[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
ছোটবেলায় আমরা মধ্য কলকাতার
কলেজস্ট্রিট পাড়ায় একটি ভাড়ার বাসায় থাকতাম। সেখান থেকে আমার স্কুল, দাদার
কলেজ ছিল পায়ে হাঁটা রাস্তায়। তখন আমাদের স্কুলজীবন শুরুই হতো ক্লাস ওয়ান থেকে। আর
ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত আমাদের স্কুল বসত সকাল বেলায়। বাবার হাত ধরে রোজ সকালে
সাদা জামা, সাদা হাফপ্যাণ্ট পড়ে আমরা স্কুলে যেতাম। হাতে থাকত বই খাতা ভরা স্টিলের
বা অ্যালুমিনিয়মের বাক্স।
আমাদের স্কুলবাড়িটা কলেজস্কোয়ার
বা গোলদীঘির উত্তর পশ্চিমদিকে। কাজেই সকাল বেলা স্কুল যাওয়ার পথে আমরা কলেজ
স্কোয়ারের ভেতর দিয়েই যেতাম। তাতে রাস্তাটা কম হত, আর মজাও লাগত খুব। গোলদীঘির জলে
সাঁতারু ছেলেদের ঝপাং ঝপাং ঝাঁপ মারা দেখতাম। দীঘির চারদিকের রাস্তার ধারের বেঞ্চে
বসে থাকতেন হাতে লাঠিওয়ালা অনেক বুড়ো মানুষ। অনেক মোটাসোটা মানুষ আবার দীঘির
চারদিক ধরে দৌড়ত। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের নিশ্বাসের হোঁসফোঁস আওয়াজ পেতাম ।
অনেকে আবার আমাদের ড্রিল ক্লাসের – এক, দুই তিন, চারের নিয়মে হাত নাড়তে নাড়তে
হেঁটে যেত পাশ দিয়ে। আমি হাঁ করে এইসব দেখতাম, আর স্কুল যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে,
বকা খেতাম বাবার কাছে।
পনেরই আগষ্টে স্কুলের ছাদে পতাকা
তুলতেন আমাদের হেডমাস্টারমশাই। ওই একদিনই আমাদের স্কুলের ছাদে যাওয়ার অনুমতি মিলত।
বাকি সারাবছর তালা দেওয়া থাকত ছাদের দরজায়। স্কুলের ছাদে উঠে আমরা অবাক হয়ে
দেখতাম, চারদিকে হাজার হাজার বাড়ির ছাদ। আর পশ্চিমদিকে বেশ খানিকটা দূরে হাওড়া
ব্রিজ। ছাদের আলসেতে বুক দিয়ে নিচেয় দেখতাম, কলেজস্ট্রিট ধরে গড়িয়ে চলা, ট্রাম,
বাস, ট্যাক্সি। ছাদ থেকে দেখে মনে হত যেন, সব ঝুলনের খেলনা। আমাদের পাড়ায় খুব
বড়োলোক পল্টুরা বাড়িতে ঝুলন সাজাতো। রঙিন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে, আর কাঠের ছোট্ট ছোট্ট
রেলগাড়ি, বাস, নৌকো, নানান রকম পুতুল দিয়ে। পল্টুদের বনেদি বিশাল যৌথ পরিবারটি ছিল
বৈষ্ণব, কৃষ্ণঠাকুরের যে কোন পুজোতেই ওদের বাড়িতে খুব ধুমধাম হতো।
পনেরই আগষ্টের একটু আগে বা পরে,
কলেজ স্কোয়ারে পুজোর মণ্ডপ বানানোর কাজ শুরু হয়ে যেত। খুব অবাক লাগত। গতকাল সকালে
যাবার সময় দেখলাম, কিচ্ছু নেই। আজ সকালে স্কুল যাবার সময় দেখলাম, মণ্ডপ বাঁধার
জায়গায় বাঁশের পাহাড়, আর মোটামোটা শালের গুঁড়ি। আমি হয়তো বাবাকে জিগ্যেস করলাম,
‘এত বাঁশ এনেছে কেন, গো’? বাবা বলতেন, ‘পুজোর মন্ডপ বানাতে হবে না? এই তো, আর মাস
দেড়েক পরেই পুজো। আর সময় কোথায়’? তারপরের দিন স্কুলে যাবার সময় দেখতাম, শালের
গুঁড়ির অনেকগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দু একদিন পরে দেখতাম শালের খুঁটির সঙ্গে
বাঁশের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর বাঁশের খাঁচা বানানো হয়ে যেত, আর মোটা
ত্রিপল দিয়ে ঢাকা পড়ে যেত সেই মস্ত খাঁচা। ত্রিপলে ঢাকার পর শুরু হত আসল কাজ।
নানান রংয়ের কাপড়ের কুঁচি বানানো। এই কুঁচি দেওয়া রঙিন কাপড়ে, ধীরে ধীরে অদ্ভূত
সুন্দর হয়ে উঠতে থাকত সেই মণ্ডপ।
কলেজ স্কোয়ারের মণ্ডপে যত রং ধরত,
আমার স্কুলে যাবার ইচ্ছের রং তত ফিকে হয়ে আসতো। সারাবছর অনায়াসে হেঁটে যাওয়া
স্কুলের রাস্তাটাকে মনে হতো কি কষ্টকর! মণ্ডপের সেজে ওঠা দেখতে দেখতে আমার
দুটো পা পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠতো! বাবা
আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতেন স্কুলের দিকে, বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা, হাঁ করা
ছেলে। এরপর স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আর ঢুকতে দেবে না’।
আমাদের মাথায় তখন শুধু কি কলেজ
স্কোয়ারের পুজো মণ্ডপ ঢুকে থাকত? ঢুকে থাকত পুজোর নতুন জামা প্যান্ট। ঢুকে থাকত
সেই নতুন জামা প্যান্টের গন্ধ। স্কুল থেকে ফিরে, দুপুরে ভাত খেয়ে, মায়ের কাছে নতুন
জামা প্যান্ট দেখানোর জন্য রোজ একবার বায়না করতাম। হাত বুলোতাম জামার গায়ে, গন্ধ
নিতাম। দেখে হেসে ফেলতেন মা, বলতেন, ‘দ্যাখো, পাগল ছেলের কাণ্ড দ্যাখো, রোজ রোজ কী
শুঁকিস কি’? জামার বুকে আর হাফ প্যান্টের পায়ের কাছে সুতো দিয়ে সেলাই করা থাকতো
দোকানের লেবেল। লেবেলগুলোতে কি সুন্দর লেখা থাকত ‘কমলালয় স্টোর্স’।
একবার মনে আছে, পুজোয় অনেক
বন্ধুদের নতুন জুতো কেনা হয়ে গেছে, আমার হয়নি। বাবা বলেছিলেন, আমার জুতোজোড়া নাকি
বেশ ভালোই আছে, এবারে আর জুতো কেনার দরকার নেই। ভীষণ রাগ হয়েছিল বাবার ওপর, আর
আমার খারাপ না হওয়া বিশ্বাসঘাতক জুতোর ওপর। পরদিন থেকে স্কুল চলার পথে, শুরু হল
জুতোর ওপর অমানুষিক অত্যাচার। ফুটপাথে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। পাথরে, ইঁটের টুকরোয়
অনেকবার ঠোক্কর খেলাম। কিন্তু জুতোর কিচ্ছু হল না। স্কুলে গিয়ে ডাবের খোলা দিয়ে
ফুটবল খেলার বুদ্ধি দিল কয়েকজন বন্ধু। এই উপায়ে আমার অনেক বন্ধুই নাকি সফল হয়েছে।
স্কুল শুরু হওয়ার আগে আর টিফিনের সময় চলতে লাগল আমাদের অনলস ফুটবলচর্চা।
ডাব নিয়ে ফুটবল চর্চার দিন
তিনেকের মাথায়, আমার জুতো হাল ছেড়ে দিল। আমার ডান পায়ের বিদ্ধস্ত জুতোর তলা থেকে,
মস্ত জিভের মতো, সোল খুলে গেল। আমার নিষ্ঠুর হাত থেকে তাও সে পরিত্রাণ পেল না।
মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার পথে, আমি পা ঘষে ঘষে, বিবর্ণ, বিকৃত করে দিলাম,
আমার জুতোর সেই মস্ত জিভ। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “জুতোর এই দশা কী করে হলো? কী
করিস কি স্কুলে গিয়ে”? আমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, “আমি তো বলেইছিলাম, এ জুতো আর
চলবে না। তোমরা বললে ভালোই আছে”। থমথমে মুখে মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে
রইলেন আমার মুখের দিকে। সেদিন আমার সারাটা দিন কাটল চাপা আতঙ্কে। মা এখন কিছু
বললেন না ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরলে? কী হবে? দিন যত গড়িয়ে
চলল সন্ধের দিকে, আমার বুকের ভেতর ঢিব ঢিব ততই বাড়তে লাগল।
বাবা ফিরলেন, জল খাবারের পর মা
আমার জুতোর করুণ অবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। বাবা উঠে গিয়ে নিজের চোখে
দেখলেন আমার জুতোর দশা। ঘরে ফিরে কিছু বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখলেনও
না। মাকে বললেন, “কালকেই আমি ও জুতোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়াও না”।
সেই জুতোজোড়া সঙ্গে নিয়ে পরদিন
বাবা অফিসে গেলেন, দিন সাতেক পর আবার অফিস থেকে ফেরার সময়েই জুতোজোড়া ফিরিয়ে নিয়ে
এলেন। মেঝেয় ফেলে দিয়ে মাকে বললেন, “কেমন সারিয়েছে, দেখো। একদম নতুন করে দিয়েছে”।
মা অবাক হয়ে হাসি মুখে বললেন, “সত্যি তো, বোঝাই যাচ্ছে
না। যা হাল করে নিয়ে এসেছিল, একদম নতুন হয়ে গেছে”।
“বাটার দোকানে দিয়েছিলাম, ওরাই
সারিয়ে দিয়েছে। ওরা বলল, ‘এ জুতো আরো অন্ততঃ দু বছর চলে যাবে। কিছু হলে নিয়ে
আসবেন, আবার সারিয়ে দেব। এ জুতোর নাম নটি বয়, খুব টেকসই’”।
আমি হিংস্র চোখে তাকিয়ে রইলাম
সেরে ওঠা চকচকে মজবুত জুতোজোড়ার দিকে। আমার পাদুটোকে গ্রাস করার জন্যে ওদুটো হাঁ
করে হা হা হাসছিল। ওরা যদি নটি বয় না হবে তো, কে হবে, আমি?
--00--
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন