[পূর্ব প্রকাশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীর পর্ব ১ এই সূত্রে পড়া যাবে - শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ১ ]
আগেই বলেছি মার্কণ্ডেয় পুরাণের তেরটি অধ্যায়
নিয়ে “দেবীমাহাত্ম্যম্” বা “শ্রীশ্রী চণ্ডী” বিরচিত। এই শ্রীশ্রী চণ্ডী তিনটি চরিতে
বিভক্ত। প্রথম চরিত (প্রথম অধ্যায়), মধ্যম চরিত (দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়) এবং
উত্তর চরিত (পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায়)। বলা হয় যে, মনে যে কোন কামনার সংকল্প নিয়ে এই তিন চরিত পাঠ
করলে, পাঠকের ধর্ম, অর্থ ও কাম অর্থাৎ অভ্যুদয় বা সাংসারিক উন্নতি লাভ হয়। আর
নিষ্কাম সংকল্প নিয়ে পাঠ করলে পাঠকের মোক্ষলাভ হয় অর্থাৎ সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া
যায়। অতএব চণ্ডীপাঠে মানবজীবনের সমুদয় চতুর্বর্গ লাভ হয়ে থাকে। এই কারণেই
শ্রীশ্রীচণ্ডীদেবীর আরাধনা করে রাজা সুরথ হারানো-রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন এবং বৈশ্য
সমাধি ব্রহ্মজ্ঞান বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন।
প্রথম চরিত – মধুকৈটভ বধ
প্রথম অধ্যায়
ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ
ওঁ ক্লীং মার্কণ্ডেয় উবাচ। ১
সাবর্ণিঃ সূর্যতনয়ো যো মনুঃ
কথ্যতেঽষ্টমঃ।
নিশাময় তদুৎপত্তিং বিস্তরাৎ গদতো
মম।। ২
[সাবর্ণিঃ সূর্য-তনয়ঃ যঃ মনুঃ
কথ্যতে অষ্টমঃ। নিশাময় তৎ উৎপত্তিম্ বিস্তরাৎ গদতঃ মম।। ২]
ঋষি মার্কণ্ডেয় বললেন। সূর্য-পুত্র সাবর্ণি, যাঁকে অষ্টম মনু বলা হয়, তাঁর
জন্মবৃত্তান্তের কথা আমি বিস্তারিত বর্ণনা করছি, মন দিয়ে শোন।
[ওঁ, ঐং, হ্রীং, ক্লীং প্রভৃতি শব্দগুলি বৈদিক ও তন্ত্রশাস্ত্রের বীজ মন্ত্র। ওঁ আদি প্রণব মন্ত্র। ঐং মন্ত্র চিৎরূপা সরস্বতী কে, হ্রীং মন্ত্র সত-রূপা লক্ষ্মীকে, ক্লীং মন্ত্রে আনন্দস্বরূপিনী মহাকালীকে সম্বোধন, আবাহন এবং স্মরণ করা হয়।]
মহামায়ানুভাবেন যথা
মন্বন্তরাধিপঃ।
সঃ বভূব মহাভাগঃ সাবর্ণিস্তনয়ো
রবেঃ।। ৩
[মহামায়া অনুভাবেন যথা মন্বন্তর
অধিপঃ। স বভূব মহাভাগঃ সাবর্ণিঃ তনয়ঃ রবেঃ।। ৩]
মহামায়ার অনুগ্রহে রবির পুত্র সেই মহা-ঐশ্বর্যবান সাবর্ণি যে ভাবে
মন্বন্তরের অধীশ্বর হয়েছিলেন, (সে কথাই এখন বলব)।
স্বারোচিষেঽন্তরে পূর্বং
চৈত্রবংশসমুদ্ভবঃ।
সুরথো নাম রাজাঽভূৎ সমস্ত
ক্ষিতিমণ্ডলে।। ৪
[স্বারোচিষে অন্তরে পূর্বং চৈত্র-বংশ-সমুদ্ভবঃ।
সুরথঃ নাম রাজা অভূৎ সমস্ত ক্ষিতিমণ্ডলে।। ৪]
পুরাকালে স্বারোচিষ মনুর সময়ে এই পৃথিবীতে চৈত্র বংশজাত সুরথ নামে এক রাজা
ছিলেন।
তস্য পালয়তঃ সম্যক্ প্রজাঃ
পুত্রানিবৌরসান্।
বভূবুঃ শত্রবো ভূপাঃ
কোলা-বিধ্বংসিনঃ তদা।। ৫
[তস্য পালয়তঃ সম্যক্ প্রজাঃ
পুত্রান্ ইব ঔরসান্। বভূবুঃ শত্রবঃ ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা।। ৫]
সেই রাজা প্রজাদের নিজের পুত্রদের মতোই যথানীতি পালন করতেন। কিন্তু সেই সময়
কোলা-ধ্বংসকারী কিছু যবন রাজা তাঁর শত্রু হয়ে উঠছিল।
[কোলা – কোন মতে কোলা রাজা সুরথের রাজধানী শহর। কাশ্মীর
সীমান্তের কোন যবন জাতি – অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যরা কোলা আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ৭
নম্বর শ্লোকে আমরা দেখব, শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তিনি নিজের রাজধানীতে ফিরে এলেন।
সেক্ষেত্রে কোলা রাজা সুরথের রাজধানী ছিল না। অথবা এমনও হতে পারে, যবন সৈন্যরা রাজধানী
লুঠপাট করে, চলে গিয়েছিল – রাজা সুরথ তাদের ঠেকাতে পারেননি। দ্বাদশ শতাব্দীর
প্রথমার্ধ থেকে গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম আক্রমণকারীদের এমনই উপদ্রব শুরু
করেছিল।]
তস্য তৈরভবদ্
যুদ্ধমতিপ্রবলদণ্ডিনঃ।
ন্যূনৈরপি স তৈর্যুদ্ধে
কোলাবিধ্বংসিভির্জিতঃ।। ৬
[তস্য তৈঃ অভবৎ যুদ্ধম্
অতি-প্রবল-দণ্ডিনঃ। ন্যূনৈঃ অপি স তৈঃ যুদ্ধে কোলাবিধ্বংসিভিঃ জিতঃ।। ৬]
শত্রুদের অতি কঠোর দণ্ডদাতা, রাজা সুরথের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু
সেই যুদ্ধে তাদের সংখ্যা কম হলেও রাজা সুরথ, কোলাবিধ্বংসীদের কাছে পরাজিত
হয়েছিলেন।
ততঃ স্বপুরমায়াতো নিজদেশাধিপোঽভবৎ।
আক্রান্তঃ স মহাভাগস্তৈ স্তদা
প্রবলারিভিঃ।। ৭
[ততঃ স্বপুরম্ আয়াতঃ নিজ-দেশ অধিপঃ অভবৎ। আক্রান্তঃ স মহাভাগঃ তৈঃ তদা
প্রবল-অরিভিঃ।। ৭]
সেই প্রবল শত্রুদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর, তিনি নিজের রাজধানীতে ফিরে এসে,
নিজ-রাজ্যেরই অধিপতি হলেন।
অমাত্যৈর্বলিভির্দুষ্টৈর্দুর্বলস্য
দুরাত্মভিঃ।
কোষো বলঞ্চাপহৃতং তত্রাপি স্বপুরে
ততঃ।। ৮
[অমাত্যৈঃ বলিভিঃ দুষ্টৈঃ
দুর্বলস্য দুরাত্মভিঃ। কোষঃ বলম্ চ অপহৃতং তত্র অপি স্বপুরে ততঃ।। ৮]
কিন্তু তাঁর নিজের রাজধানীতেও দুর্বল রাজা সুরথের দুষ্ট, প্রভাবশালী, নীচ
অমাত্যরা তাঁর সেনাদল এবং রাজকোষ অপহরণ করে নিল।
ততো মৃগয়াব্যাজেন হৃতস্বাম্যঃ স
ভূপতিঃ।
একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনম্।।
৯
[ততঃ মৃগয়া-ব্যাজেন হৃত-স্বাম্যঃ
স ভূপতিঃ। একাকী হয়ম্ আরুহ্য জগাম গহনম্ বনম্।। ৯]
তখন রাজ্যহারা সেই ভূপতি মৃগয়ার অজুহাতে একা একাই ঘোড়ায় চড়ে গহন অরণ্যে চলে
গেলেন।
স তত্রাশ্রমমদ্রাক্ষীদ্
দ্বিজবর্যস্য মেধসঃ।
প্রশান্তশ্বাপদাকীর্ণং
মুনিশিষ্যোপশোভিতম্।। ১০
[স তত্র আশ্রমম্ অদ্রাক্ষীৎ
দ্বিজ-বর্যস্য মেধসঃ। প্রশান্ত-শ্বাপদ-আকীর্ণং মুনি-শিষ্য উপশোভিতম্।। ১০]
শান্ত-স্বভাবের হিংস্রপশু ঘুরে বেড়ানো সেই
অরণ্যের মধ্যে, তিনি মুনি ও শিষ্য শোভিত দ্বিজবর ঋষি মেধসের আশ্রম দেখতে পেলেন।
তস্থৌ কঞ্চিৎ স কালঞ্চ মুনিনা তেন
সৎকৃতঃ।
ইতশ্চেতশ্চ বিচরংস্তস্মিন্ মুনিবরাশ্রমে।। ১১
[তস্থৌ কঞ্চিৎ সঃ কালম্ চ মুনিনা
তেন সৎকৃতঃ। ইতঃ চ এতঃ চ বিচরন্ তস্মিন্ মুনিবর-আশ্রমে।। ১১]
মুনিদের থেকে সমাদর পেয়ে রাজা সুরথ সেই
মুনিবরের আশ্রমে কিছুদিন থাকলেন এবং এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালেন।
সোঽচিন্তয়ত্তদা তত্র
মমত্বাকৃষ্টচেতনঃ।
মৎপূর্বৈঃ পালিতং পূর্বং ময়া হীনং
পুরং হি তৎ।।
মদ্ভৃত্যৈস্তৈরসদ্বৃত্তৈরধর্মতঃ
পাল্যতে ন বা। ১২
[সঃ অচিন্তয়ৎ তদা তত্র
মমত্ব-আকৃষ্ট-চেতনঃ। মৎ-পূর্বৈঃ পালিতং পূর্বং ময়া হীনং পুরং হি তৎ।। মৎ ভৃত্যৈঃ
তৈঃ অসৎ-বৃত্তৈঃ ধর্মতঃ পাল্যতে ন বা। ১২]
সেখানে মমতায় অভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে
লাগলেন, অতীতকালে আমার পূর্বপুরুষেরা যাকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই রাজধানীতে আমি
এখন আর নেই। আমার সেই অসৎ-চরিত্রের ভৃত্যেরা তাকে ধর্মানুসারে রক্ষা করছে কি?
ন জানে সপ্রধানো মে শূরহস্তী
সদামদঃ।
মম বৈরিবশং যাতঃ কান্
ভোগানুপলপ্স্যতে।। ১৩
[ন জানে সপ্রধানো মে শূরহস্তী
সদা-মদঃ। মম বৈরি-বশং যাতঃ কান্ ভোগান্ উপলপ্স্যতে।। ১৩]
জানিনা আমার সেই সর্বদা মদস্রাবী প্রধান গজবীর, আমার শত্রুদের অধীন হয়ে
কেমন আহার্য পাচ্ছে।
যে মমানুগতা নিত্যং
প্রসাদ-ধন-ভোজনৈঃ।
অনুবৃত্তিং ধ্রুবং তেঽদ্য
কুর্বন্ত্যন্যমহীভৃতাম্।। ১৪
[যে মম অনুগতা নিত্যং
প্রসাদ-ধন-ভোজনৈঃ। অনুবৃত্তিং ধ্রুবং তে অদ্য কুর্বন্তি অন্য-মহীভৃতাম্।। ১৪]
আমার থেকে নিত্য পুরষ্কার- বেতন – ভোজ্য লাভ করে যারা অনুগত ছিল, তারা
নিশ্চয়ই আজকাল অন্য রাজার দাসত্ব করছে।
অসম্যগ্ব্যয়শীলৈস্তৈঃ কুর্বদ্ভিঃ
সতত ব্যয়ম্।
সঞ্চিতঃ সোঽতিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষো
গমিষ্যতি।। ১৫
[অসম্যক্ ব্যয়শীলৈঃ তৈঃ
কুর্বদ্ভিঃ সতত ব্যয়ম্। সঞ্চিতঃ সঃ অতিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষঃ গমিষ্যতি।। ১৫]
অতিকষ্টে আমি যে ধন সঞ্চয় করেছিলাম, সর্বদা অমিতব্যয়ী সেই তাদের
(অমাত্যদের) অপরিমিত ব্যয়ে রাজকোষ নিঃশেষ হয়ে যাবে।
এতচ্চান্যচ্চ সততং চিন্তয়ামাস
পার্থিবঃ।
তত্র বিপ্রাশ্রমাভ্যাসে বৈশ্যমেকং
দদর্শ সঃ।। ১৬
[এতৎ চ অন্যৎ চ সততং চিন্তয়াম্
আস পার্থিবঃ। তত্র বিপ্র আশ্রম-অভ্যাসে বৈশ্যম্ একম্ দদর্শ সঃ।। ১৬]
এই রকম নানান বিষয় নিয়ে রাজা যখন চিন্তা
করছিলেন, তখন, হে বিপ্র, আশ্রমের কাছেই তিনি এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন।
[ মার্কণ্ডেয় পুরাণের প্রবক্তা স্বয়ং ঋষি মার্কণ্ডেয় এই কাহিনী বলছিলেন
তাঁর শিষ্যকে, তাঁকেই তিনি “বিপ্র” বলে সম্বোধন করলেন।]
স পৃষ্টস্তেন কস্ত্বম্ভো
হেতুশ্চাগমনেঽত্র কঃ।
সশোক ইব কস্মাত্ত্বং দুর্মনা ইব
লক্ষ্যসে।। ১৭
[সঃ পৃষ্টঃ তেন কঃ ত্বম্ ভোঃ হেতুঃ চ আগমনে অত্র কঃ। সশোক ইব
কস্মাৎ ত্বং দুর্মনা ইব লক্ষ্যসে।। ১৭]
রাজা (বৈশ্যকে) জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভদ্র, আপনি
কে? কিসের জন্যে এখানে এসেছেন? কিসের জন্যে আপনাকে এত শোকাকুল এবং বিমনা
দেখাচ্ছে?
ইত্যাকর্ণ্য বচস্তস্য ভূপতেঃ
প্রণয়োদিতম্।
প্রত্যুবাচ স তং বৈশ্যঃ
প্রশ্রয়াবনতো নৃপম।। ১৮
[ইতি আকর্ণ্য বচঃ তস্য ভূপতেঃ
প্রণয়-উদিতম্।
প্রতি-উবাচ স তং বৈশ্যঃ প্রশ্রয়া-অবনতঃ নৃপম।। ১৮]
রাজার সহানুভূতি পূর্ণ এই কথা শুনে, সেই বৈশ্য
বিনীত শ্রদ্ধায় রাজাকে উত্তরে বললেন।
বৈশ্য উবাচ
সমাধির্নাম বৈশ্যোঽহমুৎপন্নো
ধনিনাং কুলে।
পুত্রদারৈর্নিরস্তশ্চ
ধনলোভাদসাধুভিঃ।। ১৯
[সমাধিঃ নাম বৈশ্যঃ অহম উৎপন্নঃ
ধনিনাং কুলে। পুত্র-দারৈঃ নিরস্তঃ চ ধন-লোভাৎ- অসাধুভিঃ।। ১৯]
বৈশ্য বললেন, ধনী বৈশ্য বংশে আমার জন্ম, আমার
নাম সমাধি। ধনের লোভে অসাধু স্ত্রী ও পুত্ররা আমাকে পরিত্যাগ করেছে।
বিহীনশ্চ ধনৈর্দারৈঃ পুত্রৈরাদায়
মে ধনম্।
বনমভ্যাগতো দুঃখী
নিরস্তশ্চাপ্তবন্ধুভিঃ।। ২০
[বিহীনঃ চ ধনৈঃ দারৈঃ পুত্রৈঃ
আদায় মে ধনম্। বনম্ অভ্যাগতঃ দুঃখী নিরস্তঃ চ আপ্ত-বন্ধুভিঃ।। ২০]
স্ত্রী-পুত্ররা আমার ধন কেড়ে নিয়েছে, ধনহীন হওয়াতে ছেড়ে গেছে আমার আত্মীয়-বন্ধুরাও। (তাই) মনের দুঃখে এই বনে এসেছি।
সোঽহং ন বেদ্মি পুত্রাণাং
কুশলাকুশলাত্মিকাম্।
প্রবৃত্তিং স্বজনানাঞ্চ
দারাণাঞ্চাত্র সংস্থিতঃ।। ২১
[সঃ অহম্ ন বেদ্মি পুত্রাণাং
কুশল-অকুশল-আত্মিকাম্। প্রবৃত্তিম্ স্বজনানাম্ চ দারাণাম্ চ অত্র সংস্থিতঃ।।
২১]
এখন এই বনে অবস্থান করায়, আমি পুত্রদের, পত্নীদের এবং স্বজনদের শুভ কিংবা অশুভ কোন সংবাদই আর পাই না।
কিন্নু তেষাং গৃহে ক্ষেমমক্ষেমং
কিন্নু সাম্প্রতম্।
কথন্তে কিন্নু সদ্বৃত্তা
দুর্বৃত্তাঃ কিন্নু মে সুতাঃ।। ২২
[কিন্নু তেষাং গৃহে ক্ষেমম্-অক্ষেমম্
কিন্নু সাম্প্রতম্। কথন্তে কিন্নু সদ্বৃত্তা দুর্বৃত্তাঃ কিন্নু মে সুতাঃ।। ২২]
তাদের সংসারে সম্প্রতি মঙ্গল বা অমঙ্গল কিনা,
পুত্রেরা সজ্জন নাকি দুর্জন হয়েছে, সে কথাও জানি না।
রাজোবাচ।
যৈর্নিরস্তো ভবাঁল্লুব্ধৈঃ
পুত্রদারাদিভির্ধনৈঃ।
তেষু কিং ভবতঃ স্নেহমনুবধ্নাতি
মানসম্।। ২৩
[রাজা উবাচ। যৈঃ নিরস্তঃ ভবান্
লুব্ধৈঃ পুত্র-দারাদিভিঃ ধনৈঃ। তেষু কিম্ ভবতঃ স্নেহম্ অনুবধ্নাতি মানসম্।। ২৩]
রাজা বললেন, ধনলোভী পুত্র-পরিবারাদি আপনাকে
পরিত্যাগ করার পরেও, আপনার মনে কেন (তাদের প্রতি) স্নেহবন্ধন রয়েছে?
বৈশ্য উবাচ।
এবমেতদ্ যথা প্রাহ ভবানস্মদ্গতং
বচঃ।
কিং করোমি ন বধ্নাতি মম
নিষ্ঠুরতাং মনঃ।। ২৪
[এবম্ এতৎ যথা প্রাহ ভবান্
অস্মদ্গতম্ বচঃ। কিম্ করোমি ন বধ্নাতি মম নিষ্ঠুরতাম্ মনঃ।। ২৪]
বৈশ্য বললেন। আমার সম্বন্ধে যা বললেন সে কথা
ঠিকই, কিন্তু কী করব আমার মন মমতাহীন হতে পারছি না।
যৈঃ সন্ত্যজ্য পিতৃস্নেহং ধনলুব্ধৈর্নিরাকৃতঃ।
পতিস্বজনহার্দঞ্চ হার্দি তেষ্বেব
মে মনঃ।। ২৫
[যৈঃ সন্ত্যজ্য পিতৃস্নেহং
ধনলুব্ধৈঃ নিরাকৃতঃ। পতি-স্বজন-হার্দম্ চ হার্দি তেষু এব মে মনঃ।। ২৫]
যে ধনলোভীরা আমার পিতৃস্নেহ, পতি-প্রেম এবং
স্বজনপ্রীতি ভুলে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, আমার মনে এখনও তাদের প্রতিই স্নেহবন্ধন
রয়ে গেছে।
যৎ প্রেমপ্রবণং চিত্তং
বিগুণেষ্বপি বন্ধুষু।। ২৬
[কিম্ এতৎ ন অভিজানামি জানন্
অপি মহামতে। যৎ প্রেম-প্রবণং চিত্তম্ বিগুণেষু অপি বন্ধুষু।। ২৬]
হে মহামতি, সব জেনেও, গুণহীন বন্ধু
(পুত্র-দারা-স্বজন)-দের প্রতি কেন আমার মন স্নেহপ্রবণ হচ্ছে আমি জানি না।
তেষাং কৃতে মে নিঃশ্বাসো
দৌর্মনস্যঞ্চ জায়তে।
করোমি কিং যন্ন মনস্তেষ্বপ্রীতিষু
নিষ্ঠুরম্।। ২৭
[তেষাম্
কৃতে মে নিঃশ্বাসঃ দৌঃ-মনস্যম্ চ জায়তে। করোমি কিং যৎ ন মনঃ তেষু অপ্রীতিষু
নিষ্ঠুরম্।। ২৭]
প্রীতিহীন তাদের জন্যে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছি,
আমার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, কিন্তু কী করব, তাও তাদের প্রতি আমার মন নিষ্ঠুর হচ্ছে
না।
মার্কণ্ডেয় উবাচ।
ততস্তৌ সহিতৌ বিপ্র তং মুনিং
সমুপস্থিতৌ।
সমাধির্নাম বৈশ্যঽসৌ স চ
পার্থিবসত্তমঃ।। ২৮
[ততঃ তৌ সহিতৌ বিপ্র তম্ মুনিম্
সমুপস্থিতৌ। সমাধিঃ-নাম বৈশ্যঃ অসৌ স চ পার্থিব-সত্তমঃ।। ২৮]
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বললেন। হে বিপ্র, তখন সেই
বৈশ্য সমাধি এবং সেই রাজা - দুজনে একসঙ্গে মুনির
(মেধস) সামনে উপস্থিত হলেন।
কৃত্বা তু তৌ যথান্যায়ং যথার্হং তেন সংবিদম্।
উপবিষ্টৌ কথাঃ
কাশ্চিচ্চক্রতুর্বৈশ্যপার্থিবৌ।। ২৯
[কৃত্বা
তু তৌ যথা-ন্যায়ং যথা-অর্হম্ তেন সংবিদম্। উপবিষ্টৌ কথাঃ কাঃ চিৎ চক্রতুঃ
বৈশ্য-পার্থিবৌ।। ২৯]
সেই বৈশ্য এবং রাজা দুজনে যথাবিধি ও যথাযোগ্য
সম্মান জানিয়ে তাঁর (মুনির) সামনে বসে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করলেন।
রাজোবাচ।
ভগবংস্ত্বামহং
প্রষ্টুমিচ্ছাম্যেকং বদস্ব তৎ।
দুঃখায় যন্মে মনসঃ
স্বচিত্তায়ত্ততাং বিনা।। ৩০
[রাজা উবাচ। ভগবন্ ত্বাম্ অহম্ প্রষ্টুম্ ইচ্ছামি একম্ বদস্ব তৎ।
দুঃখায় যৎ মে মনসঃ স্ব-চিত্ত-আয়ত্ততাম্ বিনা।। ৩০]
রাজা বললেন। হে ভগবন্, আপনাকে আমি একটি
প্রশ্ন করতে চাই, (দয়া করে) উত্তর দিন। দুঃখের কারণে আমার মন নিজের আয়ত্ত্বে নেই।
জানতোঽপি যথাজ্ঞস্য
কিমেতন্মুনিসত্তম।। ৩১
[মমত্বম্ গত-রাজ্যস্য
রাজ্য-অঙ্গেষু অখিলেষু অপি। জানতঃ অপি যথা-অজ্ঞস্য কিম্ এতৎ মুনিসত্তম।। ৩১]
হে মুনিবর, রাজ্য এবং সকল রাজ্যাঙ্গ আর আমার
নয় জেনেও, অজ্ঞের মতো (তার প্রতি) মনে কেন মমত্ব রয়েছে?
[রাজ্যাঙ্গ – ভূস্বামী, অমাত্য, সুহৃৎ, রাজকোষ, রাষ্ট্র,
দুর্গ ও বল বা সেনা – এই সাতটিকে রাজ্যাঙ্গ বলে।
অয়ঞ্চ নিকৃতঃ পুত্রৈর্দারৈর্ভৃত্যৈস্তথোজ্ঝিতঃ।
স্বজনেন চ সন্ত্যক্তস্তেষু হার্দী
তথাপ্যতি।। ৩২
[অয়ম্ চ নিকৃতঃ
পুত্রৈঃ-দারৈঃ-ভৃত্যৈঃ তথা উজ্ঝিতঃ। স্বজনেন চ সন্ত্যক্তঃ তেষু হার্দী
তথা-অপি-অতি।। ৩২]
এই মহাশয়ও (বৈশ্য সমাধি) পুত্র-দারাদের থেকে
বঞ্চিত হয়েছেন, ভৃত্যেরা উদ্ব্যস্ত করেছে, স্বজনেরা পরিত্যাগ করেছে, তা সত্ত্বেও
ইনি তাঁদের প্রতি অতীব মমতাময়।
এবমেষ তথাহঞ্চ দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ।
দৃষ্টদোষেঽপি বিষয়ে
মমত্বাকৃষ্টমানসৌ।। ৩৩
[এবম্ এষ তথা অহম্ চ দ্বৌ এব
অপি অত্যন্ত-দুঃখিতৌ। দৃষ্ট-দোষে অপি বিষয়ে মমত্ব-আকৃষ্ট-মানসৌ।। ৩৩]
অতএব ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত, যারা
এই দুঃখের কারণ তা বুঝতে পেরেও, আমাদের মন তাদের প্রতিই মমতায় আকৃষ্ট।
তৎ কেনৈতন্মহাভাগ যন্মোহো জ্ঞানিনোরপি।
মমাস্য চ ভবতোষা বিবেকান্ধস্য
মূঢ়তা।। ৩৪
[তৎ কেন এতৎ মহাভাগ যৎ মোহঃ
জ্ঞানিনঃ অপি। মম-অস্য চ ভবতি এষা বিবেক-অন্ধস্য মূঢ়তা।। ৩৪]
হে মহামতি, আমি এবং ইনি দুজনেই জানি মোহ
দোষযুক্ত, কিন্তু তাও বিবেকহীন মূর্খের মতো কেন আমাদের মনে এই মোহ আসছে?
ঋষিরুবাচ।
জ্ঞানমস্তি সমস্তস্য
জন্তোর্বিষয়গোচরে।
বিষয়শ্চ মহাভাগ যাতি চৈবং পৃথক্
পৃথক্।। ৩৫
দিবান্ধাঃ প্রাণিনং
কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে।
কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ
প্রাণিনস্তুল্য দৃষ্টয়ঃ।। ৩৬
[ঋষিঃ উবাচ। জ্ঞানম্ অস্তি সমস্তস্য জন্তোঃ
বিষয়-গোচরে। বিষয়ঃ চ মহাভাগ যাতি চ এবং পৃথক্ পৃথক্।। ৩৫
দিবা-অন্ধাঃ প্রাণিনং কেচিৎ রাত্রৌ-অন্ধাঃ
তথা-অপরে। কেচিৎ দিবা তথা রাত্রৌ প্রাণিনঃ তুল্য দৃষ্টয়ঃ।। ৩৬]
ঋষি মেধস বললেন। সমস্ত প্রাণীদেরই
(ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) বিষয়ের জ্ঞান আছে, হে মহাভাগ, কিন্তু সেই জ্ঞান প্রত্যেকের
আলাদা আলাদা। কেউ কেউ দিনের বেলায় অন্ধ, আবার অন্য কেউ অন্ধ রাত্রে, অনেকে আবার
দিন ও রাত্রে সমান দেখতে পায়, অনেকে কোন সময়েই দেখতে পায় না।
জ্ঞানিনো মনুজাঃ সত্যং কিন্তু তে ন হি কেবলম্।
যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে
পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ।। ৩৭
জ্ঞানঞ্চ তন্মনুষ্যাণাং যত্তেষাং
মৃগপক্ষিণাম্।
মনুষ্যাণাঞ্চ যত্তেষাং তুল্যমন্যৎ
তথোভয়োঃ।। ৩৮
[জ্ঞানিনঃ মনুজাঃ সত্যং কিন্তু তে ন হি কেবলম্।
যতঃ হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশু-পক্ষি-মৃগ-আদয়ঃ।। ৩৭
জ্ঞানম্ চ তৎ মনুষ্যাণাম্ যৎ এষাম্ মৃগপক্ষিণাম্। মনুষ্যাণাম্ চ যৎ
এষাম্ তুল্যম্ অন্যৎ তথা উভয়োঃ।।
৩৮]
শুধু মাত্র যে মনুজ অর্থাৎ মানুষরাই
(ইন্দ্রিয়বিষয়ে) জ্ঞানী তা নয়, পশু-পক্ষি-মৃগাদি সকল প্রাণীও জ্ঞানী। মানুষের যতটা
বিষয়জ্ঞান, মৃগপক্ষিদের বিষয়জ্ঞান ঠিক ততটাই। আহার-নিদ্রা-মৈথুন বিষয়ে মানুষ ও
প্রাণীদের জ্ঞান সমতুল্য।
জ্ঞানেঽপি সতি পশ্যৈতান্ পতগাঞ্ছাবচঞ্চুষু।
কণমোক্ষাদৃতান্ মোহাৎ
পীড্যমানানপি ক্ষুধা।। ৩৯
[জ্ঞানে অপি সতি পশ্য এতান্ পতগান্ শাবচঞ্চুষু। কণ-মোক্ষ-আদৃতান্ মোহাৎ
পীড্যমানান্ অপি ক্ষুধা।। ৩৯]
দেখুন, (ইন্দ্রিয় বিষয়ের) জ্ঞান থাকা
সত্ত্বেও, ক্ষুধায় পীড়িত পাখিরা (নিজে অভুক্ত থেকে) মোহবশে শাবকের ঠোঁটে শস্যকণা
তুলে দিয়ে আনন্দ পায়।
মানুষা মনুজব্যাঘ্র সাভিলাষাঃ সুতান্ প্রতি।
লোভাৎ প্রত্যুপকারায় নন্বেতে কিং
ন পশ্যতি।। ৪০
[মানুষা মনুজব্যাঘ্র স-অভিলাষাঃ সুতান্
প্রতি। লোভাৎ প্রত্যুপকারায় ননু এতে কিম্ ন পশ্যতি।। ৪০]
হে নরশ্রেষ্ঠ, মানুষ (পিতা) যে প্রত্যুপকারের
লোভে সন্তানের প্রতি অনুরক্ত হয়, সেটা কী দেখছেন না?
মহামায়াপ্রভাবেণ
সংসারস্থিতিকারিণা।। ৪১
তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো
যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ।
মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সংমোহ্যতে
জগৎ।। ৪২
[তথাপি মমতা-আবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।
মহামায়াপ্রভাবেণ সংসার-স্থিতি-কারিণা।। ৪১
তৎ-ন-অত্র বিস্ময়ঃ কার্যঃ যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ।
মহামায়া হরেঃ চ এতৎ তয়া সংমোহ্যতে জগৎ।। ৪২]
তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে, সবাই
মোহ রূপ গর্তে মমতার আবর্তে নিমগ্ন থাকে।
জগৎপতি শ্রীহরিও মহামায়ার প্রভাবে যোগনিদ্রায় অভিভূত ছিলেন। অতএব তাঁর
সম্মোহনেই যে এই জগৎ চলছে, এর মধ্যে আর আশ্চর্য হওয়ার কারণ কি?
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া
প্রযচ্ছতি।। ৪৩
তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং
জগদেতচ্চরাচরম্।
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি
মুক্তয়ে।। ৪৪
[জ্ঞানিনাম্ অপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাৎ আকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।। ৪৩
তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগৎ এতৎ চরাচরম্। সা
এষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।। ৪৪]
এই দেবী ভগবতী (মহা-ঐশ্বর্যশালিনী) মহামায়া,
জ্ঞানীদের চেতনাও সবলে আকর্ষণ করে মোহগর্তে নিক্ষেপ করেন। তিনিই এই
বিশ্ব-জগৎ-চরাচর সৃষ্টি করেছেন, তিনি প্রসন্না হলেই মানুষকে মুক্তির বরদান করে
থাকেন।
সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।। ৪৫
[সা বিদ্যা পরমা মুক্তেঃ হেতু-ভূতা সনাতনী।
সংসার-বন্ধ-হেতুঃ চ সা এব সর্ব-ঈশ্বর-ঈশ্বরী।। ৪৫]
তিনিই সনাতনী (অনাদি, অনন্তা, নিত্যস্থিতা) এবং তিনিই মুক্তির কারণ
স্বরূপা পরমাবিদ্যা (ব্রহ্মজ্ঞান)। তিনিই (অবিদ্যা-রূপা) সংসার বন্ধনের
কারণস্বরূপা, তিনি সকল ঈশ্বরেরও (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহশ্বর) ঈশ্বরী।
রাজোবাচ।
ভগবন্ কা হি সা দেবী মহামায়েতি যাং ভবান্।
ব্রবীতি কথমুৎপন্না সা কর্মাস্যাশ্চ কিং দ্বিজ।। ৪৬
যৎস্বভাবা চ সা দেবী যৎস্বরূপা যদুদ্ভবা।
তৎ সর্বং শ্রোতুমিচ্ছামি ত্বত্তো ব্রহ্মবিদাং বর।। ৪৭
[রাজা উবাচ। ভগবন্ কা হি সা দেবী মহামায়া ইতি যাম্ ভবান্। ব্রবীতি
কথম্ উৎপন্না সা কর্ম অস্যাঃ চ কিম্ দ্বিজ।। ৪৬
যৎ-স্বভাবা চ সা দেবী যৎ-স্বরূপা যৎ-উদ্ভবা। তৎ সর্বম্ শ্রোতুম্
ইচ্ছামি ত্বত্তঃ ব্রহ্মবিদাং বর।। ৪৭]
রাজা বললেন। হে ভগবন্, আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? হে
মুনিবর, তিনি কিভাবে আবির্ভূতা হন, তাঁর কারণই বা কী? হে ব্রহ্মবিদ-শ্রেষ্ঠ, সেই দেবীর যেমন স্বভাব,
যেমন স্বরূপ এবং যে কারণে তাঁর আবির্ভাব – সবই আপনার থেকে জানতে ইচ্ছে করি।
ঋষিরুবাচ।
নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্।
তথাপি তৎ সমুৎপত্তির্বহুধা শ্রূয়তাং মম।। ৪৮
[ঋষিঃ উবাচ। নিত্যা এব সা জগৎ-মূর্তিঃ তয়া সর্বম্ ইদম্ ততম্। তথাপি
তৎ সমুৎপত্তিঃ বহুধা শ্রূয়তাং মম।। ৪৮]
মেধস ঋষি বললেন, তিনিই নিত্য – সনাতনী, এই প্রপঞ্চময় জগৎ তারই মূর্তি,
তিনিই সর্বত্রই ব্যাপ্ত। কিন্তু তিনিই যে বহুরূপে আবির্ভূতা হয়ে থাকেন, সে কথাটি
আমার কাছে শুনুন।
দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভবতি সা যদা।
উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যভিধীয়তে।। ৪৯
যোগনিদ্রাং যদা বিষ্ণুর্জগত্যেকার্ণবীকৃতে।
আস্তীর্য শেষমভজৎ কল্পান্তে ভগবান্ প্রভুঃ।। ৫০
তদা দ্বাবসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধুকৈটভৌ।
বিষ্ণুকর্ণমলোদ্ভূতৌ হন্তুং ব্রহ্মাণমুদ্যতৌ।। ৫১
[দেবানাং
কার্য-সিদ্ধি-অর্থম্ আবির্ভবতি সা যদা। উৎপন্না ইতি তদা লোকে সা নিত্যা অপি
অভিধীয়তে।। ৪৯
যোগনিদ্রাম্ যদা বিষ্ণুঃ জগতি এক-অর্ণবীকৃতে। আস্তীর্য শেষম্ অভজৎ
কল্প-অন্তে ভগবান্ প্রভুঃ।। ৫০
তদা দ্বৌ অসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধু-কৈটভৌ। বিষ্ণু-কর্ণমল-উদ্ভূতৌ হন্তুং
ব্রহ্মাণম্ উদ্যতৌ।। ৫১]
যখন তিনি দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্যে আবির্ভূতা হন, তিনি স্বরূপতঃ
নিত্য হলেও, তিনি এই ধরণীতে জন্ম নিয়েছেন, লোকে এমন কথাই বলেন। প্রলয়কালে
(ব্রহ্মার দিবা অবসানে) পৃথিবী যখন বিশাল এক সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল, তখন শেষ বা
অনন্তনাগকে শয্যার মত বিছিয়ে প্রভু বিষ্ণু যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। সেই সময় মধু ও
কৈটভ নামে বিখ্যাত দুই ভয়ংকর অসুর বিষ্ণুর কর্ণমল (কানের ময়লা) থেকে উৎপন্ন হয়ে
ব্রহ্মাকেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল।
[ব্রহ্মার
দিবা অবসানে - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি – মানুষের এই চার যুগে দেবতাদের এক
দিব্য-যুগ হয়। মোটামুটি ৭১ দিব্য-যুগে এক মন্বন্তর হয়। এরকম চোদ্দ মন্বন্তরে
ব্রহ্মার এক দিবস।
বিষ্ণু
জগতের পালনকর্তা। পৃথিবীর লয়ের সময় যখন তাঁর কার্য স্থগিত হয়ে যায়, তিনি নিষ্ক্রিয়
হয়ে যোগনিদ্রায় মগ্ন হন। দেবী মহামায়ার সত্ত্বগুণ বিষ্ণুরূপে প্রকাশিত। অতএব দেবীর
সাত্ত্বিকী পালিকা শক্তিও তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।]
স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতো ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ।
দৃষ্ট্বা তাবসুরৌ চোগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্।। ৫২
তুষ্টাব যোগনিদ্রাং তামেকাগ্রহৃদয়স্থিতঃ।
বিবোধনার্থায় হরের্হরিনেত্রকৃতালয়াম্।। ৫৩
ওঁ ঐঁ বিশ্বেশ্বরীং জগদ্ধাত্রীং স্থিতিসংহারকারিণীম্।
নিদ্রাং ভগবতীং বিষ্ণোরতুল্যং তেজসঃ প্রভুঃ।। ৫৪
[স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতঃ ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ। দৃষ্ট্বা তৌ অসুরৌ চ
উগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্।। ৫২
তুষ্টাব যোগনিদ্রাম্ তাম্ একাগ্র-হৃদয়-স্থিতঃ। বিবোধন-অর্থায় হরেঃ
হরি-নেত্র-কৃত-আলয়াম্।। ৫৩
ওঁ ঐঁ
বিশ্বেশ্বরীম্ জগদ্ধাত্রীম্ স্থিতি-সংহার-কারিণীম্। নিদ্রাম্ ভগবতীম্ বিষ্ণোঃ
অতুল্যম্ তেজসঃ প্রভুঃ।। ৫৪]
সেই (অনন্ত শয়ানে যোগনিদ্রারত)
বিষ্ণুর নাভি থেকে প্রস্ফুটিত কমলের উপর অবস্থান করছিলেন প্রভু প্রজাপতি-ব্রহ্মা।
তিনি উগ্র দুই অসুরকে দেখলেন, দেখলেন যোগনিদ্রামগ্ন জনার্দনকে। শ্রীহরির জাগরণের
জন্যে তিনি একাগ্র চিত্তে, হরির নেত্রে অবস্থানকারী অতুলনীয় তেজশক্তি স্বরূপা
বিশ্বেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী – স্থিতি-সংহারকারিণী ভগবতী যোগনিদ্রার স্তব করতে শুরু
করলেন।
ব্রহ্মোবাচ।
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।। ৫৫
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।। ৫৬
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।। ৫৭
[ব্রহ্মা উবাচ। ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ
স্বর-আত্মিকা। সুধা ত্বম্ অক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রা-আত্মিকা স্থিতা।। ৫৫
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যা ন-উচ্চার্যা বিশেষতঃ। ত্বম্ এব সা ত্বং
সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।। ৫৬
ত্বয়া এব
ধার্যতে সর্বং ত্বয়া এতৎ সৃজ্যতে জগৎ। ত্বয়া এতৎ পাল্যতে দেবি ত্বম্ অৎসি অন্তে চ
সর্বদা।। ৫৭]
ব্রহ্মা বললেন, আপনিই স্বাহা, আপনিই স্বধা, আপনিই বষট্মন্ত্র এবং
স্বর-স্বরূপা। আপনিই অমৃত, আপনি নিত্য ত্রিমাত্রারূপে অধিষ্ঠিতা অক্ষর। আপনিই
নির্গুণে অধিষ্ঠিতা, আপনিই নিত্যা, আপনাকে বিশেষতঃ বর্ণনা করা যায় না। আপনিই সেই
গায়ত্রীর দেবী সাবিত্রী, আপনিই দেবজননী, আপনিই সর্বোত্তমা। আপনিই এই জগতকে সৃষ্টি
করেছেন এবং ধারণ করেছেন। আপনিই একে পালন করেন, আবার হে দেবি, প্রলয়কালে আপনিই এই
জগতকে গ্রাস করে থাকেন।
[দেবতাদের যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার প্রধান মন্ত্র – “স্বাহা”। পিতৃযজ্ঞের
আহুতি মন্ত্র “স্বধা”। বষট্ মন্ত্রে দেবতাদের আবাহন করা হয়। ত্রিমাত্রা – অ-কার,
উ-কার ম-কার এই তিন মাত্রার অক্ষর বা বর্ণ আদি বীজ মন্ত্র, অউম বা ঔঁ এই মন্ত্রকে
প্রণব বলা হয়।]
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে।। ৫৮
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।
মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।। ৫৯
[বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে। তথা সংহৃতিরূপ অন্তে
জগতঃ অস্য জগৎ-ময়ে।। ৫৮
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ। মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী
মহাসুরী।। ৫৯]
আপনিই সৃষ্টিরূপে সৃজন করেন, স্থিতিরূপে আপনিই পালন করেন, আবার আপনিই
বিনাশিনীরূপে প্রলয় উপস্থিত করেন। আপনিই এই জগৎময় ব্যাপ্ত। আপনিই
(ব্রহ্মস্বরূপা) মহাবিদ্যা, আবার আপনিই (অবিদ্যাস্বরূপা) মহামায়া, আপনিই
মহৎ-চেতনা, আপনিই মহা-স্মৃতি, আপনিই (অজ্ঞানরূপা) মহামোহ, আপনিই দেবশক্তি-স্বরূপা
মহাদেবী এবং অসুরশক্তি-স্বরূপা মহাসুরী।
কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা।। ৬০
[প্রকৃতিঃ ত্বং হি সর্বস্য গুণত্রয় বিভাবিনী। কালরাত্রিঃ –মহারাত্রিঃ –
মোহরাত্রিঃ চ দারুণা।। ৬০]
আপনিই সর্বভূতের প্রকৃতিরূপা – তাদের তিনগুণের (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)
বিধায়িনী। আপনিই কালরাত্রি, মহারাত্রি এবং নিদারুণ মোহরাত্রি।
[যে সময় ব্রহ্মার দিবাবসান হয়, সেই কালে সত্ত্বগুণ লয় হয়, সেই রাত্রিকে
কালরাত্রি বলা হয়। যে সময় জগতের লয় হয়, অর্থাৎ রজোগুণের বিলোপ ঘটে, সেই
রাত্রিকে মহারাত্রি বলে। মোহরাত্রি মানুষ এবং জীবের নিত্য সঙ্গী। জীবের জন্ম
মাত্রই মোহরাত্রির শুরু, মৃত্যুতে তার লয়। অর্থাৎ তমোগুণের প্রভাবে মোহরাত্রি আসে।
এই মোহরাত্রি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় দুস্তর ব্রহ্মজ্ঞানলাভ।]
লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্ত্বং শান্তি ক্ষান্তিরেব চ।। ৬১
খড়্গিনী, শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণভুসণ্ডীপরিঘায়ুধা।। ৬২
[ত্বম্
শ্রীঃ ত্বম্ ঈশ্বরী ত্বম্ হ্রীঃ ত্বম্ বুদ্ধিঃ-বোধ-লক্ষণা। লজ্জা পুষ্টিঃ তথা
তুষ্টিঃ ত্বম্ শান্তি ক্ষান্তিঃ এব চ।। ৬১
খড়্গিনী, শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা। শঙ্খিনী চাপিনী
বাণ-ভুসণ্ডী-পরিঘ-আয়ুধা।। ৬২]
আপনিই লক্ষ্মীরূপা শ্রী, আপনিই ঐশ্বর্যরূপা ঈশ্বরী, আপনিই হ্রী, আপনিই
বুদ্ধি ও চেতনার লক্ষণ। আপনিই লজ্জা, পুষ্টি ও তুষ্টি, আপনিই শান্তি এবং
ক্ষান্তিও। আপনিই খড়্গ, ত্রিশূলধারিণী, একহাতে নরমুণ্ডধারিণী ভয়ংকরী, আপনিই গদা,
চক্র, শঙ্খ, ধনুক, তির, ভুসণ্ডী ও মুষলধারিণী। অর্থাৎ দশ হাতে দশ অস্ত্রধারিণী।
সৌম্যাসৌম্যতরাশেষসৌম্যেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী।
পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।। ৬৩
যচ্চ কিঞ্চিৎ ক্বচিদ্বস্তু সদসদ্ বাখিলাত্মিকে।
তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বং কিং স্তূয়সে ময়া।। ৬৪
[সৌম্য অসৌম্যতর অশেষ-সৌম্যেভ্যঃ
তু অতিসুন্দরী। পরা পরাণাম্ পরমা ত্বম্ এব পরমা-ঈশ্বরী।। ৬৩ যৎ চ কিম্-চিৎ
ক্বচিৎ বস্তু সৎ-অসৎ বা অখিল-আত্মিকে। তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বম্ কিম্
স্তূয়সে ময়া।। ৬৪]
আপনি (দেবতাদের প্রতি) প্রশান্ত, আপনি (অসুরদের প্রতি) রুদ্রা, অশেষ
সুন্দরের তুলনায় আপনি অতীব সুন্দরী। সকল শ্রেষ্ঠদের মধ্যে আপনিই
শ্রেষ্ঠা, আপনিই পরমা, আপনিই পরমেশ্বরী। হে বিশ্ব-স্বরূপিণী, জগতের যেখানে যত কিছু
চেতন বা জড় বস্তুর (অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে) শক্তি, সে সবই
আপনি। অতএব আমার পক্ষে আপনার স্তব কিভাবে করা সম্ভব?
সোঽপি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।। ৬৫
বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণমহমীশান এব চ।
কারিতাস্তে যতোঽতস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান্ ভবেৎ।। ৬৬
[যয়া ত্বয়া জগৎ-স্রষ্টা জগৎ-পাতা অত্তি যঃ জগৎ। সঃ অপি নিদ্রা-বশম্
নীতঃ কঃ ত্বাম্ স্তোতুম ইহ ঈশ্বরঃ।। ৬৫
বিষ্ণুঃ শরীর-গ্রহণম্ অহম্ ঈশান এব চ। কারিতাঃ তে যতঃ অতঃ ত্বাম্ কঃ
স্তোতুম্ শক্তিমান্ ভবেৎ।। ৬৬]
যিনি ব্রহ্মারূপে জগতের স্রষ্টা, বিষ্ণুরূপে যিনি জগতের পালয়িতা,
শিবরূপে যিনি জগতকে গ্রাস করেন, তাঁদের সকলকেই আপনি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছেন,
সুতরাং আপনার স্তব করতে কে আর সমর্থ হবেন? আপনিই আমাকে, বিষ্ণুকে এবং রুদ্রকে শরীর
ধারণ করিয়েছেন, অতএব আপনার স্তব কে করতে পারে?
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দৈবি সংস্তুতা।
মোহয়ৈতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।। ৬৭
প্রবোধঞ্চ জগৎস্বামী নীয়তামচ্যুতো লঘু।
বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুমেতৌ মহাসুরৌ।। ৬৮
[সা ত্বম্ ইত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈঃ উদারৈঃ দৈবি সংস্তুতা। মোহয় এতৌ
দুরাধর্ষৌ অসুরৌ মধুকৈটভৌ।। ৬৭
প্রবোধম্ চ জগৎস্বামী নীয়তাম্ অচ্যুতঃ লঘু। বোধঃ চ ক্রিয়তাম্ অস্য
হন্তুম্ এতৌ মহাসুরৌ।। ৬৮]
হে দেবি, নিজের এবংবিধ অলৌকিক প্রভাবে সজ্জিত হয়ে, আপনি এই দুই
দুর্ধর্ষ অসুর মধু ও কৈটভকে মোহিত করুন। আপনি জগৎ-স্বামী অচ্যুতকে যোগনিদ্রা থেকে
শীঘ্র জাগরিত করুন এবং এই দুই মহাসুরকে বধ করার জন্যে তাঁকে উদ্দীপ্ত করুন।
ঋষিরুবাচ।
এবং স্তুতা তদা দেবী তামসী তত্র বেধসা।
বিষ্ণোঃ প্রবোধনার্থায় নিহন্তুং মধুকৈটভৌ।। ৬৯
নেত্রাস্যনাসিকবাহুহৃদয়েভ্যস্তথোরসঃ।
নির্গম্য দর্শনে তস্থৌ ব্রহ্মণোঽব্যক্তজন্মনঃ।।৭০
[ঋষিঃ উবাচ। এবম্ স্তুতা তদা দেবী তামসী তত্র বেধসা। বিষ্ণোঃ প্রবোধনার্থায়
নিহন্তুম্ মধুকৈটভৌ।। ৬৯
নেত্র অস্য নাসিক-বাহু-হৃদয়েভ্যঃ তথা উরসঃ। নির্গম্য দর্শনে তস্থৌ
ব্রহ্মণঃ অব্যক্ত-জন্মনঃ।। ৭০]
(মেধস) ঋষি বললেন। ব্রহ্মার এই স্তুতিতে দেবী তামসী মধু-কৈটভকে বধ করার
জন্যে এবং বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগরিত করার জন্যে, তাঁর চোখ, মুখ, নাক, বাহু,
হৃদয় এবং বক্ষ থেকে প্রকাশিতা হয়ে স্বয়ম্ভূ-ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন।
[তিনগুণে শ্রীশ্রী চণ্ডীর তিনটি রূপ, তিনি সত্ত্বরূপে মহাসরস্বতী,
রজোরূপে মহালক্ষ্মী এবং তমোরূপে মহাকালী। এখানে তিনি তামসী অর্থাৎ মহাকালীরূপে
প্রকট হলেন।]
একার্ণবেঽহিশয়নাত্ততঃ স দদৃশে চ তৌ।। ৭১
মধুকৈটভৌ দুরাত্মানাবতিবীর্যপরাক্রমৌ।
ক্রোধরক্তেক্ষণাবত্তুং ব্রহ্মাণং জনিতোদ্যমৌ।। ৭২
[উত্তস্থৌ চ জগন্নাথঃ তয়া
মুক্তঃ জনার্দনঃ। একার্ণবে অহি-শয়নাৎ ততঃ স দদৃশে চ তৌ।। ৭১
মধুকৈটভৌ দুরাত্মানৌ অতিবীর্য-পরাক্রমৌ। ক্রোধ-রক্ত ঈক্ষণৌ অত্তুম্
ব্রহ্মাণম্ জনিত উদ্যমৌ।। ৭২]
(যোগনিদ্রা থেকে) মুক্ত হয়ে জনার্দন জগন্নাথ একার্ণবের অনন্তশয়ান থেকে
উঠে দেখলেন, মধু-কৈটভ নামের অতিপরাক্রমী দুরাত্মা দুই অসুর, ক্রোধে রক্ত চক্ষু হয়ে
ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।
সমুত্থায় ততস্তাভ্যাং যুযুধে ভগবান্ হরিঃ।
পঞ্চবর্ষসহস্রাণি বাহুপ্রহরণো বিভুঃ।। ৭৩
[সমুত্থায় ততঃ তাভ্যাং যুযুধে ভগবান্ হরিঃ। পঞ্চ-বর্ষ-সহস্রাণি
বাহু-প্রহরণঃ বিভুঃ।। ৭৩]
তৎক্ষণাৎ ভগবান শ্রীহরি উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন এবং তাদের সঙ্গে পাঁচহাজার
বছর ধরে বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন।
তাবপ্যতিবলোন্মত্তৌ মহামায়াবিমোহিতৌ।
উক্তবন্তৌ বরোঽস্মত্তো ব্রিয়তামিতি কেশবম্।। ৭৪
শ্রীভগবানুবাচ।
ভবেতামদ্য মে তুষ্টৌ মম বধ্যাবুভাবপি।
কিমন্যেন বরেণাত্র এতাবদ্ধি বৃতং মম।। ৭৫
[তৌ অপি অতিবল-উন্মত্তৌ মহামায়া-বিমোহিতৌ। উক্তবন্তৌ বরঃ অস্মত্তঃ
ব্রিয়তাম্ ইতি কেশবম্।। ৭৪
শ্রীভগবান্ উবাচ। ভবেতাম্ অদ্য মে তুষ্টৌ মম বধ্যৌ উভৌ অপি। কিম্
অন্যেন বরেণ অত্র এতাবৎ হি বৃতম্ মম।। ৭৫]
অতঃপর অতি-পরাক্রমী উদ্ধত দুই অসুর, মহামায়ার প্রভাবে বিমোহিত হয়ে
ভগবান কেশবকে বলল, “আমাদের থেকে বর প্রার্থনা করো”।
শ্রীভগবান বললেন, “তোমরা দুজনেই যদি আজ আমার প্রতি তুষ্ট হয়ে থাকো,
তাহলে তোমরা দুজনেই আমার হাতে বধ্য হও, এখন এই আমার একান্ত অভিপ্রায়, এছাড়া অন্য
বরের আর প্রয়োজন কি?”
ঋষিরুবাচ।
বঞ্চিতাভ্যামিতি তদা সর্বমাপোময়ং জগৎ।
বিলোক্য তাভ্যাং গদিতো ভগবান্ কমলেক্ষণঃ।। ৭৬
প্রীতৌ স্বস্তব যুদ্ধেন শ্লাঘ্যস্ত্বন্মৃত্যুরাবয়োঃ।
আবাং জহি ন যত্রোর্বী সলিলেন পরিপ্লুতা।। ৭৭
[ঋষিঃ উবাচ। বঞ্চিতাভ্যাম্ ইতি তদা সর্বম্ আপোময়ম্ জগৎ। বিলোক্য
তাভ্যাম্ গদিতঃ ভগবান্ কমল-ঈক্ষণঃ।। ৭৬
প্রীতৌ স্বঃ তব যুদ্ধেন শ্লাঘ্যঃ ত্বৎ মৃত্যুঃ আবয়োঃ। আবাম্ জহি ন
যত্র ঊর্বী সলিলেন পরিপ্লুতা।। ৭৭]
ঋষি বললেন, সমগ্র বিশ্ব জলময় দেখে, মহামায়ার প্রভাবে বিমোহিত দুই অসুর,
কমললোচন শ্রীবিষ্ণুকে বলল, “তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা খুব প্রীত হয়েছি। তোমার
হাতে মৃত্যু আমাদের গৌরবের বিষয়। পৃথিবীর যে স্থানে জল নেই, আমাদের সেখানেই হত্যা
করো”।
ঋষিরুবাচ।
তথেত্যুক্ত্বা ভগবতা শঙ্খচক্রগদাভূতা।
কৃত্বা চক্রেণ বৈ ছিন্নে জঘনে শিরসী তয়োঃ।। ৭৮
[ঋষিঃ উবাচ। তথা ইতি উক্ত্বা ভগবতা শঙ্খ-চক্র-গদা-ভূতা। কৃত্বা চক্রেণ
বৈ ছিন্নে জঘনে শিরসী তয়োঃ।। ৭৮]
ঋষি বললেন। শঙ্খ-চক্র-গদাধারী ভগবান “তাই হোক” - এই বলে তিনি নিজের
উরুতে তাদের দুজনকে রেখে, চক্র দিয়ে তাদের মাথা কেটে ফেললেন।
এবমেষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম্।
প্রভাবমস্যা দেব্যাস্তু ভূয়ঃ শৃণু বদামি তে।। ৭৯
[এবম্ এষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম্। প্রভাবম্ অস্যা
দেব্যা অস্তু ভূয়ঃ শৃণু বদামি তে।। ৭৯]
এইভাবে ব্রহ্মার একনিষ্ঠ স্তবে সন্তুষ্টা দেবী সেখানে সাক্ষাৎ
আবির্ভূতা হয়েছিলেন। এই দেবীর আরও প্রভাবের কথা আপনাকে আবার বলছি, আপনি শুনতে
থাকুন।
শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে
মধুকৈটভবধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হল।
...চলবে...
পরের পর্বে আসবে শ্রীশ্রী চণ্ডীর দ্বিতীয় চরিত
গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন