রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৫

রতনে রতন চেনে

 

বেকার যুবকের কথা বা গল্প অনেক হয়ে গেছে এরপরেও আরো হয়তো হতে থাকবে। কিন্তু বেকার বালকের কথা আমি অন্ততঃ কোনদিন শুনিনি তবে প্রায় মাস তিনেক বেকার জীবনের আস্বাদ উপভোগ করেছিলাম আমার বালক বয়সেই।

আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মর্নিং সেসন ছিল - ক্লাস সিক্স থেকে ডে। কাজেই ক্লাস ফাইভের সিনিয়ার মোস্ট বাচ্চারা, ক্লাস সিক্সে উঠলেই হয়ে যেত জুনিয়ার-মোস্ট বড়। এই বড় হবার একটা আলাদা আমেজ সঞ্চারিত হচ্ছিল আমার মধ্যে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুল ড্রেস পরে বাচ্চাদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে সারাটা দিন বাচ্চাদের মত মায়ের সঙ্গে ঘুর ঘুর করা। আমার ঘুম না আসা দুপুরে মায়ের হাতের মিঠে চাপড়ি খেয়ে ঘুমের অভিনয় করা। মা ঘুমিয়ে পড়লেই সারাটা দুপুর চুপিচুপি বিস্তর উনখুটে কাজ সারা - হোমিওপ্যাথির মিষ্টি মিষ্টি গুলি, শুকনো হরলিকস, ডবল বিস্কুটের মাঝে মাখন চেপে বিস্কুটের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসা মাখন লেহন... অর্থাৎ মকখন চোর, নন্দকিশোর হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছিল না।

ক্লাস সিক্সে উঠলে দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে বড়দের মতো বেরিয়ে যাবো। যেমন বাবাও একটু আগে অফিস বেরোন। বিকেল বেলা বিদ্যের বোঝা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরব, যেমন বাবাও সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন একটু সন্ধ্যের পর। মনে হত - বড় হতে এমন কি আর দেরি, কতটাই বা বাকি আর?

 সে স্বপ্নে বাদ সাধল, যেদিন আমরা ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন নিতে স্কুলে গেলাম। সেটা সত্তর সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তা হবে। রুটিন নিয়েই আমাদের ছুটি হয়ে যাবে সাতদিনের জন্যে - পড়ার ছুটি। তারপর পরীক্ষা, আবার ছুটি, পরের বছর জানুয়ারির দশ এগারো করে রেজাল্ট বেরিয়ে গেলেই নতুন ক্লাস, নতুন বই আর নতুন ধরনের এক বড়সড়ো জীবনের সূত্রপাত।

 অন্যদিন স্কুলের বেশ কিছুদূর থেকেই ছেলেদের চেঁচামেচি আর হৈচৈতে স্কুলকে স্কুল বলে মনে হত। সেদিন একদম চুপচাপ - থমথমে ভাব। শোলে রিলিজ হতে তখনো অনেক দেরি, নাহলে বলা যেত ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায়, ভাইইই?  স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই সিঁড়ির মুখে একটা ব্ল্যাকবোর্ড – চার ঠ্যাং সাপোর্টে দাঁড় করানো, তাতে লেখা

বিশেষ বিজ্ঞপ্তি

এতদ্বারা সকল অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রগণকে জানানো যাইতেছে যে অনিবার্য কারণবশতঃ এবং পঃ বঃ সরকারের মাননীয় শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ অনুসারে বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর পঠনপাঠন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকিবে। সকল শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাও আপাততঃ স্থগিত থাকিবেবিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হইবার তারিখ পঃ বঃ শিক্ষা দপ্তরকর্তৃক সংবাদপত্র ও বেতার মাধ্যমে পরিজ্ঞাত হইবে এবং তদনুসারে স্থগিত সকল বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচী বিদ্যালয় হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে।

অনুমত্যনুসারে

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

 

আমরা মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে নোটিসটা বেশ বার কয়েক পড়ে ফেললাম। যেটুকু বোধগম্য হতে বাকি ছিল অভিভাবকদের আলাপ আলোচনা ও কথাবার্তা থেকে সেটাও বুঝে ফেলা গেল। কিন্তু আমাদের হতভম্ব ভাবটা কাটাতে ভাস্করদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সদাহাস্যমুখ উৎকলবাসী ভাস্করদার আমাদের স্কুলের মেন গেট সামলানোর দায়িত্ব ছিল। বছরের পর বছর আমাদের মতো ছেলেপুলেদের বেয়ারা বায়নাই হোক অথবা বাইরের লোকের উটকো হম্বিতম্বিই হোক ভাস্করদা সবকিছুই সামলাত হাসিমুখে এবং স্কুল চলাকালীন ভাস্করদা ছিল নিশ্ছিদ্র প্রহরী - হেডস্যারের বিনা অনুমতিতে ভেতরের জিনিষ বাইরে অথবা বাইরের জিনিষ ভেতরে আসতে পারত না।

 কিছুটা বাংলা আর অনেকটা ওড়িয়া ভাষায় ভাস্করদা বলেছিল গতকাল স্কুল ছুটির পর - প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, কয়েকজন ছোকরা হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।  কি দরকার জিগ্যেস করাতে তারা কোন এক কলেজের নাম বলেছিল। এমন তো আসেই অনেকে - অন্য স্কুল থেকে, কলেজ থেকে ভাস্করদা গেট খুলে দিয়েছিল। ছেলেগুলো হেডস্যারের ঘরের দিকে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠেছিল সিঁড়িতে। হতচকিত ভাস্করদা তাদেরকে ডেকে কিছু বলার আগেই তারা উঠে গেছে ওপরে। ভাস্করদার সন্দেহ হতে অন্য সবাইকে নিয়ে যখন ওপরে খুঁজতে যায় তাদের সে সময়ে ভিতরের উঠোনের দিক থেকে পর পর দুটো বোমা ফাটার বীভৎস আওয়াজ শুনতে পায়। ওরা বুঝতে পারে আমাদের স্কুল সত্তরের ছাত্র আন্দোলনে আক্রান্ত।

এতদিন আমরা জানতাম না, কোন ঘরে আমাদের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন ছাপা হয়ে সংরক্ষিত হতো। সেদিন জানলাম। কারণ সেই ঘরের দরজাটা ভাঙা এক কব্জায় ঝুলছে। ঘরের ভিতরে বাইরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে পোড়া কাগজের ছাই, আধপোড়া প্রশ্নপত্রের প্যাকেট। ঘরের ভিতরের দেওয়ালে, সিলিংয়ে আগুনের আঁচে কালো কালো ঝলসানো দাগ। ওপরের বারান্দা থেকে ছোঁড়া বোমা ফেটে উঠোনের ঝলসে যাওয়া দাগ দুটোও দেখলাম।

 রোজ স্কুলে এসে বা টিফিনের সময় আমরা ওই উঠোনে লেম-ম্যান খেলতাম। লেম-ম্যান এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। একটা গন্ডির মধ্যে সীমিত থাকত সেই খেলা। গন্ডির বাইরে চলে গেলে বা লেম-ম্যান ছুঁয়ে দিলে যে আউট  হতো সেই হতো পরবর্তী লেম-ম্যান। ছাত্র আন্দোলনের একটা বোমা ফেটেছে আমাদের সেই গন্ডির মাঝখানেই প্রায়।

বারান্দায় ঘরের বাইরের দেওয়ালে স্লোগান লিখে গিয়েছিল তারা। সেখানে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল। ছিল চীনের চেয়ারম্যানকে আপন করে নেবার দায়িত্বপূর্ণ আব্দার। বন্দুকের নলই যে শক্তির একমাত্র উৎস আমাদের সে তথ্য দিতেও তারা ভুল করেনি সেখানে। বিপ্লবের দীর্ঘজীবনের প্রতিও সংশয়ের অবকাশ রাখেনি তারা। সবশেষে তারা লিখে গিয়েছিল একটি ধাঁধা – ‘রতনে রতন চেনে / বিড়লা চেনে জ্যোতি

 কলকাতায় তখন দারুণ টালমাটাল পরিস্থিতি। রোজ শেষ রাত্রে পাড়ায় পুলিশ আসে। তাদের পায়ের ভারি বুটের শব্দে ঘুম ভাঙা চোখে আর ঘুম আসে না। সকালে দুঃসংবাদ কানে আসে। কোন কোন তরুণ কোন কোন যুবক আন্দোলনে যুক্ত সন্দেহে ধৃত। অনেক সময়েই তাদের কোনভাবেই আর হদিশ মেলে না। আমার বাবা আর মা পরামর্শ করে ঠিক করলেন আমাদের বর্ধমানের গ্রামে মামারবাড়িতে পাঠিয়ে দেবার। মাও থাকবেন আমাদের সঙ্গে। বাবা আমাদের পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবা খবর দেবেন এবং আমাদের আবার নিয়ে আসবেন কলকাতায়।

 প্রায় মাস তিনেক থাকতে হয়েছিল মামার বাড়িতেবইখাতার বোঝা নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে, কিন্তু সমস্ত রকমের লেখাপড়াহীন এক বেকার জীবন কাটিয়েছিলাম গ্রাম বাংলায়।    

 একদিন খুব ভোরে আমরা হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরে রওনা দিলাম বর্ধমান। পিছনে পড়ে রইল তপ্ত কলকাতা আর শান্ত শীতল আমার স্কুল। হিন্দু স্কুল। স্থগিত হয়ে গেল আমার চটজলদি বেড়ে ওঠার স্বপ্ন


তখন বুঝিনি আজ বুঝি - অনেক বড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন, প্রতিটি ঘটনায় ঋদ্ধ হচ্ছিল অভিজ্ঞতা। যে পাঠ কোন স্কুলের সিলেবাসে নেই, সেই পাঠ যেন নিজে এসে মেলে ধরছিল তার রহস্য রূপ, শব্দ আর গন্ধ দিয়ে। যে রতন নেই কোনো জহুরির ঘরে, সেই রতন চিনে নেবার দায় এসে পড়ল আমার ছোট্ট দুই কাঁধে।

  -০০-

 

শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৫

সর্ষে ফুল


[গল্পটি সৃষ্টিসুখ প্রকাশনার উদ্যোগে – ৯২.৭ বিগ এফ এম–এর “শীতের মিষ্টি স্টোরিজ”- এ ৩১.০১.২০২২ তারিখে পড়া হয়েছিল। বিভিন্ন ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছিলেনঃ শিউলি – রাই, কাশ – দেবাশীষ, সূত্রধার – রায়ান, আবহ সঙ্গীত – স্বাগত। সাবলীল পাঠে একটা গল্প কতটা শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে সে অভিজ্ঞতা পাবেন পাশের লিংক খুলে গল্পটি শুনতে শুনতে - সর্ষে ফুল ।]


আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতো?”

“যেদিকে দু-চোখ যায়”।

“কিন্তু দু-চোখেরও তো একটা লিমিট আছে – সেটা কোথায়? কদ্দূর”?

“তোকে তো বলেইছিলাম, এবারের পঁচিশ-তারিখটা আলাদা রকম কাটাবো। টুনিবাল্ব-জ্বলা শিং নিয়ে পার্কস্ট্রিট নয়। কিংবা কোন মলও নয়, যেখানে ঢুকলেই কিছু-মিছু কিনতে তুই ছটফট করিস”।

“শহর ছেড়ে হাইওয়েতে গাঁগাঁ বাইক হাঁকিয়ে তুই যে আমাকে মলে তুলবি না, সে আমি বুঝেছি। কিন্তু যাচ্ছিটা কোথায়?”

“আমার সঙ্গে এভাবে এতদূরে যেতে... ভয় পাচ্ছিস, না?”

“এখানে ভয়? কেন? তোকে নিয়ে মলে ঢুকতেই বরং আমার ভয় লাগে। কিছু একটা জিনিষ আমার মনে ধরলেই, তুই এমন একখানা মুখ করিস না? যেন শীতের রাতে তোর কম্বলে আমি জল ঢেলে দিয়েছি”।

“হা-হা-হা, অতটা না হলেও কতকটা ঠিকই বলেছিস”।

“তুই এত্তো... এত্তো কিপটে, জানি না, তোকে নিয়ে আমি ঘর করবো কী করে?”

“তুলকালাম করবি রোজ। ছাদে যেন একটাও কাক-চিল বসতে না পারে। শুনেছি ঝগড়ুটি মেয়েদের হার্টের ব্যারাম হয় না”।

দুহাতে কাশের পেট জড়িয়ে ঘনিষ্ঠ বসেছিল শিউলি। কাশের পেটে একটা চিমটি কাটল, কিন্তু জ্যাকেট- জামার পরত পার হয়ে সেটা কাশের ত্বক পর্যন্ত পৌঁছোলো না। চিমটিটা ফল্‌স্‌ হয়ে যাওয়াতে শিউলি একটু রেগেই গেল, চেঁচিয়ে বলল, “মুখপোড়া, তুই আমাকে ঝগড়ুটি বললি, তোর এত্তবড়ো সাহস?”

কাশ বাইকের স্পিড কমিয়ে হাইওয়ের ধারে ঘেসোজমিতে দাঁড় করাল, চারদিক দেখে বলল, “মনে হচ্ছে, এসে গেছি, চল এবার নিচেয় নামব...”। শিউলি মাটিতে নেমে পড়েছিল, মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াও, হলদে রঙের ওগুলো কী ফুল রে? গোটা মাঠ জুড়ে কী সুন্দর ফুটে রয়েছে? দারুণ, না!”

“আহাঃ নেমে পড়লি কেন? বললাম না, নিচেয় নামব। ওগুলো কী ফুল তোর না জানলেও চলবে, বিয়ের পর তুই সারা জীবন আমাদের ঘরে ওই ফুলই অজস্র ফোটাবি..! ওঠ উঠে আয়, আলপথে যাবো, খুব ঝাঁকুনি হবে, ভালো করে চেপে ধরিস”। শিউলি বাইকে আবার উঠে বসতে বসতে বলল, “আজকাল তুই বড্ডো ট্যাঁকট্যাঁকে  কথা শিখেছিস, কী ফুল ওগুলো বললি না তো”?

শিউলি ঠিকঠাক বসার পর, কাশ খুব সাবধানে প্রথম গিয়ারে বাইক নামিয়ে দিল হাইওয়ে থেকে ক্ষেতের আলপথে। তারপর দ্বিতীয় গিয়ারে এবড়ো খেবড়ো আলপথ ধরে চলতে লাগল। দুপাশের হলুদ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে, শিউলি কাশের কোমর ছেড়ে, পাখির ডানার মতো দু হাত ছড়িয়ে আনন্দে বলল, “ওয়াও, মনে হচ্ছে যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলেছি”।

কাশ মজা করে বলল, “বেশি স্বপ্ন দেখিস না, বাইক থেকে ধপাস হলে, কোমরে বড্ডো নাগবে গো, খুকুমণি”। শিউলি এবার চিমটি কাটল কাশের উরুতে, ট্রাউজারের দুর্বল প্রতিরোধ ভেদ করে এবার কাশের ব্যথা লাগল। একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ কী হচ্ছে কি? বাইকে বসে এয়ারকি করবি না”।

“আর তুই যে সেই থেকে যা খুশি বলে যাচ্ছিস, তার বেলা?”

খেতের আলপথ শেষ হল, বাঁধের নিচে। সেখানেই বাইক স্ট্যাণ্ড করিয়ে কাশ বলল, “চলে এসেছি, এবার নেমে পড়”। হেলমেট দুটো ঝুলিয়ে দিল ক্লাচারে। তারপর শিউলির হাত ধরে উঠতে লাগল বাঁধের ওপর। শিউলি বলল, “তুই এখনও কিন্তু বললি না, অমন সুন্দর হলুদ ফুলগুলো কী ফুল?”

“ওগুলো সর্ষেফুল”।

অবাক হয়ে শিউলি বলল, “ওঃমা, তাই – সর্ষেফুলের কথা অনেক শুনেছি...আজ প্রথম দেখলাম...” তারপরেই বেশ গম্ভীর হয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আমি বিয়ের পর তোকে রোজ সর্ষেফুল দেখাবো, হতচ্ছাড়া? বেশ করবো। দেখাবোই তো!”

কাশ হাসতে হাসতে শিউলির হাতটা আবার নিজের হাতে নিয়ে বাঁধের ওপরে উঠে দু হাত ছড়িয়ে বলল, “এইবার চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখ, খেপি, কোন স্বপ্নরাজ্যে তোকে এনে ফেলেছি! শান্ত নিবিড় এই সমস্ত রঙ তোর দু চোখে বসত করুক আজীবন”।

শিউলি আশ্চর্য হয়ে দেখছিল – সোনালী রোদ্দুরে মাখা উজ্জ্বল নীল আকাশ, তুলির হালকা টানে বয়ে চলা সব্‌জে নদী, তার দুপাড়ের নিবিড় সবুজ গাছপালা আর পিছনে বিছানো পীত পুষ্পপ্রান্তর..। আনন্দে আবেগে শিউলি বলল, “কাশ, কাশ, কাশ...এমন একটা কিউট জায়গা আমাদের এত কাছেই রয়েছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না! তুই আমাকে এমন করেই বারবার অবাক করে দিবি তো, কাশ, সারাটা জীবন?”

“দেব, তবে একটা শর্তে”।

“কী?” মুখ তুলে কাশের চোখের দিকে তাকাল শিউলি।

“আমাদের ঘরে আমার চোখের সামনে রোজ এমন অজস্র সর্ষেফুল যদি ফোটাতে পারিস, তবেই...”।

লাজুক হেসে শিউলি কাছে এসে কাশের বুকে কিল মারল আদরে, বলল, “অসভ্য”।

কাশ হাসতে হাসতে বুকে চেপে ধরল তার খেপিটাকে।  


...০০...



শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৫

কঠোপনিষদ - ২/৩ (শেষ পর্ব)

  দ্বিতীয় অধ্যায়

তৃতীয় বল্লী

 

ঊর্ধ্বমূলোঽবাক্‌শাখ এষোঽশ্বত্থঃ সনাতনঃ।

তদেব শুক্রং তদ্‌ব্রহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে।

তস্মিঁল্লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তদু নাত্যেতি কশ্চন।

এতদ্বৈ তৎ।। ২/৩/১

ঊর্ধ্বমূলঃ অবাক্‌শাখ এষঃ অশ্বত্থঃ সনাতনঃ।

তৎ এব শুক্রম্‌ তৎ-ব্রহ্ম তৎ এব অমৃতম্‌ উচ্যতে।

তস্মিন্‌ লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তৎ উ ন অত্যেতি কঃ চন। এতৎ বৈ তৎ।।

এই সংসার সনাতন এক অশ্বত্থ বৃক্ষের মতো, যার মূল ঊর্ধে (বিষ্ণুপদ) এবং শাখাসমূহ নিম্নমুখী। সেই মূলই শুদ্ধ, সেই মূলই ব্রহ্ম, সেই মূলকেই অমৃত বলা হয়। সর্বলোক তাঁর পদমূলেই আশ্রিত, তাঁকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না। ইনিই সেই ব্রহ্ম।   

[গীতার পঞ্চদশ অধ্যায় – পুরুষোত্তমযোগের প্রথম চারটি শ্লোকে কঠোপনিষদের এই শ্লোকটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে - তাঁর সেই ব্যাখ্যার চারটি শ্লোকের সারাংশ এইরকমঃ-  

"শ্রীভগবান বললেন- জ্ঞানীজনেরা বলেন এই সংসার যেন একটি অক্ষয় অশ্বত্থ বৃক্ষ, যার ঊর্ধে শিকড় আর নিচেয় শাখা প্রশাখা, চারবেদ যেন এই বৃক্ষের পাতা। এই বৃক্ষটির স্বরূপ যিনি বোঝেন, তিনিই বেদজ্ঞ। এই বৃক্ষের শাখা প্রশাখা ত্রিগুণের প্রভাবে বেড়ে উঠে বিষয়রূপ পল্লব হয়ে নীচের থেকে উপর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আবার ঊর্ধের মূলসমূহ মানুষের সুকর্ম এবং কুকর্মের ফলস্বরূপ নীচের দিকেও প্রসারিত হয়ে থাকে। ইহলোকে সংসাররূপ এই অশ্বত্থের রূপ সঠিক উপলব্ধি করা যায় না, কারণ এই বৃক্ষের শেষ নেই, শুরু নেই, এমনকি মধ্যবর্তী স্থিতাবস্থাও নেই। এই বদ্ধমূল অশ্বত্থবৃক্ষকে বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রে কেটে ফেলার পর, যে ব্রহ্মপদ লাভ করলে সংসারে আর ফিরে আসতে হয় না, সেই পরম ব্রহ্মপদের অন্বেষণ করা উচিৎ। আমি সেই আদি পরমব্রহ্মপুরুষেরই শরণাপন্ন হই, যাঁর থেকে এই চিরন্তনী সংসার-প্রবৃত্তি প্রবাহিত হয়ে চলেছে।"]

 

যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্‌।

মহদ্ভয়ং বজ্রমুদ্যতং য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।। ২/৩/২

যৎ ইদম্‌ কিম্‌ চ জগৎ সর্বম্‌ প্রাণঃ এজতি নিঃসৃতম্‌।

মহৎ ভয়ম্‌ বজ্রম্‌ উদ্যতং যঃ এতৎ বিদুঃ অমৃতাঃ তে ভবন্তি।

এই যা কিছু চরাচর জগৎসকল, তাঁর প্রাণরূপ থেকেই নিঃসৃত হয়ে স্পন্দিত হচ্ছে। তিনি উদ্যতবজ্র পুরুষের মতো মহা ভয়ংকর, এই ব্রহ্মকে যিনি জানতে পারেন, তিনিই অমৃতত্ব লাভ করেন।    

 

ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্যঃ।

ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।। ২/৩/৩

ভয়াৎ অস্য অগ্নিঃ তপতি ভয়াৎ তপতি সূর্যঃ।

ভয়াৎ ইন্দ্রঃ চ বায়ুঃ চ মৃত্যুঃ ধাবতি পঞ্চমঃ।।

তাঁর ভয়েই অগ্নি তাপ দেয়, তাঁর ভয়েই সূর্য কিরণ দেয়, তাঁর ভয়েই ইন্দ্র, বায়ু এবং পঞ্চমস্থানীয় মৃত্যু নিজ নিজ কাজে ব্যাপৃত থাকেন। 

 

ইহ চেদশকদ্‌ বোদ্ধুং প্রাক্‌ শরীরস্য বিস্রসঃ।

ততঃ সর্গেষু লোকেষু শরীরত্বায় কল্পতে।। ২/৩/৪

ইহ চেৎ শকৎ বোদ্ধুং প্রাক্‌ শরীরস্য বিস্রসঃ।

ততঃ সর্গেষু লোকেষু শরীরত্বায় কল্পতে।।

এই দেহ বিনাশের আগেই যদি কেউ তাঁকে জানতে সক্ষম হন (তিনি বিমুক্ত হন), তা না হলে সেই অজ্ঞানতার কারণে এই পৃথিবীতে অথবা অন্যান্য লোকে বার বার জন্মাতে হয়।  

 

যথাদর্শে তথাত্মনি যথা স্বপ্নে তথা পিতৃলোকে।

যথাপ্সু পরীব দদৃশে তথা গন্ধর্বলোকে

ছায়া তপয়োরিব ব্রহ্মলোকে।। ২/৩/৫

যথা আদর্শে তথা আত্মনি যথা স্বপ্নে তথা পিতৃলোকে।

যথা অপ্সু পরি ইব দদৃশে তথা গন্ধর্বলোকে

ছায়া আতপয়ঃ ইব ব্রহ্মলোকে।।

আত্মা জীবের নির্মল চিত্তে, আয়নায় দেখা মুখের মতো প্রতিবিম্বিত হয়, পিতৃলোকে স্বপ্নে দেখার মতো অস্পষ্ট, গন্ধর্বলোকেও জলে দেখা ছায়ার মতো। শুধু ব্রহ্মলোকেই আত্মা ছায়া ও রৌদ্রের মতো সুস্পষ্ট।    

 

ইন্দ্রিয়াণাং পৃথগ্‌ভাবমুদয়াস্তময়ৌ চ যৎ।

পৃথগুৎপদ্যমানানাং মত্বা ধীরো ন শোচতি।। ২/৩/৬

ইন্দ্রিয়াণাম্‌ পৃথক্‌ ভাবম্‌ উদয়-অস্তময়ৌ চ যৎ।

পৃথক্‌ উৎপদ্যমানানাং মত্বা ধীরঃ ন শোচতি।।

জীবের ইন্দ্রিয়সমূহ পঞ্চভূত থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তাদের ভাব আত্মার থেকে পৃথক, এই তত্ত্ব জেনে ব্রহ্মনিষ্ঠ জ্ঞানীরা তাদের সৃষ্টি অথবা লয় নিয়ে শোক করেন না।

[পঞ্চইন্দ্রিয় অর্থাৎ কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও নাক, পঞ্চভূত অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, তেজ, জল ও ক্ষিতি থেকে যথাক্রমে সৃষ্টি হয়। অতএব পঞ্চভূতের সঙ্গে পঞ্চইন্দ্রিয়েরও সৃষ্টি ও বিনাশ আছে।]

 

ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ মনসঃ সত্ত্বমুত্তমম্‌।

সত্ত্বাদধি মহানাত্মা মহতোঽব্যক্তমুত্তমম্‌।। ২/৩/৭

ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরম্‌ মনঃ মনসঃ সত্ত্ব্ম্‌ উত্তমম্‌।

সত্ত্বাৎ অধি মহান্‌-আত্মা মহতঃ অব্যক্তম্‌ উত্তমম্‌।।

ইন্দ্রিয়সমূহের থেকে মন শ্রেষ্ঠ, মনের থেকে সত্ত্বা অর্থাৎ বুদ্ধি উত্তম, সত্ত্বার থেকে আত্মা মহান, কিন্তু আত্মার থেকেও অব্যক্ত অর্থাৎ মায়া উত্তম।

 

অব্যক্তাত্তু পরঃ পুরুষো ব্যাপকোঽলিঙ্গ এব চ।

যং জ্ঞাত্বা মুচ্যতে জন্তুরমৃতত্বং চ গচ্ছতি।। ২/৩/৮

অব্যক্তাৎ তু পরঃ পুরুষঃ ব্যাপকঃ অলিঙ্গঃ এব চ।

যম্‌ জ্ঞাত্বা মুচ্যতে জন্তুঃ অমৃতত্বম্‌ চ গচ্ছতি।।

সর্বব্যাপ্ত অথচ নির্গুণ যে পরমাত্মাকে জানলে জীব সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয় ও অমৃতত্ব লাভ করে, সেই পরমপুরুষ অব্যক্তের থেকেও উত্তম।

[আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নানান লক্ষণ বিচার করে, সকল বিষয়কে চিহ্নিত করতে পারি, আত্মার কোন লক্ষণ নেই, তাঁর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন গুণ নেই, তিনি নির্গুণ, তিনি অলিঙ্গঃ।]

 

 

ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য, ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্‌।

হৃদা মনীষা মনসাভিক্লৃপ্তো য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।। ২/৩/৯

ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপম্‌ অস্য, ন চক্ষুষা পশ্যতি কঃ চন এনম্‌।

হৃদা মনীষা মনসা অভিক্লৃপ্তো য এতৎ বিদুঃ অমৃতাঃ তে ভবন্তি।।

তাঁর প্রকৃত স্বরূপ আমাদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির বিষয় নয়, চোখ দিয়ে আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। আমাদের নির্মল হৃদয়ের অনুভূতিতে, নিঃসন্দিগ্ধ জ্ঞানে, শুদ্ধ মনে তিনি প্রকাশিত হন। তাঁকে যিনি জানতে পারেন, তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন।     

 

যদা পঞ্চাবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।

বুদ্ধিশ্চ ন বিচেষ্টতি তামাহুঃ পরমাং গতিম্‌।। ২/৩/১০

যদা পঞ্চ অবতিষ্ঠন্তে জ্ঞানানি মনসা সহ।

বুদ্ধিঃ চ ন বিচেষ্টতি তাম্‌ আহুঃ পরমাম্‌ গতিম্‌।। ২/৩/১০

যে অবস্থায় মনের সঙ্গে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় নিশ্চল অবস্থান করে, বুদ্ধিও স্বতন্ত্র বিষয়ে প্রবৃত্ত হয় না, সেই অবস্থাকে পণ্ডিতগণ পরমাগতি বলেন। 

 

তাং যোগমিতি মন্যন্তে স্থিরামিন্দ্রিয়ধারণাম্‌।

অপ্রমত্তস্তদা ভবতি যোগো হি প্রভবাপ্যয়ৌ।। ২/৩/১১

তাম্‌ যোগম্‌ ইতি মন্যন্তে স্থিরাম্‌ ইন্দ্রিয়ধারণাম্‌।

অপ্রমত্তঃ তদা ভবতি যোগঃ হি প্রভবাপ্যয়ৌ।।

এই অচঞ্চল ইন্দ্রিয়ধারণাকে যোগীগণ যোগ মনে করেন, সেই সময় সমাহিত ভাব উপস্থিত হয়। (কিন্তু সর্বদা নয়, কারণ) যোগভাবেরও বিকাশ ও বিনাশ আছে।  

 

নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা।

অস্তীতি ব্রুবতোঽন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে।। ২/৩/১২

ন এব বাচা ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা।

অস্তি ইতি ব্রুবতঃ অন্যত্র কথম্‌ তৎ উপলভ্যতে।।

পরমাত্মাকে কথায় জানা যায় না, মন দিয়ে কিংবা চোখ দিয়েও জানতে পারা যায় না। “তিনি আছেন” এই কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা ছাড়া অন্য লোক তাঁকে কী ভাবে উপলব্ধি করবে?

 

অস্তীত্যেবোপলব্‌ধব্যস্তত্ত্বভাবেন চোভয়োঃ ।

অস্তীত্যেবোপলব্‌ধস্য তত্ত্বভাবঃ প্রসীদতি।। ২/৩/১৩

অস্তি ইতি এব উপলব্ধব্যঃ তত্ত্বভাবেন চ উভয়োঃ ।

অস্তি ইতি এব উপলব্ধস্য তত্ত্বভাবঃ প্রসীদতি।।

তিনি আছেন” এই ভাবে তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে, তত্ত্বভাবেও তাঁকে উপলব্ধি করতে হবে। এই উভয় ভাবেই “তিনি আছেন” এই তত্ত্বটি যিনি উপলব্ধি করেছেন, তাঁর কাছে ব্রহ্মের স্বরূপ প্রকাশিত হয়।

[আত্মাকে প্রথমে “সৎ” অর্থাৎ বুদ্ধি ও মনের উপাধিযুক্ত ভাবেই উপলব্ধি করতে হবে, এই ভাবকে আত্মার সোপাধিক ভাব বলা হয়। আত্মার উপাধিহীন বিকারহীন যে ভাব, তাকেই তত্ত্বভাব অথবা নিরুপাধিক ভাব বলা হয়। এই উভয় ভাবের মধ্যে প্রথমতঃ সোপাধিক ভাবে আত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধি করার পর, তাঁর নিরুপাধিক তত্ত্বভাবের উপলব্ধি আসে। (শংকরভাষ্য)]      

 

 

যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেঽস্য হৃদি শ্রিতাঃ।

অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।। ২/৩/১৪

যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যে অস্য হৃদি শ্রিতাঃ।

অথ মর্ত্যঃ অমৃতঃ ভবতি অত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।।

মানুষের মনে আশ্রিত যত কামনা যখন মন থেকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়, তখনই মরণশীল মানুষের অমৃতলাভ হয়, তখন এই দেহেই ব্রহ্মের উপলব্ধি আসে। 

 

যদা সর্বে প্রভিদ্যন্তে হৃদয়েস্যেহ গ্রন্থয়ঃ।

অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবত্যেতাবদ্ধ্যনুশাসনম্‌।। ২/৩/১৫

যদা সর্বে প্রভিদ্যন্তে হৃদয়েস্য ইহ গ্রন্থয়ঃ।

অথ মর্ত্যঃ অমৃতঃ ভবতি এতাবৎ হি অনুশাসনম্‌।।

এই জীবনেই মনের সকল বন্ধন যখন নিঃশেষে ছিন্ন হয়, তখন মরণশীল মানুষ অমৃতলাভ করে, সকল বেদান্তের এই উপদেশ।

 

শতঞ্চৈকা চ হৃদয়স্য নাড্যস্তাসাং মূর্ধানমভিনিঃসৃতৈকা

তয়োর্ধ্বমায়ন্নমৃতত্বমেতি বিষ্বঙ্‌ঙন্যা উৎক্রমণে ভবন্তি।।

২/৩/১৬

শতম্‌ চ একা চ হৃদয়স্য নাড্যঃ তাসান্‌  মূর্ধানম্‌ অভিনিঃসৃতা একা।

তয়া ঊর্ধ্বম্‌ আয়ন্‌ অমৃ্তত্বম্‌ এতি বিষ্বক্‌ অন্যাঃ উৎক্রমণে ভবন্তি।।

মানুষের হৃদয় থেকে নিঃসৃত একশত এক নাড়ি আছে। তার মধ্যে একটি নাড়ি (সুষুম্না) মূর্ধা (ব্রহ্মরন্ধ্র) ভেদ করে বের হয়েছে। মৃত্যুকালে সাধক এই নাড়িপথে ঊর্ধে উঠে অমৃতত্ত্ব লাভ করে, কিন্তু অন্যান্য নাড়ি পথে সংসার-গতি পায়।    

 

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ  পুরুষোঽন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।

তং স্বাচ্ছরীরাৎ প্রবৃহেন্মুঞ্জাদিবেষীকাং ধৈর্যেণ।

তং বিদ্যাচ্ছুক্রমমৃতং তং বিদ্যাচ্ছুক্রমমৃতমিতি।। ২/৩/১৭

অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ  পুরুষঃ অন্তরাত্মা সদা জনানাম্‌ হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।

তম্‌  স্বাৎ শরীরাৎ প্রবৃহেৎ মুঞ্জাৎ ইব ইষীকাং ধৈর্যেণ।

তম্‌ বিদ্যাৎ শুক্রম্‌ অমৃতম্‌ তম্‌ বিদ্যাৎ শুক্রম্‌ অমৃতম্‌ ইতি।।

অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ অন্তরাত্মা পুরুষ সকলের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থান করছেন। মুঞ্জ ঘাসের মধ্যে একটি শীষের মতো তাঁকে নিজের শরীর থেকে সংযত হয়ে পৃথক করবে। এইভাবেই তাঁকে শুদ্ধ অমৃতব্রহ্ম  জানবে, ইনিই সেই শুদ্ধ অমৃত ব্রহ্ম।

 

মৃত্যুপ্রোক্তাং নচিকেতোঽথ লব্‌ধ্বা

বিদ্যামেতাং যোগবিধিং চ কৃৎস্নম্‌।

ব্রহ্মপ্রাপ্তো বিরজোঽভূদ্বিমৃত্যুরন্যোঽপ্যেবং

যো বিদধ্যাত্মমেব।। ২/৩/১৮

মৃত্যুপ্রোক্তাং নচিকেতঃ অথ লব্‌ধ্বা

বিদ্যাম্‌ এতাম্‌ যোগবিধিম্‌ চ কৃৎস্নম্‌।

ব্রহ্মপ্রাপ্তঃ বিরজঃ অভূৎ বিমৃত্যুঃ অন্যঃ অপি এবং

যঃ বিৎ অধ্যাত্মম্‌ এব।।

এরপর যমরাজের বলা এই ব্রহ্মবিদ্যা এবং সম্পূর্ণ যোগবিধি জেনে, নচিকেতা ব্রহ্মকে লাভ করলেন এবং নির্মল চিত্ত হয়ে অমৃতত্ব লাভ করলেন। অন্য যে কেউ যদি এইভাবে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি করেন, তিনিও একই ফল লাভ করেন। 

 

সমাপ্ত দ্বিতীয় অধ্যায় – তৃতীয় বল্লী

 

ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নাবধীতমস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

ওঁ সহ নৌ অবতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নৌ অধীতম্‌ অস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

আমাদের দুজনকে তিনি সমভাবে রক্ষা করুন, দুজনকেই সমভাবে (জ্ঞান) লাভ করান, আমাদের উভয়কেই (জ্ঞানলাভের) উপযুক্ত করে তুলুন। আমাদের উভয়ের কাছেই লব্ধজ্ঞান যেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। (আমরা যেন পরষ্পরের প্রতি) বিদ্বেষ না করি।  ওঁ শান্তি, সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।


  সমাপ্ত কঠোপনিষদ 

..০০..

কৃতজ্ঞতাঃ 

উপনিষদঃ শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন 

উপনিষদ গ্রন্থাবলীঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত  


বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৩


আগের পর্বটি পড়তে এই সূত্রে ক্লিক করুন - সুরক্ষিতা - পর্ব ১২

 

 

বিতান “একান্ত সহায়”-এ চলে গেছে প্রায় মাস চারেক হতে চলল। প্রথম প্রথম শুভময়ীদেবী খুব দুশ্চিন্তা করতেন। কে জানে ওরা কিভাবে ট্রিট করবে তাঁর বিট্টুকে। আজকাল মার্কেটিংযের যুগ, অ্যাডমিশানের সময় সকলেই বড়ো বড়ো প্রমিস আর স্বপ্ন বিক্রি করে, কিন্তু আসল সময়ে বেরিয়ে পড়ে লুকিয়ে রাখা নখ আর দাঁত। ভাগ্য ভালো “একান্ত সহায়”-এ সে রকম কিছু ঘটেনি। এই মাস চারেক ওদের অ্যাটিটিউড আর পারফর্ম্যান্সে শুভময়ী দেবী খুশি। তিনি খুশি বিট্টু এখন অনেকটাই ভালো আছে, বাড়িতে সে যেরকম খুব ইরিটেটেড থাকত কিংবা মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠত, সেটা এখন আর নেই। তার মতো আরো যে নানান বয়সের ছেলে মেয়েরা ওখানে থাকে, তাদের সঙ্গে গড়ে তুলতে পেরেছে সখ্যের সম্পর্ক।

তিনি আরও খুশী এই ভেবে যে, বিট্টুর ব্যাপারে তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তে কোন ভুল হয়নি। তিনি শুনেছেন বিট্টুর বাবা মাস খানেক আগে বিট্টুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল “একান্ত সহায়”-এবিট্টুর বাবা কলকাতায় এসেছিল, কিন্তু বাড়িতে আসেনি, কোন খবর দেওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করেনি। তাঁর একার দায়িত্বে নেওয়া সিদ্ধান্তে যদি বিট্টুর কোন ক্ষতি হতো, বিতানের বাবা তাঁকে ছেড়ে কথা বলতো না। তাঁর এই সিদ্ধান্ত তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দু-দুটো সত্যের মুখোমুখি। এক, তাঁর বিট্টু ভালোই থাকবে। দু্‌ই, বিট্টুর বাবার সঙ্গে তাঁর শীতল সম্পর্কের দূরত্ব বহু যোজন বেড়ে এমন জায়গায় পৌঁছোলো, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা আর না খোঁজাই ভাল।

আর কেনই বা ফেরার রাস্তা খুঁজতে যাবেন শুভময়ীদেবী? আজ তিনি জীবনের এক সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত। যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন তাঁর জীবনের নতুন অর্থ। মনের সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এতদিন যে সম্পর্কটাকে বহন করে চলছিলেন, সেটা একটা অভ্যেস ছাড়া কিছুই ছিল না মূল্যহীন বদভ্যেস। দায়হীন এক পলকা সুতোয় বাঁধা সেই সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়াতে তিনি আজ মুক্ত, ভারহীন। তিনি অনেক দিন পর, নতুন করে চিনছেন নিজেকে। এক বদ্ধঘরের সব বন্ধ জানালা হাট হয়ে খুলে গিয়েছে দীর্ঘদিন পরে, তাঁর ঘরের মধ্যে ঢুকছে দমকা বাতাস, প্রচুর আলো আর রোদ্দুর।

 

সেদিন তিনি স্কুলে বেরোতে পারলেন না। গতরাত থেকে টানা প্রবল বৃষ্টি চলছে, খবর পেলেন এই কম্পাউণ্ডের বাইরে কলকাতার পথঘাট জলে ভাসছে। সকালে টিভি খুলেও দেখলেন, একই খবর, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত এখন হাঁটুভর জলের তলায়গাড়ি চলছে না। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়। স্কুলে বার চারেক ফোনে চেষ্টা করলেন যোগাযোগ করার, রিং হয়ে গেল, কেউ ওঠালো না। তিনজন সহশিক্ষককে ফোন করে জানলেন – কেউ বের হতে পারছে না, কারণ বের হওয়া অসম্ভব। হাল ছেড়ে দিয়ে সোফায় এসে ধপাস করে বসলেন শুভময়ীদেবী। কি করা যায় এখন সারাটা দিন? ছবি এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল শুভময়ীদেবীকে, তাঁকে সোফায় বসতে দেখে বলল, “এমা, মামীমা, এখন আবার বসলে কেন? স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে না”?

প্রথমে শুভময়ীদেবী বুঝতে পারেননি, সরল মনে উত্তর দিলেন, “এই বৃষ্টিতে যাই কী করে বলতো”? বলার পরই তাঁর মনে হল, ছবির গলায় যেন একটু ঠাট্টার ছোঁয়া! ছবির চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “ওরে, মেয়ে আমাকে নিয়ে মজা হচ্ছে”?

ছবি অল্প হেসে উত্তর দিল, “সকাল থেকে উঠে যা করছো, একবার বারান্দা, একবার জানালা। এই টিভি দেখছ। এই ফোন করছো। একটা দিন ইচ্ছে হয় না একটু বেনিয়মে চলতে? বিশেষ করে আজকের মত দিনে? এই বৃষ্টির দিনে কেউ বাইরে বেরোনোর কথা ভাবতে পারে”?

শুভময়ীদেবী অবাক হয়ে ছবির কথা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। এই মেয়েটি তাঁর সংসারে আজ কত বছর ধরে রয়েছে, বছর ছয়েক তো হবেই! অথচ এই মেয়েটি সম্পর্কে তিনি খুব সামান্যই জানেন। কোনদিন মনেও হয়নি, ওর বয়সি একটা মেয়ে, একটা অসুস্থ ছেলের সেবা করে চলেছে রাতদিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কি বৈচিত্র্যহীন সে জীবনযাপন। হতে পারে, এর বিনিময়ে সে যথেষ্ট অর্থ পেয়েছে, কিন্তু এতদিনেও কি সে তাঁর জীবনের একটা অংশ হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করে উঠতে পারেনি? আর কেউ না জানুক, শুভময়ীদেবী জানেন, এই মেয়েটি কোনদিন, কোনভাবেই তাঁর বিট্টুর অযত্ন বা অবহেলা করেনি। এই নিষ্ঠার মূল্য কি শুধুই মাস গেলে কিছু টাকা? ছবির পরবর্তী কথায় তাঁর চিন্তায় ছেদ পল।

“কি খাবে বলো, অন্যদিন তো এ সময়ে রুটি সব্জি খেয়ে, স্কুলে দৌড়োও। আজ দুটো পরোটা ভেজে দি? সঙ্গে আলুভাজা? তোমার তো খুব প্রিয়”?

“কেন? তুই রুটি তরকারি বানাস নি? তুই কি করে জানলি যে আজ আমি স্কুলে যাবো না”?

“ভোরে উঠে বৃষ্টি আর মেঘের অবস্থা দেখেই আমি বুঝেছিলাম, আজ কোনমতেই তোমার যাওয়া হবে না”

“বাবা, তুই তো অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারিস! তবে আর কি? তোর বেনিয়মের পাল্লায় যখন পড়েছি, তাই কর। যা তোর প্রাণ চায় বানা, আর আমাকে খাওয়া”তাঁর কথা শেষ না হতে, ছবি রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল।

 

শুভময়ীদেবী তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলেন –  এই মেয়েটি এতদিন ধরে তাঁর চোখের সামনে থেকেও, দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কী করে এবং কেন? আমাদের চোখের পিছনে থাকে বোধ তাঁর সেই বোধ কি আবৃত ছিল? এই যে আজ আকাশ জুড়ে মেঘ আর বৃষ্টি। আকাশের নীল কি নেই? নেই দিনের উজ্জ্বল আলো? আছে। সব আছে, চোখে পড়ছে না, কারণ তারা ঢাকা আছে ঘন মেঘের আবরণে। এতদিন তাঁর বোধ, তাঁর মন ঢাকা ছিল অদৃশ্য কিন্তু ভারি এক পাথরের দেওয়ালেসে দেওয়াল তাঁর হার না মানা জেদ। অসুস্থ সন্তানকে নির্বিঘ্নে বাঁচিয়ে রাখার জেদ। তাঁর একমাত্র সন্তানের পিতার এবং তাঁর স্বামীর চরম ঔদাসীন্যকে নির্বিষ করার জেদ। বাইরের জগতে নিজের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করার জেদ। অন্য আর কোনদিকে তাকানোর, মনোযোগ দেওয়ার অবকাশই হয়নি তাঁর। আজ যেন সেই দেওয়াল সরে গে

 দেওয়ালটা সরে গেছে, তিনি এখন মুক্ত। সামাজিক নিয়মে বাঁধা তাঁর চিরজীবনের সঙ্গী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বহুদূরে। তাঁর সন্তানকেও তিনি নিজের হাতে মুক্তি দিয়েছেন অবুঝ স্নেহের শিকল ছিঁড়ে একদিক থেকে দেখলে তিনি কি আজ ভীষণভাবে একা আর নিঃসঙ্গ নন? কিন্তু তাই বা কী করে ভাবছেন তিনি? এই যে আজ ভরা বাদলের সকালে, একটি মেয়ে, তাঁর কথা নিরন্তর ভেবে চলেছে, তার চেয়ে বড়ো সঙ্গী কে হতে পারে আর? যে মেয়েটি তিনি বলার অনেক আগেই বুঝে ফেলেছে, তিনি আজ স্কুলে বেরোতে পারবেন না। কর্মহীন অলস দিনটাকে উদ্‌যাপনের জন্যে যে মেয়েটি তাঁর ভালো লাগার কথা ভেবে সকাল থেকে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। এই সবের পিছনে মেয়েটির নিখাদ ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুর কথা তাঁর মনে এল না।

 ছবির মুখেই তিনি শুনেছেন, ভীষণ স্নেহশীল ওর বাবার কথা। যার কথা বলতে গেলেই ওর গলা কেঁপে ওঠে। ওর মুখখানা হয়ে ওঠে ছোট্ট এক শিশুর মতো। এই বিশাল জীবনের মেলায় বাবাকে সে হারিয়ে ফেলেছে সারাজীবনের মতো, কিন্তু তাও যেন তাকে খুঁজে চলেছে নিরন্তর। সেই মেয়ে বাল্যের শেষ থেকে আজ যৌবনের পথ চলা শুরু করা পর্যন্ত পরের বাড়িতে কাজ করে চলেছে, নিরাপদ আশ্রয় আর নিত্য আহারের জন্যে। তার এই অসহায়তার সুযোগে তিনি এই মেয়েটিকে নিংড়ে নিয়েছেন প্রত্যেকদিন বাধ্য করেছেন ওর মন থেকে সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত ইচ্ছেকে নিকিয়ে ফেলতে। বিনিময়ে ছুঁড়ে দিয়েছেন মাসান্তে নির্দিষ্ট টাকা কাছে বসিয়ে কোনদিন দুটো কথাও কি বলেছেন ওর সঙ্গে? বলেননি। আচমকা মনে পড়ল বলে, তিনি ছবিকে ডেকে বললেন, “হ্যারে, ছবি তোর মাকে বলে দিয়েছিস তো, আজ এই বাদলায়, যেন আর না বের হয়”?

“মা ভোরে বেরিয়েছিল ট্রেন চলছে না বলে, স্টেসান থেকেই ফিরে গেছে। আর তোমাকে বলা হয়নি মামী, এ বাড়ির কাজ মা আর করে না। আমি ছাড়িয়ে দিয়েছি”

অবাক শুভময়ীদেবী জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন”?

“বিট্টু চলে গেল তার বোর্ডিংয়ে। মামাও আর থাকে না। রয়েছো তো একমাত্র তুমিই, কি এমন কাজ আছে বলো তো, যে দুজন কাজের লোক রাখতে হবে? আমিই তোমার সব কাজ করে দেব, মাকে তাই বললাম অন্য বাড়ি দেখতে, মা কাজ খুঁজে নিয়েছে সে বাড়িতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নাও গরম গরম খেয়ে নাও”

দুটো পরোটা আর গরম আলুভাজা একটা প্লেটে নিয়ে এসে ছবি সোফার সামনের টেবিলে রাখলখাবারের গন্ধে বড়ো আনন্দ পেলেন শুভময়ীদেবী। পরোটার একটা কোনা ভেঙে কালোজিরে আর কাঁচালংকার ফোড়ন দেওয়া আলুভাজা সমেত মুখে নিয়ে তিনি যেন শুধু জিভে নয়, জীবনেও নতুন স্বাদ পেলেন। তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলতাঁর মনে হল, কে বলেছে তিনি নিঃসঙ্গ? এমন সঙ্গী থাকলে অনেক দূর লড়ে যাওয়া যায় অনায়াসে, তিনি লড়ে যেতে প্রস্তুত বাকি জীবনটা, যদি ছবি তাঁকে ছেড়ে না যায়।

খুব তৃপ্তি করে, বলা ভাল, তারিয়ে তারিয়ে পরোটা আর আলুভাজা শেষ করলেন শুভময়ীদেবী। ছবি প্রথমে দুটো দিয়েছিল, পরে তাঁর আগ্রহ দেখে আরো একটা পরোটা আর অনেকটা আলুভাজা দিয়ে গেল। খাওয়া শেষে বেসিনে মুখ-হাত ধুয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন আরেকবার। বৃষ্টি চলছে একটানা, মেঘের অবস্থাও একইরকম – ভেজা তুলোর তোষকের মতো ছড়িয়ে আছে গোটা আকাশ জুড়ে। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে ভাবলেন, ওই মেঘ আজ আর কাটবে না, বৃষ্টিও আজ থামবে বলে মনে হয় না। কিন্তু স্কুলে যেতে না পারার জন্যে তাঁর মনের কোনে যে একটা উদ্বেগের মেঘ জমে উঠেছিল – সেটা কেটে গেল। ভাবলেন, এমন আকস্মিক এক অবকাশের দিনে, মনের মধ্যে অকারণ উদ্বেগ পুষে রাখার কোন মানে হয় না। বরং বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসে, সারাটা বেলা অলস কাটিয়ে দেওয়া যায়, বাইরের দিকে তাকিয়ে। এ সময় যদি এক কাপ গরম কফি পাওয়া যেত...।

ভাবলেন ছবিকে জিজ্ঞেস করবেন, ঘরে কফি আছে কিনা। আবার ভাবলেন, নাঃ যদি না থাকে, তাহলে এখনই হয়তো এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেয়েটা বাইরে বেরোবে কফি কিনতে। দরকার নেই ছবিকে ব্যতিব্যস্ত করে। শুভময়ীদেবী ঘর থেকে একটা হাল্কা পিভিসি চেয়ার নিয়ে এলেন। পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন। আর তখনই তাঁর নাকে এল কফির সুবাস। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, কফির মাগ হাতে দাঁড়িয়ে ছবি।

“তুমি এখন বারান্দাতেই বসবে? তাহলে ঘর থেকে চায়ের টেবিলটা নিয়ে আসি। কফির মাগটা একটু ধরো তো...”। কফির মাগটা হাতে নিয়ে শুভময়ীদেবী যেমন আশ্চর্য হলেন, তেমনি আরও একবার অদ্ভূত ভাল লাগায় তাঁর মনটা ভরে গেল। এক চুমুক কফি খেয়ে তিনি বললেন, “বাঃ পারফেক্ট”। ছবি ঘর থেকে ছোট্ট টি-টেব্‌লটা আনতে, কফির মাগটা সযত্নে রাখলেন তার ওপর। বললেন, “পড়ে পাওয়া উটকো এই ছুটির দিনটা সত্যিই তুই জমিয়ে দিলি”।

“তুমি যে বলো – সামান্য তেঁতো স্বাদ না থাকলে কফি তোমার পানসে লাগে - লিকার ঠিক আছে তো?”

উজ্জ্বল তৃপ্ত হাসিমাখা মুখে শুভময়ী দেবী বললেন, “বললাম যে, পারফেক্ট”?

ছবি হাসল বলল, “সে তো বললে। তাতে কি আর বোঝা যায়? বোঝা যায় মুখ দেখলে...”।

“আচ্ছা? কী বুঝলি?”

“সে আর তোমার শুনে কাজ নেই”।

“আচ্ছা, বেশ। কিন্তু তোর খাওয়া হয়েছে? পরোটা-আলুভাজা - দুটোই দারুণ হয়েছিল, তাই না?” শুভময়ীদেবী হাসতে হাসতে বললেন।

“পরোটা আমার একদম ভাল্লাগে না। তোমা কফিটা দিলাম, এই বার খাবো - রুটি-আলুভাজা...”।

“কেন? পরোটা ভাল লাগে না কেন?” অবাক হয়ে শুভময়ীদেবী জিজ্ঞেস করলেন।

“এমনিই...। দুপুরে কী খাবে? আজ বাদুলে দিন – ভেবেছিলাম, মুসুরি ডাল দিয়ে বেশ খিচুড়ি বানাবো”।

“ভালই তো। বানিয়ে ফেল”।

“নাঃ, ভাজা পাঁপড় আর ডিমভাজা ছাড়া খিচুড়ির মানায়? ঘরে একটাও ডিম নেই”।

“তাতে কি? তোর হাতের রান্নায় ডিমভাজা ছাড়াই খিচুড়ি জমে যাবে”।

ছবি ম্লান হেসে বাইরের দিকে তাকিয়ে লল, “পাঁচমিনিটের জন্যেও বৃষ্টিটা যদি ধরতো – ঝপ করে নিয়ে চলে আসতাম…”, শুভময়ীদেবী বেশ ধমক দিয়েই বললেন, “চারদিকে জল জমে আছে, ঝমঝমিয়ে টানা বৃষ্টি হচ্ছে… এক পাও বেরোবি না বাড়ি থেকে – বৃষ্টি ভিজে জ্বর বাধালে – কাল থেকে এমন সেবা যত্ন কে করবে আমার?” কফির মাগে হাল্কা চুমুক দিয়ে তিনি তৃপ্তি পেলেন খুব, কপট রাগত স্বরে বললেন, “ভাবছিলাম কফিটা বেশ মৌজ করে খাবো – তা নয় - দিলি মেজাজটাকে বিগড়ে…”। ছবি ভয় পাওয়া ম্লান মুখে তাকাল শুভময়ী দেবীর মুখের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন শুভময়ী দেবী, বললেন, “আরেঃ তোকে বকিনি রে, বোকা মেয়ে – এই দুর্যোগে কাক-পক্ষীও বাসার বাইরে বেরোয় না, আর তুই পাকামি করে যাচ্ছিলি ডিম কিনতে…! বেলা হল, যা খেয়ে নে – তারপর ঘরে যা আছে তাই দিয়েই খিচুড়ি কর – সোনামুখ করে খেয়ে নেব, দেখে নিস”। 

...চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...