মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ২/৪

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে

"ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।

এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে, স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে

ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]


দ্বিতীয় পর্ব - ৪র্থ পর্বাংশ

(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)

 [এর আগের পর্বাংশ পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 - ধর্মাধর্ম - ২/৩ ]


২.৪.৩ আর্যদের ভারতে আগমন

ভারতীয় ইতিহাসে আর্যদের মতো বিতর্কিত বিষয় আর বোধ হয় নেই। তারা কী ভারতেরই লোক, নাকি বহিরাগত। যদি বহিরাগত হয়, তাহলে তারা ঠিক কবে এসেছিল? আসার পথে তারাই সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের কচুকাটা করে রেখে আসেনি তো? কারণ আর্যরাই ভারতে প্রথম ঘোড়া এনেছিল এবং ভারতে আসার আগেই তারা লোহার অস্ত্র ব্যবহার করত। নাকি আসলে তারাই সিন্ধুসভ্যতা গড়ে তুলেছিল? আর্য বলতে কী কোন বিশেষ ভাষা বোঝায় নাকি তারা একটা জাতি? তারা কী ভারত আক্রমণ করে, যুদ্ধ জয় করে ভারতে ঢুকেছিল? নাকি লক্ষ লক্ষ বছরের পরম্পরা অনুসরণ করে ছোট ছোট দলে ভারতে এসে উপনিবেশ গড়ে তুলছিল?

এত বিদগ্ধ বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে, এটুকু ধরে নেওয়া খুব একটা অযৌক্তিক হবে না, যে ভাষায় বেদ রচিত হয়েছিল, এবং সেই ভাষায় যারা কথা বলত তারাই আর্য। আর্যরা ভারতে এসেছিল অন্যান্য অজস্র গোষ্ঠীর মতোই, তাদের ভাষা ভারতের সমসাময়িক অধিবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অবশ্যই বিশিষ্ট। মূলতঃ এই ধারণা নিয়েই আর্যদের ভারতে আসার পর্বটাকে একটু পর্যালোচনা করা যাক।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আর্যদের আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়ায়[1], হয়তো আজকের কাজাকাস্তান, কিরঘিজস্থান বা তাজিকিস্তান অঞ্চলে। আর্যরা উচ্চস্তরের কোন মানব প্রজাতি নয়, তারাও অন্যান্য হোমো স্যাপিয়েন্সদের মতোই শিকারী-সংগ্রাহী যাযাবর জীবনেই অভ্যস্ত ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অন্য মানুষরাও যেমন নতুন এলাকার সন্ধানে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত, আর্যরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বহু শতাব্দী পরের কোন এক সময়ে তাদের মধ্যে দুটি দল মধ্য এশিয়ার দেশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটি দল চলে গিয়েছিল অ্যানাতোলিয়া, তুর্কির দিকে। আরেকটি দল এসেছিল ইরানের দিকে। আরও কয়েক শতাব্দী পরে ইরানে আসা দলটির একটি শাখা রওনা হয়েছিল ভারতের দিকে। ভারতের দিকে যখন তারা রওনা হয়েছিল, তারা তখন ছিল মূলতঃ যাযাবর পশুপালক (pastoral) গোষ্ঠী।

বৈদিক-ভাষার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রাচীন ইরানী ভাষার খুব মিল, কারণ শুরুতে তারা একই গোষ্ঠীর মানুষ ছিল। আবার পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষতঃ উত্তর সিরিয়ার ভাষার সঙ্গেও এই ভাষার বেশ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মোটামুটি ১৪০০ বি.সি.ইতে উত্তর সিরিয়ার দুটি সাম্রাজ্য হিটাইট এবং মিতান্নিস-এর মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির সাক্ষী হিসেবে তারা কয়েকজন দেবতার নাম উল্লেখ করেছিল, যেমন ইন্দারা, মিত্রসিল, নাসাতিয়ানা, এবং উরুবনসিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই চারজন দেবতার মধ্যে অন্ততঃ তিনজন আর্যদেরও দেবতা ইন্দ্র, মিত্র[2] এবং বরুণ। আগেই বলেছি বহু শতাব্দী আগে আর্যদের অন্য একটি শাখা তুর্কির দিকে গিয়েছিল, তার পাশের দেশই সিরিয়া। অতএব আমাদের আর্যরা যে সিরিয়ার আর্যদের জ্ঞাতি, সেটা এই দেবতাদের নামের মিল থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাচীন ইরানী ভাষা থেকেই বৈদিক ভাষার উদ্ভব। কারণ প্রায় সমসাময়িক কালে প্রাচীন ইরানী ভাষার “আবেস্তা” এবং আমাদের আর্যদের “ঋগ্বেদ”-এর মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় – শুধু ভাষাতেই নয়, বিষয়েও। আবেস্তা হল মহান জরথুস্ত্র (Zarathustra) বা জরোয়াস্তার (Zoroaster) ধর্মগ্রন্থ। নিজেদের গোষ্ঠী পরিচয়ে আবেস্তায় বলা আছে তারা “আইরিয়া”, আর ঋগ্বেদে সেই পরিচয় হল আর্য (সঠিক উচ্চারণ আরইয়া)।  দুই ভাষার সব থেকে বেশি অমিল শুধু “হ” এবং “স” অক্ষরের। আবেস্তার হওমা, দাহ, হেপ্তহিন্দু, অহুর, ঋগ্বেদে সোমা, দাস, সপ্তসিন্ধু, অসুর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ঋগ্বেদের দেবতা এবং অসুরের ধারণা, আবেস্তার ধারণার ঠিক উলটো। যেমন আবেস্তায় ইন্দ্র হল “দয়েব” মানে দৈত্য, কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি প্রধান দেবতা - দেব। অহুর মাজদাকে আবেস্তায় পরমেশ্বর মনে করা হয়, অথচ ঋগ্বেদে অসুর মানে দেবতাদের শত্রুপক্ষ।

বিশেষজ্ঞরা এর থেকে অনুমান করেন, প্রাচীন ইরানী এবং এই বৈদিকভাষীরা আগে যদিও একই গোষ্ঠীর মানুষ ছিল, কিন্তু পরে তাদের মধ্যে তীব্র বিবাদ এবং মতভেদ হয়েছিল এবং সেই কারণেই তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার বিদ্বেষেই, আইরিয়ার দৈত্য হয়েছেন আর্যদের দেবতা, আর আইরিয়াদের দেবতাকে আর্যরা অসুর বানিয়েছে। এই সময়ে, বৈদিক আর্যরা বাস করত ইন্দো-ইরান সীমান্তের কাছে, এখনকার আফগানিস্তানের হরক্সবতী (সরস্বতী) নদীর উপত্যকায়। সেখান থেকেই তারা হেপ্তহিন্দু (সপ্তসিন্ধু) উপত্যকার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকেও এই ঘটনার কিছু সূত্র পাওয়া গেছে, ওই অঞ্চলের হরপ্পা সংস্কৃতির কিছু জনপদে। ওই সীমান্তবর্তী কয়েকটি জনপদে বেশ কিছু ঘোড়ার হাড়ের জীবাশ্ম এবং পোড়ামাটির অশ্ব-মূর্তি পাওয়া গেছে। এমন ঘোড়ার মূর্তি, মোটিফ বা তার হাড়ের জীবাশ্ম সিন্ধু সভ্যতার অন্য আর কোথাও পাওয়া যায়নি। ঘোড়া যদি আর্যদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়, ঋগ্বেদের ধর্মীয় প্রথায় যার উল্লেখ বারবার আছে, তাহলে ওই জনপদের মানুষ প্রথম ঘোড়া দেখেছিল এবং আর্যদের সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয়ও হয়েছিল। এই নিদর্শনের সময়কাল ২০০০ বি.সি.ই-র শুরুর দিকে অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার সূর্য যখন অস্তগামী। অতএব তখনও আর্যরা মূল সিন্ধু উপত্যকা এবং মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে।

কয়েকশ বছর ধরে ঋগ্বেদ যাঁরা রচনা করছিলেন, তাঁদের ভৌগোলিক বর্ণনা থেকেও আর্যদের যাত্রাপথ সম্পর্কে বেশ একটা ধারণা করে নেওয়া যায়। পূর্ব আফগানিস্তান, সোয়াৎ উপত্যকা এবং তার পরের পরপর নদীগুলি। সিন্ধু, চিনাব, রাভি, শতদ্রু, বিয়াস, ঝিলাম, গঙ্গা – ঋগ্বেদের সপ্তসিন্ধু। এখানেও লক্ষ্য করার বিষয়, তারা হাকরা নদী দেখতে পায়নি, অথচ সিন্ধু সভ্যতা যখন মধ্য গগনে, তখন হাকরা নদী সিন্ধুর পরেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অর্থাৎ আর্যরা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে যখন ঢুকছিল তার বহুদিন আগেই ২০০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি হাকরা শুকিয়ে গেছে। অতএব আর্যদের ভারতে পদার্পণ মোটামুটি ১৫০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়ে। তার প্রায় আড়াইশ বছর আগে ১৭৫০ বি.সি.ইতে সিন্ধু সভ্যতার সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। ভারতে আসার পথে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাওয়া সিন্ধুসভ্যতার পরিত্যক্ত শহর বা জনপদগুলিও তাদের চোখে পড়েনি। অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেলেও, ঋগ্বেদে এমন ঘটনার কোথাও কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। অতএব তুমুল যুদ্ধ করে আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের নির্বংশ করেছে – এমন কখনোই ঘটেনি।  

২.৪.৪ আর্য উপনিবেশ

আগেই বলেছি, আর্যরা মূলতঃ ছিল পশুপালক (pastoralist) গোষ্ঠী। গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়ার পাল এবং অবশ্যই ঘোড়ার দল নিয়ে, সবুজ তৃণক্ষেত্রের সন্ধানে, তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত। আর যেখানেই চাষযোগ্য জমি পেত, চাষ করে ফসল ঘরে তুলত। তবে নিবিড়ভাবে চাষ করার অভিজ্ঞতা এবং ধৈর্য তাদের বোধহয় ছিল না। প্রথম দিকে তারা ছোট ছোট দলে ভারতবর্ষে ঢুকছিল এবং প্রথমতঃ উত্তর-পশ্চিম উপত্যকায় তারা বসবাস শুরু করেছিল। কিন্তু পিছনে আসতে থাকা দল এবং তাদের পশু সংখ্যার চাপে তারা আরও পূর্বদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পরে গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে এগোতে শুরু করেছিল। এই সময় থেকে পরবর্তী পাঁচশ বছরে ভারতের কোথাও, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমেও, তাদের অস্তিত্বের তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পাননি। ভারতে তাদের এই উপনিবেশ গড়ে তোলার সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদের পরবর্তী রচনাগুলি থেকে।

বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে রচনা করা ঋগ্বেদের সূক্তগুলি, খ্রীষ্টপূর্ব মোটামুটি প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সংকলন করা হয়েছিল। সেই সংকলনই চলে আসছে আজ পর্যন্ত। কিন্তু তার পরবর্তী বেদসমূহের, যেমন সাম, যজুঃ এবং অথর্ব-র রচনাকাল মোটামুটি ৫০০ বি.সি.ই-র মধ্যেই। বেদের সংহিতা পর্ব হল মন্ত্রের সংকলন, ব্রাহ্মণ পর্ব হল যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাখ্যা। বেদের আরও দুটি পর্ব - উপনিষদ এবং আরণ্যক মূলতঃ দার্শনিক তত্ত্ব। বেদের সঙ্কলনে আরও একটি পর্ব প্রায়ই যোগ করা হয় সেটি হল সূত্র। সূত্রের তিনটি বিভাগ, গৃহ্যসূত্র, শ্রৌতসূত্র এবং ধর্মসূত্র। গৃহস্থের বিধি-বিধান ও প্রথার বর্ণনা নিয়ে গৃহ্যসূত্র, শ্রৌতসূত্র হল গোষ্ঠীগত বিধি-বিধান আর ধর্মসূত্র হল বর্ণভেদ আর সামাজিক কর্তব্যের বিধি-বিধান। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এদেশে উপনিবেশ গড়ে তোলার মাত্র কয়েকশ বছরের মধ্যেই আর্যরা ঋগ্বেদের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতেই পরবর্তী বেদগুলি রচনা করেছিল।

শুধু আদর্শ এবং উদ্দেশ্যই নয়, ঋগ্বেদের ভাষা থেকে পরবর্তী সব রচনার ভাষাও অনেকটা বদলে গিয়েছিল। তার কারণ এদেশের পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়া এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠা। আর্যরা এদেশে আসার আগে অনেক বিষয়েই অনভিজ্ঞ ছিল, যেমন লাঙল এবং বলদ দিয়ে চাষ করার প্রথা। গম এবং যবের মতো আরেকটি প্রধান শস্য ধানের সঙ্গেও তাদের পরিচয় ছিল না। বন্য প্রাণীদের মধ্যে সিংহের সঙ্গে তাদের পরিচয় থাকলেও, বাঘ, গণ্ডার কিংবা হাতি তাদের কাছে নতুন। কয়েকশ বছর ধরে তারা এদেশের কৃষি প্রযুক্তি শিখেছে। অনার্যদের নানান পেশার দক্ষতা ও কর্মকুশলতা শিখেছে। এদেশের নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সড়গড় হয়েছে। অতএব পরবর্তী রচনাগুলির ভাষায় অনেক পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করতে হচ্ছিল। অনার্য বহু পরিভাষা এবং শব্দ গ্রহণ করে এবং পরিমার্জিত হয়ে এই ভাষাই হয়ে উঠল সংস্কৃত – যে ভাষার সংস্কার করা হয়েছে। অতএব এখন থেকে আর্যদের ভাষা আর বৈদিক ভাষা নয়, সংস্কৃত। যে ভাষা নিয়ে তারা ইন্দো-ইরান সীমান্ত থেকে ভারতের দিকে রওনা হয়েছিল, সে ভাষা থেকে সংস্কৃত অনেকটাই আলাদা।

মোটামুটি ৫০০ বি.সি.ইতে পাণিণি অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব ব্যাকরণ যে নতুন ভাষাকে সুশৃঙ্খল একটা আকার এবং নিয়মে বাঁধার জন্যেই রচিত হয়েছিল, সেকথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। এই ব্যাকরণ আর্যদের তো বটেই অনার্যদের পক্ষেও সংস্কৃতভাষা শেখা ও বোঝার সুবিধে করে দিয়েছিল। যার ফলে পরবর্তী সময়ে সমাজের উচ্চস্তরের সুশিক্ষিত মানুষরা সংস্কৃত ভাষাতেই কথা বলত। যেমন আজও ভারতের সমস্ত এলিট সমাজ একত্র হলে, ইংরিজিতেই কথা বলে, তাদের মাতৃভাষা তামিল, তেলুগু, বাংলা, অহমিয়া কিংবা গুজরাটি, যাই হোক না কেন। একই ভাবে সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে তারা প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। এই প্রাকৃত ভাষাও সংস্কৃত, কিন্তু তার মধ্যে অনার্য শব্দ এবং বাগ্‌ধারার বহুল ব্যবহার হত, বলাই বাহুল্য। আর্য এবং অনার্য মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ভাষাই ছিল প্রাকৃত। সংস্কৃত ভাষা একদিকে উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে যেমন ঐক্য এনে দিয়েছিল, তেমনি সাধারণ অনার্য তো বটেই এমনকি সাধারণ আর্যদেরও দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কারণ খেটে খাওয়া অধিকাংশ সাধারণ মানুষের পক্ষে জটিল সংস্কৃত ভাষা শেখার মতো সময় ও ধৈর্য কোনটাই ছিল না।

প্রচলিত প্রাকৃত এবং অনার্য ভাষার মিশ্রণে গড়ে ওঠা সংস্কৃত ভাষা, বৈদিক ভাষা থেকে এতটাই দূরে সরে গেল, যে আরও পরবর্তীকালে, কয়েকশ বছরের ব্যবধানে, বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের রচিত ব্যাখ্যা ছাড়া, সাধারণের পক্ষে বেদসমূহ বোধগম্য হত না। এই ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল পণ্ডিত যাস্ক-র “নিরুক্ত” এবং সায়নাচার্যের “সায়ন-ভাষ্য”। তাঁদের ব্যাখ্যা এবং টীকা ছাড়া বেদের – বিশেষ করে ঋগ্বেদের অর্থোদ্ধার অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

 খুব স্বাভাবিকভাবেই এদেশে ধীরে ধীরে ঢুকতে থাকা আর্য দলগুলির সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের বিবাদ এবং দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। সে সব ঘটনার কথা এবং মন্তব্য ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। আবেস্তায় “দাহ” ও “দহ্যু” শব্দদুটির মানে, অন্য লোক। ঋগ্বেদেও স্থানীয় মানুষদের ক্ষেত্রে শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে, দাস এবং দস্যু হিসেবে। সে সময় স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা কৃষি, বাণিজ্য এবং পশুপালনে যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল, সেকারণেই তারা ছিল আর্যদের ঈর্ষার পাত্র। আবার আর্যদের নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেও একদিকে পশু লুঠ করা খুব কৃতিত্ব এবং অন্যদিকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হত। অর্থাৎ যে দলনেতা অন্যদল থেকে পশু লুঠ করে আনতে পারত, নিজের দলে সে হত নায়ক। অন্য দিকে পরাজিত পশু হারানো আর্যগোষ্ঠী তাদের গাল দিয়ে বলত “পনি”।

ঋগ্বেদে বেশ কিছু আর্যগোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যে এমন অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলা আছে। যেমন পশ্চিম পাঞ্জাবে স্থিতু হওয়া ভরত-গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন সুদাস, তাঁর প্রধান দুই পুরোহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ঠ। আর্যদের দশটি গোষ্ঠী একত্র হয়ে ভরতগোষ্ঠীকে আক্রমণ করেছিল রাভি নদীর ধারে, সেই যুদ্ধে সুদাস জয়ী হয়েছিলেন। পশুসম্পদ বাড়ানোর এই লড়াই আর্যরা নিজেদের মধ্যেও যেমন করত, তেমনই করত, দাস অর্থাৎ স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও।

পরবর্তী সময়ে আর্যদের পাঞ্চাল গোষ্ঠী গাঙ্গেয় সমভূমিতে পৌঁছে কুরুগোষ্ঠীর সঙ্গে জোট বেঁধে বেশ বড় এলাকায় প্রভূত প্রতিপত্তি স্থাপন করতে পেরেছিল। তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে বেশ কয়েকমাস ধরে লাগাতার গাভীলুণ্ঠনের অভিযান করেছিল। মহাভারতে তার উল্লেখ আছে এবং কুরু ও পাঞ্চাল মহাভারতের অন্যতম প্রধান দুই আর্যগোষ্ঠী। আর্যদের কাছে গাভী ছিল মহামূল্যবান পশুসম্পদ, গাভীর সংখ্যা দিয়েই কোন গোষ্ঠীর ঐশ্বর্যের বিচার হত। গোহত্যা ছিল বিরল, বিশেষ অনুষ্ঠান এবং বিশিষ্ট অতিথির সম্মানেই গোহত্যা করা হত, যার জন্যে সম্মানীয় অতিথিকে “গোঘ্ন” বলা হত – যাঁর জন্যে গরু হত্যা করা যায়। (সেক্ষেত্রে একথা অনুমান করাই যায়, অতিথির জন্যে গোহত্যা করে, গৃহকর্তা ও তাঁর পরিবার নিশ্চয়ই সেই প্রসাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতেন না।) অন্যদের গাভীসম্পদ লুঠ করাকে পবিত্র কর্তব্য, “গবিষ্ঠি” বলা হত।

এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি ও প্রভাবে এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারাও যথেষ্ট ভাল সংস্কৃত শিখে নিয়েছিল এবং সঠিক বলতেও পারত। এই অঞ্চলের পশ্চিমের এবং পূর্বের বাসিন্দাদের বলা হত “ম্লেচ্ছ”- কারণ তারা সঠিক উচ্চারণে সংস্কৃত বলতে পারত না। সংস্কৃতে এই তিনটি শব্দ - “দাস”, “দস্যু” এবং “ম্লেচ্ছ”-র - পরবর্তী কালে, মোটামুটি খ্রী.পূ. অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীতে - অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যায়। সমাজের নিম্নতম শ্রেণী হয়ে যায়, “দাস”। উপদ্রব সৃষ্টিকারী সমাজের বাইরের লোক হয়ে ওঠে “দস্যু”। আর বেদ ও আর্যদের সামাজিক বিধি না মানা, সমাজের বাইরের লোকেরা হয়ে উঠল “ম্লেচ্ছ” – মানে অপবিত্র।

এর থেকে বোঝা যায়, ততদিনে আর্যরা ওই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের ভালো ভাবেই আয়ত্ত্ব ও অধীনস্থ করতে পেরেছিল। স্থানীয় মানুষদের ওপর তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে পেরেছিল এবং যার ফলে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। যার জন্যে নিরীহ অনার্য “দাস” মানুষেরা হয়ে উঠল ভৃত্যশ্রেণী এবং “দস্যু” ও “ম্লেচ্ছ”রা হয়ে উঠল ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাত্র। অন্যদিকে লড়াকু এবং দুর্দমনীয় বিরোধী অনার্য মানুষেরা তাদের কাছে হয়ে উঠল দৈত্য এবং রাক্ষস। ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পড়তে যাদের সঙ্গে আর্যদের অনেকবারই লড়াই করতে হয়েছিল, এবং আর্যরা বহুবার পরাস্তও হয়েছিল। যদিচ শেষমেষ জিত হয়েছিল আর্যদেরই এবং সমগ্র উত্তর ভারতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে, বৈদিক সংস্কৃতি এবং সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।

 

২.৪.৫ বৈদিক সংস্কৃতি

বৈদিক সংস্কৃতি বা ধর্ম সম্পূর্ণ বেদ-কেন্দ্রিক। বলা হয় বেদের মন্ত্রগুলি অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঐশ্বরিক – কোন জাগতিক মানুষের রচনা নয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য কোন কোন ঋষি এই মন্ত্রগুলির দ্রষ্টা - তাঁদের অন্তরে অনুভব করেছিলেন, স্রষ্টা নন। অতএব সেকালের ঋষিদের কাছে এই মন্ত্রগুলির সঠিক মর্যাদায় সংরক্ষণ ছিল অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। সে সময় যেহেতু লিপি ছিল না, অতএব লিখিত সংরক্ষণেরও কোন উপায় ছিল না। সুতরাং বেদের মন্ত্রগুলি এক প্রজন্মের থেকে নির্ভুল শুনে পরবর্তী প্রজন্মকে নির্ভুল মনে রাখতে হত। এই কারণে বেদের অন্য নাম “শ্রুতি”। শুনে শুনে মনে রাখা অর্থাৎ মুখস্থ করার সুবিধের জন্যে মন্ত্রগুলি ছন্দ বা সুরে গাওয়া হত, প্রত্যেকটি মন্ত্রের নিজস্ব ছন্দও ছিল নির্দিষ্ট। আজও স্কুলের পড়া মুখস্থ করার সময়, আমরা দেখি পদ্য বা ছড়া মুখস্থ করা অনেক সহজ কিন্তু নীরস গদ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ মুখস্থ করা দুঃসাধ্য।

এই মন্ত্রগুলি নির্ভুল মনে রাখার দক্ষতা গোষ্ঠীর সকলের পক্ষে কখনই ছিল না, গোষ্ঠীর কতিপয় মানুষ যাঁরা এই মন্ত্রগুলি বহন করতে পারতেন, তাঁরাই মহর্ষি এবং ঋষি, তাঁরাই পুরোহিত এবং পরবর্তী সময়ে, অতীব সম্মানীয় ব্রাহ্মণ। রণদক্ষ ও পরের পশু লুণ্ঠনকারী বীর যোদ্ধা গোষ্ঠীপতি হলেও, পুরোহিত তাঁর অধীনে নয় বরং তিনিই পুরোহিতের অধীন। প্রথম দিকে বৈদিক সংস্কৃতির এটাই ছিল মূল ধারা। পরবর্তী কালে বৈদিক সমাজেও এর প্রভাব থাকবে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আসবে পরে। 

বৈদিক সংস্কৃতিতে অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান ছিল যজ্ঞ। যজ্ঞে একাধিক পুরোহিত থাকা আবশ্যিক ছিল। যে কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে বেদের মন্ত্রগুলি অত্যন্ত নিষ্ঠায়, সঠিক উচ্চারণে এবং সঠিক ছন্দে অবশ্যই পাঠ করতে হত। আরো সঠিক বললে, বেদের মন্ত্রগুলি গম্ভীর স্বরে এবং নির্দিষ্ট সুরে গাইতেও হত। অগ্নিস্থাপন ছিল যজ্ঞের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। ঋগ্বেদের আগ্নেয় সূক্তের প্রথম মণ্ডলের প্রথম মন্ত্রটির দ্রষ্টা ছিলেন, মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র ঋষি মধুচ্ছন্দ। সেই মন্ত্রটি হল,

ওঁ অগ্নিমীডে[3] পুরোহিতংযজ্ঞস্যদেবমৃত্বিজং। হোতারংরত্নধাতমং।” [সন্ধি ও সমাস ভেঙে নিলে, সূক্তটি বুঝতে কিছুটা সুবিধে হবে, যেমন - ওঁ অগ্নিম্‌ ঈডে পুরোহিতম্‌, যজ্ঞস্য দেবম্‌, ঋত্বিজম্‌ হোতারম্‌, রত্নধাতমম্‌।] সরলার্থ, (আমি এই যজ্ঞে আবাহন করে) অগ্নির অর্চনা করছি। তিনিই (অগ্নিই) এই যজ্ঞের পুরোহিত। (তিনিই এই) যজ্ঞের দেবতা, (তিনিই) হোতাদের মধ্যে ঋত্বিক। তিনিই সর্ব(রত্ন)ফল[4]দাতা।

কথিত আছে, মনে মনে সূর্যকে স্মরণ করে, মহর্ষিরা এই মন্ত্র উচ্চারণ করলেই যজ্ঞের অরণিতে নিজে নিজেই অগ্নিসঞ্চার হয়ে যেত। আর তা নাহলে বোঝা যেত ঋষির মন্ত্র উচ্চারণে কোন ত্রুটি আছে, অথবা যজমান –অর্থাৎ যাঁর জন্যে যজ্ঞের আয়োজন তাঁর কোন পাপ বা অপরাধ ঘটে গেছে।

সে যাই হোক, যজ্ঞ যেহেতু বৈদিক ধর্মের প্রধানতম অনুষ্ঠান, অতএব তার প্রতিটি পদে নিয়ম, বিধি-বিধানের শৃঙ্খল ছিল কঠোর। যে কোন যজ্ঞের অনুষ্ঠান হত ত্রিবেদী – অর্থাৎ তিনটি বেদের মন্ত্র উচ্চারণে যজ্ঞ সম্পন্ন করা হত, ত্রিবেদ পাঠের জন্যে তিনজন পুরোহিত আবশ্যিক। ঋক পুরোহিত যজ্ঞের দেবতাদের স্তব বা প্রার্থনা করে আবাহন করতেন, আবাহন শেষে ঋক, যজুঃ এবং সাম পুরোহিতরা যজ্ঞে আহুতি দিতেন। আর পুরো অনুষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন অথর্ব পুরোহিত।

একমাত্র অশ্বমেধ যজ্ঞ ছাড়া সব যজ্ঞেই অগ্নি ছিল আবশ্যিক। যে কোন যজ্ঞে তিনটি অগ্নির প্রয়োজন হত –গার্হপত্য, আহ্বনীয় ও দক্ষিণাগ্নি। গৃহে গার্হপত্য অগ্নি সর্বদা জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম। যজ্ঞের সময় এই গার্হপত্য-অগ্নি থেকে যজ্ঞের অগ্নি আহুত অর্থাৎ গৃহীত হত বলেই আহ্বনীয় অগ্নিতে প্রধান হোমের অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। দক্ষিণাগ্নিও গার্হপত্য অগ্নি থেকে গ্রহণ করা হত এবং যজ্ঞের সময় যজ্ঞবেদীর দক্ষিণ দিকে স্থাপনা করা হত। যে ব্রাহ্মণের গৃহের গার্হপত্য অগ্নি থেকে যজ্ঞের আগুনগুলি সংগ্রহ করা হত, তাঁদের অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ বলা হত, যজ্ঞে তাঁর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

বহু বছর আগে থেকেই মানুষ দৈনন্দিন কাজে আগুনকে আয়ত্বে এনে ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু একবার নিভে গেলে আগুন জ্বালিয়ে তোলা ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিল না। চকমকি পাথর-ঘষা স্ফুলিঙ্গ থেকে শুকনো পাতায় আগুন ধরাতে যথেষ্ট দক্ষতা এবং ধৈর্যের প্রয়োজন হত, বিশেষ করে বর্ষার সময়। সেই কারণে যে কোন গ্রামেই সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে সর্বদাই আগুন সংরক্ষণ করা হত। আগুন সংরক্ষণ যথেষ্ট বিপজ্জনক, কারণ অসাবধানে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারত। সেই কারণেই বাড়ির বিশেষ কোন নিরাপদ ঘরে, খুব ছোট প্রদীপ বা ছোট্ট উনুন সর্বদা জ্বালিয়ে রাখা হত। অনার্য গ্রামেও আগুন সংরক্ষণের এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই সংরক্ষিত আগুনকেই সংস্কৃতে নাম দেওয়া হয়েছিল গার্হপত্য অগ্নি –গৃহপতির অগ্নি। মন্ত্রবলে আগুন জ্বালানোর ঝুঁকি না নিয়ে, সেই আগুনেই সর্বদা যজ্ঞে অগ্নি সংযোগ করা হত।

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য যজ্ঞের মধ্যে একটি অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। যিনি যজ্ঞের জন্যে অগ্নি সংরক্ষণ করতেন, সেই অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণকে দিনে দুবার-সকালে ও সন্ধ্যায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হত। সংরক্ষিত আগুনের সীমিত দহনকে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যেই দুবেলা নিয়মিত লক্ষ্য রাখাই ছিল এই যজ্ঞের মুখ্য উদ্দেশ্য। এরপর ছিল দশপৌর্ণমাস যজ্ঞ, প্রত্যেক পূর্ণিমা এবং অমাবস্যায় এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হত। চাতুর্মাস্য যজ্ঞ, প্রত্যেক প্রধান ঋতু, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও বসন্তর শুরুতে এই যজ্ঞ করা হত। বসন্ত কালে আরেকটি যজ্ঞ করা হত তার নাম অগ্নিষ্টোভ যজ্ঞ এবং নতুন শস্য বা ফসল তোলার পর অগ্রহায়ণ যজ্ঞ করা হত। এই যজ্ঞে উৎপন্ন শস্য নিবেদন বা আহুতি দেওয়া হত। প্রবজ্ঞ যজ্ঞ – এই যজ্ঞ অশ্বিনীকুমার দেবতাদের যজ্ঞ, অগ্নিতে ছাগলের দুধ আহুতি দেওয়া হত। কোন রাজা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলে বাজপেয় যজ্ঞ করার নিয়ম ছিল। এরকম আরেকটি যজ্ঞ ছিল রাজসূয় যজ্ঞ। এই যজ্ঞ করতেন প্রবল ক্ষমতাশালী রাজারা, প্রতিবেশী এবং সকল অধীনস্থ রাজাদের নিমন্ত্রণ করে এই যজ্ঞের আয়োজন ছিল এলাহী ব্যাপার।

সে যুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ করাটা খুব বড়ো একটা সম্মান ও প্রতিপত্তির বিষয় ছিল। এই যজ্ঞ সেই সব মহারাজারাই করতেন, যাঁদের প্রতিবেশী রাজ্যের রাজাদের ওপরেও অবিসম্বাদিত আধিপত্য থাকত। নির্দিষ্ট শুভদিনে একটি ঘোড়াকে সামনে রেখে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল বের হয়ে পড়ত। তারা বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়াত এবং বশীভূত রাজাদের থেকে প্রভূত সম্পদ দান হিসেবে আহরণ করত। কোন রাজা ওই ঘোড়াকে আটকালে বা কোন দান না দিলে, সেনাবাহিনী ওই রাজাকে পরাস্ত করত এবং ওই রাজ্য থেকে সম্পদ আহরণ (লুঠ) করে নিয়ে আসত। সেনাবাহিনী সেই রাজাকে পরাস্ত করতে না পারলে, অশ্বমেধ যজ্ঞকারী মহারাজা আরো বড়ো সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ওই বিরোধী রাজার চূড়ান্ত সর্বনাশের ব্যবস্থা করতেন। সেই আতঙ্কেই প্রায় সমস্ত ছোট ছোট রাজ্যের রাজারা ঝামেলা এবং বিপদ এড়াতে দান দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতেন। নানান দিকের নানান রাজ্য ঘুরে ঘোড়া আবার স্বরাজ্যে ফিরে এলে, সেই ঘোড়াকে মেধ অর্থাৎ বলি দিয়ে বিপুল ব্যয়বহুল যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা হত।

বৈদিক সংস্কৃতিতে দেবতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। বেদের দেবতাদের তিনটি কোটি বা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন

১) পৃথ্বীস্থান-দেবতা অর্থাৎ পার্থিব দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেন, অগ্নি, পৃথ্বী, সোম এবং বৃহষ্পতি। অগ্নি ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা, তাঁর উদ্দেশে প্রায় দুশটি মন্ত্র আছে। আবার অন্য অনেক দেবতাদের সঙ্গেও অগ্নির স্তব আছে। পৃথ্বীর উদ্দেশে একটি মাত্র মন্ত্র পাওয়া যায়। সোমদেবের উদ্দেশে প্রায় একশ চোদ্দটি মন্ত্র পাওয়া যায়। সোমদেব বলতে চন্দ্র এবং সোমলতার কথাও বলা হয়েছে। সোমলতারও আরেক নাম অংশু। বলা হয় সোমলতা দ্যুলোকে ছিল এবং পৃথিবীতে এনেছিল কোন পাখি। আবার সোম যখন চন্দ্র তিনি দুই হাতে অস্ত্রচালনা করতে পারেন এবং যুদ্ধের সময় তিনি সর্বদাই ইন্দ্রের সঙ্গে একই রথে থাকেন। ঋগ্বেদে বৃহষ্পতির উদ্দেশে এগারোটি মন্ত্র আছে। বৃহষ্পতিকে অনেক পণ্ডিত অগ্নিরই আরেক রূপ বলে থাকেন।

২) অন্তরীক্ষস্থান-দেবতা অর্থাৎ আকাশের দেবতাদের প্রধান হলেন ইন্দ্র, পর্জন্য, রুদ্র এবং মরুৎ। ঋগ্বেদে ইন্দ্র হলেন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা, তাঁর নামে প্রায় আড়াইশটি মন্ত্র আছে। তিনি হিরণ্যবর্ণ। তাঁর রথ সোনার তৈরি এবং সে রথ মনের থেকেও দ্রুতগামী। সকল দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রই সব থেকে বেশি সোমপান করতেন। ইন্দ্র ছিলেন মহাযোদ্ধা, তিনি বৃত্র, ত্বষ্টা, সুশনা, নমুচি, শম্বর প্রমুখ অনেক দৈত্য এবং রাক্ষসদের হত্যা করেছিলেন। পর্জন্য হলেন বৃষ্টির দেবতা, তাঁর উদ্দেশে মাত্র তিনটি মন্ত্র পাওয়া যায়। রুদ্রর উদ্দেশেও মাত্র তিনটি মন্ত্র পাওয়া যায়। রুদ্র একদিকে বিনাশ করেন আবার অন্যদিকে ভক্তদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। মরুতের উদ্দেশে তেত্রিশটি মন্ত্র পাওয়া যায়। মরুতও বৃষ্টি, মেঘ ও বজ্রের দেবতা।

৩) দ্বৌস্থান-দেবতা অর্থাৎ স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেন বরুণ, সবিত্র, বিষ্ণু, পূষণ। বরুণের উদ্দেশে বারোটি মন্ত্র আছে। তাঁর সহস্র চোখ। বরুণের অসীম শক্তি – তিনিই আকাশের বিস্তার দিয়েছেন, অশ্বের শক্তি দিয়েছেন, গাভীতে দুধ দিয়েছেন, দ্যুলোকে সূর্য দিয়েছেন এবং পাহাড়ে সোম(লতা) দিয়েছেন। তিনি স্বর্গ থেকে সকলের পাপ-পুণ্য, দোষ-গুণের হিসাব রাখেন এবং পাপীদের পাশবদ্ধ করেন। সবিত্রের উদ্দেশে এগারোটি মন্ত্র আছে। উদীয়মান সূর্যই সবিত্র, তিনি সকল অন্ধকার দূর করেন। ঋগ্বেদের ছটি মন্ত্র বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয়েছে। সূর্যকিরণের সঙ্গেই বিষ্ণুর প্রকাশ। সর্বদাই অমৃতধারা উৎসারিত হয় যে চিরন্তন বিষ্ণুলোকে, ভক্তরা সেখানেই যাওয়ার কামনা করেন। আটটি মন্ত্র আছে পূষণের উদ্দেশে। পূষণও উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে প্রকাশিত হন। পূষণ সকল জীব ও জড়ের দেবতা।

২.৪.৬ ব্রাহ্মণ্য সমাজ

পশ্চিম থেকে পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি বরাবর উপনিবেশ গড়তে আর্যদের খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কারণ সে সময়ে লড়াই করে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি স্থানীয় অধিবাসীদের ছিল না। বহুদিন আগে থেকেই কৃষি নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায়, তাদের শিকারী-সংগ্রাহী মানুষদের মতো লড়াকু স্বভাব আর ছিল না। তাছাড়া, ব্যপ্ত এই দেশের প্রায় সর্বত্র ছিল অফুরন্ত কৃষিজ, বনজ, খনিজ এবং প্রাণীজ সম্পদ - তুলনায় জনসংখ্যা ছিল নগণ্য। অতএব যুদ্ধ করে প্রতিবেশী অঞ্চলগুলিকে অধিকারে এনে নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর যে প্রবল প্রচেষ্টা, আমরা পরবর্তী যুগে দেখতে পাবো, সেই মনোভাবও তাদের ছিল না। নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো লড়াই নিশ্চয়ই হত, কিন্তু সত্যিকারের যুদ্ধ করার মতো মানসিকতা তাদের ছিল না বলেই মনে হয়।      

 অপর পক্ষে আর্যরা এল ঘোড়া ছুটিয়ে বজ্রের মতো ধারালো এবং সাংঘাতিক কঠিন লোহার অস্ত্র – বর্শা, তীর-ধনুক নিয়ে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তরোয়াল এবং খড়্গ নিয়ে - লড়াই করতে। তাদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে প্রাণ হারানো বা আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় রইল না। পালিয়েই বা যাবে কোথায়, গভীর অরণ্যে গিয়ে তারা করবে কী? তাদের পক্ষে শিকারী-সংগ্রাহী জীবনে আবার ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না, যে কোন অরণ্যকে রাতারাতি আবাদী জমি করে তোলা। অতএব আর্যদের অধীনতা মেনে নিতে তারা বাধ্য হল। তাদের বশ্যতায় আর্যদেরও সুবিধা হল খুব। এত জমি চাষ-আবাদ করার মতো তাদের জনবল কোথায় এবং যেটুকু জনবল আছে তাদের এত জমি চাষ করার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাই বা কোথায়?

এই সময়েই নতুন সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈদিক সমাজ এবং বৈদিক আদর্শ থেকে আর্যদের অনেকটাই সরে আসত হল। এতদিন তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে খুব একটা বৈষম্য ছিল না। গোষ্ঠীপতি বা পুরোহিতের স্থান অনেক বেশি সম্মানীয় হলেও গোষ্ঠী বা পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা এবং অধিকার মোটামুটি সমানই ছিল। এখন গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে লক্ষ্য দিতে হল বৃহত্তর সমাজ গড়ায়। যে সমাজে মোটামুটি সকলের স্থান, মর্যাদা এবং কাজ বা দায়িত্বের সীমানাও স্থির করে দেওয়া হল। আমার মনে হয়, শুধু ভারতের অনার্য অধিবাসীরা নয়, আর্যরাও এরকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা এর আগে কোনদিন দেখেনি। সমাজের শ্রেণীভেদ অনার্যদের মধ্যেও ছিল, সেকথা আগেই বলেছি। কিন্তু সে ছিল অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ - ধনী, মধ্যবিত্ত, বণিক এবং দরিদ্র – কিন্তু সে বিভেদ সমাজপতিদের আরোপিত বিধি নিষেধের বিভাজন নয়।

অভূতপূর্ব এই সামাজিক বিন্যাসের শীর্ষে রইল ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা হল – যিনি ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পরমজ্ঞান লাভ করেছেন। ব্রাহ্মণদের প্রধান কর্তব্য হল, পৌরোহিত্য অথবা যাজন এবং অধ্যাপনা। পরবর্তী সামাজিক অবস্থানে রইল ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়দের কর্তব্য-ধর্মযুদ্ধ করা। নিজের এলাকার অধিকার নিরাপদ আয়ত্ত্বে রাখা। প্রয়োজনে এবং যথেষ্ট শক্তিশালী হলে অন্য এলাকা জয় করা। সুযোগ পেলেই পরস্বাপহরণ এবং পশ্বপহরণ। অতএব একজন ক্ষত্রিয়ই হতে পারেন একটি দলের বা গোষ্ঠীর দলপতি বা রাজা – যিনি অবশ্যই ক্ষত্রিয়র সমস্ত কর্তব্য পালন করবেন এবং প্রজাদের ন্যায়-অন্যায় বিচার করবেন। রাজাকে সহায়তা এবং পরামর্শ দেবেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত।

মহাভারতের এমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলে, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে,

কোন এক সময় অজুর্নের সঙ্গে যুদ্ধে গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ পরাস্ত হন, তার পরে তাঁদের মধ্যে অবিশ্যি সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই গন্ধর্বরাজ এবং অর্জুনের কথোপকথনের কিছুটা এখানে তুলে ধরছি,  

অর্জুন বললেন, “হে গন্ধর্বরাজ, আমি তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্র দান করে, তার প্রতিদানে তোমার গন্ধর্বজ অশ্ব গ্রহণ করব। কিন্তু আমার মনের একান্ত ইচ্ছা, আমাদের সখ্যতা যেন চিরস্থায়ী হয়। হে বন্ধু, যে কারণে আমরা তোমাদের ভয় পাই, আমরা বেদবিদ্‌ সাধু চরিত্রের লোক হওয়া সত্ত্বেও, রাত্রিকালে নদীতীরে আসার জন্যে, তুমি আমাদের যেভাবে অপমান ও তিরষ্কার করলে, তার কারণ কী? একথা আমাদের খুলে বল।”

গন্ধর্বরাজ বললেন, “হে অর্জুন, তোমরা অন্ধকারে অগ্নিহীন হয়ে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছ, তোমাদের সঙ্গে কোন ব্রাহ্মণও নেই, সেই জন্যেই আমি তোমাদের অপমান ও তিরষ্কার করেছিলাম। তা না হলে, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, পিশাচ, উরগ এবং দানবেরাও কুরুবংশের কীর্তি কীর্তন করে থাকে। নারদ প্রমুখ দেবর্ষিদের মুখেও তোমার পূর্বপুরুষদের গুণের বর্ণনা শুনেছি। ত্রিলোক বিখ্যাত দ্রোণ, যাঁর কাছে তোমরা বেদ ও ধনুর্বেদ শিখেছ, তিনিও আমার অত্যন্ত পরিচিত। দেবপ্রধান ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও দুই অশ্বিনীকুমার এবং নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু তোমাদের পিতা – তাঁদের সকলকেই আমি জানি। তোমরা অতি সচ্চরিত্র, মহাত্মা ও মহাবীর; তোমাদের সঙ্কল্প এবং অধ্যবসায়ের কথা জেনেও, আমি তোমাদের অপমান ও তিরষ্কার করেছিলাম। হে অর্জুন, আমি তখন সস্ত্রীক ছিলাম এবং রাত্রে আমাদের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে। যে কোন বীরপুরুষ স্ত্রীর সামনে অপমানিত হলে, ক্ষমা করতে পারে না। এই কারণেই আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। হে বীর, তুমি আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছ ঠিকই, কিন্তু যে কারণে তুমি জয়ী হয়েছ, সে কথা বলছি শোন।

ব্রহ্মচর্য সবার থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তুমি সেই ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছ বলেই, তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারলে। যে ক্ষত্রিয় কামনার বশ, সে রাত্রে যুদ্ধ করলে কখনো নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারে না। হে তাপত্য[5], যিনি সনাতন বেদশাস্ত্র পাঠ করে, পুরোহিতের উপর সমস্ত কাজের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন, তিনি সমস্ত নিশাচরকে অবশ্যই পরাস্ত করতে পারেন। ইহলোকে যে যে বিষয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের সম্ভাবনা, সেই সকল বিষয়ে ইন্দ্রিয়দমনশীল পুরোহিতের নিয়োগ অবশ্য কর্তব্য। ষড়ঙ্গ[6] বেদজ্ঞানী, অতি পবিত্র, সত্যবাদী, ধর্মাত্মা ও সুধীর ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ রাজাদের পুরোহিত হয়ে থাকেন। রাজারা পুরোহিতের সাহায্য নিলে বহুকাল নিশ্চিন্তে রাজ্যপালন করতে পারেন”। [আদি পর্ব/১৭০ অধ্যায়]

অতএব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতো বিচক্ষণ রাজা এবং ভীম ও অর্জুনের মতো মহা পরাক্রমী বীর ক্ষত্রিয়দেরকেও উপদেষ্টা পুরোহিতের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল, তিনি ঋষি আয়োদধৌম্য।  

ক্ষত্রিয়র নীচে সামাজিক অবস্থান হল বৈশ্যদের। বৈশ্যদের কর্তব্য হল কাজ করা, সে কাজের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। কৃষক, বণিক, বিভিন্ন পেশার মানুষ, সূত্রধর, কর্মকার, কুম্ভকার, স্বর্ণকার। তাদের দায়িত্ব সমাজের সকলের অন্নসংস্থান করা, প্রয়োজনীয় সামগ্রী বানানো, অলংকার, বিলাসদ্রব্য তৈরি করা। উদ্বৃত্ত সামগ্রী বাণিজ্য করে রাজ্যের এবং রাজার অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করা।

সমাজের নিম্নতম স্তরে রইল শূদ্র। শূদ্রদের কর্তব্য সমাজের ঊর্ধতন তিন শ্রেণীর সেবা করা। তারা যে শূদ্রদের তুলনায় অনেকটাই উচ্চশ্রেণীর মানুষ, সমাজে সেই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের উপনয়নের অধিকার দেওয়া হল।

২.৫.১ চতুর্বর্ণাশ্রম 

ব্রাহ্মণ্য সমাজের এই চারটি শ্রেণী – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র - বিন্যাসকে চতুর্বর্ণাশ্রম বলা হয়ে থাকে। এই বর্ণ মানে কি রঙ? চলন্তিকা অনুযায়ী – বর্ণ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে – রঙ, অক্ষর (যেমন স্বরবর্ণ ইত্যাদি), এবং জাতি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি)। শব্দকোষের বক্তব্যও প্রায় একই।

তাহলে কী এই শ্রেণী বিভাগ ত্বকের রঙ দেখে করা হয়েছিল? সেক্ষেত্রে আর্য ব্রাহ্মণ – যারা সারাদিন গাছের ছায়ায়, কুটিরে বসে বেদচর্চা করত, তাদের গায়ের রঙ গৌরবর্ণ (? গোধূমবর্ণ)। আর্য ক্ষত্রিয়দেরও একই গায়ের রঙ হওয়ার কথা - কিন্তু রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের যুদ্ধ শিখতে হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে চোট-আঘাত সহ্য করতে হয়েছে – অতএব তাদের গায়ের রঙ তামাটে (তাম্রাভ) হতে পারে। সমাজের দক্ষ কাজের মানুষরা বৈশ্য - তাদের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন অনার্য - তাদের গায়ের রঙ ছিল কালো (কৃষ্ণ)। শুদ্রদের সকলেই অনার্য – তাদেরও গায়ের রঙ কালো। ত্বকের এই বর্ণ বিচার করেই কি ব্রাহ্মণরা চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছিল? নাঃ, ব্যাপারটা এত সহজ ও সরল বলে মনে হয় না।

সংস্কৃতে একটি ক্রিয়াপদের মূল বা ধাতু হল, বৃ। ব্যাকরণ কৌমুদীতে এই বৃ ধাতুর অর্থ দেওয়া আছে to chooseবৃ-ধাতুর সঙ্গে নানান প্রত্যয়ের যোগসাজসে অনেকগুলি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ল্যুট্‌ প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়েছে বরণ বা বরণম্‌। যার অর্থ বরণ করা, সসম্মানে গ্রহণ করা  – যেমন বধূবরণ, পতিত্বে বরণ। কিংবা কোন বিশেষ উদ্দেশে কষ্ট স্বীকার করা, যেমন কারাবরণ। ক্ত-প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়ে যায় বৃত, যার অর্থ নির্বাচিত, মনোনীত, সিদ্ধান্ত-কৃত (selected, decided)যদিচ বৃ-ধাতু থেকে কোন প্রত্যয় যোগ করে, “বর্ণ” শব্দে পৌঁছানো যায় – এমন কোন সূত্র ব্যাকরণ কৌমূদীতে মেলেনি। তবু আমার ধারণা, এই শব্দগুলি ব্রাহ্মণদের সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। ব্রাহ্মণরা অনেক বিচার-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবং নির্বাচন করেছিল, সমাজের কোন স্তরে থাকবে আর্যরা এবং অনার্যদের কোথায় স্থান দেওয়া হবে।

এই প্রসঙ্গে  অনেক বিতর্ক ও  আলোচনার অবকাশ রয়ে গেল। অতএব এ প্রসঙ্গের এখানেই সমাপ্তি হোক। আমরা বরং মেনেই নিই, অন্যান্য অর্থের সঙ্গে বর্ণ শব্দের মানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি জাতি।

এবার আমরা  চোখ ফেরাই, নিজেদের মনোমত বর্ণ-ব্যবস্থা গুছিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ ঠিক কেমন সমাজ গড়ে তুলল। আর এই সমাজ ব্যবস্থা ভারতের কোন কোন অঞ্চলকে কতখানি প্রাভাবিত করল। এই বিষয়ে আমি “মহাভারত”-এর মতো মহাকাব্যকেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরেছি। অতএব মহাভারত এই বিষয়ে আমাদের কতখানি সাহায্য করতে পারে সেটাও দেখে নেওয়া যাক।


২.৫.২  ভারতে আর্যদের প্রাথমিক বিস্তার

১৫০০ বি.সি.ই-তে ভারতে পা রেখে, মোটামুটি গুছিয়ে বসে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে আর্যদের চার-পাঁচশ বছর চলেই গেল। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। যদিও প্রাথমিক ভাবে আর্যরা গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণদিকে তখনও সম্ভবতঃ আসেনি। সে সময় আর্যাবর্তের সীমানা ছিল যমুনা নদী থেকে পূর্বদিকে বঙ্গ[7]র সীমানা পর্যন্ত। দক্ষিণে গঙ্গা এবং উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত তরাই অঞ্চল। এই সময়কার প্রত্ন-নিদর্শনেও কিছু কিছু শহরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেমন হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র, কাশি, বিদেহ এবং কৌসাম্বী। এই জনপদগুলির সময়কাল ঐতিহাসিকরা বলেন ৯০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই-র কোন সময়ে। প্রত্নখননে, কিছু PGW-এর টুকরো, কিছু তামার যন্ত্রপাতি, সামান্য কিছু লোহার টুকরো, আর রোদে-পোড়া ইঁটে বানানো বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এখন হস্তিনাপুরের নাম শুনলেই আমাদের মহাভারতের কথা মনে পড়ে যায়। মহাভারতের সব ঘটনাই কী তাহলে ঐতিহাসিক?

ঐতিহাসিকেরা সিদ্ধান্ত করেছেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়কাল খ্রী.পূ. নবম শতাব্দীর কোন এক সময়ে। কিন্তু মহাভারতে কুরু এবং পাণ্ডব রাজাদের যে জৌলুষ এবং জাঁকজমকের বর্ণনা পাওয়া যায়, (ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের নতুন জমকালো প্রাসাদের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজা দুর্যোধন ও তাঁর ভাইদের অত্যন্ত অপদস্থ হতে হয়েছিল এবং তাঁরা ঈর্ষায় জ্বলে গিয়েছিলেন!) তার তুলনায় প্রত্নখননে পাওয়া অবশেষ অতীব সাধারণ এবং গুরুত্বহীন। তবে কুরুগোষ্ঠী, পাঞ্চালগোষ্ঠীর নাম অন্যান্য বেদের “ব্রাহ্মণ” অংশে, পুরাণ ও অন্যান্য শাস্ত্রে পাওয়া যায় এবং কুরু রাজাদের মধ্যে পরীক্ষিৎ এবং জন্মেজয়েরও নাম পাওয়া যায়। মহাভারতের প্রধান দুই চরিত্র –যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন - হয়তো প্রতীকী চরিত্র, পুরোটা না হলেও অনেকটাই কাল্পনিক। কারণ কর্ণ ও যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চপাণ্ডব এবং দুর্যোধন সহ শত-কৌরব ভাই ও এক বোনের জন্মবৃত্তান্ত খুবই অস্বাভাবিক। তাছাড়া তাঁদের নামগুলি, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকট, দুরাধন, দুঃশলা ইত্যাদি এবং তাঁদের মামা শকুনি, যেন চরিত্রগত নাম! কোন বাবা-মায়ের পক্ষে জন্মের সময়েই তাঁদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে কী চরিত্রের হবে বুঝে নিয়ে প্রত্যেকের এমন সব মোক্ষম নাম দেওয়া সম্ভব?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যদি খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর কোন সময় হয়ে থাকে, তাহলে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকেও সমসাময়িক হতেই হবে। কারণ সমগ্র মহাভারতে এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ঘটে ওঠার পেছনে বেদব্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। তিনিই ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা, অর্থাৎ কৌরব এবং পাণ্ডবদের পিতামহ। পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব সুবিদিত এবং সঠিক সময়ে জ্যেষ্ঠ নপ্তা যুধিষ্ঠির এবং পুত্রবধূ কুন্তীকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়ে সঠিক পথে চালনা করেছেন বারবার। কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়ের পশ্চাৎপটে তাঁর অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রচলিত প্রবাদ ও তথ্য অনুযায়ী এই বেদব্যাসই বেদের সংকলক এবং মূল মহাভারত মহাকাব্যের রচয়িতা। অতএব এই সংকলন এবং রচনা - দুটোই খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর ঘটনা হওয়া উচিৎ। ঋগ্বেদের সংকলন তিনি পরিণত বয়সে করেছিলেন আর মহাভারত রচনা করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, তিনি শ্রুতিলিখনে (Dictation) গণপতিদেবকে দিয়ে মহাভারত লিখিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে, কোন লিপিতে লিখিয়েছিলেন? ভারতবর্ষের প্রথম যে লিপির ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, সে লিপি ব্রাহ্মীলিপি এবং তার ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন মৌর্য সম্রাট অশোক, তাঁর রাজত্বকালে। ব্রাহ্মীলিপির সীমিত প্রচলন তার আগেও নিশ্চিত ছিল, বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং রাজকোষগুলিতে (Treasury) – স্থূল আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্যে। মনের ভাব প্রকাশ অথবা জনগণকে লিখিত নির্দেশ দেবার জন্যে এই ভাষার প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সম্রাট অশোক। অন্ততঃ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে সে কথাই প্রমাণ হয়। তার আগে, বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগ এমনকি বুদ্ধদেবের সময়েরও কোন লিপির নিদর্শন আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে কোথাও পাওয়া যায়নি। অতএব এই সময়ে বেদ সংকলিত এবং মহাভারত রচনা হলেও, ওই সময়েই লেখা হয়েছিল কিনা, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলার কোন অবকাশ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মহাভারতের কাহিনী শুরুই হয়েছে, একজনের আবৃত্তি এবং অনেকের শোনার মধ্যে দিয়ে, যেমন, -

কোন সময়ে নৈমিষ্যারণ্যে কুলপতি শৌনক দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। একদা মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম সমাধানপূর্বক সকলে সমবেত হইয়া কথা প্রসঙ্গে সুখে অধ্যাসীন হইয়া আছেন, ইত্যবসরে লোমহর্ষণ-পুত্র পৌরাণিক সৌতি অতি বিনীতভাবে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। নৈমিষ্যারণ্যবাসী ঋষিগণ তাঁহাকে অভ্যাগত দেখিয়া অত্যাশ্চর্য কথা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। উগ্রশ্রবাঃ সৌতি কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাদিগকে অভিবাদন করিয়া তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারাও অতিথির যথোচিত পূজা করিয়া বসিবার নিমিত্ত আসন প্রদানপূর্বক আপনারাও যথাস্থানে উপবেশন করিলেন। অনন্তর সৌতি নির্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট হইলে ঋষিরা তাঁহাকে বিশ্রান্ত দেখিয়া কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে কমললোচন সূতনন্দন! এখন কোথা হইতে আসিতেছ এবং এত কাল কোন্‌ কোন্‌ স্থানেই বা পর্য্যটন করিলে, তাহা আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বল”। সৌতি এরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে অতি শান্ত প্রকৃতি ঋষিদিগের সমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “হে মহর্ষিগণ! আমি মহাত্মা জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে গমন করিয়াছিলাম। তথায় বৈশম্পায়নের মুখে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন-প্রোক্ত মহাভারতীয় কথা শ্রবণ করিলাম। অনন্তর তথা হইতে প্রস্থান করিয়া বহুবিধ তীর্থ দর্শন ও অনেক আশ্রমে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে সমন্তপঞ্চক তীর্থে উপস্থিত হইলাম; - পূর্ব্বে যথায় কুরু ও পাণ্ডব এবং উভয়পক্ষীয় ভূপালদিগের তুমুল সংগ্রাম হইয়াছিল। তথা হইতে আপনাদিগের দর্শনার্থে এই পবিত্র আশ্রমে আসিয়াছি”।... (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের মূল সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত – বানান অপরিবর্তিত।)

উপরের উদ্ধৃতিটুকু মহাভারতের আদিপর্বের – অনুক্রমণিকা অধ্যায়ের, প্রথম স্তবক থেকে নেওয়া। এখানে সৌতি অর্থাৎ সূত-পুত্র। বৈদিক যুগে সূত বা সূত্রধর[8]-রা পুরাণের কাহিনী এবং গল্পকথার ভাণ্ডারী ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন যজ্ঞে বা রাজসভায় অর্থাৎ যেখানে অনেক বিশিষ্ট মানুষের সমাবেশ হত, সেখানে পুরাণকথা শুনিয়ে বেড়াতেন। পুরাণ কথা শোনানোর উদ্দেশ্য বহুবিধ। যিনি পুরাণকথা বলছেন তাঁর এবং যাঁরা শুনছেন তাঁদের - সকলেরই অশেষ পুণ্য এবং পরমা লাভ হয়ে থাকে। একথা মহাভারত তো বটেই, যে কোন পুরাণের প্রত্যেকটি অধ্যায়ের উপসংহারে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পুণ্য সঞ্চয় ছাড়া আরও জরুরি সঞ্চয় ছিল, উপার্জন। যে রাজার যজ্ঞ অথবা সভা, তিনি এবং অন্যান্য সম্পন্ন সভাসদরাও সূতকে দক্ষিণা বা পুরষ্কার দিতে কার্পণ্য করতেন না। শোনা যায়, যেহেতু বিভিন্ন রাজ্যের রাজা এবং উচ্চমহলে তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিল, তাঁরা পারষ্পরিক গুপ্ত তথ্যেরও আদানপ্রদান করতেন – অর্থাৎ তাঁরা প্রচ্ছন্ন গুপ্তচরও বটেন!

সে যাই হোক, এখানে সূত্রধর উগ্রশ্রবাঃ বলছেন, “তিনি বৈশম্পায়ন-এর মুখ থেকে সেই মহাভারত শুনেছেন, যে মহাভারত বৈশম্পায়ন শুনেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মুখ থেকে – “প্রোক্ত” কথার অর্থ যা প্রকৃষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখানে কোথাও পুঁথি বা গ্রন্থ দেখে পাঠ করা হয়েছে, এমন কথা উগ্রশ্রবাঃ বললেন না। অতএব এই সময়ে মহাভারত লিখে ফেলা হয়েছিল, এমন কথা মহাভারতেও পাওয়া গেল না।

আমাদের দুই মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত থেকে সমস্ত ঘটনার ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তবে যে জনপদগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি সবই ঐতিহাসিক, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিকরা বলেন, আর্যদের বিশিষ্ট কিছু গোষ্ঠীপতি রাজা এদেশে এসে উপনিবেশ গড়ে তোলার সময়, কখনও অনার্য অধিবাসীদের সঙ্গে লড়েছেন, কখনো নিজেদের মধ্যেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। সেই কাহিনী চারণকবিরা অলংকৃত এবং অতিরঞ্জিত করে, প্রধানতঃ রাজসভায় কিংবা বিশেষ কোন যজ্ঞের সমাবেশে আবৃত্তি করতেন। যে রাজার যজ্ঞ, সেই রাজার এবং তাঁর পূর্বপুরুষ রাজাদের স্তুতি, স্তব এবং মহত্ব প্রচার করে, রাজাদের মনোরঞ্জন করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে তাঁর প্রপিতামহ[9]-দের মহিমা কীর্তনই ছিল মহাভারতের মূল কাব্য কথা। অতএব তার থেকে ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া, খড়ের গাদা থেকে ছুঁচ খোঁজার মতোই দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা।

যেমন মহাভারতে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের রাজ্যের রাজারা সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে পশ্চিমে সিন্ধু নদের ওপারের রাজ্য থেকে পূর্বের আসাম, কিংবা উত্তরের পাঞ্জাব থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্য কোন রাজ্যই বাকি নেই। কিন্তু ৯০০ বি.সি.ই-র বাস্তব বিস্তার আদৌ তেমন ছিল না। পূর্বের বঙ্গ, রাঢ়, সমতট, কলিঙ্গ, পৌন্ড্র, সুহ্ম, প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্য বা জনপদে আর্যদের অস্তিত্ব তখনও প্রতিষ্ঠাই হয়নি। এমনকি দক্ষিণের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু হয়েছে, কয়েকশ বছর পরে, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের হাত ধরে। অর্জুনের মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণের কাহিনী বহু শতাব্দী পরে সংযুক্ত হয়েছে। সেকথা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে।


চলবে...



[1] এই লেখার ১.৭.১ অধ্যায়ে লিখেছিলাম, হোমো স্যাপিয়েন্সদের কিছু গোষ্ঠী প্রায় ২৫,০০০ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার দিকে গিয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে কয়েক হাজার বছর পরে তারাই আবার দক্ষিণদিকে রওনা হয়েছিল, নতুন এলাকার খোঁজে। 

[2] মিত্র ঋগ্বেদীয় দেবতা – ভোরের আলো, এবং নবীন সূর্যের নাম মিত্র।

[3] সাধারণতঃ এই মন্ত্রটিতে “ঈডে”-র জায়গায় “ঈলে” পাঠ দেখা যায়, আমি মহারাজ স্বামী সমর্পণানন্দর পাঠ ও ব্যাখ্যা অনুসরণ করেছি। দুটি শব্দেরই অর্থ অবিশ্যি একই, বন্দনা বা অর্চনা করা।

[4] এই “রত্ন” শব্দের ব্যাখ্যা বিগত হাজার বছরে বহু ধরনের করা হয়েছে। রত্ন বলতে আমরা দামি পাথর যেমন মণি-রত্ন বা শ্রেষ্ঠ বস্তু বা ব্যক্তি, যেমন কবিরত্ন বুঝি। বেদের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার সায়নাচার্য এই অর্থগুলির সঙ্গে বলেছেন, যজ্ঞের উদ্দেশ্য তো শুধু মণিরত্ন লাভ করা নয়, প্রচুর শস্য-সম্পদ, সুস্থ সন্তান, যুদ্ধ জয়, এমনকি শান্তিও হতে পারে। অতএব “রত্ন” অর্থে এখানে “ফল” বা সাফল্য। 

[5] তাপত্য অর্থাৎ তপতীর সন্তান। তপতী সূর্য কন্যা, তিনি পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ মহান রাজা সম্বরণের পত্নী ছিলেন। অতএব পাণ্ডবদের তিনি প্রবৃদ্ধাপিতামহী।

[6] বেদের জ্ঞানকে ছটি অঙ্গে ভাগ করা হয়েছে – শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। এই ষড়ঙ্গ জ্ঞানই সম্পূর্ণ বেদজ্ঞান।

[7] তখনকার বঙ্গের পুরোটাই প্রায় আধুনিক পূর্ব-বিহার।

[8] সূত্রধরের প্রচলিত অর্থ ছুতোর – অর্থাৎ যাঁরা টুকরো-টুকরো কাঠ জুড়ে কাঠের দ্রব্যাদি বানান। আবার সংস্কৃত শাস্ত্র বা নাটকের শ্লোকগুলিকে “সূত্র” বলা হয়, সেই সূত্রগুলি যাঁরা স্মরণে রাখেন তাঁরাও সূত্রধর।

[9] অর্জুন > অভিমন্যু > পরীক্ষিৎ > জন্মেজয় – অতএব পঞ্চপাণ্ডব জন্মেজয়ের প্রপিতামহ।  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

সুরক্ষিতা - শেষ পর্ব

  [এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি ...