গীতার প্রথম অধ্যায় পড়া যাবে এই সূত্রে "গীতা - ১ম পর্ব"
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ সাংখ্যযোগ
|
১ |
সঞ্জয় বললেন- অর্জুনের
অশ্রুভরা চোখ, বিষণ্ণ মুখ ও মানসিক অবসাদ দেখে, শ্রীমধুসূদন এই কথা বললেন, |
|
||||
|
২ |
শ্রী ভগবান বললেন- হে
অর্জুন, এই সংকটের সময় তোমার মধ্যে এমন অবিবেচক, এমন অধর্মজনক এবং নিজের সুনামের
প্রতি অবিচারকারী অদ্ভূত মোহ কোথা থেকে উদয় হল?
|
|
||||
|
৩ |
হে পার্থ, পঙ্গুর মতো
আচরণ করো না, এই আচরণ তোমাকে শোভা পায় না। তোমার মনের এই তুচ্ছ দুর্বলতা ঝেড়ে
ফেলে, যুদ্ধের জন্যে উন্মুখ হয়ে ওঠো, হে অরিজিৎ। |
|
||||
|
৪ |
অর্জুন বললেন- হে
শত্রুবিনাশক মধুসূদন, ভীষ্ম, দ্রোণ, এঁদেরকে আমি এতদিন পুষ্প-চন্দনে পুজো করে
এসেছি, আজ কিভাবে এঁদের শরীরে আমি তিরের আঘাত করব, কিভাবেই বা যুদ্ধ করব? |
|
||||
|
৫ |
ইহলোকে মহানুভব
গুরুজনদের বধ না করে, ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করাও আমার পক্ষে কল্যাণকর।
কারণ এই
গুরুজনদের হত্যা করে, তাঁদের রক্তমাখা ধনসম্পদ ও অন্যন্য বিষয়, আমাকে এই জীবনেই ভোগ
করতে হবে।
|
|
||||
|
৬ |
এই অধর্মের যুদ্ধে হয় আমরা
জয়ী হব, অথবা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের জয় করবে, কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে
কোনটি আমাদের পক্ষে মঙ্গলকর হবে? যাঁদের হত্যা করে আমরা বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করি
না, ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে সেই লোকজন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
|
|
||||
|
৭ |
গুরুজন ও
বান্ধবদের হত্যা করে কিভাবে বেঁচে থাকব, সেই চিন্তায় আমি ব্যাকুল, আমার মন অবসন্ন।
আমি তোমার শিষ্য এবং তোমার শরণাগত। আমার পক্ষে যা নিশ্চিত মঙ্গলকর
হবে, তুমি আমায় সেই উপদেশ দাও। |
|
||||
|
৮ |
এই
পৃথিবীতে শত্রুহীন সমৃদ্ধ রাজ্য, এমনকি স্বর্গের আধিপত্য পেলেও, জ্ঞাতিবধের মতো
ভয়ানক শোকের কোন প্রতিকার আমি দেখতে পাচ্ছি না।
|
|
||||
|
৯ |
সঞ্জয়
বললেন - এই কথা বলে, জিতনিদ্র শত্রুতাপন অর্জুন, হৃষীকেশ গোবিন্দকে বললেন “আমি কিছুতেই
যুদ্ধ করতে পারব না”, তারপর আর কোন কথা না বলে, গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। |
||||
|
১০ |
হে
মহারাজ, হৃষীকেশ এতটুকু বিচলিত না হয়ে, উভয় সৈন্য সমাবেশের মধ্যে রথে বসে থাকা
বিষণ্ণ অর্জুনকে স্মিত মুখে বললেন, |
||||
|
১১ |
শ্রী ভগবান বললেন – তুমি
পণ্ডিতের মতো কথা বলছ, অথচ যা আদৌ শোকের বিষয় নয়, তার জন্যে তুমি শোকও করছ। যাঁরা
প্রকৃত পণ্ডিত তাঁরা কিন্তু জীবিত কিংবা মৃত কারোর জন্যেই শোক করেন না।
|
||||
|
১২ |
এই
জীবনের আগে, আমি কোনদিন ছিলাম না, এমন নয়। তুমি কিংবা উপস্থিত এই রাজন্যবর্গ কেউ
ছিলে না, তাও নয়। এই দেহ ধারণের আগেও আমরা সকলে ছিলাম, ভবিষ্যতে দেহত্যাগের পরেও
আমরা সকলেই থাকব।
|
||||
|
১৩ |
আমাদের
এই দেহে কৌমার, যৌবন ও জরা উপস্থিত হয়, কিন্তু আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না।
মৃত্যুর পরেও আত্মা অবিকৃত থাকে। তাই যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানী, তাঁরা মৃত্যুতে
বিচলিত হন না।
|
||||
|
১৪ |
হে কুন্তীপুত্র,
বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগে শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির অনুভব হয়,
কিন্তু এই দ্বন্দ্ব মাঝে মাঝে আসে, আবার চলেও যায়, অর্থাৎ অনিত্য। অতএব, হে
অর্জুন, এই অনুভব সহ্য করো।
|
||||
|
১৫ |
হে
বীরশ্রেষ্ঠ পুরুষ, সুখ দুঃখে যাঁর সমান অনুভব, যিনি সুখে আনন্দিত কিংবা দুঃখে
বিষণ্ণ হন না, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী এবং তিনিই পরম মোক্ষের অধিকারী।
|
||||
|
১৬ |
আমাদের
এই দেহ উৎপত্তি ও বিনাশশীল অর্থাৎ অনিত্য। কিন্তু আমাদের আত্মা সৃষ্টি ও
বিনাশহীন, অর্থাৎ নিত্য। যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানী তাঁরা এই দুই তত্ত্বই সম্যক
উপলব্ধি করেছেন।
|
||||
|
১৭ |
এই
অবিনাশী আত্মা, যা কিছু চোখে দেখা যায়, এমন সব বিষয়ে ব্যাপ্ত রয়েছেন। কোন
ব্যক্তির পক্ষে এই অবিনাশী আত্মার বিনাশ সাধন সম্ভব নয়।
|
||||
|
১৮ |
এই
অবিনাশী আত্মাকে আমরা কোন ইন্দ্রিয় দিয়েই উপলব্ধি করতে পারি না। এই আত্মা যে
দেহে বাস করেন, সেই অনিত্য দেহকে বলে নশ্বর। কাজেই, হে অর্জুন তুমি যুদ্ধ কর।
|
||||
|
১৯ |
যে
ব্যক্তি এই আত্মাকে হত্যাকারী মনে করেন, অথবা যিনি এই আত্মাকে মৃত বলে মনে করে্ন
তাঁরা দুজনেই প্রকৃত এই তত্ত্বটি জানেন না যে, আত্মা কাউকে হত্যা করতে পারেন না,
কিংবা নিহতও হন না।
|
||||
|
২০ |
এই আত্মা
না কখনো জন্ম নেয়, না কখনো মারা যায়। আগে ছিল না, কিন্তু এখন আছে – এই হল জন্ম।
এখন আছে কিন্তু পরে থাকবে না – সে হল মৃত্যু। আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই।
আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। আত্মার না ক্ষয় আছে, না আছে বৃদ্ধি। শরীর নষ্ট হলেও,
আত্মার কোন বিনাশ ঘটে না।
|
||||
|
২১ |
হে
পার্থ, যে ব্যক্তি এই আত্মাকে নিত্য, অবিনশ্বর, জন্মহীন, ক্ষয়-বৃদ্ধিহীন ও
মৃত্যুহীন বলে উপলব্ধি করেন, তিনি কিভাবেই বা কাউকে হত্যা করাতে পারেন, কিংবা
হত্যা করতে পারেন?
|
||||
|
২২ |
মানুষ
যেমন পুরোনো বস্ত্র ফেলে দিয়ে নতুন বস্ত্রে অঙ্গ সাজায়, আত্মাও ঠিক সেইভাবেই
পুরোনো শরীর ত্যাগ করে, নতুন শরীর গ্রহণ করেন। |
||||
|
২৩-২৫ |
এই
আত্মাকে অস্ত্র দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা যায় না, আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যায় না। জল আত্মাকে
ভেজাতে পারে না, বাতাস শুষ্ক করতেও পারে না। এই আত্মা নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির,
অচল এবং সনাতন। এই আত্মা সকল ইন্দ্রিয়ের
অগোচর, ইনি চিন্তার অতীত, রূপান্তরহীন নির্বিকার – জ্ঞানীগণ এমনই বলে থাকেন।
অতএব এতসব জেনেও তোমার এমন অনুতাপ করা উচিৎ নয়।
|
||||
|
২৬ |
আর যদি
এমনও মনে করা যায় যে, দেহের সৃষ্টিতে আত্মার সৃষ্টি, আর দেহের বিনাশেই আত্মার
মৃত্যু, তাতেও, হে মহাবীর, তুমি অনুতাপ করতে পারো না।
|
||||
|
২৭ |
কারণ,
জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত এবং মৃত ব্যক্তির পুনর্জন্মও নিশ্চিত। অতএব
প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা অবশ্যম্ভাবী, তা নিয়ে তোমার অনুতাপ করা উচিত নয়। |
||||
|
২৮ |
হে
অর্জুন, জীবের শরীর জন্মের আগে ছিল না, মৃত্যুর পরেও থাকবে না। থাকে শুধু মধ্যবর্তী
বর্তমানে। তার জন্যে এত শোক করছ কেন?
|
||||
|
২৯ |
কেউ কেউ
এই আত্মাকে দেখে আশ্চর্য হন। কেউ কেউ এই আত্মাকে আশ্চর্য বর্ণনা করেন। আরও কেউ
এই আত্মাকে আশ্চর্যরূপে শুনতে পান। আবার কেউ শুনে, বলে বা দেখেও ঠিক বুঝতে পারেন
না। [যিনি
আত্মাকে দেখেছেন তিনি আশ্চর্য। যিনি আত্মতত্ত্ব উপদেশ দেন বা শোনেন তিনিও
আশ্চর্য। এই ধরনের আশ্চর্য জ্ঞানী কদাচিৎ দু একজনই হয়। (শাংকরভাষ্য)।] |
||||
|
৩০ |
সমস্ত
জীবের দেহে বসতি করেন যে আত্মা তাঁকে হত্যা করা যায় না। কাজেই শুধুমাত্র
জীবদেহের জন্য তোমার এই শোক, তোমাকে মানায় না। |
||||
|
৩১ |
আর
স্বধর্মের কথাই যদি বলো, হে অর্জুন, তাও তোমার বিচলিত হওয়া উচিৎ নয়। কারণ
ক্ষত্রিয়ের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ করার চেয়ে মঙ্গলজনক কাজ আর কিছুই
হতে পারে না। |
||||
|
৩২ |
হে
পার্থ, তুমি একজন ভাগ্যবান ক্ষত্রিয়, কারণ স্বর্গের উন্মুক্ত দরজার মতো এমন
ধর্মযুদ্ধ করার সুযোগ, এত সহজেই তুমি পেয়ে গেছ।
|
||||
|
৩৩ |
আর তুমি
যদি এই ধর্মযুদ্ধ না করো, তাহলে নিজের ধর্ম এবং কীর্তি হারিয়ে, তোমার পাওনা হবে
অধর্ম, আর অকীর্তির নিন্দা। |
||||
|
৩৪ |
তাছাড়াও
তোমার এই অকীর্তির কথা চিরকাল সকলে বলতে থাকবে। তোমার মতো সম্মানীয় মানুষের পক্ষে
এমন অখ্যাতি, মৃত্যুর থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর।
|
||||
|
৩৫ |
রণক্ষেত্রে
উপস্থিত মহাবীরগণ মনে করবেন, ভয় পেয়েই তুমি যুদ্ধ করছো না। যাঁরা এতদিন তোমায়
সম্মান করে এসেছেন, তাঁরাই এখন তোমায় উপহাস করবেন। |
||||
|
৩৬ |
তোমার
শত্রুরাও সুযোগ পেয়ে তোমার ক্ষমতার নিন্দা করে অনেক অকথা কুকথা বলবে। এর চেয়ে
বেশী দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে?
|
||||
|
৩৭ |
এই
যুদ্ধে প্রাণ হারালে তোমার স্বর্গলাভ হবে, জয়ী হলে তোমার রাজ্যলাভ হবে। সুতরাং
হে কুন্তীপুত্র অর্জুন, যুদ্ধের জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে প্রস্তুত হও। |
||||
|
৩৮ |
সুখ-দুঃখ,
লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়ের মধ্যে কোন ব্যবধান মনের মধ্যে না রেখে ধর্মযুদ্ধে্র জন্য
প্রস্তুত হও। তাহলেই স্বজন হত্যার কোন পাপ আর তোমাকে স্পর্শ করবে না। |
||||
|
৩৯ |
হে
পার্থ, যে জ্ঞান থেকে পরমাত্মাতত্ত্ব সম্যক ভাবে বোঝা যায় তাকে বলে সাংখ্য।
এতক্ষণ তোমাকে জন্ম-মৃত্যুর সুখ-দুঃখ শোক-মোহ বিনাশকারী যে আত্মতত্ত্ব বর্ণনা
করলাম, এটাই সাংখ্য। এখন তোমাকে কর্মযোগের কথা বলছি, শোনো। ফলের আশা ছেড়ে ধর্ম
অনুসারী কাজ করাকেই কর্মযোগ বলে। নিষ্কাম কর্মযোগের এই তত্ত্ব বুঝতে পারলে, তোমার
মন থেকে সমস্ত ভেদাভেদ দূর হয়ে যাবে। |
||||
|
৪০ |
নিষ্কাম
কর্মযোগে কোনো প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয় না এবং কোন পাপও হয় না। খুব সামান্য নিষ্কাম
কর্মযোগেও জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখময় সংসারের মহাভয় থেকে মুক্ত থাকা যায়। |
||||
|
৪১ |
হে
কুরুনন্দন, নিষ্কাম কর্মযোগে একনিষ্ঠ প্রত্যয়বুদ্ধির উদয় হয়। আর যেহেতু কামনার
কোনো সীমা নেই, তাই যারা ফলের আশায় কর্ম করে, তাদের বুদ্ধি বহুদিকে বিক্ষিপ্ত
হয়ে থাকে। |
||||
|
৪২-৪৪ |
হে
পার্থ, অজ্ঞ লোকেরা বেদের নীতি ছাড়া অন্য কিছুই মানে না, তাদের বিশ্বাস, একমাত্র
স্বর্গলাভের জন্যই সকল কর্ম করা উচিৎ। তারা কামনাপরায়ণ ও স্বর্গকামী। এই ধরনের
ব্যক্তি জন্মান্তরের কর্মফল থেকে শুরু ক’রে, ভোগ ও ঐশ্বর্যলাভের জন্য নানান
কর্মযোগের কথা খুব সুন্দর ব্যাখ্যা ক’রে থাকেন। যে ব্যক্তি ভোগ ও ঐশ্বর্যের
প্রতি লোভী, সে কখনই একনিষ্ঠ হতে পারে না। |
||||
|
৪৫ |
হে
অর্জুন, বেদ সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ এই তিনগুণের কার্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ
বেদ ফলের কামনায় কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তুমি জন্ম-মৃত্যু,
সুখ-দুঃখের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও। তিনগুণের কর্ম অনুসরণ না করে সর্বদা
সত্ত্বগুণ অনুসরণ করো। যা তোমার নেই তা পাওয়ার জন্য যোগ এবং পাওয়া বস্তু রক্ষার
জন্য যে ক্ষেম – এই দুই কর্মের চিন্তাই তুমি ত্যাগ করে আত্মস্থ হও।
|
||||
|
৪৬ |
বন্যার
জলে সমস্ত এলাকা যখন ভেসে যায়, কূপ এবং ছোটখাটো জলাশয়ও প্রয়োজনীয় জলে ভরে ওঠে।
ঠিক তেমনই নিষ্কাম কর্মের চিত্তশুদ্ধিতে যে পরম আনন্দলাভ হয়, তাতে বেদে বর্ণিত
সমস্ত কাম্য কর্মের ফলও উপলব্ধি করা যায়। |
||||
|
৪৭ |
তোমার
অধিকার শুধুমাত্র কাজ করায়, কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কর্মফলের প্রত্যাশায় যেমন
কোন কাজ করা উচিৎ নয়, তেমনই তোমার কর্মত্যাগের মতিও যেন না হয়। |
||||
|
৪৮ |
হে
ধনঞ্জয়, ফলের কামনা ছেড়ে, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতাকে একইভাবে গ্রহণ করে, একনিষ্ঠ
যোগে সকল কাজ করতে থাক। যে কোন কর্মফলে মনকে নির্বিকার রাখাই হল যোগ।
|
||||
|
৪৯ |
ফলের
কামনার জন্য কর্ম, নিষ্কাম কর্মের থেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট। কাজেই তুমি
সত্ত্ববুদ্ধিতে কামনা বিহীন কর্ম করো। কারণ যারা কিছু পাওয়ার আশায় কাজ
করে তারা খুবই কৃপণ। |
||||
|
৫০ |
নিষ্কাম
কর্মযোগী পুণ্য ও পাপের বোধ থেকে এই জীবনেই মুক্ত হয়ে যান। সুতরাং তুমি নিষ্কাম
কর্ম করতে থাক। নিষ্কাম কর্মের কৌশলকেই যোগ বলে। পুণ্য কিংবা পাপ, জন্ম কিংবা
মৃত্যুতে মনের সমভাবকেই নিষ্কাম কর্মের কৌশল বলে। |
||||
|
৫১ |
নিষ্কাম
কর্মযোগী মনীষিগণ তাঁদের কাজের সকল ফল ত্যাগ করে জন্ম-মৃত্যুর বাঁধন থেকে মুক্ত
হয়ে থাকেন এবং জগতের সমস্ত উপদ্রবের ঊর্ধে নিরঙ্কুশ ব্রহ্মপদে উত্তীর্ণ হন।
|
||||
|
৫২ |
যেদিন
তোমার চিন্তা সমস্ত আসক্তি ও মোহের করাল গ্রাস অতিক্রম করে যাবে, সেদিন শাস্ত্রে
যত কর্মফলের কথা তুমি শুনছ কিংবা শুনেছ, সে সব তোমার কাছে অর্থহীন প্রলাপ বলে
মনে হবে। |
||||
|
৫৩ |
কর্মফল
সম্পর্কে নানান মতামত শুনে তোমার চিত্ত এখন বিক্ষিপ্ত। যেদিন তোমার উপলব্ধিতে
পরমাত্মা্র স্বরূপ অচঞ্চল স্থায়িরূপ নেবে, সেদিন তোমার পরম তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ
যোগ লাভ ঘটে যাবে। |
||||
|
৫৪ |
অর্জুন
বললেন – হে কেশব, সমাধিতে অবস্থান করা স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষকে কিভাবে চিনতে পারব,
তাঁরা কি ভাষায় কথা বলেন, কিভাবে থাকেন আর তাঁর চালচলনই বা কেমন হয়? |
||||
|
৫৫ |
শ্রীভগবান
বললেন – হে পার্থ, পরমাত্মার অনুভূতিতে যাঁর নিজের আত্মা সন্তুষ্ট হয়ে ওঠে এবং
মনের সমস্ত কামনা বাসনা যিনি সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেন, তাঁকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলে।
আত্মার কোন বাসনা হয় না, বাসনা থাকে শুধুমাত্র মানুষের মনে। |
||||
|
৫৬ |
যিনি
দুঃখের সময় উদ্বেগ করেন না, যিনি সুখের সময় উদাসীন থাকেন, যিনি সমস্ত আসক্তি, ভয়
এবং ক্রোধ জয় করতে পেরেছেন, সেইরকম
মননশীল যোগীকেই স্থিতধী বা স্থিতপ্রজ্ঞা মুনি বলা হয়। |
||||
|
৫৭ |
কোন
বিষয়েই যাঁর কোন অনুরাগ নেই, ভাল বা মন্দ কোন কারণেই যিনি আনন্দিত হন না বা দুঃখ
অনুভব করেন না, তাঁর অন্তরে স্থিতপ্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলা যায়।
|
||||
|
৫৮ |
কচ্ছপ
যেমন ভয় পেলে তার খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, একজন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিও
তেমনি সমস্ত বিষয় থেকেই নিজের সকল ইন্দ্রিয়কে নিরস্ত এবং সংযত রাখতে পারেন।
|
||||
|
৫৯ |
অসমর্থ
জড় কিংবা আতুর ব্যক্তি বিষয় উপভোগে অসমর্থ হলেও, তাদের বিষয়ের প্রতি আসক্তি
থেকেই যায়, তারা স্থিতপ্রজ্ঞ হতে পারে না। পরমাত্মাকে অনুভবের পর,
স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষের বিষয়ের প্রতি আসক্তি ও ভোগের ইচ্ছা দুইই লোপ পায়। |
||||
|
৬০ |
হে কুন্তীপুত্র,
মানুষের ইন্দ্রিয়গুলি মানুষের মনকে সর্বদা চঞ্চল ও বিক্ষিপ্ত করার কাজেই ব্যস্ত।
বহু একনিষ্ঠ জ্ঞানী পুরুষের মনকেও এই ইন্দ্রিয়সকল দুর্বল করে তুলতে পারে।
|
||||
|
৬১ |
যে যোগী
ব্যক্তি এই সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করে, আত্মস্থ ও একনিষ্ঠ থাকতে পারেন, সমস্ত
ইন্দ্রিয় যাঁর বশীভূত, তাঁর স্থিতপ্রজ্ঞা সুনিশ্চিত।
|
||||
|
৬২ |
বিষয়ের
কথা চিন্তা করতে করতে বিষয়ের উপর আসক্তি তৈরি হয়, আসক্তি থেকে কামনার জন্ম হয়,
আর কামনা থেকেই আসে ক্রোধ।
|
||||
|
৬৩ |
ক্রোধ
থেকে জন্ম নেয় মোহ, ভালো মন্দ বিবেচনার শক্তি লোপ পায়। মোহ থেকে আসে
স্মৃতিবিভ্রম। স্মৃতিনাশ থেকে বুদ্ধিনাশ হয়, শুভ অশুভ বিচারের বুদ্ধি লোপ পায়।
বুদ্ধিনাশ হলে মানুষ মনুষ্যত্বই হারিয়ে ফেলে। |
||||
|
৬৪ |
একজন
সংযত মনের মানুষ, আসক্তি ও হিংসা ত্যাগ করে, ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজের সংযমে রেখে, দেহধারণের
জন্য একান্ত জরুরি সকল বিষয় উপভোগ করেও প্রসন্নতা লাভ করতে পারেন।
|
||||
|
৬৫ |
প্রসন্ন
চিত্ত মানুষের বুদ্ধি অবিলম্বে পরমপুরুষের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়, এবং তাঁর অনুগ্রহে
সকল দুঃখের অবসান হয়। [মানুষের
জীবনে তিন ধরনের দুঃখ উপস্থিত হতে পারে। আধ্যাত্মিক – মানসিক বা দৈহিক ব্যাধিজনিত
দুঃখ, আধিদৈবিক – ঝড়, বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণ জনিত দুঃখ এবং আধিভৌতিক –
সাপ, বিছে ইত্যাদির দংশন জনিত কষ্ট।] |
||||
|
৬৬ |
অপ্রসন্ন
চিত্ত মানুষের আত্ম উপলব্ধি হয় না, আত্ম উপলব্ধিহীন মানুষের পরমার্থ চিন্তায়
অনুরাগ জন্মায় না। পরমার্থ চিন্তাহীন ব্যক্তির বিষয়তৃষ্ণার শান্তি হয় না। যে
ব্যক্তি বিষয়ের প্রতি আসক্ত তার প্রকৃত সুখ কোথায়? |
||||
|
৬৭ |
জলে
ভাসমান নৌকাকে বাতাস যেমন বিক্ষিপ্ত করে তোলে, তেমনই ইন্দ্রিয়ের বশীভূত চিত্ত
যদি ইন্দ্রিয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব মেনে নেয়, তাহলে সেই চিত্ত মানুষের বিবেক বোধকে
বিভ্রান্ত করতে থাকে।
|
||||
|
৬৮ |
সেই
কারণে, হে মহাবীর, যে ব্যক্তি সকল বিষয়ের থেকে ইন্দ্রিয়কে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত
করতে পেরেছেন, তিনিই প্রকৃত স্থিতপ্রজ্ঞ। |
||||
|
৬৯ |
অজ্ঞানের
অন্ধকারে সাধারণ মানুষ যে সময়কে রাত্রি মনে করে, সেই সময় স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি
জেগে থাকেন, আর সাধারণ মানুষ বিষয়ের আলোয় যে সময় জেগে থাকে, স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি
সেই সময়কে রাত্রি মনে করেন। |
||||
|
৭০ |
সমস্ত নদীর জল সাগরে মিশলেও বিপুল সাগরের যেমন কোন পরিবর্তন হয় না, তেমনি সমস্ত বিষয় কামনা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে বিলীন হলেও তিনি শান্ত থাকেন। কিন্তু কামনায় অভিভূত সাধারণ মানুষ কখনো শান্তি পায় না। |
||||
|
৭১ |
যে
ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করে নির্বিকার, নিরহঙ্কার এবং সমস্ত বিষয়ের প্রতি
আসক্তি মুক্ত হয়ে থাকতে পারেন, তিনিই পরম শান্তি লাভ করেন।
|
||||
|
৭২ |
হে
পার্থ, এই রকম একনিষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞান যে ব্যক্তি লাভ করতে পারেন, সংসারের কোন
বিষয়ের প্রতি তাঁর কোন মোহ অবশিষ্ট থাকতে পারে না। এই নিষ্ঠা নিয়ে মৃত্যু হলেও
তিনি পরমব্রহ্মে মিলিত হন।
|
||||
সাংখ্যযোগ
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন