[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলামে
"ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।
এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লে, স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে
ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]
দ্বিতীয় পর্ব - ষষ্ঠ ও শেষ পর্বাংশ
(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)
[এর আগের পর্বাংশ পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 - ধর্মাধর্ম - ২/৫ ]
২.৬.২ গণসঙ্ঘী জনপদ ও মহাজনপদ
গণসঙ্ঘী মহাজনপদগুলির ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য সমাজের
বিপরীত। এই শাসনব্যবস্থা প্রাচীন পদ্ধতিরই নবীন রূপ। আদিম সমাজে আমরা যেমন দেখেছি, পরিবার
ভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রধান হত পরিবারের বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ কোন পুরুষ। গণসঙ্ঘ শাসন
ব্যবস্থাও মূলত একই রকম। এখানে তফাৎটা হল, অনেকগুলি গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে যে
মহাজনপদ গড়ে উঠেছিল,
তার প্রশাসনে থাকত,
সবকটি গোষ্ঠীর এক বা একাধিক প্রধানেরা। এই কারণেই, বৃজি
মহাজনপদে ৭৭০৭ জন এবং মল্ল মহাজনপদে ৫০০ জন রাজা(? আসলে প্রধান)-র উল্লেখ পাওয়া যায়, পরবর্তী
কালের জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে। এরকম গণসঙ্ঘী প্রশাসনের কথাই আমরা আলোচনা করেছি
২.৩.৭ অধ্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে। এই মহাজনপদগুলির প্রশাসনিক স্তরে বেশ কিছু
অনার্য গোষ্ঠীও যে সামিল ছিল, সে কথা অনুমান করতে, আমার কোন দ্বিধা নেই। বহু গোষ্ঠী
মিলে পরমত-সহিষ্ণু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা আর্যদের মস্তিষ্কে হঠাৎ
করেই উদয় হয়েছিল, এমন
ভাবার কোন কারণ নেই। যেখানে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, আর্যরা আসার অন্ততঃ দুহাজার বছর আগে
থেকেই অনার্যরা এই প্রশাসন পদ্ধতি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছে।
যাই হোক, সকল গোষ্ঠীর সব প্রধানদের নিয়ে গড়ে
তোলা হত বিধানসভা। এই বিধানসভাতেই রাজ্যের শাসন পদ্ধতি এবং রাজ্য পরিচালনার
বিধি-বিধান স্থির হত। সভাতে সকল প্রতিনিধি সহমত হয়ে গেলে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু
মতবিরোধ দেখা দিলে, ভোট
নেওয়া হত। যে মতে অধিকাংশের সমর্থন, বলা বাহুল্য, সে মতই
বিধানসভার অনুমোদন পেত। তাই বলে, এটিকে গণতন্ত্র মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ এই বিধানসভাতে
দেশের সাধারণ জন সমাজের কোন প্রতিনিধি থাকত না, এবং তাদের সে অধিকার দেওয়াও হত না।
অনেক গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে গণসঙ্ঘ যেমন ছিল, তেমনই ছিল
একটিমাত্র গোষ্ঠীর গণসঙ্ঘও। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলির আয়তন খুবই ছোট, অতএব সেগুলি
মহাজনপদ নয়, সেগুলিকে
বলা হত জনপদ, যেমন
শাক্য, কোলিয়া, লিচ্ছবি, মোরিয়
ইত্যাদি।
আর্য-অনার্য সম্মিলিত এই ধরনের মহাজনপদগুলিতে
সামাজিক গঠন ছিল সরল এবং যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। শাসক গোষ্ঠীগুলিতে - সে আর্য বা
অনার্য যেই হোক, চতুর্বর্ণের
কোন বিন্যাস ছিল না। যদিও জনপদ-প্রধান নিজেকে ক্ষত্রিয় বলেই পরিচয় দিত। এই গণসঙ্ঘী
সমাজেও ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের সম্মান ছিল, কিন্তু আধিপত্য ছিল সীমিত।
ব্রাহ্মণদের আধিপত্য না থাকায় এই সমাজ বিপুল আড়ম্বরে যজ্ঞের আয়োজন করত না। অতএব
ব্রাহ্মণ্য সমাজের কটাক্ষে এই গণসঙ্ঘী সমাজ “বেদ-বিমুখ” হিসেবে পরিচিতি লাভ
করেছিল। এবং এই কারণেই ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ও মহাকাব্যগুলিতে এই সমাজগুলি ছিল
অপাংক্তেয় এবং সে ভাবে কোন গুরুত্বই পায়নি।
যদিও আমরা পরবর্তী পর্বে দেখব, গণসঙ্ঘী সমাজের শিক্ষিত ও অভিজাত
পরিবারগুলিতে বেদচর্চা আবশ্যিক ছিল।
এই সমাজের আর্য এবং অনার্য মানুষরা নিজ নিজ
দক্ষতা অনুযায়ী, নানান
কাজে নিযুক্ত থাকত। গণসঙ্ঘী সমাজে এই কর্মী মানুষদের বলা হত কর্মকার, যারা
বাণিজ্য করত তাদের বলা হত বণিক বা শ্রেষ্ঠী। ব্রাহ্মণ্য সমাজের মতো সম্পন্ন কৃষক, বণিক বা
শিল্পীদের বৈশ্য বানিয়ে তাদের সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন তৃতীয় স্তরে নামিয়ে দেওয়া
হয়নি। প্রশাসনিক স্তরেও তাদের যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব দেওয়া হত। ভূমিহীন ও অদক্ষ
শ্রমজীবি মানুষদের বলা হত দাস – তাদের মধ্যে স্বাধীন শ্রমিক যেমন ছিল তেমনি
ক্রীতদাসও ছিল। ক্রীতদাসরা সাধারণতঃ গার্হস্থ্য কাজেই নিযুক্ত হত। আর কৃষি ও
পশুপালনের কাজে সাধারণ স্বাধীন শ্রমিকদের নিয়োগ করা হত।
অবস্থানের দিক থেকে গণসঙঘ মহাজনপদগুলি কিছুটা
দুর্বলই ছিল বলা চলে। গাঙ্গেয় সমভূমির অত্যন্ত উর্বর অঞ্চলের ব্রাহ্মণ্য
মহাজনপদগুলি থেকে তাদের অবস্থান ছিল কিছুটা দূরে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে অর্থাৎ
অপেক্ষাকৃত কম উর্বর অঞ্চলে। এর কারণ হতে পারে, তারা শক্তিশালী ও আগ্রাসী
আর্যগোষ্ঠীদের থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে নিরিবিলি শান্তিতেই থাকতে চেয়েছিল। অথবা
ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য বিষয়ে, প্রধান আর্যগোষ্ঠীদের সঙ্গে তাদের মতভেদ হওয়াতে, তারা ওই সব
অঞ্চলে সরে গিয়েছিল।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, ষোড়শ
মহাজনপদের মধ্যে দ্বারকার কোথাও কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু দ্বারকাও সম্ভবতঃ এমনই
আরেক গণসঙ্ঘী জনপদ ছিল। মথুরায় কংস নিধনের পর, কংসের শ্বশুর প্রবল পরাক্রমী চেদিরাজ
জরাসন্ধের সঙ্গে বারংবার সম্মুখ সমরের বিপদ এড়াতে, শ্রীকৃষ্ণ সুদূর দ্বারকায় সরে
গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল,
যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ ও অন্ধক
গোষ্ঠী। যদিও দ্বারকাধীশ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে
তাঁকে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হত বলে, দ্বারকা জনপদের প্রশাসনিক প্রধান
ছিলেন, তাঁর
পিতা বসুদেব এবং মাতামহ উগ্রসেন। এই গোষ্ঠীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল, শ্রীকৃষ্ণ-পিতা
বসুদেব হলেন বৃষ্ণি বা শূর বংশীয়। শ্রীকৃষ্ণ-মাতা দেবকী হলেন, যদু, ভোজ ও অন্ধকদের অধিপতি উগ্রসেনের
কন্যা। এই উগ্রসেনের পুত্র অর্থাৎ মাতা-দেবকীর ভাই কংস – একটি দৈববাণী শুনেছিলেন, বসুদেব ও
দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। অতএব, তিনি নিজের মৃত্যু রোধ করতে বোন
দেবকী ও ভগ্নীপতিকে কারারুদ্ধ করলেন। কিন্তু পিতা উগ্রসেন কংসের এই সিদ্ধান্ত
অনুমোদন না করাতে, তিনি
পিতাকেও বন্দী করে, নিজেই
সব কটি গোষ্ঠীর অধিপতি হয়ে বসেছিলেন। কংসের দুই পত্নী – অস্তি ও প্রাপ্তি ছিলেন
চেদি (মগধ) -র অধিপতি জরাসন্ধের কন্যা এবং কংসের মিত্ররা ছিল বাণ ও ভৌম নামে দুই
রাক্ষস(অনার্য)-রাজ। [শ্রীমদ্ভাগবত/ দশম স্কন্ধ/প্রথম অধ্যায়।]
যাই হোক, আর্য-অনার্য সহাবস্থান এবং
পরমতসহিষ্ণু উদারনীতির জন্যেই গণসঙ্ঘী মহাজনপদ ও জনপদগুলির মানুষরা অনেকটাই
মুক্তচিন্তার অবকাশ পেয়েছিল। আর সেই কারণেই সে যুগে যে দুজন যুগন্ধর মহাপুরুষের
আবির্ভাব হয়েছিল, তাঁরা
দুজনেই এমনই দুই গণসঙ্ঘী জনপদের বাসিন্দা ছিলেন। বৃজি গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন মহাবীর
এবং শাক্য গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। দুজনেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধী দুই
ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিতকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
তাঁদের, বিশেষ
করে গৌতমবুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে, প্রায় এক হাজার বছর রাজশক্তি থেকে
দূরে থাকতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে। পরবর্তীকালে তারা আবার যখন হারানো আধিপত্য
ফিরে পেল, দেখা
গেল, ততদিনে
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নিজেদের ধর্মভাবনাকে আমূল বদলে জনমুখী নতুন এক ধর্মে রূপান্তরিত
হয়ে উঠেছে, যার
নাম হিন্দু ধর্ম। কিন্তু সেই আলোচনা আসবে যথা সময়ে, এখন নয়। এখন সমকালীন, ব্রাহ্মণ্য
ধর্মের বিরুদ্ধ মতগুলির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
২.৬.৩ প্রতিবাদী কণ্ঠ, বিরোধী মতামত
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় - এই
বর্ণযুগলের দাপটে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অদ্ভূত সামাজিক সংস্কৃতি মেনে নিল আমাদের মতোই
ভীত ছাপোষা সাধারণ মানুষ। কিন্তু কখনোই মনে নেয়নি, সেকথা বলাই বাহুল্য। তাদের প্রতিবাদী
কণ্ঠস্বর শোনা গেছে বারবার। সেই কণ্ঠস্বর তেমন দুর্বলও যে নয়, তার প্রমাণ
পাওয়া যায় সমকালীন ও পরবর্তী সময়ের সংস্কৃত শাস্ত্রগুলিতে এবং মহাকাব্যে। বিভিন্ন
ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে তাদের সমালোচনা, নিন্দা, আক্ষরিক
অর্থে গালাগাল, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ
থেমে থাকেনি, বহুদিন
পর্যন্ত। এমনকি অসামান্য প্রতিভাবান পণ্ডিত শঙ্করাচার্যকেও (যাঁর সময়কাল ৭৮৮-৮২০
খ্রীষ্টাব্দ) এ বিষয়ে বেশ কড়া করে দুচার কথা শোনাতে হয়েছিল। অতএব সহজেই অনুমান করে
নেওয়া যায়, বিরুদ্ধ
এই কণ্ঠস্বরগুলি ব্রাহ্মণদের পক্ষে যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের বেদ-বিরোধী
প্রতিবাদী মানুষগুলিকে “নাস্তিক” অর্থাৎ নিরীশ্বর বলা হয়েছে। শুধু নাস্তিকই নয়, তাদের বিকৃত
আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি
ও নিষ্ঠুরকর্মা বলা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল তপস্বী, কিন্তু ক্রোধে এবং বিদ্বেষে রাক্ষস
বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবাদী মানুষগুলিকে ব্রাহ্মণেরা কতখানি ভয় পেত, তার কয়েকটি
উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে।
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ষোড়শ অধ্যায়
(দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ)-এর ৬, ৭,
৮ ও ৯ সংখ্যক শ্লোকে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন,
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেঽস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।।
১৬/৬
[সন্ধি-সমাসের
বিচ্ছেদে শ্লোকটি বুঝতে কিছুটা সুবিধে হয় –
দ্বৌ ভূত-সর্গৌ লোকে অস্মিন্ দৈবঃ আসুরঃ এব চ।
দৈবঃ বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরম্ পার্থ মে শৃণু।।]
সরলার্থ - হে পার্থ, এই জগতে দৈব
এবং আসুর, এই
দুই প্রকার স্বভাবেরই জীব ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দেবসুলভ মানুষের কথা তোমাকে আগেই
সবিস্তারে আমি বলেছি,
এখন, অসুরসুলভ
মানুষের কথা বলছি, শোন।
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭
[প্রবৃত্তিম্
চ নিবৃত্তিম্ চ জনা ন বিদুঃ আসুরাঃ। ন শৌচম্ ন অপি চ আচারঃ ন সত্যম্ তেষু
বিদ্যতে।।]
সরলার্থ - আসু্রী মানুষের না ধর্মে প্রবৃত্তি
থাকে, না
অধর্মের নিবৃত্তি জানে। তাদের শুচিতা থাকে না, সদাচার থাকে না, এমনকি সত্যও
থাকে না।
“অসত্যমপ্রতিষ্ঠং
তে জগদাহুরনীশ্বরম্।
অপরস্পরসম্ভূতংকিমন্যৎ কামহৈতুকম্।। ১৬/৮
[অসত্যম্
অপ্রতিষ্ঠম্ তে জগৎ আহুঃ অনীশ্বরম্। অপরঃ-পর-সম্ভূতম্ কিম্ অন্যৎ কামহৈতুকম্।।]
সরলার্থ - তারা বলে, জগৎ মিথ্যা, এখানে ধর্ম
বা অধর্মের কোন সংস্থান নেই এবং ঈশ্বরও নেই। এই জগৎ সৃষ্টিতে স্ত্রী ও পুরুষের
পারষ্পরিক কাম সংযোগ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?
“এতাংদৃষ্টিমবষ্টভ্যনষ্টাত্মানোঽল্পবুদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মণঃক্ষয়ায়জগতোঽহিতাঃ।। ১৬/৯
[এতাম্
দৃষ্টিম্ অবষ্টভ্য নষ্ট-আত্মানঃ-অল্পবুদ্ধয়ঃ। প্রভবন্তি-উগ্রকর্মণঃ ক্ষয়ায়
জগতঃ-অহিতাঃ।।]
সরলার্থ - বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি
ও নিষ্ঠুরকর্মা এই ব্যক্তিরা, এই দর্শন অনুসরণ ক’রে, জগতের অমঙ্গল ও বিনাশের জন্যেই
জন্মগ্রহণ করে। (শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ- লেখক)
এই বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা লোকগুলি
কারা, যাদের
কথা প্রিয়বন্ধু, পিসতুতো
ভাই ও ভক্ত অর্জুনকে বললেন,
স্বয়ং ভগবান?
আরেকটি উদাহরণ দিই রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের ১০৮
সর্গ থেকে, যেখানে
জাবালি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে বলছেন, “...পিতার অনুরোধে পৈতৃক রাজ্য পরিত্যাগ
করিয়া দুঃখজনক দুর্গম সঙ্কটপূর্ণ অরণ্য আশ্রয় করা তোমার কর্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে
তুমি সুসমৃদ্ধ অযোধ্যায় প্রতিগমন কর। সেই একবেণীধরা নগরী তোমার
প্রতীক্ষা করিতেছে। তুমি তথায় রাজভোগে কালক্ষেপ করিয়া দেবলোকে সুররাজ ইন্দ্রের
ন্যায় পরমসুখে বিহার করিবে। দশরথ তোমার কেহ নহেন, তুমিও তাঁহার কেহ নও, তিনি অন্য
তুমিও অন্য, সুতরাং
আমি যেরূপ কহিতেছি তুমি তাহারই অনুষ্ঠান কর। দেখ, জন্মবিষয়ে পিতা নিমিত্তমাত্র বলিয়া
নির্দিষ্ট হন, বস্তুতঃ
মাতা ঋতুকালে গর্ভে যে শুক্রশোণিত ধারণ করেন, তাহাই জীবোৎপত্তির উপাদান। এখন দশরথ
যেস্থানে যাইবার গিয়াছেন,
ইহাই মনুষ্যের স্বভাব। কিন্তু বৎস! তুমি স্ববুদ্ধিদোষে বৃথা নষ্ট হইতেছ।
যাহারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি
তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ
করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। লোকে পিতৃদেবতার উদ্দেশে অষ্টকা শ্রাদ্ধ করিয়া
থাকে। দেখ, ইহাতে
কেবল অন্ন অনর্থক নষ্ট করা হয়, কারণ কে কোথায় শুনিয়াছে যে, মৃত ব্যক্তি আহার করিতে পারে? যদি একজন
ভোজন করিলে অন্যের শরীরে উহার সঞ্চার হয়, তবে প্রবাসীর উদ্দেশে এক ব্যক্তিকে
যদি আহার করাও, উহাতে
কি ঐ প্রবাসীর তৃপ্তিলাভ হইবে? কখনই না। যে-সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা, যজ্ঞ, দান ও
তপস্যা প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে
বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেই সকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছেন। অতএব, রাম!
পরলোক-সাধন-ধর্ম নামে কোন পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক।
তুমি প্রত্যক্ষের অনুষ্ঠান এবং পরোক্ষের অননুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও। ভরত তোমাকে
অনুরোধ করিতেছেন, তুমি
সর্বসম্মত বুদ্ধির অনুসরণপূর্বক রাজ্যভার গ্রহণ কর”।
জাবালির এই প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে, ভগবান
শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার এবং তিরষ্কার করেছিলেন, কিন্তু
জাবালিকে তিনি “তপোধন” বলে সম্বোধনও করেছিলেন। তপোধন কথার অর্থ তপস্বী, মুনি বা
ঋষি! অতএব জাবালি বড়ো সামান্য লোক নন, তিনি ভগবান রামচন্দ্রকেও মুখের ওপর
এমন সব কথা বলার ক্ষমতা রাখতেন! ভগবান রামচন্দ্র এবং জাবালির মধ্যে এমন কোন
কথোপকথন যদি সত্যিই হয়ে থাকে, মহাকবি বাল্মীকি সেটুকু অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারতেন। তাতে
রামায়ণের কাহিনী বা কাব্যের এতটুকুও হানি হত না। কিন্তু তিনি তা করেননি, তাঁর মনে
হয়েছিল, রামায়ণের
মতো জনপ্রিয় কাব্যে এই ঘটনার উল্লেখ থাকলে, ব্রাহ্মণ্য-বিরোধীদের বিরুদ্ধে
জনগণকে সজাগ করা যাবে। তাদের খুব স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যাবে, দেখ, ওই দুষ্ট
তপস্বীকে ভগবান রামচন্দ্রও কীভাবে ধিক্কৃত করেছিলেন।
আরেক জন মুনির কথা পাওয়া যায় মহাভারতে, তাঁর নাম
চার্বাক। চার্বাক সম্বন্ধে আর কিছু না জানলেও, বাঙালী তাঁর নামে প্রচলিত “ঋণং
কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” প্রবচনটি খুব ভালোভাবেই জানে এবং সর্বদাই বিদ্রূপ অর্থে
ব্যবহার করে থাকে।
মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজা যুধিষ্ঠির যখন
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজয় করে রাজধানীতে ফিরছেন, “...সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতি
প্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে
দুর্য্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্ব্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ করিয়া অবস্থান
করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে
কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই নির্ভীক চিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্ব্বিত বাক্যে যুধিষ্ঠিরকে
সম্বোধনপূর্বক কহিল,
“মহারাজ! এই ব্রাহ্মণগণ আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী ও অতি কুৎসিত রাজা বলিয়া ধিক্কার
প্রদান করিতেছেন। ফলতঃ এইরূপ জ্ঞাতি-সংক্ষয় ও গুরুজনদিগের বিনাশসাধন করিয়া আপনার
কি লাভ হইল? এক্ষণে
আপনার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ। জীবন ধারণ করিবার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই”।
এই কথা শুনে উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা ক্রোধে, দুঃখে
লজ্জায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তাদের চুপ করে থাকতে দেখে, রাজা
যুধিষ্ঠির বলেছিলেন,
ব্রাহ্মণেরা যেন তাঁর প্রতি প্রসন্ন হন, কারণ তিনি তখনই প্রাণ ত্যাগ করবেন।
রাজা যুধিষ্ঠিরের কথায় ব্রাহ্মণেরা সম্বিৎ ফিরে পেল, বলল, “ধর্মরাজ! আমরা আপনাকে ধিক্কার প্রদান
করি নাই। আপনার মঙ্গল হউক।...মহারাজ, যে ব্যক্তি আপনার প্রতি কটূক্তি করিল, ঐ দুরাত্মা, দুর্য্যোধনের
পরম বন্ধু চার্ব্বাক নামক রাক্ষস। ঐ পাপাত্মা দুর্য্যোধনের হিতকামনায় আপনার প্রতি
কুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে,
আমরা কোন কথাই কহি নাই। অতএব আপনার কিছুমাত্র শঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি
ভ্রাতৃগণের সহিত কল্যাণভাজন হউন”।
এরপরে সমবেত ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের ওপর ভয়ংকর
ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ-শাপান্ত এবং হুংকার ধ্বনি করতে লাগল এবং অচিরেই চার্ব্বাক
বাজে-পড়া গাছের মতো ঝলসে মারা গেল। এই সব কিছু মিটে যাওয়ার পর ভগবান জনার্দন আসল
রহস্যটি ফাঁস করলেন,
বললেন, “সত্য
যুগে চার্ব্বাক নামে এক রাক্ষস বদরী-তপোবনে বহুকাল অত্যন্ত কঠোর তপস্যা করেছিল।
তার কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে বর দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন
রাক্ষস বলেছিল, হে
ভগবন, প্রসন্ন
যখন হয়েছেন, তখন
এমন বর দিন যে, কোন
প্রাণীর থেকেই আমার কোনদিন যেন মৃত্যু না হয়। ভগবান ব্রহ্মা বলেছিলেন, তথাস্তু।
কিন্তু তুমি কখনও ব্রাহ্মণদের অপমান করো না, ব্রাহ্মণের অপমান করলেই তুমি
বিপদগ্রস্ত হবে”। অতএব সত্য যুগের কঠোর তপস্বী রাক্ষস দ্বাপরে এসে ব্রাহ্মণদের
ক্রুদ্ধ অভিশাপে মারা গেল – ব্রাহ্মণদের কেউ মারেওনি, ধরেওনি, কিন্তু তাও
মারা গেল, স্বয়ং
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সামনেই! এই বার্তাটি বেদ-বিমুখ মানুষদের
পক্ষে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ,
তাতে আর সন্দেহ কি?
রামায়ণে রামচন্দ্র-জাবালি ঘটনার মতো, যুধিষ্ঠির-চার্বাকের
এই কাহিনীও সমান গুরুত্বহীন। অর্থাৎ এই ঘটনাটির উল্লেখ না থাকলে – মহাভারতের মূল
কাহিনীর কোন ইতরবিশেষ ঘটত না। কিন্তু এই কাহিনীর উপস্থাপনা করার উদ্দেশ্য –
বেদ-বিরোধী মতাবলম্বীদের হুমকি দেওয়া। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধর্মরাজ
যুধিষ্ঠিরের উপস্থিতিতে বেদ-বিরোধী চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধাগ্নি(?)তে ঝলসে
মরতে হল।
অবশ্য অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে মহাভারতের সমস্ত
প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভূত দুই মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে
ধর্ম-সংস্থাপক অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত-অনুরাগীবৃন্দ, যেমন পঞ্চপাণ্ডব,
বিরাট, দ্রুপদ প্রমুখ রাজন্যবর্গ এবং অন্যদিকে চার্বাক মিত্র দুর্যোধনাদি কৌরব
পক্ষ ও তার সহযোগী রাজন্যবর্গ। কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই, তবুও সহজেই অনুমান করা
যায়, মথুরার রাজা কংস, চেদিরাজ জরাসন্ধ প্রমুখের বিনাশও বেদ-বিরোধী তথা বিষ্ণু-বিরোধী
তথা ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী মতামতকে সমূলে উচ্ছেদ করা।
২.৬.৪ ভারতীয় দর্শনের সূচনা
যে কোন দর্শনের মূলকথা হল মানব-মঙ্গল। ভারতীয়
দর্শনের উদ্দেশ্য একই – এবং আমাদের দর্শনের ধারণা আরও সঠিক বললে মোক্ষ অর্থাৎ
পরমমুক্তি। কোথা থেকে মুক্তি, না পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি। ভারতীয় দর্শনের বক্তব্য মানুষের
জীবন মানেই কিছুটা সুখ আর অনেকটা দুঃখ-শোক এবং ইহকাল ও পরকাল। একজন মানুষ সারা
জীবনে এই যে সুখ-আনন্দ,
দুঃখ-শোক ভোগ করে,
তার কারণ, তার
পূর্বজন্মের সুকৃতি এবং দুষ্কৃতি। গতজন্মের যত দুষ্কৃতি এই জন্মে
দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসে। অতএব ইহকালে অর্থাৎ এই জীবনে যদি নিশ্ছিদ্র
সুকৃতি করা যায়, তাহলে
পরকালে অর্থাৎ পরজন্মে বড়ো সুখের সময় আসে। যেমন এই জীবনে আপনি শূদ্র হয়ে নিখুঁত
আনন্দে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের সেবা যদি করতে পারেন, মৃত্যুর পর
পরজন্মে আপনি অবশ্যই ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয় হয়ে পুনর্জন্ম নেবেন – অন্ততঃ বৈশ্য
তো হবেনই! আর সব থেকে ভালো হল পুনর্জন্মের চক্করে না গিয়ে, সরাসরি
মোক্ষ পেয়ে যাওয়া। একবার মোক্ষ পেয়ে গেলে, জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র থেকে বেরিয়ে
আপনি পিতৃলোক, দেবলোক, স্বর্গলোক, বৈকুণ্ঠলোক
বা কৈলাসলোকে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু এই লোকগুলোতে গিয়েও কোন স্থায়ী সমাধান হবে
না। কারণ এই প্রত্যেকটি লোকের সুখ ভোগ করার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, সেই সময় শেষ
হলেই আবার আপনাকে মর্তলোকে ফিরে আসতে হবে। অনেকটা আমাদের আজকালকার ছুটি কাটানোর
মতো, তিনদিনের
উইকেণ্ড বা একমাসের পূজা ভ্যাকেশন, তারপর তো সেই কাজে ফিরতেই হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যেটা আছে, সেটাই হল
পরমমোক্ষ–পরমমুক্তি – এর পরে আর মানুষকে মরজগতে ফিরে আসতে হয় না। তবে ব্যাপারাটা
ভারি শক্ত, বিগত
প্রায় আড়াই হাজার বছরে কজন মানুষ পরমমোক্ষ পেয়েছেন, সেটা কেউই সঠিক বলতে পারে না। কারণ
পরমমুক্তি ব্যাপারটা হল পরম ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়া। সাধনার যে উচ্চতম স্তরে পরম
ঈশ্বরে লীন হওয়া যায়,
সেই স্তরে সাধক আর কিছু বলার অবস্থায় থাকেন না। নদী যখন নিজেকে সমুদ্রের জলে
মিশিয়ে দেয়, তখন
সে তো আর নদী থাকে না,
সে তখন সমুদ্রই হয়ে যায়। তেমনি সাধক যখন ঈশ্বরে লীন হন, তিনি ঈশ্বরই
হয়ে যান। তাঁর পক্ষে সেই পরমমুক্তির আস্বাদ জাগতিক মানুষের কাছে প্রকাশ করা সম্ভব
হয় না।
ভারতীয় দর্শনের ভিত্তি অবশ্যই বেদ, বেদের
সংহিতা এবং উপনিষদসমূহ। ভারতীয় দর্শনের প্রধান তত্ত্ব ছয়টি - সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত।
একত্রে ষড়দর্শন বলা হয়ে থাকে। আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, মোটামুটি
৬০০ বি.সি.ই পর্যন্ত,
তার মোটামুটি শত খানেক বছর পরের কোন সময়ে দর্শন শাস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল
সাংখ্য দর্শনে। মহর্ষি কপিল এই সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক। মহর্ষি বা কপিল মুনি, ভগবান
বিষ্ণুর অংশ-অবতার। শ্রীমদ্ভাগবত গীতার “বিভূতি যোগে” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে
বলেছেন,
“অশ্বত্থঃ
সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ।
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ।।
১০/২৬
সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমিই অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের
মধ্যে আমিই নারদ, গন্ধর্বগণের
মধ্যে আমিই চিত্ররথ,
সিদ্ধযোগীগণের মধ্যে আমিই কপিল মুনি। (শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ-
লেখক)
পণ্ডিতেরা বলেন সাংখ্য দর্শনের রচনাকাল ৫০০
বি.সি.ই-র কিছু আগে এবং তার কিছুদিন পরেই পাতঞ্জল দর্শনের রচনাকাল, এবং তারও
কয়েকশ বছর পরে মোটামুটি ৩০০-২০০ বি.সি.ই-তে ন্যায়দর্শনের রচনাকাল। অতএব আমাদের
আলোচ্য সময়কালের কিছু পরেই সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শন রচনা হয়েছে। সে প্রসঙ্গের
একত্র আলোচনা আসবে এই গ্রন্থের অন্তিম পর্বে।
২.৬.৫ ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী মতাদর্শ বা লোকায়ত দর্শন
লোকায়ত দর্শনের মূলকথা হল, তারা
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জড়জগৎ ছাড়া অন্য কোন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। অতএব
তাদের কাছে পার্থিব সুখ-দুঃখ ছাড়া অন্য আর কিছু পুরুষার্থ থাকতে পারে না। তাদের
দর্শনে ঈশ্বর বা দেবতা নেই,
পরলোক বা পরজন্ম নেই,
মৃত্যুর পর মানুষের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই দর্শনকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে
চূড়ান্ত অবিশ্বাসবাদও বলা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ বৌদ্ধগ্রন্থ “সামান্য ফলসূত্ত”-এর
বর্ণনা অনুযায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অবিশ্বাসী অজিত কেশকম্বলীর কথাগুলি, এই দর্শনের
ধারণাটিকে স্পষ্ট করে। এই দর্শনের সঙ্গে রামায়ণের তপোধন জাবালির মতের বিশেষ
পার্থক্য পাওয়া যায় না।
“দান
যজ্ঞ হোম এবং সুকৃত ও দুষ্কৃত কর্মসমূহের কোন ফলবিপাক নাই। ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই।
মাতা নাই, পিতা
নাই, উপপত্তিক
(যৌক্তিক বা প্রামাণিক) কোনো সত্তাও নাই। ইহলোকে সম্মগ-গতো (সম্যকজ্ঞানগত?) কোনো শ্রমণ
বা ব্রাহ্মণ নাই – যাঁহারা সম্যক গমন করেন, যাঁহারা স্বয়ং অভিন্ন সাক্ষ্য দ্বারা
ইহলোক এবং পরলোকগুলিকে অনুধাবন করিতে পারেন এবং নিজেদের জ্ঞান অপরের কাছে বিতরণ
করিতেও পারেন।
চারি মহাভূত-বিশিষ্ট পুরুষ যখন মারা যায় তখন তার
কায়ার পৃথিবী পৃথিবীতে প্রবেশ করে, কায়ার জল জলে প্রবেশ করে, কায়ার তেজ
তেজে প্রবেশ করে, কায়ার
বায়ু বায়ুতে প্রবেশ করে এবং ইন্দ্রিয়গুলি শূণ্যে বিলীন হয়। চারজন শববাহী– এবং
শবাধার হল পঞ্চম – তাহার মৃতদেহকে লইয়া যায় এবং সৎকার স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত
মানুষরা তাহার গৌরব কীর্তন করে। তাহার অস্থিগুলি কপোতের ন্যায় হইয়া যায় (পুড়িয়া
ছাই হইয়া যায়) এবং তাহার আহুতিগুলি ভস্মে পরিণত হয়। ভিক্ষা অথবা দান – যাহারা
এইরূপ তুচ্ছ মিথ্যা প্রলাপ বকে তাহাদিগকে আস্তিক্যবাদী বলা হয়। মৃত্যুর পর মূর্খ ও
পণ্ডিতের মধ্যে প্রভেদ ছিন্ন হয় এবং মরণের পর আর কিছুই থাকে না”।
আগেই বলেছি, লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের আজ
পর্যন্ত কোন গ্রন্থ বা পুঁথি পাওয়া যায়নি, নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু নষ্ট
করে দেওয়া হয়েছিল। লোকায়ত দর্শন বলতে সংস্কৃত ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতেরা বলেছেন, এটি সাধারণ
লোকের দর্শন– জনসাধারণের দর্শন। লোকেষু আয়তো-লোকায়তঃ। অর্থাৎ সাধারণ লোকের মধ্যে
এই দর্শন ব্যাপ্ত বলেই লোকায়ত। লোকায়ত দর্শনের এই ব্যাখ্যায় ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের
একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ যেন লুকিয়ে আছে। সাধারণ লোক মানেই তারা মূর্খ এবং মূঢ়, বেদ ও
উপনিষদের মহান জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু লোকায়তের আরও একটা অর্থ হয়। লোকায়ত
হল ইহলোকের দর্শন। যারা পরলোক মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে
না, মোক্ষ
মানে না, তাদের
বলা হয় লোকায়তিক। তারা মনে করে মাটি-জল-আগুন আর বায়ু দিয়ে গড়া এই মানব দেহ এবং এই
পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য। দেহ যতদিন আছে, ইহলোক আছে, এই পৃথিবী
আছে, দেহ
না থাকলে অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ।
এখনও পর্যন্ত লোকায়ত দর্শনে এমন কী দেখা গেল, যার জন্যে
ব্রাহ্মণ্য আস্তিকরা এতটা বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল? প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুব প্রচ্ছন্ন
কিন্তু ভয়ংকর। ব্রাহ্মণ্য দর্শন নীচু স্তরের মানুষদের স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছে। এই
জন্মের শুদ্রত্ব বা দাসত্ব ভুলে গিয়ে তারা যদি উচ্চবর্ণের একনিষ্ঠ সেবা করে, তাহলে
পরজন্মে তাদের উত্তরণ সুনিশ্চিত। উচ্চবর্ণে উত্তরণ তো সামান্য কথা, ঈশ্বরে
প্রগাঢ় বিশ্বাস রেখে একনিষ্ঠ সেবা করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে চলে যাওয়াও অসম্ভব
নয়। আর স্বর্গ মানেই তো,
চূড়ান্ত আনন্দ এবং সুখভোগ– তৃষ্ণা নিবারণে সুধা, ক্ষুধায় পর্যাপ্ত সুস্বাদু খাদ্য, চিরবসন্ত
ঋতু, স্থিরযৌবনা
অপ্সরাদের নৃত্য-গীত এবং সঙ্গ। এ সব কিছুই পাওয়া যেতে পারে দাসত্ব এবং শূদ্রত্ব
ভুলে একনিষ্ঠ সেবায়।
লোকায়ত দর্শনের এখানেই আপত্তি। তাদের বক্তব্য এটা
প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বর্গ কে দেখেছে, পরজন্ম কে জেনেছে? ব্রাহ্মণ্য
ধর্মের কিছু স্বার্থপর ব্রাহ্মণ এই মোহ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
সাধারণের কাছে যা কিছু প্রত্যক্ষ তার প্রমাণকে স্বীকার করাই, তাদের এই
বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার একমাত্র নিরাপদ রাস্তা। শুধু তাই নয় লোকায়ত দার্শনিকদের
আরও একটা আশঙ্কা ছিল,
এই স্বপ্নে নিবিড় আস্থা রাখলে, দাস ভুলে যাবে তার দাসত্ব, দরিদ্র ভুলে
যাবে তার দারিদ্র। ব্যাপারটা হয়ে উঠবে, মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়ার মতো।
কারণ এক অবস্থা থেকে উচ্চতর অবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টা মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক
ধর্ম। বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী একজন দাস বা শূদ্র জন্মসূত্রেই সে শূদ্র বা দাস।
তার সন্তানাদিও দাসই থাকবে।
ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা
করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো
সেবা করতে থাক, তাহলে
নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন
উপায় নেই, কিন্তু
এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু
হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই
ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই
দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নীচুস্তরের পার্থিব
স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এই লোকায়ত দর্শনের অনেক প্রবক্তাই
ক্রীতদাস ছিলেন। যেমন বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে অজিত কেশকম্বলী ছিলেন একজন ক্রীতদাস।
লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রায় শুরুর
থেকেই সমান্তরাল পথে চলতে থাকলেও - নিরন্তর বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া খুব মারাত্মক কোন
প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনীষী পণ্ডিত প্রবক্তারাও কোনদিনই
সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁরা লোকায়ত দর্শনকে বারবার শাপ-শাপান্ত করেছেন
এবং প্ররোচিত করেছেন লোকায়তিক মানুষদের বিনাশ করতে। তার সব থেকে বড়ো উদাহরণ
চার্বাক মুনির হত্যাকে মহাভারতের অকুণ্ঠ প্রশ্রয়।
লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ওপর তেমন কোন
প্রভাব ফেলতে না পারলেও,
দুটি নতুন দর্শন তাদের যথেষ্ট বিপদে ফেলেছিল। এই দুই দর্শনের প্রবল ধাক্কায়
বদলে ফেলতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের খোল নলচে। সে দুটি হল জৈন এবং বৌদ্ধ দর্শন।
সে আলোচনা আসবে পরবর্তী পর্বে।
কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধের সময় কাল ৯০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে
শ্রীশ্রীগীতা উপদেশ শুনিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে।
তিনি তখন কপিলমুনির প্রসঙ্গ কী করে আনলেন? কপিল মুনি ও তাঁর সাংখ্য দর্শনের সময়
কাল, ৫০০
বি.সি.ই-র কাছাকাছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ না হয় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, ভবিষ্যতের
কোন কথাই তাঁর অজানা নয়। কিন্তু অর্জুন কেন কৌতূহলী হলেন না, বিখ্যাত এই
কপিল মুনি কে? তাঁর
নাম তো কোনদিন শুনিনি। অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, মহাভারতে শ্রীশ্রীগীতা সংকলিত হয়েছে
বহুযুগ পরে।
_______________________________________________________________________
এই পর্বের মানচিত্র ঋণঃ
১) https://cdn1.byjus.com/wp-content/uploads/2020/08/16-Mahajanapadas-768x591.png
২) https://www.harappa.com
এই পর্বের গ্রন্থ ঋণঃ
১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
২) বাঙ্গালীর ইতিহাস (প্রথম পর্ব) –ডঃ নীহাররঞ্জন রায়।
৩) বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য – স্বামী সমর্পণানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড়মঠ।
৪) The wonder that was India – A. L. Basham.
৫) মহাভারত (মূল সংস্কৃত থেকে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।
৬) The Decline of Harappans – A research report (1966) - Mr. George F Dales (উৎসাহী
পাঠকেরা এই লিংক থেকে পুরো রিসার্চ রিপোর্টটি পড়ে নিতে পারেন,
https://www.harappa.com/content/decline-harappans
৭) Ancient Gold Mining Activities in India - An Overview: An Article published in
Iranian Journal of Earth Sciences 7 (2015) – by A.K. Grover and M.K. Pandit
৮) The wonder that was India – A. L. Basham.
৯) মহাভারতের সমাজ - শ্রীযুক্ত সুখময় শর্মা।
১০) শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলা অনুবাদ (চিরসখা হে) – কিশোর ঘোষাল
১১) লোকায়ত দর্শন–শ্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
১২) শ্রীমদ্ভাগবত (পুরাণ) – বাংলা গদ্যানুবাদ শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ।
১৩) বাল্মীকি রামায়ণ – বাংলায় গদ্যানুবাদ– শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য।
ধর্মাধর্ম দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত