Powered By Blogger

শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১

 

 

লক্ষ্মীকান্তপুরের মালতী পোল্লে রোজ সকালের লোকাল ট্রেন ধরে টালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে প্রায় দৌড়ে চলে তার গন্তব্যে। মালতী পোল্লে একা নয় তার সঙ্গে থাকে আরো অন্ততঃ জনা পনেরো। একটু এগিয়ে, পিছিয়ে - নানান বয়সের - বুড়ি, মাঝবয়সি, ছুকরি। কেউ মুখরা - সব কথাতেই তেতে ওঠে – কেউ বাচাল – সব কথাতেই হেসে ওঠে। কেউ কেউ একটু আলাদা রকম - চুপচাপ উদাসীন নির্লিপ্তিতে দু একটা মন্তব্য করেই থেমে যায়। দুজন কমবয়সীর পরনে শালোয়ার-কামিজ ছাড়া প্রায় সকলেরই পরনে আটপৌরে সস্তার শাড়ী। পায়ে পেলাস্টিকের স্যান্ডেল – সস্তা কিন্তু বেশ টেকসই।  

 

মালতী পোল্লেদের এই দলটা একসঙ্গেই আসে রোজ। কোনদিন এক আধ জন কেউ বাড়তি কাজের চাপে আটকা না পড়লে, তারা ফিরেও যায় মোটামুটি একই সঙ্গে। এরা সকলেই ঠিকে ঝি। একটু ভাল করে বললে কাজের মাসি – কিংবা কাজের মেয়ে। বাবুদের বাড়ি তারা বাসন ধোয়, ঘর মোছে। কেউ কেউ কাপড়ও কাচে। এরা সকলেই কাজ করে এক বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্সে। সে কমপ্লেক্সে কত যে ফ্ল্যাট আর কত যে বাসিন্দা তার হিসেব ওরা রাখে না। কিন্তু তাদের কাজের অভাব হয় না। এক বাড়ি ছাড়িয়ে দিলে অন্য বাড়ি থেকে ডেকে নেয়। তারা অর্থনীতি বোঝে না, বোঝে না মার্কেটের সাপ্লাই - ডিম্যান্ড রেশিও। পরতায় না পোষালে ওরা নিজেরাও এক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে যায় নিশ্চিন্তে

সাধারণ ভাগচাষী ঘরের মেয়ে মালতীর বিয়ে হয়েছিল হলধর পোল্লের সঙ্গে। হলধর ছিল মহাজন সাঁপুইয়ের গুদামে রাতের সিকিউরিটি। মহাজন সাঁপুই বেশ পছন্দ করতেন হলধরকে আর ভরসাও করতেন। কারণ হলধরের ছিল ডাকাবুকো লম্বাচওড়া চেহারা আর বিস্তর গায়ের জোরডেকে হেঁকে কথাও বলতে পারত বেশ।

বিয়ের পর পরই মালতীর মনে আছে, একদিন শেষ বিকেলে তারা দুজন রথের মেলা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ মাঝরাস্তায় কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি। আকাশ জুড়ে একখান বিশাল পাথরের মতো নিরেট মেঘ আর তেমনি জলের ধারা। দুপাশে ফাঁকা ক্ষেতের মধ্যে রাস্তার কোথাও মাথা বাঁচাবার উপায় নেই। ভেজা শাড়িতে ঘোমটাতে মালতীর একে জবুথবু অবস্থা, তার ওপর পেছল কাঁচা রাস্তায় হাঁটা দায়। পিছিয়ে পড়া মালতীর জন্যে বারবার দাঁড়াতে দাঁড়াতে হলধর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল।

তারপর আচমকা মালতীকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, “এত হাল্কা তুই, য্যাঃ, য্যান এত্তটুকুন পাকি।...দ্যাক দেকি, এতটুকু গত্তি নেই শরীলে, আমার সঙ্গে পারবি ক্যানে - আজ থিকে আমার সঙ্গেরে খাবি”। মালতী অনেক অনুনয় - বিনয় - ঝটপট করেছিল ছাড়া পেতে, ছাড়েনি হলধর। আরো চেপে ধরে রেখেছিল আর হাসছিল হা হা করে। একসময় সেই বেহায়া ডাকাতটা অঝোর ধারায় নির্জন পথ চলতে চলতে মালতীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল। 

কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল মনে নেই মালতীর। ভীষণ লজ্জা কিন্তু তার চেয়েও ভীষণ ভালো লাগায় সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলছাড়া পাওয়ার পরে মালতী বলেছিল, “তুমি একটা ডাকাত, মাঝ স্তায় এমন করতি আচে? কেউ যদি দেকে ফেলে”?

হলধরের পাটার মতো বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে সংলিপ্ত মালতী, হলধরের হৃদয়ের শব্দ শুনতে শুনতে অবাক হয়ে দেখছিল তার মানুষটিকে। বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল সেইদিন। বিয়ের পর সেইদিনই প্রথম মালতী হলধরকে “তুমি” ডেকেছিল – তার আগে সে “আপনি” বলতকোন কথা বলছিল না হলধর। মালতী অস্ফুটে বলেছিল, “আমারে ছাড়ি দ্যাও। নামায়ে দ্যাও আমারে”হলধর নামিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছিল সেই নির্জন মেঠো পথে – মুষলধারে ঝরতে থাকা বরষার মধ্যে। তীব্র সুখে ডুবে থাকা শরীরি আবেগে মালতীর মনে হয়েছিল সে এক অদ্ভূত পথচলা – শেষ না হলেই বুঝি ভালো হয়।      

সেই দিনের কথা আজও মালতীর মনে আঁকা হয়ে আছে একই রকম জীবন্ত হয়ে। কারণ সেদিন ঘরে ফিরে অস্বস্তির শীতল সিক্ত বসনমুক্ত হতে হতেই ঘটে গিয়েছিল এক পরম আনন্দের মিলন। জোৎস্নাপ্লাবিত সাগরবেলা নয়। মনোরম পর্বত শিখরের মায়াবী পরিবেশও নয়। কিন্তু এক মধুর মধুচন্দ্রিমায় তারা সেদিন ভেসে যেতে পেরেছিল নিটোল ভালোবাসায় সম্পৃক্ত আকুল মিলনে।

কোল আলো করে এসেছিল তাদের মেয়ে। শ্যামল বরণ, ডাগর চোখে দুষ্টু হাসি। ছবির মতোই দেখতে, তারা আদর করে তার নাম দিল ছবি। হলধর যখন নাইট ডিউটি সেরে ভোরে ফিরত - ওই একরত্তি মেয়েটাও ঘুম ভেঙে জেগে বসে থাকত বাপের অপেক্ষায়। এমন বাপ সোহাগী! সেই মেয়েও বড়ো হতে থাকল দ্রুত। মালতীর মনে হয় যেন এই তো সেদিন।

স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এল ওর বাপ। মেয়ের চুলে বেড়িবিনুনি বেঁধে দিত মালতী। “বুলু” স্কার্ট আর সাদা জামা, পিঠে ইস্কুল ব্যাগ। ডিউটি থেকে ফিরে ওর বাপ মুখ হাত ধুয়ে চা খেয়েই বেরিয়ে যেত মেয়েকে নিয়ে – মেয়ে থাকত কোলে আর বাপের হাতে ব্যাগ। ওইটুকু মেয়ে আবার বোঝা বইবে কি – হোক না কেন সে বিদ্যের বোঝা – এই ছিল হলধরের কথা।

সব চলছিল খুব সুন্দর - একদম মনোমত। কিন্তু এত সুখ সইল না মালতীর। তার সুখের কপাল পুড়ল সে এক গভীর রাত্রে।

 

মহাজন সাঁপুইয়ের পাইকারি ব্যবসা – নানান কারোবার, হরেক এজেন্সি। চারটে গুদাম বোঝাই থাকে মাল। রাত্রে যে মাল লোড হয় না, তা নয়। নিয়মিতই হয়। কিন্তু তার নিয়ম আছে। ডেলিভারি চালান, গেট পাস চলে আসে আগেই। কার গাড়ি, কোন গাড়ি লোড হবে সে সংবাদ সন্ধের আগেই চলে আসে অফিস থেকে। সেই অনুযায়ী মেন গেট খুলে লরি ঢোকে। মাল লোড হয়, চেক হয়ে - চালান সই হয়ে গাড়ি বেরিয়ে যায় নিয়ম মতো। যারা মাল নিতে আসে তারা নিয়মিতই আসে এবং তারা এই নিয়ম কানুন সবই জানে। কাজেই কোনোদিন অসুবিধে হয়নি - চেনা জানা অভ্যস্ত কাস্টমারদের সামলাতে।

সে রাতে ওরা চারজন এসেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল খালি ট্রাক আর ট্রাক লোড করার লেবার। তারা কেউই চেনা নয়, সম্পূর্ণ অজানা। অফিস থেকে কোন খবর ছিল না। ওরা দেখাতে পারে নি কোন চালান বা গেট পাস। গেট খোলা হয় নি। হলধর কোনোমতেই অ্যালাউ করে নি তাদের। লোহার গেটের ভিতরে থাকা হলধর আর তার সঙ্গী সিকিউরিটির সঙ্গে বচসা শুরু হয়ে যায় গেটের বাইরে দাঁড়ানো ওই চারজনের। কথা কাটাকাটি, গালাগালি, হুমকি চলতে চলতেই গুলি চালায় ওদের মধ্যে একজন।

গুলির আওয়াজে এবং হলধর মাটিতে পড়ে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সকলেই। হলধরের সঙ্গী সিকিউরিটি চেঁচামেচি করতে করতে সরে গিয়েছিল গেট থেকে – ফোন করে দিয়েছিল অফিসের বাবুদের। যে চারজন এসেছিল তারাও ব্যাপার সুবিধে নয় বুঝে উধাও হয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। শুধু মালতীর কপাল পুড়িয়ে এবং তার জীবনের সমস্ত রঙ নিকিয়ে নিয়ে, মাটিতে শুয়েই রইল হলধরের বলিষ্ঠ, স্তব্ধ - নিথর শরীরটা। রাত তখন পৌনে একটা।

রাতে মেয়ের লেখা পড়া সারা হলে, মা আর মেয়ে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছিল নিত্যদিনের রুটিন মাফিক। হঠাৎ মাঝ রাত্রে ডাকাডাকি করে তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল মহাজন সাঁপুইয়ের লোক। হলধরের শরীর খুব খারাপ, তাকে নাকি সদরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তারা এসেছে গাড়ি নিয়ে হলধরের মেয়ে বউকে নিয়ে যেতে। দিশাহারা মালতী আর মেয়ে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই বেড়িয়ে পড়েছিল। কী হয়েছে। কখন হয়েছে। গাড়িতে যেতে যেতে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও মহাজন সাঁপুইয়ের লোকটি কোন স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছিল না।

 যেন এক অনন্ত যাত্রা শেষে তারা সদর হাসপাতালে পৌঁছোলো। তাদের আসতে দেখে অনেক লোকজনসহ মহাজন সাঁপুইও এগিয়ে এসেছিল। ব্যাকুল হয়ে মালতী জিজ্ঞাসা করেছিল, “বাবু, এরা কেউ কিচু বললনি আমারে, কি হয়েচে আমারে বলেন না, মানুষটা বেঁচে আচে তো”? আধো আলো - আধো অন্ধকার হাসপাতাল কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে মহাজন সাঁপুই অন্ধকার মুখ করে উত্তর দিয়েছিল, “ধৈর্য হারায়ো না, মাশান্ত হও -  তোমার সোয়ামি বীরগতি পেয়েচে – এসো, আমার সঙ্গেরে এসো”।  অবাক মালতী কি বলবে বুঝতে পারল না, “বীরগতি” মানেই বা কি হতে পারে তার বোধে কোন সাড়া দিল না।


হাজন সাঁপুই ওদেরকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল। দীর্ঘ করিডর, প্যাসেজ পার হয়ে বারান্দার ধারে রাখা একটা বেডের সামনে তারা দাঁড়াল। সে বেডে মাথা থেকে পা অব্দি ময়লা সাদা চাদরে ঢাকা একটা শব। মহাজন সাঁপুইয়ের ইশারায় কেউ একজন মুখ থেকে সরিয়ে দিল সাদা চাদরের আবরণ। চোখ বুজে শুয়ে আছে হলধর পোল্লে। যেন ঘুমোচ্ছে। মুখে কোন বিকৃতি নেই, কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই – শুধু কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা গভীর ছিদ্র। আর তার পাশে শুকিয়ে যাওয়া অনেকটা রক্তের দাগ। 

(পরের পর্ব নেক্সট শনিবার...)

বুধবার, ২১ মে, ২০২৫

যুদ্ধ প্রস্তুতি - পর্ব ২

 [২২শে এপ্রিল ২৫ এর পহেলগামে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে নিখুঁত এবং নিশ্চিত আঘাত হানার জন্যে ভারত মাত্র চোদ্দদিন সময় নিয়েছে প্রস্তুতির জন্যে।  সরাসরি রণাঙ্গনে নামার আগে এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কথাই চিন্তা করেছিলেন যুধিষ্ঠিরও।  বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের তের বছরে ধৈর্য ধরে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন - কী ভাবে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করা যায়। সেই আলোচনাই করেছি - মহাভারতের বন পর্ব থেকে।]



অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্র দান

পিনাকপাণি পশুপতি দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর, অর্জুন চিন্তা করতে লাগলেন, “আমি ভগবান শঙ্করের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এ এক আশ্চর্য ঘটনা, আমি ধন্য আমি কৃতার্থ। আজ আমি ভগবান ভবানীপতির সাক্ষাৎ ও স্পর্শ লাভ করেছি! আমাদের সকল শত্রু যে সংগ্রামে পরাজিত হবে, এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত, আমাদের প্রয়োজন আজ সিদ্ধ হল!”
 
অর্জুন যখন এমন চিন্তা করছেন, তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন জলের অধিপতি বরুণদেব। তাঁর অঙ্গের বৈদূর্যমণির মতো আভায় চতুর্দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাঁর সঙ্গী ছিল নানান জলজন্তু, নাগ, নদ, নদী, দৈত্য, সাধ্য ও দৈবতগণ। তারপর যক্ষদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন শ্রীমান ধনেশ্বর কুবের, তাঁর উজ্জ্বল বিমানের আলোকে সমস্ত কানন আলোকিত হয়ে উঠল। তারপর দ্বিতীয় সূর্যের মতো উজ্জ্বল, দণ্ডপাণি শ্রীমান ধর্মরাজ সেখানে উপস্থিত হলেন। এমন সময় ঐরাবতে আরোহণ করে, ইন্দ্রাণীকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন, স্বর্গের সকল দেবতা। ওই কাননের অধিবাসী যত গন্ধর্ব এবং মহর্ষিরা দেবরাজ ইন্দ্রের স্তব করতে লাগলেন। 
 
দক্ষিণদিকস্থ লোকপাল পরমধর্মজ্ঞ যম, মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, “হে পার্থ, দেখ, আমরা সকল লোকপাল এখানে উপস্থিত হয়েছি। তুমি দিব্য জ্ঞানের যোগ্য আধার, আমরা তোমাকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করছি, শোনো। হে পার্থ, তুমি পূর্বজন্মে মহাপরাক্রান্ত নর নামে মহর্ষি ছিলে। এখন ভগবান ব্রহ্মার নিয়োগেই তুমি মানুষের কলেবর গ্রহণ করেছো।  তুমি মহাবীর ও পরমধর্মাত্মা পিতামহ ভীষ্মকে সংগ্রামে পরাজিত করবে। দ্রোণ রক্ষিত ক্ষত্রিয়কুল তোমার শরানলে দগ্ধ হবে। যে সমস্ত দানবগণ মনুষ্যসমাজে জন্ম নিয়েছে, তারা সকলে এবং নিবাত-কবচ প্রভৃতি অন্যান্য দানবেরাও তোমার হাতে নিহত হবে। আমার পিতা সূর্যের অংশে জাত কর্ণ তোমারই বধ্য হবে। তোমার কীর্তি অক্ষয় হয়ে চিরকাল এই পৃথিবীতে বিরাজ করবে। হে মহাবাহো, তুমি সাক্ষাৎ মহাদেবকে প্রসন্ন করেছো, এখন বিষ্ণুর সহযোগিতায় তুমিই ভূভার হরণ করবে। হে মহাবীর, তুমি আমার এই দণ্ড গ্রহণ করো, এই অস্ত্রের তেজ কেউ নিবারণ করতে পারে না, এই অস্ত্রে তুমি সুমহৎ সকল কর্ম করতে পারবে”। অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে, পরম প্রীতমনে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের বিধিমন্ত্র সহ ওই যমদণ্ড গ্রহণ করলেন।
 
[ এখানে অর্জুন কিছু বলার আগেই যমরাজ নিজের থেকেই  অর্জুনকে বললেন তুমি ভীষ্মকে হারাবে,দ্রোণকে দগ্ধ করবে এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই কর্ণকেও বধ করবে। এমন সমর্থন ও সহযোগীতার জন্যেই তো যুধিষ্ঠির দুশ্চিন্তা করছিলেন।]      
 
তখন পশ্চিমদিকস্থ জলধরের মতো শ্যাম কলেবর জলেশ্বর বরুণ বললেন, “হে পার্থ, তুমি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ও সর্বদাই ক্ষাত্রধর্ম অবলম্বন করে থাকো। আমি জলদাধিপতি বরুণ, তোমাকে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের বিধিমন্ত্র সহ বারুণপাশ প্রদান করছি, গ্রহণ করো। আমি তারকাসুরের সঙ্গে সংগ্রামের সময় সহস্র সহস্র দানবকে এই অস্ত্রে বদ্ধ করেছিলাম। হে মহাসত্ত্ব, আমি প্রসন্ন হয়ে তোমাকে এই পাশ প্রদান করছি, এই পাশ দিয়ে ধর্মরাজ যমকে বদ্ধ করতে অভিলাষী হলে, তিনিও এই অস্ত্রের থেকে রক্ষা পাবেন না। এই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রামে গেলে, এই পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হয়ে যাবে সন্দেহ নেই!”

অর্জুনকে এইভাবে যম ও বরুণের  দিব্যাস্ত্র প্রদান করার পর,  কৈলাস পর্বত নিবাসী ধনাধ্যক্ষ কুবের বললেন, “হে মহাবল-পরাক্রান্ত মহাপ্রাজ্ঞ পাণ্ডুনন্দন, আমি কৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভ করে যেমন প্রীত হই, আজ তোমার সঙ্গে দেখা হয়েও সেই রকমই আনন্দিত হলাম। হে সব্যসাচিন্‌, হে পূর্বদেব সনাতন, তুমি পুরাকল্পে আমাদের সঙ্গে প্রত্যহ তপস্যা করেছিলে। এখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ হল, আমি তোমাকে এই দিব্য অস্ত্র প্রদান করছি, গ্রহণ করো। এই অস্ত্র দিয়ে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য দুর্জয় যোদ্ধাকে পরাজয় করতে পারবে এবং ধৃতরাষ্ট্রের সমস্ত সৈন্যদের শমনসদনে পাঠাতে পারবে। অতএব তুমি এই অরাতিকুলনাশক, ওজঃ, তেজ ও দ্যুতিকর আমার প্রিয়তম প্রস্বাপন অস্ত্র গ্রহণ করো। মহাত্মা শঙ্করের ত্রিপুরবিনাশকালে আমি এই অস্ত্র নিক্ষেপ করে, মহাসুরদের দগ্ধ করেছিলাম। এখন আমি সেই অস্ত্র তোমার জন্য এনেছি। হে সত্যপরাক্রম, তুমিই এই অস্ত্রধারণে সমর্থ"।  মহাবল অর্জুন বিধি অনুযায়ী কুবেরের সেই দিব্য অস্ত্র গ্রহণ করলেন।
 
এরপর দেবরাজ ইন্দ্র অক্লিষ্টকর্মা[1] পার্থকে মেঘ গম্ভীর স্বরে বললেন, “হে মহাবাহো কৌন্তেয়, তুমি পুরাতন মহর্ষি। এখন উৎকৃষ্ট সিদ্ধিলাভ করে দেবত্ব লাভ করেছো। তোমাকে দেবকার্য সাধনের জন্য স্বর্গে যেতে হবে, অতএব প্রস্তুত হও। মাতলি তোমার জন্য রথ নিয়ে ভূতলে আসবে, তুমি সেই রথে চড়ে স্বর্গে এলে, সেখানে আমিও তোমাকে নানান দিব্য অস্ত্র প্রদান করবো”।
ধীমান অর্জুন সেই গিরিশিখরে সকল লোকপালদের উপস্থিত দেখে অভিভূত হলেন, তিনি জল ও ফল দিয়ে সকল দেবতাদের পূজা করার পর দেবতারা নিজ নিজ লোকে ফিরে গেলেন। অর্জুনও দেবতাদের থেকে এতগুলি দিব্য অস্ত্র লাভ করে, নিজেকে কৃতার্থ বোধ করলেন।
[শুধু যম নন, বরুণ, কুবেরের মতো লোকপালগণও অর্জুনের অস্ত্রসংগ্রহের কারণ সম্পূর্ণ অবগত হয়েও, প্রসন্নমনে তাঁদের সকলের দিব্য অস্ত্রসমূহ অর্জুনকে অর্পণ করলেন! অতএব যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবদের মহাবীর জ্ঞাতিদের হত্যা নিয়ে যে সংশয় ও দ্বিধা ছিল সে সবেরই নিরসন হল। এরপর দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে স্বর্গে আহ্বান করে আরও কী কী অস্ত্র উপহার দেন সেটাও দেখা যাক। ]   

অর্জুনের ইন্দ্রলোকে গমন
লোকপালেরা চলে যাওয়ার পর, শত্রুবিনাশন অর্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের রথের প্রতীক্ষা করছিলেন, এমন সময় মাতলি রথ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। দশসহস্র তুরঙ্গম[2], যাদের গতি বায়ুবেগের মতো, সেই নয়নমনোহর রথকে বহন করে নিয়ে এল। তার প্রচণ্ডবেগে আকাশের মেঘমালা ছিন্নভিন্ন হয়ে, আকাশ নির্মল হয়ে গেল। স্বর্ণালংকারে ভূষিত বৈজয়ন্তী পতাকা বিরাজিত রথে, সোনার অলংকারে ভূষিত সারথিকে দেখে, মহাবলী অর্জুন চিন্তা করলেন, ইনি নিশ্চয়ই কোন দেবতা হবেন।
 
সেই অদ্ভূত রথের সারথি অত্যন্ত বিনীতভাবে অর্জুনের সামনে এসে বললেন, “হে রূপনিধান ইন্দ্রাত্মজ, দেবরাজ তোমাকে দেখতে অভিলাষ করেছেন। অতএব তুমি শীঘ্র তাঁর এই রথে আরোহণ করো। আমি মাতলি, তোমার পিতা অমররাজ আমাকে আদেশ করেছেন যে, ‘কুন্তীতনয়কে এখানে আনো। দেবতাদের সকলে তাঁকে দেখবেন’। সম্প্রতি ত্রিদশাধিপতি[3] দেব, ঋষি, গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ তোমাকে দেখার ইচ্ছায় কালপ্রতীক্ষা করছেন। তাঁর আদেশ মতো ভূলোক ত্যাগ করে, তুমি আমার সঙ্গে দেবলোকে চলো, দিব্য অস্ত্র লাভ করার পর আবার ফিরে আসবে”।
 
অর্জুন বললেন, “হে মাতলে, তুমি রথে চড়ে অশ্বসমুদয়কে সুস্থির করলে, সুকৃতী ব্যক্তি যেমন সৎপথে স্বর্গে আরোহণ করেন, আমিও তেমন ওই স্বর্গরথে আরোহণ করবো। এই দিব্য রথ শত অশ্বমেধ যজ্ঞ ও রাজসূয় যজ্ঞে দুর্লভ; মহাভাগ যজ্ঞশীল রাজগণ এবং দেবদানবেরাও এই রথে আরোহণ করতে পারেন না। তপোহীন জনগণের এই রথে আরোহণের প্রত্যাশা দূরে থাকুক, তাঁরা এই রথ দর্শন বা স্পর্শ করতেও সমর্থ হন না”।  ইন্দ্রসারথি মাতলি অর্জুনের এই কথায় রথে আরোহণ করে, রশ্মি আকর্ষণ করে সকল অশ্বকে সংযত করলেন।
 
তখন অর্জুন শান্তমনে গঙ্গাস্নান করে পবিত্র হয়ে জপ সমাপন করলেন এবং যথাবিধি পিতৃতর্পণ করে শৈলরাজ মন্দরের স্তুতি করে বললেন, “হে গিরীন্দ্র, আপনি স্বর্গাভিলাষী পুণ্যশীল সাধুলোকদের আশ্রয়। আপনার প্রসাদে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়রা সুরলোক প্রাপ্ত হয়ে সুরলোকে অমরগণের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বিহার করছেন। আপনাতে নানান তীর্থ বিরাজ করছে! হে অদ্রিরাজ, আমি আপনার কাছে পরমসুখে বাস করেছি, এখন আপনার থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আপনার সানু[4], কুঞ্জ, নদী, প্রস্রবণ ও অনেকানেক পুণ্যতীর্থ দর্শন করেছি। যথেচ্ছ ভ্রমণ করে নানাপ্রকার সুগন্ধি সুমধুর ফল ভক্ষণ করেছি, আপনার শরীর নিঃসৃত সুগন্ধী প্রস্রবণের জলে পিপাসার শান্তি করেছি। শিশুসন্তান যেমন পিতার ক্রোড়ে সুখে কালযাপন করে, আমি তেমনই আপনার অঙ্কে নিঃশঙ্ক অবস্থান করেছি। আমি এতদিন বেদধ্বনি নিনাদিত অপ্সরাগণ সমাকীর্ণ পরমরমণীয় আপনার সানুদেশে সুখে বাস করছিলাম, এখন বিদায় নিচ্ছি”।
 
অর্জুন শৈলাধীশের কাছে এইভাবে বিদায় নেওয়ার পর উজ্জ্বল সূর্যের মতো সেই মহারথকে উদ্ভাসিত করে, রথে আরোহণ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে সেই রথ আকাশপথে যাত্রা করল।
 
মর্তলোকের দৃষ্টিপথের বাইরে গিয়ে, আকাশ পথে তিনি সহস্র সহস্র বিমান দেখতে পেলেন। সেখানে সূর্য বা চন্দ্রের আলোক নেই, লোকেরা নিজ নিজ পুণ্যপ্রভাতেই দীপ্ত হয়েছেন।  যে সব তারকামণ্ডলকে মর্ত্য থেকে দূরত্বের কারণে ক্ষুদ্র দীপের মতো মনে হত, এখানে তারা অত্যন্ত উজ্জ্বল ও বৃহদাকারসম্পন্ন। যে সমস্ত মহাবীর রাজর্ষিগণ রণস্থলে প্রাণত্যাগ করেছিলেন, অর্জুন দেখলেন, তাঁরা সকলে নিজ নিজ স্থানে নিজেদের প্রভাপুঞ্জে দীপ্ত হয়ে রয়েছেন। সূর্যের মতো তেজস্বী সহস্র সহস্র গন্ধর্ব, তপোবলে স্বর্গজয় করে সেখানে উপনীত হয়েছেন।
 
অর্জুন ওই সকল গুহ্যক, ঋষি, অপ্সরাগণ এবং আত্মপ্রভ লোকসমূহকে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে মাতলিকে জিজ্ঞাসা করায়, মাতলি বললেন, “হে পার্থ, তুমি ভূমণ্ডল থেকে যে সমস্ত তারকা পর্যবেক্ষণ করেছো, সেই পুণ্যশীলেরা সুকৃতিফলে এই তারকারূপে নিজ নিজ স্থানে অবস্থিতি করছেন।“
 
কিছু পরে, অর্জুন বিশাল দ্বারদেশে কৈলাস পর্বতের মতো চতুর্দন্ত ঐরাবত হস্তী দেখতে পেলেন। তিনি সিদ্ধিমার্গে পৌঁছে পার্থিবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মান্ধাতার মতো শোভন হয়ে উঠলেন। এইভাবে মহাবীর অর্জুন সকল রাজলোক অতিক্রম করে সুরলোকে গিয়ে পরমরমণীয় ইন্দ্রপুরী অমরাবতীর দর্শন পেলেন।

মহাযশা অর্জুন সিদ্ধচারণদের সঙ্গে সকল ঋতুর সুন্দর পুষ্প শোভিত, পবিত্র তরুরাজি বিরাজিত অমরাবতী দেখতে লাগলেন। যেখানে কুসুমের গন্ধ সম্পৃক্ত মন্দ মধুর বাতাস বহমান, তিনি সেই নন্দনবনে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন অপ্সরাগণ সেখানে যথেচ্ছ ভ্রমণ করছে, ধীর বাতাসে পুষ্পিত বৃক্ষের শাখা দুলছে, তারা সকলেই যেন তাঁকে আহ্বান করছে।
 
সেখানে কেবল পুণ্যশীলেরাই যেতে পারে, যাঁরা তপোবিহীন, অগ্নিতে কখনো আহুতি দেননি ও যুদ্ধে পরাঙ্মুখ, তাঁরা কখনও ওই মহেন্দ্রলোকে যেতে পারেন না। যাগ, যজ্ঞ ও ব্রতবিহীন, বেদ-শ্রুতি পরিত্যাগী, যারা তীর্থ স্নান করেনি, যারা অদাতা, যজ্ঞহন্তা, সুরাপায়ী এবং গুরুপত্নীগামী, তারা কখনও ইন্দ্রলোক দর্শন করতে সমর্থ হয় না। মহাবাহু অর্জুন দিব্য গান ও সুরে নিনাদিত মনোহর নন্দন-কাননে প্রবেশ করে, অজস্র দেববিমান দেখতে পেলেন। তার মধ্যে কয়েকটি অপেক্ষমাণ, কয়েকটি আকাশে ওড়ার জন্যে গতি নিচ্ছে, কয়েকটি আকাশ থেকে অবতরণ করছে।
অর্জুন অমরাবতীতে প্রবেশ করলে, অন্যান্য গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ তাঁর স্তব করতে লাগল। দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও মহর্ষিরা আনন্দিত চিত্তে তাঁর পূজা করলেন ও আশীর্বাদ করলেন। তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে কুসুমের সৌরভবাহী পবিত্র বায়ু বইতে লাগল। দিব্যবাদ্য, শঙ্খ ও দুন্দুভি বেজে উঠল। এইভাবে অর্জুন চতুর্দিক থেকে স্তূত হয়ে, ইন্দ্রের আদেশে অতি বিস্তীর্ণ নক্ষত্রপথে যাত্রা করলেন।
 
সেখানে সাধ্য, বিশ্ব, মরুৎ, অশ্বিনীকুমার, আদিত্য, বসুগণ, রুদ্র, ব্রহ্মর্ষি, দিলীপ-প্রমুখ রাজর্ষিগণ, তুম্বুরু, নারদ ও হাহা, হূহূ প্রভৃতি গন্ধর্বদের সঙ্গে একত্রে দেবরাজ ইন্দ্রর সামনে উপস্থিত হলেন।
এরপর রথ থেকে নিচে নেমে দেখলেন, বিশ্বাবসু প্রমুখ গন্ধর্বগণ এবং ঋক-সাম-যজুঃ বেদজ্ঞানী শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্রের স্তব করছেন। পাণ্ডুপুত্র অর্জুন বিনীতভাবে সুররাজ ইন্দ্রের সামনে উপস্থিত হয়ে নতমস্তকে প্রণাম করলেন, দেবরাজও স্নেহ পরবশ হয়ে পুত্র অর্জুনকে আলিঙ্গন ও মস্তকের ঘ্রাণ নিয়ে, তাঁর হাত ধরে, নিজের পবিত্র আসনে উপবেশন করালেন। 
 
স্বয়ং দেবরাজের আসনে উপবিষ্ট মহাবলী অর্জুনকে তখন দ্বিতীয় ইন্দ্রের মতোই শোভন মনে হচ্ছিল। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বজ্রকঠিন কিণাঙ্কিত[5] হাত দিয়ে অর্জুনের মুখ তুলে ধরে, পরম স্নেহে আদর করতে লাগলেন। চতুর্দশী তিথিতে একই সঙ্গে সূর্য ও চন্দ্রের উদয় হলে, আকাশের যেমন অবর্ণনীয় শোভা হয়, তেমনি পিতাপুত্র একাসনে বসে সভামণ্ডলকে উদ্ভাসিত করে তুললেন। সেই সভায় সামগানকুশল তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বরা মধুরস্বরে গান গাইতে লাগল। ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা, পূর্বচিত্তি, স্বয়ম্প্রভা, উর্বশী, মিশ্রকেশী, দণ্ডগৌরী, বরূথিনী, গোপালী, কুম্ভযোনি, প্রজাগরা, চিত্রসেনা, চিত্রলেখা, সহা প্রমুখা কমললোচনা কলকণ্ঠী নর্তকীরা সিদ্ধপুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য করতে লাগলেন। তাঁদের সুললিত নিতম্বাভিনয়, কম্পমান পয়োধর ও মনোহর হাব-ভাব-বিলাস এবং কটাক্ষ বিক্ষেপে উপস্থিত সকলের চিত্ত চঞ্চল ও মোহিত হল।


অর্জুনের গান্ধর্ব নৃত্য-গীত শিক্ষা
 দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে, দেবতারা উৎকৃষ্ট অর্ঘ্য দিয়ে অর্জুনের অর্চনা করলেন এবং পাদ্য ও আচমনীয় দিয়ে পুরন্দর ভবনে প্রবেশ করালেন। বীরবর অর্জুন এইরূপে সসম্মানে নানান মহাস্ত্র সমূহের প্রয়োগ ও নিবারণ শিক্ষা করে পিতৃগৃহে বাস করতে লাগলেন। তিনি পিতা ইন্দ্রের নিকট বজ্র ও অশনি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রসমূহ লাভ করে, পরম আনন্দে অরণ্যবাসী রাজা যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য ভাইদের অসহ্য কষ্টের কথা স্মরণ করলেন, তারপর পিতার আদেশে ইন্দ্রলোকেই পাঁচ বছর কাটিয়ে ফেললেন।
 
অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে জেনে একদিন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে বললেন, “হে কৌন্তেয়, তুমি গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে সকল নৃত্য, গীত ও নরলোকে প্রসিদ্ধ সকল বাদ্য শিক্ষা করো, তোমার এই শিক্ষা অবশ্যই মঙ্গলকর হবে”। এই কথা বলে দেবরাজ চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুনের মিত্রতা স্থাপন করে দিলেন। এরপর নবীন মিত্র গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের সঙ্গেই অর্জুনের সময় কাটতে লাগল। সুররাজ ইন্দ্র অর্জুনকে বার বার নৃত্য, গীত ও বাদ্য শিক্ষার জন্য আদেশ করতেন, কিন্তু অর্জুন কিছুতেই শান্তভাবে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন না। কারণ অক্ষক্রীড়ার ফলে সৃষ্ট, তাঁর ভ্রাতাদের ও দ্রৌপদীর দুঃসহ দুঃখের কথা তাঁর সর্বদাই মনে পড়ত। তিনি সর্বদাই শকুনি, দুর্যোধন ও দুঃশাসনের হত্যা চিন্তায় ক্রোধে জ্বলতে থাকতেন, কখনো কখনো পিতার আদেশে অনুপম গান্ধর্ব নৃত্য ও বাদ্য শিক্ষা করতেন। এই অত্যন্ত প্রতিকূল মানসিক পরিস্থিতিতেও মহাবীর অর্জুন ক্রমশঃ গান্ধর্ব নৃত্য-গীতে সুশিক্ষিত হয়ে উঠলেন।
 
[এই নৃত্য শিক্ষা বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতবাসের সময় অর্জুনের ভীষণ কাজে লেগেছিল। বিরাট রাজকুমারীদের নৃত্যশিক্ষক হিসাবে তাঁর নিয়োগের ব্যবস্থা যেন তাঁর পিতা ইন্দ্রই সুনির্দিষ্ট করে দিলেন।]        

উর্বশী ও অর্জুন
 
নৃত্যগীতের শিক্ষা চলা কালীন, দেবরাজ ইন্দ্রের মনে হল, অর্জুনের মন উর্বশীতে আসক্ত হয়েছে। তিনি একদিন চিত্রসেনকে গোপনে ডেকে বললেন, “হে গন্ধর্বরাজ, আজ তুমি অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা উর্বশীর কাছে যাও, তাকে বলবে সে যেন অর্জুনের মনের ইচ্ছা পূরণ করে, বলবে এ আমারই নির্দেশ। সে যেমন আমার নির্দেশে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, এখন গান্ধর্ব নৃত্য-গীতাদি শিক্ষা করছে, তেমনি লাস্যময়ী রমণীদের হাব-ভাব ও কামকলা শিক্ষাতেও নিপুণ হয়ে উঠুক”। 
 
চিত্রসেন দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশ পেয়েই উর্বশীর কাছে গিয়ে কুশল ও মঙ্গলবাক্যাদির পর বললেন, “হে নিবিড়নিতম্বিনি, ত্রিদশাধিপতি যে কারণে তোমার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন, বোধহয় তুমি বুঝে থাকবে। যিনি নৈসর্গিক গুণাবলী দিয়ে দেবলোক ও মনুষ্যলোকে প্রভূত যশ লাভ করেছেন, যিনি অনুপম রূপবান, অবিচলিত ব্রতানুষ্ঠানকারী, অসাধারণ ইন্দ্রিয়সংযম, অলোকসামান্য বলবীর্যসম্পন্ন ও ক্ষমাগুণে সর্বত্র সুখ্যাত। যিনি বেদ, বেদাঙ্গ ও উপনিষদ অধ্যয়ন করে কৃতবিদ্যা হয়েছেন, যিনি অকৃত্রিম ভক্তি সহকারে গুরুজনের সেবা করে থাকেন, সেই মহাবীর অর্জুন যেন আজ স্বর্গ-ফললাভে বঞ্চিত না হন। হে কল্যাণি, আজ তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশ, অর্জুন যেন তোমার প্রণয়লাভ করে, পরিতুষ্ট হয়। অর্জুন তোমার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হয়েছেন”।
 
সর্বলোকের অলংকার স্বরূপ উর্বশী, গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে সহাস্যে বললেন, “হে মহারাজ, আপনি অর্জুনের যে সকল গুণের কথা বললেন, সে সকলই সত্য। আমিও লোকমুখে অর্জুনের নানান গুণের কথা শুনে কামশরে অত্যন্ত জর্জরিত আছি। অতএব আমি আর তাঁকে নতুন করে বরণ আর কি করব, আমি তো অনেক আগেই তাঁকে বরণ করে নিয়েছি। এখন সুরপতির আদেশ এবং আপনার অনুরোধে ফাল্গুনীর সাক্ষাতের জন্য আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি। আপনি এখন ফিরে যান, আমি অর্জুনের কাছে অবশ্যই যাবো”।

গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে বিদায় দিয়ে, পার্থ-মিলন লালসায় অভিভূত হয়ে উর্বশী তখনই স্নান করলেন। তারপর গন্ধ, মাল্য ও রমণীয় বেশভূষায় নিজেকে সুসজ্জিতা করে তুললেন। তখনো প্রদোষকালের কিছুটা বিলম্ব ছিল, সে কারণে নিজের দিব্য আস্তরণ সংবৃত শয্যায় শুয়ে অর্জুনের প্রতিমা কল্পনা করে, মন্মথশরে একান্ত অভিভূত হয়ে উঠতে লাগলেন।
 
গভীর প্রদোষকাল উপস্থিত হলে, পৃথুনিতম্বিনী নিজের গৃহ থেকে বের হয়ে পার্থর নিবাসের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সেই লাবণ্যবতী ললনার সুকোমল, কুঞ্চিত, কুসুমগুচ্ছ শোভিত কেশদাম। তাঁর সুন্দর আনন দর্শনে পূর্ণশশীও লজ্জিত হল। তাঁর সর্বাঙ্গ চন্দনচর্চিত ও সুরভিত, তাঁর পীনোন্নত পয়োধরযুগল চলার ছন্দে বিকম্পিত হচ্ছিল, তাঁর ত্রিবলীদাম কটিদেশের কী অবর্ণনীয় শোভা! তাঁর রজত অলংকারে ভূষিত নিতম্বে যেন মন্মথের আবাস।  সূক্ষ্ম বসনে আবৃত তাঁর অনিন্দনীয় জঘন দর্শনে ঋষিদেরও চিত্তবিকার উপস্থিত হয়। একে তো সেই অনুপমা রমণী কামনায় উন্মত্তা, তার ওপর পরিমিত সুরাপানে প্রফুল্লচিত্তা, অর্জুনভবনের অভিসারিকা সেই বিলাসিনী সুরলোকেও পরমদর্শনীয়া হয়ে উঠেছিলেন।

অর্জুন নিকেতনের দ্বারে উর্বশী কিছুক্ষণের মধ্যেই উপনীত হলেন। দ্বারপাল অন্দরে অধিষ্ঠিত পার্থকে গিয়ে উর্বশীর আগমন সংবাদ দিল। অর্জুন দ্বারপালকে উর্বশীর গৃহপ্রবেশের অনুমতি দিয়ে, স্বয়ং প্রত্যুদ্গমন[6] করলেন। পার্থ উর্বশীকে দেখেই লজ্জাবনত মুখে তাঁকে অভিবাদন করলেন এবং গুরুর মতো সম্মানসহ বললেন, “হে অপ্সরাশ্রেষ্ঠে, আমার প্রণাম নেবেন, কীসের জন্যে আমার গৃহে আপনার এই শুভাগমন, ভৃত্যকে আদেশ করুন”।
উর্বশী অর্জুনের কথায় অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে, গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের সকল কথা আদ্যন্ত বর্ণনা করে বললেন, “হে মনুষ্যশ্রেষ্ঠ, আপনার সুরলোকে আসার দিন, রাজসভায় যখন সকল অপ্সরাদের নৃত্য এবং গন্ধর্বগণের গীতবাদ্য অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তখন আপনি অন্য অপ্সরাদের ছেড়ে, আমার দিকেই অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে ছিলেন। আপনার পিতা দেবরাজ ইন্দ্রও সেই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই আমি আপনার সেবা ও শুশ্রূষা করার জন্য আজ এখানে এসেছি। আপনার গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে, আমি কামদেব অনঙ্গের বশবর্তিনী হয়েছি। আপনি আমার পতি হবেন, এ আমার বহুদিনের অভিলাষ”!
 
উর্বশীর এই কথায় অর্জুন অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে, হাত দিয়ে দুই কান আবৃত রেখে বললেন, “হে ভাবিনি, আপনি যে বিষয়ের জন্য আমাকে অনুরোধ করছেন, সেই বিষয় আমার কাছে অশ্রাব্য। আপনি আমার গুরুপত্নীতুল্য। যেমন মহাভাগা কুন্তী ও ইন্দ্রাণী আমার পূজনীয়, আপনিও আমার কাছে তেমনই। হে শুভে, আপনি পৌরববংশে[7]র জননী, সেই কারণে সভা মধ্যে আমি আপনার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে ছিলাম। তার মধ্যে কোন অসৎ অভিসন্ধি বিবেচনা করা আপনার উচিৎ নয়। হে কল্যাণী, আপনার থেকে পৌরব বংশের উদ্ভব, অতএব আপনি আমার পরম গুরু”।
অর্জুনের এই কথায় উর্বশী বললেন, “হে দেবরাজনন্দন, আমরা সামান্যা নারী। আমাকে আপনার গুরু সম্বোধন করা অনুচিত। পুরুবংশের পুত্র, পৌত্রেরা তপোবলে স্বর্গলাভ করে, আমাদের সঙ্গে যথেচ্ছ ক্রীড়াকৌতুক করেন, তাঁদের কাছে কখনো এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করিনি। আমাকে আপনার প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। আমি মদনবাণে আহত হয়ে, আপনার একান্ত অনুরক্ত হয়েছি, এখন আমার ভজনা করে আপনি আমার মন ও প্রাণ রক্ষা করুন”।  
অর্জুন বললেন, “হে বরারোহে[8], আমি প্রতিজ্ঞা করেই বলছি, আপনি শুনুন এবং দিগ্‌বিদিক ও লোকপালগণও শুনুন। কুন্তী, মাদ্রী ও শচীর মতোই আপনিও আমার পরমগুরু। হে অনঘে[9], আমি নতশিরে আপনার চরণে প্রণিপাত করছি, আপনি যেমন আমার মাতৃবৎ পূজনীয়া, তেমন আমি আপনার পুত্রবৎ রক্ষণীয়, অতএব আপনি এখন নিজ গৃহে ফিরে যান”।
 
উর্বশী ধনঞ্জয়ের কথায় ক্রোধে ভ্রুকুটিকুটিল আননে অভিশাপ দিলেন, “হে পার্থ, আমি অনঙ্গবাণে পীড়িতা হয়ে, আপনার পিতার আদেশে, অভিসারিকা হয়ে আপনার গৃহে নিজেই এসেছি, তবুও আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন, অতএব আপনাকেও কোনদিন সম্মানহীন ক্লীব নামে বিখ্যাত হয়ে, স্ত্রীগণের মধ্যে নপুংসকের মতো সময় কাটাতে হবে”। এই কথা বলে, ক্রোধে স্ফূরিত অধরে, দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে, উর্বশী নিজে গৃহে ফিরে গেলেন।
 
অর্জুন তখনই গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে গিয়ে উর্বশীর সঙ্গে তাঁর সকল আলাপের আদ্যন্ত বর্ণনা দিলেন এবং তিনি যে অভিশপ্ত হয়েছেন, সে কথাও বললেন।  চিত্রসেন আবার এই বৃত্তান্ত দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে সবিস্তার বিবরণ করলেন।
 
সুররাজ ইন্দ্র নির্জন স্থানে পুত্র অর্জুনকে ডেকে নিয়ে বললেন, “হে পুত্র, তোমাকে গর্ভে ধারণ করে, আজ পৃথা সৎপুত্রবতী হলেন। তুমি ধৈর্যগুণে ঋষিদেরও পরাজিত করেছো। তুমি চিন্তা করো না, উর্বশীর দেওয়া অভিশাপ তোমার পক্ষে মঙ্গলকর ও অর্থপূর্ণ হবে, সন্দেহ নেই। হে অনঘ, বারোবছর পরে, তোমরা যখন একবছর অজ্ঞাতবাসে থাকবে, তখন তুমি ক্লীববেশে নর্তকশিক্ষক হয়ে অনায়াসে একবছর অতিক্রান্ত করবে এবং বর্ষ পূরণ হলেই তুমি আবার পুরুষত্ব ফিরে পাবে!” অর্জুন দেবরাজের কথায় নিশ্চিন্ত হলেন এবং মন থেকে অভিশাপ চিন্তা দূর করে মিত্র চিত্রসেনের সঙ্গে স্বর্গে কালযাপন করতে লাগলেন।
[স্বর্গে নিয়ে গিয়ে পুত্র অর্জুনকে দৈব-অস্ত্র সকল অর্পণ করে সাহায্য করলেন তো বটেই, তার ওপর অজ্ঞাতবাসের সময় পুত্র অর্জুনের ছদ্মবেশ ধারণের বিষয়টিও পিতা ইন্দ্র নির্দিষ্ট করে দিলেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের এই অকুণ্ঠ সহায়তা কুচক্রী কৌরবদের মৃত্যু নিশ্চিত করে তুলল, বলাই যায়।]   

ইন্দ্রসভায় লোমশ ঋষি
 
একবার মহর্ষি লোমশ ভ্রমণ করতে করতে ইন্দ্রকে দর্শনের ইচ্ছায় স্বর্গে উপস্থিত হলেন। মহামুনি সেখানে গিয়ে দেবরাজকে নমস্কার করে দেখলেন, পাণ্ডুপুত্র ধনঞ্জয় বাসবের আসনের একপাশে উপবিষ্ট রয়েছেন। তিনি কিছু বললেন না, কিন্তু মনে মনে আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করলেন, ‘একজন ক্ষত্রিয় কী ভাবে ইন্দ্রের আসন লাভ করতে পারে? এমন কোন পুণ্যকর্ম বা এমন কোন লোক সে জয় করেছে যে, তার জন্যে সে এই দেবপূজিত স্থান লাভ করল’?
দেবরাজ ইন্দ্র মহর্ষির মনের ভাব বুঝতে পেরে, মহর্ষিকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে, সহাস্য মুখে বললেন, “হে ব্রহ্মর্ষে, আপনি যা জানতে চাইছেন, সে কথা বলছি শুনুন। এই কৌন্তেয় শুধুমাত্র মানব নয়, এর মধ্যে দেবত্বও আছে; অর্জুন কুন্তীর গর্ভজাত আমারই পুত্র। এখানে কোন কারণে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এসেছে। আর তাছাড়াও কী আশ্চর্য, আপনি এই পুরাতন ঋষিকে চিনতে পারলেন না? হৃষীকেশ ও ধনঞ্জয় এই দুই পুরাতন ঋষি ত্রিলোকে নর-নারায়ণ নামে বিখ্যাত, এঁরা বিশেষ কাজের জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন! সিদ্ধচারণ সেবিত গঙ্গা যে স্থান থেকে প্রবাহিত হয়েছেন, সেই বিখ্যাত বদ্রী নামক আশ্রমপাদে বিষ্ণু ও এই জিষ্ণুর নিবাস। নিবাতকবচ নামে কতকগুলি মহাপরাক্রান্ত পাতালপুরবাসী দানবেরা, বরলাভে মোহান্ধ হয়ে, আমাদের বিদ্বেষ করছে এবং প্রাণসংহারের চেষ্টা করছে! দেবতারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে সমর্থ নন। অতএব যিনি কপিল নামে অবতীর্ণ হয়ে রসাতল খননে প্রবৃত্ত সগরসন্তানদের দর্শনমাত্র দগ্ধ করেছিলেন, সেই মধুসূদন মহাযুদ্ধে অর্জুনের সঙ্গে মিলিতভাবে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন, সন্দেহ নেই। মধুসূদনের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতেই নিবাতকবচ ও তার অনুচরেরা বিনষ্ট হতে পারে, কিন্তু এই সামান্য কাজের জন্য তাঁকে ব্যস্ত করে তোলার প্রয়োজন দেখি না। আমার পুত্র ধনঞ্জয়ই তাদের অনায়াসে নিহত করে আবার মর্ত্যলোকে ফিরে যাবে।
এখন আপনি আমার একটি অনুরোধ রক্ষা করুন, রাজা যুধিষ্ঠির কাম্যকবনে অবস্থান করছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলবেন যে, তিনি যেন অর্জুনের জন্য উৎকণ্ঠিত না হন। অর্জুন অস্ত্র-সংগ্রহ করে খুব শীঘ্রই মর্তে ফিরে যাবেন, কেননা বাহুবলের সংশোধন ও উপযুক্ত অস্ত্রসংগ্রহ ছাড়া ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ বীরকে সংগ্রামে পরাজিত করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। মহাবাহু ধনঞ্জয় বিবিধ অস্ত্র পেয়ে গেছেন এবং দিব্য নৃত্য, গীত ও বাদ্যে কুশলী হয়েছেন। তিনি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে পবিত্র তীর্থ দর্শন ও সেখানে অবগাহন করে বিগতপাপ ও গতসন্তাপ হয়ে সুখে রাজ্যভোগ করবেন”।
দেবরাজ ইন্দ্রের কথা শেষ হলে, পবিত্রাত্মা অর্জুনও মহর্ষি লোমশকে অনুরোধ করে বললেন, “হে মহামুনে, আপনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবেন ও তাঁদের তীর্থপর্যটন ও ধর্মকর্ম যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সে বিষয়েও যত্নবান হবেন”।
 
মহাতপাঃ লোমশ তাঁদের কথা স্বীকার করে, পৃথিবীতে নেমে এলেন, তারপর কাম্যক বনে গিয়ে ভ্রাতৃগণ সহ বনবাসী ধর্মরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।

[এইভাবেই মহর্ষি বেদব্যাসের প্রদত্ত রহস্যময় প্রতিস্মৃতি বিদ্যার প্রয়োগে অর্জুন দেবলোক পর্যন্ত নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি স্থাপনা করলেন, সেই সঙ্গে তাঁর সঙ্কল্প মতো দিব্য অস্ত্রসমূহও লাভ করলেন। উপরন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে, তাঁদের জ্ঞাতিযুদ্ধের সপক্ষে দেবতাদের প্রসন্ন সমর্থন ও প্রশ্রয়ের বার্তাও বহন করে আনলেন! যে নৈতিক সমর্থনের জন্য রাজা যুধিষ্ঠির উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেই উদ্বেগের অবসান হল। যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই কৌরবদের নিশ্চিত পরাজয় যেন নির্দিষ্ট হয়ে উঠল!]
 
..০০..               


[1] নিরন্তর কাজ করেও যিনি অক্লান্ত থাকেন।

[2] অশ্ব।

[3] দেবতাদের অধিপতি, দেবরাজ ইন্দ্র

[4] পর্বতের উপরিস্থ সমতল

[5] জ্যার আঘাতে বাহুতে কড়ার দাগ। 

[6] এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা করা

[7] রাজা পুরূরুবা ও উর্বশীর সন্তানদের থেকেই পুরু এবং কুরু বংশের উদ্ভব।

[8] যে নারীর নিতম্ব সুন্দর – বরারোহা, সম্বোধনে বরারোহে।

[9] অনঘ – নিষ্পাপ। স্ত্রীলিঙ্গ - অনঘা, সম্বোধনে – অনঘে

অদ্বিতীয়া

 [দিল্লির "কলমের সাত রঙ" পত্রিকার বৈশাখী সংখ্যায় প্রকাশিত] 

 

চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চের উল্টোদিক থেকে রোজকার মতোই “চেপে পড়ো” অ্যাপের নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠল মঞ্জরী। গাড়িতে উঠতেই গুরপ্রীত কওর মিষ্টি হেসে তাকাল, বলল, “গুড মর্নিং, মঞ্জু”। মঞ্জরীও উত্তরে বলল, “ভেরি গুড মর্নিং”। মঞ্জরী গাড়ির দরজা বন্ধ করে বেল্ট লাগাতেই, সামনে পাছা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অটোটাকে পাশ কাটিয়ে গুরপ্রীত গাড়ি চালিয়ে দিল। মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “কীরে, আজ কি মুড অফ নাকি, মুখটা গোমড়া করে রয়েছিশ যে?”

মঞ্জরী হেসে উত্তর দিল “কোথায় মুখ গোমড়া? কিছুই হয়নি”!

গুরপ্রীত থাকে নিউ আলিপুরের বি ব্লকে, আর তার অফিস নিউ টাউনে। এতটা দূরত্ব বাসে-টাসে গুঁতোগুঁতি করে রোজ অফিসে যাওয়া এবং ফেরা তার পোষাচ্ছিল না। তাই বাবার গাড়িটা সে নিজেই ড্রাইভ করে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু এতটা পথ মুখ বুজে প্রত্যেকদিন গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করাও তো বেশ বিড়ম্বনার ব্যাপার। তাই সে “চেপে পড়” অ্যাপে রেজিস্টার করে তিনজন সহযাত্রিনী যোগাড় করে ফেলেছে। চারজনে গল্প করতে করতে জার্নি-টাইমটা দিব্যি কেটে যায় – আবার তেলের খরচা আর গাড়ি সার্ভিসিংয়ের পয়সাও উঠে আসে। মঞ্জরী ওঠে চেতলায়, সহেলি ওঠে গড়িয়াহাট থেকে, আর সিক্তা ওঠে কসবা মোড় থেকে। গুরপ্রীতের মাতা বঙ্গবালা এবং পিতা শিখ সর্দারজি। ইংরিজি, গুরুমুখী, পাঞ্জাবি, হিন্দী ও বাংলা অনর্গল বলতে পারে। বাংলায় তো অসম্ভব দখল, শুধু একটাই দোষ গুরপ্রীতের – ওর উচ্চারণে স নেই শবই শ।

রাসবিহারী মোড়ের সিগন্যালটা খেয়ে গাড়ি থামাল, তারপর মঞ্জরীর কথার উত্তরে গুরপ্রীত বলল, “কিছুই হয়নি বললে হবে? পতিদেবের সঙ্গে কিংবা শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে কিছু একটা খিটিমিটি তো নিশ্চিত হয়েছে”।

মঞ্জরী বলল, “না রে বাবা, সে সব কিছু না। বাই দা ওয়ে আমি কিন্তু ফেরার সময় তোর সঙ্গে ফিরব না। অফিস থেকেই সোজা মানিকতলা মায়ের কাছে যাব”।

সিগন্যাল খুলে যাওয়াতে, গুরপ্রীত গাড়ি স্টার্ট করে ফার্স্ট গিয়ার ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করল, “এনি থিং রং? বাবা-মার শরীর খারাপ হয়নি তো?”

“না, না। ওঁদের শরীর ঠিক আছে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি – তাই ভাবলাম কটা দিন থেকে আসি মায়ের কাছে...”।

“একদম খালি হাতে? কোন ব্যাগ-ট্যাগ নিসনি?”

“টুকটাক কিছু আমার এই ব্যাগেই নিয়ে নিয়েছি...আর কাপড়চোপড় মায়ের কাছে রাখাই থাকে...ও নিয়ে কোন চাপ নেই”।

“ওক্কে। যাই বলিস, তুই কিন্তু আসল ব্যাপারটা চেপে গেলি। আমাকে বললি না”।

মঞ্জরী কিছুক্ষণ চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল, তারপর লেকমলের হাল্কা সিগন্যালটা পার করে বলল, “সকালে ছোট্ট একটা ব্যাপারে মা এমন রিয়্যাক্ট করলেন, জাস্ট ভাবা যায় না”।

“কোন মা, শাশুড়ি মা? তুই যে বলিস তোর শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভাল – তোকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন?”

“সেটাই। মেয়ের মতো – আর নিজের মেয়ের মধ্যে কিছুটা ফারাক হয়তো থেকেই যায়। ব্যাপারটা এতই সামান্য, এখনও চিন্তা করলে অবাক লাগছে”। মঞ্জরী একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, “অফিসের জন্যে রেডি হয়ে পথিক আর আমি টেবিলে খেতে বসেছিলাম, মা খাবার সার্ভ করছিলেন। হঠাৎই আমার হাতে লেগে কাচের গেলাসটা টেবিল থেকে পড়ল - ভেঙে চুরমার – মেঝেয় জল থৈ থৈ। তাড়াহুড়োর সময় মেঝেয় ভাঙা কাচ, ছড়িয়ে পড়া জল ... খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার”।

দেশপ্রিয় মোড়ের সিগন্যালটাও খেয়ে গেল গুরপ্রীত, বলল “ধ্যাত্তেরিকা...দুটো সেকেণ্ডের জন্যে... যাগ্‌গে, তারপর?”

“ভাঙা কাচ আর জলটা মুছে নেওয়ার জন্যে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব...মা রীতিমতো ঝংকার তুলে বললেন, থাক থাক বৌমা, আমি দেখছি... খাওয়া ছেড়ে উঠে তোমাকে আর কাজ দেখাতে হবে না...তারপর প্লেটে ভাত আর তরকারি দিতে দিতে বললেন, কদিনের জন্যে তুমি বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস বৌমা। বুঝতে পারছি তুমি খুব প্রেসারে আছ। আজই সন্ধেবেলা অফিস থেকে চলে যাও – কদিন ওখানে থেকে মাথাটা ঠাণ্ডা করে এস”।

“তোকে নাম ধরে ডাকেন আর “তুই” বলেন – বলেছিলি না?”

“হ্যাঁ তাই বলেন, কিন্তু কোন কারণে বিরক্ত হলে বৌমা আর “তুমি” বলেন”।

সিগন্যাল খুলতে গুরপ্রীতের গাড়ি আবার গড়াতে লাগল, গাড়ি থার্ড গিয়ারে তুলে বলল, “হুম। বুঝলাম, তারপর? তুই কিছু বললি না?”

“নারে, ব্যাপারটা এতটাই আচমকা ঘটে গেল, আমি মাথা নিচু করে ভাত নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে, উঠে পড়লাম। ওই সময় আমি যদি কিছু বলতাম, ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে উঠত...”।

“তা ঠিক, পথিকও কিছু বলল না?”

“নাঃ, কিচ্ছু না। আমার দিকে খুব সহানুভূতি মাখা দুঃখীদুঃখী মুখে তাকাচ্ছিল বারবার”। গুরপ্রীতের হাসি পেলেও হাসল না, গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। লেক ভিউ রোডের সিগন্যালটা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে – ট্রাঙ্গুলার পার্কের সিগন্যালে আবার আটকে গেল।

মঞ্জরী আবার বলল, “আমরা বাড়ি থেকে বেরোনর সময়ে মা আবার বললেন, অন্যভাবে নিস না, মা। কদিন ও বাড়ি থেকে ঘুরেই আয়। আজ শুক্রবার, মঙ্গলবার ফিরে আসিস - আর ওই দিন অফিসে ছুটি নিয়ে নিস, কিন্তু। যা বললাম, তার যেন নড়চড় না হয়, আমার কথার অবাধ্য হবি না”।

গুরপ্রীত মঞ্জরীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখল, তারপর সিগন্যাল খুলতে গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “ বেরোনর সময় আবার “তুই” বললেন? আশ্চর্য তো?”

“হ্যাঁ”।

“দেখ মঞ্জু, গড়িয়াহাটে সহেলি ওঠার আগেই আমি এই প্রসঙ্গটা ক্লোজ করতে চাই। ওদের সামনে এসব আলোচনা না করাই ভাল। তবে আমার কেমন খটকা লাগছে, মঞ্জু, উনি তোর ওপর মোটেও বিরক্ত হননি। অন্য কিছু ব্যাপার আছে”।

“কে জানে? জানি না। রাস্তায় বেরিয়ে পথিক বলল, মায়ের কথায় ও খুব বিরক্ত হয়েছে... এ কটা দিন ও আমার সঙ্গেই থাকবে”।

গুরপ্রীত হেসে বলল, “ওয়াও। আমি শিয়র এসবের পেছনে দারুণ একটা প্ল্যান আছে – তোর জন্যে সারপ্রাইজ”।

“তোর তাই মনে হচ্ছে?” মঞ্জরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল গুরপ্রীতের দিকে।

“গড়িয়াহাট এসে পড়েছি, এখন এসব কথা থাক। তবে যা বুঝলাম, কাল, সোম আর মঙ্গল তোর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। দেখা হবে সেই বুধবার...। সহেলি গাড়ির দিকে এগিয়ে এল, গুরপ্রীত এবং মঞ্জরী একই সঙ্গে বলে উঠল, “হাই সহেলি, গুড মর্নিং”।

 

সন্ধে সাড়েসাতটা নাগাদ মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে মানিকতলায় তার বাপের বাড়ি পৌঁছল। ওদের দুজনকে একত্রে দেখে মঞ্জরীর মা প্রীতমা একটু আশ্চর্য হয়েই বললেন, “ওমা, কোন খবর না দিয়ে দুটিতে এসে উপস্থিত হলি? আয়, আয় ভেতরে আয়, খবর-টবর সব ভালো তো?”

মঞ্জরী বসার ঘরের সোফায় বসে বলল, “তোমার কাছে থাকতে এলাম। কাজের চাপে আমার হাতপা নাকি বশে নেই। তাই ওবাড়ির মা এখানে পাঠালেন কটা দিন রিল্যাক্স করে যেতে।”

প্রীতমাদেবী আরও অবাক হলেন, “সে আবার কি? নিশ্চয়ই কিছু ঘটিয়েছিস – বাবা পথিক, কী ব্যাপার বলো তো? তোমার মা অকারণে এরকম বলার মানুষ তো নন?”

পথিক মঞ্জরীর পাশেই বসেছিল, বলল “আজ সকালে খাবার টেবিলে মঞ্জুর কনুই লেগে একটা কাচের গ্লাস ভেঙে গেছে... সেই সময়েই...”।

প্রীতমাদেবী কী বলবেন ভেবে পেলেন না, মেয়ে জামাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “যাগ্‌গে, মঞ্জরী পথিককে নিয়ে তোর ঘরে যা, অফিসের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে আয়, তারপর সব কথা শুনব। এখন তোদের জলখাবারের যোগাড় দেখি। এদিকে তোর বাবা একবার বেরোলে আর ফেরার নাম করে না। জামাই এসেছে... আর তিনি এখন বন্ধুদের সঙ্গে...যা ওঠ - ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে”।

মঞ্জরী আর পথিক উঠে ভেতরে গেল, প্রীতমাদেবী ফোন তুলে কর্তাকে ধরলেন, “শুনছো, মঞ্জু আর জামাই এসেছে, আড্ডা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি এস – কথা আছে। আর ফেরার সময় কিছু মিষ্টি-টিষ্টি – চিকেন-টিকেন নিয়ে এস”। ফোন বন্ধ করে তিনি রান্নাঘরে গেলেন।

গিন্নির ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন অতনুবাবু। ঘরে ঢুকতেই তাঁর নাকে এল লুচিভাজার গন্ধ। ইদানীং তাঁর লিপিড প্রোফাইল আর বিপি সামান্য বিশ্বাসঘাতকতা করায় – ও জিনিষ তাঁর গালের নাগালে আর আসে না। বাইরের ঘরে জুতো ছেড়েই তিনি সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন, গিন্নি বেজায় ব্যস্ত। প্রতিমা লুচি বেলছে আর প্রীতমা গরম তেলে লুচি ছাড়ছেন। পাশে একটা থালায় বড়ো বড়ো বেগুনের টুকরো নুন আর হলুদ মেখে হাসছে। অতনুবাবু অন্ততঃ চারটে লুচি উইথ দুপিস বেগুনভাজার আশায় বুক বেঁধে খুব নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মঞ্জুরা এমন হঠাৎ করে চলে এল, তোমায় আগে ফোন করেনি?”

প্রীতমা গরম তেল থেকে লুচি তুলতে তুলতে বললেন, “হাত চালা প্রতিমা, এর পরে আবার বেগুন ভাজতে হবে। একবার ফোন করলে এত হুটোপাটি করতে হত? সব যোগাড় করে রেখে দিতাম”। শেষ কথাগুলি তিনি অতনুবাবুকে বললেন।

“হুঁ। কী ব্যাপার কিছু বুঝলে? মঞ্জু তো এমন করে না!”

“ঠিক বুঝলাম না। জামাই বলল, আজ সকালে খেতে বসে মঞ্জুর হাত লেগে নাকি একটা কাচের গ্লাস ভেঙেছে। তাতেই বিরক্ত হয়ে বেয়ান মঞ্জুকে খুব বকাবকি করেছেন, আর বলেছেন, কটা দিন বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এস, বৌমা”।

অতনুবাবু মিষ্টির বাক্সদুটো ফ্রিজের মাথায় রেখে, প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে চিকেনটা বের করে একটা বড় বাটিতে ঢালতে ঢালতে বললেন, “তেলের শিশির জায়গায়, জলের গেলাস?”

প্রীতমাদেবী বললেন, “সে আবার কি?”

“কেন শোননি? তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ওপর রাগ করো? অন্নদাবাবু সেখানে ভারত ভাঙার কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখানে যে পরিবার ভাঙার উপক্রম?”

“যাঃ ও আবার কী অলক্ষুণে কথা বলছ? বেয়ান আমাদের তেমন লোকই নন। আমাদের মঞ্জুই কিছু একটা বড়ো গণ্ডগোল বাধিয়েছে”।

“উঁহু, তাহলে পথিককে সঙ্গে নিয়ে এসে পড়ল কেন? ব্যাপারটা অত সহজ আর সিম্পল নয় মনে হচ্ছে”!

“কি জানি বাপু, আমার এখন অত ভাববার সময় নেই। আগে দুজনকে খেতে দিই। ওদের ফ্রেশ হতে বললাম, তুমি দেখ তো ওদের হল কি না?”

অতনুবাবু বাইরে এসে, মঞ্জুদের ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় একটু বেশ জোরে কাশলেন, তারপর দরজায় টোকা মেরে বললেন, “পথিক, মঞ্জু তোমাদের হল বাবা? খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তোমাদের মা তাড়া দিচ্ছেন যে”।

খুট শব্দে দরজার ছিটকিনি খুলে প্রথমে পথিক, পিছনে মঞ্জু বের হল। পথিক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, দেখাদেখি মঞ্জুও।

অতনুবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “আরে ধ্যাৎ কী যে করিস তোরা, খেতে বসার আগে কেউ পায়ের ধুলো নেয়? আবার তো হাত ধুতে হবে”।

পথিক হেসে উত্তর দিল, “ওই তো বেসিন, হাতটা ধুয়ে নিলেই হল”।

অতনুবাবু ডাইনিং টেবিলে বসলেন, বললেন, “আয় আয় বসে পড়, তোর মা এখনই সব নিয়ে আসছে”। বেসিনে হাত ধুয়ে পথিক এবং মঞ্জু টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। অতনু দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মঞ্জুটার মুখ কিছুটা গম্ভীর, তবে পথিকের স্বাভাবিক। এর মধ্যেই প্রীতমা দু হাতে দুটি প্লেটে চারটে করে লুচি আর দুটো করে বেগুনভাজা এনে পথিক আর মঞ্জুর সামনে রাখলেন। বললেন, “গরম গরম খেয়ে নাও বাবা, সেই কোন সকালে দুটো ভাত মুখে গুঁজে অফিসে বেরোও... খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। অফিসে কী খাও কে জানে?”

মঞ্জু একটু মনখারাপি সুরে বলল, “মা, লুচি চারটে না, দুটো তুলে দিচ্ছি, আর একটা বেগুনভাজা”।

প্রীতমাদেবী অতনুবাবুর জন্যেও একটা প্লেটে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা নিয়ে এসেছিলেন, কর্তাকে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন কী হয়েছে? খিদে হয়নি না মন খারাপ? খেয়ে নে, রাত্তিরে বরং রুটি কম খাস”।

মঞ্জু ঘ্যানঘেনে সুরে বলল, “না মা, প্লিজ। একদম ভাল্লাগছে না। আমি বাবার প্লেটে তুলে দিচ্ছি”।

পথিক মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এত টেনশান কর না, মঞ্জু। বারবার তো তোমাকে বলছি কিচ্ছু হয়নি। মা তোমার ওপর মোটেই রাগ করেননি। যেটুকু করেছেন, আমি বলছি মিলিয়ে নিও, মঙ্গলবার তিনিই সব কিছু ভুলিয়ে দেবেন”।

মঞ্জু কান্নাধরা গলায় বলল, “আমাকে বাচ্চা মেয়ে পেয়েছ? যা বোঝাবে তাই বুঝে যাব?”

মঞ্জুর চোখের জল দেখে বিচলিত হলেন প্রীতমাদেবী এবং অতনুবাবুও। একমাত্র কন্যা। এই বছর খানেক আগে ভালো ঘর-বর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। পথিকের মতো জামাই লাখে একটা মেলে। কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার পথিকের বাবা-মা। এমন সজ্জন ভালোমানুষ আজকাল বড়ো দেখা যায় না। তাঁরা যতবারই গিয়েছেন, তাঁদের কন্যা মঞ্জুকে ও বাড়িতে বিরাজ করতে দেখেছেন। ও বাড়ি থেকে ফিরে তাঁরা কত্তা-গিন্নিতে মাঝে মাঝে অভিমানও করেছেন, দেখলে, মেয়েটা আমাদের যেন ভুলেই গিয়েছে! মনে হচ্ছে শ্বশুর-শাশুড়িই ওর বাপ-মা, আর আমরা কেউ নই! ওরে মুখপুড়ি তোকে যে দশমাস পেটে ধরেছি, তোর বাপ আর আমি যে তোকে বুকে করে আগলে আগলে এতটি বড় করে তুললাম, সে সব কথা ভুলে গেলি? আবার মনকে সান্ত্বনাও দিয়েছেন, সারাজীবন মেয়েকে আপন করে রাখার জন্যে তো মেয়েদের জন্ম হয় না। তিনিও কি বাবা-মায়ের কম আদরের দুলালি ছিলেন? স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং মঞ্জুকে নিয়ে তিনিও কি তাঁর বাপ-মাকে ভুলে যাননি?

মঞ্জু মুখ নামিয়ে কোনরকমে দুটো লুচি আর বেগুনভাজা খেয়ে উঠে গেল। প্রীতমাদেবী বললেন, “কী রে উঠে পড়লি কেন? বাবা তোদের জন্যে হাতে করে সন্দেশ নিয়ে এল, দুটো মুখে দিবি না?” বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে এসে মঞ্জু বলল, “ভাল্লাগছে না, রাত্রে খাবো”, তারপর নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল।

পথিক দেখল কিছু বলল না। খুব মন দিয়ে ছটা লুচি, বেগুনভাজা আর দুটো কড়াপাক সন্দেশ তৃপ্তি করে খেয়ে উঠল। বেসিনে মুখ হাত ধুয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার মায়ের ব্যবহারে মঞ্জু একটু মুষড়ে পড়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন মঞ্জুকে নিয়ে মায়ের একটা মজার প্ল্যান আছে। আর তার জন্যেই এত সব নাটক”।

প্রীতমাদেবী স্বামীর মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটাকে বহুদিন এমন মনমরা থাকতে দেখিনি, তোমার মায়ের কী প্ল্যান, বাবা?”

অতনুবাবু পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা মঞ্জুকে গোপন করে, ওকে চমকে দেওয়ার জন্যে কিছু একটা মজার প্ল্যান ভেঁজেছ, তাই না? তা তোমরা ফিরছ কবে?”

পথিক ম্লান হাসল, বলল, “মঙ্গলবার। মায়ের সেরকমই আদেশ”।

প্রীতমাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার মায়ের প্ল্যানটা কী, বললে না তো?”

পথিক প্রীতমাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আগামী কাল আমার মা-বাবা আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আমরা দুজন অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর, সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ। দুপুরে এখানেই খাবেন। এর থেকে বেশি কিছু বলতে আমার মানা আছে। যা বলার মা-বাবাই বলবেন”।

প্রীতমাদেবী অবাক হয়ে পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঙ্কোচের হাল্কা হাসিমাখা মুখে পথিক বলল, “আগামীকাল আমার বাবা-মা আসার ব্যাপারটাও মঞ্জুকে এখনই বলবেন না, প্লিজ”।

 

 

 

আধুনিক সভ্যতায় কত ট্রেন কত এরোপ্লেন নিত্য দেরি করে চলে। কিন্তু মঞ্জরীর মাথায় গুচ্ছের দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধার বোঝা চাপিয়ে, মঙ্গলবার সকালটা ক্যালেণ্ডারের পাতার মতো একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এসে পড়ল। গত রাত্রে তার ভাল ঘুম হয়নি। নানান চিন্তায় তার বারবার ঘুম টুটেছেআচ্ছা, সে কি আজ থেকে পঞ্চাশ-একশ বছর আগেকার যুগে ফিরে যাচ্ছে? শাশুড়ি যেমন খুশি নাচাবে সেও মাদারির হাতে বাঁধা বাঁদরীর মতো নেচে চলবে? কাচের একটা গেলাস কনুইয়ের ধাক্কায় পড়ে ভেঙে যাওয়াতে – শাশুড়ি তাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন বাপের বাড়ি থেকে কয়েকটা দিন ঘুরে আয়। আর মঞ্জরীও সুবোধ বালিকার মতো চলে এল? শাশুড়ি বলেছিলেন, মঙ্গলবার অফিসে ছুটি নিয়ে সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি আসবি। এর যেন কোন অন্যথা না হয়। আর সেও আজ এই সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে স্নান-টান সেরে সাজুগুজু করতে বসেছে, নেচে নেচে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্যে?

সে শুনেছে শনিবার তারা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওশাশুড়িমাতা ও শ্বশুরপিতা এ বাড়িতে এসেছিলেন। তার মায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প-গাছা করে গেছেন। সানন্দে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরেছেন। এবং তার জন্যে রানি কালারের জমিতে ছোট্ট ছোট্ট হলুদের বুটি দেওয়া উজ্জ্বল সুন্দর টাঙ্গাইল তাঁতের একটি শাড়ি দিয়ে গেছেন। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ এবং শায়া। তিনি নাকি বারবার বলে গেছেন মঞ্জু যেন মঙ্গলবার এই শাড়ি পরেই ও বাড়িতে যায়। আজকে সে সাজতে বসেছে এবং সেই শাড়িটিই বিছানায় রেখেছে সেজে উঠে পরবে বলে!

কেন? কিসের জন্যে? সে যথেষ্ট লেখাপড়া করেছে। নিজের যোগ্যতায় সে চাকরি যোগাড় করেছে। তার বয়স অনুপাতে তার পদমর্যাদা এবং বার্ষিক ক্ষতিপূরণ অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। সে তো পতি-নির্ভর লবঙ্গলতাসম গৃহবধূ নয়। সে তার ইচ্ছেমত জীবন যাপন করতেই পারে – তার মধ্যে নাক গলানোর অধিকার শ্বশুর-শাশুড়ির কতটা আছে? এমন কি তেমন তেমন হলে তার বাবা-মায়েরও নেই। তাহলে সে কেন যাচ্ছে আজ? মঞ্জরী কাল রাত্রে শোবার পর ভেবেছিল – অফিসেই যাবে, শ্বশুরবাড়ি যাবে না। ছুটি নেওয়া সত্ত্বেও অফিসে গেলে সহকর্মীরা অবাক হবে? হোক না। যে অনুষ্ঠানের জন্যে সে ছুটি নিয়েছিল, সে বলবে, সেই অনুষ্ঠান ভেস্তে গিয়েছে? আর শ্বশুরবাড়ি না গেলে, শাশুড়ি রাগ করবে? কতটা? তার স্বামী পথিক সেও কি ক্ষুণ্ণ হবে? কতটা? ও বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে যাবে? ডিভোর্স? সধবা মঞ্জরী থেকে, ডিভোর্সি মঞ্জরী? তাদের কোন ছেলেপুলে হয়নি, অতএব তার বাবা-মা কি আবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন, “ডিভোর্সী - নাম-মাত্র বিবাহ – কর্পোরেট অফিসে চাকরিরতা সুন্দরী গৃহকর্মনিপুণা শাণ্ডিল্য গোত্রীয় যুবতীর জন্য পাত্র চাই”? এই দুই বাড়ির সম্পর্কগুলো কি ওই কাচের গেলাসের মতোই ঠুনকো? তার কনুইয়ের হাল্কা ঠোকাতেই ভূমিসাৎ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়বে মেঝেয়? ভাঙা সম্পর্কের টুকরোতে ক্ষতবিক্ষত হবে তাদের সকলের জীবন?   

নাঃ। এতটা দূরদর্শী দুশ্চিন্তার স্বপক্ষে সবল যুক্তি বা প্রমাণ মঞ্জরী নিজের মনের অন্দরে খুঁজে পাচ্ছে না। যাকে বলা যায় “ঠোস সাবুদ”। তার মনের মধ্যে এখনও জাঁকিয়ে বসে রয়েছে, তার প্রতি শ্বশুর এবং শাশুড়ির নিঃস্বার্থ অপত্য স্নেহ – তার ওপরে ওঁদের অকুণ্ঠ নির্ভরতা ও বিশ্বাসও। মাত্র একদিনের আচরণ থেকে এতটা বিষম পরিণতির চিন্তা করার সময় এখনও আসেনি। আজ ও বাড়ি গিয়ে তাকে ঘিরে কী ঘটনা ঘটে, দেখাই যাক না? তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে!

অতএব সাড়ে সাতটা নাগাদ মঞ্জরী আর পথিক রেডি হয়ে তাদের ঘর থেকে বের হল। মায়ের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ওদের দেখে প্রীতমাদেবী বেরিয়ে এলেন। মঞ্জরী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এত সকালে কোথায় বেরোচ্ছ, মা?”

“আমরাও যাবো তো, ও বাড়িতে। তোর বাবাও রেডি, গাড়ি বের করতে গিয়েছে। তোরা রেডি?”

“তোমরাও ও বাড়িতে যাবে?” মঞ্জরীর বিশ্বাসই হচ্ছে না, “কিন্তু কেন?”

প্রীতমাদেবী থমথমে মুখে বললেন, “বেরোনর সময় সে সব কথা এখন থাক। তিক্ততা বাড়বে...”।

মঞ্জরী বলল, “কিসের তিক্ততা?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছিস তো? তোরা এগো, আমি দরজা বন্ধ করে সদরে তালা দেব”।

হতভম্ব মঞ্জরী পথিকের সঙ্গে বাইরে এল। পথিকের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার বলো তো?” পথিক মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “নো আইডিয়া”!

অতনুবাবু গাড়ি বের করে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। প্রীতমাদেবী গাড়ির কাছে এসে বললেন “তোরা দুজনে পিছনে বস, আমি সামনে বসছি”। মঞ্জরীর বিয়ের পর থেকে একসঙ্গে কোথাও গাড়ি নিয়ে বেরোলে, অতনুবাবুর পাশের সিটটা জামাই পথিকের জন্যেই বরাদ্দ থাকত। মা আর মঞ্জরী বসত পিছনের সিটে, কথা বলতে বা গল্প করতে সুবিধে হত বেশ। আজ তার ব্যত্যয় কেন? মঞ্জরীর মনে খটকা।

গলি থেকে বেরিয়ে গাড়ি বড়ো রাস্তায় পড়তেই, মঞ্জরী জিজ্ঞাসা করল, “তখন তুমি কিসের তিক্ততা বাড়বে বলছিলে, মা?”

“ওফ্‌, একটা কথা তোর মাথায় ঢুকলে, সেটাতেই তুই আটকে থাকিস, মঞ্জু! ওসব আলোচনা এখন থাক না”।

মঞ্জরীর গলায় জেদ, “না, বলতেই হবে। বলা নেই কওয়া নেই - তোমরা হঠাৎ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে কেন”?

অতনু সামলানোর চেষ্টায় বললেন, “কেন আবার কি? গাড়িটা অনেকদিন বের করিনি, তোরা এতটা পথ যাবি – গাড়িটা ঠিকঠাক থাকবে, আমারও হাতপাগুলোর একটু প্র্যাক্টিস হবে...এই সব ভেবেই...”।

“একদম বাজে অজুহাত দিও না, বাবা। তোমাদের আজই ও বাড়িতে যাওয়ার কী এমন দরকার পড়ে গেল, সেটাই জানতে চাইছি”।

সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরোনর এই এক মজা, রাস্তা-ঘাট বেশ খালিই থাকে। পরপর দুটো-তিনটে মোড়ের সিগন্যাল ক্লিয়ার পাওয়া যায়। অতনুবাবু মিনিট পনেরর মধ্যেই বেকবাগান মোড় পার হয়ে শরৎ বোস রোডে ঢুকে পড়লেন।

“মা, তুমি বলবে না?”

“আচ্ছা, কী এত জিদ করিস বলতো, ছেলেমানুষের মতো? পথিকের বাবা-মা শনিবার আমাদের বাড়িতে এসে নেমন্তন্ন করে গেছেন, আজ যাওয়ার জন্যে। যাচ্ছি। কেন আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি কী মানুষ যায় না?”

“একশবার যায়, কিন্তু সেখানে তিক্ততা আসছে কোত্থেকে? আর তুমি আগে বলনি কেন? আমাদের সঙ্গে তোমরাও যাবে?”

“তিক্ততা নয়? এই যে তুই সেই শুক্কুরবার থেকে আজ পর্যন্ত মুখটা তোলো-হাঁড়ির মতো করে ঘরে ঘুরে বেড়ালি, সেটা তিক্ততা নয়? তার ওপর আগেই যদি বলতাম, আমরাও তোদের সঙ্গে যাবো, তুই কী ভাববি, কী মনে করবি – সেই ভয়েই তোকে বলিনি”।

অতনুবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “তিক্তম্‌ আশুফলপ্রদম্‌”, রেয়ার ভিউ দিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে মুচকি হাসলেন।

বিরক্তমুখে মঞ্জু বাবার দিকেই তাকিয়ে বলল, “তার মানে?”

অতনুবাবু হাসলেন, বললেন, “এগুলো আগেকার দিনের কবিরাজদের প্রবচন – ওষুধ যত তেঁতো হবে, তার ফল হবে তত তাড়াতাড়ি। আমি কবিরাজ নই, তবে এটুকু বলতে পারি – এই কদিনের তিক্ততার শেষে, একটু পরেই দারুণ মজাদার কিছু ঘটবে। ওই তো রাসবিহারি মোড় এসে গেছে। আহা সিগন্যালটাও খোলা আছে, সাঁ সাঁ করে পৌঁছে যাব, চেতলা অহীন্দ্র মঞ্চ। এখনকার মতো এই সব কথার নটেগাছগুলোকে মুড়িয়ে ফ্যাল”।        

 

 

গাড়ির আওয়াজ পেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শুক্তিদেবী আর অনীশবাবু। অনীশবাবুর মুখে হাসি, কিন্তু শুক্তিদেবীর মুখেচোখে কেমন যেন উদ্বেগ। মঞ্জুকে কাছে টেনে নিয়ে হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন, সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে, বিছানায় বসালেন। তারপর মঞ্জুর মুখটা তুলে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। মঞ্জু অবাক হয়ে দেখল, শুক্তিদেবী কাঁদছেন, তাঁর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা। মঞ্জু দুহাতে জড়িয়ে ধরল শাশুড়িকে।

শুক্তিদেবী কান্নাধরা গলায় বললেন, “আমার ওপরে যাচ্ছেতাই রাগ করেছিস না? শুনেছি এ কদিন তুই ভালো করে খাসনি, হাসিস নি। মুখ গোমড়া করে ছিলি সারাক্ষণ। শুনে আমার বুকের ভেতরটা যে কেমন করছিল, সে কথা তোকে বোঝাতে পারব না, পাগলি। আমারও মুখে রুচি নেই, রাতে ঘুম নেই, সিরিয়ালে মজা পাইনি। ভাবছিলাম আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ির মতো আমি এত কষ্ট দিতে পারলাম তো?”

মঞ্জুও আবেগ সামলাতে পারল না, তার দুই চোখ ঝামড়ে জল চলে এল, কানে কানে বলল, “কেন এমন করলে বলো তো, মা?”

শুক্তিদেবী উত্তর দিলেন না। নিজের চোখ মুছলেন, পরম মমতায় মঞ্জুরও চোখের জল মুছে দিলেন। তার কপালে একটি চুম্বন এঁকে দিয়ে গভীর স্বরে বললেন, “বলছি, এখন ও ঘরে চল”।    

বসার ঘরে সবাই রুদ্ধশ্বাস বসেছিল, শুক্তিদেবী আর মঞ্জু ঢুকতেই সবাই গভীর শ্বাস নিল। মঞ্জুর শ্বশুর অনীশবাবু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাক, কিছুটা বৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন মেঘলাভাবটা কেটে এবার রবিকিরণ দেখা যাবে, কী বলেন, অতনুবাবু?”

অতনুবাবু বললেন, “ঠিক বলেছেন, চারদিনের টানা দুর্যোগ মনে হচ্ছে আজ কেটে গেল”।

বসার ঘরের অন্যদিকে ডিভান সরিয়ে, মেঝেয় কার্পেটের বড় একটা আসন পাতা ছিল। সুন্দর রঙিন আলপনা আঁকা সেই আসনটি ঘিরে। শুক্তিদেবী মঞ্জুকে বুকের কাছে ধরে নিয়ে আসনের সামনে দাঁড়ালেন, বললেন, “এই আসনটিতে লক্ষ্মীসোনার মতো চুপটি করে বস। পূবমুখো। আমি এখনই আসছি”।

মঞ্জু অবাক হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল, কিছু বলল না, তার চোখের কোলে এখনও জল টলটল করছে। শুক্তিদেবী স্নেহস্বরে মৃদু ধমক দিলেন, “হাঁ করে মুখ দেখছিস কি? কথা কানে গেল না? আসনে বস, আমি এখনই আসছি।”

মঞ্জু আসনে পা দিয়ে দাঁড়াল, সসঙ্কোচে ধীরে ধীরে বসল, সলজ্জ মুখে সোফায় বসা সকলের মুখের দিকে তাকাল। সকলের মুখেই এখন হাসি, বাবা, মা, পথিক, অনীশবাবু। সকলেই সোফা ছেড়ে মেঝেয় এসে বসলেন, মঞ্জুকে ঘিরে। প্রীতমাদেবী মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

অনতিবিলম্বেই শুক্তিদেবী ঘরে এলেন, তাঁর হাতে সাজানো বরণডালা। পিছনে সুষমাদি পেতলের বড় থালায় এনেছে, প্রদীপ, ধূপদানি আর শাঁখ, একপাশে ধান, দুর্বা। শুক্তিদেবী মেঝেয় বসলেন, বরণডালা রাখলেন মঞ্জুর সামনে। সুষমাদির হাত থেকে পেতলের থালাটি নিয়ে, মেঝেয় এক পাশে রাখলেন। দেশলাই জ্বেলে প্রদীপ জ্বাললেন, প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা থেকে ধরিয়ে নিলেন দুটি ধূপ। সুগন্ধে ভরে উঠতে লাগল বসার ঘরের প্রতিটি কোণ। এবার শুক্তিদেবী হাঁটুগেড়ে বসলেন, দুহাতে সাজানো বরণডালা নিয়ে, বললেন, “সুষমা, শাঁখ বাজা, প্রীতমা উলু দাও। তারপর নিজেও উলু দিতে দিতে বরণ করলেন মঞ্জুকে। আশ্চর্য ভালো লাগায় মঞ্জুর দুই চোখ আবার জলে ভরে উঠল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুক্তিদেবীর মুখের দিকে। শুক্তিদেবী মঞ্জুর চিবুক স্পর্শ করে চুমো খেলেন।

বরণডালাটি সুষমার হাতে তুলে দিয়ে, মঞ্জুর মাথায় ধান আর দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “আশীর্বাদ করলাম, অ্যাই মেয়ে, আমাকে প্রণাম করার কথাটা বলে দিতে হবে নাকি? এবার সকলেই তোকে আশীর্বাদ করবেন, চুপটি করে বসে থাক। আমি আসছি।” শুক্তিদেবী উঠলেন, সুষমাদির সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন।

সকলের আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতেই, শুক্তিদেবী বড় প্লেটে সাজিয়ে আনলেন চারটে লুচি আর বেগুনভাজা। মঞ্জুর সামনে রেখে বললেন, “শুরু কর, আরো আনছি”।

“আমি কি একা একা খাবো নাকি? সবাইকে দাও। তুমিও নাও”।

“কেউ পালাচ্ছে না, সবাই খাবে – আজকে তুই আগে...আজ তোর দিন, আমাদের মধ্যে আজ তুই অদ্বিতীয়া রানি”।

সকলের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মঞ্জু লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু শাশুড়ি ছাড়বেন না, তাই লুচি ছিঁড়ে বেগুনভাজার টুকরো সহ মুখে পুরে বলল, “আজকে কী বলো তো? আমাকে এত আদর করছ? আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে”।

মমতামাখা স্বরে শুক্তিদেবী বললেন, “আজ আমাদের বধূদ্বিতীয়া”।

মঞ্জু থমকে গেল, “সে আবার কি? এমন তো কোনদিন শুনিনি”।

অনীশবাবু বাবু হা হা করে হাসলেন, বললেন, “আমাদের মানে জামাইদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চিরকাল অনেক আদিখ্যেতা হয় – বলা হয় জামাই ষষ্ঠী! কিন্তু কই, বাপ-মায়ের ঘর ছেড়ে আসা মেয়েটিকে কোন বিশেষ দিনে কোন যত্নআত্তি আমরা কোনদিন করি না তো? এটি তোমার শাশুড়িমায়ের আবিষ্কার, বৌমা, বধূদ্বিতীয়া”।

শুক্তিদেবী মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। কর্তার কথা শেষ হতে সুষমাদিকে ডাকলেন, “কইরে, সুষমা দুটো লুচি আরো নিয়ে আয়। সঙ্গে মিষ্টির প্লেটটাও নিয়ে আসিস”।

মঞ্জু আঁতকে উঠল যেন, “তুমি জান মা, আমি চারটের বেশি লুচি কোনদিন খাই না”।

শুক্তিদেবী রীতিমতো ভিলেনি কায়দায় বললেন, “কিন্তু আজ তো আপনাকে ছটা লুচি খেতেই হবে মঞ্জরীদেবী। শুক্রবার চারটে লুচি আপনি খাননি, দুটো লুচি খেয়েই মাকে বলেছিলেন, ভাল্লাগছে না। সে আমার ওপরে রাগ করেই না?”

মঞ্জু এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, বলল, “তোমরা সবাই মিলে আমার সঙ্গে চিটিং করলে না? পথিক তো বটেই, এমন কি আমার বাবা-মাকেও দলে টেনে নিয়েছিলে?”

শুক্তিদেবীও হাসলেন, বললেন, “পথিকের বাবাকে প্রথম যখন এসব কথা বলেছিলাম, ও তো এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু আমি বললাম, মঞ্জুকে এ বাড়ি থেকে কদিনের জন্যে তাড়াই কী করে?”

মঞ্জু আঁতকে উঠে বলল, “তার মানে?”

শুক্তিদেবী বললেন, “আহা, ব্যাপারটা পুরো শোন না। জামাইরা সকলেই জামাইষষ্ঠীর দিন সেজেগুজে বউকে বগলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়। তুই তো শ্বশুরবাড়িতেই আছিস। তুই বাড়ির মধ্যেই থাকবি, আর আমি বরণডালা সাজিয়ে উলু দিয়ে তোকে বরণ করব... নাঃ আমার মোটেই মনঃপূত হল না। সেটা বড্ডো ন্যাকা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিল”।

মঞ্জু চার নম্বর লুচি শেষ করে পঞ্চমে হাত দিয়ে বলল, “আমাকে বললেই পারতে, আমি কদিন না হয় বাপের বাড়ি থেকে এমনিই ঘুরে আসতাম”।

শুক্তিদেবী মুখ ভেংচে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই আমার সেই মেয়েই বটে। তোকে সব কথা বললে, তুই আমাকেই উপদেশ আর জ্ঞান দিয়ে আমার পুরো স্বপ্নটাই ভেস্তে দিতিস। বলতিস, ওসব বধূদ্বিতীয়া- টিতিয়া কোন কাজের কথা নয়, ওসব বোরিং আর বোকাবোকা ব্যাপার-স্যাপার তোর একদমই পছন্দ নয়। তোকে আমি চিনি না, হুঁঃ”।

মঞ্জু খিলখিল করে হাসল, বলল, “সে কথা মন্দ বলনি। কিন্তু কাচের গেলাস ভাঙা?”

শুক্তিদেবী বিখ্যাত গোয়েন্দাদের মতো মুচকি হেসে বললেন, “ওটাই তো আমার ফাঁদ – যে ফাঁদে তুই কনুই ঠেকালি। অন্যাদিন আগেই দিই, সেদিন খাবার বাড়ার পরে জলের গ্লাসটা দিয়েছিলাম। তোরা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করার পর। জলভরা গেলাসটা রাখলাম, টেবিলের একদম কোণায় তোর হাতের একদম কাছাকাছি। ব্যস, তুই ঠেলা মেরে গেলাসটা ভাঙলি, আর আমিও তোকে তাড়াবার জন্যে কড়া করে দুটো কথা শুনিয়ে দিলাম”।

মঞ্জু হাসল, বলল, “বাব্বাঃ, তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি? বোঝা যায় না তো?”

অনীশবাবু বললেন, “তোকে তো তাড়াল বৌমা, তুই যাওয়ার পর সে কি কান্না তোর শাশুড়ি মায়ের। বললে, মেয়েটাকে খেতে দিয়ে অমন মুখ ঝামটা দিলাম? ছিছি ছিছি। তার পরের দিন তোদের বাড়ি গিয়ে সব কথা খুলে বলে কতকটা স্বস্তি হল। তাও এ কটা দিন তোর চিন্তায় যা করল শুক্তি, সে কথা...”।

শুক্তিদেবী এবার মুখ ঝামটা দিয়ে স্বামীকে বললেন, “থাক, থাক। আমার কথা নিয়ে তোমার এত ঢাক পেটানোর কী দরকার বুঝি না বাপু। সুষমা, মঞ্জুর হয়ে গেছে, এবার আমাদের খাবারগুলোও নিয়ে আয়। কদিন পরে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া যাক”।

-০০-   

নতুন পোস্টগুলি

জঙ্গী ব্যবসা

  ১   ভারতে কবে কবে কোথায় কোথায় সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছিল তার একটা লিস্ট নিয়ে নিজের দপ্তরে বসে সুলতান মামুদ রাগে ফুঁসছিল। আর মনে মনে ঘোরির ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ