ইঁটে গাথা ভল্লাদের পাকা বাসার সামনে বাঁধানো উঠোনে বসে নোনাপুর গ্রামের বয়স্ক ছজন মানুষ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। অন্যদিকে নিজের ঘরে বসে কমলিমা বিরক্ত মুখে কুসির চুলের জট ছাড়াচ্ছিলেন কাঁকুই দিয়ে। কুসি মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠছিল, দুহাতে মাথা চেপে ধরছিল ব্যথায়, “জেঠিমা লাগছে গো”। কমলিমা রাগী গলায় বললেন, “লাগুক। এমন মেঘের মতো চুল – চানের পর একবার কাঁকই দিতে পারিস না? জটেবুড়ি এমন জট পাকিয়েছিস, লাগবে না তো কী হবে, মুখপুড়ি? বেশি চেঁচাবি না, গলা টিপে দেব, একেবারে...”।
ব্যথায় চোখে
জল চলে এসেছিল কুসির – তার মধ্যেও সে ফিক করে হাসল, জেঠিমার গলা টেপার কথায়। কমলিমা
কুসির মাথার পিছনে বাঁহাতের মুঠিতে চেপে ধরে রেখেছিলেন, কুসির চুলের মোটা গুছি। অন্য
হাতে কাঁকুই চালাচ্ছিলেন খস খস করে। “তেলের ভাঁড়টা হাত বাড়িয়ে দে তো”। কুসি হাত
বাড়িয়ে নাগাল পাচ্ছিল না – সামনে একটু এগোতেই – তার মাথায় কাঁকই দিয়ে টোকা দিলেন
কমলিমা – “অত নড়ছিস কেন রে, হতভাগী? এক দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারিস না?”
চুলে তেল লাগানো
শুরু হতে কুসি যেমন স্বস্তি পেল, কমলিমাও চুলের জটিল জট ছাড়াতে পেরে তেমনি খুশি হয়ে
বললেন, “হ্যারে, লোকগুলোকে বিদেয় হতে বললাম, যায়নি তো! এখনো উঠোনে বসে কী গুজগুজ করছে?”
কুসি বলল, “ভল্লাদাদার
সঙ্গে দেখা করবে – তাই অপেক্ষা করছে”।
মুখ ঝামটা দিয়ে
কমলিমা চাপা স্বরে বললেন, “যা বলার আমি তো বলেই দিয়েছি – ভল্লা এসে কী করবে?”
“তোমারই বা এত
আপত্তি কিসের জেঠিমা?”
“চুকঃ। পাকামি
করিসনি”। কুসির চুলে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে কমলিমা বললেন।
“ওই তো রামালিদাদা আর ভল্লাদাদা এসে গেল...”। কুসি একটু
উচ্ছসিত হয়ে বলল।
কমলিমা অবাক
হয়ে বললেন, “এখান থেকে দেখা যায় নাকি? কী করে বুঝলি?”
“ও আমি
পায়ের শব্দ শুনলেই বুঝতে পারি...”।
“আচ্ছা?
সবার পায়ের শব্দ চিনিস?”
“হুঁ।
ভল্লাদাদা, রামালিদাদা, তোমার...”। কুসির
চুল বাঁধা হয়ে গিয়েছিল।
কমলিমা
বললেন, “দেখি তো আমার মুখপোড়া বাঁদরীটাকে”। তারপর কুসির মুখের দিকে তাকিয়ে কমলিমা
খুশি হলেন বেশ। নিজের শাড়ির আঁচলে কুসির মুখটা চেপে মুছে দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে
রইলেন কিছুক্ষণ, বললেন, “যা মাথার তেল, কাঁকই সব ঠিক জায়গায় রেখে আয় – হাতের কাছে
না পেলে তোর পিঠ আমি ভাঙবো”। কুসি লাজুক হেসে উঠে দাঁড়াল আর তখনই ভল্লাদাদা দরজা থেকে
ডাক দিল, “ঘরে বসে কী করছিস রে মা? সন্ধে হতে চলল, এখনও গা ধুতে যাসনি?”
ভল্লার
পিছনে দাঁড়িয়ে রামালি কুসিকে দেখছিল। কুসির চোখও কয়েক মুহূর্তের জন্যে আটকে রইল
রামালির চোখে, তারপর লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে কমলিমায়ের পাশে এসে বসল। বলল, “চলো,
জেঠিমা আমরা গা ধুয়ে আসি”।
কমলিমা
রামালিকে দেখতে পাননি – ভল্লার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকায়। কিন্তু কুসির চোখ-মুখের ভাষা চকিতে
বদলে যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন, ভল্লার ওপাশে রামালি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন ধরে তিনি
ওদের দুজনের চোখেই লাজুক চোরা চাউনির লক্ষণটা টের পাচ্ছিলেন। আজ নিশ্চিত হলেন।
মুচকি হেসে
বললেন, “এখনও আকাশে যে কনে দেখা আলো রয়েছে রে, ভল্লা। যাবো এইবার। গ্রামের লোকগুলো
বিদেয় হয়েছে? ওদের সামনে ঘর-দোর ফেলে যাই কী করে?”
ভল্লা
কমলিমায়ের ইঙ্গিতটা লক্ষ্য করল না, কিন্তু রামালি করল। লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি বাইরেই
বসি, বেশ হাওয়া দিচ্ছে”।
ভল্লা বলল,
“ওদের বেশ দুকথা শুনিয়ে আমি বিদেয় করে দিয়েছি মা। বলে দিয়েছি তুই কোন মতেই গ্রামপ্রধান
হবি না। দেখিস, তোকে আর ওরা বিরক্ত করতে আসবে না”।
কমলিমা
ভল্লার কথায় খুশি হলেন না, বললেন, “প্রধান হবো না বলেছি, তা বলে তুই ওদের দুকথা
শুনিয়ে দিলি? গাঁয়ের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না? এ আবার কেমন কথা?”
ভল্লা খুব
গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি তো জানি মা, তুই এক কথার মানুষ। হ্যাঁ তো হ্যাঁ। না তো না।
তোর কাছে এসে ওরা সেই একই কথা ব্যাজর ব্যাজর করবে – তাই মানা করে দিয়েছি”।
কমলিমা এবার
বিরক্ত হয়ে বললেন, “যাক বাবা, বেশ করেছিস। অ্যাই মুখপুড়ি, তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী
কথা শুনছিস? বললাম না - চ গা ধুয়ে আসি”?
কমলিমায়ের
বিরক্তিতে ভল্লা বেশ মজাই পেল, বলল, “সেই ভালো মা, ঘাট থেকে ঘুরে আয়, অনেক কথা
আছে”।
কুসিকে
সঙ্গে নিয়ে কমলিমা পিছনের পথে পুকুরের দিকে চলে যেতেই রামালি ভল্লাকে বলল, “তুমি
তো ওদের নিশ্চিত করে বললে, জেঠিমাকে তুমি রাজি করাবে। এখন জেঠিমাকে উলটো কথা বললে
কেন?”
“তোর মনে এই তো সবে তোর রঙ ধরেছে, রামালি।
এর মধ্যেই তুই মেয়েদের মন বুঝে ফেলবি”?
ভল্লা ভ্রূ নাচিয়ে বলল।
রামালি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, তার আর
কুসির ব্যাপারটা ভল্লাদাও বুঝে ফেলেছে নাকি? কিছুটা জোরের সঙ্গে বলল, “মনে রঙ ধরেছে?
তার মানে?”
মুচকি হাসল ভল্লা, প্রসঙ্গটা এড়িয়ে বলল,
“মাকে আমি যদি বলতাম – সবাই যখন বলছে তুমি প্রধান হয়েই যাও না, মা – মা পুরো বেঁকে
বসত। ওই যে বললাম, তোমার হ্যাঁ মানে হ্যাঁ আর না তো না, ওতেই মায়ের মন গলে গিয়েছে।
আমি মানা করে দিয়েছি বলাতেই, দেখলি না, মা কেমন বিরক্ত হয়ে কুসিকে ধমকালো। তুই তাতে
কষ্ট পেয়েছিস জানি, কিন্তু ওটা কুসিকে নয় – আসলে আমাকেই ধমকালো…”! রামালির চোখের দিকে
তাকিয়ে ভল্লা বলল।
রামালি দেখল ভল্লাদাদার মুখে কোথাও হাসির
লেশমাত্র নেই – কিন্তু হাসছে তার দুই চোখ।
এবার সত্যিই লজ্জা পেল রামালি। বলল, “জেঠিমা কুসিকে ধমকালে আমি কষ্ট পেতে যাব কেন?”
ভল্লা
দার্শনিকের মতো গম্ভীর হয়ে বলল, “এমনিতে গায়ে তির বিঁধলে কষ্ট তো হয়ই। আবার কোন
কোন চোখের তির, বিঁধলে বুক অব্দি কনকন করে
– কিন্তু সে তির চোখে দেখাও যায় না, ছাই...”। রামালি ভল্লার কথার কোন উত্তর দিল না
ভল্লাও আর কথা বাড়াল না। বাঁধানো উঠোনের ধারে বাঁধানো আসনে দুজনে বসে রইল
পাশাপাশি।
কমলিমা আর
কুসি গা ধুয়ে ফিরে ঘরে ঢুকলেন। ঢোকার সময় কমলিমা দুজনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে খুব
অবাক হলেন, কিছু বললেন না। ভেজা কাপড় পালটে ঘরের মধ্যে প্রদীপ জ্বালালেন, তারপর
বাইরে এসে তুলসীতলায় প্রদীপটি রেখে প্রণাম করলেন মাটিতে বসে। উঠে ঘরে যাবার সময়
ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে? দুটোতে বাঁদরের মতো চুপ করে বসে রয়েছিস কেন?”
ভল্লা বেশ
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “রামালিটা খুব বিপদে পড়ে গেছে, মা...কী করা যায় আমিও
বুঝে উঠতে পারছি না”। রামালি অবাক হয়ে ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বুঝতেই পারল
না, তার বিপদটা কি?
কমলিমা
দাওয়ার পৈঠেতে পা দিয়ে থমকে গেলেন, ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “রামালির আবার বিপদ
কিসের?”
ভল্লা উঠে
গিয়ে কমলিমায়ের হাত ধরে টেনে উঠোনের আসনে বসাল, পায়ের কাছে বসে বলল, “একা হাতে
সারাদিন আর কত কাজ করবি বল তো মা? এক দণ্ড বস না আমাদের কাছে। কুসি আজ রান্না করুক।
ঘরের কাজকর্ম ওকে শিখতে হবে না? দুদিন পরে ওরও তো নিজের সংসার হবে”।
কমলিমা কিছু
বললেন না, রামালির দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে বললেন, “কুসি আমার লক্ষ্মী মেয়ে – সব
কাজ জানে। কিন্তু তুই রামালির কী বিপদ বলছিলি?”
“হ্যাঁ, সে
কথাই বলছিলাম। কথা দিয়ে যদি কথা রাখতে না পারে...বিপদের কথা নয়, মা? আস্থানের আধিকারিককে,
ও সেদিন বলে ফেলেছে, গ্রামের মানুষ সবাই মিলে তোকেই প্রধান করতে চায়। আধিকারিক
শুনে খুব খুশিই হলেন। আমাদের মতো মুখ্যু তো নয় – রীতিমতো পড়াশোনা করা শহরের মানুষ।
বললেন, বাঃ এতো খুবই ভালো কথা। শুনেছি ওঁনাকে গ্রামে সকলেই শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।
তা ছাড়াও উনি কী বললেন জানিস মা? গ্রামের প্রধান কখনও বাবার স্থান নিতে পারে না,
কিন্তু উনি গ্রামের সবার কাছেই মা হয়ে উঠতে পারবেন...”। একটু থেমে আবার বলল, “এই
সব বার্তা দিয়ে - ওই দিনই উনি পত্র লিখে রাজধানীতে পাঠিয়েও দিয়েছেন। এখন কাল আমরা যদি
গিয়ে বলি, তুই প্রধান হচ্ছিস না - রামালি বড্ডো খেলো হয়ে যাবে না, মা? আধিকারিকও
রাজধানীর কাছে অপ্রস্তুত হবেন। ভাববেন, ছেলেছোকরার কথায় নেচে উঠে কী ভুলটাই না
তিনি করে ফেলেছেন...”। এতক্ষণ রামালি মুগ্ধ চোখে ভল্লার দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল,
এখন কমলিমায়ের মুখের দিকে তাকাল।
কমলিমা
কিছুক্ষণ পরে বললেন, “তোদেরই বা এত পাকামি কীসের শুনি? রামালি আগ
বাড়িয়ে আধিকারিককে বলে দিল? আর তুইও গ্রামের মানুষগুলোকে দুকথা শুনিয়ে তাড়িয়ে
দিলি... তোদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কবে যে হবে?” বিরক্ত
হয়ে মুখ ফিরিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন তুলসীতলার দীপ শিখাটির দিকে। ভল্লা এবং রামালি কোন
কথা বলল না, অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর
বললেন, “রামালি মুখপোড়া এমন তালগোল পাকিয়ে তুলেছে, প্রধান না হয়ে এখন আর উপায়ই বা কী?”
রামালি বলে উঠল,
“জেঠিমা তুমি বাঁচালে আমাদের…”।
ভল্লা বলল,
“তাহলে আমি এখনই গ্রামে গিয়ে ওঁদের ডেকে আনি, মা?”
কমলিমা বললেন,
“থাক এত রাত্রে আর মানুষগুলোকে ব্যতিব্যস্ত করে কাজ নেই – যা করার কাল সকালে করিস।
কিন্তু আমি এখনও বুঝছি না, লেখাপড়া জানিনা। দেশের বিধিবিধান কিছুই জানি না - প্রধান
হওয়া কি মুখের কথা”?
ভল্লা বলল,
“গ্রামের ভালো-মন্দ কিসে হয়। গ্রামের মানুষদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিসে হয়। সে কথা তোর
থেকে আর কে ভালো বোঝে বল তো, মা? প্রত্যেকটি
জীবনের আর সমাজের পক্ষে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় সে কথাও তুই সকলের থেকে ভালো
জানিস মা। দেশের বিধিবিধান, খায় না মাথায় মাখে,
সে কথা জেনে-বুঝে তোর কাজ কি? সকলের দুঃখ-দারিদ্রের কথা আধিকারিকদের বলবি - গ্রামের
সবাইকে একত্রে বেঁধে রাখবি – ব্যস্, সেটাই তো তোর কাজ মা”!
ভীরু ও স্নিগ্ধ
দীপশিখাটির দিকে তাকিয়ে কমলিমা বসে রইলেন, কিছুক্ষণ। তারপর গলা তুলে কুসিকে
জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে মা, তুই একা হাতে সামলাতে পারছিস তো, নাকি আমি যাবো?”
দরজার কাছে
কুসি মুখ বাড়াল, বলল, “একটা দিন আমার হাতের রান্না খেয়ে দেখই না, জেঠিমা। তুমি বসে
কথা বলো...আমি ঠিক সামলে নেব”।
সকলেই
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভল্লা বলল, “কিন্তু তোর তো এখানে আর থাকা চলবে না, মা”!
জিজ্ঞাসু
চোখে কমলিমা তাকালেন ভল্লার মুখের দিকে।
“এতদিন তুই
আমার মা হয়ে, আমার কাছে রইলি, সে ভালো কথা। কিন্তু কাল থেকে তুই গ্রামের প্রধান –
তোকে তো গ্রামেই থাকতে হবে মা। রাজ্যসীমার বাইরে এই জঙ্গলে থাকাটা শোভা পাবে না। আমি
বলি কি, তুই রামালিকে নিয়ে তোর বাড়িতেই ফিরে যা মা। বাড়ি জমি-জমার দেখা-শোনা হবে। তারপর
রামালির একটা বিয়ে দিতে পারলেই – কুসির মতো একটি মেয়ে তোর পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করবে –
জেঠিমা নয়, “মা” ডাকবে সারাদিন। সংসারে আবার শ্রী ফিরে আসবে দেখিস...”।
কমলিমা
রামালির মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, “কুসি আমার বাড়িতে যাবে কেন? তার কী
নিজের ঘরদোর নেই?”
“তুই এমন বলছিস
না মা, যেন কিছুই জানিস না। কুসিকে কী করে তোর কাছে বেঁধে রাখবি – সে কথা তুই আমার
থেকে অনেক ভালো জানিস মা। রামালিটা ছোটবেলা থেকেই মনমরা, দুখী-মুখি ছেলে – কাকা-কাকিমার
মুখনাড়া খেয়ে অতিষ্ঠ হয়েছে এতকাল...”
“এসব হাসি-
ঠাট্টা আমার ভালো লাগছে না, ভল্লাদাদা” রামালি একটু রেগে গিয়ে বলল।
সেই সময়েই
উঠোনে এসে দাঁড়াল মারুলা। ভল্লার পাশে বসেই বলল, “অবাক কাণ্ড রামালি, তোকে তো
কোনদিন রাগতে দেখিনি! আজ হঠাৎ ভল্লার ওপর রেগে গেলি কেন”?
“দেখ না
মারুলাদাদা, ভল্লাদাদা সেই থেকে আমার পেছনে লেগেই যাচ্ছে”।
কমলিমা
বললেন, “আচ্ছা মারুলা তুই তো এইমাত্র এলি, রামালিকে দেখে কী মনে হচ্ছে ও সত্যিই ভল্লার
ওপর রেগে গেছে?” কমলিমা আর ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে মারুলা বিষয়টা আঁচ করতে
চেষ্টা করল, তারপর মুচকি হেসে বলল, “দাঁড়াও মা, তেষ্টা পেয়েছে খুব – কুসি, আমাকে
একঘটি জল খাওয়াবি দিদি”?
কুসির হাত
থেকে ঘটি নিতে নিতে মারুলা গম্ভীর হয়ে বলল, “রামালি কি সত্যিই খুব রেগে গেছে কুসি,
মুখটা একবার ভালো করে দেখ তো, দিদি...”।
“এঃ ম্মা..”
বলেই কুসি দৌড়ে গেল ঘরের দিকে।
তিনজনেই
হেসে উঠল উচ্চস্বরে – রামালি শুধু গোমড়া মুখ তুলে জঙ্গলের গাছ দেখতে লাগল মন দিয়ে।
- - - -
ভল্লা বলল,
“তোরা তো ভালই এগোচ্ছিস জনা। এক জন গ্রামিককে শেষ করে দিলি – আরেকজনকে সর্বস্বান্ত
করে দিলি। কিন্তু এরপর তোদের ভাবনা কি? কী করতে চাইছিস এর পরে?”
জনা বলল, “কিছুদিনের
জন্যে আমরা এধরনের আক্রমণ থেকে ভাবছি বিরত থাকবো। গ্রামের সাধারণ মানুষদের জন্যে এবার
আমরা কিছু কিছু কাজ শুরু করব”।
ভল্লা বলল,
“বাঃ খুব ভালো সিদ্ধান্ত। এখন তোদের
দুটো কাজ - গ্রামের সাধারণ মানুষদের মনে বিশ্বাস
গড়ে তোলা। পাশাপাশি তোদের দলটাকেও গুছিয়ে তোলা”
জনা বলল, “গুছিয়ে
তোলা মানে?”
“তোদের দল এখন প্রতিদিন বাড়ছে।
এরপরে আরও বাড়বে। তুই আর মিলা সব দিক সামলাতে পারবি? কিছু কিছু দায়িত্ব নির্ভরযোগ্য
কিছু ছেলেদের হাতে তুলে দে। যেমন ধর, দুএকজন রইল যারা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজন মতো
তাদের জন্য উন্নতির কাজ করবে এবং করাবে। চাষের
জন্যে জলের ব্যবস্থা করা। ভালো বীজ কিনে চাষীদের আরও বেশি জমিতে চাষবাস শুরু
করানো। তাদের দুঃখে সুখে যতটা সম্ভব পাশে থাকা। এতে গ্রামের সাধারণ মানুষ তোদের
বশে এসে যাবে।
এটা খুব
জরুরি। একটা কথা মনে রাখিস যতই ভালো কাজ করিস, মানুষের উপকার করিস - কিছুলোক তোদের
কাজে ব্যাগড়া দেবে, বিরুদ্ধে যাবে। সেই লোকগুলো কারা - গ্রামের মানুষরাই তোদের বলে
দেবে। তোরা সতর্ক হতে পারবি। তার ওপর বিভিন্ন গ্রামে – প্রয়োজনে কাছের শহরগুলোতেও কিছু
ছেলেকে রেখে দিতে হবে গুপ্তচর হিসেবে। সব থেকে ভালো হয় চটি বা পান্থশালার
অধ্যক্ষকে হাতে রাখতে পারলে। তোরা এই যে বিদ্রোহের কাজকর্ম শুরু করেছিস – তাতে
বাইরের লোকজন তোদের সম্পর্কে কী ভাবছে? রাজধানীতে তোদের নিয়ে কী চিন্তাভাবনা চলছে –
সে বার্তাগুলো সংগ্রহ করতে না পারলে, কোথা থেকে আচমকা সর্বনাশ উপস্থিত হবে, টেরও
পাবিনা। হঠাৎ একদিন সকালে দেখবি রাজধানী থেকে বিরাট রক্ষীবাহিনী এসে তোদের ধরপাকড়
শুরু করে দিল”।
জনা
উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের মধ্যে গুপ্তচর পাবো কোথায়, ভল্লাদাদা?”
“ধুর ব্যাটা
গুপ্তচর হয়ে কেউ জন্মায় নাকি? আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ গুপ্তচর হয়ে ওঠে। কিছুই না –
ছেলেটাকে অস্ত্র-শস্ত্র চালানো জানতে হবে। রণপা চড়ে দৌড়ে বেড়াতে হবে। আর হ্যাঁ
ছেলেটাকে ভদ্র, বিনয়ী কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমান হতে হবে। অচেনা লোকদের সঙ্গে চট
করে আলাপ করে – তার বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে।
রাজপথের
ধারের পান্থশালাগুলোতে বহু ধরনের লোকজন আসে – ধনী বণিক, তীর্থযাত্রী, নানা পদের
আধিকারিক। তাদের সঙ্গে পান্থশালার অধ্যক্ষদের খুব হৃদ্যতা থাকে। এমন দু চারটে
পান্থশালায় তোদের দু-চারজন ছেলে একবার যদি সহকারি হয়ে ঢুকতে পারে তোদের কাজটা সহজ
হয়ে যাবে। জানিস না হয়তো, পান্থশালার অধ্যক্ষের সঙ্গে শহরের সকল বণিকদেরই নিবিড়
সম্পর্ক থাকে। কারণ চটির যাবতীয় পসরা সরবরাহ করে স্থানীয় বণিকরাই – সম্বৎসর
প্রতিদিন। ওই বণিকরা কত যে সংবাদ রাখে তোদের ধারণা নেই। তাদের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা
করতে পারলেই – তোকে জিজ্ঞাসাও করতে হবে না – নিজে থেকেই নানান গল্প শোনাবে। এবার
তার থেকে কোন সংবাদটুকু তোদের প্রয়োজন – সেটা বুঝে তোদের সময় মতো অবহিত করাই হচ্ছে
গুপ্তচরের কাজ”।
“বুঝেছি।
যেভাবে তোমার সংবাদ আমরা প্রথম বার পেয়েছিলাম আমাদের গ্রাম থেকে তিনক্রোশ দূরের
হাট থেকে। এখনও পাই – তোমার, রামালি, আহোকের খবর...। এমনকি আমাদের নানান কীর্তির
কথাও – তারা আমাদের চোখে দেখেনি কোনদিন – চেনে না – কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা
করে”।
ভল্লা হাসল,
“ঠিক। দেখবি দুপুরের দিকে হাটের ব্যাপারিদের ব্যস্ততা কিছুটা কমে যায়। সকাল থেকে
মোটামুটি ভাল বেচাকেনা হয়ে গেলে, তারা এক এক জায়গায় বসে ঘোঁট পাকায়। তাদের মধ্যে সর্বদা
তিনটে দল থাকে – একদল তোদের সমর্থন করবে, বলবে যা করছিস ঠিক করছিস। অন্যায়ের প্রতিবাদ
হওয়া প্রয়োজন। অন্যদল বলবে রাজার বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক নয়। রাজার কত ক্ষমতা
রক্ষীবাহিনী, সেনাবাহিনী – শুনলাম রাজধানী থেকে পাঠাচ্ছে একটা দল – ছোকরাদের
জারিজুরি শেষ করে দেবে। আরেকদল বলবে – কী প্রয়োজন ভাই আমাদের ওসব কথায় থাকার – কে
কোথায় শুনে ফেলবে। তারপরে আমাদের নিয়ে টানাটানি করবে...। তোদের ছেলেটিকে এই ধরনের ঘোঁটে
যোগ দিতে হবে। প্রথম দুই পক্ষকে একটু একটু টুইয়ে দিয়ে দেখতে হবে আরও কতটা কী সংবাদ
পাওয়া যায়।
তোদের এই
গুপ্তচরের দল যত দক্ষ হবে – তোদের কাজ কর্ম করতে এবং পরবর্তী ভাবনাচিন্তা করতে ততই
সুবিধে হবে”।
মিলা এতক্ষণ
ভল্লার কথা মন দিয়ে শুনছিল, বলল, “আমাদের দলে এরকম চার-পাঁচজন ছেলে আছে, ভল্লাদাদা
– মনে হয় তারা পারবে”।
ভল্লা বলল,
“বেশ, তাদের কয়েকদিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজে লাগিয়ে দে। এরপর তোদের যেটা করতে হবে – একটা
বা দুটো বিশ্বাসী ছেলে – যে তোদের টাকাকড়ির সমস্ত আয়-ব্যয়ের খতিয়ান করবে। এটা না
করলে কিংবা ঢিলে দিলে – টাকার নয়-ছয় হওয়াই স্বাভাবিক। দেখবি তোরা পরিশ্রম করে
মরছিস, আর তোদের মধ্যেই দু-একজন বেশ আনন্দ করছে...টাকা ওড়াচ্ছে। টাকা ব্যাপারটা
বড্ডো লোভনীয় – মাথা ঠিক রাখা সহজ কথা নয়”।
জনা মিলার
মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছ ভল্লাদাদা, এরই মধ্যে চিনকা বলে একজন – দ্বিতীয়
গ্রামিকের বাড়ি ডাকাতির সময় – কিছু গয়না সরিয়ে ফেলেছিল, দৈবাৎ একজনের চোখে পড়ে
যাওয়াতে...”।
ভল্লা বলল,
“ছেলেটি কী করে ওগুলো হাতে পেল? সিন্দুক তো তোরাই খুলেছিলি?”
জনা বলল,
“হ্যাঁ আমরা যখন ঘরের ভেতরে সিন্দুক নিয়ে ব্যস্ত – তখন বাইরে গ্রামিকের ছোট ছেলের
বুকে ভল্ল ঠেকিয়ে ঘরের বৌদের গা থেকে গয়না খুলে নিজের কোঁচড়ে রাখছিল – দলেরই একজন
দেখতে পেয়ে আমাদের বার্তা দেয় – আমরা বেরিয়ে এসে চিনকার থেকে কেড়ে নিয়ে সে গয়না আবার ফিরিয়ে
দিয়েছি...”। একটু থেমে জনা বলল, “তুমি বলেছিলে, কোন বাড়ির মেয়ে-বৌয়ের অসম্মান
না করতে – আমরা সেকথা মেনে চলছি, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা বলল,
“কথাটা সারাজীবন মনে রাখিস। মেয়ে-বউদের একটু ভয়টয় দেখালি সে কথা আলাদা, কিন্তু অপমান,
অত্যাচার কখনও করবি না – যেদিন থেকে করবি, টের পাবি তোদের মনের আগুন নিভতে শুরু করছে।
তোদের আজকের এই শক্তি, এই প্রভাব-প্রতিপত্তি, মুঠোয় ধরা বালির মতো ধীরে ধীরে ঝরে
পড়বে আঙুলের ফাঁক দিয়ে... সাধারণ মানুষ
তোদের নাম শুনলে আতঙ্কে শিউরে উঠবে, আড়ালে ঘৃণায় থুথু ছেটাবে…”।
অনেকক্ষণ কেউ
কোন কথা বলল না, চুপ করে বসে রইল মাথা নীচু করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভল্লা সকলের মুখের
দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “অনেক
নীতিকথা শুনিয়ে দিলাম, এবার কাজের কথায় আসি, চাষের জন্যে জল-জমি-বীজের ব্যবস্থা
করছিস, এর সঙ্গে আরেকটা ব্যবস্থা করছিস না কেন?”
মিলা
জিজ্ঞাসা করল, “আর কীসের ব্যবস্থা বলছ, ভল্লাদাদা?”
“প্রত্যেক
গ্রামের জন্যে দুটো বা তিনটে করে বলদ কিনছিস না কেন? নিজের হাতে লাঙ্গল ঠেলে একজন
মানুষের পক্ষে কত জমি আর চাষ করা সম্ভব? বলদ পেলে চাষীদের পরিশ্রম কমবে – অথচ
কাজটাও ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। তোদের দল থেকেই ধর তিনটে বলদ কিনলি, তোদের গোয়ালে
রাখলি, তোরাই দেখভাল করলি। যখন যে চাষীর দরকার সে তোদের থেকে সকালে নিয়ে যাবে –
কাজ হয়ে গেলে বিকেলে তোদের গোয়ালেই আবার রেখে যাবে। শুরুতে কোন পয়সা নিলি না – ফসল
উঠলে চাষীদের থেকে কিছু কিছু পয়সা নিবি – বলদের মূল্য এবং তাদের পালনপোষণের ব্যয়ের
জন্যে”।
জনা আর মিলা
দুজনেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “বাঃ ভল্লাদাদা দারুণ বলেছো তো। সামনের হাট থেকেই চারটে
বলদ কিনব”।
“উঁহু, অত তাড়াহুড়ো
করিস না। তোদের মধ্যে বা গ্রামের কেউ কোনদিন গো-বলদ পালন করেছে? এ কাজটাও জানতে হয়
– যারা করেছে তারাই জানে। আমাদের ওদিকে যারা গোপালন করেই জীবিকা উপার্জন করে তাদের
আহীর বা যাদব বলে। সেরকম কেউ আছে তোদের বা আশেপাশের গ্রামে?”
জনা বলল, “আমাদের
এদিকেও বেশ কিছু ঘর যাদব আছে। যদিও এখন তারাও চাষবাস করে – গোপালন করার সামর্থ্য নেই
বলে”।
“তাদের মধ্যে
বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে কথা বল। তারা হয়তো এখনও ভোলেননি। বলদ কিনতে যাওয়ার সময় তাঁদের
দু-একজনকে সঙ্গে নিবি – তা নাহলে বণিকরা ঠকিয়ে দেবে…অসুস্থ বুড়ো বলদ গছিয়ে দেবে – বুঝতেও
পারবি না”।
মিলা বলল, “আমাদের
ঠকাবে…হতভাগাদের হাটে আসাই বন্ধ করে দেব”।
ভল্লা হাসল,
বলল, “সে জানি। কিন্তু তাতে সময় নষ্ট হবে, নাকাল হতে হবে – আর ঠকার পর শাস্তি দিয়ে
তোদের লাভ কী হবে? গোপালনের ভালো লোক যদি পাস – কিছু গাইও আনতে পারিস – গ্রামের বাচ্চা-বুড়োর
জন্যে দুধ – বাড়তি দুধ থেকে দই, ঘি, ননী – একঘেয়ে খাবারের থেকে মুক্তি। যাদবরাও তাদের
মনোমত কাজ পেয়ে যাবে…”। একটু থেমে ভল্লা আবার বলল, “ভেবে দ্যাখ, তোদের সাহায্যে - চাষীরা
মনের আনন্দে চাষ করবে, যাদবরা গোপালন করবে – ছুতোর, কামার, কুমোরদেরও অনেক কাজ বাড়বে
– গ্রামের মানুষ কৃতজ্ঞ হয়ে তোদের দু হাত তুলে আশীর্বাদ করবে। প্রথমে দু চারটে গ্রামের
এমন উন্নতি হলে, আশেপাশের সব গ্রামই তোদের কাছে আসবে – বাড়বে তোদের প্রভাব-প্রতিপত্তি।
তখন আর কখানা গ্রাম মাত্র নয় – গোটা অঞ্চল – এমনকি গোটা বিষয়ের সাধারণ মানুষ তোদের
জয়-জয়কার করবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই তো তোরা শুরুতে আমার কাছে এসেছিলি, তাই না?”
জনা আর মিলা
কোন কথা বলতে পারল না, মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ভল্লার মুখের দিকে। তারপর জনা
বলল, “তুমি পাশে থাকলে নিশ্চয়ই পারবো, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা হাসল,
“আমি না থাকলেই বা কি? এরা তো থাকছে – রামালি, আহোক, বিনেশ…”।
“তুমি কী কোথাও
চলে যাচ্ছো ভল্লাদাদা?” মিলা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
ভল্লা মিলার
কাঁধে হাত রেখে বলল, “চলে যাবো না রে বোকা, পালাবো। পালাতে হবে। তোদের সবাইকে কুবুদ্ধি
দিয়ে আমি যে তোদের মাথা খাচ্ছি – এ বার্তা চলে গেছে আমাদের এবং তোদের রাজধানীতেও। তারাই
আমার আয়ু নির্দিষ্ট করে ফেলেছে – অতএব নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমাকে এখন পালাতে হবে…”।
জনা রামালিকে
বলল, “তোরা আমরা – সবাই মিলে ভল্লাদাদাকে রক্ষা করতে পারবো না, রামালি?”
রামালি গম্ভীর
হয়ে বলল, “রাজসৈন্যদের বিরুদ্ধে কতদিন লড়াই করবি, জনা? তার চেয়ে ভল্লাদাদা বিশাল এই
রাজ্যের কোথাও গাঢাকা দিয়ে থাকলে – আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে – বছরে এক দুবার দেখা
পাওয়া যাবে… সেটাই সবার পক্ষে ভালো হবে”।
জনা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে চুপ করে রইল।
ভল্লা বলল,
“হতভাগা তোরা তো ঝিম মেরে গেলি …কাল কী হবে, সে কথা পরে চিন্তা করবি – এখন বল, এদিকের
সব কাজ সামলে, তোদের পরের আক্রমণের লক্ষ্য কে?”
মিলা বলল, “একটু
গুছিয়ে নিয়েই আমরা এবার সেনা শিবিরে আক্রমণ চালাবো, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা হতাশ সুরে
বলল, “বোঝো, আক্রমণের আর লক্ষ্য পেলি না? সেনা শিবির আক্রমণ করে তোদের কী লাভ হবে?
কিছু অস্ত্র-শস্ত্র হয়তো পাবি – কিন্তু টাকাকড়ি মণিমুক্তা পাবি? মধু পেতে গেলে মৌচাক
ভাঙতে হয়, ভোমরার বাসা ভেঙে কি আর মধু পাওয়া যায় রে বোকা? তোরা গ্রামিক বা প্রধান,
করাধ্যক্ষ্যের আস্থানে রক্ষীবাহিনীদের যতখুশি আক্রমণ কর – কিন্তু ভুলেও সেনা শিবিরে
খোঁচা দিতে যাস না। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, তাদের গায়ে হাত
পড়লে তোদের শেষ করে দেবে। রক্ষীবাহিনী থাকে গৃহমন্ত্রকের অধীনে – সেনাবাহিনীর তুলনায়
তারা সবদিক দিয়েই দুর্বল। একটা আস্থান লুঠ করতে পারলে কত যে রূপো বা তামার মুদ্রা পাবি
গুনে শেষ করতে পারবি না … আর ওই গ্রামপ্রধান বা বিষয়প্রধানরা তো রইলই”।
জনা বলল, “আমাদের
বটতলির উত্তরে পাঁচক্রোশ দূরে করাধ্যক্ষের আস্থান – তাহলে সেখানেই…”।
“হ্যাঁ। আটঘাট
বেঁধে, ভেতরের সব সংবাদ নিয়ে, রামালিদের সঙ্গে বসে পুরো পরিকল্পনাটা ছকে নিস। তারপর
এক রাত্রে হানা দিয়ে দে। মনে রাখিস, সফল হলে একরাত্রেই তোদের প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি
লাভ হবে… এ দিগরের সর্বত্র তোদের নাম ছড়িয়ে
পড়বে। ভয় ঢুকবে যত দুনীর্তিগ্রস্ত আধিকারিক ও বণিক মহলে। ডাকাত থেকে - সাধারণ
মানুষের চোখে এক ধাক্কায় – তোরা উঠে বসবি বিদ্রোহীর আসনে।
সাধারণ
মানুষ রাজাকে কবে আর চোখে দেখেছে? তারা চেনে এবং ভয় পায় রাজকর্মচারীদের। সেই রাজকর্মচারীদের
চোখে চোখ রেখে, তাদের হারিয়ে দেওয়ার সাহস যারা করতে পারে, সাধারণের চোখে তারাই তো
বীর। তাদেরকেই তো তারা বসাবে তাদের হৃদয়ের রাজাসনে...”।
মিলা আর জনা
ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে শুনছিল। ভল্লার কথা শেষ হলেও তারা কোন কথা বলল
না। তারা দুজনেই ডুব দিল গভীর স্বপ্নের গহনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন