মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৫

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


এর আগের পর্ব পাশের সূত্রে "শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৪"


উত্তরচরিত

ষষ্ঠ অধ্যায়

ধ্যান

নাগাধীশ্বরবিষ্টরাং ফণিফণোত্তংসোরুরত্নাবলীং ভাস্বদ্দেহলতাং দিবাকরনিভাং নেত্রত্রয়োদ্ভাসিতাং।

মালাকুম্ভকপালনীরজকরাং চন্দ্রার্ধচূড়াং পরাং সর্বজ্ঞেশ্বরভৈরবাঙ্কনিলয়াং পদ্মাবতীং চিন্তয়ে।।

[নাগ-অধীশ্বর-বিষ্টরাম্‌ ফণি-ফণা-উত্তংস-ঊরু-রত্নাবলীং ভাস্বৎ-দেহলতাম্‌ দিবাকর-নিভাম্‌  নেত্র-ত্রয়-উদ্ভাসিতাম্‌

মালা-কুম্ভ-কপাল-নীরজ-করাম্‌ চন্দ্র-অর্ধ-চূড়াম্‌ পরাম্‌ সর্বজ্ঞ-ঈশ্বর-ভৈরব-অঙ্ক-নিলয়াম্‌ পদ্মাবতীম্‌ চিন্তয়ে।।]

নাগরাজ বাসুকি যাঁর আসন, সাপের ফণার মণিসমূহ যাঁর ঊরুর রত্ন, যাঁর দেহলতা জ্যোতির্ময় ও সূর্যের মতো রক্তবর্ণ, যাঁর উজ্জ্বল ত্রিনয়ন। যাঁর চতুর্ভুজে অক্ষমালা, কমণ্ডলু, নরমুণ্ড, পদ্ম, যাঁর শিখরে অর্ধচন্দ্র, সর্বজ্ঞ ও ঈশ্বর ভৈরবের ক্রোড়ে যিনি শায়িতা, সে পরমা দেবী পদ্মাবতীকে চিন্তন করি।

 ষষ্ঠ অধ্যায় – ধূম্রলোচন-বধ 

ঋষিরুবাচ।

ইত্যাকর্ণ্য বচো দেব্যাঃ স দূতোঽমর্ষপূরিতঃ।

সমাচষ্ট সমাগম্য দৈত্যরাজায় বিস্তরাৎ।। ১

তস্য দূতস্য তদ্‌বাক্যমাকর্ণ্যাসুররাট্‌ ততঃ।

সক্রোধঃ প্রাহ দৈত্যনামধিপং ধূম্রলোচনম্‌।। ২

    [ঋষিঃ উবাচ। ইতি আকর্ণ্য বচঃ দেব্যাঃ সঃ দূতঃ অমর্ষ-পূরিতঃ। সমাচষ্ট সমাগম্য দৈত্যরাজায় বিস্তরাৎ।। ১

তস্য দূতস্য তৎ বাক্যম্‌ আকর্ণ্য অসুররাট্‌ ততঃ। সক্রোধঃ প্রাহ দৈত্যনাম্‌ অধিপম্‌ ধূম্রলোচনম্‌।। ২]

ঋষি বললেন। দেবীর কথা শুনে সেই দূত ক্রোধান্বিত হয়ে, দৈত্যরাজের কাছে ফিরে গিয়ে সবিস্তারে সব কথা বলল। সেই দূতের সবকথা শুনে অসুররাজও সক্রোধে দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে বলল।

হে ধূম্রলোচনাশু ত্বং স্বসৈন্যেপরিবারিতঃ।

তামানয় বলাদ্‌ দুষ্টাং কেশাকর্ষণবিহ্বলাম্‌।। ৩

তৎপরিত্রাণদঃ কশ্চিদ্‌ যদি বোত্তিষ্ঠতেঽপরঃ।

স হন্তব্যোঽমরো বাপি যক্ষো গন্ধর্ব এব বা।। ৪

[হে ধূম্রলোচন্‌ আশু ত্বম্‌ স্ব-সৈন্যে-পরিবারিতঃ। তাম্‌ আনয় বলাৎ দুষ্টাম্‌ কেশ-আকর্ষণ-বিহ্বলাম্‌।। ৩

তৎ-পরিত্রাণদঃ কঃ চিৎ যদি ব উত্তিষ্ঠতে অপরঃ। সঃ হন্তব্যঃ অমরঃ বা অপি যক্ষঃ গন্ধর্বঃ এব বা।। ৪]

হে ধূম্রলোচন, এখনই তুমি নিজ-সৈন্য-পরিবৃত হয়ে যাও, সেই দুষ্টাকে জোর করে কেশ-আকর্ষণে সন্ত্রস্তা করে এখানে নিয়ে এস। তার পরিত্রাণে যদি কোন দেবতা বা যক্ষ বা গন্ধর্ব বা অন্য কেউ সামনে উদয় হয়, তাকে হত্যা করবে।

ঋষিরুবাচ।

তেনাজ্ঞপ্তস্ততঃ শীঘ্রং স দৈত্যো ধূম্রলোচনঃ।

বৃতঃ ষষ্ট্যা সহস্রাণামসুরাণাং দ্রুতং যযৌ।। ৫

স দৃষ্ট্বা তাং ততো দেবীং তুহিনাচলসংস্থিতাম্‌।

জগাদোচ্চৈঃ প্রযাহীতি মূলং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ৬

ন চেৎ প্রীত্যাদ্য ভবতী মদ্‌ভর্তারমুপৈষ্যতি।

ততো বলান্নয়াম্যেষ কেশাকর্ষণবিহ্বলাম।। ৭

[ঋষিঃ উবাচ। তেন আজ্ঞপ্তঃ ততঃ শীঘ্রম্‌ সঃ দৈত্যঃ ধূম্রলোচনঃ। বৃতঃ ষষ্ট্যা সহস্রাণাম্‌ অসুরাণাম্‌ দ্রুতম্‌ যযৌ।। ৫

সঃ দৃষ্ট্বা তাম্‌ ততঃ দেবীম্‌ তুহিন-অচল-সংস্থিতাম্‌। জগাদ উচ্চৈঃ প্রযাহি ইতি মূলম্‌ শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ৬

ন চেৎ প্রীতি অদ্য ভবতী মৎ-ভর্তারম্‌ উপৈষ্যতি। ততঃ বলাৎ নয়ামি এষ কেশ-আকর্ষণ-বিহ্বলাম।। ৭]

ঋষি বললেন। সেই দৈত্য ধূম্রলোচন শুম্ভর আদেশ পাওয়া মাত্র ষাট হাজার অসুর-সৈন্য নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। তারপর হিমাচলে অধিষ্ঠিতা দেবীকে দেখে, উচ্চস্বরে বলল, “শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে চলুন। আজ যদি আমার প্রভুদের কাছে আপনি প্রীতি-সহ না যান, তাহলে আমিই আপনাকে গায়ের জোরে কেশ-আকর্ষণে ভীত-ব্যাকুলা করে নিয়ে যাবো।

দেব্যুবাচ।

দৈত্যেশ্বরেণ প্রহিতো বলবান্‌ বলসংবৃতঃ।

বলান্নয়সি মামেবং ততঃ কিং তে করোম্যহম্‌।। ৮

ঋষিরুবাচ।

ইত্যুক্তঃ সোঽভ্যধাবৎ তামসুরো ধূম্রলোচনঃ।

হুঙ্কারেণৈব তং ভস্ম সা চকারাম্বিকা ততঃ।। ৯

[দেবী উবাচ। দৈত্য-ঈশ্বরেণ প্রহিতঃ বলবান্‌ বলসংবৃতঃ। বলাৎ নয়সি মাম্‌ এবম্‌ ততঃ কিম্‌ তে করোমি অহম্‌।। ৮

ঋষিঃ উবাচ। ইতি উক্তঃ সঃ অভ্যধাবৎ তাম্‌ অসুরঃ ধূম্রলোচনঃ। হুঙ্কারেণ এব তম্‌ ভস্ম সা চকার অম্বিকা ততঃ।। ৯]

দেবী বললেন। দৈত্যেশ্বর যখন সেনাদল সহ মহাবীর তোমাকে পাঠিয়েছে, তখন আমাকে জোর করে নিয়ে গেলে,  আমি আর কী করতে পারি?

ঋষি বললেন। এই কথা শুনে সেই অসুর ধূম্রলোচন তাঁর দিকে যখনই ধেয়ে আসতে লাগল, দেবীর হুঙ্কারেই সেই অসুর ভস্ম হয়ে গেল।

অথ ক্রুদ্ধং মহাসৈন্যমসুরাণাং তথাম্বিকাম্‌।

ববর্ষ সায়কৈস্তীক্ষ্ণৈস্তথা শক্তিপরশ্বধৈঃ।। ১০

ততঃ ধূতশটঃ কোপাৎ কৃত্বা নাদং সুভৈরবম্‌।

পপাতাসুরসেনায়াং সিংহো দেব্যাঃ স বাহনঃ।। ১১

[অথ ক্রুদ্ধম্‌ মহাসৈন্যম্‌ অসুরাণাম্‌ তথা অম্বিকাম্‌। ববর্ষ সায়কৈঃ-তীক্ষ্ণৈঃ তথা শক্তি-পরশ্বধৈঃ।। ১০

ততঃ ধূতশটঃ কোপাৎ কৃত্বা নাদম্‌ সুভৈরবম্‌। পপাত অসুরসেনায়াম্‌ সিংহঃ দেব্যাঃ সঃ বাহনঃ।। ১১]

এতে অসুরদের মহাসৈন্যরা ক্রুদ্ধ হয়ে দেবী অম্বিকার দিকে অজস্র তীক্ষ্ণ তির, শূল এবং কুঠার বর্ষণ করতে লাগল। তখন দেবীর বাহন সিংহ ক্রোধে ভয়ংকর গর্জন করে উঠল এবং কেশর ফুলিয়ে লাফিয়ে পড়ল অসুরসেনাদের মাঝখানে।  

কাংশ্চিৎ করপ্রহারেণ দৈত্যানাস্যেন চাপরান্‌।

আক্রান্ত্যা চাধরেণান্যান্‌ জঘান স মহাসুরান্‌।। ১২

কেষাঞ্চিৎ পাটয়ামাস নখৈঃ কোষ্ঠানি কেশরী।

তথা তলপ্রহারেণ শিরাংসি কৃতবান্‌ পৃথক্‌।। ১৩

বিচ্ছিন্নবাহুশিরসঃ কৃতাস্তেন তথাপরে।

পপৌচ রুধিরং কোষ্ঠাদন্যেষাং ধূতকেশরঃ।। ১৪

[কান্‌ চিৎ কর-প্রহারেণ দৈত্যান্‌ আস্যেন চ অপরান্‌। আক্রান্ত্যা চ অধরেণ অন্যান্‌ জঘান স মহাসুরান্‌।। ১২

কেষাম্‌ চিৎ পাটয়ামাস নখৈঃ কোষ্ঠানি কেশরী। তথা তলপ্রহারেণ শিরাংসি কৃতবান্‌ পৃথক্‌।। ১৩

বিচ্ছিন্ন-বাহু-শিরসঃ কৃতাঃ তেন তথা অপরে। পপৌ চ রুধিরম্‌ কোষ্ঠাৎ অন্যেষাম্‌ ধূত-কেশরঃ।। ১৪]

সেই সিংহ দৈত্যদের কাউকে চপেটাঘাতে, অন্যান্য মহাসুরদের দংশন করে বিনাশ করতে লাগল। নখের আঘাতে কারও পেট চিরে ফেলল, আবার থাবার আঘাতে অনেকের মাথা ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। সেই সিংহ কারো কারো বাহু-মাথা ছিন্নভিন্ন করতে লাগল, কারও বা পেটের থেকে রেখে রক্তপান করতে লাগল।  

ক্ষণেন তদ্‌বলং সর্বং ক্ষয়ং নীতং মহাত্মনা।

তেন কেশরিণা দেব্যা বাহনেনাতিকোপিনা।। ১৫

শ্রুত্বা তমসুরং দেব্যা নিহতং ধূম্রলোচনম্‌।

বলঞ্চ ক্ষয়িতং কৃৎস্নং দেবীকেশরিণা ততঃ।। ১৬

চুকোপ দৈত্যাধিপতিঃ শুম্ভঃ প্রস্ফুরিতাধরঃ।

আজ্ঞাপয়ামাস চ তৌ চণ্ডমুণ্ডৌ মহাসুরৌ।। ১৭

[ক্ষণেন তৎ বলম্‌ সর্বম্‌ ক্ষয়ম্‌ নীতম্‌ মহাত্মনা। তেন কেশরিণা দেব্যা বাহনেন অতিকোপিনা।। ১৫

শ্রুত্বা তম্‌ অসুরম্‌ দেব্যা নিহতম্‌ ধূম্রলোচনম্‌। বলম্‌ চ ক্ষয়িতম্‌ কৃৎস্নম্‌ দেবী-কেশরিণা ততঃ।। ১৬

চুকোপ দৈত্য-অধিপতিঃ শুম্ভঃ প্রস্ফুরিত-অধরঃ। আজ্ঞাপয়ামাস চ তৌ চণ্ড-মুণ্ডৌ মহাসুরৌ।। ১৭]

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবীরবাহন সেই অতিকুপিত সিংহ দৈত্যসৈন্যদের সকলকে বিনাশ করে ফেলল। অসুর ধূম্রলোচনকে দেবী বধ করেছেন এবং দেবীর সিংহ সমুদয় দৈত্যসেনাদের বিনাশ করেছে, এই কথা শুনে দৈত্যরাজ শুম্ভ ভয়ংকর কুপিত হয়ে, কম্পিত অধরে মহাসুর চণ্ড ও মুণ্ডকে আদেশ দিয়ে বলল,  

হে চণ্ড হে মুণ্ড বলৈর্বহুলৈঃ পরিবারিতৌ।

তত্র গচ্ছতং গত্বা চ সা সমানীয়তাং লঘু।। ১৮

কেশেষ্বাকৃষ্য বদ্ধা বা যদি বঃ সংশয়ো যুধি।

তদাশেষায়ুধৈঃ সর্বৈরসুরৈর্বিনিহন্যতাম্‌।। ১৯

তস্যা হতায়াং দুষ্টায়াং সিংহে চ বিনিপাতিতে।

শীঘ্রমাগম্যতাং বদ্ধা গৃহীত্বা তামথাম্বিকাম্‌।। ২০

[হে চণ্ড হে মুণ্ড বলৈঃ বহুলৈঃ পরিবারিতৌ। তত্র গচ্ছতম্‌ গত্বা চ সা সমানীয়তাম্‌ লঘু।। ১৮

কেশেষু আকৃষ্য বদ্ধা বা যদি বঃ সংশয়ঃ যুধি। তৎ অশেষ-আয়ুধৈঃ সর্বৈঃ অসুরৈঃ বিনিহন্যতাম্‌।। ১৯

তস্যা হতায়াম্‌ দুষ্টায়াম্‌ সিংহে চ বিনিপাতিতে। শীঘ্রম্‌ আগম্যতাম্‌ বদ্ধা গৃহীত্বা তাম্‌ অথা অম্বিকাম্‌।। ২০]

হে চণ্ড-মুণ্ড তোমরা দুজনেই আরো অনেক সৈন্য পরিবৃত হয়ে সেখানে যাও এবং গিয়ে সেই নারীর কেশ আকর্ষণ করে বা বেঁধে তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে এস। যদি এই যুদ্ধে তোমাদের কোন সংশয় থাকে, তাহলে সকল অসুর মিলে, অজস্র অস্ত্র-শস্ত্র প্রয়োগে, তাকে অর্ধ-মৃত করে আনবে। সেই সিংহকে হত্যা করে এবং সেই মৃতপ্রায় অম্বিকাকে, বেঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।  

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে শুম্ভনিশুম্ভসেনানী ধূম্রলোচনবধো 

নাম ষষ্ঠোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

শুম্ভ-নিশুম্ভ-সেনানী ধূম্রলোচন বধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত

 

উত্তরচরিত

সপ্তম অধ্যায়

ধ্যান

ধ্যায়েয়ং রত্নপীঠে শুককলপঠিতং শৃণ্বতীং শ্যামলাঙ্গীং

ন্যস্তৈকাঙ্ঘ্রিং সরোজে শশিশকলধরাং বল্লকীং বাদয়ন্তীম্‌।

কহ্লারাবদ্ধমালাং নিয়মিতবিলসচ্চূড়িকাং রক্তবস্ত্রাং

মাতঙ্গীং শঙ্খপাত্রাং মধুরমধুমদাং চিত্রকোদ্ভাসিভালাম্‌।।

[ধ্যায়েয়ম্‌ রত্ন-পীঠে শুক-কল-পঠিতম্‌ শৃণ্বতীম্‌ শ্যামলাঙ্গীম্‌ ন্যস্ত-এক-অঙ্ঘ্রিম্‌ সরোজে শশি-শকলধরাম্‌ বল্লকীম্‌ বাদয়ন্তীম্‌। কহ্লার-আবদ্ধ-মালাম্‌ নিয়মিত-বিলসৎ-চূড়িকাম্‌ রক্ত-বস্ত্রাম্‌ মাতঙ্গীম্‌ শঙ্খ-পাত্রাম্‌ মধুর-মধু-মদাম্‌ চিত্রক-উদ্ভাসি-ভালাম্‌।।]

যিনি রত্নময় বেদীতে অধিষ্ঠিতা, যিনি শুকপাখির কাকলি শোনায় নিমগ্না, পদ্মের উপর এক পা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে শ্যামলাঙ্গী দেবী, যাঁর ললাটে চন্দ্রকলা শোভিত, যিনি বীণা বাদন করেন। যিনি কহ্লার-পুষ্পের মালা পরেছেন, যাঁর হাতে সুচারু সজ্জিত চুড়ি, রক্তবসনা, শঙ্খপাত্রধারিণী, মধুর মধুমদ্যে যিনি আসক্তা, যাঁর কপাল বিচিত্র-চিত্রে উজ্জ্বল, সেই দেবী মাতঙ্গীর ধ্যান করি।

[কহ্লার জলজ পুষ্পবিশেষ – সম্ভবতঃ কুমুদ।]

 

সপ্তম অধ্যায় – চণ্ডমুণ্ড বধ

 ঋষিরুবাচ।

আজ্ঞপ্তাস্তে ততো দৈত্যাশ্চণ্ডমুণ্ডপুরোগমাঃ।

চতুরঙ্গবলোপেতা যযুরভ্যুদ্যতায়ুধাঃ।। ১

দদৃশুস্তে ততো দেবীমীষদ্ধাসাং ব্যবস্থিতাম্‌।

সিংহস্যোপরি শৈলেন্দ্র-শৃঙ্গে মহতি কাঞ্চনে।। ২

[ঋষিঃ উবাচ। আজ্ঞপ্তাঃ তে ততঃ দৈত্যাঃ-চণ্ড-মুণ্ড-পুরোগমাঃ। চতুরঙ্গ-বল-উপেতা যযুঃ অভি-উদ্যত-আয়ুধাঃ।। ১

দদৃশুঃ তে ততঃ দেবীম্‌ ঈষৎ হাসাং ব্যবস্থিতাম্‌। সিংহস্য উপরি শৈলেন্দ্র-শৃঙ্গে মহতি কাঞ্চনে।। ২]

ঋষি বললেন। শুম্ভের আদেশে চণ্ড-মুণ্ডকে সামনে রেখে দৈত্যসেনা চতুরঙ্গ সৈন্যসাজে উদ্যত অস্ত্র–শস্ত্র হাতে রওনা হল। সেখানে স্বর্ণপ্রভা বিপুল হিমালয়-শিখরে, সিংহের উপরে আসীনা স্বল্পহাস্যমুখী দেবী-অম্বিকাকে অবস্থিতা দেখতে পেল।

তে দৃষ্ট্বা তাং সমাদাতুমুদ্যমঞ্চক্রুরুদ্যতাঃ।

আকৃষ্টচাপাসিধরাস্তথান্যে তৎসমীপগাঃ।। ৩

ততঃ কোপঞ্চকারোচ্চৈরম্বিকা তানরীন্‌ প্রতি।

কোপেন চাস্যা বদনং মসীবর্ণমভূৎ তদা।। ৪

ভ্রুকুটিকুটিলাৎ তস্যা ললাটফলকাদ্‌ দ্রুতম্‌।

কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসিপাশিনী।। ৫

[তে দৃষ্ট্বা তাম্‌ সমাদাতুম্‌ উদ্যমম্‌ চক্রুঃ উদ্যতাঃ। আকৃষ্ট-চাপ-অসি-ধরাঃ তথা অন্যে তৎ-সমীপ-গাঃ।। ৩

ততঃ কোপম্‌ চকার উচ্চৈঃ অম্বিকা তান্‌-অরীন্‌ প্রতি। কোপেন চ অস্যাঃ বদনম্‌ মসী-বর্ণম্‌ অভূৎ তদা।। ৪

ভ্রুকুটি-কুটিলাৎ তস্যাঃ ললাট-ফলকাদ্‌ দ্রুতম্‌। কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তা অসিপাশিনী।। ৫]

তাঁকে দেখে তারা উদ্গ্রীব হয়ে, তাঁকে ধরার জন্যে উদ্যত হল, কেউ ধনুকের জ্যা টান-টান করে, কেউ বা হাতে খড়্গ উদ্যত করে, দেবীর কাছাকাছি এগোতে লাগল। তখন দেবী অম্বিকা তাঁর শত্রুদের প্রতি ভয়ানক কুপিতা হলেন, ক্রোধে তাঁর মুখ কৃষ্ণ-বর্ণ ধারণ করল। তাঁর ভ্রুকুটি-কুটিল ললাট থেকে খড়্গ ও পাশধারিণী করালবদনা দেবী কালী আবির্ভূতা হলেন।

বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।

দ্বীপিচর্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।। ৬

অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।

নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্‌মুখা।। ৭

[বিচিত্র-খট্বাঙ্গ-ধরা নর-মালা-বিভূষণা। দ্বীপি-চর্ম-পরীধানা শুষ্ক-মাংসা অতিভৈরবা।। ৬

অতি-বিস্তার-বদনা জিহ্বাললন-ভীষণা। নিমগ্ন-আরক্ত-নয়না নাদ-আপূরিত-দিক-মুখা।। ৭]

সেই দেবী বিচিত্র-নরকঙ্কালধারিণী, নরমুণ্ডমালিনী, ব্যাঘ্র-চর্ম পরিহিতা, অস্থি-চর্মসার দেহধারী অতি ভয়ংকরী। তাঁর অতি বিস্তৃত মুখে, লকলকে জিভ ভয়ংকর, কোটরাগত তাঁর চোখ আরক্ত, তাঁর চিৎকারে সকল দিক কেঁপে উঠল

সা বেগেনাভিপতিতা ঘাতয়ন্তী মহাসুরান।

সৈন্যে তত্র সুরারীণামভক্ষয়ত তদ্‌বলম্‌।। ৮

পার্ষ্ণিগ্রাহাঙ্কুশগ্রাহি-যোধ-ঘন্টা-সমন্বিতান্‌।

সমাদায়ৈকহস্তেন মুখে চিক্ষেপ বারণান্‌।। ৯

[সা বেগেন অভিপতিতা ঘাতয়ন্তী মহাসুরান। সৈন্যে তত্র সুর-অরীণাম্‌ অভক্ষয়ত তৎ বলম্‌।। ৮

পার্ষ্ণিগ্রাহ-অঙ্কুশগ্রাহি-যোধ-ঘন্টা-সমন্বিতান্‌। সমাদায়-এক-হস্তেন মুখে চিক্ষেপ বারণান্‌।। ৯]

তিনি সবেগে অসুরসেনাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং মহাসুরদের হত্যা করে দেবারিসৈন্যদের ভক্ষণ করতে লাগলেন। মাহুত, গজারোহী যোদ্ধা এবং হাতির গলায় বাঁধা ঘন্টা সহ সম্পূর্ণ হাতিকে এক হাতে তুলে, তিনি মুখে নিক্ষেপ করতে লাগলেন।

তথৈব যোধং তুরগৈঃ রথঃ সারথিনা সহ।

নিক্ষিপ্য বক্ত্রে দশনৈশ্চর্বয়ত্যতিভৈরবম্‌।। ১০

একং জগ্রাহ কেশেষু গ্রীবায়ামথ চাপরম্‌।

পাদেনাক্রম্য চৈবান্যমুরসান্যমপোথয়ৎ।। ১১

তৈর্মুক্তানি চ শস্ত্রাণি মহাস্ত্রাণি তথাসুরৈঃ।

মুখেন জগ্রাহ রুষা দশনৈর্মথিতান্যপি।। ১২

[তথা এব যোধম্‌ তুরগৈঃ রথঃ সারথিনা সহ। নিক্ষিপ্য বক্ত্রে দশনৈঃ চর্বয়তি অতিভৈরবম্‌।। ১০

একম্‌ জগ্রাহ কেশেষু গ্রীবায়াম্‌ অথ চ অপরম্‌। পাদেন আক্রম্য চ এব অন্যম্‌ উরসা অন্যম্‌ অপোথয়ৎ।। ১১

তৈঃ মুক্তানি চ শস্ত্রাণি মহা-অস্ত্রাণি তথা অসুরৈঃ। মুখেন জগ্রাহ রুষা দশনৈঃ মথিতানি অপি।। ১২]

সারথি, যোদ্ধা ও অশ্বসহ রথ মুখের মধ্যে নিয়ে, তাঁর অতি-ভয়ংকর দাঁতে চিবোতে লাগলেন। কাউকে তিনি চুলের মুঠি ধরে, আবার কাউকে ঘাড় ধরে তুলে নিলেন, কাউকে পা দিয়ে চেপে ধরলেন, কাউকে আবার বুকে চেপে মর্দন করতে লাগলেন। অসুরদের ছোঁড়া মহা-অস্ত্র–শস্ত্রসমূহ তিনি মুখ দিয়ে গ্রহণ করলেন এবং প্রচণ্ড রোষে দাঁতে চিবিয়ে সেগুলি চূর্ণ করে ফেললেন।    

বলিনাং তদ্‌বলং সর্বমসুরাণাং মহাত্মনাম্‌।

মর্মদাভক্ষয়চ্চান্যানন্যাংশ্চাতাড়য়ৎ তদা।। ১৩

অসিনা নিহতাঃ কেচিৎ কেচিৎ খট্বাঙ্গতাড়িতাঃ।

জগ্মুর্বিনাশমসুরা দন্তাগ্রাভিহতাস্তথা।। ১৪

[বলিনাম্‌ তৎ বলম্‌ সর্বম্‌ অসুরাণাম্‌ মহাত্মনাম্‌। মর্মদ অভক্ষয়ৎ চ অন্য অনন্যাম্‌ চ অতাড়য়ৎ তদা।। ১৩

অসিনা নিহতাঃ কেচিৎ কেচিৎ খট্বাঙ্গ-তাড়িতাঃ। জগ্মুঃ বিনাশম্‌ অসুরা দন্ত-অগ্র-অভিহতাঃ তথা।। ১৪]

বিশালাকায় সকল অসুরসৈন্যদের কাউকে তিনি দলিত করলেন, কাউকে গ্রাস করলেন, কাউকে আবার বিতাড়িত করলেন। কেউ কেউ খড়্গের, কেউ কেউ খট্বাঙ্গের আঘাতে নিহত হল, কোন কোন অসুর আবার তাঁর দংশনে বিনষ্ট হল।

[খট্বাঙ্গ – যে দেবতা শ্মশানে সিদ্ধিদান করেন, তাঁর দেওয়া ভয়ংকর অস্ত্র। অথবা মৃত অসুরের কঙ্কাল থেকে খুলে নেওয়া হাত বা পায়ের বড়ো হাড়।]    

ক্ষণেন তদ্‌বলং সর্বমসুরাণাং নিপাতিতম্‌।

দৃষ্ট্বা চণ্ডোঽভিদুদ্রাব তাং কালীমতিভীষণাম্‌।। ১৫

শরবর্ষৈর্মহাভীমৈর্ভীমাক্ষীং তাং মহাসুরঃ।

ছাদয়ামাস চক্রৈশ্চ মুণ্ডঃ ক্ষিপ্তৈঃ সহস্রশঃ।। ১৬

[ক্ষণেন তৎ বলম্‌ সর্বম্‌ অসুরাণাম্‌ নিপাতিতম্‌। দৃষ্ট্বা চণ্ডঃ অভিদুদ্রাব তাম্‌ কালীম্‌ অতিভীষণাম্‌।। ১৫

শরবর্ষৈঃ মহাভীমৈঃ ভীমাক্ষীম্‌ তাম্‌ মহা-অসুরঃ। ছাদয়ামাস চক্রৈঃ চ মুণ্ডঃ ক্ষিপ্তৈঃ সহস্রশঃ।। ১৬]

কিছুক্ষণের মধ্যেই অসুরদের সকল সৈন্যদল নিহত হয়েছে দেখে, চণ্ড সেই অতিভয়ংকরী দেবীকালীর দিকে দৌড়ে গেল। সেই ভীষণ-নয়না দেবীর দিকে চণ্ড ভয়ংকর শরবর্ষণ এবং ক্রুদ্ধ মুণ্ড হাজার-হাজার চক্র নিক্ষেপ করে, তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।     

তানি চক্রাণ্যনেকানি বিশমানানি তন্মুখম্‌।

বভূর্যথার্কবিম্বানি সুবহূনি ঘনোদরম্‌। ১৭

ততো জহাসাতিরুষা ভীমং ভৈরবনাদিনী।

কালী করালবক্ত্রান্তর্দুর্দশদশনোজ্জ্বলা।। ১৮

উত্থায় চ মহাসিংহং দেবী চণ্ডমধাবত।

গৃহীত্বা চাস্য কেশেষু শিরস্তেনাসিনাচ্ছিনৎ।। ১৯

[তানি চক্রাণি অনেকানি বিশমানানি তৎ মুখম্‌। বভূঃ যথা অর্ক-বিম্বানি সুবহূনি ঘন-উদরম্‌। ১৭

ততঃ জহাস অতিরুষা ভীমম্‌ ভৈরবনাদিনী। কালী করাল-বক্ত্র-অন্তঃ-দুর্দর্শ-দশন উজ্জ্বলা।। ১৮

উত্থায় চ মহাসিংহম্‌ দেবী চণ্ডম্‌ অধাবত। গৃহীত্বা চ অস্য কেশেষু শিরঃ তেন অসিনা অচ্ছিনৎ।। ১৯]

ঘোর মেঘের মধ্যে যেমন সূর্যের অজস্র প্রতিবিম্ব দেখা যায়, তেমনি দেবীর মুখের মধ্যে সেই অসংখ্য চক্র প্রবেশ করে শোভন-সুন্দর হয়ে উঠল। তখন ভয়ংকরী দেবী ভৈরবধ্বনিতে করাল-রোষে ভীষণ অট্টহাস্য  করে উঠলেন, তাঁর করাল মুখের ভয়ংকর দন্তরাজির প্রভায় দেবীকালী জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠলেন। এরপর মহাসিংহের পিঠে আরোহণ করে তিনি চণ্ডকে তাড়া করে গেলেন এবং তার চুলের মুঠি ধরে, খড়্গের আঘাতে তার মুণ্ড ছিন্ন করলেন।    

অথ মুণ্ডোঽপ্যধাবৎ তাং দৃষ্ট্বা চণ্ডং নিপাতিতম্‌।

তমপ্যপাতয়দ্ভূমৌ সা খড়্গাভিহতং রুষা। ২০

হতশেষং ততঃ সৈন্যং দৃষ্ট্বা চণ্ডং নিপাতিতম্‌।

মুণ্ডঞ্চ সুমহাবীর্যং দিশো ভেজে ভয়াতুরম্‌।। ২১

[অথ মুণ্ডঃ অপি অধাবৎ তাম্‌ দৃষ্ট্বা চণ্ডম্‌ নিপাতিতম্‌। তম্‌ অপি অপাতয়ৎ ভূমৌ সা খড়্গ-অভিহতম্‌ রুষা। ২০

হত-শেষম্‌ ততঃ সৈন্যম্‌ দৃষ্ট্বা চণ্ডম্‌ নিপাতিতম্‌। মুণ্ডম্‌ চ সুমহাবীর্যম্‌ দিশঃ ভেজে ভয়-আতুরম্‌।। ২১]

চণ্ড নিহত হওয়ায় এবার মুণ্ড দেবীর দিকে দৌড়ে এল, তাকেও রুষ্টা দেবী খড়্গের আঘাতে ধরাশায়ী করলেন। মহাবীর চণ্ড ও মুণ্ড নিহত হওয়ায়, অবশিষ্ট দৈত্যসেনা ভয়ে ব্যাকুল হয়ে দিকে দিকে পালিয়ে গেল।  

শিরশ্চণ্ডস্য কালী চ গৃহীত্বা মুণ্ডমেব চ।

প্রাহ প্রচণ্ডাট্টহাসমিশ্রমভোত্য চণ্ডিকাম্‌।। ২২

ময়া তবাত্রোপহৃতৌ চণ্ডমুণ্ডৌ মহাপশূ।

যুদ্ধযজ্ঞে স্বয়ং শুম্ভং নিশুম্ভঞ্চ হনিষ্যসি।। ২৩

ঋষিরুবাচ।

তাবানীতৌ ততো দৃষ্ট্বা চণ্ডমুণ্ডৌ মহাসুরৌ।

উবাচ কালীং কল্যাণী ললিতং চণ্ডিকা বচঃ।। ২৪

যস্মাচ্চণ্ডঞ্চ মুণ্ডঞ্চ গৃহীত্বা ত্বমুপাগতা।

চামুণ্ডেতি ততো লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি।। ২৫

 [শিরঃ চণ্ডস্য কালী চ গৃহীত্বা মুণ্ডম্‌ এব চ। প্রাহ প্রচণ্ড-অট্টহাসমিশ্রম্‌ অভি-এত্য চণ্ডিকাম্‌।। ২২

ময়া তব অত্র উপহৃতৌ চণ্ড-মুণ্ডৌ মহাপশূ। যুদ্ধ-যজ্ঞে স্বয়ম্‌ শুম্ভম্‌ নিশুম্ভম্‌ চ হনিষ্যসি।। ২৩

ঋষিঃ উবাচ। তৌ আনীতৌ ততঃ দৃষ্ট্বা চণ্ড-মুণ্ডৌ মহা-অসুরৌ। উবাচ কালীম্‌ কল্যাণী ললিতম্‌ চণ্ডিকা বচঃ।। ২৪

যস্মাৎ চণ্ডম্‌ চ মুণ্ডম্‌ চ গৃহীত্বা ত্বম্‌ উপাগতা। চামুণ্ডা ইতি ততঃ লোকে খ্যাতা দেবি ভবিষ্যসি।। ২৫]

দেবী কালী চণ্ড ও মুণ্ডের কাটামুণ্ড হাতে দেবী চণ্ডিকার সামনে গিয়ে ভয়ংকর অট্টহেসে বললেন, “যুদ্ধরূপ এই যজ্ঞে, দুই মহাপশু চণ্ড-মুণ্ডের মাথা আপনাকে উপহার দিলাম। এরপর আপনি নিজে শুম্ভ-নিশুম্ভকেও বধ করবেন”।

ঋষি বললেন, দেবী কালীকে দুই মহাসুর চণ্ড-মুণ্ডের মুণ্ডদুটি বয়ে আনতে দেখে, কল্যাণী চণ্ডিকাদেবী মধুর স্বরে বললেন, “হে দেবি, যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডের মাথাদুটি আমার কাছে নিয়ে এসেছ, সেহেতু ত্রিলোকে তুমি চামুণ্ডা নামেই বিখ্যাত হবে”    

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে চণ্ডমুণ্ডবধো 

নাম সপ্তমোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

চণ্ডমুণ্ড বধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত

  

উত্তরচরিত

অষ্টম অধ্যায়

ধ্যান

 

অরুণাং করুণাতরঙ্গিতাক্ষীং ধৃতপাশাঙ্কুশমুখ্যচাপহস্তাম্‌।

অণিমাদিভিরাবৃতাং ময়ূখৈরহমিত্যেব বিভাবয়ে ভবানীম্‌। 

[অরুণাম্‌ করুণা-তরঙ্গিতা-অক্ষীম্‌ ধৃত-পাশ-অঙ্কুশমুখ্য-চাপ-হস্তাম্‌। অণিমাদিভিঃ আবৃতাম্‌ ময়ূখৈঃ অহম ইতি এব বিভাবয়ে ভবানীম্‌।]

যিনি অরুণবর্ণা, যাঁর নয়নযুগল কৃপাতরঙ্গে আকুল, চারহাতে যিনি পাশ, অঙ্কুশ, ধনুক ও শর-ধারিণী, যিনি অণিমাদি অষ্ট সিদ্ধিতে জ্যোতির্ময়ী, সেই দেবী ভবানীকে আমি চিন্তন করি।

[তন্ত্র যোগ-সাধনায় যে অষ্ট সিদ্ধির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি এরকম, 

প্রথম অণিমাসিদ্ধি – সাধক অণুর মত অতি সূক্ষ্মরূপ ধারণ করে যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারেন।

দ্বিতীয় লঘিমা - এর প্রভাবে সাধক শুকনো তৃণের থেকেও হাল্কা হয়ে যেতে পারেন।

তৃতীয় গরিমা – গরিমা সিদ্ধ সাধক যে কোন ভারের থেকেও ভারবহুল হয়ে উঠতে পারেনযেমন রাজা শিবি ও তাঁর আশ্রয়প্রার্থী পায়রার কাহিনীতে আছে - মহারাজ শিবি নিজের শরীর দান করেও, তুলাদণ্ডে সামান্য পায়রার সমান হতে পারেননি! কারণ সে পায়রা কোন সাধারণ পায়রা ছিল না, তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী ধর্ম, তিনি সিদ্ধযোগী!

চতুর্থ মহিমা - এর প্রভাবে সাধক পর্বতের মতো বিশাল আকার এবং ভারসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেন।

পঞ্চম প্রাপ্তি - এর প্রভাবে সাধক বহুদূর থেকেও ইচ্ছামতো বস্তুকে স্পর্শ ও গ্রহণ করতে সক্ষম হন

ষষ্ঠ প্রাকাম্য – সাধক এই সিদ্ধি লাভের পর জগতের যে কোন বস্তু ইচ্ছা মতো অর্জন করিতে পারেন।

সপ্তম বশিত্ব - এর প্রভাবে নিখিল চরাচর যোগীর বশীভূত হয়। তাঁর কথায় সকল জীব ও জড় পুতুলের মত আচরণ করে

অষ্টম ঈশিত্ব – এর প্রভাবে সাধক সৃষ্টি বিষয়েও প্রভুত্ব করতে পারেন। ]

 

অষ্টম অধ্যায় – রক্তবীজ বধ

 

ঋষিরুবাচ।

চণ্ডে চ নিহতে দৈত্যে মুণ্ডে চ বিনিপাতিতে।

বহুলেষু চ সৈন্যেষু ক্ষয়িতেষ্বসুরেশ্বরঃ।। ১

ততঃ কোপপরাধীনচেতাঃ শুম্ভঃ প্রতাপবান্‌।

উদ্‌যোগঃ সর্বসৈন্যানাং দৈত্যানামাদিদেশ হ।। ২

অদ্য সর্ববলৈর্দৈত্যাঃ ষড়শীতিরুদায়ুধাঃ।

কম্বূনাং চতুরশীতির্নির্যান্তু স্ববলৈর্বৃতাঃ।। ৩

কোটিবীর্যাণি পঞ্চাশদসুরাণাং কুলানি বৈ।

শতং কুলানি ধৌম্রাণাং নির্গচ্ছন্তু মমাজ্ঞয়া।। ৪

কালকা দৌহৃর্দা মৌর্যাঃ কালকেয়াস্তথাসুরাঃ।

যুদ্ধায় সজ্জা নির্যান্তু আজ্ঞয়া ত্বরিতা মম।। ৫

[ঋষিঃ উবাচ। চণ্ডে চ নিহতে দৈত্যে মুণ্ডে চ বিনিপাতিতে। বহুলেষু চ সৈন্যেষু ক্ষয়িতেষু অসুরেশ্বরঃ।। ১

ততঃ কোপ-পরাধীন-চেতাঃ শুম্ভঃ প্রতাপবান্‌। উদ্‌যোগঃ সর্ব-সৈন্যানাম্‌ দৈত্যানাম্‌ আদিদেশ হ।। ২

অদ্য সর্ব-বলৈঃ দৈত্যাঃ ষড়শীতি-উৎ-আয়ুধাঃ। কম্বূনাম্‌ চতুরশীতিঃ নির্যান্তু স্ববলৈঃ বৃতাঃ।। ৩

কোটি-বীর্যাণি পঞ্চাশৎ-অসুরাণাম্‌ কুলানি বৈ। শতম্‌ কুলানি ধৌম্রাণাম্‌ নির্গচ্ছন্তু মম আজ্ঞয়া।। ৪

কালকাঃ দৌহৃর্দাঃ মৌর্যাঃ কালকেয়াঃ তথা অসুরাঃ। যুদ্ধায় সজ্জা নির্যান্তু আজ্ঞয়া ত্বরিতা মম।। ৫]

ঋষি বললেন। দৈত্য চণ্ড ও মুণ্ড নিহত হওয়ায় এবং বহু অসুরসেনার বিনাশ হওয়ায়, মহাপরাক্রমী অসুরেশ্বর শুম্ভ ক্রোধে বিবশ বুদ্ধি হয়ে, সকল দৈত্যসেনাদের যুদ্ধের উদ্যোগ নিতে আদেশ দিল- “আজই চতুরঙ্গ সেনা সাজিয়ে ছিয়াশিজন উদ্যত-অস্ত্র দৈত্য এবং কম্বু-বংশীয় চুরাশিজন তাদের নিজেদের সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়ুক। আমার আদেশে কোটিবীর্য নামক অসুরবংশের পঞ্চাশটি সেনাদল এবং ধৌম্র নামক বংশের একশটি সেনাদলও বেরিয়ে পড়ুক। কালক, দৌহৃর্দ, মৌর্য এবং কালকেয় অসুররাও আমার আদেশে যুদ্ধসাজে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে রওনা হয়ে পড়ুক”।

ইত্যাজ্ঞাপ্যাসুরপতিঃ শুম্ভো ভৈরবশাসনঃ।

নির্জগাম মহাসৈন্যসহস্রৈর্বহুভির্বৃতঃ।। ৬

আয়াতং চণ্ডিকা দৃষ্ট্বা তৎসৈন্যমতিভীষণম্‌।

জ্যাস্বনৈঃ পূরয়ামাস ধরণীগগনান্তরম্‌।। ৭

ততঃ সিংহো মহানাদমতীব কৃতবান্‌ নৃপ।

ঘন্টাস্বনেন তান্‌ নাদানম্বিকা চোপবৃংহয়ৎ।। ৮

[ইতি আজ্ঞাপ্য অসুরপতিঃ শুম্ভঃ ভৈরবশাসনঃ। নির্জগাম মহা-সৈন্য-সহস্রৈঃ-বহুভিঃ বৃতঃ।। ৬

আয়াতম্‌ চণ্ডিকা দৃষ্ট্বা তৎসৈন্যম্‌ অতিভীষণম্‌। জ্যা-স্বনৈঃ পূরয়ামাস ধরণী-গগন-অন্তরম্‌।। ৭

ততঃ সিংহঃ মহানাদম্‌ অতীব কৃতবান্‌ নৃপ। ঘন্টা-স্বনেন তান্‌ নাদান্‌ অম্বিকা চ উপবৃংহয়ৎ।। ৮]

হে রাজা (সুরথ), এই আদেশ দিয়ে উগ্রশাসন অসুরপতি শুম্ভ নিজেও বহু সহস্র মহাসৈন্য-পরিবৃত হয়ে রওনা দিল। অতি ভয়ানক সেই দৈত্যসমাবেশ দেখে দেবী চণ্ডিকা তাঁর ধনুতে যে টংকার-ধ্বনি করলেন, তাতে পৃথিবী, আকাশ এবং অন্তরীক্ষ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তারপর দেবীর বাহন সিংহও অতিভয়ানক গর্জন করে উঠল। দেবী অম্বিকাও ঘণ্টার শব্দে সেই সকল মহাধ্বনিকে আরও ভয়াল করে তুললেন।

ধনুর্জ্যাসিংহঘণ্টানাং শব্দাপূরিতদিঙ্মুখা।

নিনাদৈর্ভীষণৈঃ কালী জিগ্যে বিস্তারিতাননা।। ৯

তন্নিনাদমুপশ্রুত্য দৈত্যসৈন্যৈশ্চতুর্দিশম্‌।

দেবী সিংহস্তথা কালী সরোষৈঃ পরিবারিতাঃ।। ১০

[ধনুঃ-জ্যা-সিংহ-ঘণ্টানাম্‌ শব্দ-আপূরিত-দিক্‌ মুখা। নিনাদৈঃ ভীষণৈঃ কালী জিগ্যে বিস্তারিতা-আননা।। ৯

তৎ নিনাদম্‌ উপশ্রুত্য দৈত্য-সৈন্যৈঃ চতুঃ-দিশম্‌। দেবী সিংহঃ তথা কালী সরোষৈঃ পরিবারিতাঃ।। ১০]

তখন ব্যাদিতা আননা দেবী কালীর ভয়ংকর গর্জনের ধ্বনিতে সেই ধনুষ্টংকার, সিংহের গর্জন এবং ঘন্টাধ্বনির প্রবল শব্দও যেন ঢাকা পড়ে গেল। সেই মহাগর্জন শুনে ক্রুদ্ধ দৈত্যসৈন্যরা চারদিক থেকে দেবী চণ্ডিকা, সিংহ এবং দেবী কালীকে ঘিরে ধরল।

এতস্মিন্নন্তরে ভূপ বিনাশায় সুরদ্বিষাম্‌।

ভবায়ামরসিংহানামতিবীর্যবলান্বিতাঃ।। ১১

ব্রহ্মেশগুহবিষ্ণূনাং তথেন্দ্রস্য চ শক্তয়ঃ।

শরীরেভ্যো বিনিষ্ক্রম্য তদ্রূপৈশ্চণ্ডিকাং যযুঃ।। ১২

[এতস্মিন্‌ অন্তরে ভূপ বিনাশায় সুরদ্বিষাম্‌। ভবায় অমর-সিংহানাম্‌ অতিবীর্য-বলান্বিতাঃ।। ১১

ব্রহ্ম-ঈশ-গুহ-বিষ্ণূনাম্‌ তথা ইন্দ্রস্য চ শক্তয়ঃ। শরীরেভ্যো বিনিষ্ক্রম্য তৎ রূপৈঃ চণ্ডিকাম্‌ যযুঃ।। ১২]

হে রাজা, এরই মধ্যে দেব-বিদ্বেষীদের বিনাশ এবং দেব-শ্রেষ্ঠদের মঙ্গলের জন্য, অতিবীর ও পরাক্রমী ব্রহ্মা, শিব, কার্তিকেয় ও বিষ্ণুদেবতাগণের এবং ইন্দ্রেরও শরীর থেকে শক্তি নির্গত হয়ে সেই সকল দেবতার দেবীরূপে দেবী চণ্ডিকার অনুগমন করলেন।

[বিষ্ণুদেবগণ – অর্থাৎ স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু এবং তাঁর পরাক্রমী অবতার সমূহ, যেমন নৃসিংহ, পরশুরাম, বরাহ প্রমুখ।]

যস্য দেবস্য যদ্রূপং যথা ভূষণবাহনম্‌।

তদ্‌বদেব হি তচ্ছক্তিরসুরান্‌ যোদ্ধুমাযযৌ।। ১৩

হংসযুক্তবিমানাগ্রে সাক্ষসূত্রকমণ্ডলুঃ।

আয়াতা ব্রহ্মণঃ শক্তির্ব্রহ্মাণী সাঽভিধীয়তে।। ১৪

মাহেশ্বরী বৃষারূঢ়া ত্রিশূলবরধারিণী।

মহাহিবলয়া প্রাপ্তা চন্দ্ররেখাবিভূষণা।। ১৫

[যস্য দেবস্য যৎ রূপম্‌ যথা ভূষণ-বাহনম্‌। তৎ-বৎ-এব দেব হি তৎ শক্তিঃ অসুরান্‌ যোদ্ধুম্‌ আযযৌ।। ১৩

হংস-যুক্ত-বিমান-অগ্রে সাক্ষ-সূত্র-কমণ্ডলুঃ। আয়াতা ব্রহ্মণঃ শক্তিঃ ব্রহ্মাণী সা অভিধীয়তে।। ১৪

মাহেশ্বরী বৃষ-আরূঢ়াঃ ত্রিশূল-বর-ধারিণী। মহা-অহি-বলয়া প্রাপ্তাঃ চন্দ্র-রেখা-বিভূষণা।। ১৫]

যে দেবতার যেমন রূপ, যেমন তাঁদের ভূষণ ও বাহন, সেই দেবের শক্তিও সেই সেই রূপে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন। প্রথমে জপমালা ও কমণ্ডলু হাতে হংসযুক্ত বিমানে এলেন ব্রহ্মের শক্তি, তিনি ব্রহ্মাণী নামে পরিচিতা হলেন। বৃষে আরোহণ করে এলেন মাহেশ্বরী (মহেশ্বরের শক্তি), তাঁর হাতে শ্রেষ্ঠ ত্রিশূল, মহানাগের বলয় এবং চন্দ্রকলায় বিভূষিতা।

কৌমারী শক্তিহস্তা চ ময়ুরবরবাহনা।

যোদ্ধুমভ্যাযযৌ দৈত্যানাম্বিকা গুহরূপিণী।। ১৬

তথৈব বৈষ্ণবীশক্তির্গরুড়োপরি সংস্থিতা।

শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গখড়্গহস্তাভ্যুপাযযৌ।। ১৭

যজ্ঞবরাহমতুলং রূপং যা বিভ্রতো হরেঃ।

শক্তিঃ সাপ্যাযযৌ তত্র বারাহীং বিভ্রতি তনুম্‌। ১৮

নারসিংহী নৃসিংহস্য বিভ্রতী সদৃশং বপুঃ।

প্রাপ্তা তত্র সটাক্ষেপক্ষিপ্তনক্ষত্র সংহতিঃ।। ১৯

বজ্রহস্তা তথৈবৈন্দ্রী গজরাজোপরি স্থিতা।

প্রাপ্তা সহস্রনয়না যথা শক্রস্তথৈব সা।। ২০

[কৌমারী শক্তিহস্তা চ ময়ুর-বর-বাহনা। যোদ্ধুম্‌ অভ্যাযযৌ দৈত্যান্‌ অম্বিকা গুহরূপিণী।। ১৬

তথা এব বৈষ্ণবী-শক্তিঃ-গরুড়-উপরি সংস্থিতা। শঙ্খ-চক্র-গদা-শার্ঙ্গ-খড়্গ-হস্তা অভ্যুপাযযৌ।। ১৭

যজ্ঞ-বরাহম্‌ অতুলম্‌ রূপম্‌ যা বিভ্রতঃ হরেঃ। শক্তিঃ সা অপি আযযৌ তত্র বারাহী্ম্‌ বিভ্রতি তনুম্‌। ১৮

নারসিংহী নৃসিংহস্য বিভ্রতী সদৃশম্‌ বপুঃ। প্রাপ্তা তত্র সটা-আক্ষেপ-ক্ষিপ্ত-নক্ষত্র-সংহতিঃ।। ১৯

বজ্র-হস্তা তথা এব ইন্দ্রী গজ-রাজ-উপরি স্থিতা। প্রাপ্তা সহস্রনয়না যথা শক্রঃ তথা এব সা।। ২০]

কুমার কার্তিকেয় রূপিণী অম্বিকা-শক্তি কৌমারী শ্রেষ্ঠময়ুরবাহনে এলেন দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তারপর (বিষ্ণুর) শক্তি বৈষ্ণবী এলেন গরুড়ে আরোহিতা এবং হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-শার্ঙ্গ-খড়্গধারিণী হয়ে। হরির অতুলনীয় যজ্ঞ-বরাহের রূপ ও শক্তি নিয়ে সেখানে আবির্ভূতা হলেন বারাহী। নৃসিংহের শরীর ও শক্তি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন নারসিংহী, যাঁর কেশরসঞ্চালনে নক্ষত্রসমূহ চালিত হয়। বজ্র হাতে গজরাজে আরোহিতা হয়ে সেখানে এলেন ইন্দ্রী, তিনিও শক্রের মতোই সহস্রনয়না।

ততঃ পরিবৃতস্তাভিরীশানো দেবশক্তিভিঃ।

হন্যন্তামসুরাঃ শীঘ্র মম প্রীত্যাহ চণ্ডিকাম্‌।। ২১

ততো দেবীশরীরাত্তু বিনিষ্ক্রান্তাতিভীষণা।

চণ্ডিকাশক্তিরত্যুগ্রা শিবাশতনিনাদিনী।। ২২

সা চাহ ধূম্রজটিলমীশানমপরাজিতা।

দূতত্বং গচ্ছ ভগবন্‌ পার্শ্বং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ২৩

.ব্রূহি শুম্ভং নিশুম্ভঞ্চ দানবাবতিগর্বিতৌ।

যে চান্যে দানবাস্তত্র যুদ্ধায় সমুপস্থিতাঃ।। ২৪

[ততঃ পরিবৃতঃ তাভিঃ ঈশানঃ দেবশক্তিভিঃ। হন্যন্তাম্‌ অসুরাঃ শীঘ্র মম প্রীতি আহ চণ্ডিকাম্‌।। ২১

ততঃ দেবীশরীরাৎ তু বিনিষ্ক্রান্তা অতিভীষণা। চণ্ডিকা-শক্তিঃ-অতি-উগ্রা শিবা-শত-নিনাদিনী।। ২২

সা চ আহ ধূম্র-জটিলম্‌ ঈশানম্‌ অপরাজিতাদূতত্বম্‌ গচ্ছ ভগবন্‌ পার্শ্বম্‌ শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।। ২৩

ব্রূহি শুম্ভম্‌ নিশুম্ভম্‌ চ দানবৌ অতিগর্বিতৌ। যে চ অন্যে দানবাঃ তত্র যুদ্ধায় সমুপস্থিতাঃ।। ২৪]

তখন দেবশক্তি দেবী পরিবৃত হয়ে ভগবান ঈশান দেবী চণ্ডিকাকে বললেন, “আমার প্রতি প্রীতিবশতঃ আপনারা শীঘ্র অসুরদের বিনাশ করুন”। তখন দেবীর শরীর থেকেই অতিভীষণ-অতিউগ্র শতশৃগালের মত চিৎকারকারিণী চণ্ডিকাশক্তি আবির্ভূতা হলেন। সেই অপরাজিতা দেবী, ধূম্র-জটাধারী ঈশানকে বললেন, “হে ভগবন্‌, আপনি দূত হয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে যান। সেই অতিগর্বিত দুই দানব শুম্ভ-নিশুম্ভকে এবং যুদ্ধের জন্যে উপস্থিত হওয়া অন্য দানবদেরও গিয়ে বলুন যে,     

ত্রৈলোক্যমিন্দ্রো লভতাং দেবাঃ সন্তু হবির্ভুজঃ।

যূয়ং প্রয়াত পাতালং যদি জীবিতুমিচ্ছথ।। ২৫

বলাবলেপাদথ চেদ্‌ ভবন্তো যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিণঃ।

তদাগচ্ছত তৃপ্যন্তু মচ্ছিবাঃ পিশিতেন বঃ।। ২৬

[ত্রৈলোক্যম্‌ ইন্দ্রঃ লভতাম্‌ দেবাঃ সন্তু হবির্ভুজঃ। যূয়ম্‌ প্রয়াত পাতালম্‌ যদি জীবিতুম্‌ ইচ্ছথ।। ২৫

বল-অবলেপাৎ অথ চেৎ ভবন্তঃ যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিণঃ। তদা আগচ্ছত তৃপ্যন্তু মৎ শিবাঃ পিশিতেন বঃ।। ২৬]

ইন্দ্র ত্রৈলোক্য লাভ করুন, দেবতারা যজ্ঞ-আহুতি ভোগ করুন। তোমরা যদি বাঁচতে ইচ্ছা করো, তাহলে পাতালে প্রবেশ করোআর যদি বলদর্পের কারণে যুদ্ধ করতেই ইচ্ছা করো, তাহলে এস, আমার শৃগালীরা তোমাদের মাংসভক্ষণে তৃপ্ত হোক”। 

যতো নিযুক্তো দৌত্যেন তয়া দেব্যা শিবঃ স্বয়ম্‌।

শিবদূতীতি লোকেঽস্মিংস্ততঃ সা খ্যাতিমাগতা।। ২৭

তেঽপি শ্রুত্বা বচো দেব্যাঃ শর্বাখ্যাতং মহাসুরাঃ।

অমর্ষাপূরিতা জগ্মুর্যতঃ কাত্যায়নী স্থিতা।। ২৮

[যতঃ নিযুক্তঃ দৌত্যেন তয়া দেব্যা শিবঃ স্বয়ম্‌। শিবদূতী-ইতি লোকে অস্মিন্‌ ততঃ সা খ্যাতিম্‌ আগতা।। ২৭

তে অপি শ্রুত্বা বচঃ দেব্যাঃ শর্ব-আখ্যাতম্‌ মহাসুরাঃ। অমর্ষ-আপূরিতা জগ্মুঃ যতঃ কাত্যায়নী স্থিতা।। ২৮]

দেবী যেহেতু স্বয়ং শিবকেই দূত হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, সেহেতু তিনি এই জগতে শিবদূতী নামেও প্রসিদ্ধা হয়েছেন। কিন্তু সেই মহাসুরেরা শিবের মুখে দেবীর কথা শুনে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে, যেখানে দেবী কাত্যায়নী অবস্থান করছেন, সেদিকেই এগিয়ে চলল।     

ততঃ প্রথমমেবাগ্রে শরশক্ত্যৃষ্টিবৃষ্টিভিঃ।

ববর্ষুরুদ্ধতামর্ষাস্তাং দেবীমমরারয়ঃ।। ২৯

সা চ তান্‌ প্রহিতান্‌ বাণাঞ্ছূলচক্রপরশ্বধান্‌।

চিচ্ছেদ লীলয়াধ্মাতধনুর্মুক্তৈর্মহেষুভিঃ।। ৩০

তস্যাগ্রতস্তথা কালী শূলপাতবিদারিতান্‌।

খট্বাঙ্গপ্রোথিতাংশ্চারীন্‌ কুর্বতী ব্যচরৎ তদা।। ৩১

কমণ্ডলুজলাক্ষেপহতবীর্যান্‌ হতৌজসঃ।

ব্রহ্মাণী চাকরোচ্ছত্রূন্‌ যেন যেন স্ম ধাবতি।। ৩২

[ততঃ প্রথমম্‌ এব অগ্রে শর-শক্তি-ঋষ্টি-বৃষ্টিভিঃ। ববর্ষুঃ উদ্ধত-অমর্ষঃ তাম্‌ দেবীম্‌ অমর-অরয়ঃ।। ২৯

সা চ তান্‌ প্রহিতান্‌ বাণাম্‌ শূল-চক্র-পরশ্বধান্‌। চিচ্ছেদ লীলয়া আধ্মাত-ধনুঃ-র্মুক্তৈঃ মহ-ইষুভিঃ।। ৩০

তস্য অগ্রতঃ তথা কালী শূল-পাত-বিদারিতান্‌। খট্বাঙ্গ-প্রোথিতান্‌ -চ অরীন্‌ কুর্বতী ব্যচরৎ তদা।। ৩১

কমণ্ডলু-জল-আক্ষেপত-হত-বীর্যান্‌ হত-ওজসঃ। ব্রহ্মাণী চ অকরোৎ শত্রূন্‌ যেন যেন স্ম ধাবতি।। ৩২]

তারপর সেই দেব-শত্রুরা উগ্র ক্রোধে দেবীর দিকে প্রথমেই বৃষ্টির মতো তির-শূল-খড়্গ নিক্ষেপ করে তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। দেবীও তাঁর ধনু থেকে মহা-তিরসমূহ নিক্ষেপ করে, তাদের ছোঁড়া বাণ-শূল-চক্র-কুঠার অবহেলা ভরে ছিন্ন-ভিন্ন করতে লাগলেন। তাঁর আগে আগে দেবীকালী শূলের আঘাতে এবং খট্বাঙ্গ-হাড়ের প্রহারে দেব-দ্বেষী অসুরদের বিদীর্ণ করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ব্রহ্মাণীও যে যে দিকে দৌড়ে গেলেন, কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে সেদিকে শত্রু অসুরদের বীর্য এবং তেজ হরণ করতে লাগলেন।

ঐন্দ্রীকুলিশপাতেন শতশো দৈত্যদানবাঃ।

পেতুর্বিদারিতাঃ পৃথ্ব্যাং রুধিরৌঘ প্রবর্ষিণঃ।। ৩৩

তুণ্ডপ্রহারবিধ্বস্তা দংষ্ট্রাগ্রক্ষতবক্ষসঃ।

বরাহমূর্ত্যা ন্যপতংশ্চক্রেণ চ বিদারিতাঃ।। ৩৪

[ঐন্দ্রী কুলিশ-পাতেন শতশঃ দৈত্যদানবাঃ। পেতুঃ বিদারিতাঃ পৃথ্ব্যাম্‌ রুধির-ঔঘ প্রবর্ষিণঃ।। ৩৩

তুণ্ড-প্রহার-বিধ্বস্তা দংষ্ট্রা-অগ্র-ক্ষত-বক্ষসঃ। বরাহমূর্ত্যা নি-অপতন্‌ চক্রেণ চ বিদারিতাঃ।। ৩৪]

(ইন্দ্র–শক্তি) ঐন্দ্রী বজ্রের আঘাতে শত-শত দৈত্যদানবকে বিদীর্ণ করলেন, তারা রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে ধরাশায়ী হল। (বরাহ-অবতার-শক্তি) বরাহ-মূর্তির তুণ্ড-চক্র ও তাঁর সামনের দাঁতের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে রাক্ষসদের বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে নিপাতিত হতে লাগল

নখৈর্বিদারিতাংশ্চান্যান্‌ ভক্ষয়ন্তী মহাসুরান্‌।

নারসিংহী চচারাজৌ নাদাপূর্ণদিগম্বরা।। ৩৫

চণ্ডাট্টহাসৈরসুরাঃ শিবদূত্যাভিদূষিতাঃ।

পেতুঃ পৃথিব্যাং পতিতাংস্তাংশ্চখাদাথ সা তদা।। ৩৬

ইতি মাতৃগণং ক্রুদ্ধং মর্দয়ন্তং মহাসুরান্‌।

দৃষ্ট্বাভ্যুপায়ৈর্বিবিধৈর্নেশুর্দেবারিসৈনিকাঃ।। ৩৭

[নখৈঃ বিদারিতাম্‌ চ অন্যান্‌ ভক্ষয়ন্তী মহাসুরান্‌। নারসিংহী চচার আজৌ নাদ-আপূর্ণ-দিক্‌-অম্বরা।। ৩৫

চণ্ড-অট্ট-হাসৈঃ অসুরাঃ শিবদূতী-অভিদূষিতাঃ। পেতুঃ পৃথিব্যাম্‌ পতিতাম্‌ তান্‌ চখাদ অথ সা তদা।। ৩৬

ইতি মাতৃগণম্‌ ক্রুদ্ধম্‌ মর্দয়ন্তম্‌ মহাসুরান্‌। দৃষ্ট্বা অভ্যুপায়ৈঃ বিবিধৈঃ নেশুঃ দেব-অরি-সৈনিকাঃ।। ৩৭]

(নরসিংহ-শক্তি) নারসিংহী গর্জনে দিক ও আকাশ পূর্ণ করে তুলল, তারপর নখরে মহাসুরদের বিদীর্ণ করে, ভক্ষণ করতে লাগল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিবদূতীর উৎকট অট্টহাসিতে অসুরগণ জ্ঞান হারিয়ে ধরাশায়ী হতে লাগল এবং মাটিতে পড়ে থাকা অসুরদের তিনিও ভক্ষণ করতে লাগলেন। এইভাবে ক্রুদ্ধা মাতৃগণকে নানান ভাবে মহাসুরদের বিধ্বস্ত করতে দেখে অসুরসৈন্যরা পালাতে শুরু করল।    

পলায়নপরান্‌ দৃষ্ট্বা দৈত্যান্‌ মাতৃগণার্দিতান্‌।

যোদ্ধুমভ্যাযযৌ ক্রুদ্ধো রক্তবীজো মহাসুরঃ।। ৩৮

রক্তবিন্দুর্যদা ভূমৌ পতত্যস্য শরীরতঃ।

সমুৎপততি মেদিন্যাস্তাৎপ্রমাণস্তদাসুরঃ।। ৩৯

[পলায়নপরান্‌ দৃষ্ট্বা দৈত্যান্‌ মাতৃগণ-আর্দিতান্‌। যোদ্ধুম্‌ অভ্যাযযৌ ক্রুদ্ধঃ রক্তবীজঃ মহাসুরঃ।। ৩৮

রক্তবিন্দুঃ যদা ভূমৌ পততি অস্য শরীরতঃ। সমুৎপততি মেদিন্যাঃ তাৎ প্রমাণঃ তৎ অসুরঃ।। ৩৯]

মাতৃগণের হাতে মর্দিত হওয়া অসুরদের পালাতে দেখে, ক্রুদ্ধ মহাসুর রক্তবীজ যুদ্ধের জন্যে সামনে এগিয়ে এল। তার শরীর থেকে মাটিতে রক্তবিন্দু পড়া মাত্র, মাটিতে পড়ে থাকা সেই রক্তবিন্দু থেকে তার মতোই আরেক অসুরের উৎপন্ন হচ্ছিল।

যুযুধে স গদাপাণিরিন্দ্রশক্ত্যা মহাসুরঃ।

ততশ্চৈন্দ্রী স্ববজ্রেণ রক্তবীজমতাড়য়ৎ।। ৪০

কুলিশেনাহতস্যাশু তস্য সুস্রাব শোণিতম্‌।

সমুত্তস্থুস্ততো যোধাস্তদ্রূপাস্তৎপরাক্রমাঃ।। ৪১

[যুযুধে সঃ গদা-পাণিঃ ইন্দ্র-শক্ত্যা মহাসুরঃ। ততঃ চ ঐন্দ্রী স্ব-বজ্রেণ রক্তবীজম্‌ অতাড়য়ৎ।। ৪০

কুলিশেন আহতস্য আশু তস্য সুস্রাব শোণিতম্‌। সমুত্তস্থুঃ ততঃ যোধাঃ তৎ-রূপাঃ তৎ-পরাক্রমাঃ।। ৪১]

সেই মহাসুর গদাহাতে ইন্দ্র-শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছিল, তখন ঐন্দ্রী নিজের বজ্র দিয়ে রক্তবীজকে আঘাত করলেন। বজ্রের আঘাতে তার রক্ত ঝরতে লাগল এবং সঙ্গেসঙ্গেই তার মতো চেহারা, তার মতোই পরাক্রমী যোদ্ধাগণ উৎপন্ন হতে লাগল।

যাবন্তঃ পতিতাস্তস্য শরীরাদ্‌ রক্তবিন্দবঃ।

তাবন্তঃ পুরুষা জাতাস্তদ্‌বীর্যবলবিক্রমঃ।। ৪২

তে চাপি যুযুধুস্তত্র পুরুষা রক্তসম্ভবাঃ।

সমং মাতৃভিরত্যুগ্রশস্ত্রপাতাতিভীষণম্‌।। ৪৩

পুনশ্চ বজ্রপাতেন ক্ষতমস্য শিরো যদা।

ববাহ রক্তং পুরুষাস্ততো জাতাঃ সহস্রশঃ।। ৪৪

[যাবন্তঃ পতিতাঃ তস্য শরীরাৎ রক্তবিন্দবঃ। তাবন্তঃ পুরুষা জাতাঃ তৎ-বীর্য-বল-বিক্রমঃ।। ৪২

তে চ অপি যুযুধুঃ তত্র পুরুষা রক্ত-সম্ভবাঃ। সমম্‌ মাতৃভিঃ অতি-উগ্র-শস্ত্রপাত-অতিভীষণম্‌।। ৪৩

পুনঃ চ বজ্রপাতেন ক্ষতম্‌ অস্য শিরঃ যদা। ববাহ রক্তম্‌ পুরুষাঃ ততঃ জাতাঃ সহস্রশঃ।। ৪৪]

সেই অসুরের শরীর থেকে যত রক্তবিন্দু মাটিতে পড়ছিল, একই বীর্য-বল-বিক্রমের ততজন পুরুষ উৎপন্ন হতে লাগল। সেই রক্ত-জাত পুরুষরাও সেখানেই মাতৃগণের সঙ্গে একই ভাবে অতি ভয়ানক অস্ত্র–শস্ত্র দিয়ে অতি ভয়ংকর যুদ্ধ করতে লাগল। বজ্রের আঘাতে তার মাথায় যখনই আবার ক্ষত সৃষ্টি হল, তখনই সেই রক্তধারা থেকে সহস্র-সহস্র পুরুষের সৃষ্টি হতে লাগল।

বৈষ্ণবী সমরে চৈনং চক্রেণাভিজঘান হ।

গদয়া তাড়য়ামাস ঐন্দ্রী তমসুরেশ্বরম্‌।। ৪৫

বৈষ্ণবীচক্রভিন্নস্য রুধিরস্রাবসম্ভবৈঃ।

সহস্রশো জগদ্‌ব্যাপ্তং তৎপ্রমাণৈর্মহাসুরৈঃ।। ৪৬

[বৈষ্ণবী সমরে চ এনম্‌ চক্রেণ অভিজঘান হ। গদয়া তাড়য়ামাস ঐন্দ্রী তম্‌ অসুরেশ্বরম্‌।। ৪৫

বৈষ্ণবী-চক্র-ভিন্নস্য রুধির-স্রাব-সম্ভবৈঃ। সহস্রশঃ জগদ্‌ব্যাপ্তম্‌ তৎপ্রমাণৈঃ মহাসুরৈঃ।। ৪৬]

  সেই যুদ্ধে বৈষ্ণবী তাকে চক্র দিয়ে আঘাত করল, ঐন্দ্রী গদা দিয়ে অসুরেশ্বরকে প্রহার করতে লাগল। বৈষ্ণবীর চক্রে ছিন্ন সেই অসুর-শরীরের রক্তস্রাব থেকে রক্তবীজের মতোই হাজার-হাজার মহাসুর সৃষ্টি হয়ে জগৎ ছেয়ে ফেলল।

শক্ত্যা জঘান কৌমারী বারাহী চ তথাসিনা।

মাহেশ্বরী ত্রিশূলেন রক্তবীজং মহাসুরম্‌।। ৪৭

স চাপি গদয়া দৈত্যঃ সর্বা এবাহনৎ পৃথক্‌।

মাতৃঃ কোপসমাবিষ্টো রক্তবীজো মহাসুরঃ।। ৪৮

তস্যাহতস্য বহুধা শক্তিশূলাদিভির্ভূবি।

পপাত যো বৈ রক্তৌঘস্তেনাসঞ্ছতশোঽসুরাঃ।। ৪৯

তৈশ্চাসুরাসৃকসম্ভূতৈরসুরৈঃ সকলং জগৎ।

ব্যাপ্তমাসীৎ ততো দেবা ভয়মাজগ্মুরুত্তমম্‌।। ৫০

[শক্ত্যা জঘান কৌমারী বারাহী চ তথা অসিনা। মাহেশ্বরী ত্রিশূলেন রক্তবীজম্‌ মহাসুরম্‌।। ৪৭

স চ অপি গদয়া দৈত্যঃ সর্বা এব অহনৎ পৃথক্‌। মাতৃঃ কোপ-সমাবিষ্টো রক্তবীজঃ মহাসুরঃ।। ৪৮

তস্য আহতস্য বহুধা শক্তি-শূলাদিভিঃ ভূবি। পপাত যঃ বৈ রক্ত-ওঘঃ তেনা আসন্‌ শতশঃ অসুরাঃ।। ৪৯

তৈঃ চ অসুর-অসৃক্‌-সম্ভূতৈঃ অসুরৈঃ সকলম্‌ জগৎ। ব্যাপ্তম্‌ আসীৎ ততঃ দেবা ভয়ম্‌ আজগ্মুঃ উত্তমম্‌।। ৫০

  কৌমারী শূল দিয়ে, বারাহী অসি দিয়ে এবং মাহেশ্বরী ত্রিশূল দিয়ে রক্তবীজকে বারবার আঘাত করছিলেনসেই দৈত্য মহাসুর রক্তবীজ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সকল মাতৃগণকেই আলাদা আলাদা করে আঘাত করতে লাগল। বহু শক্তি ও শূলের আঘাতে যে যত আহত হতে লাগল, তার শোণিতধারা মাটিতে পড়লেই তার থেকে শতশত অসুর জন্ম নিতে লাগল। এবং সেই অসুরের রক্তজাত অসুরে যখন জগতে ভরে উঠতে লাগল, তখন দেবতারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন।

তান্‌ বিষণ্ণান সুরান্‌ দৃষ্ট্বা চণ্ডিকা প্রাহসত্ত্বরা।

উবাচ কালীং চামুণ্ডে বিস্তরং বদন কুরু।। ৫১

মচ্ছস্ত্রপাতসম্ভূতান্‌ রক্তবিন্দূন্‌ মহাসুরান্‌।

রক্তবিন্দোঃ প্রতীচ্ছ ত্বং বক্ত্রেণানেন বেগিতা।। ৫২

ভক্ষয়ন্তী চর রণে তদুৎপন্নান্মহাসুরান্‌।

এবমেষ ক্ষয়ং দৈত্যঃ ক্ষীণরক্তো গমিষ্যতি।। ৫৩

ভক্ষ্যমাণাস্ত্বয়া চোগ্রা ন চোৎপৎস্যন্তি চাপরে।

ইত্যুক্ত্বা তাং ততো দেবী শূলেনাভিজঘান তম্‌।।৫৪

[তান্‌ বিষণ্ণান সুরান্‌ দৃষ্ট্বা চণ্ডিকা প্রাহসৎ ত্বরা। উবাচ কালীম্‌ চামুণ্ডে বিস্তরম্‌ বদন কুরু।। ৫১

মৎ শস্ত্রপাত-সম্ভূতান্‌ রক্তবিন্দূন্‌ মহাসুরান্‌। রক্তবিন্দোঃ প্রতীচ্ছ ত্বং বক্ত্রেণ অনেন বেগিতা।। ৫২

ভক্ষয়ন্তী চর রণে তদুৎপন্নাৎ মহাসুরান্‌। এবম্‌ এষ ক্ষয়ম্‌ দৈত্যঃ ক্ষীণ-রক্তঃ গমিষ্যতি।। ৫৩

ভক্ষ্যমাণাঃ ত্বয়া চ উগ্রা ন চ উপৎস্যন্তি চ অপরে। ইতি উক্ত্বা তাম্‌ ততঃ দেবী শূলেন অভিজঘান তম্‌।।৫৪]

সেই বিষণ্ণ দেবতাদের দেখে দেবী চণ্ডিকা সহাস্যমুখে দেবী কালীকে বললেন, “চামুণ্ডে তুমি শীঘ্র মুখ ব্যাদান করো। আমার শস্ত্রের আঘাতে যখনই মহাসুরের দেহ থেকে রক্তবিন্দু ক্ষরণ হবে, তৎক্ষণাৎ সেই রক্তবিন্দু এবং তার থেকে জাত অসুরদের তুমি ভক্ষণ করো।  যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে তুমি সেই রক্ত-জাত অসুরদের ভক্ষণ করতে থাক, এতে ওই দৈত্য রক্তহীন হয়ে পড়তে থাকবে। তুমি ভক্ষণ করতে থাকলে এর পরে আর এই উগ্র-অসুররা জন্ম নিতে পারবে না”। এই কথা বলেই দেবী সেই অসুরকে শূলের আঘাত করলেন।

মুখেন কালী জগৃহে রক্তবীজস্য শোণিতম্‌।

ততোঽসাবাজঘানাথ গদয়া তত্র চণ্ডিকাম্‌।। ৫৫

ন চাস্যা বেদনাঞ্চক্রে গদাপাতোঽল্পিকামপি।

তস্যাহতস্য দেহাত্তু বহু সুস্রাব শোণিতম্‌। ৫৬

যতস্ততস্তদ্‌বক্ত্রেণ চামুণ্ডা সম্প্রতীচ্ছতি।

মুখে সমুদ্‌গতা যেঽস্যা রক্তপাতান্মহাসুরাঃ।। ৫৭  

[মুখেন কালী জগৃহে রক্তবীজস্য শোণিতম্‌। ততঃ অসৌ অজঘান অথ গদয়া তত্র চণ্ডিকাম্‌।। ৫৫

ন চ অস্যা বেদনাম্‌ চক্রে গদাপাতঃ অল্পিকাম্‌ অপি। তস্য আহতস্য দেহাৎ তু বহু সুস্রাব শোণিতম্‌। ৫৬        

যতঃ ততঃ তৎ বক্ত্রেণ চামুণ্ডা সম্প্রতীচ্ছতি। মুখে সমুদ্‌গতা যে অস্যা রক্তপাতান্‌ মহাসুরাঃ।। ৫৭]        

এবং দেবীকালী তাঁর মুখ দিয়ে রক্তবীজের শোণিত পান করতে লাগলেন। তখন সেই অসুর গদা দিয়ে দেবী চণ্ডিকাকে আঘাত করলেন। কিন্তু সেই আঘাতে দেবীর কিছুমাত্র বেদনার অনুভব হল না। (কারণ তিনি চিৎশক্তিময়ী, মহামায়া)। তবে অসুরের দেহের আঘাত থেকে বহুল রক্তক্ষরণ হতে থাকল এবং দেবী চামুণ্ডা সঙ্গে সঙ্গেই সেই মহাসুরের রক্তস্রাব মুখ দিয়ে পান করতে লাগলেন।

তাংশ্চখাদাথ চামুণ্ডা পপৌ তস্য চ শোণিতম্‌।

দেবী শূলেন বজ্রেণ বাণৈরসিভির্‌ঋষ্টিভিঃ।। ৫৮

জঘান রক্তবীজং তং চামুণ্ডাপীত শোণিতম্‌।

স পপাত মহীপৃষ্ঠে শস্ত্রসঙ্ঘসমাহতঃ।। ৫৯

নীরক্তশ্চ মহীপাল রক্তবীজো মহাসুরঃ।

ততস্তে হর্ষমতুলমবাপুস্ত্রিদশা নৃপ।। ৬০

তেষাং মাতৃগণো জাতো ননর্তাসৃঙ্মদোদ্ধতঃ।। ৬১

[তান্‌ চখাদ অথ চামুণ্ডা পপৌ তস্য চ শোণিতম্‌। দেবী শূলেন বজ্রেণ বাণৈঃ-অসিভিঃ-ঋষ্টিভিঃ।। ৫৮

জঘান রক্তবীজম্‌ তম্‌ চামুণ্ডাপীত শোণিতম্‌। স পপাত মহীপৃষ্ঠে শস্ত্র-সঙ্ঘ-সমাহতঃ।। ৫৯

নীরক্তঃ চ মহীপাল রক্তবীজঃ মহাসুরঃ। ততঃ তে হর্ষম্‌ অতুলম্‌ অবাপুঃ ত্রিদশা নৃপ।। ৬০

তেষাম্‌ মাতৃগণঃ জাতঃ ননর্ত অসৃক্‌-মদ-উদ্ধতঃ।। ৬১

দেবী চামুণ্ডা সেই অসুরের রক্ত পান করার সঙ্গে, সেই রক্ত থেকে জাত অসুরদেরও গ্রাস করতে লাগলেন। তখন দেবীও রক্তবীজকে শূল, বজ্র, খড়্গ ও ঋষ্টি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। হে মহীপাল, দেবী চামুণ্ডা তার রক্ত পান করতে থাকায়, অজস্র অস্ত্রে বিদ্ধ সেই অসুর রক্তবীজ রক্তহীন হয়ে ধরাশায়ী হল। হে নৃপ, তখন দেবতারা অতুলনীয় আনন্দ লাভ করলেন, এবং তাঁদের দেহ থেকে জাত মাতৃগণ রক্ত-মদিরা পানে উদ্ধত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন।          

               

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে রক্তবীজবধো 

নাম অষ্টমোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

রক্তবীজ বধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত


...চলবে...

পরের পর্বে আসবে শ্রীশ্রী চণ্ডীর উত্তর চরিত নবম অধ্যায় 

গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির  


২টি মন্তব্য:

  1. এইসব উদ্ভট গল্প গাথা বলিউড হলিউডের মারকাটারি সিনেমা হতে পারে। এগুলো যদি হিন্দুধর্ম হিসাবে পরিবেশিত তবে হিন্দুদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য আমার করুণা হচ্ছে।

    উত্তরমুছুন
  2. ঠিকই বলেছিস, এই বিষয়গুলো সকলের কাছে স্পষ্ট করার জন্যেই পুরাণের অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। তবে করুণা করার কিছু নেই - এসব কথা কোন কট্টর হিন্দুও বিশ্বাস করবে বলে তোর মনে হয়? আমার তো হয় না।

    উত্তরমুছুন

নতুন পোস্টগুলি

গিরগিটি

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...