৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ
শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ
দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যলীলার যাবতীয় ঘটনার কথা জানা
যায়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বিবরণের কথা ভারতীয় হিন্দুদের অতি পরিচিত, সে বর্ণনায় যাচ্ছি না।
একটিমাত্র বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কৃষ্ণের জন্মের পরেই মাতা যশোদার কন্যার
সঙ্গে মাতা দেবকীর পুত্রের বদলাবদলি ঘটিয়ে ছিলেন পিতা বসুদেব। মাতা দেবকীর অষ্টম
গর্ভের সন্তান ভেবে, রাজা
কংস এই কন্যাটিকে যখন হত্যা করতে গেলেন, দেখা গেল, এই কন্যা কোন সাধারণ শিশু নয়, তিনি দেবী যোগমায়া। তিনি অষ্টভুজা
দেবী, তাঁর হাতে ধনু, শূল, বাণ, চর্ম, খড়গ, অসি, চক্র ও গদা। তিনি
দিব্যমালা,
বসন ও
রত্ন-অলংকারে ভূষিতা। পুজোর অর্ঘ নিয়ে তাঁর সঙ্গীরা - সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, কিন্নর, অপ্সরা ও উরগগণ - তাঁর
স্তুতি করছিল। বলা বাহুল্য, এই দেবী অনার্য দেবী, কৃষ্ণের জন্মের নিরাপত্তার জন্যেই
তিনি মাতা যশোদার গর্ভে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।
এরপর কৃষ্ণের শৈশব, বাল্য ও কৈশোরের নানান আশ্চর্য লীলার কথা আমরা সকলেই জানি, তবুও আরেকবার সংক্ষেপে
আলোচনা করে নেওয়া যাক।
রাজা কংস দেবকীর কন্যা সন্তানের দেবী রূপ দেখেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন
না, কারণ অন্তর্হিত হওয়ার আগে
দেবী ঘোষণা করেছিলেন, “রে
দুষ্ট কংস,
আমাকে মেরে
তুই কী করবি?
তোর শত্রু
তোর মৃত্যুরূপে কোথাও না কোথাও জন্ম নিয়েছেন। অতএব, এরপর তুই আর অন্য নিরাপরাধ
শিশুদের অকারণ বধ করিস না”। কংসের মন্ত্রণাদাতারা সকলেই ছিলেন, রাক্ষস বা দৈত্য-দানব।
তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে, তিনি স্থির করলেন, মথুরা, ব্রজ (বৃন্দাবন) এবং আশেপাশের
গ্রামের শিশুদের, যাদের
বয়স দশদিনের আশেপাশে, তাদের
হত্যা করবেন। ভোজরাজ কংসের এই “কৃষ্ণ-হত্যা” সিদ্ধান্তের সঙ্গে রোম প্রশাসক হেরডের
“যিশু-হত্যা” ঘোষণার আশ্চর্য মিল। দুই কাহিনীর কোনটি মূল এবং কোনটি অন্যকে
প্রভাবিত করেছিল, আজ
তার হদিশ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
শ্রীকৃষ্ণ শৈশব থেকেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী, আর হবে নাই বা কেন, মানুষের রূপে তিনিই যে
পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ঈশ্বর বিষ্ণু। তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় দাদা, বলরাম, গোপরাজা নন্দর পত্নী
রোহিণীর পুত্র। তিনিও বিষ্ণুর অংশ-অবতার। দুই ভাইকে একত্রে রাম-কৃষ্ণও বলা হত।
শৈশব থেকে বাল্য বয়েসের মধ্যেই তিনি অনেকগুলি কীর্তি করে ফেললেন। কৃষ্ণকে বধ করতে
রাজা কংস তাঁর যে অনুচরদের পাঠাচ্ছিলেন, যেমন পূতনা রাক্ষসী, দৈত্য তৃণাবর্ত বা চক্রবাত, বৎসাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর বা অজগর অসুর, অরিষ্টাসুর, কেশী দৈত্য, প্রলম্ব– সকলেই কৃষ্ণের
হাতে নিহত হলেন। তরুণ বয়সে তিনি দমন করলেন কালিয় নাগকে।
এই কাহিনীগুলিতে অলৌকিক রোমাঞ্চ অনুভব করা ছাড়া আর কোন তাৎপর্য
নেই। অবশ্য চিন্তা করলে একটি তাৎপর্য মনে
আসে, শ্রীকৃষ্ণের মামা রাজা
কংস নিশ্চয়ই অনার্য? তা
নাহলে তাঁর মন্ত্রণাদাতা পারিষদ থেকে শিশু কৃষ্ণকে বধ করতে আসা অনুচরী/অনুচররা
রাক্ষসী,
দৈত্য, অসুর কেন? সদ্যজাত শ্রীকৃষ্ণকে
রক্ষা করতে শিশুকন্যা রূপে জন্ম নিলেন অনার্য দেবী যোগমায়া, আবার তাঁকে হত্যা করতে
রাজা কংস “সুপারি” দিলেন অনার্য খুনীদের! অতএব শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে মাতুল কংস ও
মাতুলের শ্বশুর জরাসন্ধের সঙ্গে যে দীর্ঘ বিবাদ সেটি আসলে ছিল অনার্য যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ, অন্ধক ও চেদি গোষ্ঠীর
অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে কথা আগেও বলেছি, এই গ্রন্থের ২.৬.২ অধ্যায়ে।
এবার শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার দুটি ঘটনা, আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে
হয়েছে, সে দুটির উল্লেখ এখানে
করছি।
৫.৪.১.১ ব্রাহ্মণযজ্ঞে অন্ন প্রার্থনা
একবার যমুনা তীরে গোচারণের সময় রাম-কৃষ্ণ সহ সকল গোপবালক ক্ষুধার্ত হয়ে
পড়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকদের বললেন, “একটু দূরেই দেখ, ব্রাহ্মণরা দেবযজ্ঞ করছেন। সেখানে গিয়ে তোরা দাদা আর আমার
নাম করে বল,
আমরা সবাই
ক্ষুধার্ত আমাদের অন্নদান করুন”। গোপবালকরা যজ্ঞস্থলে গিয়ে ব্রাহ্মণদের সেকথা
বলাতে, ব্রাহ্মণেরা “হ্যাঁ” বা
“না” কোন উত্তর দিলেন না। গোপবালকরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে শ্রীকৃষ্ণকে সব কথা বলাতে, কৃষ্ণ হাসলেন, বললেন, “এবার তোরা ব্রাহ্মণীদের
কাছে যা,
সেখানে গিয়ে
একই কথা বলবি”। গোপবালকরা এবার ব্রাহ্মণীদের কাছে গিয়ে রাম ও কৃষ্ণের নামে অন্ন
প্রার্থনা করল।
ব্রাহ্মণীরা কৃষ্ণের অনেক কথা আগেই শুনেছিলেন। তিনি কাছেই যমুনাতীরে
রয়েছেন শুনে,
তাঁরা
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। প্রচুর অন্ন এবং সুস্বাদু খাদ্যের সম্ভার নিয়ে তাঁরা প্রায়
দৌড়ে এলেন। কৃষ্ণের শ্যামলবরণ[1] কান্তি, পীতবসন, গলায় বনমালা, মাথায় শিখীপুচ্ছ দেখে
তাঁরা বিহ্বলা হয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গনও করে ফেললেন। রাম-কৃষ্ণ ও গোপবালকদের অন্ন ও
খাদ্য নিবেদন করে, তাঁরা
কিছুক্ষণ কৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ করলেন। কিন্তু ফেরার সময় তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে
উঠেছিলেন,
কারণ আসার
সময় তাঁরা স্বামীদের অনুমতি না নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছিলেন। উপরন্তু
আবেগের বশে তাঁরা গোপবালক কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে ফেলেছিলেন। তাঁরা আশংকা করছিলেন, তাঁদের স্বামীরা হয়তো
তাঁদের গ্রহণ করবেন না। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বাস দিলেন, সেরকম কিছু ঘটবে না, বললেন, “আপনারা আমাতেই সমর্পিত
চিত্ত, নিবেদিত প্রাণ, অতএব কেউ আপনাদের কোন দোষ
দেখবে না”। ব্রাহ্মণীরা যজ্ঞস্থলে ফিরে যেতে, সত্যিই কেউ কিছু বললেন না।
ব্রাহ্মণরা নিজ নিজ পত্নীদের সঙ্গে যথারীতি যজ্ঞে আহুতি দিয়ে, যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে আহুতি দেওয়ার সময়, পত্নীদের পতির পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোন ভূমিকা থাকত না। সেই বুঝেই কী কৃষ্ণ এমন একটা ঘটনা
ঘটিয়েছিলেন। তিনি কী অনুমান করেছিলেন, ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের ব্যস্ততায় গোপবালকদের কথায় গুরুত্ব না
দিলেও, অলস বসে থাকা
দ্বিজপত্নীরা তাঁর নাম শুনলেই, তাঁকে দেখার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠবেন? আশৈশব তাঁর অতিনায়কোচিত
অলৌকিক কীর্তির সৌরভ যে মহিলা মহলে তাঁকে প্রবাদে পরিণত করেছে, সেটাও কী তিনি বুঝতে
পেরেছিলেন?
এও কী
বুঝেছিলেন,
নায়কের
প্রতি মহিলাদের উদ্বেল আবেগকে তাঁদের স্বামীরা তেমন দোষাবহ মনে করেন না? ধন্য বটে তাঁর নারী ও
নর-চরিত্র বিশ্লেষণ।
৫.৪.১.২ কৃষ্ণের ইন্দ্র বিরোধ
একবার রাম-কৃষ্ণ গোকুলে যাওয়ার পথে দেখলেন, গোপেরা ইন্দ্রযজ্ঞ করার প্রস্তুতি
নিচ্ছেন। তিনি পিতাকে এই যজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করায় গোপরাজ নন্দ বললেন, “বৎস, ভগবান ইন্দ্র মেঘের
দেবতা। বর্ষায় মেঘ থেকে তিনি বৃষ্টি দেন বলেই আমাদের ক্ষেত্র, নদী, সরোবর সরস হয়, আমাদের সমৃদ্ধি আসে। এই
কারণেই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের প্রীতির জন্যে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করি”। এর উত্তরে
কৃষ্ণ যে কথাগুলি বললেন, সেগুলিকে বৈপ্লবিক বললেও কম বলা হয়। তিনি বললেন, “পিতা, নিজের কর্মবশেই জীব সুখ, দুঃখ, ভয় বা মঙ্গল ভোগ করে। যদি
কর্মফল দাতা কোন ঈশ্বর থেকে থাকেন, তিনি কর্মকর্তাকেই সমর্থন করবেন। কারণ যে কোন কর্মই করে না, তাঁকে তিনি ফল দেবেন কী
করে? চতুর্বণ অনুযায়ী কর্ম
নির্দিষ্ট করা আছে। ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ ইত্যাদি, ক্ষত্রিয়রা পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণ, বৈশ্যরা বার্তা অর্থাৎ
কৃষি-বাণিজ্য এবং শূদ্ররা তিনবর্ণের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করবে। বৈশ্যবৃত্তি
চার ধরণের কৃষি,
বাণিজ্য, গোরক্ষা ও কুসীদ[2]। এর মধ্যে আমরা গোপালন করে
থাকি।
তাছাড়া সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের কারণ যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ। মেঘরাজি
রজোগুণে পরিচালিত হয়ে, বর্ষা
ঘটায়, তার থেকে শস্যাদি উৎপন্ন
হয় এবং মানুষ শস্য দিয়ে জীবনধারণ করে। এখানে ইন্দ্রের ভূমিকা কোথায়? আমরা বনবাসী, আমাদের নগর ও জনপদ কিছুই
নেই। অতএব আমাদের কর্তব্য গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বতের উদ্দেশে যজ্ঞ করা। পিতা, এই আমার অভিমত। আপনি যদি
ভালো মনে করেন,
তাহলে
ইন্দ্রযজ্ঞ ছেড়ে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। এই যজ্ঞ ব্রাহ্মণদের এবং আমারও
অভিপ্রেত”। গোপরাজ নন্দ খুশি মনেই গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বত যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।
ওদিকে স্বর্গে বসে ইন্দ্র শুনলেন, ব্রজে তাঁর যজ্ঞ স্থগিত হয়ে গেছে।
তিনি কৃষ্ণ ও গোপরাজ নন্দের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে সংবর্তক নামের ভয়ংকর মেঘকে পাঠালেন, প্রবল বর্ষণ ও বজ্রপাতে
ব্রজের গোষ্ঠকে প্লাবিত করার জন্যে। তিনি বললেন, “কৃষ্ণ কে? একজন সাধারণ মানব। সে অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালকমাত্র। ঐশ্বর্যের
অহংকারে গোপেরা উদ্ধত হয়ে, আমার অপ্রিয় আচরণ করল? সংবর্তক, যাও, তুমি গোপদের ঐশ্বর্য এবং তাদের
পশু সম্পদ ধ্বংস করে এসো”।
সংবর্তকের প্রভাবে গোকুলে প্রবল ঝড়, ঝঞ্ঝা ও শিলাবৃষ্টি শুরু হল।
প্রবল বর্ষণে নদীতে বন্যা দেখা দিল। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, ইন্দ্রের যজ্ঞ না করাতে, ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়েছেন।
তিনি নিজের হাতে গোবর্ধন পর্বত তুলে নিলেন এবং ব্রজবাসী সবাইকে বললেন, সমস্ত পশুদের নিয়ে, সেই পর্বতের গুহায় আশ্রয়
নিতে। ব্রজবাসীরা তাই করলেন এবং সাতদিন প্রবল বর্ষণের মধ্যে তাঁরা সকলেই নিরাপদে
সেই পর্বতের অন্দরে বাস করলেন। সাতদিন ধরে গোবর্ধন পর্বতকে হাতে ধারণ করে থাকা
শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভূত বিক্রমে ইন্দ্র হার মানলেন, তিনি বর্ষণে ক্ষান্ত হলেন। মেঘ
সরে গিয়ে উজ্জ্বল সূর্যের উদয় হল। ব্রজবাসীরা গিরি কন্দর ছেড়ে বের হয়ে এলেন, শ্রীকৃষ্ণও গোবর্ধন
পর্বতকে আবার যথাস্থানে স্থাপনা করলেন।
ইন্দ্র পূজা ছেড়ে, গো-ব্রাহ্মণের পূজা করার মধ্যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অবহেলা করে
হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠা বলেই আমি মনে করি। হিন্দু ধর্মে ভগবান কৃষ্ণ-গোবিন্দের
স্তবের মন্ত্রই হল “ওঁ ব্রহ্মণ্যদেবায়, গো-ব্রাহ্মণ হিতায় চ, জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায়, গোবিন্দায় নমোনমঃ”। আরও
একটা বিষয়ে খটকা লাগে, দেবরাজ
ইন্দ্র যখন শুনলেন, ব্রজবাসীরা
তাঁর পূজা বন্ধ করেছেন এবং এর পিছনে আছেন কৃষ্ণ, তখন তিনি কৃষ্ণকে “অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালক” বললেন কেন? দেবরাজ হয়েও তিনি কী
জানতেন না,
কৃষ্ণরূপে
ভগবান বিষ্ণুই মর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন? পৃথিবীতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্যে কৃষ্ণ হয়ে ভগবান বিষ্ণুর
আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই স্বর্গের দেবমহলে এর প্রস্তুতি হয়েছিল, শ্রীরামচন্দ্রের
আবির্ভাবের পূর্বপ্রস্তুতির মতো। যেমন, ব্রজরাজ নন্দ, তাঁর দুই রাণি – রোহিণী ও যশোদা, বলরাম (যিনি বিষ্ণুর অংশ-অবতার)
এবং ব্রজের সকল গোপ ও গোপীগণ স্বর্গ থেকে আবির্ভূত, তাঁরা কৃষ্ণের আগে জন্ম নিয়েছিলেন, শিশু ও বালক কৃষ্ণকে
লালন-পালনের জন্য। রাজা কংসের চোখে ধুলো দিতে, কৃষ্ণের সঙ্গে একই সময়ে আবির্ভূতা
হয়েছিলেন,
দেবী
যোগমায়া। দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের এই সব সংবাদ কিছুই জানতেন না? কেমন দেবরাজ তিনি? নাকি পুরাণকারেরা কাহিনী কল্পনার
সময়, এই দিকটি খেয়াল রাখেননি? নাকি অনার্য বা হিন্দু
দেবতার কাছে বৈদিক দেবরাজের লাঞ্ছনার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন?
৫.৪.১.৩ রাস উৎসব
মহিলা মহলে কৃষ্ণের আধিপত্য ছিল প্রবল। ব্রজের বয়স্থা মহিলাদের আদর্শ
ছিলেন মা যশোদা,
তাঁদের
সকলেই দুরন্ত শিশু ও বাল-কৃষ্ণের দৌরাত্ম্য অনুভবের স্বপ্ন দেখতেন। বালক-কৃষ্ণের
মুখ দর্শনেই তাঁদের কুচযুগ পয়স্বিনী হয়ে উঠত। আবার ব্রজের কিশোরী থেকে যুবতীরাও
তাঁর দর্শন এবং স্পর্শ লাভের জন্যে ব্যাকুল। এমন কি বিবাহিতা রমণীরাও কৃষ্ণ প্রেমে
উন্মাদিনী। তাঁদের এই গণ উন্মাদনার কারণ কৃষ্ণের রূপ, তাঁর অপ্রচলিত বেশভূষা, তাঁর অলৌকিক কীর্তির
প্রবাদ এবং তাঁর মোহন-বাঁশির সুরের জাদু। সবার উপরে রয়েছে তাঁর কোমলে-কঠোর মেশা
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
মহিলা মহলে কৃষ্ণের এই গণ সম্মোহনকে ভাগবত শাস্ত্রে রাস-উৎসব, রাস-যাত্রা বা রাস-ক্রীড়া
বলা হয়েছে। রাস শব্দের উৎপত্তি রস থেকে, আবার রাস শব্দের অর্থ শব্দ, ধ্বনি বা কোলাহল। অর্থাৎ রাস-উৎসব
রসময় কোলাহল।
সেদিন কার্তিকমাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণ চন্দ্র উদিত হয়েছে পূর্ব আকাশে। সামান্য হিমের পরশ লাগা স্নিগ্ধ বাতাস বহমান। যমুনার তীরে একাকী ভ্রমণ করতে করতে, কৃষ্ণ তাঁর বাঁশিতে তুললেন অদ্ভূত মোহন সুর। গোপপল্লীগুলিতে সেই মোহিনী সুরের মন-কাড়া জাদু বয়ে নিয়ে গেল হেমন্তের মনোরম বাতাস। নির্মেঘ আকাশ প্লাবিত নির্মল জ্যোৎস্নায়। বাতাসে ভেসে আসা সূরমূর্ছনা, আকাশের মোহিনী আলোক গোপনারীদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করল। কেউ রান্না করছিলেন, কেউ শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন, কেউ স্বামীসেবা করছিলেন। যাঁর যা কিছু হাতের কাজ ফেলে, তাঁরা দৌড়ে চললেন যমুনার তীরে। তাঁদের পিতা, মাতা, স্বামী, পুত্র, ভ্রাতারা নিষেধ করলেন বারবার, কিন্তু ওই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁদের যে অন্য কোন উপায় নেই! তাঁরা সমবেত হলেন যমুনা পুলিনে।
বাঁকুড়া - বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই মন্দিরের দেওয়ালে
"রাসযাত্রা"-র টেরাকোটা মোটিফ। চিত্র - লেখক।
সমবেত ব্রজবালাদের দেখে লীলাপুরুষ বললেন, “এত রাত্রে তোমরা এখানে কেন? তোমরা কী জানো না, নির্জন এই যমুনাতটে এখন
নিশাচর পশুরা ঘুরে বেড়ায়? তোমরা এখনই ব্রজপল্লীতে ফিরে যাও, সেখানে তোমাদের
মাতা-পিতা-পতি-ভ্রাতারা তোমাদের দেখতে না পেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তোমাদের আচরণে
বন্ধু ও আত্মীয়দের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করো না”। গোপললনারা কৃষ্ণের কথায় হতাশ হলেন, তাঁরা প্রণয়-অভিমানে
বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণ স্মিতমুখে আবার বললেন, “তোমরা কি, যমুনার তীরে পূর্ণ-জ্যোৎস্নার
শোভা দেখতে এসেছ? তাহলে
বলি, দেখা তো হয়েছে, এবার গৃহে ফিরে যাও। হে
কল্যাণি,
তোমরাই
গৃহের ঐশ্বর্য,
তোমরা ঘরে
ফিরে পতি,
পিতা-মাতা-সন্তান-শিশুদের
সেবায় মনোনিবেশ করো। হে কুলকামিনীগণ, আমার ধ্যান, চিন্তা বা আমার কথাতে যেমন প্রীতিবন্ধন হয়, আমার স্পর্শে তেমন হয় না।
অতএব তোমরা এখনই ঘরে ফিরে যাও”।
গোপললনারা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “হে প্রভো, এমন কঠিন কথা তোমার বলা উচিৎ
হচ্ছে না। স্বামী-পুত্র-সংসার সব ছেড়েই আমরা তোমার কাছে এসেছি। তোমার সেবা করলেও
স্বামী-পুত্রেরই সেবা হবে। আমাদের যে মন ও হাত এতদিন সংসারের কাজে সতত লিপ্ত ছিল, সেই মন ও হাত তুমি কেড়ে
নিয়েছ। আমরা জেনেছি, তুমিই
সেই আদি পুরুষ,
যিনি
দেবতাদের রক্ষা করেন, এখন
এসেছ আমাদের ব্রজভূমির দুঃখনাশ করতে। আমরা তোমার কিংকরী, তোমার করকমল আমাদের তপ্ত স্তনে
এবং মাথায় অর্পণ করো, আমাদের
তৃপ্ত করো”। এর পর কৃষ্ণ মনোরম যমুনা পুলিনে গোপললনাদের আলিঙ্গন করলেন, তাঁদের হাতে, চুলে, উরুতে, কোমরে, স্তনে হাত রাখলেন। শতাধিক
গোপরমণী তাঁর স্পর্শে মানিনী হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলেই নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ নারী
বলে মনে করলেন। গোপীদের এই গর্ব, অভিমান ও তূরীয় অবস্থা দেখে কৃষ্ণ সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে
গেলেন।
কৃষ্ণ অদৃশ্য হয়ে যেতে গোপ কামিনীরা তাঁর বিরহে অস্থির হয়ে উঠলেন।
তাঁরা বনের তৃণ,
গাছপালা, নদীর জল, বালুতট সকলের কাছে
উন্মাদিনীর মতো,
জিজ্ঞাসা
করতে লাগলেন,
তারা
কৃষ্ণকে দেখেছে কিনা? তাঁদের
মধ্যে কেউ নিজেই কৃষ্ণ হলেন, কেউ হলেন বৎসাসুর, কেউ হলেন পূতনা। তাঁরা নিজেদের
মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মত্তা হলেন। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে বালকৃষ্ণের মতো আচরণ করতে
লাগলেন। এক কথায় তাঁরা কৃষ্ণময় হয়ে নিজেদের মধ্যেই মত্ত হয়ে উঠলেন। এক সময়ে তাঁরা
কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে গান ধরলেন।
এই সময়েই হঠাৎ উপস্থিত হলেন কৃষ্ণ। তাঁর অকস্মাৎ আবির্ভাবে গোপললনাদের
মধ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল, গোপরমণীদের অবসন্ন শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। তাঁরা সকলে
কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে, মাঝখানে
বসিয়ে, চারদিকে ঘিরে রাখলেন।
একজন গোপকামিনী কৃষ্ণের প্রতি কটাক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে কৃষ্ণ, কেউ ভজনা করলে, তাঁকেও অন্য কেউ ভজনা
করেন। আবার তাঁকে কেউই ভজনা করেন না। অথবা কেউই কাউকে ভজনা করেন না। হে সখে, এই ব্যাপারটা কেমন, আমাকে বুঝিয়ে দাও তো!”
কৃষ্ণ বললেন, “সখীরা, যাঁরা পরষ্পরের ভজনা করেন, তাঁরা স্বার্থের জন্যেই ভজনা করেন, সেখানে ধর্ম বা
বন্ধুত্বের কোন উদ্দেশ্য থাকে না। যাঁরা ভজনা করেন না, অথচ তাঁদের যাঁরা ভজনা করেন, তাঁরা পিতামাতার মতো
দয়ালু ও স্নেহ অনুসারে দুই প্রকারের ভজনা করেন। দয়ালু ভজনায় নিষ্কৃতি লাভ হয় এবং
যাঁরা স্নেহময় হয়ে ভজনা করেন, তাঁরা বন্ধুত্ব লাভ করেন। দরিদ্র ব্যক্তি হঠাৎ ধন লাভ করে, সে ধন যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে যেমন সর্বদা এই
নিয়েই চিন্তায় মগ্ন থাকে, তেমনি তোমরাও সব ভুলে এতক্ষণ আমার চিন্তাতেই মগ্ন ছিলে।
তোমরা গৃহের কঠিন শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমার কাছে এসেছ, এই মিলন অনিন্দনীয়। আমি তোমাদের
এই উপকারের কোন প্রতিদান দিতে পারবো না। সুতরাং প্রত্যুপকার করে আমি অ-ঋণীও হতে
পারলাম না,
আমার ঋণ
মোচনের একমাত্র সহায় তোমাদের এই প্রেমবন্ধন”।
গোপীরা ভগবান কৃষ্ণের এই সান্ত্বনা বাক্যে, বিরহের কথা ভুলে উৎফুল্ল হয়ে
উঠলেন এবং তাঁরা পরমানন্দে নিজেদের হাতে হাত রেখে কৃষ্ণকে ঘিরে নৃত্য ও গীত শুরু
করলেন। কৃষ্ণ-গোবিন্দ রমণীবেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে রাসলীলা করতে লাগলেন। রাস-উৎসব শুরু
হল। কৃষ্ণ প্রতি দুই জন গোপীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই গোপীর কাঁধে রাখলেন।
প্রত্যেক গোপ রমণীরই মনে হল, কৃষ্ণ তাঁর পাশেই আছেন, তাঁর কণ্ঠে হাত রেখে তাঁর মুখের
দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। এই রাস উৎসবে বিভোর হয়ে রইলেন গোপরমণীরা, তাঁদের সকলের অঙ্গেই
কৃষ্ণের মোহন স্পর্শের অনুভব। রাত্রি শেষ প্রহরে কৃষ্ণের আদেশে তাঁরা যখন অনিচ্ছায়
নিজ নিজ ঘরে ফিরলেন, কৃষ্ণ
মায়ায় মোহিত ব্রজবাসীরা মনে করলেন, তাঁদের পত্নী, মা, ভগিনী ও কন্যারা সারারাত তাঁদের পাশেই ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যভারত এবং মথুরার মতো বেশ কিছু অঞ্চলের পশুপালক অনার্য
গোষ্ঠীদের মধ্যে কৃষ্ণ নামে এক বংশীধারী রাখাল বালক ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন এবং
বালদেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। মহিলা মহলে তাঁর প্রভাব ছিল ঈর্ষণীয়। সেই অনার্য
কৃষ্ণের নানান প্রবাদ কাহিনীকে আরও রমণীয় এবং কামোদ্দীপক (erotic) করে তুলেছিলেন
পুরাণকারেরা। হয়তো তাঁরা মনে করেছিলেন, ধর্মরসের মধ্যে কিছুটা দৈবী আদিরস সঞ্চার করলে, সাধারণ জনসমাজ কৃষ্ণ
সম্পর্কে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠবে, বাড়বে ভাগবত ধর্মের প্রভাব।
৫.৪.১.৪ দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ
দ্বারকা ও রাজস্থানে কৃষ্ণ “রণছোড়জী” নামেই প্রসিদ্ধ। এই নামটি সম্ভবতঃ
মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত হয়েছিল। যেমন আমাদের পূর্বভারতে, কৃষ্ণ নামটি কাহ্ন, কানু, কানাই নামেও জনপ্রিয়
হয়েছে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাবে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ “রণছোড়” শব্দটির অর্থ – যিনি যুদ্ধ ছেড়ে এসেছেন। মথুরায় কংসবধের পর, রাজা কংসের শ্বশুর পরাক্রান্ত চেদিরাজ জরাসন্ধ, কৃষ্ণ-নিধনের জন্যে বারবার (পৌরাণিক মতে আঠারোবার) মথুরা আক্রমণ করেছিলেন। সে যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়ী হতে পারেননি, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই দুই পক্ষের বহু নিরীহ সৈন্য নিহত, আহত এবং অজস্র সম্পদ হানি হত। এই অকারণ রক্তপাত এবং শক্তি ও সম্পদ-ক্ষয় এড়াতে কৃষ্ণ যুদ্ধ ছেড়ে সুদূর দ্বারকায় সরে গিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এ তাঁর অসাধারণ দূরদর্শীতা, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয়। কারণ পরবর্তীকালে তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে একক যুদ্ধে প্ররোচিত করে জরাসন্ধকে নিহত করিয়ে শত্রুমুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে কোন নিরীহের রক্তপাত হয়নি। প্রতিকূল সময়ে যুদ্ধ ছেড়ে আসা যে আসলে অনুকূল সময়ে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি, সে কথাটাই শ্রীকৃষ্ণের “রণছোড়জি” নামের মহিমা।
দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের দশজন প্রধানা পত্নীর নাম শোনা যায় - রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, নাগ্নজিতী, কালিন্দী, মাদ্রী, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা। প্রাগজ্যোতিষপুরের
ভৌমাসুর বহু রাজাকে পরাস্ত করে ষোল হাজার রাজকন্যাকে বন্দী করে রেখেছিলেন।
প্রাগজ্যোতিষপুরের নরকাসুরকে বধ করে, কৃষ্ণ ভৌমাসুরের অন্তঃপুরে যান এবং বন্দিনী রাজকন্যাদের
মুক্ত করার আদেশ দিলে, ষোল
হাজার রাজকন্যা তাঁকেই পতিরূপে বরণ করেছিলেন। কৃষ্ণও সানন্দে তাঁদের গ্রহণ করে, দ্বারকায় পাঠিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেক পত্নীর
জন্যে সুন্দর গৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রধানা দশ মহিষীর প্রত্যেকের গর্ভে ভগবান
কৃষ্ণের দশটি করে পুত্রের জন্ম হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন, প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, ভানু, শাম্ব, সুমিত্র, পুরুজিৎ, বীর, সুবাহু, প্রঘোষ, বৃক, হর্ষ, সংগ্রামজিৎ, বৃহৎসেন প্রমুখ। শোনা যায়
তাঁর মোট পুত্রসংখ্যা নাকি সহস্রাধিক।
ব্রজবাসী কৃষ্ণের আরও একটি বহুল জনপ্রিয় প্রেমের উপাখ্যানের উল্লেখ
মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না। সেটি হল পরবর্তী কালের বহুল জনপ্রিয়
রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যান। মহাভারতের পরিপূরক গ্রন্থ “খিলহরিবংশ”-এ – কৃষ্ণের রাসলীলার
বর্ণনায় কৃষ্ণের মুখে দুটি মাত্র নামের উদ্দেশে বিরহ ভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়, “হা রাধে! হা চন্দ্রমুখি!”
(খিল হরিবংশ,
অধ্যায় ৭৬), কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে
আর কোন বিবরণ বা তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ পরবর্তী কালের কবিকুল, বিশেষত বঙ্গের কবিকুল এই
যুগলকে নিয়ে অজস্র ভাবের ও আবেগের গান ও পদাবলী রচনা করেছেন। কৃষ্ণভক্ত যুগাবতার
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩ সি.ই) আবির্ভাবের পর, বঙ্গদেশে রাধা-কৃষ্ণই অন্যতম
প্রধান উপাস্য হয়ে উঠেছিলেন।
--০০--
[আমার "ধর্মাধর্ম" গ্রন্থের পঞ্চম পর্বের চতুর্থ অধ্যায় থেকে সংকলিত।]
[1] ভালোবেসে
আমরা যতই “শ্যামলবরণ” বা “রঙটা একটু চাপা” বলি না কেন, এই গাত্রবর্ণ অনার্য লক্ষণ। আদতে
তিনি কৃষ্ণবর্ণই ছিলেন, তাই তাঁর নামও কৃষ্ণ। তাঁর কৃষ্ণবরণ বলিষ্ঠ কান্তিতে
উজ্জ্বল পীতবসন,
গলায়
বনফুলের মালা,
অঙ্গে
হাল্কা স্বর্ণালঙ্কার এবং কেশে শিখীপক্ষ – অসাধারণ এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর্য বা
অনার্য – সে যে সভাতেই তিনি উপস্থিত হোন না কেন –তাঁর উপস্থিতি সর্বদাই প্রত্যয়ী
পৌরুষরূপে অনন্য এক ঔজ্জ্বল্য সঞ্চার করে। এর সঙ্গে ছিল শৈশব থেকে আবাল্য, তাঁর নানান কীর্তির
মহিমা। বাস্তবিক, এমন
একজন ব্যক্তিত্ব সামনে এসে দাঁড়ালে, হয় মুগ্ধ হতে হয় অথবা ঈর্ষায় দগ্ধ হতে হয়, কিন্তু কোনমতেই অবহেলা
করা যায় না। মহিলাদের আর দোষ কি?
[2] কুসীদ
মানে সুদ,
কুসীদজীবী
মানে যাঁরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন, এখানে শ্রেষ্ঠী অর্থাৎ Banker।
রাধা কৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান তবে বাঙালি পদকর্তাদের দ্বারাই বহুল প্রচারিত হয়।
উত্তরমুছুনএকদমই - কবি জয়দেব এবং অন্যান্যরা যেমন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ রাধা-কৃষ্ণর প্রেমকাহিনীকে অবিস্মরণীয় করে দিয়ে গিয়েছেন।
উত্তরমুছুন