সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫

চোদ্দ শাক

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]


মা-কালীর মর্ত্যে আবির্ভাব দিবস কার্তিক মাসের অমাবস্যায়। তাঁর আসার আগের দিন চতুর্দশী তিথিতে পৃথিবীতে নাকি ভূত-প্রেত-পেত্নী-শাঁকচুন্নি, ব্রহ্মদৈত্য প্রমুখদের উৎপাত বাড়ে। (পৃথিবী বলতে অবশ্য সনাতন-ধর্ম বিশ্বাসী পৃথিবী বুঝতে হবে, কারণ ইসলাম এবং খ্রিস্টিয় ধর্মে বিশ্বাসী দুনিয়ায় কিংবা ওয়ার্ল্ডেও এমন ঘটনা ঘটে তবে ঠিক এই দিনটাতে নয়, অন্য কোন বিশেষ বিশেষ দিনে।) মা কালীর চ্যালা-চামুণ্ডা, ডাকিনী-যোগিনীদের অকস্মাৎ এই উৎপাত বাড়ার কারণটা সিকিউরিটি রিজ্‌ন্‌ হতে পারে কি? দিল্লি থেকে আমাদের রাজ্যের কোন শহরে ভিভিআইপি আসার আগের কয়েকদিন যেমন নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতা বাড়ে – সেরকম!

না, তাও নয়। কারণ নিরাপত্তা-বলয় গড়ে তোলার তাগিদে শহরের কিছু কিছু অঞ্চল বা কয়েকটি প্রধান সড়ক যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, আমরা উদ্ভট রকমের জ্যাম-জটে জড়িয়ে থাকি – গুড়ের নাগরিতে আটকে থাকা মাছি বা পিঁপড়ের মতো। কিন্তু মা কালীর অদৃশ্য অশরীরী ভূত-প্রেতদের কারণে আমাদের সামাজিক বা নাগরিক জীবন-যাত্রায় তেমন কোন প্রভাব লক্ষ্য করি না। অতএব, সুরক্ষার কারণে চতুর্দশীর দিন মা কালীর চতুর সাঙ্গোপাঙ্গোরা আমাদের কোনভাবেই উৎপাত করে না।

তাহলে আমাদের শাস্ত্র-পুরাণে ভূত-চতুর্দশীতে ভূতেদের কেন চতুর ও দোষী বানানো হল? কেনই বা বিধান দেওয়া হল এই দিন চোদ্দ-শাক খেতেই হবে। শাক খেয়ে ভূত তাড়ানো যায় – এমন কথা আবহমানকাল থেকে যত ভূতের গল্প আমরা শুনেছি বা পড়েছি -  কোথাও কোন ভূতের ওঝা বা গুণিনকে কখনো বলতে শোনা যায়নি।                

এই চোদ্দ শাক নিয়ে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর “চিরঞ্জীব বনৌষধি (২য় খণ্ড)” গ্রন্থে কী বলেছেন, দেখে নেওয়া যাক -

 “চোদ্দশাক খেলে নাকি কার্তিকের টান থেকে রেহাই পাওয়া যায়; কারণ এই মাসে যমের বাড়ির ৮টি দরজা খোলা থাকে -  এই প্রবাদটি আজও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

যদি এটিকে গেঁয়ো বাচস্পতি শাস্ত্রের কথা বলে উড়িয়ে দেওয়াও যায়, কিন্তু এ কথাটার যে একটা মৌল কারণ আছে এবং তার পিছনে বিজ্ঞানও যে আছে, সেটার অনুসন্ধান অগোচরেই বা থাকে কেন? এটা তো ঠিক যে তখনকার যুগের চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এবং ষোড়শ শতাব্দীর রঘুনন্দনের গ্রন্থাবলীতেও এটিকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে”।

কে এই রঘুনন্দন? রঘুনন্দন ভট্টাচার্য চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক যুগের বিখ্যাত বাঙালী শাস্ত্রজ্ঞ, স্মার্ত (স্মৃতি > স্মার্ত) পণ্ডিত এবং লেখক ছিলেন। বলা হয় ষোড়শ শতাব্দীতে – চৈতন্যদেবের জন্মের পঁচিশ বছর পর – নবদ্বীপে তাঁর জন্ম হয়। বাংলা তথা পূর্বভারতের অধিকাংশ হিন্দু সমাজ নানান অনুষ্ঠান, পূজা, পার্বণ, ব্রত পালন এবং পঞ্জিকা রচনার বিধি-বিধান তাঁর রচিত গ্রন্থ থেকেই অনুসরণ করে থাকে।

এই প্রসঙ্গে ‘স্মৃতি’ নিয়েও দু চার কথা বলে নিই।

আমরা সকলেই জানি আর্যরা এদেশে এসে তাদের মৌরসী-পাট্টা বসানোর সময় ঋগ্বেদ এবং অন্য তিনটি বেদ ছিল তাদের সকল রকম বিধি-বিধান – নিয়মকানুনের একমাত্র শাস্ত্র। এই বেদ অপৌরুষেয় – অর্থাৎ কোন মানুষের রচনা নয়, অতএব তার কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংস্কার ইত্যাদি করার কোন প্রশ্নই উঠত না। বেদ প্রসঙ্গে কদাচ কেউ কোন সংশয় বা দ্বিধা প্রকাশ করলে তার পরিণতি হয়ে উঠত সাংঘাতিক।

কিন্তু বেদ নামক গ্রন্থগুলি নিত্য-পরিবর্তনশীল মানুষের সমাজ-জীবনকে চিরকাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এমন হতে পারে না এবং হয়ওনি। মহাভারতের যুগ পার হয়ে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ভারতীয় সমাজে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল যে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে, বেদ নামক গ্রন্থগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে লাগল। সত্যি বলতে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য সমাজপতিরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন এই ভেবে যে, এভাবে চললে, রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ প্রজা কেউই যদি বেদকে আর গণ্যিমান্যি না করে, তাহলে তাঁদের কী হবে?         

এই পরিস্থিতি সামাল দিতে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতে মনু নামের কোন একজন ঋষি বা ঋষিবৃন্দ “স্মৃতি-সংহিতা” নামক বিশাল এক শাস্ত্র রচনা করলেন। এই শাস্ত্র সমসাময়িক সমাজের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় নিয়েই নানা বিধি-বিধান, কী করণীয়, কী অকরণীয়, কোনটা পাপকর্ম আর কোনটাই বা পুণ্যকর্ম – সব কিছু নির্ধারণ করে দিল।

এর ফলে কি বেদ পুরো বাতিল হয়ে গেল? মোটেই না, বরং বলা হল শ্রুতি ও স্মৃতি এক অপরের পরিপূরক, স্মৃতিতে যদি কোন বিষয়ে কোন সংশয় ঘটে – তার সমাধান করতে হবে বেদ থেকে। অর্থাৎ শ্রুতি স্মৃতির থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ কথাটি যে বিভ্রান্তিমূলক, সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। প্রথম কারণ বেদের রচনাকাল স্মৃতির রচনাকাল থেকে প্রায় বারোশ থেকে চোদ্দশ বছর আগে। দ্বিতীয় কারণ বেদের সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতি ও স্মৃতির সামাজিক অবস্থানের মধ্যে ঘটে গেছে আকাশ-পাতাল তফাৎ। অতএব স্মৃতির কোন বিষয় যদি স্পষ্ট না হয়, তার সমাধান বেদ থেকে কী করে হতে পারে?

তবে শ্রুতি বা বেদ যেমন চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়, স্মৃতি কিন্তু তা নয়। মনুসংহিতার পরেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন অঞ্চলে নানান নামে বহু স্মৃতি-গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম আমাদের বাংলার স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য।

 এবার ধান ভানতে শিবের গীত ছেড়ে আবার চোদ্দ শাকেই ফিরে আসি।

আমাদের দেশে বিশেষ করে বাংলা এবং পূর্ব ভারতে ঋতুগুলি বড় বেশি প্রকট। কোন ক্যালেণ্ডার না দেখেও প্রকৃতি-পরিবেশ ও শারীরীক অনুভব থেকেও কোন সময় কোন ঋতু বেশ টের পাওয়া যায়। যেমন খুব স্পষ্ট টের পাই বর্ষা শেষ হয়ে শরতের আগমন। কিংবা শরৎ শেষ হয়ে সামান্য হিমের ছোঁয়া লাগা হেমন্তকে চিনতেও আমাদের অসুবিধা হয় না। অথবা শীত শেষে মধুকালের আগমন।

এই ঋতু-পরিবর্তন আমাদের মনে এবং শরীরে নানান ভাবে প্রভাব ফেলে। বর্ষা শেষে শরতের – বিশেষ করে ভাদ্রের - ভ্যাপসা ক্লান্তিকর ঘেমো গরমের পর হেমন্তের বিকেলে সামান্য হিমের পরশ-লাগা বাতাস আমাদের মন-প্রাণ যেমন জুড়িয়ে দেয়, তেমনি তার সঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসে নানান ব্যাধিও। বিজ্ঞানীরা বলেন বিশেষ বিশেষ ঋতু-পরিবর্তনের সময় নানান ভাইরাস – যারা অন্য সময় নিষ্ক্রিয় জড়পদার্থ হয়ে থাকে – তারা অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভাইরাসের কাহিনী ষোড়শ শতাব্দীর স্মার্ত পণ্ডিতের জানার কথা নয় – কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তাঁরা জানতেন – আশ্বিন-কার্তিকের ঋতু পরিবর্তনের সময়টা আমাদের শরীরের পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। তাঁরা এই সময়টাকে বলেছেন “যমদংষ্ট্রা কাল” – অর্থাৎ মৃত্যু-দংশনের কাল।

ভয়ংকর এই কালের প্রতিষেধক হিসাবে বাংলার নব্য-স্মৃতিকার রঘুনন্দন চোদ্দশাক খাওয়ার বিধান দিয়েছেন। তাঁর গ্রন্থের শ্লোক থেকে পাওয়া যায়, কার্তিক মাসে ভূত-চতুর্দশীর দিনে অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন, চোদ্দটি বিশেষ শাক খেলে যমের দংশন এড়িয়ে ভালোভাবেই বেঁচে-বর্তে থাকা যায়। এই চোদ্দটি কোন কোন কোন শাক – দেখে নেওয়া যাকঃ-

 

 

শাকের নাম

উপকারিতা

ওলের পাতা

কোষ্ঠ সাফ করায়, পিত্ত নাশ করে।

কেঁউ

কৃমিকে প্রতিহত করে।  

বেতো বা বেথুয়া

লিভারকে শাসন করে।

কালকাসুন্দে

কাশি এবং কফ নাশ করে।

সরিষা

কোষ্ঠ সাফ হওয়ার সহায়ক।

নিম

পিত্তজ চর্মরোগ নাশ করে।

জয়ন্তী

ঠাণ্ডা লাগা বা কাঁচা সর্দি প্রতিহত করে।

শালিঞ্চ বা শাঞ্চি

দুর্বলতা ও আলস্য দূর হয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

গুড়ুচি বা গুলঞ্চ পাতা

বায়ুবিকার দূর করে।

১০

পলতা – পটোল পাতা

পিত্তদোষকে সংশোধন করে।

১১

শেলকা বা শুলফা

ক্ষিধে বাড়ায়, মুখে রুচি আনে।

১২

হিঞ্চে বা হেলেঞ্চা

হজম শক্তি বাড়ায়, রক্তে লোহিত কণিকা বাড়ায়।

১৩

ভাঁট বা ঘেঁটু পাতা

কৃমিকে প্রতিহত করে।

১৪

সুষুনি বা সুশনি

স্নায়ুকে শান্ত রাখে, সুনিদ্রা হয়।

        

আবার অন্য মতে*, ওপরের সারণির তিনটি শাক নেই – যেমন ওল, কেঁউ, শেলকা, তার জায়গায় যে তিনটি শাকের নাম পাচ্ছি –

১) থানকুনি – রক্তসঞ্চালন বাড়ায় ও চর্মরোগ উপশম করে।

২) কুলেখাড়া - রক্তাল্পতা দূর করে।

৩) পুনর্নবা বা পুনকে – কোষ্ঠ সাফ করায়, কিডনিকে সুস্থ রাখে।      

আজকের দিনে কলকাতা শহরে এই সবকটি শাক একত্রে পাওয়া দুঃসাধ্য, প্রায় অসম্ভব। যাঁরা মফস্বল শহরে বা গ্রামে থাকেন এবং অনেক ধরনের গাছগাছড়া চেনেন, তাঁরা চোদ্দটি না হলেও অন্ততঃ আট-দশটি শাক অনায়াসে যোগাড় করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু বিগত দুদিন বাজারে চোদ্দ শাক বলে বহুমূল্য যে পাঁচমিশালী টুকরো পাতার সম্ভার বিক্রি হতে দেখেছি, তাতে বড়ো জোর পাঁচটি শাকই পেয়েছি। তার মধ্যে দুটি পাতা খুব চেনা সাদা নটে আর লাল নটে। দু একজনের কাছে আবার এই মিশ্রণে ফুলকপির ছেঁড়াপাতাও দেখেছি। নটে বা ফুলকপির পাতায় কোন ভেষজ গুণ নেই তা বলছি না, কিন্তু শাস্ত্রীয় চোদ্দ শাকের মধ্যে এদের স্থান নেই। অতএব কলকাতা মহানগরে বাস করে, চোদ্দ শাক খেয়ে নিশ্চিন্তে ভূত-চতুর্দশী পালন করে ফেলেছেন, এমন ভাবনার অবকাশ আপনার নেই।

এখানে আমার আরেকটি প্রশ্ন আছে। এই চোদ্দ শাকের সবকটি যদি পাওয়াও যেত, সেটা কি মাত্র একদিন খেলেই যম দংশন থেকে মুক্তি পাওয়া যেত?

না ব্যাপারটা এত সহজ নয়, বরং শাস্ত্রীয় মতে এই দিন থেকে শুরু করে, এই শাকগুলি অন্ততঃ সপ্তাহ দুই বা তিনেক খাওয়া চলুক। পরিমাণে কম হোক, ক্ষতি নেই – কিন্তু নিয়মিত। উপরন্তু একসঙ্গে চোদ্দটি শাক না পেলেও, অন্য কয়েকটি শাক – যেমন হিঞ্চে, পলতা, নিম, কালকাসুন্দে, বেথুয়া, থানকুনি, কুলেখাড়া, পুনকে শাক মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়। সহজলভ্যতা অনুযায়ী একটি বা দুটি শাক বা পাতার ব্যঞ্জন নিয়মিত খাওয়ার পাতে থাকলে ক্ষতি তো নেই। চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে সামনের কিছু দিন – অন্ততঃ কার্তিক মাসটা।

 ---০০---

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ –

১) চিরঞ্জীব বনৌষধি (দ্বিতীয় খণ্ড) – আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য।              

২) *শ্রীমতী সম্রাজ্ঞী ভট্টাচার্য – বোটানির অধ্যাপিকা ও বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

চোদ্দ শাক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉   বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার...