[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাধার্মিক
ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ
ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে
তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা
হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক
পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগরা এই ইহলোকের রাজা,
তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে সংক্ষিপ্ত
ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভাগবৎ-পুরাণে (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়), সেই ঘটনার
সম্ভাব্য পুনর্নির্মাণ এই উপন্যাস।]
১
মহারাজ বেণের মন আজ অত্যন্ত প্রসন্ন। রাজসভায় আজ
প্রথমবার অত্যন্ত জরুরি, একদম মনের মতো কিছু সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পেরেছেন। তাঁর
পিতার সমসাময়িক জরাগ্রস্ত মন্ত্রী-অমাত্যদের তিনি কোন কথাই বলতে দেননি। আজকের এই
সাফল্যের পর তাঁর ইচ্ছে আছে, অচিরেই এই সকল অপদার্থ জড়বুদ্ধি মন্ত্রি ও অমাত্যদের রাজসভা
থেকে বিদায় করে দেবেন। রাজসভায় নিয়ে আসবেন এমন সব যুবা অমাত্য, যারা বিনা দ্বিধায়
তাঁর আদেশ মেনে নেবে এবং তৎক্ষণাৎ কাজ করবে। যে
কোন সিদ্ধান্তের আগে, রাজসভায় বসে দিনের পর দিন, বৃদ্ধ এই অমাত্যদের “কিন্তু”, “তবে”,
“হয়তো”, “নয়তো” এত আলোচনা তাঁর সহ্য হয় না। তাঁর মনে হয়, রাজসভায় যে কোন বিষয় নিয়ে
আলোচনা ও মত বিনিময়, আসলে সময়ের অকারণ অপচয়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই রাজ্যের
মহারাজার অধিকারে, তিনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সকল নির্দেশ দেবেন। আর অমাত্যদের
একমাত্র কর্তব্য হবে, বিনা প্রশ্নে তাঁর সকল নির্দেশ অত্যন্ত দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে
পালন করা! তাঁর আজকের এই বলিষ্ঠ ঘোষণা, খুব শীঘ্রই বদলে দেবে এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ।
মহারাজা বেণকে ইতিহাস মনে রাখবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয়, স্বয়ং ঈশ্বর রূপেই।
আজ তিনি অসময়ে সভার কাজ বন্ধ করে দিয়ে এসেছেন! এই
সভাভঙ্গের কারণ, তাঁর পিতার সমসাময়িক মন্ত্রী ও অমাত্যদের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক
করে তোলা। তাঁর আদেশ ও নির্দেশ নিয়ে, রাজসভায় পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, কোন আলোচনাই
যাতে না ঘটতে পারে! রাজ-অন্নে প্রতিপালিত ওই অলস জরাগ্রস্ত অমাত্যদের তিনি একটা
স্পষ্ট সংকেত দিলেন “ওহে বিগতবুদ্ধি জম্বুকের দল, এই রাজ্য পরিচালনায় তোমাদের আর
কোন অধিকার নেই! নিজেদের সম্মান যদি রাখতে চাও, তবে স্বেচ্ছা অবসর নাও। নচেৎ আরো
বড়ো অপমান ও দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত হতে থাকো”!
রাজসভা থেকে তিনি অন্তঃপুরে চলে এসেছেন অনেকক্ষণ। রাজবেশ
পরিত্যাগ করে, তিনি এখন নিজের ঘরের অলিন্দে পায়চারি করছেন, আর মনে মনে পর্যালোচনা
করছিলেন, আজকের রাজসভার অধিবেশনের সমস্ত ঘটনা। তিনি, মহারাজ বেণ, অনেক কিছুই হয়তো সহ্য
করলেও করতে পারেন। কিন্তু সহ্য করতে পারেন না, অকৃতজ্ঞতা আর ঔদ্ধত্য। তিনি এই
রাজ্যের অধীশ্বর, তাঁর অনুগ্রহে সুখে শান্তিতে সংসারধর্ম পালন করছে সমস্ত প্রজাকুল।
তাঁর একটি ইশারায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি সংসার, একটি গ্রাম, একটি অঞ্চল। কিন্তু
কই তিনি তো তা করেন না! দরিদ্র শ্রমনির্ভর মানুষগুলির প্রতি, সত্যি বলতে, তিনি
অদ্ভূত এক করুণা অনুভব করেন। কারণ এই মানুষগুলি কীটপতঙ্গের মতো কী ভাবে বেঁচে থাকে,
সেটা ভাবলেই তিনি আশ্চর্য হয়ে যান!
মানুষের মতোই দেখতে এই অদ্ভূত জীবগুলির কোন আনন্দ নেই,
বিলাস নেই, কিছু না কিছু কাজ নিয়ে এরা সর্বদাই ব্যস্ত –সারাটাদিন, প্রত্যেকদিন! হয়
বাইরের কাজ, নয়তো ঘরের কাজ। আর যখন কোনও কাজ করে না, তখন দেবতার পূজা করে। হে ঈশ্বর ধন দাও, সন্তান দাও, সুখ
দাও, সমৃদ্ধি দাও। মূর্খ এই জীবগুলো এটাও বোঝে না, ঈশ্বর তাদের কিছু দেয় না। দেয়
কে? দেশের রাজা। অত্যন্ত কৃপাপরবশ হয়ে রাজাই তোদের কৃষির জমি দেয়, কর্মের অধিকার
দেয়, আবাসের ভূমি দেয়। তবেই না তোদের সুখ আসে, সমৃদ্ধি আসে, ধন আসে, সন্তান আসে,
সন্তানের প্রতিপালন হয়! আর সন্তান যে আসে, সে তো প্রকৃতির বিধান। কীট-পতঙ্গ থেকে অজ,
মেষ, গবাদি, শ্বাপদ সকলেরই সন্তান আসে, তার জন্যে ঈশ্বর কী করবে? এত অনুগ্রহের প্রতিদান
স্বরূপ রাজা যদি কখনো অধিক শুল্ক আদায়ের নির্দেশ দেন, কিংবা মহামান্য রাজার অনুচরদের
কেউ যদি সামান্য অবিচার অনাচার কিছু করেই ফেলে, তার জন্যে এত আক্রোশ কেন? কর্ম করে
যে মানুষ, তার এক-আধটা ভুল-ভ্রান্তি তো হতেই পারে! কিন্তু তুচ্ছ পিপীলিকার তুল্য এই
মানুষগুলোর কী এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে নেই?
সকালের সমস্ত ঘটনার কথা মনে পড়লে, মহারাজ বেণের মস্তিষ্ক এখনো তপ্ত হয়ে উঠছে।
মহারাজ বেণের বহুদিনের স্বপ্ন, রাজধানীর অদূরে সুরম্য
একটি উদ্যান বাটিকা প্রতিষ্ঠা। আগামী শ্রাবণী পূর্ণিমায় সেই বাটিকার গৃহপ্রবেশের
পরিকল্পনা করেছেন তিনি। গতকাল দ্বিপ্রহরে সভার অধিবেশন স্থগিত রেখে, মহারাজ বেণ
তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে উদ্যান বাটিকায় গিয়েছিলেন, নির্মাণ কার্যের পরিস্থিতি
পর্যবেক্ষণ করতে। উদ্যান বাটিকার নির্মাণ পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট হলেও, সন্তুষ্ট
হননি পথের পরিস্থিতিতে। রাজধানী থেকে উদ্যানবাটিকা পর্যন্ত যাবার যে একমাত্র পথ,
সে পথের অবস্থা আদৌ আরামদায়ক নয়। কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া, প্রাকবর্ষার অর্ধপ্রহরের
বৃষ্টিতেই সে পথের পরিস্থিতি কদাকার। আসন্ন বর্ষায় সে পথের কী দশা হবে সে কথা
সহজেই অনুমান করা যায়। উদ্যান বাটিকা পরিদর্শনের পর, এই পথের আশু নির্মাণ কী ভাবে
করা সম্ভব সেই আলোচনাই ছিল আজকের সভার মুখ্য বিষয়।
আজ প্রভাতী সভায় সিংহাসনে বসেই মহারাজ বেণ গম্ভীর স্বরে
বললেন, “গতকাল উদ্যান বাটিকার কাজ স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে এসে আমার মনে হচ্ছে,
আমার চতুর্দিক অকর্মণ্য ব্যক্তিরা বেষ্টন করে আছে। হাতে আর মাত্র পাঁচ পক্ষকাল সময়। এই সভায় সকলেই উপস্থিত, কিভাবে এই
রাজপথের দ্রুত নির্মাণ সম্ভব, আমাকে এখনই জ্ঞাত করা হোক। আগামী দুই পক্ষের মধ্যে,
আমার রথ এবং অশ্বারোহী নিরাপত্তারক্ষীদের যাওয়ার মতো কঠিন ও সমতল পথ আমার চাই। মনে
রেখো, আজ থেকে ঠিক দুই পক্ষকাল পর, আমি নিজে রথ চালনা করে উদ্যান বাটিকায় যাবো।
সেইদিন যদি পথের পরিস্থিতির মনোমত উন্নতি না দেখি, ইহজগতে তোমাদের মুখও আমি দেখতে
চাইব না”।
ভীত সন্ত্রস্ত প্রাজ্ঞ বাস্তুবিদ শংকরপাদ, মহারাজ বেণের
সামনে নতজানু হয়ে, তাঁর আদেশের অপেক্ষা করছিলেন। গতকাল রাজা বেণের উদ্যান বাটিকা
পরিদর্শনের সময়েই, তিনি কঠোরভাবে সতর্কিত হয়েছিলেন। রাজসভায় তাঁর উপস্থিতির
নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন রাজা বেণ নিজে! আজ রাজসভায় ভীত কম্পিত স্বরে বললেন, “মহারাজ,
আপনার মনোমত উদ্যান-প্রাসাদ নির্মাণেই আমি আমার সমস্ত মনোযোগ নিয়োগ করেছিলাম। পথের
প্রতি অবহেলা হয়ে গিয়েছে সত্য। এক মাসকালের মধ্যে পথের যথাযথ সংস্কার হয়তো সম্ভব,
কিন্তু...”।
সভায় উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, অত্যন্ত
বিরক্তিতে রাজা বেণ গর্জন করে উঠলেন, “কি মূর্খ এই বাস্তুবিদ্! এখনো একটি বাক্যও
সম্পূর্ণ করেনি, অথচ তার মধ্যেই “হয়তো” এবং “কিন্তু”! কিসের “কিন্তু”, কিসের “হয়তো”? আপনারা সকলেই
অবগত আছেন, এই মূর্খ, আমার সরল সজ্জন পিতার প্রশ্রয়ে সারা জীবন সুসম্মানের সঙ্গে
প্রতিপালিত হয়েছে! এই ধরনের কর্মবিমুখ অলস জীবেরা রাজার অন্নে প্রতিপালিত হয়, অথচ
কর্মকালে দেখা যায় সে একটি বরাহ বিশেষ”! তারপর বাস্তুবিদ শংকরপাদের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ
কণ্ঠে বললেন, “তোমার নাম শংকরপাদ কেন হে? শংকর তো তোমাদের এক ভগবানের নাম। এখনই
যদি ঘাতককে তোমার মুণ্ডটা ধড় থেকে আলাদা করে দিতে বলি, তোমার ভগবান তোমাকে রক্ষা
করবে তো?”
বৃদ্ধ, প্রাজ্ঞ বাস্তুবিদ শংকরপাদ আতঙ্কে অপমানে শিউরে
উঠলেন। তাঁর সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল, তিনি বললেন, “মহারাজ, এক মাসের মধ্যে
পথের নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু নির্মাণের জন্যে যে বিপুল পরিমাণ পাথরের টুকরো
প্রয়োজন, এই কয়দিনের মধ্যে তা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব”।
মহারাজ ঘৃণায় কুঞ্চিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “অসম্ভব কেন?”
“আজ্ঞে মহারাজ, দয়া করে বিবেচনা করে দেখুন। মাত্র দুই
পক্ষকালের মধ্যে পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ করা, সেগুলো বহন করে এনে ভেঙে টুকরো করা কি
একান্তই অসম্ভব নয়?”
মহারাজ বেণ অত্যন্ত বিরক্ত হলেন বাস্তুবিদ শংকরের কথায়, “আরে
এই রাসভনন্দন একই কথা বারংবার বলেই চলেছে, “অসম্ভব, অসম্ভব”। ও শুনে আমার কোন
মোক্ষলাভ হবে? কী করলে সম্ভব হবে, সেটা বলার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি তোমার আছে কি?”
সভার মধ্যে বসেছিলেন বৃদ্ধ নগরপালের যুবক পুত্র,
শক্তিধর। শক্তিধর মহারাজ বেণের বাল্যবন্ধু ও অকৃত্রিম ক্রীড়া সহচর। সেই অনুগ্রহেই শক্তিধর
সম্প্রতি উপ-নগরপাল পদের অধিকারী হয়েছেন। তিনি বললেন, “মহারাজ, আমার একটি নিবেদন
আছে”।
বন্ধুবর শক্তিধরের কথায় মহারাজ বেণ কৌতূহলী হলেন, বললেন,
“কী নিবেদন, শক্তিধর”।
“আপনার উদ্যানবাটিকার অনতিদূরেই একটি বড়ো গ্রাম আছে। সেই
গ্রামের অধিকাংশ গৃহই ইঁট এবং পাথরে তৈরি। ওই বাড়িগুলিকে ভেঙে ফেললে, বিপুল পরিমাণ
ইঁট ও পাথরের টুকরো পাওয়া সম্ভব। শতাধিক গোশকটে এবং রাসভ-বাহনে সেই সমস্ত উপাদান
বহন করে এনে, পথের উপর বিছিয়ে দিলেই আপনার সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব, মহারাজ”।
মহারাজা বেণ বন্ধুবর শক্তিধরের অদ্ভূত প্রস্তাবটা নিয়ে
কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন। সভার
মধ্যে তখন অখণ্ড নীরবতা। মহারাজা বেণের অত্যন্ত ধার্মিক পিতা মহারাজা অঙ্গের
সমসাময়িক মন্ত্রী, অমাত্যরা সকলেই রয়েছেন সেই সভায়। শক্তিধরের এই প্রস্তাবে তাঁরা
সকলেই শিউরে উঠলেন। মহারাজা
বেণ যদি তাঁর বাল্যসখার এই প্রস্তাবে রাজি হন, তাহলে আসন্ন বর্ষায়, ওই সমস্ত অসহায়
গৃহবাসীর করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে তাঁরা মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন।
মহারাজা বেণ কিছু বলতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমন সময়, দুই
রক্ষীর সঙ্গে সভার মধ্যে ঢুকে পড়ল এক বৃদ্ধ। দুই রক্ষী তাকে নিরস্ত করতে চাইছে,
কিন্তু বৃদ্ধ কিছুতেই তাদের বাধা শুনছে না। চেঁচামেচি হট্টগোলে সভার রুদ্ধশ্বাস
নীরবতা ভেঙে গেল। বিরক্ত মহারাজা বেণ, জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে, রক্ষীগণ? এত
শক্তিশালী তোমরা, দুইজনে মিলে একজন বৃদ্ধকে সামলাতে পারছো না? কে এই বৃদ্ধ, কী চায়
আমার কাছে?”
রক্ষী দুজন দুইপাশ থেকে দুইবাহু ধরে থাকল সেই বৃদ্ধর, তারা
নত হয়ে মহারাজকে প্রণাম করে বলল, “মহারাজ, ইনি শ্রীবিষ্ণুমন্দিরের মুখ্যপুরোহিত। সম্মানীয়
ব্যক্তি, ওঁনার ওপর শক্তি প্রয়োগ করা সমীচিন নয় বিবেচনা করেই আমরা শক্তি প্রয়োগ
করিনি। মহারাজ, অন্য কোন অবাধ্য দর্শনার্থী হলে, তার রক্তদর্শন করে, ফেলে রাখতাম
কারাগারের অন্তরালে। মহারাজ, আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন”।
অদ্ভূত এক বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ সুরে রাজা বেণ বললেন, “শুধুমাত্র
মন্দিরের পুরোহিত বলেই একজনের এত সম্মান?” সভার সকলের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে
মহারাজা বেণ আবার বললেন, “এই ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের মতো পরাশ্রয়ী জীব, আমি আর
দ্বিতীয় দেখি না। কোন কর্ম করে না, সারাদিন ঈশ্বর নামক এক নিষ্প্রাণ মূর্তির সেবা,
আরতি, যজ্ঞে কাল কাটায়, আর মূর্খ জনগণকে পাপ-পুণ্যের ভয় দেখিয়ে অর্থ আর মহামূল্য
দ্রব্য হরণ করে। নিজেরা আনন্দে থাকে, সমাজের সমস্ত মানুষের থেকে সম্মান আদায় করে!
ওহে, পুরোহিত, কি নাম তোমার?”
“শ্রীবিষ্ণুদাস দেবশর্মা” সেই ব্রাহ্মণ দৃপ্ত ভঙ্গিতে
বললেন। ব্রাহ্মণপুরোহিতের
এই ঔদ্ধত্য, মহারাজ বেণের পছন্দ হল না।
তিনি লক্ষ্য করেছেন, সভায় এসে থেকে এই ব্রাহ্মণ তাঁর প্রতি সম্মানের অভিবাদন,
নমস্কার কিংবা প্রণাম কিছুই করেনি।
শ্লেষ ভরা কণ্ঠে বললেন, “খুব তেজস্বী ব্যক্তি সন্দেহ
নেই। কী তোমার বক্তব্য, শুনি”।
“মহারাজ, গতকাল সন্ধ্যার একটু আগে, কিছু অশ্বারোহী দুরাত্মা
আমার কন্যাকে জোর করে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। ওরা পাঁচজন ছিল, কাল সারারাত আমার
কন্যাকে বলাৎকার করেছে, মহারাজ! আমি এর বিচার চাই, আপনি এর বিহিত করুন। আজ সকালে সেই
অশ্বারোহীদের কেউ তাকে রাজ পথের ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমার কন্যা বিধ্বস্ত,
মৃতপ্রায়, বাঁচার আশা ক্ষীণ। সে বলেছে, ওই পাঁচজনের মধ্যে উপনগরপাল শক্তিধরও ছিল”।
নিস্তব্ধ রাজসভায়, মহারাজ বেণ বৃদ্ধ পুরোহিতের মুখের
দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, তারপর বললেন, “তোমার কন্যা সুন্দরী এবং
দুশ্চরিত্রা নিশ্চয়ই। নচেৎ এমন হবার তো কথা নয়। একজন মৃতপ্রায়, দুশ্চরিত্রা রমণীর
কথা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? এমন তো নয়, তোমার দুশ্চরিত্রা কন্যা মিথ্যা অপবাদে
উপনগরপালের চরিত্র হনন করছে?”
রাজসভায় উপস্থিত প্রাচীন সদস্যরা সকলে মাথা নীচু করলেন।
মহারাজ বেণ এবং তাঁদের সকলের দিকে তাকিয়ে, বিমূঢ় বৃদ্ধ পুরোহিত অন্তরের অসহায়
আক্ষেপ থেকে হাহাকার করে উঠলেন, “আমার কন্যা দুশ্চরিত্রা? হাআআআঃ, আমার কন্যা
দুশ্চরিত্রা? হা ঈশ্বর, হা ভগবান। এ কোন রাজার কাছে আমি এলাম সুবিচারের আশায়! সারা
জীবন তোমার পূজা আর আরাধনায়, আমার কী কোন অপরাধ ঘটে গেছে? কেন আমার কন্যার এই বীভৎস
পরিণতি! কেন বিচারের জন্য এসে আমার নিষ্পাপ কন্যার নামে এমন চরম অপবাদ শুনতে
হচ্ছে? হে ঈশ্বর, হে পতিতপাবন, হে করুণাসিন্ধু, রক্ষা করো, রক্ষা করো আমাদের।”
মহারাজ বেণের পিতা মহারাজ অঙ্গ, সভায় প্রবেশের মুখেই ভগবান
শ্রীবিষ্ণুর একটি সুন্দর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সভায় প্রবেশের আগে, তিনি এই
ভগবান বিষ্ণুর পায়ে পুষ্পমাল্য অর্ঘ্য দিয়ে, রাজ সিংহাসনে বসতেন। পাথরের সেই
মূর্তির পায়ে মাথা কুটতে লাগলেন বৃদ্ধ পুরোহিত। কপাল কেটে রক্তাক্ত হয়ে উঠল তাঁর শুভ্র
কেশ, দাড়ি। অসহায় হতাশায় আর আক্ষেপে, কান্নাভাঙা বিকৃত স্বরে তিনি চিৎকার করতে
লাগলেন, পাথরের কঠিন পাদুটি ধরে।
মহারাজ বেণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সিংহাসন ছেড়ে সভাকক্ষের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে তিনি গর্জন করে উঠলেন, “শক্তিধর, এটা কি রাজসভা, নাকি নাট্যশালা? বসে বসে কী
দেখছিস? তোর রক্ষীদের ডাক। আমি মহারাজা বেণ, আদেশ দিচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই
দুর্বিনীত ব্রাহ্মণ পুরোহিত জ্ঞান না হারায় ওকে কশাঘাত কর। তারপর রাজপথের স্তম্ভে
বেঁধে রেখে দে, তৃষ্ণার একবিন্দু জলও যেন না পায়, লক্ষ্য রাখিস। নগরের সকলে দেখুক
মহারাজা বেণই বিচার করেন, কোন ঈশ্বর নয়। আর ভেঙে ফ্যাল ওই দেব মূর্তি, আজই, এখনই।
সারা রাজ্যে আদেশ ঘোষণা কর, আগামীকাল থেকে সমস্ত দেবতার পূজা, আরাধনা বন্ধ। যদি
পূজা করতেই হয়, প্রজারা আমার আরাধনা করবে। অন্য কারো নয়। আমি এই রাজ্যের রাজা,
সমস্ত প্রজার মঙ্গল-অমঙ্গলের আমিই নিয়ামক, আমিই বিধাতা, আমিই ঈশ্বর”।
মহারাজ বেণের এই ভয়ংকর রুদ্ররূপ কোনদিন দেখেনি, তাঁর
বাল্যবন্ধু উপনগরপাল শক্তিধর। সন্ত্রস্ত উপনগরপাল, তার রক্ষীবাহিনী দিয়ে তৎক্ষণাৎ
রাজার আদেশ পালন করল। রক্ষীদের লৌহ মূষলে, টুকরো টুকরো হয়ে ধুলোয় মিশে গেল
শ্রীবিষ্ণু ভগবানের পাথরের সুচারু মূর্তি। অন্য একদল রক্ষী টেনে হিঁচড়ে সভাঘরের
বাইরে নিয়ে গেল বৃদ্ধ পুরোহিতকে। তাঁকে নিয়ে যাবার সময় মহারাজ বেণের কানে এল
কশাঘাতের তীক্ষ্ণ আওয়াজ ও বৃদ্ধ পুরোহিতের আর্ত চিৎকার। আভূমি নত হয়ে সন্ত্রস্ত
উপনগরপাল শক্তিধর বললেন, “আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়েছে, মহারাজ। কাল
প্রত্যূষে দিকে দিকে সংবাদবাহক রওনা হয়ে যাবে আপনার আদেশপত্র নিয়ে। আগামী সাতদিনের
মধ্যে সমস্ত রাজ্যবাসী জেনে যাবে আপনার ঘোষণা”।
মহারাজ বেণের তীব্র ক্রোধ এখন অনেকটাই প্রশমিত। আজ তিনি
আরেকবার উপলব্ধি করলেন, বাল্যবন্ধু শক্তিধরকে তিনি উপনগরপালের দায়িত্ব দিয়ে ভুল
কিছু করেননি। শক্তিধরের
পিতা ছিলেন, তাঁর পিতা মহারাজা অঙ্গের নগরপাল। তাঁকে তিনি অবসর নিতে বাধ্য করেছেন।
এত দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া তাঁর মত অশক্ত বৃদ্ধের পক্ষে সম্ভব হতো না।
মহারাজ বেণ, স্মিতমুখে বললেন, “খুব ভালো, প্রিয়সখা
শক্তিধর, খুব ভালো। যে কোন ঔদ্ধত্যের অঙ্কুরেই বিনাশ জরুরি। বিলম্বে আয়ত্ত্বের
বাইরে চলে যায়। অনেকদিন ধরেই আমি ভাবছিলাম, ধর্ম নিয়ে বিরক্তিকর এই ছেলেখেলাটা
বন্ধ হওয়া দরকার। ভগবানের নামে কত যে সময় নষ্ট হয়, কত যে অজুহাত বানানো যায়!
ভগবানের নামে অশিক্ষিত প্রজাদের কতভাবে যে বঞ্চনা করা যায়! আরও ভয়ংকর হচ্ছে,
ভগবানের নামে কত অর্থ যে ব্যয় হয় মন্দির নির্মাণে, যজ্ঞ আর নিত্য পূজা-আরতির নামে,
তার সীমা নেই। কোন একজনকে এই কাজটা করতেই হত। আমি মহারাজা বেণ, সেই কাজটাই শুরু
করলাম, আগামীকাল থেকে এই রাজ্যে সমস্ত পূজা-পাঠ, শাস্ত্রচর্চা বন্ধ। এখন থেকে যাবতীয় স্তব-স্তুতি রচনা
হবে মহারাজা বেণের নামে। আমিই এই রাজ্যের অবিসংবাদিত ঈশ্বর। এখন থেকে আমার সমস্ত
নির্দেশ ও আদেশই হবে একমাত্র শাস্ত্রবচন”।
উপনগরপাল শক্তিধর, মহারাজা বেণের এখনকার স্বাভাবিক আলাপে অনেকটাই স্বস্তি পেলেন। মহারাজা বেণ তাঁর এককালের বাল্যসখা হলেও, তাঁর মনে প্রীতির থেকে আতঙ্কই বেশি কাজ করে। অপ্রত্যাশিত অনুগ্রহে তিনি উপনগরপাল হয়েছেন। অভূতপূর্ব এই ক্ষমতায় তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন হয়ে উঠছেন, উচ্ছৃঙ্খল, অত্যাচারী ও দাম্ভিক। বাল্যসখার প্রতিটি আদেশ তিনি নির্দ্বিধায় পালন করতে বদ্ধপরিকর। তিনি জানেন, যতদিন তিনি মহারাজ বেণের অনুগত থাকবেন, তাঁর কোন অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হবে না। আবাল্য সঙ্গী মহারাজ বেণকে তিনি চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো। মহারাজ বেণের সবথেকে পছন্দের ক্রীড়া, নৃশংসতম ও বীভৎসতম অত্যাচার।
মহারাজ বেণের প্রসন্নতায় নিশ্চিন্ত হয়ে, উপনগরপাল
শক্তিধর বললেন, “মহারাজ, সব তো হল। কিন্তু আপনার উদ্যান-বাটিকায় যাওয়ার পথের কী
হবে?”
“কেন, শক্তিধর? তুইই তো বললি, পাথর আর ইঁটের টুকরোর
ব্যবস্থা তুই করে ফেলবি। ওই বাস্তুবিদ গেল কোথায়? উত্তেজনায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
এই তো, এখনো নতজানু বসেই আছে, সিংহাসনের সামনে! হতভাগ্য অজনন্দন, এই কদিনের মধ্যে
ওই পথ যদি বানিয়ে তুলতে পারে, তো ভালো, না হলে –”।
“আপনার আদেশ, শিরোধার্য মহারাজ”। উপনগরপাল শক্তিধর
বললেন। তারপর আতঙ্কিত বাস্তুবিদ শংকরপাদকে বললেন, “কাল অতি প্রত্যূষে পথের কাজ
শুরু হওয়া চাই, ইঁট-পাথরের টুকরো আজ মধ্য রাতের মধ্যেই পৌঁছতে থাকবে। এখন যান”।
মহারাজ বেণকে এবং উপনগরপাল শক্তিধরকে প্রণাম করে
অপমানিত, আতঙ্কিত বাস্তুবিদ শংকরপাদ, ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন
সভা থেকে। তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন মহারাজা বেণ, তাঁর মুখ বিরক্তিতে ভরে
উঠল। অপদার্থ এই বৃদ্ধের কথা তিনি মনে রাখবেন। ওর আয়ু এখন তাঁর হাতে, হয়তো উদ্যানবাটিকার
নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত!
এতক্ষণ সভায় উপস্থিত সভাসদগণের কথা মহারাজ বেণের মনেই ছিল না। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এই জরাগ্রস্ত বৃদ্ধেরা যদি পুত্তলির মতো বসে না থেকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে সচেতন হত, তাহলে তাঁর রাজকার্যের অনেক সুবিধা হত। তাঁদের স্থাণু মুখের দিকে তাকিয়ে মহারাজা বেণ বললেন, “আজকের মতো এখানেই সভার কাজ সাঙ্গ হল। আপনারা সকলে আসতে পারেন। নিশ্চেষ্ট বসে থাকবেন না, আমার ঘোষণা অনুযায়ী রাজ্যবাসীকে সচেতন করুন। আগামীকাল থেকে রাজ্যে সমস্ত ধরনের পূজা ও শাস্ত্রচর্চা বন্ধ”।
২
বেলা দুপ্রহরে হাটে তখনও জমজমাট ভিড়। সকাল থেকে বেচাকেনা, ব্যস্ততার পর হাটুরেদের এখন একটু গাছাড়া ভাব। বেসাতির লাভ
ক্ষতি যা হয়েছে, সে হয়ে গেছে। এখন একটু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, সংবাদের
আদানপ্রদান। একটু নেশা ভাঙ। ভাত থেকে ধেনো, তালের রস থেকে তাড়ি, গুড় থেকে গৌড়ি। আর
বিলাসীদের জন্য মধু থেকে মাধ্বী। তার সঙ্গে আছে আফিং, গঞ্জিকার নেশাও। নেশার ঝোঁকে
তর্কবিবাদ, কলহ। নেশার ঝোঁকে রসের ফোয়ারা। তরল রসের ভিয়েন যেই করুক, মাটির কলসি
থেকে শালপাতার দোনায় উপচে ওঠা রসের বেসাতি করে যুবতী মেয়েরা। রসের ভাণ্ডারি সেই
মেয়েরাও কম রসিকা নয়। তাদের প্ররোচনায় হাটের রসিক মানুষজন উথলে ওঠে। বাড়াবাড়ি করলে
অবশ্যি নিস্তার নেই, তাদের পিছনে থাকে খাণ্ডারনী মাসি, আড়ালে আবডালে থাকে
ষন্ডাগুন্ডা লোকজন। তারা হাটের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বেতালা মাতালদের। সে সময়
সকালের যতো উপার্জন, মদ্যপদের ট্যাঁক থেকে হস্তান্তর হয়ে যায় তাদের হাতে।
মাথার উপর থেকে সূর্য একটু পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলেই হাটের লোকজন ঘরে ফেরার তোড়জোড় করে। যারা দূরের গাঁয়ে যাবে, তারা আর দেরি করে না। যারা কাছাকাছি থাকে, তারা আরো কিছুক্ষণ রসের সন্ধান করতে থাকে।
বিশ্বপ্রভ হাটে এসেছিল আশ্রমের জন্য জিনিষপত্র আদায় করতে। আশ্রমবাসীদের পূজার জন্য চন্দন,
ধূপ, ধুনো, নানান গন্ধ দ্রব্য, রন্ধনের মশলা।
জরুরি কিছু লোহার ও কাঠের তৈজসপত্র, কিছু জড়ি, বুটি, ঔষধি গাছগাছড়া। তিন সঙ্গীকে নিয়ে গরুরগাড়িতে সে
হাটে এসেছে। আশ্রমের জিনিষে গরুরগাড়ি বোঝাই হয়ে গেছে। হাট থেকে তাদের আশ্রম ক্রোশ তিনেকের স্বল্প
পথ। তাই কেনাকাটা হয়ে যাওয়ার পরেও হাতে
অনেকটা সময় ছিল বলে বিশ্বপ্রভ ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছিল হাটের মধ্যে।
হাটের মধ্যে সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করতে বিশ্বপ্রভর
খুব ভাল লাগে। ছোটখাটো লাভক্ষতি, সুখদুঃখ, শোকতাপে এই মানুষগুলো সহজেই উতলা হয়ে
ওঠে। এরা নিজেদের মধ্যে খুব সামান্য কারণেই ঝগড়া করে, বিলাপ করে, কপাল চাপড়ে হা
হুতাশ করে। আবার খুব স্বল্প আনন্দেই, হুল্লোড় করে, একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে, সুরার
আসরে গিয়ে বসে, আকণ্ঠ মদ্যপানের পর আবার নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে, চিৎকার করে,
হাটের লোক জড়ো করে। জীবনের এই সমস্ত লীলায় বিশ্বপ্রভ নিজে যোগ দেয় না ঠিকই, কিন্তু
উপভোগ করে। তার আশ্রমের সুচারু শৃঙ্খলার জীবনপ্রণালীতে সে অভ্যস্ত, কিন্তু দূর
থেকে হলেও, সাধারণ মানুষের এই আচরণের প্রতি সে বিদ্বিষ্ট নয়।
সে বিশ্বাস করে, এই সব সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের
আবেগ থেকেই গড়ে ওঠে সুস্থ একটা সমাজ, বয়ে চলে সমাজবদ্ধ জীবনধারা। এই সমাজের
প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের পরিপূরক। এই মানুষদের মধ্যে কৃষক চাষ করে ফসল ফলায়,
সেই ফসল সমস্ত সমাজের মুখে তুলে দেয় দুবেলার অন্ন। তন্তুকার বানায় বস্ত্র পরিধান। কুম্ভকার
বানায় গৃহস্থালীর মাটির তৈজসপত্র। কর্মকার
বানায় লোহার নানান সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র। সূত্রধর শিল্পীরা বানায় কাঠের আসবাব,
খেলনা। স্বর্ণকার বানায় সোনা বা রূপোর অলংকার। আর এই সমস্ত পণ্য নিয়ে বাণিজ্য করে
বণিকরা। তারা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক রাজ্য থেকে
অন্য রাজ্যে পণ্যের বেসাতি করে। তাদের বাণিজ্যের সাফল্যের সঙ্গে নির্ভর করে গোটা
সমাজের আর্থিক উন্নতি! সকল শ্রেণীর মানুষের সফল যোগদানেই গড়ে ওঠে সুস্থ সমাজের
কাঠামো।
বিশ্বপ্রভ যে আশ্রমে এখন শিক্ষারত, এই রাজ্যে তো বটেই,
সমগ্র ভারতভূমিতেই সেই আশ্রমের খুব সুনাম। সকলে এই আশ্রমকে মহাবিদ্যালয় বললেও, মহর্ষি
ভৃগু যিনি এই মহাবিদ্যালয়ের মহাচার্য্য, তিনি কিন্তু আশ্রম নামটিই পছন্দ করেন। এই রাজ্য এবং এই বিশাল ভারতভূমির
অন্যান্য রাজ্যের পরাক্রান্ত রাজারাও তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। বিচক্ষণ সুপণ্ডিত
হিসেবে তিনি সুবিদিত, সাধারণ জনগণও তাঁর নাম শুনলেই প্রণাম করে, শ্রদ্ধায় মাথা নত
করে। মহর্ষির প্রতি শ্রদ্ধায় এবং তাঁর আশ্রমের একজন আশ্রমিক হওয়ার কারণেই, তাকেও
এই হাটে অনেকেই চেনে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। মহর্ষি ভৃগুর কাছে শিক্ষারত এই
তরুণের বুকের মধ্যে তারা নিঃস্বার্থ মায়ার আঁচ পায়। বয়সে তরুণ হলেও সাধারণ মানুষ
তাদের সুখদুঃখের কথা, বিশ্বপ্রভকে বলে যেন শান্তি পায়।
হাটে ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে বিশ্বপ্রভর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল
আচার্য বেদব্রতর। আচার্য
বেদব্রতও গুরুদেব ভৃগুর কৃতী শিষ্য, তবে প্রাক্তনী। বিশ্বপ্রভর থেকে বয়সে অনেকটাই
বড়ো। মহর্ষি ভৃগুর আশ্রম থেকে পাঠ সাঙ্গ করে, আচার্য বেদব্রত এখন গার্হস্থ্য ধর্ম
পালন করছেন এবং বেশ সুনামের সঙ্গে নিজেই একটি আশ্রম পরিচালনা করছেন। আচার্য বেদব্রতর সঙ্গে বিশ্বপ্রভর পরিচয়
মহর্ষির আশ্রমে। নানান অনুষ্ঠানে আশ্রমের কৃতী প্রাক্তন ছাত্ররা আমন্ত্রিত হন,
সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। পরিচয় পর্ব থেকেই দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল।
আচার্য বেদব্রতর আচার্য সুলভ গাম্ভীর্য থাকলেও, আলাপে সুরসিক ও আন্তরিক। সকল
বয়সীদের সঙ্গেই তিনি স্বচ্ছন্দ। মহর্ষির সঙ্গে কোথাও যেন তাঁর খুব মিল খুঁজে পায়
বিশ্বপ্রভ।
বিশ্বপ্রভ আচার্য বেদব্রতকে প্রণাম করল, আচার্য বেদব্রত
তাকে বুকে জড়িয়ে মস্তক আঘ্রাণ করার পর জিজ্ঞাসা করলেন, “গুরুদেব, ভালো আছেন তো, বিশ্ব?
অনেকদিন তোমাদের ওখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি”।
“ভালো আছেন, আচার্য। আপনার সংবাদ সব কুশল তো?”
“সংসারী মানুষ কবে কোথায় সর্বকুশলে থাকে, আমার জানা নেই
বিশ্ব, তবে সাধারণ অর্থে কুশল। তোমার লেখাপড়া কদ্দূর?”
“আশা করি সামনের বাসন্তী সমাবর্তনে সামবেদ কিছুটা আয়ত্ত্ব
হয়ে উঠবে”।
“তোমার মেধা এবং স্মরণশক্তি সম্পর্কে, গুরুদেব স্বয়ং
উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, আমি জানি। তারপরেও তুমি কিছুটা বলছো কেন, বিশ্ব? তোমার পাঠ
সম্পর্কে তোমার মনে কি কোন দ্বিধা আছে?”
বিশ্বপ্রভ কিছুটা ম্লান মুখে বলল, “আমার বিদ্যাচর্চায়
গুরুদেব সন্তুষ্ট কিনা, গুরুদেবের আচরণে ঠিক বুঝতে পারি না, আচার্য”।
“কেন বলতো, উনি কি কিছু বলেছেন, তোমাকে”?
“কিছুই বলেননি। মাস তিনেক আগে, আমার সহপাঠী ছয়জনকে
গুরুদেব বিদ্যাসমাপ্তির নির্দেশ দিলেন। তাদের
আশ্রম ত্যাগ করে, জীবিকার সন্ধান এবং গার্হস্থ্যধর্ম পালন করার নির্দেশ দিলেন। অথচ
আমার পাঠ নিয়ে কোন মন্তব্যই করলেন না”।
আচার্য বেদব্রত প্রাণখোলা হাস্যে চমকে দিলেন আশেপাশের
সকলকে, বললেন, “আমার ধারণা, ছয়মাস চর্চার পরও তোমার ঐ সহপাঠীরা তেমন সুবিধে করতে
পারেনি বলেই, গুরুদেব তাদের বিদায় করেছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমার সম্পর্কে
তাঁর মতামত ভিন্ন...”
হঠাৎ উৎকট পটহের আওয়াজে আচার্য বিরক্ত হয়ে কথা থামালেন। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন হাটের মধ্যস্থলে দেবমণ্ডপের অঙ্গনে। সেখানে রাজার দুই অশ্বারোহী সৈনিক দাঁড়িয়ে, সঙ্গে এসেছে বাদ্যকরের দল আর অশ্বারোহী ঘোষক। রাজার কোন বিশেষ ঘোষণা প্রচার করার থাকলে এই ধরনের হাটেই সেই ঘোষণার প্রচার হয়, এই ভাবেই পনের-বিশখানা গ্রামে লোকমুখে প্রচার হয়ে যায় রাষ্ট্রের ঘোষণা। পটহ ধ্বনিতে হাটে উপস্থিত সকলেই যখন সৈনিকদের দিকে মনোযোগ দিল, পটহ বাদন বন্ধ হয়ে শোনা গেল ঘোষকের উচ্চস্বর,
“আজ জৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের পুণ্য দ্বিতীয়া তিথির বিশেষ ঘোষণা
- আজ থেকে এই রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, প্রজাদের কাছে স্বয়ং পরমপুরুষস্বরূপ, মহারাজাধিরাজ
বেণ ছাড়া অন্য কোন ঈশ্বরের অথবা দেবতার পুজো করা চলবে না। এই রাজ্যের অধিপতি মহারাজাধিরাজ
বেণই সকল দেবতার পরম দেবতা, সকল ঈশ্বরের তিনিই পরম ঈশ্বর। অতএব তাঁকে ছাড়া অন্য
কোন দেবতার কিংবা ঈশ্বরের পূজাকর্মকে, তাঁর অপমান কিংবা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ বলেই
বিবেচনা করা হবে। রাজশক্তির অপমানের শাস্তি নির্বাসন, অথবা সশ্রম কারাদণ্ড কিংবা
ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদণ্ড। অতএব, প্রজাদের মঙ্গলের জন্য সদাচিন্তিত, প্রজাদের পিতৃতুল্য
ও স্বয়ং ঈশ্বরস্বরূপ রাজাধিরাজ বেণের ভজন ও পূজনই সকল প্রজার পক্ষে কল্যাণকর।
অন্যথায় সমূহ সর্বনাশ”।
ঘোষণা শেষে রাজার সৈনিকেরা চলে গেল।
দেবপূজা বন্ধ? এ কখনো হতে পারে? হাটে উপস্থিত লোকজন
ঘোষণার অভিঘাতে বিহ্বল ও হতবাক। তারা যা শুনল, তার সম্যক অর্থ সকলের কাছে যেন
স্পষ্ট নয়। তাদের আচরণে উদ্বেগ ও শংকা। এতক্ষণ যে স্বাভাবিক আচরণে হাটে উচ্চ
কোলাহল শোনা যাচ্ছিল, এখন তা চাপা গুঞ্জনে পরিণত হল।
আচার্য বেদব্রত বিশ্বপ্রভর কাঁধে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “হাটের কাজ যদি শেষ হয়ে থাকে, তুমি তাড়াতাড়ি আশ্রমে ফিরে যাও, বিশ্ব। গুরুদেবকে আমার প্রণাম দিও, যা শুনলে ও জানলে, ওঁকে বিস্তারিত জানিও। আর বলো, আমরা অতি শীঘ্রই গুরুদেবের দর্শনপ্রার্থী হবো। এখন এসো, আর বিলম্ব করো না”।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন