বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ২/২

 

 [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


দ্বিতীয় পর্ব - ২য় পর্বাংশ

(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)

 [এর আগের পর্বাংশ পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 -  ধর্মাধর্ম - ২/১ ]


২.২.২ নিবিড় বাণিজ্য

সমাজের অভিজাত শ্রেণীরই একাংশ আবার অনেকে বণিকও হয়ে উঠল, অথবা অন্যভাবে বললে বণিক সমাজের অনেকে অভিজাত হয়ে উঠল। তারা গ্রাম ছেড়ে সুবিধেজনক জায়গায় বসতি-স্থাপন করতে লাগল। এই বসতি-স্থাপন যে কোন জঙ্গল সাফ করে গ্রাম বা কৃষিক্ষেত্র বানিয়ে তোলার মতো সহজ সরল নয়। এর অবস্থান নির্দিষ্ট হত কৌশলগত দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার থেকে।

বাণিজ্যের নিবিড় আন্তর্জাল (network) গড়ে তুলতে প্রধান যে কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হয়, সেগুলি হলঃ

ক) যোগাযোগঃ দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল সড়কপথ।  নদীমাতৃক এই উপমহাদেশে নদী এবং শাখানদীগুলিও ছিল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। সত্যি বলতে নদীবহুল অঞ্চলে যাওয়া-আসার পক্ষে নদীপথই ছিল সীমিত ব্যয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ উপায়। তার ওপর আমাদের দেশের বিস্তৃত সমুদ্রতট ধরে অন্তর্দেশীয় এবং এমনকি বহির্বিশ্বের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে উঠছিল। অতএব এই তিনটি উপায়ের সম্যক সমন্বয়েই বাণিজ্যের নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্তর্জাল গড়ে ওঠা সম্ভব।

 খ) পরিবহণঃ স্থলপথে পরিবহন বলদের গাড়ি, গাধা এবং উটের পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল, অতএব সব ধরনের পথই সারা বছর ধরে পরিবহণযোগ্য রাখাটা জরুরি। নদীপথে নদীর নাব্যতা অনুযায়ী ভেলা বা নৌকা এবং সমুদ্রপথে যাওয়ার মতো বড়ো নৌকা এবং নৌবহর।

 গ) নিরাপত্তাঃ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাঁচামাল আমদানি এবং তৈরি সামগ্রী রপ্তানির সময়, যাতে লুঠপাট না হয়, তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখাও অত্যন্ত জরুরি। পথশ্রমে পরিশ্রান্ত বণিকদের এবং পশুদের বিশ্রামের জন্যে পথের ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে নিরাপদ আশ্রয় এবং খাদ্যের যোগাড় রাখাও ছিল অত্যাবশ্যক। অতএব প্রধান সড়কপথের ধারে ধারে গড়ে উঠতে লাগল – চটি, পান্থশালা।  

 ঘ) বাণিজ্য কেন্দ্রঃ যে কোন বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তুলতেও দরকার নিবিড় বিচক্ষণতা, যেমন,

১) সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল সুরক্ষিত সঞ্চয় করে রাখার মতো উপযুক্ত জায়গা (ware house)প্রত্যেকটি কাঁচামালের গুণগত মান পরীক্ষা, তার পরিমাণের হিসেব এবং সেই হিসেব অনুযায়ী আঞ্চলিক বণিকদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়া।

 ২) যারা কাঁচামাল থেকে নানান প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করবে, বিভিন্ন পেশার সেই কর্মীদের কাজ করার নির্দিষ্ট জায়গা।

৩) তৈরি হতে থাকা প্রত্যেকটি সামগ্রীর গুণগত মান নিয়মিত পরীক্ষা করার জন্য থাকতে হবে দক্ষ পরিদর্শক।

 ৪) তৈরি হয়ে যাওয়া সামগ্রীর কোনটি কোথায় যাবে - দেশের অভ্যন্তরে অথবা বিদেশে - নির্দিষ্ট করে সুরক্ষিত রাখা এবং প্রাপ্য আদায়ের পর আঞ্চলিক বণিকদের হাতে সেগুলি হস্তান্তর করা।

৫) বিদেশে যাওয়ার সামগ্রীগুলি নির্দিষ্ট পরিবহণে বন্দরে পৌঁছে দেওয়া।

৬) এই সমগ্র ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে থাকতে হবে প্রচুর করণিক এবং উচ্চপর্যায়ের পরিচালকবৃন্দ।

৭) বাণিজ্য কেন্দ্রে কর্মরত সকল স্তরের মানুষের থাকা, খাওয়া এবং অন্যান্য সুবিধের জন্যে রাখতে হবে সমস্ত ধরনের সুব্যবস্থা।

৮) দূর দেশ থেকে আসা এবং বিদেশী বণিকদের এবং তাদের পশুদের থাকার জন্যে পর্যাপ্ত আয়োজন।

৯) সবার উপরে দরকার প্রত্যেকটি স্তরের মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত করা, তা নাহলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে।

১০) নিয়মিত খাদ্য সরবরাহের জন্যে, বাণিজ্য কেন্দ্রের আশেপাশে নদীর দুপাড়ের বিস্তীর্ণ জমিকে চাষযোগ্য করে তুলতে হবে। সেখানে দক্ষ কৃষকদের দেওয়া হবে উন্নতমানের বীজ, বলদ এবং লাঙল। নানা ধরনের শস্য এবং সব্জি উৎপন্ন করে তারা নিয়মিত সরবরাহ করবে বাণিজ্য কেন্দ্রের নিয়ামককে। তার বদলে তারাও পাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য। বাণিজ্য কেন্দ্রের নিয়ামকই ব্যবস্থা করে দেবে চাষের জন্যে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত জলের সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা।

 ১১) বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশে পশুপালন ক্ষেত্রও বানিয়ে তুলতে হবে, সেখানে নানান ধরনের পশু - গরু, ছাগল, ভেড়া পালন করা হবে। সেখান থেকে বাণিজ্যকেন্দ্রের অধিবাসীদের জন্যে আসবে দুধ, ঘী, মাখন এবং প্রয়োজন মতো মাংস।

১২) সব শেষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিপুল সংখ্যক দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমজীবি মানুষ সংগ্রহ, যারা বাণিজ্য কেন্দ্রের সম্পূর্ণ পরিকাঠামো এবং পরিষেবা পরিকল্পনা মতো গড়ে তুলতে পারবে।

 

আজকের যুগে এমন ব্যাপ্ত এবং নিখুঁত বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা তেমন কিছু বড়ো ব্যাপার নয়, সত্যি কথা বলতে পৃথিবীর যে কোন দেশের বাণিজ্যিক মহানগর এবং নগরগুলি উপরের নিয়মেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই উপমহাদেশেরই এক প্রান্তে এমনই সফল বাণিজ্যের এক নিখুঁত পরিকাঠামো গড়ে তোলার সূচনা করেছিল। সে আলোচনায় একটু পরেই আসছি। আর সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, এই পর্যায়ে মানুষের সামাজিক জীবন যাপনের পরিস্থিতির দিকে সংক্ষেপে চোখ রাখা যাক।  

 

২.২.৩ কৃষি সমাজে জীবনযাত্রার মান

ভুলকা পরিবার এবং বিশ্‌ভাইয়ের যে কল্পনা দিয়ে এই পর্বের শুরু করেছিলাম, তার সময়কাল আজ থেকে মোটামুটি চোদ্দ হাজার বছরের শুরুতে। যখন অধিকাংশ মানুষের সমাজই পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে কৃষিকাজে এবং পশুপালনে যুক্ত হয়ে গেছে। এবং এই অধ্যায় শেষ করছি আজ থেকে মোটামুটি ন’হাজার বছরের শেষে।

আলোচ্য এই পাঁচ হাজার বছরে মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে যে যে উন্নতি এবং অবনতি ঘটল, তা এই রকমঃ -

 

১) শিকারী-সংগ্রাহী মানুষের সম্পদ যত সামান্যই হোক, পরিবারের কোন সদস্যেরই তাতে ব্যক্তিগত অধিকার ছিল না, সে সম্পদ ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক। এক পরিবারের মেয়ে অন্য পরিবারে বধূ হয়ে আসাতে পারিবারিক বাঁধন আলগা হতে শুরু হল। এখন পরিবারের সম্পদে ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্ন এবং বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কারণ একই পরিবারভুক্ত ভাইরা এবং পুত্রেরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারের কর্তা। অর্থাৎ এখন যে কোন পরিবারই অনেকগুলি ছোট ছোট পরিবারের সমষ্টি। তাদের সকলেই পিতার সম্পদের অধিকারী।  এই সম্পদের অধিকার ও বণ্টন থেকেই জ্ঞাতি শত্রুতার উদ্ভব হতে লাগল। এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমাদের আজও হতে হয়। এই ভাঙনের জন্যে ঠিক কে কতটা দায়ি, সে বিতর্কের প্রসঙ্গ আমাদের এখানে আলোচ্য নয়। দায়ি যেই হোক, আমি শুধু পারিবারিক অশান্তি আর দুশ্চিন্তার বিষয়টির দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছি। পরিবারের সামগ্রিক বিপদ-আপদ, প্রাকৃতিক এবং আশেপাশের আরণ্যক প্রতিকূলতার সঙ্গে নতুন এক শত্রুশ্রেণী গড়ে উঠল, যার নাম জ্ঞাতিশত্রু – একই পরিবারের রক্ত সম্পর্কিত ভাইদের মধ্যে বিবাদ। অর্থাৎ নিবিড় পারিবারিক বন্ধন ভেঙে, এখন মানুষের মনে পারিবারিক অন্তর্কলহের দুশ্চিন্তা এনে দিল।

২) পরিবারে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের যে সমমর্যাদা এবং সমদক্ষতার অবস্থান ছিল, সেখান থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে, কৃষিসমাজের পরিবারগুলি পুরুষপ্রধান - পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠল। মেয়েরা এখন জন্ম থেকেই পরের ঘরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল। অতএব আগের মতো দক্ষ শিকারী, অরণ্যচারী হওয়ার থেকে মেয়েরা এখন রূপচর্চা করে, কোমল ও পেলব অবলা নারী হয়ে উঠতে শুরু করল। তাদের সঠিক বরে এবং ঘরে বিয়ে দেওয়াটাই হয়ে উঠল পরিবারের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয়।

৩) পরিবারে নারীদের ভূমিকার আমূল পরিবর্তনে, তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহুপ্রসবিনী হয়ে উঠতে হল। তার মধ্যেও যে নারী যত বেশী পুত্র-প্রসবিনী, তার মর্যাদা বাড়তে থাকল। কারণ পুত্রেরা পরিবারেই থাকবে এবং পিতার কৃষিকাজে অচিরেই সহায় হবে। অতএব পুত্রসন্তানকে “Asset” এবং কন্যাসন্তানকে “Liability”- ভাবার সূচনা হল।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীদের বহুপ্রসবিনী হওয়ার আরও একটি কারণ, মাতৃস্তন্যের বিকল্প হিসেবে গৃহপালিত গরুর দুধের ব্যাপক ব্যবহার। শিকারী-সংগ্রাহী পরিবারের শিশুদের মাতৃস্তন্য ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না।  বিজ্ঞানীরা বলেন, সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেই দেখা যায়, সন্তান যতদিন মাতৃস্তন্যে নির্ভরশীল থাকে, প্রাকৃতিক নিয়মেই মায়েদের পরবর্তী সন্তান নেওয়ার আগ্রহ কম থাকে। কিন্তু গরুর দুধের ব্যাপক প্রচলন শুরু হওয়াতে মানুষের সন্তান যখন অতি শৈশবেই মাতৃস্তন্য ছেড়ে গরুর দুধে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল, মায়েদের পরবর্তী সন্তান গ্রহণের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাও দূর হয়ে গেল।

বহু প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল বহুপ্রসবিনী মাতা এবং সদ্যজাত শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি। এও আরেক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠল বৈকি!

৪) শিকারী-সংগ্রাহীদের জীবনযাপন আপাতদৃষ্টিতে কঠোর এবং সর্বদাই বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত জীবন বলে মনে হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, তার ঠিক উল্টো। কৃষিজ ফসলের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মানুষ প্রায়ই চরম বিপদগ্রস্ত হত, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, নদীতে বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এবং পঙ্গপাল[1]-এর মতো কিছু পতঙ্গের আক্রমণে। খরা বা বন্যার কবলে কৃষিজীবিদের চরম দুর্দশা আজকের মতো অত্যাধুনিক যুগেও অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয় (আধুনিক শহরের শিক্ষিত স্বচ্ছল সমাজ এ বিষয়ে সচেতন হন, যখন খরা বা বন্যার কারণে শেয়ার সূচকের পতন ঘটে)। তাছাড়াও ছিল বন্যপশুদের হঠাৎ আক্রমণ, যেমন হাতির পাল (আজও তারা নেমে আসে দলমার পাহাড়ি অঞ্চল থেকে), কিংবা নীলগাইয়ের দল (২০১৬ সালে বিহারের বেশ কিছু গ্রামে নীলগাইকে ভার্মিন (vermin) ঘোষণা করে প্রায় ২৫০ নীলগাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল)।  এবং আরও ছিল বিদ্বেষী কোন শিকারী-সংগ্রাহী দলের অতর্কিত আক্রমণ, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

 উদ্বৃত্ত-সম্পদশালী অভিজাত মানুষেরা এ ধরনের ধাক্কা সামলে নিতে পারলেও, সাধারণ মানুষের পক্ষে এইরকম ধাক্কা প্রায়শঃ মর্মান্তিক হয়ে উঠত। অতএব সাধারণভাবে দুশ্চিন্তা বাড়ল অনাহারের, দুর্ভিক্ষের।

৫) দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি হল কৃষিসমাজের আরেকটি বিশেষত্ব, সে কথা আগেই বলেছি। তারই সঙ্গে মানুষের বসতির সঙ্গেই থাকত বহু ধরনের গৃহপালিত পশু - কুকুর, গরু, বলদ, ছাগল, ভেড়া, গাধা, উট। অল্প জায়গার মধ্যে অপরিচ্ছন্ন ভাবে পশুদের সঙ্গে একত্রে বসবাসের ফলে, পশুবাহিত সংক্রমণের বিপদ প্রায়ই লেগে থাকত। তার ওপর কৃষি ক্ষেত্রের জমে থাকা জলের মশা জাতীয় নানান কীট পতঙ্গের সংস্রবে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলেও নানান অসুখ-বিসুখের সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল। যার ফলে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, কলেরা, বসন্তের মতো মহামারিতে প্রচুর মানুষ মারা যেত।

আমাদের অত্যাধুনিক সভ্য সমাজেও বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ কী ভয়ানক আকার নিতে পারে তার সদ্য উদাহরণ কোভিড১৯ কোরোনা ভাইরাস। আদিম শিকারী-সংগ্রাহীদের এই সংক্রমণের মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম বা নগণ্য। আর মহামারি বলতে খুব জোর কোন একটি দলের পঞ্চাশ-ষাট জন সদস্যের মৃত্যু। কারণ তাদের প্রত্যেকটি দলই বিচ্ছিন্ন থাকতো – তাদের স্বাভাবিক সামাজিক দূরত্ব এতটাই ছিল যে, এক দল থেকে অন্য দলে সংক্রমণ হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। অতএব কৃষি নির্ভর সমাজের অজানা-অচেনা নানান অসুখ ও মহামারির দুশ্চিন্তা বাড়ল।

৬) শিকারী-সংগ্রাহী পরিবারের সদস্যদের শারীরিক এবং সকল কাজ করার দক্ষতা ছিল বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। কৃষি সমাজের মানুষরা শারীরিক দক্ষতায় (physical fitness) দুর্বল কিন্তু বিশেষ বিশেষ কাজে দক্ষ হতে থাকল। যেমন কৃষক শুধুমাত্র কৃষিকাজে দক্ষ, কুম্ভকার মাটির পাত্র গড়ায়, কর্মকার ধাতব কাজে, অভিজাত মানুষ, অন্য মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ায় দক্ষ হয়ে উঠল। একজন শিকারী-সংগ্রাহী মানুষ আর একজন কর্মকারের বাহুবল (পাঞ্জার শক্তি) একই হতে পারে। কিন্তু দুজনের লড়াইতে, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষ অনায়াসে জিতে যেত পারত ক্ষিপ্রতায় এবং লড়াই করার দক্ষতায়। সক্ষম এবং সবল শরীর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে, শারীরিক দুর্বলতা বাড়িয়ে তোলে মানসিক দৌর্বল্য, বাড়িয়ে তোলে দুশ্চিন্তা।

৭) বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুষ্টির ব্যাপারেও কৃষিজীবিরা অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। তার কারণ তাদের একমাত্র প্রধান খাদ্য হয়ে উঠেছিল গম, যব, ধান অথবা ভুট্টা। সাধারণ মানুষ দিনের মধ্যে তিন থেকে চারবার একই শস্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। আজও আমাদের সাধারণ মানুষ বছরের প্রত্যেকটি দিন, সারাদিনে যে তিনবার খাদ্য গ্রহণ করে, অঞ্চলভেদে সেগুলি হল প্রধানতঃ মুড়ি-ভাত-ভাত অথবা রুটি-ভাত-রুটি অথবা ইডলি-ভাত-ভাত এবং তার সঙ্গে থাকে সামান্য কিছু সব্জি। (এখানে পিৎজা, পাস্তা, বিরিয়নি, হেলথড্রিংক্স-বিলাসী স্বচ্ছল নাগরিকদের কথা বললাম না। কারণ সে যুগেও অভিজাত স্বচ্ছল পারিবারিক আহারে নানান ফলমূল, মধু, আখরোট-বাদাম থাকত।) সাধারণ মানুষের নিয়মিত এই খাদ্যের অভ্যাসে অনেকগুলি জরুরি ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের অভাব ঘটতে থাকে।

অন্য দিকে শিকারী-সংগ্রাহীদের খাদ্যের অভ্যাস ছিল অনিশ্চিত এবং বিচিত্র। নানান ফলমূল, মাশরুম, কন্দ, বিচিত্র পশুমাংস এবং বুনো শাক-সব্জি-শস্য ছিল তাদের খাদ্য তালিকায়। এই খাদ্যে পুষ্টির সঙ্গে জরুরি ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের প্রয়োজন অনেকটাই মিটে যেত। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ত।

উপরন্তু পর পর কয়েক বছরের অনাবৃষ্টিতে যদি শস্যের উৎপাদন যথেষ্ট না হত, সেক্ষেত্রে বিকল্প কোন খাদ্যের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষি নির্ভর মানুষদের অনাহারে বা স্বল্পাহারে থাকতে হত। তাদের পক্ষে গ্রামের স্থায়ী ঘরবাড়ি, পশুখামার ছেড়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার বিকল্প পথও খোলা থাকত না। কিন্তু শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরা এমন পরিস্থিতিতে – কোন অঞ্চলে খাদ্যাভাব ঘটলে, নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়ত নতুন তৃণভূমি, নতুন এলাকার সন্ধানে। অতএব পূর্ণ কৃষি নির্ভরতা সাধারণ মানুষের জীবনে খাদ্যের নিরাপত্তা যতটা দিল, তার থেকেও বেশি এনে দিল খাদ্যের অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তা। 

৮) গৃহপালিত পশুদের কথা আগেই বলেছি।  আগেই বলেছি সমাজে মানুষের শ্রেণী বিন্যাসের কথাও। কিন্তু এই সময় থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী বহুদিন, হাতে গোনা কিছু অভিজাত মানুষ এক শ্রেণীর সাধারণ মানুষকেও গৃহপালিত পশুর মতোই ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এই পশুর মতো মানুষরাই সভ্য এবং অভিজাত মানুষের জন্যে বানিয়ে তুলেছিল তাদের গর্বের পিরামিড এবং রোম সাম্রাজ্যের অতুলনীয় সব প্রাসাদ। বিভিন্ন অঞ্চলের তথাকথিত অসভ্য শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের পরাস্ত এবং বন্দী করে গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো সংগ্রহ করত বণিকরাই। তাদের বিক্রি করে দেওয়া হত সভ্য সমাজের পশু হাটে। স্বাধীন ও সমমর্যাদার শিকারী-সংগ্রাহী মানুষরা সেই সময় হয়ে উঠল ক্রীতদাস (slave)ন্যূনতম খাদ্য, পায়ের শিকল এবং চাবুকের বিনিময়ে তারা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল আমাদের প্রাচীন যত সভ্যতার প্রতীক।

ভারতীয় উপমহাদেশে এই কদর্য ক্রীতদাস প্রথার প্রত্যক্ষ নিদর্শনের অভাব থাকলেও, একটু অন্যভাবে – যাদের চুক্তি শ্রমিক (bonded labour) বলা যায় -  এই প্রথা বহুল প্রচলিত ছিল। কিছু দিন আগেও প্রপিতামহের ঋণ শোধ করার জন্যে সপরিবার-নাতিকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটার ঘটনা আকছার শোনা যেত।

৯) প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আরণ্য বিপদ-আপদের দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কের জন্যে, শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা পশুপতিদেব, দেবীমা এবং নানান আত্মার ওপর নির্ভর করত। কিন্তু সেই নির্ভরতায় অসহায়তা ছিল অনেকটাই কাল্পনিক। সে কথা আগেই বলেছি। কখনো কখনো ঝড়ে বা হাতির দলের আক্রমণে তাদের পর্যুদস্ত হতে হত, দলের কিছু লোক মারাও যেত। তার পরেও দলের বেঁচে যাওয়া মানুষরা দেবতা-দেবী অথবা আত্মাকে তাদের প্রাণরক্ষার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, স্বাভাবিক জীবনে আবার সহজেই ফিরে যেতে পারত। যেভাবে আমরা আজও যে কোন মৃত্যুর শোক-দুঃখ এবং বিচ্ছেদকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় চট করে ফিরে আসি।

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সমাজের অধিকাংশ মানুষ - কৃষক থেকে সাধারণ শ্রমিক এতটাই অসহায় অবস্থায় ছিল, আজকের যুগে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। এই অসহায় অবস্থা থেকে কবে, কীভাবে তারা মুক্তি পাবে তারও কোন দিশা তাদের সামনে থাকত না। এই বছর কৃষকরা হয়তো খরায় সর্বস্বান্ত হল, কিন্তু পরের বছর কী হবে? সুবর্ষা, বন্যা, নাকি আবারও খরা? অতএব তারা আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল, ভাগ্যের ওপর, অর্থাৎ পশুপতিদেব এবং দেবীমার ওপর। অতএব দ্রুত বাড়তে লাগল পূজা-পার্বণ, ব্রত, মানত, নতুন নতুন প্রথা, আচার, আচরণ, এমনকি নিত্য নতুন দেব-দেবীও!

 

২.২.৪ এই সময় কালের প্রত্ন নিদর্শন

এতদিন পর্যন্ত আমি আদিম মানুষের জীবনযাত্রার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করেছি পুরোটাই কল্পনায়। কিন্তু এই সময়কালে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু প্রত্ন নিদর্শন, আমার এই কাল্পনিক পুনর্নির্মাণকে অনেকটাই সমর্থন করবে। সেরকমই কিছু প্রত্ন নিদর্শনের কথা এখানে আমি উল্লেখ করব-

প্রথমদিকে আদিম মানুষদের আবাস ছিল পাহাড়ের গুহায়, অথবা পাথর সাজিয়ে কিংবা কাঠকুটো আর বড়োবড়ো পাতা দিয়ে বানিয়ে তোলা অস্থায়ী আস্তানায়।

পাহাড়ের গুহায় বেশ কিছু মানব ও মানুষের গোষ্ঠীর বসবাসের নিদর্শন পাওয়া গেছে, মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকা, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সাঙ্ঘাউ, অন্ধ্রের কুর্নুলে। পাহাড়ের গুহার আস্তানা থেকে তাদের সম্বন্ধে জানা যতটা সহজ, অস্থায়ী আস্তানার ক্ষেত্রে ততটা সহজ নয়। কারণ আজ বেশ কয়েক হাজার বছর পরে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোন প্রত্যক্ষ সূত্র নেই। বিশেষজ্ঞরা অস্থায়ী আস্তানার হদিশ সেখানেই আন্দাজ করেন, যে যে বিশেষ এলাকায় একত্রে অনেক ধরনের জীবাশ্ম উদ্ধার করা গেছে। যেমন একসঙ্গে প্রচুর পশুহাড়, বেশ কিছু পাথরের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রের জীবাশ্ম। একই জায়গায় নানান ধরনের পশুহাড়ের প্রচুর জীবাশ্ম থেকে আন্দাজ করা যায়, এগুলি ওই মানব প্রজাতির শিকার ও খাদ্যের অবশেষ। এই পশুদের মধ্যে হরিণ, বুনো ছাগল, ভেড়া, শুয়োর, গবাদি পশু এমন কি বন্য বেড়াল জাতীয় প্রাণীর হাড়ও পাওয়া গেছে। এই ধরনের আবাসগুলি হত, কোন নদী বা বড়ো জলাশয়ের কাছাকাছি এবং ঝোপঝাড়ওয়ালা অগভীর জঙ্গলে। অতএব ওই সময়ে মানুষের জীবনধারণের একমাত্র উপায় ছিল শিকার - সংগ্রহ এবং পরিভ্রমণ। এক জায়গা থেকে অন্য কোন অনুকূল জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।

মধ্য প্রদেশের ভীমবেটকা গুহাগুলির অনন্য বিশেষত্বের কথা একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। ভূপাল শহর থেকে ৪৫ কি.মি. দূরে রাইসেন জেলার সাতটি পাহাড়ে প্রায় ৭৫০টি গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় দশ কি.মি.-র মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই গুহাগুলিতে লক্ষাধিক বছর ধরে মানুষের নিরন্তর বসবাসের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। কয়েকটি গুহায় এক লক্ষ বছর আগেও যাদের বসবাস ছিল, তারা নিশ্চয়ই ইরেক্টাস অথবা অন্য কোন মানব প্রজাতি, হোমোস্যাপিয়েন্স নয়। এর পরে দশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত এই গুহাগুলি বিভিন্ন সময় এবং পর্যায়ে মানুষের আবাস ছিল। যার ফলে একই জায়গায় মানব ও মানুষে[2]র সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পর্যায়গুলি খুব স্পষ্ট চিনে নেওয়া যায়। এই গুহাগুলিতে পাওয়া বিভিন্ন সময়ের পাথরের সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র এবং গুহাচিত্র থেকে বিভিন্ন যুগের – প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক এবং নিওলিথিক - মানুষদের সম্পর্কে অনেক তথ্য নিশ্চিত করা যায়।

আদিম প্রস্তর বা প্যালিওলিথিক যুগের বিভিন্ন পর্যায় এবং নব্য প্রস্তর যুগের মূল পার্থক্য হল পাথরের অস্ত্র ও সামগ্রীর গুণগত পার্থক্য। আদিম যুগের মানুষেরা নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ি জঙ্গলে পড়ে থাকা নুড়ি পাথরকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। সেই পাথরকে ভেঙে ধারালো করে তোলা হল পরবর্তী পর্যায়। তারপর অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষ কোন পাথরকে, যেমন ফ্লিন্ট বা কোয়ার্জ, চিহ্নিত করে, তাকে বিশেষ স্তরে ভেঙে আরো ধারালো অস্ত্র তৈরি হল পরবর্তী পর্যায়। নব্যপ্রস্তর যুগে এল আরো ছোট ছোট অস্ত্র, যাকে মাইক্রোলিথ (microlith) বলা হয়, যার সাইজ ৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে এবং তীক্ষ্ণ ধারালো ফলক। এগুলি নানান কাজে ব্যবহার হত, পশুর চামড়া ছাড়ানো বা মাংসের ফালি কেটে নেওয়ার ছুরি, শস্য কাটার কাস্তে, হাতির দাঁত বা পশুর হাড় থেকে পুঁতি এবং গয়না বানানোর কাজে। কিছু তিনকোণা ধারালো ফলক পাওয়া গেছে, যেগুলি কাঠির ডগায় বেঁধে তির হিসেবে ধনুক থেকে ছোঁড়া হত, এবং বর্শার ফলক তো ছিলই। তির-ধনুকের ব্যবহারে দূর থেকে শিকার করতে যেমন সুবিধে হয়েছিল, তেমনি বেড়েছিল শিকারীর নিরাপত্তা।

নব্যপ্রস্তর বা মেসোলিথিকযুগে পাথর-প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তনে মানুষের নুড়ি পাথরের জন্যে শুধু নদীর ধারে বা পাহাড়ের কাছাকাছি থাকার দরকার হত না, বরং যে অঞ্চলে বেশি ফ্লিন্ট বা কোয়ার্জ পাথর পাওয়া যেত সেই সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নব্য প্রস্তর যুগের শেষ থেকেই শিকারী-সংগ্রাহী মানুষেরা চাষ-আবাদ এবং পশুপালনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল, তার সঙ্গে শুরু করেছিল আগুনে পুড়িয়ে মাটির নানান রকম পাত্র বানাতে।

প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক পর্যায়ের নিদর্শন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া গেছে। সুদূর উত্তর-পশ্চিমের সোয়াৎ নদীর অববাহিকা, পটোয়ার উপত্যকা থেকে মধ্যপ্রদেশের আদমগড়, গুজরাটের লঙ্ঘনাজ, রাজস্থানের সরাই নাহার রাই, উত্তরপ্রদেশের মহাদহ এবং বিহারে। একথাও মনে রাখা দরকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি বলেই, কোন অঞ্চলে যে মানুষের বসবাস ছিল না এমন ধারণা করার কোন অর্থ হয় না। কারণ যে যুগ যত আদিম তার নিদর্শন পাওয়া ততই কঠিন। নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিপর্যয়, যেমন প্রবল বন্যা, ভূমিকম্প, নদীর গতিপথ পরিবর্তন আদিম মানুষের দুর্বল পদচিহ্নগুলি মুছে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

নিওলিথিক যুগের মানুষ শিকারী-সংগ্রাহী জীবন থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে কৃষি এবং পশুপালনে আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগল। ভারতীয় উপমহাদেশে এই যুগের প্রত্ন-নিদর্শনের বিস্তার ব্যাপক। উত্তর পশ্চিমের সোয়াথ উপত্যকা, তার কিছুটা দক্ষিণে সরাই খোলা, বালুচিস্তানের মেহেরগড়, কাশ্মীর উপত্যকা, বিহারের চিরাণ্ড, উত্তর প্রদেশের বেলান উপত্যকায় চোপানি মাণ্ডো এবং কোলদিহা আরও পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের অজয় নদীর অববাহিকায় পাণ্ডু রাজার ঢিপি, আসামের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দাওজালি হাদিং এবং সরুতারু। দক্ষিণে রায়চুর দোয়াব, গোদাবরী এবং কৃষ্ণার অববাহিকায় উটনুর, পিকলিহাল, মাসকি, টেক্কালাকোটা, ব্রহ্মগিরি, হাল্লুর, পাইয়ামপল্লি, এবং টি. নরসিপুর। এর মধ্যে অনেকগুলিতে মানুষ ঐতিহাসিক যুগেও বসবাস করত। এখনও পর্যন্ত এতগুলি এলাকায় নিওলিথিক মানুষের বসতি যখন আবিষ্কার করা গেছে, তখন ধরে নেওয়া যায় এর আশেপাশের এলাকাতে তাদের পূর্বসূরি যুগের মানুষদেরও আবাসও ছিল। একমাত্র ভিমবেটকায় বাস করা মানুষরাই বিভিন্ন সময়ে ভারতের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এমন হতেই পারে না।

অতএব যুক্তিসঙ্গত ভাবেই কল্পনা করে নেওয়া যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই আদিমকাল থেকেই মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করত। প্রযুক্তিগত প্রগতি সকলের এক হতে পারে না, হয়ওনি। অতএব পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষ যখন বৃহত্তর যৌথ সমাজ গড়ে গ্রাম ও বৃহত্তর জনপদ তৈরি করতে শুরু করল, তাদের উন্নতি ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করলেন, বিশ্‌ভাই এবং তাঁর হাত ধরে বণিকসম্প্রদায়। এক অঞ্চলের উদ্বৃত্ত সামগ্রীর বদলে অন্য অঞ্চলের উদ্বৃত্ত সামগ্রী সংগ্রহ (procurement) এবং বিতরণ (distribution)-এর যে প্রক্রিয়া অর্থাৎ বাণিজ্যই এই ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষকে বৃহত্তর সমাজ গড়তে সাহায্য করল। বণিকদের মাধ্যমেই বহুদূরের অচেনা-অজানা সমাজের বিচিত্র প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়তে পারল অন্যান্য সমাজেও।

বিশ্‌ভাই বহুদিন বিগত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর মহিমাগাথা বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ এবং বণিকরা মনে রেখেছে। বিশ্‌ভাই এখন বিশ্‌দেব। এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন পশুপতিদেব, তিনি রুষ্ট হলে বিনাশও করতে পারেন। আর বিশ্‌দেব মানুষকে প্রতিপালন করেন, তাদের সমৃদ্ধ করেন।

নিওলিথিকের পরবর্তী চ্যালকোলিথিক যুগ বলতে বোঝায় যে যুগে মানুষ ধাতু আবিষ্কার করে ধাতব সামগ্রীর ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। ধাতু বলতে এখানে তামা, টিন এবং উভয় ধাতুর সংকর ব্রোঞ্জ। এই যুগকে অনেক ঐতিহাসিক ব্রোঞ্জ যুগও বলে থাকেন। পাথর আর কাঠের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মানুষের প্রগতির গতি আমূল বদলে গেল ধাতব স্পর্শে। প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর ধরে শম্বুক গতিতে চলা কাঠ, বাঁশ আর পাথর-প্রযুক্তির ধারা, সামান্য কয়েক শ’ বা বড়ো জোর হাজার খানেক বছরের মধ্যে উঠে পড়ল দ্রুতগামী রথে। সে প্রসঙ্গ আসছে পরবর্তী অধ্যায়ে।

 

২.২.৫ প্রাগৈতিহাসিক পর্ব এবং ঐতিহাসিক পর্ব

পরবর্তী অধ্যায়ে যাওয়ার আগে, এইখানে বলে রাখি, এই ৭০ হাজার বিসিই থেকে ১২ হাজার বিসিই পর্যন্ত সময়কালের পুরোটাই প্রাগৈতিহাসিক পর্ব। অর্থাৎ ওই সময়ের প্রত্ন নিদর্শনের (ভিমভেটকা গুহার নিদর্শন ছাড়া) অস্তিত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত নগণ্য। এই নিদর্শন থেকে ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয় বলেই, আমি কল্পনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।

আমরা এখন যে সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের সভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। এই সময়ের দেড় দু হাজার বছর পরেই তারা শুরু করবে বিস্ময়কর নগর সভ্যতার এক চূড়ান্ত নিদর্শন। যার প্রত্ন নিদর্শন দেখে আমরা অভিভূত হবো।

আমরা পরের অধ্যায়েই দেখব, সুনিয়ন্ত্রিত বিপুল এক জনসমাজের নিবিড় পরিকল্পনাতেই এই নগর সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব। সে সমাজ গড়ার সূচনা হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে কোন এক সময়ে। দুটি বিচ্ছিন্ন দলের সংযুক্তির ফলে যে সমাজ গঠনের সূত্রপাত, তার পিছনে “বিবাহ” নামক সামাজিক প্রথা ছাড়া আর কোনভাবেই সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। এই সামাজিক প্রথা সৃষ্টির পিছনে নিশ্চয়ই ছিল গভীর চিন্তা-ভাবনা, দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক এবং দূরদৃষ্টি। এই চিন্তা-ভাবনার পিছনে অবশ্যই ছিল মানুষের জিন ও মস্তিষ্কের অনন্যতা। আগুনকে রান্নার কাজে ব্যবহারের ফলস্বরূপ যার বিকাশ ঘটেছিল। তা নাহলে শিম্পাঞ্জি বা হাতিদের পারিবারিক দলগুলিও এতদিনে সমাজ-টমাজ গড়ে আমাদের সভ্যতার সঙ্গে টক্কর দিতে পারত। অতএব আমার কল্পনার ঘটনাগুলি যে ঘটেছিল, এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

তবে এখন আর কল্পনার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা যে পর্যায়ে চলে এসেছি, সে সময়ের প্রত্ননিদর্শনের খুব অভাব নেই। বরং বেশ কিছু স্থানে প্রত্ননিদর্শনের হদিশ জেনেও আমরা প্রত্ন-খনন করতে পারিনি, আর্থিক এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের সদিচ্ছার অভাবে। অতএব এখন থেকে ইতিহাস চলবে তার ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে।                  

  

২.২.৬ গ্রাম থেকে জনপদ

অখণ্ড ভারতের বালুচিস্তানের কোয়েতা অঞ্চলের মেহেরগড়ে নিওলিথিক যুগের বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে বেশ বড় একটি জনপদের প্রত্নতাত্ত্বিক হদিশ পাওয়া গেছে। এই জায়গাটির গুরুত্ব এই কারণে যে, পরবর্তী কয়েক হাজার বছরে মানুষের কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে নাগরিক সমাজে উত্তরণের পর্যায়গুলি এখানে সুস্পষ্ট ধরা পড়ে।

মেহেরগড় জনপদের শুরু মোটামুটি ৭০০০ বিসিই অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ন হাজার বছর আগে। মেহেরগড়ের মানুষরা প্রধানতঃ গম আর যবের চাষ করত। গরুবাছুর, ছাগল, ভেড়ার মতো কিছু পশুপালন করত। রোদে পোড়া ইঁটের বাড়িতে বাস করত এবং অধিকাংশ বাড়িতে রান্নার উনুন ছিল। কিছু কিছু কাঠামোকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা শস্যভাণ্ডারের নিদর্শন বলে মনে করেন। মাটির নিচে বেশ কিছু সমাধি পাওয়া গেছে, সে সমাধিতে কিছু কিছু উৎসর্গ সামগ্রীও পাওয়া গেছে, যেমন লাপিস ও টারকোয়েজ[3][4]-এর পুঁতির মালা এবং ছোটছোট কিছু মাটির মূর্তি।

মেহেরগড়ের কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে মোটামুটি একই সময়ে শুরু হয়ে মোটামুটি সাত হাজার বছর আগেকার আরও কিছু জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেমন কিলে গুল মহম্মদ, রানা ঘুণ্ডাই, শেরি খান তারাকাই, গুমলা এবং রেহমান ঢেরি। এই জনপদগুলিতেও কৃষি এবং পশুচারণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই জনপদগুলির অবস্থান, পশ্চিমদিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করার যে সুপ্রাচীন স্থলপথ তার আশেপাশেই এবং সিন্ধু নদের অববাহিকার খুবই কাছে। সিন্ধু নদের অববাহিকায় আরও দুটি জনপদের নিদর্শন মিলেছে কোট দিজি আর আমরিতে। এই সবকটি জনপদকেই প্রাক-হরপ্পা সংস্কৃতির বাহক বলা চলে।

কোট দিজি থেকে মাটির পাত্রের যে নমুনা মিলেছে, তাতে রঙ দিয়ে আঁকা অশ্বত্থের পাতা, কিংবা মাছ বা মাছের আঁশের নকশা – হরপ্পা থেকে পাওয়া মাটির পাত্রের সঙ্গে তাদের মিল চোখে পড়ার মতো। কোট দিজির মতোই নকশাদার মাটির পাত্র পাওয়া গেছে রাজস্থানের সোথি এবং কালিবাংগান এলাকা থেকে। আরো পূর্বে হরিয়ানার কুনাল এবং বানাওয়ালি থেকেও একই রকমের নকশাকাটা মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। আবার দক্ষিণে গুজরাটের ধোলাভিরাতেও, প্রাক-হরপ্পা জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আরাবল্লি পাহাড় আজও খনিজ তামার উৎস। তামা এবং তার সংকর ধাতুর উৎপাদনে ওই সময় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল গানেশ্বর। সংকর ধাতু উৎপাদনে হরপ্পা সংস্কৃতির ছিল একাধিপত্য, অতএব আরাবল্লির পাহাড়ি এলাকা থেকেই সেখানে তামা ও অন্যান্য ধাতু সরবরাহ হত। ইতিমধ্যে এসে গেছে সোনা ও রূপো। রূপো আসত আরাবল্লী থেকে আর রাজস্থান ও গুজরাটের পাহাড়ি হিরণ্যগর্ভ অঞ্চল থেকে সোনা আসত তার লোভনীয় ঔজ্জ্বল্য নিয়ে।

সিন্ধু ছাড়াও হাকরা নদীর অববাহিকায় আধুনিক বাহাওয়ালপুর এবং চোলিস্তানের কাছে দুটি জনপদের সঙ্গে রাজস্থান ও পাঞ্জাবের বেশ কয়েকটি জনপদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই সময় হাকরা যথেষ্ট শক্তিশালী নদী থাকলেও পরের দিকে শুকিয়ে গিয়েছিল এবং গতিপথ পালটে পাঞ্জাবের ঘাঘর নদী হয়ে উঠেছিল।

অতএব সিন্ধু-হাকরা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা জনপদগুলির মধ্যে যে নিবিড় সংযোগ গড়ে উঠেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে যাওয়া-আসার জন্যে জলপথে  নদী এবং শাখানদীগুলি সহায়ক ছিল। আর ছিল সেই স্থলপথ – যে স্থলপথ দিয়েই সমস্ত মানব প্রজাতি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এবং পরবর্তীকালে হোমো স্যাপিয়েন্সরাও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। আরও পরবর্তী কালে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্থান স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত, সোয়াৎ উপত্যকা হয়ে ওই স্থলপথই ছিল পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসা এবং যাওয়ার একমাত্র স্থল পথ। এই জনপদগুলির আন্তর্বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং মৈত্রী-সম্পর্ক, কয়েক শ বছরের মধ্যে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদরো-র মতো সুপরিকল্পিত নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সহায়ক হয়েছিল। এর পিছনে পিতা পশুপতি বা পশুপতিদেব, মিত্তিকা বা দেবীমা এবং বিশ্‌ভাই বা বিশ্‌দেবের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

২.৩.১ সিন্ধু সভ্যতা এবং হরপ্পা সংস্কৃতির বিস্তার       

শুরুতেই বলে রাখি, এই সভ্যতার সমস্ত শহরগুলির কোন নামই, ওই শহরগুলির ভূমিপুত্রদের রাখা নাম নয়। এই নামগুলি আমরা রেখেছি প্রত্নখননের সময়ে বা পরে – নিকটবর্তী কোন আধুনিক শহর বা গ্রাম অথবা কোন লোকশ্রুতি থেকে। নিচের মানচিত্র থেকে সিন্ধু ও হরপ্পা সভ্যতার বিস্তারের আন্দাজ অনেকটাই পাওয়া যাবে।


সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুই শহর হরপ্পা (পাঞ্জাব প্রদেশ, পাকিস্তান) এবং মহেঞ্জোদারো (সিন্দ প্রদেশ, পাকিস্তান)। এই দুই প্রধান শহর ছাড়াও আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে, ধোলাভিরা (রান অফ কছ, গুজরাট, ভারত), গানেরিওয়ালা (পাঞ্জাব প্রদেশ, পাকিস্তান), রাখি গারহি (হরিয়ানা, ভারত) এবং লোথাল (খাম্বাৎ খাঁড়ি, গুজরাট, ভারত)। এছাড়াও হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং প্রভাবিত প্রচুর ছোট শহর এবং জনপদ ছিল। যার অনেকগুলিকেই চিহ্নিত করা গেলেও, প্রত্নখননের কাজ শুরু করা যায়নি। এবং কে জানে আরো অনেক জনপদই হয়তো রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। বিস্তৃত এই সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিলউত্তর-পশ্চিমের পামির মালভূমির শরতুঘাই থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আরবীয় উপদ্বীপের ওমান। পূর্বদিকে রাজস্থান, হরিয়ানা এবং দোয়াব অঞ্চলের কিছুটা। উত্তরে নিম্ন কাশ্মীর এবং দক্ষিণে গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের উত্তরাংশ পর্যন্ত।

২.৩.২ নগর নির্মাণ

প্রত্যেকটি শহর নির্মাণে সুষ্ঠু নাগরিক বোধ এবং সুপরিকল্পিত চিন্তা-ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও প্রত্যেকটি শহরের পূর্ণ প্রত্নখনন করা হয়ে ওঠেনি, তবুও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেন, বৃহত্তর মহেঞ্জোদারো শহরের আয়তন প্রায় দু’শ হেক্টেয়ারের কাছাকাছি। তবে মূল বড় শহরগুলির আয়তন কমবেশি একশ হেক্টেয়ার[4]। ছোট শহরগুলির আয়তন এর থেকে অনেকটাই ছোট। প্রত্যেকটি শহরই নির্দিষ্ট কয়েকটি পাড়ায় ভাগ করা হত। যেমন কাজের জায়গা, আবাস পাড়া, মালপত্র-রাখার গুদাম এবং অফিস পাড়া। আবাস পাড়াগুলি সাধারণতঃ শহরের পশ্চিমদিকে হত, আর কাজের জায়গা ও অফিস পাড়া হত পূর্বদিকে।

পশ্চিম আর পূর্বদিকের এই উপযোগীতাকে বাস্তুবিজ্ঞান ভেবে বসবেন না। কারণ খুব স্বাভাবিক সরল ধারণা থেকেই এই নগর নির্মাণের পরিকল্পনা।  পূর্বদিকে সূর্যোদয় হয় – অতএব দিনের আলোর পূর্ণ ব্যবহারের জন্যেই এরকম ব্যবস্থাপনা। আধুনিক প্রযুক্তিতে কাচের বড়ো বড়ো জানালায় ভারি ভারি পর্দা দিয়ে দিবালোক বর্জিত অন্ধকার হলঘরে লুকোনো ডিফিউজ্‌ড্‌ আলোকমালায় সজ্জিত অফিস স্পেস নির্মাণের প্রযুক্তি তখন জানা ছিল না যে! দিবালোকের সদ্ব্যব্যবহারে কত যে বিদ্যুতের সাশ্রয় হয় – কমিয়ে ফেলা যায় বিদ্যুতের চাহিদা এবং পাওয়ার প্ল্যান্টের দূষণ মাত্রা - আমাদের বিজ্ঞান সচেতন রুদ্ধদ্বার মস্তিষ্কে  সে কথা প্রবেশের পথ হারিয়ে ফেলেছে!         

আবাসিক পাড়াঃ আবাস পাড়ায় শ্রমিক, কর্মী, কেরানি, ছোট-বড় অফিসাররা সবাই থাকত। আবাস বাড়ির নিদর্শন যা পাওয়া গেছে, তাতে শ্রেণীগতভাবে খুব পার্থক্য ছিল না। আজকাল যে কোন শিল্পনগরীতে সচরাচর যেমন দেখা যায়, লেবার কলোনি থেকে জি.এম-বাংলোর গ্রেডেশন, সেরকম কোন পার্থক্য প্রত্নবিদেরা খুঁজে পাননি। শহরের বড়ো রাস্তা এবং পাড়ার ভেতরের সমস্ত রাস্তাই হত সোজা এবং যথেষ্ট চওড়া। কোন শহরেই অ্যাঁকা-ব্যাঁকা গলি ও তস্য-গলির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। রাস্তাগুলি সবই ছিল বাঁধানো, পাথরের ব্লকে অথবা পোড়া-ইঁটে। বড়ো কিংবা ছোট প্রত্যেকটি রাস্তার দুপাশে ছিল বাঁধানো নর্দমা, এমনকি কিছু কিছু শহরে ছিল ঢাকা-নর্দমা।

সমস্ত বাড়িগুলিই বানানো হত, রোদে-শুকোনো ইঁটে, যাকে আমরা আমা-ইঁট বলে থাকি। কিছু কিছু শহরে পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো বাড়িও পাওয়া গেছে। একটি উন্মুক্ত উঠোন ঘিরে বেশ কয়েকটি বাড়ি বানানো হত এবং কোন বাড়ি থেকেই সরাসরি রাস্তায় ওঠা যেত না। বাড়ির দরজা এবং জানালাগুলো হত, উঠোনমুখী, বিপরীত দিকে জানালা থাকত না। একতলা এবং দোতলা বাড়ির সমতল ছাদ হত চুণ-সুরকির ঢালাই করা। প্রত্যেকটি বাড়ির নর্দমা, উঠোনের পরিসীমা ঘুরে রাস্তার নর্দমার সঙ্গে যুক্ত থাকত। বেশ কিছু বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগার থাকত, থাকত রান্নাঘর – হয়তো এই বাড়িগুলিই ছিল অফিসারদের মতো কিছু উচ্চশ্রেণীর মানুষদের জন্যে। সাধারণের জন্যে থাকত যৌথ স্নানাগার। পানীয়জলের সরবরাহ হত কুয়োর জল থেকে।

কারখানাঃ দক্ষকর্মী এবং শিল্পীদের জন্যে ছিল আলাদা আলাদা কাজ করার জায়গা। কর্মকার – যারা ধাতুর কাজ করত। সূত্রধর – যারা কাঠের কাজ করত, কুম্ভকার যারা – মাটির নানান পাত্র বানাত, শিল্পী – যারা নানারকম পাথরের অলঙ্কার, মাটি এবং ধাতুর মূর্তি, পুতুল বানাত। সমকালীন সব কটি সভ্যতার মধ্যে, সিন্ধু সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্যই ছিল এই ধাতুর কাজ, পাথরের কাজ, মৃৎপাত্র এবং নানান শিল্প সামগ্রী, সে কথা আসবে পরে।

গুদামঘরঃ এর মধ্যে শস্যাগার ছিল, শহরের অধিবাসীদের জন্যে মজুত রাখা হত খাদ্য ভাণ্ডার, যেমন গম, যব, ভুট্টা, ধান। বিভিন্ন দূরের এলাকা থেকে সংগ্রহ করে আনা কাঁচামাল মজুত করে রাখা হত, যেমন তামা, টিন, সোনা, রূপো, খনিজ পাথর, যেমন লাপিস, টারকোয়েজ, সামুদ্রিক সামগ্রী, যেমন কড়ি, ঝিনুক, শাঁখ, মুক্তো। আরও মজুত করা থাকত কাঁচামাল থেকে বানানো সামগ্রী (finished products), যেমন নানান অলংকার, মাটির, পাথরের  এবং ধাতুর পুতুল, মূর্তি, পাত্র। এই সামগ্রীগুলিই রপ্তানি হতো ভারতীয় উপমহাদেশের ভেতরে এবং সমুদ্র বন্দর পথে বিদেশেও।

অফিসপাড়াঃ আজকের যে কোন শহরের মতোই অফিসপাড়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখান থেকেই শহরের এবং শহরের বাইরের যাবতীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হত। কাঁচামাল সংগ্রহ করা, গুণগত মান পরীক্ষা করা এবং হিসেব করে গুদামে তুলে রাখা। কাজ অনুযায়ী দক্ষ কর্মী ও শিল্পীদের কাঁচামাল বণ্টন করা এবং তার হিসেব রাখা। শিল্পীদের কাজ হয়ে গেলে, তাদের বানানো সামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা করা, হিসেব রাখা এবং নির্দিষ্ট গুদামে সযত্নে তুলে রাখা। আন্তর্দেশীয় এবং অন্তর্দেশীয় বণিকদের চাহিদা অনুযায়ী বানানো সামগ্রী হস্তান্তর করা এবং তার হিসেব রাখা। এছাড়াও ছিল শহরের অধিবাসীদের জন্যে নানান খাদ্য সংগ্রহ করা, তার সঞ্চয় এবং বণ্টন। শহরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গুদামের নিয়মিত দেখভাল করা এবং প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের কাজ। এ ছাড়াও ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা বা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশেষ সংরক্ষণের কাজ।

এরকম নিখুঁত পরিকল্পনার কেজো শহর নির্মাণ যেমন আশ্চর্যের – তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয় এই সভ্যতার কোন শহরেই যা পাওয়া যায়নি - সেটাও! নগর-প্রধান অথবা রাজা কিংবা সমাজপতিদের থাকার যোগ্য, সবার থেকে আলাদা প্রাসাদতুল্য কোন বড় বাড়ির নিদর্শন কোন শহরেই পাওয়া যায়নি! পাওয়া যায়নি কোন দেব বা দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত কোন মন্দির বা ধর্মস্থল মনে করার মতো নকশাদার, সুন্দর সাজানো বাড়ি অথবা ভবনের প্রত্ননিদর্শন। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়ের আলোচনা যথাস্থানে করা যাবে। 

২.৩.৩ খাদ্য সরবরাহ

সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য সরবরাহ হত আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে এবং শহরের বাইরের আবাদি জমিতে চাষ করে। খাদ্যশস্যের মধ্যে ছিল প্রধানতঃ গম, যব, জোয়ার, ভুট্টা এবং কিছু কিছু ধান। নানা রকমের ডাল, ছোলা, মটরের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। অনুমান করা যায় ওই সব আবাদি জমি থেকে নানানধরনের সবজিও সরবরাহ হত। তার কোন নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয় কারণ সব্জি সঞ্চয় করা যায় না এবং তার অবশেষ এতবছর পরে পাওয়া সম্ভবও নয়। ফলমূলও হয়তো খাদ্য ছিল, অন্ততঃ শুকনো ফল হিসেবে খেজুরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ওই অঞ্চলের মেওয়া, যেমন আখরোট, আঞ্জির, খেজুর, পেস্তা আজও বিখ্যাত। আশেপাশের গ্রাম এবং শহরের বাইরের পশুচারণক্ষেত্রগুলি, দুধ, ঘি এবং মাংস সরবরাহ করত।

বড়ো শহরগুলির আবাসন পরিকল্পনা থেকে প্রত্নবিদেরা অনুমান করেন, এক একটি শহরে মোটামুটি বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক বসবাস করতে পারত। এতগুলি লোকের দৈনন্দিন খাদ্য সরবরাহ খুব সহজ কাজ নয়। আশেপাশের গ্রাম এবং শহর সংলগ্ন কৃষিক্ষেত্র থেকে এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপন্ন করত যে কৃষকরা, তারা যে অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ এবং প্রযুক্তিতেও উন্নত ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এমন কথাও ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে, সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকার অনুকূল উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত জলধারায় তারাই প্রথম খরিফ শস্য হিসেবে ধান এবং রবি শস্য হিসেবে গম, ভুট্টা, জোয়ারের চাষ শুরু করেছিল। কারণ ধান সেই সময় ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক শস্য ছিল না, ধান চাষের উৎপত্তি হয়েছিল চিন,  উত্তরপূর্ব এবং পূর্ব ভারতে। প্রসঙ্গতঃ “খরিফ” শব্দটি আরবি শব্দ – যার অর্থ শরৎঋতু, বিজ্ঞানীরা বলেন এই শব্দটি ভারতে এসেছিল মুসলিম বিজেতাদের সঙ্গে। কিন্তু কথাটা সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই জনপ্রিয় হওয়াও অসম্ভব নয়, কারণ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ইরান, মেসোপটেমিয়া (ইরাক) এবং আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল।

সে যাই হোক, একথা স্পষ্ট অনুমান করা যায়, বিস্তীর্ণ সিন্ধুসভ্যতার এতগুলি শহরের এতগুলি মানুষের দৈনন্দিন অন্ন সংস্থানের জন্যে প্রচুর শস্যের প্রয়োজন হত। অতএব এই বিপুল উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের জন্যে সৃষ্টি করতে হয়েছিল বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র। ফলতঃ প্রচুর বনভূমি এবং প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্রকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করতে হয়েছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। যার ফল হয়েছিল মারাত্মক, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা পরে আসবে।  

২.৩.৪ বাণিজ্যই ছিল শহরগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য

শহরগুলির উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নিবিড় বাণিজ্য শৃঙ্খল (Trade chain) গড়ে তোলা। সিন্ধুসভ্যতার সম্পূর্ণ বিস্তারের দিকে চোখ রাখলেই এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বাণিজ্য শৃঙ্খলের প্রধান স্তম্ভ ছিল দুটি, প্রথমতঃ কারিগরি এবং শিল্প কুশলতা এবং দ্বিতীয়তঃ বন্ধুত্বপূর্ণ নিবিড় যোগাযোগ।

কারিগরি এবং শিল্প কুশলতাঃ হরপ্পা সভ্যতার বেশ কয়েকটি সামগ্রী যে গুণগত উৎকৃষ্টতায় সমসাময়িককালে যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং সমাদর পেয়েছিল, সে কথা স্পষ্ট। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা এই শহরগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভজনক (viable) ছিল, তা নাহলে এই শহরগুলির গড়ে ওঠা এবং এতদিন ধরে সগৌরবে টিকে থাকা সম্ভব হত না। সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের শুরু মোটামুটি ৩৫০০ বি.সি.ইতে এবং অন্তিম সময় মোটামুটি ১৭৫০ বি.সি.ই।

রাজস্থান এবং বালুচিস্তান [বালুচিস্তানের লোভনীয় খনিজ ভাণ্ডারের প্রতি আজও চোখ রেখেছে চিন, আমেরিকা এবং পাকিস্তানের সিন্দ ও পাঞ্জাব প্রদেশ] থেকে আসত তামা, টিন আর রূপো। রাজস্থান থেকেই পাহাড়ি নদীর বালু চেলে সংগ্রহ করা সোনা আসত। পশ্চিম ভারত থেকে আসত মূল্যবান পাথর, লাপিস আসত ছাগাই পর্বত বা পামির থেকে। দামি কাঠ, যেমন সেগুন বা মেহ্‌গিনি আসত গুজরাটের অরণ্য থেকে। সুদীর্ঘ সমুদ্র তটরেখা থেকে আসত ঝিনুক, শাঁখ, কড়ি। তাছাড়া সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকায় প্রত্যেকবার বন্যায় জমে ওঠা মিহিন পলিমাটি ছিল মাটির পাত্র বানানোর উপাদান। 

দূর দূর প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করে আনা এই সমস্ত উপকরণ দিয়ে অপূর্ব সব সামগ্রী বানিয়ে তুলত দক্ষ শিল্পী এবং কর্মীরা। এই দক্ষ শিল্পীদের সকলেই কী স্থানীয় ছিল? নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু আন্দাজ করাই যায়। ছাগাই পাহাড় থেকে আনা, খনিজ পাথর কেটে কী ভাবে লাপিস লাজুলির দানা বানাতে হয় এবং পালিশ করে তাকে চকচকে করতে হয়, কী ভাবে শিখে যাবে, হরপ্পার পাশের গ্রামের একটি সাধারণ ছেলে বা মেয়ে? যে জীবনে কোনদিন ওই পাথর হয়তো চোখেই দেখেনি। অথবা রাজস্থানের তামা বা টিনের ইনগট থেকে কীভাবে সেরা ব্রোঞ্জ বানাতে হয়। কী ভাবে কাঠের ছাঁচ বানাতে হয়, সে ছাঁচে গলানো ব্রোঞ্জ ঢেলে কীভাবে বানাতে হয়, অপূর্ব ভঙ্গিমার নারী কিংবা মাতৃকা মূর্তি? তাও কী জানা সম্ভব ছিল স্থানীয় অধিবাসীদের?

অতএব ধরে নেওয়াই যায়, দক্ষ কারিগর এবং শিল্পীদের আনা হয়েছিল, সংলগ্ন সব অঞ্চল থেকে। অন্ততঃ প্রথম দিকে তো বটেই, যতদিন না, স্থানীয় ছেলে বা মেয়েরা, দক্ষ শিল্পী ও কারিগরদের থেকে শিখে নিতে পারে এই কুশলতা।

সেক্ষেত্রে দক্ষ এই শিল্পীদের দল, অবশ্যই বিভিন্ন অঞ্চলের, সমাজের এবং সংস্কৃতির মানুষ। নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কেন এসেছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত এক অঞ্চলে? নিশ্চিতভাবে বলা খুবই কঠিন। তবে ক্রীতদাস হয়ে যে নয়, সেটা হয়তো নিশ্চিত। অনুমান করা যায়, হয়তো লোভনীয় পারিশ্রমিক, গুণের যথোচিত মর্যাদা এবং গভীর আস্থা ও মৈত্রীর টানে।

সে যাই হোক সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান পণ্য ছিল, দামি পাথরের দানা বসানো সোনার অলংকার। হাতির দাঁত, ঝিনুক আর শাঁখ কেটে বানানো নানান অলংকার এবং বিলাসসামগ্রী। মাটি এবং ব্রোঞ্জের অজস্র মূর্তি। মাটির খেলনা, পুতুল। তবে এই সভ্যতার অনন্য নিদর্শন হল, বিচিত্র নকশাকাটা, উজ্জ্বল রঙের চকচকে মাটির নানান পাত্র। সেই সময়ে এই পাত্রগুলি সিন্ধু সভ্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দেশ বা বিদেশের কোন জনপদের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া হরপ্পার মাটির পাত্র কিংবা তার ভগ্নাংশ দেখে, প্রত্নবিদেরা সেই জনপদের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার যোগসূত্র নির্ধারণ করতে পারেন। অন্যান্য জনপদের মাটির পাত্রটি হয়তো হরপ্পার উৎকৃষ্ট পাত্র নয়, তার অনুকরণে স্থানীয় কুম্ভকার বানিয়েছে। কিন্তু তাতেও প্রমাণ হয়, কুম্ভকার অন্ততঃ কয়েকটি হরপ্পার মৃৎ-পাত্র চাক্ষুষ করেছিল।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রের নমুনা -                        


সিন্ধু সভ্যতার মাতৃকা মূর্তি 
 

 

 

বিশেষজ্ঞদের মতে পশুপতি মূর্তি   

 


 

 


দেশের বাইরে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল মেসোপটেমিয়া (ইরাক), পারস্য (ইরান), ওমান, আরব এবং হয়তো আরো পশ্চিমে মিশর পর্যন্ত । এই দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল স্থলপথে এবং জলপথে। বোলান গিরিপথ ধরে স্থলপথের কথা আগেই বলেছি, যে পথে লক্ষলক্ষ বছর ধরে মানব প্রজাতি এবং মানুষের যাতায়াত। আর জলপথ ছিল, সমুদ্রের উপকূল ধরে, পারস্য উপসাগরের পথে। মেসোপটেমিয়া এবং পারস্য উপসাগরের দুপাশের উপকূলে হরপ্পা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। কোন এক মেলুহা দেশ এবং তার অধিবাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার কিছু প্রাচীন লিপিতে। সেই দেশ থেকে তারা হাতির দাঁত, সোনা, নানা দামি পাথরের অলংকার, কাঠ এবং লাপিস আমদানি করত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মেলুহাই হল সিন্ধু সভ্যতা। অতএব এই সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা না বলে – হয়তো “মেলুহা সভ্যতা” বললে – অসাধারণ ওই মানুষদের কৃতিত্বকে আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।   

সফল বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল গুণমান নিয়ন্ত্রণ (Quality control)সোনা বা দামী পাথরের সূক্ষ্ম ওজন থেকে ভারি শস্যের বস্তা ওজনের সরঞ্জাম সবই পাওয়া গেছে এই সিন্ধুসভ্যতায়। বিশেষজ্ঞরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং চানহু-দারো থেকে মোট ৫৫৮টি ছোটবড়ো বাটখারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই বাটখারাগুলির ওজনের মান যথেষ্ট নিখুঁত ছিল। আজকের ১৩.৭ গ্রাম ওজন ছিল তাদের ওজনের একক। এই বাটখারাগুলির অধিকাংশই বানানো হত চুণের ঘনক (lime cube) থেকে। দৈর্ঘ্য মাপার জন্যে হাতির দাঁতের রুলার পাওয়া গেছে, যার একক ছিল ১.৩২ ইঞ্চি বা ৩৩.৫০ মিমি। এই পরিমাপের সূক্ষ্মতা ছিল আশ্চর্যজনক। এই সভ্যতায় ব্যবহার করা যত ইঁট পাওয়া গেছে, এই পরিমাপ অনুযায়ী তাদের ছিল সুনির্দিষ্ট আকার। প্রত্নখননে দাঁড়িপাল্লাও পাওয়া গেছে। তামা কিংবা ব্রোঞ্জ দিয়ে বানানো হত দাঁড়ি (stand বা bar) আর দুপাশের পাল্লা (pans)সার্ভে এবং নির্মাণ কাজের জন্যেও অনেক যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে, যার থেকে বোঝা যায়, এই সভ্যতার মানুষরা কৌণিক পরিমাপেও দক্ষ ছিল। কয়েক হাজার বছর আগে বিশ্‌ভাই পরিমিতির (mensuration and measurement) যে ধারণার সূচনা করেছিলেন, সেই ধারণাই আরও অনেক উন্নত হয়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার সময় কালে।



[1] পঙ্গপাল এক ধরনের ঘাসফড়িং। সাধারণতঃ এরা একা একাই থাকে এবং সে সময় এরা আদৌ বিপজ্জনক নয়। কিন্তু কোন কোন সময়, বিশেষতঃ দীর্ঘ খরার পর প্রচুর বৃষ্টির ফলে, শস্যক্ষেত্র যখন দ্রুত সবুজ হয়ে উঠতে থাকে, তখন এদের মস্তিষ্কে সিরোটিন নামে একটি হরমোনের ক্ষরণ হঠাৎ বেড়ে যায়। যার ফলে এই পতঙ্গের অসম্ভব দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং স্বাভাবিক চরিত্র বদলে এরা দলবদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন দলবদ্ধ কোটি কোটি পতঙ্গের ঝাঁক মেঘের মতো উড়তে শুরু করে এবং যাযাবরের মতো স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। সেই সময় এদের ওড়ার পথে যত শস্যক্ষেত্র পড়ে সেগুলিকে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস করে দিয়ে যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভয়ংকর এই পতঙ্গের উল্লেখ বিশ্বের প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। এই পতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।

[2] আরেকবার মনে করিয়ে দিই, হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিকে আমি “মানুষ” বলে বর্ণনা করছি, এবং তাদের আগেকার প্রজাতিগুলিকে একত্রে “মানব” প্রজাতি বলছি।

[3] লাপিস ও টারকোয়েজ – লাপিস লাজুলি (Lapis Lazuli) বা সংক্ষেপে লাপিস হল গভীর নীলরঙের খনিজ পাথর আর টারকোয়েজ (Turquoise) হল নীলচে-সবুজ রঙের খনিজ পাথর – তামা বা অ্যালুমিনিয়ম ঘটিত ফসফেট যৌগ। এই দুই পাথরই সুন্দর রঙের জন্যে দামি পাথর হিসেবে অলংকারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

[4] হেক্টেয়ার (hectare): ১ হেক্টেয়ার = ১০,০০০ বর্গ মিটার; অর্থাৎ ১০০ হেক্টেয়ার = এক বর্গ কিলোমিটার।


চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

গিরগিটি

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...