আমার সুদীর্ঘ জীবনের প্রত্যেকটি রেলযাত্রায় প্রতিবারই নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেমন পৌঁছেছি – তেমনই সে পথে কখনো পেয়েছি ইতিহাসের স্পর্শ, কখনো জাগিয়েছে কৌতূহল, কখনো পেয়েছি নির্মল আনন্দ। কিছু স্টেশন নিয়ে আমার সেই নানান অনুভবের কথাই এখন বলব।
১)
আদিসপ্তগ্রামঃ - হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে
ব্যাণ্ডেল জংশন থেকে ৪ কিমি দূরত্বে আদি সপ্তগ্রাম স্টেশন বাংলার মধ্যযুগে অত্যন্ত
সম্পন্ন বন্দর নগর ছিল, যদিও সে সময় তার নাম ছিল সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদীর তীরে
অবস্থিত এই বন্দরনগরীর গৌরবকথার বারবার উল্লেখ পাওয়া যায় বাংলার মঙ্গল
কাব্যগুলিতে। হিন্দু রাজত্বের পর মুসলিম রাজত্বেও এই বন্দর-নগরের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি।
শোনা যায় মরক্কো নিবাসী ভূপর্যটক ইবন বতুতা (১৩০৪-১৩৬৮),
১৩৫০ সালে কিছু দিন এই নগরে বাস করেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ
বৃত্তান্ত থেকে এই নগরের এবং দক্ষিণ বাংলার সমসাময়িক বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
১৫৩৫ থেকে বহু বাধা, বিঘ্ন এবং বারবার যুদ্ধের পর ১৫৫০ সালে বাংলার তৎকালীন আফগান
শাসকের থেকে পর্তুগীজরা এই বন্দর থেকে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। যদিও পরবর্তী কালে
সরস্বতী নদী নাব্যতা হারায় এবং তার প্রবাহ একসময় ক্ষীণ হতে হতে অবলুপ্ত হয়ে যায়। সেই
সঙ্গে সপ্তগ্রামও অতীতের সমস্ত গৌরব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
২) আমবাড়ি – ফালাকাটাঃ - নিউজলপাইগুড়ি থেকে আসামগামী রেলপথে, জলপাইগুড়ি জেলার একটি রেল স্টেশন। দ্রুতগামী রেলগাড়ি এই স্টেশনকে না ধরলেও, নিউজলপাইগুড়ি এবং হলদিবাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের রেলপথে এই স্টেশনটি বেশ বিখ্যাত। এই স্টেশনের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ – কারণ নামের প্রথম অংশটি গ্রামের নাম – আমবাড়ি এবং দ্বিতীয় নামটি ওই গ্রামের আরাধ্য দেবমূর্তি রাজা ফালাকাটার নামে।
শোনা যায় প্রায় ৩০০ বছর আগে যে ফালাকাটা দেবতার পুজো শুরু
হয় – সেটি প্রকৃতপক্ষে শিবঠাকুর। যে মন্দিরে এখন ফালাকাটা দেবের পুজো হয় সেটি
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেবী চৌধুরানি, যাঁর কথা চিরন্তন করে গিয়েছেন সাহিত্যসম্রাট
বঙ্কিম। কথিত আছে দেবী চৌধুরানির সঙ্গে ভবানী পাঠকও এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো দিতে
আসতেন। প্রাচীন পরম্পরা অনুযায়ী আষাঢ় মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে, মন্দিরে
স্থাপিত তিনটি বিগ্রহের পুজা হয় – রাজা ফালাকাটা, তুলাকাটা এবং ধনাকাটা। এই পুজোর
পরেই জমিতে আমন ধান রোপনের কাজ শুরু হয়। এই পুজো উপলক্ষে যেহেতু দূরদূরান্ত থেকে
ভক্ত সমাবেশ হয়, সেই কারণে অন্য সময় স্টেশনটি নির্জন থাকলেও, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে খুবই
ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
২)
কর্ণ সুবর্ণঃ - কাটোয়া – আজিমগঞ্জ রেলপথে একটি ছোট
স্টেশন কর্ণসুবর্ণ, বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্কর (রাজত্বকাল ৬০৬-৬৩৭
খ্রীষ্টাব্দ) রাজধানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে আজও। যদিও এই শহরের গৌরব অত্যন্ত
ক্ষণস্থায়ী মাত্র ৩১ বছর, রাজা শশাঙ্কর মৃত্যুর পরেই এই শহর ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত
হয় এবং কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে যায়। এই রাজধানী শহরের অদূরেই ছিল বৌদ্ধদের রক্তমৃত্তিকা
মহাবিহার। স্থানীয় মানুষের মুখে সে নাম ছিল
রাঙামাটি বিহার। এই বিহার ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে নিয়ে যদিও বিতর্ক আছে,
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এটির প্রতিষ্ঠাতা মৌর্য সম্রাট ধর্মাশোক। কর্ণসুবর্ণ এবং
রাঙামাটি বিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত
থেকে। ভারতের ইতিহাসে শশাঙ্ক বিখ্যাত কারণ সম্রাট হর্ষবর্ধন অন্ততঃ বার দুয়েক চেষ্টা
করেও তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেননি। বরং হর্ষবর্ধন সিংহাসনে বসার আগে, তাঁর দাদা
রাজ্যবর্ধনকে (৬০৬ সালে) শশাঙ্ক যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করেছিলেন। সিংহাসনে বসার
কিছুদিন পর হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়ে চিরশত্রু
হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বৌদ্ধ বিদ্বেষী মনে করতেন। কিন্তু হিউ-য়েন-সাং-য়ের ভ্রমণ
বৃত্তান্তে রাঙামাটি বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং কর্ণসুবর্ণ (যার চলিত নাম ছিল কানসোনা)
নগরের হিন্দুদের মধ্যে কোন বৈরীতার উল্লেখ নেই – বরং দুই ধর্মের মধ্যে তিনি
সম্প্রীতিই লক্ষ্য করেছিলেন।
৩)
কৃষ্ণনগরঃ বাংলার ইতিহাসে নদীয়ার রাজা এবং রাজধানী শহর কৃষ্ণনগরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-৮৩) এক স্মরণীয় নাম। তিনি সংস্কৃত ও ফার্সী দুটি ভাষাতেই যেমন
বিদ্বান ছিলেন, তেমনি তিনি সঙ্গীত ও অস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। বিদ্যাচর্চার
জন্যে মধ্যযুগে বাংলার নদীয়া জেলার যে সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল, তার অনেকটাই তিনি
ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তাঁর সভায় নবরত্ন সভার মতোই জ্ঞানী-গুণীজনের সমাবেশ ছিল।
তাঁর সভাকবি ছিলেন সাধক রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত
আজও বাংলার ঘরে ঘরে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য, শত খানেক
বছর আগেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাঁর সভায় আরও ছিলেন, পুরাণ বিশারদ পণ্ডিত গদাধর
তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল
বাচস্পতি, রাজবৈদ্য ও আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন
গোপালচন্দ্র বিদূষক – যিনি গোপাল ভাঁড় নামে আজও বঙ্গ সমাজে তাঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধি
এবং তীক্ষ্ণ রসবোধের জন্য সুপরিচিত। শোনা যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায়
জগদ্ধাত্রী পূজারও প্রচলন করেছিলেন।
৪)
খাগড়াঘাট রোডঃ - কাটোয়া – মালদহ রুটে এই স্টেশনের অতীত ঐতিহ্য আধুনিক
যুগে কেউই মনে রাখেনি। খাগড়াঘাট ভাগিরথীর পশ্চিম তীরে হলেও – নদীর পূর্ব পাড়ের
খাগড়া গ্রাম বিগত হাজার খানেক বছর আগে থেকে বিখ্যাত ছিল কাঁসা এবং পিতলের
বাসনপত্রের জন্য। শুধু মাত্র বাসনপত্র নয়, কাঁসা, পিতল এবং অষ্টধাতুর মূর্তিশিল্পেও এই গ্রামটির সুনাম ছিল
দেশেবিদেশে। আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি, কন্যার বিবাহে বরকে “খাগড়াই কাঁসার”
দানসামগ্রী দিতে পেরে কন্যার পিতারা বড়ো তৃপ্তি পেতেন। স্টেনলেস স্টিল এবং
অন্যান্য আধুনিক উপকরণ আমাদের এই প্রাচীন শিল্পটিকে মোটামুটি শেষ করে ছেড়েছে।
গুরুত্ব হারিয়েছে খাগড়া।
৫) গুঞ্জরিয়াঃ - ছাত্রাবস্থায় জলপাইগুড়িতে থাকার সময় শেয়ালদা থেকে নিউজলপাইগুড়িগামী
দার্জিলিং মেল ছিল আমাদের নিত্যসাথী। সেরকমই কোন এক যাত্রার সময়, সিগন্যাল না পেয়ে
দার্জিলিং মেল দাঁড়িয়ে গেল “গুঞ্জরিয়া” স্টেশনে। জায়গাটি উত্তর দিনাজপুর জেলায়।
তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে, নির্জন-নিরিবিলি, গাছপালা
ঘেরা ফাঁকামাঠের মধ্যে স্টেশন। আমাদের এক বন্ধু বলেছিল, এই
স্টেশনের নাম নিশ্চয়ই রবিঠাকুর রেখেছিলেন। মংপু, দার্জিলিং, কালিম্পং যাওয়ার পথে
তিনি নিশ্চয়ই কোনদিন এইখানে নেমেছিলেন। গাছগাছালি ঘেরা
নিরিবিলি এই জায়গাটি ঋষিপ্রতিম কবির মনে হয়তো কোন অনুভূতির গুঞ্জরন তুলেছিল।
বন্ধুর গল্পটি সত্যি কিনা জানি না, অন্য কোন সূত্রে এই তথ্যটি আজ পর্যন্ত পাইনি।
কিন্তু আজও ওই লাইনে যাওয়ার সময় মনে মনে আশা করি, ট্রেনটি যেন সিগন্যাল না পায়, ওই
স্টেশনে যেন একবারটি দাঁড়ায়, মনে পড়ে যায় কবিগুরুর গানের দুটি পংক্তি -
“ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে
নাড়া,
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে
সাড়া”।
৬) জয়নগর-মজিলপুরঃ – শেয়ালদা-লক্ষ্মীকান্তপুর
রেলপথে জয়নগর-মজিলপুর বেশ ব্যস্ত একটি স্টেশন। শেয়ালদা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৯
কিমি। জয়নগরের নাম শুনলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে এই অঞ্চলের বিখ্যাত মোয়ার কথা। নলেনগুড়
এবং ক্ষীর দিয়ে মাখা সুগন্ধী খইয়ের মোয়াগুলি শীতের দিনের অত্যন্ত লোভনীয় একটি
খাবার সন্দেহ নেই। মোয়া ছাড়াও এই অঞ্চলটি মনে রাখার মতো – এর প্রাচীন ঐতিহ্যের
জন্য, কিন্তু সে সব কথা আমরা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। নিমতা গ্রামের বাসিন্দা কবি
কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যে এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৫৮ সালে। সে
সময় এই সম্পন্ন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত হুগলি নদীর প্রধান শাখানদী আদি গঙ্গা। এই
নদী পথে বাণিজ্যের কারণেই এই অঞ্চল সে সময় অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু গ্রাম হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী
কালে আদিগঙ্গার প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে এই অঞ্চলটির গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়ে
আসে। শোনা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে, বাংলার সুবাদার ইসলাম খানের কাছে যশোরের
(আধুনিক বাংলাদশে) রাজা প্রতাপাদিত্য
পরাজিত হওয়ায়, চন্দ্রকেতু দত্ত নামক জনৈক ভাগ্যান্বেষী সম্পন্ন ব্যক্তি যশোর ছেড়ে মজিলপুরে
চলে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন তাঁদের পারিবারিক পুরোহিত শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতা এবং
রঘুনন্দন পোতা। পরবর্তী সময়ে দত্ত পরিবার বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্গাতার বংশধরেরা ভট্টাচার্য উপাধি গ্রহণ করেন, এবং শিক্ষা-দীক্ষায়
এই বংশ অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেন। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও অসামান্য পণ্ডিত শিবনাথ
শাস্ত্রী এই বংশেরই সন্তান। এই বংশের আরেক কৃতী সন্তান হলেন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী
কানাইলাল ভট্টাচার্য।
সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন কালের গ্রাসে অনেকটাই নষ্ট
হয়ে গেলেও, বেশ কিছু নিদর্শন আজও জয়নগরের তৎকালীন গৌরব ও সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয়। যেমন,
জয়চণ্ডী মন্দির, নাটমন্দির সহ রাধাবল্লভ মন্দির ও তার সংলগ্ন চারচালা দোলমঞ্চ, দ্বাদশ
শিবমন্দির ইত্যাদি।
৭) ঝাপটের ঢাল, পিচকুরির ঢাল এবং
নোয়াদার ঢালঃ – পূর্ব বর্ধমানে সাহেবগঞ্জ
লুপে এই তিনটি স্টেশনের অবস্থান। প্রায় পাশাপাশি এই তিনটি স্টেশনের নামে ঢাল
শব্দটিতেই আমার কৌতূহল। এই অঞ্চলের পশ্চাৎভূমি কি
অনেকটাই উঁচু, এই তিনটি এলাকা কি নিম্নগামী, ঢালু? সেই কারণেই কি তিনটি গ্রামের
নামে ঢাল যুক্ত হয়েছে? ওইদিকের কিছু অধিবাসীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর পাইনি
– বলেছিলেন - নাম-নামই তার আবার কারণ কি? তবে নোয়াদার ঢাল সম্বন্ধে একটি জনশ্রুতি
শোনা যায় – পরপর দুটি স্টেশনের নামে ঢাল শব্দটি শুনে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার নাকি বিরক্ত
হয়ে বলেছিল, “নো আদার ঢাল”। কিন্তু ভালো ইংরিজি না জানা বাঙালী ওভারসিয়ার ভেবেছিল
সায়েব স্টেশনটির নাম রাখল- “নোয়াদার ঢাল”।
৮) পলাশীঃ – শেয়ালদা-বহরমপুর
শাখায় পলাশী স্টেশনের অদূরের আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে
যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের। নবাবের
সৈন্য বাহিনীর তুলনায় যদিও কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা ছিল তুচ্ছ।
কিন্তু সিরাজের প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্য আমলাদের ষড়যন্ত্রে নবাব সেই যুদ্ধে শুধু
পরাজিত হননি, নিহতও হয়েছিলেন তাঁর নিজেরই বিশ্বাসঘাতক এক কর্মচারীর হাতে। দিনটা
ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন। এই সাফল্য লোভী ও হিংস্র স্বার্থপর ব্রিটিশজাতিকে পথ
দেখিয়েছিল কীভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতকে গ্রাস করে চরম শোষণ করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রভাবশালী
সামান্য কিছু মুসলিম ও হিন্দুর ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত চক্রান্তের কারণে, ভারতের
আপামর জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগে প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশের পদানত থাকতে হয়েছিল। ভারতের
যাবতীয় সম্পদ প্রায় নিঃশেষে লুঠ করে, সে সময় ব্রিটেন হয়ে উঠেছিল বিশ্বের এক নম্বর বৈভবশালী,
সভ্য, শিক্ষিত ও রুচিশীল দেশ! তার সূত্রপাত হয়েছিল এই পলাশীতেই।
৯) বর্ধমানঃ - হাওড়া-দিল্লি রেলপথে বর্ধমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং
ব্যস্ত জংশন স্টেশন। মিহিদানা-সীতাভোগের জন্য বিখ্যাত এই শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও
কিন্তু অপরিসীম, যদিচ আমরা অনেকেই সেকথা মনে রাখি না। বর্ধমান পূর্ব ভারতের
প্রাচীনতম জনপদের একটি। এই জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জৈন কল্পসূত্রে। বলা হয়
২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর – যাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল
বর্ধমান – ধর্মপ্রচারের জন্য কিছুদিন আস্তিকগ্রামে ছিলেন। তাঁর পুণ্য স্মৃতিতে এই
জনপদের নাম হয় বর্ধমান। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসনকালেও এই শহর এবং জনপদের
গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যার ফলে এই শহরটিকেই বাংলার প্রাচীনতম শহর বলা যায় – যা আজও
সগৌরবে বিদ্যমান।
১০) বোলপুর-শান্তিনিকেতনঃ
- বর্ধমান–রামপুরহাট রেলপথে বোলপুর স্টেশন। প্রথমেই এই বোলপুর নামের ইতিহাসটা জেনে
নেওয়া যাক। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী রাজা সুরথ ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা, এবং তাঁর
রাজধানী ছিল বোলপুর সংলগ্ন সুপুর এলাকা। এই রাজা সুরথের নাম মহালয়ার ভোরে
শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের সময় আমরা শুনেছি এবং তিনিই মর্তে মহিষাসুরমর্দিনী দূর্গাপূজার
প্রচলন করেন। সন্ধিপূজার সময় তিনি নাকি লক্ষাধিক ছাগবলি দিতেন এবং সেই রক্ত প্রবাহ
আটকাতে বাঁধ দেওয়া হত প্রতিবছর। এই বলি থেকেই ওই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বলিপুর, যা লোকমুখে হয়ে
ওঠে বোলপুর এবং সেই বাঁধের নামেই আজকের বাঁধগোড়া এলাকা।
প্রাচীন কাহিনী যাই হোক, আধুনিক বোলপুরের
সঙ্গে সর্বতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের গভীর স্বপ্ন ও অজস্র স্মৃতি।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একবার পশ্চিম-ভ্রমণ
থেকে ফেরার পথে আমদপুর স্টেশনে নেমে পাল্কি চড়ে বোলপুর হয়ে রায়পুর যাচ্ছিলেন। তাঁর
ভক্ত-শিষ্য শ্রীকণ্ঠ সিংহরায় ছিলেন রায়পুরের জমিদার। যাওয়ার পথে তাঁর চোখে পড়ে প্রায়
জনবিরল অনন্ত-বিস্তৃত এই নিঃস্ব প্রান্তরটি – যার এক প্রান্তে সম্বল ছিল দুটি মাত্র
ছাতিমগাছ। জায়গাটি তাঁর ভালো লেগে যায় এবং ধ্যানী ও প্রকৃতিরসিক মহর্ষি স্থির করেন
– এইখানেই আসন পেতে তিনি মগ্ন থাকবেন তাঁর পরমপিতার ধ্যানে – এই বিবাগী প্রান্তরই
হবে তাঁর শান্তিনিকেতন। রায়পুরের জমিদারের থেকে প্রায় ২০ একর জমি লিজ নিয়ে তিনি
১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন আশ্রম।
সেই আশ্রমটিই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ে হয়ে উঠল বিশ্ব-মনীষার মিলনক্ষেত্র। আশ্রম ভিত্তিক বিদ্যালয়
দিয়ে শুরু করে, আমৃত্যু কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর
আমন্ত্রণে বিশ্বের কত দেশ থেকে সম্মিলিত হয়েছিলেন কত যে মনীষী। শুধু বিদ্যাচর্চাই
নয় – ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, নৃত্য, গীত, অভিনয় – এককথায় ললিতকলার সর্ববিষয়েই সে সময় ভারতবর্ষে
শান্তিনিকেতনই ছিল পথিকৃৎ।
সেই স্মৃতি বাঙালী হিসেবে আমাদের
যেমন গর্বিত করে, তেমনই তাকে ঘিরে আধুনিক বিদ্বজ্জনদের নানান কলহ চরম লজ্জা দেয়।
১১) মুর্শিদাবাদঃ শেয়ালদা-লালগোলা রেলপথে
এই স্টেশনের অবস্থান। ১৭০৩ থেকে ১৭৭১ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ছিল সুবে বংলার রাজধানী। মুঘল আমলে সুবে বাংলা বলতে আধুনিক
পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, বিহার ও ঊড়িষ্যা অঞ্চল বোঝাতো। শোনা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের
অন্যান্য যে কোন অঞ্চলের তুলনায় এই সুবে বাংলা থেকেই নাকি সর্বাধিক রাজস্ব আদায়
হত। সেই কারণেই, মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব, ১৭০৩ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর
দক্ষতায় আস্থা রেখে, তাঁকে বাংলার দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেন। বাংলার
দেওয়ান হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর তীরের ছোট শহর মকসুদাবাদে তাঁর
দপ্তর সরিয়ে আনেন এবং ১৭০৪ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়ে নিজের নামে এই
শহরের নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। মুঘল বাদশাদের দেওয়ান হলেও প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদাকুলি
খাঁ হয়ে উঠলেন বাংলার নবাব – কারণ বাংলার শাসন ব্যবস্থায় দিল্লি তেমন নাক গলাত না,
সময় মতো নির্দিষ্ট রাজস্ব পেয়ে গেলেই দিল্লি খুশি থাকত।
১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির
মসনদ ঘিরে মুঘল পরিবারে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল, স্বাধীন নবাব হয়ে উঠতে মুর্শিদকুলির
কোন বাধাই রইল না। প্রশাসক হিসাবে অত্যন্ত দক্ষ মুর্শিদকুলি, এবার নিজের মনের মতো
করে সাজিয়ে তুললেন মুর্শিদাবাদ শহর এবং রাজ্য প্রশাসন। তখনকার ঐতিহাসিকদের বর্ণনা
থেকে জানা যায় – ভাগীরথীর তীরে রম্য প্রাসাদ ও বাগিচা ঘেরা মুর্শিদাবাদ ছিল
উজ্জ্বল এক শহর – যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষই আনন্দে, সুখে, শান্তিতে বাস করত।
১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলির মৃত্যুর
পর মুর্শিদাবাদের মসনদে বসলেন, তাঁর জামাই সুজাউদ্দিন। তাঁর আমলে শহরে আরও অনেক
প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং বেড়ে ওঠে শহরের জাঁকজমক। এরপর ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের
মৃত্যুর পর মসনদে বসলেন তাঁর পুত্র সরফরাজ। কিন্তু মাত্র একবছরের মধ্যে তাঁর পিতার
অমাত্য ও পারিষদদের ষড়যন্ত্রে, তাঁর পিতার অধীনস্থ বিহারের দিওয়ান আলিবর্দী মুর্শিদাবাদ
দখল করতে এলে, ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত এবং নিহত হলেন। আলিবর্দী
হলেন মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব।
আলিবর্দী খাঁ অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক
ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর আমলেই - ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ - মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে
দক্ষিণবঙ্গ প্রত্যেকবছর বিধ্বস্ত হতে থাকে এবং তাঁকেও ব্যতিবস্ত থাকতে হত। অবশেষে
আলিবর্দির সঙ্গে মারাঠাদের বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা দেওয়ার এক চুক্তির ভিত্তিতে ১৭৫১
সালের পর বর্গী আক্রমণ থেকে বাংলা পরিত্রাণ পায়।
১৭৫৬ সালে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর, তাঁর
মসনদে বসলেন তাঁর দৌহিত্র, মাত্র ২৩ বছর বয়সী সিরাজদ্দৌলা। প্রথম থেকেই তাঁকে ঘিরে
প্রাসাদের ভিতরে এবং প্রশাসনিক মহলে ঘোরতর ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। সেই
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে
চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হন এবং পরে নিহত হন।
সিরাজের পতনের পর ব্রিটিশ গভর্নর ক্লাইভ
মুর্শিদাবাদ শহর এবং তার ঐশ্বর্য দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন,
“মুর্শিদাবাদ লণ্ডন শহরের মতোই বিশাল, জনবহুল এবং ধনী শহর, কিন্তু দুটোর
মধ্যে তফাত একটাই, এই শহরের অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তি, যে বিপুল পরিমাণ
সম্পদের অধিকারী, কোন লণ্ডনবাসীর পক্ষেই তা কল্পনা করা সম্ভব হবে না”।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ছোট্ট
অংশ বাংলার এই ঐশ্বর্য ভাণ্ডার লুঠ করে ব্রিটিশদের অর্থলিপ্সা বেড়ে গেল বহুগুণ। সম্পূর্ণ
ভারত লুঠের জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করল এবং ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদ
থেকে তারা বাংলার রাজধানী সরিয়ে আনল
কলকাতায়, পরে কলকাতাই হয়ে ওঠে ভারতের রাজধানী।
মুর্শিদাবাদ পড়ে রইল অবহেলায় এবং
কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে গেল স্বাধীন বাংলার শেষ গৌরবময় ইতিহাস।
১২) রাজাভাত খাওয়াঃ – নিউজলপাইগুড়ি –
আলিপুরদুয়ার রেলপথে এই স্টেশনটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসাধারণ এক মৈত্রীর
লোককথা। কোচবিহারের কোচ রাজাদের সঙ্গে ভূটানের ভোট
রাজাদের ছিল তীব্র রেষারেষি, উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত এবং উভয়েই হার
মেনে মিত্রতা স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে ১৮০০ সালের কোন এক
সময় কোচ রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, ভোট রাজাকে পরাস্ত না করে তিনি ভাত খাবেন না। এই প্রতিজ্ঞার কথা কানে আসতে ভূটানের রাজা বিচলিত
হলেন এবং সপারিষদ দেখা করতে গেলেন কোচ রাজার সঙ্গে। দুই পক্ষের সাক্ষাৎ হয়েছিল এই
গ্রামেই – কিন্তু সেবার আর যুদ্ধ নয় দুই রাজা মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে আহার
করেছিলেন, বলা বাহুল্য ভাতই ছিল উভয় রাজার প্রধান খাদ্য। সেই থেকেই নাকি এই
গ্রামের নাম রাজাভাত খাওয়া।
সম্পা: পথিক রাহা ও রাজীবকুমার সাহা
একপর্ণিকা প্রকাশনী, ৪০০\- (১৫% ছাড় ও ফ্রি শিপিং)
WhatsApp Easy Order +91 9366 531 526
কলেজ স্ট্রিটে জয়ঢাক প্রকাশন ১৮, সূর্য সেন স্ট্রিট দ্বিতল
জানা স্টেশন, অজানা ইতিহাস। ধন্যবাদ লেখক ও তাঁর টিমকে।
উত্তরমুছুনআরও ধন্যবাদ লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্যে।
উত্তরমুছুন