[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে
"ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।
এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে, স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে
ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
১
বিশাল এই বাড়িতে সারা বছর তাঁরা
সব মিলিয়ে থাকেন সাতটি প্রাণী। সস্ত্রীক অজিতেশবাবু, সরযূদেবীর এক বোনপো পথিক।
রান্নাবান্না করার জন্যে মালতী, ঘরদোর পরিষ্কার রাখার জন্যে লক্ষ্মী। পাহারা দেওয়া এবং বাজার হাট করে দেওয়ার জন্যে মাধব আর
বাগানের গাছপালা দেখাশোনা করে রামখিলাওন। পথিক ছাড়া অন্য সবাই এ বাড়িতে অনেকদিন
ধরেই রয়েছেন, যার ফলে ওঁনারাও এ বাড়ির এবং এই পরিবারেরই সদস্য হয়ে গেছেন বহুদিন।
বড়দিনের ছুটিতে অজিতেশবাবুর
নির্জন এই বাড়িটা প্রত্যেকবারই বেশ জমে ওঠে। ওই সময় নাতি-নাতনীদের স্কুলে
ছুটি থাকে, দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং মেয়ে-জামাইও এ সময় অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি
নেয়। আগের দিন ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছে, সকালের ট্রেন ধরে, হৈচৈ করতে করতে ওরা কলকাতা
থেকে এসে উপস্থিত হয়। স্টেশন থেকে ওদের আনতে অজিতেশবাবু গাড়ি পাঠান। বাতের
ব্যথাটা আয়ত্ত্বে থাকলে কোন কোন বার নিজেই যান গাড়ি নিয়ে। বাড়িতে ঢুকেই বাচ্চা
নাতি-নাতনীগুলো এমন আনন্দ আর হৈচৈ শুরু করে, অজিতেশবাবুর মনটা ভরে ওঠে। সারা বছর
তিনি এই দিনগুলোর প্রতীক্ষাতেই থাকেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সরযূদেবী এত খুশী হন,
এ কটাদিনের অনভ্যস্ত বাড়তি পরিশ্রমকেও গায়ে মাখেন না।
প্রত্যেকবারই অন্ততঃ দিন তিনেক
তাঁরা সব্বাই মিলে, ময়ূরাক্ষীর ধারে পিকনিক করতে যান। সক্কাল সক্কাল খাবার-দাবার
বানিয়ে দুটো গাড়ি ভাড়া করে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। নদীর পাড়ে সারাদিন খেলাধুলো, আড্ডা,
গল্প করে, বিকেলের দিকে ফিরে আসেন। বেশ মজায় কাটে দিনগুলো, বিশেষ করে ছোটদের
ফূর্তি আর আনন্দের কোন সীমা থাকে না। অজিতেশবাবু আর সরযূদেবী ওদের সঙ্গে পাল্লা
দিতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু শতরঞ্চিতে বসে বসে ওদের লাফালাফি আর হৈচৈ করতে দেখে
ভারি আনন্দ পান।
তবে প্রতিবারই ভাড়া করা গাড়ির
ড্রাইভারগুলো কিছু না কিছু ঝামেলা পাকায়। সকাল থেকে বিকেল অব্দি বসে থাকতে তাদের
ভালো লাগে না। তাদের দুপুরের খাবারও পছন্দ হয় না, আর দুপুর থেকেই ফেরার জন্যে
তাগাদা দিতে থাকে। তাদের কোন না কোন অজুহাতের আর শেষ নেই! চাকায় হাওয়া কম আছে। ঠিকঠাক
ব্রেক ধরছে না। বাঁদিকের হেডলাইটটা জ্বলছে না, রাত হয়ে গেলে অন্ধকারে গাড়ি চালাতে
অসুবিধে। একটা না একটা কিছু থাকবেই!
এ বছর অজিতেশবাবুর প্ল্যান রয়েছে সব্বাইকে বেশ একটু চমকে দেবেন। তিনি বেশ জব্বর একটা এসইউভি গাড়ি বুক করেছেন। সেটার ডেলিভারি দেওয়ার ডেট ছিল গত পরশু। কিন্তু সে আর হয়নি। যথারীতি তারা দুঃখ-টুঃখ পেয়ে, ক্ষমা-টমা চেয়ে, দুদিন পিছিয়ে আজ শনিবার ডেলিভারি দেবে বলেছে। ওদিকে ছেলেমেয়েরা পৌঁছচ্ছে আগামিকাল, সকাল দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ। তিনি ভেবেছিলেন, পথিককে সঙ্গে নিয়ে, নিজেই শহরে যাবেন গাড়ি ডেলিভারি নিতে। কিন্তু আজ সকালে উঠে দেখলেন, শরীরটা তাঁর ভালো নেই। সারা গায়ে, হাতে-পায়ে ব্যথা, গলাটাও খুসখুস করছে, একটু যেন জ্বর-জ্বর ভাব। তিনি তাও হয়তো বেরিয়ে পড়তেন, কিন্তু সরযূদেবী বেরোতে দিলেন না। বললেন, “আজকের দিনটা বিশ্রাম নাও, বরং কাল সকালে গাড়ি নিয়ে ওদের স্টেশনে আনতে যেও। আজ এবং কাল, পরপর দুদিন, এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া-আসার ধকলে শরীর খারাপ বাড়লে, সকলের ছুটির মজাটাই মাটি হয়ে যাবে”। এই গ্রাম থেকে শহরের দূরত্ব পায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার। সেখানেই রেলস্টেশনও। কাজেই তাঁর এই বয়সে পরপর দুদিন এতটা পথ যাওয়া-আসা মোটেই সহজ কাজ নয়। অতএব স্ত্রীর কথাটা অজিতেশবাবু মেনে নিলেন এবং ঠিক হল পথিক একাই যাবে এবং শোরুম থেকে একজন ড্রাইভার নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ি আসবে। কথা হয়ে আছে শোরুমের ওই ড্রাইভারই এ কটা দিন এ বাড়িতেই থাকবে।
২
গাড়ির ডেলিভারি নিতে পথিক শোরুমে
পৌঁছে গেল সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। কাগজপত্র সইসাবুদ হয়ে, গাড়িতে হাই-সিকিউরিটি নাম্বার প্লেট
লাগিয়ে, গাড়ি রেডি হল প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ। তারপর শোরুমের ড্রাইভার,
গোবিন্দবাবু গেল, দিন দশেক বাইরে থাকার মতো, বাড়ি থেকে জামাকাপড় আনতে। ফিরল প্রায় পৌনে ছটা নাগাদ। সব ঝামেলা মিটিয়ে নতুন গাড়ি
রাস্তায় নামল যখন, তখন ঘড়িতে সোয়া ছটা। ডিসেম্বরের শেষে দিন খুবই ছোট, ততক্ষণে
অন্ধকার হয়ে সন্ধে নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। শোরুম থেকে বেরিয়েই তারা প্রথমেই পেট্রল
পাম্পে ঢুকল। সেখান থেকে ট্যাংকি ফুল করে তেল নিয়ে, গাড়ি মুচকুন্দপুরের দিকে রওনা
হল যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন পৌনে সাতটা। পেট্রলপাম্প থেকে বেরিয়েই পথিক ফোন করে মেসোমশাইকে
জানাল তারা রওনা হয়ে পড়েছে। বাড়ি পৌঁছতে খুব জোর ঘন্টা দুয়েক লাগবে। অজিতেশবাবু
স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা, শেষ অব্দি গাড়ি হাতে এসেছে! সাবধানে আয়।
তাড়াহুড়ো করিস না, একটু বেশি সময় লাগে তো লাগুক। এদিকের রাস্তাটা তেমন সুবিধের নয়”। পথিক বলল, “ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, মেসোমশাই, আমি সাবধানেই
আসব”।
পথিক ফোনটা বন্ধ করার পরেই গোবিন্দবাবু,
শহরের ঘিঞ্জি রাস্তায় ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, “পথিকদা, নতুন গাড়ি
কিনলেন পুজো দেবেন না? সবাই দেয় কিন্তু”। পুজোর ব্যাপারটা পথিকের মাথাতেই আসেনি।
একটু চিন্তা করে পথিক বলল, “তা ঠিক। কিন্তু সে পরে দেখা যাবে। বাড়ি গিয়ে মাসিমা
পুজো-টুজো যা করার করবেন, এখন সোজা বাড়িই চলুন”।
গোবিন্দবাবু ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন,
“আপনাদের যেমন ইচ্ছে”।
শহরের সীমানা থেকে তিন-চার
কিলোমিটার রাস্তার দুধারে খাপছাড়া কিছু বসতি রয়েছে, তারপর থেকেই শুরু হল জঙ্গল। রাস্তায়
লোকজন কিংবা অটোরিকশ, সাইকেল রিকশ না থাকাতে বেশ ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা। গোবিন্দবাবু
এবার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে তুললেন পঞ্চাশের ওপর। আরো মিনিট কুড়ি পঁচিশ যাওয়ার পর রাস্তা
সম্পূর্ণ নির্জন হয়ে গেল, মাঝে মাঝে দু একখানা ট্রাক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁৎ
সাঁৎ করে। রাস্তার দুপাশে বেশ গভীর জঙ্গল। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে তার
বাইরে ঘন অন্ধকার। এ রাস্তায় গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড তুললেন আশি-নব্বইয়ের
কাছাকাছি।
গাড়ির এত স্পিড দেখে পথিক একটু
ঘাবড়ে গেল, বলল, “এতটা স্পিডে না চালালে হত না, গোবিন্দবাবু? একটু পরেই বড়ো রাস্তা
ছেড়ে, আমাদের ডানদিকে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকতে হবে। অন্ধকারে জায়গাটা চিনতে ভুল হলে,
মুশকিল”।
গোবিন্দবাবু সামনের দিকে স্থির
নজর রেখে, হেসে বললেন, “মুচকুন্দপুর আমি অনেকবার গিয়েছি, ও রাস্তা আমার হাতের
তালুর মতো চেনা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পথিকদা, কিচ্ছু ভুল হবে না”।
আরো মিনিট পনের চলার পর
গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড কমিয়ে ডানদিকে সিগ্ন্যাল দিল। তারপর বেশ কিছুটা গিয়েই
ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল গাড়িটা, তারপর বলল, “কী পথিকদা? ঠিক আছে? ভুল করিনি তো?”
ব্যাপারটা এমনই চট করে ঘটে গেল, পথিক ঠিক ঠাহর করতে পারল না।
তার মনে কেমন যেন খটকা লাগল। বলল,
“মোড়ের বাঁদিকে একটা বড়ো বটগাছ ছিল? যার তলাটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো?” এই রাস্তাটা
বড়ো রাস্তার মতো মসৃণ নয়, পিচের রাস্তাই তবে একটু এবড়ো-খেবড়ো। গাড়ি লাফাচ্ছে,
তিরিশের বেশি স্পিডে চালাতে পারছেন না, গোবিন্দবাবু।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “বটগাছ
তো দেখিনি। আমি তো শুধু রাস্তা দেখছি!”
পথিক বলল, “আমার কিন্তু এ
রাস্তাটা চেনা মনে হচ্ছে না, গোবিন্দবাবু। রাস্তা ভুল হয়েছে...”।
“এ রুটে গোবিন্দলাল মিদ্দার
রাস্তা ভুল হবে? আপনি হাসালেন, পথিকদা...” বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন খুব। এই সময়েই গাড়ির হেডলাইট দুটো নিভে গেল ঝপ করে। সামনে পেছনে
এবং দুপাশে গভীর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, প্রায়। গোবিন্দবাবু খুব অবাক হয়ে
গাড়ি থামালেন। হেডলাইটের লিভারটা কয়েকবার নাড়াচাড়া করলেন, কোন লাভ হল না।
তারপর দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতে
নামতে বললেন, “কী ব্যাপার হল?”
পথিক বলল, “তখনই বললাম, এত স্পিডে
গাড়ি চালাবেন না, ঝাঁকুনিতে লাইটের তার-টার খুলে গেছে হয়তো”।
“আনকোরা গাড়ির তার খুলে গেছে,
বললেই হল? টিভিতে এ গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখেননি? পাহাড়ি রাস্তায় কেমন নাচতে নাচতে
দৌড়োয়? একখুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু চেক করে নিই...”। গোবিন্দবাবু বনেট খুলে,
আলো জ্বেলে মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। তারপর কী সব খুটখাট করতে লাগলেন।
পথিকও এবার গাড়ি থেকে নামল। বাইরে
একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ। কোন একটা পাখি কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর একসুরে ডেকে চলেছে,
টুইট, টুইট, টুইট...। পথিকের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। হেডলাইট যদি না জ্বলে, কী করে
গাড়ি চালানো যাবে? সারারাতই তাদের এই জঙ্গলেই থাকতে হবে নাকি? অসহায় ভাবে সে একবার
মুখ তুলে তাকাল, আর তখনই আকাশের এপার থেকে ওপার, ফালাফালা করে দিল বিদ্যুতের সুদীর্ঘ
নীল ঝলক। আর সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল, গাড়ির হেডলাইট। কয়েক মূহুর্ত পরেই, আকাশের এ
প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গড়িয়ে গেল ভীষণ ভারি একটা লোহার গোলা – দেখা গেল
না, কিন্তু আওয়াজ পাওয়া গেল গুম, গুম, হুড়ুম, গুড়ুম, গুম, গুম...। পথিক কেমন শিউরে উঠল। অসময়ে এসব কী হচ্ছে? আজ সারাদিন
মেঘ-টেঘের কোন বালাই ছিল না, সারা দিনটা শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে ঝলমল করছিল। কখনই
বা এমন মেঘ জমে উঠল, আর এমন ভয়ংকর গর্জন করতে শুরু করল? গোবিন্দবাবু বনেট ফেলে
দিয়ে বললেন, “উঠে পড়ুন, পথিকদা, লাইট ঠিক হয়ে গেছে”। পথিক এবং গোবিন্দবাবু দুজনেই
গাড়িতে উঠল, এবং গাড়ি স্টার্ট করতে না করতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি চলতে লাগল, কিন্তু ওয়াইপার চালিয়েও
উইণ্ডস্ক্রিন থেকে বৃষ্টির ধারা মোছা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছে কেউ যেন বড় হোসপাইপ
থেকে হুড় হুড় করে জল ঢালছে, কাচের ওপর।
পথিকের গলা শুকিয়ে গেল, খসখসে
গলায় বলল, “বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে এ কী বৃষ্টি রে, বাবা?”
“প্রকৃতির খেয়াল, ও কী আর আমার
আপনার হাতে?” খুব ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে গোবিন্দবাবু বললেন।
কিছুক্ষণ গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে চলতে গাড়িটা হঠাৎ যেন জোর ধাক্কা খেল কিছুর সঙ্গে।
বীভৎস আওয়াজ করে ঝাঁকিয়ে উঠল গোটা গাড়িটা।
পথিক আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, “কী
করছেন কী? ব্রেক করুন, গাড়ি থামান!”
গোবিন্দবাবুও অসহায়ভাবে বলে উঠলেন,
“ব্রেক চেপে মেঝেয় ঠেকিয়ে দিয়েছি, গাড়ি দাঁড়াচ্ছেই না। মনে হয় ব্রেক ফেল হয়েছে”। এ জায়গায় রাস্তাটা বেশ কিছুটা ঢালু। গাড়ি নিচের দিকে গড়াতে
লাগল বেশ জোরেই...এবং তার সঙ্গে মড়মড় কড়কড় ধাতব শব্দে, খুলে গেল গাড়ির ছাদ। কেউ
যেন চেঁছে দিল গাড়ির মাথাটা। ওরা গাড়িতে বসে আছে, গাড়ি চলছে, কিন্তু মাথার ওপরে
কোন ছাদ নেই। পথিক বিস্ময়ে আর আতঙ্কে মাথায় হাত দিল, বলে উঠল “সর্বনাআআআশ”। ওদিকে
গোবিন্দবাবু তখনো গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করছেন, হ্যান্ডব্রেকটাও টানছেন বারবার,
কোন ফল হচ্ছে না। গাড়ি ঢালু রাস্তায় গড়িয়েই চলেছে। খানা-খন্দে ভরা রাস্তায়
গাড়িটা লাফাচ্ছেও বেশ।
মিনিট পাঁচেক এভাবে গড়িয়ে চলার পর গাড়িটা রাস্তার ধারের একটা বিশাল উইঢিবিতে গিয়ে ধাক্কা মারল, তারপর বিশ্রী একটা ঘ্যাস্স্স্ শব্দ করে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ির বাঁদিকের হেডলাইটের উপর ভেঙে পড়ল উইঢিবির মাথাটা, ঝুরঝুরে কাদা মাটিতে ঝাপসা হয়ে গেল, হেড লাইটের আলো।
৩
সে গোবিন্দবাবুকে জিগ্যেস করল,
“কী হচ্ছে বলুন তো?”
গোবিন্দবাবু জিভে চিক শব্দ করে
বললেন, “ঝড়ে কোন গাছের ডাল হয়তো বেঁকে নিচু হয়ে এসেছিল। তাতে ধাক্কা খেতেই গাড়ির
মাথাটা চেঁছে গেছে। আমার বাইশ বছরের ড্রাইভারি জীবনে এমন কাণ্ড কোনদিন হতে দেখিনি।
তার ওপর নতুন গাড়িটাও বার বার কেন যে বিগড়োচ্ছে, তাও আমার ছাতার মাথায় কিছুতেই
ঢুকছে না”!
গোবিন্দবাবুর কথায় আরও অবাক হল
পথিক। তুমুল বৃষ্টি হল, কিন্তু ছাদভাঙা গাড়িতে বসেও তারা ভিজল না! প্রবল ঝড়ে গাছের
ডাল নুয়ে পড়ল, কিন্তু মাথার ওপরে চাঁদের কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নার আকাশ!
“এ গাড়ি কার?” পেছন থেকে হঠাৎ
বাজখাঁই আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালো। পথিকের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।
গোবিন্দবাবু কোন ক্রমে তোৎলাতে
তোৎলাতে বললেন, “ইয়ে...এ গ্-গাড়ি, ম্মুচকুন্দপুরের অ-অজিতেশ ক্-কুণ্ডু চ্-চৌধুরিবাবুর।
শোরুম থেকে নতুন নিয়ে বেরিয়েছিলাম, এখন ভাঙাচোরা...”।
“অ, খুদু? খুদুর গাড়ি? খুদু নতুন
গাড়ি কিনল? বাঃ বেশ বেশ, আয়, তোরা আমার সঙ্গে আয়”। একথা বলেই বাজখাঁই গলাওয়ালা
লোকটি জঙ্গলের ভেতরের দিকে হাঁটা লাগাল। গোবিন্দবাবু পথিকের হাত ধরে টানতে টানতে
তার পিছু নিলেন। লোকটার মাথায় ঝাঁকড়া সাদা চুল, মুখেও সাদা গোঁফ দাড়ি,
চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিল। পরনে একটা ছোট্ট ধুতি, সেটা সাদা নয়। হয়তো লাল, আবছা
আলোয় ভালো বোঝা যাচ্ছে না। বেশ ঢ্যাঙা আর ডিগডিগে রোগা চেহারা। কিন্তু গলার আওয়াজ
গমগমে। লোকটা কে? কেনই বা তারা ওর কথা মতো
পেছন পেছন দৌড়চ্ছে? সে কথা দুজনের কারও মাথাতেই এল না। দুজনেই ভূতে পাওয়া মানুষের
মতো জঙ্গলের পায়েচলা সরু পথে লোকটার পেছন পেছন দ্রুত হাঁটতে লাগল।
বেশ কিছুটা যাওয়ার পর তারা একটা
ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছল। একটু দূরেই দেখতে পেল একটা মন্দিরের আবছা কালো মতো অবয়ব।
চাঁদের আলোয় আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। লোকটা সেই মন্দিরের দিকেই যেন দৌড়চ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মন্দিরের কাছে পৌঁছল। ভাঙ্গাচোরা বহুদিনের পুরোনো কাঠামোর
মন্দির। দরজার পাল্লা নেই। ভেতর থেকে হাল্কা আলো আসছে। লোকটা দরজার ভেতরে ঢুকে
গেল। ওরা ঢুকল না, বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখল, কুলুঙ্গিতে একটা প্রদীপ জ্বলছে
টিমটিম করে। সেই অল্প আলোতেই তারা দেখল ফাটা-চটা পাথরের বেদিতে এক দেবী প্রতিমা।
হাত তিনেক উঁচু, কুচকুচে কালো তাঁর গায়ের রং।
গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে পথিককে
বললেন, “বিশালাক্ষী মা! আমরা তার মানে বিশালাক্ষীতলায় চলে এসেছি”!
পথিক কিছু বলার আগেই লোকটা দরজার
সামনে এগিয়ে এল, পথিকের হাতে এক মুঠো তাজা জবাফুল তুলে দিয়ে একই রকম গমগমে গলায়
বলল, “বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে আয়। মায়ের পায়ে ভক্তিভরে পুজো দে, হতভাগা!”
ভয়ে পথিকের পা কাঁপছিল থরথর করে। কোনরকমে এগিয়ে গিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল।
হাতের জবাফুলগুলি দু হাতের অঞ্জলিতে ধরে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে। কতক্ষণ বসে
ছিল তার মনেও নেই।
গোবিন্দবাবু তার কাঁধে হাত রাখতে
পথিকের সম্বিৎ ফিরল। গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে বললেন, “পথিকদা, মায়ের বেদিতে ফুলগুলো
ছড়িয়ে দিয়ে শিগ্গির উঠে আসুন। তাকিয়ে দেখুন কিচ্ছু নেই”। পথিক তাকিয়ে দেখল, তার সামনে কোন প্রতিমা নেই। ঘরের মধ্যে
জ্বলতে থাকা কোন প্রদীপ নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটাও নেই। এমনকি মন্দিরের
মাথার ওপর ছাদও নেই! চাঁদের ঝাপসা আলোয়, হা হা করছে শূণ্য ভাঙা মন্দির! পাথরের
শূণ্য বেদিতে জবাফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, গোবিন্দবাবু আর পথিক ঊর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে এল
মন্দিরের বাইরে। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে ফাঁকা জমিটুকু পেরিয়ে দৌড়তে লাগল জঙ্গলের
পায়ে চলা পথ দিয়ে।
মুচকুন্দপুরের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে পথিক আর গোবিন্দবাবু যখন পৌঁছল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। সদরের উঠোনে গাড়িটা রেখে পথিক দোতলায় উঠল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সরযূদেবী সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
পথিকের চেহারা দেখে সরযূদেবী
রীতিমতো চমকে উঠলেন, চাপা গলায় বললেন, “কী রে? এ কি চেহারা তোর? কী হয়েছে?”
সে কথার উত্তর না দিয়ে পথিক
হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, বলল, “মাসিমা, সর্বনাশ হয়ে গেছে”।
“আঃ কী হয়েছে, বলবি তো? নতুন গাড়ি
ওরা দেয়নি? তাহলে নিচেয় গাড়ি আসার শব্দ শুনলাম যে”!
“নতুন গাড়ি তো দিয়েছে, কিন্তু যে
গাড়ি নিয়ে এসেছি, সে ভেঙেচুরে একেবারে লজ্ঝড় হয়ে গেছে”।
“কী বলছিস? কী করে হল? অন্য
গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছিস নাকি? দাঁড়া, তোর মেসোকে ডাকি। কী সর্বনাশ। একটা
কাজ তোকে দিয়ে ঠিকমতো হয় না।”
“সে সব কিচ্ছু হয়নি, মাসিমা।
পুরোটা না শুনলে বুঝতে পারবে না! সে এক অদ্ভূত ব্যাপার”।
“থাম, থাম। কোথায় কী সব সর্বনাশ
ঘটিয়ে এসে, এখন অদ্ভূত গল্প শোনাবি?” মাসিমা রাগে থমথমে মুখে বললেন, “তোর মেসোকে
খবর দিই। তিনিই যা করার করুন”।
ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই মেসোমশাই
ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিসের সর্বনাশ হয়েছে? গাড়ি
কোথায়, পথিক”?
“গাড়ি তো নিয়ে এসেছি, মেসোমশাই,
কিন্তু তার অবস্থা সঙ্গীন। নিচেয় যাবেন? চলুন না। দেখলে বুঝতে পারবেন, কোন সাধারণ
দুর্ঘটনা নয়, বেশ ভুতুড়ে ব্যাপার। কি করে যে কী ঘটে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা”।
সবার আগে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অজিতেশবাবু
বললেন, “আমরা আবার কে কে”?
পথিক বলল, “মানে, আমি আর
গোবিন্দবাবু, শোরুমের ড্রাইভার”।
অজিতেশবাবুর পিছনে নামছিলেন
সরযূদেবী, তাঁর পিছনে পথিক। অজিতেশবাবু সরযূদেবীকে খুবই বিরক্তির সুরে বললেন,
“তোমাকে বলেছিলাম কিনা, তোমার এই বোনপোটি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছে? নেশা করে নতুন গাড়িটার
বারোটা বাজিয়ে, এখন আমাদের ভূতের গল্প শোনাবে”।
পথিক খুব ব্যাকুল গলায় বলল,
“মেসোমশাই, বিশ্বাস করুন, চা ছাড়া কোন নেশা আমি করি না। আর আমাদের আসার পথে যা
ঘটেছে, সেটার মাথামুণ্ডু আমরা কিছুই খুঁজে পাইনি”।
উঠোনের আলোটা খুব জোরদার নয়, তবুও সে আলোয় ঝলমল করছিল গভীর নীল রঙের নতুন গাড়িটা। সরযূদেবী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাঃ, কী সুন্দর রং গো, ঠিক যেন ময়ূরকণ্ঠী। দারুণ হয়েছে। মনে হচ্ছে ময়ূরপঙ্খী নাও, এখনি আমাদের নিয়ে ভেসে পড়বে স্বপ্ন রাজ্যে”।
অজিতেশবাবু খুব তৃপ্তিমাখা সুরে
বললেন, “রঙটা তার মানে তোমার পছন্দ হয়েছে, কী বল? অনেকদিনের শখ অ্যাদ্দিনে পূরণ
হল। এবার দেখ না, সব্বাই মিলে যখন পিকনিকে যাব, কী মজাটাই না হবে! পিকলু, মুনিয়া,
টাবলু আর টিপ খুব আনন্দ পাবে। কাল সকালে ওদের আনতে আমিই স্টেশনে যাব। ওরা যা অবাক
হবে না...ওঃ”!
অজিতেশবাবু দু হাত কচলে আনন্দে
সামান্য দুলে উঠলেন। সরযূদেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে, মুখে আঁচল চাপা
দিলেন। দাদু আর তাঁর নাতি-নাতনীদের আনন্দের মধ্যে খুব একটা তফাৎ দেখতে পেলেন না। পিকলু,
মুনিয়া, টাবলু আর টিপ ওঁদের নাতি-নাতনীদের নাম।
অজিতেশবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, গম্ভীর গলায় বললেন, “পথিক, তুই যে বললি, গাড়িটার নাকি সঙ্গীন অবস্থা করে ছেড়েছে ভূতেরা? কই কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না”।
বাস্তবিক মেসোমশাই আর মাসিমার
পিছনে দাঁড়িয়ে পথিকও এতক্ষণ সেটাই দেখছিল। কোথাও কোন ভাঙাচোরা দেখা যাচ্ছে না,
দেখা যাচ্ছে না একটা আঁচড়ের দাগও! অবাক হয়ে সে তাকিয়েছিল গাড়িটার দিকে। পথিককে
দেখে তার পাশে এসে দাঁড়াল গোবিন্দবাবুও।
মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে পথিক থতমত
খেয়ে বলে উঠল, “এ কী দেখছি, গোবিন্দবাবু? গাড়িটার কোত্থাও কিছু হয়নি তো, কোত্থাও
এতটুকু টোলও খায়নি!” অজিতেশবাবু এবং সরযূদেবী পথিকের কথায় আরও বিরক্ত হলেন।
সরযূদেবী তো ঝংকার দিয়ে বললেন,
“নতুন গাড়ি নিয়ে ঢুকে থেকে তোর মুখে যতো অলক্ষুণে কথা শুনছি”। অজিতেশবাবু কিছু
বললেন না, কিন্তু কটমট করে তাকিয়ে রইলেন পথিকের দিকে।
পথিক উজবুকের মতো গোবিন্দবাবুর
মুখের দিকে তাকাল, মাথা চুলকে বলল, “গতকাল আসার সময় যা বিপদে পড়েছিলাম। যেমন ঝড়,
তেমনি বৃষ্টি, তার ওপর মেঘের গর্জন। গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির ছাদটা উড়েই
গেছিল...কিন্তু এখন...”।
অজিতেশবাবু এবার ধমকে উঠে, পথিককে
বললেন, “থামোঃ, বেয়াদব ছোকরা”। তারপর গলা নামিয়ে সরযূদেবীকে বললেন, “তোমাকে বললে
তুমি আমার কথা তো কানেই নাও না। ছোঁড়াটা যে দিন কে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে! এবার মিলিয়ে
নাও আমার কথাটা”!
পথিক ছটফট করে বলল, “আমার কথা
বিশ্বাস করছেন না, মেসোমশাই? পুরোটা শুনুন, শুনলে বুঝতে পারবেন”। সেদিন সন্ধ্যেয় নতুন
গাড়ি নিয়ে আসার পথে যা যা হয়েছিল, পথিক সব বলল মাসিমা আর মেসোমশাইকে। গোবিন্দবাবুও ঘাড় নেড়ে
নেড়ে সায় দিলেন পথিকের কথায়। পথিকের কথা শুনতে শুনতে অজিতেশবাবুর ভুরু কুঁচকে উঠল,
আর সরযূদেবী অবাক তো হলেনই, ভয়ও পাচ্ছিলেন খুব।
পথিকের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর,
সরযূদেবী খুব আতঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করলেন, “যে মানুষটা তোদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন,
যাঁর পেছন পেছন তোরা সেই মন্দিরে ঢুকলি, কেমন দেখতে বল তো, মানুষটা?”
পথিক বলল, “ঝাপসা আলোয় মুখটা তো
ভাল করে দেখতে পাইনি, মাসিমা। আর দেখবই বা কী? গোটা মুখটাই সাদা ধপধপে দাড়িগোঁফে
ঢাকা। মাথাতেও ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সাদা চুল। চেহারাটা রোগা, কিন্তু বেশ লম্বা। এই
মেসোমশাইয়ের থেকেও অন্ততঃ ফুটখানেক বেশি তো হবেই! আর গলাটাও ভীষণ গমগমে, শুনলেই
বুকের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে ওঠে”!
সরযূদেবী অজিতেশবাবুর দিকে তাকিয়ে
বললেন, “চিনতে পারলে?”
অজিতেশবাবু রাগে গজগজ করতে করতে
বললেন, “কাকে? তোমার এই বোনপোটিকে তো? আমি ওকে বহুদিন থেকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি।
আজকাল উনি ভালই নেশা করতে শিখেছেন। তা নইলে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে?” তারপর কিছুটা
ভেংচে বললেন, ““অ, খুদু! খুদুর গাড়ি! খুদু নতুন গাড়ি কিনল”! হতভাগা আমাকে ওর
ইয়ার-বন্ধু ঠাউরেছে, আমার নাম ধরেই ডাকছে, তাও আমারই সামনে”! পথিক কিছুই বুঝল না,
অবাক হয়ে মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু সরযূদেবী বিরক্ত হয়ে
অজিতেশবাবুকে বললেন, “তুমি কী গো? পথিক কী করে তোমার ওই ডাক নাম জানবে? তোমাকে ওই
নামে ডাকার মতো লোক কেউ আর আছে নাকি ইহলোকে, যে ও শুনবে? তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। রোগা
চেহারা, খুব লম্বা। চুল, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। তোমাকে ভীষণ ভালবাসতেন, আর “খুদু”
বলেই তোমাকে ডাকতেন। মনে নেই? তোমার ছোড়দাদু, গো!”
অজিতেশবাবু গভীর চোখে তাকিয়ে
রইলেন, স্ত্রীর দিকে।
সরযূদেবী আবার বললেন, “আমার বিয়ের
পর বার তিনেক এ বাড়িতে এসেছিলেন, তখন দেখেছি। তুমিই তো গল্প করেছিলে, বিএ পাস করে
উনি ঘর ছেড়েছিলেন, সাধু হবার জন্যে। কোনদিন তিনি আর সংসার করেননি। কখনো সখনো হুট করে বাড়ি
আসতেন, এক-দুদিন বারবাড়িতে থেকে আবার চলে যেতেন কোথাও। তিনি কী তবে আর বেঁচে নেই ...”! সরযূদেবী কথা শেষ না করে, হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন। তারপর গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম
করে বললেন, “আমাদের নতুন গাড়ি দেখে খুব খুশি হয়েছেন, আর আমাদের আশীর্বাদ করার
জন্যেই উনি কাল এত অশৈরণ কাণ্ড ঘটিয়েছেন, গো”!
অজিতেশবাবু বিড়বিড় করে কিছু বললেন, শোনা গেল না! তারপর দু হাত জোড় করে তিনিও কপালে ঠেকালেন। তাঁর দুই চোখ ভরে উঠল জলে, অস্ফুট স্বরে বললেন, “আমাদের ছোড়দাদু, বাবার ছোটকা...ইস্স্ আমিও যদি গাড়ি আনতে শহরে যেতাম, তাঁর সঙ্গে শেষ দেখাটাও হয়ে যেত”!
..০০..
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন