রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫

বকের মৃত্যু

 

[এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 "বাংলাদেশের হৃদয় হতে"]

 

শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এসে একদিন বলল, অ্যাই আমিও খেলব তোদের সঙ্গে, আমায় খেলতে নিবি? কিছুদিন ধরেই আমরা শেখরদাকে দেখছিলাম। পাড়ার কেউ না হলেও, এ পাড়ায় শেখরদার অনেক বন্ধু আছেতাদের বাড়িতেই শেখরদা থাকে। ওর বাড়ি কোথায়, বাড়িতে কে কে আছে, কিছুই জানতাম না। শুধু জানতাম শেখরদা প্রেসিডেন্সিতে পড়ত, এখন আর পড়ে না। পড়া ছেড়ে দিয়েছে, কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজ, বুর্জোয়াদের কলেজ। এই বুর্জোয়ারা কে, তাদের খায় না মাথায় মাখে তখন বুঝিনি। বেশ কদিন আলাপের পর আরও জেনেছিলাম, আমরাও যে সব স্কুলে পড়ি, পরীক্ষা দিই সে সবও বুর্জোয়াদের শিক্ষা।

ক্লাস সেভেনের ছাত্র হলেও, এইসব তথ্য জেনে যেমন আশ্চর্য হয়েছিলাম তেমন বিচলিতও হয়েছিলাম। তার মানে আমরা এতদিন যা কিছু পড়লাম, শিখলাম, সব ভুল? শেখরদা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিল, ভুল। তাহলে সঠিক লেখাপড়া কবে শুরু করব? আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে শেখরদা হেসে বলেছিল, তোদের জন্যেই তো আমরা লড়ছি, আমাদের ভুলটা যেন তোরা শুধরে নিতে পারিস। এখন যা, বল কর দেখি, মনের সুখে তোকে একটু পেটাই।

এর কয়েকদিন পরে সক্কালবেলা পল্টু এসে চুপিচুপি খবর দিল শেখরদার লাশ পড়ে গেছে বড়ো রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে শেখরদার লাশ

কে মারল শেখরদাকে, কেন?

তুই জানিস না, শেখরদা তো নকশাল ছিল।

নকশাল? শেখরদা নকশাল ছিল?

পল্টু আমার অজ্ঞতায় বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁরে বাবা, নকশাল। রোজই ভোরে শেখরদা যেমন চা খেতে যায়, হারাণদার চায়ের দোকানে, আজও গিয়েছিল। বিশাল বস্তা নিয়ে একটা কাগজকুড়ুনে লোক শেখরদার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাগজ তোলার জন্যে আচমকা নীচু হওয়াতে, শেখরদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। লোকটা কাগজ কুড়িয়ে যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার হাতে গুলিভরা রিভলভার। দুটো গুলি, ঢিচিকাঁউ ঢিচিকাঁউ, ব্যস শেখরদা পড়ে গেল রাস্তায়, সব শেষ।

কাগজকুড়ুনে লোকটা কেন মারল শেখরদাকে?

তুই একটা আস্ত গাধা, ও কি আর সত্যি সত্যি কাগজকুড়ুনে? ও নিশ্চয়ই ছদ্মবেশে খোচর ছিল। 

খোচর?

তুই দেখছি কিছুই জানিস না, প্লেন ড্রেসের পুলিশের ডিটেকটিভকে খোচর বলে। আমাকে দাদা বলেছে। শেখরদার বাড়ি নাকি কসবার দিকে, এখানে লুকিয়ে ছিলপুলিশের খোচর অনেকদিন ধরেই ওকে খুঁজছিল। আজ পেয়ে যেতেই, শেষ করে দিল। 

শেখরদাও নকশাল! নকশালরা তো পুলিশ মারে, স্কুলের টিচারদের মারে। গ্রামের বড়োলোকদের মারে। আমাদের স্কুলের সামনে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর আর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মূর্তির মাথা ভেঙে দেয়আবার অনেক নকশাল জেলে বসে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দিয়ে, খুব ভালো রেজাল্টও করে। শেখরদার চেহারা, তার হাসি, আমাদের সঙ্গে তার কয়েকদিন ক্রিকেট খেলার কথা সব মনে পড়ে গেল।  মনে পড়ল, শেখরদার সেই কথা “তোদের জন্যেই তো আমরা লড়ছি, আমাদের ভুলটা যেন তোরা শুধরে নিতে পারিস”শেখরদাও অন্য নকশালদের মতো পুলিশ মেরেছে? স্কুলের টিচার মেরেছে? সেটাই কি তাহলে আমাদের জন্যে লড়াই? পুলিশদের মেরে ফেলতে পারলেই বুঝি আমাদের ভুল বুর্জোয়া শিক্ষা ঠিকঠাক হয়ে যেতে পারত? 

আরো অবাক হয়েছিলাম আমার প্রিয় বন্ধু পল্টুর ব্যবহারে এবং কথাবার্তায়। আমাদের খেলার সঙ্গী হিসেবে শেখরদা পল্টুরও খুব প্রিয় ছিল, সেই শেখরদার আচমকা এই মার্ডার হওয়াটা পল্টু কি ভাবে বলতে পারল ‘লাশ পড়ে যাওয়া’, যেন জলভাত ব্যাপার! আসলে সে সময় আমাদের আশেপাশে এরকম মৃত্যুর ঘটনা এত ঘটতে থাকত, শেখরদার মার্ডারটা সেই সংখ্যায় আরেকটা সংযোজন ছাড়া যেন কিছুই নয়। আমার চেয়ে অনেক বেশী বাস্তববোধ সম্পন্ন পল্টুর মনে এই ঘটনা কোন আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি। যদিও শেখরদার হত্যা আমার বালকমনে বেশ ধাক্কা দিয়ে গেল। অজস্র প্রশ্নের উত্তর আজও সঠিক জানা হয়ে উঠল নানকশাল হয়ে যাওয়া এবং খোচরের গুলিতে মৃত শেখরদা ছাড়া আর কে দিতে পারে এই সব প্রশ্নের সঠিক জবাব?   

সেই সময় রাজনৈতিক পালাবদলের সমস্ত ঘটনা যে ঠিকঠাক বুঝতাম তা নয়। কিন্তু আমাদের জীবন যাত্রায় তার প্রভাব ছিল নিরন্তর। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৭ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস ভাঙনের ইতিহাস। অস্থিরতা আর নীতিহীন রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল আর স্বার্থের ইতিহাস। হরতাল, বাংলাবন্ধ ছিল নিত্য সঙ্গী। আমাদের স্কুলের জানালা থেকে কলেজস্ট্রিটের ওপর কতদিন যে ট্রাম বাস জ্বলতে দেখেছি তার হিসেব বলা মুশকিল। সত্তরের শেষ আর একাত্তরের প্রথমদিকে প্রায় তিনমাস আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল সে কথা আগেই বলেছি। সেবার আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাও বাতিল হয়ে গিয়েছিল। আমরা ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে প্রমোশন পেয়েছিলাম বিনা পরীক্ষায়।

সেই সময় বছর খানেকের জন্যে আমরা শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসা বদল করে, বাসা নিয়েছিলাম ব্রজনাথ দত্ত লেনের এক বাড়িতে। আমাদের বাড়িটা ছিল ছোট্ট এক কানাগলির মুখে। ওই সময়ে মা ছিলেন অসুস্থ শয্যাশায়ী। ঠিক কি কারণে আজ আর মনে নেই, স্কুল ছিল না, আমি বাড়িতেই ছিলাম। একঘেয়ে অসহ্য দুপুরে আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ ব্রজনাথ দত্ত লেনের গলির মুখ থেকে কানে এল, অনেক লোক দৌড়ে আসার আর চেঁচামেচির আওয়াজ। একজন লোক উন্মত্তের মতো দৌড়ে এসে ঢুকল আমাদের কানাগলির ভিতরে। পথহীন বদ্ধ গলির মধ্যে ঢুকে দিশাহারা লোকটি অসহায় চোখে তাকাল চারদিকে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল ক্ষণেকের জন্যে, তার চোখে বীভৎস আতঙ্কের ছায়া। আমাদের কানাগলি থেকে বেরিয়ে সে আবার বেরিয়ে গেল ব্রজনাথের রাস্তায়, দৌড়ে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টোদিকে। পিছনে তাড়া করে আসা লোকগুলো আবার চিৎকার করে উঠল। ‘ওই তো, ওই তো...’। আমাদের বাড়ির একতলার দেওয়ালে, আর সামনের রাস্তায় এসে ফাটল দুটি বোমা। তারপর একদল লোক, হাতে তাদের উদ্যত অস্ত্রশস্ত্র, দৌড়ে গেল পালিয়ে যাওয়া লোকটির পিছনেমৃত্যুসাক্ষী করা সেই লোকটির ক্ষণিকের দৃষ্টি, আজও মনে পড়লে শিউরে উঠি আতঙ্কে।

বোমার তীব্র বিস্ফোরণ এবং আওয়াজে আমাদের গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠেছিল, অসুস্থা মা দৌড়ে এসে আমাকে টেনে নিলেন ঘরের মধ্যে, মায়েরও দু চোখে বিস্ফারিত আতঙ্ক।

-‘পাগল হয়ে গেছিস, নাকি তুই, বাইরে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস এই সময়’? পাড়ার সমস্ত বাড়ির দরজা, জানালা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সমস্ত পাড়া জুড়ে নেমে এল থমথমে নিস্তব্ধতা।

কংগ্রেস দল ভেঙে গেল। নতুন সবল কংগ্রেস দল হল ইন্দিরাপন্থী কংগ্রেস। গাইবাছুর হল এই কংগ্রেসের ভোটের চিহ্ন। কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেল, এক দল হল মার্ক্সবাদী, অন্যদল মার্ক্স ও লেনিনবাদীদ্বিতীয় দলটির অন্য নাম হয়ে গেল নকশাল। শুরু হল ক্ষমতা দখল আর আধিপত্য কায়েমের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। হত্যা, গণহত্যা আর নৃশংসতার নিত্য নতুন সংবাদে ভরে উঠল সংস্কৃতিসম্পন্ন বঙ্গ সমাজ।  রাজ্য শাসনেও চরম অস্থিরতা। স্বল্পমেয়াদি দুর্বল সরকার ও রাষ্ট্রপতির শাসনের দোলাচলে দুলতে লাগল রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা। রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল আতঙ্ক আর সন্ত্রাস। সত্যি বলতে, সেইসময় থেকেই রাজনীতির সমার্থক হয়ে উঠল সন্ত্রাস। 

আমাদের স্কুল, আশপাশের স্কুলগুলি, উল্টোদিকের প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং সংলগ্ন এলাকাগুলি হয়ে উঠল নকশাল বিপ্লবের চারণক্ষেত্র। পাড়ায় টহলদারি পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজে ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত। ধরা পড়ত লাগল অজস্র নকশাল সমর্থক এবং সম্ভাব্য নকশাল সমর্থকরাতাদের অধিকাংশই আর কোনোদিন ফিরে আসে নি। সকালের খবরের কাগজ ভরা থাকত নিহত যুবকদের সংবাদে। স্কুলে গিয়ে শুনতাম হিন্দু হস্টেল আর হার্ডিঞ্জ হস্টেলে আবাসিক ছাত্রদের উপর রাজনৈতিক অত্যাচারের গোপন কাহিনী এরই মধ্যেই ঘটে গেল বর্ধমানের কংগ্রেস সমর্থক সাঁইবাড়ির হত্যা কাণ্ড। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রলম্বিত নিরপেক্ষ তদন্ত ও ন্যায় বিচারের প্রহসন চলতেই থাকল বছরের পর বছর। এই নৃশংসতার নিত্য ছবির মধ্যেই আমার বড়ো হয়ে ওঠা। স্কুলযাওয়া, লেখাপড়া, নিয়মিত পরীক্ষা পাশ করা, খেলাধুলো সবই চলতে লাগল এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই। 

‘পুলিশের গু খেয়ে বকের মৃত্যু’ এমন একটি উদ্ভট চুটকি তখন খুব শোনা যেতবকেরা কি গু খায়? আর খেলেও, পুলিশের গুকি এতই বিষাক্ত, যা খেয়ে মাঠচরা বকেদের মৃত্যু হচ্ছে! তা নয়, এটি নিছক কল্পিত একটি মুদ্রণ প্রমাদ। আসল সংবাদটি হচ্ছে, ‘পুলিশের গুলি খেয়ে যুবকের মৃত্যু’। প্রত্যেকদিন সকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত অজস্র যুবকের হত্যার সংবাদ নিয়ে এমন নিষ্ঠুর রসিকতা আমাদের মতো চূড়ান্ত স্বার্থপর ছাড়া কে করতে পারে আর! যদিচ, সেই যুবকদের অনেকেই হয়তো আমাদের পড়শিদের কেউ, চেনা, অল্পচেনা অথবা অচেনা। কিন্তু আমরা তো বেঁচে আছি, কোনমতে টিকে আছি আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে!

সেই সময়ে আমার অসুস্থা মায়ের সংবাদ নেবার জন্যে আমার এক মাসিমা বর্ধমান থেকে, কলেজে পাঠরত তাঁর দেবরকে পাঠিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন, বিধ্বস্ত আতঙ্কিত মুখ নিয়ে। কী হয়েছে জিগ্যেস করতে তিনি বললেন, আমাদের বাড়ি থেকে অদূরে আর পুলি লেন আর মধু গুপ্ত লেনের সংযোগস্থলে তাঁকে আটক করেছিল বেশ কয়েকজন সশস্ত্র যুবক। প্রায় একঘন্টা ধরে চলেছিল তাঁর প্রশ্নোত্তর পর্ব। কোথা থেকে এসেছেন, কোন বাড়ি যাবেন, কিসের জন্যে এসেছেন, কী করেন, কতদিন থাকবেন এইসব প্রশ্নের পাশাপাশি ছিল হত্যার হুমকি। ‘এতো কতার কি আচে গুরু, মগজে শিসে ভরে দিলেই শ্লা সব ঠাণ্ডা মেরে যাবে।’ এমন মন্তব্যও করেছিল তাঁকে ঘিরে থাকা সেই যুবকদের কেউ কেউ

মাত্র এই কয়েকটা বছরের মধ্যে পাল্টে গেল আমাদের জীবনযাত্রার ধারা। মনে আছে সেই ক’বছর পনেরই আগষ্টে পাড়ার সকলেই বাড়িতে পতাকা তোলার কথা এড়িয়ে যেত। আমাদের বাসার বারান্দায় প্রত্যেকবার ঐ দিনটিতে ছোট্ট একটি পতাকা তুলতাম, ওই কবছর বাবা তুলতে দেননি। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ নীতিতে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল যদি হামলা করে, এই আতঙ্কে।

ভালোমন্দ মিশিয়ে সুস্থ সামাজিক জীবনযাপনের রংবাহারি চিত্রটার রং বদলে হয়ে গেল একটাই রং, লাল, রক্ত লাল। হত্যা হয়ে উঠল প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা, আবার প্রশাসনিক ভাষা হিসেবেও নিরঙ্কুশ আধিপত্য পেয়ে গেল হত্যা। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সামাজিক নীতি, মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের কোনো রংই আর ধোপে টিকল না। জীবনের একটাই রং, রাজনৈতিক দলের রং। সমস্ত নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনীতি হয়ে উঠল সন্ত্রাস এবং আতঙ্কের সমার্থক। এই সন্ত্রাসনীতিই হয়ে উঠল বঙ্গ রাজনীতির অঙ্গ।

--00--

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

বকের মৃত্যু

  [এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 " বাংলাদেশের হৃদয় হতে "]   শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এ...