১
আমার তেমন কোন তাড়া নেই, তাই ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে রইলাম। হুড়মুড়িয়ে অনেক লোক এই স্টেশনে নামল, স্টেশন থেকে বেরোনর জন্যে
তারা এমন হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে দৌড়ল যেন মানুষখেকো বাঘে তাদের তাড়া করেছে। আমি
ওই ব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে জড়ালাম না। বাইরে বের হবার গেটের মুখে টিকিট কালেক্টর
সায়েব দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সকলের টিকিট চেক করছিলেন। ভিড়টা একটু কমতে আমি গেটের
দিকে এগোলাম।
পকেট থেকে টিকিট বের করে ওঁনাকে দেখিয়ে, জিজ্ঞাসা করলাম, “সিংহবাহিনী
বাড়ি যাবো, রিকশা পেয়ে যাবো না?”
কালেক্টর সায়েব হাঁড়িপানা মুখ করে বললেন, “তার আমি কী
জানি? আমি ট্রেনের খবর রাখি। সিংহ – টিংহর ব্যাপার আমি জানিও না, কোনদিন দেখিওনি।
বাইরে রিকশাওয়ালাদের জিজ্ঞাসা করুন”।
একজন আমার কথার উত্তরে বলল, “সিংহবাহিনী বাড়ি? না না ওদিকে এখন যাবো না”। আমি একটু অবাকই হলাম।
ওই রিকশাওয়ালাটি যাবো না বলল, আর বাকি চার-পাঁচজন যারা দৌড়ে এসে আমাকে ঘিরে
ধরেছিল, তারাও সকলে আমাকে পাত্তা না দিয়েই ফিরে গেল, আর অন্য খদ্দের ধরার জন্যে
হাঁকাহাঁকি করতে লাগল। যে রিকশাওয়ালাটি আমাকে না বলল, কাছে গিয়ে তাকেই আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “ওদিকে যাবেন
না, কেন?”
“ইয়ে মানে...ওদিকটা তেমন সুবিধের জায়গা নয়, কিনা। তার ওপর অনেকটা দূর,
ফেরার পথে সওয়ারি পাওয়া যাবে না। সন্ধে হয়ে যাবে...ওদিকে এখন যাওয়া যাবে না।
সকালের দিকে হলে যেতাম, এখন যাবো না”।
বোঝো কাণ্ড। এর পর তো আর কোন কথা চলে না! রিক্সা স্ট্যাণ্ডের ওপাশে
দেখলাম বেশ কয়েকটা টোটো দাঁড়িয়ে আছে। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে তাদের দিকে এগোতে
যাবো, এমন সময় আমার কাঁধে এক জন হাত রাখল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, খুব রোগা শুঁটকে
চেহারার একজন বুড়োমানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
“সিংহবাহিনী বাড়ি যাবে, পিকলুবাবু? আমার সঙ্গে এসো। ওরা যাবে না তো কী
হয়েছে, আমি নিয়ে যাবো”। এই কথা বলেই বুড়ো লোকটি আমার হাত
ধরে প্রায় টানতে লাগল।
এখানে সবই দেখি আজব কাণ্ড কারখানা! স্ট্যাণ্ডের রিকশাগুলো সবাই
সিংহবাহিনী বাড়ি যেতে রাজি না হওয়ায় যতটা আশ্চর্য হয়েছিলাম, এখন এই বুড়ো লোকটির
কথায় তার দশগুণ অবাক হলাম! আমি হুগলির এই ছোট্ট শহরে এলাম প্রায়, সতের বছর পর। শেষ
বার যখন এসেছিলাম, তখন আমার বয়েস ছয় কি সাত। কিন্তু এই লোকটি আমায় চিনল কী করে?
আমার নামই বা জানল কী করে? তার ওপর রিকশাওয়ালারা বলছিল, সিংহবাহিনী বাড়ি অনেকটাই
দূর, সেক্ষেত্রে এই বুড়ো লোকটার রোগাভোগা শীর্ণ চেহারা দেখে আমি মোটেই ভরসা করতে
পারছিলাম না। কোন বদ মতলব নেই তো? তবে আমার কাছে আছেটাই বা কী? আর ওই লোকটির যা
বয়েস আর চেহারা, তাতে তার
বদ মতলব আর কী থাকতে পারে?
রিকসা স্ট্যাণ্ডের পিছনদিকে একটা মস্ত ঝাঁকড়া মাথা মহানিম গাছ। যত না
পাতা, তার থেকে বেশি পাখি। বিকেলে সব বাসায় ফিরে এমন কিচিরমিচির লাগিয়েছে, সেই
শুনে মনটা শান্ত হয়ে গেল, চিন্তাহীন হয়ে মাথাটাও হালকা হয়ে গেল।
সেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা ভাঙাচোরা রিকশর সামনে নিয়ে গিয়ে বুড়ো
লোকটি আমাকে বলল, “চটপট উঠে পড়ো পিকলুবাবু, ওরা দেখলে আবার তোমায় ব্যাগড়া দেবে”।
লজঝরে সেই রিকশাতে উঠতে উঠতে আমি বললাম, “আপনি আমায়
চিনলেন কী করে? আর আপনার রিকশার যা হাল তাতে এটা সিংহবাহিনী বাড়ি অব্দি পৌঁছবে তো?”
হ্যা হ্যা করে খুব খানিক হেসে বুড়ো লোকটি বলল, “পৌঁছবে মানে,
দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছবে! ও নিয়ে তুমি ভেবো নি, পিকলুবাবু”।
আমি রিকশায় উঠে বসতেই, বুড়ো লোকটি তার সাইকেলের সিটে বসে, প্যাডেল করতে
শুরু করল, তারপর ঝরঝরিয়ে গড়াতে লাগল রিকশাটা। স্ট্যাণ্ডে দাঁড়ানো রিকশাগুলোর পাশ
দিয়ে আমাদের রিকশাটা যখন স্টেসন চত্বরের বাইরে বের হয়ে এল, তখন দেখলাম
রিকশাওয়ালাদের কেউ কেউ হৈ হৈ করে চেঁচাতে লেগেছে, “ও খোকাবাবু, ও খোকাবাবু, ও
রিকশায় যেও নি, সব্বোনাশ হল গো, এ হে হে নতুন লোক....”।
ওদের কথা শেষ হবার আগেই আমরা বড়রাস্তার ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছি, তাই তাদের বাকি কথা শুনতে পেলাম না। বড়ো রাস্তার ভিড়ভাট্টা জ্যামট্যাম ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা রাস্তায় যখন এসে পড়লাম, বুড়ো লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি আমায় চিনলেন কী করে, সেটা তো বললেন না?”
সামনের দিকে তাকিয়ে বুড়ো লোকটি বলল, “তুমি বুড়িঠাকমার পুতি তো, তোমাকে
চিনব নি”?
আমি আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “পুতি? পুতি
মানে”?
প্যাডেল করতে করতে বুড়ো লোকটি বলল, “বুড়িঠাকমার মেয়ে, তোমার মায়ের
পিসিমা হন। থালে তোমার মা, বুড়ি ঠাকুমার নাতনি হলেন কিনা? আর তুমি পুতি হলে কিনা?
আর আমাকে তুমি দেখেছ, মনে নেই। আমি লক্ষ্মণ বাগ – লখাই, বুড়িঠাকমার বাঁধা
রিকশাওয়ালা। বুড়িঠাকমার বাজার হাট করে দেওয়া, বচ্ছরকার দিনে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া,
অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তারবদ্যি করা – এ সব আমিই করি। তোমরা শেষবার যখন এসেছিলে, তুমি, তোমার মা আর
বাবাকে আমিই স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিলাম, আবার ফেরার সময় আমিই স্টেশনে পৌঁছে
দিয়েছিলাম। তুমি তখন ছোট্টটি, মনে না থাকারই কথা”।
ঝরঝরে রিকশাটা যতটা ভাঙাচোরা মনে হয়েছিল, এখন দেখছি ততটা নয়। রাস্তাও
বেশ ভালো। লখাইমামা চালাচ্ছিলও বেশ। এত মসৃণ যেন ঢাকনা খোলা মোটরগাড়িতে চড়েছি।
লখাইমামার কথায়, সে বারের কথা আমার আবছা আবছা মনে পড়ল ঠিকই, আমরা রিকশ চেপে স্টেশন
ফিরেছিলাম, সেটাও মনে পড়ল। তবে লখাইমামার নাম আর চেহারা কিছুতেই মনে করতে পারলাম
না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “দিদুয়ারা কেমন আছেন, এখন? ভালো আছেন তো?”
“অ্যাই, তুমি বলাতে মনে পড়ল। তোমার মা পিসিমার মাকে “দিদুয়া” বলত। দেখেছ, এই কথাটা আমি ভুলে
গেছিলাম, পিকলুবাবু। হ্যাঁ, তা ভালই আছেন। এই বয়েসে যতটা ভালো থাকা যায়, সে তুলনায়
যথেষ্ট ভালো আছেন। তা তুমি কী কোন খবর পেয়ে এসেছ? নাকি এমনিই হুট করে দেখা করতে
চলে এলে”?
“না, না, লখাই মামা, অনেকদিন কোন খবর পাইনি বলেই হুট করে খবর নিতে চলে
এলাম”।
“বাঃ, তোমার মুখে লখাইমামা ডাকটি বেশ লাগল। তা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? কিচু মনে করবে
নি তো, পিকলুবাবু”?
“না না, মনে করবো কেন, বলো না, লখাইমামা”।
“অ্যাদ্দিন পর, হঠাৎ করে বুড়িঠাকমাদের দেখার, খবর নেওয়ার কথা মনে পড়ল
কেন”?
সত্যি এই প্রশ্নে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়লাম। বড়োরা নিজেদের নানান কাজের
ফাঁদে এমন জড়িয়ে যান, অসহায় স্বজন, পরিজনদের খবর নেওয়ার কাজটা, ইচ্ছে থাকলেও সবসময়
করে উঠতে পারেন না।
আমি বললাম, “আমরা সেবার এখান থেকে ফেরার কয়েকমাস পরেই অফিস থেকে বাবাকে
ব্যাঙ্গালুরু পাঠিয়ে দিল। আমরাও বাবার সঙ্গে ওখানে চলে গেলাম, আর আমি ওখানেই
স্কুলে ভর্তি হলাম। ওখান থেকে আবার অফিসের কাজে, বাবাকে প্রায়ই বিদেশে যেতে হত। এই
সবের জন্যে এদিকে আর আসাই হয় নি। আমার কলেজের পড়া এই সবে শেষ হল। একটা চাকরিও পেয়ে
গেলাম। তাই মা বললেন, “চল অনেকদিন কলকাতায় যাওয়া হয়নি, কটা দিন ঘুরে আসি”। কলকাতায় আসার পর মাও
বললেন, আর আমারও দিদুয়াকে একবার দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল, তাই চলে এলাম”।
“বাঃ বেশ করেছ, যাওয়া আসা না করলে কী আর সব খবরাখবর পাওয়া যায়? তবে
পিকলুবাবু, তুমি তো এখন সত্যিই বাবু হয়ে গেছ, দেখছি! পড়াশোনা শেষ, চাকরি করছো।
কত্তো বড়ো হয়ে গেছ! দেখতে দেখতে কতগুলো বছর চলে গেল, নয়?”
ছোট্ট শহর ছাড়িয়ে আমরা এখন মাঠের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি, দু পাশে
ধানের ক্ষেত। পড়ন্ত বিকেলে বেশ লাগছিল চারপাশ। আমি লখাইমামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কতদূর,
লখাইমামা”?
“এ হে তুমি দেখছি একেবারেই ভুলে গেছ। তা ভুলে যাওয়ারই কথাই অবিশ্যি। আর
বেশি দূর নেই গো, ওই সামনের মাঠটা পেরিয়ে মন্দির তলা, তার বাঁদিকের রাস্তা ধরে
একটু এগোলেই তোমার দিদুয়ার বাড়ি। তোমার দিদুয়া কিন্তু খুব চমকে যাবে, তোমাকে দেখে।
আমি অবিশ্যি খবর দিয়ে দিয়েছি।”
“খবর দিয়ে দিয়েছ? কখন দিলে?” আমি খুব অবাক
হলাম, কই ওকে একবারও তো মোবাইলে কথা বলতে দেখলাম না। আর লখাইমামার যা চেহারা, ওর
কাছে মোবাইল ফোন থাকাটাও কিছু কম আশ্চর্য নয়!
“গোমড়ামুখো টিকিট চেকারকে তুমি যখন জিজ্ঞাসা করলে সিংহবাহিনী বাড়ি
যাবার রিস্কা পাওয়া যাবে কিনা, তখনই বুঝে গেছি। আর খবরও পাঠিয়ে দিয়েছি”।
“বলো কী? তখনই আমাকে চিনতে পেরেছিলে”?
লখাইমামা হাসল, বলল, “তবে? লখাই বাগের বয়েস হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কিছুই ভোলে
নি। আর তাছাড়া তিন কুলে যে দুই বুড়ির কেউ নেই, তাদের খোঁজে কলকাতার ছেলে আর কে
আসবে? তুমি ছাড়া?”
কথা বলতে বলতে আমাদের রিকশাটা মন্দিরতলার সামনে দিয়ে এগিয়ে বাঁদিকে
সাঁৎ করে মোড় নিল। মন্দিরের চাতালে কয়েকজন বসেছিল, তারা আমাদের দেখে কেন যে অমন
চমকে উঠে দাঁড়াল, সেটা বুঝলাম না। লখাইদাদার রিকশওয়ালা হিসেবে খুব একটা সুনাম নেই
বুঝতে পারছিলাম, অনেক লোককেই ধাক্কা-টাক্কা মেরে বেশ বদনাম কুড়িয়েছে। কাছাকাছি
এলেই তাই লোকজন ছিটকে সরে যাচ্ছে, নয়তো আতঙ্কে চমকে উঠছে।
বিশাল ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়িটার সামনে লখাইমামা রিকশটাকে যখন দাঁড় করাল,
তখন সুয্যিমামা পাটে বসে গেছেন, আকাশে শেষ আলোর রেশটুকু শুধু রয়ে গেছে। আমি পার্স
থেকে টাকা বের করে লখাইমামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কত দেব, মামা”?
লখাইমামা রিকশটা বাড়ির পিছনদিকে টানতে টানতে বলল, “অ্যাঃ, মামাও
বলবে, আবার ভাড়াও দেবে? অ্যাদ্দিন পরে এলে, সবে চাকরি পেয়েছ, পেট পুরে মিষ্টি
খাইয়ে দিও”। বলেই খুব খানিক হাসল, তারপর আবার বলল, “সে পেটই নেই,
তা আবার মিষ্টি খাওয়া!”
আমি কিছু বলতে পারলাম না, টাকা কটা আবার পার্সে ঢুকিয়ে পশ্চিম আকাশের
রঙ দেখতে দেখতে ভাবলাম, এই মানুষগুলোও দিন-দিন বিরল প্রজাতি হয়ে যাচ্ছে! বাঘ সিংহ
হাতি গণ্ডার সংরক্ষণের জন্যে যেমন বিশ্বজুড়ে নানান প্রকল্প চলছে, এদের জন্যে তেমন
একটা কিছু করা, খুব দরকার।
“ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত কাবার করে দিবি নাকি রে, মুখপোড়া?”
দিদুয়া! এই ডাক, এই গলা শুনে আমার সেই ছোট্টবেলাকার ভুলে যাওয়া স্মৃতি
আবার ফিরে এল। পিছন ফিরে দেখলাম, দিদুয়া বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর বাঁ হাতে
হ্যারিকেন। বয়েসের ভারে কোমর ভেঙে গেছে, সোজা দাঁড়াতে পারেন না। সূর্যডোবা মৃদু
আলো এখনো রয়েছে, সেই আলোয় তাঁর আবছা মুখের দিকে তাকালাম। গালের, কপালের ত্বক
কুঁচকে গেছে, কিন্তু ফোকলা মুখের হাসিটি ঠিক তেমনই আছে, যেমনটি দেখেছিলাম, আজ থেকে
প্রায় সতের বছর আগে! ওই হাসিতে মিশে আছে আন্তরিক ভালোবাসা আর অদ্ভূত মায়াময় এক
আনন্দ।
আমি কাছে গিয়ে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন আছ,
দিদুয়া?” আমার চিবুক ছুঁয়ে উনি চুমো খেলেন, তারপর ভেতরে
ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আয়, আয় আগে ভেতরে আয়। মুখেচোখে একটু
জল দে, কিছু খা। তারপর সব কথা হবে”।
দিদুয়ার পিছন পিছন আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাসা করলাম, “পিসদিদা কোথায়?”
“কোথায় আবার, রান্নাঘরে? যেমনি শুনেছে, তুই আসছিস, সেই যে সে রান্নাঘরে
ঢুকেছে, তার আর বেরোবার নামটি নেই। রান্নাবান্না করা আমার আর ক্ষমতায় কুলোয় না,
জানিস? বয়েস তো আর কম হল না, বাছা”।
দালান পেরিয়ে পাশের বড়ো একটা ঘরের মধ্যে আমাকে নিয়ে গেলেন দিদুয়া,
বললেন, “এই সেই ঘর, মনে আছে? তোরা এসে এইখানেই থাকতিস। শেষ বার যখন মা-বাবার
সঙ্গে এসে দিন তিনেক ছিলি, এই ঘরেই ছিলি। মনে পড়ছে”? আমার
মনে পড়ল না, আমি হাসলাম।
দিদুয়া বললেন, “তা সে মনে না পড়ারই কথা। তখন তুই আর কতটুকু? তোর মা মুখপুড়ি সেই যে
গেল, আমাদের তো ভুলেই গেল”।
আমি মায়ের হয়ে বলতে গেলাম, “না গো দিদুয়া, মা মোটেই ভোলেনি, মাই তো
আমাকে পাঠালো তোমাদের খবর নেওয়ার জন্যে। আমরা অনেকদিন বাইরে ছিলাম কি না, তাই
এদিকে আর আসা হয়নি। মায়ের কোন দোষ নেই গো!”
“নে নে, মেলা বকিস না, সেদিনের সেই এতটুকু মুখপোড়া পিকলু কতবড়ো হয়ে
গেছিস! এখন আবার দিদুয়ার কাছে, মায়ের হয়ে সাউখুরি করছিস? এই সেদিন তোর মাকে আমি
জন্মাতে দেখলাম – তোর মাকে আমি বেশি দেখেছি, না তুই?”
এ কথায় হেসে ফেললাম, কোন উত্তর দিলাম না, ঘরের মধ্যে হ্যারিকেনটা রেখে
দিয়ে দিদুয়া বললেন, “নে জামাকাপড় ছেড়ে নে। কলতলায় জল ধরা আছে, মুখ হাত ধুয়ে নে। তোরা
পিসদিদা খাবার আনছে”।
বলতে বলতে দিদুয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমিও পিঠের থেকে ব্যাগ নামিয়ে
বিছানায় রাখলাম। তারপর ব্যাগ খুলে বের করলাম, দিদুয়া আর পিসদিদার জন্যে শাড়ি, শায়া
ব্লাউজ। একবাক্স সন্দেশ। চিনি দেওয়া দুপ্যাকেট বিস্কুট, এক প্যাকেট চানাচুর। কাঠের
টেবিলের ওপর সেগুলো সাজিয়ে রেখে, আমি নিজের পাজামা, পাঞ্জাবি, তোয়ালে, চপ্পল বের
করলাম। সাবানও নিয়ে এসেছিলাম, সাবানটা নিয়ে তোয়ালে পরে, ঘরের বাইরে এলাম কলতলার
খোঁজে। বসার ঘরের ওদিকের দরজা দিয়ে, বেরিয়ে, বাড়ির ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট উঠোন
পেলাম। তার বাঁদিকের বারান্দার দেওয়ালে একটা লন্ঠন জ্বলছে, সেই আলোয় টিউব ওয়েলটা
চোখে পড়ল। সেটার সামনে গিয়ে দেখলাম, বড় পরিষ্কার একটা বালতিতে জল ভরা রয়েছে, আর
তার ওপরে ভাসছে লাল টুকটুকে একটা প্লাস্টিকের মগ। সবই নতুন, আনকোরা,
বালতির গায়ে এখনো লেবেল চিপকানো রয়েছে।
ব্যবস্থা ভালই লাগল, কিন্তু দুই থুত্থুড়ি বুড়ি আমার জন্যে কল টিপে জল
ভরে রেখে দেবে, আর আমি সেই জল ব্যবহার করবো, এটা আমার পছন্দ হল না। এখন কিছু করার
নেই, তবে ঠিক করলাম, এর পরে আর এমন করতে দেব না। সাবান দিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে বেশ
ভালই লাগল। বালতির যেটুকু জল খালি হল, সেটা এই বার ভরে নিই, এই ভেবে যেমনি
টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে হাত দিয়েছি।
অন্ধকার থেকে লখাইমামা চেঁচিয়ে উঠল, “আরে করছো কি, বুড়িঠাকমা দেখতে
পেলে আমার পিণ্ডি চটকে দেবে। যাও যাও, ঘরে যাও দিকি, তোমার জন্যে পিসদিদা নুচি,
আলুরদাম আর মোহন ভোগ বানিয়েছে”। লণ্ঠনের আলোয় লখাইমামার চোখদুটো
চিকচিক করছিল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় উঠে এলাম, বললাম, “রাত্রে কি তুমি
এখানেই থাকো, লখাইমামা”?
“হুঁ, কোতায় আর যাবো বলো? বুড়ি দুটো বড্ডো অসহায়, তিনকুলে কেউ নেই। আর
বলতে গেলে আমার জন্যেই তো এসব হল...” লখাইমামার কথা শেষ
হবার আগেই, দিদুয়ার গলা পেলাম, বসার ঘরের দরজায়, কোমরে হাত দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে
আছেন, তিনি বললেন, “লখাই...কথা কওয়ার জন্যে সারারাত পড়ে
আছে, এখন ছেলেটাকে খেতে দে, একটু বিশ্রাম নিতে দে। এতখানি বয়েস হল, তোর কী একটুও
সুজবুঝ হবে না রে, মুখপোড়া”?
আমি ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দিদুয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার কাছে কী
সবাই মুখপোড়া, দিদুয়া? আমি, মা, লখাইমামা...মাঝে মাঝে ভাবি ওটা তুমি ভালোবেসে বলো,
নাকি রাগ করে বলো?” আমি হাসতে হাসতে বললাম।
দিদুয়া বলল, “তোর অত খোঁজে কী দরকার, রে পোড়ারমুখো? মিনু তোর জন্যে খাবার কোলে বসে
আছে, তাড়াতাড়ি যা”।
মায়ের পিসিমা, আমার পিসদিদার নাম মৃণালিনী, ডাক নাম মিনু। মায়ের এই
পিসিমা মায়ের বাবার খুড়তুতো বোন। বিয়ের পরেই খুব অল্প বয়সে মায়ের পিসেমশাই মারা
গিয়েছিলেন। দিদার তো কোন ছেলেপুলেও নেই, সত্যি বলতে আমরা ছাড়া তিনকুলে কেউ নেই
ওঁদের।
ঘরে ঢুকে চটপট জামা কাপড় বদলে রেডি হতে হতেই, পিসদিদা এল। বড়ো একটা
কাঁসার থালায়, লুচির পাহাড়, আর কাঁসার বাটি ভরা আলুর দম। কাঠের টেবিলে রাখতে রাখতে
বললেন, “শুরু কর, গরম গরম ভেজে আরো আনছি”। তারপর টেবিলের ওপর
আমার আনা জিনিষপত্রগুলো দেখে বললেন, “এগুলো কে পাঠালো, অনু? মেয়েটার কোনকালে
আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না, সেই একইরকম ছেলেমানুষ রয়ে গেল। আমাদের আর এসব খাওয়া পরার
অবস্থা আছে?”
আমি পা ছুঁয়ে পিসদিদাকে প্রণাম করলাম, পিসদিদাও আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমু
খেলেন। তারপর বিছানার এক ধারে বসে বললেন, “শুরু কর, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমি আরো আনছি”।
আমি কথা না বাড়িয়ে একটা লুচি ছিঁড়ে মুখে পুরলাম। তারপর বললাম, “দিদা, এই লুচির
পর আর একখানা লুচিও যদি আনো, আমি এখনই কলকাতা ফিরে যাবো”।
দিদা আমার এই কথায় যেন শিউরে উঠলেন, বললেন, “সেই কোন সকালে
বেরিয়েছিস, এতটা পথ। ওই কটা লুচিতে কী হবে শুনি? না খাইয়ে খাইয়ে, অনু তোর পেট একদম
মেরে দিয়েছে”। অনু আমার মায়ের নাম, অনুশ্রী।
আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “তোমার পাল্লায় পড়লে আমি এতদিনে বক
রাক্ষস হয়ে উঠতাম, দিদা”।
“নে, নে বেশি বাহাদুরি করিস না, রাতের বেলা রাক্ষস- খোক্কসের কথা কেউ
বলে নাকি? রাতে কী খাবি? এই অবেলায়, এত কম সময়ে তেমন যোগাড়টোগাড় করতে পারলাম না,
মাছের ঝোল বেগুনভাজা, ঘি আর ভাত। ঠিক আছে?”
“এখন এই লুচির পাহাড়ের পর, রাত্রে আবার ভাত? দিদা, প্লিজ...”।
আমাদের কথার মধ্যে, দিদুয়া ঘরের মধ্যে এলেন, বললেন, “মিনু, তোর আবার
ভুলে যাওয়ার ব্যারাম আছে, মোহনভোগের বাটিটা নিয়ে আয়, আর ওই সঙ্গে খানকতক লুচি”।
“তোমরা দুজনে কি আমাকে খাইয়ে খাইয়েই মেরে ফেলবে নাকি?” এবার আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম।
দিদুয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “আচ্ছা, ছাড়।
আজকালকার এই ছোঁড়াদের না খেয়ে থাকাটা বেশ একটা পাকামি হয়েছে। লুচি না নিক,
মোহনভোগটা তো নিয়ে আয়, মিনু”।
৩
একপেট খেয়ে আমার হাঁসফাঁস অবস্থা। দুজনে মিলে যেভাবে চেপে ধরেছেন,
রাত্রে ভাত খেতে বসে, আমাকে যে লড়াই করতে হবে, সেটা বেশ টের পেয়ে গেলাম।
খাবার পর পিসদিদা এঁটো থালা তুলে নিয়ে যেতে, দিদুয়া বললেন, “বেশ ক বছর হল,
আমাদের এ বাড়িতে বিজলি নেই। বিল-টিল ভরা হয় না বলে, কেটে দিয়ে গেছে। এ ঘরে তোর
ভালো লাগবে না, ওপরের ছাদে চ, খোলা হাওয়া একটু গায়ে লাগলে, আরাম পাবি। অবিশ্যি আজ
আবার কৃষ্ণপক্ষের একাদশী। জ্যোৎস্নাও থাকবে না তেমন”।
কথাটা আমার মনে ধরল। ঘরের ভেতরটা সত্যিই খুব গুমোট। আর অনেক দিন বন্ধ
থাকা ঘরে, কেমন যেন একটা গন্ধ হয়, সেটাও খুব অস্বস্তিকর লাগছিল।
আমরা তিনজনে উপরে চললাম, হাতে হ্যারিকেন নিয়ে একদম সামনে দিদুয়া,
মাঝখানে হাতে মাদুর নিয়ে পিসদিদা। ছাদে উঠে সত্যি বেশ ভালো লাগল। মোটামুটি চওড়া বড়
ছাদ, চারদিকে নিরেট অন্ধকার। মাথার উপরে আরেকটা বিশাল ছাদ – ঝকঝকে তারায় ভরা। এত
পরিষ্কার তারায় ভরা আকাশ, আমি ব্যঙ্গালুরু বা কলকাতাতে দেখিনি। শহরের আকাশগুলো
অন্যরকম হয়।
পিসদিদা ছাদের একদম মাঝখানে মাদুরটা বিছিয়ে দিলেন, তারপর বললেন, “আয় বোস, ইচ্ছে
হলে শুতেও পারিস। ছাদের ধারের দিকে একদম যাবি না, পুরোনো বাড়ি - ছাদের আলসে অনেক
জায়গাতেই ভাঙা আছে”।
আমি মাদুরে বসতে, দিদুয়াও বসলেন। বললেন, “বেশিক্ষণ আর
দাঁড়াতে পারি না, কোমর ধরে যায়। বসলে কিংবা শুলে আরাম পাই। মিনু, চোখে লাগছে,
হ্যারিকেনটা কমিয়ে দে না। অন্ধকারই ভাল”। পিসদিদা হ্যারিকেনের
সলতেটা কমিয়ে ছোট্ট করে দিতে, আলোটা কমে গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার যেন
দৌড়ে এসে ঘিরে ধরল আমাদের। একটু পরে, অন্ধকারেও চোখ সয়ে গেল, আবছা আবছা দেখতে
পাচ্ছিলাম। আমাদের ছাদের পাশেই একটা বিশাল গাছ দেখলাম ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অন্ধকারে চিনতে পারলাম না। কাল সকালে দেখতে হবে, কী গাছ।
নিচের ঘরে অনেকবার দেখেছিলাম, আমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। দুবার
রিস্টার্ট করেও দেখলাম। ভেবেছিলাম ছাদে হয়তো নেটওয়ার্ক পেয়ে যাবো, পেলাম না। বাবা
মা নিশ্চয়ই বার বার চেষ্টা করছেন, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। স্টেসনে নেমেই মাকে
একটা ফোন করলে, মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হতেন, এখন নিশ্চয়ই চিন্তায় ছটফট করছেন। কিন্তু
কিছু করার নেই, আজকাল ফোনে নেট ওয়ার্ক না থাকলে মনে হয় সভ্যজগতের বাইরে বসে আছি।
অবিশ্যি এই ছাদে বসে অন্ধকারে যতদূর চোখ যায়, তার মধ্যে কোন লোক বসতি চোখে পড়ছে
না। এমনকি লোকজনের কোন শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। বহুদূরে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা
যাচ্ছে। আর কাছাকাছির মধ্যে রাতচরা কোন এক পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম, টিট-টি
টিট-টি...আর কোন শব্দ নেই চারপাশে। সায়েবরা এই পাখির ডাককে বলে, ডিড ইউ ডু ইট।
ছাদে বসে খোলা হাওয়ায় বেশ ভালই লাগছিল। তিনজনে বসে নানান গল্প শুরু হল।
আমার এবং বাবা মায়ের কথা থেকে ওঁনাদের ছোটবেলার নানান কথা শুনতে শুনতে কতক্ষণ কেটে
গেল কে জানে? এখানে সময়ও যেন অনেক হাল্কা চালে চলে, শহরের মতো সর্বদাই ব্যস্ত নয়।
পিসদিদা কথা বলতে বলতে একসময় ঝিমোতে লাগলেন, মনে হল। কিন্তু দিদুয়ার কোন ক্লান্তি
নেই এক নাগাড়ে বকেই চলেছেন।
হঠাৎ কী মনে হতে, দিদুয়া জিজ্ঞাসা করলেন, “কটা বাজছে, রে?” আমার মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে ঘড়িটাও
দেখা যাচ্ছিল না। দিদুয়া হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনটা উস্কে দিয়ে বললেন, “দেখতো কটা বাজে?”
হ্যারিকেনের আলোয় ঘড়ি দেখে বললাম, “এগারোটা দশ”।
শুনেই দিদুয়া খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বললেন, “সে কি রে? এই
মিনু, মিনু? কত রাত হয়ে গেল, দ্যাখ। ওঠ, ওঠ, পিকলুকে খেতে দিয়ে দে, ও শুয়ে পড়ুক।
এখনি বারোটা বেজে যাবে...ওঠ ওঠ শিগ্গির নিচেয় চল”।
অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে নানান কথা চিন্তা করতে করতে, একটা কথা হঠাৎ মনের
মধ্যে কেমন যেন খটকা এনে দিল। লখাইমামা যে বলল দিদুয়াকে খবর দিয়ে দিয়েছে, কী করে
দিল? এখানে তো নেট ওয়ার্কই নেই। কাল সকালে এটার খোঁজ নিতে হবে, নেটওয়ার্ক ছাড়াই
যদি দিদুয়ার সঙ্গে কথা বলা যায়, তার চেয়ে মজা আর কী হবে? তবে এটা বোধহয় আমাদের
জন্যে নয় - দিদুয়া, দিদা আর লখাইমামা ছাড়া এ নেটওয়ার্ক অচল। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
পা দেওয়া থেকে, এই ঘরের বিছানায় এখন এই যে শুয়ে আছি, এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা
ব্যাপার! এটা আমার জন্যেই স্পেশাল, অন্য কেউ এলে হয়তো প্রাণটাই দিত বেঘোরে! তবে
এখন আমারও একটু অঘোর হলে মন্দ হত না, ইয়ে মানে অঘোর ঘুম আর কি!
মা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আমার মুখে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে
বললেন, “ঠিক আছিস তো রে, পিকলু? কাল সন্ধে থেকে আমাদের যে কী গেছে! তুই ফোন
করিসনি কেন? তোর বাবা আর আমি অন্ততঃ দুশোবার ফোন করেছি!”
বাবা কিছু বলছিলেন না, আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কিছু দেখছিলেন। বাবার পিছনে আরো
দুজন লোক ছিল, তাদের চিনি না। তারা আমার দিকে ভূত দেখার মতো, হাঁ করে
তাকিয়ে ছিল।
মাকে শান্ত করার জন্যে, আমি বললাম, “আমি একদম ঠিক আছি, মা। কিচ্ছু হয়নি। ফোন করতে
পারিনি এখানে নেটওয়ার্ক ছিল না। কিন্তু এত সকালে তোমরা কী করে এলে, আর এলেই বা
কেন? বসো, বসো এই ঘরে একটা বিছানা আছে, এ ঘরে এসে বসো।”
মাকে ঘরে এনে বিছানায় বসালাম, বাবাও এলেন ঘরের ভেতর। সেই লোকদুজন
দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকল, ঢুকল না।
আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা, ওঁনারা
কে?”
বাবা বললেন, “ইয়ে মানে, ওঁনারা ওই সামনের মন্দিরতলায় মন্দিরের সামনে বসেছিলাম। আজ
ভোরে আসার সময়, আমরা তোর কথা জিজ্ঞাসা করাতে, ওঁনারা বললেন, তুই গতকাল
সন্ধের আগে একটা রিকশা করে এই বাড়িতে নাকি এসেছিস। কিন্তু তারপর আর কিছু জানে না।
রিকশাটা লখাই চালাচ্ছিল। এই লখাই বছর ছয়েক আগে একটা দুর্ঘটনায় ইয়ে মানে...সে এক
ভয়ংকর ব্যাপার...”।
বাবাকে আমি কথাটা শেষ করতে দিলাম না, আমি ওই দুজনকে বললাম, “কাকু, আমরা
সবাই ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি। আমার মা-বাবাকে সাহায্য করার জন্যে অনেক থ্যাংক্স।
আপনারা মন্দিরের সামনেই থাকুন। ফেরার সময় আমরা দেখা করে যাবো”।
আমার কথায় লোক দুজন কোন উত্তর দিল না, বরং আমার দিকে স্থির দৃষ্টি
রেখে, ভয়ে ভয়ে পিছনে হাঁটতে লাগল। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে, এক দৌড়ে ওদের সাইকেলে
গিয়ে উঠল, তারপর পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে, একজন বলল, “এ ছোঁড়াটা কি
ওঝা নাকি বলতো”?
“ওঝা না হাতি। ছোঁড়াটা কাল সন্ধেতেই ভূত হয়ে গেছে! ও আমি দেখেই বুঝে
গেছি”। এ কথার পরে দুজনে ঊর্ধশ্বাসে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল,
মন্দিরতলার দিকে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ঘরে এসে মায়ের পাশে বসলাম, বাবাকেও বললাম, “দাঁড়িয়ে কেন,
বাবা? বসো না”। বাবা বিছানায় বসে, আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কখন জানলে, সব কথা?”
মা এখন অনেকটাই শান্ত, বললেন, “কাল সন্ধেবেলা, পাশের বাড়ির অনিলবাবু,
তোর বাবার হাতে একগাদা চিঠির গোছা দিয়ে গেলেন। বললেন, “আপনারা তো অনেকদিন আসেননি,
তা প্রায় বছর আষ্টেক তো হলোই। এ কবছরে আপনাদের কিছু চিঠি এসে আমার কাছেই পড়ে
রয়েছে। চিঠিগুলো তেমন জরুরি বলে আমার মনে হয়নি, তাই ফোনেও আপনাদের কিছু বলিনি। এখন
যখন এসেই পড়েছেন, চিঠিগুলোও দেখে নিন”। অনিলবাবু তারপরেও
অনেকক্ষণ ছিলেন, অনেক কথাবার্তা হল। তোর কথাও হল, বললাম যে, আজ দুপুরে তুই এখানে
এসেছিস। আগামীকাল ফিরে আসবি। তুই ফোন করিসনি বলে, উনিও খুব চিন্তা করছিলেন।
অনিলবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ফেললাম। তোর বাবা বসল
চিঠির গোছা নিয়ে। আর আমি ঘরের জিনিষপত্র সাজাচ্ছিলাম”।
মা একটু থামতে বাবা বলতে শুরু করলেন, “অনিলবাবু ঠিকই বলেছিলেন,
অধিকাংশই নানান ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড কিংবা বিজ্ঞাপনের আবর্জনা চিঠি। এই অফার, সেই অফার,
হাবিজাবি। শুধু একটা চিঠি, হলুদখামের ওপর হাতে লেখা ঠিকানা, তোর মায়ের নামে।
চিঠিটা খুলেই আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এইখান থেকে কোন একজন মৃণালবাবু চিঠিটা
লিখেছেন। তারিখ দুহাজার সাতের ষোলোই সেপ্টেম্বর। আমাদের ঠিকানা কোথাও থেকে যোগাড়
করেছেন...”
“কি লিখেছেন”? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কিন্তু উত্তর দিলেন, বাবা নয়, দিদুয়া, তিনি বললেন, “অ এ ওই মুখপোড়া
মৃণালের কাজ। ওইজন্যে হতভাগা, একদিন এসে এ বাড়ির ঘরেদোর, আলমারি, টেবিলের ড্রয়ার
হাঁটকাচ্ছিল”। আমি দিদুয়াকে দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু মা-বাবা
দেখতে পাচ্ছেন না, বুঝতে পারলাম। দিদুয়ার গলা শুনে দুজনেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেছেন।
আমি বললাম, “দিদুয়া, বলা নেই কওয়া নেই, এমন চমকে দাও কেন বলো তো?”
“থাম তো, তুই আর বকিস না, পিকলু। তুই একটা কচি ছেলে, নাক টিপলে এখনো
দুধের গন্ধ মেলে, কাল সেই সন্ধে থেকে আমাদের সঙ্গে রয়েছিস, উঠছিস, বসছিস, খাচ্ছিস,
দাচ্ছিস, কোন ভয় নেই। সেখানে তোর বাবা আর আমাদের মেয়ে মুখপুড়ি অনু ভয়ে একেবারে
সিঁটিয়ে গেল? তাও আবার সকালবেলা, প্রকাশ্য দিবালোকে? তা হ্যাঁরে, অনু, আমরা থাকতে
তোর ছেলের কোন ক্ষতি হবে এমনটা ভাবলি কী করে তুই? আমাদের সে ক্ষমতাও নেই, আর সে
সাধ্যিও নেই, তবু তার মধ্যেই কাল তোর ছেলের যত্নআত্তি করতে চেষ্টার কসুর করিনি রে,
অনু। তবে একটা কথা বলব, ছেলে তোর হীরের টুকরো। একে অন্ধকার, লন্ঠনের আলো, খুব কষ্ট
পেয়েছে, টিভি নেই, পাখা নেই, তবু মুখে হাসিটি সর্বদা লেগে আছে। মনে মনে সব বুঝেছে,
কিন্তু আমাদের অশরীরী বলে এতটুকু ভয়ও পায়নি, কিংবা হতচ্ছেদ্দাও করেনি”।
মা আর বাবা অবাক হয়ে কথা শুনছিলেন, আর মা বারবার আমার দিকে
তাকাচ্ছিলেন। মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, ভয়টা অনেক কেটেছে।
আমি উঠে গিয়ে দিদুয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালাম, বললাম, “মন থেকে ভয়
মুছে ফেল মা, তাহলেই তুমিও দিদুয়াকে দেখতে পাবে। বাবা বোধহয় একটু একটু দেখতে
পাচ্ছো, না?” বাবা কিছু বললেন না, ঘাড় নেড়ে সম্মতি
জানালেন। মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর নিশ্চয়ই মাও দেখতে পেলেন দিদুয়াকে, কারণ
দেখলাম, মায়ের চোখে জল। মা এবার ধরা ধরা গলায় বললেন, “পিসিমণি,
কোথায় দিদুয়া? তোমাদের যে এভাবে দেখতে হবে ভাবিনি গো”। মা উঠে এসে দিদুয়াকে
প্রণাম করতে, দিদুয়া মাকে জড়িয়েই ধরলেন, আর তারপর মা হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন।
দিদুয়া কিছুক্ষণ পরে, মাকে বললেন, “কাঁদিস নে, মুখপুড়ি, কাঁদিস নে। চুপ কর,
তোর ছেলের জন্যে তাও তো আমাদের দেখাটা হল। তোরা বোস, আমি মিনুকে বলি, তোদের জন্যে
একটু চা করে দিক, আর জলখাবারের কি ব্যবস্থা করছে তাও দেখি”।
মা তখনো কাঁদছিলেন, বললেন, “ওসব নিয়ে তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, দিদুয়া। আমরা এখনই ফিরে যাবো,
পিকলুকে নিয়ে”।
“তাই বুঝি? কেমন ফিরে যাস আমি দেখছি। আমরা বুঝি খোনা সুরে কথা বলতে পারি
না? হিহিহিহি করে হাসতে পারি না? তুই কী মনে করেছিস? আমরা ঘাড় মটকে রক্ত শুষে খেতে
জানিনা?”
দিদুয়ার এই কথায় বাবা হাসলেন,
মাও ফিক করে হেসে ফেললেন, তারপর মা বললেন, “তুমি এখনো সেই আগের মতোই রয়ে
গেছ, দিদুয়া। একটুও বদলাও নি”।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিদুয়া বললেন, “খোলসটুকুই যা গেছে রে, পোড়ারমুখি। বাকি
সব তো একই। কিন্তু দুপুরে দুটি মাছের ঝোল ভাত খাইয়ে তবেই তোদের ছাড়বো। এ কথার
অবাধ্য হয়ে আর জ্বালাস না, অনু”।
এই সময়েই পিসদিদা দুহাতে দুটো প্লেটে দুকাপ গরম চা হাতে নিয়ে ঘরে
ঢুকলেন। তাঁরও চোখ ভেজা ভেজা, তিনিও সব কথাই শুনেছেন। চায়ের
কাপদুটো মা আর বাবার হাতে দিয়ে, দিদা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর জন্যে এক
গ্লাস দুধ এনে দিই, খা”।
আমি খুব অবাক হলাম, বললাম, “কেন? আমাকে কি এতই বাচ্চা মনে হচ্ছে?
আমিও সকালে চা খাই, আমাকেও চা দাও, দিদা”।
“তুই খুব ফচকে হয়েছিস, বুঝলি তো? একটুও ভিরমি না খেয়ে তিন তিনটে অশরীরীর সঙ্গে কাল সারারাত
আরামে কাটিয়ে দিলি, এখন আবার বলছিস চা খাবি?” দিদা আরো বললেন, “বলি আমাদের কি একটুও মান্যিগণ্যি করতে নেই? এসব অলক্ষুণে আর অসৈরন
ব্যাপারস্যাপার আমার ভালো ঠেকছে না বাপু। শেষে আমরা কী আবার মানুষ হয়ে যাবো নাকি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “ও দিদা, তা তোমার মানুষ হতে আপত্তি
কিসের”?
দিদা যেন চমকে উঠে বললেন, “রক্ষে কর বাবা, মানুষ হবার অনেক ঝক্কি।
বাতের ব্যাথা, অম্বলের চোঁয়া ঢেঁকুর, মশার কামড়। সরস্বতীপুজোয় পাড়ার ছোঁড়াদের
চাঁদার দৌরাত্ম্যি। সে সব থেকে মুক্তি পেয়ে দিব্যি আছি। আর মানুষ হয়ে কাজ নেই। এই
বেশ আছি। ভয়ে কেউ এ বাড়ির কাছ ঘেঁসে না, বলে হানাবাড়ি। দাঁড়া, তোর চাটাও নিয়ে আসি”।
এমন সময় লখাইমামা এসে ঘরে ঢুকল। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি আবার কে?”
বাবার এই কথায় দিদুয়া উত্তর দিলেন, “ওই তো আমাদের পোড়ারমুখো লখাই।
রিকশা চালাত, আমাদের দেখভালও করত। তারকেশ্বরে পুজো দিয়ে সেদিন আমরা মা আর মেয়েতে
স্টেশন থেকে ওর রিকশাতেই ফিরছিলাম। একটা লরি এসে রিকশার পিছনে টুক করে একটু ছুঁয়ে
দিল। আমরা তিনজনে তিনদিকে ছিটকে পড়লাম, আর ব্যস্ – মহানিম গাছের মগ ডালে পা
ঝুলিয়ে বসে আমরা মজা দেখতে লাগলাম। স্টেশনের বাইরে, বড়ো রাস্তায় আমরা তিনদিকে শুয়ে
আছি, আমাদের ঘিরে ধরে গুচ্ছের লোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হা হুতোশ করছে। কিছুক্ষণ পরে
পুলিশ এল, অ্যাম্বুলেন্স এল। আস্তে আস্তে ভিড়ও সরে গেল। আমরা মহানিম গাছের থেকে
সোজা এ বাড়ির ওই মহানিম গাছে ভেসে উঠলাম”।
“দিদুয়া, তোমাদের বাড়ির সামনের ওই বড়ো গাছটাও মহানিম, না? মহানিম গাছের
সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কটা কী বলোতো? কালকে স্টেশনে আমাকে লখাই মামা চিনল কী করে? আর
চেনার পরে, তোমাদের খবরই বা দিল কী করে?”
“আমাদের সব খবর জেনে তোর কী কাজ রে, মুখপোড়া?”
“ও দিদুয়া বলো না, বলো না”, আমি বায়না ধরলাম
খুব।
“আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি। বট, অশ্বত্থ, আম, জাম গাছে যেমন পাখিপুকলিদের বাস,
তেমনি মহানিম গাছে আমাদের সঙ্গীসাথিদের অনেকেই বাস করে। তোর মুখে সিংহবাহিনী বাড়ি
আসার কথা শুনে, লখাই তোকে চিনতে পেরেছিল, এ তুই ছাড়া আর কেউ না। লখাই ওর বন্ধু
হারুর সঙ্গে আড্ডা দিতে ওই মহানিম গাছে, প্রায় রোজই যায়। হারুকে দিয়ে লখাই খবর
পাঠিয়ে ছিল, আর ওই হারুই তোর জন্যে রান্নাবান্নার সব যোগাড় করে দিয়েছিল। আমাদের
যাওয়া আসাতে তেমন আর সময় লাগে কোথায়? চোখের পলক ফেলার আগেই পৌঁছে যাই, এদিক সেদিক”।
কথার মাঝখানেই দিদা আমার চা এনে দিল, আমি চা খেতে খেতে বললাম, “হুঁ, এতক্ষণে
লখাইমামার ব্যাপারটা বুঝলাম। এবার বলো তো, আমার জন্যে এই যে এত খাবার দাবার
বানাচ্ছো, জিনিষপত্র, মাছ, সবজি, আনাজ, তেল মশলা, কোথা থেকে আনছো? লখাইমামা,
লখাইমামার বন্ধু দোকান থেকে চুরি করে আনছে নাকি”?
আমার এই কথায় দিদুয়া খুব রেগে গেলেন, ডানহাত দিয়ে বাঁহাতটা খুলে নিয়ে,
লাঠির মতো ধরে আমায় মারতে উদ্যত হলেন, আর আগুনের ভাঁটার মতো চোখ জ্বালিয়ে বললেন, “তোর আস্পদ্দা
তো কম নয়? মুখপোড়া ছোঁড়া, আমাকে চোর বলছিস? তোকে আমি চুরি করে খাওয়াচ্ছি? তোর ঘাড়
আমি আজ না মটকেছি তো আমার নাম শৈলবামনি নয়”।
দিদুয়ার এই রাগ দেখে লখাইমামা মাঝখানে দাঁড়াল, বলল, “ও বুড়িঠাকমা,
ঠাণ্ডা হও, ঠাণ্ডা হও। আমি বলছি যা বলার। তুমি ঠাণ্ডা হয়ে বসো দেখি। পিকলুবাবু,
আমাদের অশরীরীদের খাওয়াদাওয়ার কোন ঝামেলা নেই, আর কোন খরচাও নেই। তোমার
দিদুয়ার কি জমানো পয়সার অভাব ছিল, মনে করছো? তুমি যে ঘরে কাল ঘুমিয়েছ, সে ঘরেই
সুটকেসে এখনো অনেক নগদ টাকা রাখা আছে। মাঝে এই নোট বাতিলের সময় কদিন একটু ঝামেলা
হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, কী হবে ওই নোট বদলে? তোমার দিদুয়াই বললেন, “নারে লখাই, কখন
কী কাজে লাগে কে জানে? টাকা কটা তুই গোপালবেনের মুদিখানা থেকে পালটেই নিয়ে আয়”। সেই টাকা দিয়েই কাল
আমার বন্ধু হারু, গোপালবেনের দোকান থেকে সব জিনিষ এনে দিয়েছে”।
“গোপালবেনে তোমাদের দেখতে পায়? কথা বলে”?
“হে হে গোপালও তো আমাদের মতো অশরীরী। আমরা এপারে আসার
কিছুদিন পরেই, পুকুরে চান করতে গিয়ে ডুবে মরল। ব্যস, পুকুরের ওপাড় থেকে, চলে এল
আমাদের এ পারে। গোপালের দোকানে এখন বসে তার বড়ো ছেলে নেপাল। ছোকরার ক্যাশবাক্সে
হিসেব মতো টাকা ফেলে, গোপাল আমাদের মাল এনে দেয়। অসৈরণ কিছু একটা ঘটছে,
সে টের পায়, তবে বেনে-ব্যবসাদার মানুষ, টাকা পেলেই হল, ও নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না”।
৫
দিদুয়া আমার ওপর যা রেগে গিয়েছিলেন, বাপরে, অনেক কষ্টে সে রাগ ভাঙালাম। বললাম, “ও দিদুয়া, খুব খিদে পেয়েছে গো, আজকে পরোটা আর আলুভাজা খাওয়াও না”। আমার এই কথাতেই কাজ হল। দিদুয়া আর পিসদিদা মিলে ময়দা মেখে পরোটা বানাতে বসলেন। আর আমরা সবাই মিলে রান্নাঘরের সামনে বসে গল্প করতে লাগলাম। অনেক কথা। সেই মায়ের ছোটবেলাকার কথা। দিদুয়ার বিয়ের আগে কলকাতায় চিড়িয়াখানা, যাদুঘর দেখতে যাওয়ার কথা। কলকাতায় তাঁর দেখা পোড়ারমুখো লালমুখো গোরা সায়েব মেমদের কথা। দিদুয়ার মুখে সেই পোড়ারমুখো লালমুখোদের কথা শুনতে শুনতে আমরা তো হেসেই সারা হয়ে গেলাম।
বেশ কাটল সারাটা দিন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে, আমরা গাড়িতে ওঠার আগে
দিদুয়া আর দিদাকে মা আর আমি আবার প্রণাম করলাম। এবার বাবাও প্রণাম করলেন।
দিদুয়া আর দিদা দুজনেই বললেন, “অফিসের ছুটিছাটায় চলে আসিস। তোরা আসাতে
কতদিন পরে কত কথা হল। খুব আনন্দ হল”।
“আসব, দিদুয়া, নিশ্চয়ই আসবো। কিন্তু তোমরা কলকাতায় যেতে পারবে না”?
“আমরা কী করে যাবো বল? ইচ্ছে করলেই কী আর যাওয়া যায়? আমাদের আর সে উপায়
নেই রে!”
লখাই মামা পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি, কোন
মহানিম গাছ আছে কি? যদি থাকে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি”।
“মহানিম গাছ? লক্ষ্য করিনি তো! এবার গিয়ে লক্ষ্য করবো। যদি থাকে তাহলে
তোমাকে কী করে খবর দেবো?”
“খুব সহজ। নির্জন দুপুরে গাছের নিচেয় গিয়ে, মুখ উঁচু করে বলবে,
“সিংহবাহিনী বাড়ির লখাইকে একটু খবর দেবেন ভাই? বলবেন, বুড়িঠাকমার পুতি পিকলু তাকে
ডাকছে”-ব্যস”।
কলকাতায় আমাদের পাড়ায় কোন মহানিমগাছ নেই। তোমাদের পাড়ায় আছে কি? থাকলে একটু খবর দেবে, ভাই? খুব জরুরি একটা খবর দেওয়ার আছে দিদুয়াকে। দেখে জানাও না, প্লিজ।
বেশ ভাল লিখেছিস। সুন্দর রম্যরচনা।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ, সিদ্ধার্থ।
উত্তরমুছুন