["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/১"
তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয় পর্বাংশ
(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)
৩.১.৩.১ শাক্য রাজপুত্র সিদ্ধার্থ
ভগবান মহাবীরের সমসাময়িক, বয়সে কয়েক
বছরের ছোট ভগবান বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, কপিলাবস্তু (আধুনিক নেপালে) নগরে, শাক্য
গোষ্ঠীর গণসঙ্ঘী জনপদের রাজধানীতে। তাঁর পিতা ছিলেন ক্ষত্রিয় শুদ্ধোধন, মাতা
মায়াদেবী। শৈশবেই মাতৃবিয়োগের পর তাঁকে নিজের পুত্রের মতোই পালন করেছিলেন, তাঁর মাসি
গৌতমী, শুদ্ধোদনের
দ্বিতীয়া পত্নী। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ, কিন্তু বিমাতা গৌতমীর স্নেহচ্ছায়ায়
বড়ো হতে হতে তিনি গৌতমী-পুত্র গৌতম নামেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তী কালে
বোধি লাভ করার পরেও,
তিনি গৌতমবুদ্ধ নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন।
বৃদ্ধ মহর্ষি অসিত ধ্যানযোগে জানতে পেরেছিলেন, শাক্য
রাজপরিবারে এক শিশুর আবির্ভাব ঘটেছে, পরবর্তী জীবনে যিনি যুগপুরুষ হয়ে
উঠবেন। অসামান্য সেই শিশুটিকে দেখতে তিনি রাজপ্রাসাদে এসেছিলেন। রাজা শুদ্ধোদনের
কোলে সদ্যজাত সিদ্ধার্থর শরীরে মহাপুরুষের সমস্ত লক্ষণ দেখে একদিকে তিনি নিশ্চিত
হয়েছিলেন, অন্যদিকে
দুঃখে কেঁদেও ফেলেছিলেন।
মহর্ষির চোখে জল দেখে পিতা শুদ্ধোদন পুত্রের
ভবিষ্যতের শঙ্কায় যখন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, মহর্ষি অসিত সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, “শিশুর
ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, রাজন্। আমি কাঁদছি আমার দুর্ভাগ্যের
জন্যে। এই শিশু একদিন পৃথিবীর মানুষকে দুঃখ-শোক, জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির
পথ দেখাবে, কিন্তু
ততদিন আমি থাকব না। এই জাতক যখন বড়ো হবে, তার মুখ থেকে সেই পরমজ্ঞানের কথা
আমার শোনা হবে না”। তিনি আরও বললেন, “এই জাতক রাজসিংহাসনে বসবেন না, তিনি সংসার
ত্যাগ করে পরমমুক্তির সন্ধানে সন্ন্যাসী হবেন”। বৃদ্ধ ঋষি চলে গেলেন, যাওয়ার সময়
প্রণাম করলেন সেই সদ্যজাত শিশুকে।
ভগবান বুদ্ধের এই আশ্চর্য আবির্ভাবের ঘটনা কয়েকশ
বছর পরে আবার ঘটেছিল অন্য এক মহাপুরুষের আবির্ভাবের সময়। কিন্তু সে প্রসঙ্গ আসবে
পরে।
একমাত্র পুত্র সিদ্ধার্থর সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার
কথায় পিতা শুদ্ধোদন মোটেই শান্তি পেলেন না। তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে গেল এই
দুশ্চিন্তা। পুত্রের বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর শিক্ষার জন্যে সকল ব্যবস্থা
করলেন। দেখা গেল সিদ্ধার্থ অত্যন্ত মেধাবী এবং মনোযোগী ছাত্র এবং অল্প সময়ের
মধ্যেই বেদ-বেদাঙ্গ সহ সকল শিক্ষা অনায়াসে আয়ত্ত্ব করে ফেললেন। তিনি আরও লক্ষ্য
করলেন, অন্য
সকল বালকের মতো, সিদ্ধার্থের
মধ্যে কোন বালসুলভ চাপল্য নেই। অত্যন্ত সুস্থ সবল বালক, কিন্তু
অত্যন্ত ধীর, শান্ত, নম্র এবং
সকলের সঙ্গেই অত্যন্ত বিনয়ী তার ব্যবহার। এতে শুদ্ধোদন আরও উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি এ
সবই পুত্রের সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার লক্ষণ ধরে নিয়ে, পুত্রের জন্যে বিপুল বিলাস, ব্যসনের
আয়োজন করলেন। তিনি মনে করেছিলেন, গভীর ভোগ-বিলাসের দিকে পুত্রের মন যদি ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সে
সংসার ত্যাগের কথা ভুলে যাবে। এর সঙ্গে সিদ্ধার্থের শিক্ষা সম্পূর্ণ হতেই, অত্যন্ত
রূপসী, বিদূষী
এবং নম্র স্বভাবের এক কন্যা, তরুণী যশোধরার সঙ্গে তিনি তরুণ পুত্রের বিয়েও দিয়ে দিলেন।
যাতে পুত্র ঘোর সংসারী হয়ে উঠে, তার মনে গৃহত্যাগ করার কোন চিন্তাই যেন না আসে। বিয়ের কয়েক
বছরের মধ্যেই সিদ্ধার্থ-যশোধরার একটি পুত্রও হল, তার নাম রাখা হল রাহুল। রাজা
শুদ্ধোদন এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন, পুত্র এবার নিশ্চয়ই ঘোর সংসারী
হয়েছে।
পিতা শুদ্ধোদনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, নগরের পথে
ভ্রমণের সময় সিদ্ধার্থের চোখে এমন কোন ঘটনা বা দৃশ্য যেন তার চোখে না পড়ে, যার থেকে
পুত্রের মন বিচলিত হয়। সেভাবেই তিনি সমস্ত রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন।
কিন্তু পিতার এই সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যুবক গৌতম নগরের পথে একদিন এক
অশক্ত, শীর্ণ, দুর্বল
জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে দেখলেন। আরেকদিন দেখলেন অসুস্থ এক মানুষকে, অসহ্য
যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করছিল। নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে, সে নিজেই
নিজের মৃত্যু কামনা করছিল। এর পর অন্য আরেকদিন দেখলেন, একদল
শবযাত্রীকে, যারা
দুঃখে-শোকে কাঁদতে কাঁদতে কাঁধে বহন করে নিয়ে চলেছে শবদেহ। সেই ক্রন্দনরত
শবযাত্রীদের মধ্যে ছিল,
মৃত মানুষটির পত্নী,
পুত্রকন্যা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব[1]।
গৌতম বিচলিত হলেন। তিনি বিস্মিত হলেন, বিষণ্ণ
হলেন। চিন্তা করলেন,
এই কী তবে মানুষের পরিণতি? এই সব কিছু জেনেও মানুষ কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকে? কিভাবে তারা
খায়-দায়, ঘুমোয়, বিলাস করে, আমোদ-প্রমোদ, নৃত্য-গীত
করে, স্ত্রী-পুরুষে
রমণ করে, সন্তানের
জন্ম দেয়? যুদ্ধ
করে, রাজ্য
জয় করে, সম্পদ
সঞ্চয় করে, অহংকার
করে? তারা
তো সকলেই জানে কোন একদিন তারাও জরাগ্রস্ত হবে, মৃত্যুর কবলে পড়বে অথবা চরম অসুস্থ
হয়ে পড়বে। এতদিন তাঁর পিতা এই সব দুঃখ-শোকের দৃশ্য থেকে তাঁকে আগলে রেখেছিলেন, চেয়েছিলেন
তাঁর পুত্র সিদ্ধার্থ হোক সংসারী, ভোগী, বিলাসী। কিন্তু সিদ্ধার্থের চোখের সামনে থেকে এখন সেই পর্দা
সরে গেল। জীবনে আনন্দ,
সুখ আর উৎসবের আড়ালে যে এভাবেই অঙ্গাঙ্গী জুড়ে আছে কদর্য জরা, ব্যাধি আর
মৃত্যু, সেই
সত্য নির্দিষ্ট করে দিল তাঁর ভবিষ্যতের পথচলার দিশা।
কিছুদিন চিন্তাভাবনা করে, তিনি পিতাকে
নিবেদন করলেন, তিনি
সন্ন্যাসী হতে চান। তিনি সন্ধান করতে চান সেই সত্যের, যে সত্য
মানুষকে এনে দেবে পরমমুক্তি – মহানির্বাণ। মানুষকে বারবার ফিরে আসতে হবে না
সংসারের এই কদর্য রঙ্গভূমিতে। পিতা শুদ্ধোদন কেঁপে উঠলেন আশঙ্কায়, তিনি
পুত্রকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তোমার হাতে এখনই রাজ্যভার সমর্পণ করে, আমি
বাণপ্রস্থে যাব। অসহায় বৃদ্ধ পিতাকে ছেড়ে তোমার সন্ন্যাসী হওয়া একান্তই অধর্ম হবে, পুত্র।
তাছাড়া পণ্ডিতেরা বলেন,
নবীন বয়সে সমস্ত ইন্দ্রিয় যখন সজাগ, তখন ধর্মাচরণ করাও বিধেয় নয়। অতএব এই
সঙ্কল্প তুমি ভুলে যাও,
পুত্র। রাজ্যভার গ্রহণ করো, সুখে শান্তিতে সংসার কর, তারপর বার্ধক্য এলে ধর্মাচরণে মন
দিও”।
যুবরাজ সিদ্ধার্থ দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বললেন, “হে পিতা!
আপনি যদি আমার চারটি বিষয়ের দায়িত্ব নেন, তবেই আমি আমার সঙ্কল্প ত্যাগ করতে
পারি। প্রথমতঃ আমার যেন মৃত্যু না হয়। দ্বিতীয়তঃ আমার যৌবন যেন কখনো জরাগ্রস্ত না
হয়। তৃতীয়তঃ কোনদিন কোন ব্যাধিতে আমি যেন অসুস্থ না হই। চতুর্থতঃ এই রাজ্য এবং
আমাদের সঞ্চিত সম্পদ কোনদিন যেন বিনষ্ট না হয়”। এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায় না -
রাজা শুদ্ধোদনও দিতে পারলেন না। কিন্তু তিনি সিদ্ধার্থকে সন্ন্যাসী হবার অনুমতিও
দিলেন না।
কিন্তু কৃতসঙ্কল্প সিদ্ধার্থ একদিন মধ্যরাত্রে
গৃহত্যাগ করলেন। অদ্ভূত দৈবপ্রভাবেই যেন সেদিন গভীর নিদ্রিত হয়ে রইলেন রাহুল-মাতা
যশোধরা[2], মাতা গৌতমী ও পিতা শুদ্ধোদন - এমনকি
প্রাসাদের যত নৈশ প্রহরীরাও। তাঁর সঙ্গী হল বিশ্বস্ত অনুচর ছন্দক এবং তাঁর প্রিয়তম
ঘোড়া কন্থক। সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি যখন শাক্যরাজ্যের সীমানায় পৌঁছলেন, সূর্য তখন
উদয়াচলে।
সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক ব্যাধের, পরনে তার
সন্ন্যাসীর পরিধেয় পবিত্র কাষায় বস্ত্র। বিস্মিত সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কাষায়
বস্ত্র পরে বেরিয়েছেন পশুপাখি শিকারে?” দৈব নির্দেশেই যেন সেই কিরাত উত্তর
দিল, “পশুপাখিরাও
জানে কাষায় বস্ত্র পরা মানুষ সন্ন্যাসী হয়, তারা শিকার করে না, অতএব তারা
ভয়ও পায় না। সেই সুযোগে আমি তাদের খুব কাছে চলে যেতে পারি, তাতে
শিকারের খুব সুবিধে হয়। আপনার কী এই বসন চাই? আপনার বহুমূল্য রাজপোষাকের পরিবর্তে
আমি এ কাষায় বসন আপনাকে সানন্দে দিতে
পারি”।
যুবরাজ সিদ্ধার্থ সেই প্রসন্ন ঊষায়, সেই কিরাতের
দেওয়া কাষায় বসন পরে,
খুলে ফেললেন, রাজকীয়
পোষাক এবং সমস্ত অলংকার। তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেললেন নিজের বিলাসী কেশগুচ্ছ। তারপর
সন্ন্যাসীর বেশে স্মিত মুখে ছন্দকের হাতে তুলে দিলেন, সব
রত্নালংকার এবং মণিরত্ন খচিত তলোয়ার। সেই কিরাতকে দিলেন তাঁর পরিত্যক্ত রাজপোষাক।
তারপর বিদায় দিলেন তাঁর রাজসঙ্গীদের – প্রিয় অনুচর ছন্দক এবং প্রিয়তম অশ্ব
কন্থককে।
৩.২.১ সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ
ওরা চলে যাওয়ার পরেই সেই অরণ্যে এবার এক
সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল। দীর্ঘ তপস্যায় জীর্ণ তাঁর শরীর। সিদ্ধার্থ
জোড়হাতে নমস্কার করে তাঁকে বললেন, তিনি আজই গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন। কিন্তু এখনও কোন
গুরুর সন্ধান পাননি। সেই বৃদ্ধ তপস্বী বললেন, আমি ভার্গব। আমি নিজে আচার্য আলাড়ের
শিষ্য ছিলাম। আচার্য আলাড়,
কালামস গোত্রের মুনি। আপনি তাঁর কাছে যেতে পারেন। তিনি বৈশালীর উত্তরে এক
তপোবন প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এখন সেখানেই আছেন। আচার্যের ওই আশ্রমে প্রায় চারশো
শিষ্য পাঠ নেয়। তিনি সে আশ্রম ভালভাবেই চেনেন, এবং সিদ্ধার্থের ইচ্ছে হলে, তিনি খুশি
মনেই তাঁকে নিয়ে যেতে পারেন।
সিদ্ধার্থ তপস্বী ভার্গবের সঙ্গেই অরণ্যের পথে
রওনা হলেন বৈশালী নগরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর হয়ে গেল, তপস্বী
ভার্গব অরণ্য থেকেই নানান ফল এবং মূল-কন্দ সংগ্রহ করলেন। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ খুব
মন দিয়ে চিনতে লাগলেন বনের গাছপালা, লতাগুল্ম, শিখতে
লাগলেন কীভাবে ফল, মূল, কন্দ চিনতে
হয়, সংগ্রহ
করতে হয়। তপস্বী ভার্গব বললেন, আচার্য আলাড় ও তাঁর শিষ্যরাও এভাবেই কখনো কখনো খাদ্য সংগ্রহ
করেন, কখনো
ভিক্ষা করতে যান লোকালয় বা প্রতিবেশী গ্রামগুলিতে।
এভাবে ন’দিন চলার পর তাঁরা
অনুপ্রিয়ার কাছে আচার্য আলাড়ের তপোবনে পৌঁছলেন। আচার্য আলাড় সিদ্ধার্থের সঙ্গে
কিছুক্ষণ কথা বলেই, তাঁকে
সানন্দে শিষ্যত্বে গ্রহণ করলেন। সিদ্ধার্থ অন্য সহশিষ্যদের সঙ্গে ভিক্ষা করা
শিখলেন। আচার্যের থেকে শিখলেন শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে, ধ্যান করার
পদ্ধতি। সিদ্ধার্থের মনঃসংযোগ এবং সাধনার দ্রুত উন্নতি দেখে, আচার্য
অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। তিনি অচিরেই সিদ্ধার্থকে বললেন, নিজের
অন্তরে অনন্ত আকাশের চিন্তন করো। একাকী অরণ্যে মাত্র কয়েকদিনের ধ্যানেই সিদ্ধার্থ
নিজের মনে সেই ধারণা অনুভব করতে পারলেন। পরীক্ষা নিয়ে আচার্য আশ্চর্য হলেন এবং
সিদ্ধার্থকে বললেন, এবার
অন্তরে অনন্ত চৈতন্যের ধারণা করো। সিদ্ধার্থ মাত্র দুদিনের মধ্যেই সাধনার এই
পর্যায়ও অধিগত করে ফেললেন। তিনি অনুভব করলেন, পৃথিবীর সমস্ত ঘটনাই যেন তাঁর
চেতনা-সাগরে অধিষ্ঠিত রয়েছে। কিন্তু এখানেই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি
আচার্যকে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা বললেন। আচার্য বললেন, “তুমি লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে
গিয়েছ, সিদ্ধার্থ।
মনে রেখ জগতের সকল ঘটনাই মায়া। আমরা আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চ-তন্মাত্র[3] দিয়ে, আমাদের মনে
সেই মায়াকে গড়ে তুলি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা যা কিছু অনুভব করি, রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ এবং
স্পর্শ – এসবই আমাদের মনের ভ্রান্তি। আমাদের চেতনা যেন এক শিল্পী, প্রতিটি
কল্পনাকে সে তুলির আঁচড়ে বাস্তব করে দেখাচ্ছে। সাধনা দিয়ে একবার যদি এই অসীম
নিরাকার স্তরে পৌঁছতে পার,
তুমি দেখবে আমাদের চেতনার বাইরে এই জগতে আর কিছুই নেই”।
মাসখানেকের মধ্যেই সিদ্ধার্থ নিরাকার সাধন স্তরে
পৌঁছে গেলেন। কিন্তু এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি
আচার্যকে গিয়ে সেকথা বললেন। আচার্য আশ্চর্য হলেন সিদ্ধার্থের মেধায় এবং অত্যন্ত
প্রসন্ন মনে বললেন,
“সিদ্ধার্থ তুমি অসাধারণ। আমার পক্ষে যতটা শিক্ষা তোমাকে দেওয়া সম্ভব, আমি তোমাকে
সবই দিয়েছি। আমার জ্ঞান এবং তোমার জ্ঞান এখন সমান। তুমি আমার আশ্রমেই যোগ দাও, এই
সন্ন্যাসীদের তুমি শিক্ষা দাও”।
এই প্রস্তাব সিদ্ধার্থের মনঃপূত হল না। তিনি
জোড়হাতে নিবেদন করলেন,
“হে গুরুদেব, জন্ম-মৃত্যুর
চক্র থেকে আমি নিষ্কৃতির পথ খুঁজছি। সে লক্ষ্যে নিরাকার সাধন শেষ পর্যায় হতে পারে
না। আপনার অমূল্য শিক্ষার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু অনুমতি দিন, আমার
লক্ষ্যে পৌঁছোনর পথ আমি অন্য কোথাও সন্ধান করতে চাই”। আচার্য আলাড় হতাশ হলেন, কিন্তু
সিদ্ধার্থ পরের দিনই সেই তপোবন ছেড়ে অন্য গুরুর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।
এবার গঙ্গা পার হয়ে তিনি পৌঁছলেন
মগধরাজ্যে। তখনকার দিনে মগধ ছিল অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু রাজ্য এবং সেখানে বহু ঋষি, মুনি এবং
পণ্ডিত আচার্যদের আবাস। তিনি অক্লান্তভাবে গুরুর সন্ধানে ফিরতে লাগলেন, যিনি তাঁকে
জন্ম-মৃত্যুকে জয় করার পথ দেখাবেন। কোথাও তিনমাস, কোথাও বা ছ মাস, তিনি অসংখ্য
সন্ন্যাসী এবং ঋষিদের আশ্রমে ঘুরে বেড়ালেন। তাঁদের কেউ দিগম্বর কেউ শ্বেতাম্বর।
কেউ অগ্নির উপাসক। কেউ বনের ফলমূল ছাড়া কিছু খান না এবং ভীষণ দৈহিক কষ্টে কঠোর
তপস্যা করেন। তাঁদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য মৃত্যুর পরে স্বর্গলাভ। গৃহত্যাগের পর
প্রায় তিনবছর হতে চলল,
তিনি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। যদিও তাঁর ধ্যান এবং মনঃসংযোগ আরও গভীর
হয়েছে। পিতা শুদ্ধোদন,
যশোধরা এবং পুত্র রাহুলের কথা তাঁর মাঝেমাঝেই মনে আসত, কিন্তু তাও
তিনি হতাশ হননি, তাঁর
দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি
যে পথ খুঁজছেন, তার
সন্ধান তিনি অচিরেই পেয়ে যাবেন।
এক সময় তিনি মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরের অদূরে
পাণ্ডব পাহাড়ে বাস করছিলেন। একদিন তিনি ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ভিক্ষা করতে ঢুকলেন
রাজগৃহ নগরে। তাঁর অপরূপ উজ্জ্বল সৌম্যশান্ত মূর্তি দেখে রাজপথের দুপাশের লোক
আশ্চর্য হয়ে গেল। কে এই দেবকান্তি সন্ন্যাসী? কোথা থেকে এলেন? ঘটনাচক্রে
সেই পথেই রথে চড়ে যাচ্ছিলেন, মগধের রাজা বিম্বিসার। তিনিও লক্ষ্য করলেন এই সন্ন্যাসীকে।
তিনি তাঁর অনুচরকে বললেন,
সন্ন্যাসীকে যথেষ্ট ভিক্ষা দিতে এবং নির্দেশ দিলেন, অনুসরণ করে
সন্ন্যাসী কোথায় থাকেন জেনে আসতে।
পরের দিন বিকেলে রাজা বিম্বিসার পাণ্ডব পাহাড়ে
গেলেন। পাহাড়ের নিচেয় রথ রেখে, একমাত্র সেই অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পায়ে হেঁটে পাহাড়ে
উঠলেন। দেখলেন সেই সন্ন্যাসী বিশাল একটি গাছের ছায়ায় বড়ো একটি পাথরের উপর বসে
আছেন। রাজা বিম্বিসারের পোষাক এবং আচরণ দেখে, সিদ্ধার্থ বুঝলেন, তাঁর অতিথি
কোন রাজা। তিনি শ্রদ্ধায় উঠে দাঁড়ালেন, এবং জোড়হাতে রাজাকে অন্য একটি পাথরে
বসার জন্যে অনুরোধ করলেন। রাজা বিম্বিসার সন্ন্যাসীর শান্ত ও বিনয়ী ব্যবহারে প্রীত
হলেন, বললেন, “আমি এই
মগধের রাজা। আমি আপনাকে আমার রাজধানীতে আসার নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। আপনি আমার পাশে
থেকে আমাকে ধর্ম এবং সৎশিক্ষা দান করুন। আমার বিশ্বাস আপনি আমার পাশে থাকলে মগধ
রাজ্যে আরও উন্নতি এবং শান্তি আসবে”।
সিদ্ধার্থ স্মিত মুখে বললেন, “হে মহারাজ, আমি এই
অরণ্যেই অভ্যস্ত, আমি
বেশ আছি”।
“কিন্তু
এ যে কঠোর জীবনযাপন। আপনার কোন শয্যা নেই, কোন অনুচর নেই। আপনি যদি আমার সঙ্গে
আসতে রাজি হন, আমি
আপনাকে আপনার নিজস্ব প্রাসাদ বানিয়ে দেব। অনুগ্রহ করে আপনি আমার সঙ্গে আমার
প্রাসাদে চলুন”।
“মহারাজ, প্রাসাদের
জীবন আমার যোগ্য নয়। আমি নিজের এবং সকল জীবের জন্য, জীবনের সব দুঃখ-শোক থেকে মুক্তির
উপায় খুঁজে চলেছি। একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রাসাদ-জীবন মোটেই উপযুক্ত নয়”।
“আমারই
মতো, আপনারও
এখন বয়স কম। আমার একজন প্রকৃত বন্ধুর প্রয়োজন, যাকে মনের সব কথা খুলে বলা যায়।
আপনাকে দেখেই মনে হল,
আপনিই সেই বন্ধু। আপনি আমার সঙ্গেই চলুন, আপনি চাইলে আমার রাজ্যের অর্ধেক আপনি
অধিকারে রাখুন। তারপর বার্ধক্য এলে, আপনি সে সব ছেড়ে চলে যাবেন আপনার
তপস্যার পথে”।
“আপনার
ঔদার্যে আমি অভিভূত,
মহারাজ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার মনের এখন একটাই লক্ষ্য, দুঃখ-শোক থেকে মানুষের মুক্তিপথের
সন্ধান। এখনই সঠিক সময়,
আমার কম বয়স, শক্তি
আছে, উৎসাহ
আছে। দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে যাবে, তখন এই শক্তি আর থাকবে না, আমারও অনুশোচনার অন্ত থাকবে না। জীবন
অনির্দিষ্ট – অসুস্থতা এবং মৃত্যু যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে। এর মধ্যেই লোভ, ক্রোধ, বিদ্বেষ, মোহ, মাৎসর্য এবং
অহংকার আমার মনকে ক্ষতবিক্ষতও করে তুলতে পারে। আপনি যদি আমাকে প্রকৃত বন্ধু মনে
করেন, আপনি
আমার পথেই আমাকে চলতে দিন”।
সিদ্ধার্থের কথায় মহারাজ বিম্বিসার মুগ্ধ হলেন, তিনি বললেন, “হে
সন্ন্যাসী, আপনার
এই দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনে আমি অভিভূত। আমি কী জানতে পারি, আপনি কোথা
থেকে এসেছেন, কোন
পরিবারে আপনার জন্ম?”
“হে
মহারাজ, আমি
শাক্যরাজ্য থেকে এসেছি। আমার পিতা শুদ্ধোদন শাক্যরাজ্যের রাজা, রাণি
মহামায়া আমার মাতা। আমার পিতা কপিলাবস্তু রাজধানীতে থেকে এখনও রাজ্য শাসন করছেন
এবং আমিই ছিলাম সেই রাজ্যের যুবরাজ। আমার নাম সিদ্ধার্থ। আজ প্রায় চারবছর হল সে সব
আমি ছেড়ে এসেছি, পিছনে
রয়েছেন আমার পিতা-মাতা,
পত্নী এবং পুত্র। আমি স্বেচ্ছায় এই সন্ন্যাস-জীবন গ্রহণ করে মুক্তির পথ খুঁজে
চলেছি”।
রাজা বিম্বিসার আশ্চর্য হয়ে বললেন, “বলেন কী, আপনার নিজের
শরীরেই রয়েছে রাজরক্ত! হে মহান সন্ন্যাসী, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমি ধন্য
হলাম। শুনেছি শাক্য এবং মগধের রাজ পরিবারে কিছুদিন আগেও খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল।
আর আমি কী না মূর্খের মতো আপনাকে রাজ্যের লোভ দেখিয়ে আমার প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার
চেষ্টা করছিলাম! আমাকে ক্ষমা করবেন, হে সন্ন্যাসী। তবে আমার একটাই অনুরোধ, আপনি যতদিন
এখানে আছেন, দয়া
করে আমার প্রাসাদ থেকেই ভিক্ষা গ্রহণ করবেন। আমি বিশ্বাস করি আপনি যে পথের সন্ধান
করছেন, সে
পথ খুব শিগ্গিরি আপনার কাছে ধরা দেবে। আমার একান্ত অনুরোধ, সেদিন আপনি
দয়া করে আবার আসবেন,
আমি শিষ্য হয়ে আপনার পদতলে বসে, আপনার থেকেই সেই পরমজ্ঞান লাভ করব”।
সিদ্ধার্থ করজোড়ে বিনীত স্বরে বললেন, “যেদিন আমি
এই পথ আবিষ্কার করব,
মহারাজ, কথা
দিচ্ছি, আপনার
কাছে ফিরে আসব”।
মহারাজ বিম্বিসার আর কিছু বললেন না, তিনি নিচু
হয়ে সিদ্ধার্থকে প্রণাম করলেন, তারপর পাহাড়ি পথে একমাত্র অনুচরকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন।
পরদিন প্রত্যূষেই সিদ্ধার্থ পাণ্ডব পাহাড় থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, রাজা
বিম্বিসার মাঝে মাঝেই তাঁর কাছে আসবেন এবং অনুচরদের হাতে পাঠিয়ে দেবেন প্রচুর
খাদ্যসামগ্রীর ভিক্ষা! সিদ্ধার্থ শুনেছিলেন, রাজগৃহ থেকে কিছুটা দূরেই মহাগুরু
রুদ্রক রামপুত্রর একটি বড়ো আশ্রম আছে। সেখানে তিনশ সন্ন্যাসী বাস করেন এবং চারশর
ওপর শিষ্য যোগসাধনা করেন। সিদ্ধার্থ রওনা হলেন সেই আশ্রমের দিকে।
আচার্য রুদ্রক পঁচাত্তর বছর বয়সী এক প্রাজ্ঞ
বৃদ্ধ। তাঁকে আশ্রমের সকলেই সাক্ষাৎ ঈশ্বর বলে মনে করত। সিদ্ধার্থর কাছে তাঁর
সাধনার বৃত্তান্ত শুনে আচার্য রুদ্রক তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করে বললেন, “হে
সন্ন্যাসী গৌতম, নিরাকার
অবস্থার শূণ্যতা আর যাই হোক আকাশ নয় এমনকি একে সাধারণতঃ যে চৈতন্য বলা হয়, তাও নয়।
সাধনার এই স্তরে যা থাকে তা হল উপলব্ধি এবং তার বিষয়সমূহ। মুক্তির পথ লাভ করতে
গেলে তোমাকে সেই চেতনার স্তরে উঠতে হবে যেখানে এই উপলব্ধি এবং অনুপলব্ধি – দুইই
নির্মূল হয়ে যাবে। অতএব,
তুমি এখন সেই স্তরের সাধনা কর”।
সিদ্ধার্থ তাই করলেন এবং মাত্র পনের দিনের
সাধনাতেই তিনি সমাধি লাভ করলেন, চেতনার যে অবস্থায় উপলব্ধি এবং অনুপলব্ধির কোন স্থান নেই।
কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি লক্ষ্য করলেন, যতক্ষণ তিনি
সমাধি অবস্থায় রয়েছেন,
ততক্ষণ অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করেন। কিন্তু সমাধি অবস্থার বাইরে এলেই তিনি
বুঝতে পারেন, এই
অসাধারণ অনুভূতি দিয়েও জন্ম-মৃত্যু সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না। আচার্য রুদ্রক
রামপুত্র তাঁর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “সন্ন্যাসী গৌতম, আমার দীর্ঘ
অভিজ্ঞতায় তুমিই আমার শ্রেষ্ঠ ছাত্র। তুমি এত কমবয়সে সাধনার যে উচ্চস্তরে পৌঁছেছো, তা এক কথায়
অচিন্ত্যনীয়। তোমার এবং আমার সাধনা এবং প্রজ্ঞায় কোন পার্থক্য আর রইল না। তুমি এই
আশ্রমেই থেকে যাও, আমার
সঙ্গেই তুমিও এখানকার আচার্য হও। আমার বয়েস হয়েছে, আমার মৃত্যু হলে, তুমিই হবে
এই আশ্রমের আচার্য”।
সিদ্ধার্থ রাজি হলেন না। তাঁর লক্ষ্য
জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি, তিনি চেতন-অচেতন, উপলব্ধি-অনুপলব্ধির সাধনা নিয়ে কী
করবেন? তিনি
আচার্য রুদ্রককে বিনীত শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁর আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। এই
আশ্রমে কৌণ্ডিল্য নামে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে সিদ্ধার্থের অন্তরঙ্গতা হয়েছিল।
সিদ্ধার্থকে তিনি যেমন শ্রদ্ধা করতেন, তেমনি ভালওবাসতেন। কৌণ্ডিল্য
সিদ্ধার্থর সঙ্গে বহুদূর এসে তাঁকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সিদ্ধার্থ
একদিন তার লক্ষ্যে পৌঁছবেনই।
৩.২.২ তপস্বী সিদ্ধার্থ
আচার্য রুদ্রকের আশ্রম থেকে বেরিয়ে, সিদ্ধার্থ
পশ্চিম দিকে হাঁটতে লাগলেন। তিনি চিন্তা করলেন, বিগত বছর চারেক ধরে তিনি এতজন
বিখ্যাত আচার্য এবং ঋষিদের থেকে এত ধরনের শিক্ষা নিলেন, কিন্তু কেউই
তাঁর লক্ষ্যপথের সন্ধান দিতে পারলেন না। এবার তাঁর মনে হল, আর কোন গুরু
নয়, এবার
তিনি একলাই অজ্ঞানের অন্ধকারে জ্ঞানের দীপ জ্বালার চেষ্টা করবেন।
পশ্চিমে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নৈরঞ্জনা নদীর ধারে
উরুবিল্ব গ্রামের অনতিদূরের পাহাড়ে কয়েকটি গুহা দেখতে পেলেন। তিনি স্থির করলেন, যতদিন না
তিনি মুক্তির সন্ধান পান,
এখানেই তিনি তপস্যা করবেন। মনোমত একটি গুহায় ধ্যানাসনে বসে তিনি চিন্তা করলেন, এতদিন তিনি
অনেক তপস্বীকে বলে এসেছেন,
কৃচ্ছ্রসাধন তপস্যার কোন পন্থা হতে পারে না। জীবনে এমনিতেই যথেষ্ট দুঃখ রয়েছে, তার ওপর
কৃচ্ছ্রসাধনে আরও দুঃখ ডেকে আনা অর্থহীন। কিন্তু এখন তাঁর অন্যরকম মনে হল, নরম বা ভেজা
কাঠে তো আগুন ধরানো যায় না। আমাদের দেহও তো ওই কাঠেরই মতো। মনের সকল কামনা যদি
কঠোর হাতে নিবৃত্ত করা না যায়, তাহলে কী ভাবে জ্বলবে জ্ঞানের আলো? তিনি স্থির
করলেন, “এখন
থেকে আমি কৃচ্ছ্রসাধনেই মুক্তিপথের সন্ধান করব”।
সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ কৃচ্ছ্রসাধনে তপস্যা শুরু
করলেন। গভীর রাত্রে তিনি চলে যেতেন গভীর অরণ্যে। দিনের আলোতেই যেখানে ঢুকতে ভয় করে, সেখানে তিনি
বসে থাকতেন সারারাত। সমস্ত রাত্রি আতঙ্ক এবং আশঙ্কায় তিনি শিউরে উঠতে লাগলেন, কিন্তু তাও
ধ্যানের আসন ছেড়ে উঠলেন না। গভীর অন্ধকারে কাছে চলে আসা কোন হরিণের নিঃশ্বাসের
শব্দেও তাঁর মনে হত,
এ বুঝি কোন হিংস্র প্রাণী। ময়ুরের পায়ের চাপে গাছের শুকনো ডাল ভাঙার আওয়াজে
তাঁর মনে হত, ওই
অজগর আসছে। ভয়ে তাঁর দাঁতে দাঁত লেগে যেত, দমবন্ধ হয়ে আসত, কিন্তু
ধ্যানের আসন তিনি ছাড়েননি। তাঁর মনে হয়েছিল, এভাবেই দূর করা যাবে মনের যত ভয় এবং
আতঙ্ক, যে
আতঙ্ক আমাদের অনেক দুঃখেরই কারণ। তিনি দীর্ঘক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ করে ধ্যান করতেন।
অসহ্য যন্ত্রণায় তাঁর মাথা দপদপ করত, মনে হত তাঁর সমস্ত শরীরে আগুন জ্বলছে, সারা শরীরে
অনুভব করতেন অসহ্য যন্ত্রণা। কখনও মনে হত কানের মধ্যে বেজে উঠছে বজ্রপাতের আওয়াজ, কখনো মনে হত
কেউ যেন তাঁর পেট কেটে ফেলেছে, যন্ত্রণায় কাটা পশুর মতো ছটফট করছেন তিনি। কঠোর এই তপস্যায়
তাঁর শরীরের কষ্ট সহ্য করার শক্তি বেড়ে গেল বহুগুণ, কিন্তু তাও তিনি মুক্তিপথের দিশা
পেলেন না।
এমন কঠোর তপস্যার যখন ছ’মাস চলছে, একদিন তাঁকে
খুঁজতে খুঁজতে উপস্থিত হলেন সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্য এবং আচার্য রুদ্রকের আরও চার
শিষ্য। সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্যও কিছুদিন আগেই সাধনায় উপলব্ধি-অনুপলব্ধির স্তরে পৌঁছে
গেছেন। যেহেতু আচার্য রুদ্রকের থেকে এর পরে আর কিছু শিক্ষা পাওয়ার নেই, তাই তিনি
এবং তাঁর সহ-সন্ন্যাসীরা বেরিয়ে পড়েছেন, সিদ্ধার্থের সন্ধানে। সন্ন্যাসী
কৌণ্ডিল্যর ধারণা সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ আরো উচ্চমার্গের পথিক। সিদ্ধার্থ তাঁদের
পাঁচজনের কাছেই কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন তপস্যার কথা বললেন। তিনি বললেন, এই
তপস্যাতেই হবে চিত্তশুদ্ধি,
মন থেকে মুছে যাবে কাম,
ক্রোধ, ভয়, মায়া, মোহ, অহংকার, দ্বেষ -
সমস্ত রিপু। সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্য এবং অন্য সন্ন্যাসীরাও - বপ্র, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ এবং
মহানামা, সানন্দে
গৌতমের সঙ্গে তপশ্চর্চার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্থির হল, প্রত্যেকদিন তাঁদের মধ্যে থেকে একজন
কেউ কাছাকাছি গ্রাম থেকে ভিক্ষা আনবেন, সেই ভিক্ষাই ছয়ভাগ করে, সকলে আহার
করবেন। আহারের পরিমাণ হবে সামান্য, তাতে কৃচ্ছ্রসাধন বাড়বে, বাড়বে
তপস্যার তীব্রতা।
স্বল্পাহার এবং কঠোর তপস্যায় পাঁচজন সন্ন্যাসীই
সেখানে আরও ছ’মাস রয়ে গেলেন। তাঁদের দেহ এখন অত্যন্ত শীর্ণ এবং দুর্বল। পাহাড়ের
গুহা ছেড়ে তাঁরা পূর্বদিকে,
উরুবিল্ব গ্রামের কাছাকাছি নৈরঞ্জনা নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলেন। সিদ্ধার্থ এই
সময় তাঁর তপস্যার কঠোরতা আরও বাড়িয়ে দিলেন। এখন আর তিনি দিনে একবার ভিক্ষার অন্নও
খান না। বনের মধ্যে যেদিন যা জোটে তাই খান। কোনদিন মাটিতে খসে পড়া কষ্টা পেয়ারা, কোনদিন বা
ষাঁড়ের শুকনো গোবর। এখন তিনি নদীতে স্নান করাও ছেড়ে দিলেন। গৌতমের শরীর এখন
কঙ্কালসার, এতটুকু
মাংসও যেন আর অবশিষ্ট নেই,
চূড়ান্ত দুর্বল।
একদিন প্রখর রৌদ্রে বসে সারাটা দিন ধ্যান করার পর, দিনান্তে
সূর্য তখন অস্তাচলে। অপরাহ্নের শীতল বাতাস তাঁর শরীরে এনে দিল স্নিগ্ধতা, মনেও অনুভব
করলেন শান্তি। হঠাৎ তাঁর ধ্যানস্থ অন্তরে মনে হল, এ তিনি কী করছেন? দেহ ও মন তো
কোন আলাদা সত্ত্বা নয়। তিনি অনুভব করলেন, দেহ যদি শান্তি না পায়, মন শান্ত
হবে কী করে? তিনি
দেহকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন,
মানে মনকেও সমান কষ্ট দিচ্ছেন। তাহলে আর কোন মনের চিন্তনে তিনি উপলব্ধি করবেন, পরম সত্য?
এতদিন তিনি ধ্যান করে চেতন-অচেতন, উপলব্ধি-অনুপলব্ধির
স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন,
কখনো দেহ তাঁর ধ্যানের অন্তরায় তো হয়নি। বরং সাধনার অনুভূতি তাঁর মনে এনে
দিয়েছিল অদ্ভূত আনন্দ ও প্রশান্তি। তাঁর মনে হল, “এই আনন্দ-প্রশান্তি তো কোন পার্থিব
কামনা বা ভোগের বিষয় নয়। বরং এই প্রশান্তি তাঁর দেহকে এবং মনকে পুষ্ট করেছে, পৌঁছে
দিয়েছে সাধনার পরবর্তী স্তরে। তিনি প্রচলিত পুঁথিগত ধারণার বশে এ কোন কৃচ্ছ্রসাধনে
দেহ নিপাত করছেন, সঙ্গে
সঙ্গে বিনাশ করছেন মনকেও”?
তিনি স্থির করলেন,
এখন থেকে তিনি নিজেই নিজের পথ সৃষ্টি করবেন, অন্য কোন মতবাদ অথবা শাস্ত্রীয়
নির্দেশাবলী আর অনুসরণ করবেন না। বহুদিন পর সিদ্ধার্থের ভীষণ ঘুম পেল, তিনি নরম
ঘাসের ওপর শুয়ে গভীর ঘুমে ডুব দিলেন। তাঁর মাথার ওপর নির্মেঘ আকাশে তখন ঝলমল করছে
ছায়াপথ, আর
পূর্ণ চাঁদের জ্যোস্না।
পরের দিন ভোরে ঘুম ভেঙেই মনে পড়ল গত রাত্রে নেওয়া
তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকালেন। সমস্ত শরীরে ধুলো, কাদা, কদর্য মলিন।
পরনের বস্ত্রটি যেমন ছেঁড়া তেমনি ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত। তাঁর মনে পড়ল গতকাল গ্রামের কিছু মানুষ নদীতীরে
এসেছিল, মৃতদেহ
সৎকার করতে। সৎকার শেষে নদীর পাড়েই তারা ফেলে গিয়েছে একটি লালবস্ত্র, যে বস্ত্রে
তারা ঢেকে এনেছিল শবদেহ। সিদ্ধার্থ ধীর পায়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন, বহুদিন পর
তিনি আজ স্নান করবেন। পবিত্র করবেন তাঁর শরীর, মলিন বসন ত্যাগ করে, নতুন বস্ত্র
পরবেন। বহতা নদীর জলে শুদ্ধ হয়ে উঠবে সন্ন্যাসীর রক্তবসন, হোক না সে
গতকালের শবাচ্ছাদন।
সমস্ত শরীর ঘষে ঘষে স্নান করতে এবং সেই বস্ত্র
কাচতে তাঁর অনেকটাই সময় লাগল এবং পরিশ্রমও হল। জল থেকে উঠে আসার সময় তাঁর মাথাটা
ঘুরে উঠল, পা
টলে গেল। জলের ধারেই নিচু হয়ে আসা একটা গাছের ডাল ধরে তিনি কোনমতে উঠে এলেন পাড়ে।
পাড়ে উঠে বড় একটি গাছের তলায় বসলেন, রোদ্দুরে শুকোবার জন্যে, ঘাসের ওপর
বিছিয়ে দিলেন কেচে আনা ভেজা কাপড়। অপেক্ষা করলেন অনেকক্ষণ, তারপর শুকনো
কাপড় পরে স্থির করলেন,
কাছেই উরুবিল্ব গ্রামে যাবেন ভিক্ষা করতে। কিন্তু দুর্বল পায়ে কিছুটা চলার পর
আর পারলেন না, সমস্ত
জগৎ যেন অন্ধকার হয়ে এল,
তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।
বনের দেবতাকে দুধের নৈবেদ্য দিতে সে পথেই আসছিল
বালিকা সুজাতা। পথের ধারে মাটিতে সে পড়ে থাকতে দেখল একটি কঙ্কালসার মানুষকে। সে
জানে মানুষটি সন্ন্যাসী,
এর আগেও সে বহুবার দেখেছে তাঁকে, নদীতে যাওয়ার পথে, বনের
দেবস্থানে যাওয়ার সময়। মেয়েটি হাঁটু মুড়ে বসল, দেখল মানুষটির শ্বাস চলছে কিন্তু
অত্যন্ত ধীর। সে বুঝতে পারল মানুষটি ক্ষুধার্ত এবং অত্যন্ত দুর্বল। সে তার হাতের
দুধের বাটি কাত করে এক-দু ফোঁটা ফেলল মানুষটির ঠোঁটে। ঠোঁট এবং জিভে দুধের স্বাদ
লাগতেই সিদ্ধার্থর নিস্তেজ দেহে যেন প্রাণ ফিরে এল। তিনি উঠে বসলেন, সুজাতার হাত
থেকে দুধের বাটিটি নিয়ে পরমতৃপ্তিতে পান করলেন সবটুকু দুধ। তারপর সুজাতাকে ইশারা
করলেন আরও একবাটি দুধ দিতে,
সুজাতা দিল।
তারপর থেকে গৌতম কৃচ্ছ্রসাধনের তপস্যা ছেড়ে আগের
সন্ন্যাস জীবনেই ফিরে গেলেন। তিনি রোজই এখন নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করেন। দুবেলা
নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতেও গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তিনি রোজই ভিক্ষা করতে যান
গ্রামে, কখনো
কখনো গোপবালিকা সুজাতা তাঁর জন্যে খাবার নিয়ে আসে। দিনের অন্য সময় গাছের ছায়ায় বসে
ডুব দেন গভীর চিন্তনে। তাঁর সঙ্গী পাঁচ সন্ন্যাসী তাঁর আচরণে এখন বিরক্ত।
সিদ্ধার্থ এখন রোজই খাবার খান। আগের মতো সেভাবে কঠোর সাধনাও করেন না। নদীর ধারে
ঘুরে ঘুরে বেড়ান। একটি মেয়ের সঙ্গে গৌতম প্রায়ই হেসে হেসে আলাপ করেন, তার আনা দুধ
তৃপ্তি করে খান। তাদের মনে হল, সিদ্ধার্থ এখন ভ্রষ্ট, লক্ষ্যচ্যুত। সে এখন দেহসুখের জন্যে
ভোগবিলাসী হয়ে উঠেছেন। তারা একদিন কিছু না জানিয়েই সিদ্ধার্থকে ত্যাগ করে চলে গেল।
সিদ্ধার্থ সবই দেখলেন,
কিন্তু বাধা দিলেন না।
সিদ্ধার্থের মনে এখন নিত্য নতুন উপলব্ধি। তিনি
এখন দেহের ধ্যান করতে করতে অনুভূতির ধ্যান করেন, অনুভূতি থেকে পৌঁছে যান চেতনায়। তিনি
উপলব্ধি করছেন দেহ ও মনের একাত্মতা, তিনি উপলব্ধি করছেন, দেহের
প্রতিটি কোষেই রয়েছে অনন্ত প্রজ্ঞা। এতদিন বেদের তত্ত্ব থেকে তাঁর ধারণা ছিল, দেহ
পঞ্চভূতে গড়া একটি খোলস মাত্র। দেহের অন্তরে থাকে আলাদা একটি সত্ত্বা, যার নাম
আত্মা। জীবের সকল কার্য-কারণ নিয়ন্ত্রণ করে সেই আত্মা। কারণ আত্মাই জীবের
ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে জীবের বুদ্ধি, বিবেক, চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশাল এক
অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে ধ্যানস্থ সিদ্ধার্থের চেতনায় এখন মাঝে মাঝেই এমন নতুন
উপলব্ধি ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। ধীরে ধীরে তাঁর মনে আসছে অসীম প্রশান্তি, অদ্ভূত এক
আনন্দ। সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করছেন লক্ষ্য থেকে তিনি খুব বেশি দূরে নয়।
এই সময়েই নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসীর নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠল
এক বালক, মহিষপালক
স্বস্তি, বালিকা
সুজাতা এবং তাদের সমবয়সী বন্ধুরা। অশিক্ষিত এই গ্রাম্য বালক-বালিকাদের সঙ্গে তাঁর
উপলব্ধির কথা যখন তিনি আলোচনা করেন, তারা ঠিকই বুঝতে পারে, তাঁর মনের
কথাটি। তারাও আনন্দ পায়,
খুশি হয়, তাদের
সন্ন্যাসীর এই সাফল্যে। তারা যথাসাধ্য খেয়াল রাখে সন্ন্যাসীর সুখ-সুবিধার। একদিন
নদীর ধার থেকে একবোঝা কুশতৃণ কেটে এনে, সন্ন্যাসীর ধ্যানে বসার নরম আসন
বানিয়ে দিল স্বস্তি। অশ্বত্থের ছায়ায় সজীব কুশের নরম আসনে বসে গৌতম আরও নিশ্চিন্ত
মনোযোগে নতুন করে ধ্যান শুরু করলেন।
অশ্বত্থের ছায়ায় কুশাসনে নিবিষ্ট ধ্যানে বসে
সিদ্ধার্থ দেখলেন, তাঁর
দেহ অজস্র কোষে বিভক্ত। প্রত্যেকটি কোষ যেন এক একটি জলবিন্দু। তারা নদীর মতোই
সর্বদা অনন্ত প্রবাহে বয়ে চলেছে, তারা জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। সতত
পরিবর্তনশীল এই দেহে চিরস্থায়ী অথচ ভিন্ন, এমন কোন সত্ত্বা দেখতে পেলেন না।
দেহের এই প্রবাহের মতোই অঙ্গাঙ্গী বয়ে চলেছে অনুভূতির একই রকম প্রবাহ, তারও আছে
জন্ম-মৃত্যু এবং অস্তিত্ব। এই অনুভূতির কিছু আনন্দময় কিছু নিরানন্দ, আবার কিছু
নির্বিকার। এই অনুভূতিগুলিও সতত পরিবর্তনশীল এবং অস্থায়ী।
এর পরে আরও একনিষ্ঠ সাধনায়, সিদ্ধার্থ
উপলব্ধি করলেন চেতনার প্রবাহ। এই প্রবাহও দেহের কোষপ্রবাহ এবং অনুভব-প্রবাহের মতোই
প্রবহমান। এই তিন প্রবাহই জীবের জন্ম, বেঁচে থাকা এবং মৃত্যুর সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গী সংযুক্ত। যার চেতনা সঠিক বাস্তবে যত সুস্থিত, সেই জীব ততই
প্রশান্ত। কিন্তু যাদের ভ্রান্ত চেতনায় বাস্তব সুপ্ত, তারাই অনন্ত
কষ্টের শিকার। তারা অস্থায়ীকে মনে করে চিরন্তন, যা কিছু অবিচ্ছিন্ন, তাকেও
বিচ্ছিন্ন দেখে। এরপর তিনি সচেতন হলেন দুঃখ-শোকের কারণসমূহে - ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা, অবিনয়, ঈর্ষা, লোভ। তাঁর
মনের মধ্যে উজ্জ্বল সূর্যের মতোই স্পষ্ট হল যে, দুঃখ-শোকের এই সমস্ত কারণের পিছনে
আছে শুধুই অজ্ঞানতা। অজ্ঞান থেকেই মনে আসে নানান প্রতিকূলতা, তার থেকেই
আসে মানসিক তমসা – এই তমসা অজ্ঞানতার তমসা। তিনি উপলব্ধি করলেন মন থেকে এই
অজ্ঞানতা দূর করতে পারলেই,
মুক্তির পথ নিজেই এসে ধরা দেবে প্রত্যেক মানুষের মনে। এই জ্ঞান যুক্তি আর তর্ক
দিয়ে অনুধাবন করার নয়,
এই জ্ঞান আসে ভিতর থেকে, নিজস্ব অভিজ্ঞতায়। অতীতে সিদ্ধার্থ মন থেকে ভয়, ক্রোধ এবং
লোভ ত্যাগ করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন সফল হননি, কারণ তখন
সেই চেষ্টা ছিল এই প্রবৃত্তিগুলিকে নিছক অবদমনের। এখন উপলব্ধি করলেন, অজ্ঞান থেকে
মন মুক্ত হতেই, সে
সব নিজে নিজেই দূর হয়ে গেল মন থেকে, যেভাবে ভোরের আলোয় দূর হয়ে যায় রাতের
অন্ধকার।
তিনি স্মিত মুখে ওপরের দিকে তাকালেন, দেখলেন, নীল আকাশের
বুকে যেন একটি অশ্বত্থপাতা আঁকা হয়ে আছে। অশ্বত্থপাতার দীর্ঘ পুচ্ছ বাতাসে দুলছে, যেন তাঁকেই
ডাকছে বারবার। সেই পাতার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, ওই পাতার
মধ্যেই রয়েছে সূর্য এবং সকল তারা। কারণ সূর্যের আলো আর উত্তাপ ছাড়া ওই পাতার
অস্তিত্বই থাকত না। ওই পাতার মধ্যেই রয়েছে মেঘ ও বৃষ্টি। কারণ মেঘ থেকেই হয় বৃষ্টি, আর সেই
বৃষ্টি ছাড়াও ওই পাতা সৃষ্টি হতে পারত না। ওই পাতায় তিনি আরও দেখলেন পৃথিবী, সময়, আকাশ এবং
মন। এই সব কিছু ছাড়া ওই পাতার কোন অস্তিত্ব নেই। এক কথায় ওই পাতার মধ্যেই তিনি
দেখতে পেলেন এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। ছোট্ট ওই পাতাটির অস্তিত্বই যেন জাগতিক
এক বিস্ময়।
সাধারণতঃ আমরা দেখি বসন্তে গাছে নবীন পাতার উদ্গম
হয়। সিদ্ধার্থ দেখলেন,
শুধু বসন্তেই নয়,
ওই পাতা অনন্তকাল ধরেই রয়েছে, রোদ,
মেঘ, বৃষ্টি
আর গাছ হয়ে, যেমন
তিনি নিজেও রয়েছেন এই সবের মধ্যেই। তিনি দেখলেন, ওই পাতা কিংবা তিনি নিজে কোনদিনই
প্রকৃত অর্থে জন্ম নেননি – বিশ্বপ্রকৃতির সবকিছুর সঙ্গে তাঁরা দুজনেই উদ্ভাসিত
হয়েছেন মাত্র। তাঁদের কোনদিন যদি জন্ম না হয়ে থাকে তবে মৃত্যুই বা হবে কী করে? তাঁর মন
থেকে জন্ম-মৃত্যুর রহস্য দূর হয়ে গেল নিমেষে। তিনি উপলব্ধি করলেন, যে কোন
ঘটনার অস্তিত্বের পিছনে থাকে আরও অজস্র ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। একের মধ্যেই যেমন বহু
আছে, তেমনি
সবকিছুই সংযুক্ত আছে একের সঙ্গে।
ছোট্ট ওই পাতা এবং তাঁর শরীর একই। কারও মধ্যেই
কোন আলাদা এবং স্থায়ী সত্ত্বা নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছাড়া কারও স্বাধীন অস্তিত্ব
থাকতে পারে না। প্রকৃতির এই পারষ্পরিক নির্ভরতা দেখে সিদ্ধার্থ আরও উপলব্ধি করলেন, অজস্র
সংযুক্ত ঘটনা থেকে কোন একটিমাত্র ঘটনাকে যদি বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায়, সে তখন আসলে
শূণ্যগর্ভ হয়ে ওঠে – যাকে বলা যায় অনাত্ম অবস্থা । অথচ সকলের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায়, প্রত্যেকটি
ঘটনাই ভরে ওঠে অনন্য পূর্ণতায়। তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর মুক্তিপথের আরেকটি চাবিকাঠি এই
অবিচ্ছিন্ন পারষ্পরিক নির্ভরতা।
এবার তাঁর উপলব্ধি হল, জীবের বেঁচে
থাকার অত্যন্ত জরুরি দুটি সূত্র হল অনিত্যতা এবং অনাত্মতা। এই দুই বিষয় ছাড়া কোন
কিছুরই উদ্ভব সম্ভব হত না। মেঘ যদি অনিত্য এবং অনাত্ম না হত, তার পক্ষে
বৃষ্টি হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। বৃষ্টি যদি অনিত্য এবং অনাত্ম না হত, তার পক্ষেও
মাঠঘাট ধানের ক্ষেত্রকে সরস করে তোলা সম্ভব হত না। ধানের একটি দানা যদি অনিত্য এবং
অনাত্ম না হত, তার
পক্ষে শস্য হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। অনিত্য এবং অনাত্ম না হলে, একটি
মানব-শিশু বড়ো হতে পারত না। বিপরীত দিকে আমাদের মনে যখন নিত্যতা এবং
বিচ্ছিন্ন-সত্ত্বার ভ্রান্ত বিশ্বাস গড়ে ওঠে, তখনই শুরু হয় আমাদের দুঃখভোগ। তাই
তার্কিক পণ্ডিতেরা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে বলেন, জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-বিনাশ, পবিত্র-অপবিত্র, অন্তর-বাহির
সবই মায়া। এই সমস্ত বিষয়ের অনাত্মতা যদি কেউ উপলব্ধি করতে পারে, সে সকল
মানসিক বাধা জয় করবে এবং যাবতীয় দুঃখভোগের ঊর্ধে মুক্ত হয়ে উঠবে।
সেই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে সিদ্ধার্থ রাত্রির পর
রাত্রি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন রইলেন, তাঁর জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে লাগল তাঁর দেহ, মন এবং এই
বিশ্বচরাচর। সেই পাঁচ সঙ্গী তাঁকে কবেই ছেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন
তাঁর অনেক সঙ্গী – এই অরণ্য, নদী,
গাছপালা, পশু, পাখি, অজস্র
কীটপতঙ্গ। এই অশ্বত্থগাছ তাঁর সাধনার সঙ্গী। প্রতিদিন ধ্যানে বসার সময় তিনি যে
সন্ধ্যাতারাটি দেখেন,
সেও তাঁর সাধনসঙ্গী।
সাধারণতঃ গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাঁর কাছে আসে
বিকেলের শুরুতে। আজও যেমন সুজাতা এসেছিল চাল, দুধ আর মধু দিয়ে বানানো পায়েস নিয়ে
আর স্বস্তি এসেছিল নতুন সজীব কুশতৃণ নিয়ে। ওরা চলে যাওয়ার পর সিদ্ধার্থের মনে হল, আজ রাত্রেই
হয়তো তিনি অনুভব করতে পারবেন সেই মহাজাগরণ, যার জন্যে তাঁর এতদিনের তপস্যা।
গতকাল রাত্রে নিদ্রার মধ্যে তিনি তিনটি অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছেন। প্রথমটিতে তিনি
সুদীর্ঘ দেহ নিয়ে যেন শুয়ে আছেন, তাঁর মাথা স্পর্শ করেছে হিমালয়, বাঁহাত
স্পর্শ করছে পুবের সমুদ্র,
ডানহাত পশ্চিম সমুদ্র এবং দুই পা ছড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে। আরেকটি
স্বপ্ন হল, রথের
চাকার মতো বড়ো একটি পদ্ম,
তাঁর নাভি থেকে বেরিয়ে যেন আকাশ ছুঁয়েছে! তৃতীয় স্বপ্নটি হল রঙবেরঙের অজস্র
পাখি যেন দশদিক থেকে উড়ে আসছে শুধু তাঁরই দিকে। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় এ সবই যেন সেই
ঘোষণা – আজ তাঁর মহাজাগরণ ঘটবেই!
শেষ বিকেলে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে গৌতম
অনেকক্ষণ ধ্যান করলেন। তারপর নদীতে নেমে স্নান করলেন, গোধূলির
কিছু পরে তিনি ফিরে এলেন তাঁর বহুদিনের সাধনসঙ্গী সেই অশ্বত্থগাছের নিচে। স্বস্তির
দেওয়া তাজা কুশতৃণের নতুন আসনে তিনি বসলেন পদ্মাসনে। অদূরে বয়ে চলেছে নদী, স্নিগ্ধ
বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে ঘাসেঘাসে, গাছের পাতায়পাতায়। অন্ধকার নেমে আসছে, নীরব অরণ্য
জেগে উঠছে অজস্র কীটপতঙ্গের শব্দে। তিনি শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে নিবিষ্ট ধ্যানে মগ্ন
হতে হতে চোখ বন্ধ করলেন যখন, তখনই আকাশে ফুটল সন্ধ্যাতারা। এখন তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন
মহাজ্ঞানের প্রবেশদ্বারে সামনে, দরজা খুলে শুধু ঢোকার অপেক্ষা।
[1] কিছু
বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয়েছে,
রাজকুমার সিদ্ধার্থ রাজপথে তিনদিন এই যে তিন দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়েছিলেন, সেগুলি সবই
ছিল নাকি দেবতাদের মায়া। ওই সময় ওরকম ঘটনা বাস্তবে নাকি ঘটেনি এবং উপস্থিত নাগরিক
ও রাজকর্মচারীরা কেউই কিছু দেখতে পাননি। ওই তিনটি দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন শুধুমাত্র
দুজন, কুমার
সিদ্ধার্থ আর তাঁর রথের বিশ্বস্ত সারথি ছন্দক। যদিও রাজা শুদ্ধোদনের নির্দেশ ছিল
রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে কোন দুঃখের কথা না জানানোর, কিন্তু দেবতাদের মায়ায় ছন্দক ওই
তিনটি দৃশ্যের মর্মান্তিক বর্ণনাও তার প্রভুকে বিস্তারিত বলেছিল।
[2] কিছু
বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয়েছে,
সিদ্ধার্থের প্রাসাদ ত্যাগের রাত্রিটি, পত্নী যশোধরা আগেই উপলব্ধি করতে
পেরেছিলেন। তিনি শিশু পুত্রকে নিয়ে শয়নাগারে যাবার আগেই, বিশ্বস্ত
ছন্দককে বলেছিলেন, সিদ্ধার্থের
প্রিয় ঘোড়া কন্থককে প্রস্তুত রাখতে, এবং ছন্দক নিজেও যেন প্রস্তুত হয়ে
থাকে। কারণ সেই রাত্রে ছন্দকের প্রভু সিদ্ধার্থকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে।
সমস্ত ব্যবস্থা করে তিনি,
পুত্রকে নিয়ে শয্যায় শুতে গিয়েছিলেন। মহীয়সী যশোধরা চাননি, গৃহত্যাগের
মূহুর্তে তাঁর এবং পুত্রের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধার্থ তাঁর সঙ্কল্পসাধনে দুর্বল হয়ে
পড়ুন।
[3] পঞ্চ
তন্মাত্র সাংখ্য দর্শনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিশব্দ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
করব পঞ্চম পর্বে।
চলবে...