সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৬

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


এর আগের পর্ব পাশের সূত্রে "শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৫"


উত্তরচরিত

নবম অধ্যায়

ধ্যান

                         বন্ধুককাঞ্চননিভং রুচিরাক্ষমালাং পাশাঙ্কুশৌ চ বরদাং নিজবাহুদণ্ডৈঃ।

বিভ্রাণমিন্দু-শকলাভরণং ত্রিনেত্রম্‌ অর্ধাম্বিকেশমনিশং বপুরাশ্রয়ামি।।

[বন্ধুক-কাঞ্চন-নিভং রুচিঃ-অক্ষ-মালাম্‌ পাশ-অঙ্কুশৌ চ বরদাম্‌ নিজ-বাহু-দণ্ডৈঃ।

বিভ্রাণম্‌-ইন্দু-শকল-আভরণম্‌ ত্রিনেত্রম্‌ অর্ধ-অম্বিকা-ঈশম্‌ অনিশং বপুঃ আশ্রয়ামি।।]

যাঁর বর্ণ বন্ধুক-পুষ্প ও স্বর্ণ তুল্য, যিনি নিজের চার হাতে সুচারু রুদ্রাক্ষমালা, পাশ, অঙ্কুশ এবং বরদামুদ্রাধারিণী, যে ত্রিনয়না দেবীর আভরণ চন্দ্রকলা, ভগবান মহেশ্বরের যিনি অর্ধাঙ্গিনী, সেই দেবীকেই আমি সর্বদা আশ্রয় করে থাকি।

 

নবম অধ্যায় – নিশুম্ভবধ

রাজোবাচ।

বিচিত্রমিদমাখ্যাতং ভগবন্‌ ভবতা মম।

দেব্যাশ্চরিতমাহাত্ম্যং রক্তবীজবধাশ্রিতম্‌।। ১

ভূয়শ্চেচ্ছাম্যহং শ্রোতুং রক্তবীজে নিপাতিতে।

চকার শুম্ভ যৎ কর্ম নিশুম্ভশ্চাতিকোপনঃ।। ২

[রাজা উবাচ। বিচিত্রম্‌ ইদম্‌ আখ্যাতম্‌ ভগবন্‌ ভবতা মম। দেব্যাঃ চরিত-মাহাত্ম্যং রক্তবীজ-বধ আশ্রিতম্‌।। ১

ভূয়ঃ চ ইচ্ছামি অহম্‌ শ্রোতুম্‌ রক্তবীজে নিপাতিতে। চকার শুম্ভ যৎ কর্ম নিশুম্ভঃ চ অতিকোপনঃ।। ২]

রাজা সুরথ বললেন। হে ভগবন্‌, রক্তবীজ-নিধন বিষয়ে আপনি দেবীদের যে চরিত্র-মাহাত্ম্যের কথা আমাদের বললেন, সেই কাহিনী বিচিত্র। রক্তবীজ নিহত হলে ভয়ংকর কুপিত শুম্ভ ও নিশুম্ভ যা করেছিল, সে কথা শুনতেও আমি ইচ্ছা করি।

ঋষিরুবাচ।

চকার কোপমতুলং রক্তবীজে নিপাতিতে।

শুম্ভাসুরো নিশুম্ভশ্চ হতেষ্বন্যেষু চাহবে।। ৩

হন্যমানং মহাসৈন্যং বিলোক্যামর্ষমুদ্‌বহন্‌।

অভ্যধাবন্নিশুম্ভোঽথ মুখ্যয়াসুরসেনয়া।। ৪

তস্যাগ্রতস্তথা পৃষ্ঠে পার্শ্বয়োশ্চ মহাসুরাঃ।

সন্দোষ্টৌষ্ঠপুটাঃ ক্রুদ্ধা হন্তুং দেবীমুপাযযুঃ।। ৫

[ঋষিঃ উবাচ। চকার কোপম্‌ অতুলম্‌ রক্তবীজে নিপাতিতে। শুম্ভ-অসুরঃ নিশুম্ভঃ চ হতেষু অন্যেষু চ আহবে।। ৩

হন্যমানম্‌ মহাসৈন্যম্‌ বিলোক্য- অমর্ষম্‌ উদ্‌বহন্‌। অভ্যধাবৎ নিশুম্ভঃ অথ মুখ্যয়া-অসুর-সেনয়া।। ৪

তস্য অগ্রতঃ তথা পৃষ্ঠে পার্শ্বয়োঃ চ মহাসুরাঃ। সন্দোষ্ট-ওষ্ঠ-পুটাঃ ক্রুদ্ধা হন্তুম্‌ দেবীম্‌ উপাযযুঃ।। ৫]

ঋষি বললেন। সেই যুদ্ধে রক্তবীজ ও অন্যান্য মহাসুরদের মৃত্যুতে  অসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভ ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। আরও ক্রুদ্ধ হল মহাসৈন্যদের নিহত হতে দেখে এবং মুখ্য অসুর সেনাপতিদের নিয়ে নিশুম্ভ দেবীর দিকে এগিয়ে চলল। তার সামনে, পিছনে এবং দুই পাশে মহাসুরেরা মহাক্রোধে দাঁতে অধর দংশন করতে করতে দেবীকে হত্যার উদ্দেশে উপস্থিত হল।

আজগাম মহাবীর্যঃ শুম্ভোঽপি স্ববলৈর্বৃতঃ।

নিহন্তুং চণ্ডিকাং কোপাৎ কৃত্বা যুদ্ধস্তু মাতৃভিঃ।। ৬

ততো যুদ্ধমতীবাসীৎ দেব্যা শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।

শরবর্ষমতীবোগ্রং মেঘয়োরিব বর্ষতোঃ।। ৭

[আজগাম মহাবীর্যঃ শুম্ভঃ অপি স্ব-বলৈঃ-বৃতঃ। নিহন্তুম্‌ চণ্ডিকাম্‌ কোপাৎ কৃত্বা যুদ্ধঃ তু মাতৃভিঃ।। ৬

ততঃ যুদ্ধম্‌ অতীব আসীৎ দেব্যা শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ। শরবর্ষম্‌ অতীব উগ্রম্‌ মেঘয়োঃ ইব বর্ষতোঃ।। ৭]

নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে ক্রুদ্ধ শুম্ভও উপস্থিত হল, যুদ্ধে মাতৃগণকে হত্যা করার পর, দেবী চণ্ডিকাকে হত্যা করবে বলে। এরপর মেঘ থেকে বর্ষাধারার মতো উগ্র-তির-বর্ষণ করে শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীদের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু করে দিল।

চিচ্ছেদাস্তাঞ্ছরাংস্তাভ্যাং চণ্ডিকা স্বশরোৎকরৈঃ।

তাড়য়ামাস চাঙ্গেষু শস্ত্রৌঘৈরসুরেশ্বরৌ।। ৮

নিশিম্ভো নিশিতং খড়্গং চর্ম চাদায় সুপ্রভম্‌।

অতাড়য়ন্মূর্ধ্নি সিংহং দেব্যা বাহনমুত্তমম্‌।। ৯

তাড়িতে বাহনে দেবী খুরপ্রেণাসিমুত্তমম্‌।

নিশুম্ভস্যাশু চিচ্ছেদ চর্ম চাপ্যষ্টচন্দ্রকম্‌।। ১০

[চিচ্ছেদ অস্তান্‌ শরান্‌ তাভ্যাম্‌ চণ্ডিকা স্ব-শরঃ উৎকরৈঃ। তাড়য়ামাস চ অঙ্গেষু শস্ত্র-ওঘৈঃ অসুরেশ্বরৌ।। ৮

নিশুম্ভঃ নিশিতম্‌ খড়্গম্‌ চর্ম চ আদায় সুপ্রভম্‌। অতাড়য়ৎ মূর্ধ্নি সিংহম্‌ দেব্যা বাহনম উত্তমম্‌।। ৯

তাড়িতে বাহনে দেবী খুরপ্রেণ অসিম্‌ উত্তমম্‌। নিশুম্ভস্যা আশু চিচ্ছেদ চর্ম চ অপি অষ্টচন্দ্রকম্‌।। ১০]

দেবী চণ্ডিকা নিজের বাণসমূহ দিয়ে তাদের তিরগুলিকে ছিন্ন করলেন এবং দুই অসুর-অধিপতির সর্বদেহে শস্ত্র দিয়ে আঘাত করলেন। নিশুম্ভ শাণিত খড়্গ ও ঝকঝকে ঢাল হাতে নিয়ে, দেবী চণ্ডিকার শ্রেষ্ঠ বাহন সিংহের মাথায় আঘাত করল। বাহনের গায়ে আঘাত লাগতে দেবী তৎক্ষণাৎ ধারালো খুরপ্র দিয়ে নিশুম্ভের খড়্গ ও অষ্টচন্দ্রবিশিষ্ট ঢাল ছিন্ন করে দিলেন।

ছিন্নে চর্মণি খড়্গে চ শক্তিং চিক্ষেপ সোঽসুরঃ।

তামপ্যস্য দ্বিধা চক্রে চক্রেণাভিমুখাগতাম্‌।। ১১

কোপাধ্মতো নিশুম্ভোঽথ শূলং জগ্রাহ দানবঃ।

আয়ান্তং মুষ্টিপাতেন দেবী তচ্চাপ্যচূর্ণয়ৎ।। ১২

[ছিন্নে চর্মণি খড়্গে চ শক্তিম্‌ চিক্ষেপ সঃ অসুরঃ। তাম্‌ অপি অস্য দ্বিধা চক্রে চক্রেণ অভিমুখ আগতাম্‌।। ১১

কোপ আধ্মতঃ নিশুম্ভঃ অথ শূলম্‌ জগ্রাহ দানবঃ। আয়ান্তম্‌ মুষ্টিপাতেন দেবী তৎ চ অপি অচূর্ণয়ৎ।। ১২]

খড়্গ ও ঢাল ছিন্ন হওয়ার পর সেই অসুর শক্তি নিক্ষেপ করতে লাগল, কিন্তু সেগুলিকেও দেবী তাঁর চক্র দিয়ে দু-টুকরো করে ফেললেন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে দানব নিশুম্ভ তখন শূল নিয়ে আক্রমণ করল, কিন্তু দেবী তাঁর দিকে ছুটে আসা সেই সব শূলগুলিকে মুষ্টির আঘাতে চূর্ণ করে দিলেন।

আবিধ্যাথ গদাং সোঽপি চিক্ষেপ চণ্ডিকাং প্রতি।

সাপি দেব্যা ত্রিশূলেন ভিন্না ভস্মত্বমাগতা।। ১৩

ততঃ পরশুহস্তং তমায়ান্তং দৈত্যপুঙ্গবম্‌।।

আহত্য দেবী বাণৌঘৈরপাতয়ত ভূতলে।। ১৪

তস্মিন্নিপতিতে ভূমৌ নিশুম্ভে ভীমবিক্রমে।

ভ্রাতর্যতীব সংক্রুদ্ধ প্রযযৌ হন্তুমম্বিকাম্‌।। ১৫

[আবিধ্যা অথ গদাম্‌ সঃ অপি চিক্ষেপ চণ্ডিকাম্‌ প্রতি। সা অপি দেব্যা ত্রিশূলেন ভিন্না ভস্মত্বম্‌ আগতা।। ১৩

ততঃ পরশু-হস্তম্‌ তম্‌ আয়ান্তম্‌ দৈত্যপুঙ্গবম্‌।। আহত্য দেবী বাণ-ওঘৈঃ অপাতয়ত ভূতলে।। ১৪

তস্মিন্‌ নিপতিতে ভূমৌ নিশুম্ভে ভীমবিক্রমে। ভ্রাতরি অতীব সংক্রুদ্ধ প্রযযৌ হন্তুম্‌ অম্বিকাম্‌।। ১৫]

এরপর সে দেবী চণ্ডিকার দিকে গদা ঘুরিয়ে নিক্ষেপ করতে লাগল, কিন্তু সেগুলিও দেবী তাঁর ত্রিশূল দিয়ে ভস্মীভূত করে ফেললেন। তারপর সেই দৈত্য বীর কুঠার হাতে যখন এগিয়ে এল, দেবী অজস্র তির নিক্ষেপ করে তাকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। নিশুম্ভ মাটিতে পড়ে যেতে তার প্রবল-পরাক্রমী ভাই ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে দেবী অম্বিকাকে হত্যা করার জন্যে এগিয়ে এল।

স রথস্থস্তথাত্যুচ্চৈর্গৃহীতপরমায়ুধৈঃ।

ভুজৈরষ্টাভিরতুলৈর্ব্যাপ্যাশেষং বভৌ নভঃ।। ১৬

তমায়ান্তং সমালোক্য দেবী শঙ্খমবাদয়ৎ।

জ্যাশব্দঞ্চাপি ধনুষশ্চকারাতীব দুঃসহম্‌।। ১৭

[সঃ রথস্থঃ তথা অতি-উচ্চৈঃ গৃহীত-পরম আয়ুধৈঃ। ভুজৈঃ অষ্টাভিঃ অতুলৈঃ ব্যাপ্যা অশেষম্‌ বভৌ নভঃ।। ১৬

তম্‌ আয়ান্তম্‌ সমালোক্য দেবী শঙ্খম্‌ অবাদয়ৎ। জ্যা-শব্দম্‌ অপি ধনুষঃ চকার অতীব দুঃসহম্‌।। ১৭]

সে অতি উচ্চ রথে চড়ে, তার অনুপম সুদীর্ঘ আট হাতে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র–শস্ত্র নিয়ে আকাশজুড়ে শোভিত হল। তাকে আসতে দেখে দেবী তাঁর শঙ্খধ্বনি করলেন এবং অতি অসহ্য ধনুষ্টংকার করতে লাগলেন।

পূরয়ামাস ককুভো নিজঘণ্টাস্বনেন চ।

সমস্তদৈত্যসৈন্যানাং তেজোবধবিধায়িনা।। ১৮

ততঃ সিংহো মহানাদৈস্ত্যাজিতেভমহামদৈঃ।

পূরয়ামাস গগনং গাং তথোপদিশো দশ।। ১৯

ততঃ কালী সমুৎপত্য গগনং ক্ষ্মামতাড়য়ৎ।

করাভ্যাং তন্নিনাদেন প্রাক্‌স্বনাস্তে তিরোহিতাঃ।। ২০

[পূরয়ামাস ককুভঃ নিজ-ঘণ্টা-স্বনেন চ। সমস্ত-দৈত্য-সৈন্যানাং তেজঃ-বধ-বিধায়িনা।। ১৮

ততঃ সিংহঃ মহানাদৈঃ ত্যাজিত-ইভ-মহা-মদৈঃ। পূরয়ামাস গগনম্‌ গাম্‌ তথা উপদিশঃ দশ।। ১৯

ততঃ কালী সমুৎপত্য গগনম্‌ ক্ষ্মাম্‌ অতাড়য়ৎ। করাভ্যাম্‌ তৎ নিনাদেন প্রাক্‌স্বনাঃ তে তিরোহিতাঃ।। ২০]

তখন সমস্ত দৈত্য এবং দৈত্যসেনাদের তেজক্ষয়কারক তাঁর ঘণ্টাধ্বনিতে দেবী চতুর্দিক ভরে তুললেন। সেই সিংহও তখন রণমত্ত হাতিদের ভীত করার জন্যে ভয়ংকর গর্জন করতে লাগল, সেই গর্জনে পূর্ণ হল আকাশ ও পৃথিবীর দশদিক। তারপর দেবী কালী আকাশে উঠে তাঁর দুই করতল দিয়ে মাটিতে চাপড় মারতে লাগলেন, সেই শব্দে আগের সমস্ত শব্দই চাপা পড়ে গেল।

অট্টাট্টহাসমশিবং শিবদূতী চকার হ।

তৈঃ শব্দৈরসুরাস্ত্রেসুঃ শুম্ভঃ কোপং পরং যযৌ।। ২১

দুরাত্মংস্তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি ব্যাজহারাম্বিকা যদা।

তদা জয়েত্যভিহিতং দেবৈরাকাশসংস্থিতৈঃ।। ২২

শুম্ভেনাগত্য যা শক্তির্মুক্তা জ্বালাতিভীষণা।

আয়ান্তী বহ্নিকূটাভা সা নিরস্তা মহোল্কয়া।। ২৩

[অট্ট-অট্ট-হাসম্‌ অশিবম্‌ শিবদূতী চকার হ। তৈঃ শব্দৈঃ অসুরাঃ-ত্রেসুঃ শুম্ভঃ কোপম্‌ পরম্‌ যযৌ।। ২১

দুরাত্মন্‌ তিষ্ঠ তিষ্ঠ ইতি ব্যাজহার অম্বিকা যদা। তদা জয় ইতি অভিহিতম্‌ দেবৈঃ আকাশ-সংস্থিতৈঃ।। ২২

শুম্ভেন আগত্য যা শক্তিঃ মুক্তা জ্বালা- অতিভীষণা। আয়ান্তী বহ্নি-কূট-আভা সা নিরস্তা মহা-উল্কয়া।। ২৩]

শত্রুদের পক্ষে অশুভ শিবদূতী প্রবল অট্টহাসি হাসতে লাগলেন, সেই শব্দে অসুরসৈন্যরা ত্রস্ত হয়ে উঠল এবং শুম্ভ ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। দেবী অম্বিকা যখন “ওরে দুরাত্মন্‌, থাম, থাম” বললেন, আকাশে উপস্থিত হয়ে দেবতারা তাঁর জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। শুম্ভ এসেই ভয়ংকর তেজোময় ও অগ্নি-তুল্য-আভাময় শক্তি নিক্ষেপ করল, কিন্তু সেটি আসার পথেই দেবীর মহা-উল্কা অস্ত্রে বিনষ্ট হল।

সিংহনাদেন শুম্ভস্য ব্যাপ্তং লোকত্রয়ান্তরম্‌।

নির্ঘাতনিঃস্বনো ঘোরো জিতবানবনীপতে।। ২৪

শুম্ভমুক্তাঞ্ছরান্‌ দেবী শুম্ভস্তৎপ্রহিতাঞ্ছরান্‌।

চিচ্ছেদ স্বশরৈরুগ্রৈঃ শতশোঽথ সহস্রশঃ।। ২৫

[সিংহ-নাদেন শুম্ভস্য ব্যাপ্তম্‌ লোক-ত্রয়-অন্তরম্‌। নির্ঘাত-নিঃস্বনঃ ঘোরঃ জিতবান্‌ অবনীপতে।। ২৪

শুম্ভ-মুক্তান্‌-শরান্‌ দেবী শুম্ভঃ তৎ প্রহিতান্‌ শরান্‌। চিচ্ছেদ স্ব-শরৈঃ উগ্রৈঃ শতশঃ অথ সহস্রশঃ।। ২৫]

হে অবনীপতি সুরথ, শুম্ভের ভয়ংকর গর্জনে ত্রিলোক এবং অন্তরীক্ষ পরিপূর্ণ হল, কিন্তু সেই ধ্বনিকে জয় অকস্মাৎ এক বজ্র-নির্ঘোষ। শুম্ভের নিক্ষিপ্ত শত-শত সহস্র-সহস্র শাণিত-তীর দেবী নিজের তির দিয়ে প্রতিহত করতে লাগলেন, আবার শুম্ভও দেবীর শর প্রতিহত করতে লাগল।   

ততঃ সা চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা শূলেনাভিজঘান তম্‌।

স তদাভিহতো ভূমৌ মূর্ছিতো নিপাতত হ।। ২৬

ততো নিশুম্ভঃ সংপ্রাপ্য চেতনামাত্তকার্মুকঃ।

আজঘান শরৈর্দেবীং কালীং কেশরিণং তথা।। ২৭

পুনশ্চ কৃত্বা বাহূনামযূতং দনুজেশ্বরঃ।

চক্রায়ুধেন দিতিজশ্ছাদয়ামাস চণ্ডিকাম্‌।। ২৮

[ততঃ সা চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা শূলেন অভিজঘান তম্‌। স তৎ অভিহতঃ ভূমৌ মূর্ছিতঃ নিপাতত হ।। ২৬

ততঃ নিশুম্ভঃ সংপ্রাপ্য চেতনাম্‌ আত্ত-কার্মুকঃ। আজঘান শরৈঃ দেবীম্‌ কালীম্‌ কেশরিণম্‌ তথা।। ২৭

পুনঃ চ কৃত্বা বাহূনাম্‌ অযূতম্‌ দনুজ-ঈশ্বরঃ। চক্র আয়ুধেন দিতিজঃ ছাদয়ামাস চণ্ডিকাম্‌।। ২৮]

তখন দেবী চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা হয়ে তাকে শূল দিয়ে আঘাত করলেন, সেই আঘাতে সে মূর্ছিত হয়ে ধরাশায়ী হল। এই সময় নিশুম্ভ সংজ্ঞা ফিরে পেল এবং ধনু তুলে নিয়ে দেবী অম্বিকা, কালী ও সিংহকে তিরের আঘাত করতে লাগল। দিতি-পুত্র দানব-অধিপতি (নিশুম্ভ) আবার অযূত বাহুধর হয়ে চক্রাস্ত্র দিয়ে দেবী চণ্ডিকাকে আচ্ছন্ন করতে লাগল।

ততো ভগবতী ক্রুদ্ধা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।

চিচ্ছেদ তানি চক্রাণি স্বশরৈঃ সায়কাংশ্চ তান্‌।। ২৯

ততো নিশুম্ভো বেগেন গদামাদায় চণ্ডিকাম্‌।

অভ্যধাবত বৈ হন্তুং দৈত্যসেনাসমাবৃতঃ।। ৩০

তস্যাপতত এবাশু গদাং চিচ্ছেদ চণ্ডিকা।

খড়্গেন শিতধারেণ স চ শূলং সমাদদে।। ৩১

শূলহস্তং সমায়ান্তং নিশুম্ভমমরার্দনম্‌।

হৃদি বিব্যাধ শূলেন বেগাবিদ্ধেন চণ্ডিকা।। ৩২

[ততঃ ভগবতী ক্রুদ্ধা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। চিচ্ছেদ তানি চক্রাণি স্ব-শরৈঃ সায়কান্‌ চ তান্‌।। ২৯

ততঃ নিশুম্ভঃ বেগেন গদাম্‌ আদায় চণ্ডিকাম্‌। অভ্যধাবত বৈ হন্তুম্‌ দৈত্য-সেনা-সমাবৃতঃ।। ৩০

তস্য আপততঃ এব আশু গদাম্‌ চিচ্ছেদ চণ্ডিকা। খড়্গেন শিত-ধারেণ স চ শূলম্‌ সমাদদে।। ৩১

শূল-হস্তম্‌ সমায়ান্তম্‌ নিশুম্ভম্‌ অমর-অর্দনম্‌। হৃদি বিব্যাধ শূলেন বেগ আবিদ্ধেন চণ্ডিকা।। ৩২]

তখন দেবী দুর্গা, দুর্গতনাশিনী ভগবতী, ক্রুদ্ধা হয়ে নিজের শর দিয়ে তার সকল চক্রাস্ত্র ছিন্ন করলেন। তখন নিশুম্ভ গদা হাতে দেবী চণ্ডিকাকে হত্যা করার জন্যে দৈত্যসেনা সমাবৃত হয়ে ধেয়ে এল। তাঁর শরীরে আঘাত করার আগেই দেবী চণ্ডিকা তৎক্ষণাৎ সেই গদা নিজের সুতীক্ষ্ণ খড়্গে ছিন্ন করলেন এবং হাতে শূল তুলে নিলেন। শূল হাতে দেবী, সামনে এগিয়ে আসতে থাকা দেব-বিদ্বেষী নিশুম্ভের বুকে প্রবল বেগে আঘাত করলেন এবং বিদ্ধ করলেন।      

ভিন্নস্য তস্য শূলেন হৃদয়ান্নিঃসৃতোঽপরঃ।

মহাবলো মহাবীর্যস্তিষ্ঠেতি পুরুষো বদন্‌।। ৩৩

তস্য নিষ্ক্রামতো দেবী প্রহস্য স্বনবৎ ততঃ।

শিরশ্চিচ্ছেদ খড়্গেন ততোঽসাবপতদ্‌ ভুবি।। ৩৪

ততঃ সিংহশ্চখাদোগ্রদংষ্ট্রাক্ষুণ্ণশিরোধরান্‌।

অসুরাংস্তাংস্তথা কালী শিবদূতী তথাপরান্‌।। ৩৫

 [ভিন্নস্য তস্য শূলেন হৃদয়াৎ নিঃসৃতঃ অপরঃ। মহাবলঃ মহাবীর্যঃ তিষ্ঠ-ইতি পুরুষঃ বদন্‌।। ৩৩

তস্য নিষ্ক্রামতঃ দেবী প্রহস্য স্বনবৎ ততঃ। শিরঃ চিচ্ছেদ খড়্গেন ততঃ অসৌ অপতৎ ভুবি।। ৩৪

ততঃ সিংহঃ চখাদ-উগ্র-দংষ্ট্রা-ক্ষুণ্ণ শিরঃ-ধরান্‌। অসুরান্‌ তান্‌ তথা কালী শিবদূতী তথাপরান্‌।। ৩৫]

নিশুম্ভের শূলবিদ্ধ হৃদয় থেকে অন্য এক মহাপরাক্রমী মহাবীর পুরুষ বেরিয়ে এসে বলল, “থাম, থাম”। নিশুম্ভের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা সেই অসুরকে দেখে দেবী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন, তারপর খড়্গ দিয়ে তার শিরোচ্ছেদ করলেন। তখন দেবীর বাহন সিংহ ধারালো দাঁতে অসুরদের ধর থেকে মুণ্ড আলাদা করতে লাগল এবং দেবী কালী ও শিবদূতীও অন্যান্য অসুরসেনাদের নিধন করলেন।

কৌমারীশক্তিনির্ভিন্নাঃ কেচিন্নেশুর্মহাসুরাঃ।

ব্রহ্মাণীমন্ত্রপুতেন তোয়েনান্যে নিরাকৃতাঃ।। ৩৬

মাহেশ্বরীত্রিশূলেন ভিন্নাঃ পেতুস্তথাপরে।

বারাহীতুণ্ডঘাতেন কেচিচ্চূর্ণীকৃতা ভুবি।। ৩৭

খণ্ডং খণ্ডঞ্চ চক্রেণ বৈষ্ণব্যা দানবাঃ কৃতাঃ।

বজ্রেণ চৈন্দ্রীহস্তাগ্রবিমুক্তেন তথাপরে।। ৩৮

কেচিদ্বিনেশুরসুরাঃ কেচিন্নষ্টা মহাহবাৎ।

ভক্ষিতাশ্চাপরে কালীশিবদূতীমৃগাধিপৈঃ।। ৩৯

[কৌমারী-শক্তি-নির্ভিন্নাঃ কে চিৎ নেশুঃ মহাসুরাঃ। ব্রহ্মাণী-মন্ত্র-পুতেন তোয়েন অন্যে নিরাকৃতাঃ।। ৩৬

মাহেশ্বরী-ত্রিশূলেন ভিন্নাঃ পেতুঃ তথা অপরে। বারাহী-তুণ্ড-ঘাতেন কে চিৎ চূর্ণীকৃতা ভুবি।। ৩৭

খণ্ডম্‌ খণ্ডম্‌ চ চক্রেণ বৈষ্ণব্যা দানবাঃ কৃতাঃ। বজ্রেণ চ ঐন্দ্রী-হস্ত-অগ্র-বিমুক্তেন তথা অপরে।। ৩৮

কে চিৎ বিনেশুঃ অসুরাঃ কে চিৎ নষ্টা মহা-আহবাৎ। ভক্ষিতাঃ চ অপরে কালী-শিবদূতী-মৃগ-অধিপৈঃ।। ৩৯]

মহাসুরদের কেউ কেউ কৌমারীর শক্তি-অস্ত্রে ছিন্নভিন্ন হল, কেউবা ব্রহ্মাণীর মন্ত্রপূতঃ জলে বিনষ্ট হল। তারপরে মাহেশ্বরীর ত্রিশূলে কেউ বিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হল, কেউ আবার বারাহীর তুণ্ডের আঘাতে বিচূর্ণ হল। বৈষ্ণবী তাঁর চক্র দিয়ে এবং ঐন্দ্রীর হাতের নিক্ষিপ্ত বজ্রের আঘাতে দানবেরা খণ্ড-বিখণ্ড হল। সেই যুদ্ধে কোন কোন অসুর নিহত হল, কেউ কেউ অদৃশ্য হল, দেবী কালী ও শিবদূতি এবং মৃগরাজ সিংহ অনেক অসুরকে ভক্ষণও করে ফেলল।  

                       ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে নিশুম্ভবধো 

নাম নবমোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

নিশুম্ভ বধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার নবম অধ্যায় সমাপ্ত


উত্তরচরিত

দশম অধ্যায়

ধ্যান

উত্তপ্তহেমরুচিরাং রবিচন্দ্রবহ্নিনেত্রাং ধনুঃশরযুতাঙ্কুশপাশশূলম্‌।

রম্যৈর্ভুজৈশ্চ দধতীং শিবশক্তিরূপাং কামেশ্বরীং হৃদি ভজামি ধৃতেন্দুলেখাম্‌।।

[উত্তপ্ত-হেম-রুচিরাম্‌ রবি-চন্দ্র-বহ্নি-নেত্রাম্‌ ধনুঃ-শরযুত-অঙ্কুশ-পাশ-শূলম্‌। রম্যৈঃ ভুজৈঃ চ দধতীম্‌ শিব-শক্তি-রূপাম্‌ কাম-ঈশ্বরীম্‌ হৃদি ভজামি ধৃত-ইন্দু-লেখাম্‌।।]

তপ্ত-সোনার মতো যিনি তেজোময়ী, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি যাঁর ত্রিনয়ন, যাঁর রম্য চার হাতে শরযুক্ত-ধনু, অঙ্কুশ, পাশ ও শূল শোভা পায়, যিনি শিব-শক্তিরূপা অভীষ্টপ্রদায়িনী, ললাটে চন্দ্রকলা শোভিত সেই দেবীকে আমি হৃদয়ে ধ্যান করি।   

 

দশম অধ্যায় – শুম্ভবধ

ঋষিরুবাচ।

নিশুম্ভং নিহতং দৃষ্ট্বা ভ্রাতরং প্রাণসম্মিতম্‌।

হন্যমানং বলঞ্চৈব শুম্ভঃ ক্রুদ্ধোঽব্রবীদ্‌ বচঃ।। ১

বলাবলেপদুষ্টে ত্বং মা দুর্গে গর্বমাবহ।

অন্যাসাং বলমাশ্রিত্য যুধ্যসে যাঽতিমানিনী।। ২

[ঋষিঃ উবাচ। নিশুম্ভম্‌ নিহতম্‌ দৃষ্ট্বা ভ্রাতরম্‌ প্রাণ-সম্মিতম্‌। হন্যমানম্‌ বলম্‌ চ এব শুম্ভঃ ক্রুদ্ধঃ অব্রবীৎ বচঃ।। ১

বল-অবলেপ-দুষ্টে ত্বম মা দুর্গে গর্বম-আবহ। অন্যাসাম্‌ বলম্‌ আশ্রিত্য যুধ্যসে যা অতিমানিনী।। ২]

ঋষি বললেন। প্রাণপ্রতিম ভাই নিশুম্ভকে নিহত হতে দেখে এবং অজস্র অসুরসেনাদের বিনষ্ট হতে দেখে ক্রুদ্ধ শুম্ভ বলল, “রে দুষ্টে দুর্গে, তুমি শক্তির গর্ব করো না, অন্য দেবীদের সাহায্যে যুদ্ধ করেই তোমার এই অতি গর্ব”।    

দেব্যুবাচ।

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।

পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্‌বিভূতয়ঃ।। ৩

ঋষিরুবাচ।

ততঃ সমস্তাস্তা দেব্যো ব্রহ্মাণীপ্রমুখা লয়ম্‌।

তস্যা দেব্যাস্তনৌ জগ্মুরেকৈবাসীৎ তদাম্বিকা।। ৪

দেব্যুবাচ।

অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।

তৎ সং হৃতং ময়ৈকৈব তিষ্ঠ্যাম্যাজৌ স্থিরো ভব।। ৫

[দেবী উবাচ। একা এব অহং জগতি অত্র দ্বিতীয়া কা মম অপরা। পশ্য এতাঃ দুষ্ট ময়ি এব বিশন্ত্যঃ মৎ-বিভূতয়ঃ।। ৩

ঋষিঃ উবাচ। ততঃ সমস্তাঃ তাঃ দেব্যঃ ব্রহ্মাণীপ্রমুখা লয়ম্‌। তস্যা দেব্যাঃ তনৌ জগ্মুঃ একা-এব আসীৎ তদা-অম্বিকা।। ৪

দেবী উবাচ। অহম্‌ বিভূত্যা বহুভিঃ ইহ রূপৈঃ যৎ আস্থিতা। তৎ সংহৃতম্‌ ময়া একা এব তিষ্ঠ্যামি আজৌ স্থিরঃ ভব।। ৫]

দেবী বললেন, “জগতে আমিই একা, আমি ছাড়া দ্বিতীয় আর কে আছে? রে দুরাত্মা, এই দেবীরা সকলেই আমার বিভূতি, দেখ এরা আমার মধ্যেই প্রবেশ করবে। [“আমিই একা” – অর্থাৎ তিনিই আদ্যাশক্তি, তিনি জগতের থেকে পৃথক নন, জগতও তিনি ছাড়া কিছুই নয়। তিনি জগন্ময়ী এবং জগতও তন্ময় – অর্থাৎ তিনি-ময়।] 

ঋষি বললেন, তখন ব্রহ্মাণীপ্রমুখা সমস্ত দেবী তাঁর মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন, তাঁর তনুতে যখন সকল দেবী লীন হল, তিনিই একা দেবী অম্বিকা রইলেন।

দেবী বললেন, যে বহু বিভূতিরূপে আমি বিরাজ করছিলাম, তাঁদের সকলকে সংহত করে আমি এখন একা হয়েই রইলাম, তুমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।

ঋষিরুবাচ।

ততঃ প্রববৃতে যুদ্ধং দেব্যাঃ শুম্ভস্য চোভয়োঃ।

পশ্যতাং সর্বদেবানামসুরাণাঞ্চ দারুণম্‌।।

শরবর্ষৈঃ শিতৈঃ শস্ত্রৈস্তথাস্ত্রৈশ্চৈব দারুণৈঃ।

তয়োর্যুদ্ধম্ভূদ্‌ ভুয়ঃ সর্বলোকভয়ঙ্করম্‌।। ৭

[ঋষিঃ উবাচ। ততঃ প্রববৃতে যুদ্ধম্‌ দেব্যাঃ শুম্ভস্য চ উভয়োঃ। পশ্যতাম সর্ব-দেবানাম্‌-অসুরাণাম্‌ চ দারুণম্‌।। ৬

শরবর্ষৈঃ শিতৈঃ শস্ত্রৈঃ তথা অস্ত্রৈঃ চ এব দারুণৈঃ। তয়োঃ যুদ্ধম্‌ অভূৎ ভুয়ঃ সর্ব-লোক-ভয়ঙ্করম্‌।। ৭]

ঋষি বললেন, তখন সমস্ত দেবতা ও অসুরদের সামনে দেবী ও শুম্ভ – উভয়েই,  দারুণ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তাঁদের সেই যুদ্ধে তীরের বর্ষণ, তীক্ষ্ণ শস্ত্র এবং ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধ শুরু হল, তা সর্বলোকের কাছেই ভীতিপ্রদ।

দিব্যান্যস্ত্রাণি শতশো মুমুচে যান্যথাম্বিকা।

বভঞ্জ তানি দৈত্যেন্দ্রস্তৎপ্রতিঘাতকর্তৃভিঃ।। ৮

মুক্তানি তেন চাস্ত্রাণি দিব্যানি পরমেশ্বরী।

বভঞ্জ লীলয়ৈবোগ্রহুঙ্কারোচ্চারণাদিভিঃ।। ৯

ততঃ শরশতৈর্দেবীমাচ্ছদয়ত সোঽসুরঃ।

সাপি তৎ কুপিতা দেবী ধনুশ্চিচ্ছেদ চেষুভিঃ।। ১০

[দিব্যানি অস্ত্রাণি শতশঃ মুমুচে যা অন্যথা অম্বিকা। বভঞ্জ তানি দৈত্য-ইন্দ্রঃ তৎ প্রতিঘাত-কর্তৃভিঃ।। ৮

মুক্তানি তেন চ অস্ত্রাণি দিব্যানি পরম-ঈশ্বরী। বভঞ্জ লীলয়া এব উগ্র-হুঙ্কার-উচ্চারণ-আদিভিঃ।। ৯

ততঃ শর-শতৈঃ দেবীম্‌ আচ্ছদয়ত সঃ অসুরঃ। স অপি তৎ কুপিতা দেবী ধনুঃ চিচ্ছেদ চ ইষুভিঃ।। ১০]

দেবী অম্বিকা যে শতশত দিব্য-অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, দৈত্যরাজ তাদের সবগুলিকেই প্রতিহত করে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। শুম্ভও যে সকল দিব্য অস্ত্র পরমেশ্বরীর দিকে প্রয়োগ করছিল, প্রচণ্ড হুংকার ধ্বনিতে তিনি অনায়াসেই সেগুলিকে ভেঙে ফেললেন। তখন সেই অসুর দেবীকে শত-শত তীরে আচ্ছন্ন করে ফেলল, তাতে দেবী ক্রুদ্ধা হয়ে তির নিক্ষেপ করে, দৈত্যের ধনু ছিন্নভিন্ন করে দিলেন।

ছিন্নে ধনুষি দৈত্যেন্দ্রস্তথা শক্তিমথাদদে।

চিচ্ছেদ দেবী চক্রেণ তামপ্যস্য করস্থিতাম্‌।। ১১

ততঃ খড়্গমুপাদায় শতচন্দ্রঞ্চ ভানুমৎ।

অভ্যধাবৎ তদা দেবীং দৈত্যানামধিপেশ্বরঃ।। ১২

তস্যাপতত এবাশু খড়্গং চিচ্ছেদ চণ্ডিকা।

ধনুর্মুক্তৈঃ শিতৈর্বাণৈশ্চর্ম চার্ককরামলম্‌।। ১৩

হতাশ্বঃ স তদা দৈত্যশ্ছিন্নধন্বা বিসারথিঃ।

জগ্রাহ মুদ্গরং ঘোরমম্বিকানিধনোদ্যতঃ।। ১৪

[ছিন্নে ধনুষি দৈত্য-ইন্দ্রঃ তথা শক্তিম্‌ অথ আদদে। চিচ্ছেদ দেবী চক্রেণ তাম্‌ অপি অস্য কর-স্থিতাম্‌।। ১১

ততঃ খড়্গম্‌ উপাদায় শত-চন্দ্রম্‌ চ ভানুমৎ। অভ্যধাবৎ তদা দেবীম্‌ দৈত্যানাম্‌ অধিপ-ঈশ্বরঃ।। ১২

তস্য আপততঃ এব আশু খড়্গম্‌ চিচ্ছেদ চণ্ডিকা। ধনুঃ মুক্তৈঃ শিতৈঃ-বাণৈঃ চর্ম চ অর্ক-কর-অমলম্‌।। ১৩

হত-অশ্বঃ সঃ তদা দৈত্যঃ ছিন্ন-ধন্বা বিসারথিঃ। জগ্রাহ মুদ্গরম্‌ ঘোরম্‌ অম্বিকা-নিধন-উদ্যতঃ।। ১৪]

ধনুক ছিন্ন হওয়াতে দৈত্যরাজ হাতে শক্তি তুলে নিল, কিন্তু দেবী তাঁর চক্র দিয়ে, তার হাতে-ধরে-থাকা  সেই শক্তি ভেঙে ফেললেন। তখন সেই দৈত্যদের অধীশ্বর শত-চন্দ্রের মতো উজ্জ্বল খড়্গ হাতে নিয়ে দেবীর দিকে ধেয়ে গেল। কিন্তু আঘাত করার আগেই দেবী তাঁর ধনু থেকে তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করে, শুম্ভের সেই সূর্য-কিরণ তুল্য খড়্গ ও ঢাল ছিন্ন করে দিলেন। নিহত-অশ্ব, ছিন্ন-ধনু ও সারথিহীন সেই দৈত্য, তখন ভয়ংকর এক মুগুর নিয়ে দেবী অম্বিকাকে বধ করতে উদ্যত হল।   

চিচ্ছেদাপততস্তস্য মুদ্গরং নিশিতৈঃ শরৈঃ।

তথাপি সোঽভ্যধাবত্তাং মুষ্টিমুদ্যম্য বেগবান্‌।। ১৫

স মুষ্টিং পাতয়ামাস হৃদয়ে দৈত্যপুঙ্গবঃ।

দেব্যাস্তঞ্চাপি সা দেবী তলেনোরস্য তাড়য়ৎ।। ১৬

তলপ্রহারাভিহতো নিপপাত মহীতলে।

স দৈত্যরাজঃ সহসা পুনরেব তথোত্থিতঃ।। ১৭

উৎপত্য চ প্রগৃহ্যোচ্চৈর্দেবীং গগনমাস্থিতঃ।

তত্রাপি সা নিরাধারা যুযুধে তেন চণ্ডিকা।। ১৮

[চিচ্ছেদ আপততঃ তস্য মুদ্গরম্‌ নিশিতৈঃ শরৈঃ। তথা অপি সঃ অভ্যধাবৎ তাম্‌ মুষ্টিম্‌ উদ্যম্য বেগবান্‌।। ১৫

স মুষ্টিম্‌ পাতয়ামাস হৃদয়ে দৈত্যপুঙ্গবঃ। দেব্যাঃ তম্‌ চ অপি সা দেবী তলেন উরসি অতাড়য়ৎ।। ১৬

তল-প্রহার-অভিহতঃ নিপপাত মহীতলে। সঃ দৈত্যরাজঃ সহসা পুনঃ এব তথা উত্থিতঃ।। ১৭

উৎপত্য চ প্রগৃহ্যঃ উচ্চৈঃ দেবীম্‌ গগনম্‌ আস্থিতঃ। তত্র অপি সা নিঃ-আধারা যুযুধে তেন চণ্ডিকা।। ১৮]

দেবীর তীক্ষ্ণ তিরের আঘাতে তার সেই মুগুরও ছিন্ন হল, কিন্তু তাও সে উদ্যত-মুষ্টিতে দেবীর দিকে দ্রুতবেগে ধেয়ে এল। দৈত্যবীরের সেই মুষ্টি দেবীর বক্ষে আঘাত করল, দেবীও তার বুকে চপেটাঘাত করলেন। সেই চপেটাঘাতে দৈত্যরাজ মাটিতে পড়ে গেল, কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই সে আবার উঠে দাঁড়াল। এবার সে দেবীকে নিয়ে উঁচু এক লাফ দিয়ে আকাশে উঠে পড়ল, কিন্তু সেখানে নিরালম্ব-অবস্থাতেও দেবী চণ্ডিকা যুদ্ধ করতে লাগলেন।

নিযুদ্ধং খে তদা দৈত্যশ্চণ্ডিকা চ পরষ্পরম্‌।

চক্রতুঃ প্রথমং সিদ্ধমুনিবিস্ময়কারকম্‌।। ১৯

ততো নিযুদ্ধং সুচিরং কৃত্বা তেনাম্বিকা সহ।

উৎপাত্য ভ্রাময়ামাস চিক্ষেপ ধরণীতলে।। ২০

স ক্ষিপ্তো ধরণীং প্রাপ্য মুষ্টিমুদ্যম্য বেগতঃ।

অভ্যধাবত দুষ্টাত্মা চণ্ডিকানধনেচ্ছয়া।। ২১

[নিযুদ্ধম্‌ খে তদা দৈত্যঃ চণ্ডিকা চ পরঃ-পরম্‌। চক্রতুঃ প্রথমম্‌ সিদ্ধ-মুনি-বিস্ময়-কারকম্‌।। ১৯

ততঃ নিযুদ্ধম্‌ সুচিরম্‌ কৃত্বা তেন অম্বিকা সহ। উৎপাত্য ভ্রাময়ামাস চিক্ষেপ ধরণীতলে।। ২০

সঃ ক্ষিপ্তঃ ধরণীম্‌ প্রাপ্য মুষ্টিম্‌ উদ্যম্য বেগতঃ। অভ্যধাবত দুষ্ট-আত্মা চণ্ডিকা-নিধন-ইচ্ছয়া।। ২১]

আকাশে দেবী-চণ্ডিকা ও দৈত্যের মধ্যে অভূতপূর্ব সেই বাহুযুদ্ধ সিদ্ধমুনিদের কাছেও বিস্ময়জনক। সেখানে দীর্ঘ সময় বাহুযুদ্ধের পর দেবী অম্বিকা অসুরকে উপরে-তুলে-ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আছড়ে ধরাতলে ফেললেন। কিন্তু সেই দুরাত্মা মাটিতে পড়েই, দেবী চণ্ডিকাকে নিধনের ইচ্ছায়, উদ্যত মুষ্টি করে আবার দ্রুত বেগে ধেয়ে গেল।

তমায়ান্তং ততো দেবী সর্বদৈত্যজনেশ্বরম্‌।

জগত্যাং পাতয়ামাস ভিত্ত্বা শূলেন বক্ষসি।। ২২

স গতাসু পপাতোর্ব্যাং দেবীশূলাগ্রবিক্ষতঃ।

চালয়ন্‌ সকলাং পৃথ্বীং সাবধিদ্বীপাং সপর্বতাম্‌।। ২৩

ততঃ প্রসন্নমখিলং হতে তস্মিন্‌ দুরাত্মনি।

জগৎ স্বাস্থ্যমতীবাপ নির্মলঞ্চাভবন্নভঃ।। ২৪

[তম্‌ আয়ান্তম্‌ ততঃ দেবী সর্ব-দৈত্য-জন-ঈশ্বরম্‌। জগত্যাম্‌ পাতয়ামাস ভিত্ত্বা শূলেন বক্ষসি।। ২২

সঃ গতাসু পপাতঃ উর্ব্যাং দেবী-শূল-অগ্র-বিক্ষতঃ। চালয়ন্‌ সকলাম্‌ পৃথ্বীম্‌ স-অবধি-দ্বীপাম্‌ স-পর্বতাম্‌।। ২৩

ততঃ প্রসন্নম্‌ অখিলম হতে তস্মিন্‌ দুরাত্মনি। জগৎ স্বাস্থ্যম্‌ অতীব আপ নির্মলম্‌ চ ভবৎ নভঃ।। ২৪]

তখন দেবী ধেয়ে আসা সেই সর্ব-দৈত্যজন-প্রভুর বুকে শূল বিদ্ধ করে মাটিতে ফেললেন। দেবীর শূলের আঘাতে বিক্ষত সেই নিহত দৈত্য যখন মাটিতে পড়ল, সমস্ত পৃথিবী, সকল সাগর, দ্বীপ ও পর্বত কেঁপে উঠল। সেই দুরাত্মার মৃত্যুতে সমস্ত চরাচর অত্যন্ত প্রসন্ন হল, জগৎ সুস্থ এবং আকাশ নির্মল হল।

উৎপাতমেঘাঃ সোল্কা যে প্রাগাসংস্তে শমং যযুঃ।

সরিতো মার্গবাহিন্যস্তথাসংস্তত্র পাতিতে।। ২৫

ততো দেবগণাঃ সর্বে হর্ষনির্ভরমানসাঃ।

বভূবুর্নিহতে তস্মিন গন্ধর্বাং ললিতং জগুঃ।। ২৬

অবাদয়ংস্তথৈবান্যে ননৃতুশ্চাপ্সরোগণাঃ।

ববুঃ পুণ্যাস্তথা বাতাঃ সুপ্রভোঽভুদ্দিবাকরঃ।। ২৭

জজ্বলুশ্চাগ্নয়ঃ শান্তাঃ শান্তদিগ্‌জনিতস্বনাঃ।। ২৮

[উৎপাত মেঘাঃ স-উল্কা যে প্রাক্‌ আসন্‌ তে শমম্‌ যযুঃ। সরিতঃ মার্গ-বাহিন্যঃ তথা আসন্‌ তত্র পাতিতে।। ২৫

ততঃ দেবগণাঃ সর্বে হর্ষ-নির্ভর-মানসাঃ। বভূবুঃ নিহতে তস্মিন গন্ধর্বাম্‌ ললিতম্‌ জগুঃ।। ২৬

অবাদয়ন্‌ তথা এব অন্যে ননৃতুঃ চ অপ্সরোগণাঃ। ববুঃ পুণ্যাঃ তথা বাতাঃ সুপ্রভঃ অভুৎ দিবাকরঃ।। ২৭

জজ্বলুঃ চ অগ্নয়ঃ শান্তাঃ শান্ত-দিক্‌-জনিত-স্বনাঃ।। ২৮]

শুম্ভর পতনের আগে উল্কাপাতে বিঘ্ন-সৃষ্টিকারী মেঘেরা শান্ত হল, নদীগুলির প্রতিকূলতা দূর হল। শুম্ভ নিহত হওয়ায় সকল দেবতাদের মন আনন্দময় হল, গন্ধর্বরা মধুরস্বরে গান গাইতে লাগল। অন্যেরা যখন বাদ্য বাজাতে লাগল, অপ্সরাগণ শুরু করল নৃত্য। বাতাস পবিত্র হল, সূর্য সুদীপ্ত হল। সর্বদিকের অমঙ্গল-ধ্বনি প্রশমিত করে প্রশান্ত যজ্ঞ-অগ্নি জ্বলে উঠল।

                       ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে শুম্ভবধো 

নাম দশমোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

শুম্ভ বধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার দশম অধ্যায় সমাপ্ত


...চলবে...

এর পরে আসবে শেষ পর্ব - থাকবে শ্রীশ্রী চণ্ডীর উত্তর চরিত একাদশ থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায়। 

গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

চোদ্দ শাক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉   বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার...