[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
১
আমাদের স্কুলের খেলাধুলোর ব্যাপারে এই এলাকায় বেশ
সুনাম আছে। আমাদের এলাকার চোদ্দটি স্কুল নিয়ে প্রত্যেক বছর যে ক্রিকেট লিগ হয় – তার
চ্যাম্পিয়ান’স ট্রোফিটা এবার নিয়ে পরপর পাঁচবার আমরাই জিতে নিলাম। অর্থাৎ আমি
ক্যাপ্টেন হবার আগেই আমাদের স্কুল পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল – আমি সেই
ধারাটাকেই ধরে রেখেছি মাত্র।
কিন্তু এবারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবং আমিই এই লিগের
বেস্ট ব্যাটার হওয়া সত্ত্বেও আমার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে। এই ফাইন্যাল
ম্যাচটা আমরা সত্যিই কি ভালো খেলে জিতলাম? নাকি কোন কারসাজিতে? ব্যাপারটা এতই গোপনীয়,
বন্ধুদের সঙ্গেও আলোচনা করা সম্ভব নয়। এই রহস্যটা জানি আমরা মাত্র তিনজন – আমাদের
স্কুলের গেম টিচার পার্বতীস্যার, বাংলা ও সংস্কৃতর মাস্টারমশাই - নিত্যানন্দস্যার আর
ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি। অন্যান্য বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে অদ্ভূত আনন্দ পাই – এবার অন্ততঃ
আমি সেই আনন্দ অনুভব করতে পারলাম না। যদিও আমাদের টিমের অন্য সবাই – যারা ভেতরের
খবর জানে না – তারা প্রতিবারের মতোই আনন্দে মেতে উঠেছে।
আমার খটকার বিষয়টি তাহলে শুরুর থেকেই বলি।
সে যাই হোক, ওদের খেলার খটকাটা প্রথম চোখে পড়ল লিগের
চার নম্বর খেলায়। আমাদের সঙ্গে ক্ষেমঙ্করী টিমের প্রথম খেলাতে। ওই খেলায় টসে জিতে
আমরা ফিল্ডিং নিয়েছিলাম, ওদের পাঠিয়েছিলাম প্রথমে ব্যাট করতে। পাওয়ার প্লে রাউণ্ডে
ওদের যখন পনের রানে তিন উইকেট পড়ে গেল, তখনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, ক্ষেমঙ্করীর টিম
আমাদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তার পরেই খেলাটা আশ্চর্যভাবে ঘুরে গেল।
আমাদের টিমে যেন মিসফিল্ডের মহামারি লেগে গেল। ওদের ব্যাটাররা ফ্রন্টফুটে বা
ব্যাকফুটে ডিফেন্সিভ খেলেও পরের পর বাউণ্ডারি পেয়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটা আরেকটু
খোলসা করে বলি। ধরা যাক আমি সিলি মিডঅফে ফিল্ডিং করছি, ব্যাটারের ডিফেন্স করা
গড়ানে বল, আমার দিকে আসছে – সে বল হঠাৎ দিক বদল করে বিদ্যুৎগতিতে সীমানার বাইরে
চলে গেল লং অফ দিয়ে! অথবা ব্যাটের কানায় লেগে লোপ্পা ক্যাচ হয়ে বলটা নেমে আসছে থার্ডম্যান
ফিল্ডারের হাতে – কিন্তু না বলটা নিচেয় নামল না, উল্টে বলটা মাঝ আকাশে বাউন্স করে ফিল্ডারের
মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল বাউণ্ডারির বাইরে – ছক্কা! এরকম উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি।
ওদের ইনিংস শেষে ওদের স্কোর হল আট উইকেটে পঁচানব্বই।
খেলা শেষে হিসেব কষে দেখেছিলাম, আমাদের আজেবাজে ফিল্ডিংয়ের জন্যে মোটামুটি
তিরিশ-পঁয়ত্রিশ রান ওদের আমরা উপহার দিয়েছিলাম। তা না হলে আমরা ওদের পঁয়ষট্টি –
সত্তর রানেই বাণ্ডিল করে দিতে পারতাম। একথা ঠিক আমাদের মধ্যে কেউই ঝন্টি রোড্স্
বা রবীন্দ্র জাদেজার মতো ফিল্ডার নই – কিন্তু ওরকম বাজে ফিল্ডিংও আমরা কোনদিন
করিনি। তা না হলে আমরা আগের লিগগুলিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম কী করে?
এরপর আমরা ছিয়ানব্বই রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট
করতে নামলাম। ওপেনিং জুটিতে ছিলাম আমি আর পলাশ। প্রথম ওভারের তিনটে বল, আমরা
দুজনেই সিঙ্গল রান নিয়ে, একটু দেখেশুনে খেললাম। তারপর ব্যাট চালাতে শুরু করলাম। পলু
ওই ওভারের শেষ তিন বলে দুটো চার আর একটা ছক্কা হাঁকাল। তিনটে শটই অনবদ্য –
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পরের দু ওভারেও আমরা ভালই রান তুললাম – প্রথম
তিন ওভারে আমাদের রান গিয়ে দাঁড়াল কোন উইকেট না হারিয়ে বত্রিশ। আর তারপরেই শুরু হল
অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার। আমার এবং পলাশের
একটা বলও আর বাউণ্ডারির ধারে কাছে পৌঁছতে পারল না।
কয়েকটা উদাহরণ দিই। চতুর্থ ওভারের প্রথম বলটা এল
অফস্টাম্পের ওপর হাঁটুর লেভেলে ফুলটস, আমি নিখুঁত টাইমিংয়ে বলটা লফট করলাম –
নিশ্চিত ছক্কা। এতটাই নিশ্চিত ছিলাম, আমি বা পলাশ কেউ রান নেওয়ার জন্যে দৌড়লাম না।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম – লং অফ বাউণ্ডারির দশ পনের ফুট ভেতরে বলটা সোজা নেমে
এল। মনে হল মাঝ-শূণ্যে অদৃশ্য কোন দেওয়াল রয়েছে – সেই দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বলটা –
গাছ থেকে পাকা আম পড়ার মতো - টুপ করে মাটিতে নেমে পড়ল। ছ রান তো দূরের কথা –
দৌড়ইনি বলে একটা রানও পেলাম না। এরপরে আমাদের একটা বলও বাউণ্ডারি ছুঁতে পারল না।
পলাশ এবং আমি যে পাশ দিয়েই মারি - সে মিডঅফ, মিডঅন, এক্সট্রা কভার, স্কোয়্যার লেগ
– ব্যাট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বল বাউণ্ডারির দিকে ছুটছে – কিন্তু মাঠের মাঝখানে ধপ
করে থেমে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। ওখানে বলগুলো যেন কেউ খপ করে ধরে ফেলছে – যে ধরছে
তাকে অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না।
এভাবেই লিগের ওই ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম,
কুড়ি ওভারে আমাদের স্কোর হয়েছিল বিনা উইকেটে চুয়াত্তর। ব্যাটার হিসেবে পলু এবং
আমার এই অঞ্চলে যে সুনাম ছিল, সে নাম একদম ধুলোয় মিশে গেল। ক্ষেমঙ্করীর টিম খেলা
শেষে জয়ের আনন্দে যখন নাচানাচি করছে, আমাদের দুজনের তখন মুখ লুকোবার জায়গা কোথায়? মুখ
কালো করে আমরা দুজন যখন আমাদের তাঁবুতে ফিরলাম, পার্বতীস্যার আমাদের দুজনকে বুকে
জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, “ভাবিস না, একেই বলে ইন্দ্রপতন”। আগেই বলেছি, পার্বতীস্যার
আমাদের গেম টিচার। আমাদের দুজনের চোখেই তখন জল। পলাশ বলল, “এমন কেন হল, স্যার? আমি
না হয় পারিনি, নানুও কেন পারল না? এর থেকে, স্যার, আমরা যদি অল আউট হয়ে হেরে ফিরতাম,
তাতেও সান্ত্বনা থাকত – খেলায় হারজিৎ তো আছেই! কিন্তু নানু এবং আমি দুজনেই পুরো
কুড়ি ওভার খেলেও এই রান তুলতে পারলাম না?”
আমাদের অঙ্কের কুনালস্যার এবং নিত্যানন্দস্যার মাঠে এসেছিলেন খেলা দেখতে, বললেন, “তোরা দুজনেই আমাদের টিমের জুয়েল ব্যাটার – এভাবে ভেঙে পড়িস না। কালকে আমাদের কোন খেলা নেই। আজকের খেলা নিয়ে আগামীকাল টিফিনের পর আমাদের একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। নানু সেই মিটিংয়ে তুই থাকবি। এই খেলাটা মনে রাখিস স্বাভাবিক খেলা নয় – এই খেলার স্ট্র্যাটেজি অন্য রকম হবে”।
২
একতলায় হেডস্যারের ঘরের দরজা বন্ধ, দরজার বাইরে
টুলে বসে ছিল প্রভাকরদা। প্রভাকরদা আমায় দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যারেরা সবাই চলে
এসেছেন, তোমার জন্যেই সকলে অপেক্ষা করছেন। যাও, ভেতরে যাও। কালকের খেলাটা ভুলে
যাও, নানু। অমন দু একদিন হয়। দেখবে পরের খেলায় আবার তুমি সবাইকে চমকে দেবে”। আমি
মৃদু হাসলাম, মনে মনে ভাবলাম, পরের খেলায় সুযোগ যদি পাই তবেই না...। দরজা খুলে আমি
ভেতরে ঢুকলাম, প্রভাকরদা আমার পিছনে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।
ঘরে ঢুকে দেখি, হেডস্যার নিজের চেয়ারে বসে আছেন,
তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে – পার্বতীস্যার, নিত্যানন্দস্যার, বিজ্ঞানের প্রদীপ্তস্যার,
অঙ্কের কুনালস্যার, ভূগোলের প্রশান্তস্যার আর ইতিহাসের সন্দীপস্যার। আমি ঢুকতেই
হেডস্যার বললেন, “এস নয়ন, এস, আমার সামনের এই চেয়ারটায় বস”। আমি ভীষণ সংকোচে আর
ভয়ে ভয়ে স্যারেদের চেয়ার পার হয়ে, হেডস্যারের সামনের খালি চেয়ারটাতেই বসলাম। আমি
বসতেই হেডস্যার বললেন, “কালকের খেলা দেখতে আমি মাঠে যেতে পারিনি। কিন্তু আপনাদের
মুখে যা শুনলাম, তাতে আমি স্তম্ভিত। আমাদের নয়ন আর পলাশ নাকি একের পর এক ছক্কা
মেরেছে, কিন্তু সেগুলি মাঠের ভেতরেই টুপ-টাপ করে ঝরে পড়েছে। ওরা অনেকবার বাউণ্ডারি
মারারও চেষ্টা করেছে – কিন্তু সেগুলিও বাউণ্ডারির একটু আগেই থমকে গেছে। এসব কীভাবে
সম্ভব? কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু আপনারা দুজনেই বিজ্ঞানের মানুষ – এর কোনো ব্যাখ্যা
দিতে পারেন?”
সুদীপ্তস্যার কুনালস্যারকে বললেন, “আপনি কাল খেলা
দেখেছেন, আপনিই ভাল বোঝাতে পারবেন কুনালদা”।
কুনালস্যার তিন রঙের মার্কার পেন আর ডাস্টার নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ঘরের কোণে রাখা হোয়াইট-বোর্ডের সামনে গেলেন। তারপর ইংরিজিতে খসখসিয়ে লিখলেন, Projectiles। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “নয়নরা যে ছক্কাগুলো মারে, মানে বলগুলোকে পিটিয়ে যেভাবে বাউণ্ডারির বাইরে ফেলে – সেই টেকনিকটাকে অংকের ভাষায় বলে প্রজেক্টাইলস”। এই বলে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বোর্ডে স্কেচ করতে শুরু করলেন, “এই হচ্ছে নয়ন – আর এই হচ্ছে বাউণ্ডারি। নয়নের ব্যাটের বাড়ি খেয়ে বলগুলো এই পথ ধরে বাউণ্ডারির বাইরে পড়ে। বলের এই উড়ে যাওয়ার পথটাকেই প্রজেক্টাইলস বলে। ব্যাটেবলে ঠিকঠাক কানেক্ট না হলে বাউণ্ডারির বাইরে না গিয়ে বল ভেতরেই পড়বে – এবং ফিল্ডার থাকলে সে ক্যাচ করে নেবে। কিন্তু সে বলও প্রজেক্টাইলস হয়েই পড়বে – অন্যভাবে নয়। কিন্তু গতকাল ওদের ছক্কার বলগুলো - এই যে এই লাল লাইনটা দেখুন, এভাবে আচমকা নীচেয় নেমে এসেছে। আমার অঙ্কের জ্ঞানে এ অসম্ভব। সুদীপ্তবাবু, আপনার ফিজিক্সে কী বলে?”
Projectiles
ফিজিক্সের সুদীপ্তস্যারও বললেন, “এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম কুনালবাবু। ক্রিকেটের বল, তির, জ্যাভেলিন বা শর্টপাট – সব কিছুতেই এই নিয়মই একমাত্র নিয়ম। অবশ্যই এই দক্ষতার সঙ্গে শক্তি থাকাটাও জরুরি। নয়নের ব্যাট কতটা শক্তি দিয়ে বলটা মারবে তার ওপরেও নির্ভর করবে বলটা কোথায় গিয়ে নামবে। কিন্তু লালরঙের যে পথটা আপনি আঁকলেন, সেভাবে কোন বস্তু নেমে আসতে পারে না – একমাত্র ব্যাডমিন্টনের শাটল-কক ছাড়া”।
হেডস্যার বললেন, “তাহলে, এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি? আপনারাই
বলছেন, গতকাল এমন ঘটনা একবার নয় বহুবার ঘটেছে – নয়ন এবং পলাশ দুজনের ক্ষেত্রেই!”
কুনালস্যার বোর্ডের সামনে থেকে ফিরে এসে চেয়ারে
বসলেন, মাথা নেড়ে বললেন, “আমার জানা নেই, স্যার”।
“সুদীপ্তবাবু?” হেডস্যার জিজ্ঞাসা করলেন।
“না স্যার। আমারও একই অবস্থা – কোন যুক্তিই খুঁজে
পাচ্ছি না”। সুদীপ্তস্যার উত্তর দিলেন।
“তাহলে? পার্বতীবাবু, উপায় কি? আমাদের টিমকে নতুন
কিছু প্র্যাক্টিস করাবেন নাকি? এভাবে হারতে থাকলে, আমাদের স্কুলের সম্মান কোথায়
দাঁড়াবে?”
পার্বতীস্যার আমতা আমতা করে বললেন, “কী বলি বলুন
তো স্যার? আমার ছেলেরা এর আগে তিনটে খেলায় দারুণ খেলে জিতল। আমি নিশ্চিত এর পরের
খেলাতেও ওরা নিজেদের সুনাম অনুযায়ীই খেলবে। কিন্তু গতকাল... কী যে হচ্ছিল... কিছুই
বুঝলাম না...”।
ঘরের মধ্যে সবাই চুপ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ।
সকলেই চিন্তিত, কোন সুরাহা মিলছে না। এমন সময় নিত্যানন্দস্যার বললেন, “আমাকে যদি দুদিন ছুটি
মঞ্জুর করেন স্যার, তাহলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।
হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন, “আপনি? কী উপায় দেখবেন?
আপনি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন কি?”
“বুঝেছি বৈ কি, স্যার, বিলক্ষণ বুঝেছি। ব্যাপারটা
অলৌকিক। সমস্যাটা বিজ্ঞান দিয়ে কিংবা সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সবই অশরীরীদের
কারসাজি”। নিত্যানন্দ স্যার সংস্কৃতের পণ্ডিত, তবে এখন আর আমাদের স্কুলে সংস্কৃত
পড়ানো হয় না বলে, আমাদের বাংলা পড়ান।
“তার মানে?” সব স্যারই একসঙ্গে চমকে উঠে বললেন। আমিও
হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমরা গতকাল একদল ভূতের বিরুদ্ধে খেলেছি – কী সর্বনাশ!
নিত্যানন্দস্যারের কথায় অন্য স্যাররা হেসে ফেললেন,
এমনকি হেডস্যারও। তারপর বললেন, “আর বিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে আসানসোল-কলকাতার মতো,
চাঁদ বা মঙ্গল থেকে মানুষ পৃথিবীতে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করার কথা ভাবছে, আর আপনি
ক্রিকেট মাঠে ভূতের উপদ্রব দেখতে পাচ্ছেন?”
নিত্যানন্দস্যারও হাসলেন, “আলবাৎ স্যার। আপনারা বিশ্বাস
না করতে পারেন। কিন্তু ওরা আছে। আমি বলি কি স্যার, কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু এই সমস্যা
সমাধানের যখন কোন উপায় ভেবে বের করতে পারছেন না, তখন আমাকে একটা সুযোগ দিতে দোষ
কি? গতকাল ওদের এবং আমাদের – দু পক্ষের ছেলেদের খেলাই আমি মন দিয়ে দেখেছি। নয়নদের
অনেক ছক্কা এবং চৌকা যেমন অদ্ভূতভাবে পণ্ড হয়েছে, ওদের ছেলেদের অনেক বল যেগুলো
চার-রান হবার নয়, সেগুলো চার হয়েছে। মাঠের ধারে যে বলগুলো আমাদের ছেলেরা অনায়াসে
ক্যাচ করতে পারত, সেগুলো আশ্চর্যভাবে ছক্কা হয়েছে। নিজের চোখে না দেখলে আমিও
বিশ্বাস করতাম না। কি পার্বতীবাবু? কি রে নয়ন?” নিত্যানন্দবাবু আমাদের সাক্ষী
মানলেন।
পার্বতীস্যার এবং আমি নিত্যানন্দবাবুকে সমর্থন
করে বললাম, “হ্যাঁ স্যার, তাজ্জব হয়ে গেছি। ক্রিকেট বলের এমন আচরণ কোনদিন দেখিনি”!
কেউ কোন কথা বললেন না। হেডস্যারও কিছুক্ষণ চিন্তা
করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। অন্য কোন রাস্তা যখন পাওয়া যাচ্ছে
না, নিত্যানন্দবাবু আপনার কথা আমরা সকলে মেনে নিলাম। কিন্তু ক্ষেমঙ্করী স্কুলের
ছেলেদের সঙ্গে আমাদের আর কোন খেলার সম্ভাবনা নেই, তাই না, পার্বতীবাবু?”
পার্বতীস্যার কিছু বলার আগেই নিত্যানন্দ স্যার
বললেন, “আছে বৈকি, স্যার, ফাইন্যালে আবার দেখা হবে”।
পার্বতীস্যার খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
“ক্ষেমঙ্করীর দল ফাইন্যাল অব্দি উঠবে?”
নিত্যানন্দস্যার বললেন, “উঠবে পার্বতীবাবু। আমার
ধারণা ক্ষেমঙ্করীর দল এই কারসাজি করেই ফাইন্যালে উঠবে। এবং শুধু উঠবে না – অন্য
কোন টিমের কাছে না হেরে – আনডিফিটেড উঠবে। আমাদের দলও ফাইন্যালে উঠবে, আমার দৃঢ়
বিশ্বাস। কিরে নয়ন, পারবি না?” নিত্যানন্দস্যারের কথায় আমি খুব একটা জোর অনুভব
করলাম, আমার মনে, সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “উঠবই স্যার”।
নিত্যানন্দবাবু আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ভেরি
গুড। এই তো চাই। সত্যি বলতে, আমি নয়নদের অন্য খেলাগুলির জন্য চিন্তাই করছি না,
ওগুলো ওরা নিজেরাই জিতে নিতে পারবে। কিন্তু ক্ষেমঙ্করীদের সঙ্গে খেলাটা একটু মুশকিল
– ওটা জিততে হলে বাইরে থেকে আমাদেরও একটু খেলতে হবে...”।
স্যারেরা সকলেই নিত্যানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে
রইলেন। হেডস্যারও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “বেশ আপনি দু দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে
আসুন, আর কী কী বন্দোবস্ত করবেন, সে সব সেরে ফেলুন। কিন্তু নয়ন, আমি কিন্তু এবারও
আমাদের স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন দেখতে চাই”।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে গভীর বিশ্বাসে বললাম, “ওই কাপ
আমরাই আবার আনব, স্যার”।
“গুড। যাও, এখন ক্লাসে যাও”।
৩
যাই হোক গতকাল ফাইন্যাল হল। একদম স্বাভাবিক খেলা। কোন অলৌকিক কারসাজির চিহ্নমাত্র ছিল না। আমরা টসে হেরেছিলাম, ক্ষেমঙ্করী আমাদের ব্যাটিং করতে পাঠাল। বিশ ওভারে আমরা স্কোর করলাম, তিন উইকেটে দুশো পঁয়তাল্লিশ। পলাশের রান বাইশ বলে চুয়ান্ন, আর আমি পঞ্চান্ন বলে একশ আট, পান্না বিয়াল্লিশ, তিমির সাতাশ, রমেশ ছয়, আর এক্সট্রা আট। ক্ষেমঙ্করীর টিম বিশ ওভার খেলে আট উইকেটে একশ সাতান্ন করেই থমকে গেল। অতএব এবারেও লিগের ট্রফি আমাদের স্কুলেই হেডস্যারের ঘরে এসে জমা হল। এই নিয়ে বারবার পাঁচবার।
নিত্যানন্দস্যার কী করে ক্ষেমঙ্করী টিমের কারসাজি
বন্ধ করলেন, সে কথা উনি কাউকেই বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, “সব কথা তো তোকে
বলা যাবে না। বললে বিশ্বাসও করবি না। খুব ছোট্ট করে বলি, ওরা কোন একজন তান্ত্রিক
সাধুকে ভাড়া করেছিল। এসব তাঁরই কুকীর্তি। তিনিই যোগ-বলে বেশ কয়েকজন ভূতকে সেদিন
মাঠে নামিয়েছিলেন, তোদের বিরুদ্ধে। ভূতের টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে অশরীরী আত্মা,
জানিস তো? তান্ত্রিক সাধুরা তাঁদের চেলাদের ভূত-প্রেত, পেত্নী-শাঁকচুন্নি বলেন না,
কাউকে বলতে শুনলে বেজায় রেগেও যান।
সে যাগ্গে, আমি তো ওই অশরীরীদের কাউকেই চোখে
দেখতে পাইনি। কিন্তু তাও ব্যাপারটা বুঝতে আমি ভুল করিনি। তাই হেডস্যারের অনুমতি
নিয়ে আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আমার এক কাকা আছেন, তিনি বিখ্যাত
সাধক, সিদ্ধ যোগী। তাঁকে গিয়ে সব কথা খুলে বলতে খুব রেগে গেলেন। ওই তান্ত্রিক সাধুর
সঙ্গে ফোনে কথা বললেন, “ছেলেপুলেদের খেলার মধ্যে তোমরা অশরীরীদেরও মাঠে নামাচ্ছ?
ছিছিছি ছিঃ। আমি কিন্তু এসব হতে দেব না”, বলেই উনি ফোন রেখে দিলেন।
তারপর আমাকে বললেন, “তুই ফিরে যা, একদম ভাবিস না,
সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ তোদের ছেলেদের খেলায় আর কোন বিঘ্ন ঘটাবে না”। একটু চুপ করে
থেকে নিত্যানন্দস্যার বললেন, “ওসব খুব গোপন আর ভজকট ব্যাপার, নানু। আমিও কী আর
সবটা বুঝি? সব কথা তোর না শোনাই ভালো”। তারপর আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তোর কাজ মন
দিয়ে খেলা, তার বাইরে আর কোন চিন্তা নয় - তোকে শুধু বেঙ্গল টিমেই নয়, ইণ্ডিয়া
টিমেও চান্স পেতে হবে, নানু। কথাটা মনে রাখিস – আমরা সবাই তোর পিছনে আছি”।
সবই তো ভালোয় ভালোয় মিটল, কিন্তু আমার মনের খটকাটা
রয়েই গেল – অশরীরীরা খেলাধুলোতেও নাক গলিয়ে এমন কারসাজি করতে পারে? ভূতেদের অসাধ্য
কি কিছুই নেই?
দুর্দান্ত। নতুন ধরনের ভৌতিক গল্প।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ নেবেন।
উত্তরমুছুন