Powered By Blogger

রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

বিপ্লবের আগুন - পর্ব ৩২

হাটের কেনাকাটা সেরে ডামল নদীর ঘাটে এসে বসল। এখান থেকে নদী পার হয়ে ওপাড়ে পৌঁছতে হবে তাকে। নদী পার হয়ে ক্রোশ দুয়েক হাঁটলেই পিপুলতলা গ্রাম। ওপাড়ের বেশ কিছু যাত্রী নিয়ে এদিকেই আসছে নৌকোটা। ভাদরের ভরা নদীতে স্রোত আছে ভালই – বিশেষ করে মাঝগাঙে।  সেই স্রোত এড়াতেই ওপাড়ের ঘাট ছেড়ে, নৌকোটা নদীর আড়াআড়ি উজানে বয়ে গেল বেশ কিছুটা। এখন নৌকোটা এপাড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে আসছে। দেখলে মনে হবে, এ পাড়ের ঘাটটা যে ও পাড়ের সোজাসুজি উল্টোদিকে – সে কথা নাইয়া যেন ভুলে গেছিল। বহতা নদীর ঘোলাটে সবুজ জলের দিকে ডামল তাকিয়ে রইল।

ঘাটের পইঠাতে পা ঝুলিয়ে ছজন হাটুরে ছোকরা গাঁজা খাচ্ছিল। তাদের হাতে হাতে ঘুরছিল জ্বলন্ত কলকে। নদীর আঁশটেগন্ধী হাওয়ার সঙ্গে ডামলের নাকে আসছিল গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধও। একটু বিরক্ত হচ্ছিল ডামল, কিন্তু কিছু করার নেই। এ দেশের ছেলেপিলেরা গাঁজার নেশায় পোক্ত না হতে পারলে সাবালক হয় না। বোধহয় সে অন্যতম ব্যতিক্রম। তার বাবাকেও সে কোনদিন নেশা করতে দেখেনি। হয়তো সে কারণেই নেশার ব্যাপারে তার কোনদিনই কোন আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু সে দেখেছে গাঁজার আসরে বসা, মানুষগুলির মধ্যে নিবিড় একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমন কি নেশার টানে আসা অচেনা অজানা রসিক মানুষও সেই আসরে যোগ দিতে চাইলে, সকলেই সাগ্রহে অনুমতি দেয়। এবং কলকের প্রসাদ আস্বাদনের মধ্যে অচেনা লোকটিও হয়ে ওঠে পরম মিত্র।

এ ব্যাপারে মারুলা রীতিমতো অভিজ্ঞ। হতভাগার নেশা নেই, কিন্তু প্রয়োজনে এরকম গাঁজার আসরে সে অনায়াসে ভিড়ে যেতে পারে। কলকেটা তার হাতে দু-তিনবার ঘুরতে না ঘুরতেই, সে আসরের লোকদের থেকে অচেনা গ্রামের হাঁড়ির খবর বের করে আনতে পারে।

মারুলার কথা মনে হতেই ডামল কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। হতভাগাটা এখন কোথায়? বাড়ি এসেছে? নোনাপুরের কী সংবাদ? রতিকান্তকে শেষ পর্যন্ত খাসি করতে পেরেছিল মারুলা? কমলিমা, রামালি, কুসিরা, অন্যান্য ছেলেরা - কেমন আছে? প্রায় সাতমাস সে নোনাপুরে ছিল। ভালো-মন্দ মিলিয়ে ওখানকার লোকগুলোর সঙ্গে সে বড্ডো বেশিই জড়িয়ে পড়েছিল। কারণ সত্যি বলতে, পনের বছর বয়সে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে তার বাবা যেদিন থেকে তাকে এই রাজ কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে, সে নিজের গ্রামেই একসঙ্গে টানা সাতমাস থাকেনি।

সে বাড়ি এসেছে জষ্টির শেষ দিকে। আড়াই মাসের ওপর হতে চলল। তার কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে আসার মাস খানেক আগেই। বাড়ি ফিরে সদ্যজাতা শিশুকে প্রথম কোলে নিয়ে তার চোখে জল চলে এসেছিল। সে অশ্রু আনন্দের না কষ্টের – সে কথা আজও সে বুঝতে পারেনি। প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার আনন্দ তো ছিলই। কিন্তু কষ্টও ছিল। নিজের প্রথম সন্তানের জন্মের মতো আশ্চর্য এক ঘটনার মুহূর্তে সে উপস্থিত থাকতে পারেনি। হুল এবং মায়ের চরম উদ্বেগের সময় পাশে থেকে পিতৃসুলভ কোন কর্তব্যই সে পালন করতে পারেনি। রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় একজন অভিজ্ঞা ধাই এবং সেবিকা অবশ্য ছিল সর্বক্ষণ। সেবিকা মহিলা তার বাড়িতেই এখনও রয়েছে। প্রতি পক্ষান্তরে ধাইমা আসে শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। একথা সত্যি কোথাও কোন ত্রুটি ঘটেনি। ত্রুটি যা কিছু ঘটেছে, সে সব তার অর্থাৎ কন্যার পিতার পক্ষ থেকেই।

সেদিন ডামলের মনে হয়েছিল, এরকম কাজের তার কী প্রয়োজন? যে কাজের জন্যে সে নিজের পরিবার, নিজের সন্তানের পাশে সময়মতো থাকতে পারে না? কিসের জন্যে সে ছুটে চলেছে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে? তার পরিবারের সুখ-শান্তি-নিরাপত্তার জন্যেই তো? গ্রাম প্রধানকে বলে এই গ্রামে কিছু জমি নিয়ে – সে যদি অন্যান্য গ্রামবাসীদের মতো চাষবাস শুরু করে – অনায়াসে সে পেয়ে যেতে পারে নিশ্চিন্ত সুস্থির একটা জীবন। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমান ভাগীদার হয়ে সে সর্বদা থাকতে পারবে, তার এই ছোট্ট সুন্দর পরিবারের সঙ্গে।

একথা সে আর কাউকেই বলেনি, একমাত্র হুলকে ছাড়া। শুনে হুল অনেকক্ষণ কিছু বলেনি, তাকিয়ে ছিল ডামলের চোখের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “চাষবাসের কাজ তোমারে মোটেই মানাবে গো...।

অবাক হয়ে ডামল একটু জেদ নিয়ে জবাব দিয়েছিল, “ক্যানে? মানাবে না ক্যানে? গোটা রাজ্য জুড়ে এত লোককে মানাচ্চে, আর আমি কোন রাজার ব্যাটা এয়েচি?”

চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ ধমক দিয়ে বিরক্ত হুল বলল, “ও আবার কী কতা? এর মধ্যে বাবাঠাকুরকে টানতিস ক্যানে?” ডামল একটু থতমত খেয়ে বলল, “বাবাকে আবার কখন টানলাম?”

“বারে, ওই যে বল্লে, আমি কোন রাজার ব্যাটা?”

“বোজো, বাবাকে টানব ক্যানে? ও একটা কতার কতা…”

খুব গম্ভীর স্বরে হুল বলল, “অমন কতার কতাও বলতে নেই, ঠাকুর পাপ দে”।

ডামল হেসে ফেলে বলল, “ওই দ্যাক, তোর মেয়ে কেমন মা-সোহাগী হয়েচে – পা ছুঁড়ে আমাকে লাথি মারল। তুই যে আমার ওপর রেগে গেচিস, এইটুকুনি মেয়েও বুজে ফেলেচে”।

ফিক করে হেসে হুল বলল, “মা-সোহাগী না হাতি। যবে থেকে মেয়ে তার বাপকে পেয়েচে – তখন থেকেই সে বাপকে চোকে হারাচ্চে…”।

ডামল মেয়ের ছোট্ট নাকে নাক ঘষতে, মেয়ে হাঁ করে চেঁটে দিল ডামলের থুতনি। খিলখিল করে হাসল ডামল, এবং ফোকলা মুখে হাসল ওদের কন্যাও। ডামল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মেয়ের মুখের দিকে, চোখের দিকে। আত্মজার মুখের এই হাসি, তার দুই চোখের এমন নিষ্পাপ নির্ভরতা ছেড়ে সে কোথায় ঘুরে বেড়াবে শহরে শহরে, গ্রামে-প্রান্তরে, বনে-বাদাড়ে? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস? ডামল হুলকে জিজ্ঞাসা করল, “তোর কেন মনে হচ্চে চাষ-বাস আমাকে মানাবে না? ঘরেই থাকব, চাষবাস করব, চোখের সামনে দেখব তিল তিল করে মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা। দুজনে মিলে মেয়েটারে খুব আদর-যত্নে বড়ো করে তুলব রে, হুল”।

হুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গেরামের সারাদিনের কটকেনা নিয়ে থাকলে অধিকাংশ মানুষই কেমন জানি ছোট মনের হয়ে যায়ঘাটে নাইতে গিয়ে মেয়ে-বউদের মুখে, গ্রামের পুরুষদের কিত্তিকলাপ শুনি তো…। অনেকেই গাঁজা খায়, মদ খায়। চণ্ডীমণ্ডপে বসে হয় গুটি খেলে, নয় এর নামে তার নামে চুকলি কেটে সময় কাটায়। করবেই বা কী? চাষবাসের কাজ মানে তো - বীজ-বোনা আর ফসল কাটা – বছরে সাকুল্যে চারমাস কি বড়ো জোর পাঁচ মাস? বাকি সময় -  সকাল থেকে রাতের দু প্রহর পর্যন্ত গাব-জ্বাল দেয়া ছাড়া করবে কী লোকগুলো? একটু থেমে হুল আবার বলল, “সত্যি-মিথ্যে জানি না, শুনেছি দু-একজন টাকার কুমীর আবার নগরে যায় – নানান কুকিত্তি করতে”।  

ডামল কোন কথা বলল না। রেশমী চুলে ভরা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মন দিয়ে সে হুলের কথা শুনছিল। হুল আড় চোখে তাকিয়ে দেখল ডামলের গম্ভীর মুখটা। তারপর আবার বলল, “তোমার কাজের কতা কিচু কিচু শুনেচি ধাইদিদির কাচে। তুমি কোতায় কোতায় ঘুরে বেড়াও। রাজধানীর কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে তোমার চেনাশোনা। তুমি না থাকলে, ফুলকিদিদি নিয়মিত আসে আমাদের দেখাশোনা করতে। ধাইদিদি আর বিম্‌লাকে তো ফুলকিদিদিই সঙ্গে করে এনেচিল। ও সময় এ গাঁয়ের ধাইমাও এয়েচিল, পাড়ার বউদের সঙ্গে। কিন্তু ধাইদিদির সঙ্গে কতাবাত্তা বলে সে একেবারে যেন বোবা হয়ে গেলসারাক্ষণ সঙ্গে ছিল, কিন্তু একটাও রা কাড়েনি। অবিশ্যি ফুলকিদিদি তার পাওনাগণ্ডা পুরো মিটিয়ে দেওয়াতে ধাইবুড়ি খুব খুশি হয়েচে। মেয়েকে বুকে নিয়ে আশীব্বাদ করেচে খুব”।

ডামল কিছু বলল না দেখে, একটু পরে হুল বলল, “এই সব দেখেশুনে গাঁয়ের মানুষরা তোমারে এখন যেমন সমীহ করেতুমি ওদের মতো চাষবাস করলে, কিংবা ওদের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপে বসে দুবেলা গুটি চালাচালি করলে কী তোমারে আর সে মর্যাদা করবে? তোমারেও ওদের দলে টেনে নামানোর তরে ওরা সব্বাই উঠে পড়ে লাগবে না?

ডামল তবুও কোন উত্তর দিল না। গোঁজ হয়ে বসেই রইল বিছানার একধারে। এরপর হুল আর কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অস্ফুটে বলেছিল “মায়ের ওপর দিয়ে কদিন বড্ডো ধকল গেচে, আমি আসচি...”।

এই নিয়ে ডামল আর কথা বাড়ায়নি। হুলের কথায় সে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু এটাও ঠিক  গ্রামের মানুষরা তার সঙ্গে ভাবসাব করার জন্যে মুখিয়ে বসে আছে তাও নয়। তার বাবার সময় থেকেই গ্রামের পাঁচজনের সঙ্গে তাদের পরিবারের একটা দূরত্ব ছিলই। বড়ো হয়ে বাবার হাত ধরে সেও রাজকাজে যোগ দেওয়ার কারণে সে দূরত্ব বেড়েছে বই কমেনি। সেই দূরত্বের কারণ তাদের কাজের গোপনীয়তা। আর্থিক স্বাচ্ছল্য। বিপদে আপদে প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভরশীল না থাকা। অর্থাৎ এই রাজকাজ শুধু নিজের পরিবার নয়, গ্রামের মানুষদের থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ডামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করেছিল – অনেক হয়েছে, আর নয় – এভাবে চলতে পারে না। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক হৃদ্যতা গড়ে তুলতেই হবে – আর কাল হরণ নয়, এবার তেড়েফুঁড়ে লাগতে হবে।

প্রায় পক্ষকাল লেগেছিল গ্রামের বয়স্ক এবং তার সমবয়সী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে। যে পরিচয়ে বিকেলের দিকে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে সকলের সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ আলোচনা করা যায়। কটা দিন বেশ ভালই লাগছিল ডামলের। তারপর থেকেই বেরিয়ে আসতে লাগল ওদের আসল রূপ। হয়তো তার প্রতি সমীহবশতঃ অথবা চক্ষুলজ্জার খাতিরে প্রথম কয়েকটা দিন তারা নেশাটেশা করেনি। কিন্তু নেশাখোর মানুষ কতদিন আর অমন সুন্দর বৈকালগুলোকে বিফলে যেতে দেবে? একদিন তারা সসঙ্কোচে প্রস্তাব করেই বসল, “বাইরে বাইরে খুব ঘোরাঘুরির কাজ, তা ভায়ার নিশ্চয়ই ঘাসের নেশায় কোন আপত্তি নেই”? ডামল হেসে ফেলে বলেছিল, “নাঃ, কোনদিনই করিনি, করার ইচ্ছেও নেই”। “বেশ, বেশ, খুব ভালো। কিন্তু আমরা যদি সকলে বাবার প্রসাদ একটু পেতে ইচ্ছে করি, তাতে ভায়ার কোন আপত্তি হবে না আশা করি”। ডামল উত্তর দিয়েছিল “আমার আবার আপত্তি কিসের? আপনারা শুরু করুন”।

সেদিন ডামল আপত্তি করলেও ওরা নিরস্ত হত কি? হত না। বাবার-প্রসাদ বঞ্চিত কয়েকটা দিন যে তাদের কী ভাবে কেটেছে – সে তারাই জানে। আপত্তি করলেও সেদিন তারা নেশা করতই। গাঁজার কলকে সকলের হাত ঘুরতে ঘুরতে নিমেষে যেমন শেষ হচ্ছিল, তেমনই ভরেও উঠছিল তৎক্ষণাৎ। নেশার সঙ্গে সঙ্গে আসর জমতেও সময় লাগল না। বদলে যেতে লাগল তাদের ভাষা এবং আচরণ। সে ভাষা যেমন অশ্রাব্য, তেমনি কদর্য তাদের অঙ্গভঙ্গি। কেউ কেউ অশ্লীল আদিরসের গল্প বললেই – অন্যরা ফেটে পড়ছে উল্লাসে। ডামল দেখল এবং শুনল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে সরে এল সেখান থেকে। এমন মানুষজনের  সঙ্গী হওয়ার থেকে নদীর নির্জন ঘাট তার কাছে অনেক শান্তির। হুলই সঠিক চিনেছে, গ্রামের এই পরিবেশকে এবং তার কন্যার বাপটিকেও।

 

ডামলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে তার ডানপাশে এসে কেউ বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মারুলা! অবাক আনন্দে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, জিজ্ঞাসা করল, “তুই এখানে? কোত্থেকে এলি, যাবি কোথায়?”

মারুলা বলল, “আসছি বাড়ি থেকে। যাবো তোর বাড়ি। আমাকে দেখে তেমন খুশি হলি না মনে হচ্ছে?”

“শালা তোর তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু আমি এখানে বসে আছি তুই জানলি কী করে?”

মারুলা স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলল, “অচেনা মানুষ দেখেই হাটের মোদকমশাইয়ের বেজায় কৌতূহল। জিজ্ঞাসা করল, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, যাওয়া হবে কোথায়? তোর আর তোর গ্রামের নাম বলতেই বলল, একটু আগেই ঘাটের দিকে এসেছিস...চলে এলাম। দেখলাম জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনার জাবর কেটে চলেছিস”।

ওদের কথার মধ্যেই নৌকোটা পাড়ে এসে ঠেকল। ডামল হাসল, বলল, “চল। যেতে যেতে কথা হবে”।   

 

দুপুরের খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম সেরে মারুলাকে নিয়ে ডামল গেল তাদের বাড়ির পিছন দিকে। বিরাট  এক জারুল গাছের ছায়ায় গিয়ে দুজনে বসল।

ডামল বলল, “হুঁ। রাজধানী থেকে কী বার্তা নিয়ে এলি? একটু ঝেড়ে কাশ তো!”

“মাস খানেক পরে বেরোতে পারবি?”

“এবার কোন দিকে?”                                                                        

“পূবদিকে। পাশের রাজ্যের এক মাকাল অস্ত্র কিনতে চায়। হতভাগা, ওই রাজ্যের এক বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে। বটতলি গ্রামের কাহিনী শুনে তার বীরত্ব চেগে উঠেছে। বিদ্রোহ করতে চায় নিজেরই মামার বিরুদ্ধে”।

“মামা বিষয়াধারিক মানে, সে তো রাজবংশেরই একজন। মামাকে শেষ করে ভাগ্নে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার সাধ হয়েছে? কিন্তু সাধ্য আছে?”

“তা তো জানি না রে। আমাদের লখাই - এদিকের আস্থানের আধিকারিককে এই গোপন বার্তা পাঠিয়েছে। সে সংবাদ গিয়েছে রাজধানীতে। নোনাপুর থেকে ফেরার পথে যখন রাজধানী গিয়েছিলাম, মান্যবর নিবাত বলেছিলেন – বর্ষার পরে তুমি ডামলের সঙ্গে যোগাযোগ করে – রাজধানীতে আসবে। তারপর দুজনে মিলে লেগে পড়ো। আরও বললেন, এবারের কর্মকাণ্ডে তোর নাম হবে চণ্ড”।

“তুই কবে ফিরেছিস, নোনাপুর থেকে?”

“এই তো মাস দেড়েক হল। ঘরে আর মন টিকছে না, শালা। শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে। ভাবছি আশ্বিনের পূর্ণিমা সেরে রাজধানী যাবো – তুই যাবি তো?”

মারুলার “শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে” কথাটা ডামলের মনে ধরে গেল বেজায়। বাড়ি আসার পর মাস খানেক বেশ ভালই লাগছিল – কিন্তু তার পর থেকেই তারও মন চঞ্চল হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এভাবে শুয়ে বসে আর কতদিন? নিশিদিন অপেক্ষা করছিল রাজধানী থেকে কবে তার ডাক আসবে। মারুলার কথায় স্বস্তি পেল ডামল, কিন্তু সরাসরি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওদিকের কী খবর? খাসি হয়ে রতিকান্ত খুশি?”

“বেশ বলেছিস, শালা” বেশ কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক করে হাসল মারুলা, তারপর বলল, “রাজবৈদ্যদের লাগাতার চিকিৎসায় হতভাগার ঘা সারতে মাস দেড়েক লেগেছিল। শষ্পকের মুখে শুনেছি সে এখন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। দু বেলা ঘন্টা নাড়িয়ে পুজো করে। মুখে সর্বদা ঠাকুরদেবতাদের নাম। আমিষ খাবার ছোঁয় না, শাক-সব্জি, ঘাস-পাতা চিবোচ্ছে চারবেলা”। আবার কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক হেসে বলল, “শালা এক পাপের প্রতিমূর্তিকে, পুণ্যের পথে ঠেলে দিলাম – আমার কি একটুও পুণ্য সঞ্চয় হবে না রে, ডামল”?

ডামলও হাসল, বলল, “সত্যিই ভাবা যায় না। আর ওদিকের কী খবর – কমলিমা, রামালি…”।

মারুলা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “ভালই আছে, রে সবাই ভালো আছে। কমলিমায়ের কথা মনে পড়লেই মনে কেমন একটা পাপবোধ আসে। অমন মানুষটাকে বহু বছর আগেই শোকে-তাপে পুড়িয়েছিলেন ঈশ্বর। এতদিন পরে আমরাও তাঁকে ভয়ানক আঘাত দিয়েছি। সেই সমস্ত ক্ষতে প্রলেপের ব্যবস্থা তুইই তো করে এসেছিলি, ডামল, তিনজনকে এক সুতোয় বেঁধে। রামালি আর কুসিকে বুকে নিয়ে কমলিমা ভালই আছেন”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডামল কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইল, একটু পরে বলল, “ওদিকে বটতলির ছেলেদের কী খবর – কিছু শুনেছিস?”

“আরেব্বাস রে, ওরা তো কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে! ওখান থেকে বেরিয়ে আসার কয়েকদিন আগে রামালির মুখে শুনলাম। ওদিকের কোন এক আস্থানায় আক্রমণ করে সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে এনেছে। আটজন রক্ষী এবং রক্ষীসর্দার মারা গেছে। এখানে আসার আগে বীজপুরে ছিলাম দুদিন। হাটের লোকজন দেখলাম খুব উত্তেজিত। খুব বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে – একপক্ষ বলছে ঠিক করেছে, কতদিন মানুষ পড়ে পড়ে মার খাবে? আরেক পক্ষ বলছে, এভাবে রাজার বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক নয়। তোমাদের অভাব-অভিযোগের কথা রাজাকে জানাও। তার উত্তরে প্রথম পক্ষ বলছে, রাজাকে পাচ্ছি কোথায় যে বলব? আমাদের কাছে রাজকর্মচারীরাই তো রাজা – ব্যাটারা চুরি করে আর দুর্নীতি করে আমাদের শেষ করে দিল”। মারুলা একটু থেমে আবার বলল, “বললে বলবি আমি বানিয়ে বলছি – প্রথম পক্ষের কাছে “ভল্লা” এখন বীর, যে ন্যায়ের পক্ষে লড়ে প্রাণ দিয়েছে। আর দ্বিতীয়পক্ষের কাছে “ভল্লা” ডাকাত – যে ছোকরাদের মাথাগুলো চিবিয়ে খেয়ে গেছে”।

ডামল কোন কথা বলল না, দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। পশ্চিমদিকে সূর্য হেলে পড়েছে। পাখপাখালির দল ফিরে আসছে তাদের বাসায়। খুব শান্ত-নিরিবিলি চারদিক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডামল বলল, “আবারও সেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। শান্তির জায়গাতে অশান্তি তৈরি করা। ঠিক আছে - আশ্বিনের কৃষ্ণা তৃতীয়ায় আমি রাজধানী পৌঁছে যাবো…ওখানেই তাহলে তোর সঙ্গে দেখা হবে?”

মারুলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

ডামল একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমাদের কাজটা শুধু অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করা”?

“মনে হয় না। মান্যবর নিবাতের কথা শুনে মনে হল, বটতলির ছেলেদের মতোই এদের ছোকরাদেরও যুদ্ধ শেখাতে হবে। তা নাহলে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে করবে কি?”

“বটতলির ছোকরারা হল সাধারণ ঘরের ছেলে। রাজকর্মচারীদের ওপর তিতিবিরক্ত হয়েই ওরা একাজে নেমেছে। কিন্তু এ তো বলছিস বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে – বড়োলোকের লালু ছোকরা। সে কী করে বিদ্রোহ করার ফন্দী আঁটছে – আর তার কথা শুনে সাধারণ ছেলের দল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে যাবে? ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি নারে, মারুলা”।


চলবে...



রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

বিপ্লবের আগুন - পর্ব একত্রিশ


এর আগের পর্বগুলি পড়তে হলে এই সূত্র ধরে টান দিন

https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=31438


 ৩১ 


বীজপুরে জনাইয়ের চটিতে ভল্লা আর মারুলা যখন পৌঁছল মধ্যরাত্রি তখনো দণ্ডদুয়েক বাকি। পিছনের দরজায় ভল্লা টোকা দিতে জনাইয়ের সহকারী এসে দরজা খুলে দিল। দুজন পরিচারক ভল্লাদের ঘোড়াদুটো নিয়ে চলে গেল অশ্বশালার দিকে। দরজা বন্ধ করে নমস্কার জানিয়ে সহকারী চলে যেতে, ভল্লারা  জনাইয়ের ঘরে ঢুকল। ভল্লা এবং মারুলা দুজনের কাছেই এই ঘর অত্যন্ত সুপরিচিত। কাজেই তারা নিজেদের মতো করে মেঝেয় আরাম করে বসল।  

জনাই বাইরে কোথাও ছিল, ঘরে ঢুকে ওদের জিজ্ঞাসা করল, “এত রাত্রে নিশ্চয়ই চান করবি না, একবারে মুখ-হাত-পা ধুয়ে এসে বস না। খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়বি”।

মারুলা বলল, “কী খাওয়াবি?”

গমের রুটি আর অজমাস”।

মারুলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভল্লা রে, চল চল ঝট করে চানটা সেরে আসি – ওফ্‌ কত মাস পর যে অজ-মাংস খাবো...শুনেই পেটটা খিদেয় কেমন জ্বলে উঠল”।

 

খেতে বসে জনাই বলল, “কী অবস্থায় তুই সেদিন এসেছিলি, মনে আছে ভল্লা?”

“মনে নেই আবার? আধমরা অবস্থায়”।  

“তোকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম খুব – এতটা পথ হেঁটে যাবি কী করে? যাওয়ার সময় তুই রণপা নিতে চেয়েছিলি – দিতে পারিনি – ওপরের নিষেধ ছিল। শেষ রাতে তুই যখন বেরিয়ে গেলি – মনটা খুব খারাপ হয়েছিল – জ্যান্ত অবস্থায় নোনাপুর পৌঁছতে পারবি তো? কাজ শেষ করে সুস্থ শরীরে এখন বাড়ি ফিরছিস, এটা ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া আর কী বলব?”

ভল্লা হাসল কিছু বলল না।

“এখন কী অবস্থা নোনাপুরের?” জনাই জিজ্ঞাসা করল।

“নোনাপুর নয় – গ্রামের নাম এখন জুজাকপুর”। ভল্লা বলল।

“শুনেছি। কিন্তু ও নাম আমাদের মাথায় বসতে সময় লাগবে। এও শুনেছি গ্রামপ্রধান হয়েছেন কমলিমা”।

“ওটাও তোর বোদা মাথায় বসতে সময় লাগবে, জনাই। গ্রামপ্রধান নয় প্রধানা – উনি একজন মহিলা”। হাড়ের ভিতর থেকে মজ্জা বের করার চেষ্টা করতে করতে মারুলা বলল।

“বুঝলাম – কিন্তু তাতে ওই গ্রামগুলোর কিছু উন্নতি হচ্ছে বা হবে বলে মনে হচ্ছে? তা নাহলে গ্রামের নাম বদলে কিংবা মহিলাপ্রধান নিয়ে কি গ্রামের লোক ধুয়ে ধুয়ে খাবে?”

ভল্লা বলল, “হয়েছে বৈকি। নতুন যে জমিগুলোতে বাদাম আর তুলোর চাষ করেছিল গ্রামের লোক, ভালই ফসল হয়েছে। জনাধিকারিক এসেছিল দুজন – গ্রামের পরিস্থিতি দেখে গেছে। তারা আমাদের বানানো নড়বড়ে বাঁধটা দক্ষ লোক এনে আরো পোক্ত করে তুলবে। কাছাকাছি কয়েকটা কূপও বানিয়ে দেবে – জমিতে জলসেচের জন্যে। চাষের জন্যে ওরা ছটা বলদ দেবে – আর দেবে গোটা পাঁচেক দুধেল গাই। তোর জানাশোনা জনা দুয়েক যাদব-ছোকরাকে ওখানে পাঠাতে পারবি? গ্রামের লোকদের মধ্যে কোনদিনই কেউ গোপালন করেনি...কীভাবে করতে হয় জানেও না”।

জনাই বলল, “মাস খানেক আগে আমার কাছে একটা ছোঁড়া এসে উপস্থিত হয়েছিল। একেবারে আধমরা সঙ্গীন অবস্থায়। এখানে কদিন রেখে, খাইয়েদাইয়ে সুস্থ করে জানতে পারলাম এই ছোঁড়াটার সঙ্গেই উপানু বজ্জাতি করত। ছোঁড়া গোপালনের কাজ ভালই জানে – আমার গোশালাতেই ওকে কাজে লাগিয়েছি। ছোঁড়ার নাম বিড্ডা। ওকে আমি তোদের গ্রামে পাঠাতে পারলে নিশ্চিন্ত হই...”।

“কেন?” খাওয়া থামিয়ে মারুলা জিজ্ঞাসা করল, “ছোঁড়াটা কি সত্যিই ঢ্যামনা? নিজেঘাড় থেকে নামিয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছিস?”

“ধ্যার ব্যাটা, সে হলে তো আমিই ওকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতাম। ওসব কিছু নয় - ছোঁড়া খুবই নিরীহ – নাদুনুদু ধরনের। কিন্তু কাজের ছেলে। এত ভীতু আর মুখচোরা – হয়তো উপানুর অত্যাচারের জন্যেই – দেখলেই তোদের মায়া হবে”। একটু থেমে জনাই আবার বলল, “আমার এখানে অনেক লোক কাজ করে, সে তো তোরা জানিস। তাদের সকলেই জেনে গেছে – উপানু ওকে কীভাবে অত্যাচার করত। তাদের মধ্যে অনেকেই ওর পেছনে লাগছে – অশ্রাব্য নানান ইঙ্গিত করছে। অন্যের জীবনে যদি কেউ একটা বিষাক্ত ক্ষত খুঁজে পায়, জানি না কেন, কিছু লোক সেটাকেই খুঁচিয়ে বড়ো আনন্দ পায়…”।

মারুলা বলল, “ভাবিস না জনাই, আমি ওকে নিয়ে যাবো…ও জুজাকপুরেই থাকবে। কিন্তু ও একা হাতে দশ-বারোটা বলদ-গরু সামলাতে পারবে?”।

জনাই বলল, “দু-একজন হাত-নুড়কুত দিলে ও শিখিয়ে নেবে – যতটা দেখেছি ওকে, কাজটা ও ভালই বোঝে”।

“তাহলে নিশ্চিন্ত থাক – ওকে আমি কালই নিয়ে যাবো”।

খাওয়া হয়ে যাওয়াতে সকলেই উঠে পড়ল, বাইরে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের বিছানায় এসে আবার যখন বসল, রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর শেষের ঘন্টা বেজে উঠল দুবার। মারুলা বিছানায় আরাম করে আড় হয়ে বসে বলল, “অনেকদিন পর, খেয়ে বড়ো আনন্দ পেলাম রে জনাই, আশীর্বাদ করছি তুই শত সন্তানের বাবা হবি”।  

জনাই খ্যাঁক করে উঠল, মুখ ভেংচে বলল, “কেন রে হতভাগা? আমাকে তোর জন্মান্ধ বলে মনে হচ্ছে?”

জনাইয়ের ভড়কে যাওয়া দেখে মারুলা হাসল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। তাকে পাত্তা না দিয়ে জনাই ভল্লাকে জিজ্ঞাসা করল, “এদিকে তোর সেই ছোকরা রামালি ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ নামিয়ে ফেলল? একেবারে বিয়ে-থা করে কমলিমায়ের বাড়িতেই জাঁকিয়ে বসল? দু-দুটো গাঁয়ের লোককে পেট ভরে  খাওয়াল?”

“কেন? তাতে খারাপটা কি হয়েছে? কমলিমায়ের শূণ্য সংসার আবার ভরে উঠল। শৈশবেই বাপ-মা হারানো রামালি পেল একজন মা। কুসির মতো সুন্দর মেয়েটি বউ এবং বউমা হয়ে – দুজনকেই বেঁধে রাখবে পরম মমতায়। কমলিমা এবং রামালি দুজনেরই জীবন এতদিনে সার্থক হয়ে উঠবে। আর আড়ালে থাকবে কুসি। ওই দিকের সবকটা গ্রামের অবস্থাই আমূল বদলে যাবে – একথা তোকে আমি আজ জোর গলায় বলে যাচ্ছি জনাই, ভবিষ্যতে মিলিয়ে নিস”।

ভল্লার আবেগ জনাই এবং মারুলা দুজনকেই স্পর্শ করল বেশ। দুজনেই মাথা নীচু করে বসে রইল অনেকক্ষণ। নিজেকে সামলে নিয়ে, গম্ভীর পরিবেশটাকে হাল্কা করার জন্যে, ভল্লা বলল, “রাজ-শ্যালকের কী সংবাদ রে? ব্যাটাকে কী খাওয়াচ্ছিস কি? তোর চটি থেকে সে নড়ছেই না। নিজের প্রাসাদে কবে যাবে?”

জনাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর বলিস না ভাই, রতিকান্তর চ্যালাচামুণ্ডারা যা শুরু করেছে... আমার রাত্রে ঘুম ছুটে গেছে। যেদিন বিদায় হবে... দুমাসের ছুটি নিয়ে উত্তরে যাবো গঙ্গাস্নান করতে”।

“কেন কী করছে কি?” ভল্লা জিজ্ঞাসা করল।

“কী আর করবে? মাকালটা চিরকাল যা করে এসেছে - পতিতাপল্লী থেকে মেয়েদের তুলে আনছে”। মারুলা খুব নিশ্চিত সুরে আরও বলল, “বীজপুরের ছোকরাদের একটা বড় দল খেপেছে – দু তিনদিনের মধ্যেই কিছু একটা ঘটবে...একটু ধৈর্য ধর জনাই। আচ্ছা একটা কথা বলতো জনাই – তোর এই পান্থশালা থেকে আধক্রোশ দূরে, জঙ্গলের মধ্যে নাকি হঠাৎ কোন এক পাগলের উদয় হয়েছে? জানিস কিছু?”

“হ্যাঁ। এই ধর মাস দেড়েক আগে। শুনেছি তার ঝোলায় নাকি মড়ার খুলি এবং আরও বেশ কিছু হাড়গোড় আছে। সঙ্গে আছে দুটো ভল্লও। যারা প্রথম থেকে ওকে দেখেছে, বছে,  ও প্রথম এসেছিল মস্ত গালপাট্টা আর গোঁফ নিয়ে। সারাক্ষণ নিজের মনেই বিড়বিড় করত – মাথা-খ্যাপা মানুষ যেমন হয় আর কি। তখন মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। এখন শুনেছি তার মাথায় জটা, মস্ত দাড়ি গোঁফ। ভয়ংকর নোংরা চেহারা – খালি গা আর পরনে বিশ্রী নোংরা ট্যানা। আগের মতোই সারাক্ষণ আপনমনে বিড়বিড় করে।  কিন্তু আজকাল রাত্রে মাঝে মাঝে বিকট চিৎকার করে ওঠে। কি বলতে চায় সঠিক বোঝা যায় না

বিরাট গালপাট্টা আর গোঁফ… আচ্ছা?” মারুলা বলল।

জনাই জিজ্ঞাসা করল, “তুই চিনিস নাকি?”

না রে ভাই, আমি চিনব কী করে? তবে গালে গালপাট্টা আর বড়ো গোঁফ থাকলে - সহজেই লোকের মনে থাকে যায়…তাই না? তা লোকটা খায় কি?

“এদিকের লোকদের খুব দয়া-মায়া রে মারুলা – কাছকাছি গ্রামের লোকজন কেউ না কেউ যাওয়া আসার পথে দুবেলা দুমুঠো খাওয়া জুগিয়ে যাচ্ছে, শুনেছি”।

“লোকটা পাগল-ছাগল যাই হোক, তার মানে বেশ সুখেই আছে...”

জনাই এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল, “কাঁধে হাড়গোড়ের ঝোলা নিয়ে – লোকটা সত্যিই পাগল নাকি কোন অভিসন্ধিতে ভেক ধরে আছে – কে জানে? যাগ্‌গে আমি আর চিন্তা করে কী করব? তোরা ঘুমো – সব ঠিকঠাক আছে কিনা একবার দেখে আসি চট করে, শালা-মহারাজের পান থেকে চূণ খসলেই… ”। জনাই উঠে পড়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল – দরজাটা চেপে দিয়ে।

ভল্লা খুবই নীচু গলায় মারুলাকে জিজ্ঞাসা করল, “পাগলাটাকে তুই চিনিস মনে হচ্ছে?”

মারুলা ভল্লার মুখের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “আমার ধারণা ও আস্থান থেকে পালিয়ে যাওয়া একব্যাটা রক্ষী - নাম বিপন। আমরা যে রাতে আস্থান আক্রমণ করেছিলাম – ও ঘরে ঘুমোচ্ছিল। তারপর ভোর হতেই সবার সঙ্গে পালিয়েছিল। ওই ঘটনার দিন পনের আগে বিপনের ছেলেটাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়...”।

নিরুদ্দেশ?”

আরেঃ - ওই ছোঁড়াটাই তো ছিল উপানুর চর। রাজধানীর অস্ত্রবাহী শকটগুলোর পিছনে ব্যাটা এঁটুলির মতো সেঁটেছিল, মনে নেই? ছোঁড়াটাকে মেরে পুঁতে দিয়েছিলাম – বীজপুর থেকে নোনাপুর যাওয়ার পথের ধারের মাঠে। মনে হচ্ছে নেকড়ে বা শেয়ালের দল সন্ধান পেয়ে হতভাগার দেহটা খুঁড়ে বের করেছিল। বিপন পালানোর সময় কোনোভাবে সেই দেহাবশেষ দেখতে পেয়েছে। আর তার নিরুদ্দেশ হওয়া ছেলেকে চিনতেপেরেছে... সেই কারণেই শোকে-দুঃখে ওর মাথা খারাপ…। কিন্তু এ লোককে তো বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, ভল্লা। ওর পাগলামি কোনক্রমে ভালো হয়ে গেলে – ব্যাটা রাজধানীতে অভিযোগ করতে পারে – তাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লেও অবাক হব না”।

“ঠিক। তাহলে আর কি – কাজটা নির্বিঘ্নে সেরে ফেল”।

“উঁহু – আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে – শালা এক ঢিলে দু পাখি মারবো”।

“কী রকম?”

“তুই তো জানিস, রতিকান্তকে মুতিকান্ত বানানোর দায়টা তোর ঘাড়ে চাপিয়ে – তোকে মেরে ফেলার নাটক করে, “ভল্লা” নামটাকেই মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কোন নিরীহ লোককে ভল্লা সাজিয়ে, অকারণ না মেরে, বিপনকে মারলেই সব ল্যাঠা চুকে যায় – কী বলিস?”

কেউ বিশ্বাস করবে - কুখ্যাত ভল্লা পাগল সেজে প্রায় একমাসের ওপর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে”?

“থাকতেই পারে...ভল্লা যে কি ভয়ানক তুই জানিস না? সে জলে আগুন জ্বালতে পারে… পাখি হয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে পারে…”।

ভল্লা বিরক্ত হয়ে বলল, “ওফ্‌ এত বাজে বকিস কেন বল তো?”

মারুলা গম্ভীর হয়ে বলল, “ভল্লার মৃত্যুসংবাদ শুনে – এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ওরকমই বলবে রে, ডামল। নিরীহ বঞ্চিত জনসাধারণের কাছে “ভল্লা” তখন হয়ে উঠবে স্বপ্নপূরণের নাম। যে নিজের জীবন দিয়েছে – কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়েনি। “ভল্লা” নামটাই হয়ে উঠবে – বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ…। বাজে কথা বলিনি, রে ডামল – আর আমার কথা যদি না ফলে – তাহলে তোর বাড়ির গাইটার নাম রাখিস মারুলা – আমি গোমাতা হয়ে যৌবনের শেষদিন পর্যন্ত তোর পরিবারকে দুধ জুগিয়ে যাবো…”।

ভল্লা লাথি কষাল মারুলার কোমরে – মারুলা খিঁকখিঁক করে ফিচেল হাসল, বলল, “রতিকান্তকে খাসি করার পরিকল্পনাটা শুনেছিস?”

“বললি কখন যে শুনবো”?

মারুলা উত্তেজিত হয়ে বিছানায় উঠে বসল, বলল, “রতিকান্ত রোজই বিকেলের ঝোঁকে বিশেষ একটা পাড়ার দিকে যায়…”

“বেশ্যাপাড়া”?

“হুঁ। কিন্তু পাড়ার ভেতরে যায় না। রতির আড়কাঠিরা পাড়ার বেশ কিছু মেয়েকে পাড়ার বাইরে এনে – সার দিয়ে দাঁড় করায় তার সামনে। যাকে তার চোখে ধরে – তাকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে রসালাপ করে – আর বাকিরা ফিরে যায়। তার দেহরক্ষীরা ওই সময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে…”।

“বলিস কী, রসালাপের জন্যে এত বড়ো ঝুঁকি নেয় হতভাগা?”

“বুঝলি না, রসের জোয়ারে মাথা ঠিক রাখতে পারে না”। খুকখুক করে একটু হাসল মারুলা, তারপর বলল, “বীজপুরের কিছু ছেলেদের নিয়ে আমি আগামীকাল বিকেলে এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করব। ওই দলে এক ছোঁড়া আছে – বেশ সুন্দর দেখতে – শুনেছি যাত্রা পালায় সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী সেজে দর্শকদের চোখের জলের বান আনে। কালকে পতিতা মেয়েদের সঙ্গে ওই ছেলেটিকে মেয়ে সাজিয়ে দাঁড় করানো হবে”।

“তোরা ধরে নিচ্ছিস, অন্য সকলকে ছেড়ে রতিকান্ত ওই ছেলেটিকেই ডাকবে…যদি না ডাকে?”

“একশবার ডাকবে – ওর সঙ্গে বাকি যারা থাকবে – তারা সকলেই হবে যৌবনের উপান্তে পৌঁছানো পৃথুলা নারী…তাদের মধ্যে ওই ছেলেটিকে ছাড়া আর কাউকেই চোখে ধরবে না রতিকান্তর। আমরা কয়েকজন লুকিয়ে থাকবো… রতিকান্ত ছেলেটিকে নিয়ে আড়ালে এলেই – ব্যাটার মুখ-হাত-পা চেপে ধরে আসল কাজটা সেরে ফেলব…”।      

“এই কাজটার জন্যেই তুই দাড়ি আর চুল রাখতে শুরু করেছিস?”

“তা নয় তো কী - কদম্বপুরে রতির দিকে তুই ভল্ল ছুঁড়েছিলি – তোর ছিল গালভর্তি দাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল – আমারও এখন তাই। রতি ভয়ে দুজনকে একই লোক ধরে নেবে – বলবে এটাও ভল্লারই কাজ। ওখান থেকে পালিয়ে আমি প্রথমেই চুলদাড়িগোঁফ সাফ করব – তারপর বিপানকে শেষ করে ভল্লার গল্প শেষ করে দেব”।

ভল্লা মুচকি হেসে বলল, “পরিকল্পনাটা ভালই ফেঁদেছিস – নিজের চোখে দেখে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে…”।

মারুলা উদ্বিগ্নমুখে বলল, “এ কথা মনেও আনিস না ডামল, রক্ষীদের অনেকেই তোকে খুব ভালো ভাবে চেনে – দেখতে পেলে তোকে বাঁচানো যাবে না…”।

ভল্লা মারুলার আন্তরিক উদ্বেগটা অনুভব করে মারুলার একটা হাত টেনে নিয়ে বলল, “ভাবিস না – তোরা যখন কাজটা করবি – তখন আমি হয়তো অনন্তপুরের চটিতে পৌঁছে যাবো”।

মারুলা ভল্লার ধরে থাকা হাতে চাপ দিয়ে বলল, “না – তুই কাল অনন্তপুরের থামবি না, সোজা কদম্বপুর যাবি। সহাধ্যক্ষকে সব বার্তা দিয়ে, তারপর তুই বাড়ি ঢুকবি”।

ভল্লা মারুলার চোখে চোখ রাখল কিছুক্ষণ, বলল, “শুয়ে পড় – কাল বেরোনোর আগে তুই আমার ক্ষৌরী করে দিবি – ভল্লা যেন আগের ডামল হয়ে উঠতে পারে”।


(ক্রমশঃ)


নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ