বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

মায়া

 প্রায় মাস তিনেক হল, আমার বোন ছুটির একটি মেয়ে হয়েছে জেনেও, ওদের বাড়ি যেতে পারিনি। খুবই খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। তার কয়েকদিন আগেই মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ আর দৌড়োদৌড়িতেই ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। তারপর যা হল, সে তো আরও ভয়ংকর। মা চলেই গেলেন। সে সময়টা যে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি, ভাবলে এখনও মন খারাপ হয়ে যায়। সব কাজকর্ম, শ্রাদ্ধশান্তি একা হাতেই সামলাতে হল। ওই সময় ছুটি আর আমার ভগ্নীপতি, বিভাস পাশে থাকলে, একটু মনের জোর পেতাম। কিন্তু ছুটির সে সময় আসার উপায় ছিল না। বিভাস একদিন এসেছিল কিন্তু থাকতে পারেনি। সকালে এসে রাত্রের ট্রেনেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। ছুটির এই সময়ে, তাকে ছেড়ে বিভাস থাকবেই বা কী করে?

মায়ের অসুস্থতা আর ওই শ্রাদ্ধশান্তির কাজে বেশ কিছুদিন অফিস কামাই হয়েছিল। কাজেই হুট করে আবার ছুটি নিয়ে ছুটির কাছে যাওয়াটা সম্ভব হচ্ছিল না। উপরন্তু পাড়ার বয়স্ক কজন উপদেশ দিলেন, মা হচ্ছেন মহাগুরু। মায়ের মৃত্যু মানে মহাগুরু নিপাত। এই সময় একটু সাবধানে চলাফেরা করা উচিৎ। তাছাড়া এই অবস্থায় সদ্যজাতা শিশুর কাছেও যাওয়াটা নাকি উচিৎ নয়। মন থেকে বিশ্বাস না করলেও, একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। সে সময়ের মানসিক দুর্বলতার জন্যেই বোধ হয়, মনে হয়েছিল, আমার বোনের বা তার মেয়ের কোন অমঙ্গল যদি সত্যিসত্যিই ঘটে যায়!

আসলে মা যেদিন মারা গেলেন, তার দশদিন পরেই ছুটির মেয়ে হল। বোনের শাশুড়িমা নাতনীর নাম রেখেছেন, টিপ। টিপের জন্মের সময়ে কিছু জটিলতা হওয়ায়, ছুটিও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন অনেকটাই সেরে উঠেছে, কিন্তু তাও ট্রেন জার্নির এতটা ধকল নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মচলন্দনগর থেকে জলপাইগুড়ির মোহিতপুর, আসা যাওয়ার ধকলটাও তো নেহাত কম নয়। তাছাড়া আমার  মা-হারা এই একার সংসারে শিশু মেয়েকে সে সামলাবেই বা কী করে? বিভাসের মা খুবই মমতাময়ী মহিলা, তিনি ছুটিকে নিজের মেয়ের মতোই যত্নআত্তি করেন।

যাই হোক ছুটি আর বিভাসের বারবার ডাকাডাকিতে, আমি শেষ অব্দি ওদের বাড়ি যেতে রাজি হলাম। দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে রওনা হলাম জলপাইগুড়ি। পাশের বাড়ির কাকিমাকে চাবি দিতে গিয়েছিলাম, আমি ছুটি নিয়ে ছুটির বাড়ি যাচ্ছি শুনে খুব খুশি হলেন না, বললেন, একটা বছর কাটিয়ে গেলে পারতিস। বললাম, ঘুরেই আসি একবার। ছুটি বড্ডো কান্নাকাটি করছে, বারবার বলছে, দাদা একবারটি আয়।  

 

মোহিতপুর বাসস্ট্যাণ্ডে বিভাস আমার জন্যে সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাস থেকে নেমে, আমার ব্যাগটা হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বিভাসের পিছনের উঠে বসলাম। বিভাস জিগ্যেস করল, “সাইকেলে যেতে পারবি, নাকি রিকশা করবো”? বিভাস আর আমি কলকাতায় একই কলেজে পড়তাম। খুবই ভালো বন্ধু, তারপর তো ছুটির সঙ্গে ওর বিয়ে হল। আমি একটু হেসে বললাম, “তোর ঘাড়ে চেপে যাওয়ার মজাই আলাদা, সাইকেল ছেড়ে রিকশায় চড়তে যাবো কোন দুঃখে?” কথা না বাড়িয়ে বিভাস সাইকেল চালু করল, আমি জিগ্যেস করলাম, “কাল রাত্রে বলছিলি, টিপের গাটা একটু গরম গরম লাগছে, জ্বর-টর আসেনি তো?”

“নাঃ জ্বর-টর নয়। কিন্তু মেয়েটা কাল প্রায় সারারাতই ঘুমোয়নি। বারবার আমার নয়তো ছুটির ফোনটা হাতে নিয়ে কী যে বলতে চাইছিল বুঝলাম না। একটু হয়তো শুল, আমরাও শুলাম। আধঘন্টা না যেতেই উঠে পড়ে, আমাকে নয় ওর মাকে থাবড়া দিয়ে জাগিয়ে ফোন দেখায়”।

“ফোনে কোন গেম-টেম বা সিনেমা দেখে ভালো লেগেছে হয়তো, বারবার দেখতে চাইছে। আজকাল বাচ্চাদের ফোনের ওপর খুব ঝোঁক”।

“না রে, আমরাও তাই ভেবেছিলাম। খাবার সময় ওকে ভোলানোর জন্যে কয়েকটা গানের ভিডিও দেখান হয়, সেগুলো দেখিয়ে শান্ত করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেইনি, বরং বিরক্ত হচ্ছিল খুব...অন্য কিছু করতে বলছিল, সেটা কী, বুঝতে বুঝতেই রাত কাবার হয়ে গেল।”

“বাব্বা, একরত্তি মেয়ের এত কৌতূহল?” কিছুক্ষণ আমরা কেউ কথা বললাম না। বিভাস সাইকেল চালাতে লাগল। কেন জানি না আমার মনে হল, বিভাস সাইকেলটা খুব আস্তে চালাচ্ছে, এখনই একদৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে খুব আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বিভাস বড়ো রাস্তা থেকে বাঁদিকের ছোট ঢালু রাস্তায় নামতে নামতে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, তোর আসার অপেক্ষাতেই ও এত ছটফট করছে!”

 “যাঃ। আমাকে তো দেখেইনি। চেনেই না। তাছাড়া তিনমাসের একটা শিশু, মামা কী বস্তু, খায় না মাথায় মাখে বুঝতে পারে নাকি?”

“তা ঠিক। কিন্তু যেদিন থেকে আমাদের এখানে তুই আসছিস, এ কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেদিন থেকেই ও যেন খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে”।

“তাই?”

“হুঁ। কাল মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে, মেয়েটা গতকাল ফোনে হয়তো তোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছিল। কদ্দূর এলি, ট্রেন লেট কী না, ট্রেনে খাওয়াদাওয়া কী করলি...এসব জানার কৌতূহল হচ্ছিল হয়তো!”

“কী বলছিস? এমন হতে পারে নাকি?”

“জানি না, মনে হল, তাই বললাম। হতেও তো পারে”!

আমারও টিপ বলে ছোট্ট একরত্তি ওই মেয়েটাকে দেখার জন্যে মনটা ভীষণ উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে।

 

কিছুটা দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলাম। বিভাসের মা, ছুটি আর ছুটির কোলে ছোট্ট টিপ। গ্রিল-গেটের বাইরেই ওঁরা দাঁড়িয়েছিলেন। বিভাস সাইকেল নিয়ে সামনে দাঁড়াতেই, বিভাসের মা বললেন, “ওফ্‌, মেয়ে বটে; অচেনা অদেখা মামাকে দেখার জন্যে কী ছটফটই না করছে! ঘরে থাকতে দিচ্ছে না”।

ছুটি মিষ্টি হেসে বলল, “আয়। ভাল আছিস, দাদা”?

আমি সাইকেল থেকে নেমে মাসিমা, বিভাসের মাকে প্রণাম করলাম। ছুটির কোল থেকে টিপ হাত বাড়াল আমার কাছে আসবে বলে। ওকে কোলে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, কিন্তু ভয়ও পাচ্ছিলাম। সারারাতের ট্রেন জার্নি, তারপরে ভোরবেলার বাসে এতটা এলাম! সারা গায়ে – জামাকাপড়ে ধুলোময়লার তো অন্ত নেই। এই অবস্থায় শিশুকে কোলে নেওয়া মোটেই উচিৎ নয়।

আমি টিপকে বললাম, “একটু দাঁড়াও মা, জামাকাপড় ছেড়ে, মুখহাত ধুয়ে তোমায় কোলে নেব। বিচ্ছিরি ধুলো আর নোংরা সারা গায়ে”।

বিভাসের মা বললেন, “ঠিক বলেছ বাবা, আমি বলি কি, গরম জলে চানটাও সেরে নাও, স্বস্তি পাবে। এতটা পথ জার্নি করে এলে। চলো চলো, ঘরে চলো”

আমরা সবাই বাড়িতে ঢুকলাম, বিভাস সাইকেলে আমার ব্যাগটা নিয়ে পেছনে আসতে লাগল।

 

স্নান সেরে এসে পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরেই আমি ডাক দিলাম, “কই রে, আমার টিপ সোনা কই?” ছুটি টিপকে কোলে নিয়ে সামনে এলো, বলল, “ওফ্‌, মেয়ে সেই থেকে বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে...কখন তুই বেরোবি। এ রাম, চুল আঁচড়ালি না?” চুল আঁচড়ানোর কথা আমার মনেই ছিল না, আসলে আমিও টিপকে কোলে নিতে চাইছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

চুলের ওপর হাত বুলিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। কে আর দেখবে এখানে, তোরাই তো। এচো, এচো, ছোনা মাটা...” বলে হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে আমি টিপকে কোলে নিলাম। টিপও উদ্গ্রীব ছিল, টুক করে কোলে এসে, আমার গলা জড়িয়ে ধরল। ছুটি হেসে বলল, “বাবাঃ, মায়ের চেয়েও মামা বেশি আদরের...টিপকে নিয়ে তুই বোস, দাদা, আমি তোর জলখাবার আনছি। মা, লুচি আর বেগুন ভাজছেন”।

আমি টিপকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, “তাই যা। আমি ততক্ষণ টিপের সঙ্গে একটু ভাব করি”।

টিপকে কোলে নিয়ে আমি বাইরের বারান্দায় এলাম। এতক্ষণ টিপ আমার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ রেখেছিল, এবার সে গলা ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। তার দু চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অদ্ভূত এক অনুভূতি হল। হাল্কা নীলচে সাদা টলটলে চোখের মধ্যে ঘন কালো চোখের তারা, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কী দেখছে? কী খুঁজছে আমার মুখে?

“এত দিন লাগল তোর এখানে আসতে? ছুটি পাসনি, না? এমন আর কক্‌খনো করিস না...”।

কে বলল কথাটা? আশেপাশে ঘাড় ঘোরালাম। কেউ কোত্থাও নেই। সামনের ঘাসে আর গাছের ডালে কিছু চড়ুই, শালিক, ঘুঘু আর কাক ওড়াওড়ি করছে। আমার ঘাড় থেকে শিরশিরে একটা অনুভূতি পিঠের দিকে নামতে লাগল। এই কণ্ঠস্বর আমার খুবই পরিচিত। ভীষণ পরিচিত। হাজার লোকের কণ্ঠস্বরের মধ্যেও এই স্বর আমি ঠিক চিনে ফেলতে পারি! আমি টিপের মুখের দিকে আবার তাকালাম। আগের মতোই সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পবিত্র পাতলা রাঙা দুই ঠোঁটে এখন মুচকি হাসি।

“এমন কক্‌খনো করিস না আর, তোকে দেখতে যে, বড্ডো ইচ্ছে করে, বাবা। ছুটি-ছাটা পেলেই চলে আসবি, কেমন?”

আমি তাকিয়ে রইলাম শিশুর চোখের দিকে। টিপ কথাগুলো বলেনি। তাঁর দুই ঠোঁট এতটুকুও নড়েনি। কিন্তু আমার চেতনায় কথাগুলো বেজে উঠল। কীভাবে জানি না। এখন টিপ তার দুই হাত বাড়িয়ে মোচার ছোট্টছোট্ট কলির মতো আঙুলগুলি রাখল আমার গালে, কপালে।

আমার দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল, আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “মা”!

টিপ ফোকলা মুখে ছোট্ট ছোট্ট হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠল খিলখিল করে, অপূর্ব স্বর্গীয় সেই হাসি। আমি বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম টিপকে। “চিনতে পেরেছিস তাহলে?” কথাটা স্পষ্ট শুনলাম, আর শুনে আমার দু চোখ ঝাপসা করে নেমে এল অশ্রুধারা!

 

..০০..

   

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫

ভেন্টিলেশান

 



 

[বিছানায় টানটান শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল পৈলান, পৈলান মণ্ডলঘাড়ের নিচে ভাঁজ করা হাত। বেশ হাল্কাপুল্কা মেজাজ। এখন সবে ভোর। আরেকটু বেলা হলেই লোকজন আসা শুরু হবে। সঠিক কতদিন তা মনে নেই, তবে অনেকদিন কেটে গেল বিছানায় শুয়ে। আজকে একটু বেরোবে ভাবছে। নিঃশব্দে দরজা ঠেলে যে ঢুকল, সে বেঁটেখাটো, লাল্টুস দেখতে একজন। তার নাম হুহু!]

 

হুহুঃ               সুপ্রভাত! আপনার ঘুম ভেঙে গেছে, দেখছি! তাহলে একটু চা দিয়ে যাই, প্রভু’?

পৈলানঃ           সুপ্পোভাত? এখানে গুডমন্নিং বলার রেওয়াজ নেই নাকি হে? তার ওপর আবার পোভু? এমন তো শুনি নাই কভু? হা হা হা হা। বলি যাত্রা-পালা হচ্ছে নাকি বলো তো, পৌরাণিক পালার রিহার্শল করছো? আমি বাপু, ওসব একদম পছন্দ করি না। আমি খাঁটি বাঙালি, বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। আমি গুডমন্নিং, স্যার, এই সব শুনতেই অভ্যস্ত। ওই সব আলফাল বকে আমার মেজাজ খিচড়ে দিও না, বুঝলে?

হুহুঃ               আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রভু...ইয়ে মানে, স্যার। আর ভুল হবে না। আজ্ঞে, এখানে নতুন নতুন তো, সড়গড় হতে একটু সময় লাগবে বৈকি। তবে স্যার, ওই যে বলছিলাম, চা দেবো, না কফি দেবো, স্যার?

পৈলানঃ           চা-ই দাও। সকাল সকাল কফিটা তেমন জমে না। আমার চাটা কেমন হয় জানো তো? চিনি ছাড়া, হাল্কা লিকার, মিষ্টির বড়ি - দুটো

হুহুঃ               লিকার চায়ে মিষ্টির বড়ি? তাহলে একটা কথা জিগ্যেস করি, স্যার? আপনি লিকার চা কী ভালোবেসে খান? নাকি নাচার হয়ে খান?

পৈলানঃ           চিনি ছাড়া লিকার চা শখ করে, কে খায় চাঁদ? সাড়ে চারশোর ওপর সুগার, তার ওপর বুকজ্বলা অম্বল। বাধ্য হয়ে খাই। তিন চামচ চিনি, ঘন দুধের সর জমে ওঠা চা। তবে না চা খেয়ে আরাম, চা খেয়ে মজা!

হুহুঃ               সে আর বলতে, স্যার? কিন্তু এখানে স্যার নো সুগার, নো অম্বল। এক কাপ নিয়ে আসছি খেয়ে দেখুন, স্যার। এখানকার সুগারে সুগার হয় না। এখানকার চায়ে চাইলেও চোঁয়া ঢেঁকুর কিংবা অম্বল হয় না।

পৈলানঃ           গ্রান্টি দিচ্ছ? তবে হলেই বা, আমার আর কী হবে? তোমারই ভোগান্তি হবে। ডাক্তারবাবুকে বলে তোমার চাকরিটা খাবো। তেমন তেমন হলে জেলেও ভরে দেব। বিনা বিচারে সতের বছর। আমাকে বিভভান্ত করার চেষ্টা এবং আমাকে হোত্তা করা চক্কান্ত..., এমন কেস খাওয়াবো না, টের পেয়ে যাবে বাছাধন!

হুহুঃ               [হেসে] না স্যার। গ্যারান্টি। একবার তো ট্রাই করে দেখুন। [দরজার দিকে ফিরতে যায়]

পৈলানঃ           ওহে, শোনো হে, শোনো। হন হন করে তো চললে, বলি নামটা কী তোমার? কী বলে ডাকব?

হুহুঃ               হে হে, স্যার। আমার নাম? আমার নাম শুনে হাসবেন, স্যার।

পৈলানঃ            হে হে ? সে না হয় হাসলামই, কিন্তু নামটা কী শুনিই না।

হুহুঃ               হুহু, স্যার। হুহু গন্ধর্ব

পৈলানঃ           [ভুরু কুঁচকে] হুহু? বেশ বেআক্কেলে নামটা তো, হে! বাঙালি যে নও, সে তো বুঝতেই পারছি। ইউপি না বিহার, নাকি তেলেগু? তা এখানে জুটলে কোত্থেকে?

হুহুঃ               আমরা বহিরাগত নই, স্যার! এইখানেই আমাদের বরাবরের বাসবহুদিনের।

পৈলানঃ           তবে যে একটু আগে বললে, এখানে নতুন নতুন, সড়গড় হতে সময় লাগবে! তোমার রকম সকম আমার একটুও ভাল ঠেকছে না, হে। তোমার ওপর আমার নজর থাকবে, এই বলে দিলাম। এখন যাও, চাটা নিয়ে এসো, তারপর তোমার হচ্ছে...তোমার ওই গন্ধটাও ধরবো।

হুহুঃ               হে হে, গন্ধ নয় স্যার, গন্ধর্ব। [হুহু হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে]

 

[পৈলান বিছানা থেকে নেমে মেঝেয় দাঁড়ালনিজেকে খুব হাল্কা মনে হচ্ছে তার, যেন কোন ভার নেই! ফাঁকা ঘরে কিছুটা নেচেও নিল আপন মনেতার এই হুমদো চেহারাটার জন্যে গত বছর তিরিশেক নানান অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু এখন আর সে সব নেই। নিজেকে বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা মনে হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দেওয়ালে টোকা মেরে...]

পৈলানঃ           এ ঘরের দেওয়ালগুলো কাচের, নাকি পেলাস্টিকের, কে জানে! একটাও জানালা নেই। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাইরে কি কুয়াশা হয়েচে, নাকি মেঘ করেচে? সুজ্যি ওঠার নাম নেই। সেই থেকে মনে হচ্ছে যেন ভোর। মেঘে মেঘে বেলা কত হল কে জানে? এ ঘরে, ব্যাটারা একটা ঘড়িও দেয়নি। ওই গন্ধধরবো নাকি, ব্যাটাকে বলতে হবে একটা ঘড়ি দিতে। আরেকটা...আরেকটা কি যেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ফোন, ইন্টারকম। না, না ইন্টারকম নয় কলিংবেল হলেই ভালো। বেলটা হাতের কাছে রেখে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। বারবার উঠে ফোন ডায়াল করতে হবেনা। তবে ব্যাটাদের ঘরদোর, বিছানাপত্র বেশ ভালোই। বেশ একটা ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব আছে। দেওয়ালে ইস্প্লিট কিংবা কোন এসি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু...অ, বুঝেছি, এখানে সেন্টাল এসি। শালা সবকিছুই সেন্টালের হাতে!  

                   [হুহু হাতে ট্রের ওপর চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল]

                   অ্যাই। শোনো হে, তোমাকে কটা কথা বলবো বলেই ভাবছিলাম। ঘরে একটা ঘড়ি রাখোনি কেন বলতো? এটাও কী আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার ম্যানেজার কে আছে? ডেকে দিও তো। আর ওই সঙ্গে একটা কলিং বেলও যেন ব্যবস্থা করে। আশ্চর্য। এতটুকু সাধারণ কমন সেন্স যদি থাকে!  আর এই ঘরটাতে জানালা নেই কেন, হে? বাইরের আলো হাওয়া একটু পাওয়া যেত। 

হুহুঃ               আজ্ঞে স্যার এই যে আপনার চা, একটু চুমুক দিয়ে দেখুন তো। মনোমত হল কিনা?

[চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুড়ুৎ শব্দে লম্বা চুমুক দিয়ে]

পৈলানঃ           আঃ। বেড়ে হয়েছে চাটা। মাইরি। মনে হচ্ছে সেই ইয়ং বয়সে যেমন খেতাম আর কি। যেমন মিঠে, তেমনি কড়া লিকারে ঘন দুধ। না তোমাকে যতটা অকম্মা মনে হচ্ছিল, ততটা নও। কিন্তু সেই সুগার আর অম্বলের ব্যাপারটা কিন্তু আমি ভুলছি না, মনে রেখো।

হুহুঃ               ওসব, একদম ভুলে যাবেন স্যার। কোনদিন যে ছিল এমন মনেও হবে না।

পৈলানঃ           বাইরে কি, কুয়াশা করে আছে? নাকি মেঘলা? সেই থেকে সুজ্যি দেখা যাচ্ছে না কেন?

হুহুঃ               আজ্ঞে স্যার, এখানে সবসময় এরকমই – ভোরের আলোর মতো। রোদ্দুরের ধাঁধানো আলোও হয় না, আবার অমবস্যার মিশমিশে অন্ধকারও হয় না।

পৈলানঃ           অ, সব চাইনিজ এলইডি মাল- বুজে গেছি, আমাকে আর বোকা বুঝিও না হে, তোমার চালবাজির কথায় আমি ভুলছি না। ম্যানেজারকে বলে এক্ষুনি একটা ঘড়ি, ওই সঙ্গে ক্যালেন্ডার আমার চাই। আজকে কত তারিখ আর এখন কটা বাজছে, বলো দেখি।

হুহুঃ               আজ্ঞে, এখানে ঘড়ি পাওয়া যায় না, স্যার। ক্যালেণ্ডারও না। এখানে কেউ সময়ও মাপে না, কারো মেয়াদও ফুরোয় না, স্যার। এখানে আসতেই যা কষ্ট, তারপরেই ব্যস - হয়ে গেল। সময় থমকে যায়!

পৈলানঃ           [ভুরু কুঁচকে ধমকের সুরে] কোথায় এসেছি আমি? কিসের কী হয়ে গেল? কী সব আবোলতাবোল বকছো বলো তো?

হুহুঃ               মানে স্যার, ব্যাপারটা চট করে বুঝে ওঠা ভারি শক্ত। নতুন নতুন তো, কদিন থাকুন, ধীরে ধীরে সবই বুঝে যাবেন। এখানে এলে সবাই অনাদি আর অনন্ত হয়ে যায়

পৈলানঃ           [খুব রেগে। আঙুল তুলে] অ্যাই শালা, অনাদি, অনন্তর নাম তুলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? ওদের সব খবর আমি জানতাম বলেই, ওদের দুটোরই আমি খবর লিয়ে লিয়েচিলাম, হ্যাঁ[একটু থেমে] অ, তাই বল, এইবার বুঝেচি, তোরা সব শালা কোন দলের লোক। কিন্তু ভালো কথা বলচি শোন, আমাকে একদম ঘাঁটাস না। সেই থেকে আমাকে তাপ্পি মারচিস? শালা, তোরা আমায় কিডন্যাপ করে এনেচিস, না? [চাটা শেষ করে, হুহুর হাতে খালি কাপটা ধরিয়ে দিল]

হুহুঃ               ব্রেকফাস্টে কী খাবেন, স্যার? মাংসের হালকা ঝোল আর মাংসেরপুর দেওয়া পাঁউরুটি টোস্ট, দিই?

পৈলানঃ           সোজা কথার উত্তর দিবি না, না? তুই খুব হারামি, জানিস তো? সাত হারামির এক হারামি বললেও কম বলা হয়। তোর নামটা বললি গানধরবো! তখন বুঝিনি, আমিও শ্লা টিউবলাইট মেরে গেচি, এখন বুঝছি তুই পাক্কা টেররিস্ট। শুরুর থেকেই তুই আমাকে, গান ধরবো, গান ধরবো করে থ্রেট করচিস, বন্দুক ধরবি? ভেবেছিস আমি গেঁড়ে ভোঁৎনা? ভয় দেখালেই সিঁটিয়ে কাদা? এখন আবার মাংসের ইস্টু, সেন্ডউইচ টুচ খাইয়ে আমার মন ভুলোতে চাচ্চিস? আমার পছন্দ-অপছন্দ সবই তোদের খবরে আছে, কেমন?

হুহুঃ               আপনি খুব বিচলিত হয়ে উঠছেন, স্যার। সবার সব খবরই, আমাদের রাখতে হয়, সেটাই আমাদের কাজ স্যার। যে যেমন কাজ করে, সে তেমনই ফল পায়, এ নিয়ম স্যার, আমাদেরও, আপনাদেরও। বিচলিত হবেন না স্যার। খাবারের সঙ্গে এবার কফি এনে দিই স্যার? আরাম করে খান।

পৈলানঃ           [ভুরু কুঁচকে] অ্যাই, বিচলিত আবার কী রে? তোকে আগেই বললাম না, বাংলায় বল।

হুহুঃ               হে হে। বিচলিত-র বাংলা টেনসান, স্যার।

পৈলানঃ           টেনসান? অ তাই বল। অ্যাঁ কী বললি, টেনসান? শালা তুই আমাকে টেনসান শেখাচ্চিস? আমার মোবাইলটা কোতায়? আমার মোওওবাইলটা কোতায়? ওটা আমাকে একবার দে, তারপর তোদের কেমন টেনসনে দৌড় করাই দেখ। আমার ছেলেরা একবার খবর পেলে না? তোদের হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে জেনে রেখে দে।

হুহুঃ               আপনার খাবারটা আমি নিয়ে আসি, স্যার। আরাম করে খানখেতে খেতে না হয় আপনার কথার উত্তর দেওয়া যাবে। [হুহু বেরিয়ে গেল]

পৈলানঃ           [চিন্তিত মুখে, পায়চারি করতে করতে] ছিলাম তো শালা কলকাতার সেরা নার্সিং হোমে। কতদিন ছিলাম, সে তো মনেও নেই ছাতা। কখন ঘুমোতাম, কখন জাগতাম কে জানে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখতাম মাথার ওপর সিলিংয়ের ফুটোয় লুকোনো মিটমিটে আলো। বিছানায় শুয়ে আচি বুঝতে পারতাম। আড়ষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার ক্ষমতাও ছিল না। তবে সারা গায়ে, নাকে, মুখে গুচ্ছের নল লাগানো ছিল দেখতাম। ডানপাশের দেওয়ালে একটা টিভির মতো নীল পর্দার বাস্কো! বাস্কো নয়, বাস্কো নয়, কি যেন বলে, হ্যাঁ মনে পড়েচে মনিটর মনিটর। স্কুলে ন বছর পড়েছিলাম, সব কেলাসে আমিই মনিটর হতাম। মনিটর মানেই মাতব্বরি। মাতব্বরি ব্যাপারটা আমার জন্ম থেকেই। সেই ভাঙিয়েই তো এত ক্ষমতা আর দাপট। আমার নাম শুনলে, পোয়াতি মেয়েদের গবভোপাত হয়ে যায়। মায়ের কোলে ঘুমকাতুরে খোকারা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিরোধী দলের নেতাদের ধুতি হলুদ হয়ে কেচ্ছা কেলেংকারি হয়। কিন্তু এ ব্যাটারা কারা? কোন দলের? আমাকে তুলে এনেছে বুঝতে পারচিকিন্তু কী চায় কি আমার থেকে! দু-চার পেটি হলে, তেমন পবলেম নেই। সে আমার ঘরেই গোয়ালের মাচায় রাখা আচে। কিন্তু না হলে? এ জায়গাটা কোথায়? এখান থেকে বেরোনোর উপায় কী? তবে হ্যাঁ, একবার বেরোতে পারলে, শালাদের গুষ্টির ষষ্টিপুজো যদি না করে ছাড়ি তো আমার নাম পৈলেন নয়। ওই গান ধরবোটা এবার এলেই, একটু ধাতানি দিয়ে কথা বলতে হবে। আমার ধাতানি হজম করার লোক এ তল্লাটে তেমন আর কই?

[ট্রে হাতে হুহু ঢুকল। প্লেটে স্যাণ্ডউইচ টোস্ট, বোওলে মাংসের স্টু আর কাপে গরম কফি]

হুহুঃ               একদম গরম গরম খেয়ে নিন, স্যার।

পৈলানঃ           হুঁ। তেমন খিদে মনে হচ্চিল না, কিন্তু গন্ধটা হেবি ছেড়েচে, তাতেই কেমন যেন খিদেটা চনমনে হয়ে উঠেচেতোদের পেটের মধ্যে কী মতলবটা আচে বুঝতে পারচি না, তবে ভয় পেয়ে আমি পেটে না খেয়ে দুব্বল হবো, এমন আহাম্মক আমায় ভাবিসনি, রে!

                   [স্যাণ্ডউইচে কামড় দিয়ে, এক চামচ সুপ নিল]

                   বাঃ। রান্নাবান্না তো ভালই তোদের ক্যান্টিনে। তা তোদের মতলবটা কী খুলে বলবি? আমাকে এখানে এনে বন্দী রেখে তোদের লাভটা কী হবে? এই এত দামি ঘর, এই রকম খাওয়া দাওয়া...তোদের বস কে আচে? তাকে বল না, এসব ভাঁটের খরচা আর সময় নষ্ট না করে, সামনে এসে ঝেড়ে কাশতে!

হুহুঃ               না, না, আপনাকে বন্দী রাখা হয়েচে, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা স্যার! আপনি তো বন্দী নন। আপনি মুক্ত হয়েই তো এখানে এসেছেন! বরং এতদিন যেখানে ছিলেন, সেখানেই আপনি বন্দী ছিলেন!

পৈলানঃ           এখানে বন্দী নই? এই ঘরের বাইরে, যেখানে খুশি আমি যেতে পারি? কী ফালতো বকচিস মাইরি।

হুহুঃ               হ্যাঁ স্যার। যেখানে খুশি আপনি যেতে পারেন। কোন বাধা নেই। তবে এই লোকে পনের দিনের মেয়াদ, তার পরে অন্য লোক।

পৈলানঃ           অ তোর ওই সময় ডিউটি চেঞ্জ হয়ে যাবে বুঝি? অন্য লোক আসবে? তবে পনের দিন তো অনেক দিন রে? তার আগেই আমি চলে যাবো। আচ্ছা, আমি যদি বন্দী না হই, তাহলে আমার মোবাইলটা দিচ্চিস না কেন?

হুহুঃ               এখানে ওটার কাজ কী, স্যার? টালির টুকরো। এখানে নেট ওয়ার্ক নেই, মোবাইল থাকা না থাকা সমান।

পৈলানঃ           এ জায়গাটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে?

হুহুঃ               তা স্যার, বেশ খানিকটা দূরেই।

পৈলানঃ           [মুখ ভেংচে] বেশ খানিকটা দূরে, আবে কতটা দূরে বল না?  হতভাগা, আমাকে বন্দী করেই যদি না রাখবি, তাহলে কলকাতা ছেড়ে এখানে নিয়ে এলি কী করতে?

হুহুঃ               আজ্ঞে মুক্তি পেলে এখানেই আসতে হয় প্রথমে, তারপর অন্য লোকে। হে হে, আপনি এতদিন যে ফাঁদে বন্দী ছিলেন, তারপরে আপনাকে কে আবার বন্দী করবে?

পৈলানঃ           আমি বন্দী ছিলাম? হারামজাদা, এমন দেব না কানের গোড়ায়। আমাকে বন্দী করতে পারে এমন কারো ক্ষমতা ছিল বাংলায়?

হুহুঃ               হে হে ছিলেন বৈকি, স্যার। সে এমনই বন্দী, বুঝতেও পারেননি। এই এখন যেমন বুঝতে পারছেন না, যে আপনি মুক্ত। আর আপনি স্যার এখন বাংলাতেও আর নেই।

পৈলানঃ           (চমকে) বাংলাতেও নেই মানে? আমি তাহলে এখন কোথায়? বিহার, ইউপি না দিল্লিতে? কী ভজকট বকচিস মাইরি!

হুহুঃ               ওসব নয়, ওসব নয়, হে হে এ একেবারে অন্যলোকের জায়গা। তবে এ লোকে সবাইকেই একবার আসত হয়। 

পৈলানঃ           হতভাগা জেনে রাখ, অন্যলোকের এলাকাতে আমি একলা যাই না। আমার সঙ্গে সাঙ্গপাঙ্গ থাকে, তাদের হাতে দানা থাকে, নারকেল থাকে। বলা নেই কওয়া নেই, অন্য লোকের এলাকায় এনেচিস কেন বে, আঁটকুড়ির ব্যাটা?

হুহুঃ               আপনি স্যার, সেই থেকে অনেক আকথা কুকথা বলছেন, সেটা না বললেই ভালো, স্যার। আমি আপনার নাড়ি নক্ষত্র, হাঁড়ির খবর সব জানি, কিন্তু আপনি আমার কিছুই জানেন না। কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে জানে, স্যার? আর কী কথায় কখন কী ঘটে যায়, কে বলতে পারে? এখানে আবার সব কথার এবং কাজের হিসেবও রাখা হয়, সেটাই মুশকিল।

পৈলানঃ           (সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে স্যুপ খেতে খেতে) (জনান্তিকে) ব্যাটাকে অ্যাত হড়কাচ্চি, তাও হেব্বি ক্যাজুয়াল রয়েছে কিন্তু। উলটে মাঝে মাঝে, আমাকেই দেখচি কচি করে হড়কে দিচ্চে হারামীটার পেছনে বেশ লম্বা হাত আচে বোঝা যাচ্চেহয়তো সিবিআই, ইডি। বুঝেচি, এ শালা নিগ্‌ঘাৎ কেন্দের চক্কান্ত। যাই হোক মাথা গরম করে লাভ হবে না মনে হচ্চেব্যাটাকে অন্য ভাবে ম্যানেজ করা যায় কিন দেখি।

                   (স্যুপ স্যাণ্ডউইচ শেষ, এবার কফির কাপে চুমুক দিয়ে) (প্রকাশ্যে) তা বাপু, তোমার ওপর যতোই রাগটাগ করি না কেন, একটা কথা মানতেই হবে, রান্নার হাতটা খাসা। কিসের মাংস ঠিক বুঝলাম না, তবে খুব তার হয়েচে রান্নায়! কোথাকার ঠাকুর হে? আর মাংসটাই বা কিসের?

হুহুঃ               ঠাকুর বলে এখানে কেউ নেই, রান্নাটান্নাও করতে হয় না, স্যার। যে যেমন কর্ম করে, তার মনোমত ঠিকঠাক জিনিষ এখানে তৈরি হয়েই থাকে।

পৈলানঃ           এতো বেশ বেড়ে জায়গা মাইরি। এর পর যেন বলে বসো না, যে এর জন্যে কোন খরচাও হয় না!

হুহুঃ               হে হে, স্যার ঠিকই ধরেছেন, সত্যিই কোন খরচা নেই। সারা জীবনের লুঠপাট, চুরিচামারি করে জমানো পয়সায় ছ্যাদলা ধরে। তারপর সাত ভুতে কামড়াকামড়ি করে সে পয়সার ষষ্ঠীপুজো করে।

পৈলানঃ           তা ঠিক, তবু মন তো মানে না। পোথম পোথম তোমার ওপর একটু বিরক্ত হয়েচিলাম ঠিকই, এখন দেখচি তোমার মধ্যে অনেক গুণ আচে হে। আর পৈলেন মণ্ডল গুণের কদর জানে। ঐ যে অনন্ত, ব্যাটার অনেক গুণ ছিল, খালপাড়ের বস্তি থেকে একদিন ভোরবেলা ফেরার সময় ওকে দেখেছিলাম। আর দেখেই বুঝেছিলাম ওর ভেতরে মাল আচেতুলে এনে সঙ্গে রাখলাম কদিন। ঝট করে তৈরি হয়ে গেল, জান?

হুহুঃ               হে হে, সে আপনার হাত যশ।

পৈলানঃ           সেই অনন্ত, আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে, দু বছরে রাজার ব্যাটা কেরাসিনওয়ালা বানিয়ে দিলাম! আর সেই কিনা এলো আমার পেছনে কাটি করতে? এমন বিশ্বেসঘাতক! দিলেম শালাকে টপকে।

হুহুঃ               জানি, স্যার।

পৈলানঃ           আর ওই অনাদি? আমার বিরোধী দলে ছিল, ওখানে ব্যাটাকে ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ছেড়েছিল। যে কোনদিন লাশ হয়ে ভুরভুরি কাটত পোড়ো সেপটিক ট্যাংকে। একদিন মাঝ রাত্রে ধড়াস করে পায়ে এসে পড়ল, পলুদা বাঁচাও। আমার চোখের কোলটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠল।

হুহুঃ               হে হে, সে আর বলতে? আপনার দয়ার শরীর।

পৈলানঃ           আরে তা নয়, তা নয়। পেটে জল পড়লে আমার মনটা কেমন যেন মাখো মাখো হয়ে যায়। সেই অনাদি অনন্তর সঙ্গে ভিড়ে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার ছক কষছিল। দিলাম শালার ঘন্টা বাজিয়ে।

হুহুঃ               হে হে, আপনিই তো শেষ বিচারের মালিক। এই তুলছেন, এই খালাস করছেন।

পৈলানঃ           ছেঁদো গ্যাস দিয়ে লাভ নেই, গন্ধকাজের কথাটা শোন। এখানে কত পাও? বলি ফিউচারের কথা কিছু ভেবেছ? সারা জীবন এভাবেই কাটাবে? নাকি দু পয়সা কামিয়ে, একটু রোখঠোক রোয়াবি দেখিয়ে রাজার হালে থাকবে?

হুহুঃ               আজ্ঞে, সে আর বলতে? আর উণিশ বিশ হলেই খালে লাশ - একেবারে খাল্লাস।

পৈলানঃ           আরে তা কেন? সবাই কী আর ওদের মতো নাকি? ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।

হুহুঃ               সে কথা একশবার, আমাদের ভাবনা তো আপনি ভেবেই রেখেছেন। আপনার নিজের দলেরই আটত্রিশজন এখন মাটির তলায় কংকাল হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আর ষোলজনের, বানিয়ে তোলা মামলায় যাবজ্জীবন চলছে।

পৈলানঃ           (ভুরু কুঁচকে) বেশ ছোকরা হে, তুমি! আমার থেকেও তোমার দেখি সব হিসেব একেবারে মুখস্থ!

হুহুঃ               আজ্ঞে তা তো হবেই! আপনার হরেক লীলা, সব কী আর আপনার মনে রাখা ঠিক হয়? এরপর আছে বিরোধী দলের একশ আটত্রিশ জন, আর নিরীহ আম জনগণ গোটা চল্লিশেক তো হবেই!

পৈলানঃ           (কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে) সব কী আর মনে আছে? কাজের মধ্যে অমন দু চারটে হয়েই যায়। আর ওসব না করলে লোকে মান্যিগণ্যিই বা করবে কেন? আর পাব্লিকের মনে ভয়ভক্তিই বা আসবে কোত্থেকে, হে? ওটাই তো আমাদের পোফেসন, ওটাই তো আমাদের ইউএসপি। ওটুকু না থাকলে, পলিটিক্যাল ন্যাতারা আমাদের দিয়ে ঘরও মোছাবে না, হে।

হুহুঃ               আর পলিটিক্যাল হাতটা যদি মাথায় না থাকে, ক্ষমতার ল্যাজ নাড়াই বা থাকবে কোথায়?

পৈলানঃ           তুমি বেশ চালাকচতুরও আচো, অ্যাঁ? ভেজা বেড়ালটা সেজে থাকো, দেখে বোঝাই যায় না। এখনই কিছু বলতে হবে না। ভালো করে চিন্তা ভাবনা করে দেখ। এখান থেকে সটকে নিয়ে একবারটি আমায় কলকাতায় নিয়ে চলো, তারপর তোমার লাইফ কেমন বানিয়ে দিই দেখবে! হে হে, এটুকু না বোঝার মতো বোকা তুমি তো নও হে!

হুহুঃ               আজ্ঞে, ভাবনা চিন্তার বাকি আর কী রাখলেন বলুন দেখি?

পৈলানঃ           বলো কী হে, ভাবনা চিন্তা করেই ফেলেছ? বা বেশ বেশ। তা বেরোবার আগে লাঞ্চের ব্যবস্থা কিছু করেচ নাকি? দুপুরে ওই মাংসের কষা আর খান কতক পরোটা বানাবে নাকি? যাওয়ার আগে এ পাড়ার খাবারটা জমিয়ে খেয়েই যায়। আচ্ছা, ওই মাংসটা কিসের বলো তো হে, অমন স্বাদ এর আগে কোনদিন পাই নি।

হুহুঃ               ও তেমন কিছু না, স্যার। যেমন সস্তা, তেমনি সহজেই পাওয়া যায়। মানে এ মাংসের কোনদিন অভাব হয় না, স্যার। হালাল কিংবা ঝটকা; গরু কিংবা শুয়োর –এসব কোন লাফড়াও নেই, স্যার!।

পৈলানঃ           বলো কী হে? সস্তায় এমন মাংস, কিসের বলো তো?

হুহুঃ               আপনি জানেন, স্যার, আপনার খুবই প্রিয় মাংস। ওটা নরমাংস, স্যার।

পৈলানঃ           অ তাই বলো! অ্যাঁঃ কী বললি? নরমাংস? আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ তোর পেটে পেটে এই ছিল, গন্ধ?

হুহুঃ               কেন স্যার? কিছু অন্যায় করে ফেললাম নাকি, স্যার? একটা মানুষখেকো বাঘ, কিংবা একটা হাঙর সারা জীবনেও অতো মানুষ খেতে পারে না স্যার, এই ক বছরে আপনি যা খেয়েছেন।

পৈলানঃ           হ্যাক থুঃ থুঃ। ছিঃ ছিঃ। কোন শালা বলে আমি নরমাংস খেয়েছি? লাশ ফেললেই তার মাংস খাওয়া হয়ে যায়? আমার মতো একজন সমাজসেবীকে তুই নরমাংস খাওয়ালি?

হুহুঃ               এ হে হে, আপনি এত ছ্যাছ্যা থুথু করছেন কেন স্যার, মানুষ কি এতই অখাদ্য স্যার? বাঘ ভাল্লুক স্যার কখনো কখনো মানুষ মারে পেটের জ্বালায়, আপনি মারেন, স্যার ক্ষমতা আর টাকার জ্বালায়। তা স্যার একটু খেয়ে দেখতে দোষ কী?

পৈলানঃ           তোকে আমি ফাঁসিতে চড়াবো। তোকে আমি... আমি...ওয়াক ওয়াক...ওরে বাবা আমার কেমন গা গুলোচ্ছে...ইস...ইস...ছ্যাঃ ছ্যাঃ...ওয়াক ওয়াক...

 

[আলো নিভে গেল, কিছুক্ষণ পৈলানের ‘ওয়াক ওয়াক, থু থু’ আর হুহুর ‘ঘাবড়াবেন না স্যার, সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম অমন হতে পারে স্যার’ শোনা যেতে লাগল...তারপর হুহুর কণ্ঠের বদলে একটি মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘স্যার, স্যার একটু শান্ত হোন স্যার, ও স্যার, স্যার...’আলো জ্বলে উঠলে দেখা গেল, হস্পিট্যালের বেডে পৈলেন শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে একটি নার্স, নাম পিংকি পৈলানের সারা গায়ে নাকে মুখে নানান টিউব, সে সব খুলে সে উঠে পড়তে চাইছে।]

 

পিংকিঃ            বীণাদি, শিখাদি একবার আসবে গো, পেশেন্ট হঠাৎ কেমন করছে দেখে যাও। সামলাতে পারছি না। ও বীণাদি, ও শিখাদি।

                   [আরো দুই নার্স বীণা আর শিখা দৌড়ে ঢুকল কেবিনে]

বীণাঃ              ও মা, এ আবার কী হল রে? কোমার পেশেন্ট এমন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে এই প্রথম দেখছি শিখা তুই স্যারকে বরং একবার ফোন কর। আমি আর পিংকি ততক্ষণ দেখছি একে শান্ত করা যায় কি না

                   [শিখা মোবাইলে ডায়াল করতে থাকে]

শিখাঃ             যাচ্চলে, নেট ওয়ার্ক সীমার বাইরে বলছে।

বীণাঃ              যাচ্ছেতাই নেট ওয়ার্ক। আবার কর

শিখাঃ             দাঁড়া দাঁড়া রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...যাঃ, স্যার তুললেন না।

বীণাঃ              ছেড়ে দে, এখন আর তাড়া নেই। পেশেন্ট ঠাণ্ডা মেরে গেছে...এখন আর কোমা নয়, একদম ফুলস্টপ।

পিংকিঃ            তাহলে, ভেন্টিলেশান খুলে দিই?

বীণাঃ              পাগল হয়েছিস? ভেণ্টিলেশন চলুক...বড়ো বড়ো ডাক্তাররা আসুক, তাঁরা যা করার করবেনরাত এখনো ঢের বাকি, যা একটু ঘুমিয়ে নে। কাল সকাল থেকে আবার কোমার ডিউটি... এ কোমা কবে কমবে, কে জানে? 

 

[তিনজন বেডের দুপাশে দাঁড়িয়ে পৈলানের দিকে তাকিয়ে রইল। পর্দা নেমে এল]

 

..০০..             

মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

কঠোপনিষদ - ১/২

 

প্রথম অধ্যায়

দ্বিতীয় বল্লী

 

অন্যচ্ছ্রেয়োঽন্যদুতৈব প্রেয়স্তে

উভে নানার্থে পুরুষং সিনীতঃ।

তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি

হীয়তেঽর্থাদ্‌ য উ প্রেয়ো বৃণীতে।। ১/২/১

অন্যৎ শ্রেয়ঃ অন্যৎ উত এব প্রেয়ঃ তে

উভে নানা অর্থে পুরুষম্‌ সিনীতঃ।

তয়োঃ শ্রেয়ঃ আদদানস্য সাধু ভবতি

হীয়তে অর্থাৎ য উ প্রেয়ঃ বৃণীতে।। ১/২/১

(নচিকেতার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে রাজা যম বললেন) “শ্রেয় মার্গ ভিন্ন এবং প্রেয় মার্গও ভিন্ন, উভয়েই বিভিন্ন বিষয়ে পুরুষকে আবদ্ধ করে। উভয়ের মধ্যে যিনি শ্রেয় পথে যান, তাঁর মঙ্গল হয়। আর যিনি প্রেয় পথ আশ্রয় করেন, তিনি ভ্রষ্ট হন”।

[শ্রেয় মার্গ অর্থ নিষ্কাম পরমমুক্তির সাধন পথ। আর প্রেয় মার্গ হল স্বর্গ কিংবা পার্থিব বিষয় (পুত্র, পশু, সম্পদ ইত্যাদি) কামনার পথ। দুটি পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন, একই পুরুষের পক্ষে দুই পথ গ্রহণ করা অসম্ভব।]

 

শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ

সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।

শ্রেয়ো হি ধীরোঽভি প্রেয়সো বৃণীতে

প্রেয়ো মন্দো যোগক্ষেমাদ্‌ বৃণীতে।। ১/২/২

শ্রেয়ঃ চ প্রেয়ঃ চ মনুষ্যম্‌ এতঃ তৌ

সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।

শ্রেয়ঃ হি ধীরঃ অভি প্রেয়সঃ বৃণীতে

প্রেয়ঃ মন্দঃ যোগ-ক্ষেমাদ্‌ বৃণীতে।। ১/২/২

সাধারণ মানুষ শ্রেয় এবং প্রেয় উভয় মার্গেই জড়িয়ে থাকে, কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি সম্যক বিচার করে উভয় পথকে পৃথক করেন। ধীমান ব্যক্তি প্রেয় মার্গ ছেড়ে শ্রেয় মার্গ বরণ করেন, কিন্তু মন্দবুদ্ধি ব্যক্তিরা প্রেয় মার্গ বরণ করে, যোগ ও ক্ষেমে নিযুক্ত থাকেন”।

[না পাওয়া বিষয়কে পাওয়ার প্রচেষ্টাকে যোগ বলে, পাওয়া বিষয়ের সংরক্ষণকে বলে ক্ষেম।]

 

স ত্বং প্রিয়ান্‌ প্রিয়রূপাংশ্চ

কামানভিধ্যায়ন্নচিকেতোঽত্যস্রাক্ষীঃ।

নৈতাং সৃঙ্কাং বিত্তময়ীমবাপ্তো যস্যাং

মজ্জন্তি বহবো মনুষ্যাঃ।। ১/২/৩

স ত্বম্‌ প্রিয়ান্‌ প্রিয়রূপান্‌ চ

কামান্‌ অভিধ্যায়ৎ নচিকেতঃ অত্যস্রাক্ষীঃ।

ন এতাং সৃঙ্কাম্‌ বিত্তময়ীম্‌ অবাপ্তো যস্যাং

মজ্জন্তি বহবঃ মনুষ্যাঃ।। ১/২/৩

“হে নচিকেতা, (বারবার প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও) তুমি সেই কামনার প্রিয় বস্তুসমূহ এবং ভোগ্য বিষয় (অনিত্য) বিচার করে, ত্যাগ করেছ। বহুমানুষ যে ধন-সম্পদবহুল পথে মগ্ন থাকে, তুমি সেই পথ অবলম্বন করোনি”।

 

দূরমেতে বিপরীতে বিষূচী

অবিদ্যা যা চ বিদ্যেতি জ্ঞাতা।

বিদ্যাভীপ্সিনং নচিকেতসং মন্যে

ন ত্বা কামা বহবোঽলোলুপন্ত।। ১/২/৪

দূরম্‌ এতে বিপরীতে বিষূচী

অবিদ্যা যা চ বিদ্যা ইতি জ্ঞাতা।

বিদ্যা অভীপ্সিনম্‌ নচিকেতসম্‌ মন্যে

ন ত্বা কামা বহবঃ অলোলুপন্ত।। ১/২/৪

বিদ্বানেরা জানেন, অবিদ্যা ও বিদ্যা – এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য এবং সম্পূর্ণ বিপরীতহে নচিকেতা, আমি মনে করি বিদ্যা শিক্ষাতেই তোমার বাসনা, কারণ বহু কামনাবস্তুর প্রলোভনে তুমি লুব্ধ হওনি”।

[অবিদ্যার কর্মকাণ্ড পার্থিব বিষয়ের কামনায় সংলিপ্ত আর বিদ্যা পরমমুক্তি বা মোক্ষ লাভের উপায়।]     

 

অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ

স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতম্মন্যমানাঃ।

দন্দ্রম্যমাণাঃ পরিয়ন্তি মূঢ়া

অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ।। ১/২/৫

অবিদ্যায়াম্‌ অন্তরে বর্তমানাঃ

স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতম্‌ মন্যমানাঃ।

দন্দ্রম্যমাণাঃ পরিয়ন্তি মূঢ়া

অন্ধেন এব নীয়মানা যথা অন্ধাঃ।। ১/২/৫

“অন্তরে অবিদ্যার ভাব নিয়ে, যে নিজেকে বুদ্ধিমান এবং পণ্ডিত বলে গর্ব করে, এক অন্ধকে অন্য অন্ধ পরিচালনা করার মতো, সেই মূঢ় ব্যক্তিরা জটিল পথেই ঘুরে বেড়াতে থাকে”।

 

ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং

প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্‌।

অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি মানী

পুনঃ পুনর্বশমাপদ্যতে মে।। ১/২/৬

ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং

প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্‌।

অয়ম্‌ লোকঃ ন অস্তি পর ইতি মানী

পুনঃ পুনঃ বশম্‌ আপদ্যতে মে।। ১/২/৬

“সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন ভ্রান্ত ও মূঢ় বিবেকহীন ব্যক্তির কাছে পরলোক বিষয়ের সাধন প্রকাশিত হয় না। “শুধু এই মর্ত্যলোকই আছে, পরলোক নেই” এই চিন্তা করে তারা বারবার আমার বশীভূত হয়”।

[এই মর্ত্যলোকে তাদের বারবার জন্ম হয় এবং বারবার “আমার” অর্থাৎ মৃত্যুর বশীভূত হয়]    

 

শ্রবণায়াপি বহুভির্যো ন লভ্যঃ

শৃণ্বন্তোঽপি বহবো যং ন বিদ্যুঃ।

আশ্চর্যো বক্তা কুশলোঽস্য

লব্ধাশ্চর্যো জ্ঞাত্বা কুশলানুশিষ্টঃ।। ১/২/৭

শ্রবণায় অপি বহুভিঃ যঃ ন লভ্যঃ

শৃণ্বন্তঃ অপি বহবঃ যং ন বিদ্যুঃ।

আশ্চর্যঃ বক্তা কুশলঃ অস্য

লব্ধ আশ্চর্যঃ জ্ঞাত্বা কুশল অনুশিষ্টঃ।। ১/২/৭

“অনেকে (আত্মতত্ত্বকথা) শুনতেই পায় না, আবার অনেকে শুনতে পেলেও উপলব্ধি করতে পারে না(অতএব) যিনি এই আত্মার তত্ত্ব উপদেশ দেন এবং যিনি সেই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন, দুজনেই অত্যন্ত বিরল এবং কুশল”। 

 

ন নরেণাবরেণ প্রোক্ত এষ

সুবিজ্ঞেয়ো বহুধা চিন্ত্যমানঃ।

অনন্যপ্রোক্তে গতিরত্র

নাস্ত্যণীয়ান্‌ হ্যতর্ক্যমণুপ্রমাণাৎ।। ১/২/৮

ন নরেণ অবরেণ প্রোক্ত এষ

সুবিজ্ঞেয়ঃ বহুধা চিন্ত্যমানঃ।

অনন্যপ্রোক্তে গতিঃ অত্র ন অস্তি

অণীয়ান্‌ হি অতর্ক্যম্‌ অণুপ্রমাণাৎ।। ১/২/৮

“স্বল্পজ্ঞানী মানুষের উপদেশে এই আত্মতত্ত্ব সঠিক বোঝা যায় না, কারণ তাঁর চিন্তার বিষয় (পরলোক আছে কি নেই, কর্তা-অকর্তা, শুদ্ধ-অশুদ্ধ বিচার ইত্যাদি) বহুবিধ। “আত্মা তর্কের অতীত, কারণ তাঁকে সূক্ষ্মরূপে প্রমাণ করলেও সূক্ষ্মতররূপে প্রমাণ করা যায়”, এই আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠ আচার্যের উপদেশে এই বিষয়ে আর কোন সংশয় থাকে না”  

 

নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া

প্রোক্তাঽন্যেনৈব সুজ্ঞানায় প্রেষ্ঠ।

যাং ত্বমাপঃ সত্যধৃতির্বতাসি

ত্বাদৃঙ্‌নো ভূয়ান্নচিকেতঃ প্রষ্টা।। ১/২/৯

ন এষা তর্কেণ মতিঃ আপনেয়া

প্রোক্তাঃ অন্যেন এব সুজ্ঞানায় প্রেষ্ঠ।

যাম্‌ ত্বম্‌ আপঃ সত্য-ধৃতিঃ বত অসি

ত্বাদৃক্‌ নঃ ভূয়াৎ নচিকেতঃ প্রষ্টা।। ১/২/৯

“হে প্রিয়, তোমার এই মতি তুমি তর্ক থেকে লাভ করোনি। কোন তার্কিক নন, বিশিষ্ট জ্ঞানী কোন আচার্যের উপদেশ শুনেই তোমার এমন মতি হয়েছে। হে নচিকেতা, তোমার সত্যিই পরমার্থবিষয়ে উপলব্ধি হয়েছে, তোমার মতো জিজ্ঞাসু আমাদের কাছে আরও যেন আসে”।   

 

জানাম্যহং শেবধিরিত্যনিত্যং

ন হ্যধ্রুবৈঃ প্রাপ্যতে হি ধ্রুবং তৎ।

ততো ময়া নাচিকেতশ্চিতোঽগ্নি-

রনিত্যৈর্দ্রব্যৈঃ প্রাপ্তবানস্মি নিত্যম্‌।। ১/২/১০

জানামি অহং শেবধিঃ ইতি অনিত্যং

ন হি অধ্রুবৈঃ প্রাপ্যতে হি ধ্রুবং তৎ।

ততঃ ময়া নাচিকেতঃ চিতঃ অগ্নিঃ

অনিত্যৈঃ দ্রব্যৈঃ প্রাপ্তবান্‌ অস্মি নিত্যম্‌।। ১/২/১০

“আমি এই জানি যে কর্মফল অনিত্য, এবং অনিত্য বিষয় দিয়ে ধ্রুবপদ লাভ করা যায় না। তৎসত্ত্বেও আমি অনিত্য দ্রব্য দিয়েই নাচিকেত অগ্নি চয়ন করেছি এবং তার ফলে আমি এই নিত্য (যম) পদ লাভ করেছি”।  

 

কামস্যাপ্তিং জগতঃ প্রতিষ্ঠাং

ক্রতোরনন্ত্যমভয়স্য পারম্‌।

স্তোমমহদুরুগায়ং প্রতিষ্ঠাং দৃষ্ট্বা

ধৃত্যা ধীরো নচিকেতোঽত্যস্রাক্ষীঃ।। ১/২/১১

কামস্য আপ্তিং জগতঃ প্রতিষ্ঠাং

ক্রতঃ অনন্ত্যম্‌ অভয়স্য পারম্‌।

স্তোম-মহৎ উরুগায়ং প্রতিষ্ঠাং দৃষ্ট্বা

ধৃত্যা ধীরো নচিকেতঃ অত্যস্রাক্ষীঃ।। ১/২/১১

হে নচিকেতা, যাতে সকল কামনার অবসান হয়, যা জগতের (অধ্যাত্ম, অধিভূত ও অধিদৈব সকল বিষয়ের) আশ্রয়, যজ্ঞের অনন্ত ও অভয় ফল লাভ করে, পরলোকের মহৎ ও অনাদি প্রতিষ্ঠার বিষয় ধৈর্য সহকারে বিচার করেছ, (অনিত্য সকল বিষয়কে) ত্যাগ করে, তুমি ধীমান হয়েছো”।

  

তং দুর্দর্শং গূঢ়মনুপ্রবিষ্টং

গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং পুরাণম্‌।

অধ্যাত্মযোগাধিগমেন দেবং

মত্বা ধীরো হর্ষশোকৌ জহাতি।। ১/২/১২

তং দুর্দর্শং গূঢ়ম্‌ অনুপ্রবিষ্টং

গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং পুরাণম্‌।

অধ্যাত্মযোগ অধিগমেন দেবং

মত্বা ধীরঃ হর্ষশোকৌ জহাতি।। ১/২/১২

“তুমি যাঁর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছো, তাঁর দর্শন দুর্লভ, তিনি (বাসনাযুক্ত) শরীরেই, অন্তরের অন্দরে গূঢ়ভাবে অবস্থান করছেন। পরমাত্মার প্রতি একনিষ্ঠ সাধনায় সেই সনাতন ও স্বপ্রকাশ আত্মাকে সাক্ষাৎ করলেই ধীমান ব্যক্তিরা সকল দুঃখশোক জয় করতে পারেন”।  

 

এতচ্ছ্রুত্বা সম্পরিগৃহ্য মর্ত্যঃ

প্রবৃহ্য ধর্ম্যমণুমেতমাপ্য।

স মোদতে মোদনীয়ং হি লব্ধ্বা

বিবৃতং সদ্ম নচিকেতসং মন্যে।। ১/২/১৩

এতৎ শ্রুত্বা সম্পরিগৃহ্য মর্ত্যঃ

প্রবৃহ্য ধর্ম্যম্‌ অণুম্‌ এতম্‌ আপ্য।

স মোদতে মোদনীয়ম্‌ হি লব্ধ্বা

বিবৃতং সদ্ম নচিকেতসং মন্যে।। ১/২/১৩

“মানুষ এই (আত্মতত্ত্ব) শুনে এবং সম্যক উপলব্ধি করে, ধর্মতত্ত্ব অনুসারে শরীরের থেকে পৃথক এই সূক্ষ্ম আত্মাকে (নিজের শরীরেই) অনুভব করে। পরম আনন্দময় এই আত্মাকে লাভ করে সেই ব্যক্তিও আনন্দিত হয়। আমি মনে করি, নচিকেতার জন্য (ব্রহ্মরূপ) ভবনের দ্বার উন্মুক্তই রয়েছে”।      

 

অন্যত্র ধর্মাদন্যত্রাধর্মাদন্যত্রাস্মাৎ কৃতাকৃতাৎ।

অন্যত্র ভূতাচ্চ ভব্যাচ্চ যৎ তৎ পশ্যসি তদ্বদ।।

১/২/১৪

অন্যত্র ধর্মাৎ অন্যত্র অধর্মাৎ অন্যত্র অস্মাৎ কৃত- অকৃতাৎ।

অন্যত্র ভূতাৎ চ ভব্যাৎ চ যৎ তৎ পশ্যসি তৎ বদ।।

১/২/১৪

(নচিকেতা বললেন) “ধর্ম থেকে ভিন্ন, অধর্ম থেকে ভিন্ন, সকল কার্য-কারণ থেকেও ভিন্ন, (এমন কী) অতীত, (বর্তমান) এবং ভবিষ্যৎ থেকেও পৃথক যে বিষয় আপনি দেখেছেন, আমাকে সেই তত্ত্ব বলুন”।   

 

সর্ব বেদা যৎ পদমামনন্তি

তপাংসি সর্বাণি চ যদ্‌ বদন্তি।

যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে

পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি –ওমিত্যেতৎ।। ১/২/১৫

সর্ব বেদাঃ যৎ পদম্‌ আমনন্তি

তপাংসি সর্বাণি চ যৎ বদন্তি।

যৎ ইচ্ছন্তঃ ব্রহ্মচর্যম্‌ চরন্তি তৎ তে

পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি –ওম্‌ ইতি তৎ।। ১/২/১৫

(রাজা যম বললেন) “সকল বেদ যে পরমপদের কথা নিশ্চিতভাবে বর্ণনা করে, সকল তপস্যায় যাঁর উপলব্ধি উচ্চারিত হয়, যাঁকে লাভ করার জন্যে লোক ব্রহ্মচর্য আচরণ করে, আমি সেই পরমপদ লাভের কথাই তোমাকে সংক্ষেপে বলছি – তিনিই ওঁ”।

[ ওঁ এই শব্দ বা অক্ষরটি ব্রহ্মের নাম এবং প্রতীক, “ওঁ” শব্দে ব্রহ্মকেই বোঝায় - এই শব্দটিকেই প্রণব বলা হয়।]    

 

এতদ্ধ্যেবাক্ষরং ব্রহ্ম

এতদ্ধ্যেবাক্ষরং পরম্‌।

এতদ্ধ্যেবাক্ষরং জ্ঞাত্বা

যো যদিচ্ছতি তস্য তৎ।। ১/২/১৬

এতৎ হি এব অক্ষরং ব্রহ্ম

এতৎ হি এব অক্ষরং পরম্‌।

এতৎ হি এব অক্ষরং জ্ঞাত্বা

যঃ যৎ ইচ্ছতি তস্য তৎ।। ১/২/১৬

“এই অক্ষরই ব্রহ্ম, এই অক্ষরই পরম। এই অক্ষরকে উপলব্ধি করে, যার যেমন ইচ্ছা তেমনই হয়ে থাকে”।

 

এতদালম্‌বনং শ্রেষ্ঠমেতদালম্‌বনং পরম্‌।

এতদালম্‌বনং জ্ঞাত্বা ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।।

                  ১/২/১৭

এতৎ আলম্‌বনম্‌ শ্রেষ্ঠম্‌ এতৎ আলম্‌বনম্‌ পরম্‌।

এতৎ আলম্‌বনম্‌ জ্ঞাত্বা ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।।

                    ১/২/১৭

“এই অক্ষর (ব্রহ্মলাভের) শ্রেষ্ঠ উপায়, এই অক্ষর পরমপদের আশ্রয়, এই অক্ষরের সাধনায় ব্রহ্মস্বরূপে মহীয়ান হওয়া যায়”।  

 

ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্‌

নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।। ১/২/১৮

ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিৎ

ন অয়ং কুতঃ চিৎ ন বভূব কশ্চিৎ।

অজঃ নিত্যঃ শাশ্বতঃ অয়ং পুরাণঃ

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।। ১/২/১৮

“এই ব্রহ্মরূপ আত্মচেতনার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। এই আত্মাকে কেউ সৃষ্টি করেনি, এই আত্মাও কাউকে সৃষ্টি করেন না। শরীরের বিনাশ হলেও, জন্মহীন, নিত্য, শাশ্বত এবং সনাতন এই আত্মা বিনষ্ট হন না”।

[এই শ্লোকটি ও গীতার সাংখ্য যোগের (দ্বিতীয় অধ্যায়ের) কুড়িতম শ্লোকটি প্রায় অভিন্ন। এরকম অনেক সাদৃশ্য থেকেই পণ্ডিতেরা নির্দিষ্ট করেন যে উপনিষদ বা বেদান্ত দর্শনের থেকেই শ্রীমদ্ভাগবত গীতার সৃষ্টি।]        

 

হন্তা চেন্মন্যতে হন্তুং হতশ্চেন্মন্যতে হতম্‌।

উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।

১/২/১৯

হন্তা চেৎ মন্যতে হন্তুম্‌ হতঃ চেৎ মন্যতে হতম্‌।

উভৌ তৌ ন বিজানীতো না অয়ং হন্তি ন হন্যতে।।

১/২/১৯

“ঘাতক মনে করে আমি হত্যা করলাম, মৃত মনে করে আমি মারা গেলাম, দুজনের কেউই জানে না, এই আত্মা কাউকে হত্যা করতে পারে না এবং নিজেও নিহত হন না”। 

 

অণোরণীয়ান্‌ মহতো মহীয়ান্‌

আত্মাঽস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম্‌।

তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো

ধাতুপ্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ।। ১/২/২০

অণোঃ অণীয়ান্‌ মহতঃ মহীয়ান্‌

আত্মা অস্য জন্তোঃ নিহিতঃ গুহায়াম্‌।

তম্‌ অক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকঃ

ধাতুপ্রসাদাৎ মহিমানম্‌ আত্মনঃ।। ১/২/২০

“সূক্ষ্ম থেকেও অনেক সূক্ষ্ম, মহানের থেকেও অনেক ব্যাপ্ত এই আত্মা জীবের দেহগুহায় অবস্থান করেন। সকল প্রবৃত্তির নিরসনে নিষ্কাম ব্যক্তি, যখন এই আত্মার ব্যপ্তমহিমা উপলব্ধি করেন, তিনি সকল দুঃখশোকের ঊর্ধে অবস্থান করেন”।     

 

আসীনো দূরং ব্রজতি শয়ানো যাতি সর্বত্রঃ।

কস্তং মদামদং দেবং মদন্যো জ্ঞাতুমর্হতি।। ১/২/২১

আসীনঃ দূরম্‌ ব্রজতি শয়ানঃ যাতি সর্বত্রঃ।

কঃ তম্‌ মদ-অমদম্‌ দেবম্‌ মৎ-অন্যঃ জ্ঞাতুম্‌ অর্হতি।।

১/২/২১

“(আত্মা) উপবিষ্ট অবস্থাতেও দূরে ভ্রমণ করতে পারেন, শায়িত অবস্থাতেও সর্বত্র যেতে পারেন। সেই আনন্দময় অথচ নিরানন্দ আত্মাকে আমাদের মতো কয়েকজন বিবেকী ব্যক্তি ছাড়া কে উপলব্ধি করতে পারবে?”

 

অশরীরং শরীরেষ্বনবস্থেষ্ববস্থিতম্‌।

মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি।। ১/২/২২

অশরীরং শরীরেষু অনবস্থেষু অবস্থিতম্‌।

মহান্তম্‌ বিভুম আত্মানং মত্বা ধীরঃ ন শোচতি।।

১/২/২২

“নানান দেহে অশরীরী রূপে অবস্থিত, অনিত্য বিষয়ে নিত্য রূপে বিরাজিত, এই সুমহান ও সর্বব্যাপী আত্মাকে যে ধীমান ব্যক্তি নিজের স্বরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁকে কোনদিন আর শোক করতে হয় না”।

   

নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো

ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।

যমবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ

আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্‌।। ১/২/২৩

ন অয়ম্‌ আত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ

ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।

যম্‌ এব এষঃ বৃণুতে তেন লভ্যঃ তস্য এষঃ

আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্‌।। ১/২/২৩

“এই আত্মাকে শাস্ত্রবচনে লাভ করা যায় না, তীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে কিংবা অনেকের মুখে শুনেও লাভ করা যায় না। এই আত্মা যে সাধককে অনুগ্রহ করেন, সেই সাধকই তাঁকে জানতে পারেন, তাঁর কাছেই তিনি নিজের পরমার্থ স্বরূপ প্রকাশ করেন”। 

 

নাবিরতো দুশ্চরিতান্নাশান্তো নাসমাহিতঃ।

নাশান্তমনসো বাঽপি প্রজ্ঞানেনৈনমাপ্নুয়াৎ।। ১/২/২৪

না বিরতঃ দুশ্চরিতাৎ না শান্তঃ না সমাহিতঃ।

ন অশান্তমনসঃ বা অপি প্রজ্ঞানেন এনম্‌ আপ্নুয়াৎ।।১/২/২৪

“দুষ্কর্ম থেকে যার নিবৃত্তি হয়নি, ইন্দ্রিয়ের প্রবৃত্তি যার শান্ত হয়নি, যার একনিষ্ঠ সাধনা নেই, যার মন সাধনার ফললাভের জন্যে অস্থির, সেই ব্যক্তি শুধুমাত্র জ্ঞান দিয়ে এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না”।

 

যস্য ব্রহ্ম চ ক্ষত্রং চ উভে ভবত ওদনঃ।

মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্র সঃ।। ১/২/২৫

যস্য ব্রহ্ম চ ক্ষত্রম্‌ চ উভে ভবত ওদনঃ।

মৃত্যুঃ যস্য উপসেচনং ক ইত্থা বেদ যত্র সঃ।। ১/২/২৫

“যাঁর কাছে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় অন্নের মতো, মৃত্যু যাঁর কাছে ব্যঞ্জনের মতো, সাধারণ মানুষের পক্ষে এইভাবে তাঁকে উপলব্ধি করা সম্ভব?”

 প্রথম অধ্যায় - দ্বিতীয় বল্লী সমাপ্ত


চলবে... ১/৩ বল্লী আসবে সামনের বুধবার।  


কৃতজ্ঞতাঃ 

উপনিষদঃ শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন 

উপনিষদ গ্রন্থাবলীঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত  

নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...