[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
১
ভোরের কুয়াশা মাখা মায়াবি আলোয়,
লেকের ধারে বেঞ্চে বসে, অনামিকা মন দিয়ে শুনছিলেন, কথকতার কথা, “আজকেই ফিরে গিয়ে
বোমাটা ফাটিয়ে দাও, অনু”।
অনামিকা হাসলেন, স্নিগ্ধ দৃষ্টি
মেলে কথকতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বৌমাকে বোমা? ঠিকই বলেছেন। বলবো, আজই বলবো। আগে
পেতাম না, আজকাল মনের মধ্যে বেশ একটা জোর পাচ্ছি। ক'মাস আগেও, আজ যে কথাগুলো বলবো
বলে মনস্থ করেছি, বলা তো দূরের কথা, সে চিন্তাটুকুও করতে পারতাম না”।
“থ্যাংক্স আ লট”।
“ও মা, কেন?”
“এটা আমার কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই
ধরে নিলাম, তাই। তোমার এই নতুন জীবনে পা ফেলার পেছনে আমার এ ক'মাসের আন্তরিক
প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছে, এটুকু আমি ধরে নিতেই পারি”।
অনামিকা স্মিত উজ্জ্বল চোখে
তাকালেন কথকতার দিকে, বললেন, “সত্যি, আজ যে আমি আমার রুদ্ধকণ্ঠ ইচ্ছেগুলো ওদের সামনে
ঘোষণা করবো, তার পিছনে যে এত দিনের প্রস্তুতি, এত রকমের কথা। সে সব কথা তো আপনারই
কথা, কথকতা! আমার নতুন এই জীবনটাই কী কন্গ্র্যাচুলেটরি নয়?”
“ওভাবে বলো না, প্লিজ। এই বয়েসে তোমাকে
কাছে পেয়ে আমিই একটু বেশি মাত্রায় কমপ্লিমেন্টেড ফিল করছি। আমার
মনের এই কথাটা ইংরিজিতে প্রকাশ করার মতো কোন উপযুক্ত শব্দ মনে আসছে না। বরং বাংলায়
বলতে পারি অতি সহজে। কথাটা হল, তুমি আমার জীবনে এসেছো আশ্চর্য এক আভ্যুদয়িক হয়ে! তবু তো তুমি আজও “আপনি” থেকে “তুমি” তে নামতে পারলে না। আজকাল
ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর নিজেদের মধ্যে “তুই” “তুই” করে। বিয়ের আগে, বিয়ের পরেও। প্রথম প্রথম “হ্যাঁগো শুনচো”, “কী গো, কী বলচো”
শুনতে বা বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। ছেলেমেয়ে হয়ে যাওয়ার পর, স্ত্রী বলতেন, তোর
বাবাকে ডাক, আমিও বলতাম, তোর মা কোথায় রে? আর এরা, সারাজীবনই বন্ধু। যেন দাম্পত্য
নয়, ইলংগেটেড ফ্রেন্ডশিপ! বাইরে যে বন্ধুত্বটা ছিল, তাকেই সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে
গৃহী করে তোলার আনন্দ!”
হাসতে হাসতে অনামিকা বললেন, “ওফ,
বাপরে, আপনি এত কথাও বলতে পারেন। তবে আপনি যাই বলুন, আমি ওই তুই-তোকারি পর্যন্ত
যেতে পারবো না, সে কথা কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি।”
কথকতাও হাসলেন, বললেন, “অতটা
ছোকরা হতে আমারও সাধ নেই। তবে “আপনি” থেকে “তুমি” তে আসার কথা আগেই বলেছি, আবারও
বলছি বলে বিরক্ত হয়ো না, প্লিজ। আর সঙ্গে যদি “ওগো শুনছো, হ্যাঁগো শুনছো” পাই,
তাহলে তো সোনায় নয়, শোনায় সোহাগা”।
অনামিকা হাসলেন না, আনমনা মুখে
লেকের স্থির জলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এক মাসিমা আছেন, এখন অনেক বয়েস, একসময় ছুঁচসুতোর
টানাপোড়েনে খুব সুন্দর চটের আসন বুনতেন। আমরা নানান বয়সের তুতো ভাইবোনেরা লম্বা
মাটির দাওয়ায়, সেই সব আসনে বসে ভাত খেতাম একসঙ্গে। একটা আসনে ছিল ঘনিষ্ঠ শুকসারির
নকশা আঁকা, তার মাথার ওপরে লেখা “শাসন করা তারই সাজে” আর পায়ের তলায় “সোহাগ করে
যে”। আপনার সোনায় সোহাগা কথাটা শুনে হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ে গেল”।
কথকতা কিছু বললেন না। কোলের ওপর রাখা অনামিকার ডান হাতটি টেনে নিয়ে, নিজের দু হাতে চেপে ধরলেন। মুখ নীচু করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে, অনামিকা স্মিত মুখ তুলে তাকিয়ে রইলেন কথকতার মুখের দিকে। তারপর না বলা কথার অনুভবে দুজনেই মগ্ন হয়ে রইলেন কতক্ষণ।
২
আজ খেতে বসে অনামিকা বললেন, “আজ
তোমাদের চিকেন হয়েছে না? একটু দিও তো, বৌমা!”
অনামিকার এই কথায়, পৃথিবীটাই থমকে
রইল কিছুক্ষণ। রাজনের বাবা পৃথ্বীশ দেহ রেখেছেন, বছর চারেক হল। সেই থেকে অনেক
অনুরোধ-উপরোধেও অনামিকা আমিষ স্পর্শ করেননি।
আহ্নিকগতি আবার স্বাভাবিক হতেই,
অনামিকার প্লেটে একটুকরো চিকেন আর একটু ঝোল দিতে দিতে ঝুমুর বলল, “আর কত খেল্ যে
দেখাবেন, মা! সেই তো খেলেন, তবে এতদিন এত নাটকের কী দরকার ছিল”?
“তোমাদের আবার কম পড়বে না তো,
বৌমা?” নির্বিকার অনামিকা রাজন আর গুবলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে? তোদের চিকেনে
ভাগ বসালাম নাকি?”
রাজন বিরক্ত কিনা বোঝা গেল না,
বলল, “আমরা কতবার কতদিন তোমাকে বলে বলে হেরে গেলাম, মা, হঠাৎ আজকে
তোমার সুমতি হল?”
“সুমতি, নাকি দুর্মতি?” অনামিকা
হেসে বললেন, “কী জানি,
কেন যে ইচ্ছে হল। হয়তো যাওয়ার আগে লোভটোভগুলো আবার জেগে উঠছে!”
ঝুমুর তীব্র শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল,
“লোভ আপনার কোনদিনই যায়নি, মা। পুরোটাই ছিল লোকদেখানে বাহাদুরি - “দ্যাখো স্বামী
মারা গেছে, আমি সাধ্বী বিধবা, মাছ-মাংস ছেড়ে দিলাম। আজ সেই চক্ষুলজ্জাটাও
ঘুঁচে গেল!”
“তাই হবে হয়তো, মা। দেরি করছো কেন, তুমিও বসে
যাও”।
“থাক ঢের হয়েছে, আপনারা শুরু করুন,
আমি বসছি। আপনার আরও বায়নাক্কা যদি কিছু থাকে”!
“বুঝতে পারি, আমাকে নিয়ে তোমাদের
খুব হ্যাপা, তাই না, বৌমা? না না, আপাতত আর কোন বায়নাক্কা নেই। বসে পড়ো। এই তো আর কটাই বা দিন, এ
মাসের তিরিশ তারিখ। আজ তো
সতের হয়েই গেল, তার মানে তেরদিন - ব্যাস্”।
“কেন, তারপরে কী হবে?” রাজন মুখে
খাবার তুলতে গিয়েও থমকে গেল।
অনামিকা হাসলেন, বললেন, “সেদিন
থেকে আর দমন নয়, ইচ্ছেবরণ। এত দিন পূর্ণ না হওয়া সকল সাধপূরণ! তোর বাবার আর তোদের এই সংসারের আধারে
দুমড়ে-মুচড়ে গুঁজে রাখা এতদিনের মনটা সেদিন ডানা মেলবে”।
“কী ব্যাপার বলো তো মা? কোনদিন তো এভাবে তোমায় কথা বলতে
শুনিনি। আজ বেশ মুডে রয়েছো মনে হচ্ছে? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? হঠাৎ
ডানা মেলার উত্তেজনায় চিকেন খেয়ে মাঝরাত্রে আবার কিছু বাধিয়ে বসো না,
প্লিজ! কাল সকালে আমার অফিসে জরুরি মিটিং, ঝুমুরের স্কুলে পরীক্ষা। গুবলুর
ক্লাসটেস্ট! সব ভেস্তে যাবে”।
হালকা হেসে অনামিকা ছোট্ট
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিচ্ছু হবে না, ভাবিস না। সত্যি বলতে বিয়ের পর থেকে এত
ভালো আমি কোনদিন ছিলাম না। আমার নিজের বিয়ের কথা বললাম, বৌমা, তুমি আবার তোমার
বিয়ের দিন থেকে ধরে বসো না”।
ঝুমুর ভীষণ বিরক্ত হয়ে রেগে উঠে বলল,
“তোমাদের মা আর ছেলের এই হেঁয়ালি করার বদভ্যেসটা কবে যাবে বলো তো? লোককে হ্যারাস
করে তোমরা খুব আনন্দ পাও, না? স্যাডিস্টের ঝাড়! তোমাদের সংসারে এসে আমার জীবনটার
কী হাল হচ্ছে, সেটা একবারও ভেবে দেখেছো, স্বার্থপর শয়তানের দল?”
এতক্ষণ বড়োদের কথার মধ্যে গুবলু
কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না, এখন সে বলে উঠল, “স্যাটানের মাথায় হর্ন থাকে না,
মাম্মি?”
অনামিকা হেসে ফেলে বললেন, “থাকে
বৈকি, গুবলুসোনা, হর্ন দেখেই তো চট করে, স্যাটান চেনা যায়। তবে মানুষ-শয়তানদের
শিং, নখ, দাঁত কিছুই থাকে না, তাদের চিনে ওঠা খুব মুশকিল”। অনামিকার খাওয়া হয়ে
গিয়েছিল, তিনি উঠে পড়লেন।
ঝুমুর দু চোখে আগুন নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী আমাকে মিন করলেন, মা”?
বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে
যেতে যেতে বললেন, “ও মা, তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি?”
অনামিকা নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা
চেপে দিতে দিতে ঝুমুরের গলা শুনলেন, “তোমার মা যা নয় তাই বলে গেল আমাকে, তুমি চুপ
করে শুনলে? সারাজীবন কী মেনিমুখো মায়ের ছেলে হয়ে কাল কাটাবে? এই যদি তোমার ইচ্ছে
ছিল, বিয়ে করে সংসার পাতলে কেন? আজ নবছর হল বিয়ে হয়েছে, আজও নিজের সংসার, নিজের
পরিবার কেমন জিনিষ জানতেই পারলাম না। আর কতদিনে তুমি নিজের স্ত্রীকে, কাজের লোক হিসেবে
না দেখে, স্ত্রী বলে সম্মান করতে শিখবে? একনম্বরের স্পাইনলেস… ”।
অনামিকা দরজাটা চেপে দিতে, ইয়েল লকে আওয়াজ হল, ক্লিক। নির্জন ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনামিকা নিজের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তাঁর নতুন জীবনে পা ফেলার কথা ওদের বলার জন্যেই তিনি কথার সূত্রপাত করেছিলেন। কিন্তু কেউই তেমন কোন কৌতূহল প্রকাশ করল না – আসলে এ সংসারে তাঁর থাকাটা এতই স্বাভাবিক – অনেকটা রোদ-বৃষ্টি-হাওয়ার মতোই। সাধারণ ঝড়বাদলে আমাদের মনে একটু প্রভাব ফেলে ঠিকই – কিন্তু সেটাকেও জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ধরে নিয়ে আমরা তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়ার কোন প্রয়োজনই অনুভব করি না। অনামিকা শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এ সংসারে তাঁর অস্তিত্ব – সামনের ওই ড্রেসিং টেব্ল্টার মতোই। বিয়ের পর তাঁর এ বাড়িতে আসার দিন থেকে ওটা ওই জায়গাতেই রয়েছে - নড়েও চড়েও না – শুধু সার্ভিস দিয়ে যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো লাইট নিভিয়ে, নাইট ল্যাম্প জ্বেলে নিঃসঙ্গ বিস্তৃত বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তেরো দিন পরের নির্মল সকালে তিনি কী প্রবল ঝড় হয়ে উঠবেন?
৩
ভীষণ ভালো লাগায়, মনটা ভরে উঠল
অনামিকার, বললেন, “এসে গেছো! এসো এসো, ভেতরে এসো। ধন্যি টাইমিং তোমার, ঘড়িও হার
মেনে যাবে তোমার কাছে”।
“তুমিও তো রেডি! মেয়েরা যে টাইমে
রেডি হয় তোমাকেই প্রথম দেখলাম”। ভেতরে এসে অনামিকার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর টাইমিংয়ে, তুমিই
বা কম কী? এই যে “তুমি” ডেকে, আজ আমাকে অবাক করে দিলে, বিশ্বাস করো এতটুকু বাড়িয়ে
বলছি না, বিশেষ দিনের সঠিক লগ্নে বরণ করতে পারে শুধু মেয়েরাই। আমরা
ছেলেরা যেখানে সেখানে যখন তখন আগলহীন হয়ে নিজেদের হাল্কা করে
ফেলি! শুভক্ষণ, কিংবা পরমলগ্নের হিসেব করতে ছেলেরা কোনদিনই
শিখল না।”
তারপর অনামিকার ডানহাতটা তুলে
নিলেন নিজের হাতে, নিজের
অধরে স্পর্শ করে বললেন, “আজ এই সর্বমঙ্গলা সকালে তোমার শাড়ির হাল্কা আসমানি রঙটি, যে কী গভীরতা পেলো, তুমি তো তা জানতেও পারলে না! এতদিনের বর্ণহীন তুমি, কোন জাদুমন্ত্রে আজ অবর্ণনীয়
হয়ে উঠলে, গো?”
স্মিত সলজ্জ মুখে অনামিকা অস্ফুটে
বললেন, “মন্ত্রটা কার, সে কী তোমার অজানা কথক ঠাকুর? এ শাড়ি তুমিই দিয়েছিলে, আমার
লাস্ট জন্মদিনে। সেটাও
মনে নেই, বুঝি?”
বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে, ঘরের বাইরে এসে ঝুমুর দেখল, অনামিকার ডানহাত হাতে নিয়ে উটকো একটা লোক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! সেদিনের সেই কথাবার্তার পর গতকাল রাত পর্যন্ত, তার কোন বাক্যালাপ ছিল না শ্বাশুড়ির সঙ্গে।
ভীষণ অবাক হয়ে সে আজ বলে
ফেলল, “ইনি কে মা? এই ভোরবেলা সুটকেস-টুটকেস
নিয়ে কোথায় বেরোচ্ছেন? আজ মর্নিং ওয়াকে যাননি?”
কথকতার হাতে অনামিকার হাত ধরাই
রইল, অনামিকাও ছাড়াবার চেষ্টা করলেন না, মৃদু হেসে বললেন, “ইনি কথকতা যশ, আমার বন্ধু,
আমার বন্ধুর জীবনপথের নবীন সঙ্গী। ওঁনার সঙ্গে আজ সপ্তপদী যাত্রায় চললাম, মা, তাই মনে হল রোজকার
মর্নিং ওয়াকটা আজ বাহুল্য। সেদিন তুমি খুব রেগে গেলে, কিন্তু তোমাকে তো বলেইছিলাম,
চোদ্দদিন
পরে আমার ইচ্ছে-বরণ। আজ সেই দিন, বৌমা”। ঝুমুর বাক্যরহিত। রাজনকে ডাকতে হল না, বেলের আওয়াজ, তারপর
ঝুমুর আর মায়ের কথাবার্তা শুনে সেও বেরিয়ে এল।
রাজনকে দেখে অনামিকা বললেন, “রাজু
উঠে পড়েছিস, বেশ করেছিস! আয়, পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি কথকতা যশ, বাকি যে কদিন বাঁচি,
এঁনার সঙ্গেই থাকবো ঠিক করেছি, রাজু”।
টেবিলের ওপর একটা মুখবন্ধ মোটা
খাম রাখা ছিল, সেটা রাজুর হাতে দিয়ে অনামিকা বললেন, “এই খামটা যত্ন করে রাখ, আমি
চলে যাবার পর খুলিস”।
“চলে যাচ্ছো মানে? বলা নেই কওয়া
নেই, এমন আচমকা?”
“চোদ্দদিন আগেই বলতে চেয়েছিলাম
তো! তোরা তো শুনতে চাসনি। সেদিন মনের নিবিড় কথাটি – তোদের সংসারের তুচ্ছ খিটিমিটির
মধ্যে জোর করে টেনে আনতে আমারও আর প্রবৃত্তি হল না। তোর বাবার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে
গতকাল পর্যন্ত নিজের ইচ্ছেয় তো কিছুই করিনি। আজ সেসব নিয়ে অভিযোগ করার মানে হয় না,
করছিও না। এতদিন নিজের সকল ইচ্ছের মরণ বরণ করেই বেঁচে
চলছিলাম, আজ থেকে নিজের ইচ্ছেকে বরণ করেই বাঁচবো। এই ইচ্ছে-বরণ
আশা করি আনন্দেরই হবে। রিক্ত প্রাণের জ্বালা
মেটানোর মৃত্যু নয়, অনেক পাওয়ার সাধ মেটানো তৃপ্তির মৃত্যু। তাই আজ সব
লজ্জা-ভয়-মান-অভিমান, ঠুনকো সব দায়-দায়িত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর ছাড়ছি, রে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে নতুন করে
বাঁচার”।
খুব কর্কশ স্বরে, ঝুমুর বলল, “এভাবে
মুখ পুড়িয়ে আপনি চলে গেলে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, ওর অফিস, আমার স্কুল,
গুবলুর স্কুলে আমরা মুখে দেখাতে পারবো? আপনার ভীমরতি হয়েছে, মা! এভাবে কোনমতেই
আপনি যেতে পারেন না”!
স্মিতমুখে অনামিকা বললেন, “তুমিই সেদিন
বলেছিলে না, ওসবই তুচ্ছ চক্ষুলজ্জা আর লোক দেখানো বাহাদুরি! সত্যিই তাই, বৌমা,
অদ্ভূত কিছু সংস্কার – যার পিছনে কী এক মোহে যে আমরা সারাক্ষণ ছুটে চলি। ও সবে কিচ্ছু
যাবে আসবে না, মা, লোকে এক হপ্তা, দু হপ্তা বলবে, তারপর ভুলে যাবে। ও নিয়ে তুমি
ভেবো না। ঝোড়ো হাওয়া একটু উঠবে, বন্ধ করতে হবে ঘরদোরের এবং মনের জানালাগুলো –
কিন্তু তার দৌড় শেষ রাত্তিরেও পৌঁছবে না – দেখে নিও – ঝকঝকে নির্মল সকালটা দেখতে
পাবে বন্ধ জানালা খুললেই”।
ঝুমুরের মতো মুখরা মেয়েও এমন কথায় আর ঘটনার
আকস্মিকতায় কথা হারিয়ে ফেলল যেন। অনামিকা কথকতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো”
“এই দুটো সুটকেশই তো? আমাকে দাও”।
“হুঁ দুটোই? না একটা তুমি নাও,
একটা আমি। আমার নিজের গুরুত্বটা এখনই
হাল্কা করে দিও না কথক”। কথকতা অপ্রস্তুত মুখে অনামিকার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“অমন চিন্তা আমি করিও না, অনু। পুরুষের কাজ মেয়েদের বহন করা। মেয়েরা যদি নিজের ভার
নিজেরাই বইতে থাকে, অথবা তারা যদি হাল্কা হয়ে ওঠে রাতারাতি, তাহলে পুরুষের কর্তব্য
কী হবে বল দেখি?”
অনামিকা বললেন, “আচ্ছা সে তর্ক
করার অনেক সময় পাবো আমরা প্রতিদিন – বাকি জীবন। এখন চলো, বেরিয়ে পড়ি। রাজনের অফিস
আছে, গুবলুর স্কুল, বৌমারও স্কুল - ওদের বেরোতে দেরি হয়ে যাবে”। তারপর রাজনের দিকে
ফিরে বললেন, “চলি রে। বৌমা চললাম। গুবলুটার সঙ্গে দেখা হল না...”।
রাজন ধরা গলায় বলল “চলি নয়, আসি
বলো, মা”।
রাজনের কথায় অনামিকা হাসলেন, “না
রে, আবার ফিরে আসার ইচ্ছে তো নেই, তাই আসি নয়, চলিই”।
প্রচণ্ড রাগে ঝুমুর হিসহিস্ করে
বলে উঠল, “কী বলছো কি, তুমি? মাকে আটকাও। তুমিও কি পাগল হলে নাকি? অচেনা অজানা এক পরপুরুষের
সঙ্গে তোমার মা এই বয়সে ভেগে পড়ছে...আর তুমি বলছো, এসো?”
রাজন সেকথার কোন উত্তর দিল না,
মাকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠিকানাটা দেবে না, মা?”
অনামিকা বললেন, “ঠিকানা কলকাতারই
কোথাও, তবে ঠিকানার কী দরকার, মোবাইল নাম্বার তো রইলই”।
অনামিকা কথকতার সঙ্গে বাড়ির বাইরে
পা রাখলেন। ছোট্ট গাড়ির ডিকিতে সুটকেশ তুলে, অনামিকা সামনের বাঁদিকের সিটে বসলেন,
কথকতা ডিকি বন্ধ করে, গাড়ির ডানদিকের সিটে বসে স্টার্ট দিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন