপক্ষকে প্রচুর ধনসম্পদে সন্তুষ্ট
করে, কন্যা
গ্রহণ।
৬. গান্ধর্ব -
বর ও কন্যার প্রণয় থেকে যে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
৭. রাক্ষস – কন্যাপক্ষ কন্যা দানে রাজি না হলেও, বর যদি
গায়ের জোরে ক্রন্দনরতা কন্যাকে বিবাহ করে।
৮. পৈশাচ – ঘুমন্ত অথবা প্রমত্তা কন্যাকে বলাৎকার
করে, রমণ
করা। [অনু/৪৪]
উপরের আটটি বিবাহ পদ্ধতির মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব এবং
প্রাজপত্য সকলের জন্য ধর্মসঙ্গত। এই প্রথার বিবাহ অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের অভিভাবকের
সম্মতি আবশ্যিক ছিল। গান্ধর্ব ও রাক্ষস ক্ষত্রিয়দের পক্ষে চলতে পারে। আর্য ও আসুর
নিন্দনীয়। পৈশাচ বিবাহ সমাজে নিন্দিত। এই বিবাহ প্রথার নিয়মগুলি থেকে আন্দাজ করা
যায়, আর্য
সমাজে তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বিবাহ অনুষ্ঠান ছাড়াও, নারী-পুরুষের
কিছু নিন্দনীয় সম্পর্কও প্রচলিত ছিল। যাকে সমাজ একধরনের বিবাহ বলেই স্বীকৃতি
দিয়েছে। অতএব আর্যদের প্রাচীন সামাজিক রীতির কিছুটা আভাস এর থেকে আন্দাজ করা যায়। এ
ছাড়াও আরেকটি ধর্মসঙ্গত বিবাহের প্রথা ছিল, স্বয়ংবর বিবাহ। যদিচ সেই প্রথা
সাধারণের জন্যে নয়, বিশেষ
কোন অসামান্যা রাজকন্যার জন্যে প্রচলিত ছিল।
যদিও ধর্মসঙ্গত প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মহাভারতের
বেশ কয়েকটি প্রধান চরিত্র,
কামনা চরিতার্থ করেছিলেন। যেমন,
দুষ্মন্ত-শকুন্তলা – শকুন্তলা
তাঁর পালক পিতা কণ্বমুনির অনুমতি ছাড়া মিলিত হতে না চাইলেও, দুর্দান্ত
রাজা, দুষ্মন্ত
বলেছিলেন, “তোমার
শরীর তোমারই অধীন, পিতার
অপেক্ষার প্রয়োজন কী?
আত্মাই আত্মার বন্ধু,
আত্মাই আত্মার গতি। অতএব তুমি নিজেই আমাতে আত্মসমর্পণ করতে পারো”।
(আদি/৭৩) আশ্রমবাসিনী এক কিশোরীকে কামনা
করে দুষ্মন্তের মতো বিখ্যাত রাজার এই প্ররোচনামূলক উপদেশ তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি!
প্রসঙ্গতঃ তাঁদের এই মিলনে জাত পুত্রের নাম, ভরত, যাঁর থেকে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ।
পরাশর-সত্যবতী –
সর্বজনশ্রদ্ধেয় ঋষি পরাশর,
কুমারী ধীবরকন্যা সত্যবতী (মৎস্যগন্ধা)-কে কামনা করায়, সত্যবতী
বলেছিলেন, “ভগবন্, আমি পিতার
অধীন, সুতরাং
আপনি সংযত হন। আমার কৌমার্য নষ্ট হলে আমি কী করে পিতৃগৃহে বাস করব?” (আদি/৬৩)।
কিন্তু ঋষি সে কথায় নিরস্ত হননি। মিলনের আগে তিনি কন্যাকে পদ্মগন্ধী করে তোলেন এবং
মিলনের পরেও কন্যার অক্ষত কৌমার্যের বর দিয়ে ঋষি পরাশর সত্যবতীর সঙ্গে নির্জন এক
নদী-দ্বীপে মিলিত হন। তাঁদের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস – বেদের সংকলক ও
মহাভারতের রচয়িতা! এই ধীবরকন্যা সত্যবতীই আবার ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতামহী এবং
বেদব্যাস তাঁদের পিতা! অর্থাৎ কৌরব আর্যগোষ্ঠীর রক্তে ওতপ্রোত মিশে গিয়েছিল অনার্য
রক্ত।
সূর্য্য-কুন্তী – মুনি
দুর্বাসার বরের সত্যতা পরীক্ষা করতে কৌতূহলী কিশোরী ও কুমারী কুন্তী সূর্যকে
আহ্বান করেছিলেন। সত্যি সত্যি সূর্যদেব যখন উপস্থিত হলেন, কুন্তী ভয়ে
এবং লোকলজ্জায় বলেছিলেন,
“দেব, আমার
পিতামাতা প্রমুখ গুরুজন আমাকে দান করার অধিকারী। দয়া করে আমাকে অধর্মে লিপ্ত করবেন
না”। (বন/৩০৫)। বলা বাহুল্য, সূর্যদেব কুমারী কুন্তীকে দয়া করেননি এবং তাঁদের মিলনে জাত
পুত্রের নাম, কর্ণ।
মহাভারতে অর্জুনের পরেই সব থেকে বর্ণময় চরিত্র।
সাধারণ সমাজে পুরুষের এক বিবাহের প্রচলন থাকলেও, রাজপরিবারের
বহুবিবাহ সাধারণ ঘটনা ছিল। অতি প্রাচীন পৌরাণিক কালে ব্রহ্মার মানসপুত্র
দক্ষ-প্রজাপতি, তাঁর
তেরটি কন্যা মারীচ-কশ্যপকে,
দশটি কন্যা ধর্মকে এবং সাতাশটি কন্যা চন্দ্রকে দান করেছিলেন। মহারাজা পাণ্ডুর
দুই পত্নীর - কুন্তী ও মাদ্রীর সংস্থান করেছিলেন, তাঁর পিতৃব্য মহামতি ভীষ্ম। পাণ্ডব
ভাইদের যৌথ পত্নী দ্রৌপদী ছাড়াও সকলেরই অন্য পত্নী ছিলেন।
পাণ্ডবদের পাঁচ ভাই মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করা, আর্যসমাজে বিরলতম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই বিবাহের অনুমোদন ও আয়োজন স্থির করতে রাজা দ্রুপদের রাজসভায় বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। রাজা যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, পুরাকালে জটিলা নামের এক ধর্মপরায়ণা গৌতমবংশীয়া কন্যা সাতজন ঋষিকে বিবাহ করেছিলেন। বার্ক্ষী নামের আরেক মুনিকন্যা প্রচেতা নামের দশভাইকে বিবাহ করেছিলেন। তারপরে আরও বললেন, পণ্ডিতেরা বলেন, গুরুর আদেশই ধর্ম এবং সে আদেশ নিঃসংশয়ে পালন করা উচিৎ। পুত্রদের কাছে মায়ের থেকে পরমগুরু আর কে হতে পারেন, সেই মা-ই আমাদের এই আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তবুও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না, কারণ বিরোধীদের যুক্তিগুলিও ছিল অকাট্য এবং সারগর্ভ। এই সময়েই রাজসভায় উপস্থিত হলেন স্বয়ং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি উভয়পক্ষের কথা শুনে বললেন, যুধিষ্ঠির যে কথা বলেছেন, সেটাই সনাতন ধর্ম। তাছাড়া পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বিষয়ে আমি এমন কিছু গুহ্য তত্ত্ব বলব, যা সকলের সামনে বলা যাবে না। তিনি রাজা দ্রুপদের হাত ধরে, রাজার নিভৃত মন্ত্রণা কক্ষে গেলেন, সেখানে আর যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন, মাতাকুন্তী, পঞ্চপাণ্ডব এবং রাজা দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। সেখানে তিনি পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের এক পৌরাণিক কাহিনী শোনালেন। পরিশেষে বললেন, এই বিবাহ পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির নির্দেশ, অতএব এই বিবাহে কোন ভাবেই কোন অধর্ম ঘটতে পারে না। (আদি/১৯৬,১৯৭) এই আলোচনার পর সকল বিতর্কের অবসান হয়েছিল এবং পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ নির্বিঘ্নেই ঘটে গিয়েছিল।
সে সময় কিন্নরদেশে (আধুনিক হিমাচলের একটি জেলা)
নারীর বহুস্বামীত্ব (Polyandry)
প্রচলিত ছিল এবং আজও নাকি কিন্নরের কোন কোন গ্রামে এমন প্রথার প্রচলন আছে।
মহাভারত এবং পুরাণে কিন্নরী নর ও নারীদের গীত ও রূপের প্রশংসা করা হয়েছে বারবার।
অতএব অনার্য কিন্নরদের সঙ্গে আর্যদের ঘনিষ্ঠ পরিচিতি ছিল, একথা সহজেই
অনুমান করে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনীর মোড়কে, দ্রৌপদীর
পঞ্চ-স্বামীত্ব হয়তো কিন্নরী প্রথার অনুসরণ!
বিবাহের অনুষ্ঠান ছাড়াও রাজপরিবারে বংশরক্ষার
জন্যে নানাবিধ উপায় তখন বহুল প্রচলিত ছিল। নিঃসন্তান বিধবা এমনকি সধবা নারীদেরও
নিয়োগ-প্রথায় সন্তান ধারণ করতে হত। সাধারণতঃ এই নিয়োগের পুরুষরা হতেন, পতির ভাই বা
গুণসম্পন্ন কোন সৎ-ব্রাহ্মণ। আবার অন্যদিকে বিবাহের অনুষ্ঠান ছাড়াই, রাজন্যবর্গ
এবং উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা অন্তঃপুরের দাসীদের সঙ্গেও কামনা চরিতার্থ করেছেন
বারবার। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে রাণিরাও অবাঞ্ছিত পুরুষদের সংস্রব এড়াতে দাসীদের
ব্যবহার করেছেন। অতএব রাজা বা ধনী ঘরের প্রভু এবং প্রভুপত্নীরা তাঁদের খেয়ালখুশি
মতো দাসীদের যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করতেন। মহাভারত থেকে দু একটা উদাহরণ দিলে, এই দুটি
বিষয়ই স্পষ্ট হবে।
কুরুবংশ রক্ষার কারণে, অকালে মৃত
রাজা বিচিত্রবীর্যের দুই নিঃসন্তান পত্নীতে রাজমাতা সত্যবতী মহর্ষি বেদব্যাসকে
নিয়োগ করেছিলেন। এই বেদব্যাস ছিলেন, রাজামাতা সত্যবতীর কুমারী বয়সের
পুত্র, অতএব
রাজা বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্রেয়[3]দাদা, বিধবা দুই
বধূর ভাশুর। বিধবা দুই রানী, অম্বিকা ও অম্বালিকা মহর্ষির রূপ ও চেহারায় মোটেই স্বস্তি
পাননি। অম্বিকা চোখ বন্ধ করে এবং অম্বালিকা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে মহর্ষিকে শয্যায় সহ্য
করেছিলেন। যার ফলে, অম্বিকার
পুত্র হল জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডুর[4] বর্ণের
পাণ্ডু। পৌত্রদের দেখে রাজমাতা সত্যবতী খুশি হলেন না, তিনি পুত্র
বেদব্যাসকে আরেকবার অম্বিকার জন্য নিয়োগ করলেন। কিন্তু অম্বিকা এবার নিজে না গিয়ে, তাঁর
বিশ্বস্ত এক দাসীকে মূল্যবান বস্ত্র ও অলংকারে রাণি সাজিয়ে শয্যায় পাঠালেন। সেই
শূদ্রাদাসী ভক্তিভরে মহর্ষিকে গ্রহণ করলেন, তাঁর পুত্র হলেন, মহাত্মা
বিদুর।
অন্ধতার কারণে জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও ধৃতরাষ্ট্র
রাজা হতে পারলেন না,
কুরু বংশের সিংহাসনে বসলেন পাণ্ডু। বেশ কিছুদিন দাপটে রাজত্ব করার পর, তিনি দুই
পত্নী সহ রাজ্য ছেড়ে বনবাসী হলেন। শারীরিক অক্ষমতায় তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। এই
বনবাসের সময়, স্বামীর
সকরুণ অনুরোধে, দুর্বাসা
মুনির থেকে পাওয়া বরের সাহায্যে রাণি কুন্তী তিনটি পুত্রের জন্ম দিলেন, যুধিষ্ঠির, ভীম ও
অর্জুন, যথাক্রমে
ধর্মদেব, পবনদেব
ও দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসাদে। তারপর স্বামী ও সতীন মাদ্রীর একান্ত অনুরোধে, কুন্তী
মাদ্রীকেও যমজ পুত্রের জন্ম দিতে সাহায্য করলেন, নকুল ও সহদেব, দেবযুগল
অশ্বিনীকুমারের প্রসাদে।
গান্ধারী তাঁর সুদীর্ঘ গর্ভাবস্থায় যখন কাতর হয়ে
পড়েছিলেন, এক
বৈশ্যা পরিচারিকা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যা করতেন। তাঁর গর্ভে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের
পুত্র যুযুৎসুর জন্ম হয়। পাণ্ডবেরা যখন বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন, সেসময়
দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী ছদ্মনামে রাণি সুদেষ্ণার পরিচারিকা ছিলেন। বিরাট রাজের শ্যালক
ও সেনাপতি কীচকের হাতে,
রাণি সুদেষ্ণার প্ররোচনায় এবং বিরাট রাজার ঔদাসীন্যে, সৈরিন্ধ্রীকে
যে ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অন্তঃপুরের দাসীদের কতটা দুর্গতি
নীরবে সহ্য করতে হত। এমনকি কৌরব রাজসভায়, পাশা খেলায় সর্বস্ব হারানো
পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীকে “দাসী” সম্বোধন করে, দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং
কর্ণ যে আচরণ করেছিলেন,
তার থেকেও দাসী সম্পর্কে তাঁদের কদর্য ধারণাই স্পষ্ট হয়। বস্তুত মহীয়সী নারী
দ্রৌপদীর বারবার ভাগ্য বিড়ম্বনা না ঘটলে, রাজান্তঃপুরের পরিচারিকা ও দাসীদের
দুর্গতির কথা আমরা হয়তো জানতেও পারতাম না।
মহাভারত গ্রন্থের এইখানে অনন্যতা, রাজা-রাজড়াদের
স্তব-স্তুতি মূলক অতিরঞ্জন বর্ণনা যেমন আছে, তেমনই আছে এমনই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা
অনেক ঘটনার উদ্ঘাটন। এবার আমরা মূল আলোচনায় আবার ফিরে যাই।
২.৫.৪ বর্ণভেদের সমাজ
শুরুতে আর্যদের গোষ্ঠীতে প্রাথমিক ভাবে কোন
বর্ণভেদ ছিল না। খুবই স্বাভাবিক, পরিবারভিত্তিক গোষ্ঠীর একই পরিবারের মধ্যে বর্ণভেদ হয় কী
করে? অন্য
পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যখন সমাজ গড়ে উঠতে লাগল, তখনই
বর্ণভেদের সূত্রপাত। প্রথম দিকে পারিবারিক গোষ্ঠীর সদস্যরা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন, কারণ ভগবান
ব্রহ্মা ছিলেন তাদের সবার পিতামহ। তবে সেই ব্রাহ্মণ চতুর্বর্ণের ব্রাহ্মণ নন, বলাই
বাহুল্য।
আর্যদের বহু গোষ্ঠী এবং অনার্য মানুষদের নিয়ে যখন
বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠার সূত্রপাত হল, তখন দেখা গেল, কিছু মানুষ
চিন্তাভাবনা, শাস্ত্র-টাস্ত্র
এবং ঈশ্বরের ধ্যান নিয়ে শান্তিতে থাকতে ভালোবাসেন - এগুলি তাঁদের সত্ত্বগুণ। কিছু
মানুষের স্বভাব মারকুটে,
হাঁকডাক করা এবং কর্তৃত্ব ফলানো – এগুলি রজোগুণ। কিছু মানুষের স্বভাব সারাদিন
কিছু না কিছু কাজ করে যাওয়া। অনার্যদের থেকে শিখে কেউ চাষবাস করছে, মাটির পাত্র, হাঁড়ি-কলসি
বানাচ্ছে। কাঠ দিয়ে রথের চাকা, আসবাবপত্র বানাচ্ছে। লোহা পিটিয়ে যন্ত্রপাতি অস্ত্র-শস্ত্র
বানাচ্ছে। এগুলির কিছু রজো আবার কিছু তমোগুণ। আবার কিছু মানুষ একটু বোকাসোকা
ধরনের। নিজে থেকে তেমন কিছুই করতে পারে না, কিন্তু অন্যে বলে দিলে, মন দিয়ে সে
কাজটা করতে পারে অথবা অন্যের সেবা করতে পারে – এটি তমোগুণ। এই ভাবেই গুণগতভাবেও
চার বর্ণের সূত্রপাত হল,
যথাক্রমে ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়, বৈশ্য
এবং শূদ্র (শান্তি/১৮৮)। প্রসঙ্গতঃ মহাভারতের এই অধ্যায়েই বলা হয়েছে, ভগবান্
ব্রহ্মা “দেব, দানব, গন্ধর্ব, দৈত্য, অসুর, যজ্ঞ, রাক্ষস, নাগ, পিশাচ এবং
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই
চতুর্বিধ মনুষ্যজাতির” সৃষ্টি করেছিলেন। কাজেই এই পর্যায়ে শুধু আর্যরাই ব্রহ্মার
সন্তান – এমন সীমিত ধারণা থেকে পিতামহ ব্রহ্মার মুক্তি মিলল।
সামাজিক এই বিন্যাস নিয়ে মানুষের মনে যাতে কোন
বিভ্রান্তি না আসে তার পেছনে একটা ধর্মীয় মোড়ক প্রয়োজন। আগে সব মানুষের সৃষ্টি
হয়েছিল ব্রহ্মার থেকে,
এখনও তাঁরা তাই রইলেন। কিন্তু তাঁদের জন্মস্থান বদলে গেল। ব্রাহ্মণদের জন্ম হল
ভগবান ব্রহ্মার মুখ থেকে,
তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয়দের, উরু থেকে বৈশ্যদের এবং পা থেকে শূদ্রদের (ভীষ্ম/৬৭)। এবং
তাঁদের মধ্যে সত্ত্ব,
রজঃ এবং তমঃ– এই তিনটি গুণগত পার্থক্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হল, কেন তাঁরা
একে অপরের থেকে আলাদা ও নিকৃষ্ট। চার বর্ণের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেকটি
বর্ণই জন্মগত বর্ণ। অর্থাৎ জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের
সন্তান ক্ষত্রিয়, ইত্যাদি।
প্রত্যেক বর্ণেরই প্রধান কর্মসমূহ নির্দিষ্ট ছিল, যার কথা
আগেই বলেছি। কিন্তু বর্ণ অনুযায়ী কর্ম না করলেও ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হত
না। যেমন পরশুরাম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য
এবং তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা,
এঁরা সকলেই ভয়ংকর যোদ্ধা এবং প্রথম তিনজন তো রণশিক্ষকও। তাঁদের কাজ-কর্ম আচার
আচরণ দেখে ব্রাহ্মণ বলে যেন মনেই হয় না, বরং নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয়বর্ণ
অনুসারী। কিন্তু তাও তাঁরা ব্রাহ্মণ। আচার্য দ্রোণকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
ধৃষ্টদ্যুম্ন নিহত করেছিলেন বলে, তিনি ব্রহ্মহত্যার পাতকী হয়েছিলেন। একজন ব্রাহ্মণ বেদ-চর্চা
ও যাগ-যজ্ঞ ছেড়ে, রণক্ষেত্রে
অজস্র শত্রুসৈন্য হত্যা করলেন, তাতে বিন্দুমাত্র দোষ হল না। কিন্তু সেই রণক্ষেত্রেই তাঁকে
হত্যা করার জন্যে একজন ক্ষত্রিয় পাতকী হয়ে গেলেন! অশ্বত্থামা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের
অন্তে কাপুরুষের মতো রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকে শিশু ও বালকদের হত্যা
করেছিলেন, তাঁকে
অভিশাপ এবং শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অর্জুন, ভীম এবং ভগবান কৃষ্ণ তাঁকে হত্যা
করেননি, তিনি
ব্রাহ্মণ বলে। অতএব জন্মানোর সঙ্গেসঙ্গেই
পিতা-মাতার বর্ণ সন্তানদের বর্ণ হয়ে যেত। তবে কোন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়
অত্যন্ত গর্হিত কাজ করলে বা অনাচার করলে, শূদ্রসম-ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হয়ে
যেতেন এবং সমাজে পতিত হয়ে যেতেন (অনু/১৩৫)। যেমন অশ্বত্থামা হয়েছিলেন।
কিন্তু নিম্ন বর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণের মতো জ্ঞানী
ও ধার্মিক হলেও, তাঁকে
ব্রাহ্মণসম-শূদ্র বলার নিয়ম ছিল না। যেমন শূদ্রা দাসীর গর্ভজাত মহর্ষি বেদব্যাসের
পুত্র বিদুর। তাঁকে অধিকাংশ সময়েই মহাভারতে “মহাত্মা বিদুর” বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাঁর মতামত এবং পরামর্শকে পাণ্ডবরা, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, মহামতি
ভীষ্ম অত্যন্ত সম্মান করতেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে দৌত্য করতে এসে, ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের আতিথ্য স্বীকার না করে, বিদুরের গৃহে রাত্রিযাপন করেছিলেন, তবুও তিনি
ব্রাহ্মণ-সম হতে পারেননি। তুলাধার নামে বারাণসীর এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর নাম জানা
যায়, যিনি
বর্ণে বৈশ্য কিন্তু ধর্মতত্ত্বে বিশেষ প্রাজ্ঞ ছিলেন। (শান্তি/২৬১, ২৬২)।
মিথিলা নগরীর এক মাংসবিক্রেতা ব্যাধ, মহাভারত যাঁকে ধর্মব্যাধ বলে বিশেষ
সম্মান দেখিয়েছেন, তিনিও
ধর্মশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ছিলেন। ধর্মব্যাধ শূদ্র এবং তুলাধার বৈশ্য ছিলেন বলেন, শূদ্র বা
বৈশ্যদের গর্ব করার কোন কারণই নেই। কারণ মহাভারত রচয়িতা, মনে করিয়ে
দিয়েছেন, এঁরা
দুজনেই পূর্বজন্মে ঋষি ছিলেন, সেই জন্মের সামান্য ভুলের জন্যে শাপগ্রস্ত হয়ে, এ জন্মে
যথাক্রমে শূদ্র ও বৈশ্য হয়েছেন। এই জন্মে তাঁরা সুকর্ম করছেন, অতএব
পরজন্মে তাঁরা আবার ঋষিই হবেন, এই জন্মের বৈশ্যত্ব বা শূদ্রত্ব নিছক কালক্ষেপ মাত্র!
অর্থাৎ জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো, এই আপ্তবাক্য ব্রাহ্মণ্য সমাজের
ক্ষেত্রে খাটে না।
এমন উদাহরণ আরও আছে, যেমন, সূতপুত্র
কর্ণ যখন আচার্য দ্রোণের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র শিখতে এসেছিলেন, তিনি কর্ণকে
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন,
কারণ কর্ণ সূতপুত্র - তিনি ক্ষত্রিয় রাজপুত্র নন। প্রিয় শিষ্য অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি
এমন অজুহাত খাড়া করেছিলেন। যেমন নিষাদ-রাজপুত্র একলব্যের শর-সন্ধানে আশ্চর্য
দক্ষতা দেখে, তাঁর
থেকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে,
ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নিয়েছিলেন। অথচ একলব্য নিষাদ বলে, আচার্য
দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণই করেননি। এই দুটি ঘটনা থেকেই আচার্য দ্রোণের
ব্রাহ্মণত্ব এবং তাঁর সাত্ত্বিক গুণ সম্পর্কে ঘোরতর সন্দেহ হয় বৈকি!
চতুর্বর্ণের বাইরেও মহাভারতে বেশ কয়েকটি জাতির
নাম পাওয়া যায়। এই জাতিগুলির নামকরণ প্রধানতঃ তাঁদের বৃত্তি অনুযায়ী হলেও, মহাভারতে
তাঁদের বর্ণসংকর বলে হেয় করা হয়েছে। যেমন, সৈরন্ধ্র জাতি, রাজা ও ধনী
পুরুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ,
সাজগোজ এবং সৈরিন্ধ্রীরা রাণি ও অন্তঃপুরিকাদের সাজসজ্জা ও প্রসাধনে নিযুক্ত
ছিলেন। এই কারণেই বিরাটরাজার অন্তঃপুরে ছদ্মবেশীনি দ্রৌপদী, সৈরিন্ধ্রী
নাম নিয়ে রাণি সুদেষ্ণার কেশবিন্যাস ও প্রসাধনের পরিচারিকা হয়ে ঢুকেছিলেন। সূত
জাতি, সাধারণতঃ
রাজাদের রথের সারথি হতেন,
আবার তাঁরা প্রায়ই রাজাদের স্তবগান এবং কথকতা, ধর্মকথা শোনাতেন। বৈদেহক নামে একটি
জাতির নাম পাওয়া যায়,
যাঁদের দায়িত্ব ছিল,
রাজপ্রাসাদ এবং অন্তঃপুর পাহারা দেওয়া এবং সুরক্ষিত রাখা। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত
অপরাধীদের যাঁরা মুণ্ডচ্ছেদ করতেন, তাঁদের চণ্ডাল জাতি বলা হয়েছে।
বস্ত্র ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল রজক জাতির। রাজসভায় উপস্থিত থেকে রাজা ও
অন্যান্য রাজ-অতিথির বন্দনা করতেন বন্দী জাতির মানুষরা। নিষাদ জাতির কাজ ছিল
মাছধরা। মদ প্রস্তুত করতেন,
মৈরেয়ক জাতি। মাছধরা কিংবা অন্য কাজের জন্যেও যাঁরা জাল বুনতেন, তাঁদের
আয়োগব জাতি বলা হয়েছে। দাস জাতির মানুষেরা নৌকা বানিয়ে এবং নৌকা চালিয়ে জীবিকা
অর্জন করতেন। (অনু/৪৮)। যাঁরা চিকিৎসা করে, অসুস্থকে
নিরাময় করতেন, তাঁরা
হলেন, অম্বষ্ঠ
বা বৈদ্যজাতি। এরকম আরও কিছু বর্ণসংকর জাতির নাম পাওয়া যায়, যাঁদের
বৃত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা পাওয়া যায় না, যেমন, উগ্র, শ্বপাক, পুক্কশ, স্তেন, মাগধ, করণ, ব্রাত্য
ইত্যাদি। (শান্তি/২৯৭)। এই ধরনের জাতিগুলিকে বর্ণ-সংকর বলে, সমাজে
নিজেদের বর্ণাশ্রমকে শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করাই যে সমাজরক্ষকদের প্রধান উদ্দেশ্য
ছিল, একথা
সহজেই অনুমান করা যায়।
২.৫.৫ সামাজিক ক্ষোভ ও অসন্তোষ
সামাজিক এই শ্রেণী বিভাগে অসন্তোষের সৃষ্টি
হয়েছিল শুরুর থেকেই। এতদিন যারা নিজেদের সুখ-দুঃখ নিয়ে নিজেদের সামাজিক ব্যবস্থায়
অভ্যস্ত ছিল, নতুন
বিভাজনে তাদের মনে ক্ষোভ ও বিরক্তি আসবেই। ব্রাহ্মণরাও তার আঁচ বুঝতে ভুল করেনি।
তারা এই অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রশমনের দাওয়াই নিয়ে এল - জন্মান্তর। এই জন্মে তোমরা
যে কষ্ট পাচ্ছো, তার
কারণ তোমাদের পূর্বজন্মের কৃতকর্ম। এই জন্মে মন দিয়ে নিজেদের কাজ করো, উচ্চশ্রেণীর
সেবা করো। ঝগড়াঝাঁটি,
ঝুটঝামেলা বাধিও না,
পরজন্মে তোমাদেরও ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ঘরে জন্ম হবে, তখন সুখই
সুখ।
ক্ষোভ এবং অসন্তোষ যতই হোক, অসহায়
অনার্যদের কিছু করারও ছিল না, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের এতদিনের ভরসা
দেব-দেবীদের কাছে আকুল প্রার্থনা করার স্বাধীনতাটুকুও তারা হারিয়ে ফেলছিল। সেখানেও
আর্য মানুষেরা বিদ্রূপ করে,
অবহেলা করে, কখনো
কখনো তাদের দেব-দেবীর মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দিল আবর্জনায়[5]। আর্যদের দেবতা ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ।
তাঁদের জন্যে আছে গ্রামভারি মন্ত্র, যজ্ঞ, যজ্ঞের আগুনে আহুতি। সে মন্ত্রের
ভাষা সাধারণ অনার্যদের কাছে দুর্বোধ্য। তারা দূর থেকে দেখে, পুরোহিতদের
গম্ভীর আচরণ, তাদের
পোষাক-পরিচ্ছদ, মন্ত্রের
উচ্চারণ, যজ্ঞের
আগুনে প্রচুর ঘি এবং প্রচুর আহুতি দান। যজ্ঞের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গ্রাম।
যজ্ঞশেষের ছাই উড়তে থাকে বাতাসে।
এই যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য
দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল
সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে
যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা,
রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য
সম্ভার, ধাতব
কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা
বুঝতেই পারে না, দেবতারা
কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে
কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের
পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে
মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের
পায়ে।
২.৬.১ জনপদ ও মহাজনপদ
মোটামুটি ৬০০ বি.সি.ইতে উত্তর-পশ্চিম এবং প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে বেশ কিছু রাজ্য গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। রাজ্য এবং রাজ্য-ব্যবস্থা বলতে ঠিক কী বোঝায় সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক।
যথেষ্ট বড়োসড়ো নির্দিষ্ট একটা এলাকা নিয়ে রাজ্য
গড়ে উঠতে পারে। সেখানে প্রয়োজনমত জনবসতি থাকতে হবে। সেখানকার মানুষ যথেষ্ট
উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদন করবে। শুধু মাত্র কৃষি সম্পদ নয়, আরও অনেক
কিছু। খনিজ সম্পদ, ধাতু, কিংবা
মূল্যবান পাথর, অরণ্য
সম্পদ, কাঠ, পশুসম্পদ ইত্যাদি। এক কথায় সম্পদ হল সব কিছু, যা থেকে
রাজ্যবাসীদের জীবনধারণ হয়ে যাবে এবং উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিবর্তে বাণিজ্য করে অন্য
রাজ্য থেকে অন্যান্য সম্পদও আমদানি করা যাবে। এর সঙ্গে শিল্প-সম্পদও যুক্ত হবে, যেমন ধাতব
যন্ত্রপাতি, অস্ত্র–শস্ত্র, বাসন-কোসন, কাঠের
আসবাবপত্র, মাটির
তৈজসপত্র, খেলনা, মূর্তি।
অতএব একটি রাজ্যে সর্বস্তরের যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ ও কুশল কর্মী থাকা আবশ্যিক।
কিন্তু এই সব কিছু থাকা সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট
অঞ্চল রাজ্য হয়ে উঠতে পারবে না, যতক্ষণ না তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে দক্ষ প্রশাসন। একজন কৃষক
অকারণ খেটে কেন উদ্বৃত্ত শস্য ফলাবে, যদি সেই উদ্বৃত্ত থেকে তার বাড়তি কোন
স্বার্থ পূরণ না হয়?
প্রশাসনের কাজ উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহ করাই নয়, আরও বেশি উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদনে
উৎসাহ দেওয়া। সাধারণ মানুষ এবং কর্মীরা যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে তাদের কাজে
মনোনিবেশ করতে পারে,
সেদিকে লক্ষ্য রাখা। বাইরের আক্রমণ, লুঠ-তরাজ থেকে তাদের রক্ষা করা।
প্রশাসনের আরও কাজ রাজ্যের সম্পন্ন বণিকদের রাজ্যের ভিতরে এবং অন্য রাজ্যের সঙ্গেও
বাণিজ্যে উৎসাহ দেওয়া।
এই সবের সঙ্গে সমান্তরাল জরুরি শুল্ক বা কর আদায়।
প্রশাসনিক কাজকর্মের যে ব্যয়ভার – রাজ্য সুরক্ষার জন্যে সেনাবাহিনী, অজস্র
স্তরের আধিকারিক ও কর্মচারী, করণিকের বেতন, রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যয় -
রাস্তাঘাট, সেচ
ব্যবস্থা। এই সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার পরেও, প্রশাসন এবং প্রশাসনিক প্রধানের হাতে
পর্যাপ্ত সম্পদ গচ্ছিত থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের বন্যা, খরা, মহামারি
কিংবা কোন বিপর্যয় বা জরুরি অবস্থার জন্যে। এর পরেও যে উদ্বৃত্ত সম্পদ, সেই সম্পদও
জরুরি - প্রশাসনিক প্রধান বা রাজা এবং তার পরিবারের রাজকীয় আবাস, জাঁকজমক, অলংকার-ভূষণ, বিলাস-ব্যসন, উৎসব, অনুষ্ঠান, যজ্ঞের
জন্যে।
সম্পূর্ণ এই ব্যবস্থা এবং তার নিবিড় অন্তর্জাল
থেকেই গড়ে ওঠে রাজ্য। অতএব আর্যরা ভারতে আসার প্রায় হাজার বছর পরে, রাজ্য গড়ে
তোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিল।
প্রথমদিকে এই রাজ্যগুলিকে “রাজ্য” নামে চিহ্নিত
করা যায়নি। রাজা এবং রাজ্যের ধারণা আর্যদের মাথায় তখনও হয়তো দানা বেঁধে ওঠেনি।
তারা এই ধরনের অঞ্চলগুলিকে বলত, মহাজনপদ। এর আগে অনার্য সমাজের অজস্র জনপদ তারা দেখেছে।
তাদের মধ্যে অনেকগুলিই ছিল অত্যন্ত সম্পন্ন, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খণ্ডন করতে
আর্য ক্ষত্রিয়দের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! সেই ছোট বড়ো জনপদগুলির সরল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক
এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাও তারা দেখেছে। সেখানে একজন প্রধান এবং তার সঙ্গে বেশ
কয়েকজন বয়স্ক প্রতিনিধিই জনপদের প্রশাসন পরিচালন করত। কিন্তু এখন তারা যে মহাজনপদ
গড়ে তুলল, তার
প্রশাসন অনেক ব্যাপ্ত,
জটিল এবং সামাজিক পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন – সংখ্যাগুরু বিজিত এবং সংখ্যালঘু
বিজয়ীদের সমাজ।
ভারতীয় সভ্যতায় ষোড়শ মহাজনপদ
এই ষোলোটি মহাজনপদের মধ্যে তিনটি ছিল, মৈত্রী-সঙ্ঘ
বা গণসঙ্ঘ (confederation)। মোট
আটটি গোষ্ঠী যৌথভাবে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করত বৃজি মহাজনপদে, তাদের রাজার
সংখ্যা ছিল নাকি ৭,৭০৭।
মল্লদের রাজা ছিল প্রায় ৫০০ জন এবং চেদিদের আরও বেশি।
রাজতান্ত্রিক মহাজনপদগুলির বর্ণনা আমরা ইতিহাস
এবং মহাভারতে সুবিস্তারে পেয়ে থাকি। পূর্ববর্তী ২.৪.৬ অধ্যায় থেকেই তাদের
প্রশাসনিক ও সামাজিক বিন্যাস সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা তৈরি করা যায়। অতএব, সে প্রসঙ্গে
আবার না গিয়ে আমরা বরং গণসঙ্ঘগুলির দিকে একটু নজর দিই। আমাদের সাধারণ ইতিহাসে এই
জনপদগুলিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং মহাভারত ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য
গ্রন্থগুলি এই বিষয়ে খুব সঙ্গত কারণেই উদাসীন।
চলবে...
[1]
উত্তরকুরুর অবস্থান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ আছে। তাঁদের কেউ
বলেন, কুরু
রাজ্যের উত্তরে, হিমালয়ের
পাদদেশে উত্তরকুরুর অবস্থান। কেউ বলেন, উত্তরকুরু আর্যদের আদি বাসস্থান -
কিরঘিজস্তানের কোন অঞ্চল,
আবার কেউ বলেন, উত্তরকুরুর
বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই।
[2] মহাভারতের
যে পর্বের যে অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে, এটি তার সংকেত। আদি/১২২-এর অর্থ আদি
পর্বের ১২২ তম অধ্যায়। এই পদ্ধতি সর্বত্রই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
[3]
পিতার একাধিক পত্নীর সন্তানেরা যেমন পরষ্পরের “বৈমাত্রেয়” ভাই বা বোন হয়, তেমনি একই
মাতার একাধিক স্বামীর সন্তানদের “বৈপিত্রেয়” ভাই বা বোন বলা হয়।
[4] পাণ্ডুর
বর্ণের অর্থ - “শ্বেতপীত,
ফ্যাকাসে, শ্বেত”
[শব্দকোষ]।
[5] এ
ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু পরবর্তী কালে আমরা এরকম ঘটনার
অজস্র উদাহরণের সম্মুখীন হবো, এবং আমরা বুঝতে পারবো ব্রাহ্মণ্য সমাজ কোনদিনই পরমতসহিষ্ণু
ছিল না, বরং
নৃশংস বিরোধিতায় অভ্যস্ত ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন