শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৮

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


[আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে "সুরক্ষিতা - পর্ব ১৭"]


১৮

অন্যদিনের থেকে বেশ একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলেন শুভময়ীদেবী সাদা রঙের চেনা ছোট গাড়িটা ঢুকে এল কম্পাউন্ডে। শুভময়ীদেবী নামলেন গাড়ি থেকে, ওপরের বারান্দায় ছবির সঙ্গে চোখাচোখি হতে হাসলেন। উনি উঠে আসছেন ওপরে, ছবি দরজা খুলতে গেল। শুভময়ীদেবী ঘরে এসে সোফায় বসলেন বেশ আরাম করে। খুশির হাসি তাঁর মুখে। সোফায় বসে বললেন, “আজ বিট্টু বেশ ভাল আছে, জানিস ছবিসক্কলের সঙ্গে কি সুন্দর গল্প করছিল, তুই না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবি না। পরের রোববার তোকে নিয়ে যাব।”

ছবি ফ্রিজ থেকে কাঁচের গ্লাসে রাখা লেবু-মিছরির সরবৎ বের করে এনে, শুভময়ীদেবীর হাতে দিয়ে বলল, “তাই? অনেক বন্ধু পেয়ে গেছে না, এখানে বেচারা সারাটাদিন আমাদের সঙ্গে, খুব মনমরা থাকত সবসময়, বলো মামী”।

“একদম ঠিক। তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল জানিস তো? বাবা, তুই তো বেশ গিন্নি হয়ে উঠেছিস, রে – অ্যাঁ, ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সরবৎ, বাঃ”উজ্জ্বল হাসি শুভময়ীদেবীর মুখে, কতদিন তিনি এমন যত্নআত্তি পাননি কারোর কাছ থেকে। পাওয়ার কথা কোনদিন ভাবনাতেও ছিল না, নানান পরিস্থিতির চাপে। খুব তারিয়ে তারিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে তিনি সরবৎ খেলেন।

ছবি জিজ্ঞাসা করল, “আরেকটু দিই”?

“আছে? তাহলে দে, বেশ লাগল কিন্তু”। আরো এক গ্লাস ভরে দিল ছবি। শুভময়ীদেবী সরবৎ খালি করে গ্লাস ফেরত দিলেন ছবির হাতেগ্লাস নিয়ে ছবি রান্নাঘরে গেল, তাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন শুভময়ীদেবী।

ছবির পিছনে যেতে যেতে বললেন, “কি রান্না করেছিস রে”?

“যা, যা বলে গেছিলে সব”। রান্নাঘরে ঢুকে শুভময়ীদেবী ঢাকনা তুলে দেখতে লাগলেন সব বাটিগুলি। খুব খুশি হলেন সব কিছু দেখে। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকটি রান্না সযত্নে ঢাকা দেওয়া। তিনি হাসি মুখে ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “দারুণ রেঁধেছিস মনে হচ্ছে? কেমন হয়েছে রে”?

“কেমন হয়েছে, তা তো জানিনা, তুমিই তো খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে”।

“এ বাবা, তুই চেখে দেখিস নি? একটু একটু চেখে দেখবি তো, নুন মিষ্টি ঠিক হল কিনা”?

“না, না। তুমি খাওয়ার আগে আমি খাবো? সে আমি কক্‌খনো পারব না”।

“পাগলি কোথাকার। তোর মা আর দিদুকে বলেছিলি তো? কখন আসবে?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছবি বলল, “এসে যাবে এখনই। ততক্ষণ তুমি চানটা করে নাও না”।

“সেই ভাল – চট করে চানটা সেরে আসি।    

 

সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর, শুভময়ীদেবী মালতীদের নিজের ঘরে ডাকলেন, বললেন, “মালতী তোমাদের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে কিছু কথা আছে”। ওদের সঙ্গে ছবিও এসেছিল, শুভময়ীদেবী ছবিকে বললেন, “আমাদের বড়োদের কথার মধ্যে তোর তো থাকা চলবে না, ছবি। সকাল থেকে তোর অনেক খাটনি গেছে, তুই বরং, যা, একটু বিশ্রাম করে নে…”।

ছবির মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না এঘর থেকে যাওয়ার, তবু মামীর আদেশ তাকে মানতেই হবে। বেরিয়ে গিয়ে শুভময়ীদেবীর ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিট্টুর ঘরে গেল। এ বাড়িতে কাজে ঢুকে থেকে, বিট্টুর বিছানার পাশের মেঝেতেই সে বিছানা পাতে। রাত্রে সেখানেই সে শোয় – মাঝে মাঝে দুপুরেও। বিট্টু “একান্ত সহায়”-এ চলে যাওয়ার পর – এ ঘর এখন শূণ্য, শূণ্য বিট্টুর বিছানাও। বিছানার পাশে একটা টুল নিয়ে খোলা জানালার সামনে বসল ছবি। এদিকের জানালা দিয়ে কমপ্লেক্সের ছোট্ট পার্কটা চোখে পড়ে। ওখানে স্লিপ আছে, আছে দোলনা, দুটো সি-স। আছে বেশ কিছু সিমেন্টের বেঞ্চি। আর পার্কের চারপাশ ঘিরে চওড়া বাঁধানো পায়ে চলার পথ আছে। সকাল সকাল বড়োরা ওই পথে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে…। বিকেলে বাচ্চারা আসে খেলতে। সন্ধের দিকে মহিলারা আসে বেঞ্চে বসে গল্প করতে। এই মধ্য দুপুরে পার্কটা নির্জন, কেউ নেই।

শূণ্য এই ঘরে বসে, শূণ্য ওই পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ছবির দুশ্চিন্তাটা আরও বাড়ল। তাকে আড়াল করে, তার মা আর দিদুকে কী বলতে ডাকল মামী? সে কথা এত গোপনই বা কেন? তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথাই যদি হয় – তার জন্যে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন? কেনই বা এত আদর করে তার মা আর দিদুকে খাওয়ানোর আয়োজন? কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ছবি। মামী কী ভাবছে – এই বাড়ীর কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে – একথা শুনলে সে ডুকরে কেঁদে উঠবে? ছবির প্রতি তার মামীর এতটাই সহানুভূতি? নাকি…

কথাটা হঠাৎ মনে আসতে ছবির শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল হিমেল স্রোত। তার মাথা ঘুরে গেল। জানালার বাইরে পার্কের সবুজ ঘাস, বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম সবই কেমন ঝাপসা হয়ে এল তার চোখের সামনে। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল চুপ করে…। মামী কি কোন ভাবে জেনে গেছে মিঠুদিদির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা? যে সম্পর্ক সে নিজেই চুকিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে? তার মা এবং দিদু এসব কথা শুনলে যে পাথর হয়ে যাবে। মামী কী করে জানল? আর যদি জেনেই থাকে তাকেই তো সরাসরি বলতে পারত। তা না করে মা আর দিদুকে ডেকে আনল এসব কথা বলার জন্যেই…! ভয়ে আর লজ্জায় তার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

মালতী খুব ধীরে ধীরে ছবির ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে এল। ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথায় কি – জানালার ধারে চুপটি করে বসে আছে – দুহাতে মুখ ঢেকে…। খুব অবাক হল মালতী – ছবি এভাবে বসে আছে কেন? শরীর খারাপ নয় তো? নিঃশব্দে ছবির পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখল মালতী, মমতামাখা গলায় বলল, “কী হয়েছে রে, মা? মাথা ধরেছে? শরীর খারাপ লাগছে?”

মাথায় হাতের স্পর্শে ছবি চমকে উঠেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মা। ছবি মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মালতী অবাক হল খুব – ছবিকে এতটা অসহায় ভাবে কাঁদতে বহুদিন দেখেনি। সেই ওর বাবা মারা যাওয়ার সময় ছাড়া। ছবির মাথাটা বুকে চেপে ধরে, মালতী কান্নাধরা গলায় বলল, “কী হয়েছে মা? কীসের কষ্ট তোর? হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেন - একা একা বসে?”

দুজনে দুজনকে ধরে চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ছবির কান্নার বেগ কিছুটা কমতে, মালতী ছবির মুখটা ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “পাগল মেয়ে, কী হয়েছে বলবি তো? কাঁদছিস কেন? ওঘরে তোর মামী তোকে ডাকছে – চল – খুব ভালো খবর আছে…”।

নিজেকে সামলে নিয়ে ছবি কান্নাধরা গলায় বলল, “তোমাদের গোপন কথাবার্তা সব হয়ে গেল?”

মালতী এবার হেসে ফেলল, বলল, “অ…ও ঘর ছেড়ে তোকে চলে আসতে বলার জন্যে তোর অভিমান হয়েছে? তার জন্যে এত মনখারাপ – কান্না, পাগলি কোথাকার? চ ওঠ, মামী ডাকছে, অনেক কথা আছে…”।  

...আগামী সঙ্খ্যায় সমাপ্য...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

চোদ্দ শাক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉   বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার...