Powered By Blogger

মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫

জঙ্গী ব্যবসা

 

 ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির মুণ্ডপাত করছিল। আজকাল আর তলোয়ারের চল নেই, থাকলে হালাল করে পাঁচরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা যেত হতভাগার কাটা মুণ্ডুটা। অকর্মার ঢেঁকি একটা। কতদিন হয়ে গেল বেশ জুতসই খবর তৈরি করতে পারছে না। এমন একটা খবর যা শুনে গোটা হিন্দুস্থান তো বটেই – গোটা কাফের দুনিয়া চমকে উঠবে। রাত্রে ঘুমের মধ্যেও শিউরে উঠবে বারবার। আর গোটা ইসলাম দুনিয়া আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে – আহা কিছু ইসলাম ধর্মে এখনও কিছু মুজাহিদ আছে, যারা জেহাদ ভুলে যায়নি।      

বড়োসড়ো ঘটনা বলতে ১১/০৭/২০০৬-এ মুম্বইতে লোকাল ট্রেনের সিরিজ ব্লাস্ট – লোক মরেছিল ২০৯ জন। তাছাড়া মুম্বাইতেই তাজ হোটেল আক্রমণ – ২৬/১১/২০০৮ – ১৭৫ জন মানুষের মৃত্যু।  এছাড়াও অনেক আছে বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু সেসব পাতে দেওয়ার যোগ্য নয় – কোথাও ৭০ জন, কোথাও ৪০ জন, কোথাও মোটে চার-পাঁচজন। ছ্যাঃ জলের মতো টাকা যাচ্ছে। বন্দুক, গুলি, আরডিএক্স কেনা হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু  আসল কাজের বেলা লবডঙ্কা। মামুদ ঘোরিকে জরুরি তলব করেছে। হয়তো এসে পড়বে এখনই। এলে আচ্ছা করে তুলোধোনা করবে।

এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল আজানের সুরে। মামুদ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল এবং কানেক্ট করেই বলল, “জি স্যার”।

কী হচ্ছেটা কি, মামুদ। তুমি আর তোমার লোকজন কি মরে গেছ? নাকি আমার টাকা হাতিয়ে আয়েস করে দিন কাটাচ্ছো”?

“কেন, স্যার? একথা কেন বলছেন? আপনার পবিত্র টাকার প্রতিটি পাই-পয়সা আমরা জিহাদের জন্যে খরচ করছি। আপনার টাকা নিয়ে আয়েস করলে আমাদের যে দোজখেও স্থান হবে না, স্যার?”

“ঘোড়ার ডিম করছো? করলে আজ দেড় বছরের ওপর হয়ে গেল হিন্দুস্থানের গায়ে একটা আঁচড়ও কাটতে পারলে না?”

“ইয়ে, মানে হয়েছে কি স্যার, এলওসির এপারে আর বালোকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে হিন্দুস্থান আমাদের বড্ডো ক্ষতি করে দিয়েছে, স্যার। আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। নতুন ক্যাম্প গড়ে, নতুন ছেলে যোগাড় করে, তাদের ট্রেনিং দিয়ে। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে- মানে সবদিক আবার গুছিয়ে তুলতে একটু সময় লাগছে আর কি?”

“তোমার বেফিজুল বাহানায় চিঁড়ে ভিজবে না, মামুদ। কড়ি যখন গুনেছি, তেলও আমি মাখবো। তা না হলে মনে রেখো – তোমাদের প্রত্যেকের তেল আমি নিংড়ে নেব। মনে করো না, আমার পয়সা হজম করে তুমি পার পেয়ে যাবে। দুনিয়ার যেখানে তুমি ঘাঁটি গাড়বে – সেখান থেকে বের করে তোমাকে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো”।

“আজ্ঞে সে কথা তো একশবার। আপনি আমাদের পয়গম্বরের মতোই...আপনার নজর এড়িয়ে আমাদের একপাও কোথাও নড়বার জো আছে? তবে বিশ্বাস করুন, স্যার, আমরা সত্যিই বসে নেই...দিন-রাত এক করে তৈরি হচ্ছি হিন্দুস্থানের বুকে মোক্ষম আঘাত দেওয়ার জন্যে...”।

“আরে বাঃ। ২০০৬এর জুলাই মাসের মতো আরেকটা ধামাকা লাগিয়ে দাও দেখি, মামুদ। ওফ্‌ সেবার যা মজা পেয়েছিলাম। টিভিতে হিন্দুস্থানের লোকদের হাহাকার যত শুনেছি – ততই তোমাদের জন্যে আমার গর্বে বুক ফুলে উঠেছে। মনে হয়েছিল হিন্দুস্থানের বরবাদ হতে আর বাকি নেই...হা হা হা হা হা। তারপর তোমরাই করলে তাজ হোটেলের সেই গণহত্যা। সে সব দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আহা কী আনন্দ, কি আনন্দ...হিন্দুস্থানের মুম্বাই শহর – সারা বিশ্বে তার কম গুরুত্ব? আর সেই শহরের সেরা হোটেল – কি তার শান, শওকত – সেখানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলে, হে তোমরা! ওই দেখ আমি আবার গঙ্গা বলে ফেললাম – বলা উচিৎ ছিল রক্তসিন্ধু...”।

“যা বলেছেন স্যার। সবই আল্লা আর আপনার রহমত...”।

“ভেবেছিলাম ওরকম একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে তুমি হিন্দুস্থানের দফারফা করে দেবে...ও মা কোথায় কি? তারপর থেকেই তোমরা কেমন যেন মিইয়ে গেলে...ভেজা বেড়ালের মতো... আঁচড়ে কোন ধার নেই...ছ্যাঃ ছ্যাঃ - এর জন্যে আমি তোমাদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছি?”

“একটু ধৈর্য ধরুন, স্যার। আবার হবে। আসলে কী জানেন, স্যার? হিন্দুস্থানের লোকগুলো আর আগের মতো ন্যালাভোলা নেই। সেয়ানা হয়ে উঠেছে খুব। ওদের জালে প্রায়ই আমাদের লোকজন ধরা পড়ে যাচ্ছে...তার মধ্যেও ঘটনা ঘটাইনি তা নয় – যেমন ধরুন ২০০৮-এর জয়পুরের সিরিজ ব্লাস্ট – ৭১ জন মরেছিল, স্যার। আমার সামনে পুরো লিস্ট রয়েছে স্যার। তারপর ধরুন, ওই ২০০৮এই আমদাবাদের সিরিজ ব্লাস্ট – লোক মরেছিল ৫৬ জন। ছোটখাটো ব্লাস্টিংগুলো বাদ দিলেও ২০১৯-এ উরি, পুলওয়ামা, কিংবা তারও আগে সেই ২০০১-এর পার্লামেন্ট হাউস...”।

ফোনের ওপাশ থেকে প্রচণ্ড চিৎকারে উত্তর এল, “রাখো তোমার ওই ছুটকো পটকা ফাটানোর হিসেব...। মিলিটারি, জওয়ান কিংবা পুলিশের লোক মেরে লাভটা কী হয়েছে? হিন্দুস্থানের সাধারণ হিন্দুদের মনে ভয় ঢুকেছে? হিন্দুস্থানের মুসলিমরা প্রকাশ্যে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতে পেরেছে? গলাবাজি করে এমন বলছো মনে হচ্ছে হিন্দুস্থানের আধখানা জয় করে ফেলেছো? উরি আর পুলওয়ামা কাণ্ডের পর হিন্দুস্থান এমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করল – একটু আগেই তো বালাকোটে তোমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে নাকে কাঁদছিলে! লজ্জা করে না, বেশরম? আর বুক বাজিয়ে পার্লামেন্টের কথা বলছ – তোমার সব কটা লোককেই তো কুকুরের মতো গুলি করে মেরে দিয়েছিল, মনে নেই? ওদের মরেছিল, পাঁচজন পুলিশ, একজন নিরাপত্তা কর্মী আর একজন মালী – বেচারা বাগানে কাজ করছিল”।

মামুদ কোন উত্তর দিল না, ওপাশের ঝাড় শুনতে শুনতে তার কান এবং মাথা গরম হয়ে উঠল। বিদেশের এই ব্যক্তিটির সঙ্গে তার যোগাযোগ হট-লাইনে, যখন তখন ফোন করে আর ঝাড়ে। এতদিনে মামুদ টের পেল এ লাইনটাকে কেন হট-লাইন বলা হয় – হারামিটা চেঁচিয়ে মাথা-কান গরম করে তুলল। উপায় নেই, হতভাগার প্রচুর টাকা, ঝাড় শুনতেই হবে। তবে এটাও ঠিক ব্যাটা হাত ঝেড়ে কোটি কোটি টাকাও বের করে দেয়।  

“কী হল? বোবা মেরে গেলে কেন? কানে কথা ঢুকছে না?” ওপাশ থেকে আবার কড়া প্রশ্ন আসাতে সুলতান মামুদ বলল, “না স্যার...মানে হ্যাঁ স্যার – শুনছি স্যার”।

“হুঁ। কী ভাবছো কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু একটা করবে- নাকি বসে বসে হিন্দুস্থানের দিকে তাকিয়ে কুকুরের মতো শুধু লেজ নেড়ে ঘেউ ঘেউ করবে?”

“করছি তো স্যার, আমরা কি ছেড়ে দেওয়ার লোক, স্যার? এবার এমন প্ল্যান করেছি না, স্যার, হিন্দুস্থানের সাধারণ হিন্দুরা ভয়ে, আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠবে – আর ভাববে মুসলমান ঘরে জন্ম না হয়ে কেন ওদের জন্ম হিন্দু ঘরে হল...দেখে নেবেন স্যার”।

“আচ্ছা?” ফোনের ওপাশ থেকে খ্যাঁ খ্যাঁ হাসির শব্দ শোনা গেল – অনেকটা হায়নার ডাকের মতো... “তা প্ল্যানটা কী শুনি”?

“না স্যার, প্ল্যানটা এখনই বলব না। তবে কাশ্মীরের বিখ্যাত কোন টুরিস্ট স্পটে হামলা করার একটা প্ল্যান করেছি – ঠিকঠাক লেগে গেলে স্যার – শুধু হিন্দুরা নয় – কাশ্মীরের মুসলমানরাও জব্দ হয়ে যাবে। কাশ্মীরী এই মুসলমানগুলো হিন্দু টুরিস্টদের থেকে ভালই পয়সা কামায় স্যার। সেই জন্যে জিহাদ-টিহাদ ভুলে এখন দু হাত তুলে আনন্দে নাচছে...। ওদের এই ভালো থাকার আনন্দও ফাটা বেলুনের মতো একেবারে ফুস হয়ে যাবে”।

“সত্যি? মাইরি বলছো? আহা তোমার প্ল্যানের কথা শুনেই কী আনন্দ যে হচ্ছে...। ঠিকঠাক করতে পারলে না জানি কী হবে। একটা ব্যাপার মনে রাখবে সব সময় – আমাদের প্রধান লক্ষ্য হিন্দুরা হলেও – হিন্দুস্থানে থাকা মুসলিমরা – যারা জিহাদ ভুলে হিন্দুস্থানি হয়ে উঠছে দিনকে দিন – তাদেরও চমকাতে হবে। তাদেরও বোঝাতে হবে...মুসলমান হয়েছ যখন, আমাদের সঙ্গে বেরাদরি কর। তা না হলে মৃত্যুর পর ওদের ঠাঁই হবে দোজখে। শুধু মুসলমান বলেই মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে বাহাত্তর হুরি-পরি নিয়ে ঢালাও ফুর্তির আসরে যোগ দেওয়া যাবে না। যাগ্‌গে কবে নাগাদ করছো হামলাটা?”

“খুব শিগ্‌গিরি স্যার, কাশ্মীরে এখন বেড়াতে আসার ভরপুর মরশুম কিনা, তাই এমাসের শেষ দিকে কিংবা সামনের মাসের মাঝামাঝি”।

“আরে এমাসেই সেরে দাও, ওমাসের জন্যে অপেক্ষা করতে যেও না”।

“অপেক্ষা করতে চাইছি না, স্যার – আটকে যাচ্ছি অন্য একটা ব্যাপারে”।

“কী ব্যাপারে”?

“কী আর বলব স্যার। আপনার মতো মহান ইসলাম দরদী মানুষের কাছে বারবার বলতে লজ্জা করছে স্যার”।

“ন্যাকামি রেখে, কী বলতে চাইছ, বল না ছাই”।

“আজ্ঞে কিছু টাকার খুব দরকার ছিল -  আপাততঃ কোটি দশেক যদি দেন...কাজটা চটপট শুরু করে দিতে পারি”।

“দ-অ-অ-শ কোটি? টাকা কি খোলামকুচি নাকি – কী ভাবো বলো তো?”

“সত্যি বলছি, স্যার। এভাবে আপনার কাছে চাইতে খুব লজ্জা করে। কিন্তু কী করবো স্যার, উপায় নেই। বছর দশ পনের আগেও ছেলেপিলের দল – ছমাসের ট্রেনিং নিয়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ত জিহাদিতে। নগদ টাকা-পয়সার দিকে কোন খাঁই ছিল না। ফ্রিতে থাকা খাওয়া টুকটাক হাত খরচা দিলেই চলে যেত। এখন সেই ছেলেদের বাড়ি থেকে বের করতেই, তাদের বাপ-মাকে পনের-বিশ লাখ টাকা গুনে দিতে হয়। তারা বলে, এ ছেলে তো আর ফিরবে কিনা ঠিক নেই – হিন্দুস্থানের জওয়ানদের গুলিতে হয়তো বেঘোরে মরবে। ছেলে যদি ঘরে থাকত – পনের-বিশ লাখ টাকা তো তারা তিন চার বছরেই কামাই করে নিতে পারত – হিন্দুস্থানী টুরিস্টদের সার্ভিস দিয়ে। তারপর ধরুন হিন্দুস্থানে ঢুকে যাদের বাড়িতে কদিন থাকবে, খাবে – তারাও আগে পয়সা নিত না। এখন পারহেড পারডে এক লাখ থেকে দেড় লাখ করে চাইছে – তাদের শেল্টার দেওয়ার জন্যে। বলছে সন্ত্রাসী হানার পর হিন্দুস্থানি মিলিটারিরা খোঁজখবর নিয়ে ঠিক পৌঁছে যায় বাড়িতে – বাড়ির ছেলেদের ধরে নিয়ে জেলে ভরে দেয়, বাড়ির অন্য লোকদেরও জিজ্ঞাসাবাদের নামে বড্ডো হয়রানি করে, স্যার। তাছাড়া বন্দুক আর গোলাগুলির দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চার মাস আগেও আমেরিকান কিংবা চিনের বন্দুকের দাম যা ছিল, এখন তা বেড়েছে দুগুণ, তিনগুণ করে। দালালরা বলছে, বিশ্বের সব দেশই এখন সন্ত্রাসবিরোধী এবং শান্তিকামী হয়ে উঠছে, তাই ওই সব দেশের ভালো বন্দুক যোগাড় করতে আমরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি, স্যার”।

ফোনের ওপাশ থেকে অশ্রাব্য একটা গালাগাল উড়ে এল, তারপর উত্তর এল, “আচ্ছা, মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভাব কি কমে যাচ্ছে? এমন একটা মহৎ কাজের জন্যে নিজেকে কুরবানি দেওয়ার এমন একটা সুযোগ পাচ্ছিস, তার জন্যে কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবি, তা নয় শুধু টাকা-টাকা করছিস? ছিঃ। টাকা কি সঙ্গে যাবে? তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি মামুদ। ঠিক আছে – তোমাকে দশ কোটিই দেব। কিন্তু এখন দেব সাত কোটি। পরে ঠিকঠাক কাজ হলে বাকি তিন দেব। আর সেরকম মোক্ষম কিছু করে যদি আমাকে খুশি করতে পারো...তাহলে হয়তো আরো বেশি। কি খুশি তো?”

“সে কথা আর বলতে, স্যার। আপনাকে খুশি রাখাই আমার জীবনের লক্ষ্য। তা টাকাটা কখন পাবো, স্যার?”

“ধরো, ট্রান্সফার হয়ে গেছে তোমার অ্যাকাউন্টে...ও নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, মামুদ। তুমি কাজে মন দাও”।

“জি স্যার”।

 

 

ফোনটা রেখে টেবিলের ওপর তবলার ঠেকা দিয়ে সুলতান মামুদ একটা গজলের সুর ভাঁজল কিছুক্ষণ। তারপর ল্যাপটপ খুলতে খুলতে ভাবল, এমন সব বুরবক জিহাদিরা আছে বলেই, ওদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে তার বাপ-ঠাকুরদারা আমীর হয়েছিল। এভাবে চলতে থাকলে তার নাতি-পুতিরাও স্বচ্ছন্দে পায়ের ওপর পা তুলে, রাজার হালে থাকতে পারবে। পাসওয়ার্ড এবং ফেস আইডেন্টিফিকেশন করে, লগইন করে খুলল, ইংল্যাণ্ডের একটি বিখ্যাত ব্যাংকের হোমপেজ। সেখানে লগইন করা মাত্র – একটা নোটিফিকেশন এল সাত কোটি টাকা ক্রেডিট হয়েছে তার অ্যাকাউন্টে। এবং তার অ্যাকাউন্টের প্রেজেন্ট ব্যালান্স সাড়ে পাঁচহাজার কোটির কিছু বেশি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে – সুলতান মামুদ লগ আউট করল ব্যাংকের সাইট থেকে। তার মুখে মুচকি হাসি।

চেয়ার থেকে উঠে আট তলায় তার এই চেম্বারের কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে ধূসর রঙের আকাশ। অনেক নীচেয় শহরের ঘিঞ্জি রাস্তায় এখন বিশাল জ্যাম। কয়েকশ গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। তার ফাঁকে ফাঁকে গোঁজা আছে টাঙ্গা, অটো, স্কুটার, বাইক...আর সেই সব এড়িয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে পিঁপড়ের মতো অজস্র মানুষ। ওদের মধ্যে কত যে বেকার ছোকরা আছে – যারা প্রত্যেকেই ভবিষ্যতের সফল জিহাদি হয়ে উঠতে পারে। আর বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যেই হয়তো কারো ছেলে এখন আজাদ কাশ্মীরের জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে চলেছে হিন্দুস্থান সীমান্তের দিকে। সাত-দশ দিনের মধ্যে হামলা করবে হিন্দুস্থানের সাধারণ মানুষের ওপর – বিশেষ করে যারা হিন্দু। তাদের পড়ে থাকা লাশ ঘিরে হিন্দুস্থানী মহিলাদের হাহাকার সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে...।

দরজায় খুট করে আওয়াজ হতে ঘুরে তাকাল সুলতান মামুদ, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার পিএ, বলল, “স্যার, মহম্মদ ঘোরি স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, পাঠাবো”?

একটু চিন্তা করে সুলতান মামুদ বলল, “হুঁ পাঠাবে – কিন্তু তার আগে বলো তো রাজিয়া, তোমার কাছে ক্যাশ কত আছে”?

“বারো”।

“গুড। হতভাগা ঘোরি তো এসেছেই টাকা চাইতে। ওখান থেকে সাত নিয়ে এসো তো। অর্থ দপ্তরে এই খরচের হিসেব পাঠিয়ে, ইমিডিয়েট ক্যাশের জন্যে রিকুইজিসন পাঠাও”।

““কন্টিনজেন্সিস ফর মিলিট্যান্ট অ্যাকশনস” হেডেই খরচটা দেখাবো তো, স্যার?”

“তুমি কি এখানে নতুন নাকি রাজিয়া?” একটু বিরক্ত হয়ে সুলতান মামুদ বলল, “আমরা যে এতিমখানার জন্যে দানত্র খুলিনি, সে কথা কি তুমি জানো না?”  

“জানি, স্যার, কিন্তু তাও একবার কনফার্ম করে নিলাম। কত টাকার জন্যে রিকুইজিসন পাঠাবো স্যার?”

“আপাততঃ কুড়ির জন্যে পাঠাও – তারপর দেখছি...”।

“ওকে স্যার”।

 

সুলতান মামুদ নিজের চেয়ারে বসার একটু পরেই রাজিয়া এল – হাতে বেশ বড়ো একটা সুটকেশ। বেশ ভারি, বয়ে আনতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দরজা বন্ধ করে সামনে এসে বলল, “সাত কোটি আছে, স্যার”।

“গুড, মিনিট দশেক পরে ঘোরিকে পাঠিয়ে দিও। আর দেখ এ সময় কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে”।

“ঠিক আছে, স্যার”।

রাজিয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই সুলতান মামুদ হাল্কা দ্রুত পায়ে দরজাটা লক করে এল নিঃশব্দে। তার সিটের ডানদিকের ক্যাবিনেট থেকে বের করল বেশ বড়ো একটা সবুজ রঙের সুটকেশ। দ্রুত হাতে সেটা খুলল, খুলে ফেলল রাজিয়ার রেখে যাওয়া সুটকেশটাও। তারপর রাজিয়ার সুটকেশ থেকে সাড়ে ছ কোটির নোট গুণে ভরে নিল সবুজ রঙের সুটকেশে। সেটাকে লক করে রেখে এল আগের ক্যাবিনেটে। তারপর বাকি টাকা সমেত রাজিয়ার সুটকেশটা বন্ধ করে চেয়ারের পাশে বাঁদিকে রাখল। আগের মতোই হাল্কা পায়ে হেঁটে নিঃশব্দে খুলে দিল তার চেম্বারের লক।

ফিরে এসে স্লিপ মোডে চলে যাওয়া ল্যাপটপের ঘুম ভাঙাল। তারপর চেয়ারে বসে ইন্টারকমে বলল, “রাজিয়া, ঘোরিকে পাঠিয়ে দাও”। এরপর সবুজ রঙের একটা ফোনের রিসিভার নিয়ে গম্ভীর মুখে কিছু শুনতে লাগল, আর মাঝে মাঝে, “হুঁ”, “জি স্যার”... বলতে লাগল। এই সময়েই চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাল ঘোরি। সুলতান মামুদ গম্ভীর চালে তাকে হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলল।

ঘোরি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। সুলতান মামুদ চেয়ার ঘুরিয়ে ফোনের কাল্পনিক কথা শুনতেই লাগল আর আগের মতোই মাঝে মাঝে “হুঁ”, “জি স্যার” বলতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ফোন রেখে খুব জোরে নিঃশ্বাস ফেলে, টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে টেবিলে রাখা গেলাস থেকে জল খেল অনেকটা। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের জল মুছে বলল, “আরেঃ দাঁড়িয়ে কেন, বসো”।

ঘোরি উল্টোদিকের চেয়ারে বসতেই সুলতান মামুদ খুব শ্লেষের সঙ্গে বলল, “অবশ্য বসেই তো আছো সারাদিন – নিশ্চিন্তে, দিব্য আরামে...। এদিকে আমার যে কী অবস্থা – এই মাত্র বিদেশ থেকে ফোন এসেছিল, বলছে, হিন্দুস্থানে ভালো মতো কোন কাণ্ড ঘটাতে না পারলে, আর একটা টাকাও দেবে না। যাচ্ছেতাই কথা শোনালো। বলল, আমরা টাকা দিই কাজের জন্যে – আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়া আর ফূর্তি করার জন্যে নয়...”।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুলতান মামুদ, আড় চোখে দেখল ঘোরি মাথা নীচু করে গোমড়া মুখে তার কথা শুনছে। তারপর আবার বলল, “বসে বসে শুনতে হল, বুঝেছ? বুক বাজিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো কোন কাজ, আমরা করতেই পারলাম না বহুদিন। যাই হোক, তোমার কী বলার আছে বলো, তবে আগেই বলে রাখছি তোমার শুকনো কথায় আর কিন্তু চিঁড়ে ভিজবে না...”।

ঘোরি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “এবার এমন কাণ্ড ঘটাবো গোটা হিন্দুস্থান চমকে উঠবে!”

“আচ্ছা? বলো কি?” বিদ্রূপের সুরে সুলতান মামুদ বলল, “তোমার কথা শুনে আমিই তো চমকে উঠছি”।

“ঠাট্টা করছেন স্যার? আমাদের পরিকল্পনা শুনলে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন, বলবেন এমন সহজ বুদ্ধিটা আমাদের মাথায় আগে আসেনি কেন?” সুলতান মামুদ কিছু বলল না, তাকিয়ে রইল ঘোরির মুখের দিকে। ঘোরি আবার বলল, “পহলগামে এই সময়ে হিন্দুস্থানের নানান প্রান্ত থেকে অনেক টুরিস্ট আসে স্যার – তাদের প্রায় সবাই হিন্দু। এবার ওদের টার্গেট করছি। একথা আপনাকে আগেই বলেছিলাম স্যার। জেহাদিদের ছোট্ট একটা দল অলরেডি ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তার মধ্যে দুজন আমাদের এদিকের, অন্য দুজন হিন্দুস্থানের লোকাল ছেলে - কাশ্মীরী। দু-তিন দিনের মধ্যেই তারা অ্যাকশনে নামবে...”।

মুখের সামনে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বিরক্তমুখে সুলতান মামুদ বলল, “ফুঃ মোটে চারজন জিহাদি? এতদিন ধরে তোমার পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢাললাম, এখন তুমি মোটে চারজন জিহাদির গল্প শোনাচ্ছো?”

“পুরোটা শুনুন না স্যার – বড়ো দল নিয়ে কাজ করার অনেক ঝামেলা – বর্ডার পার করা, ও পাশের গ্রামে ঢুকিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা...। আজকাল হিন্দুস্থানের মিলিটারিরা খুব সতর্ক হয়ে গেছে স্যার – বড় দলের কয়েকজন ধরা পড়লে পুরো অভিযানটাই ভেস্তে যায়। ওদের মধ্যে দু একজন জিহাদি হিন্দুস্থানের মিলিটারিদের মারের ঠ্যালায় প্রায় সব কথাই বলে দেয়। হিন্দুস্থানি মিলিটারি বড়ো নিষ্ঠুর হয় স্যার, আমাদের মতো থোড়ি তাদের প্রাণে দয়ামায়া আছে!

এবারে তাই চারজনের ছোট্ট দল। বন্দুক নিয়ে টুকটুক করে টুরিস্ট স্পটে যাবে। টুরিস্টদের পরিবারগুলোকে ধরে জিজ্ঞাসা করবে, তুই হিন্দু না মুসলিম। হিন্দু বললেই গুলি...শেষ...। মুসলিম বললেও রেহাই দেওয়া হবে না, বলবে কলমা পড় – না পারলে সেও খতম। তবে সবাই নয়, মরবে শুধু পরিবারের পুরুষটা - মানে স্বামীরা। তাদের বিবিরা চোখের সামনে দেখবে তাদের সোহরের মৃত্যু। ছেলেমেয়েরা দেখবে তাদের বাপ এক গুলিতেই কেমন লটকে পড়ে!”

সুলতান মামুদ অবাক হয়ে বলল, “পরিবারের সবাই নয় কেন? তাতে তো আমাদের লাভ – মরার সংখ্যাটা বেড়ে দুগুণ-তিনগুণ হয়ে যাবে...”।

“তা যাবে স্যার কিন্তু বেঁচে থাকা বউ আর ছেলে-মেয়েদের অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করুন, স্যার। রাগ, দুঃখ, শোক, ঘৃণা, হতাশা...হিন্দুস্থানের জনগণ এই দৃশ্য যখন মিডিয়ায় দেখবে স্যার - হিন্দুস্থানের নানান প্রদেশের লোকের মনেও একই প্রভাব পড়বে... ব্যস্‌, হিন্দুরা ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদেশের মুসলমানদের ওপর। আর হিন্দুরা মারলে আমাদের কওমের লোকেরাও কী ছেড়ে দেবে স্যার, শুরু হয়ে যাবে দাঙ্গা। আগুন জ্বলে যাবে ভারতের সব প্রান্তে...। আমাদের কিচ্ছু করতে হবে না, স্যার, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করেই হিন্দুস্থানের কোমর ভেঙে যাবে...। এপার থেকে আমাদের শুধু চিৎকার করে বিশ্বকে জানাতে হবে – হিন্দুস্থানে সংখ্যালঘুদের নিধনযজ্ঞ চলছে...হিউম্যান রাইট্‌স, ইউএন, আমেরিকা, রাশিয়া, সৌদি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, অস্ট্রেলিয়া – সর্বত্র ঢিঢি পড়ে যাবে হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে...ঘরে বাইরে, হিন্দুস্থানের দফারফা”।

প্ল্যানটা সুলতান মামুদের মন্দ লাগল না। খরচ কম, হ্যাপা কম, কিন্তু মুনাফা বিস্তর। ঘোরিব্যাটা ভালই ধুরন্ধর তো! কিন্তু মুখে বলল, “আমি কিন্তু অত কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তুমি স্বপ্ন দেখালেই আমিও সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাবো, এত বোকা আমি নই, ঘোরি। তবে ব্যাপারটার মধ্যে নতুনত্ব আছে – দেখ কী হয়। কবে করছো – কী করছো, তারপর কী কী ঘটছে সব কিন্তু লক্ষ্য রাখব আমি। এখন এস, আমার এখন অনেক কাজ। তোমার এই প্ল্যানের কথা, আমাদের বিদেশী বন্ধুদের এখনই জানাতে হবে, নইলে টাকা-পয়সা পাবো না। তুমি তো কাজ হলেই টাকার জন্যে আমার কাছে হত্যে দিয়ে পড়বে”।

“কিন্তু আজকে কিছু টাকা তো আমাকে দিতেই হবে, স্যার – আজকে সন্ধের মধ্যে হাওলায় পাঠালে – পরশু সকালের মধ্যে ওরা কাজে নামবে”।

“আমার কাছে সামান্য কয়েক লাখ পড়ে আছে সেটাই তোমাকে দিতে পারি – ওতেই  আপাতত কাজ চালাও। তারপর তো আমি আছিই”।

“লাখ? লাখে কী হবে স্যার? আমার এক কোটি চাইই চাই। না হলে খুব বিপদে পড়ে যাবো। তীরে এসে তরী ডুববে, স্যার। আর একথা চাউর হয়ে গেলে – একটা ছেলেকেও আর জিহাদে নামাতে পারবো না... কেউ আসবে না”।

“টাকা কি গাছে ফলে ঘোরি, যে নাড়া দেব আর ঝর ঝর করে এক কোটি নেমে আসবে? দশ টাকা যোগাড় করতে কত হেনস্থা আমাকে সহ্য করতে হয় কোন ধারণা আছে, তোমার? বললাম তো আমি দেখছি কী করা যায় – এক কোটি তো কোন প্রশ্নই নেই। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, জিহাদ তো আমাদের ধর্মে একটা পবিত্র কর্তব্য – তার জন্যে ছেলেরা এত টাকা চায় কেন? বোঝাতে পারো না, টাকার থেকে জন্নত অনেক বড়ো?”

তেঁতো খাওয়া মুখে ঘোরি বলল, “আপনাকে আগেই তো বললাম, সে সব দিন আর নেই স্যার – এখন সবার মুখেই শুধু টাকা আর টাকা। কোটি না হোক, কমসেকম পঞ্চাশ লাখ স্যার দিতেই হবে, না হলে খুব বিপদে পড়ে যাবো, স্যার”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মামুদ বলল, “টাকা থাকলে কি আমি তোমাকে দিই না, বলো? কোনদিন না করেছি? কিন্তু এখন অবস্থা আগের মতো নেই – আমাদের দেশের অবস্থা তো জানোই – দাল আনতে রুটি ফুরোয়। ফরেন থেকেও আগে যেমন ফান্ডিং হত – আজকাল তেমন আর হচ্ছে না। দেখছ না, পয়সাওয়ালা মুসলিম দেশগুলোও আজকাল হিন্দুস্থানের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। তারা এই জিহাদি-টিহাদি নিয়ে তেমন আর ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না। তোমার অবস্থাটা আমি বুঝছি, ঘোরি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নাচার। আপাততঃ বিশ লাখ নিয়ে যাও। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি – হিন্দুস্থানের বুকে একটা জমাটি ঘা মারতে পারলে, তোমাকে এক কোটিই দেব। তেমন তেমন হলে বেশিই দেব”।

ঘোরি হতাশ মুখে বলল, “বিশ নয়, স্যার, ওটা পঁচিশ করুন – নয়তো একদম মারা পড়ে যাবো”।

মামুদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘোরির মুখের দিকে, তারপর চেয়ারের বাঁদিকে রাখা রাজিয়ার সুটকেশটা তুলে টেবিলের ওপর রাখল। সুটকেশ খুলে পঁচিশ লাখ বের করে ঘোরির সামনে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কথা আমি যথাসাধ্য রাখলাম, ঘোরি, কিন্তু তুমি যদি তোমার কথা না রাখো...”।

ঘোরি টাকার বাণ্ডিলগুলো চটপট তুলে নিজের ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার হিন্দুস্থানে আগুন জ্বলবে...আর আপনিও আমায় দু হাত ভরে ইনাম দেবেন। তাহলে আসি, স্যার – টাকাটা এখনই পাঠাতে হবে সীমান্তে”।

“এসো”।

 ঘোরি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে মামুদ ফোনে ডেকে নিল রাজিয়াকে। রাজিয়া ঘরে আসতে তার হাতে সুটকেশ তুলে দিয়ে বলল, “এতে পঁচিশ আছে রাজিয়া – অনেক দরদাম করে ছয়–পঁচাত্তরে রাজি করালাম ঘোরিটাকে...। নিয়ে যাও। আর শোনো, লাঞ্চ পর্যন্ত কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে”।

রাজিয়া মুচকি হেসে উত্তর দিল, “থ্যাংকিউ স্যার” এবং সুটকেশ নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে জানে এই পঁচিশ লাখের কোন হিসেব নেই এবং স্যার জেনেশুনেই এই টাকাটা তার হাতে তুলে দিল। ছপ্পর ফেঁড়ে এমন উপরি টাকা মাঝে মাঝেই তার হাতে চলে আসে। স্যার এখান থেকে কত সরাল সে জানে না, জানার দরকারই বা কি? এটুকু সে জেনে গেছে স্যারের সঙ্গে কাজ করার মজাই আলাদা।

 

 রাজিয়া চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই মামুদ উঠে গিয়ে আবার জানালার সামনে দাঁড়াল। নীচের শহরের দিকে তাকিয়ে ঘোরির নতুন পরিকল্পনাটা নিয়ে ভাবতে লাগল। মুখে স্বীকার না করলেও, হতভাগা যে বেড়ে প্ল্যান করেছে – এ বিষয়ে তার সন্দেহ নেই। পহলাগামে বেছে বেছে হিন্দুদের কোতল করতে পারলে, হিন্দুস্থান যে উত্তাল হয়ে উঠবে, সেটাও নিশ্চিত। তবে ঘোরি যেটা বলল, হিন্দুস্থান জুড়ে দাঙ্গা-ফাসাদ শুরু হয়ে যাবে – তেমনটা তার মনে হয় না। ওদেশের সাধারণ হিন্দুগুলোও তাদের দেশের জনগণের তুলনায় অনেক বুদ্ধিমান। এমনকি ওখানকার মুসলমানগুলোও। হিন্দুরা গুচ্ছের মূর্তি-দেব-দেবীর পুজো-টুজো করে ঠিকই – কিন্তু তাদের কেউই বিশ্বাস করে না – মরার পরে তারা স্বর্গে যাবে। স্বর্গে ঊর্বশী-টুর্বশী নামের কারা যেন হুরিপরি আছে – তাদের কোলে বসে ফূর্তি করবে, একথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। আর দীর্ঘদিন হিন্দুদের সঙ্গে থেকে, ওদেশের মুসলমানদের মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ বিশ্বাস করে – এন্তেকালের পর জন্নতে গেলেই হুরি-পরিরা লুফে নেবে আমাদের। সেই জন্যে হিন্দুস্থানে জিহাদিতে বিশ্বাস করে চট করে কেউ জঙ্গী হয় না, তারা জঙ্গী হয় শুধুমাত্র প্রচুর টাকার লোভে। এদেশে জিহাদিদের টাকার লোভ নেই, তা নয় - আছে, তবে কম। তাদের বেশি আগ্রহ একটা দুটো জিহাদ নামিয়ে শহীদ হতে পারলেই – জন্নতে গিয়ে হুরিদের সঙ্গে হৈহুল্লোড়ের মজা।        

কাজেই ছোটখাটো দু একটা দাঙ্গা হয়তো বাধবে – কিন্তু অত বড়ো দেশের কাছে সেটা নস্যি। বরং বিপদ আসতে পারে অন্য দিকে। বেছে বেছে সাধারণ হিন্দু নাগরিককে মারলে, ওদেশের জনগণ ক্ষেপে উঠবে – রেগে যাবে ওদেশের প্রশাসন। এর আগেও ওরা দুবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে – কিছু জঙ্গী আস্তানা ধ্বংস করেছে। এবারেও হয়তো তাই করবে। হয়তো একটু বেশিই করবে। কিন্তু তাতে মামুদদের কত আর ক্ষতি হবে? বরং লাভ হবে অনেক বেশি। হিন্দুস্থানের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে, প্রত্যাঘাত হানার জন্যে বিদেশী মুসলমানেরা দুহাত ভরে টাকা ঢালবে, মামুদের পকেটে। মুচকি হেসে মামুদ ভাবল, ইংল্যাণ্ডের কান্ট্রি সাইডে অলরেডি তার বিশাল এক বাংলো রয়েছে। হিন্দুস্থান সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করলে, সস্তায় ভালো দ্বীপ কোথায় পাওয়া যায়...তার জন্যে তাকে আবার মাথা ঘামাতে হবে।

জ্ঞান হওয়া থেকে, হিন্দুস্থানের নাম শুনলেই মামুদের গাত্রদাহ হয়। ব্যাটারা একই বছর, আমাদের কয়েক ঘণ্টা পরে স্বাধীন হল। অথচ এই ক বছরে সবদিকেই এমন এগিয়ে গেল – অথচ আমরা রয়ে গেলাম কয়েক শতক পিছনে। হতভাগারা কাফের – কোন ধর্ম নেই – ধর্মের থেকে বেশি মন দেয় লেখাপড়ায়, গবেষণায়, কাজেকর্মে। মামুদরা মুখে স্বীকার না করলেও, মনে মনে জানে – হিন্দুস্থানের লোকগুলো সর্বদা শান্তি-শান্তি করলেও – প্রয়োজনে ভালো যুদ্ধও করে। তিনবার যুদ্ধে তাদের যা নাকানি চোবানি খাইয়েছিল – একাত্তরের যুদ্ধে তো মামুদদের ল্যাজে-গোবরে করে ছেড়েছিল হিন্দুস্থান। তখন মামুদ অবশ্য ছোট ছিল – কিন্তু বড় হতে হতে সে কাহিনী যত শুনেছে মামুদ – তত বেড়েছে তার মনের জ্বালা।

এই সব নানান ভাবনা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ একটা কথা মামুদের মনে হল। আজকাল সারা বিশ্বে যা দেখা যাচ্ছে – ট্যাংক আর কামান নিয়ে সরাসরি সেনাযুদ্ধ তেমন আর হচ্ছে না। সবই হচ্ছে দূর থেকে। নিজেদের সীমান্তে বসেই ফাইটার বিমান থেকে কিংবা মাটি থেকে মিসাইল ছুঁড়ছে – ড্রোন পাঠাচ্ছে। সেগুলো উড়ে গিয়ে আঘাত হানছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। হিন্দুস্থান যদি সেভাবেই যুদ্ধে নামে? জঙ্গীঘাঁটিগুলো এবং আমাদের সেনাঘাঁটিতে যদি অমন মিসাইল বা ড্রোন হামলা চালায়? আমাদের কাছেও অমন যুদ্ধ অস্ত্র অনেক আছে। আমরা কিনেছি আমেরিকা, চিন, তুর্কি এবং আরও কয়েকটা দেশ থেকে। অবশ্য সে সব অস্ত্র বেশ কয়েক বছরের পুরোনো। কারণ কোন দেশ কি আর তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম অন্য দেশে বিক্রি করে? তাই হয় নাকি? বাঙ্কারে পড়ে জং ধরতে থাকা বেশ কবছরের পুরোনো সেই সব অস্ত্র, তারা আমাদের মতো দেশকে বেচে বাঙ্কার খালি করার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেতাই মুনাফাও করে।

মামুদ জানে হিন্দুস্থানও সেরকম কিছু কিনেছে – ফ্রান্স থেকে, রাশিয়া থেকে। কিন্তু সেগুলো কি আমেরিকা বা চিনের অস্ত্রগুলোর থেকেও সরেস নাকি নিরেস? কে জানে? তবে একথাও ঠিক বিগত কয়েক বছরে হিন্দুস্থান যে পরিমাণে রকেট ওড়াচ্ছে – চাঁদে, মঙ্গলে, মহাকাশে। যেভাবে হিন্দুস্থানের সস্তার রকেট বহুদেশের উপগ্রহগুচ্ছ   বগলে নিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছে দিচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে! সে সব কথা সারা বিশ্বই জানে। সেই টেকনোলজিরই একটু এদিক-ওদিক করে কিছু মিসাইল-টিসাইল বানিয়ে ফেলেনি তো? কিছু কিছু খবর যে কানে আসে – আকাশ, ব্রহ্মস, অগ্নি, পৃথ্বী – সেগুলো কি সত্যি? যদি সত্যিও হয়, সেগুলো কাজের সময় কাজ দেবে কিনা কে জানে? আমেরিকা বা চিনের টেকনোলজির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি কাফেরগুলোর মাথায় আছে বলে, মামুদের মনে হয় না। তবে আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল, হিন্দুস্থানের এই উন্নতির পিছনে রয়েছেন একজন মুসলমান, ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম। ইসলামিক দেশের কথা এতটুকু চিন্তা না করে, কাফেরের দেশের জন্যেই তিনি কেন যে সারা জীবনটা উৎসর্গ করলেন, খোদায় মালুম।

হিন্দুস্থানের প্রতি তীব্র ঈর্ষার কারণে, তাদের উন্নতির কথা যদিও মামুদের মনে খুব বেশি দাগ কাটল না। সে চিন্তা করল, এসব তেমন কিছু নয় – অধিকাংশই মিথ্যা প্রচার। ও নিয়ে খুব বেশি ভাববার কোন কারণ এখনও ঘটেনি। তবে এটাও ঠিক হিন্দুস্থান যে দুটো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে – সেখানে ওদের নীতি ছিল অসামরিক কোন মানুষকে অথবা প্রতিষ্ঠানকে ওরা আঘাত হানবে না। শুধু বলা নয় – করেও ছিল তাই। ঠিকঠাক জঙ্গীঘাঁটিগুলোই ধ্বংস করেছিল। যদিও মামুদরা তীব্র গলা ফাটিয়ে মিথ্যে প্রচার করেছিল – ওই দুই হামলায় প্রচুর সাধারণ জনতা, মহিলা ও শিশু মারা গিয়েছে।

মিথ্যে কথা বারবার প্রচার করে সেটাকে সত্য করে তোলা মামুদদের বাঁ হাতের খেলা। সে জানে ওই মিথ্যে প্রচারই তার দেশবাসী বিশ্বাস করেছে এবং গোগ্রাসে গিলেছে। কিন্তু মনে মনে মামুদ জানে, হিন্দুস্থানের কথাগুলো মোটেই মিথ্যে নয়। এবং সেটাই খুব চিন্তার বিষয়। কারণ এই নীতি ঠিকঠাক অনুসরণ করলে, হিন্দুস্থান কোনদিনই হয়তো আর ট্যাংক, কামান নিয়ে স্থলযুদ্ধ কিংবা বিমান যুদ্ধ করবে না। কারণ তাতে বহু গ্রাম, জনপদ ও শহরের সাধারণ মানুষের প্রাণ যাবে। তার মানে দাঁড়ায়, মিসাইল-ড্রোন নিয়ে আধুনিক যুদ্ধের চাবিকাঠি হিন্দুস্থানের পকেটে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। যা দিয়ে তারা, সাধারণ গ্রাম-শহর ডিঙিয়ে জঙ্গীঘাঁটি, সেনাঘাঁটি এমনকি এই সেনা সদর-দপ্তর – যেখানে সে দাঁড়িয়ে নতুন একটা দ্বীপ কেনার স্বপ্ন দেখছে – সেখানেও অনায়াসে আঘাত হানতে পারে!

এই ভাবনাটা শীতল স্রোত হয়ে নেমে এল মামুদের শিরদাঁড়া বেয়ে। সে দ্রুত টেবিলে ফিরে গিয়ে ফোন করল বিবিকে।

“হ্যালো, মমতাজ”?

“বলো, তোমার মিটিং-টিটিং হয়ে গেল? কখন আসছ লাঞ্চ করতে?”

“এই একটু পরেই বেরোব। একটা কথা বলো তো – আজ রাত্রেই যদি তুমি-আমি লণ্ডনে রওনা হই, রেডি হতে পারবে?”

“কত দিনের জন্যে”?

একটু চিন্তা করে মামুদ বলল, “ধরো অনেকদিনের জন্যে। হয়তো বছর খানেক, কিংবা তারও বেশি – হয়তো চিরকালের জন্যে”।

“কী বলছো? অতদিনের জন্যে হলে – সব মালপত্র গুছিয়ে, আজকের মধ্যে রেডি হওয়া সম্ভব নাকি?”

“ঠিক আছে, আজ না হলে কাল রাত্রে?”

“তা হয়তো হয়ে যাবে – কোন ফার্নিচার বা গ্যাজেট, কিচেনের ইউটেন্‌সিল কিচ্ছু নেবে না তো? শুধু টাকা-পয়সা, গয়নাগাঁটি, জামাকাপড় এই সব - তাই তো?”

“এক্স্যাক্টলি, গুলি মারো, বাকি জিনিষপত্রে, – ইউকের বাংলোতে আমাদের কোন কিছুর অভাব আছে?”

“কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো? দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছ কেন?”

“পালাচ্ছি না, তোমাকে রেখে আমি ফিরে আসব। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তুমি ইংল্যাণ্ডেই থেকে যাবে – ওরা ওখনেই লেখাপড়া করবে”।

“কেন? হিন্দুস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাচ্ছো নাকি?”

“মমতাজ, আমাদের ঘরে বাইরে সর্বত্রই এখন শত্রু – একদিকে বালুচ, সিন্ধ, পাখতুনখোওয়া, সেই দেখে আমাদের হাতিয়ে নেওয়া কাশ্মীরও আজকাল ছটফট করছে...। আর হিন্দুস্থান তো আছেই – চিরকালের শত্রু”।

“হিন্দুস্থানকে শত্রু বলছ বটে, কিন্তু ওরা কোনদিন গায়ে পড়ে যুদ্ধ করতে আসেনি – তোমরাই বরং পায়ে পা দিয়ে বারবার যুদ্ধ বাধিয়েছ, এবং প্রতিবারই হেরেছো। এখন আবার লাগাতার জঙ্গী ঢুকিয়ে ওদের জ্বালিয়ে মারছো...”।

মামুদ একটু মজা করে বলল, “সামনাসামনি জঙ্গে হেরে যাই বলেই তো জঙ্গী ঢুকিয়ে ওদের উত্যক্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, জানেমন। আমাদের লোক মরছে কম, ওদের মরছে বেশি। তার ওপর যুদ্ধের থেকে অনেক কম খরচ”।

“কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে গেছ, সেটা ভেবেছো? সাধারণ মানুষের কাজ নেই, ব্যবসা নেই, দুবেলা দুটো রুটি জোটাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া লাটে তুলে দিয়েছো...এরপর দেশের লোক তোমাদের ছেড়ে দেবে?”

“আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংল্যাণ্ডে্র সেরা স্কুলে-কলেজে পড়ছে। আমরা রাজার হালে নিশ্চিন্তে থাকবো ইংল্যান্ডের বাংলোতে। সাধারণের জন্যে চিন্তা করব পরে। তার আগে ভারতকে যে করে হোক নাকাল করতে হবে, নিজেদের নাক কেটে হলেও”।

“কিন্তু আমাদের চলবে কী করে? আমেরিকা, চিন, তুর্কিদের থেকে ঋণ করে আর ভিক্ষে করে তোমরা দেশ চালাচ্ছো, কিন্তু কতদিন – একদিন তো সবাই মুখ ফেরাবে, তখন?”

“সে গুড়ে বালি, জানেমন। যাদের কথা বললে তারা সবাই জানে আমরা জঙ্গী তৈরী করি, আমাদের দেশে সন্ত্রাসের চাষ হয়। কিন্তু সে কথা জেনেও ওরা আমাদের ঋণ কেন দেয় জানো? ভারত যেন বেশি বাড়তে না পারে। আসল কথাটা কি জানো, ইসলামিক দেশগুলো চায় না, একটা হিন্দু দেশ হুহু করে উন্নতি করুক। আবার আমেরিকা, ইওরোপের মতো সাদা চামড়ার দেশগুলোও চায় না, ভারতের মতো বাদামি চামড়ার দেশ তাদের সঙ্গে টেক্কা দিক। চিন চায় না, তার প্রতিবেশী দেশ ভারত তাকে ডিঙিয়ে যাক।

কাজেই মুখে তারা যতই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলুক, শান্তির বাণী দিক, তারা সবাই চায় ভারতকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতে। আর সেই কাজটাই আমরা করছি। তার জন্যেই তারা আমাদের ঋণ দেয় – আর সেই ঋণের টাকাতেই আমরা ওদের থেকে পুরোন- জংধরা অস্ত্র প্রচুর দাম দিয়ে কিনি। ওদের দুদিকেই লাভ – আর আমাদের লাভ দুনম্বরি করে প্রচুর কালো টাকা উপার্জন। একটা জঙ্গীর পেছনে আমাদের কত খরচা হয় বলো তো? খুব জোর হলে দশ-পনের লাখ, কিন্তু তার বদলে আমাদের পকেটে আসে কোটি। আমাদের দেশের লোকের কাজ নেই বলছিলে না? প্রচুর জঙ্গীর কাজ রয়েছে। হাতে পেয়ে যাবে পাঁচ-দশ লাখ টাকা, থাকা-খাওয়া ফ্রি...মরে গেলে শহীদের সম্মান। জিহাদে মারা গেলে, হাতের মুঠোয় তারা পেয়ে যাবে জন্নতের সুখ। দেশের যুবকদের আমরা কত বোঝাচ্ছি – আমাদের ডাকে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে না কেন?          

রাজনীতির এত সব মারপ্যাঁচ তুমি বুঝবে না, জানেমন। আমরা বুঝি, তাই আমাদের মতো সেনাপ্রধানদের আছে অগাধ টাকা। ইউকেতে সম্পত্তি। ইউকের নিরাপত্তা”।

“আচ্ছা, ইউকের ব্যাংকাররা তো নিশ্চয়ই বোঝে তোমাদের যে টাকা ওদের ব্যাংকে রয়েছে – সেটা দুর্নীতির টাকা। এর বিরুদ্ধে ওদেশে কোন আইন নেই?”

হো হো করে হাসল মামুদ, তারপর বলল, “আমাদের মতো লোককে ওরা মাথায় করে রাখে জানেমন। বললাম না, সাদা চামড়াদের যত বাণী সব মুখে, আদতে ওরা চিরকালের ধুরন্ধর স্বার্থপর আর ধান্দাবাজ। আমার সম্পদের লোভে ওরা চোখ বন্ধ করে থাকবে – আর আমাদের কঠোর নিরাপত্তা দেবে। যাই হোক তুমি গোছগাছ করে রেডি হও। আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যে আসছি”।

“আগামী কাল যাবে বলছো, এত কম সময়ে ফ্লাইটের বুকিং পাবে?”

হাল্কা হেসে মামুদ বলল, “তুমি সাধারণ নও জানেমন, তুমি এদেশের অসাধারণ এক ভিআইপির বিবি। তোমার জন্যে থাকবে চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা। আমরা ছাড়া সে প্লেনে আর কেউ থাকবে না। সাধারণ লোকের চোখের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে তোমায় নিয়ে আমি উড়ে যাবো সব পেয়েছির দেশে। উচ্ছন্নে যাক না,  অন্ধকার অভাগা এই দেশ...বেঁচে থাক আমাদের জঙ্গী বাণিজ্য”।                 

                -০-০-

    [সব চরিত্রই কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোন মিল নেই।]                   

                    

 

 

     

 

 

 

                          

                      

  

                                     

                       

         

      

রবিবার, ২৯ জুন, ২০২৫

ভূতডাঙার গল্প

 

এ তল্লাটে প্রমথ শিকদারের নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে বসে গল্পগুজব করে, জল খায়। গোলগাল কালোকোলো চেহারায় ঘাড় নেই, কোমর নেই। আছে মস্ত বড়ো একটি পেট। গলায় শেকলের মতো মোটা সোনার চেন দুলিয়ে, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবিতে পেটটি মুড়ে, পিছনে চার পাঁচজন শাগরেদ নিয়ে যখন পথে হাঁটেন, সে ভারি ভারিক্কি আর রাশভারি ব্যাপার হয়ে ওঠে। রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোও মাঝরাস্তা ছেড়ে নর্দমার ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটুও ঘেউ ঘেউ করে না।

তাঁর দুহাতের দশ আঙুলে চোদ্দটি আংটি। চোদ্দ ভাগ দুই ইকোয়ালস টু সাত রকমের ব্যবসা, প্রমথবাবু বলেন বিজিনেস। কয়লার ব্যবসা, ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা, সতেরখানা মিনিবাস চলে মেনরুটে। আলু আর পেঁয়াজ বোঝাই চারখানা হিমঘর। আজকাল তেমন না চলা দুটো সিনেমা হল। আর বিশাল জমিতে হাত পা ছড়ানো রাইস মিল। আর সর্বশেষ সাতনম্বরটা হল বাড়ি বানানোর প্রমোটারি। ইদানীং এই প্রমোটারি করতে গিয়েই তাঁকে কিছুটা মুশকিলে পড়তে হয়েছে বলে তিনি বেশ মনমরা। মুশকিল আসানের জন্যে জ্যোতিষীর কাছে আরেকটি রত্নের বিধান নেবেন, নাকি তারাপীঠ খ্যাত কোন তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হবেন, এই দ্বিধায় তিনি চিন্তাকুল।

 

 

মৃদুলবাবু নামেও মৃদু, কাজে কর্মেও মৃদু। আজকের দিনে এমন নির্বিবাদি সাতে পাঁচে না থাকা ভদ্র মানুষ প্রায় বিরল বললেই চলে। রোগা পাতলা একহারা চেহারার মানুষটি প্রফুল্লনগরে পঁয়তিরিশ বছরের উপর রয়েছেন চাকরি সূত্রে। দীর্ঘদিন এই জায়গায় থাকার ফলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জায়গাটি খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে। ছুটিছাটাতে মেদিনীপুরের এগরা মহকুমায় তাঁদের আদি নিবাসে যান ঠিকই কিন্তু মন টেঁকে না। দিন চারেক থাকার পরেই প্রফুল্লনগর ফেরার জন্যে তাঁদের মন আঁটুবাঁটু করে।

প্রফুল্লনগর সরকারি শিল্পনগরী, সেখানে চাকরি থেকে অবসরের পর আর থাকার উপায় নেই। তাছাড়া প্রফুল্লনগরকে মৃদুলবাবু যে একাই ভালোবাসেন, তাতো নয়, আরো অনেকেই এমন আছেন। তাঁরা সকলেই মৃদুলবাবুর সহকর্মী। বছর দশেক আগে অনেকে মিলে প্রফুল্লনগরের পাশেই বিশাল জমি কিনেছিলেন একসঙ্গে, তারপর নিজের নিজের দরকার এবং সাধ্যমতো ভাগ করে নিয়েছিলেন। মৃদুলবাবু নিয়েছিলেন কাঠা পাঁচেকের জমি। তাঁর স্ত্রীর বহুদিনের স্বপ্ন ছিল ছোট্ট একটা বাড়ি, সামনে ফুলের গাছ, পিছনে সব্জিবাগান আর দু চারটে ফলফুলুরির গাছ। দামে একটু কমে পেয়েছিলেন এবং নিরিবিলিতে থাকবেন বলে মৃদুলবাবু জমিটা নিয়েছিলেন একদম এক শেষ প্রান্তে। প্রায় পঁয়ত্রিশজন সহকর্মী মিলে শখ করে গড়ে তোলা এই জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন জয়ন্তনগর।    

চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মৃদুলবাবু নতুনবাড়িতে উঠে এসেছেন এই বছর দুয়েক হল। মনোমত গাছপালা লাগিয়ে আর সকাল বিকেল তাদের সেবাশুশ্রূষা করে নিশ্চিন্ত আরামে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন তিনি আর তাঁর স্ত্রী। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে, আর একমাত্র ছেলে কলকাতার হস্টেলে থেকে ডাক্তারি পড়ে। কাজেই বাড়িতে থাকার লোক মৃদুলবাবু আর তাঁর স্ত্রী।

 

 

ছোটখাটো জমিতে প্রোমোটারি করে হাত পাকানো প্রমথবাবুর এইবার চোখে পড়ল জয়ন্তনগরের পিছনের জমিটা। বিশাল জমিটা জলের দরে একসঙ্গে নিয়ে নিলে হাউসিং কমপ্লেক্স করতে কোন বাধা নেই। কুয়ো সাইজের সুইমিং পুল, রুমাল সাইজের সবুজ বাগান, আর একটা হনুমান মার্কা দোলনা, একটা জিরাফমার্কা স্লিপ খাটানো চিলড্রেন্‌স্‌ পার্কের লোভ দেখিয়ে শ দেড়েক ফ্ল্যাট অনায়াসে বেচে দেওয়া সম্ভব। প্রমথবাবুর এক শাগরেদ আরো বুদ্ধি দিল বড়োরাস্তার ধারে একটা শপিং মল খুলতে পারলে, ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাবে দুগুণ।

শাগরেদের প্রস্তাবটা খুব মনে ধরে গিয়ে প্রমথবাবুর মুশকিল শুরু হল। জয়ন্তনগরের পিছনের যে বিশাল জমিটা প্রমথবাবু হস্তগত করেছেন, রাস্তার দিকে তার মুখটা বেশ ছোট, শপিংমল করার মতো যথেষ্ট নয়। শপিংমল করার মতো জায়গা হতে পারে মৃদুলবাবুর জমি ও তাঁর পিছনের দুটো জমি হাতাতে পারলে। পিছনের জমি দুটো এখনো খালি পড়ে আছে, কাজেই ওদুটোকে বেশি দাম ফেললেই পাওয়া যাবে, কিন্তু মৃদুলবাবুর শখের বাড়িটা?

 

 

রোববার সাতসকালে নয়নতারার ঝাড়ে নিচু হয়ে জল ঢালতে ঢালতে মৃদুলবাবু দেখলেন, তাঁর বাড়ির সদরে প্রমথবাবু আর তাঁর পিছনে চার পাঁচজন হাট্টাকাট্টা শাগরেদ দাঁড়িয়ে আছে।

জোড়হাত করে দুগাল ফোলানো হাসিমুখে প্রমথবাবু বললেন, বাঃ, ফাসকেলাস বাগান বানিয়েচেন, মৃদুলবাবু? খুব সোন্দরপ্রমথবাবুর মতো ডাকসাইটে লোকের মুখে নিজের নাম শুনে মৃদুলবাবু আরো ঘাবড়ে গেলেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর হাতের ঝাঁঝরি থেকে ঝরে পড়তে থাকা জলে হাবুডুবু খেতে লাগল নয়নতারার চারাগুলো। মৃদুলবাবুর অবস্থা বুঝতে প্রমথবাবুর অসুবিধে হল না।

গ্রিলের গেটের ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আপনি কিছু বলছেন না, তাই নিজেই ঢুকে পড়লাম, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁবিশাল পেট দুলিয়ে হাসলেন প্রমথবাবু। এতক্ষণে যেন মৃদুলবাবু ধাতস্থ হলেন।

নয়নতারার চারাগুলোর ওপরেই ঝাঁঝরি ফেলে দিয়ে হাত জোড় করে এগিয়ে গেলেন প্রমথবাবুর দিকে, বললেন, আপনার মতো মানুষ আমাদের মতো সামান্য লোকের ঘরে, খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, স্যার। আসুন, আসুন। সামনে কি ইলেকশন নাকি, কই শুনিনি তো! বিধানসভা না লোকসভা”?

ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ, আমাকে কি দেখে নেতা মনে হচ্ছে? তা অবিশ্যি মন্দ বলেন নি। না, মৃদুলবাবু সে সব নয়, অনেক খেটেখুটে সামান্য কিছু জমিয়েছি, আপনাদের সকলের শুভ ইচ্ছায়। কাজের চাপে পাড়াপড়শীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে ওঠে না, তাই এলাম একবার এদিকে। তা, বেশ বানিয়েছেন বাড়িটা। আমার খুব মনে লেগেছে

ওই আর কি”? হেঁ হেঁ হেঁ, বিগলিত হেসে মৃদুলবাবু বললেন, “গরীবের স্বপ্নটুকুই তো সম্বল

তবে যাই বলুন, আজকাল বাড়ি করে বুড়ো বয়সে একা একা থাকা খুব মুশকিল। দেখুন না, এত বড়ো বাড়ি, সামনে পেছনে গাছপালা। রাতবিরেতে বিপদ আপদ হলে কাকপক্ষিরও সাড়া পাবেন ভেবেছেন? এর চেয়ে ফ্ল্যাট কিন্তু খুব ভালো। সারাক্ষণ সিকিউরিটি। দেড়শ ফ্ল্যাটের লোকজন। ভাবতে পারছেন? বিপদে আপদে একবার হাঁক দিলে ঘরে পা ফেলার জায়গা পাবেন না, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ । তারপরে ধরুন সকালে বিকেলে সাঁতার, শরীরটাকে তো রাখতে হবে! ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। বিকেলের দিকে নাতি নাতনীদের হাত ধরে চিলড্রেন্‌স্‌ পার্ক। এগুলোও কি কম স্বপ্ন? ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ

প্রমথবাবুর দুলতে থাকা অদ্ভূত পেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মৃদুলবাবু। শুধুমাত্র ফ্ল্যাটের উপকারিতা বোঝানোর জন্যে প্রমথবাবুর মতো লোক সাত সকালে তাঁর বাড়ি বয়ে এসেছেন, এটা অসম্ভব। মৃদুলবাবু কিছু বললেন না, অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রমথবাবুর পরের কথার জন্যে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমথবাবু আবার বললেন, চোদ্দ আনা নয়, একদম পড়ে পাওয়া ষোলো আনা, মৃদুলবাবু। আপনাকে একটা ফ্ল্যাট আমি দিতে চাই, একদম ফ্রি”!

ফ্রি? তার মানে? কেন”?

একদম ফ্রি। তার সঙ্গে নগদ টাকা তা ধরুন তিন লাখ, না না তিন নয়, তিনে শত্রু হয়, ধরুন চার। একটু থেমে বড়ো মার্বেলের গুলির মতো গোলগোল চোখ করে বললেন কি? অফারটা কেমন? চৈত্র সেলকেও হার মানাবে, মোশাই। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ

কিছুই বুঝতে না পেরে, অবাক চোখে প্রমথবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মৃদুলবাবু, কিছু বললেন না।

আপনার এই বাড়িটা আমার খুব পছন্দ। ওই চার লাখ টাকাটা আপনার এই বাড়ি আর জমিটুকুনির জন্যে, আর ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি ফ্রি। কি এবার কেমন মনে হচ্ছে অফারটা? বাম্পার না? ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ

এতক্ষণে মৃদুলবাবু বুঝতে পারলেন প্রমথবাবুর আসল উদ্দেশ্যটা।

উত্তেজিত ভাবে বললেন, কিন্তু এ বাড়িতো আমি বেচব না, প্রমথবাবু। আমরা থাকব বলে এই বাড়ি বানিয়েছি, বেচে ফ্ল্যাটে যাবার জন্যে তো নয়

এতক্ষণের হাসিমাখা মুখ তাও সহ্য হচ্ছিল, এখন প্রমথবাবুর উৎকট গম্ভীরমুখের দিকে তাকিয়ে, মৃদুলবাবুর গা জ্বলে গেল। প্রমথবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “কটা দিন একটু ভেবে দেখতে ক্ষতি কি, মৃদুলবাবু। ঝোঁকের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময়েই ভুল হয়ে যায়। তাছাড়া, আমার সিদ্ধান্তটাও তো একেবারে ফেলে দেবার নয়। আমার এই জায়গাটা যে না হলেই নয়

কটা দিন কেন, প্রমথবাবু, সারা জীবন ধরে ভাবলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, মৃদুলবাবু খুব দৃঢ়স্বরে বললেন।

বেশ কথা। কিন্তু জীবনের আর কি ভরসা বলুন দেখি। আজ আছে, কাল হয়তো নেই। বিজিনেস করি বলে, ভাববেন না যেন, সাহিত্য টাহিত্য বুঝি না। ওই যে বলে না, পদ্ম পাতায় জল, করে টলোমল, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। সে যাক, তাহলে আজ এখন আসি মৃদুলবাবু, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুবই আনন্দ পেলাম। তবে অফারটা কিন্তু মনে রাখবেন বাম্পার অফার, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ । আরেকবার ভেবে দেখবেন, ভাবতে তো আর ট্যাক্সো লাগে না। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ

 

 

মৃদুলবাবুর মতো নির্বিবাদী লোককে তুলে, তাঁর জমিটা হাতিয়ে নেওয়াটা প্রমথবাবুর কাছে মশা মারার সামিল। সেখানে মুশকিল হত না, মুশকিলটা হলো অন্য জায়গায়।

রোববার দিন মৃদুলবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে প্রমথবাবু তাঁর শাগরেদদের সঙ্গে বসে ঠিক করলেন, বুধবার থেকে শুরু করে দেবেন ফ্ল্যাট বানানোর কাজ। বুধবার শুভ দিন, খনার বচনে আছে, মঙ্গলের ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছে তথা যাবুধবার দিন জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক গিয়েছিল কাজ শুরু করতে। গাছপালা, ঝোপ ঝাড় কেটে, জমিটাকে মাপ জোক করার মতো সাফ করার জন্যে। নকশায় দেখানো ফ্ল্যাটবাড়ি, সুইমিং পুল, চিল্ড্রেন্‌স্‌ পার্ক, রাস্তা, কোথায় কোনটা হবে সেটাকে জমিতে হিসেব মতো ঠিক ঠাক বসাতে হবে তো?

মিনিট পনের হয়েছে কি, হয় নি, ঝোপঝাড়ে শ্রমিকরা সবে কাস্তে, দায়ের কোপ মারতে শুরু করেছে, হঠাৎ চারদিক থেকে শুরু হয়ে গেল পাথর বৃষ্টি। পাথর শুধু নয়, ইঁটের টুকরো, আধলাও। পঞ্চাশজন লোক নেহাত কম নয়, চ্যাংড়া ছোঁড়াদের কীর্তি ভেবে তারা চারদিকে দৌড়োদৌড়ি করেও কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু ঢিলের বৃষ্টি একবারের জন্যেও ঢিলে হল না। অন্ততঃ জনা দশেকের মাথায় আলু, নাকে আলু, কপালে আলু। ছোট খাটো চোট তো সবাই পেয়েছে। আধঘন্টা চেষ্টা করেও যখন কাউকেই দেখা গেল না, বেচারা লোকগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল কাজ ছেড়ে। যাবার আগে হাল্লা লাগিয়ে দিল, ওই জমিতে নির্ঘাৎ ভূত আছে।

 

 

প্রমথবাবু ছিলেন না, হিমঘরে আলু দেখতে গিয়েছিলেন। লালচে রঙের হাজার হাজার বস্তায় ভরা আলু দেখলে তাঁর বড়ো আনন্দ হয়। শীতের শেষে চাষির ঘর থেকে তিনটাকা কিলো দরে আলু তোলেন, প্রথমদিকে দশটাকায় ছাড়েন, পরের দিকে কুড়ি বাইশেও দর তুলে দেন। ডাক্তারের পরামর্শে তাঁর আলু খাওয়া বারণ, কিন্তু আলু থেকে সারাবছরে তাঁর যা আয় হয় তাতে তাঁর মার্বেলের গুলির মতো চোখও স্বপ্নালু হয়ে ওঠে।

 দুপুরে খেতে বসে ভাইপোর থেকে সব ঘটনা শুনে প্রমথবাবু হাসলেন ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ। সারা জীবনে ব্যবসা করতে গিয়ে ছোটখাটো বিঘ্ন তিনি অনেক সামলেছেন, কাজেই এই ঘটনাকে তিনি আমলই দিলেন না। দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টা দুয়েক না ঘুমোলে তিনি শরীরের জোর হারিয়ে ফেলেন। তাই চারটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে সবার থেকে সবিস্তারে শুনলেন ঘটনাটার কথা। শুনে তিনি হুকুম দিলেন কাত্যায়ন শাস্ত্রীকো উঠাকে লাও।

শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তান্ত্রিক। এই সোনার পদক তাকে কে দিয়েছিল কেউ জানে না। সপ্তাহের ছদিন দক্ষিণবঙ্গের ছটি প্রান্তে এঁনার জমজমাট চেম্বার। নৈহাটি, ঘুঁটিয়ারি শরীফ, প্রফুল্লনগর, চাকদহ, শেওড়াফুলি আর লক্ষ্মীকান্তপুর, সোম থেকে শণি এই তাঁর চেম্বারের রুটিন। আজ বুধবার, তাঁর চেম্বার প্রফুল্লনগরে। আধঘন্টার মধ্যে তাঁকে বাইকে করে তুলে নিয়ে এল প্রমথবাবুর জনৈক শাগরেদ।

 

বাড়ির ভেতর থেকে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর বানানো প্রমথবাবুর জন্মকোষ্ঠি আনানোই ছিল। শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী প্রমথবাবুকে প্রণাম করে সামনে বসতেই, প্রমথবাবু তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন কোষ্ঠিটা।

বললেন, সময়টা ভালো যাচ্ছে না হে, কাত্তিকচন্দোর, কুষ্ঠিটা একবার দেখে দাও তোশ্রীশ্রী কাত্যায়নের আদি নাম ছিল কার্তিক চন্দ্র হাতি। প্রমথবাবু দীর্ঘ পরিচয় সূত্রে এসব তথ্য জানেন। মিনিট পাঁচেক খুব মন দিয়ে কোষ্ঠির দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুব গম্ভীর চিন্তামগ্ন মুখে বলল, জমি সংক্রান্ত ঝামেলা মনে হচ্ছে, দাদা। প্রমথবাবু মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলেন, শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর দিকে। কোষ্ঠি থেকে মুখ না তুলে সে আরো বলল, “আপনারা তো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন না দাদা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার ওপর অপদেবতার বক্র দৃষ্টি পড়েছে

প্রমথবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, মোক্ষম বলেছ, ভায়া। আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, যা আছে সে তো আছেই। এখন এর থেকে মুক্তির উপায় কি তাই বলো             

কোষ্ঠি ছেড়ে এবার শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী তার রেক্সিনের ব্যাগ খুলে বহুদিনের পুরোনো একটা পুঁথি বের করল। এমন জিনিষ উপস্থিত কেউই দেখে নি কোনদিন। তারা হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর ঘাড়ে। প্রমথবাবু মেঘের মতো স্বরে বললেন, অ্যাই, ওকে ডিস্টার্ব করিস না, এসব মোটেই ছেলে খেলার জিনিষ নয়।

 শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী তার ছোট্ট ডাইরিতে পেন্সিল দিয়ে অনেক আঁকি বুঁকি কাটতে কাটতে ভাবছিল, আজ প্রফুল্লনগরে সকাল থেকে এসে বাজার খুব খারাপ। সকালের দিকে দুটো মাত্র কেস এসেছিল, তারপর এতক্ষণ আর কোন কেস জোটেনি। বাকি সময়টা হারুর সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিল। হারু তার চেম্বারের উল্টোদিকের চায়ের দোকান থেকে চা দিয়ে যায়। হারুটা প্রফুল্লনগরের গেজেট, সব খবর তার কাছে পাওয়া যায়। আজ সকালের প্রমথবাবুর জমির ঘটনাটা সবিস্তারে হারুর কাছেই শোনা। সেটা যে এমনভাবে কাজে লেগে যাবে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী স্বপ্নেও ভাবেনি। শনিবারে লক্ষ্মীকান্তপুরের চেম্বারে তার কত রোজগার হয়, সেটা মনে মনে হিসেব করে নিল। এমন সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, আজকের ঘাটতিটা আর শনিবারের রোজগারটা সুদে আসলে এখান থেকে তুলে নিলেই তো হয়!

খুব চিন্তান্বিত মুখে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী বলল, একটা স্বস্ত্যয়ন করা দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পারলে সামনের শনিবার। আপনার জানাশোনা ভালো তন্ত্রসাধক কেউ আছে নাকি, দাদা”?

তুমি থাকতে আমি কারো কাছে যাবো না, কাত্তিক। স্বস্ত্যয়ন করলে তুমিই করবে

কিন্তু আপনি তো জানেনই, দাদা, শনিবারে আমার লক্ষ্মীকান্তপুরে কথা দেওয়া আছে

রাখো তোমার কথা। যা করার তুমিই করবে। এর আর নড়চড় চলবে না

আপনি বললে তো না করতে পারিনা, দাদা, এই হচ্ছে মুশকিল। তবে ক্ষতি হয়ে যাবে বড্ড

কত ক্ষতি হবে? বলি আমিও তো তোমাকে তোমার দক্ষিণা দেব নাকি? বাদবাকি যা খরচা হবে সেও দেব

তা ধরুন, স্বস্ত্যয়নের যোগাড়েই হাজার সাতেক যাবে, আর আমার দক্ষিণা যা আপনার ভালো মনে হয়

প্রমথবাবু কোন ঝুঁকির মধ্যে যেতে চান না, তিনি বললেন, সব মিলিয়ে তোমায় দশহাজার এক দোবো। তুমি আর মনে কোন দ্বিধা রেখো না, কাত্তিক। শনিবারের ব্যাপারটা পাক্কা করে নাও। আর এই নাও আজকের পাঁচশোপকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে কাত্তিকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

কাত্তিক নোটটা হাতে নিয়ে কপালে ঠেকালো, তারপর নিজের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, আজকেরটা দরকার ছিল না, দাদা, আমি কি আপনার পর? তবে আপনার আশীর্বাদ যখন নিতে তো হবেই

তুমি যে আমায় কি চিন্তা মুক্ত করলে, কাত্তিক, তুমি বুঝবে না

আজ্ঞে, সে কথাতো একশবার। আপনারা হচ্ছেন কৃতী পুরুষ। তবে ওই কথাই রইল দাদা, সামনের শনিবার মধ্যরাতে, আমি সব যোগাড় করে ঠিক সময় মতো চলে আসব 

 

 

ইন্দিরাদিদি রাত নটা পর্যন্ত পড়িয়ে কালকের হোমটাস্ক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর রুনু আর ঝুনুও বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই সময়টা মাও পড়ার জন্যে খুব কিছু বলেন না। কারণ ইন্দিরাদিদি এমন কড়া, তিনঘন্টার মধ্যে এতটুকুও ফাঁকি দেবার উপায় রাখে না। গতবারের চেয়ে এবারের রেজাল্টটা অনেক ভালো হওয়ায় বাড়ি থেকে চাপটা কিছুটা হলেও কমেছে।

বাইরে বেরিয়ে রুনুঝুনু পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে থাকা ঝাপসা রুকু-সুকুকে দেখতে পেল।

রুনু জিগ্‌গেস করল, কি রে, আর কিছু নতুন খবর পেলি”?

ওঃ, তোমাদের এই পড়ার চাপটা তোমরা কি করে সহ্য করো, ভেবে পাই না। ভয় লাগে না? এখন বুঝছি, কেন তোমরা আমাদেরকে ভূত জেনেও ভয় পাওনি। লেখাপড়া ব্যাপারটাই এমন ভয়ংকর, তার পরে আর কোন কিছুতেই ভয় লাগে না

বাজে বকিস না তো। সকালের পর আর কিছু হয়নি তো”?

হয়নি আবার? প্রথমবাবুর বাড়িতে বিকেলে জোর মিটিং হয়েছে

প্রথম নয়, প্রমথ

জানি, প্রমথ মানেও কিনা ভূত তাই মানুষের ওই নাম আমরা উচ্চারণ করতে চাই না

আচ্ছা বেশ, কিসের মিটিং বল

কিসের আবার ভূত তাড়ানোর মিটিং

মানে”? রুনু-ঝুনু একসঙ্গে চমকে উঠল।

হুঁ। বাসস্ট্যান্ডের গায়ে ছোট্ট গুমটিতে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী বসে, চেন”?

না। কেন? কী করেছে সে”?

মস্ত তান্ত্রিক, শনিবার স্বস্ত্যয়ন করে আমাদের পাড়া ছাড়া করবে

তান্ত্রিক? তার মানে যারা সেই ওঁ হ্রিং ক্রিং ফট্‌ করে? সর্বনাশ, তাহলে কি হবে”?

ধুর ভেবো না তো, কিচ্ছু হবে না। ও তান্ত্রিক না হাতি। ওর সত্যি নাম হচ্ছে নাত্তিক চন্দ্র হাতি

নাত্তিক? নাত্তিক আবার কারো নাম হয় নাকি”?

আরে বাবা, নাত্তিক নাত্তিক। মা দুগ্‌গার ছোট ছেলে। আমরা ভূততো তাই ঠাকুর দেবতার নাম করতে পারি না

ও কার্তিক। তাই বল। কিন্তু তাহলে মা দুর্গার নাম করলি কি করে? তিনি কি ঠাকুর নন”?

তুমি একদম বোকা ঝুনুদিদি, মায়ের আবার ঠাকুর-দেবতা কি? মা তো মা-ই। মায়ের নাম সবাই, সবসময় উচ্চারণ করতে পারি

আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি, এখন শনিবারে কী হবে, তাই বল

সে আমরা ঠিক করে নিয়েছি। আমরা সেদিন প্রফুল্লনগরে যতো ভূত আছে সব্বাইকে নিয়ে মাঠে জড়ো হবো। আর স্বস্ত্যয়ন শুরু করার আগেই ঢিল মেরে সব পণ্ড করে দেব, দেখ না। প্রথম মারব প্রথমকে আর ওই নাত্তিককে

এতক্ষণ সুকু কোন কথা বলেনি, রুকুর শেষ কথায় সুকু আওয়াজ করল - ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।

সেই শুনে ঝুনু বলল, ও আবার কি আওয়াজ, ঘুঘুর ডাকের মতো”?

হি হি করে হেসে রুকু বলল, ও হচ্ছে প্রথমের হাসি। সেদিন ওর হাসি আমরা ঘু ঘু ঘুচিয়ে দেবো

মায়ের রান্না হয়ে গিয়েছিল, বারান্দার দিকে তাঁর আসার শব্দ পেয়ে রুকুসুকু মিলিয়ে গেল পেয়ারা গাছের আড়ালে।

 

 

ঊষাদি, মৃদুলবাবুর স্ত্রী, রুনুঝুনুর মায়ের খুব বন্ধু। ঊষাদিরা যখন প্রফুল্লনগরে ছিলেন, রুনুঝুনুর মায়ের সঙ্গে খুব ভাব ছিল, একদম নিজের ছোটবোনের মতো ভালবাসতেন রুনুঝুনুর মাকে। আর মৃদুলবাবুর পাশের জমিটাও রুনুঝুনুর বাবা মুকুন্দবাবু নিয়েছেন। ইচ্ছে আছে চাকরি থেকে অবসরের পর পাশাপাশি বাড়িতে থাকবেন। আপদে বিপদে কোন সমস্যা হবে না। রবিবারের সকালে ঘটনার পরেই ঊষাদি ফোন করে সব জানিয়েছিল রুনুঝুনুর মাকে। প্রমথবাবুর দেওয়া প্রস্তাব শুনে আর মুকুন্দবাবুর কাছে প্রমথবাবুর ভয়ংকর পরিচয় শুনে রুনুঝুনুর মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল - হে ঠাকুর, একি বিপদে ফেললে ঊষাদিদিকে। সেই রোববার থেকে চিন্তায় তাঁর ভালো ঘুম হচ্ছে না।

আজ দুপুরে মুকুন্দবাবু খেতে এসে প্রমথবাবুর জমিতে ভূতের ঢিল মারার ঘটনাটা শুনিয়েছেন। সেই শুনে অব্দি তাঁর চিন্তা আরো বেড়ে গেছেএক ছিল প্রমথবাবু, তার ওপরে জুটল ভূতের ঢিল! কি সর্বনেশে কাণ্ড। হে প্রমথনাথ, হে ভূতনাথ, তোমার ভূতদের তুমি সামলাও, বাবা। প্রমথনাথ শিব ঠাকুরের আরেক নাম। ব্যাপারটা নিয়ে সেই থেকে সারাক্ষণ চিন্তা করতে করতে সন্ধ্যেবেলা তাঁর মাথায় এল, এর পিছনে তাঁর মেয়েদের, রুনুঝুনুর হাত নেই তো? তাদের ভূতবন্ধু রুকুসুকু যমজ ভূতের কাণ্ড নয়তো এটা? গতবছর তাঁরা যখন সিমলা-কুলু-মানালি হয়ে হরিদ্বার বেড়াতে গিয়েছিলেন, এই দুই যমজ ভূত এক কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিল। তাঁর খুব সন্দেহ হচ্ছে, এ ওদেরই কীর্তি।

 বারান্দায় এসে কিছু দেখতে পেলেন না, দুই বোন চুপ করে বসে আছে অন্ধকারে।

কি করছিস রে, তোরা দুজনে”? রুনুঝুনুকে জিগ্‌গেস করলেন ওদের মা।

কিচ্ছু না, এই একটু ঠাণ্ডা হাওয়া খাচ্ছি

ওরা এসেছিল”?

কারা”?

কারা আবার, রুকুসুকু”?

হুঁ, এসেছিল। তোমার ভয়ে চলে গেছে, মা

বোঝো কাণ্ড, এতদিন জানতাম ভূতেদের মানুষ ভয় পায়, এখন ভূতেরা আমাকে ভয় পাচ্ছে”!

সবাইকে নয়, ওরা মায়েদের খুব ভয় করে

আজ সকালে প্রমথবাবুর জমির ঘটনাটা ওদেরই কাজ, না”?

হুঁ

তোরা কি পাগল হয়ে গেছিস, প্রমথবাবু আমাদের ছেড়ে দেবে, জানতে পারলে”?

কেউ জানবে কেন? আর প্রমথবাবু কেন ধমকেছে, মৃদুলজেঠুর মতো শান্তশিষ্ট ভালো মানুষ কে? আমরা তো কেউ কিছু করতে পারবো না, রুকুসুকু যদি আটকাতে পারে, চেষ্টা করে দেখুক না

প্রমথবাবু এত সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? ও নাম করা তান্ত্রিক ডেকে যাগযজ্ঞ করাবে, রুকুসুকুকে তাড়িয়ে আমাদের নিয়ে পড়বে। আমরাও বিপদে পড়ব, বিপদে পড়বে ঊষাদিরাও

করছে তো, আসছে শনিবার, প্রমথবাবুর জমিতে বিশাল যজ্ঞ

তোরা কি করে জানলি”?

রুকুসুকু খবর দিয়ে গেল। ওরাও রেডি, সব ভূত মিলে পণ্ড করে দেবে যজ্ঞ

এই ভয়ংকর কাণ্ডের মধ্যে তোরা কেন জড়িয়ে পড়লি”?

সরুদা বলে, কাউকে না কাউকে তো সামনে আসতেই হবে, তা না হলে প্রমথবাবুদের মতো লোকদের ভূতের কেত্তন তো বেড়েই চলবে। তুমি একদম চিন্তা করো না, মা। রুকুসুকু সবদিক ঠিক সামলে দেবে, ভেবো না। কথাগুলো শুধু পাঁচকান না হয় সেটা দেখ। এমনকি ঊষা জেঠিমাদেরও বলো না

 

১০

 

কালো সর্ষে, সাদা সর্ষে, কালো তিল, ধুনো, গুগ্‌গুল, সতেরটা কাঁঠালি কলা, ১০৮টা বেলপাতা, এক পোয়া আতপ চাল, ঘি, মধু, গোবর, বেল কাঠ, পঞ্চ শস্য, পঞ্চগুঁড়ি, মড়ার খুলি, ছাগলের পায়ের হাড়।  দরকার ছিল মানুষের পায়ের হাড়, যোগাড় করতে পারে নি শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী। তাই ছাগলের সামনের পায়ের হাড় দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে পাড়ার মাংসের দোকান থেকে। ছাগলের না মানুষের চিনতে পারার আগেই, সাধারণ লোকে হাড় দেখলেই চমকে যাবে।

 

রাত্রি বারোটা নয় গতে মাহেন্দ্রক্ষণ। সাড়ে এগারোটা নাগাদ শ্রী কার্তিকচন্দ্র হাতি বারমুডা আর টি শার্ট ছেড়ে, রক্তাম্বর পড়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত তান্ত্রিক শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী হয়ে উঠলকপালে মোটা করে সিঁদুরের টিপ। স্বস্ত্যয়নের সব যোগাড় নিয়ে উঠে পড়ল প্রমথবাবুর জাইলো গড়িতে। গাড়িতে প্রমথবাবু এবং তাঁর ভাইপো। বাকিরা সবাই বাইকে। সকলের মনের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা, আজ স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া যাবে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ।

ঈশাণ কোণে মুখ করে বেলগাছের নীচে একটা জায়গা ঠিক করাই ছিল। সেখানে আসন পেতে স্বস্ত্যয়নের যোগাড় নিয়ে বসে পড়ল শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী । ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলে উঠল, ধুপ, ধুনো, গুগ্‌গুলের সুগন্ধে রাতের জঙ্গল ভরে উঠল। হোম কুণ্ড তৈরি করে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী প্রমথবাবুর থেকে যখন হোম শুরু করার অনুমতি চাইল, মোবাইলের পর্দায় সময় তখন রাত বারোটা বেজে আট মিনিট।

প্রমথবাবুর থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাবার পর, শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী চিৎকার করে উঠল, “ব্যোমশংকর, কালি করালী নৃমুণ্ডমালিনী ভীমা ভয়ংকরী মা, তোর সব চেলাদের সামলে রাখ মা, সামলে রাখ...তারপর হোমকুণ্ডে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে তুলল হোমের আগুন। ঘিয়ের পাত্র থেকে কাঠের কুষিতে ঘি নিয়ে, ওং হ্রিং ক্রিং ঋং লং অং বং চং স্বাহা”, বলে যজ্ঞে ঘি দিতেই উপস্থিত সকলের পিঠে এসে পড়তে লাগল ঢিল, আর আশপাশ থেকে অনেকগুলো কণ্ঠে সমবেত সুর শোনা গেল স্বাআআ হাআআআশ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, একবার তার মনে হল সব ছেড়ে ছুড়ে পালায়, কিন্তু টাকাও তো নেহাত কম নয়, প্রায় পনেরদিনের রোজগার!

দুরুদুরু বুকে সে বলল, তেনারা এসে গেছেন, তেনারা বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন। দাদা, ব্যাপার খুব সুবিধের নয় মনে হচ্ছে...” শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী একটা বেলপাতা ঘিয়ে ডুবিয়ে, যজ্ঞের আগুনে দিতে দিতে বলল, ওং হ্রিং ক্রিং ঋং লং অং বং চং স্বাহাএবারে হাজার কন্ঠের স্বর শোনা গেল স্বাআআ হাআআআ”, তার সঙ্গে চারদিক থেকে ঝরতে লাগল ঢিল আর ইঁটের বৃষ্টি। এবার আর থামল না, লাগাতার চলতেই থাকল, “স্বাআআ হাআআআআর তার সংগে সংগে ঢিলের বৃষ্টি। তার সঙ্গে নতুন শুরু হল ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ শব্দে সমবেত হাসি।            

শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, দাদা, এই অবস্থায় আপনি হাসছেন? আমি চললাম, বেঁচে থাকলে অনেক সাধনা করতে পারবো...

আমি হাসছি? হতভাগা, তোর মনে এই ছিল রে কেতো, কি যজ্ঞি শুরু করলি, এ যে দুনিয়ার ভূত এসে জড়ো হয়ে গেল। আমাকে ফেলে যাস নি, বাবা কাত্তিকপ্রমথবাবু শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীর হাত ধরে দৌড়তে শুরু করলেন গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলেন কেউ নেই, না ড্রাইভার, না তাঁর কোন শাগরেদ। বিপদ বুঝে কে কখন পালিয়ে গেছে তিনি জানতেও পারেন নি। অথচ তাঁদের পিছনে তাড়া করে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ঢিলের বৃষ্টি, আর ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ হাসি। তাঁদের দুজনের পিঠে আর মাথায় যে পরিমাণ আলু গজিয়ে উঠেছে, তাতে তাঁর হিমঘর অনেকটাই ভরে উঠবে। যদিও এ আলু অখাদ্য!            

 

১১

 

এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। প্রমথবাবুর ওই জমিটার লোকমুখে নামই হয়ে গেল ভূতডাঙা। আটষট্টি জন পার্টি, প্রমথবাবুর ফ্ল্যাট কেনার জন্যে বুকিং করেছিল, তারা সবাই সকালে সন্ধ্যেয় প্রমথবাবুর বাড়ি এসে বসে থাকে টাকা ফেরত নেওয়ার জন্যে। প্রমথবাবু ভোরে বেরিয়ে যান ফেরেন প্রায় মাঝরাত্রে। আজকাল তিনি ভুলেও আর হাসেন না।

 শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী সেই যে প্রফুল্লনগর ছেড়েছে, আর এ মুখো হয় নি। এদিকে কিভাবে কে জানে তার সব চেম্বারেই এই বিচ্ছিরি বেইজ্জতির খবরটা সবাই জেনে গেছে। কাজেই শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী এখন অন্য জায়গায় বসার জন্যে চেম্বার খুঁজছে।

 তোমাদের এলাকায় ভালো কোন জায়গা যদি পাও শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রীকে জানাবে, প্লিজ

 -০-

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ