সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - শেষ পর্ব

 [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


এর আগের পর্ব পাশের সূত্রে "শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৬"



উত্তরচরিত

একাদশ অধ্যায়

ধ্যান

বালরবিদ্যুতিমিন্দুকিরীটাং তুঙ্গকুচাং নয়নত্রয়যুক্তাম্‌।

স্মেরমুখীং বরদাঙ্কুশপাশাভীতিকরাং প্রভজে ভুবনেশীম্‌।।

[বাল-রবি-দ্যুতিম্‌ ইন্দু-কিরীটাম্‌ তুঙ্গ-কুচাম্‌ নয়ন-ত্রয়-যুক্তাম্‌। স্মের-মুখীম্‌ বরদা-অঙ্কুশ-পাশ-অভীতিকরাম্‌ প্রভজে ভুবন-ঈশীম্‌।।]

যিনি শিশু-রবির মতো প্রভাময়ী, যাঁর মুকুটে চন্দ্র, যিনি পীনপয়োধরা ও ত্রিনেত্রা। যিনি হাস্যমুখী, যিনি বরদা, অঙ্কুশ, পাশ ও অভয়দায়িনী, সেই ভুবনেশ্বরীকে একনিষ্ঠ ধ্যান করি।

  

একাদশ অধ্যায় – নারায়ণীস্তুতি

 ঋষিরুবাচ।

দেব্যা হতে তত্র মহাসুরেন্দ্র সেন্দ্রাঃ সুরা বহ্নিপুরোগমাস্তাম্‌।

কাত্যায়নীং তুষ্টুবুরিষ্টল্মভাদ্‌ বিকাসিবক্ত্রাস্তু বিকাসিতাশাঃ।। ১

দেবি প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ প্রসীদ মাতর্জগতোঽখিলস্য।

প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং ত্বমীশ্বরী দেবী চরাচরস্য।। ২

আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি।

অপাং স্বরূপস্থিতয়া ত্বয়ৈতৎ আপ্যায্যতে কৃৎস্নমলঙ্ঘ্যবীর্যে।। ৩

[ঋষিঃ উবাচ। দেব্যা হতে তত্র মহা-অসুর-ইন্দ্র স ইন্দ্রাঃ সুরাঃ বহ্নি-পুরঃ-গমাঃ তাম্‌। কাত্যায়নীম্‌ তুষ্টুবুঃ ইষ্ট-লম্ভাৎ বিকাসিবক্ত্রাঃ তু বিকাসিত-আশাঃ।। ১

দেবি প্রপন্ন-আর্তি-হরে প্রসীদ প্রসীদ মাতঃ জগতঃ অখিলস্য। প্রসীদ বিশ্ব-ঈশ্বরি পাহি বিশ্বম্‌ ত্বম্‌ ঈশ্বরী দেবী চরাচরস্য।। ২

আধার-ভূতা জগতঃ-ত্বম্‌ একা মহী-স্বরূপেণ যতঃ স্থিত অসি। অপাম্‌ স্বরূপ-স্থিতয়া ত্বয়া এতৎ আপ্যায্যতে কৃৎস্নম্‌ অলঙ্ঘ্য-বীর্যে।। ৩]

ঋষি বললেন। দেবীর হাতে মহাসুরাধিপতি শুম্ভ নিহত হওয়ায় ইন্দ্র সহ অগ্নিপ্রমুখ দেবতারা অভীষ্টলাভ ও পূর্ণমনোরথ হয়ে, সহাস্যমুখে সেই দেবী কাত্যায়নীর স্তব করতে লাগলেন।

হে দেবি, হে আশ্রিতের দুঃখ-হারিণি প্রসন্ন হোন, হে অখিল জগতের মাতা আপনি প্রসন্ন হোন। হে বিশ্বেশ্বরি, আপনি প্রসন্ন হয়ে জগৎ পালন করুন, হে দেবি আপনি বিশ্বচরাচরের ঈশ্বরী। হে দেবি, আপনাকে শক্তিতে অতিক্রম করা যায় না, আপনি পৃথিবী-স্বরূপে অবস্থিতা, আপনি একা (অদ্বিতীয়া) এই জগতের আশ্রয়রূপাআপনার জলরূপের স্থিতিতেই এই সমগ্র জগৎ পুষ্টি লাভ করে।

                    ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনন্তবীর্যা বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া।

                    সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ।। ৪

                    বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।

                    ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্‌বয়ৈতৎ কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরাপরোক্তিঃ।। ৫      

[ত্বম্‌ বৈষ্ণবী-শক্তিঃ-অনন্ত-বীর্যা বিশ্বস্য বীজম্‌ পরমা অসি মায়া। সম্মোহিতম্‌ দেবি সমস্তম্‌ এতৎ ত্বম্‌ বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-হেতুঃ।। ৪

বিদ্যাঃ সমস্তাঃ তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ স-কলাঃ জগৎসু। ত্বয়া একয়া পূরিতম্‌ অম্বয়া এতৎ কা তে স্তুতিঃ স্তব্য-পর-অপর-উক্তিঃ।। ৫]

আপনি অনন্ত শক্তিময়ী বৈষ্ণবী শক্তি, আপনি জগতের বীজস্বরূপা ও মহামায়া। হে দেবি, আপনার মায়ায় সমস্ত জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে, আবার প্রসন্না হলে আপনিই তাদের মুক্তির কারণ স্বরূপ। হে দেবি, জগতের সমস্ত বিদ্যা, সমস্ত স্ত্রী–গুণ ও সকল কলা আপনারই রূপভেদ । আপনি একা ও অদ্বিতীয়া জননীরূপে এই জগতের সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত, অতএব আপনার পরা ও অপরা মহিমার স্তব আর কী হতে পারে?

[বিদ্যা আঠারোটি – চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, আট শাস্ত্র। স্ত্রীগুণ – তিনটি, পাতিব্রত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্য। কলা – চৌষট্টি – গীত, বাদ্য, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদি। দেবীর অপরা মহিমা থেকে ঐহিক সুখ-সম্পদ লাভ হয় এবং পরা মহিমায় পরমার্থ প্রাপ্তি ঘটে।]

সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী।

ত্বং স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরমোক্তয়ঃ।। ৬

সর্বস্য বুদ্ধিরূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে।

স্বর্গাপবর্গদে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৭

[সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গ-মুক্তি-প্রদায়িনী। ত্বম্‌ স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরম-উক্তয়ঃ।। ৬

সর্বস্য বুদ্ধি-রূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে। স্বর্গ-অপবর্গ-দে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৭

আপনি সর্বভূতস্বরূপা, স্বর্গ ও মুক্তি প্রদায়িনী দেবী, যখন আপনার স্তুতি করি, তখন এর থেকে স্তবের পরমা-উক্তি আর কী হতে পারে? হে দেবি, আপনিই সকল মানুষের হৃদয়ে বুদ্ধিরূপে অবস্থান করেন, আপনিই স্বর্গ ও অপবর্গ দাত্রী নারায়ণী, আপনাকে প্রণাম করি। [তন্ত্রমতে জীবনের লক্ষ্য দুটি, অপবর্গ ও মোক্ষ বা মুক্তি। অপবর্গ হল ধর্ম, অর্থ ও কাম। দেবী এর সবগুলিই দান করেন।]

কলাকাষ্ঠাদিরূপেণ পরিণামপ্রদায়িনী।

বিশ্বস্যোপরতৌ শক্তে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৮

সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে  শিবে সর্বার্থসাধিকে।

শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৯

[কলা-কাষ্ঠাদি-রূপেণ পরিণাম-প্রদায়িনী। বিশ্বস্য উপরতৌ শক্তে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৮

সর্ব-মঙ্গল-মঙ্গল্যে  শিবে সর্ব-অর্থ-সাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৯

আপনি কলা-কাষ্ঠাদি রূপে সকল পরিণাম দান করেন। শক্তিরূপে আপনি বিশ্বের সংহার করে থাকেন, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। [কলা ও কাষ্ঠা কাল বা সময়ের একক। ১ কাষ্ঠা = ১৮ নিমেষ, ১ কলা = ৩০ কাষ্ঠা। অর্থাৎ দেবী কালরূপে সকল কর্মের ফল প্রদায়িনী।] শিবারূপে সকল মঙ্গলের আপনিই মঙ্গলস্বরূপা ও সর্ব-অর্থ (চতুর্বর্গ – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ) দায়িনী,  গৌরী রূপে আপনি ত্রিভুবনের আশ্রয়দাত্রী, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম।

সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।

গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১০

শরণাগতদীনার্তপরিত্রাণপরায়ণে।

সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১১

হংসযুক্তবিমানস্থে ব্রহ্মাণীরূপধারিণি।

কৌশাম্ভঃক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১২

[সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশানাম্‌ শক্তিভূতে সনাতনি। গুণ-আশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১০

শরণা-আগত-দীন-আর্ত-পরিত্রাণ-পরায়ণে। সর্বস্য আর্তি হরে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১১

হংস-যুক্ত-বিমানস্থে ব্রহ্মাণী-রূপ-ধারিণি। কৌশ-অম্ভঃ-ক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১২]

আপনি সৃষ্টি-স্থিতি ও সংহারের শক্তিরূপা, তিনগুণের আশ্রয় আপনি সনাতনি হলেও আপনি ত্রিগুণময়ী। হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। হে দেবি, আপনার শরণাগত দীন ও আর্তদের প্রতি আপনি পরিত্রাণ পরায়ণ, আপনি সকলের দুঃখ-হারিণী, হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। ব্রহ্মাণীরূপে আপনি হংসযুক্ত বিমানে অবস্থিতা, কমণ্ডলু থেকে কুশ দিয়ে (পবিত্র) জল-সিঞ্চনকারিনী, হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম।

[সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ – তিনগুণ। দেবী এই তিনগুণের আধার, অতএব তিনি গুণময়ী। প্রকৃতিরূপে তাঁর এই তিনগুণের প্রভাবেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি নিজে নির্গুণ এবং ত্রিগুণাতীতা, সনাতনী আদ্যাশক্তি।]

ত্রিশূলচন্দ্রাহিধরে মহাবৃষভবাহিনি।

মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৩

ময়ূরকুক্কুটবৃতে মহাশক্তিধরেঽনঘে।

কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৪

শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে।

প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৫

গৃহীতোগ্রমহাচক্রে দংষ্ট্রোদ্ধৃতবসুন্ধরে।

বরাহরূপিণি শিবে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৬

[ত্রিশূল-চন্দ্র–অহি-ধরে মহা-বৃষভ-বাহিনি। মাহেশ্বরী-স্বরূপেণ নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৩

ময়ূর-কুক্কুট-বৃতে মহা-শক্তি-ধরে-অনঘে। কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৪

শঙ্খ-চক্র-গদা-শার্ঙ্গ–গৃহীত-পরম-আয়ুধে। প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে ।। ১৫

গৃহীত-উগ্র-মহা-চক্রে দংষ্ট্র-উদ্ধৃত-বসুন্ধরে। বরাহরূপিণি শিবে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৬]

আপনি ত্রিশূল, চন্দ্র ও নাগ ধারণ করেন এবং আপনি বৃষবাহনা, এই মাহেশ্বরীস্বরূপে হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। ময়ুর ও কুক্কুট পরিবৃতা মহাশক্তিধারিণী হে দেবি, হে নিত্য-শুদ্ধ কৌমরীরূপা নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গ (বিষ্ণুর ধনু বা খড়্গের নাম শার্ঙ্গ) এই চার পরম অস্ত্রধারিণী হে দেবি, আপনি প্রসন্না হোন, হে বৈষ্ণবীরূপিণী নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। মহাতুণ্ড-চক্রে এবং উগ্রদন্তে আপনি পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন, হে নারায়ণি, মঙ্গলময়ী বারাহীরূপা, আপনাকে প্রণাম।

নৃসিংহরূপেণোগ্রেণ হন্তুং দৈত্যান্‌ কৃতোদ্যমে।

ত্রৈলোক্যত্রাণসহিতে নারায়ণি নমোঽস্তুতে।। ১৭

কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্জ্বলে।

বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৮

শিবদূতীস্বরূপেণ হতদৈত্যমহাবলে।

ঘোররূপে মহারাবে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৯

দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালাবিভূষণে।

চামুণ্ডে মুণ্ডমথনে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২০

[নৃসিংহ-রূপেণ-উগ্রেণ হন্তুম্‌ দৈত্যান্‌ কৃত-উদ্যমে। ত্রৈলোক্য-ত্রাণ-সহিতে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।।  ১৭

কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্র-নয়ন-উজ্জ্বলে। বৃত্র-প্রাণ-হরে চ ঐন্দ্রি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ।। ১৮

শিবদূতী-স্বরূপেণ হত-দৈত্য-মহা-বলে। ঘোর-রূপে মহা-আরাবে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৯

দংষ্ট্রা-করাল-বদনে শিরঃ-মালা-বিভূষণে। চামুণ্ডে মুণ্ড-মথনে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২০]

উগ্র নৃসিংহরূপে আপনার দৈত্যবধের উদ্যোগ সার্থক, হে ত্রিলোকতারিণি নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। মুকুটধারিণী, উজ্জ্বল সহস্রনয়না এবং আপনি বৃত্রেরও প্রাণঘাতিনী, ঐন্দ্রীরূপে হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। ভয়ংকরী, মহাগর্জনে মহাদৈত্যসেনা নিধনকারিণী, হে নারায়ণি শিবদূতীস্বরূপে আপনাকে প্রণাম। ভয়াল দন্তমুখী, মুণ্ডমালায় অলংকৃতা ও মুণ্ডাসুরমর্দিনী, হে নারায়ণি চামুণ্ডারূপে আপনাকে প্রণাম।

লক্ষ্মী লজ্জে মহাবিদ্যে শ্রদ্ধে পুষ্টি স্বধে ধ্রুবে।

মহারাত্রি মহামায়ে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২১

মেধে সরস্বতি বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি।

নিয়তে ত্বং প্রসীদেশে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২২

সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে।

ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবি নমোঽস্তু তে।। ২৩

এতৎ তে বদনং সৌম্যং লোচনত্রয়ভূষিতম্‌।

পাতুঃ ন সর্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমোঽস্তু তে।। ২৪

[লক্ষ্মী লজ্জে মহাবিদ্যে শ্রদ্ধে পুষ্টি স্বধে ধ্রুবে। মহারাত্রি মহামায়ে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২১

মেধে সরস্বতি বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি। নিয়তে ত্বম্‌ প্রসীদ-ঈশে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২২

সর্বস্বরূপে সর্ব-ঈশে সর্ব-শক্তি-সমন্বিতে। ভয়েভ্যঃ ত্রাহি নঃ দেবি দুর্গে দেবি নমঃ অস্তু তে।। ২৩

এতৎ তে বদনম্‌ সৌম্যম্‌ লোচন-ত্রয়-ভূষিতম্‌। পাতুঃ নঃ সর্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমঃ অস্তু তে।। ২৪]

আপনিই লক্ষ্মী, লজ্জা, পরমবিদ্যা, শ্রদ্ধা, পুষ্টি, স্বধা-মন্ত্র এবং নিত্যরূপিণী, হে নারায়ণি, আপনিই প্রলয়রূপিণী মহারাত্রি ও মহামায়া, আপনাকে প্রণাম। আপনিই সরস্বতী, মেধা, সর্বশ্রেষ্ঠারূপিণী, আপনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণধারিণী, আপনি নিয়তি এবং ঈশ্বরী। আপনি প্রসন্না হোন, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। আপনি সর্ব-স্বরূপা, সর্বেশ্বরী, সর্ব শক্তির সমন্বয়, হে দেবি দুরধিগম্যা দুর্গা, সকল ভয় থেকে আমাদের ত্রাণ করুন, হে দেবি, আপনাকে প্রণাম। ত্রিনয়নে শোভিতা, হে চারু-আননে, আমাদের সর্ব উপদ্রব থেকে রক্ষা করুন, হে কাত্যায়নি আপনাকে প্রণাম।

জ্বালাকরালমত্যুগ্রমশেষাসুরসূদনম্‌।

ত্রিশূলং পাতু নো ভীতের্ভদ্রকালি নমোঽস্তু তে।। ২৫

হিনস্তি দৈত্যতেজাংসি স্বনেনাপূর্য যা জগৎ।

সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যোঽনঃ সুতানিব।। ২৬

অসুরাসৃগ্‌বসাপঙ্কচর্চিতস্তে করোজ্জ্বলঃ।

শুভায় খড়্গো ভবতু চণ্ডিকে ত্বাং নতা বয়ম্‌।। ২৭

[জ্বালা-করালম্‌ অতি-উগ্রম্‌ অশেষ-অসুর-সূদনম্‌। ত্রিশূলং পাতু নঃ ভীতেঃ ভদ্রকালি নমঃ অস্তু তে।। ২৫

হিনস্তি দৈত্য-তেজাংসি স্বনেন আপূর্য যা জগৎ। সা ঘণ্টা পাতু নঃ দেবি পাপেভ্যঃ অনঃ সুতান্‌ ইব।। ২৬

অসুর-অসৃক্‌-বসা-পঙ্ক-চর্চিতঃ তে কর-উজ্জ্বলঃ। শুভায় খড়্গঃ ভবতু চণ্ডিকে ত্বাম্‌ নতা বয়ম্‌।। ২৭]

প্রচণ্ড তেজময়, অতি ভয়ংকর, অসংখ্য অসুর নিধনকারী আপনার ত্রিশূল আমাদের সকল ভয় থেকে রক্ষা করুক, হে ভদ্রকালি, আপনাকে প্রণাম। যে ঘণ্টার ধ্বনি জগতে ব্যাপ্ত হওয়ায়, দৈত্যরা নিস্তেজ হয়েছিল, হে দেবি, মাতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করেন, সেই ঘণ্টা সকল পাপের থেকে আমাদের রক্ষা করুক। হে চণ্ডিকে, আপনার হাতের যে উজ্জ্বল খড়্গ অসুরের রক্ত-মেদরূপ কাদায় লিপ্ত, সেই খড়্গ আমাদের মঙ্গল করুক, হে দেবী আমাদের বিনত প্রণাম নিন।

রোগানশেষানপহংসি তুষ্ট্বা রুষ্টা তু কামান্‌ সকলানভীষ্টান্‌।

ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নরাণাং ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি।। ২৮

এতৎ কৃতং যৎ কদনং ত্বয়াদ্য ধর্মদ্বিষাং দেবি মহাসুরাণাম্‌।

রূপৈরনৈকর্বহুধাত্মমূর্তিং কৃত্বাম্বিকে তৎ প্রকরোতি কান্যা।। ২৯

বিদ্যাসু শাস্ত্রেষু বিবেকদীপেষ্বাদ্যেষু বাক্যেষু চ কা ত্বদন্যা।

মমত্বগর্তেঽতিমহান্ধকারে বিভ্রাময়ত্যেতদতীব বিশ্বম্‌।। ৩০

[রোগান্‌ অশেষান্‌ অপহংসি তুষ্ট্বা রুষ্টা তু কামান্‌ সকলান্‌ অভীষ্টান্‌। ত্বাম্‌ আশ্রিতানাম্‌ ন বিপৎ নরাণাম্‌ ত্বাম্‌ আশ্রিতা হি আশ্রয়তাম্‌ প্রয়ান্তি।। ২৮

এতৎ কৃতম্‌ যৎ কদনম্‌ ত্বয়া অদ্য ধর্ম-দ্বিষাম্‌ দেবি মহা-অসুরাণাম্‌। রূপৈঃ অনৈকঃ বহুধা-আত্মমূর্তিম্‌ কৃত্বা অম্বিকে তৎ প্রকরোতি কা অন্যা।। ২৯

বিদ্যাসু শাস্ত্রেষু বিবেক-দীপেষু আদ্যেষু বাক্যেষু চ কা ত্বৎ অন্যা। মমত্ব-গর্তে-অতি-মহা-অন্ধকারে বিভ্রাময়তি এতৎ অতীব বিশ্বম্‌।। ৩০]

আপনি তুষ্টা হলে সকল রোগ এবং ক্রুদ্ধা হলে অভীষ্ট সকল সংকল্প হরণ করেন, আপনার আশ্রিত মানুষের কোন বিপদ থাকে না, আপনার আশ্রিতরাই অন্যের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে। হে দেবি, অনেক রূপে বহুবিধ আত্মমূর্তিতে এই যে আপনি আজ ধর্ম বিদ্বেষী মহাসুরদের বিনাশ করলেন, হে অম্বিকে, আপনি ছাড়া এই কাজ আর কে করতে পারে? এই বিশ্বের মানুষকে সকল বিদ্যায়, ধর্মশাস্ত্রে, বিবেকের আলোকে, আদি বাক্যে এবং মোহগর্তের মহাতিমির-অবিদ্যায়, আপনি ছাড়া কে আর বারবার ভ্রমণ করাতে পারে?     

রক্ষাংসি যত্রোগ্রবিষাশ্চ নাগা যত্রারয়ো দস্যুবলানি যত্র।

দাবানলো যত্র তথাব্‌ধিমধ্যে তত্র স্থিতা ত্বং পরিপাসি বিশ্বম্‌।। ৩১

বিশ্বেশ্বরি ত্বং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্‌।

বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবন্তি বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ।। ৩২

দেবি প্রসীদ পরিপালয় নোঽরিভীতেঃ নিত্যং যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।

পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গান্‌।। ৩৩

প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবি বিশ্বার্তিহারিণি।

ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।। ৩৪  

[রক্ষাংসি যত্র উগ্রবিষাঃ চ নাগাঃ যত্র অরয়ঃ দস্যু-বলানি যত্র। দাবানলঃ যত্র তথা অব্‌ধি-মধ্যে তত্র স্থিতা ত্বম্‌ পরিপাসি বিশ্বম্‌।। ৩১

বিশ্ব-ঈশ্বরি ত্বম্‌ পরিপাসি বিশ্বম্‌ বিশ্ব-আত্মিকা ধারয়সি ইতি বিশ্বম্‌। বিশ্ব-ঈশ-বন্দ্যা ভবতী ভবন্তি বিশ্ব-আশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তি-নম্রাঃ।। ৩২

দেবি প্রসীদ পরিপালয় নঃ অরি-ভীতেঃ নিত্যম্‌ যথা অসুর-বধাৎ অধুনা এব সদ্যঃ। পাপানি সর্ব-জগতাম্‌ চ শমম্‌ নয় আশু উৎপাৎ-অপাক-জনিতাম্‌ চ মহা-উপসর্গান্‌।। ৩৩

প্রণতানাম্‌ প্রসীদ ত্বম, দেবি বিশ্ব-আর্তিহারিণি। ত্রৈলোক্য-বাসিনাম্‌ ঈড্যে লোকানাম্‌ বরদা ভব।। ৩৪]

যেখানে রাক্ষস ও উগ্রবিষ নাগ, যেখানে শত্রু ও দস্যুসেনা, যেখানে দাবানল, সেখানে - এমনকি সমুদ্রমধ্যেও আপনি সর্বদা বিরাজিতা হয়ে বিশ্বকে প্রতিপালন করেনহে বিশ্বেশ্বরি, আপনি এই বিশ্বকে আত্ম-স্বরূপে ধারণ করেন এবং পরিপালনও করেন। আপনি বিশ্বের সকল ঈশ্বরের বন্দনীয়া, যে আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়, তিনিই বিশ্বের আশ্রয় হয়ে থাকেন। হে দেবি, আপনি প্রসন্না হোন, যেভাবে আপনি সদ্য সদ্য অসুরদের বিনাশ করলেন, সেইরকমই আমাদের শত্রুভয় থেকে সর্বদা রক্ষা করুন। সর্ব জগতে পাপের এবং উৎপাত ও অপবিত্রতা থেকে উৎপন্ন মহাউপসর্গের শান্তি এনে দিন। [মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিকে উপসর্গ বলা হয়।] হে দেবি, হে বিশ্বের দুঃখহারিণি, হে ত্রৈলোক্যবাসীদের আরাধ্যা, আপনি প্রসন্ন হন, আপনার চরণে প্রণত ভক্তদের বরদান করুন।

দেব্যুবাচ।

বরদাহং সুরগণা বরং যং মনসেচ্ছথ।

তং বৃণুধ্বং প্রযচ্ছামি জগতামুপকারকম্‌।। ৩৫

দেবা ঊচুঃ।

সর্ববাধাপ্রশমনং ত্রৈলোক্যস্যাখিলেশ্বরি।

এবমেবা ত্বয়া কার্যমস্মদ্বৈরিবিনাশনম্‌।। ৩৬

[দেবী উবাচ। বরদা অহম্‌ সুরগণা বরম্‌ যম্‌ মনস-ইচ্ছথ। তম্‌ বৃণুধ্বম্‌ প্রযচ্ছামি জগতাম্‌ উপকারকম্‌।। ৩৫

দেবা ঊচুঃ। সর্ব-বাধা-প্রশমনম্‌ ত্রৈলোক্যস্য-অখিলেশ্বরি। এবম্‌ এবা ত্বয়া কার্যম্‌ অস্মৎ বৈরি-বিনাশনম্‌।। ৩৬]

দেবী বললেন, আমিই বরদা, হে দেবগণ, তোমাদের যা মনের ইচ্ছা প্রার্থনা কর, জগতের কল্যাণের জন্য আমি প্রদান করব।

দেবতারা বললেন। হে অখিলেশ্বরী, ত্রিলোকের সকল বাধার প্রশমনে আপনি আমাদের এই যে শত্রুবিনাশ করলেন, এমনই কাজ আপনি করতে থাকুন।

দেব্যুবাচ।

বৈবস্বতেঽন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে।

শুম্ভো নিশুম্ভশ্চৈবান্যাবুৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।। ৩৭

নন্দগোফৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা।

ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলনিবাসিনী।। ৩৮

পুনরপ্যতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে।

অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তাংস্তু দানবান্‌।। ৩৯

ভক্ষয়ন্ত্যাশ্চ তানুগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্‌ মহাসুরান্‌।

রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমীকুসুমোপমাঃ।। ৪০

[দেবী উবাচ। বৈবস্বতে অন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে। শুম্ভঃ নিশুম্ভঃ চ এব অন্যৌ উৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।। ৩৭

নন্দ-গোপ-গৃহে জাতা যশোদা-গর্ভ-সম্ভবা। ততঃ তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচল-নিবাসিনী।। ৩৮

পুনঃ অপি অতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে। অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তান্‌ তু দানবান্‌।। ৩৯

ভক্ষয়ন্ত্যাঃ চ তান্‌ উগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্‌ মহাসুরান্‌। রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমী-কুসুম-উপমাঃ।। ৪০]

দেবী বললেন। অষ্টবিংশতিতম যুগে বৈবস্বত মনুর অধিকার কালে, এই দুই মহাসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভ যখন অন্য নামে প্রাদুর্ভূত হবে, তখন আমি বিন্ধ্যাচল-নিবাসিনী হয়ে এবং নন্দগোপের গৃহে যশোদার গর্ভে জন্ম নিয়ে দুজনকে বিনাশ করব। আবার অতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, পৃথিবীতে অবতীর্ণা হব এবং দানব বৈপ্রচিত্তান বংশীয় দানবদেরও হত্যা করব। সেই ভয়ানক মহাসুর বৈপ্রচিত্তানদের যখন আমি গ্রাস করব, রক্তে আমার দাঁত ডালিমফুলের তুল্য হয়ে উঠবে।

ততো মাং দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ।

স্তুবন্তো ব্যাহরিষ্যন্তি সততং রক্তদন্তিকাম্‌।। ৪১

ভূয়শ্চ শতবার্ষিক্যামনাবৃষ্ট্যামনম্ভসি।

মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যাম্যযোনিজা।। ৪২

ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যন্মুনীন্‌।

কীর্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীমিতি মাং ততঃ।। ৪৩

ততোঽহমখিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভবৈঃ।

ভরিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।। ৪৪

শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি।

তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্‌।। ৪৫

[ততঃ মাম্‌ দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ। স্তুবন্তঃ ব্যাহরিষ্যন্তি সততম্‌ রক্ত-দন্তিকাম্‌।। ৪১

ভূয়ঃ চ শত-বার্ষিক্যাম্‌ অনাবৃষ্ট্যাম্‌ অনম্ভসি। মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যামি অযোনিজা।। ৪২

ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যৎ মুনীন্‌। কীর্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীম্‌ ইতি মাম্‌ ততঃ।। ৪৩

ততঃ অহম্‌ অখিলম্‌ লোকম্‌ আত্ম-দেহ-সমুদ্ভবৈঃ। ভরিষ্যামি সুরাঃ শাকৈঃ আবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।। ৪৪

শাকম্ভরী ইতি বিখ্যাতিম্‌ তদা যাস্যামি অহম্‌ ভুবি। তত্র এব চ বধিষ্যামি দুর্গম্‌ আখ্যম্‌ মহাসুরম্‌।। ৪৫]

তখন স্বর্গের দেবতারা ও মর্তের মানবেরা স্তব করার সময় সর্বদা রক্তদন্তিকা নামে আমার কীর্তন করবে। আবার শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিতে পৃথিবী যখন জলহীন হবে, তখন মুনিদের স্তবে ভূতলে অগর্ভজাতা হয়ে আবির্ভূতা হবো। [কর্মফলের অধীন মানুষ মাতৃগর্ভে জন্ম নেয়, দেবী কর্মফলের অধীনা না হওয়ায় তিনি গর্ভজাতা না হয়েও আবির্ভূতা হতে পারেন।] তখন যেহেতু আমি শত-নেত্র দিয়ে মুনিদের নিরীক্ষণ করব, সেহেতু মানুষ শতাক্ষী নামে আমার কীর্তন করবে। হে দেবগণ, তখন বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত, নিজের দেহ থেকে জাত শাক (শস্য-সব্জি) দিয়ে অখিল জগতকে পালন করব। সেই সময় আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব এবং সেই সময়েই দুর্গম নামের এক মহাসুরকে বধ করব।

দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।

পুনশ্চাহং যদা ভীমং রূপং কৃত্বা হিমাচলে।। ৪৬

রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাং ত্রাণকারণাৎ।

তদা মাং মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্ত্যানম্রমূর্তয়ঃ।। ৪৭

ভীমাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।

যদারুণাখ্যস্ত্রৈলোক্যে মহাবাধাং করিষ্যতি।। ৪৮

তদাহং ভ্রামরং রূপং কৃত্বাঽসংখ্যেয়ষট্‌পদম্‌।

ত্রৈলোক্যস্য হিতার্থায় বধিষ্যামি মহাসুরম্‌।। ৪৯

ভ্রামরীতি চ মাং লোকাস্তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ।

ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি। 

তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্‌।। ৫০ 

[দুর্গাদেবী ইতি বিখ্যাতম্‌ তৎ মে নাম ভবিষ্যতি। পুনঃ চ অহম্‌ যদা ভীমম্‌ রূপম্‌ কৃত্বা হিমাচলে।। ৪৬

রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাম্‌ ত্রাণ-কারণাৎ। তদা মাম্‌ মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্তি আনম্র-মূর্তয়ঃ।। ৪৭

ভীমাদেবী ইতি বিখ্যাতম্‌ তৎ মে নাম ভবিষ্যতি। যৎ অরুণ-আখ্যঃ ত্রৈলোক্যে মহা-বাধাম্‌ করিষ্যতি।। ৪৮

তদা অহম্‌ ভ্রামরম্‌ রূপম্‌ কৃত্বা অসংখ্যেয়-ষট্‌পদম্‌। ত্রৈলোক্যস্য হিত-অর্থায় বধিষ্যামি মহা-অসুরম্‌।। ৪৯

ভ্রামরী ইতি চ মাম্‌ লোকাঃ তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ। ইত্থম্‌ যদা যদা বাধা দানব-উত্থা ভবিষ্যতি। তদা তদা অবতীর্য অহম্‌ করিষ্যামি অরি-সংক্ষয়ম্‌।। ৫০]

 তখন (দুর্গম অসুরকে বধ করার জন্য) আমার নাম দুর্গা নামে বিখ্যাত হবে। আবার হিমাচলে ভীমা রূপ ধারণ করে যখন আমি রাক্ষসদের বিনাশ করে মুনিদের ত্রাণকারিকা হব, তখন সকল মুনি নতমস্তকে আমার স্তব করবেন। সেই সময় আমি ভীমাদেবী নামে বিখ্যাত হব। যখন অরুণ নামক অসুর ত্রিলোকে মহাবিঘ্ন করতে থাকবে, তখন ভ্রমররূপে অসংখ্য ষট্‌-পদ ভ্রমর হয়ে ত্রিলোকের হিতের জন্যে মহাসুরকে বধ করব। তখন সর্বলোক ভ্রামরী নামেই আমার স্তব করবে। এইভাবে যখনই দানবের উত্থানে বিঘ্ন ঘটবে, তখনই আমি অবতীর্ণা হয়ে শত্রু-বিনাশ করব।

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে নারায়ণীস্তুতিঃ 

নাম একাদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে নারায়ণীস্তুতি

নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত

 

 

উত্তরচরিত

দ্বাদশ অধ্যায়

ধ্যান

বিদ্যুদ্দামসমপ্রভাং মৃগপতি-স্কন্ধ-স্থিতাং ভীষণাং

কন্যাভিঃ করবাল-খেট-বিলসদ্ধস্তাভিরাসেবিতাম্‌।

হস্তৈশ্চক্রধরালি-খেট-বিশিখাংশ্চাপং গুণং তর্জনীং

বিভ্রাণামনলাত্মিকাংশশিধরাং দুর্গাং ত্রিনেত্রাং ভজে।।

[বিদ্যুৎ-দাম-সম-প্রভাম্‌ মৃগ-পতি-স্কন্ধ-স্থিতাম্‌ ভীষণাম্‌ কন্যাভিঃ করবাল-খেট-বিলসৎ হস্তাভিঃ আসেবিতাম্‌।

হস্তৈঃ চক্র-ধরালি-খেট-বিশিখান্‌-চাপম্‌-গুণম্‌-তর্জনীম্‌ বিভ্রাণাম্‌ অনল-আত্মিকাম্‌-শশিধরাম্‌ দুর্গাম্‌ ত্রিনেত্রাম্‌ ভজে।।]

যিনি বিদ্যুতমালার মতো প্রভাময়ী, সিংহারোহণা এবং হাতে ভয়ংকর করবাল ও খেট শোভিতা মাতৃকাগণ যাঁর সেবা করেন, বহু হাতে যিনি চক্র, ধরালি, খেট, বিশিখসমূহ, ধনু, গুণ, তর্জনীমুদ্রাধারিণী, জ্যোতির্ময়ী, শশিধরা ও ত্রিনেত্রা, সেই দেবী দুর্গার ভজনা করি।

[করবাল – খড়্গ বা অসি ; খেট – ঢাল; ধরালি – শাণিত; বিশিখ – তির বা বাণ; গুণ – ধনুকের ছিলা বা জ্যা।]

 

 

উত্তর চরিত

দ্বাদশ অধ্যায় – ভগবতী বাক্য 

দেব্যুবাচ।

এভিঃ স্তবৈশ্চ মাং নিত্যং স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ।

তস্যাহং সকলাং বাধাং নাশয়িষ্যাম্যসংশয়ম্‌।। ১

মধুকৈটভনাশঞ্চ মহিষাসুরঘাতনম্‌।

কীর্তয়িষ্যন্তি যে তদ্‌বদ্‌ বধং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ২

অষ্টম্যাঞ্চ চতুর্দশ্যাং নবম্যাঞ্চৈকচেতসঃ।

শ্রোষ্যন্তি চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্‌।। ৩

ন তেষাং দুষ্কৃতং কিঞ্চিৎ দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ।

ভবিষ্যতি ন দারিদ্র্যং ন চৈবেষ্টবিয়োজনম্‌।। ৪

[দেবী উবাচ। এভিঃ স্তবৈঃ চ মাম্‌ নিত্যম্‌ স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ। তস্য অহম্‌ সকলাম্‌ বাধাম্‌ নাশয়িষ্যামি অসংশয়ম্‌।। ১

মধু-কৈটভ-নাশম্‌ চ মহিষাসুর-ঘাতনম্‌। কীর্তয়িষ্যন্তি যে তদ্‌বদ্‌ বধম্‌ শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।। ২

অষ্টম্যাম্‌ চ চতুর্দশ্যাম্‌ নবম্যাম্‌ চ এক-চেতসঃ। শ্রোষ্যন্তি চ এব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যম্‌ উত্তমম্‌।। ৩

ন তেষাম্‌ দুষ্কৃতম্‌ কিম্‌-চিৎ দুষ্কৃত-উত্থা ন চ আপদঃ। ভবিষ্যতি ন দারিদ্র্যম্‌ ন চ এব ইষ্ট-বিয়োজনম্‌।। ৪]

দেবী বললেন, নিবিষ্ট চিত্তে যে এই স্তবে আমার নিত্য স্তুতি করে, নিঃসন্দেহে তার সকল বিঘ্ন আমি নাশ করে থাকি। যারা একাগ্র চিত্তে অষ্টমী, নবমী ও চতুর্দশী তিথিতে, আমার মধু-কৈটভ বিনাশ ও মহিষাসুরবধ এবং একইভাবে শুম্ভ-নিশুম্ভবধের শ্রেষ্ঠকীর্তিগুলির মহিমা বর্ণনা করে অথবা শ্রবণ করে, সেই ভক্তদের কোন পাপ থাকে না, পাপজনিত কোন বিপদ-আপদও ঘটে না। তাদের দারিদ্র্য থাকে না, প্রিয়জন বিয়োগ ঘটে না। 

শত্রুতো ন ভয়ং তস্য দস্যুতো বা ন রাজতঃ।

ন শস্ত্রানলতোয়ৌঘাৎ কদাচিৎ সম্ভবিষ্যতি।। ৫

তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।

শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ।। ৬

উপসর্গানশেষাংস্তু মহামারীসমুদ্ভবান্‌।

তথা ত্রিবিধমুৎপাতং মাহাত্ম্যং শময়েন্মম।। ৭

[শত্রুতঃ ন ভয়ম্‌ তস্য দস্যুতঃ বা ন রাজতঃ। ন শস্ত্র–অনল-তোয়-ওঘাৎ কদাচিৎ সম্ভবিষ্যতি।। ৫

তস্মাৎ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ পঠিতব্যম্‌ সমাহিতৈঃ। শ্রোতব্যম্‌ চ সদা ভক্ত্যা পরম্‌ স্বস্ত্যয়নম্‌ হি তৎ।। ৬

উপসর্গান্‌ অশেষান্‌ তু মহামারী-সমুদ্ভবান্‌। তথা ত্রিবিধম্‌ উৎপাতম্‌ মাহাত্ম্যম্‌ শময়েৎ মম।। ৭]

আমার মহিমা কীর্তনে শত্রু, দস্যু বা রাজার থেকে এবং অস্ত্রের আঘাত, অগ্নি বা জলস্রোত থেকে কখনও ভয়ের সম্ভাবনা থাকে না। সেই কারণে আমার এই মাহাত্ম্য–বর্ণনা সমাহিত চিত্তে ভক্তদের সর্বদা পাঠ করা এবং শোনা কর্তব্য, কারণ এটাই পরম মঙ্গলজনক। আমার এই মহিমা-কীর্তনে মহামারীজনিত অসংখ্য উপসর্গ এবং তিন ধরনের উৎপাতের উপশম হয়। [তিনধরনের উৎপাত হল আধ্যাত্মিক - শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি ও বিকার; আধিভৌতিক – হিংস্র পশু, সাপ, বিছের দংশন; আধিদৈবিক – ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।] 

যত্রৈতৎ পঠ্যতে সম্যঙ্‌ নিত্যমায়তনে মম।

সদা ন তদ্‌বিমোক্ষ্যামি সান্নিধ্যং তত্র মে স্থিতম্‌।। ৮

বলিপ্রদানে পূজায়ামগ্নিকার্যে মহোৎসবে।

সর্বং মমৈতচ্চরিতমুচ্চার্যং শ্রাব্যমেব চ ।। ৯

[যত্র এতৎ পঠ্যতে সম্যক্‌ নিত্যম্‌ আয়তনে মম। সদা ন তৎ বিমোক্ষ্যামি সান্নিধ্যম্‌ তত্র মে স্থিতম্‌।। ৮

বলি-প্রদানে পূজায়াম্‌ অগ্নি-কার্যে মহা-উৎসবে। সর্বম্‌ মম এতৎ চরিতম্‌ উচ্চার্যম্‌ শ্রাব্যম্‌ এব চ ।। ৯]

যে গৃহে আমার এই মাহাত্ম্য–কথা নিত্য সম্যক্‌ভাবে পঠিত হয়, সেই গৃহ আমি কখনো ত্যাগ করি না, বরং সর্বদা সেখানে অধিষ্ঠিতা হই। বলিদানে, পূজায়, যজ্ঞে কিংবা মহোৎসবে, সর্বত্রই আমার এই চরিত-কথা পাঠ এবং শ্রবণ করা উচিৎ। 

জানতাজানতা বাপি বলিপূজাং তথা কৃতাম্‌।

প্রতীচ্ছিষ্যাম্যহং প্রীত্যা বহ্নিহোমং তথা কৃতম্‌।। ১০

শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।

তস্যাং মমৈতন্মাহাত্ম্যং শ্রুত্বা ভক্তিসমন্বিতঃ।। ১১

সর্বাবাধাবিনির্মুক্তো ধনধান্যসুতান্বিতঃ।

মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। ১২

[জানতা-অজানতা বা আপি বলিপূজাম্‌ তথা কৃতাম্‌। প্রতীচ্ছিষ্যামি অহম্‌ প্রীত্যা বহ্নি-হোমম্‌ তথা কৃতম্‌।। ১০

শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী। তস্যাম্‌ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ শ্রুত্বা ভক্তি-সমন্বিতঃ।। ১১

সর্ব-আবাধা-বিনির্মুক্তঃ ধন-ধান্য-সুত-অন্বিতঃ। মনুষ্যঃ মৎ-প্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। ১২]

বিধি-নিয়ম জেনে বা না জেনেও যে বলিপূজা এবং হোমযজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়, তাও আমি প্রীতিপূর্বক গ্রহণ করি, যদি সেখানে আমার মাহাত্ম্য পাঠ করা হয়। প্রতি বৎসর শরৎকালে আমার যে মহাপূজা করা হয়, সেই অনুষ্ঠানে ভক্তি ভরে আমার এই মাহাত্ম্য–কথা শুনলে, আমার প্রসাদে মানুষ সকল বাধা-বিঘ্ন থেকে মুক্ত হয় এবং ধন-ধান্য ও পুত্রাদিতে সম্পন্ন হয়, এতে সন্দেহ নেই[শরতের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত নবরাত্রি পূজাই দেবীর মহাপূজা। বসন্তেও একই ভাবে নবরাত্রি পূজা করা হয়ে থাকে।]  

শ্রুত্বা মমৈতন্মাহাত্ম্যং তথা চোৎপত্তয়ঃ শুভা।

পরাক্রমঞ্চ যুদ্ধেষু জায়তে নির্ভয়ঃ পুমান্‌।। ১৩

রিপবঃ সংক্ষয়ং যান্তি কল্যাণঞ্চোপপদ্যতে।

নন্দতে চ কুলং পুংসাং মাহাত্ম্যং মম শৃণ্বতাম্‌।। ১৪

শান্তিকর্মণি সর্বত্র তথা দুঃস্বপ্নদর্শনে।

গ্রহপীড়াসু চোগ্রাসু মাহাত্ম্যং শৃণুয়াণ্মম।। ১৫

উপসর্গাঃ শমং যান্তি গ্রহপীড়াশ্চ দারুণাঃ।

দুঃস্বপ্নঞ্চ নৃভির্দৃষ্টং সুস্বপ্নমুপজায়তে।। ১৬

[শ্রুত্বা মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ তথা চ উৎপত্তয়ঃ শুভা। পরাক্রমম্‌ চ যুদ্ধেষু জায়তে নির্ভয়ঃ পুমান্‌।। ১৩

রিপবঃ সংক্ষয়ম্‌ যান্তি কল্যাণম্‌ চ উপপদ্যতে। নন্দতে চ কুলম্‌ পুংসাম্‌ মাহাত্ম্যম্‌ মম শৃণ্বতাম্‌।। ১৪

শান্তি-কর্মণি সর্বত্র তথা দুঃস্বপ্ন-দর্শনে। গ্রহপীড়াসু চ উগ্রাসু মাহাত্ম্যম্‌ শৃণুয়াৎ মম।। ১৫

উপসর্গাঃ শমম্‌ যান্তি গ্রহপীড়াঃ চ দারুণাঃ। দুঃস্বপ্নম্‌ চ নৃভিঃ দৃষ্টম্‌ সুস্বপ্নম্‌ উপজায়তে।। ১৬

আমার এই মাহাত্ম্য, আমার শুভ-আবির্ভাব এবং সকল যুদ্ধে আমার পরাক্রমের বর্ণনা শুনে মানুষ নির্ভয় হয়ে ওঠে। আমার মাহাত্ম্য শুনলে শত্রুবিনাশ হয়, মঙ্গললাভ হয়, মানুষের বংশ-পরিবার আনন্দিত হয়। যে কোন শান্তি-কর্মে কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখলে, কিংবা ভয়ংকর গ্রহবৈগুণ্যে আমার মাহাত্ম্যকথাই শুনবে। আমার মাহাত্ম্য-কথা শুনলে যাবতীয় উপসর্গ ও দারুণ গ্রহবৈগুণ্যের উপশম হয়, মানুষের দেখা দুঃস্বপ্নও সুখস্বপ্ন হয়ে ওঠে।   

বালগ্রহাভিভূতানাং বালানাং শান্তিকারকম্‌।

সংঘাতভেদে চ নৃণাং মৈত্রীকরণমুত্তমম্‌।। ১৭

দুর্বৃত্তানামশেষাণাং বলহানিকরং পরম্‌

রক্ষোভূতপিশাচানাং পঠনাদেব নাশনম্‌।। ১৮

সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্‌।

পশুপুষ্পার্ঘ্যধূপৈশ্চ গন্ধদীপৈস্তথোত্তমৈঃ।। ১৯

বিপ্রাণাং ভোজনৈর্হোমৈঃ প্রোক্ষণীয়ৈরহর্নিশম্‌।

অন্যৈশ্চ বিবিধৈর্ভোগৈঃ প্রদানৈর্বৎসরেণ যা।। ২০

প্রীতিমে ক্রিয়তে সাস্মিন্‌ সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে।

শ্রুতং হরতি পাপানি তথারোগ্যং প্রযচ্ছতি।। ২১

[বালগ্রহ অভিভূতানাম্‌ বালানাম্‌ শান্তিকারকম্‌। সংঘাতভেদে চ নৃণাম্‌ মৈত্রীকরণম্‌ উত্তমম্‌।। ১৭

দুর্বৃত্তানাম্‌ অশেষাণাম্‌ বলহানিকরম্‌ পরম্‌। রক্ষঃ ভূত-পিশাচানাম্‌ পঠনাৎ এব নাশনম্‌।। ১৮

সর্বম্‌ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ মম সন্নিধিকারকম্‌। পশু-পুষ্প-অর্ঘ্য-ধূপৈঃ চ গন্ধ-দীপৈঃ তথা উত্তমৈঃ।। ১৯

বিপ্রাণাম্‌ ভোজনৈঃ হোমৈঃ প্রোক্ষণীয়ৈঃ অহঃ-নিশম্‌। অন্যৈঃ চ বিবিধৈঃ ভোগৈঃ প্রদানৈঃ বৎসরেণ যা।। ২০

প্রীতিমে ক্রিয়তে সা অস্মিন্‌ সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে। শ্রুতম্‌ হরতি পাপানি তথারোগ্যম্‌ প্রযচ্ছতি।। ২১]

আমার মাহাত্ম্য–কথা পাঠ বালগ্রহে আক্রান্ত শিশুদের শান্তিকারক এবং মানুষের নানান সংঘাতে শুভ মৈত্রীবন্ধন স্থাপনা করে। [ডাকিনী বা রাক্ষসীরা শিশু বা বালকদের উদ্ব্যস্ত করলে তাকে বালগ্রহ বলে, যেমন শিশুকৃষ্ণকে পূতনা প্রভৃতি রাক্ষসী ছলনা করে বধ করতে গিয়েছিল।] এই পাঠে যে কোন দুর্বৃত্তের শক্তিক্ষয় হয়, রাক্ষস, ভূত, পিশাচদের বিনাশ হয়। আমার এই মাহাত্ম্য সম্পূর্ণ পাঠ করলে, সেই পাঠক আমার সান্নিধ্য লাভ করে। আমার সন্তুষ্টির জন্যে, সম্বৎসর পশুবলি, পুষ্প-অর্ঘ্য, ধূপ, চন্দনাদি গন্ধ বা দীপ জ্বালানো উত্তম পূজায়, কিংবা ব্রাহ্মণ-ভোজন করানো, অথবা দিবারাত্র নানান ভোগ-উপচারের যজ্ঞ-হোমে যত অনুষ্ঠান করা হয়, তার থেকে আমার এই সুচরিত-কথা একবার পাঠেই আমি বেশি সন্তুষ্ট হই। এই পাঠ শুনলেও আমি পাপ হরণ করি এবং আরোগ্য প্রদান করি।

রক্ষাং করোতি ভূতেভ্যো জন্মনাং কীর্তনং মম।

যুদ্ধেষু চরিতং যন্মে দুষ্টদৈত্যনিবর্হণম্‌

তস্মিন্‌ শ্রুতে বৈরিকৃতং ভয়ং পুংসাং ন জায়তে।২২

যুষ্মাভিঃ স্তুতয়ো যাশ্চ যাশ্চ ব্রহ্মর্ষিভিঃ কৃতাঃ।

ব্রহ্মণা চ কৃতাস্তান্তু প্রযচ্ছন্তি শুভাং মতিম্‌।। ২৩

[রক্ষাম্‌ করোতি ভূতেভ্যো জন্মনাম্‌ কীর্তনম্‌ মম। যুদ্ধেষু চরিতম্‌ যৎ মে দুষ্ট-দৈত্য-নিবর্হণম্‌।। তস্মিন্‌ শ্রুতে বৈরিকৃতম্‌ ভয়ম্‌ পুংসাম্‌ ন জায়তে।২২

যুষ্মাভিঃ স্তুতয়ঃ যাঃ চ যাঃ চ ব্রহ্ম-ঋষিভিঃ কৃতাঃ। ব্রহ্মণা চ কৃতাঃ তান্‌ তু প্রযচ্ছন্তি শুভাম্‌ মতিম্‌।। ২৩]

আমার নানান অবতার-জন্মের এবং যুদ্ধে দুরাত্মা দৈত্যবধের কথা কীর্তনে আমি ভূত-প্রেত থেকে সকলকে রক্ষা করি। সে কথা শুনলে মানুষের শত্রুভয় থাকে না। তোমরা, ব্রহ্মর্ষিরা এবং স্বয়ং ব্রহ্মা আমার যে যে স্তব করেছেন, তার থেকে শুভবুদ্ধির উদয় হয়।    

   অরণ্যে প্রান্তরে বাপি দাবাগ্নিপরিবারিতঃ।

দস্যুভির্বা বৃতঃ শূণ্যে গৃহীতো বাপি শত্রুভিঃ।। ২৪

সিংহব্যাঘ্রানুযাতো বা বনে বা বনহস্তিভিঃ।

রাজ্ঞা ক্রুদ্ধেন বাজ্ঞপ্তো বধ্যো বন্ধগতোঽপি বা। ২৫

আঘূর্ণিতো বা বাতেন স্থিতঃ পোতে মহার্ণবে।

পতৎসু বাপি শস্ত্রেষু সংগ্রামে ভৃশদারুণে।। ২৬

সর্বাবাধাসু ঘোরাসু বেদনাভ্যর্দিতোঽপি বা।

স্মরন্‌ মমৈতচ্চরিতং নরো মুচ্যেত সঙ্কটাৎ।। ২৭

মম প্রভাবাৎ সিংহাদ্যা দস্যবো বৈরিণস্তথা।

দূরাদেব পলায়ন্তে স্মরতশ্চরিতং মম।। ২৮

[অরণ্যে প্রান্তরে বা অপি দাব-অগ্নি-পরিবারিতঃ। দস্যুভিঃ বা বৃতঃ শূণ্যে গৃহীতঃ বা অপি শত্রুভিঃ।। ২৪

সিংহ-ব্যাঘ্র-অনুযাতঃ বা বনে বা বন-হস্তিভিঃ। রাজ্ঞা ক্রুদ্ধেন বা আজ্ঞপ্তঃ বধ্যঃ বন্ধ-গতঃ অপি বা। ২৫

আঘূর্ণিতঃ বা বাতেন স্থিতঃ পোতে মহার্ণবে। পতৎসু বা অপি শস্ত্রেষু সংগ্রামে ভৃশ-দারুণে।। ২৬

সর্ব-আবাধাসু ঘোরাসু বেদনা-অভ্যর্দিতঃ অপি বা। স্মরন্‌ মম এতৎ চরিতং নরঃ মুচ্যেত সঙ্কটাৎ।। ২৭

মম প্রভাবাৎ সিংহ-আদ্যা দস্যবঃ বৈরিণঃ তথা দূরাৎ এব পলায়ন্তে স্মরতঃ চরিতম্‌ মম।। ২৮]

অরণ্যে, প্রান্তরে অথবা দাবানলের মধ্যে, নির্জনে দস্যু বা শত্রুদের কবলে পড়লে, সিংহ, বাঘ বা বন্যহাতি ধাওয়া করলে, রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে বধ করার বা বন্দী করার আদেশ দিলে, ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে মহাসমুদ্রের মধ্যে জাহাজে, ভয়ংকর যুদ্ধে অস্ত্র আঘাতে উদ্যত হলে, এমনই সকল বিঘ্ন-বিপদে এবং ঘোর যন্ত্রণার পীড়ায়, আমার এই চরিতকথা স্মরণ করলে, মানুষ সকল সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়। আমার চরিত-কথা স্মরণ করলে, আমার প্রভাবে সিংহাদি পশু, দস্যুগণ এবং শত্রুরাও দূরে পালিয়ে যায়।

ঋষিরুবাচ।

ইত্যুক্ত্বা সা ভগবতী চণ্ডিকা চণ্ডবিক্রমা।

পশ্যতামেব দেবানাং তত্রৈবান্তরধীয়ত।। ২৯

তেঽপি দেবা নিরাতঙ্কাঃ স্বাধিকারান্‌ যথা পুরা।

যজ্ঞভাগভুজঃ সর্বে চক্রুর্বিনিহতারয়ঃ।। ৩০

দৈত্যাশ্চ দেব্যা নিহতে শুম্ভে দেবরিপৌ যুধি।

জগদ্‌বিধ্বংসিনি তস্মিন্মহোগ্রেঽতুলবিক্রমে।। ৩১

নিশুম্ভে চ মহাবীর্যে শেষাঃ পাতালমাযযুঃ।। ৩২

 

[ঋষিঃ উবাচ। ইতি উক্ত্বা সা ভগবতী চণ্ডিকা চণ্ড-বিক্রমা। পশ্যতাম্‌ এব দেবানাম্‌ তত্র এব অন্তঃ-অধীয়তঃ।। ২৯

তে অপি দেবা নিরাতঙ্কাঃ স্ব-অধিকারান্‌ যথা পুরা। যজ্ঞ-ভাগ-ভুজঃ সর্বে চক্রুঃ বিনিহত অরয়ঃ।। ৩০

দৈত্যাঃ চ দেব্যা নিহতে শুম্ভে দেব-রিপৌ যুধি। জগৎ-বিধ্বংসিনি তস্মিন্‌ মহা-উগ্রে-অতুল-বিক্রমে।। ৩১

নিশুম্ভে চ মহাবীর্যে শেষাঃ পাতালম্‌ আযযুঃ।৩২]       

ঋষি বললেন, এই কথা বলে ভগবতী প্রবল-পরাক্রমশালিনী চণ্ডিকা, সেখানে দেবতাদের চোখের সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সকল শত্রু নিহত হওয়ায়, দেবতারাও আগের মতো নির্ভয়ে নিজ অধিকারে যজ্ঞভাগ ভোগে প্রতিষ্ঠিত হলেন। মহা-উদ্ধত, অতুলনীয়-পরাক্রমী, জগৎ-বিধ্বংসী, দেব-শত্রু শুম্ভ এবং মহাবীর নিশুম্ভ দেবীর হাতে যুদ্ধে নিহত হওয়ায়, অবশিষ্ট দৈত্যরা পাতালে প্রবেশ করল।

এবং ভগবতী দেবী সা নিত্যাপি পুনঃ পুনঃ।

সম্ভূয় কুরুতে ভূপ জগতঃ পরিপালনম্‌।। ৩৩

তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং সৈব বিশ্বং প্রসূয়তে।

সাঽযাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি।। ৩৪

[এবম্‌ ভগবতী দেবী সা নিত্য অপি পুনঃ পুনঃ। সম্ভূয় কুরুতে ভূপ জগতঃ পরিপালনম্‌।। ৩৩

তয়া এতৎ মোহ্যতে বিশ্বম্‌ সা এব বিশ্বম্‌ প্রসূয়তে। সা অযাচিতা চ বিজ্ঞানম্‌ তুষ্টা ঋদ্ধিম্‌ প্রযচ্ছতি।। ৩৪]

হে রাজা (সুরথ), এভাবেই সেই সনাতনী দেবী বার বার আবির্ভূতা হয়ে, জগৎ পরিপালন করেন। তাঁর প্রভাবে জগৎ মোহগ্রস্ত হয় আবার তিনিই এই বিশ্বকে প্রসব করেন। তাঁর নিষ্কাম আরাধনায় ব্রহ্মজ্ঞান এবং সকাম আরাধনায় সমৃদ্ধি লাভ হয়।

ব্যাপ্তং তয়ৈতৎ সকলং ব্রহ্মাণ্ডং মনুজেশ্বর।

মহাকাল্যা মহাকালে মহামারীস্বরূপে।। ৩৫

সৈব কালে মহামারী সৈব সৃষ্টির্ভবত্যজা।

স্থিতিং করোতি ভূতানাং সৈবকালে সনাতনী।। ৩৬

ভবকালে নৃণাং সৈব লক্ষ্মীর্বৃদ্ধিপ্রদা গৃহে।

সৈবাভাবে তথালক্ষ্মীর্বিনাশায়োপজায়তে।। ৩৭

স্তুতা সংপূজিতা পুষ্পৈর্ধূপগন্ধাদিভিস্তথা।

দদতি বিত্তং পুত্রাংশ্চ মতিং ধর্মে গতিং শুভাম্‌।। ৩৮

[ব্যাপ্তম্‌ তয়া এতৎ সকলম্‌ ব্রহ্মাণ্ডম্‌ মনুজ-ঈশ্বর। মহাকাল্যা মহাকালে মহামারী-স্বরূপে।। ৩৫

সা এব কালে মহামারী সা এব সৃষ্টিঃ ভবতি অজা। স্থিতিম্‌ করোতি ভূতানাম্‌ সা এব কালে সনাতনী।। ৩৬

ভবকালে নৃণাম্‌ সা এব লক্ষ্মীঃ-বৃদ্ধি-প্রদা গৃহে। সা এব অভাবে তথা অলক্ষ্মীঃ বিনাশায় উপজায়তে।। ৩৭

স্তুতা সংপূজিতা পুষ্পৈঃ ধূপ-গন্ধাদিভিঃ তথা। দদতি বিত্তম্‌ পুত্রাম্‌ চ মতিম্‌ ধর্মে গতিম্‌ শুভাম্‌।। ৩৮]

হে মানবেশ্বর, এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে তিনিই মহাকালী মহাকালে মহামারীস্বরূপে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। তিনিই মহাপ্রলয়ে মহাসংহারকারিণী, নিজে জন্মরহিত হয়েও তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই সনাতনী কাল এবং তিনিই সকল জীবের পালনকর্ত্রী। বৈভবকালে তিনিই মানুষের গৃহে লক্ষ্মীরূপা সমৃদ্ধিদাত্রী, আবার অভাবকালে তিনিই অলক্ষ্মী হয়ে বিনাশ করেন। পুষ্প-ধূপ-চন্দনাদি গন্ধে তিনি সম্যক-পূজিতা হলে, তিনিই সম্পদ, পুত্রাদি, ধর্ম-বুদ্ধি এবং মঙ্গলগতি প্রদান করেন।

 

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে

ফলস্তুতির্নাম দ্বাদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

ফলস্তুতি-নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত

    

 

উত্তরচরিত

ত্রয়োদশ অধ্যায়

ধ্যান

বালার্কমণ্ডলাভাসং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্‌।

পাশাঙ্কুশবরাভীতীর্ধার‍য়ন্তীং শিবাং ভজে।।

[বাল-অর্ক-মণ্ডল-আভাসম্‌ চতুঃ-বাহুম্‌ ত্রিলোচনাম্‌। পাশ-অঙ্কুশ-বর-অভীতীঃ-ধার‍য়ন্তীম্‌ শিবাম্‌ ভজে।।]

সদ্য উদিত সূর্যমণ্ডলের মতো আভাময়ী, চতুর্ভুজা, ত্রিলোচনা। পাশ-অঙ্কুশধারিণী এবং বরদা ও অভয়মুদ্রা ধারিণী মঙ্গলময়ী দেবী শিবার ভজনা করি।

 

উত্তর চরিত্র

দ্বাদশ অধ্যায় – দেবীর বরপ্রদান

ঋষিরুবাচ।

এতৎ তে কথিতং ভূপ দেবীমাহাত্ম্যমুত্তমম্‌।

এবং প্রভাবা সা দেবী যয়েদং ধার্যতে জগৎ।। ১

বিদ্যা তথৈব ক্রিয়তে ভগবদ্‌বিষ্ণুমায়য়া।

তয়া ত্বমেষ বৈশ্যশ্চ তথৈবান্যে বিবেকিনঃ।। ২

মোহ্যন্তে মোহিতাশ্চৈব মোহমেষ্যন্তি চাপরে।

তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্‌।। ৩

আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা।। ৪

[ঋষিঃ উবাচ। এতৎ তে কথিতম্‌ ভূপ দেবী-মাহাত্ম্যম্‌ উত্তমম্‌। এবম্‌ প্রভাবা সা দেবী যয়া ইদম্‌ ধার্যতে জগৎ।। ১

বিদ্যা তথা এব ক্রিয়তে ভগবৎ-বিষ্ণু-মায়য়া। তয়া ত্বম্‌ এষ বৈশ্যঃ চ তথা এব অন্যে বিবেকিনঃ।। ২

মোহ্যন্তে মোহিতাঃ চ এব মোহম্‌ এষ্যন্তি চ অপরে। তাম্‌ উপৈহি মহারাজ শরণম্‌ পরমেশ্বরীম্‌।। ৩

আরাধিতা সা এব নৃণাম্‌  ভোগ-স্বর্গ-অপবর্গ-দা।। ৪ ]

ঋষি বললেন, হে রাজন্‌, এই আপনাকে দেবীর মঙ্গল-মাহাত্ম্য-কথা বর্ণনা করলাম। সেই দেবীর এমনই প্রভাব, তিনিই এই জগতকে ধারণ করে আছেন। ভগবান বিষ্ণুর মায়াশক্তির ক্রিয়ায় এই তত্ত্বজ্ঞান হয় যে, তিনিই আপনাকে, এই বৈশ্যকে এবং অন্যান্য বিবেকী মানুষদেরও মোহগ্রস্ত করেছেন। তিনি এইভাবেই আপনাদের মতো সকলকে, এমনকি অপর-মানুষদেরও মোহগ্রস্ত করে থাকেন এবং করবেন। হে মহারাজ, আপনি সেই পরমেশ্বরীর শরণাগত হোন, ভক্তিতে পূজিতা হলে, তিনিই মানুষকে ভোগ-স্বর্গ এবং মুক্তি দান করেন।

মাকর্ণ্ডেয় উবাচ।

ইতি তস্য বচঃ শ্রুত্বা সুরথঃ স নরাধিপঃ।

প্রণিপত্য মহাভাগং তমৃষিং সংশিতব্রতম্‌।। ৫

নির্বিণ্ণোঽতিমমত্বেন রাজ্যাপহরণেন চ।

জগাম সদ্যস্তপসে স চ বৈশ্য মহামুনে।। ৬

সন্দর্শনার্থম্বায়া নদীপুলিনসংস্থিতঃ।

স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্‌।। ৭

 [মাকর্ণ্ডেয় উবাচ। ইতি তস্য বচঃ শ্রুত্বা সুরথঃ স নর-অধিপঃ। প্রণিপত্য মহাভাগম্‌ তম্‌ ঋষিম্‌ সংশিত-ব্রতম্‌।। ৫

নির্বিণ্ণঃ অতি-মমত্বেন রাজ্য-অপহরণেন চ। জগাম সদ্যঃ তপসে স চ বৈশ্য মহামুনে।। ৬

সন্দর্শন-অর্থ-অম্বায়া নদী-পুলিন-সংস্থিতঃ। সঃ চ বৈশ্যঃ তপঃ তেপে দেবী-সূক্তম্‌ পরম্‌ জপন্‌।। ৭]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তাঁর এই কথা শুনে নৃপ সুরথ, মহাজ্ঞানী সেই ঋষিকে প্রণাম করে, কঠোর তপস্যার ব্রত গ্রহণ করলেন। অত্যধিক মমত্ব এবং রাজ্য-অপহরণের জন্যে বিষণ্ণ সেই রাজা ও বৈশ্য মহামুনির থেকে বিদায় নিয়ে তখনই তপস্যা করতে চলে গেলেন। দেবী অম্বিকার দর্শন লাভের জন্য সেই রাজা ও বৈশ্য নদীতীরে অবস্থান করে পরম-দেবীসূক্ত জপ করতে করতে তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন।               

তৌ তস্মিন্‌ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্যা মূর্তিং মহীময়ীম্‌।। ৮

অর্হণাঞ্চক্রতুস্তস্যাঃ পুষ্পধূপাগ্নিতর্পণৈঃ।

নিরাহারৌ যতাহারৌ তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ।। ৯

দদতুস্তৌ বলিঞ্চৈব নিজগাত্রাসৃগুক্ষিতম্‌।

এবং সমারাধয়তোস্ত্রিভির্বর্ষৈর্যতাত্মনোঃ।। ১০

পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী প্রত্যক্ষং প্রাহ চণ্ডিকা।। ১১

[তৌ তস্মিন্‌ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্যা মূর্তিম্‌ মহীময়ীম্‌।। ৮

অর্হণাম্‌ চক্রতুঃ তস্যাঃ পুষ্প-ধূপ-অগ্নিঃ তর্পণৈঃ। নিঃ-আহারৌ যত-আহারৌ তৎ-মনস্কৌ সমাহিতৌ।। ৯

দদতুঃ তৌ বলিম্‌ চ এব নিজ-গাত্র-অসৃক্‌-উক্ষিতম্‌। এবম্‌ সম-আরাধয়তোঃ ত্রিভিঃ বর্ষৈঃ যত-আত্মনোঃ।। ১০

পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী প্রত্যক্ষম্‌ প্রাহ চণ্ডিকা।। ১১]

তাঁরা সেই নদীতীরে দেবীর এক মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পুষ্প, ধূপ ও অগ্নিতে তাঁর পূজা এবং কখনও অনাহারে, কখনও সংযত-আহারে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ ধ্যানে তর্পণ করতে লাগলেন। তাঁরা নিজ অঙ্গের রক্তে ভিজিয়ে নানান বলিও নিবেদন করলেন। এইভাবে তিন বছর আত্ম সংযমে তাঁদের সম্যক আরাধনায় দেবী জগদ্ধাত্রী চণ্ডিকা পরিতুষ্টা হয়ে দেখা দিলেন এবং বললেন,

দেব্যুবাচ।

যৎ প্রার্থ্যতে ত্বয়া ভূপ ত্বয়া চ কুলনন্দন।

মত্তস্তৎ প্রাপ্যতাং সর্বং পরিতুষ্টা দদামি তৎ।। ১২

[দেবী ঊবাচ। যৎ প্রার্থ্যতে ত্বয়া ভূপ ত্বয়া চ কুলনন্দন। মত্তঃ তৎ প্রাপ্যতাম্‌ সর্বম্‌ পরিতুষ্টা দদামি তৎ।। ১২

দেবী বললেন, হে রাজা এবং হে বৈশ্যকুলনন্দন, তোমরা আমার থেকে যা যা প্রার্থনা করেছ, আমি সন্তুষ্ট হয়ে সবই প্রদান করব।

মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ততো বব্রে নৃপো রাজ্যমবিভ্রংশ্যন্যজন্মানি।

অত্র চৈব নিজং রাজ্যং হতশত্রুবলং বলাৎ।। ১৩

সোঽপি বৈশ্যস্ততো জ্ঞানং বব্রে নির্বিণ্ণমানসঃ।

মমেত্যহমিতি প্রাজ্ঞঃ সঙ্গবিচ্যুতিকারকম্‌।। ১৪

[মার্কণ্ডেয় উবাচ। ততঃ বব্রে নৃপঃ রাজ্যম্‌ অবিভ্রংশি অন্যজন্মানি। অত্র চ এব নিজম্‌ রাজ্যম্‌ হত-শত্রু-বলম্‌ বলাৎ।। ১৩

সঃ অপি বৈশ্যঃ ততঃ জ্ঞানম্‌ বব্রে নির্বিণ্ণ-মানসঃ। মম ইতি অহম্‌ ইতি প্রাজ্ঞঃ সঙ্গ-বিচ্যুতি-কারকম্‌।। ১৪]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তখন রাজা অন্য জন্মে চিরস্থায়ী রাজ্যের এবং এই জন্মে শত্রুবিনাশ করে নিজ রাজ্য অধিকারের বর প্রার্থনা করলেন। সেই বিষণ্ণ বৈশ্যও তখন ঈশ্বর-সঙ্গ বিচ্যুতির কারণ “আমার” ও “আমি” থেকে মুক্তির প্রজ্ঞা ও পরম জ্ঞানের বর প্রার্থনা করলেন।

দেব্যুবাচ।

স্বল্পৈরহোভির্নৃপতে স্বরাজ্যং প্রাপ্স্যতে ভবান্‌। ১৫

হত্বা রিপূনস্খলিতং তব তত্র ভবিষ্যতি।। ১৬

মৃতশ্চ ভূয়ঃ সংপ্রাপ্য জন্ম দেবাদ্‌ বিবস্বতঃ।

সাবর্ণিকো নাম মনুর্ভবান্‌ ভুবি ভবিষ্যতি।। ১৭

বৈশ্যবর্য ত্বয়া যশ্চ বরোঽস্মত্তোঽভিবাঞ্ছিতঃ।

তং প্রযচ্ছামি সংসিদ্ধ্যৈ তব জ্ঞানং ভবিষ্যতি।। ১৮

[দেবী উবাচ। স্বল্পৈঃ অহোভিঃ নৃপতে স্বরাজ্যম্‌ প্রাপ্স্যতে ভবান্‌। হত্বা রিপূন্‌ অস্খলিতম্‌ তব তত্র ভবিষ্যতি।। ১৫

মৃতঃ চ ভূয়ঃ সংপ্রাপ্য জন্ম দেবাৎ বিবস্বতঃ। সাবর্ণিকঃ নাম মনুঃ ভবান্‌ ভুবি ভবিষ্যতি।। ১৬

বৈশ্য-বর্য ত্বয়া যঃ চ বরঃ অস্মত্তঃ অভিবাঞ্ছিতঃ। তম্‌ প্রযচ্ছামি সংসিদ্ধ্যৈ তব জ্ঞানম্‌ ভবিষ্যতি।। ১৭]

দেবী বললেন, হে রাজা, কিছুদিনের মধ্যেই শত্রুদের হত্যা করে তুমি নিজের রাজ্য স্থায়ীভাবে ফিরে পাবেমৃত্যুর পর তুমি আবার সূর্যদেবের থেকে জন্ম লাভ করে পৃথিবীতে সাবর্ণিক নামে মনু হবে। হে বৈশ্যশ্রেষ্ঠ, তুমি আমার থেকে যে বর প্রার্থনা করেছিলে, তোমাকে আমি তাই দান করলাম, মুক্তি-সিদ্ধির জন্য তোমার পরমজ্ঞান লাভ হবে।

মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ইতি দত্ত্বা তয়োর্দেবী যথাভিলষিতং বরম্‌।

বভূবান্তর্হিতা সদ্যো ভক্ত্যা তাভ্যামভিষ্টুতা।। ১৮

এবং দেব্যা বরং লব্ধ্বা সুরথঃ ক্ষত্রিয়র্ষভঃ।

সূর্যাজ্জন্ম সমাসাদ্য সাবর্ণির্ভবিতা মনুঃ।। ১৯

সাবর্ণির্ভবিতা মনুঃ ক্লীং ওঁ।। ২০

[মার্কণ্ডেয় উবাচ। ইতি দত্ত্বা তয়োঃ দেবী যথা অভিলষিতম্‌ বরম্‌। বভূব অন্তর্হিতা সদ্যঃ ভক্ত্যা তাভ্যাম্‌ অভিষ্টুতা।। ১৮

এবম্‌ দেব্যা বরম্‌ লব্ধ্বা সুরথঃ ক্ষত্রিয়-ঋষভঃ। সূর্যাৎ জন্ম সমাসাদ্য সাবর্ণিঃ ভবিতা মনুঃ।। ১৯

সাবর্ণিঃ ভবিতা মনুঃ ক্লীং ওঁ।। ২০]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তাঁদের অভিলষিত বর দান করে, ভক্তি নিরত তাঁদের সামনে দেবী তখনই অন্তর্হিতা হলেন। এইভাবেই দেবীর বর লাভ করে ক্ষত্রিয়-শ্রেষ্ঠ রাজা সুরথ, সূর্য থেকে পুনর্জন্ম লাভ করে সাবর্ণি মনু হবেন। সাবর্ণি মনু হবেন, ক্লীং ওঁ। 

    ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে

সুরথবৈশ্যয়োর্বর প্রদানং নাম ত্রয়োদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীসপ্তশতী-দেবীমাহাত্ম্যং সমাপ্তম্‌।

 

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

সুরথ-বৈশ্যকে বর প্রদান নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত

সাতশত শ্লোকে দেবীমাহাত্ম্য-কথা সমাপ্ত। 



গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

চোদ্দ শাক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉   বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার...