[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে,
স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
[এর আগের পর্ব "ধরে রাখাই ধর্ম" - 👈সূত্রটি ক্লিক করলেই পড়া যাবে।]
মাস দুয়েকের মধ্যে আমাদের উপনয়ন অনুষ্ঠান সমাধা হয়ে গেল, পঞ্জিকা অনুসারে নির্দিষ্ট নির্বাচিত দিনটিতে।
সূর্যোদয় থেকে একের পর এক বিধিসম্মত আচার-অনুষ্ঠান, সুদীর্ঘ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি ও একটানা যজ্ঞ শেষে ব্রহ্মচারীত্বে উত্তরণ হল সেই বালকের। সৌম্য ভিক্ষু বালক - মুণ্ডিত মস্তক, সূচ-বিদ্ধ কর্ণ। পরনে গৈরিক বসন, পায়ে কাঠের পাদুকা, হাতে অদ্ভূত আঁকাবাঁকা বেউল বাঁশের দণ্ড, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ে বানানো বিশেষ ঝোলা। ভিক্ষুর বেশ, কিন্তু ভিক্ষা বৃত্তি করতে হবে না বরং একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর সকলে আসবেন সেই ব্রহ্মচারী বালককে ভিক্ষা দেবার জন্যে। এই ভিক্ষা দান পুণ্যকর্ম। প্রথম ভিক্ষা দেবেন মাতৃসমা কোন নারী, পরবর্তী জীবনে তিনিই হবেন ব্রহ্মচারী সেই বালকের সারাজীবনের দ্বিতীয় মা - ভিক্ষুমা। এক নারী জাগতিক জন্ম দিয়েছেন, উদ্ভাসিত করেছেন প্রাণ, আর এক নারীর হাতে দ্বিতীয় জন্ম হয়ে, উদ্ভাসিত হবে আত্মা। প্রথম নারী আমার মা, দ্বিতীয় নারী হলেন ভিক্ষুমা – আমার পূর্বাশ্রমে যিনি ছিলেন আমার বড়োমামীমা।
“ভবতী ভিক্ষাং দেহি” এবং “ভবান ভিক্ষাং দেহি” বাক্য
উচ্চারণ করে ভিক্ষা চেয়েছিল সেই বালক ব্রাহ্মণ, আর কাঁধের ঝোলা ফাঁক করে ভিক্ষা
গ্রহণের পর “ওঁ স্বস্তি” উচ্চারণে ও হাতের বিশেষ ভঙ্গীতে সকলের মঙ্গল কামনা করেছিল। এই সমগ্র অনুষ্ঠান সুদূর
অতীতের বর্ণাশ্রম বিভাজিত সমাজের আনুষ্ঠানিক রীতিপ্রকরণের অনুসরণ। আজকের আধুনিক
পরিস্থিতিতে বাস্তব অর্থে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এই অনুসরণ বারবার ফিরিয়ে
আনে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যের স্মরণ।
এসব কথা সে
সময় আমার মোটেই মনে হয়নি। বরং আমার তীক্ষ্ণ লক্ষ্য ছিল ভরে উঠতে থাকা ভিক্ষার
ঝুলির দিকে। চাল, আলু আর কিছু আনাজের সঙ্গে জমে উঠছিল সোনার আংটি আর বেশ কিছু নগদ
টাকা। অন্য কিছু নয়, আমি তখন মনে মনে হিসেব করছিলাম কত টাকা জমা হল, আর এই টাকা
দিয়ে কতগুলি বই কেনা যাবে।
আসলে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে মা আমাদের হাতে টাকা দিতেন একটি করে বই কিনতে, আর সেই টাকা নিয়ে চলে যেতাম বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রীটে দেব সাহিত্য কুটিরের দোকানে। যেখানে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথ রাহার বাংলা অনুবাদে বিদেশী ক্ল্যাসিক উপন্যাসসমূহ। এভাবেই দশ-বারো টাকা দরে কিনে ফেলেছিলাম হাঞ্চব্যাক অফ নৎরদাম, ট্রেজার আইল্যান্ড, টয়লার্স অব দি সি...। প্রত্যেকটি বইয়ের পিছনে থাকত আরো অনেক অনেক বইয়ের তালিকা, মনে হত বড় হয়ে যখন চাকরি করব, প্রথম মাসের টাকায় সব বই কিনে নেব, সব – থ্রী মাস্কেটিয়ার্স, রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ, লাস্ট ডেজ অব পম্পেই, দি কানেকটিকাট ইয়াংকি, ডা: জেকিল এন্ড মিঃ হাইড...। কাজেই ভিক্ষার ঝুলি ঝেড়ে, হিসেব করে যখন তিনশ ছাপান্ন টাকা পেলাম, তখন আনন্দের সীমা ছিল না, গোটা দেব সাহিত্য কুটিরটিকে কিনে ফেলার আশ্চর্য স্পর্ধায় চনমনে হয়ে উঠেছিলাম সেদিন।
সব মিলিয়ে সীমিত সাধ্য আর অপ্রয়োজনীয় বলেই, খুব ধুমধাম-জাঁকজমক হল না ঠিকই, কিন্তু মজার কোনো কমতি, আমি অন্ততঃ অনুভব করিনি। ঘনিষ্ঠ বৃত্তের আত্মীয়স্বজন সকলেই এসেছিলেন। কিন্তু একটু বহির্বৃত্তের স্বজনরা আমাদের বয়কট করে ফেললেন, আমাদের এই অধার্মিক অনাচারের জন্যে। তাঁরা পত্রদ্বারা বাবাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন আধুনিক কালের এই হাল্কা চালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে এমন অপকর্ম চাক্ষুষ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই তাঁরা আসবেন না। তাঁদের না আসার কথায় মন খারাপ করে মা ও বাবা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তখন আর নতুন ভাবে ভাবার সময় ছিল না, আর সঙ্গে মেজদাদুর স্থিত আশ্বাস থাকায় নতুন কোন ভাবনাও দানা বাঁধতে পারেনি।
আমাদের
উপনয়ন উপলক্ষে যেদিন প্রীতিভোজ ছিল, শুধু সেদিনই - মাত্র একদিনের জন্যেই রান্নার
ঠাকুর ডাকা হয়েছিল। বাকি দিনগুলিতে মামীমা, মাসিমাদের সঙ্গে পিসিমা, কাকিমারা হাতে
হাত মিলিয়ে সব কাজ করেছিলেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁদের কাজের অন্ত ছিল না,
অথচ সারাটাক্ষণ তাঁদের মধ্যে চলছিল একে অন্যের পিছনে লাগা খুনসুটি। হাসি, হাসি আর
আনন্দ, কোন ভুল বোঝাবুঝি ছিল না। মাসিমারা বাবার শ্যালিকা, কাজেই তাঁরা জামাইবাবু
হিসেবে বাবার পিছনে লাগছিলেন খুব, আর আড়াল থেকে মাসিমাদের এই প্রগলভতা রীতিমতো
উপভোগ করতে দেখেছিলাম কাকীমাদের – কারণ ভ্রাতৃবধূ হিসেবে তাঁরা বাবার সামনে আসতেন
খুবই কম। কোন কোন সময়
এমনও দেখেছি কাকীমারাই মাসিমাদের প্ররোচিত করছেন বাবার পিছনে লাগার জন্যে! ভীষণ
ব্যস্ততার মধ্যেও মেজদাদু ও ঠাকুমা নীরবে উপভোগ করছিলেন সমস্ত পরিস্থিতি, দিদিমার
অধরেও লাগাতার মৃদু হাসি – যদিও দু একবার দুর্বলভাবে আপত্তি জানাচ্ছিলেন তাঁর
মেয়েদের বাচালতায়। এর মধ্যে ভীষণ
অভাব অনুভব হচ্ছিল অনুপস্থিত বড়োমামা আর বন্নিদিদির। বড়োমামা কী করে আসবেন, সব্বাই
মিলে ঘরবাড়ি ফেলে আসা যায় - গরু-বাছুর, খেতখামার, কাজকর্ম কে সামলাবে? আর
বন্নিদিদি চলে এলে বড়োমামার খাওয়াদাওয়া চলবে কী করে? কাজেই, ওরা নাচার, আসতে
পারলেন না।
তবু সে
যাই হোক, সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভূত মধুর আত্মীয়তা। যার প্রতিটি পরতে আনন্দ এবং
আনন্দ। তখন মনে হয়েছিল যাঁরা আমাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অনুপস্থিত রইলেন,
তাঁরা ধর্মের ধ্বজা হয়তো ধারণ করে রইলেন, কিন্তু অনুভব করতে পারলেন না – আত্মীয়তার
অনবদ্য সহজ স্বভাবধর্ম।
আমরা
ছেলেরা ও বড়োরা যখন রাত্রে ম্যারাপ বাঁধা ছাদে শুতে যেতাম, তখন নীচেয় মহিলারা খেতে
বসতেন। তাঁদের গল্প আর হাসির আওয়াজ শুনতে শুনতে
আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, আবার সকাল সকাল ছোট মাসিমা বড়ো ট্রেতে করে অনেক খালি কাপ আর
বিস্কুট আর ঢাউস কেটলিতে চা নিয়ে ছাদে আসতেন – বেড টি দিয়ে বড়োদের ঘুম ভাঙাতে। আর
আমাদের তুলে দিতেন মুখ ধুয়ে চটপট রেডি হয়ে নিতে – জল খাবার রেডি। বড়োদের অনেক কাজ
– সমস্ত অনুষ্ঠান সুষ্ঠু সম্পন্নের জন্য যোগাড় যন্ত্র করতে হবে - ব্যবস্থা করতে
হবে। সক্কাল সক্কাল উঠে সবাই বেরিয়ে পড়লেন বাজার করতে। আজ সারাটা দিনে সমস্ত কাঁচা বাজার সেরে রাখতে হবে, কালকে সকালে বেরিয়ে
শুধু মাছ, আর একটু বেলায় দই আর মিষ্টি। কাজেই
সারাটাদিন সকলের চরম ব্যস্ততা, বারবার বাজার যাওয়া আর আসা। বস্তা বস্তা মাল উঠে
আসছে বাড়ির ছাদে। আলু থেকে শুরু করে কলাপাতা, মায় মাটির গেলাস পর্যন্ত - থরে থরে
সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ছাদের একধারে আর অন্য এক ধারে কয়লা, জ্বালানি কাঠ, ঘুঁটে,
কেরোসিন আর বেশ কিছু ইঁট আর মাটি।
রান্নার
ঠাকুর বিকেলে এসে ছাদের এক কোণে মাটি আর ইঁটের গাঁথনিতে বানিয়ে তুলল দু-দুটো উনুন,
তার ভিতরে লোহার শিক দেওয়া। আজ সারারাতে মাটি শুকিয়ে উনুন রেডি হয়ে থাকবে – কালকে
সকালে ঘুঁটে আর কয়লা পেটে নিয়ে, তারা জ্বলে উঠবে প্রায় শদেড়েক লোকের রান্নার
আয়োজনে। সারাটা দিনের দৌড়োদৌড়ির পর রাত আটটা নাগাদ বড়োদের মিটিং বসল ছাদে, ফর্দ
অনুযায়ী সব মাল এসেছে কি না, না এসে থাকলে এক প্রস্থ হৈ চৈ, নীচে মহিলামহলে চায়ের
হুকুম, তারপর আবার নতুন ফর্দ বাকি জিনিষের, কাল সক্কালেই আবার বেরোতে হবে বকেয়া
মাল কিনতে।
এদিকে
নীচেয় রাত্রে বাড়ির লোকেদের রান্নায় ব্যস্ত মাসিমা আর কাকিমারা। দিদিমা আর মেজ
ঠাকুমা পা ছড়িয়ে বসেছেন সবুজ পানপাতার জঙ্গল নিয়ে। কালকের নিমন্ত্রিতদের জন্যে পান বানাচ্ছেন। চারপাশে চূণের ডাব্বা,
সুপুরির স্তূপ আর যাঁতি, তরল খয়েরের পাত্র, ধনের চাল, লাল-নীল রঙীন চিনির মোড়কে
মৌরী। আমার এক মাস্তুতো দিদি আর এক পিস্তুতো
দিদি - খুব ভাব হয়ে গেছে দুজনে – গায়ে গা ঘেঁষে বসে, খোসা ছাড়িয়ে বের করছে ছোট
এলাচের দানা। দুজনে নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কি কথা বলছে কে জানে, ক্ষণে ক্ষণে
হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের গায়ে...। দিদিমা স্নেহ মাখা কণ্ঠে তাদের বলছেন, ‘দ্যাকোদিকি
কাণ্ডখানা, এ মেয়েদুটো যে হেসে একেবারে গড়াগড়ি, এত হাসির কি হল, বাছা’? মেয়েদুটি
দিদিমার কথায় কিছুক্ষণ চুপচাপ এলাচ ভাঙল ঠিকই, কিন্তু সে আর কতক্ষণ – সামলে থাকা
যায় নাকি? তারা আবার হেসে হেসে লুটিয়ে পড়তে লাগল আগের মতোই।
সবাই
ব্যস্ত, একমাত্র আমি ছাড়া। একে আমি সদ্য পৈতে হওয়া বামুন – অন্যদিকে খুব একটা বড়োও
নই আবার খুব একটা ছোটও নই। কাজেই কিছু কাজ করতে গেলেই কেউ না কেউ দৌড়ে আসছেন আমাকে
আটকাতে, ‘এ হে হে হে, তুই কী করছিস এখানে, রাখ রাখ, এই কি তোর কাজ করার সময়’?
কাজেই আমি সব মহলেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সব কিছু, দেখতে লাগলাম এই আয়োজন। সকলের
স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ পরিশ্রম, পারষ্পরিক সম্পর্কের অদ্ভূত সংমিশ্রণ।
দুটি
মাত্র ঘর, একটি মাত্র টয়লেট, অনেকটা খোলা ছাদে বাঁশ, তেরপল আর কাপড়ের ম্যারাপ আর
বেশ কয়েকজন সজ্জন প্রতিবেশীর উদার সাহায্যে প্রায় জনা তিরিশেক স্বজনের দিব্ব্যি
সংকুলান হয়ে গেল চার-পাঁচদিনের জন্যে। কিভাবে হয়েছিল ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে, কারণ
আজকাল সব শহরেই বাজেট অনুসারি ছোটবড় উৎসববাড়ির অভাব নেই, আর দুঘরের বাসায় এমন
অনুষ্ঠান করার কথা আজ আর কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। এসব হতে পেরেছিল কারণ - অনলস
কাজের মধ্যে, ছোট বড় সবার প্রতি সমান নজর রাখতে রাখতে, বড়মামীমাকে অনেকবার বলতে
শুনেছিলাম – “যদি হও স্বজন, তেঁতুল পাতায় নজন”।
ঋণ করে
সাধ্যাতীত ব্যয়ে অনেক বড়োসড়ো আয়োজন করাই যেত, কিন্তু সমানুপাতে আনন্দ বেশী হত,
এমনটা মনে হয় না। বরং ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তার পিছুটান একটা থাকত অনুষ্ঠানের
প্রতিটি মুহূর্তেই, সেটাতে আনন্দের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে পারত।
মহাভারতে
বকবেশী ধর্মরাজ, যুধিষ্ঠিরকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল – বিশ্বে
সবচেয়ে সুখী কারা? স্থিতপ্রজ্ঞ যুধিষ্ঠির জবাবে বলেছিলেন যিনি অঋণী আর যিনি
অপ্রবাসী – তাঁরাই সবচেয়ে সুখী। আমাদের মেজদাদু তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রায়োগিক
প্রত্যয় দিয়ে আমাদের সুখী এবং বিপন্মুক্ত করেছিলেন। কারণ আমাদের এই উপনয়ন
অনুষ্ঠানের প্রায় মাস সাত-আটেক পরেই, কোনদিন অসুস্থ না হওয়া আমার মা, হঠাৎই কঠিন
অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন এবং সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছিলেন সুদীর্ঘ
চিকিৎসার পর। কাজেই ঋণ করে আনন্দ অনুষ্ঠান, আমাদের এক চরম অনায়ত্ত বিপদের দিকে
টেনে নিতে পারত। তা ঘটেনি, আমরা অঋণী ছিলাম বলে। তখন বারবার মনে হয়েছিল প্রকৃত
গুরুজন হয়ে ওঠা বড়ো সহজ কাজ নয় – শুধু বয়েস নয় দরকার আরো অনেক কিছুর – সবচেয়ে বেশী
দরকার প্রকৃত স্বজন হয়ে ওঠা।
--০০--
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন