শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

গেলেম নতুন দেশে

 

এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মাস দুয়েক পরেই ফাইন্যাল – মাধ্যমিক পরীক্ষা। জীবনের পহেলা পারাও। এবারের পরীক্ষা ক্লাসের তিন সেকশনের নব্বইজন সহপাঠীদের মধ্যে সীমিত নয়। আসমুদ্রহিমাচল বঙ্গবাসী সকল সহপাঠীদের মধ্যে – তার সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষাধিক। এই পরীক্ষা যেন ময়দান – এ – জঙ্গ! কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। নিরপেক্ষ বিচারক – যাঁর সঙ্গে আমাদের কারুর প্রত্যক্ষ কোন পরিচয় নেই। আড়ালে থেকে আমাদের জন্যে কোয়েশ্চেন সেট করবেন, আড়ালে থেকেই আমাদের অ্যানসারশীট দেখে নম্বর বসিয়ে দেবেন। আমাদের নম্বর প্রাপ্তি থেকেই বোঝা যাবে কার কত বিদ্যের দৌড়!

আমাদের মধ্যে যতটা উত্তেজনা ছিল, ততটা দুশ্চিন্তা ছিল না। দুশ্চিন্তা ছিল বাবা মায়ের। বাবা অফিস থেকে নিত্য নতুন ঘটনা শুনে আসতেন – আর সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে রোজ মায়ের কাছে গল্প করতেন –

-‘আজ মল্লিকদা যা বলল না, শুনলে শিউরে উঠবে’!

-‘কি, গো’?

-‘বছর কয়েক আগে, পরীক্ষা শেষ হবার চার-পাঁচ দিন পরেই, এক গাদা পরীক্ষার খাতা সোদপুরের এক মুদির দোকানে নাকি পাওয়া গিয়েছিল’

-‘বলো কি? কি করে ধরা পড়ল’?   

-‘একজন ছেলে ঐ দোকান থেকে চিনি কিনে ফিরছিল, হঠাৎ হাতের ঠোঙায় চোখ পরতে তার সন্দেহ হয়। ঘরে এসে ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়-ওইবারেরই পরীক্ষার খাতার একটা পাতা। কারণ ওই ছেলেটিও মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল সেবার-’।

-‘সর্বনাশ, তারপর কি হল’?

-‘এর আবার কিছু হয় নাকি? ছেলেটার বাবা-মা পাড়ার লোকজন নিয়ে থানায় গিয়েছিল, সেখান থেকে দোকানে। বেশ কিছু খাতা উদ্ধার হয়েছিল – বাকি....ওই আর কি...তদন্ত চলছে’।

-‘আর চিনির ঠোঙা...’?

-‘সে আর কি হবে, কিছু একটা নম্বর পেয়ে পাস হয়ে যাবে...’।

-‘ইস, ছেলেটি যদি ভালো ছেলে হয়, হয়তো আশা করে থাকবে ভালো নম্বরের, শেষে কিনা শুধু পাস নম্বর...ছি ছি...’

-‘তা ঠিক, আর যদি তোমার ঘুনুসোনার অঙ্ক খাতা হয়, তাহলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে..., কি বলিস রে, পান্না’? বাবার কথার শ্লেষটা শেষমেষ আমার দিকেই এল! আমি কিছু বলার আগেই, মা বলে উঠলেন –

-‘এই তিন সন্ধ্যেবেলায় অলুক্ষণে কথা তোমার মুখে দেখি আটকায় না। যাও, যাও, মুখ হাত ধুয়ে নাও, মুড়ি মাখছি...আমার আবার রাতের রান্না আছে’।

 

বাবা হাসতে হাসতে বাথরুমে চলে যেতে, মা করুণ চোখে, প্রায় চুপিচুপি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যারে, ঘুনু, অঙ্কটা খুব শক্ত লাগে, না? কিচ্ছু পারছিস না?’ 

আমি খুব গম্ভীরভাবে মাকে বলেছিলাম, ‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না তো, মা। বাবা সবেতেই একটু বাড়িয়ে বলে...’। আমার উত্তর শুনে মা কতটা নিশ্চিন্ত হলেন জানি না, তবে সন্ধ্যাদীপ আর ধূপ জ্বলা ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে জোড়হাতে নমস্কার করে বললেন, -‘দুগ্‌গা, দুগ্‌গা, সব ঠিক মতো দেখো, মা’।

 

মা রান্না ঘরে চলে গেলেন জলখাবারের জোগাড় করতে। আমার ওপর বাবার অনাস্থায় আমার মধ্যে কোন ব্যতিক্রম আসে নি, কিন্তু মা আমাকে অগাধ বিশ্বাস করে সেদিন আমাকে বিপন্ন করে দিয়ে গেলেন...।

 সারাদিন পড়া পড়া খেলা খেলতে খেলতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। মায়ের নিরন্তর তাগিদ, বাবার একটা দুটো মন্তব্য – সে সময় পড়তে বসা ছাড়া পরিত্রাণ ছিল না। কিন্তু এও দেখেছিলাম সারাটা সকাল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মুখ্য কারণ মুখস্থ করার পর – বেলা বারোটা নাগাদ অওরঙজেবের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা গুলিয়ে ফেলেছিমনে হত সারাটা সকাল ধরে পড়া ইতিহাস বইয়ের অক্ষরসমূহ আমার মাথার মধ্যে একটাও নেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আমার চেয়ারের চারপাশে – মেঝেয় এবং ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই।

এহেন সময়ে একদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ স্কুলের এক বন্ধু এসে আমাদের বাসায় উদয় হল। আমাকে বলল, ‘জয়ন্তর বাড়ি যাবো, চ। ওর কাছে অঙ্কের সাজেসান আছে, টুকে আনতে হবে। ওই সাজেসান থেকে নাকি নব্বই ভাগ অঙ্ক আসবেই...কাজেই এমন সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না...’।

 

আমার মায়ের দেওয়া মিষ্টি আর জল খেতে খেতে মাকে আমার সম্বন্ধে এমন সব সোনালী মন্তব্য সে করতে লাগল, শুনে মা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কাজেই আমি যখন বাইরে বেরোনোর জন্য রেডি হলাম, মা আমার হাতে গুঁজে দিলেন পাঁচ টাকার একটি নোট।  

 পথে বেরিয়ে আমার সেই বন্ধুটি বলল জয়ন্তর বাড়ি নয় আমাদের গন্তব্য ধর্মতলা – ‘নিউ এম্পায়ার’ সিনেমা। সেখানে ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ চলছে। দারুণ সিনেমা। বীভৎস ভয়ের বই। আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে নাকি হলের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স রাখা থাকত, এই সিনেমা চলাকালীন – ভয় পেয়ে অসুস্থ লোকেদের হসপিটালে ক্যারি করার জন্যে। আমরা ভারতীয়রা তো খুব ডরপুক, তাই অনেক সিন নাকি কেটে দিয়েছে। কিন্তু তাও যা আছে সেও বড়ো কম নয়।

মাথা নীচু করে আমি শুনতে লাগলাম ওর কথা। দোলাচলে আমার মন তখন বিভ্রান্ত। এক, মায়ের সঙ্গে এহেন মারাত্মক শঠতা আমার এই প্রথম। কোনমতেই এটা উচিৎ কর্ম হলো না। ফিরে যাবো কিনা ভাবছিলাম। অন্যদিকে বাড়ির বন্ধন থেকে মুক্তি। সারাটাদিন পড়া আর পড়া্র একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। তার সঙ্গে বাড়ির অজানিতে সিনেমা দেখার অনাস্বাদিত রোমাঞ্চ। কাজেই, ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা ঠিক দানা বেঁধে উঠল না, বরং ট্রাম ধরে ধর্মতলার মোড়ে নেমে, বাকিটা হেঁটে, পৌঁছে গেলাম নিউ এম্পায়ারের আঙ্গিনায়। 

 

সেখানে পৌঁছে দেখি আরো দুই বন্ধু আমাদের জন্যে অপেক্ষারত। অর্থাৎ এই প্রথম চারজনে একত্র হওয়া গেল স্কুলের বাইরে, একবারে এই নতুন সাম্রাজ্যের গন্ডিতে। আমাদের এক বন্ধু সিগারেট কিনেছিল, প্যাকেট থেকে একটা নিজে নিয়ে সে খুব মুরুব্বি চালে ‘খাবি নাকি’, বলে আমাদের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল। উইল্‌স্‌ ফ্লেকের প্যাকেট – হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম তাতে তিনটেই আছে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে সকলেই একটা করে সিগারেট নিলাম। তারপর পাশের সিগারেটের দোকানের একটু তফাতে টাঙানো নারকেলের দড়ি থেকে ধরিয়ে নিলাম নিজের নিজের সিগারেট। মোটেই কোন মজা পেলাম না। তামাক আর কাগজের পোড়া গন্ধে নিঃশ্বাস আর মুখের ভিতরটা কেমন অদ্ভূত বিস্বাদ হয়ে উঠল। কিন্তু ছাড়লাম না সিগারেটটা, কারণ স্বাদটা বড় কথা নয়, সেদিন নিউ এম্পায়ারের সামনে, সমস্ত কিছু মিলিয়ে আমরা এক নতুন জীবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলামসেই দরজা যেন আলগা ভেজানো - আমাদের হাতের অল্প ছোঁয়ায় উন্মুক্ত হতে যা দেরি।

 

সিগারেট শেষ করে আমরা ঢুকে পড়লাম নিউএম্পায়ারের পঁচাত্তর পয়সার খাঁচার লাইনে। লোহার শক্ত কাঠামো দিয়ে তৈরি সংকীর্ণ পিঞ্জরপথ। একজনের বেশী পাশাপাশি দাঁড়ানো যায় না। পৌনে এগারোটায় আমরা যখন সেই খাঁচায় ঢুকলাম, আমাদের সামনে অন্ততঃ জনা চল্লিশেক সিনেমারসিক ছিলেননুন শোর শুরু বেলা বারোটায়, টিকিট দেওয়া শুরু হবে তার মিনিট পনের কুড়ি আগে। কাজেই ওই আবদ্ধ অবস্থায় অভিজ্ঞ সিনেমা রসিকদের থেকে জ্ঞান আহরণ করা ছাড়া, আমাদের চারজন শিক্ষানবিশের তখন আর কিছুই করার ছিল না।

 

পৃথিবীতে কোন পাণ্ডিত্যই বোধহয় অবিতর্কিত নয়, বিভিন্ন পণ্ডিতের বিপরীত মতামতের জন্যেই যে কোন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দুরূহ। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। কলকাতার ওই অঞ্চলের বিভিন্ন সিনেমা হলের পঁচাত্তর পয়সার টিকিটে সিট সংখ্যা কত এ নিয়ে সেদিন বিস্তর আলোচনা শুনেছিলাম। নিউ এম্পায়ারের সিট সংখ্যা নিয়ে বেশ কজন সিনেমারসিকদের বাকবিতণ্ডায় আমরা যথোচিত বিভ্রান্ত হতে পেরেছিলামকেউ বলেছিল মেরে কেটে শতখানেক হবে, কেউ বলেছিল আড়াইশ, আরেকজন গম্ভীরভাবে বলেছিল – একশ আটান্ন। যে একশ আটান্ন বলেছিল, সে কতগুলো রো এবং প্রত্যেক রোতে কতগুলো সিট - তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে, জটিল অঙ্কের হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে একশ আটান্ন!

-‘আড়াইশো হোক অথবা শতখানেক, আমরা তো টিকিট পাবোই, কি বলেন - আমাদের আগে তো জনা চল্লিশেক হবে মেরেকেটে’? আমাদের এক বন্ধু, আসন-বিতর্ক থেকে মুক্তি পেতে বলে ফেলেছিলতাতে ফল হয়েছিল একদম উল্টো, আশেপাশের সক্কলে নানান সুরে এবং স্বরে এমন হেসে উঠল, আমরা হতবাক। হাসির গমক কমতে একজন খুব স্নেহমাখা স্বরে আমাদের বলল –

-‘ভাইয়েরা বুঝি এ লাইনে, নতুন? একটু দাঁড়ান - টিকিট কাউন্টার খোলার সময় হলেই দেখবেন মজাটা মাথায় হাঁটু দিয়ে তালতলা আর জানবাজারের ছেলেরা সবাই কেমন সামনে চলে যাবে, তারা যদি সমস্ত টিকিট না নিয়ে নেয়...’ এই অব্দি বলেই সে ভদ্রলোক থেমে গেল। আমরা স্বাভাবিকভাবেই খুব মুষড়ে পড়লাম, বাড়িতে এত মিথ্যে বলে, এতদূর এসেও সিনেমা দেখা হবে না! আমার মনে হল – ঠিকই তো হয়েছে, মাকে মিথ্যে বললে কোন কাজ ভাল হয় না, এই তো তার প্রমাণ! আমি আমার বন্ধুদের বললাম –

-‘এতক্ষণ, বেকার দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, চল কেটে পড়ি’। আমার কথা শুনে আমাদের পিছনে দাঁড়ানো দু-তিন জন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল –

-‘কেটে পড়ব বললেই হবে, পিছনে লাইনটা দেখেছেন, আপনারা বেরোতে পারবেন নাকি’? সত্যি ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের পিছনের সর্পিল পিঞ্জরপথ সদর রাস্তা পর্যন্ত ভরে গেছে – কম করে হলেও শ দুয়েক লোক তো হবেই আমাদের পিছনে...। আর এত সংকীর্ণ খাঁচায় পাশ কাটিয়ে বের হওয়া একরকম অসম্ভব। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে – কি আবার হবে-কপালের লিখন?

 

সেই বদ্ধ খাঁচায় আমরা কতক্ষণ নানান জনের নানান আলাপ শুনতে থাকলাম। বিড়ি, সিগারেটের  ধোঁয়া – মাঝে মাঝে আরেকটি উৎকট ধোঁয়ার গন্ধ (পরে জেনেছিলাম ওটা গঞ্জিকার গন্ধ) শুঁকতে থাকলাম। হঠাৎ মধুচক্রে লোষ্ট্রবৎ - আমাদের সামনে পিছনে সকল মানুষ তৎপর হয়ে উঠল। আর পিছনে শুনতে পেলাম গালাগালির একটা ঢেউ ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। একদল হিন্দীতে, আরেক দল বাংলাতে অশ্রাব্য গালাগাল দিচ্ছে। হিন্দীর প্রচণ্ড দাপট, বাংলা সে তুলনায় অনেকটাই ক্ষীণ।  অনেকক্ষণ শুধু শোনা যাচ্ছিল, এবার দেখাও গেল। জনা পাঁচ – সাত হবে, হাট্টা কাট্টা নেপালি চেহারার ছেলে খাঁচার ভিতরের দিকে লোহার ফ্রেমে দু হাতে ঝুলতে ঝুলতে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। কেউ তাদের বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু তারা দু পায়ে লাথি ছুঁড়ছে অনবরত আর চিৎকার করে হিন্দীতে গালাগাল দিচ্ছে সক্কলকে। তাদের লাথিতে প্রতীক্ষারত লোকগুলো মাথায় ঘাড়ে চোট খেয়ে বাংলায় গাল পাড়ছে। চট করে ইতিহাস উপলব্ধি হল – যারা পরাজিত তাদের গালাগাল বা অভিশাপে কোনদিনই জোর থাকে না...।

 

শেষমেষ তারা আমাদেরও মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বৃষ্টিহীন ঝড়ো মেঘের মতো। আমরা বীরত্বে বিশ্বাসী নই, তাই আগে থাকতেই বসে পড়েছিলাম। কাজেই চোট পেলাম না, তবে গালাগাল শিখলাম বিস্তরওরা সামনে চলে গেলআর কি আশ্চর্য ওরা পৌঁছনোমাত্রই যেন সামনের লোহার গেট খুলে গেল – আর টিকিট কাউন্টারও চালু হয়ে গেল। টিকিট পাব কি-পাব না দুশ্চিন্তায় শনৈঃ শনৈঃ এগোতে এগোতে টিকিট কাউন্টারে পৌঁছনো গেল – আর কি অবাক কাণ্ড লটারির টিকিটের মতোই টিকিটও হাতে চলে এলো...

 

মুঠিতে টিকিট নিয়ে এবার দৌড়, সিঁড়ির পর সিঁড়ি পার হয়ে আমরা উঠতেই লাগলাম। বেলা বারোটাতেও সে সিঁড়ি আধো অন্ধকার...। টিকিট তো হয়েছে এবার আসন দখলের পালা। সিট নাম্বার নেই- যে আগে যাবে সেই পাবে ভালো সিটগুলি। কাজেই দৌড়, দৌড়...এ এক নতুন জীবনের পাঠ – এরপর ট্রেনে-বাসে-সিনেমাহলে সর্বত্র অন্যকে ঠেলেঠুলে, ধাক্কা মেরে উঠতে থাকব, উঠতেই থাকব...

--০০--

কঠোপনিষদ - ২/১

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

প্রথম বল্লী

 

পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূস্তস্মাৎ পরাঙ্‌ পশ্যতি নান্তরাত্মন্‌।

কশ্চিদ্ধীরঃ প্রত্যগাত্মানমৈক্ষদ্‌ আবৃত্তচক্ষুরমৃতত্বমিচ্ছন্‌।।

২/১/১

পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূঃ তস্মাৎ পরাঙ্‌ পশ্যতি না অন্তরাত্মন্‌।

কশ্চিৎ ধীরঃ প্রত্যক্‌-আত্মানম্‌ ঐক্ষৎ আবৃত্ত-চক্ষুঃ অমৃতত্বম্‌ ইচ্ছন্‌।।

 

[পরাঞ্চি> বহির্মুখ, খানি> ইন্দ্রিয়সমূহ, ব্যতৃণৎ>সৃষ্টি করিয়াছেন।] স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর জীবের ইন্দ্রিয়সমূহকে বহির্মুখ করে সৃষ্টি করেছেন। এই কারণে জীব বাহ্য বিষয়সমূহকেই দেখে থাকে, অন্তরের বিষয় দেখতে পায় না। কোন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভের ইচ্ছায় বাইরের বিষয় থেকে চক্ষু আদি ইন্দ্রিয়সমূহকে নিবৃত্ত করে, অন্তরের আত্মাকে দর্শন করতে পারেন।

ইন্দ্রিয়সমূহ মানুষের জ্ঞানের দ্বারস্বরূপ। কিন্তু এই দ্বার যেন শুধু বাইরের দিকেই খোলে – ভেতরের দিকে নয়। সেই কারণে সে কেবল বাইরের জগৎ-লীলা সম্পর্কে অবহিত হয় – কিন্তু অন্তরের জীবাত্মাকে দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারে না। অতএব সে দেহকেই আত্মা বলে মনে করে এবং কামনা-বাসনায় বিভ্রান্ত হয়ে দেহেরই সেবা করে। প্রকৃতপক্ষে সে অজ্ঞান এবং জীবন-মৃত্যুর চক্রে বারবার এই মর্ত্য জগতেই ফিরে ফিরে আসে।   

  

পরাচঃ কামাননুযন্তি বালাস্তে মৃত্যোর্যন্তি বিততস্য পাশম্‌।

অথ ধীরা অমৃতত্বং বিদিত্বা ধ্রুবমধ্রুবেষ্বিহ ন প্রার্থয়েন্তে।। ২/১/২

পরাচঃ কামান্‌ অনুযন্তি বালাঃ তে মৃত্যোঃ যন্তি বিততস্য পাশম্‌।

অথ ধীরা অমৃতত্বং বিদিত্বা ধ্রুবম্‌ অধ্রুবেষু ইহ ন প্রার্থয়েন্তে।। ২/১/২

বালকের তুল্য অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিরা বাইরের কামনার বিষয়সমূহে প্রবৃত্ত থেকে মৃত্যুর বিস্তৃত জালে আবদ্ধ হয়। কিন্তু বিবেকী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অমৃতত্বকে উপলব্ধি করে, ওই অনিত্য কামনার বিষয় প্রার্থনা করেন না।

 

যেন রূপং রসং গন্ধং শব্দান্‌ স্পর্শাংশ্চ মৈথুনান্‌।

এতেনৈব বিজানাতি কিমত্র পরিশিষ্যতে।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৩

যেন রূপম্‌ রসম্‌ গন্ধম্‌ শব্দান্‌ স্পর্শান্‌ চ মৈথুনান্‌।

এতেন এব বিজানাতি কিম্‌ অত্র পরিশিষ্যতে।

এতৎ বৈ তৎ।।

যিনি এই আত্মাকে উপলব্ধি করে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ এবং মৈথুন উপভোগ করতে পারেন, তাঁর কাছে আর কোন বিষয় জানতে অবশিষ্ট থাকতে পারে? ইনিই (আত্মা) সেই পরমপদ।  

 

স্বপ্নান্তং জাগরিতান্তং চোভৌ যেনানুপশ্যতি।

মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি।। ২/১/৪

স্বপ্ন-অন্তম্‌ জাগরিত-অন্তম্‌ চ উভৌ যেন অনুপশ্যতি।

মহান্তং বিভুম্‌ আত্মানং মত্বা ধীরঃ ন শোচতি।।

স্বপ্ন এবং জাগরণ – উভয় অবস্থাতেই যে আত্মার জন্যে আমরা সবকিছু দেখতে পাই, সেই মহান আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারেন যে জ্ঞানী ও বিবেকী, তিনি কোন কিছুতেই আর দুঃখ করেন না। 

 

য ইমং মধ্বদং বেদ আত্মানং জীবমন্তিকাৎ।

ঈশানং ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৫

যঃ ইমম্‌ মধ্বদম্‌ বেদঃ আত্মানম্‌ জীবম্‌ অন্তিকাৎ।

ঈশানম্‌ ভূতভব্যস্য ন ততঃ বিজুগুপ্সতে।

এতৎ বৈ তৎ।।

যিনি এই কর্মফলভোগী আত্মাকে জীবের ভূত-ভবিষ্যতের নিয়ন্তা রূপে, নিজের অন্তরে তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেন, সেই ব্যক্তির কাছে আর কোন বিষয়ই গোপন থাকতে পারে না। ইনিই সেই পরমাত্মা।

 

যঃ পূর্বং তপসো জাতমদ্ভ্যঃ পূর্বমজায়ত।

গুহাং প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তং যো ভূতের্ভিব্যপশ্যত।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৬

যঃ পূর্বম্‌ তপসঃ জাতম্‌ অদ্ভ্যঃ পূর্বম্‌ অজায়ত।

গুহাম্‌ প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তম্‌ যঃ ভূতেভিঃ ব্যপশ্যত।

এতৎ বৈ তৎ।।

জলের আগে যিনি জন্ম নিয়েছেন, প্রথম চিৎশক্তি থেকে যাঁর জন্ম, সর্বজীবের অন্তরে পঞ্চভূতের সঙ্গে যিনি অবস্থান করেন, সেই আত্মপুরুষকে যিনি দেখেছেন, তিনি সেই ব্রহ্মকেই দেখেছেন। ইনিই সেই পরব্রহ্ম।

[ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম – এই পঞ্চভূত থেকে জীবের জন্ম, কিন্তু পঞ্চভূত সৃষ্টির আগে যাঁর জন্ম হয়েছে, তিনিই পরমব্রহ্ম।]   

 

যা প্রাণেন সম্ভবত্যদিতির্দেবতাময়ী।

গুহাং প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তীং যা ভূতেভির্ব্যজায়ত।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৭

যা প্রাণেন সম্ভবতি অদিতিঃ দেবতাময়ী।

গুহাম্‌ প্রবিশ্য তিষ্ঠন্তীম্‌ যা ভূতেভিঃ ব্যজায়ত।

এতৎ বৈ তৎ।।

সর্বদেবতাময়ী অদিতি প্রাণরূপে আবির্ভূত এবং সর্বভূতে সমন্বিত হয়ে, সকল জীবদেহে প্রবেশ করে অধিষ্ঠান করেন। (যিনি তাঁকে দেখেন, তিনি) সেই ব্রহ্মকেই দেখেন।

[অদিতি নামের অর্থ যিনি শব্দ, ঘ্রাণ, বাক্য ইত্যাদিকে ভোগ করেন, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সকল বিষয়সমূহের উপভোক্ত্রী। প্রাণ পঞ্চভূতের উপভোক্তা – অতএব অদিতি ও প্রাণ সমার্থক। ] 

 

অরণ্যোর্নিহিতো জাতবেদা

গর্ভ ইব সুভৃতো গর্ভিণীভিঃ।

দিবে দিব ঈড্যো জাগৃবদ্ভির্হবিষ্মদ্ভির্মনুষ্যেভিরগ্নিঃ।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৮

অরণ্যোঃ নিহিতঃ জাতবেদা

গর্ভঃ ইব সুভৃতঃ গর্ভিণীভিঃ।

দিবে দিব ঈড্যো জাগৃবদ্ভিঃ

হবিষ্মদ্ভিঃ মনুষ্যেভিঃ অগ্নিঃ।

এতৎ বৈ তৎ।।

গর্ভিণীর কাছে যেমন গর্ভ, দুই অরণির মধ্যে জাতবেদ অগ্নি তেমনই সুরক্ষিত থাকেন। জাগ্রত-চৈতন্য এবং যজ্ঞকুশল যোগীরা প্রত্যেক দিন সেই অগ্নির আরাধনা করেন। সেই অগ্নিও এই ব্রহ্ম।

[যাজ্ঞিক ঋষিরা দুই টুকরো কাঠ ঘষে আগুন জ্বালাতেন, তার নাম অরণী। উপরের টুকরোর নাম উত্তর অরণী এবং নিচের টুকরোর নাম অধর অরণী। “জাতবেদা” শব্দের এক অর্থ অগ্নি, অন্য অর্থ সৃষ্টির সকল তত্ত্ব যিনি জানেন। অতএব অগ্নিই সেই পরমপুরুষ।]     

 

যতশ্চোদেতি সূর্যোঽস্তং যত্র গচ্ছতি।

তং দেবাঃ সর্বে অর্পিতাস্তদু নাত্যেতি কশ্চন।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/৯

যতঃ চ উদেতি সূর্যঃ অস্তম্‌ যত্র গচ্ছতি।

তং দেবাঃ সর্বে অর্পিতাঃ তৎ উ ন অত্যেতি কঃ চন।

এতৎ বৈ তৎ।।

যাঁর থেকে সূর্য উদিত হন, যাঁতে সূর্য অস্ত যান; সকল দেবতা যাঁকে আশ্রয় করে অবস্থান করেন, কিন্তু কখনই অতিক্রম করতে পারেন না। তিনিই সেই সর্বাত্মক ব্রহ্ম।

 

যদেবেহ তদমুত্র যদমুত্র তদন্বিহ।

মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।

২/১/১০

যৎ এব ইহ তৎ অমুত্র যৎ অমুত্র তৎ অনু ইহ।

মৃত্যোঃ সঃ মৃত্যুম্‌ আপ্নোতি যঃ ইহ নানা ইব পশ্যতি।।

যা কিছু এখানে আছে, তার সব কিছু সেখানে আছে। যা কিছু সেখানে আছে সব এখানেও আছে। যে এই জগৎকে নানা রূপে দেখে, সেই মৃত্যুর পরেও মৃত্যু লাভ করে।

[ব্রহ্ম জগতের সর্বত্র ব্যাপ্ত, এই জগতে ব্রহ্মের ঊর্ধে বা ব্রহ্মের থেকে পৃথক কিছুই নেই। যে ব্যক্তি এই জগৎকে ব্রহ্মের থেকে পৃথক (নানা ইব) বিভিন্ন রূপ মনে করে, সে অজ্ঞানী, তাকে জন্ম-মৃত্যুর সংসারে বারবার ফিরে আসতে হয়।]

 

মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাস্তি কিঞ্চন।

মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।

২/১/১১

মনসা এব ইদম্‌ আপ্তব্যং ন ইহ নানা অস্তি কিঞ্চন।

মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি যঃ ইহ নানা ইব পশ্যতি।।

 

এই জগতে ব্রহ্ম থেকে পৃথক কিছুই নেই, এই তত্ত্বটি শুদ্ধ-সংস্কৃত মন দিয়েই উপলব্ধি করা যায়। যে “জগৎ ব্রহ্মের থেকে যেন পৃথক” এমন দেখে, সে মৃত্যুর থেকেও মৃত্যুর দিকে যায়।

 

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি।

ঈশানো ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে।।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/১২

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি।

ঈশানঃ ভূতভব্যস্য ন ততঃ বিজুগুপ্সতে।

এতৎ বৈ তৎ।।

দেহের অভ্যন্তরে যে অঙ্গুষ্ঠপরিমিত পুরুষ অধিষ্ঠান করেন, তিনি জীবের ভূত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের নিয়ন্তা। এই তত্ত্বটি জানলে সাধক নিজেকে গোপনে রাখতে পারেন না। ইনিই সেই আত্মা।  

 

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ জ্যোতিরিবাধূমকঃ।

ঈশানো ভূতভব্যস্য স এবাদ্য স উ শ্বঃ।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/১/১৩

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ জ্যোতিঃ ইব অধূমকঃ।

ঈশানঃ ভূতভব্যস্য স এব অদ্য স উ শ্বঃ।

এতৎ বৈ তৎ।।

সেই অঙ্গুষ্ঠপরিমিত পুরুষ যিনি তিনকালের নিয়ন্তা, তিনি নির্ধূম জ্যোতিঃ রূপে (অন্তরে) প্রকাশিত। তিনি আজও আছেন, আগামীকালও থাকবেন। ইনিই সেই ব্রহ্ম।

[নির্ধূম মানে বিশুদ্ধ, নির্মল, নিষ্কলঙ্ক।]

 

যথোদকং দুর্গে বৃষ্টং পর্বতেষু বিধাবতি।

এবং ধর্মান্‌ পৃথক পশ্যংস্তানেবানুবিধাবতি।। ২/১/১৪

যথ উদকম্‌ দুর্গে বৃষ্টম্‌ পর্বতেষু বিধাবতি।

এবং ধর্মান্‌ পৃথক পশ্যন্‌ তান্‌ এব অনুবিধাবতি।।

পর্বতের দুর্গম শিখরে বৃষ্টি হলে, জলধারা যেমন নানা দিকে প্রবাহিত হয়, তেমনই যে ব্যক্তি জীবের ধর্ম অনুযায়ী আত্মাকে পৃথক মনে করে, সে ওই বিভেদকেই অনুসরণ করে।

 

যথোদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি।

এবং মুনের্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।। ২/১/১৫

যথা উদকম্‌ শুদ্ধে শুদ্ধম্‌ আসিক্তম্‌ তাদৃক্‌ এব ভবতি।

এবং মুনেঃ বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।।

শুদ্ধ জল যেমন শুদ্ধজলে পড়লে শুদ্ধই থাকে, হে নচিকেতা, জ্ঞানী ব্যক্তির আত্মারও একই ভাব হয় (অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাবই লাভ করেন)

 সমাপ্ত দ্বিতীয় অধ্যায় – প্রথম বল্লী

চলবে...


কৃতজ্ঞতাঃ 

উপনিষদঃ শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন 

উপনিষদ গ্রন্থাবলীঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত  

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

মা হওয়া নয় মুখের কথা

 

গতকাল সময় হয়নি, আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেই মণিমাসি আর সুভামাসি পান্নাকে তুলে আনল, নদিদির কোলের কাছ থেকে। পান্না জেগেই ছিল, মায়ের কোলের কাছে শুয়ে হাতপা ছুঁড়ছিল, আর মুখে নানান আওয়াজ করছিল। মণি যখন তাকে হুস করে কোলে তুলে নিল, প্রথমে একটু অবাক হলেও কাঁদল না, মুখের কাছে দু হাত নিয়ে, দেখতে লাগল, মণিমাসির মুখের দিকে। পান্নাকে নিয়ে মণিমাসি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সুভামাসি খুব আস্তে ভেজিয়ে দিল ঘরের দরজাটা।

কুঠুরি ঘরের লম্বা পিঁড়েয় এসে, পান্নাকে কোলে নিয়ে বসল মণিমাসিসুভামাসিও তার পাশে বসে ঝুঁকে দেখতে লাগল পান্নাকে। তাদের সামনে ওষুধের বাক্স। তার মধ্যে সাদা তুলো, বোরিক তুলো। টিংচার আয়োডিনের ছোট্ট শিশি। ডেটলের শিশি। অ্যান্টিব্যাক্ট্রিনের শিশি। সিবাজল পাউডার। ছোট্ট কাঁচি। ব্যাণ্ডেজের কাপড়। টুকটাক আরো কিছু ওষুধ আর জিনিষপত্র।

মণিমাসি খুব সন্তর্পণে পান্নার বাঁ হাতের অনামিকায় জড়ানো ন্যাকড়ার বাঁধনটা খুলতে চেষ্টা করল। চারদিন আগের বাঁধা মোক্ষম গিঁট খোলা যাচ্ছিল না। সুভামাসি ঝুঁকে দেখতে দেখতে বলল, “কাঁচি দেব? কেটে দে, দিদি। ও গিঁট আর খোলা যাবে না”। বাঁ হাতটা চেপে ধরাতে পান্না বিরক্ত হচ্ছিল, জোর করছিল ছাড়ানোর জন্যে আর মুখে আওয়াজ করছিল, ঠোঁট সরু করে।

“তাই দে”।

কাঁচি দিয়ে গিঁটটা কেটে ফেলার পর, শাড়ির ফালির পরত খুলে আসতে লাগল। দু তিন পাক খোলার পর পান্না টের পেল ব্যথাটা। শুকনো রক্ত আর পুঁজে ক্ষতস্থানে আটকে গিয়েছে ন্যাকড়ার ফালি। টেনে খুলতে গেলেই সে ব্যথা পাচ্ছে।  ডাহাত ছুঁড়ে সে মণিমাসির হাতে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল এবার। গতকাল দুপুর থেকে যে শিশুর কান্না একবারও শোনা যায়নি, সেই কান্নার আওয়াজে বাড়ির অন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে, ভোরের ঘুম ভেঙে বেরিয়ে আসতে লাগল, ঘর ছেড়ে।

মণিমাসি পান্নার চোখে চোখ রেখে বলল, “কট্টো দিয়ে ফেলেচি, বাবু? আহারে, মরে যাই। সুভা, এক কাজ কর, এভাবে হবে না, ছোট্ট বাটিতে খানিকটা গরম জল কর। গরম জলে না ভেজালে এ ন্যাকড়া খোলা যাবে না”। সুভা দ্রুতপায়ে অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে জল নিয়ে, কেরোসিনের স্টোভ জ্বালতে বসল।

পান্নার বড়োমামা হন্তদন্ত হয়ে, বারান্দায় এসে বললেন, “তোরা ছেলেটাকে নিয়ে কী করছিস বলতো? অ, আঙুলটা? ন্যাকড়াটা খোলা যাচ্ছে না?” তিনিও এসে মণিমাসির পাশে বসলেন। “সুভা গরমজল করছিস? গুড। গরমজলে তুলো ভিজিয়ে, ফোঁটা ফোঁটা ফেললে, ন্যাকড়াটা খুলে আসবে”।

“তাই করবো। সুভা জলটা নিয়ে আসুক”। পান্নার দিদিমা খুব ভোরে উঠে বাইরে যান, তিনি ফিরে এসে পান্নাকে নিয়ে ওদের বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, রান্নাঘরে গিয়ে একটা সাঁড়াশি নিয়ে এলেন। সুভাকে সেটা দিয়ে বললেন, “এই সাঁড়াশি নে, জলে বুড়বুড়ি কাটছে, ওতেই হবে। নামিয়ে ফেল। ফুটন্ত জল কচি হাতে সইতে পারবে কেন? হাঁদা মেয়ে, জল গরম করতে বসেছিস আর সাঁড়াশি নিসনি? জল গরম হলে, হাত দিয়ে ধরতে পারবি? বোনপোর হাত দেখতে গিয়ে, নিজের হাত পোড়াবি?”

গরম জলের মধ্যে বোরিক তুলোর টুকরো ভিজিয়ে, ন্যাকড়ার ওপর টুপ টুপ জল ফেলতে লাগল সুভামাসি, আর মণিমাসি অতি সন্তর্পণে ছাড়াতে লাগল ন্যাকড়ার ফালি। ততক্ষণে কলুমাসিও চলে এসেছে।

বড়োমামা বললেন, “কলু এক কাজ কর দেখি, আমার ঘর থেকে একটা ঝুমঝুমি নিয়ে আয়, চোখের সামনে আওয়াজ করলে, কিছুটা আনমন হবে”। কলুমাসি দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল, আর উবু হয়ে বসে সে নিজেই বাজাতে লাগল পান্নার চোখের সামনে। পান্না ডানহাত বাড়ালো সেটা ধরার জন্যে, সত্যি বাঁহাতের দিকে এখন আর তার লক্ষ্য নেই।

ন্যাকড়ার ফালি সরাতেই সকলেই চমকে উঠলেন আঙুলের অবস্থা দেখে এবং দুর্গন্ধে! পান্নার মা, বাবা, দাদা হীরুও ততক্ষণে চলে এসেছে।

পান্নার দিদিমা খুব বিরক্ত হলেন মেয়ের ওপর, বললেন, “এ কিন্তু তোর খুব অন্যায়, সোনা। এইটুকু একটা ছেলে, তার হাতটার এই অবস্থা করে রেখেছিস? ছি ছি ছি। দুটি মাত্র ছেলে। তাদের দিকেও তোর চোখ দেবার সময় হয় না?” সোনা নিজেও খুব অপরাধী বোধ করছিলেন, তিনি কোন উত্তর দিলেন না, অপলক তাকিয়ে রইলেন ছেলের মুখের  দিকে।

“বলি, ঘরের কাজ আগে করবি, না ছেলেকে দেখবি? আমিও তো বাছা তোমাদের আটবোন, দুই ভাইকে বিইয়েছি, বড়ো করেছি, আবার ঘরের কাজও সেরেছি। কই এমন তো হয়নি কোনদিন?” কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন, “তোর শাশুড়িকেও বলিহারি। বাবা, অচ্যুত কিছু মনে কোর নাকচি নাতি, সবে এই এক বছর পূরল, তাঁরও কী একবার মনে হয়নি, নাতির হাতটা একবার দেখি। ছি ছি ছি। সংসারে থেকে পুজো, পাব্বণ, ব্রত, উপোস-তাপাস করে কী লাভ? যদি নিজের লোকেদের কোন কাজেই না আসি? তার থেকে সব ছেড়ে ছুড়ে সন্নিসি হয়ে চলে গেলেই হয়”।

বড়োমামা দিদিমাকে বললেন, “মা, চুপ কর, ছেড়ে দাও। যা হবার তো হয়েছে, এখন আর ওসব বলে কী লাভ? মণি, সুভা, গরম জল দিয়ে আলতো মুছে নে জায়গাটা। কাঁচা ডেটল দিয়ে, বেঁধে দিয়েছিলি, না রে, সোনা? চারপাশটা পচে হেজে গেছে। এইটুকু বাচ্চার চামড়ায় কাঁচা ডেটল সহ্য হবে কেন?”

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কী করবি? করুণাসিন্ধুকে একবার ডাকবি নাকি? এসে একবার দেখে যাক”।

“করুণামামা তো নেই, গতকাল বর্ধমান গেছেন, ফিরবেন সেই বুধ বা বেষ্পতিবার”করুণাসিন্ধু এলএমএফ ডাক্তার, গ্রামেরই মানুষ। হাতযশ ভালোই, ডাকতে, হাঁকতে পাওয়াও যায়।

“তাহলে?”

“দেখি, একটু বেলায় মহিমকাকাকে বলে হোমিওপ্যাথি যদি কিছু দেন। কাল সকাল অব্দি কেমন থাকে দেখি, সেরকম হলে মাঝের গাঁ নিয়ে যাবো। মণি, এবার খুব হাল্কা করে, এই এতটুকু টিংচার আয়োডিন জলে ফেলে, সেটা দিয়ে জায়গাটা ভিজিয়ে দে। ব্যস ব্যস, দু ফোঁটা আর না। এবার তুলোটা ভিজিয়ে, চিপে নে। হ্যাঁ, এবার থুপ থুপ করেআমি তো বলবো মা, এই ছেলেটাই হাবা। এমন অবস্থা হাতের, ব্যথা লাগছে না? অন্য কোন বাচ্চা হলে, চিল চিৎকার করে পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে দিত। হ্যাঁ, হয়েছে, এবার একটু শুকুতে দে, একদম শুকনো”। সুভোমাসি আর মণিমাসি শুকোনোর কথায় হাল্কা ফুঁ দিতে দুজনেই নীচু হতে গেল, আর তাদের মাথায় মাথায় ঠোক্কর লাগল, ঠক। দুজনেই দুজনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

বড়মামা হা হা হেসে বললেন, “বোনপোর আঙুল, দুই মাসির মাথায় এবার শিং গজিয়ে ছাড়বে, নে নে আরেকবার ঠুকে নে। তারপর দেখ শুকোলো কিনা”? দুই বোনে আরেকবার হালকা মাথা ঠোকার পর, মণিমাসি বলল, “হ্যাঁ, শুকিয়েছে”।

“গুড এবার কাটা জায়গাটাতে সিবাজল পাউডার ছড়িয়ে দে হালকা করে, তারপর ওখানটা ছোট্ট একটা গজের টুকরোয় চাপা দিয়ে, ব্যাণ্ডেজ করে দে। ব্যাণ্ডেজটা তিন, চার পরতের বেশি যেন না হয়”। মণিমাসি আর সুভামাসী অত্যন্ত মনোযোগে পান্নার আঙুলের সেবা করছিল যখন, তখন পান্না মণিমাসির চুলের একটাগুছি ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে, মুখে নেবার চেষ্টা করছিল বারবার। আর আঙুলে ব্যথা লাগলে চমকে উঠে মুখ বেঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি করছিল।

পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেলে, সুভামাসি খুব করুণ মুখ করে বলল, “আমার কোলে একবার দে না, দিদি”।

পান্নার দিদিমা বললেন, “নিবি বাছা, নিবি। পান্না কিছু পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন ওকে সোনার কোলে দে, একটু খাক। আর শোন, রোজ সকালে একবার করে, আঙুলটা খুলে দেখবি, কেমন আছে তারপর ওষুধ দিয়ে আবার ব্যাণ্ডেজ করে দিবি। এই সময় করুণাসিন্ধু আবার কোন চুলোয় গেল কে জানে! দরকারের সময়ে কাউকে পাওয়া যায় না”।

এতক্ষণ, সোনা অপরাধীর মতো বসেছিলেন মণিমাসির পিছনে, একটা কথাও বলেননি। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাইছিলেন, নিজেই ছেলের এই সেবাটুকু করতে, অথচ সংকোচে বলতে পারছিলেন না। এখন মায়ের কথায়, অধীর আগ্রহে, পান্নাকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। বুকের মধ্যে চেপে ধরে, পান্নার গালে গাল ঠেকালেন। হঠাৎ যেন ভারি হয়ে উঠল তাঁর দুই স্তন, আঁচলের মধ্যে পান্নাকে নিয়ে, তার মুখে তুলে দিলেন বৃন্ত। এখন তাঁর পাশে তিন বোন, মা আর বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই। সোনা আঁচল সরিয়ে, পান্নার মুখের দিকে তাকালেন। তার রেশমের মতো কোমল চুলে হাত বোলাতে বোলাতে তাকিয়েই রইলেন। উষ্ণ দুধের তৃপ্তিতে শিশুর চোখ বুজে আসছেমাঝে মাঝে শ্বাস নেওয়ার বিরতিতে, সে চোখ মেলে দেখছে মায়ের মায়াবি মুখখানি। তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে, নিশ্চিন্ত ঘুম। সোনার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি মনে মনে বললেন, এভাবে কষ্ট পাচ্ছিস, একবার বলতেও তো পারতিস মাকে। কথা বলতে পারিস না, গলা ছেড়ে কাঁদতেও তো পারতিস, বাবা! এত্তো, এত্তো অভিমান মায়ের ওপর! বোনেদের সামনে তিনি চাইছিলেন না, কিন্তু সামলাতে পারলেন না নিজেকে। তাঁর দুচোখ উপচে নেমে এল অশ্রু

সুভামাসি বলে উঠল, “এ মা, ও ন’দি, কাঁদছিস কেন?”

পান্নার দিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উঠে যাওয়ার সময় বললেন, “কাঁদবে বইকি, বাছা। কাঁদুক, মনটা হাল্কা হোক। মা হওয়া কী মুখের কথা বাছা? সে তোরা এখন বুঝবি না, বুঝবি পরে। তোরা যা, ওষুধপত্র সব যথাস্থানে তুলে রাখ। বৌমা চলো, আমরা চান সেরে আসি, জামাই আছে, তার জলখাবারের যোগাড় করতে হবে। অনেক কাজ সোনা এখন ছেলেকে নিয়ে একলাই থাকুক। হীরু, তুই বাবা বোস, মায়ের কাছে”।

                                                   

..০০..

সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব - ১১

 ১১

 প্রতিষ্ঠার মনটা আজ নিজের মনে নেই। গতকাল রাত্রে সম্রাট তার সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেছে। নাইট ডিউটির অবসরে ছেলেদের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ মাখামাখি তার বেশ লাগে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠার সতীত্ব-টতীত্ব নিয়ে কোন আদেখলাপনা নেই, তা সত্যি। কিন্তু, এসবের মধ্যেই সম্রাট ওকে এমন একটা গালাগাল দিল! ব্যাপারটা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না বসে গেছে তার মাথার ভিতরে। এইরকম বেজায় মন খারাপের সময় ছবির সাহচর্য তাকে বরাবর শান্তি এনে দিয়েছে। আজও ছবির সঙ্গে সে যতক্ষণ ছিল, বেশ ছিল – মন খারাপের কথা মনেও হয়নি একবারের জন্যেও! কী যে জাদু আছে ছবি বলে অতি সাধারণ মেয়েটার মধ্যে, আজও সম্পূর্ণ করে বুঝে উঠতে পারেনি প্রতিষ্ঠা। তবে এটুকু সে বোঝে, যে ছবি তাকে ভালোবাসে। ও বাড়িতে গেলে ছবির উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি, তার আন্তরিক “মিঠুদিদি” ডাক, তাকে অদ্ভূত এক নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসের অনুভূতি এনে দেয়।

কিন্তু একটি মেয়ের এই নিখাদ ভালোবাসার মধ্যে প্রতিষ্ঠা কী করে যেন এনে ফেলেছিল এক শরীরী আবেগ। প্রায় মাস আষ্টেক আগে তারা প্রথম মিলিত হয়েছিল ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে। তার জন্যে দায়ি প্রতিষ্ঠা নিজেই। মনে আছে প্রথম দিন ছবি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল তার মিঠুদিদির এই আকস্মিক আচরণে। বুঝেই উঠতে পারেনি, একজন মেয়ে হয়ে মিঠুদিদি তার কাছে ঠিক কী পেতে চাইছে? বাধা দিয়েছিল। অনুরোধ করেছিল বারবার, এমন না করতে। প্রতিষ্ঠা শোনেনি, প্রচণ্ড আবেগে সে নিজেও ভেসে গিয়েছিল - ভাসিয়ে দিয়েছিল ছবির সমস্ত সংকোচ, লজ্জা আর আপত্তি। তার পরে প্রায় নিয়মিত ছবির সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে প্রতিষ্ঠা বড়ো তৃপ্তি পায়। আগে থেকে ফোন করে প্রতিষ্ঠাই চলে আসে ছবির কাছে – নির্জন দুপুরেঅনেক সাধ্য সাধনা করে, কাঠ-খড় পুড়িয়ে, ছবিকে মাত্র দুই রাত সে নিয়ে যেতে পেরেছিল নিজের ঘরে। পিছুটান নেই, কোন তাড়া নেই, শুধু দুজনে সারারাত – সে বড় আনন্দের রাত – মনে হয়েছিল প্রতিষ্ঠার।

ছবি তাকে ভালোবাসে এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠা যতটা নিশ্চিত, ততটাই নিশ্চিত, তার এই শরীরী সম্পর্ক ছবি খুব ভালো মনে নেয় না। যে কোন কারণেই হোক মেনে নিয়েছে – আজকাল অভ্যস্ত হয়েও উঠছে দিন কে দিনআগের মতো বাধা দেয় না বা আপত্তি করে না ঠিকই, তাই বলে কোন উৎসাহও দেখায় না। উদ্‌গ্রীব আগ্রহও যেমন নেই, তেমনি উদাসীন শীতলতাও থাকে না তার ব্যবহারে।

প্রতিষ্ঠা জানে বহু স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যও এমনই নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলন। সে নিজের ঘনিষ্ঠ জীবনেই দেখেছে এরকম। তার বাবা-মার সম্পর্কটাই আজও এমনতর। তার বাবার ভীষণ সন্দেহবাতিকনিজের স্ত্রীকে সর্বদাই মনে করে কারুর প্রতি আসক্তা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকি জামাকাপড় ইস্ত্রির ধোপা, আগে যে ছেলেটা দুধ দিতে আসত, যে কেউ হতে পারে। পুরুষ হলেই হোল, আর সুপুরুষ হলে তো কথাই নেই। আজকাল কেউ আর আসে না তাদের বাড়িতেকারণ উপস্থিত লোকের সামনেই বাবা তার মাকে যে ভাষায় বিদ্রূপ করে, চেঁচামেচি করে, অপমান করে তাতে কেউই আর এ মুখো হয় না।

জ্ঞান হয়ে থেকে প্রতিষ্ঠা এ সবই দেখে আসছে। সে বড়ো হতে হতে বহুবার তার বাবাকে বুঝিয়েছে। ঝগড়া করেছে। বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছে কোন সাইকোথেরাপিস্টকে কনসাল্ট করতে। তাতে ফল হয়েছে উল্টো। বাবার এখন ধারণা সেও তার মায়ের এই ব্যাভিচারবৃত্তির পৃষ্ঠপোষক এবং মা-মেয়ে দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করছে, বাবাকে পাগল প্রতিপন্ন করতে। সাইকোথেরাপিস্ট মানে পাগলের ডাক্তার! বাবার এই মানসিক ব্যাধির জন্যে তারা তিনজনেই এক অসুস্থ জীবনের বোঝা টেনে চলেছে নিরন্তরঅথচ অন্য সব ব্যাপারে তার বাবার সব ঠিকঠাক -  কাজকর্ম, অফিস, খাওয়াদাওয়া, জিনিষপত্র তাতে কোন অসামঞ্জস্য নেই। মায়ের জন্যেও প্রায়ই দামি শাড়ি, মাঝে মাঝেই গয়না, এখান সেখান বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, সবই করে।

ছোটবেলায় একবার পনেরই আগস্টের ছুটিতে তারা চিড়িয়াখানা যাবার প্ল্যান করে বেড়িয়েছিল। বাবা সেদিন দারুণ ভালো মুডে ছিল। খুব হাসি-খুশি আর মজার। সকাল থেকে বাজার করে, মায়ের সঙ্গে রান্নায়বান্নায় হাত লাগিয়ে, তাড়াতাড়ি মাংসেরঝোল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিল তারা। সকাল থেকেই সেদিন মেঘলা ছিল, বেশ ঠাণ্ডা ওয়েদার – গরমের দিনেও বেড়ানোর পক্ষে আদর্শ ছিল দিনটাধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে তারা বাসে উঠেছিললেডিজ সিটে তারা দুজনে সিট পেয়ে গিয়েছিল, বাবা পায়নি – কারণ জেন্টস সিট সব ভর্তি ছিল। খুব বেশি ভিড় ছিল না বাসে, তাদের কাছাকাছিই বাবা দাঁড়িয়েছিল।

বাস ছাড়ার একটু পরেই বৃষ্টিটা নামল। প্রচণ্ড বৃষ্টিবাসের কণ্ডাকটার দৌড়ে এসে বাসের জানালার কাঠের পাল্লাগুলো তুলে দিচ্ছিল। প্রতিষ্ঠাদের পিছনের জানালাটায় কোন ডিফেক্ট ছিল বারবার নেমে যাচ্ছিল পাল্লাটা, কণ্ডাকটার তার আর মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে চেষ্টা করছিল পাল্লাটাকে ঠিকঠাক লাগাতে...। হঠাৎ বাবা বীভৎস বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল, “কী হচ্ছেটা কি? পাশে মেয়েকে বসিয়ে, এই এক বাস লোকের সামনে, বাসের কণ্ডাকটারের সঙ্গে ফস্টিনস্টি না করলে চলছিল না..। এই জন্যে তোর বাইরে বেরোনোর এত টান? লজ্জা, ঘেন্না-পিত্তি সব ঘুঁচে গেছে..”?

সে আর তার মা বসেই রইল পাথরের মূর্তির মতো। অপমানে তার সমস্ত শরীর রী রী করছিল। বছর বাইশ-তেইশের ছোকরা বাসের কণ্ডাকটারটা বলেছিল, “আলফাল কি বলছেন? জানালাটা বন্ধ করছিলাম – ফস্টিনস্টি কি বে?  শালার এতোই যদি, ট্যাক্সিতে যান না ...”

বাবা তাও থামেনি। অনর্গল চেঁচিয়ে চলেছিল, মাকে নিয়ে। সামনের এক ভদ্রলোক কিছু বলতে উঠেছিলেন, বাবাকে সামলাতে, বাবা তাকে নিয়েও শুরু করল, “আপনিও কিছু কম যান না, সেই থেকে দেখছি চোখে চোখে ইশারা চলছে...এখন আবার সাউখুরি করতে এয়েচেন...।”?

বাসের আরো কিছু লোকজন বাবাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল, বাবা থামছিল না, উল্টে বেড়েই চলেছিল চেঁচামেচি আর মায়ের প্রতি অশ্রাব্য সম্পর্কের টিপ্পনি। শেষে বাস ড্রাইভার রাস্তার ধারে সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বাসটা, বলেছিল, “অ্যাই, পরাণ, মালগুলোকে খালাস করত। শালা, এমনিতেই বৃষ্টিতে প্যাসেঞ্জার নেই, তার ওপর ফালতু ক্যাচাল..., হাটা সব কটাকে”।

বাসের দুজন কণ্ডাকটার মিলে তাদের তিনজনকে একরকম জোর করে নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। অঝোরে বৃষ্টি ঝরা মধ্যদিনে তারা বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে। চারিদিকে মাথা বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না। জনহীন রাস্তা – গাড়ীগুলো খুব দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল – জল ছিটিয়ে ওপারে ফোর্ট উইলিয়ামের মাঠ, এপারে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ড। কিছুটা দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ব্রিগেডের ওপারে আধুনিক শহরের ইমারতের সারি বৃষ্টিধারায় ঝাপসা দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের পিছনে।           

বাবার মুখের দিকে সে তাকায়নি, প্রবৃত্তি হয়নি তার। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন পাথরের মতো শক্ত মুখ, চোয়াল শক্ত করে কিছু ভাবছে। মায়ের দৃষ্টিতে যেন কেউ নেই, সে নেই, এই শহরের রাস্তাঘাট, নিবিড় সবুজ গাছপালা, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারাপাত কিচ্ছু নেই। সে মাকে ধরতে গেল। মা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, ভীষণ কর্কশ গলায় বলেছিল – “ছেড়ে দে, আমায় – ছেড়ে দেদূর হয়ে যা সব -”, আর তারপরেই আচমকা দৌড়তে শুরু করেছিল রাস্তা পার হয়ে। আতঙ্কে প্রতিষ্ঠা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, সমস্ত আবেগ দিয়ে প্রাণপণ ডেকে উঠেছিল – “মা.....”।

তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে গাড়িটা ব্রেক কষেছিল তাই, নাহলে কি হত ভাবতে আজও প্রতিষ্ঠা শিউরে ওঠে। গাড়ির দরজা খোলার শব্দে প্রতিষ্ঠা চোখ মেলে তাকাল। মায়ের শরীর থেকে এতটুকু দূরত্বে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়িটা। দরজা খুলে নেমে এসেছিল এক ভদ্রলোক আর মহিলা। প্রতিষ্ঠা দৌড়ে চলে গিয়েছিল মায়ের কাছে – মাকে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ যে কাঠিন্য সে দেখছিল মায়ের মধ্যে, আর এখন নেই। নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে আসা মা,  তার কাঁধে ভর দিয়ে, দুর্বল-শিথিল হয়ে আসা নিজের শরীরটা টেনে আনল রাস্তার ধারে ঘাসের ওপর। মা বসে পড়েছিল, বসতে বসতে বলল, “এ বারেও হল না রে, মিঠু, আমার মরণও হবার নয়...কেন বল তো”?

মায়ের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে প্রতিষ্ঠা বলেছিল, “না মা, না – প্লিজ, আমি কার কাছে থাকব, মা – তুমি মরবে না, মা, কিছুতেই নাঐ জানোয়ারটার হাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে তুমি শান্তি পাবে, মা? প্লিজ মা, প্লিজ, আমার জন্যে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে, মা”

 

তারা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। দুজনেই অনেক কিছু বলছিল – কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না, কান্নায় ভেঙে যাচ্ছিল তাদের উচ্চারণ আর স্বর। গাড়ি থেকে নেমে আসা ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা এতক্ষণ কিছু বলছিল না, শুধু দেখছিল তাদের। এবার ভদ্রলোক খুব উঁচুস্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বাবাকে বলেছিল, “চেহারা দেখে তো শালা, ভদ্রলোক বলেই মনে হয় – মেয়ে বউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সঙের মতো কী দেখছিস কি, য়্যাঁ...”? সপাটে এক চড় কষিয়েছিল বাবার গালে।

সেই শব্দে প্রতিষ্ঠা এবং তার মাও চমকে উঠে তাকিয়েছিল। প্রতিষ্ঠা দেখেছিল বাবা চোখ নীচু করে তাকিয়ে আছে ঘাসের দিকে... বাবাকে তার মনে হয়েছিল দুইপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সরীসৃপ বিশেষ - শীতল, আপাত নিরীহ – কিন্তু অদ্ভূত বিষযুক্ত – যে বিষে জর্জরিত তার মা এবং ওদের একমাত্র সন্তান হিসেবে, সেও। এক মারাত্মক বিপদ থেকে ভাগ্যক্রমে বেরিয়ে আসা ক্রুদ্ধ ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, উদ্যত হয়েছিলেন হয়তো আরও মারধোর করতে -। তাই দেখে মা খুব কঠিন স্বরে বলেছিল, “শুনছেন, ওকে ছেড়ে দিন। আপনারা যান, যেখানে যাচ্ছিলেন...আমাদের একা থাকতে দিন, প্লিজ”।

ভদ্রলোক একটু দমে গেলেও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সঙ্গের ভদ্রমহিলা জোর করে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গাড়িতে উঠে বসলেন ভদ্রমহিলা ওদের দিকে একবারও তাকালেন না, ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওরা চলে যেতে মা বলল – “চ, মিঠু, ঘরে যাই”।

বৃষ্টিটা তখন অনেকটাই ধরে এসেছিল, পড়ছিল - তবে হাল্কা।   

...চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

গেলেম নতুন দেশে

  এতদিন স্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর স্কুল - এই নিয়ে চলছিল আমার রুটিন বদ্ধ জীবনযাত্রা। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পার করে, টেস্ট হয়ে স্কুল ছুটি ...